মুসলমানদের সাংস্কৃতিক নষ্টামির উদাহরণ দিতে গিয়ে দেশ-বিদেশের বহু বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিত ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা মহামান্য হজরত ওমরের (৬৩৪-৪৪) উপর তৎকালীন মিশরের রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়া -র গ্রন্থাগার ধ্বংসের (৬৪২ সাল) অভিযােগ উত্থাপন করেন। এমনকি ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ ভ্যালেন্টাইনের শিক্ষানীতির আলােচনা প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতেও এই ধ্বংসের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। রটনাটি হচ্ছে : হযরত ওমরের নির্দেশ বলে আলেকজান্দ্রিয়ার অতি সুপ্রাচীন ও সুবিখ্যাত বিশাল গ্রন্থাগারটিকে একেবারেই পুড়িয়ে ফেলা হয়। হযরত ওমর নাকি তার সেনাপতি আমর ইবনুল আসকে জিজ্ঞাসা করেন— “ওই গ্রন্থাগারে যা আছে, তা কি পবিত্র কোরআনে আছে?” সেনাপতি উত্তর দেন— “তা নেই।” তখন হজরত ওমর বলেন— “তাহলে ওই পুস্তকগুলাে পবিত্র কোরআনের বিরুদ্ধবাদী, সুতরাং ওগুলােকে পুড়িয়ে ফেল।” তখন অন্য একজন সেনাপতি বললেন— “মহামান্য খলিফা, ওই সমস্ত পুস্তকে যা আছে, তা কোরআনেও আছে।” তখন খলিফা বলেন— “যা কোরআনে আছে, তাই-ই যদি ওই পুস্তকগুলােতে থাকে, তাহলে ওই পুস্তকগুলাে অনাবশ্যক, ওদের কোনাে প্রয়ােজন নেই, ওগুলােকে সত্বর পুড়িয়ে ফেল।” খলিফা হজরত ওমরের নির্দেশ মেনে তার সেনাপতি আমর (বিদ্যাসাগর যাঁকে অমরু বলে উল্লেখ করেছেন) নাকি ৬ মাস ধরে আলেকজান্দ্রিয়ার অসংখ্য স্নানাগারের অগ্নিকুন্ডে গ্রন্থাগারের মূল্যবান বই সব ফেলে ধ্বংস করেছিলেন।
ইতিহাসের বিচারে এই কাহিনী সঠিক নয়। আরবীয়রা অমুসলমানদের গ্রন্থাদি নষ্ট বা ধ্বংস করা পছন্দ করতেন না। তাদের ধর্মীয় নীতি এটা সমর্থন করে না। জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে ইসলামের তাগিদ খুবই স্পষ্ট ও তাৎপর্যপূর্ণ। ইসলামের প্রথম বাণীই হল, “পড়।” পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “(হে নবী) আপনি পড়ুন, আপনার সেই পালনকর্তার নামে…যিনি তােমাকে কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।” কোরআনে বলা হয়েছে, “তিনি নিরক্ষরদের মধ্যে তাদের একজনকে রাসুল বা প্রেরিতপুরুষ রূপে পাঠালেন, যিনি তাদের নিকট তার বাক্যসমূহ আবৃত্তি করেন এবং কেতাব ও জ্ঞানশিক্ষা দেন।” কোরআনে বলা হয়েছে, “হে নবী, আপনি লােকদেরকে বলুন, যারা জ্ঞান রাখে বা শিক্ষিত আর যারা জ্ঞান রাখে না বা অশিক্ষিত এই উভয় ধরনের লােক কি কখনও মর্যাদায় সমান হতে পারে ?”
