লামা তারানাথ এবং মিনহাজউদ্দিন সিরাজীর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, সামাজিক এই অধােগতি থেকে মুক্তি পেতে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ গােপনে বখতিয়ার খলজির সাথে যােগাযােগ করেছেন তথা গুপ্তচরের কাজ করেছেন। একই সাথে বাংলায় প্রবেশের ক্ষেত্রে বখতিয়ার খলজির পথ প্রদর্শকের কাজ করেছেন। লামা তারানাথ আরও বলেছেন যে, বখতিয়ার সংবাদবাহী ভিক্ষুদের মধ্যস্থতায় বাংলা ও তার পার্ববর্তী অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলের রাজাদের নিজ দলভুক্ত করে অনেক বৌদ্ধ আচার্যকে হত্যা করেন এবং উদন্তপুরী, নালন্দা ও বিক্রমশীলা বিহার দখল করেন। ফলে এইসব বিহারের বেঁচে যাওয়া পণ্ডিতগণ বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন এবং এই কারণে মগধে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যায়। তারানাথের এই কথা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ থেকে যায়। কারণ যে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ছিলেন মুসলমান শাসকদের গুপ্তচর এবং বাংলায় প্রবেশের পথ প্রদর্শক তাদেরকে মুসলমানরা হত্যা করেছিলেন এবং সেই মুসলমানরাই বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্তির কারণ একথা যথেষ্ট যুক্তিসংগত নয়। বরং ধারণা করা যায় যে, যেহেতু বৌদ্ধ ভিক্ষুরা গােপনে সেন শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য মুসলিম শাসকদের সাথে যােগাযােগ করেছেন এবং গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছেন, সে কারণে সম্ভবত ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন শাসকরাই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকবেন, যা অধিক যুক্তিসংগত মনে হয়।
যাই হােক, সেন শাসনের সামাজিক নির্যাতন এমন অবস্থায় পৌঁছেছিল যে, বল্লাল সেনের সময়ে আরােপিত সামাজিক বিধি আজও বাংলায় ‘বল্ললী বালাই’ নামে পরিচিত। এরূপ সামাজিক অসংগতি থেকে বাঁচার জন্য এবং যে কোনাে ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য বাংলার সাধারণ মুক্তিকামী মানুষ অধীর অপেক্ষা করছিল। একদিকে ব্রাহ্মণ্য শাসনের ভীতি, অন্যদিকে বৌদ্ধ নেতৃত্বশূন্যতা সম্ভবত বাংলায় মুসলিম রাজশাসন আগমনের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।
[৯]
বখতিয়ার খলজির আক্রমণে যদি নালন্দা না ধ্বংস হয়ে থাকে, তাহলে ধ্বংস হল কীভাবে এবং গ্রন্থাগার পােড়ানাের গল্পটাই বা কোথা থেকে এল? প্রাচীন যুগে হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে যে ভয়ংকর সংঘাত চলেছিল কয়েক শতাব্দী ধরে, তার কি কোনাে আঁচ লাগেনি নালন্দার গায়ে? কিংবদন্তিতেও অনেক ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে থাকে। তিব্বতী শাস্ত্র ‘পাগ সাম জন জ্যাং’ নামক গ্রন্থে এমনই একটি তিব্বতী কিংবদন্তির কথা জানা যায়। এই কিংবদন্তি অনুসারে, মুদিত ভদ্র নামে এক বৌদ্ধ সাধু নালন্দার চৈত্য ও বিহারগুলি মেরামত করেন এবং তৎকালীন রাজার এক মন্ত্রী কুকুটসিদ্ধ সেখানে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। আরেকটি গল্প অনুসারে, ভবনটির যখন উদ্বোধন করা হচ্ছিল, তখন দুইজন ক্রুদ্ধ তীর্থিক ভিক্ষু (ব্রাহ্মণ) সেখানে উপস্থিত হন। কয়েকজন তরুণ শিক্ষানবিশ ভিক্ষু তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন ও তাদের গায়ে কাপড় কাচার জল ছিটিয়ে দেন। প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য সেই ভিক্ষুরা সূর্যকে প্রসন্ন করার জন্য ১২ বছর তপস্যা করেন ও তপস্যার শেষে একটি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন। যজ্ঞকুণ্ডের জাগ্রত ‘ভষ্ম’ তারা বৌদ্ধ মন্দিরগুলির উপর ছিটিয়ে দেন। এতে নালন্দার গ্রন্থাগারে আগুন লেগে যায়। বুদ্ধগয়া, নালন্দা ও রাজগীরে বিখ্যাত তীর্থস্থান অথবা ধ্বংসাবশেষের উপরে লিখিত একটি পরিচিতি পুস্তিকায়ও এর কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে। যদিও সে বর্ণনায় কিছুটা অলৌকিকত্বের তত্ত্ব ঢােকানাে হয়েছে। বখতিয়ার খলজির আক্রমণ তত্ত্বের সাথে কোনও ভনিতা না করে পুস্তিকাটিতে এ তথ্য সংযােজিত হয়েছে,
“ব্রাহ্মণ দার্শনিক এবং প্রচারক কুমার ভট্ট এবং শংকরাচার্যের প্রচেষ্টাতেই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল। প্রবাদ আছে, তারা সারা ভারতে পরিভ্রমণ করে বৌদ্ধ পন্ডিতকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করে ধর্মান্তরিত করেন।…একদিন ঐ মন্দিরে যখন শাস্ত্রচর্চা চলছিল তখন দুজন কোমল স্বভাবের ব্রাহ্মণ সেখানে উপস্থিত হন। কয়েকটি অল্প বয়স্ক ভিক্ষু তাঁহাদের উপর পরিহাসােচ্ছলে জল ছিটিয়ে দেন। এতে তাঁদের ক্রোধ বেড়ে যায়। বারাে বৎসরব্যাপী সূর্যের তপস্যা করে তাঁরা যজ্ঞাগ্নি নিয়ে নালন্দার প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে এবং বৌদ্ধ বিহারগুলিতে অগ্নিসংযােগ করেন। ফলে নালন্দা অগ্নিসাৎ হয়ে যায়।”৭৯
বিশিষ্ট তাত্ত্বিক লেখক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আক্রমণকে মান্যতা দিয়েছেন। তিনিও ‘পাগ সাম জন জ্যাং’-এর বরাত দিয়ে লিখেছেন, “নালন্দার লাইব্রেরী কয়েকবার বিধ্বস্ত হয়।…তিব্বতীয় পুস্তকে উল্লিখিত হয়েছে যে, ধর্মসগন্ধ অর্থাৎ নালন্দার বৃহৎ লাইব্রেরী তিনটি মন্দিরে রক্ষিত ছিল। তীর্থিক (ব্রাহ্মণ) ভিক্ষুদের দ্বারা অগ্নিসংযােগে তাহা ধ্বংস করা হয়। মগধের রাজমন্ত্রী কুকুতসিদ্ধ নালন্দায় একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে ধর্মোপদেশ প্রদানকালে জনকতক তরুণ ভিক্ষু দু’জন তীর্থিক ভিক্ষুদের গায়ে নােংরা জল নিক্ষেপ করে। তার ফলে তারা ক্রুব্ধ হয়ে। ‘রত্নদধি’, ‘রত্নরঞ্জক’ আর নয় তলাযুক্ত ‘রত্নসাগর’ নামক তিনটি মন্দির অগ্নিসংযােগে ধ্বংস করে। উক্ত তিনটি মন্দিরেই সমষ্টিগতভাবে ধর্মগ্রন্থ বা গ্রন্থাগার ছিল।”৮০ তিব্বতী ঐতিহাসিক লামা তারানাথও এ বিষয়ে লিখেছেন :
‘During the consecration of the temple built by Kakutsiddha at Nalendra (Nalanda) “the young naughty sramanas threw slops at the two tirthika beggars and kept them pressed inside door panels and set ferocious dogs on them’.Angered by this, one of them went on arranging for their livelihood and the other sat in a deep pit and ‘engaged himself in surya sadhana’ (solar worship), first for nine years and then for three more years and having thus ‘acquired mantrasiddhi’ he ‘performed a sacrifice and scattered the charmed ashes all around which ‘immediately resulted in a miraculously produced fire’, consuming all the eighty four temples and the scriptures some of which, however, were saved by water flowing from an upper floor of the nine storey Ratnodadhi temple.’৮১
ঐতিহাসিক বি এন এস যাদবও ‘উগ্র হিন্দুদের’ (‘Hindu fanatics’) হাতে নালন্দার গ্রন্থাগার পােড়ানাে হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।৮২ এই মতের দীর্ঘ আলােচনা করেছেন আর এস শর্মা এবং কে এম শ্রীমালি।৮৩
ডি আর পাতিল অবশ্য তার পূর্বোক্ত গবেষণাপত্রে (বিহার সরকার কর্তৃক প্রকাশিত) খুব পরিষ্কার করে বলেছেন যে, নালন্দা ধ্বংস করেছিল শৈবরা।৮৪ তিনি এও লিখেছেন যে,
“…the Brahmins deliberately set fire to the famous library (at Nalanda called Ratnodadhi).”৮৫
বখতিয়ার খলজির আক্রমণের পূর্বেই যে নালন্দা। ধ্বংস হয়েছিল সে সম্পর্কে ডি আর পাতিল লিখেছেন,
“…no Mohammedan Makhdum, Pir or saint of great repute happened to grace the tops of the Nalanda mounds with their tombs or mosques. This is a feature, which, it should be noted, is commonly to be observed all over Bihar at sites of celebrated and important sanctuaries. At Bihar Sharif itself many of such Muslim monuments still exist; but their absence at Nalanda, hardly six or seven miles away, is rather surprising. Had Nalanda been a living institute of great repute or importance at the time of the invasion of Bakhtiar Khilji in 1197 or 1198 AD, we should expect the Muslim chronicles of the event to have known and mentioned the name of Nalanda. The place, said to have been destroyed by the invader, is described to be a great city and a place of study then known as Bihar, which would more appropriately be a reference to the modern Bihar Sharif, which also had a monastery, and not to Nalanda, near which there existed no big city worth the name. As is known, one of the Pala rulers had established a monastery at Odantapuri or Bihar Sharif itself which may have affected adversely. All these circumstances would indicate that, quite before Bakhtiar Khilji’s invasion, Nalanda had perhaps fallen to decay or ruins already; but how and when actually this happened is still a mystery to be unravelled.”৮৬
ডি আর পাতিলের পূর্বোক্ত গবেষণা আরও প্রমাণ করে যে,
‘There is, therefore, reason to believe that Nalanda had met its final end some time in the 11th century i.e.more than hundred years before Bakhtiyar Khilji invaded Bihar in 1197 A.D.’৮৭
লামা তারানাথ বর্ণনা করেছেন যে, রাজা তুরস্ক যিনি দীর্ঘকাল কাশ্মীরে রাজত্ব করেছিলেন, ঐতিহাসিকেরা যাঁকে মিহিরকুল (৫০২-৫৪২) নামে অভিহিত করেছেন, শৈব ধর্মের অনুসারী বৌদ্ধ নিপীড়ক এই রাজার নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হুনদের দ্বারা নালন্দা প্রথম আক্রান্ত হয়। মুর্তিবিনাশী মিহিরকুল বৌদ্ধদের সহ্য করতে পারতেন না। আমৃত্যু অভিযান চালিয়ে তিনি অসংখ্য বৌদ্ধ উপাসক ও বৌদ্ধদের হত্য করেন। কিপিনের বৌদ্ধসংঘ উৎখাত করে বুদ্ধের পবিত্র ভিক্ষাপাত্র তিনি ধ্বংস করেন। তার নিষ্ঠুরতা এতটাই ভয়ংকর ছিল যে, কাশ্মীরের ঐতিহাসিক কলহন তাঁর ‘রাজতরঙ্গিনী’তে তাকে মৃত্যুদেবতা ‘যম’-এর সাথে তুলনা করেছেন (১.২৮৯)। কলহন বলেছেন যে, এই নামটি উচ্চারণ করলে অপবিত্র হতে হয় (১.৩০৪)। হিউয়েন সাঙ মিহিরকুল সম্বন্ধে যে কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তা এই.
