মোহেন্-জো-দড়ো—হরপ্পার তথাকথিত সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে ভারতের মানুষের গর্ববোধের শেষ নেই। ঐ সভ্যতার ‘আবিষ্কার’-এর সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সভ্যতার বয়স এক ধাক্কায় দেড় হাজার বছর বেড়ে গেল। সাহেব-পণ্ডিতদের স্বকপোলকল্পিত সালতামামি চাপানোর ঠেলায় তথাকথিত বৈদিক যুগটাকে খ্রীস্টপূর্ব দেড় হাজার অব্দে স্থাপন করে আমরা আনন্দ পেয়েছিলাম আগেই। মোহেন্-জো-দড়ো—হরপ্পার কল্যাণে ওঁদেরই আরোপ করা আর একপ্রস্থ সালতারিখ চাপানোর খেলায় আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম৷ মেসোপটেমিয়া বা ক্রীট-এর চেয়ে নতুন নয়—এই ‘সত্য’ উদ্ঘাটিত হওয়ায় ঐতিহ্যসচেতন ভারতীয়রা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন। সত্যিই ত’ এটা কি কম কথা!
তথাকথিত সিন্ধু সভ্যতার মূল স্থাপত্য নিদর্শনের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে প্রশ্নটা আপাততঃ মুলতুবী রাখছি। প্রশস্ত রাজপথ, পরিকল্পিত পয়ঃপ্রণালী, স্নানাগার বা পণ্যাগার প্রসঙ্গে কোনও বক্তব্য রাখছি না। বক্তব্যটা সীমাবদ্ধ রাখছি ঐ সভ্যতার প্রত্ন উপকরণ সম্পর্কেই। ঐসব উপকরণের মধ্যে কিছু কারসাজি করা হয়েছিল কিনা – প্রতারণা তঞ্চকতা কিছু করা হয়েছিল কিনা—এইটুকুই আলোচনা করব। প্রত্ন উপকরণ যা কিছু পাওয়া গেছে তা ঐ আর্কিয়লজিক্যাল সার্ভের সৌজন্যেই। সার্ভের লোকজনেরা যে কেউ ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন না তা জানা গেছে ওঁদের ব্রাহ্মী-খরোষ্ঠী লিপি-ঘটিত জালিয়াতির উদ্যোগটা বিশ্লেষণ করার মধ্য দিয়ে। সে বিশ্লেষণ আগের অধ্যায়ে রেখেছি। এখন দেখা যাক মোহেন্-জো-দড়ো হরপ্পায় ওদের ভূমিকাটা কি ছিল।
সে ভূমিকার কথা বলার আগে ঐ তথাকথিত প্রত্নউপকরণের স্বরূপলক্ষণ নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।
সিন্ধু সভ্যতার প্রত্ন উপকরণের মধ্যে প্রচণ্ড বক্তব্য ছিল বলে পণ্ডিতেরা অনুমান করে নিয়েছেন। উপকরণের বৈচিত্র্য ‘বিশ্লেষণ’ করে নানান তথ্য তৈরী করে নিতে পণ্ডিতদের কোনও অসুবিধাই হয়নি। ঐ সুসভ্য সমাজের ধর্মীয় চিন্তা, সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা, অর্থ নৈতিক স্বয়ংসম্পুর্ণতার অনেক কিছুই পণ্ডিতেরা ‘আবিষ্কার’ করে নিয়েছেন। কল্পিত সভ্যতার যে বিবরণ তৈরী করে নেওয়া হয়েছে তার আকুতি খুব একটা ছোট নয়। প্রত্ন-উপকরণগুলোর মধ্যে প্রতীক-ধর্মী কাণ্ডকারখানা বড্ড বেশী। আর ঐসব প্রতীকের মধ্যে কেউ রামায়ণের গল্প ‘আবিষ্কার’ করেছেন—কেউবা আদি শিবের কল্পনা করে আনন্দ পেয়েছেন। পণ্ডিতেরা কে কি তত্ত্ব তৈরী করেছেন—কে কি তথ্য বানিয়েছেন সে-প্রশ্নে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন নেই। কারণ সে-সব কিছুর ওপর কিছুমাত্র গুরুত্ব দেওয়ার দরকার বোধ করছি না।
সিন্ধু সভ্যতার প্রত্ন উপকরণের মধ্যে দুর্বোধ্য লিপিযুক্ত সীলমোহর, মূর্তিগত সাক্ষ্য প্রমাণ, রোজকার জীবনে কাজে লাগে এমন কিছু টুকিটাকি জিনিষপত্র—কিছু অস্ত্রশস্ত্র বা ধাতব পদার্থ যা কিছু পাওয়া গেছে তার মধ্যেই আলোচনাটা সীমাবদ্ধ রাখব। সীলমোহর দিয়েই শুরু করা যাক্ সীলমোহর কিছু পোড়ামাটির, কিছু নরম পাথরের তৈরী। তামা এবং ব্রোঞ্জের তৈরী সীলমোহরও কিছু পাওয়া গেছে। এতে নানারকম প্রতীকগুলোর বক্তব্য সম্পর্কে নানান পণ্ডিত নানান মত পোষণ করেছেন—বক্তব্যও রেখেছেন। মোট কথা প্রতীকগুলো ছিল সীলমোহরের ব্যক্ত অংশ। এছাড়া ঐ সীলমোহরে আপাতদৃষ্টিতে লিপি বলে মনে হয় এমন কিছু চিহ্নও ছিল। চিহ্ন- গুলোকে সীলমোহরের অব্যক্ত অংশ বলেই ধরে নিতে হয়। কারণ ঐ-সব লিপির পাঠোদ্ধার এখনও পর্যন্ত হয়নি। ব্যক্ত-অব্যক্ত চিহ্নযুক্ত ঐসব সীলমোহরের প্রতীকী কাণ্ডকারখানা সম্পর্কে কিছু লেখার আগে তথাকথিত ঐ লিপিমালা সম্পর্কেই আলোচনাটা সেরে নেওয়া যাক৷
সিন্ধু লিপির ‘রহস্য’- সিন্ধু
ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি-মার্কা চিহ্ন দিয়ে শুরু করা এবং সুন্দর সুন্দর নক্সা দিয়ে শেষ করা মোহেন্-জো-দড়োর তথাকথিত লিপিমালা সত্যই অপূৰ্ব৷ তবে অপূর্ব বিস্ময় নয়—ওটা অপূর্ব রসিকতা। ঐ ‘লিপিমালা’ দুনিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক পণ্ডিতদের কাছে সপ্তমাশ্চর্যের একটি। ঐ লিপির মধ্যে নাকি প্রচণ্ড রহস্য লুকিয়ে আছে আর সে-রহস্যের কুলকিনারা করতে গিয়ে পণ্ডিতেরা নাকি হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন। সত্যিই কি ঐ লিপিমালায় রহস্য বলে কিছু আছে? আমি ত কিছুই দেখছিনা। কারণ আসলে ওটা কোনও লিপিই নয়—ওটা বিশুদ্ধ একটি জালিয়াতি। এবং জালিয়াতির মধ্যে জোচ্চুরি থাকে—রহস্য থাকে না। ‘লিপি’র প্রসঙ্গে আসা যাক। ‘লিপিমালা’য় চারশ সতেরোটা চিহ্ন আছে। বিভিন্ন আকৃতির— বিভিন্ন প্রকৃতির। বিভিন্ন প্রকৃতির বলার কারণ এই যে ঐ ‘লিপিমালা’য় কিছু চিত্রলিপি আছে, কিছু অ্যালফাবেট আছে—আছে কিছু সিলেবারিও। তিনরকম প্রকৃতির লিপি একই লিপিমালায় থাকার কথা নয় তবু আছে। থাকাটা সন্দেহজনক কিনা সে প্রশ্নে পরে আসছি। এছাড়া কিছু সংযুক্তবর্ণের অস্তিত্বের খবরও কোনও কোনও পণ্ডিত দিয়েছেন। ঐ ‘লিপিমালা’য় পঁচাশিটা চিত্রলিপি রয়েছে—যেগুলোর চিত্রধর্মিতা প্রশ্নাতীত। মাত্র পঁচাশিটা চিহ্ন সম্বল করে চিত্রলিপি বানানোর প্রয়াস কেউ নেননা। ঐ লিপির প্রাচীন কারিগরেরা নিয়েছিলেন এই তথ্যটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ ঐ ধরণের লিপি বানানোর ইচ্ছাটা আন্তরিক হলে ঐ কটা চিহ্ন নিয়ে কেউ এগোননা৷ দরকার পড়ে অনেক বেশী চিহ্নের। সিদ্ধান্ত নিতেই হয় ঐসব চিহ্ন কোনও চিত্রলিপির নয়। বিভ্রান্তি আনার জন্যই যে ঐ কটা চিত্রলিপির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল এটা বুঝে নিতে কষ্ট হয়না। এর পরে আসছে কিছু অঙ্কচিহ্নের কথা। মোট আটত্রিশটা সংখ্যাবোধক চিহ্ন ঐ ‘লিপিমালা’য় আছে যেগুলো সংখ্যা বোঝাবার অত্যন্ত কাঁচা ব্যবস্থা ছাড়া কিছুই নয়। এখানে একটি প্রশ্ন আসছে। সংখ্যাবোধক চিহ্ন এত বেশী মাত্রায় রাখার দরকারটা পড়ল কেন। দরকার ছিল বৈকি। ‘মুসভ্য’ সব দেশে যে প্রাচীনকালেই বিরাট বিশাল সংখ্যা-ভাবনার জন্ম হয়ে গিয়েছিল—এই প্রচণ্ড মিথ্যাটা প্রচার করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন দুনিয়ার প্রাচীন ইতিহাস তৈরীর নেপথ্য – শিল্পীরা। আর সে-দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলেই দেশে দেশে বিরাট- বিশাল সংখ্যাজ্ঞাপক অঙ্কচিহ্ন ওঁরা বানিয়ে রেখেছিলেন। বানিয়ে রেখেছিলেন ঐ মিথ্যার লিখিত ‘প্রমাণ’ খাড়া করার উদ্দেশ্যেই। উত্তরকালের পণ্ডিতেরা (এঁদের বেশীর ভাগই মিথ্যার কারবারীদেরই সাকরেদ) ঐসব চিহ্নের ওপর হাজার, অযুত, লক্ষ, নিযুত ইত্যাদি সংখ্যা আরোপ করার খেলা খেলেছেন। বিরাট বিশাল সব সংখ্যা ‘আবিষ্কার’ করে নিতে ওঁদের কোনও অসুবিধাই হয়নি৷ মজার কথা ওঁরা অনেক সংখ্যাই ‘আবিষ্কার’ করে নিয়েছেন। করেননি শুধু শূন্য চিহ্নটার আবিষ্কার। করেননি কারণ তা করার সুযোগ ছিল না। মিথ্যার কারবারীদের তৈরী করে নেওয়া প্রাচীন কোনও লিপিতেই শূন্যের সংস্থান ছিল না। ছিল না মোহেন্-জো-দড়োর লিপিতেও। শূন্য-চিহ্নটা থাকলে যে ঐ আটত্রিশটা সংখ্যাচিহ্ন বানিয়ে রাখার দরকারই পড়ত না। আসল কথায় আসা যাক। শূন্যচিহ্নের ধারণা – সৃষ্টির আগে যে বিরাট বিশাল সংখ্যার ধারণা আসতেই পারে না—এই ছোট্ট তথ্যটির ওপর কোনও পণ্ডিতই গুরুত্ব দেননি। এবং দেননি বলেই সাহেবপণ্ডিতদের তৈরী করে নেওয়া আজগুবি গল্পটাকে সবাই বিশ্বাস করে বসেছেন। বিশ্বাস করেছেন বৈদিক যুগের মানুষেরা বিরাট বিরাট সব সংখ্যার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। বিশ্বাস করেছেন মোহেন্-জো-দড়ো—হরপ্পার মানুষগুলোও নাকি বড় বড় সংখ্যার ধারণা আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন।
এর পরে আসছে হরেক রকম ডিজাইনের সুন্দর সুন্দর রেখাচিত্রের কথা। চলতি বাংলায় নক্সাই বলতে হয় ঐ রেখাচিত্রগুলোকে। সুষম-বিষম দু-রকম নক্সাই আছে। ডবল লাইনের ঘেরাটোপ মার্কা নক্সারও অভাব নেই। আর নক্সা বলে নক্সা! এত নক্সাও মানুষে করতে পারে! আর ঐ নক্সার জঞ্জাল ঘেঁটে পণ্ডিতেরা বেশ কিছু স্বরচিহ্নযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণের সন্ধান পেয়েছেন৷ পেয়েছেন কিছু স্বরচিহ্নহীন অ্যালফাবেটেরও। পণ্ডিতদের বলিহারি! ঐ লিপির বেশীর ভাগই ডান দিক থেকে বাঁ দিকে লেখা বলে পণ্ডিতেরা অনুমান করে নিয়েছেন—এবং ‘প্রমাণ’ দেওয়ার চেষ্টাও করেছেন। কিছু আবার বাঁ দিক থেকে ডান দিকে লেখা—এও তাঁরা বুঝে ফেলেছেন। কিছু ওপর থেকে নীচে লেখা লিপিরও সন্ধান তাঁরা দিয়েছেন। আশ্বাসের কথা এই যে নীচ থেকে ওপরে পড়া যায় এমন লিপি পণ্ডিতেরা সনাক্ত করতে পারেননি। লিপির নানান রকম লিখনকৌশলের শতকরা ভাগ জানানোর চেষ্টাও পণ্ডিতেরা করেছেন। তবে পুরো এক শ’ ভাগের হিসাব তাঁরা দেননি। সম্ভবত নীচ থেকে উপরে ‘পড়া যায়’ এমন কিছু লিপির ইঙ্গিত দেওয়ার জন্যই ঐ ব্যবস্থা! পণ্ডিতেরা এমন লিপিও ‘আবিষ্কার’ করেছেন যা বাঁ দিক দিক থেকে বাঁ দিকেও পড়া যায়- ডান দিক থেকে বাম দিকেও। ‘পড়া আসে এইটাই বুঝতে হবে। অর্থাৎ রমা কান্ত কামার-এর মোহেন-জো-দড়ো সংস্করণ৷