ইসলামের নবী হজরত মােহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, “আমি শিক্ষক হিসেবেই প্রেরিত হয়েছি।” তিনি প্রত্যেক মানুষের জন্য জ্ঞানার্জন বাধ্যতামূলক ঘােষণা করে আজ থেকে ১৪৫০ বছর আগে ইসলামে শিক্ষার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হজরত মােহাম্মাদ (সঃ) বলেছেন, বিদ্যা মুসলমানদের হারান সম্পদ; দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিদ্যা অর্জনের সময়; শিক্ষা অর্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যাও; জ্ঞানীর ঘুম মূখের ইবাদত বা উপাসনা থেকে শ্রেয়; যে জ্ঞানার্জন করে তার মৃত্যু নাই; রাত্রে কিছু সময় জ্ঞান আলোচনা করা সারারাত জেগে উপাসনা করার চেয়েও উত্তম ইত্যাদি। হজরত মােহাম্মদের কথার ফলাফল তাঁর জীবদ্দশাতেই শুরু হয়ে যায়। পরবর্তীতে ইরাকের বাগদাদ, মিশরের কায়রাে, ইতালির স্যালার্নো ও স্পেনের কর্ডোভায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। জ্ঞানচর্চার এহেন পৃষ্ঠপােষক নবীর একজন একনিষ্ঠ অনুসারী এবং সঙ্গী, ঐতিহাসিকগণ যাঁর শিক্ষাপ্রাণতা, সুবিচার এবং জীবনযাত্রার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, সেই দ্বিতীয় খলিফা ওমর কি করে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার জ্বালিয়ে দেওয়ার কথা বলতে পারেন? উপরন্তু ইতিহাস ত বলে আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের পর মুসলমানরা সে দিনের জ্ঞান সংরক্ষিত করেছিলেন, নিজেদের জ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিলেন। এমনও জানা যায় যে, গ্রীসের প্রাচীন জ্ঞান-ভাণ্ডার মুসলমানরাই অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। (সমরেন্দ্রনাথ সেন, বিজ্ঞানের ইতিহাস, খণ্ড-২, শৈব্যা প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৯৪, পৃ. ১১৬)। মুসলিমরাই প্লেটো এরিস্টটলকে ইউরােপে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
স্বামী বিবেকানন্দ আধুনিক ইউরােপের নবজাগরণের পশ্চাতে ইসলামীয় সংস্কৃতির উদার জ্ঞানচর্চার অবদানের কথা বহুস্থানে আলােচনা করেছেন। মধ্যযুগের ধর্মান্ধ খ্রীস্টান-সম্প্রদায়ের বিজ্ঞান-বিরােধিতার সঙ্গে ইসলামের মুক্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার তুলনা করে দেখিয়েছেন, ইসলামে বিজ্ঞানানুরাগ প্রবল ছিল। তিনি যথেষ্ট আত্ম-বিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন:
“আজ যে মনুষ্যের বিদ্যা এবং বিজ্ঞানে প্রবেশ আছে, তার কি অকপট ক্রিশ্চান হওয়া সম্ভব? নিউ টেস্টামেন্ট-এ প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে কোনও বিজ্ঞান বা শিল্পের প্রশংসা নেই। কিন্তু এমন বিজ্ঞান বা শিল্প নেই যা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে কোরান বা হাদিসের বহু বাক্যের দ্বারা অনুমােদিত এবং উৎসাহিত নয়।”