“..পঞ্চনদ প্রদেশের অন্তর্গত সাকল নামক রাজধানীতে মহারাজ মিহিরকুল সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন। ভারতের সুবিস্তৃত অংশে তাহার আধিপত্য বদ্ধমূল হইয়াছিল। ইনি অবসর মত বৌদ্ধশাস্ত্রের আলােচনা করিতে সমুৎসুক হইয়া একজন শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধাচাৰ্য্যকে তৎসমীপে প্রেরণ করিবার জন্য আদেশ করিয়াছিলেন। বৌদ্ধাচাৰ্যগণের অর্থাদিতে স্পৃহা ছিল না, খ্যাতিলাভেও তাহারা উদাসীন ছিলেন, সুপণ্ডিত এবং খ্যাতনামা বৌদ্ধাচাৰ্য্যগণ রাজানুগ্রহকে ঘৃণার চক্ষুই অবলােকন করিতেন। এজন্যই তাহারা মহারাজ মিহিরকুলের আদেশ প্রতিপালন করিতে অনিচ্ছুক হইলেন। একজন পুরাতন রাজ-অনুচর বহুকালাবধি ধৰ্ম্মপরিচ্ছদ ধারণ করিয়াছিলেন, তিনি তর্কে প্রাজ্ঞ এবং সুবক্তা ছিলেন। বৌদ্ধাচার্যগণ রাজসমীপে তাহার নাম প্রস্তাব করিলেন। ইহাতে মিহিরকুল নিতান্ত অসন্তুষ্ট হইয়া পঞ্চনদ ভূমি হইতে বৌদ্ধধর্ম নিষ্কাশন এবং বৌদ্ধাচাৰ্য্যগণকে বিনাশ করিবার জন্য আদেশ প্রচার করিয়াছিলেন”৮৮
মিহিরকুলের ভীষণ অত্যাচারে গুপ্ত সাম্রাজ্য জর্জরিত ও ধ্বংসমুখে পতিত হয়েছিল।৮৯ বহু বৌদ্ধবিহার তার হাতে বিধ্বস্ত হয়।৯০ মিহিরকুল যখন পাটলিপুত্র আক্রমণ করেন তখন নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বহু বৌদ্ধ ছাত্র ও বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এই আক্রমণে। রেভারেন্ড এইচ হিরাস এ বিষয়ে লিখেছেন
‘Nalanda University was not far from the capital, Pataliputra and its fame had also reached Mihirakula’s ears. The buildings of Nalanda were then probably destroyed for the first time, and its priests and students dispersed and perhaps killed.’৯১
স্কন্দগুপ্ত (৪৫৫-৪৬৮) ও তার পরবর্তী বংশধরেরা একে পুনর্গঠন করেন। তাছাড়া সাত শতকের মাঝামাঝি সময়ে মগধে অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়েছে এবং সেগুলােরও শিকার হতে পারে নালন্দা। নালন্দায় এইসব উপর্যুপরি আক্রমণের তথ্য ‘জার্নাল অব দ্য বিহার অ্যান্ড ওড়িশা রিসার্চ সােসাইটি’ থেকে পাওয়া।৯২
[১০]
স্কন্দগুপ্তের প্রায় দেড় শতাব্দী পরে বাংলার শাসক নরেন্দ্র গুপ্ত তথা শশাঙ্কের (৬০৬-৬৩৭) দ্বারাও নালন্দা আবার ধ্বংসের মুখে পড়ে। রাজা হর্ষবর্ধনের (৬০৬-৪৭) সঙ্গে তার বিরােধ ও ধর্মবিগ্ৰাস এই ধ্বংসযজ্ঞে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। রাজা হর্ষবর্ধন প্রথম দিকে শৈব ধর্মের অনুসারী হলেও পরে বৌদ্ধধর্মের একজন পৃষ্ঠপােষকে পরিণত হন। অন্যদিকে রাজা শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একান্ত অনুরাগী। ফলে উভয়ের মধ্যে সবসময় শত্রুতা লেগেই থাকত ও উভয়ের মধ্যে একটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। শৈব নরপতি শশাঙ্ক বৌদ্ধদের ধর্মীয় স্থান ছাড়াও বুদ্ধগয়াকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেন। সপ্তম শতকের একেবারে প্রথম দিকে কান্যকুজ আক্রমণের সময় বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে প্রবল আক্রোশে তিনি কেমন করে বােধিবৃক্ষ আমূল উপড়ে ফেলেছিলেন (লামা তারানাথের বিবরণীতেও শশাঙ্ককে বৌদ্ধবিদ্বেষী আখ্যা দেওয়া হয়েছে) তার রােমহর্ষক বর্ণনা আছে। হিউয়েন সাঙ-এর লেখায়, “বিধর্মী শশাঙ্ক রাজা বৌদ্ধধর্মের প্রতিপত্তি নাশ করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। তিনি সংঘারামগুলি ভেঙে ফেললেন ও বৌদ্ধবৃক্ষটিকে কেটে তার গােড়া খুঁড়ে পৃথিবীর উৎপত্তিস্থল পর্যন্ত চলে গেলেন। তবু তিনি এর শিকড়ের শেষ মাথা পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেন না। তখন তিনি এটিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে তার উপর আখের রস (গুড়) ঢেলে দিলেন যাতে গাছটি পুরােপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।৯৩ শুধু তাই নয়, নিকটবর্তী বৌদ্ধ মন্দির থেকে বুদ্ধমূর্তি সরিয়ে সেখানে শিবের মূর্তি প্রতিস্থাপন করেন। তার ফলে শশাঙ্ক কুষ্ঠরােগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।৯৪ রাজা শশাঙ্কের বৌদ্ধনীতি সম্পর্কে রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্যপুরাণ’ থেকে ধারণা পাওয়া যায়। শশাঙ্কের আদেশ ছিল সেতুবন্ধ হতে হিমগিরি পর্যন্ত যত বৌদ্ধ আছে— বালক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে তাদের হত্যা করতে হবে, যে না করবে তারও মৃত্যুদণ্ড হবে।৯৫ রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধধর্মের মূলােৎপাটনের জন্য এমন কোনও প্রচেষ্টা ছিল না যা তিনি করেননি।
রাজা শশাঙ্ক সম্পর্কে যেসব বিবরণ রয়েছে তা কতদূর সত্য তা নিয়ে সন্দেহ জাগে। যিনি নিজের মূল রাজ্য কর্ণসুবর্ণের সংঘারাম ও স্থূপগুলি অক্ষত রাখলেন, তিনি কেন মগধে গিয়ে সেখানকার সংঘারাম ভাঙতে গেলেন, বােধিবৃক্ষ কাটতে গেলেন, বুদ্ধের পদচিহ্ন অঙ্কিত পাথর গঙ্গায় ফেলে দিতে গেলেন? কেনই বা সেখানকার বৌদ্ধ বিহার থেকে বুদ্ধের মূর্তি সরিয়ে শিব বা মহের মূর্তি স্থাপনের আদেশ করলেন? সমস্ত ব্যাপারটাই গালগল্প বলে মনে হয়। অধিকার বিস্তার করতে গিয়ে শশাঙ্ক যেসব রাজাকে উচ্ছেদ ও পদানত করেন তাদের অনেকেই বােধহয় বৌদ্ধধর্মী বা তার পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। এর ফলে বৌদ্ধধর্ম তাদের পৃষ্ঠপােষণা থেকে বঞ্চিত হয়ে সম্ভবত সামগ্রিকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও শশাঙ্ককে বৌদ্ধধর্মের শত্রুরূপে মনে করতে শুরু করে। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, হর্ষবর্ধনের বড় ভাই রাজ্যবর্ধন, যাকে শশাঙ্ক হত্যা করেন বলে জানা যায়, বৌদ্ধ ছিলেন। বােধিবৃক্ষের কাছে থাকা বৌদ্ধ বিহারটি সম্পর্কে যে কিংবদন্তী হিউয়েন সাঙ শুনিয়েছেন তা থেকে সন্দেহ উঁকি দেয় যে, সেটি সম্ভবত আগে একটি শিব বা মহেথর মন্দির ছিল ও পরে তাকে বৌদ্ধবিহারে পরিণত করা হয়। হয়তাে বা সেই কারণেই শশাঙ্ক তাকে আবার মহেরে মন্দিরে রূপায়িত করার আদেশ দেন। যাইহােক, এসব যে সম্পূর্ণই অনুমানমূলক তা বলার অপো রাখে না। কিন্তু দেখুন কীরকম মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে! শশাঙ্কের কলঙ্ক ঢাকবার জন্য বলা হয়েছে যে, বােধিবৃক্ষের কাছে থাকা বৌদ্ধবিহারটি নাকি পূর্বে একটা শিবমন্দির ছিল। সেজন্য রাজা শশাঙ্ক বিহারটি হতে বুদ্ধমুর্তি সরিয়ে সেখানে শিব মূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন!
রমেশচন্দ্র মজুমদার শশাঙ্কের কলঙ্কমুক্তির চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন,
“শশাঙ্ক শিবের উপাসক ছিলেন। হুয়েন সাং তাঁহার বৌদ্ধ বিদ্বেষ সম্বন্ধে অনেক গল্প লিখিয়াছেন কিন্তু এগুলি বিধাস করা কঠিন।”৯৬
রমেশচন্দ্র শশাঙ্কের অত্যাচারের কথা স্বীকার করেননি। শশাঙ্কের বিরুদ্ধে আনীত বৌদ্ধ নির্যাতনের অভিযােগ খণ্ডনে রমেশচন্দ্র প্রয়াসী হয়েছেন নির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে নয়, বরং বিশেষ একটি নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে। যে সকল ঐতিহাসিক শশাঙ্কের বৌদ্ধ-নির্যাতনের ঘটনাকে জরুরি রাজনীতির কারণের সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখতে চেয়েছেন, তাঁদের সেই যুক্তিগ্রাহ্য প্রবণতাকে তিনি সাম্প্রদায়িক স্বার্থের খাতিরে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জনের সামিল’ বলে অভিহিত করেছেন। খুব সম্ভব হিন্দু রাজা শশাঙ্কই এ ক্ষেত্রে হিন্দু জাতীয়তার প্রতীক রূপে এবং হর্ষবর্ধন ও মগধের বৌদ্ধগণ তার প্রতিপক্ষরূপে গৃহীত হয়েছেন।৯৭
হিউয়েন সাঙ ও বাণভট্টের বিবরণ অনুযায়ী শশাঙ্ক বিধাসঘাতকতা করে রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেছিলেন। রাজ্যবর্ধনের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ থেকে জানা যায় প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধনের বড় ভাই রাজ্যবর্ধন সিংহাসনে আরােহণ করে সদ্ভাবে রাজ্যশাসন করছিলেন। এ সময় ভারতের পূর্বাঞ্চলে কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্ক অনেক সময় তাঁর মন্ত্রীদের বলতেন, রাজ্যের পাশে কোনাে ন্যায়বান রাজা থাকলে তা রাজ্যে অমঙ্গল ডেকে আনে। এরপর রাজ্যবর্ধনকে শশাঙ্ক তার রাজ্যে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনে হত্যা করেন।৯৮ বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত’ থেকে জানা যায়, থানের-রাজ রাজ্যবর্ধনকে মিথ্যা প্রলােভন দেখিয়ে তাঁকে স্বভবনে অস্ত্রহীন অবস্থায় একাকী পেয়ে শশাঙ্ক গােপনে হত্যা করেন।৯৯ দীনেশচন্দ্র সরকার ‘হর্ষচরিত’-এর মধ্যযুগীয় টীকাকারের বরাত দিয়ে লিখেছেন,
“…রাজ্যবর্ধনের বিধাস জন্মাইবার জন্য শশাঙ্ক তাহার সহিত স্বীয় কন্যার বিবাহ প্রস্তাব দ্বারা স্থানীয়রাজকে প্রলুব্ধ করিয়াছিলেন এবং তাহার গৃহে রাজ্যবর্ধন যখন আহারে প্রবৃত্ত তখন ছলে তাহাকে অনুচরগণের সহিত হত্যা করিয়াছিলেন।”
অথচ হর্ষবর্ধনের বাঁশখেরা লেখ থেকে জানা যায়, সত্যের অনুরােধে রাজ্যবর্ধন স্বয়ং শত্রু শিবিরে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এ সব বিবরণের মধ্যে পরস্পর কোনও মৌলিক বিরােধ নেই।
ঐতিহাসিক রমাপ্রসাদ চন্দ শশাঙ্কের বিবাসঘাতকতার বিবরণে বিধাসী নন। তিনি মনে করেন, রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের হাতে পরাজিত ও বন্দি হন বা আত্মসমর্পণ করেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও রমেশচন্দ্র মজুমদার উভয়েই রমাপ্রসাদকে সমর্থন করেছেন। অন্যদিকে রাধাগােবিন্দ বসাক ও ডি সি গাঙ্গুলি প্রমুখ হিউয়েন সাঙ ও বাণভট্টের বিবরণে আস্থা প্রকাশ করেছেন এবং শশাঙ্কের বিধাসঘাতকতার তত্ত্বকে তুলে ধরেছেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, বাঁশখেরা লেখ-এর সাক্ষকে আমরা একেবারে অগ্রাহ্য করতে পারি না। তাছাড়া অস্বীকার করার উপায় নেই যে, হিউয়েন সাঙ ও বাণভট্ট তাদের পৃষ্ঠপােষক হর্ষবর্ধনের শত্রু শশাঙ্কের প্রতি সর্বদা বিরূপ মনােভাব পােষণ করেছেন এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় “বৌদ্ধতীর্থ বা বৌদ্ধচাৰ্য্যগণের প্রতি শশাঙ্কের অত্যাচারের কাহিনী সম্পূর্ণরূপে বিধাসযােগ্য নহে” বললেও তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে,
“শশাঙ্ক কর্তৃক বােধিদ্রুম বিনাশ, কুশীনগরে ও পাটলিপুত্রে বৌদ্ধকীর্তি ধ্বংস প্রভৃতি কার্য্যের বােধহয় অন্য কোন কারণ ছিল। বৌদ্ধ ধর্মানুরক্ত স্থান্বীধর রাজ্যের অনুকুলাচরণের জন্যই বােধ হয় শশাঙ্ক বুদ্ধগয়া, পাটলিপুত্র ও কুশীনগরের বৌদ্ধ যাজকগণকে শাসন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।”১০০
এর আগে রাখালদাস বৌদ্ধতীর্থ বা বৌদ্ধচাৰ্য্যগণের প্রতি শশাঙ্কের অত্যাচারের কাহিনি সম্পূর্ণ বির্বাসযােগ্য না হবার কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন,
“ইহার প্রথম কারণ এই যে, চৈনিক শ্রমণের ধর্মমত অত্যন্ত সংকীর্ণ ছিল এবং তিনি ধর্মীগণের প্রতি সর্বত্র অযথা পক্ষপাত প্রদর্শন করিয়াছেন। দ্বিতীয় কারণ এই যে, শশাঙ্কের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেও বঙ্গে ও মগধে বহু মন্দির, বিহার, সংঘারাদি বিদ্যমান ছিল।”
এ সম্পর্কে নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন,
