লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
এক সময় মানুষের ধারণা ছিল যে আর্য সভ্যতাই ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের ফলে এই ভ্রান্ত ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। তবে একথা অবশ্যই ঠিক যে ভারতীয় উপমহাদেশে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়েছে আর্যদের ভারত আগমনের পর থেকেই। আর্যদের সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক জীবনযাত্রা ও ধর্মবিশ্বাস আলোচনা পর্যালোচনা করে আর্য সভ্যতার পরিচয় দান করা হয়েছে। আর্য সমাজে ধর্ম ক্ষেত্রে বৈদিক ধর্মের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ভারতে জন্ম নিয়েছে দুটি নতুন ধর্মমত- জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম।
সংস্কৃত ভাষায় ‘আর্য’ শব্দের অর্থ হল ‘সদ্বংশজাত ব্যক্তি’। ম্যাক্সমুলার, স্যার উইলিয়াম জোন্স প্রভৃতি পন্ডিতদের মত অনুযায়ী ‘আর্য’ একটি ভাষাগোষ্ঠীর নাম। অর্থাৎ যাঁরা আর্য ভাষায় কথা বলেল তাঁরাই আর্য জাতির অন্তর্ভুক্ত। ফিলিপ্পো স্যাসেটি নামক ফ্লোরেন্সের এক বণিক গোয়াতে পাঁচবছর অবস্থান করার পর (১৭৮৩-১৭৮৮ খ্রিঃ) প্রথম সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে ইউরোপের প্রধান বেশ কয়েকটি ভাষার সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করেন।
১৭৮৬ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলে দেওয়া তাঁর বক্তৃতায় তিনি বলেন যে, একই উৎস থেকে উৎপত্তির কারণে এই সাদৃশ্য। তিনি মনে করেন, সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন, পারসিক, কেল্টিক, গথিক, জার্মান ইত্যাদি একই উৎস থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এই ভাষাগুলো পন্ডিতদের কাছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বা ইন্দো-জার্মান ভাষা রূপে পরিচিত। এই ভাষাগত সাদৃশ্যের কারণে কঠিন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে যে, যে জাতিগোষ্ঠী এই আর্য ভাষা ব্যবহার করতেন তাঁদের আদি বাসভূমি বা আদি নিবাস কোথায় ছিল? তাঁরা কোথা থেকে ভারতে আগমন করেছেন? এ সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। একদল মনে করেন যে, ভারতবর্ষই আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল। পরবর্তীকালে তাঁরা ভারতের বাইরে পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন। অন্য পণ্ডিতদের মতে, আর্যরা বাইরে থেকে এসে ভারতবর্ষে বসতি স্থাপন করে। যাঁরা মনে করেন যে ভারতবর্ষ আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল, তাঁরা নিম্নলিখিত যুক্তি পেশ করেছেন,
- (১) আর্যদের প্রাচীনতম গ্রন্থ হল ‘বেদ’। এই বেদ রচিত হয়েছিল ভারতের মাটিতেই। বেদের মধ্যে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের উল্লেখ রয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে যে সকল গাছ ও পশু-পাখির উল্লেখ রয়েছে সেগুলি ভারতের এই অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়।
- (২) পারগিটারের মনে করেন, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আর্যদের ভারত আগমনের কোন নির্দিষ্ট প্রমাণ ভারতের ইতিহাসে নেই, বরং উত্তর-পশ্চিম দিক হতে আর্যদের ভারতের বাইরে চলে যাওয়াটা সম্ভব। ঋগ্বেদের মধ্যে নদী স্তোত্রে যে নদীগুলোর নাম উল্লেখ হয়েছে তা গঙ্গা দিয়ে শুরু হয়ে উত্তর-পশ্চিম হয়ে সরস্বতী নদীতে দিয়ে শেষ হয়েছে। এই নদী স্তোত্র থেকে স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে আর্যরা পূর্ব থেকে উত্তর-পশ্চিমে গিয়েছিলেন।