হজরত মোহাম্মদের মহাপ্রয়াণের (৬৩২) ১১৮ বছর পর ইউরােপ, এশিয়া ও আফ্রিকা তথা স্পেন হতে শুরু করে একেবারে ভারতের সিন্ধুনদ পর্যন্ত ইসলামীয় সভ্যতা বিস্তারলাভ করে। এই আরব মুসলিমরা শুধু দেশ জয়ই করেননি, বরং সেখানে মুসলমান পন্ডিতদের বসিয়েছেন গবেষণা করতে এবং গ্রন্থাগার ভর্তি করেছেন নতুন ও পুরাতন পুঁথিপত্র-পুস্তকাদির সম্ভারে। পুস্তক সংগ্রহ সেসময়ে মুসলমানদের জাতীয় স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। বিদ্যানুসন্ধিৎসু দল হিসেবে তারা ছিলেন পৃথিবীর উন্নত মার্গে। বন্দরে বন্দরে লোক প্রস্তুত থাকত কোনও বিদেশী এলেই তার কাছে যে বইগুলাে আছে সেগুলাে নিয়ে অজানা তথ্যের বইগুলাে সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করে তার কপি তৈরি করে তার বই ফিরিয়ে দেওয়া হত আর তাঁদের ইচ্ছা থাকলে তা কিনে নেওয়া হত। বিদ্যাশিক্ষার এহেন ধারক ও বাহক আরবীয়রা আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার, পােড়াতে যাবেন, এটা ভাবতে অবাক লাগে। যাইহােক, পাঠকদের অবগতির জন্য ওই কাল্পনিক কাহিনির অবতারণা করা যেতে পারে। তবে তার পূর্বে গ্রন্থাগারটি সম্পর্কে কিছু আলােচনা দরকার।
মেসিডােনিয়ার অধিপতি মহাবীর আলেকজান্ডার (৩৫৬-৩২৩ খ্রীঃ পূঃ) আনুমানিক ৩৩১ খ্রীঃ পূর্বাব্দে আলেকজান্দ্রিয়া শহরের পত্তন করেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য তার সেনাপতিদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। মিশর পড়ে টলেমি সােটরের ভাগে। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ায় তার রাজধানী স্থাপন করেন। অচিরে শহরটি গ্রীক-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র রূপে পরিণত হয়। তিনি সেখানে স্থাপন করেন একটি মিউজিয়াম। মিউজিয়ামটি শীঘ্রই বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ পরিগ্রহ করে। টলেমি মিউজিয়ামের সঙ্গে একটি গ্রন্থাগারও স্থাপন করেছিলেন আনুমানিক ২৮৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। ওই গ্রন্থাগারটির পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল ডেমেট্রিয়াসের উপর, তাকে প্রথম গ্রন্থাগারিকও বলা যায়। তবে ইপিসসের জেনােডােটাসকে প্রথম গ্রন্থাগারিক বলা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। টলেমি সােটরের পুত্র টলেমি ফিলাডেলফাসের (২৮৫-২৪৭ খ্রীঃ পূঃ) উদার পৃষ্ঠপােষকতায় আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারটি প্রাচীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থাগারে পরিণত হয়েছিল। নানা জায়গা থেকে পুথিপত্র সংগৃহীত হয়েছিল। সেগুলি ব্যবহারের জন্য চারদিক থেকে আসতেন পণ্ডিতদের দল। উল্লেখ্য, গ্রন্থাগারটি ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। বড়টি ছিল শহরের অভিজাত এলাকা ব্রুশিয়ামে-রাজপ্রাসাদের