লিপি নিয়ে এত ইয়ার্কি করার দরকারটা পড়ল কেন? আর লিপির নামে এত নক্সাই-বা করা হল কেন? পণ্ডিতেরা এ-সব প্রশ্ন কেউই তোলেননি। তোলার দরকার বোধ করেননি। একই লিপি একটি লাইনে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে আবার পরের লাইনে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে লেখা হবে আর পাঠক সেটা মেনে নেবে এ-তথ্যটাই আজগুবি৷ Picture কে erutciP লেখা হবে আর পাঠক অম্লান বদনে তা সহ্য করবে—এটা ভাবাই যায়না। ভারা যায় না তবু ঐ আজগুবি তথ্যের একটি সুন্দর নামকরণ করা হল ‘boustrophe- don’. সাহেব পণ্ডিতদের তৈরী করে নেওয়া ঐ শব্দের মহিমা আছে৷ শব্দ যখন রয়েছে তথ্যটিও নিশ্চয়ই সত্য। পণ্ডিতেরা তথ্যটিকে মেনে নিলেন। আসলে উল্টোপাল্টা তথ্য এবং তত্ত্ব বানাতে গিয়ে পণ্ডিত- ঠকানো বিচিত্র এবং উদ্ভট শব্দ কম তৈরী হয়নি। কোনটা ল্যাটিনমূলীয় (ভারতে তৈরী করা সংস্কৃতমূলীয়)। আর ঐসব বিচিত্রমূলীয় শব্দব্রহ্মের অবাঞ্ছিত তানু প্রবেশের ফলে অভিধানের কলেবর ভীতিপ্রদ অবস্থায় পৌঁছেছে সে যাই হোক, লিপির প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ‘চিত্রলিপি’, সংখ্যাবোধক অঙ্ক এবং নক্সার কথা আগেই বলা হয়েছে। এর পরে আসছে মোটামুটি অক্ষরের মত দেখতে এমন কিছু চিহ্নের প্রসঙ্গ। সেইসব চিহ্ন থেকে ব্রাহ্মী লিপির বেশ কয়েকটা অক্ষর সনাক্ত করে নিতে কোনও অম্বুবিধাই হয়না। ব্রাহ্মী লিপির গ ঘ ত ব প ধ র এবং থ অবিকৃতভাবেই রাখা হয়েছে ঐ লিপিতে। এছাড়া কিছু বিকৃতির মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মী লিপির ও ক চ জ ট ব অন্তঃস্থ ব ল ম য় ও ঠাঁই করে নিয়েছে ঐ লিপিতে। সবই আছে ঐ মোহেন্-জো-দড়োর লিপিমালায়। মার্শাল সাহেব নিজেই এইসব তথ্য এগিয়ে দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে বিচিত্র সংবাদ। আঠারো কিংবা উনিশ শতকে তৈরী করে নেওয়া ব্রাহ্মী লিপির খবর পাঁচ হাজার বছর আগেকার মোহেন্-জো-দড়োর সুসভ্য নাগরিকেরা পেলেন কি করে? তবে কি ঐ লিপিমালা উনিশ কিংবা বিশ শতকে উদ্ভাবন করা হয়েছিল? তাইত আসছে।
গোলমাল আরও আছে। রোমক লিপির A B C D H I U N X Y 8 অক্ষরগুলোও অবিকৃতভাবে আত্মীকৃত হয়েছে ঐ মোহেন্- জো দড়োর লিপিতে আছে ছোট হাতের p। আছে নানান কায়দার E। এটা কি করে সম্ভব হল? পাঁচ হাজার বছর আগে রোমক লিপির যে জন্মই হয়নি। আর একটা কথা। যে লিপির উদ্ভাবকেরা সুন্দর সুন্দর নক্সা আঁকার কসরৎ করলেন তাঁরা ঐ সহজ সরল অক্ষর গুলোই বা আঁকতে গেলেন। তথাকথিত ব্রাহ্মী লিপির সরল অক্ষরগুলো চুরি করতে গিয়ে ওগুলো জটিলতর করারইবা আয়োজন হল কেন? অর্বাচীন যুগের লিপিজ্ঞানহীন মানুষ সংখ্যা বোঝাতে যেসব চিহ্ন দিয়ে ‘ম্যানেজ’ করেন সেইসব চিহ্নের খবর সুপ্রাচীন যুগের মুসভ্য নাগরিকের। পেলেন কি করে? নাৎসী বাহিনীর অস্বস্তিকর স্বস্তিকা চিহ্নটাও দেখছি মোহেন্-জো-দড়োর লিপিতে—ভারতের নিজস্ব বলে প্রচারিত স্বস্তিকা চিহ্নটা ঐ লিপিতে নেই কেন?
তাসের দেশের হরতন, রুইতন, ইস্কাবন এ-সব চিহ্নও আছে ঐ মোহেন্-জো-দড়োর লিপিতে। আছে অবিকৃতভাবেই। আর আছে ঐসব চিহ্নকে মূল কাঠামো বানিয়ে বেশ কিছু জটিলতর চিহ্ন তৈরীর আয়োজন। মাটীচাপা প্রাগৈতিহাসিক মহীরাবণের সুসভ্য দেশ থেকে চিহ্নগুলো ইউরোপেই বা পাড়ি দিল কি করে? হল্যাণ্ড বা স্পেনের ‘সর্বকর্মধ্বংস তাসঅবতংশ’রা যে মহান ভারতের মূল্যবান তিনটি সুপ্রাচীন অক্ষর চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন এই উপাদেয় তথ্যটিকে কেউ সন্দেহ করেননি এইটাই আশ্চর্যের।
মোহেন-জো-দড়োর ‘লিপি’তে বেশ কিছু চিহ্ন আছে যার থেকে বোঝা যায় সুসভ্য মানুষগুলো জ্যামিতি বিদ্যাতেও ওস্তাদ ছিলেন। পরস্পরছেদী বৃত্তও ব্যবহার করা হয়েছিল সীলমোহরে। ছিল নানান জ্যামিতিক নক্সা।
‘বুস্ট ফেডন’-এর আজগুবি গল্প শুধু মোহেন-জো-দড়োর লিপি সম্পর্কেই বানানো হয়নি৷ বানানো হয়েছিল প্রাচীন গ্রীকলিপি সম্পর্কেও। প্রাচীন গ্রীকলিপি নাকি ঐ লিপির প্রবর্তনের পরে ডানদিক থেকে বাঁ দিকে লেখা হত। আবার বাঁ দিক থেকে ডানদিকে লেখার ব্যবস্থাও নাকি চালু ছিল সেই যুগে। ঐ আজগুবি অবস্থাটা কিছুকাল চলার পরে আর এক আজগুবি ঐ ‘বুস্ট ফেডন’ লিখনভঙ্গি নাকি চালু হয়েছিল ঐ গ্রীসে। এবং মোটামুটি ভাবে খ্রীস্টপূর্ব ৫০০ অব্দ থেকে শুধুই বাঁ দিক থেকে ডানদিকে লেখার ব্যবস্থা নাকি শুরু হয়েছিল। বুঝতে কষ্ট হয়না ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা লিপিসম্পর্কে নানারকম বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব দেওয়ার চেষ্টা শুধু ভারতেই করেননি। করেছিলেন খোদ ইউরোপেও৷
যাদুঘরে সিন্ধু সভ্যতার ‘প্রত্ন উপকরণে’র যাদু
সিন্ধু সভ্যতার প্রত্ন-উপকরণের বেশ কিছু নমুনা কলকাতার ইণ্ডিয়ান মিউজিয়ামে বেশ যত্ন করেই রাখা হয়েছে। রাখা হয়েছে বেশ সুদৃশ্য শোকেসে। সে-সব নমুনা দেখে বুঝে নিতে কষ্ট হয়না কি পরিমাণ কারসাজি ঐ ‘প্রত্ন-উপকরণ’গুলোর পিছনে করা হয়েছিল। পোড়ামাটির তৈরী বেশ কিছু উদ্ভট রূপকল্পনার জীবজন্তুর নিদর্শন ঐ মিউজিয়ামে আছে যার মধ্যে প্রাচীনত্বের ছিটেফোঁটা লক্ষণও নেই। মৃৎপাত্রের টুকরো-টাকরা নিদর্শন যা রয়েছে তা যে পাঁচ-হাজার বছরের পুরানো নয় তা ঐসব নিদর্শন এক ঝলক দেখেই বুঝে নেওয়া যায়। জৈব-অজৈব রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় দীর্ঘদিন মাটি চাপা মাটির কিংবা চীনামাটির তৈরী জিনিষের ন্যূনতম যে বিকৃতি আসার কথা তার কিছুমাত্র লক্ষণ ওগুলোতে নেই। ‘নির্বিকার’ গাম্ভীর্য নিয়ে ওগুলো প্রাচীন সেজে মূকাভিনয় করে আসছে দীর্ঘদিন। পাঁচ হাজার বছর পেরিয়ে আসা নিটোল অক্ষয় অস্তিত্বের অভিনয়টা কেউ বোঝেননি এইটাই আশ্চর্যের। বুঝতে কষ্ট হয়না আধুনিক কোনও সিরামিক কর্মশালা থেকে তৈরী হয়ে ওগুলো সোজা চলে এসেছে মিউজিয়ামে৷ প্রাচীনত্বের পরাকাষ্ঠার সার্টিফিকেট ঝোলানো ঐসব জিনিষ পুরাতাত্ত্বিক বিস্ময় নয়—পুরাতত্ত্বের নামে বানানো আধুনিক রসিকতা। প্রাচীন সাজা আধুনিক ব্যঙ্গ৷ পণ্ডিতেরা বোঝেননি এইটাই মর্মান্তিক। মার্শাল, রাখালদাস, হুইলার, ম্যাকেদের মিথ্যা সৃষ্টির কর্মকাণ্ডের স্মারক ঐসব ‘প্রত্ন নিদর্শন’। ওঁদের সুসংহত তৎপরতা এবং নানান জাতের নানান পণ্ডিতের গবেষণার ঠেলায় মিথ্যাটা বেঁচে আছে৷ বেঁচে আছে প্রামাণ্যতার ছদ্মবেশ চাপিয়ে৷ ইউনিকর্ন (একশৃঙ্গী) নামক উদ্ভট কল্পিত জন্তুর রিলিফ এবং তার ছাঁচও প্রদর্শিত হয়েছে ঐ শোকেসে। চীনা মাটির তৈরী সেই রিলিফ এবং ছাঁচটা এত উন্নতমানের যে বুঝতে কষ্ট হয়না ওসবই সিরামিক শিল্পের আধুনিক কারিগরদের বানিয়ে নেওয়া মাল। মৃৎপাত্র পরিচয় দেওয়া ভগ্নাংশগুলো এতই নিখুঁত—গুণগতমান তার এতই উঁচু যে বুঝতে কষ্ট হয়না ওগুলো সিরামিক শিল্পে প্রাগ্রসর আধুনিক ইউরোপের কোনও দেশের তৈরী অর্ডারী মাল। সার্ভের টিনের বাক্সয় চেপে ওগুলো প্রাগৈতিহাসিক বুড়ি আদৌ ছুঁয়েছিল কিনা সন্দেহ আছে। ওগুলো কিয়ৎকালও যে মাটিচাপা ছিল এটা মনে করে নিতেও কষ্ট হয়। কষ্ট হয় ওগুলোর অম্লান ঔজ্জ্বল্য দেখে। জাল-জালিয়াতি-জোচ্চুরির যে সীমা রাখা উচিত—বাড়াবাড়ি করতে গেলে যে ধরা পড়তে হয়- এইটাই কর্তৃপক্ষ বুঝেও বোঝেননি। তথাকথিত পণ্ডিতদের ঠকানো যতটা সহজ সবাইকে ঠকানো ঠিক ততটা সহজ নয়।
প্রাগৈতিহাসিক ধ্বংসাবশেষগুলো কি মাটিচাপা যাদুঘর?
প্রাগৈতিহাসিক ধ্বংসাবশেষগুলোতে স্থানীয় কল্পিত উদ্ভিদ-জগৎ বা প্রাণীজগতের বক্তব্য-সমৃদ্ধ প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা কেন করা হয়? এইসব দানাশস্য চাষ করার জ্ঞান তখনকার মানুষ আয়ত্ত করেছিলেন—ঐসব জীবজন্তুকে পোষ মানানোর (domesticate) কাজটা তখনকার মানুষ শিখে নিয়েছিলেন—এত সব বক্তব্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কেন করা হয়? মিনিভাস্কর্যের ক্যারিকেচারমার্কা মৃন্ময়বক্তব্যসমৃদ্ধ পুতুল কিংবা দানাশস্যের চিত্রকল্প রাখার আয়োজন কেন নেওয়া হয়? ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষে ঐ ধরণের বক্তব্যসমৃদ্ধ নিদর্শন থাকে না কেন? প্রাগৈতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ মাত্রেই কেন মাটিচাপা যাদুঘর? রাজ্যের তত্ত্বপ্রতিষ্ঠার দায় ঐ ধ্বংসাবশেষগুলোর ওপর চাপানো হয় কেন?