- (৩) আর্যদের মধ্যে যাঁরা দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে গিয়ে বসবাস স্থাপন করেন তাঁরা তাঁদের আদি বাসভূমি অর্থাৎ ভারতের কথা স্মরণ করে থাকেন। কিন্তু বৈদিক সাহিত্যে ‘সপ্তসিন্ধু’ ছাড়া অন্য কোন দেশের উল্লেখ পাওয়া যায় না।
- (৪) আর্যরা যদি বহিরাগত হয় তাহলে তাঁদের আদি বাসভূমিতে বেদের মত কোন গ্রন্থ রচিত হওয়ার কথা ছিল? এসব যুক্তির অবতারণা করে কিছু পণ্ডিত দাবী করেন যে, আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল ভারতবর্ষ।
কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক এই যুক্তিগুলোকে খণ্ডন করেছেন। তাঁদের যুক্তিগুলো নিচে বর্ণনা করা হলঃ
- (১) বেদে যেসব গাছপালা ও পশুপাখির নাম উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলই ছিল আর্যদের আদি বাসস্থান বা আদি বাসভূমি। ভারতে যখন তাঁরা প্রবেশ প্রবেশ করেন প্রথমে তাঁরা ঐ অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করেন ফলে ঐ এলাকার গাছপালা ও পশুপাখির সঙ্গে তাদের প্রথম পরিচয় ঘটে। এ কারণেই উক্ত গাছপালা ও পশুপাখির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ এলাকাতেই বেদও রচনা করা হয়েছিল।
- (২) নদী স্তোত্র দিয়ে আর্য জাতির উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে বাইরে চলে যাওয়া প্রমাণ করা যায় না। প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে ৩৯টি নদীর নাম উল্লিখিত রয়েছে। তার মধ্যে ঋগ্বেদের মধ্যেই ২৫টি নদীর নাম পাওয়া যায়, কিন্তু গঙ্গা নদীর নাম শুধুমাত্র একবার উল্লেখ করা হয়েছে। আর্যরা ভারতের মূল নিবাসী বা আদিবাসী হলে এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেলে গঙ্গা নদীর সাথে তাদের নিবিড় সম্পর্ক থাকার কথা ছিল এবং সে ক্ষেত্রে গঙ্গা নদীর নাম বারবার উল্লেখিত হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তা হয়নি।
- (৩) ঋগ্বেদের মত উন্নত কোন গ্রন্থ অন্য কোন দেশে রচনা করা হয়নি বলেই একথা বলা যায় না যে ভারতই ছিল আর্য জাতির আদি নিবাস বা আদি বাসভূমি। এটাও হতে পারে যে ভারতে আগমনের আগে বেদের মত উন্নত গ্রন্থ রচনা করার মত প্রজ্ঞা ও সামাজিক উন্নয়ন তাঁদের ঘটেনি। তাছাড়া এও বলা যায় যে ভারতবর্ষ আর্যদের আদি বাসভূমি বা আদি নিবাসী হলে তাঁরা ভারত ছাড়ার আগেই গোটা ভারতবর্ষে আর্য বসতি ও সংস্কৃতি বিস্তার করে ফেলতেন। কিন্তু উত্তর ভারতের বহু এলাকা এবং দক্ষিণ ভারত ছিল আর্য সংস্কৃতির ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
- (৪) এটাও হতে পারে যে সুদীর্ঘকাল ধরে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বসবাস করার ফলে আর্য জাতি তাঁদের আদি বাসভূমির সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলেন বলেই বেদে তার কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না।
- (৫) সংস্কৃত ভাষার মধ্যে তালব্য বর্ণের (ন, ং, ৎ) প্রাধান্য দেখা যায় যা ইউরোপীয় অন্য কোন ইন্দো ইউরোপীয় ভাষার মধ্যে নেই। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে, ইউরোপ থেকে ভারতে আগমনের পর দ্রাবিড় ভাষার প্রভাবে এমনটা হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে বন্য পশুদের মধ্যে সিংহের উল্লেখ করা থাকলেও বাঘ ও হাতির কোন উল্লেখ নেই। আর্যরা ভারতের আদিবাসী বা মূল নিবাসী হলে ভারতের এই দুটি প্রাণীর নামের উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে অবশ্যই থাকা উচিৎ ছিল। কিন্তু নেই।