“শশাঙ্কের বৌদ্ধবিদ্বেষ সম্পর্কে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। এর সবটাই নিছক কল্পনা বলে মনে হয় না। এই বৌদ্ধবিদ্বেষের কারণ…প্রথমত এই যুগে বাংলা ও আসামের সর্বত্র ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছিল, কোন কোন রাজবংশের পক্ষে এই নতুন ধর্ম ও সংস্কৃতির গোঁড়া পাণ্ডা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত যে সব উচ্চশ্রেণীর মধ্যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করছিল, তারাই ছিল রাষ্ট্রের খুঁটি। দ্বিতীয়ত, শশাঙ্কের অন্যতম প্রধান শত্রু হর্ষবর্ধন ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের বড় সমর্থক শত্রুর আশ্রিত ও লালিত ধর্ম নিজের না হলে তার প্রতি বিদ্ধেষ থাকা স্বাভাবিক। অন্য অনেক রাজনৈতিক কারণও থাকতে পারে, যেমন বাণিজ্যে বৌদ্ধদের প্রতিপত্তি। তৃতীয়ত, বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধ বর্ধিষ্ণু অবস্থা ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী রাজা বােধ হয় পছন্দ করতে পারতেন না।”
এ সব ‘কারণ’ নিশ্চয়ই বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে নির্মূল অভিযান পরিচালনার পথে ‘যুক্তি’ হতে পারে না। তবে এর মধ্য দিয়ে একটি সত্যই প্রকাশ পায়, তা হল সে যুগে বৌদ্ধধর্ম ছিল ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত ও নন্দিত। একদিকে এই ধর্ম-সংস্কৃতির বর্ধিষ্ণু অবস্থা, সেই সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যে বৌদ্ধদের বিপুল প্রতিপত্তি। আধিপত্যকামী ব্রাহ্মণ্য ধর্ম-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য তাই ব্যাপক গণ-নিপীড়ন নিধন যজ্ঞ চালানাে হয়। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পােষক রাজ-রাজড়া ও তাঁদের খুঁটিরূপে প্রতিষ্ঠিত ‘উচ্চশ্রেণি’ এ পথেই অগ্রসর হয়েছিলেন।
রাষ্ট্রের ধর্ম-সংস্কৃতি প্রণে রাজা শশাঙ্কের সন্দেহাতীত পক্ষপাতিত্বের উল্লেখ করে নীহাররঞ্জন রায় জানাচ্ছেন যে, এ পক্ষপাত শশাঙ্কের একার ছিল না, গােটা যুগ সম্বন্ধেই এ কথা প্রযােজ্য। কারণ একটানা ১৫০ বছর ধরে কোনও রাষ্ট্র বা রাজবংশই সমসাময়িক বৌদ্ধ ধর্ম-সংস্কৃতির কোনও পৃষ্ঠপােষকতা করেননি অন্যদিকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতি তাদের অবারিত দাক্ষিণ্য লাভ করেছেন। হিউয়েন সাঙের সময় বাংলাদেশে বৌদ্ধদের মাত্র ৭০টি বিহার-সংঘারাম ছিল, আর ব্রাহ্মণদের মন্দিরের সংখ্যা ছিল তখন ৩০০।
রাজা শশাঙ্কের আমলের আবিষ্কৃত মুদ্রাগুলির এক পাশে নন্দীর পিঠে বসা মহাদেবের মূর্তি, অপর পিঠে পদ্মাসনে আসীনা লক্ষ্মীর মূর্তি রয়েছে। যশাের জেলার মােহাম্মদপুর গ্রামে শশাঙ্কের একটি মুদ্রা পাওয়া গেছে। শশাঙ্কের মুদ্রাগুলির মধ্যে নিম্নমানের ধাতু ব্যবহার থেকে মনে হয় দীর্ঘদিন যুদ্ধে লিপ্ত থাকার কারণে তার রাজ্যে অর্থাভাব প্রকট হয়েছিল। তাই রূপা মিশানাে নিম্নমানের মুদ্রা চালু করতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। যুদ্ধলােলুপ রাজার একাধিপত্যে বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর নির্মূল অভিযান চলছিল। সামগ্রিকভাবে প্রজাসাধারণের জীবনে নেমে এসেছিল অর্থনৈতিক দুর্ভোগ। কিন্তু এ অবস্থার মধ্যে আর্য-ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অভ্যুত্থান প্রয়াসী এই রাজা বিদেশাগত ব্রাহ্মণদের মাঝে নিষ্কর দান হিসাবে গ্রামের পর গ্রাম বিলি করছিলেন। ১৯৩৭ সালে মেদিনীপুর জেলায় শশাঙ্কের দু’টি তাম্রশাসন পাওয়া গেছে। সেগুলির একটি হল ভট্টের নামক ব্রাহ্মণকে মহাকুম্বারপদ্রক গ্রাম। দানের দলিল। অপরটি দাম্যস্বামী নামক আরেকজন ব্রাহ্মণকে কুশরপদ্রক গ্রামের ৪০ দ্রোন জমি এবং এক দ্রোন কাপ বাস্তুভূমি দানের দলিল।
নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন,
“এ যুগের বঙ্গ ও সমতটের রাজারা সবাই ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী। শশাঙ্ক ও ভাস্করবর্মা ছিলেন শৈব রাতবংশের মধ্যে একমাত্র খঙ্গ-রাজা ছিলেন বৌদ্ধ। জনসাধারণের বেশ একটা বড় অংশে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কার প্রচলিত ছিল, কিন্তু সপ্তম শতকের শেষ পঁচিশ বছরের আগে বৌদ্ধধর্ম রাষ্ট্রের ও রাজবংশের কোন অনুগ্রহ বা সমর্থন পায়নি। ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতিই সমানে রাজকীয় সমর্থন ও পােষকতা লাভ করেছে।”
এ সব তথ্য সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণ করে যে, সে যুগে বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধ সংস্কৃতিই ছিল এ দেশের ব্যাপক জনগণের ধর্ম ও সংস্কৃতি। জনগণের ধর্ম ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী রাজা, রাজবংশ ও সমাজের উঁচু কোঠায় আধিপত্য বিস্তারকারী রাজপুরােহিতেরা দীর্ঘকালব্যাপী অভিযান পরিচালনা করে। তার মােকাবিলায় এখানে একটি শক্তিশালী প্রতিরােধ সংগ্রামের চিত্রও সহজেই পাওয়া যায়। যে বাঙালি দ্রাবিড়রা দীর্ঘকাল ধরে আর্য আগ্রাসনকে তাদের বহিঃসীমান্তে বাধা দিতে সক্ষম হয়েছিল, তারা বিদেশাগত সংখ্যালঘু ধর্ম ও সংস্কৃতির কাছে সহজে আত্মসমর্পণ করবে বলে মনে করার কারণ নেই। ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী রাজাদের যুগ-যুগব্যাপী চেষ্টা সত্ত্বেও জনগণের সংগ্রামী প্রতিরােধ শক্তির জোরে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি দীর্ঘদিন এ এলাকার প্রধান ধর্ম ও সংস্কৃতিরূপে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়।
ডি ডি কোশাম্বী কিন্তু শশাঙ্কের অত্যাচার তথা বৌদ্ধ বিদ্বেষের কথা অস্বীকার করেননি। তিনি লিখেছেন
“শশাঙ্কের আক্রমণের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল তার অভিনব ধর্মীয় ভেক্ষুক তিনি বৌদ্ধ স্থাপত্যগুলি ধ্বংস করেছিলেন এবং বুদ্ধ যে বৃক্ষের তলায় বসে বােধি লাভ করেছিলেন সেটি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এটা প্রমাণ করে যে ভিত্তিতে কিছু সংঘাত ছিল এবং এই প্রথম তা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হল ধর্মীয় চেতনার স্তরে।”১০১
তবে শশাঙ্ক যে একেবারে বৌদ্ধ বিদ্বেষী ছিলেন না তা নীহাররঞ্জন রায়ও অস্বীকার করেননি,
“য়ুয়ান-চোয়াঙ …হয়তাে শশাঙ্কের মৃত্যুর কিছুকাল পরেই ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন। তিনি কিন্তু বলিতেছেন, শশাঙ্ক ছিলেন নিদারুণ বৌদ্ধ-বিদ্বেষী এবং তিনি বৌদ্ধধর্মের উচ্ছেদসাধনেও সচেষ্ট হইয়াছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি কী কী অপকর্ম করিয়াছিলেন, তাহার একটি নাতিবৃহৎ তালিকাও দিয়াছেন। য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণের পরিণতির—অর্থাৎ দূরারােগ্য চর্মরােগেশশাঙ্কের মৃত্যুকাহিনীর…এবং খুব আশ্চর্যের বিষয়, মধ্যযুগীয় ব্রাহ্মণ্যকুল-পঞ্জীতেও আছে। বৌদ্ধ-বিদ্বেষী শশাঙ্কের প্রতি বৌদ্ধ লেখকদের বিরাগ স্বাভাবিক, কিন্তু বহুযুগ পরবর্তী ব্রাহ্মণ্যকুলপঞ্জীতে তাহার প্রতিধ্বনি শুনিতে পাওয়া একটু আশ্চর্য বই কিঙ্গ …. কিন্তু তাঁহার বিবরণ সর্বদা মিথ্যা এবং শশাঙ্কের বৌদ্ধ-বিদ্বেষ ছিল না, একথা বলিয়া শশাঙ্কের কলঙ্কমুক্তির চেষ্টাও আধুনিক ব্রাহ্মণ্য মানুষের অসার্থক প্রয়াস।”১০২
রামশরণ শর্মা ও এ এল ব্যাসাম লিখেছেন, বাংলার ধর্মোন্মাদ শৈব রাজা শশাঙ্ক বুদ্ধগয়ায় বােধিবৃক্ষ ধ্বংস করেছিলেন এবং বৌদ্ধদের উপর বহু অত্যাচার করেছেন।১০৩ একই বিবরণ পাওয়া যায় ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্পে’। বাংলার ব্রাহ্মণদের ‘কুলজীতে’ও (যেমন উমেশচন্দ্রে শর্মার ‘মহাদেব-কারিকা’ এবং রামদেবের ‘কুলপঞ্জী’) একই ট্রাডিশন পাওয়া যায়। গ্রহবিপ্র বা শক-দ্বীপী ব্রাহ্মণদের একটি শাখার মধ্যে প্রচলিত ট্রাডিশন অনুযায়ী তাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন সরযূ নদীতীরবাসী দ্বাদশ ব্রাহ্মণ। শশাঙ্ককে কুষ্ঠরােগ থেকে মুক্ত করার জন্য তাদের আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছিল এবং তারা গৌড়াধিপকে রােগমুক্ত করতে সক্ষম হন।
বুদ্ধের যাবতীয় নিদর্শন লােপ করার উদ্দেশ্যে শশাঙ্কের তাণ্ডব লক্ষ করে রাজাপূর্ণবর্মণ আক্ষেপে করেছিলেন,
“জ্ঞানের সূর্য অস্তমিত বুদ্ধের কিছুই অবশিষ্ট নেই বৃক্ষটুকু ছাড়া এবং সেটিও ধ্বংস করল তারা।”
পূর্ণবর্মণ নালন্দা পুননির্মাণ করেন। সম্রাট হর্ষবর্ধন পরে রাজা শশাঙ্কের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন ও শেষপর্যন্ত বাংলার কিছু অংশ করায়ত্ত করেন। তিনিও নালন্দার পুনর্গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। উল্লেখ্য, বৌদ্ধ ও শৈব ব্রাহ্মণদের মধ্যে এই রাজনৈতিক সংঘাত তথা ক্ষমতার লড়াই এবং এর ফলাফল হচ্ছে উত্তর ভারত হতে বৌদ্ধদের গণবিতাড়ন ও গণহত্যা। এ সময়ে হর্ষবর্ধন একবার হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে গেলেও পরবর্তীতে এক ব্রাহ্মণ গুপ্ত ঘাতকের হাতে তার মৃত্যু হয়।
এরপর বাংলার সিংহাসন দখল করেন বিহারের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত তীরহুতের জনৈক রাজা অর্জুন, যিনি চিনা সাের্সে ‘A-lo-na-shun’ (তাঁকে অনূদিত গ্রন্থে ‘Arunasva or Arunasa’ নামেও দেখা যায়) নামে পরিচিত। তিনি হর্ষবর্ধনের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন, Hans Bakker তাঁকে হর্ষবর্ধনের অধীনস্ত বলে উল্লেখ করেছেন।১০৪ অর্জুন সিংহাসনে বসার পর একদল ব্রাহ্মণ দুর্বত্তের নেতৃত্বে নালন্দা আক্রান্ত হয় ও সেটা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।১০৫ এটাই হচ্ছে নালন্দা ধ্বংসের মূল কারণ। তবে এটি সেসময় পুরােপুরি ধ্বংস হয়ে যায়নি। এ সময় চিনা প্রতিনিধি ওয়াং হিউয়েন রাজা অজুর্ন কর্তৃক আক্রান্ত হলে তিনি নেপালে আশ্রয় নেন।১০৬ নেপালের রাজা এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে রাজা অর্জুনকে আক্রমণ ও গ্রেপ্তার করে প্রতিশােধস্বরূপ চিনে পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীতে নেপালের রাজার সহযােগিতায় নালন্দা মেরামতির কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। তাছাড়া হর্ষবর্ধনের সময়ে কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার নালন্দা মহাবিহার ধূলায় গুড়িয়ে দেওয়ার হুঙ্কারও বিশেষ তাৎপর্যবাহী বলা যেতে পারে।১০৭ এছাড়াও পাল যুগে কোনও কারণে নালন্দা ভষ্মীভূত১০৮ হলে মহীপাল (৯৮১-১০২৯) আগুনে বিনষ্ট নালন্দা মহাবিহারের সংস্কার করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তা চলতেও থাকে। মহীপালের রাজ্যের একাদশ সংবৎসরে উত্তীর্ণ দুটি শিলালিপিতে আগুনে বিনষ্ট নালন্দার সংস্কারের উল্লেখ আছে।
[১১]
তাহলে কিভাবে চালু থাকা নালন্দা ধ্বংস হয়ে গেল? এর জমাটি উত্তর অধ্যাপক ডি এন ঝা পূর্বেই দিয়েছেন যে, ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধদের বিরামহীন সংঘাত এক্ষেত্রে প্রধানত দায়ী। ঐতিহাসিক এস এন সদাশিবন অবশ্য নালন্দা ধ্বংসের জন্য মুসলমান ও ব্রাহ্মণ উভয়কেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।১০৯ তিনি লিখেছেন,
“The enormous manuscript library of the Nalanda university was set on fire by the Tirthikas (all sects of Brahmins) with the support of Jainas due to the mounting Jealousy they nurtured against the great centre of learning. The Mohammedan militarists continously harassed the Buddhist monks of the university and occasionally tortured them.”