মধ্যে। আর ছােটটি ছিল সেরাপিসের মন্দিরে সিরাপিয়ামে। (জর্জ সার্টন, ইনট্রোডাকশনটু দ্য হিস্টরি অফ সায়েন্স, ভলিউম-২, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, বাল্টিমাের, পৃ. ১৪২)। গ্রন্থাগারের সংগ্রহ সংখ্যা ছিল বিপুল। খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতকের শেষভাগে জনৈক গ্রীক বৈয়াকরণ ও কবি জেটমেসের মতে এই সংখ্যা ছিল ৫৩২৮০০। ক্যাটালগও তৈরি করা হয়েছিল। প্রধান প্রধান বইয়ের ক্যাটালগ লেখকের নামানুসারে সাজানাে হয়েছিল। এই তালিকা থেকে আলেকজান্দ্রিয়া শহরের কসমােপলিটান চরিত্র বােঝা যায়।
খৃষ্টপূর্ব ৪৮ অব্দে জুলিয়াস সিজার আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণ করে অগ্নিকান্ড ঘটালে মিউজিয়াম ও গ্রন্থাগারটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ঐতিহাসিক আর এস ম্যাকেনসেন বলেন, সিজারের অগ্নিকান্ডের পরও গ্রন্থাগারে কিছু সংগ্রহ থাকায় পণ্ডিত ব্যক্তিরা এখানে যাতায়াত করতেন। কিন্তু ২১৬ সালে রােমান সম্রাট কারাকাল (১৮৬-২১৭) এটি বন্ধ করে দেন। পরে ২৭৩ সালে রােম সম্রাট অরােলিয়াম (২২২২৭৫) গ্রন্থাগারটি পুরােপুরি ধ্বংস করে দেন। (আর এস ম্যাকেনসেন, ব্যাকগ্রাউণ্ড অফ দ্য হিস্টরি অফ মুসলিম লাইব্রেরিজ, আমেরিকান জার্নাল অফ সেমিটিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ১৯৩৫, পৃ. ১১৯)। পরে এখানে আবার ‘দুহিতা লাইব্রেরী’ নামে একটি গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। ৩৮৯ সালে রােম সম্রাট থিওডােসিয়াসের ইন্ধনে এই গ্রন্থাগারও ধ্বংস করে দেওয়া হয়। অন্য সূত্র হতে জানা যায়, আলেকজান্দ্রিয়ার আর্চবিশপ থিওফিলাস ৩৯১ সালে গ্রন্থাগারটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেন। (এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা, খণ্ড-১৭, পৃ.৩৫৪) এসব ঘটনার পর অনেক পর্যটককে এখানকার শূন্য তাক দেখে হা-হুতাশ করতে দেখা যায়। বই-এর খালি তাক দেখে ঐতিহাসিক পলাশ ওরােসিয়াসের কান্না প্রমাণ করে যে, ৪১৬ সালেও আলেকজান্দ্রিয়াতে বড় আকারের কোনাে গ্রন্থাগার ছিল না।
২২৬ বছর পর আরবীয়রা যখন ৬৪২-এ আলেকজান্দ্রিয়া দখল করেন সেখানে তখনও কোনও গ্রন্থাগার ছিলই না। সমকালীন কোনও লেখক কিন্তু আমর কিংবা হজরত ওমরের বিরুদ্ধে গ্রন্থাগার ধ্বংসের অভিযােগ তােলেননি। আরবদের দ্বারা মিশর জয়ের অব্যবহিত পূর্বের ও পরের শতকের কোনাে রচনায় এই গ্রন্থাগারের উল্লেখ পাওয়া যায় না। আর তা থেকে অনুমান করা চলে যে, গ্রন্থাগারটি আরব বিজয়ের পূর্বেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া পুস্তক বিশেষজ্ঞ জন মােবাস ও তার বন্ধু সােফ্রোনিয়াস ৬৪২ সালে আরবদের মিশর জয়ের কয়েক বছর পূর্বে এ দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তারা তাদের লেখায় সমকালে বিদ্যমান স্বল্পখ্যাত গ্রন্থাগারগুলােরও বিবরণ দিয়ে গেছেন। এ ক্ষেত্রে আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব থেকে থাকলে তারা তার কথাও নিশ্চয়ই উল্লেখ করতেন কিন্তু তারা তা করেননি।