এসব প্রশ্নের কোনটারই উত্তর পণ্ডিতেরা দেননি। শ-দুয়েক বছরের পুরানো মাটিচাপা বাড়ী থেকে দু-চারটে বাস্তু সাপের সন্ধান পাওয়া যায় ঠিকই। তবে ঐ পর্যন্তই। আর কিছুই পাওয়া যায় না। না জীবন্ত, না মৃত৷ প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কোদাল-শাবল খুরপি চালালেই ছুঁ মস্তরে সব হাজির হয়ে যায় কেন? ওঁরা কি যাদুমন্তর জানেন? সুমসৃণ টর্সো কিংবা হর্ষবর্ধন জীবজন্তুর মূর্তিই বা বেরিয়ে আসে কেন? জীবনযাত্রার লিস্টিমাফিক উপকরণ সবই কেন পৌঁছে যায় ঐ ‘যাদুঘরে’? নিগ্রোবটু বৈশিষ্ট্য বা অষ্ট্রিক শারীরগঠনযুক্ত স্ট্যাচুর আবির্ভাবই বা ঘটে যায় কেন? পণ্ডিতদের প্রতারণা করার জন্য? নৃতাত্ত্বিক বিভ্রান্তি আনার জন্য? নানান ধাতব দ্রব্যইবা রাখা হয় কেন? ওগুলো কি কোনও বক্তব্য প্রচার করার জন্যই রাখা হয়? নানান ধাতুর সুপ্রাচীন প্রচলনের গল্পটাকে ‘তথ্য প্রমাণ’ দিয়ে প্রমাণসিদ্ধ বানাবার তাগিদেই কি ঐসব ধাতব দ্রব্য রাখার আয়োজন নেওয়া হয়? কোনও প্রশ্নেরই উত্তর পাচ্ছিনা। আর একটা কথা। দুনিয়ার প্রাগৈতিহাসিকস্মৃতিবিজড়িত বলে প্রচারিত প্রত্যেকটি জায়গায় বিভ্রান্তি সৃষ্টির উপযোগী কিংবা বক্তব্যসমৃদ্ধ নানান প্রত্ন-উপকরণ রাখার ব্যাপারে এত ঐক্যইবা দেখছি কেন? ইজিপ্টে, মেসোপটেমিয়ায়, হরপ্পা, মোহেন্-জো-দড়োতে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের নামে বিশেষ কয়েকজন ইউরোপীয় পণ্ডিতকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় কেন? কোনও প্রশ্নেরই উত্তর পাচ্ছি না। প্রত্যেক প্রাগৈতিহাসিক টিবিঢাবার ধারে কাছে কবরখানার সন্ধানই-বা পাওয়া যায় কেন? সিমেটারি এ বি সি ডি মার্কা কবরখানাগুলো কি প্রত্নউপকরণে সাজানোর জন্যই বানিয়ে রাখা হয়? প্রাগৈতিহাসিক জায়গাগুলো সম্পর্কে এ-সব প্রশ্ন আসছেই। ঐতিহাসিক যুগের ঢিবিঢাবা সম্পর্কেও কিছু কম প্রশ্ন আসছে না। দেখে শুনে মনে হয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বুঝি সত্যিই ম্যাজিক জানেন৷ না হলে ঐতিহাসিক যুগের ঢিবিঢাবা খুঁড়তে গেলেই রাজ্যের শিলালিপি, অফুরন্ত প্রত্নমুদ্রা, দু-চারটে বিষ্ণুমূর্তি কিংবা শিবলিঙ্গ কেন বেরিয়ে আসে? কোথাও-বা ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ—কোথাও-বা হস্তমুদ্রায় কিঞ্চিৎ পার্থক্যযুক্ত মহাবীরের স্ট্যাচু-ইবা কেন বেড়িয়ে পড়ে? আর্কিয়লজিক্যাল সার্ভের কি দুটি ডিপার্টমেন্ট? একটীতে কি তত্ত্ব তৈরী হয়—আর অন্যটিতে কি ঐ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার প্রমাণ? প্রাগৈতি- হাসিক এবং ঐতিহাসিক জায়গাগুলোর খননকার্যে সন্দেহজনক দীর্ঘ সময় নেওয়া হয় কেন? কোথাও কুড়ি বছর—কোথাও পঁচিশ বছর। এত সময় নেওয়ার দরকারটা পড়ে কেন? তবে কি ঐসব ঢিবিটাবা সম্পর্কে গল্প বানানো এবং সেই গল্পের প্রয়োজন অনুযায়ী ‘প্রত্ন-উপকরণ’ বানিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার জন্যই ঐ কালক্ষেপণের খেলা খেলতে হয়? অথবা ওখানে আদৌ কিছু না রেখে বিদেশে অর্ডার দিয়ে বানানো ‘প্রত্নউপকরণ’ সোজা মিউজিয়ামে পাচার করার জন্যই কি ঐ কালহরণের খেলা খেলা হয়? দুনিয়ার নানান রাষ্ট্রের আর্কিয়লজিক্যাল সার্ভের হেডকোয়ার্টার কি ফ্রান্সে, না ইংল্যাণ্ডে, না জার্মানীতে? এত ফরাসী, ইংরেজ বা জার্মান পণ্ডিতের নাম জড়ানোর ব্যবস্থাই বা কেন নেওয়া হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবেন?
ভাট সাহেবের ‘থিসিস’
মাধো সরূপ ভাট ছিলেন ডিরেক্টার জেনারাল অফ আর্কিয়লজি ইন ইণ্ডিয়া ৷ গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী শ্রীভাট মহাশয়ের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতেই হয়৷ তিনি এক জায়গায় লিখছেন :
“But that the climatic conditions during the 3rd Milleneum B. C. were more congenial than they are at present can be proved from the fact that the fauna represented in the Indus seals, such as buffalo, tiger, rhinoceros and elephant which must have been noticed by the Harappan artists, but many of which are not found today implies to some extent,
marshy conditions with jungle. Further, the use of costly burnt bricks, instead of sun dried bricks, by the Harappans probably also reflects a wetter climate. But it must be remembered that perhaps the basic climatic change was not the main reason for the decay of the Indus civilization. From our knowledge derived through the excavations, it seems that excessive deforestation (partly done by the Indus brick-makers), fall in the agricultural standard and other such socio-economic factors, as also the foreign invasion, probably of the Aryans, brought about the destruction of the Harappa civilization.”
গল্পটা ভালোই বানিয়েছেন ভাটমশাই। তবে মৌলিকত্ব আনতে পারেননি এইটাই দুঃখের। সিন্ধু সভ্যতার যখন রমরমা অবস্থা তখন ঐ পাঞ্জাব-সিন্ধু অঞ্চলে নাকি বৃষ্টিপাত ভালোই হত। জলাজমিও প্রচুর ছিল। গাছগাছালিরও অভাব ছিল না। তবে ঐ সভ্যতার উপকরণ ঐ ইট (আর টেরাকোটা সীল?) একটু বেশী মাত্রায় বানাতে গিয়েই নাকি মুশকিল হয়েছিল। বনজঙ্গল নাকি সবই উজাড় হয়ে গিয়েছিল। আর ঐ বনজঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ার জন্য অংশত দায়ী নাকি আগুনে পোড়ানো ইঁট তৈরীর কাণ্ডকারখানা। পরবর্তীকালে ঐ অঞ্চলে ঊষর রুক্ষ ভূপ্রকৃতির জন্ম যে ঐজন্য হয়েছিল এ-কথা না বললেও লেখক ওখানকার ভূপ্রকৃতির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা স্বীকার করেছেন। বর্তমানে হাতি, গণ্ডার বা বাঘ না থাকলেও অতীতে নাকি ঐসব জন্তুর লীলাক্ষেত্র ছিল ঐ অঞ্চলটা। আর ঐসব জন্তুজানোয়ারের লীলাক্ষেত্র ছিল বলেই নাকি হরপ্পার শিল্পীরা ঐসব প্রাণীর চিত্র সযত্নে এঁকে রেখেছেন। ভাট মশাই আর একটু মৌলিকত্ব দেখালে খুসী হতাম। ঐ ধরণের গল্প আর একটি ভূখণ্ড সম্পর্কে আগেই বানানো হয়ে গিয়েছিল। সুপ্রাচীন কল্পিত দেশ ফিনিশিয়ায় (মোটামুটি বর্তমান কালের লেবাননের একটি অংশ বলে যা প্রচার করা হয়) প্রাচীনকালে নাকি বিরাট বনাঞ্চল ছিল। তবে ফিনিশীয়দের জাহাজ তৈরীর প্রচণ্ড কর্মোদ্যোগের দরুণ সেসব বন নাকি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। এবং সেইজন্যই নাকি বর্তমানে ঐ অঞ্চলে বৃক্ষহীন শুষ্কতা বিরাজ করছে। সত্যিই ত জাহাজ কি কিছু কম তৈরী করা হত? নিজেদের ব্যবহারের জন্য—গ্রীসের জন্য—ইজিপ্টের জন্য জাহাজ বানাতে বা কাঠ সরবরাহ করতে গেলে বন ত’ শেষ হবেই। হওয়ারই যে কথা! ভূমধ্যসাগরের নৌবাণিজ্যের মনোপলি যে ঐ ফিনিশীয়দের হাতেই ছিল। ফিনিশীয়দের অস্তিত্ব থাক বা না থাক তাঁদের কৃতিত্বকে যে ছোট করে দেখার প্রশ্নই ওঠেনা। স্বনামধন্য অস্তিত্বহীন ফিনিশীয়রা গ্রীকদের শুধু অ্যালফাবেট-ই উপহার দেননি। দিয়েছিলেন ক্রীতীয়দের কাছ থেকে পাওয়া জাহাজ তৈরী করার বিদ্যাটাও। সে যাই হোক, উষর মোহেন্-জো-দড়ো বা ফিনিশিয়ার দুটো গল্পই সমান আজগুবি। মাথামুণ্ডু নেই ঐ-জাতের গল্প পুরাণে মানায় – ইতিহাসে একদম বেমানান।
আধুনিক শিল্পীদের তৈরী করে নেওয়া পুতুল বা গাছগাছালির ছবির ওপর প্রাচীনত্বের প্রলেপ চাপাতে গেলে যে ঐ রকম ‘থিসিস’ ই লিখতে হয়। না লিখে উপায় কি? আর একটা কথা। লঙ্কায় যে যায় সেই হয় রাবণ। আর্কিয়লজিক্যাল সার্ভের সঙ্গে জড়িত ভদ্রলোকেরা রাজ্যের বিভ্রান্তি সৃষ্টির দায়িত্বই-বা নেন কেন? এ-প্রশ্নেরও উত্তর পাচ্ছিনা৷
স্বস্তিকা চিহ্ন-পুসালকারের বক্তব্য
মোহেন্-জো-দড়োর প্রত্নউপকরণ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এ. ডি. পুসালকার স্বস্তিকা চিহ্নের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন :
“The Svastika design which is found in Crete, Cappadocia, Troy, Susa, Musyan etc but not in Babylonia or Egypt, appears on particular types of seal (of Mohen-jo-daro) and indicates their religious use or significance. Though cylinder seals were universally used in Sumer, only three specimens have so far been found in the Indus Valley, having purely Indian devices.” (এখানে একটি ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। মেসোপটেমিয়ায় ‘স্বস্তিকা’ চিহ্নযুক্ত প্রত্নমুদ্রা পাওয়া গেছে।)
স্বস্তিকা চিহ্নের ‘রহস্য’ সম্পর্কে পুসালকার মহাশয় অনেক তথ্যই সরবরাহ করেছেন। করেছেন বিভ্রান্তিটা বাড়াতে। ক্রীত, কাপাদোকিয়া, ট্রয়, সুসা ইত্যাদি স্থানের প্রত্নলেখগুলোতে স্বস্তিকা চিহ্নের সন্ধান যে পাওয়া গেছে এ-তথ্য বেশ যত্ন করেই তিনি দিয়েছেন এবং ব্যাবিলন ও ইজিপ্টে যে লক্ষণীয়ভাবে ঐ চিহ্নের ব্যবহার হয়নি এটাও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন হল ঐ তথ্য থেকে সিদ্ধান্তটা কি আসছে। সিদ্ধান্ত একটিই। ‘প্রাচীন ইতিহাস’ তৈরীর নেপথ্য শিল্পীরা বেশ পরিকল্পিত-ভাবেই দেশে দেশে প্রত্নউপকরণ বানিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার খেলাটা খেলেছিলেন। খেলেছিলেন পণ্ডিতদের বোকা বানাবার তাগিদেই। চিহ্নটা ব্যাবিলনেও পাওয়া যায়নি—যায়নি ইজিপ্টে ও অথচ সুদূর ইউরোপে পাওয়া গেছে। যেসব জায়গায় পাওয়া গেছে সে-সবই তথাকথিত আর্যভাষাভাষী অঞ্চলে। তবে কি তথাকথিত আর্যসন্তানদের মাথা থেকেই ঐ চিহ্নটা উদ্ভুত হয়েছিল? পণ্ডিতেরা তর্ক করুন—তর্কের ঝড় তুলুন। খেলাটা জমবে ভালো৷
গবেষকেরা গবেষণার ছয়লাপ করুন। বিভ্রান্তিটা পাকা হবে। নেপথ্যশিল্পীরা মজা দেখবেন। ব্যবস্থাটা এইরকমই হয়েছিল। মজার কথা আরও কিছু বলেছেন পুসালকার মহাশয়৷ সুমেরীয় সভ্যতার প্রত্ননিদর্শন কম নয়। প্রত্নলেখ-সমৃদ্ধ প্রচুর সিলিণ্ডার সীল পাওয়া গিয়েছিল ঐ সুমের অঞ্চলে। অথচ সিন্ধু সভ্যতার উপকরণ হিসাবে ঐ ধরণের সীল পাওয়া গেছে মাত্র তিনটি। এই অদ্ভুত ঘটনার কথা পুসালকার মশাই জানিয়েছেন। আশ্চর্য হওয়ার কোন কারণই ত’ দেখছিনা৷ প্রথম ক্ষেত্রে লক্ষাধিক সিলিণ্ডার প্রত্নলেখ লেখানোর পেছনে লক্ষ্য ছিল মিথ্যাটাকে বিশাল বানিয়ে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ঐ ধরণের মাত্র তিনটে সিলিণ্ডার বানিয়ে রাখার উদ্দেশ্য ছিল কল্পিত সুমেরীয় সভ্যতার সঙ্গে কল্পিত সিন্ধু সভ্যতার সম্পর্কের গল্প বানানোর সুযোগ করে দেওয়া। বলে রাখা ভালো ঐ সম্পর্ক সম্বন্ধেও কম গল্প পণ্ডিতেরা লেখেননি। গবেষকেরাও কিছু কম গবেষণা করেননি। পণ্ডিতদের ঠকানোর কাজটা দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ কাজ। ‘সুসভ্য’ ভূখণ্ডে প্রত্নউপকরণ সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার যে বিরাট পরিকল্পনা সুগোপন নিষ্ঠায় ঐ মিথ্যার কারবারীরা নিয়েছিলেন সেই পরিকল্পনার মধ্যেই পণ্ডিত ঠকানোর ব্যবস্থা ছিল। এই উপকরণটা মোহেন-জো-দড়োতে আছে৷ আছে ইজিপ্টেও। অতএব তত্ত্ব তৈরী ঐ উপকরণটা ক্রীতে পাওয়া গেছে আবার ইরাণেও পাওয়া যাচ্ছে অতএব আর এক প্রস্থ তত্ত্ব তৈরী করতে কোনও অসুবিধা নেই। তত্ত্বের এবং তথ্যের পাহাড় তৈরী করে বসলেন দুনিয়ার পণ্ডিতেরা। ভিত নেই সৌধ গড়ার অক্লান্ত প্রয়াস! এবং এরই নাম নাকি পাণ্ডিত্য !