সদাশিবনের প্রথম অভিযােগটির সমর্থন আছে বুদ্ধ প্রকাশের গ্রন্থে।১১০ নালন্দায় অগ্নি সংযােগের জন্য তিনি হিন্দুদেরই দায়ী করে লিখেছেন,
“…they (Hindus) performed a Yajna, a fire sacrifice and threw living embers and ashes from the sacrifice into the Buddhist temples. This produced a great conflagration which consumed Ratnabodhi, the nine-storeyed library of the Nalanda University.”
বুদ্ধ প্রকাশের বই (১৯৬৫) সদাশিবনের বইয়ের (২০০০) চেয়ে অনেক পুরােনাে। এর চেয়েও পুরােনাে বই হংসমুখ ধীরাজ সাঙ্কালিয়ার ‘দ্য ইউনিভার্সিটি অব নালন্দা’ (১৯৩৪)।১১১ সাঙ্কালিয়াও যেনতেন প্রকারে প্রমাণ করতে সচেষ্ট যে নালন্দা ধ্বংস করেছিলেন বখতিয়ার খলজি। তার ধারণা, মিনহাজ যে জায়গার বর্ণনা দিয়েছেন সেটা উদন্তপুরী নয়, নালন্দা। কেন? এ সম্পর্কে কোনাে নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই সাঙ্কালিয়ার কাছে এবং তিনি সেটা মেনেও নিয়েছে,
“It would thus appear that there is no direct evidence to prove that Nalanda was destroyed by the Mohammedans in the year A.D.1199.”১১২
সালটা গুলিয়ে ফেলেছেন তিনি, কেননা একটু পরেই তিনি আবার লিখেছেন,
“Hence Nalanda was destroyed by the Mohammedans in or about 1205 A.D.”১১৩
প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও সাঙ্কালিয়ার অনুমান,
“The Moslem invasion therefore appears to be the immediate cause of the destruction of Nalanda.” ovqats fofos 76016201, “according to another tradition, the buildings were razed to the ground by a stupid act of two mendicants. Ridiculed by the young monks, they are said to have propitiated the sun for twelve years, performed a sacrifice and alleged to have thrown |embers on the stately structures which reduced them to ashes.”১১৪
আর সেটা ঘটেছিল বখতিয়ার খলজি আসার অনেক পরে।
কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, যজ্ঞের আগুনেই যে নালন্দা পুড়েছিল তার প্রমাণ কি? ফরাসি লেখক Lucien X. Polastron তাঁর বিখ্যাত বই ‘বুকস অন ফায়ার’-এ১১৫ যজ্ঞের অঙ্গার ছুঁড়ে ফেলার দীর্ঘ বিবরণ দেওয়ার পরও বলেছেন, গল্পটা এখনও চালু আছে এবং এটা প্রচার করেছিলেন তিব্বতী লামা ধর্মস্বামী আর তিনি মােটেই সুবিধার লােক ছিলেন না। তিনি ‘যে সুবিধার লােক ছিলেন না’, Polastron একথা জানলেন বা বুঝলেন কী করে? সে সম্পর্কে তার কোনাে বক্তব্য নেই। বরং কোনাে ব্যাখ্যা ছাড়াই সম্পূর্ণ অনুমানের ভিত্তিতে Polastron ধর্মস্বামী থেকে বন্দুক ঘুরিয়ে দিয়েছেন বখতিয়ার খলজির দিকে। ঐতিহাসিক এ এল ব্যাসাম নালন্দা ধ্বংসের জন্য সরাসরি বখতিয়ারকে দায়ী না করলেও তিনি অবশ্য এটা ধ্বংসের জন্য মুসলিম আক্রমণকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। কোনাে প্রমাণ ছাড়াই তিনি লিখেছেন, “গঙ্গার তীরে তীরে মুসলিম অভিযানের তরঙ্গাভিঘাতেই নালন্দা ও বিহারের অন্যান্য বৌদ্ধ মঠ লুণ্ঠিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। গ্রন্থাগারগুলি হয় ভস্মীভূত এবং দলে দলে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় আক্রমণকারীদের হাতে।”১১৬ ধীরাজ সাঙ্কালিয়া অবশ্য নালন্দায় আগুন লাগানাের ঘটনার সমর্থনে লিখিত সূত্র উল্লেখ করে লিখেছেন,
“The tradition cited from Pagsam-jon zang ahout the final annihilation of Nalanda by fire may be true, for while excavating the Nalanda-site, heaps of ashes and coals are unearthed, even on the topmost levels after the removal of layers of earth which cover up various sites.”১১৭
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, একদিকে সাঙ্কালিয়া বলছেন নালন্দা ধ্বংস করেছিলেন বখতিয়ার খলজি, আবার পরে হিন্দুদের দ্বারা নালন্দায় অগ্নি সংযােগের ঘটনাও সত্যি বলছেন। তাহলে এমন পরস্পরবিরােধী বক্তব্যের উদ্দেশ্যই বা কি? তিনি কি নালন্দা ধ্বংসের বা নালন্দার লাইব্রেরি পােড়ানাের আসল কারণ আড়াল করতে চাইছেন?
এইসব দেখে মনে পড়ে যায় আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার ধ্বংস (৬৪২) সম্পর্কে এক শ্রেণির পণ্ডিতদের অপপ্রচার। সাংস্কৃতিক নষ্টামির উদাহরণ দিতে গিয়ে দেশ-বিদেশের বহু বুদ্ধিজীবী ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা মহামান্য হজরত ওমরের (৬৩৪-৪৪) উপর তৎকালীন মিশরের রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রীক-জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থাগার ধ্বংসের অভিযােগ উত্থাপন করেন। এমনকি ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ ভ্যালেন্টাইনের শিক্ষানীতির আলােচনা প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতেও এই ধ্বংসের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। রটনাটি হচ্ছে হযরত ওমরের নির্দেশ বলে আলেকজান্দ্রিয়ার অতি সুপ্রাচীন ও সুবিখ্যাত বিশাল গ্রন্থাগারটিকে একেবারেই পুড়িয়ে ফেলা হয়। হযরত ওমর নাকি তার সেনাপতি আমর ইবনুল আসকে জিজ্ঞাসা করেন—‘ওই গ্রন্থাগারে যা আছে, তা কি পবিত্র কোরআনে আছে?’ সেনাপতি উত্তর দেন—’তা নেই।’ তখন হজরত ওমর বলেন—‘তাহলে ওই পুস্তকগুলাে পবিত্র কোরআনের বিরুদ্ধবাদী, সুতরাং ওগুলােকে পুড়িয়ে ফেল। তখন অন্য একজন সেনাপতি বললেন—“মহামান্য খলিফা, ওই সমস্ত পুস্তকে যা আছে, তা কোরআনেও আছে।তখন খলিফা বলেন, যা কোরআনে আছে, তাই-ই যদি ওই পুস্তকগুলােতে থাকে, তাহলে ওই পুস্তকগুলাে অনাবশ্যক, ওদের কোনাে প্রয়ােজন নেই, ওগুলােকে সত্বর পুড়িয়ে ফেল।’—খলিফা হজরত ওমরের নির্দেশ মেনে তার সেনাপতি আমর (বিদ্যাসাগর যাঁকে অমরু বলে উল্লেখ করেছেন) নাকি ৬ মাস ধরে আলেকজান্দ্রিয়ার অসংখ্য স্নানাগারের অগ্নিকুন্ডে গ্রন্থাগারের মূল্যবান বইসব ফেলে ধ্বংস করেছিলেন। কিন্তু মিথ্যা তাে চিরদিন চলতে পারে না। এক সময় ওই চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যায়। রােমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার খৃষ্টপূর্ব ৪৮ অব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেন। ঐতিহাসিক আর এস ম্যাকেনসেন বলেন, সিজারের অগ্নিকান্ডের পরও গ্রন্থাগারে কিছু সংগ্রহ থাকায় পণ্ডিত ব্যক্তিরা এখানে যাতায়াত করতেন। কিন্তু ২১৬ সালে রােমান সম্রাট কারাকাল (১৮৬-২১৭) এটি বন্ধ করে দেন। পরে ২৭৩ সালে রােম সম্রাট অরােলিয়াম (২২২-২৭৫) গ্রন্থাগারটি পুরােপুরি ধ্বংস করে দেন।১১৮ পরে আবার এখানে ‘দুহিতা লাইব্রেরী’ নামে একটি গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। ৩৮৯ সালে রােম সম্রাট থিওডােসিয়াসের ইন্ধনে এই গ্রন্থাগারও ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এরপর আরবীয়রা যখন ৬৪২-এ আলেকজান্দ্রিয়া দখল করেন সেখানে তখন কোনও গ্রন্থাগার ছিলই না। সমকালীন কোনও লেখক কিন্তু আমর কিংবা হজরত ওমরের বিরুদ্ধে গ্রন্থাগার ধ্বংসের অভিযােগ তােলেননি। প্রায় ৬০০ বছর পর আল বাগদাদীই (মৃত্যু ১২৩১) সম্ভবত আজগুবি কাহিনি রটান।১১৯ অবশ্য কেন তিনি এমন প্রচার করেন তা জানা যায়নি। তবে তাঁর বক্তব্য পরবর্তীকালে লেখকরা নানাভাবে অতিরঞ্জিত করেছেন।১২০ পি কে হিট্টি বলেন, আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের গল্পটি কাহিনি হিসেবে চমৎকার, তবে এর ঐতিহাসিক মূল্য কিছুই নাই।১২২ উইলিয়াম মূরও তার ‘দ্য খালিফেট’ গ্রন্থে (এডিনবার্গ, ১৯২৪) এই কাহিনিকে কাল্পনিক বলে অভিহিত করেছেন। মুসলমানগণ কর্তৃক আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার পােড়ানাে যে ভ্রান্ত এবং খ্রিস্টানরাই যে এই কাজ করেছিল, বিশ্ব ইতিহাসের দ্রষ্টা হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দ অবহিত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন.
“এই মিশরেই সে আলেকজান্দ্রিয়া নগর, সেখানকার বিদ্যালয়, পুস্তকাগার বিদ্বজ্জন জগৎ প্রসিদ্ধ হয়েছিল। সে আলেকজান্দ্রিয়া মূখ গোঁড়া-ইতর খ্রিশ্চানদের হাতে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেল, পুস্তকালয় ভস্মরাশি হল, বিদ্যার সর্বনাশ হল।”১২২
নালন্দার ক্ষেত্রেও যেন ওই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে। ইন্টারনেটের জনপ্রিয় সাইট উইকিপিডিয়ায় ‘ডেস্ট্রাকশন অব লাইব্রেরিজ’ লিস্টে বখতিয়ার খলজিকে নালন্দা গ্রন্থাগারের ধ্বংসকারী হিসেবে দেখানাে হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে।
“Nalanda University complex was sacked by Turkic Muslim invaders under the perpetrator; this event is seen as a milestone in the decline of Buddhism in India.”
কিন্তু কোন তথ্যের ভিত্তিতে? উইকিপিডিয়া সাইটের ‘ডেস্ট্রাকশন অব লাইব্রেরিজ’ রচনার এই মন্তব্যের ওপর ভিত্তি কর,
“It is said that Khilji asked if there was a copy of the Koran at Nalanda before he sacked it.”
আলেকজান্দ্রিয়ার ঘটনার মতাে একই বানােয়াট সংলাপ!