সায়ন দেবনাথ লিখেছেন, “আর্যরা ভারতীয় না অভারতীয় সেই বিতর্কে ঐতিহাসিক মহলে নানা মুনির নানা মত। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠই আর্যরা অভারতীয় এই মতে বিশ্বাসী। জ্যোতির্বিদ রাজেশ কোচাহার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ‘বেদাঙ্গ জ্যোতিষ’ গ্রন্থের বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে,এই গ্রন্থে সর্বদীর্ঘ দিন ও ক্ষুদ্রকালীন রাতের যে তথ্য রয়েছে, তার অনুপাত করলে হয় ৩ঃ২। এই প্রকার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন অঞ্চলের সম্ভাব্য অবস্থান হতে পারে ৩৫ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখা। একমাত্র হরপ্পা সভ্যতার শোরটুগাই ছাড়া আর অন্য কোন অঞ্চল এত উচ্চ অক্ষরেখায় অবস্থিত নয়, সুতরাং সামগ্রিক ভাবে আর্যরা ভারতীয় হতে পারে না। আবার কলিন রেনফ্রিউ এর মতে, ঋগ্বেদে কোথাও বলা হয়নি যে আর্যরা বহিরাগত সুতরাং এটার সম্ভবনাই প্রবল যে আর্যরা বেদ রচনার বহু পূর্বেই ভারতে এসে বসতি স্থাপন করেছিল।” [এম ফিল, প্রথম বর্ষ প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, তথ্যসূত্রঃ মুক্তমনা]
এসব যুক্তি দ্বারা ঐতিহাসিকেরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে আর্য জাতির আদি বাসভূমি ছিল ভারতের বাইরে। তাঁরা ভারত আক্রমণ করে ভারতবর্ষ দখল করেছিলেন।
বেশ কিছু হিন্দু ধর্মগুরুও স্বীকার করেছেন যে আর্যরা ভারতের বাইরে থেকে এসেছে। তাঁদের মধ্যে আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ স্বরস্বতী মন্তব্য করেছেন যে, আর্যরা তিব্বত থেকে এসেছে। তাঁর মতে তৎকালীন তিব্বত ভারতেরই অংশ ছিল। যদিও ঐতিহাসিক বিচারে আর্যরা তিব্বত থেকে এসেছিলেন এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না। অপরদিকে বাল গঙ্গাধর তিলক মনে করতেন আর্যরা ভারতে ১০ হাজার বছর আগে আর্কেটিক থেকে ভারতে আগমন করে। আরএসএস এর প্রধান এমএস গোলওয়ালকার বাল গঙ্গাধর তিলকের মন্তব্যকে স্বীকার করে বলেছেন যে, বাল গঙ্গাধর ঠিকই বলেছেন আর্যরা ভারতে ১০ হাজার বছর আগে আর্কেটিক থেকে ভারতে আগমন করে, তবে আর্কেটিক তখন ভারতেরই অংশ ছিল। সুতরাং বিভিন্ন হিন্দু ধর্মগুরুরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে বর্তমান ভারতের ভৌগলিক সীমারেখার বাইরে থেকে আর্যরা ভারতে আগমন করেন। যদিও তাঁদের এই মন্তব্যের কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়না।
বহু ঐতিহাসিক এমন রয়েছেন যাঁরা মনে করেন যে, আর্যরা ইউরোপ থেকে ভারতে আগমন করেছিলেন। তাঁদের যুক্তিগুলো নিচে পেশ করা হলঃ
- (১) বৈদিক সাহিত্যে ওক, উইলো, বার্চ প্রভৃতি গাছ এবং ঘোড়া, গাভী, ষাঁড়, শুয়োর প্রভৃতি জন্তুর উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচ্য দেশের জীবজন্তু যেমন হাতি, বাঘ, উট ইত্যাদির জন্তুগুলির কোনো বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে নাম বা উল্লেখ নেই।
- (২) আর্য ভাষাগোষ্ঠীর সাতটি ভাষা রয়েছে, তাদের মধ্যে পাঁচটি ভাষা এখনও ইউরোপের ভাষা, শুধুমাত্র সংস্কৃত ভাষা ও পারসিক ভাষা ইউরোপের বাইরের ভাষা। ইউরোপে গ্রিক, জার্মান ল্যাটিন, প্রভৃতি আর্য ভাষাগুলোর যেরকম ঘন সন্নিবেশ লক্ষ্য করা যায় ভারতে তা লক্ষ্য করা যায় না। ইউরোপে আর্য গোষ্ঠীভুক্ত ভাষার অধিক লক্ষ্য করা যায়, সেজন্য একদল ঐতিহাসিক মনে করেন যে, প্রাচীন যুগে আর্য জাতি ইউরোপের মধ্যেই বসবাস করতেন।