তথাকথিত ‘স্বস্তিকা’ চিহ্নটা ভারতে প্রচলিত ছিল এটা মনে করলে ভুল হবে। ঐ প্রতীকচিন্তার জন্ম হয়েছিল ইউরোপে। পরে ভারতে প্রচলনের ব্যবস্থা হয়েছিল ঐ প্রতীকেরই কায়দা করা প্রতিরূপের। সংস্কৃত স্বস্তিকা নাম চাপানোর মধ্য দিয়ে পণ্ডিতদের ঠকানোর কাজটা ভালোই হয়েছিল। বলা বাহুল্য ঐ স্বস্তিকা চিহ্নের সঙ্গে স্বস্তি বা অস্বস্তি কোনও কিছুরই সম্বন্ধ নেই। আর ঐ ‘স্বস্তি’-শব্দটাও বাংলা সোয়াস্তি শব্দের সংস্কৃত ছদ্মবেশ—ওটা প্রাচীন শব্দ নয়।
স্বস্তিকা চিহ্ন-সম্পর্কে অনেক গল্পই চালু আছে৷ চিহ্নটা নাকি প্রাচীন কালে দুনিয়া জুড়েই ব্যবহার করা হত। ব্যবহার করা হত ভারতে, ইউরোপে, পলিনেশিয়ায় এমনকি আমেরিকাতেও। উত্তর আমেরিকার নাভাজো নামের রেড-ইণ্ডিয়ানদের মধ্যেও ঐ চিহ্নের প্রচলন প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। চলে আসছে মধ্য আমেরিকার ‘মায়া’ সভ্যতার উপকরণে ব্যবহার করা প্রতীক হিসাবেও। ইউরোপে নাকি তথাকথিত ব্রোঞ্জযুগ থেকে আর এসিয়ায় খ্রীস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ থেকে ঐ প্রতীকের প্রচলন শুরু হয়েছে। গল্পটা বিস্তৃত করার দরকার নেই। ঐসব তথ্য থেকে আহরণ করা ভিতরের তথ্যটাই জানানো যাক। চিহ্নটা ব্যবহার করা হত ধর্মীয় প্রতীক হিসাবে। কোথাও সূর্যের কোথাও বা আগুনের প্রতীক হিসাবে। কোথাও আবার বায়ুদেবতা ও বৃষ্টিদেবতার প্রতীক হিসাবে। দুনিয়ার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে চিহ্নটা প্রাচীনকালে পৌঁছল কি করে এ প্রশ্ন কেউই তোলেননি৷ তোলার দরকার বোধ করেননি। সন্দেহ করার কি কিছুই নেই! তবে কি ধর্মের সার্বদেশিকত্ব এবং প্রাচীনত্বের বিশ্বাস- যোগ্যতা বাড়ানোর জন্যই চিহ্নটা দেশে দেশে প্রবর্তন করেছিলেন ঐ মিথ্যার কারবারীরা? তবে কি আধুনিক কালেই ঐ বিশেষ প্রতীকটা ওঁরা দেশে দেশে চালু করেছিলেন? তাইত আসছে৷ গ্রীকো-রোমক লিপির H এবং U-কে যাঁরা প্রাচীনকালের ইস্টার আইল্যাণ্ডের লিপিমালায় ঠাঁই দিতে পেরেছিলেন তাঁদের পক্ষে অসম্ভব বলে যে কিছুই নেই। মোহেন্-জো-দড়ো লিপিতে যদি ওঁরা স্বস্তিকা-চিহ্নের ব্যবহার করে বসেন তাতে অবাক হওয়ার কি আছে? ওঁদের লীলা- খেলাটা কেউ বোঝেননি বলেই ত’ প্রাচীন ইতিহাসটা বেঁচে আছে?
সিন্ধু লিপির ‘বিশ্লেষণ’—’হিন্দু ঐতিহাসিক’ রমেশ মজুমদারের ভুমিকা
মোহেন্-জো-দড়ো লিপি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর Sources of Indian History (The History of culture and civilization of the Indian People. The Vedic Age — খণ্ডে প্রাপ্তব্য প্রবন্ধের এক জায়গায় লিখলেন :
“There are resemblances between some characters in the Indus script and those in the Sumerian. Proto- Elamite, Hittite, Egyptian, Cretan, Cypriote and Chinese scripts. Similarities have also been traced with the script of the Easter Islands, and the Tantric pictographic alphabets. All these scripts are possibly interrelated, but only upto a certain point. Some scholars even claim the Brahmi to have been derived from the Indus script.
বুঝতে কষ্ট হয়না তথাকথিত ব্রাহ্মী বা খরোষ্ঠী লিপি উদ্ভাবন করতে গিয়ে মিথ্যার কারবারীরা যে কায়দাটা নিয়েছিলেন আধুনিকতর উদ্ভাবন ঐ মোহেন্-জো-দড়োর লিপিতে সেই কায়দাটা তাঁরা নেননি। গ্রীকো-রোমক লিপি এবং ভারতে চালু কিছু লিপির সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে ঐ ব্রাহ্মী খরোষ্ঠী লিপিমালা বানিয়ে নেওয়া হয়েছিল। লিপিসমন্বয়ের খেলাটা ঐ মোহেন্-জো-দড়োর ‘লিপিমালা’য় বেসামাল ভাবেই খেলা হয়েছিল। দু-চারটে লিপির মধ্যে চুরিটা সীমাবদ্ধ না রেখে চুরি নামক অপকর্মের এলাহি কাণ্ডকারখানা করা হয়েছিল ঐ ‘লিপিমালায়।’ সে ‘লিপিমালায় সুমেরীয়, আদি-এলামীয়, হিত্তীয়, ইজিপ্টীয়, ক্রীতীয়, সাইপ্রীয় এবং চীনা লিপির সঙ্গে মিলযুক্ত অক্ষরের অস্তিত্ব পণ্ডিতেরা খুঁজে বার করেছেন। বার করেছেন ইস্টার আইল্যাণ্ডে প্রচলিত লিপির অনুরূপ লিপি। তান্ত্রিক প্রতীকেরও সন্ধান ঐ ‘লিপি’তে তাঁরা করে নিয়েছেন। দেখে শুনে মনে হয় লিপির ব্যাপারে পল্লবগ্রাহিতা যেন মোহেন্-জো-দড়োর সুসভ্য নাগরিকদের একটা খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবং সেই খেলার দাপটে দুনিয়ার লিপি আর দুনিয়ার প্রতীক চুরির কর্মযজ্ঞে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পণ্ডিতেরা এসব কিছুই বোঝেননি। বোঝার চেষ্টা করেননি। আসলে ঐ ‘লিপি’র পুরোটাই যে জালিয়াতি পুরোটাই যে উনিশ কিংবা বিশ শতকে তৈরী করে নেওয়া— এই সোজা কথাটা নিয়ে কেউই মাথা ঘামাননি৷ এবং ঘামাননি বলেই দুনিয়ার প্রাচীন ইতিহাসের তাবৎ পণ্ডিতদের কাছে ‘লিপিটা’ দ্বিমাত্রিক রহস্য সেজে বসে আছে৷
ইস্টার আইল্যাণ্ডে একদা প্রচলিত বলে প্রচারিত লিপিমালার বেশ কয়েকটা অক্ষরের সঙ্গে যে মোহেন্-জো-দড়োর তথাকথিত লিপিমালার সমসংখ্যক অক্ষরের মিল আছে এই মূল্যবান তথ্যটি কে দিয়েছিলেন? দিয়েছিলেন হাঙ্গেরীয় পণ্ডিত হেভেসি ভিলমোস। ইস্টার আইল্যাণ্ডের ঐ ‘লিপিমালা’টা যে একটা আধুনিক জালিয়াতি—ঐ ‘লিপি’ যে কস্মিনকালেও ঐ দ্বীপে চালু ছিলনা—এ-তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন সুইস-ফরাসী পণ্ডিত আলফ্রেদ ম্যাত্রো। যেসব দাঁড়ের (oar) ওপর খোদাই করা অবস্থায় ঐ লিপিগুলো পাওয়া গেছে তা সবই এমন সব কাঠের যা ইউরোপেই পাওয়া যায়৷ অন্যত্র পাওয়া যায়না। তাছাড়া “The climate of Easter Island is essentially wet and tablets of wood could not have been kept for centuries in rain-drenched huts, much less in caves. How then could those tablets have been saved for thousands of years of migration and war and come to us in the form of a modern European oar?” (India And The Pacific World – by Kalidas Nag) প্রশ্ন আসছেই। কাঠের ওপর খোদাই করা ঐ ‘দারুণ’ মিথ্যাটাকে রমেশ মজুমদারইবা গুরুত্ব নিয়ে বসলেন কেন? লিপিটা যে জাল এ-তথ্য মজুমদার মশাই-এর না জানার কথা নয় তবু ঐ তথ্যটিকে তিনি প্রকাশ করলেন না কেন? তবে কি ‘সত্যনিষ্ঠ’ ঐতিহাসিক ইচ্ছাকৃতভাবেই তথ্যটি চেপে গিয়েছিলেন ? প্রশ্ন আরও আসছে। দুনিয়ার সব প্রাচীন লিপিই যখন জাল তখন একমাত্র ঐ ইস্টার আইল্যাণ্ডের লিপিটাকে জাল প্রতিপন্ন করার জন্য এত কাঠখড় পোড়ানো হল কেন? মিথ্যার কারবারীদের সততা বোঝানোর একটা কায়দা হিসাবেই কি ঐ তৎপরতা? তাইত মনে হচ্ছে।
আসলে মোহেন্-জো-দড়োর লিপির সঙ্গে মিলজুল ওলা যতগুলো লিপির প্রসঙ্গ মজুমদার মশাই ঐ বক্তব্যে রেখেছেন তার মধ্যে চীনা লিপি ছাড়া বাকি প্রত্যেকটি লিপিই জাল৷ ওসব লিপির কোনটার প্রচলনই প্রাচীনকালে ছিল না। চীনা লিপিটাও যে প্রাচীনকালে প্রচলিত ছিল এমন প্রমাণও পাচ্ছি না। দুনিয়ার প্রাচীন ইতিহাস তৈরীর ইউরোপীয় কারিগরেরা দেশে দেশে নানান সুপ্রাচীন লিপির সবই বানিয়ে নিয়েছিলেন আর ঐসব লিপির মধ্যে অংশতঃ মিল রাখার আয়োজন তাঁরা করেছিলেন বেশ পরিকল্পনামাফিকই। করেছিলেন বিভ্রান্তি আনার ব্যবস্থা হিসাবেই। ব্যবস্থাটা দুনিয়ার পণ্ডিতেরা বোঝেননি। এবং বোঝেননি বলেই ঐ প্রচণ্ড মিথ্যার ওপর নির্ভর করে উদ্ভট উদ্ভট সব তত্ত্ব তাঁরা তৈরী করে নিয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে বিশ্ববিদ্যালয় নামক জ্ঞানপীঠে ঐসব তত্ত্বেরই চর্চা চলেছে। ছাত্রেরাও ঐসব তত্ত্বই পড়ছেন। পড়তে বাধ্য হচ্ছেন।
প্রাচীন লিপিমালাগুলোর মধ্যে লক্ষণীয় মিল রয়েছে কেন?