আরবীয়রা অমুসলমানদের গ্রন্থাদি নষ্ট বা ধ্বংস করা পছন্দ করতেন না। তাদের ধর্মীয় নীতি এটা সমর্থন করে না। জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে ইসলামের তাগিদ খুবই স্পষ্ট ও তাৎপর্যপূর্ণ। ইসলামের প্রথম বাণীই হল, ‘পড়’। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “(হে নবী) আপনি পড়ুন, আপনার সেই পালনকর্তার নামে…যিনি তােমাকে কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।” নবী হজরত মােহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, “আমি শিক্ষক হিসেবেই প্রেরিত হয়েছি। তিনি প্রত্যেক মানুষের জন্য জ্ঞানার্জন বাধ্যতামূলক ঘােষণা করে আজ থেকে ১৪১০ বছর আগে ইসলামে শিক্ষার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হজরত মােহাম্মাদ (সঃ) বলেছেন, বিদ্যা মুসলমানদের হারান সম্পদ, রাত্রে কিছু সময় জ্ঞান আলােচনা করা সারারাত জেগে উপাসনা করার চেয়েও উত্তম ইত্যাদি। হজরত মােহাম্মদের (সঃ) কথার ফলাফল তার জীবদ্দশাতেই শুরু হয়ে যায়। পরবর্তীতে ইরাকের বাগদাদ, মিশরের কায়রাে, ইতালির স্যালার্নো ও স্পেনের কর্ডোভায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে।
জ্ঞানচর্চার এহেন পৃষ্ঠপােষক নবীর একজন একনিষ্ঠ অনুসারী এবং সঙ্গী, ঐতিহাসিকগণ যার শিক্ষাপ্রাণ তা, সুবিচার এবং জীবনযাত্রার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, সেই হজরত ওমর কি করে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার জ্বালিয়ে দেওয়ার কথা বলতে পারেন! উপরন্তু ইতিহাস ত বলে আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের পর মুসলমানরা সে দিনের জ্ঞান সংরক্ষিত করেছিলেন, নিজেদের জ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিলেন। এমনও জানা যায় যে, গ্রীসের প্রাচীন জ্ঞান-ভাণ্ডার মুসলমানরাই অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। (সমরেন্দ্রনাথ সেন, বিজ্ঞানের ইতিহাস)। মুসলিমরাই প্লেটো-এরিস্টটলকে ইউরােপে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
স্বামী বিবেকানন্দ আধুনিক ইউরােপের নবজাগরণের পশ্চাতে ইসলামীয় সংস্কৃতির উদার জ্ঞানচর্চার অবদানের কথা বহুস্থানে আলােচনা করেছেন। মধ্যযুগের খ্রীস্টান-সম্প্রদায়ের বিজ্ঞান-বিরােধিতার সঙ্গে ইসলামের মুক্ত জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চার তুলনা করে দেখিয়েছেন, ইসলামে বিজ্ঞানানুরাগ প্রবল ছিল। তিনি যথেষ্ট আত্মবিাসের সঙ্গে বলেছেন,
“..নিউ টেস্টামেন্ট-এ প্রত্যক্ষ বা পরক্ষ ভাবে কোনও বিজ্ঞান বা শিল্পের প্রশংসা নেই। কিন্তু এমন বিজ্ঞান বা শিল্প নেই যা প্রত্যক্ষ বা পরক্ষ ভাবে কোরান বা হাদিসের বহু বাক্যের দ্বারা অনুমােদিত এবং উৎসাহিত নয়।”
হজরত মােহম্মদের (সঃ) মহাপ্রয়াণের (৬৩২) ১১৮ বছর পর ইউরােপ, এশিয়া ও আফ্রিকা তথা স্পেন হতে শুরু করে একেবারে ভারতের সিন্ধুনদ পর্যন্ত ইসলামীয় সভ্যতা বিস্তার লাভ করে। এই আরব মুসলিমরা শুধু দেশ জয়ই করেননি, বরং সেখানে মুসলমান পন্ডিতদের বসিয়েছেন গবেষণা করতে এবং গ্রন্থাগার ভর্তি করেছেন নতুন ও পুরাতন পুঁথিপত্র-পুস্তকাদির সম্ভারে। সেসময়ে বিদ্যানুসন্ধিৎস্য দল হিসেবে তারা ছিলেন পৃথিবীর উন্নত মার্গে। বিদ্যাশিক্ষার এহেন ধারক ও বাহক আরবীয়রা আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার পােড়াতে যাবেন, এটা ভাবতে অবাক লাগে।
শুধু নালন্দাই নয়, ময়নামতী মহাবিহারও (অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত) ধ্বংস হয় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে। নালন্দার মতাে এক্ষেত্রেও দায়ী করা হত মূলত মুসলিম আক্রমণকারীদের। একাদশ শতকের শেষভাগে বৌদ্ধ চন্দ্রবংশ উৎখাত করে অবিভক্ত দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্মণ রাজবংশ। এই বংশেরই অন্যতম শাসক ছিলেন জাতবর্মা। রাজ্য বিস্তারের লক্ষে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল পাহাড়পুরের সােমপুর মহাবিহারের প্রতি। তিনি অচিরেই বৌদ্ধবিহারটি অবরুদ্ধ এবং লুণ্ঠন করেন। অবশেষে অগ্নি সংযােগে মহাবিহারটি ধ্বংস করেন।১২৩ ওই বিহারের মঠাধ্যক্ষ সুপণ্ডিত করুণাশ্রী মিত্রকেও তিনি অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করেন।১২৪ ভােজবর্মার বেলাবলিপি থেকেও জানা যায়, পরম বিষ্ণুভক্ত জাতবর্মা সােমপুরের মহাবিহার ধ্বংস করেছিলেন। বৌদ্ধ নিপীড়নের কিছু নমুনা প্রসঙ্গে বিখ্যাত সােমপুর মহাবিহার ধ্বংসের কথা নীহাররঞ্জন রায় এভাবে উল্লেখ করেছেন,
“…ভারতীয় কোনও রাজা বা রাজবংশের পথে পরধর্মবিরােধী হওয়া অস্বাভাবিক, এ যুক্তি অত্যন্ত আদর্শবাদী যুক্তি, বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি তাে নয়ই। অন্যকাল এবং ভারতবর্ষের অন্য প্রান্তের বা দেশখণ্ডের দৃষ্টান্ত আলােচনা করিয়া লাভ নাই, প্রাচীনকালের বাঙলাদেশের কথাই বলি। বঙ্গাল-দেশের সৈন্য-সামন্তরা কি সােমপুর মহাবিহারে আগুন লাগায় নাই? বর্মণ রাজবংশের জনৈক প্রধান রাজকর্মচারী ভট্ট-ভবদেব কি বৌদ্ধ পাষন্ড বৈতালিকদের উপর জাতক্রোধ ছিলেন না? সেন-রাজ বল্লাল সেন কি নাস্তিকদের (বৌদ্ধ) পদচ্ছেদের জন্যই কলিযুগে জন্মলাভ করেন নাই?”১২৫
[১২]
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, প্রাচীন ভারতে শিক্ষার প্রসারে পৃথিবীর প্রাচীনতর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চিহিত নালন্দার মতাে বৃহদায়তন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। পঞ্চম শতকে গুপ্ত সম্রাটদের বদান্যতায় নালন্দার প্রকৃত গােড়াপত্তন হলে এই প্রতিষ্ঠান এদেশে উচ্চশিক্ষা ও মননশীলতার ক্ষেত্রে যে গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করেছিল ত্রয়ােদশ শতক পর্যন্ত দীর্ঘ আটশাে বছর তা অব্যাহত ছিল। সপ্তম শতকে চিনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ ও ইৎ-সিং নালন্দার সংগঠন, কর্মপদ্ধতি লক্ষ্য করে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তারা নালন্দা মহাবিহারের যে বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য ও গবেষণার দ্বারা তার যথার্থতা প্রতিপন্ন হয়েছে। আটটি কলেজ, কয়েকটি সুবৃহৎ আগার, গ্রন্থাগার, মানমন্দির, শ্ৰমণ, অধ্যাপক ও ছাত্রদের ব্যবস্থানের উপযােগী বহু বিচিত্র সৌধমালার অপূর্ব সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত হয়েছিল। সমগ্র বিবিদ্যালয়ের এলাকা বেষ্টন করে ছিল একটি দীর্ঘ প্রাচীর। ইৎ সিং-এর বর্ণনায় জানা যায়, প্রায় ৩০০০ শ্ৰমণ ও বিদ্যার্থী অবস্থান করবার মত ব্যবস্থা নালন্দায় ছিল। হিউয়েন সাঙ-এর জীবনীকার হুই-লি এই সংখ্যাকে ১০,০০০ লিপিবদ্ধ করেছেন। এ থেকে বিবিদ্যালয়ের বিরাটত্বের আভাস পাওয়া যায়।
এটাও বােঝা যাচ্ছে যে, বখতিয়ার খলজি কতৃর্ক নালন্দা ধ্বংসের বিষয়টি খুবই বিতর্কিত—এ নিয়ে কোনাে সহজ সিদ্ধান্তে আসা যায় না। বখতিয়ার তৎকালীন বিহারের রাজধানী হিসেবে ১২০৩ সালে আক্রমণ চালিয়েছিলেন উদন্তপুরীতে। কিন্তু তা ধ্বংস করেছেন বলা অতিরঞ্জিত। তিনি ভুলে সামরিক দূর্গ ভেবেই উদন্তপুরীতে হামলা করেছেন। এ প্রসঙ্গে গ্রন্থাগার পােড়ানাের বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও তা রটনা মাত্র। অন্যদিকে হামলা তাে দূরের কথা বখতিয়ার নালন্দাতেই যাননি। মিনহাজ তা বলেননি। এরপরেও অবশ্য কিছু পণ্ডিত নালন্দা ধ্বংসের জন্য বখতিয়ারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। উল্লেখ্য যে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবলুপ্তির সঙ্গে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্মের অন্তর্ধানের একটি সম্পর্ক রয়েছে। সপ্তম শতকে ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনের সময় হিউয়েন সাঙ লক্ষ্য করেছিলেন যে, এককালের সক্রিয় বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে পতনের দিকে এগিয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, তিনি নালন্দার পরিসমাপ্তির দুঃখজনক পূর্বাভাষও পেয়েছিলেন। সেই সময় বৌদ্ধধর্ম দ্রুততার সঙ্গে তার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। কেবলমাত্র অধুনা বিহার ও বাংলা অঞ্চলের রাজারাই এই ধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করছিলেন। পাল শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের প্রথাগত মহাযান ও হীনযান সম্প্রদায়ে গােপন আচার অনুষ্ঠান ও যাদুবিদ্যা সংক্রান্ত তান্ত্রিক কার্যকলাপ অন্তর্ভুক্ত হয়। পাশাপাশি এই ধর্মমতে সহজযান, বজ্রযান প্রভৃতি নানা গােষ্ঠীও তৈরি হয় এবং এই গােষ্ঠীগুলির অন্তর্কলহে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে ক্ষয় পেতে শুরু করে। তাছাড়া সংঘে নারীদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়ায় এবং ভিক্ষুনীদের সংখ্যা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়াও সংঘগুলিতে অনাচার ও অনৈতিকতা প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা মদেও আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। ফলে জনমানসে বৌদ্ধভিক্ষুদের সম্পর্কে একটা বিরূপ মনােভাব সৃষ্টি হতে লাগল।১২৬ সেইসঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশে বৈষ্ণব ও শৈব দার্শনিক— যেমন উদ্যোতকর, কুমারিল ভট্ট, শংকরাচার্য, উদয়নাচার্য, বাচস্পতি মিশ্র প্রমুখগণের আগ্রাসন, ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকদের চরম বৌদ্ধদ্বেষ নীতি এবং একাদশ শতকে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশের পতনের ঘটনা থেকেই বােঝা যায় যে, সে সময়ে বৌদ্ধধর্মের উপর রাজনৈতিক-দার্শনিক-নৈতিক দিক হতে চরম আঘাত নেমে এসেছিল।