এ. জে. বাটলার তাঁর ‘আরব কঙ্কোয়েস্ট অফ ইজিপ্ট’ নামক গ্রন্থে বলেন, কাহিনীটির বিশ্বস্ততার প্রধান যুক্তি হল এর চমৎকারিত্বে এবং খলিফা ওমরের উত্তরের প্রাচ্য আমেজে। (ম্যাকেনসেন, প্রাগুক্ত, পৃ.১১৭)। পারস্যদেশ জয়ের পর সেখানে যেসব বই পাওয়া গিয়েছিল, তাদের বিহিত করার উদ্দেশ্যে খলিফার আদেশ চাওয়া হলেও হযরত ওমর অনুরূপ উত্তর দিয়েছিলেন বলে ইবন খলদুন (১৩৩২-১৪০৬ খৃঃ) উল্লেখ করেছেন। এই বিবরণ অনুযায়ী, পারস্যদেশ জয়ের পর সেখানকার প্রচুর বই সেনাপতি সা’দ ইবন আবি ওয়াককাসের হস্তগত হয় বইগুলাের বিধি-ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি খলিফার পরামর্শ প্রার্থনা করেন। হজরত ওমর সেই পরিচিত উত্তর পাঠালেন। উত্তরের সঙ্গে যুক্ত করলেন, বইগুলাে জলে ফেলে দিও, অথবা আগুনে পুড়িয়ে ফেল। (ম্যাকেনসেন, প্রাগুক্ত, পৃ.১১৭) বলা বাহুল্য এ ঘটনার সঙ্গে পারস্যদেশের কোনও বিশেষ গ্রন্থাগারের নামােল্লেখ দেখা যায় না। অতএব বিষয়টির ওপর কতটা গুরুত্ব দেওয়া চলে, তা সহজেই অনুমেয়।
কিন্তু কিছু আরবি গ্রন্থে উল্লিখিত আছে বলে কিছু পাশ্চাত্য গবেষক ও পাঠক এ কাহিনিটিকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে চান। বিশপ জন অফ নিকিউ সপ্তম সতক শেষ হওয়ার পূর্বেই আরবদের আলেকজান্দ্রিয়া অবরােধের বিস্তারিত বিবরণ লিখে গেছেন। কিন্তু সেখানে এ কাহিনির কোনাে উল্লেখ নেই। বরং জন অফ নিকিউ লিখেছেন যে, আমর চার্চের কোনাে ক্ষতি করেননি, চার্চের সম্পদ লুণ্ঠনও করেননি। তিনি তাঁর সমগ্র শাসনকালে সেগুলাে সযত্নে রক্ষা করেছেন। (স্ট্যানলি লেনপুল, এ হিস্টরি অফ ইজিপ্ট ইন দ্য মিডল এজেস, মিথুয়েন, ১৯১৪, পৃ.১২)। আরবি সাহিত্যে আলােচ্য ঘটনাটির প্রথম সংক্ষিপ্ত উল্লেখ দেখা যায় দ্বাদশ শতকের শেষভাগে। ঘটনাটির প্রায় ৬০০ বছর পরে আবদুল লতিফ আল বাগদাদীই (১১৬২-১২৩১) সম্ভবত আজগুবি কাহিনি রটান। তিনি মিশরে গিয়েছিলেন ১১৯৩ সালে। তারপর ওই দেশের বিবরণ (আল ইফাদা ওয়াল ইতিবার) লিখেছিলেন ১২০২ সালের দিকে এবং তা প্রকাশিত হয়েছিল ১২০৪ সালে। সেই বিবরণীতে তিনি প্রসঙ্গত উল্লেখ করেছিলেন, আমার মনে হয় এই সেই দালান কোঠা যেখানে অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রীষ্টপূর্ব) ও তার অনুসারীরা অধ্যাপনা করতেন আর এই সেই একাডেমি যা আলেকজান্ডার নগর নির্মাণকালে স্থাপন করেছিলেন এবং যার মধ্যে অবস্থিত ছিল সেই গ্রন্থাগার যা আমর খলিফা ওমরের অনুমতিক্রমে ভস্মীভূত করেছিলেন। (আবদুল লতিফ আল বাগদাদি, আল ইফাদা ওয়াল ইতিবার, সম্পাদনা ও প্রকাশনা- জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন, ১৯৬৪, পৃ. ১৩৩)। অবশ্য কেন তিনি এমন প্রচার করেন তা জানা যায়নি। তবে তাঁর বক্তব্য পরবর্তীকালে লেখকরা যে অতিরঞ্জিত করেছেন তাতে কোননা সন্দেহ নেই। (পি কে হিট্টি, হিস্টরি অফ দ্য আরবস, বাংলা অনুবাদ, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ১৮৪)।