নানান দেশের প্রাচীন লিপিমালাগুলোর মধ্যে বেশ কিছু অক্ষরের মিল ‘আবিষ্কার’ করে যাঁরা পণ্ডিত হয়েছেন তাঁরা কি সত্যি সত্যি প্রশংসার দাবী করতে পারেন? ঐ মিলটা বার করে নিতে কি খুব একটা পাণ্ডিত্যের দরকার পড়ে? মোটেই নয়। প্রাচীন বলে প্রচারিত নানান লিপির অক্ষরসাদৃশ্যটা এত বেশী প্রকট যে এক ঝলক দেখেই তা ধরে ফেলতে কোনও অসুবিধাই হয়না। রোমক লিপির H-এর সঙ্গে মিলযুক্ত অক্ষর ব্রাহ্মী, মোহেন্-জো-দড়ো, ইস্টার আইল্যাণ্ড, আদি-এলামীয়, ইজিপ্টীয়, ক্রীতীয় সব লিপিতেই আছে। আছে ক্রস চিহ্নটাও ঐ সব লিপিতে। অধিকন্তু সুমেরীয় লিপিতেও ঐ চিহ্নের ব্যবহার পাচ্ছি। D-এর প্রতিচ্ছবি ব্রাহ্মীতে আছে৷ আছে মোহেন্ – জো-দড়োর লিপিমালায়। আছে আদি-এলামীয় লিপিতেও। পঞ্চাঙ্গুলি (পঞ্চশুল) চিহ্নটা মোহেন্-জো-দড়ো, ইস্টার আইল্যাণ্ড, আদি- এলামীয়, ইজিপ্টীয় এবং সুমেরীয় প্রত্যেকটি লিপিতেই পাওয়া যাচ্ছে। এ রকম লক্ষণীয় মিল লিপিমালাগুলোর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে যার বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন বোধ করছিনা। প্রশ্ন হচ্ছে এই যে ঐ মিল থাকার ব্যাপারটাকে কেউ সন্দেহের চোখে দেখেননি কেন? সাদৃশ্য-থাকা কাণ্ডকারখানার পশ্চাতে আধুনিক কোনও নেপথ্যশিল্পীর অবদান ছিল কিনা এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা সবাই সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন। ঐ মিল থাকার ব্যাপারটাকে নানান সুসভ্য দেশের সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের গল্পের প্রমাণ হিসাবে খাড়া করার চেষ্টা কেউ কেউ করেছেন। উগ্র জাতীয়তাবাদী চরিত্রের পণ্ডিতেরা ঐ মিলটাকে কাক- তালীয় মনে করে আনন্দ পেয়েছেন। ঘটনা হচ্ছে এই৷ আসলে স্ফাজিস্টক্স-এর জিমন্যাস্টিক্স নানান পণ্ডিতে নানান কায়দায় খেলে- ছিলেন। খেলেছিলেন বিভ্রান্তিটাকে পোক্ত করার জন্যই।
ইজিপ্টতাত্ত্বিক বলে বসলেন ‘সবার উপরে ইজিপ্টই সত্য তাহার উপরে নাই।’ সভ্যতাসংস্কৃতির উপাদানের দিক দিয়ে সব দেশই নাকি ইজিপ্টের কাছে ঋণী। অন্ততঃ লিপির ব্যাপারে ত বটেই। মেসোপটে— মিয়াকে যাঁরা পৃথিবীর সভ্যতাসংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র বলে প্রচারের অভিযানে মেতে উঠলেন তাঁরা বললেন, না, তা কি করে হয়? ওসবই নাকি মেসোপটেমিয়া থেকেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল। এমনকি লিপি- টাও। ইণ্ডোলজিস্টরা হরপ্পা মোহেন্-জো-দড়োর প্রত্নউপকরণের ফিরিস্তি দিয়ে বোঝাতে চাইলেন আদি গুরু নাকি এই ভারতই। এঁদের কারুর প্রচার অভিযানকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। কারণ এঁরা কেউই যথার্থ পণ্ডিত নন—সকলেই ভাড়াটে পণ্ডিত। ‘যথা নিয়োজিতোহস্মি তথা করোমি’-বাদী এই সব পণ্ডিত ঠিক ততটুকুই এগিয়েছিলেন যতটুকু এগুনোর সুযোগ তাঁদের দেওয়া হয়েছিল। সুযোগ তাঁরা পেয়েছিলেন কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করার। তার বেশী নয়। আসলে তথাকথিত প্রাচীন লিপিগুলোর সবই যে আধুনিক জালিয়াতি—সবই যে ইউরোপের নেপথ্যশিল্পীদের তৈরী করে নেওয়া ‘লিপি’—এবং লিপিতে লিপিতে মিল থাকার ব্যবস্থাটা যে ওঁরা সুপরিকল্পিতভাবেই নিয়েছিলেন- এই সোজা কথাটাই সবাই চেপে গিয়েছেন। যাওয়ার কারণ ছিল বলেই। কারণ দুনিয়ার প্রত্নলিপির ঐ সব বিচিত্ৰ উদ্ভট বাহনগুলোর অনস্তিত্বের তথ্যটা প্রকাশ হয়ে পড়লে যে দুনিয়ার প্রাচীন ইতিহাস নামক রম্য রচনার ঐতিহাসিকত্বের ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে যায়। তাই ঐ ‘চেপে যাওয়া’। শুধু তাই নয়। প্রাচীন ইতিহাসের ওপর গবেষণার ছয়লাপ করা — দুনিয়া জুড়ে সেমিনার ‘অ্যাটেণ্ড’ করার রাজসূয় কর্মকাণ্ড করারও যে সুযোগ বন্ধ যয়ে যায়। তাই ঐ ‘চেপে যাওয়া’ আর ঐ ‘মহান ক্রিয়া’র কল্যাণেই প্রাচীন ইতিহাস নামক মিথ্যাটা বেঁচে আছে। বেঁচে আছে পরম প্রামাণ্যতার ছদ্মবেশ চাপিয়ে। লিখিত নজীর ছাড়া ইতিহাস প্রামাণ্য হয়না। লেখাজোখা নেই ত ইতিহাসও নেই। ঐতিহাসিক যুগের শুরু ঐ লেখাজোখার মধ্য দিয়ে। মজার কথা এই যে দুনিয়ার প্রাচীন ইতিহাস বানানোর শিল্পীরা ইতিহাসটাকে এমন প্রাচীন যুগে পাঠানোর আয়োজন করেছিলেন যে যুগে দুনিয়ায় কোনও লিপিরই জন্ম হয়নি। আর তা হয়নি বলেই রাজ্যের ভূতুড়ে লিপি ওঁদের বানিয়ে নিতে হয়েছিল। বানিয়ে নিতে হয়েছিল কাল্পনিক কাহিনীগুলোকে ইতিহাস বলে প্রচার করার তাগিদেই৷
মোহেন-জো-দড়োর কৃতী ‘শিল্পী’
স্যার জন মার্শাল, মার্টিমার হুইলার, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ম্যাকে ইত্যাদি বেশ কয়েকজন পণ্ডিত ঐ মোহেন্-জো-দাড়ো-হরপ্পার তথাকথিত প্রাচীন সভ্যতার গল্প তৈরী করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। করেছিলেন মিথ্যার আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের শরিক হিসাবেই। ঐ সভ্যতার উপকরণ নির্বাচন এবং যথাস্থানে সংস্থাপনের গোপন কর্মকাণ্ড সম্ভবত আগেই শেষ হয়েছিল। ১৮২৬ সালে হরপ্পার ঢিবির খবর পাওয়ার পরে প্রায় একশ’ বছর সময় পাওয়া গিয়েছিল ঐ গোপন কর্মকাণ্ডের জন্য। জন মার্শাল আগেই হাত পাকিয়েছিলেন গ্রীসের ‘ইতিহাস’ রচনার মহান কর্মযজ্ঞে অংশ গ্রহণ করে। সে-ভূমিকা তিনি সুষ্ঠুভাবে পালন করেছিলেন। আর পেরেছিলেন বলেই জন মার্শাল ব্রিটিশ সরকার গুণীদের কদর দিতে জানতেন বৈকি। গুণী মার্শাল সাহেব পরে ‘ডিউটি’ পেয়েছিলেন এই ভারতবর্ষে। বলা বাহুল্য এ-কাজটাও তিনি সুনামের সঙ্গেই করেছিলেন। সুনামের সঙ্গে হুইলার সাহেবও কাজ করেছিলেন। করেছিলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ও। আখের গুছিয়ে নিতে অসুবিধা এঁদের কারুরই হয় নি৷ ব্রিটিশ সরকারের নেপথ্য কর্মকাণ্ডে যাঁরা জড়িত থাকতেন তাঁদের কারুরই টাকাপয়সার অভাব খুব একটা থাকত না।
মোহেন্-জো-দড়ো-সভ্যতার ‘আবিষ্কর্তা’ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আর্কিয়লজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়ার অধীনে বেশ উঁচু দরের চাকরী করতেন। চাকরীজীবনের শেষভাগে তাঁর চাকরী গিয়েছিল। গিয়েছিল একটি মূর্তি সরিয়ে ফেলার অপরাধে। সে-অপরাধের জন্য কোর্ট- কাছারীও হয়েছিল। এবং তিনি নির্দোষ সাব্যস্তও হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তাঁকে চাকরীতে পুনর্বহাল করা হয়নি। করা হয়নি ব্রিটিশ সরকারের একটি উৎকট জেদের জন্যই। গল্পটা ভালোই বানানো হয়েছিল পুরোটাই সাজানো ব্যাপার। বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের চাকরী খাওয়া হয়েছিল পরিকল্পিতভাৰেই। খাওয়া হয়েছিল ভদ্রলোকের বিশ্বাস-যোগ্যতা বাড়ানোর এবং ব্রিটিশ সরকারের নিরপেক্ষতা এবং সত্যনিষ্ঠার প্রমাণ রাখার জন্য। আসলে রাখালদাসবাবু যে ঐ মিথ্যা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এই সত্যটা যাতে কেউ ধরে না ফেলেন তার জন্যই ঐ ব্যবস্থা। হিয়া কা মূর্তি হুয়া করার নামই যে মোহেন্-জো-দড়ো- হরপ্পা এইটাই কেউ বোঝেন নি। ঐ মোহেন্-জো-দড়োতে শিবলিঙ্গ রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। ব্যবস্থা হয়েছিল নানান ‘মাতৃকা-মূর্তি’ দুনিয়ার সব প্রাগৈতিহাসিক করতে হয়েছিল। করেছিলেন রাখারও। ধ্যানমগ্ন ‘পশুপতি’ও রাখা হয়েছিল। রাখা হয়েছিল ধর্মীয় বিভ্রান্তি আনার জন্যই। নিগ্রোবটু ওষ্ঠ বা অস্ট্রিক শারীরগঠনযুক্ত স্ট্যাচুরও অভাব রাখা হয়নি৷ সে-সব রাখা হয়েছিল আর এক কায়দায় বিভ্রান্তি আনার জন্যই। নৃতাত্ত্বিক বিভ্রান্তি আনার জন্যই যে ঐসব মূর্তি রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল এটা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। ওসব মূর্তির কোনটাই ওখানে ছিল না। সবই আমদানী করা হয়েছে। আরোপ করা হয়েছে। করতে হয়। জায়গায় ঐ অপকর্ম করা হয়েছিল। মিথ্যার আন্তর্জাতিক কারবারীরা। মতলবটা বলা বাহুল্য ইউরোপের। স্যার জন মার্শাল, মার্টিমার হুইলার এবং রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যে সিন্ধু সভ্যতার উপকরণ নির্বাচন এবং ঐ সভ্যতার গল্প তৈরী করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন—এটা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। আসলে আন্তর্জাতিক মিথ্যা সৃষ্টির চক্রান্তে তিনজনই সামিল হয়েছিলেন। সামিল হয়েছিলেন ম্যাকে-সাহেবও। অজ্ঞাতনামা যেসব নেপথ্যশিল্পী নানান ‘সৃষ্টিমূলক’ কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের নাম জানার যে উপায় নেই তা বলাই বাহুল্য।
সিন্ধু লিপির রহস্যোদ্ধার কে করবেন? কবে?