এ সত্বেও ত্রয়ােদশ শতকের প্রারম্ভে বখতিয়ার খলজির বিহার আক্রমণই ভারতে বৌদ্ধধর্মের ওপর শেষ আঘাত হেনেছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, যাদের গােপন সাহায্যে বখতিয়ার তথা মুসলিমরা বিহার ও বাংলা জয় করলেন তাদের উপর বা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর মুসলমানরা চরম আঘাত হানবেন তা মানা সম্ভব নয়। আসল কথা হল, নালন্দা ধ্বংস হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের হাতেই। নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসে অর্থনীতির বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা, আমরা যখন বলি রাজনীতি সর্বদাই অর্থনীতিকে অনুসরণ করে তখন ভিন্ন প্রেক্ষাপটের দিকে নজর দেওয়ার প্রয়ােজন পড়ে। ক্ষত্রিয় রাজানুকুল্য নয়, ছিল বিদ্যা শিক্ষাদানের জমজমাট ব্যবসা। এক-একজন ব্রাহ্মণ পরিবারে কম করে হলেও চার-পাঁচশ ছাত্র থাকত। এরা গুরুর কাছে শুধু বিদ্যাশিক্ষাই করত না, গুরুগৃহের যাবতীয় কাজকর্ম ভাগ করে নিত। যার ফলে আরাম আয়েশের দিক দিয়ে একেকজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এক-একজন সামন্তের মতাে দিন যাপন করতেন। আচার্যের গ্রাম একটি ছােট্ট সামন্ত রাজের গ্রামের মতােই প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ছিল যদিও এই আচার্য ছিলেন রাজপুরােহিত। আর এখানেই আঘাত হানে। বৌদ্ধধর্মীদের বিহার। বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র ছিল বিহারগুলি। শত শত আবাসিক বিহার গড়ে ওঠে সারা ভারতভূমিতে। বিদ্যাশিক্ষার জন্য দলে দলে বিদ্যার্থীরা নাম লেখাতে থাকে নানা বিহারে। তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের সংখ্যাও কম নয়। ইতিমধ্যে তাদের পরিবার বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়ে নেয়। তাছাড়া বিদ্যাদানের ব্যাপারে বিহারগুলিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, চণ্ডাল—এসবের কোনাে বৈষম্য ছিল না। সব শ্রেণির মানুষের জন্য বিহারের দরজা ছিল উন্মুক্ত। ফলে টোলের ব্রাহ্মণদের বিদ্যাদানের ভাটার টান ধরে, একদমই মহাভাটা। অতএব, নালন্দা বিহার ধ্বংস করা অর্থনৈতিক কারণেও তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে।
ঐতিহাসিক ডি আর পাতিল তার ‘অ্যান্টিকোয়ারিয়ান রিমেইক্স অফ বিহার’ গ্রন্থে (বিহার সরকার কতৃর্ক প্রকাশিত, এটা নালন্দা ধ্বংসের উপর লিখিত একমাত্র গবেষণাপত্র) বলেছেন যে, শৈবরাই নালন্দা ধ্বংস করেছিল। তিনি এও লিখেছেন যে, নালন্দা ধ্বংস হয়েছিল বখতিয়ারের বিহার আক্রমণের পূর্বেই। স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৮) নালন্দা প্রথম আক্রান্ত। ও ধ্বংস হয় শৈব রাজা মিহিরকুলের দ্বারা। প্রায় দেড় শতাব্দী পরে গৌড়রাজ শশাঙ্কের সময়ে (৬০৬-৬৪৭) নালন্দা দ্বিতীয়বার আত্রান্ত হয়। এটা ছিল রাজা শশাঙ্ক ও কনৌজের রাজা হর্ষবর্ধনের সংঘর্ষের ফলশ্রুতি। এরপর উত্তর বিহারের তিরহুতের রাজা অর্জুনের সময় একদল ব্রাহ্মণ দুর্বৃত্তের হাতে নালন্দা আত্রান্ত হয় ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও পালযুগে মহীপালের সময়ে (৯৮১-১০২৯) নালন্দা আগুনে বিনষ্ট হয়। বার বার ধ্বংসপ্রাপ্ত নালন্দার সংস্কারও হয়েছে।
সুতরাং স্পষ্টতই বলা যায় যে, বখতিয়ার বিহার ও পরবর্তীতে বাংলায় অভিযান চালিয়েছেন সত্য এবং সেটা তিনি করেছেন বৌদ্ধদের আহ্বানে। সেটা করতে গিয়ে তার বাহিনীর হাতে উদন্তপুরী ও বিক্রমশীলা মহাবিহার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং সেই সঙ্গে বহু মানুষও মারা গিয়েছিল। কিন্তু বখতিয়ার ঐতিহাসিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের সংগে কোনােভাবেই জড়িত ছিলেন না। বরং বখতিয়ারের সময় ও পরবর্তী মুসলিম শাসনে নালন্দা সহ অনেক বৌদ্ধবিহারে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্বের মতােই জ্ঞানচর্চা চলেছিল। কিন্তু দেশীয় ও বিদেশীয় রাজাদের পৃষ্ঠপােষকতা সত্ত্বেও মূলত অষ্টম শতকের শেষভাগ থেকে নালন্দার গৌরব-সূর্য ধীরে ধীরে অস্তমিত হতে থাকে, বিশেষ করে ৮১০ সালে বিক্রমশীলা মহাবিহার প্রতিষ্ঠার পরই। পাল রাজাদের সময়ে বিক্রমশীলার পরিচালকবৃন্দই নালন্দা পরিচালনা করতেন। তার ওপর তখনকার নানা গােষ্ঠীগত সংঘর্ষ ও আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে দীর্ণ নালন্দা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। অথচ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে সমূলে ধ্বংস করা ও বৌদ্ধধর্মকে তার উৎসস্থল হতে নির্মূল করার জন্য বখতিয়ারের উপর দোষারােপ করা হয়—এটা ঐতিহাসিক সততার চরম ও কদর্য বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। পক্ষপাতদুষ্ট ঐতিহাসিকগণের এই প্রচেষ্টা তাদের বস্তুনিষ্ঠ ঐতিহাসিক জ্ঞানের চরম দীনতা প্রকাশ করে।
[The End]
[প্রথম পর্ব] – [দ্বিতীয় পর্ব] [তৃতীয় পর্ব]আরও পড়ুন,
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বখতিয়ার খলজি ধ্বংস করেননিঃ ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
তথ্যসূত্রঃ
- ৭৯. বুদ্ধগয়া গয়া-দৰ্শন রাজগীর নালন্দা পাওয়াপুরী পর্যটক সহায়ক পুস্তিকা, নালন্দা, পৃ. ১৬-১৭, দ্রঃ-আমীর হােসেন, বাঙালীর বিভাজন, অনুষ্টুপ, বিশেষ শীতকালীন সংখ্যা ১৪০৮, কলকাতা। অষ্টম শতকে হিন্দুধর্মের পুন(স্থানকালে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি কর্তৃক বৌদ্ধবাদ ও জৈনবাদ ধ্বংসের অন্যতম হােতা ছিলেন পণ্ডিত কুমারিল ভট্ট। তিনি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করে প্রথমে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে শৈব মতাবলম্বী হন এবং প্রচণ্ড বৌদ্ধ বিরােধী হয়ে পড়েন। বৌদ্ধ সংহারে নিজের যাবতীয় শক্তি ও কূটকৌশল প্রয়ােগ করেন। তিনি বৌদ্ধ নির্যাতনের স্বপক্ষে রীতিমতাে শাস্ত্রীয় নির্দেশই জারি করেছিলেন। বৌদ্ধ মাত্রই বধ্য’-এই মতের প্রচার করেছিলেন তিনি। (উইলহেম হাবফাস, ট্রাডিশন অ্যান্ড রিফ্লেকশন এক্সশেরেসন্স ইন ইন্ডিয়ান থট, শ্রীগুরু পাবলিকেশনস্, নিউ দিল্লি, ১৯৯২, পৃ. ৬০)। কুমারিল গৌড়ে এসেছিলেন কিনা সে বিষয়ে কোনাে কোনাে ইতিহাসবেত্তাগণ নীরব থাকলেও গৌড়রাজ শশাঙ্কের সময়কালেই তিনি গৌড়ে এসেছিলেন। তাঁর পৌরহিত্যে রাজা শশাঙ্ক অমেধ যজ্ঞ করেন। তিব্বতের বিভিন্ন বৌদ্ধধর্মীয় পুস্তকে কুমারিলকে ভয়ংকর বৌদ্ধ নিপীড়ক বলা হয়েছে। তবে কুমারিলের সংগে শংকরাচার্যের সাক্ষাৎ যে ঘটেছিল তা স্পষ্ট করেই ঐতিহাসিকরা বলেছেন। আর এই দু’জনেই ছিলেন বৌদ্ধ নিধন যজ্ঞের অন্যতম নায়ক। বৌদ্ধ নিধন করার জন্য কুমারিল প্ররােচিত করেন উজ্জয়িনীর (আজকের ভারতের মধ্যপ্রদেশে) রাজা শুদ্ধভানকে। শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিকা’র বর্ণনায় আছে, কেমন করে উজ্জয়িনীর রাজার শ্যালক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের উপর অত্যাচার করত, তাদেরকে বলদ হিসেবে ব্যবহার করা হত। কুমারিলের থেকে বয়সে ছােটো ও তার সমসাময়িক শংকরাচার্য (৭৮৮-৮২০) বৌদ্ধদ্বেষী হিসেবে আরও কঠিন অপসহীন ছিলেন। গৌতম বুদ্ধের মতাদর্শের সঙ্গে বেদের দ্বন্দ্ব চিরকাল। বেদের ভিত্তি বর্ণাশ্রম। গৌতম বুদ্ধ এই ভিত্তিকে নাকচ করে দেন। বুদ্ধের এই মতাদর্শ ক্ষিপ্ত করে তােলে শংকরাচার্যকে। তিনি গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে বললেন, “বুদ্ধ মানুষের শত্রু বিশেষ এবং বুদ্ধের শিক্ষা হইল বিরুদ্ধ ও পরস্পর দ্বন্দ্বমূলক।” (মনিকুন্তলা হালদার, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস, মহাবােধি বুক এজেন্সি, চতুর্থ মুদ্রণ, কলকাতা, ২০১৭, পৃ. ২৮১)। নিখাদ ব্রাহ্মণ শংকরাচার্য তাই বেদভূমি ভারত থেকে বৌদ্ধধর্মের নাম-নিশানা মুছে ফেলার ব্রত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। শংকরাচার্য তাঁর ‘গীতাভাষ্য’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ব্রাহ্মণত্বস্য রক্ষিতেন রক্ষিত, স্যাৎ বৈদিকো ধর্ম… ব্রাহ্মণরাই পবিত্র বৈদিক ধর্মের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন।” (স্বামী অপূর্বানন্দ, আচার্য শংকর, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ১৩৬)। সুতরাং খাঁটি ব্রাহ্মণ হয়ে বৈদিক ধর্ম তিনি রক্ষা করবেন না তাে কে করবে? এবং বেদ ও বৈদিক ধর্ম রক্ষায় দানবীয় মূর্তি ধারণ করে বৌদ্ধ হত্যায় প্রবৃত্ত হলেন। শংকরের আবির্ভাবের সময়কাল নিয়ে ইতিহাসবেত্তাদের মধ্যে মতভেদ আছে। মহাপণ্ডিত রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন তাঁর ‘ভারতে বৌদ্ধধর্মের উত্থান-পতন’ গ্রন্থে বলছেন, “শঙ্কর কুমারিল ভট্ট থেকে পূর্বেকার হতে পারেন না। কুমারিল বৌদ্ধ নৈয়ায়িক ধর্ম-কীর্তির সমসাময়িক ছিলেন, যিনি সপ্তম শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাহলে শঙ্কর সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকের লােক হতে পারেন না। শঙ্কর কুমারিল ভট্টের সমকালীন ছিলেন এবং দু’জনেই একে অন্যের সাক্ষাৎকার পেয়েছিলেন।” (রাহুল্য সাংকৃত্যায়ন, ভারতে বৌদ্ধধর্মের উত্থান-পতন, অনুবাদ- শ্রীজ্যোতিঃপাল মহাথেরাে, কোটপাড়, চট্টগ্রাম, ১৯৭৯, পৃ. ১২)। শংকরাচার্যের আবির্ভাবকাল নিয়ে আমাদের হাতে তিনটি সময়কাল রয়েছে। একটি শ্রীভগীবথ রচিত ‘জগদগুরু শঙ্করাচার্য’। শ্রীভগীরথ তার এ পুস্তকে শংকরাচার্যের জন্মসাল উল্লেখ করেছেন ৬৮৬ খ্রিস্টাব্দ। আরেকটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ভাষার অধ্যাপিকা মনিকুন্তলা হালদারের ‘বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস’। তিনি এ পুস্তকে শংকরাচার্যের জন্মকাল ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দ উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভারতে বৌদ্ধধর্মের উত্থান-পতন’ গ্রন্থের অনুবাদক তার ভূমিকায় শংকরাচার্যের আবির্ভাবকাল ৬৭৭-৭২০ খ্রিষ্টাব্দ উল্লেখ করেছেন। আমরা দ্বিতীয় মতটিকেই গ্রহণ করব। দক্ষিণ ভারতের কেরল রাজ্যের কোচিন-শেরানুর রেলপথে আলােয়াই স্টেশন থেকে মাইল ছয়ের দূরের গ্রাম কালাডি। এই গ্রামের নাম্বুদি ব্রাহ্মণ বংশে শংকরের জন্ম। পিতা শিবপুক্ষ, শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি । মাতা বিশিষ্টা দেবী। অতি অল্প বয়সেই বেদজ্ঞ পণ্ডিত হিসেবে শংকরের নাম ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধধর্মের ধ্বংস সাধন ও বর্ণশ্রম তথা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিষ্ঠায় তিনি সারা ভারতভূমি পরিত্র(মণে বের হন। এ পরিক্রমণের নামকরণ তাঁর অনুসারীরা করেন ‘দিগ্বিজয়’। এক অর্থে ‘দিগ্বিজয়’ তাে বটেই। বৌদ্ধ সংহারের মধ্য দিয়ে এ বিজয় অর্জিত হয়। ভারতভূমি পরিক্রমণে তার অনুগমন করেন ‘তিন সহস্র ব্রাহ্মণ’। এ তথ্য পরিবেশন করেছেন স্বামী অপূর্বানন্দ তার ‘আচার্য শংকর’ পুস্তকে। আর শ্রীভগীরথ তার ‘জগদ্গুরু শঙ্করাচার্য’ পুস্তকে অনুগামী ব্রাহ্মণের সংখ্যা বলেছেন সহস্রাধিক। তখনকার দিনে স্বামী অপূর্বানন্দ বর্ণিত ‘তিন সহস্র’ মানে বিশাল ব্যাপার। গুরুর প্রতি ভক্তির আতিশয্যে এ সংখ্যাটি এসে গেছে স্বামীজীর কলমে। তবে শ্রীভগীরথের দেওয়া সংখ্যাটি গ্রাহ্যে আনা যেতে পারে। শংকরাচার্যের অনুগামী এক সহস্র বা তার অধিক গোঁড়া ব্রাহ্মণ এক হাতে কমণ্ডলু, আরেক হাতে জপমালা নিয়ে উচ্চকণ্ঠে বেদের শ্লোক গাইতে গাইতে বেদের অনুশাসন