কাহিনীর প্রথম বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন মিশরীয় ঐতিহাসিক ইবনুল কিফতি (মৃত্যু ১২৪৮) তাঁর ‘তারিখুল জকামা’ গ্রন্থে। তার মৃত্যুর পর গ্রন্থটির সংক্ষিপ্তসার প্রস্তুত করেন আল জৌযানি। ১২৪৮ সালে মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে সিরিয়ার খৃষ্টান পণ্ডিত আবুল ফারাজ তার ‘সিরীয় ইতিতাস’-এর প্রথম ভাগের এক সংক্ষিপ্তসার প্রস্তুত করেন। এই ইতিহাসের সঙ্গে তিনি সংযুক্ত করেন বাইবেলের ইতিহাস ও বিজ্ঞান বিষয়ক আরবি সাহিত্যের বিবরণ। শেষােক্ত বিষয়টির তথ্য তিনি প্রধানত সংগ্রহ করেন ইবনুল কিফতির গ্রন্থ থেকে এবং সেখান থেকেই তিনি হুবহু নকল করেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের ভাগ্যবিড়ম্বনার তথ্যটি। (জর্জ সার্টন, ইনট্রোডাকশন টু দ্য হিস্টরি অফ সায়েন্স, ভলিয়ম-২, বাল্টিমোের, ১৯৩০, প, ৯৭৬)। এ বিষয়ে ম্যাকেনসেন গুরুত্বপূর্ণ আলােচনা করেছেন তার পূর্বোক্ত গ্রন্থে (ম্যাকেনসেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৬২২)। তিনি নানা যক্তির অবতারণা করে দেখিয়েছেন যে, এই কাহিনিটি আদৌ কোনাে ভিত্তি নেই। তার মতে, আমরকে যদি গ্রন্থাগারের বইগুলাে নষ্ট করে দেওয়া হুকুমই দেওয়া হয়ে থাকে, তবে সে জন্যে তিনি শহরের বিভিন্ন স্নানাগারে দীর্ঘ ছ’মাস ধরে অনেকসময় ও শ্রম দিয়ে সেগুলাে জ্বালিয়ে নষ্ট করবেন, এমন কাণ্ড অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। গ্রন্থ অনুরাগীর পক্ষে এই বিলম্বের সুযােগে মূল্যবান বইগুলাে সরিয়ে ফেলাও বিচিত্র ছিল না। জন ফিললাপনাস সম্পর্কেও একটা মারাত্মক অসংগতি লক্ষ্য করা যায়। তিনি সম্রাট জাস্টিনিয়ানের সময়কার লােক ছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। বলা বাহুল্য ৫২৭ খ্রীষ্টাব্দে জাস্টিনিয়ান সিংহাসনে বসেন। সুতরাং ৬৪২ সালে আমরের আলেকজান্দ্রিয়া বিজয়ের সময় পর্যন্ত ফিলােপনাস জীবিত ছিলেন, এমনটা আশা করা যায় না।
আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার ধ্বংসের সংগে জড়িত বিখ্যাত কাহিনীটির দায়িত্ব থেকে কিছু কিছু লেখক আবুল ফারাজকে অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা বলেন যে, এ-কাহিনি আবুল ফারাজের মূল সিরীয় ইতিহাসে নেই এবং সেই জন্য তাদের বক্তব্য যে, পরবর্তীকালে আরবি ইতিহাসে ওই কাহিনি সংযােজিত হয়েছে। কিন্তু ম্যাকেনসেন বলেন যে, আবুল ফারাজ স্বয়ং তাঁর গ্রন্থে আরবি সংক্ষিপ্তসার ও সংযােজনের জন্য দায়ী। বৈরুত সংস্করণে এ কাহিনী পাওয়া না যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি তুর্কি সেন্সরের