মোহেন্-জো-দড়ো লিপির মর্মোদ্ধার এখনও পর্যন্ত কেউ করেননি। করেননি কারণ ইতিহাস-তৈরীর নেপথ্য নায়কদের কাছ থেকে এখনও সে-নির্দেশ আসেনি। সে-নির্দেশ এসে পৌঁছলেই নতুন কোনও প্রিন্সেপ সাহেব অবলীলায় লিপির রহস্য উন্মোচন করে বসবেন। ভাগ্য প্রসন্ন হলে একটা নোবেল প্রাইজও হয়ত পেয়ে যাবেন। ঐতিহাসিকদের বাহবা কুড়াতেও দেরী হবেনা৷ অসুবিধাও খুব একটা হবে বলে মনে হয়না। কারণ ইতিমধ্যে সংস্কৃত ভাষার অতি-প্রাচীনত্ব সম্পর্কে এত বেশী মাত্রায় গল্প লেখা হয়ে গিয়েছে এবং তুরস্কের বোঘাসকয়ে তথাকথিত মিত্তানি নামের প্রায়-সংস্কৃত-মার্কা ভাষায় শিলালিপি বানিয়ে রেখে এবং তার আনুমানিক বয়স জানিয়ে রেখে সে- প্রাচীনত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা আনার কাজটা মিথ্যার আন্তর্জাতিক কারবারীরা যেমন সুষ্ঠুভাবে করে রেখেছেন তাতে ঐ রহস্যময়ী ভাষাকে সংস্কৃত বলে প্রচার করতে কোনও অসুবিধাই হবেনা। হওয়ার কথাও নয়। তার আর একটা কারণ তথাকথিত রহস্যময়ী লিপির মাধ্যমে লেখা হয়েছে ঐ সংস্কৃত ভাষাই৷ অন্য কোনও ভাষা নয়। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো এই প্রবন্ধ লেখার সময় সংবাদপত্রের একটি খবরে জানা গেল জনৈক রাও-মহাশয় নাকি মোহেন্-জো-দড়ো-লিপির মর্মোদ্ধার করে বসেছেন। আর ঐ ‘রহস্যময়ী’ লিপির মধ্য থেকে তিনি শুধু সংস্কৃত শব্দই খুঁজে পেয়েছেন। অন্য কোনও ভাষার শব্দ পান নি। সংশ্লিষ্ট মহল তদ্বির-তদারক শুরু করে দিয়েছেন যাতে রাও-মশাই তাঁর এই ‘কৃতিত্বে’র স্বীকৃতি হিসাবে নোবেল প্রাইজটা পেয়ে যান। দুনিয়ায় অসম্ভব বলে কিছু নেই। রাও-সাহেব সত্যিই যদি ঐ প্রাইজ পেয়ে যান তবে বুঝব ঐ নোবেল কমিটি দুনিয়ার মিথ্যার কারবারীদেরই প্রতিভূ। সত্যের নয়।
সিন্ধু সভ্যতা বনাম অ্যাসিরীয় সভ্যতা
বেদোক্ত অসুর-শব্দের সঙ্গে অ্যাসিরিয়া শব্দের আপাতসাদৃশ্য দেখে অ্যাসিরীয় সভ্যতার সঙ্গে সিন্ধু-সভ্যতার নিকটতর সম্পর্ক ‘আবিষ্কার’ করার চেষ্টা অনেক পণ্ডিতই করেছেন। মজার কথা এই যে ঐ ‘অসুর’ নামক শব্দটা আধুনিক কালে বানিয়ে নেওয়া ঋগ্বেদে রাখা হয়েছিল বিভ্রান্তি আনার একটা ব্যবস্থা হিসাবেই। আসলে অ্যাসিরিয়া নামক কল্পিত নামটা যাঁরা মেসোপটেমিয়ার একটি কল্পিত সেমিটিক জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের ওপর আরোপ করেছিলেন তাঁরাই সিন্ধু সভ্যতার জন্মদাতা ‘সুসভ্য’ জাতির ওপর অস্থর বা দস্যু বা দাস নানান রকম নাম আরোপ করার খেলা খেলেছিলেন। সবই ‘তাঁরাই খেলেছিলেন। ‘তাঁরা’ অর্থে ছনিয়ার প্রাচীন ইতিহাসের সৃষ্টিকর্তা ইউরোপের নেপথ্য কারিগরদেরই বুঝতে হবে।
সিন্ধু লিপির মাধ্যমে কোন ভাষা লেখা হয়েছিল?
সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার না হলে কি হবে পণ্ডিতেরা ঐ ‘লিপি’-ধৃত ভাষাসম্পর্কেও নানান মত ব্যক্ত করেছেন। ব্যক্ত করেছেন পাণ্ডিত্যের পরিমণ্ডল রচনা করেই। কেউ বলেছেন ওটা দ্রাবিড় ভাষা৷ কেউ মনে করেছেন ওটা সংস্কৃত৷ অনেক পণ্ডিত প্ৰাকৃত শব্দও ঐ ‘লিপির’ মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন। কোনও পণ্ডিত এম্বর (monosyllafic) শব্দের গন্ধও ‘আবিষ্কার’ করে ফেলেছেন ঐ লিপির মধ্যে। পণ্ডিতের অভাব হয়নি। একদল পণ্ডিত ঐ লিপির মধ্যে মুণ্ডা-ভাষীর লক্ষণও ‘আবিষ্কার’ করে নিয়েছেন। সত্যিই ত’ অস্টিক শারীরগঠনযুক্ত মহিলার ধাতৰ মডেল যখন ঐ সভ্যতার উপকরণ হিসাবে রয়েছে তখন ঐ চিন্তা তো আসতেই পারে। আসাটা বিচিত্র কি! গবেষকেরা যাঁর যেমন খুসি তত্ত্ব তৈরী করে নিয়ে গবেষণাপত্র হাজির করেছেন। সব রকম তত্ত্বের উপযোগী উপাদানে যখন সভ্যতাটা সমৃদ্ধ তখন অসুবিধা হবেই বা কেন? পণ্ডিতদের নামের তালিকা দিয়ে প্রবন্ধের কলেবর বাড়ানোর ইচ্ছা নেই৷
সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা কি দ্রাবিড় জাতি?
বিভ্রান্তির ওপর বিভ্রান্তি! ঋগ্বেদে ‘হরিযুপিয়া’ ছদ্মনাম চাপানো হরপ্পার অধিবাসীদের নাম পণি রাখা হয়েছিল। রাখা হয়েছিল উদ্দেশ্যমূলকভাবেই। পণ-শব্দটা তামিল। আর শব্দটা তামিল হওয়ার সুবাদে এবং পণি শব্দের প্রয়োগ দেখে সিন্ধু সভ্যতা সৃষ্টির মূলে দ্রাবিড়দেরই যে অবদান বেশী ছিল এই মূল্যবান তথ্যটিও অনেক পণ্ডিত দিয়ে বসেছেন। আসলে ঋগ্বেদ নামক আধুনিক পুণ্যগ্রন্থে যে নানান বিভ্রান্তি আনার তাগিদেই ঐ অসুর বা পণি শব্দের ধাঁধা সৃষ্টি করা হয়েছিল—এইটাই কেউ বোঝেননি। চতুর্বেদ তথা বৈদিক সাহিত্যের পুরোটাই যে আধুনিক কালে বানিয়ে নেওয়া প্রতারণা তা প্রমাণ করব পরের অধ্যায়ে। পণি শব্দের সঙ্গে ‘ফনিক’-শব্দের ধ্বনিগত সাদৃশ্য দেখিয়ে এবং ঐ ‘ফনিক’এর অর্থ ফিনিশীয় বানিয়ে নিয়ে আর একদল পণ্ডিত (সম্ভবত ভাড়াটে) আর এক উদ্ভট গল্প বানিয়েছেন। এঁদের বক্তব্য মেনে নিতে গেলে বলতে হয় ব্যবসা বাণিজ্য ব্যাপদেশে ঐ ফিনিশীয়রা মোহেন-জো-দড়ো-হরপ্পাতেও নাকি হানা দিয়েছিলেন। দুনিয়ায় পাণ্ডিত্যব্যবসায়ীর সংখ্যা বড্ড বেশী!
সিন্ধু সভ্যতা এবং ‘পঞ্চধাতু’র গল্প
মোহেন্-জো-দড়োর প্রত্ন উপকরণের মধ্যে বেশ কিছু ধাতব দ্রব্য রাখারও ব্যবস্থা হয়েছিল। সোনা, রূপো, তামা, টিন ও সীসা এই পাঁচটা মৌলিক ধাতু আর ব্রোঞ্জ নামক মিশ্রধাতুর ব্যবহার যে ঐ মোহেন্-জো- দড়োতে হত এ-তথ্য পণ্ডিতেরা দিয়েছেন। “স্যার এডউইন পাস্কো অনুমান করেন যে সোনা দক্ষিণ ভারত (হায়দ্রাবাদ, মহীশূর অথবা মাদ্রাজ দেশ) হইতে আনা হইয়াছিল। মহীশূরের অন্তর্গত কোলার খনির ও মাদ্রাজের অন্তর্গত অনন্তপুরের সোনার সঙ্গে মোহেন্-জো-দড়োর সোনার যথেষ্ট সাদৃশ্য দেখা যায়।” (উৎস—কুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামী লিখিত “প্রাগৈতিহাসিক মোহেন-জো-দড়ে৷”) ঐ গ্রন্থেরই আর এক জায়গায় লেখক ওখানকার তামার প্রসঙ্গে লিখেছেন : “প্রত্নবিভাগের রাসায়নিক পরীক্ষক মহাশয় অনুমান করেন, ইহা (তামা) হয়ত রাজপুতানা, বেলুচিস্থান অথবা পারস্য দেশ হইতে আনীত হইয়াছিল। মোহেন্-জো-দড়োতে প্রাপ্ত তামার গুণবিশিষ্ট তামা আফগানিস্থান, বেলুচিস্থান, রাজপুতানা এবং হাজারীবাগেও দেখিতে পাওয়া যায়।”
জনৈক ‘স্যার’ কিংবা ‘প্রত্নবিভাগের রাসায়নিক পরীক্ষক’ কিছু তথ্য দিলেই তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। আজগুবি তথ্য আজগুবিই থেকে যায়৷ ‘সাদৃশ্যযুক্ত সোনা’ বা একই ‘গুণবিশিষ্ট তামার’ গল্পটা কম আজগুবি নয়। খাঁটি সোনা বা তামার একটাই জাত। তাছাড়া ঐসব খনির ‘উদ্বোধন’ প্রাগৈতিহাসিক যুগে ঘটেছিল এ তথ্য যুক্তিগ্রাহ্য নয়৷ যুক্তিগ্রাহ্য নয় ধাতুর প্রাচীন প্রচলনের পুরো গল্পটাই। এ-সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা এ-বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে করা যাবে। (আদি প্রস্তর—নব্যপ্রস্তর – লৌহ — তাম্র—ব্রোঞ্জ যুগ—মার্কা নাম দিয়ে সভ্যতার কালপর্ব রচনার অভিনব উদ্যোগ যে মিথ্যার কারবারীরাই নিয়েছিলেন—এইটাই কেউ বোঝেননি। ডেনমার্কের ধনীপুত্তুরের খামখেয়ালের গল্পের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করা ঐ ‘আর্কিয়লজি’ নামক জ্ঞানের শাখাটি প্রচণ্ড মিথ্যায় ‘সমৃদ্ধ’। প্রাচীনকালে ঐসব ‘ধাতুযুগ’ ছিলনা।)
একই লিপিমালায় চার ধরণের লিপি থাকেনা