প্রতিষ্ঠায় বেরিয়েছেন, এটা একমাত্র মুখরাই বিশ্বাস করবে। অথচ ভক্তরা গুরু শংকরাচার্যকে নিয়ে যত বই লিখেছেন, তাতে তার ভারত পরিক্রমণে এ দৃশ্যকেই প্রতিভাত করে। এর ঠিক বিপরীত চিত্রটি হচ্ছে—বেদের অনুশাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি নেপালে গেলে প্রাণভয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা অন্যত্র পালিয়ে যায়। বহু ভিক্ষু আশ্রয় নেয় জঙ্গলে। শ্রীভগীরথ তাঁর ‘জগগুরু শঙ্করাচার্য’ পুস্তকে বলেছেন, শংকর ভারতভূমি পরিক্রমণকালে সঙ্গে বিরাট একটি কড়াই নিয়ে চলতেন। বিরােধী বা বেদ ধর্মের কোনাে ভিন্ন মতাবলম্বীর সঙ্গে শাস্ত্র নিয়ে আলােচনা করবার সময় প্রতিজ্ঞা করানাে হত—ওই কড়াইতে তেল ফুটতে থাকবে এবং যে তর্কে পরাস্ত হবে, তাকে ওই কড়াইতে ফেলে দেওয়া হবে। সমস্ত তর্কে শংকরই জয়ী হতেন। পরাজিতের ভাগ্যে কী ঘটত, তা সহজেই অনুমেয়। আসলে তার ভক্তরা তর্কের কথা বললেও মূলত বৌদ্ধদের ধরে এনে ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ের মধ্যে ছেড়ে দেখা হতাে। তার এই নিধনযজ্ঞ থেকে প্রাণে বাঁচতে হাজার হাজার বৌদ্ধ ভারতভূমি ছেড়ে বিদেশ চলে যান। এমনকি যে রাজ্যে তিনি পা রাখতেন সেখানকার বৌদ্ধরা প্রাণ রক্ষার তাগিদে বনে জঙ্গলে গিয়েও আশ্রয় নিতেন। বিহারগুলি ধ্বংস করে দেওয়া হত। ফলে সেখানকার আবাসিক ভিক্ষুরা তিব্বত, নেপাল ও অন্যান্য দেশে পলায়ন করেন। শংকরাচার্য বেদের অনুশাসন প্রতিষ্ঠায় তার বিরাট ব্রাহ্মণবাহিনীকে নিয়ে গেছেন অযােধ্যা, অহােবল (দক্ষিণ ভারতে), ইন্দ্রপ্রস্তপুর (দিল্লী ও তার আশেপাশের এলাকা), উজ্জয়িনী, কাঞ্চিপুরম, কামরূপ (তৎকালীন আসামের প্রধান নগর), কাশী, কুক্ষ (ভারতীয় পাঞ্জাবে), কেদার (উত্তরাখণ্ড), গণবর (দক্ষিণ ভারতে), গয়া, গােকর্ণ (মুম্বাইয়ের কাছাকাছি), চিদাম্বর (দক্ষিণ ভারতে), জগন্নাথ (উড়িষ্যা), দ্বারকা (ভারতের পশ্চিম তীরে), নৈমিল (উত্তরপ্রদেশে), পণ্ডরপুর (মহারাষ্ট্রে) , প্রয়াগ (ত্রিবেণী তটে), পাঞ্চাল, গৌড়বঙ্গ, ভবানীনগর (দক্ষিণ ভারতে), মাদুরা (দক্ষিণ ভারতে), মথুরা প্রভৃতি স্থানে। বেদের অনুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে বিরুদ্ধ ধর্মের মানুষের বাধা গুড়িয়ে দিয়েছেন নির্মমভাবে, রক্তপাত ঘটিয়েছেন চূড়ান্ত নিশ্চয়তায়। তার নিষ্ঠুরতার সঙ্গে খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের নৃশংসতাই কেবল তুলনীয়। এখানে শংকরাচার্য হয়ে উঠেছেন আর এক আচার্য ইস্রা। শুধু হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে গৌতমবুদ্ধের মতাদর্শ নির্মূল করার পথ বেছে নিয়ে তিনি ক্ষান্ত হননি, তেলে-জলে মিশ খাওয়ালেন বৌদ্ধধর্মের মূল চেতনার শেকড় আলগা করতে। যে গৌতম বুদ্ধকে তিনি মানুষের শত্রু বিশেষ বলে অভিহিত করেছেন, তার শিক্ষাকে বিরুদ্ধ ও পরস্পর দ্বন্দ্বমূলক বলেছেন, সেই নিরীশ্বরবাদী গৌতমকে তিনি ভগবান বিষ্ণুর দশাবতারের অন্যতম বলে গুণগানও করলেন। (স্বামী অপূর্বানন্দ, আচার্য শংকর, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯২)। শংকরাচার্য ভগবৎ ও পঞ্চ রাত্রিসহ অ-বৈদিক সমস্ত ধারাকে পরিষ্কারভাবে বর্জন করেছিলেন। (ডি এন ঝা, আর্লি ইন্ডিয়া এ কনসাইজ হিস্ট্রি, বাংলা সং- আদি ভারত একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৮,পৃ. ২৪)। অ-ব্রাহ্মণ্যবাদী লােকদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, এই দৃশ্য উপভােগ করার শঙ্করাচার্যের আনন্দানুভূতির অত্যন্ত স্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় শংকর ‘দিগ্বিজয়ে’। শঙ্করাচার্যের আগ্রাসী মনােভাব সম্বন্ধে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন। ‘শঙ্কর দিগ্বিজয়ে’ (৭৯০) আছে—বৌদ্ধগুরু বধের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ যখন কুমারিল ভট্ট তুষানলে প্রবেশ করেন, সে সময়ে শঙ্কর তার নিকট উপস্থিত হলে কুমারিল বলেছিলেন—“তথাগতাক্রান্তভুদশেষং স বৈদিকো ইব্বা বিরলী বভূব’ অর্থাৎ ‘বৌদ্ধেরা সমস্ত দেশ অধিকার করে নিয়েছে, বৈদিক মার্গও লুপ্তপ্রায় অবস্থা’। বৌদ্ধ সাম্যবাদ জনসাধারণের মধ্যে প্রচারিত হওয়ায় ব্রাহ্মণ ও তৎসঙ্গীদের বুনিয়াদী স্বার্থে যে বিশেষ আঘাত পড়েছিল এবং তা দূর করার জন্যে পুরােহিতবর্গ আর উচ্চস্তরের লােকেরা যে কি করেছিল তা পূর্বেই বলা হয়েছে। তারা নবক্ষত্রিয়’ শ্রেণী সৃষ্টি করে তাদের সাহায্যে সাম্যবাদীদের উপর নির্যাতন শুরু করে দিল। কুমারিল নিজেই মহারাষ্ট্র দেশের এক রাজাকে প্ররােচিত করে বহু সহস্র বৌদ্ধের প্রাণনাশের কারণ হয়েছিলেন। এখন শঙ্করও সেই মত গ্রহণ করে দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়েন। যে বেদান্ত মত প্রচারকল্পে শঙ্কর দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন সেটা যে কতদূর অভিজাতদের স্বার্থের অনুকূলে চালিত হয়েছিল তাহা শঙ্করের কার্যই প্রকাশ পায়। তিনি ভিন্ন মতাবলম্বীদের তর্কে পরাস্ত করার জন্য ‘বেদ একমাত্র অভ্রান্ত প্রামাণ্য’ বলে গ্রহণ করলেন এবং খৃষ্টীয় নাইট টেমপলার’দের মত একদল ষণ্ডা গুণ্ডা পালােয়ান চেলা তার সঙ্গে সবসময়ই থাকত উদ্দেশ্য—প্রহারপূর্বক স্বীয় মত প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। বেদের বিরুদ্ধে কোনও মতই তিনি গ্রাহ্য করেননি। অন্যত্র ‘শঙ্কর দিগ্বিজয়’ গ্রন্থে উল্লিখিত আছে যে, বৌদ্ধ ও জৈনদের তর্কে পরাস্ত করে তাদের মাথা কেটে নিয়ে চেঁকিতে কুটবার ব্যবস্থার কথা আছে। তবেদার নব-ক্ষত্রিয়েরা এদের হুকুম তামিল করবার জন্যে মােতায়েন থাকত। এই প্রচার অমােঘ অস্ত্র নিয়েই নব-বৈদিকের দল অর্থাৎ বৈদান্তিকেরা দিগ্বিজয়ে বার হতেন। সঙ্গে সঙ্গে শঙ্কর বৌদ্ধ ও জৈনদের ‘পুনর্জন্মবাদ’, ‘কর্মফলবাদ’ রূপ মতবাদের অস্ত্রকে নিজস্ব করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। তাের শিল, তাের নােড়া, তাের ভাঙ্গব দাঁতের গােড়া’—যেন এই ভাব আর প্রণালী তিনি গ্রহণ করেছিলেন।” (দেখুনভূপেন্দ্রনাথ দত্ত , বাঙ্গলার ইতিহাস, চিরায়ত প্রকাশন, প্রথম পরিমার্জিত সংস্করণ, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ৬৫)। অষ্টম শতকেই গাড়ােয়ালের হিন্দুরাজা তিব্বতের রাজা লামা ইয়ােসীহােতকে বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করাবার চেষ্টায় তাকে যেভাবে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন, তার বর্ণনা শরৎচন্দ্র দাস প্রণীত ‘এ ইন্ডিয়ান পণ্ডিতস ইন দ্য ল্যাণ্ড অফ স্নাে’ নামক গ্রন্থে (ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেস, কলকাতা, ১৮৯৩, রূপা, নিউ দিল্লি, ২০০৬) পাওয়া যাবে। সপ্তম শতকে কুমায়ুনে রীতিমত প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল বৌদ্ধধর্ম। অথচ শংকরাচার্যের আন্দোলন সেখানে একটি বৌদ্ধ মন্দিরও প্রায় অবশিষ্ট রাখেনি। (দীনেশচন্দ্র সেন, প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃ. ১১-১২)। শংকরাচার্যের ভারতভূমি পরিক্রমণ মানে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিজয়কেতন-উড্ডীন অর্থাৎ বৌদ্ধদের নিধন। এ সম্পর্কে তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মীয় পুস্তকে বলা হয়েছে, “শংকরের আগমনে বৌদ্ধবিহারগুলি কম্পমান হইত এবং ভিক্ষুগণ ছত্রভঙ্গ হইয়া পলায়ন করিত।” (মণিকুন্তলা হালদার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮১)। এছাড়া শঙ্করাচার্য সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে, “শংকরাচার্যের আত্মজীবনীগুলিতে বর্ণিত রহিয়াছে যে, শংকরাচার্য বৌদ্ধদিগের বি(দ্ধে অভিযান চালাইয়া আসমুদ্রহিমাচলের বৌদ্ধদের ধ্বংস করিয়াছিলেন।” (মণিকুন্তলা হালদার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮১) শঙ্করাচার্যের কাজকর্ম এমনই ছিল যে, অসংখ্য বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের তিনি পুড়িয়ে মারেন তাদেরকে বিতর্কে হারাবার পর। শংকরের এই কাজকর্মকে ধর্মীয় গোঁড়ামী ছাড়া আর কি বলা যায়। (কমটি ওয়ার্কস অফ স্বামী বিবেকানন্দ, খণ্ড-৩, কলকাতা, পৃ. ১১৮)। শঙ্করাচার্য রাজা সুধকে কন্যাকুমারিকা থেকে আসমুদ্রহিমাচল পর্যন্ত বৌদ্ধদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কেবল রাজা সুধন্বাই নয়, অন্যান্য ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় রাজাদের তিনি একই আদেশ দেন। রাজা সুধন্বা ও অন্য রাজারা তার নির্দেশ কীভাবে পালন করেছিলেন, আনন্দগিরি ও মাধবাচার্যের ‘শঙ্কর বিজয়’ গ্রন্থকে উদ্ধৃত করে রাহুল্য সাংস্কৃত্যায়ন বলছেন, “তার আজ্ঞায় রাজা সুধন্বা প্রভৃতি হাজার হাজার বৌদ্ধকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছিলেন এবং তলােয়ার দ্বারা তাদের শিরচ্ছেদ পূর্বক সংহার করিয়াছিলেন।” (রাহুল সাংকৃত্যায়ন, প্রাগুত্ত(, পৃ. ১২)। স্পষ্টতই বােঝা যায় যে, বৌদ্ধদের ওপর কি ভয়ঙ্কর জান্তব হিংস্রতা নিয়ে শংকরাচার্য ও তার অনুসারীরা ঝাপিয়ে পড়েন। তার অনুসারীরা রাজা সুধন্বা প্রমুখ যাঁদের কথা বলেছেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন, তারা কোন কোন রাজ্যের রাজা ছিলেন, সেই রাজ্যগুলিই বা কি? এসবের বিস্তারে গেলে আমরা শিলালিপিতে উদ্ধৃত ৬৪০০০ বৌদ্ধ হত্যার সত্যতা খুঁজে পাব।
- নাগার্জুনকোণ্ডার (বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশ) বৌদ্ধমূর্তি ও স্মৃতিসৌধগুলি ধ্বংস করতেও শংকরাচার্য দৈত্যসম ভূমিকা পালন করেন। এ এইচ লঙ্গহার্স্ট নাগার্জুনকোণ্ডায় খননকার্য পরিচালনা করেন। এ কাহিনি তিনি নথীভুক্ত করেছেন তাঁর গ্রন্থে। (এ এইচ লঙ্গহাস্ট, মেমােরিজ অফ দ্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, নং-৫৪ দ্য বুদ্ধিস্ট এন্টিকুইটিজ অফ নাগার্জুনকোণ্ডা, দিল্লি, ১৯৩৮, পৃ. ৬)। যে বীভৎস পন্থায় নাগার্জুনকোণ্ডার সমস্ত সৌধ ধ্বংস করা হয় তা সাধারণভাবে হৃদয় বিদারক। অসংখ্য স্তম্ভ, মূর্তি ও ভাস্কর্য এমন নির্মমভাবে ভেঙে টুকরাে টুকরাে করা হয় যে সেসব দেখে স্পষ্টতই বােঝা যায় যে, এসব ধনসম্পদ লুণ্ঠনকারীদের কাজ নয়। স্থানীয় কাহিনি বর্ণনা করে, হিন্দু মহাদার্শনিক ও ধর্মগুরু শঙ্করাচার্য তার বহু অনুগামীসহ নাগার্জুনকোণ্ডায় আগমন করেন এবং বৌদ্ধ স্মৃতিসৌধসমূহ ধ্বংস করেন। এই শংকরাচার্য একুশ শতকের ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে পরম পূজিত। শংকরাচার্য বা কুমারিল ভট্ট যে ধারায় হত্যাযজ্ঞ চালান, একই ধারায় আজকের হিন্দুত্ববাদীরা, যা ব্রাহ্মণ্যবাদের নামান্তর, তারা ভিন্নধর্মী নিধনে লিপ্ত হচ্ছে। নিপীড়ন-নির্যাতন চালানাে হচ্ছে শূদ্র তথা অস্পৃশ্যদের ওপরও। সংহারযজ্ঞের দৃষ্টান্তে গুজরাট সামনে এসে পড়ে। আমরা এর বিস্তারে যাব না। কুমারিল-শংকরাচার্যের কথায় যেতে হল অপরিহার্য কারণে। তাদের পরিচিতিই বলে দেবে বিশ ও একুশ শতকের শংকরাচার্যরা কীভাবে মনুষ্য রক্তের স্বাদ নিতে ড্রাকুলার মতাে ভয়ঙ্কর সুঁচালাে দাঁত বের করে রেখেছে।