বরাত দিয়েছেন। এই অধ্যায় এবং আরও কতিপয় অধ্যায় এই সংস্করণে পাওয়া না গেলেও সেগুলি প্রফশীটে বিদ্যমান ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। (ম্যাকেনসেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২০) শুধু আবুল ফারাজই নয়, ইবনুল কিফতি ও আবদুল লতিফের বিবরণ থেকেও জানা যায় যে, আরবি সাহিত্যে কাহিনিটি চালু ছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এর উৎপত্তির সম্বন্ধে কেউই কিছু বলতে পারেননি। যাইহােক, খৃস্টান ও মুসলিম ঐতিহাসিকদের রচনায় উল্লেখ থাকলেও ম্যাকেনসেন বলেন যে, এ কাহিনি কিন্তু সর্বৈব ভিত্তিহীন। গিবন বলেন, ঘটনার কথাই বল আর তার ফলাফলের কথাই বল, এর একটিও আমার বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না। তিনি আরও বলছেন, আরবরা বিধর্মীদের গ্রন্থাদি নষ্ট করা পছন্দ করত না। তাদের ধর্মীয় নীতি এটা অনুমােন করে না। (এডওয়ার্ড গিবন, দ্য ডেকলিন অ্যান্ড ফল অফ দ্য রােমান এম্পায়ার, মডার্ণ লাইব্রেরী, পৃ.১৭৭)। সাৰ্টনের মতে, এ কাহিনির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর ধ্বংস করার মত উল্লেখযােগ্য লাইব্রেরী তেমন ছিলও না। (জর্জ সার্টন, প্রাগুক্ত, পৃ.১৫৭)। পি কে হিট্টি মনে করেন, আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী ধ্বংসের গল্পটি কাহিনি হিসেবে চমৎকার, তবে এর ঐতিহাসিক মূল্য কিছুই নাই। (হিট্টি, দ্য আরবস: এ শর্ট হিস্টরি, বাংলা অনুবাদ, অবসর, ঢাকা, ২০১৩, পৃ. ৩৬)। উইলিয়াম মূরও তঁার ‘দ্য খালিফেট’ গ্রন্থে (এডিনবার্গ, ১৯২৪) এই কাহিনীকে কাল্পনিক বলে অভিহিত করেছেন। মুসলমানগণ কর্তৃক আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার পােড়ানাে যে ভ্রান্ত এবং খ্রিস্টানরাই যে এই কাজ করেছিল, বিশ্ব ইতিহাসের দ্রষ্টা হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দ অবহিত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন:
“এই মিশরেই সে আলেকজান্দ্রিয়া নগর, সেখানকার বিদ্যালয়, পুস্তকাগার, বিদ্বজ্জন জগৎ প্রসিদ্ধ হয়েছিল। সে আলেকজান্দ্রিয়া মূখ গোঁড়া-ইতর ক্রিশ্চানদের হাতে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেল, পুস্তকালয় ভস্মরাশি হল, বিদ্যার সর্বনাশ হল।” (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৬, পৃ. ৯৭)।
আইজ্যাক আসিমভ মনে করেন, এটা নেহায়েত গল্প, সত্য নয়। কয়েক শতাব্দী ধরে মিশরের খ্রিস্টান শাসকদের পৌত্তলিক বিরােধী শক্ত অবস্থানের ফলে ধ্বংস করার মত খুব কম গ্রন্থই টিকেছিল। (আইজাক আসিমভ, মিশরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ঢাকা, পৃ. ১২৫)। অতএব হযরত ওমরের নির্দেশে আমরের আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী ধ্বংস করার কোন প্রশ্নই উঠে না।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।