একই লিপিতে ‘অ্যালফাবেট’ ‘চিত্রলিপি’ ‘সিলেবারি’ এবং ‘ভাবলিপি’ লেখার ব্যবস্থাটা আজগুবি৷ আজগুবি কেন এ প্রশ্ন উঠবেই। সে প্রশ্নের উত্তর হিসাবে কিছু তথ্য দেওয়া যাক৷ এক, লিপি সম্পর্কে নানান জাতির ধারণার মধ্যে কোনকালেই সমতা ছিল না। এখনও নেই। এবং নেই বলেই নানান ধরণের লিপির জন্ম হয়েছে। জন্ম হয়েছে অন্য ধরণের লিপির প্রভাবে প্রভাবিত না হয়েই৷ নানান দেশে বিচ্ছিন্নভাবে অন্যনিরপেক্ষভাবেই নানান ধরণের লিপির জন্ম হয়েছে। একই ধরণের নানান লিপির মধ্যে একটার প্রভাব অন্যটিতে পড়েছে ঠিকই। ওড়িয়া লিপিতে বাংলা এবং নাগরী লিপির প্রভাব অস্বীকার করা যায়না । নানান ধরণের লিপির মধ্যে একের প্রভাব অন্যটিতে নেই। দুই, চিত্রলিপি থেকে অ্যালফাবেটে উত্তরণের তত্ত্বটা পণ্ডিতেরা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সে তত্ত্বের মধ্যে ছিল প্রচণ্ড ফাঁকি। ফাঁকিটা ধরে ফেলতেও খুব একটা অসুবিধা হয়নি। কারণ যেসব সুপ্রাচীন চিত্রলিপি থেকে ক্রমপরিবর্তনের সূত্রে অ্যালফাবেটের জন্মের গল্প বানানো হয়েছে এবং নানান তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে সেইসব প্রাচীন লিপির প্রচলনই ছিল না৷ তথাকথিত ইজিপ্টীয় হায়েরোগ্লিফিক বা সুমেরীয় চিত্রলিপি এবং ঐ লিপি থেকে উদ্ভুত বলে প্রচারিত কিউনিফর্ম লিপির প্রচলন ছিলইনা। ছিল না লিনিয়ার এ-বি নামারোপিত কোনও লিপির প্রচলন। ওগুলো সবই আধুনিক জালিয়াতি। ‘প্রাচীন ইতিহাস’ লেখার আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা ঐসব ‘লিপি’ তৈরী করে নিয়েছিলেন। করে নিয়েছিলেন লিপি সম্পর্কে নানান বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার তাগিদেই। প্রাচীন ইতিহাসের সুপরিকল্পিত কাঁচা মাল বানিয়ে রাখার উদ্যোগ আয়োজনের অংশ হিসাবেই যে ঐসব লিপির ‘উদ্ভাবন’ হয়েছিল এটা বুঝে নিতে কষ্ট হয়না। তিন, চিত্রলিপি বা ভাবলিপি থেকে অ্যালফাবেটে উত্তরণে সময় নেওয়ার তত্ত্বটিও সমান আজগুবি। চীনাভাষায় দীর্ঘকাল ভাবলিপির (ইডিওগ্রামের) ব্যবহার চলে আসছে৷ আজও সে লিপির অ্যালফাবেটে পরিবর্তিত হওয়ার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। আসলে লিপির পরিবর্তন সম্পর্কে পণ্ডিতেরা যত.তত্ত্ব আজ পর্যন্ত দিয়েছেন তা সবই ভ্রান্ত৷ সহজে ঐ পরিবর্তন হয় বলে তাঁরা রায় দিয়েছেন তা হয়না। কেন হয়না সে-প্রসঙ্গে আগের একটি অধ্যায়ে বক্তব্য রেখেছি।
একই সঙ্গে নানান ধরণের লিপির বিধান যে একটি ভাষায় হতে পারেনা এটা আগেই লিখেছি ৷ প্রশ্ন উঠবে ব্যতিক্রম কি নেই? আছে। জাপানী ভাষায় কাতাকানা, হিরাগানা এবং কাঞ্জি—এই তিন রকম মৌলিক লিপির ব্যবহার আছে। প্রথম দুটো সিলেবারি তৃতীয়টি ভাবলিপি। একই লেখায় কাতাকানা এবং কাঞ্জি কিংবা হিরাগানা এবং কাঞ্জি লিপি ব্যবহার করার রেওয়াজ যে জাপানী ভাষায় নেই তা নয়। রেওয়াজ আছে কারণ আধুনিককালে তৈরী করে নেওয়া ঐ দু-রকম সিলেবারির একটি এবং ভাবলিপির যুগপৎ ব্যবহার করার ব্যবস্থাটাকে ওঁরা সুবিধাজনক মনে করেছেন। মনে করেছেন কারণ লেখার ব্যাপারে সহজসাধ্যতা কিংবা বোঝার ব্যাপারে সহজবোধ্যতা আনার কাজে ঐ ব্যবস্থার কার্যকারিতা তাঁরা উপলব্ধি করেছেন। আসলে সহজবোধ্যতা আনার আধুনিক প্রয়াস হিসাবেই যে দু-রকম লিপি একই সঙ্গে ব্যবহার করা হয় এটা বুঝে নিতে কষ্ট হয়না। কাঞ্জিলিপির অধিকাংশ অক্ষরই অত্যন্ত জটিল। লিখতে সময়ও লাগে বেশী। আর ঐ কাতাকানা বা হিরাগানা দুটোই সরল লিপি। তাই একাধারে দু-রকম লিপির সহ-অবস্থান দেখে অবাক হওয়ার কোনও কারণই খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক বলে প্রচারিত মোহেন্-জো- দড়োর লিপিমালায় যুগপৎ চার ধরণের লিপির সহ-অবস্থানের গল্পটা এতই আজগুবি যে সেটা মেনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা।
যে ভাষায় ভাবলিপির প্রচলন আছে সে ভাষায় শুধু ভাবলিপিরই ব্যবহার হয়—সিলেবারি বা অ্যালফাবেটের ব্যবহার হয়না। আবার যে ভাষায় সিলেবারি প্রচলিত সে ভাষায় শুধু সিলেবারিরই চল। ভাবলিপি বা অ্যালফাবেটের চল নেই। যেমন আফ্রিকার আম্হারিক সিলেবারি। জাপানে যদিও ভাবলিপির সঙ্গে সঙ্গেই সিলেবারির প্রচলন আছে তবু বলব সেটা ব্যতিক্রম। সেদেশে দু-ধরণের লিপির সহাবস্থানের কারণ আগেই আলোচনা করেছি। আবার যেসব ভাষায় অ্যালফাবেটের ব্যবহার আছে সেসব ভাষায় শুধু অ্যালফাবেটই চলে। সিলেবারি বা ভাবলিপি থাকার প্রশ্ন ওঠেনা। ভারতবর্ষের লিপিগুলো না ভাবলিপি, না সিলেবারি, না অ্যালফাবেট। এদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘কারেক্টার’। পাঁচ রকম লক্ষণযুক্ত অক্ষর নিয়ে গড়ে উঠেছে ভারতীয় ‘কারেক্টার’। এ-কায়দাটা ভারতের নিজস্ব। ভারতীয় লিপির তামিল বাদে সবগুলোই ‘কারেক্টার’-ধর্মী। মোটকথা চার রকম চরিত্রের অক্ষরের সহ-অবস্থান কোনও ভাষাতেই থাকেনা। থাকতে পারেনা। থাকাটাই আজগুবি। মোহেন্-জো-দড়োর প্রচলিত লিপিতে ঐ আজগুবি ব্যবস্থা চালু থাকার প্রশ্নই ওঠেনা।
এহ বাহ্য৷ চার কায়দার লিপির সহ-অবস্থানের আজগুবি ব্যবস্থার কথা লেখার পরে আর এক খটকা এসে যাচ্ছে। নানান ধরণের লিপির মধ্যে তথাকথিত ‘চিত্রলিপি’-গুলো সবই যে মিথ্যার কারবারীদেরই ‘আবিষ্কার’। যতগুলো চিত্রলিপির সন্ধান পাচ্ছি তার সবই যে ওঁদেরই ‘সৃষ্টি’। তাহলে? চীনা ভাবলিপির মধ্যে সামান্য কিছু চিত্রলিপি-ধৰ্মী লিপি থাকলেও ওটা মূলতঃ ভাবলিপিই। সিলেবারি-লিপির যে দু-একটা নমুনা পাওয়া যাচ্ছে তাও ত’ দেখছি সবই আধুনিক উদ্ভাবন। ওগুলো যে খুব একটা প্রাচীন এও ত’ মনে করার কারণ দেখছিনা৷ বাকি থাকছে অ্যালফাবেট, ভাবলিপি আর কারেক্টার। আধুনিক কালে উদ্ভাবিত জাল লিপিগুলো বাদ দিলে থাকছে শুধু আজকের প্রচলিত লিপিগুলোই। স্বভাবতই কয়েকটি প্রশ্ন আসছে। তবে কি সিন্ধু লিপিটাকে ভারতীয় লিপিমালাগুলোর জনক সাজানোর ব্যবস্থা হয়েছিল? এবং সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল বলেই কি এটা কারেক্টার-ধর্মী? তবে কি ঐ লিপিমালায় অ্যালফাবেট, চিত্রলিপি, সিলেবারি এবং একম্বর শব্দের অস্তিত্বের নানান গল্পকথা ভাড়াটে পণ্ডিতেরা বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্যই বানিয়ে রেখেছেন? তাইত’ মনে হচ্ছে।
সিন্ধু সভ্যতা এবং উগ্রজাতীয়তাবাদী বাঙ্গালী পণ্ডিতের ভূমিকা
অত্যুৎসাহী পণ্ডিতের অভাব কোনও দেশেই নেই৷ মোহেন-জো-দাড়ো-হরপ্পার প্রত্ন-উপকরণের মধ্যে মাছ ধরার বঁড়শী পাওয়া গেছে৷ পাওয়া গেছে বেশ কিছু মাছেরও চিত্রকল্প। এ ছাড়া সরিষা চাষের ব্যবস্থাও যে ওখানে ছিল—এমন ইঙ্গিতও নাকি পাওয়া গেছে। এসব দেখেশুনে বাঙ্গালী পণ্ডিত লোভ সামলাতে পারেননি। পারার কথাও নয়। এ-সুযোগ কি ছাড়া যায়? ঋগ্বেদে পণি শব্দের উল্লেখ থাকাতে দ্রাবিড়-পণ্ডিত যদি উল্লসিত হতে পারেন বাঙ্গালী-ইবা কি দোষ করেছেন? মাছের ভক্ত বাঙ্গালীরা যে সিন্ধু সভ্যতার অসূরদেরই বংশধর এই উপাদেয় তথ্য উপহার দিয়ে বসলেন মোহেন্-জো-দাড়ো-হরপ্পা-মুগ্ধ (মো-ই-মুগ্ধ?) বাঙ্গালী পণ্ডিত ডাঃ অতুল সুর। তিনি লিখলেন :
“সিন্ধু -র অসূররা যে বাঙ্গালীদের পূর্বপুরুষ তা সহজেই অনুমেয়, ঋগ্বেদের ১ম মণ্ডলে (১/৫৩) বর্ণিত বঙ্গদ নামক অসূর বাঙ্গালী কিনা তা বিবেচ্য।”
উৎস : হিন্দু সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য—লেখক ডাঃ অতুল সুর।
ঋগ্বেদ-নামক পুণ্যগ্রন্থে যখন বঙ্গদ-নামক অসূরের নাম পাওয়া যাচ্ছে—আর মোহেন্-জো-দড়ো-হরপ্পায় যখন বাঙ্গালীর একান্ত প্রিয় খাবারের ইঙ্গিত রাখা হয়েছে—তখন মেনে নিতেই হয় তথ্যটি ‘বিবেচ্য। প্রশ্ন হল কোলাকুলি যে সেয়ানে সেয়ানেই হয়। কোলব্রুক সাহেবদের মিথ্যা বানানোর কারখানায় ‘ঋগ্বেদ’ লেখানোর আয়োজন হয়েছিল। সে আয়োজন যাঁদের উদ্যোগে করা হয়েছিল তাঁদের উদ্যোগেই যে ঐ মোহেন্-জো-দড়ো-হরপ্পার ‘প্রত্ন উপকরণ’ বানানো হয়েছিল। ঋগ্বেদে ‘বঙ্গদ’ শব্দটা পরিকল্পিতভাবেই রাখা হয়েছিল সম্ভবত অত্যুৎসাহী কিছু বাঙ্গালী পণ্ডিতকে বোকা বানানোর জন্যই। অসূর, পণি, বঙ্গ দ অধিবাসীবাচক নানান শব্দই রাখা হয়েছিল ঐ কেতাবে—বলা বাহুল্য নানান জাতের পণ্ডিতদের ‘গবেষণা’ করার সুযোগ করে দেওয়ার তাগিদেই৷
সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কর্মকাণ্ডে জড়িত অতুল সুর আরও কিছু তথ্য উপহার দিয়েছেন। সিন্ধু সভ্যতায় গণিতের ভূমিকা আলোচনা করতে গিয়ে তিনি এক জায়গায় লিখলেন :
“দৈর্ঘ্য মাপবার জন্য তারা যে দশমিক প্রথা ব্যবহার করত তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। সরু Shell-এর ওপরে 6.9 মিলিমিটার অন্তর দাগ দেওয়া একটা মাপকাটি থেকে।”
উৎস — সিন্ধু সভ্যতার স্বরূপ ও অবদান—লেখক শ্রীঅতুল সুর।
অকাট্য যুক্তি ত একেই বলে! 6.9 মিলিমিটার অন্তর দাগ দেওয়া মাপকাটি যখন পাওয়া গেছে—আর জনৈক পণ্ডিত ব্যক্তি যখন-তা জানিয়েছেন তখন তথ্যটি মেনে নিতেই হয়। প্রশ্ন হল মিলিমিটার-নামক দৈর্ঘ্য-এককটি কি প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে দুনিয়া জুড়েই চালু ছিল? এই আজগুবি কথা-প্রসঙ্গে আর কিছু লেখার দরকার বোধ করছি না। স্বভাবতই সন্দেহ আসছে তবে কি সুর-মশাই-ও মিথ্যার চক্রীদেরই একজন? না হলে ঐ ধরণের উদ্ভট তথ্যটি তিনি দিতে গেলেন কেন?