- ৮০. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৬। দেখুন-পাগ সাম জন জ্যাং, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯২। প্রখ্যাত শি(বিদ শ্যামাপ্রসাদ চট্টরাজ লিখেছেন, “দু’জন তান্ত্রিক সন্ন্যাসী নালন্দায় আসেন এবং কোনাে কারণে নালন্দায় শিক্ষার্থীদের দ্বারা অপমানিত হয়ে প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য আগুন লাগিয়ে এই বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়টি ধ্বংস করে দেয়।” (শ্যামাপ্রসাদ চট্টরাজ, ভারতের শিক্ষার ইতিহাস, প্রথম প্রকাশ, সাহিত্যশ্রী, কলকাতা, ২০১৬, পৃ. ৮৭)।
- ৮১. লামা তারানাথ, হিস্টরি অফ বুদ্ধিজম ইন ইন্ডিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪১-৪২।
- ৮২. বি এন এস যাদব, সােসাইটি অ্যান্ড কালচার ইন নর্দার্ন ইন্ডিয়া ইন টুয়েলভথ সেঞ্চুরি, রাকা প্রকাশন, এলাহাবাদ, ২০১২, পৃ. ৩৪৬।
- ৮৩. আর এস শর্মা ও কে এম শ্রীমালি, এ কমপ্রিহেসিভ হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, খণ্ড-৪, ভাগ-২, অধ্যায় ২৫-খ বৌদ্ধধর্ম, মনােহর পাবলিশার্স, নিউদিল্লি, ২০০৮, পাদটীকা, পৃ. ৭৯-৮২।
- ৮৪. ডি আর পাতিল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২৭।
- ৮৫. ডি আর পাতিল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২৫।
- ৮৬. ডি আর পাতিল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৪।
- ৮৭. ডি আর পাতিল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২৫।
- ৮৮. দেখুন- যতীন্দ্রমােহন রায়, ঢাকার ইতিহাস, খণ্ড-২, প্রথম দিব্যপ্রকাশ সংস্করণ, ঢাকা, ২০১৭, পৃ. ৫৯। স্যামুয়েল বিল (ট্রান্সলেটেড), সি ইউ কি বুদ্ধিস্ট রেকর্ডস অফ দ্য ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড, খণ্ড-১, কিগান পল ট্রেঞ্চ ডুবনার অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড, লন্ডন, ১৯০৬, পৃ. ১৬৭-৭১। কলহন, রাজতরঙ্গিনী (এম এ স্টেন, ক্রনিকলস অফ দ্য কিং অফ কামীর, ওয়েস্টমিনিস্টার, ১৯০০, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৬১), খণ্ড-১, পৃ. ৮২৫। আরও দেখুন-রমেশচন্দ্র মিত্র, ডেকলাইন অফ বুদ্ধইজম ইন ইন্ডিয়া, শান্তিনিকেতন, ১৯৪৯, পৃ. ১২০।
- ৮৯. দেখুন– যতীন্দ্রমােহন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩।
- ৯০. এ এল ব্যাসাম, দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া, বাংলা সংস্করণ- অতীতের উজ্জ্বল ভারত, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০১৮, পৃ. ৩৬১। ঐতিহাসিক মােরল্যান্ড ও চ্যাটার্জির যৌথ প্রচেষ্টায় লিখিত ‘A short History of India’ গ্রন্থের ৯৮ পৃষ্ঠায়ও এ তথ্য রয়েছে। হিউয়েন সাঙ জানিয়েছেন, মিহিরকুল ১৬০০ বৌদ্ধতূপ ও মন্দির ধ্বংস করেন এবং হাজার হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে হত্যা করেন। তার বিবরণকে সমর্থন করেছেন একাদশ শতকের ঐতিহাসিক কলহন, যিনি কামীরের রাজা হর্ষ কর্তৃক বৌদ্ধদের নিগ্রহের উল্লেখ করেছেন। (ডি এন ঝা, এক হিন্দু আত্মপরিচয়ের খোঁজে, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ২৫)।
- ৯১. রেভারেন্ড এইচ হিরাস, দ্য রয়েল পেট্রনস্ অফ দ্য ইউনিভার্সিটি অফ নালন্দা, দেখুন- জার্নাল অফ দ্য বিহার অ্যান্ড উড়িষ্যা রিসার্চ সােসাইটি, পার্ট-১, খণ্ড-১৪, ১৯২৮, পৃ. ৮-৯।
- ৯২. জার্নাল অফ দ্য বিহার অ্যান্ড উড়িষ্যা রিসার্চ সােসাইটি, প্রাগুক্ত,
- ৯৩. প্রেমময় দাশগুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৫, বিপুল সাহা সম্পাদিত, হিউয়েন সাঙের ভারত ভ্রমণ, প্রান্তিক, কলকাতা, ২০০৯, পৃ. ১০৪, হিউয়েন সাঙ, বৌদ্ধযুগের ভারত, বারিদবরণ ঘােষ সম্পাদিত, পত্রলেখা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, কলকাতা, ২০১৭, পৃ. ১৪৬। আরও দেখুন- এ এল ব্যাসাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬১।
- ৯৪. টমাস ওয়াটার্স (ট্রান্সলেটেড), অন হিউয়েন সাঙস ট্রাভেলস্ ইন ইন্ডিয়া (৬২৯-৬৪৫ খ্রীঃ), খণ্ড-২, টি ডব্লিউ রিজ টেভিডস অ্যান্ড এস ডব্লিউ বুসেল, দিল্লি, ১৯৬১, পৃ. ১১-১৫।
- ৯৫. শূন্য পূরাণ-এ বলা হয়েছে ‘আ-সেতাের আতুষারাদ্রের বৌদ্ধনাং বৃদ্ধবালকান।/যাে ন হস্তি স হন্তব্যো ভৃত্যান্ ইত্যশিষ নৃপঃ।।”—সেতুবন্ধ হতে হিমালয় পর্যন্ত যেখানে যত বৌদ্ধ আছে, তাদের বৃদ্ধ ও বালকদের পর্যন্ত যে না হত্যা করবে, সে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হবে—রাজভৃত্যদিগের প্রতি রাজার এই আদেশ।
- ৯৬. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮।
- ৯৭. রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৪৩, পৃ. ৬৭।
- ৯৮. প্রেমময় দাশগুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৭। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রচনীকান্ত চক্রবর্তী লিখেছেন, “কর্ণসুবর্ণরাজ শশাঙ্কের সহিত মালবরাজের মিত্রতা ছিল। মালবরাজ দেবগুপ্ত বিদ্রোহী হইয়া কান্যকুজের গ্রহবর্মাকে নিহত করেন। গ্রহবর্মা স্থান্ধীরাধিপতি রাজ্যবর্ধনের ভগ্নি রাজ্যশ্রীর পাণিগ্রহণ করেছিলেন। মালবরাজ রাজশ্রীকে কারারুদ্ধ করেন।…রাজ্যবর্ধন মালবেরকে পরাজিত করিলে কর্ণসুবর্ণরাজ শশাঙ্ক নরেন্দ্র রাজ্যবর্ধনকে নিমন্ত্রণ করিয়া স্বশিবিরে আনিয়া বিধাসঘাতকতাপূর্বক মালবরাজ দেবগুপ্তের দ্বারা নিহত করান।” (রজনীকান্ত চক্রবর্তী, গৌড়ের ইতিহাস, দে’জ পাবলিশিং হাউস, তৃতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ৪৯)।
- ৯৯. বাণভট্ট হর্ষচরিত, প্রসূন বসু সম্পাদিত (প্রধান উপদেষ্টা ডঃ গৌরীনাথ শাস্ত্রী), নবপত্র প্রকাশন, চতুর্থ মুদ্রণ, কলকাতা, ২০১৭, পৃ. ১৫০।
- ১০০. রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙ্গালার ইতিহাস, অখণ্ড সংস্করণ, প্রথম ভাগ, দে’জ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ৬৭-৬৮।
- ১০১. ডি ডি কোশাম্বী, অ্যান ইনট্রোডাকশন টু দ্য স্টাডি অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি, বাংলা অনুবাদ-ভারত-ইতিহাস চর্চার ভূমিকা, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, তৃতীয় মুদ্রণ, কলকাতা, ২০১৩, পৃ. ২৫৪।
- ১০২. নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০৫-৫০৬।
- ১০৩. দেখুন-রামশরণ শর্মা, ভারতের প্রাচীন অতীত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৬ এবং এ এল ব্যাসাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬১। আরও দেখুন-ডি এন ঝা, আর্লি ইন্ডিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৫।
- ১০৪. হান্স বেকার, দ্য ওয়ার্ল্ড অফ দ্য স্কন্দপুরাণ নর্দার্ন ইন্ডিয়া ইন দ্য সিক্সথ অ্যান্ড সেভেন্থ সেঞ্চুরিজ (সাপ্টিমেন্ট টু গ্রোনিনজেন ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ), ব্রিল অ্যাকাডেমিক পাবলিশার্স, লিডেন, নেদারল্যান্ডস, ২০১৪, পৃ. ১২৮-২৯।
- ১০৫, ডি ডি কোসাম্বী, দ্য কালচার অ্যান্ড সিভিলাইজেশন অফ এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া ইন হিস্টরিক্যাল আউটলাইন, লাহাের, ১৯৯১, পৃ.১৮০।
- ১০৬. শৈলেন্দ্রনাথ সেন, অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়ান হিস্টরি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন, নিউ এজ ইন্টারন্যাশনাল, নিউদিল্লি, ১৯৯৯, পৃ. ২৬১।
- ১০৭. দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৮।
- ১০৮. অমলানন্দ ঘােষ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩।
- ১০৯. এস এন সদাশিবন, এ সােস্যাল হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, এ পি এইচ পাবলিশিং, নিউদিল্লি, ২০০০, পৃ. ২০৯।
- ১১০. বুদ্ধ প্রকাশ, অ্যাস্পেক্টস অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন, শিবলাল আগরওয়াল, আগ্রা, ১৯৬৫।
- ১১১. এইচ ধিরাজ সাংকালিয়া, ইউনিভার্সিটি অফ নালন্দা, বি জি পাল অ্যান্ড কোম্পানি, মাদ্রাজ, ১৯৩৪।
- ১১২. এইচ ধিরাজ সাংকালিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১২।
- ১১৩. এইচ ধিরাজ সাংকালিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৪।
- ১১৪. এইচ ধিরাজ সাংকালিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৮।
- ১১৫, লুসিয়েন পােলা, বুকস অন ফায়ার দ্য ডেস্ট্রাকশন অফ লাইব্রেরিজ থুআউট হিস্টরি, ইনার ট্রাডিশন্স পাবলিকেশন, রােচেস্টার, ইউনাইটেড স্টেটস্, ২০০৭।
- ১১৬. এ এল ব্যাসাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬২ ও পৃ. ২২৫, ৩৬০।
- ১১৭. এইচ ধিরাজ সাংকালিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৪।
- ১১৮. ব্যাকগ্রাউণ্ড অফ দ্য হিস্টরি অফ মুসলিম লাইব্রেরিজ, আমেরিকান জার্নাল অফ সেমিটিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ১৯৩৫, পৃ. ১১৯।
- ১১৯. আল বাগদাদী, আল ইফাদা ওয়াল ইতিবার, সম্পাদনা ও ল্যাটিন অনুবাদ, জে হােয়াইট, অক্সফোর্ড, ১৮০০, পৃ. ১১৪।
- ১২০. পি কে হিট্টি, হিস্টরি অফ দ্য আরবস, বাংলা অনুবাদ, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ১৮৪।
- ১২১. পি কে হিট্টি, দ্য আরবস এ শর্ট হিস্টরি, বাংলা অনুবাদ, অবসর, ঢাকা, ২০১৩, পৃ. ৩৬।
- ১২২. বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, নবপত্র প্রকাশন, ২০০১, কলকাতা, পৃ. ৬৬।
- ১২৩. এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, খণ্ড-২১, বিপুলশ্রী মিত্রের নালন্দা তাম্রশাসন, পৃ. ৯৭। আরও দেখুন- শামসুন নাহার, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের আলােকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ধারাবাহিক ইতিহাস, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ১৮৯।
- ১২৪. এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, প্রাগুক্ত, দ্বিতীয় পংক্তি দ্রষ্টব্য।
- ১২৫. নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০৬ ও পৃ. ৪১৯, ৩০২।
- ১২৬. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রচনা সংগ্রহ, খণ্ড-৩, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮১।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।