প্রাগৈতিহাসিক ‘সাম্রাজ্যের’ গল্প—ফরাসী পণ্ডিত রেনোর কীর্তি
ফরাসী ঐতিহাসিক রেনোর মতে সিন্ধু সভ্যতা নাকি কোনও দিক দিয়েই বেদের কাছে ঋণী ছিলনা। বেদও ঋণী ছিলনা ঐ সিন্ধু সভ্যতার কাছে ৷ সভ্যতা দুটো গড়ে উঠেছিল অন্যনিরপেক্ষ ভাবেই৷ তিনি এক জায়গায় লিখলেন :
“The Aryan tribes may well have overrun it (Indus civilization) without in any way being influenced by it, settling on the ruins of a decayed or decaying empire”
বানানো গল্পের উপর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রেনো সাহেব নিজেকেই প্রকাশ করে ফেলেছেন। তাঁর ঐ ‘তত্ত্ব-সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়োজন দেখছি না। তাঁর ব্যবহার-করা একটি শব্দ সম্পর্কেই বক্তব্য রাখছি। ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর উদ্যোগেই যে প্রাচীন ইতিহাস লেখানোর আয়োজন হয়েছিল এ কথা আগেই লিখেছি। মজার কথা এই যে ওঁদের তৈরী করে নেওয়া ‘ইতিহাস’- এর কল্যাণে দেশে দেশে প্রাচীন কালে কম ‘সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটেনি। ভারতে, চীনে, পারস্যে, মেসোপটেমিয়ায়, রোমে বা গ্রীসে সর্বত্রই একই খেলা ওঁরা খেলেছেন। সর্বত্রই ওঁরা ‘সাম্রাজ্য’ বানিয়েছেন। ‘সাম্রাজ্য’ ভেঙ্গেছেন—গড়েছেন। ভারতেও ঐ বস্তু কম বানানো হয়নি। কম বানানো হয়নি চীনেও৷ ‘ইং বিং মিং মার্কা কত সব নামই না পাচ্ছি! দেখে শুনে মনে হয় আধুনিক সাম্রাজ্যবাদীরা দেশে দেশে উপনিবেশ বানিয়ে এমন কি আর অপরাধ করেছেন। ওবস্তু যে ইতিহাসের জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের সঙ্গী। আমাদের অর্থে দুনিয়ার ইতিহাস- গর্বী সবদেশেরই। সাম্রাজ্যবাদীদের যৌথ উদ্যোগে লেখা ঐ ‘ইতিহাস-এ প্রাচীন সব ‘সাম্রাজ্যের’ পীড়ন-উৎপীড়নের ছবি আঁকা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম-নামক অত্যন্ত মূল্যবান আইডিয়া প্রসারে কিংবা কোনও মূল্যবান ধর্মের বিরুদ্ধতা করার কাজে ঐসব ‘সাম্রাজ্যের’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। ব্যবস্থাটা ভালোই। ধর্মটা যেন যুগ যুগ ধরেই বেঁচে আছে। সাম্রাজ্যবাদ-টাও যেন তাই। মজার কথা আরও আছে। শুধু ইতিহাসের জন্মলগ্নে ‘সাম্রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করেই ওঁরা ক্ষান্ত হননি৷ তথাকথিত প্রাক্-ইতিহাস-টাও (বলা বাহুল্য ওঁদেরই আরেক ‘সৃষ্টি’) সাজানো হয়েছে নানান ‘সাম্রাজ্য’ দিয়ে। প্রাগৈতিহাসিক রাষ্ট্রগুলোতে ঐজন্যই হরেক নামের ‘সাম্রাজ্য’ বানানোর প্রয়োজন ওরা বোধ করেছিলেন। রেনো-সাহেবের অন্য কিছু লেখার সুযোগ ছিলনা কারণ তিনি ছিলেন ঐ মিথ্যার চক্রীদেরই একজন। এবং তা ছিলেন বলেই ঐ ‘decayed or decaying empire’ এর বিভ্রান্তিকর তথ্যটি তিনি হাজির করেছিলেন।
তিন ‘সুপ্রাচীন’ সভ্যতার ঐক্য—গর্ডন চাইল্ডের বক্তব্য
সিন্ধু সিন্ধু, সুমের এবং ইজিপ্টীয় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যেসব প্রত্নউপকরণ পাওয়া গেছে বলে প্রচার করা হয়েছে সেসব কিছুর মধ্যে বেশ মিল খুঁজে পেয়েছেন পণ্ডিতেরা। মৌলিক ধ্যানধারণা এবং উদ্ভাবনী শক্তির দিক দিয়ে সভ্যতা তিনটির মধ্যে যে বেশ ঐক্য ছিল—এটা তাঁরা লক্ষ্য করেছেন। সভ্যতার উপকরণের দিক দিয়েও বেশ ঐক্য ছিল। যেসব ব্যাপারে ঐ ঐক্য ছিল সেগুলিকে গর্ডন চাইল্ড সনাক্ত করেছেন৷ নাগরিক জীবন, দানা শস্যের চাষ, গবাদি পশুকে পোষ মানানো, ধাতুনিষ্কাষণবিদ্যা, বয়নশিল্প, ইট এবং নানারকম পাত্র তৈরী করার কৌশল, নানান পাথর থেকে মালা তৈরী করার উপযোগী গুটিকা বানানো, রাজপট্ট বা নীলকান্তমণির প্রতি অনুরাগ এবং চিত্রিত মাটি বা চীনামাটির পাত্র বানানোর জ্ঞান—এই নটা ব্যাপারে যে সভ্যতাতিনটির মধ্যে লক্ষণীয় ঐক্য ছিল তা গর্ডনসাহেব তাঁর “New light on The Most Ancient East” নামক গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন । গর্ডন সাহেব প্রচণ্ড পরিশ্রমই করেছেন। তবে দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয় তিনি সন্দেহ করার ক্ষমতাটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন। নানান দেশের প্রাগৈতিহাসিক ধ্বংসাবশেষগুলোতে ‘প্রত্নউপকরণ’গুলো যে বেশ পরিকল্পিতভাবেই গুছিয়ে গাছিয়ে রাখা হয়েছিল—এইটাই তিনি ধরতে পারেননি৷ ‘প্রত্নউপকরণ’গুলোর সমধর্মিতাটাকে তিনি সন্দেহের চোখে দেখেননি। নেপথ্যশিল্পীদের সযত্নলালিত নানান তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার দায় যে ঐসব প্রাগৈতিহাসিক ধ্বংসাবশেষের ওপর চাপানো হয়েছিল—এই সোজা কথাটা হয় তিনি বুঝেও বোঝেননি— সেক্ষেত্রে তাঁকে মিথ্যার কারবারীদের শরিক হিসাবে সনাক্ত করে নিতে হয়—নয় তিনি কিছুই বোঝেননি৷
সূক্ষ্ম কাজেও ওস্তাদ ছিলেন প্রাগৈতিহাসিক ‘শিল্পী’
মোহেন্-জো-দড়োর লিপিগুলো শিলালিপি আকারে পাওয়া যায়নি ।
পাওয়া গিয়েছিল সীলমোহরে। সেসব সীলমোহরের প্রতীকগুলো সত্যিই দেখবার মত। পরিচিত জীবজন্তুর উদ্ভট রূপকল্প অনেক সীলমোহরেই রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। উদ্ভট জন্তু একশৃঙ্গী (unicorn)-র সংস্থান বেশ কিছু সীলমোহরে ছিল। ছিল নানান জীবজন্তুর প্রতিরূপ রাখার ব্যবস্থাও। রূপকল্পের মধ্যে যতই ঔদ্ভট্য থাক ঐসব সীলমোহরের উচ্চাবচতা (relief) সত্যিই প্রশংসনীয়। আজকের যুগেও ঐধরণের উন্নতমানের রিলিফযুক্ত সীল বানানোর শিল্পী ভারতে খুব কমই আছেন। ঐ ধরণের উঁচুদরের রিলিফ তখনকার দিনের মানুষ তৈরী করে নিয়েছিলেন এটা একটা আজগুবি কথা। আজগুবি কারণ সে যুগে সূক্ষ্ম কাজ করার মতন উপকরণ অঢেল ছিল এটা মনে করাটাই বাতুলতা। বলা হয়েছে ওসব নাকি ‘পাঞ্চ’ করা হয়েছিল। পাঁচ হাজার বছর আগে ‘পাঞ্চ’ করাটা হত কি দিয়ে এবং কিভাবে এ-প্রশ্ন তোলার দরকার ভারতীয় পণ্ডিতেরা কেউই বোধ করেননি। বোধ করেননি কারণ সাহেব পণ্ডিতেরা কেউই সে প্রশ্ন তোলেন নি।
হরপ্পার খবর বেদেও আছে!
তথাকথিত বৈদিকযুগে মৃতদেহ দাহ করার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। প্রচলিত ছিল সমাধি দেওয়ার ব্যবস্থাও৷ সমাধিতে মৃতব্যক্তির বাঁ হাতে তীরধনুক রাখার ব্যবস্থার কথা ঋগ্বেদে (১০, ১৮, ৯) আছে৷ মজার ব্যাপার, হরপ্পার Cemetary H চিহ্নিত সমাধির শবাধারে অঙ্কিত চিত্রে ঐ ব্যবস্থার ইঙ্গিত প্রতিফলিত হয়েছে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ( ১৪, ১৬, ১৮) সূক্তে সমাধি সম্পর্কিত আচার অনুষ্ঠান এবং বিশ্বাস সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে ঐসব চিত্রে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। তথাকথিত বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ড এবং মোহেন্-জো-দড়ো-হরপ্পার প্রত্ন- উপকরণের বক্তব্যের মধ্যে এরকম অনেক মিলই আছে। বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ নেই৷ প্রশ্ন হচ্ছে ঐসব মিল পাওয়া যাচ্ছে কেন। দু-রকম অনুমান করা যায়। এক, বেদবর্ণিত তথ্যের সঙ্গে মিল আছে এমন কিছু উপকরণ ঐ হরপ্পায় রাখার ব্যবস্থা হয়েছে অথবা হরপ্পায় প্ৰাপ্ত উপকরণ বা তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে ঋগ্বেদের ঐ অংশটা লেখা হয়েছে৷ দ্বিতীয় অনুমানটা গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রহণযোগ্য নয় কারণ হরপ্পার ঐসব উপকরণের বেশীর ভাগের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল ১৯২২ সালেরও পরে। (কিছু উপকরণ অবশ্য উনিশ শতকেই পাওয়া গিয়েছিল। পাওয়া গিয়েছিল কানিংহামের অনুসন্ধানের সূত্রে) ঋগ্বেদ পূর্ণতঃ প্রকাশিত হয়েছিল ওর চল্লিশ বছর আগেই। সিদ্ধান্ত একটিই তা হচ্ছে এই : ঋগ্বেদের ঐ অংশটি এবং সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কিত প্রচ্ছন্ন বক্তব্য সমৃদ্ধ সব অংশই ১৮২৬ সালের পরে লেখা। কারণ ঐ হরপ্পার তিবির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল ১৮২৬ সালে। তথাকথিত বক্তব্যসমৃদ্ধ প্রত্ননিদর্শনগুলো রাখার ব্যবস্থা হয়েছে পরে। অর্থাৎ ১৮২৬ সাল থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে কোনও এক সময়ে৷
হরপ্পার প্রাগৈতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত ধ্বংসাবশেষের খবর আঠারো শ’ ছাব্বিশ সালেই কর্তৃপক্ষ পেয়েছিলেন। এ-তথ্য ইতিহাসে পাওয়া যাচ্ছে। প্রশ্ন হল সে-তথ্য জানা থাকা সত্ত্বেও ওখানে খননকার্য বা অনুসন্ধানের কাজ প্রায় একশ’ বছর ফেলে রাখা হয়েছিল কেন? তবে কি ঐ সুদীর্ঘ সময়টা ‘প্রাগৈতিহাসিক’ কিছু উপকরণ, বিচিত্র-উদ্ভট আধাচিত্রলিপি—আধাঅক্ষরমার্কা ‘প্রাগৈতিহাসিক’ লিপিমালা উদ্ভাবনের জন্যই খরচ হয়েছিল? সন্দেহের আরও কিছু কারণ পাচ্ছি। তথ্যদৃষ্টে বুঝতে কষ্ট হয়না ঐ সময়েই (অর্থাৎ ১৮২৬ সালের পরে বেশ কয়েক বছর ধরে) বেদ-নামক পুণ্যগ্রন্থটি বৈদিক ভাষায় রচিত হচ্ছিল। ঐ বেদে হরপ্পার নাম জড়িয়ে কিছু গল্প লেখা হলে পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকদের বিভ্রান্ত করা যাবে—এই চিন্তা কি মিথ্যার কারবারীদের মধ্যে কাজ করেছিল? এবং সেই চিন্তাতেই কি ঐ হরপ্পার গল্পটা পবিত্র ঐ বেদে রাখা হয়েছিল? নাহলে হরিয়ুপিয়া নামক নদীর কথা ঐ বেদে পাচ্ছি কেন? হরপ্পা এবং হরিয়ুপিয়া নাম দুটোর মধ্যে ধ্বনিগত কিছু সাদৃশ্যত আছেই। অর্থহীন বিচিত্র ঐ “বৈদিক’ শব্দটা যে ঐ গল্পের স্বার্থে তৈরী করা হয়েছিল—এটা কি বলার দরকার আছে? বলে রাখা ভালো পরবর্তীকালের পণ্ডিতেরা ঐ ফাঁদেই পা দিয়েছেন। তাঁরা ঐ ধ্বনিসাদৃশ্য থেকে নানা তথ্য এবং কিছু তত্ত্বও তৈরী করে নিয়েছেন। সে তত্ত্বের উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছিনা। কারণ মিথ্যা থেকে তত্ত্ব তৈরী হয়না—তৈরী হয় মিথ্যার ডালপালা।
একটি নিবেদন
প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কিত এই প্রতিবেদনকে যাঁরা ভারতবিদ্বেষী অপপ্রচার বলে মনে করে বসবেন এবং বে-আইনী ঘোষণা করার দাবী তুলবেন- তাঁদের কাছে আমার নিবেদন এইঃ শুধু ভারতের ইতিহাস সম্পর্কেই আমার বক্তব্যটা সীমাবদ্ধ রাখিনি। বক্তব্য রেখেছি সারা দুনিয়ার প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কেই। মিথ্যাটা শুধু ভারত সম্পর্কেই বানানো হয়নি। হয়েছে দুনিয়া জুড়েই। সারা পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসটাই যে ভুয়ো ওসবই যে আধুনিককালে বানিয়ে নেওয়া কল্পনাবিলাস—ওসবই যে ইউরোপের রাষ্ট্রপোষ্য নেপথ্যশিল্পীদের চক্রান্ত—এইটা প্রমাণ করাই আমার উদ্দিষ্ট। শুধু ভারতেরটাই নয়। যদিও শুরু করেছি ভারত সম্পর্কিত আলোচনার মধ্য দিয়ে তবু বলব দুনিয়ার প্রাচীন ইতিহাস লেখার চক্রান্তটাকে ফাঁস করাটাই আমার মূল উদ্দেশ্য৷ তথ্যের জাল ছিন্নভিন্ন করে মূল সত্যে পৌঁছানোরই চেষ্টা করেছি। ভারতবিদ্বেষী অপপ্রচারের কিছুমাত্র অভিপ্রায় আমার নেই। এ-দেশ সম্পর্কে শ্রদ্ধাভক্তি কারুর চেয়ে আমার কম নেই। আসলে মিথ্যা ইতিহাসকে সত্যি মনে করে গর্ব বোধ করার কোনও যুক্তি খুঁজে পাইনি এবং পাইনি বলেই অপ্রীতিকর সত্যের সন্ধান করে নিতে কোনও কুণ্ঠাবোধ আসেনি। অকুণ্ঠচিত্তেই সবকিছু লিখেছি। ভারতের বাইরের প্রাচীন যুগের ইতিহাস লেখার পশ্চাতেও যে ঐ একই শিল্পীদের কর্মতৎপরতা কাজ করেছিল৷
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।