- (৩) অধ্যাপক গাইলস মনে করেন, আর্য জাতির আদি নিবাস বা বাসভূমি ছিল দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপ। আদি ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাযর মধ্যে সমুদ্রের কোন উল্লেখ না থাকায় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে আর্য জাতির যদি বাসভূমি কোন দ্বীপে বা সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে ছিলনা। আর্যরা যেসব গাছপালা ও পশুপাখির নাম উল্লেখ করেছেন সেগুলো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের আর্যরা তখন স্থায়ীভাবে বসবাস এবং কৃষিকাজ শুরু করেছিলেন। আর্যদের গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, ঘোড়া ও ভেড়ার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রযয়োজন ছিল। সুতরাং ধরে নিতে হবে যে আর্যদের আদি বাসস্থান এমন একটি অঞ্চলে ছিল যেখানে কৃষিকাজ ও চারণযোগ্য প্রাকৃতিক পরিবেশ কোনটিরই অভাব ছিলনা। সেখানে কৃষিকাজের জন্য কৃষিযোগ্য জমি, ঘোড়া চারণের জন্য বিস্তীর্ণ স্তেপ এবং ভেড়া চরানোর জন্য উঁচু জমি- সবকিছুই ছিল। এসব অনুকুল পরিবেশের দিকে লক্ষ রেখে অধ্যাপক ডঃ গাইলস বর্তমান অষ্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি অঞ্চলকেই আর্য জাতির আদি বাসভূমি বা আদি নিবাস হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।
অপরিকে অধ্যাপক ব্র্যান্ডেস্টাইনের বক্তব্য হল, উরাল পর্বতের দক্ষিণ দিকে কিরঘিজ স্তেপ অঞ্চলই ছিল আর্য জাতিরর আদি নিবাস বা আদি বাসভূমি। এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য অধ্যাপক ব্র্যান্ডেস্টাইন শব্দতত্ত্বের সাহায্য নিয়েছেন। তিনি মনে করেন, প্রথম দিকের ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দাবলীতে কোন পর্বতমালার পাদদেশে বিস্তীর্ণ স্তেপ ভূমিতে আর্য জাতির আদি নিবাসের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পরবর্তীকালের ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দাবলীতে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির গাছপালা, জমি এবং বিভিন্ন জীবজন্তুর সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে শুষ্ক স্তেপভূমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শব্দাবলীর পরিবর্তে জলাভূমির সুস্পষ্ট ইঙ্গিতবাহী শব্দাবলী পাওয়া যায়।
বর্তমানে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই ব্র্যান্ডেস্টাইনের মতকে সমর্থন করেছেন এবং তাঁরা মনে করেন যে, কিরঘিজ অঞ্চলই আর্য জাতির আদি নিবাস বা আদি বাসভূমি।
আর্যদের প্রাচীনতম সাহিত্য হচ্ছে ‘বেদ’। চারটি বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ সবথেকে প্রাচীনতম গ্রন্থ। বেদ প্রথমে লিখিত গ্রন্থ আকারে লিপিবদ্ধ ছিলনা। ঋগ্বেদের স্তোত্রগুলো সর্বপ্রথম রচিত হয় এবং ‘শ্রুতি’ বা কানে শুনে মুখস্থ রেখে বা আবৃত্তির মাধ্যমে বহুকাল বংশ পরম্পরায় থেকে যায়। বহুকাল পরে বেদকে লিপিবদ্ধ করা হয়। ঋগ্বেদের সঠিক রচনাকাল আবিস্কৃত হলে আর্যদের ভারতে আগমনের সময় নির্ধারণ করা যায়। জার্মান পন্ডিত ম্যাক্সমুলার মনে করেন, আর্যগ্রন্থ ঋগ্বেদ কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে রচনা করা হয়নি। ঋগ্বেদের বিভিন্ন অংশ বা স্তোত্রগুলো বিভিন্ন সমযয়ে রচনা করা হয়েছিল। তিনি মনে করেন, ১২০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ঋগ্বেদ রচনা করা হয়েছিল।
উইন্টারনিস ঋগ্বেদ ও প্রাচীন পারসিক ধর্মগ্রন্থ জেন্দ আবেস্তার ভাষার মধ্যে অসাধারণ সাদৃশ্য লক্ষ্য করে মনে করেন যে, দুটি গ্রন্থই সমসাময়িককালে রচনা করা হয়েছিল। তবে বেদে যেখানে ‘দেব’ শব্দটি অত্যন্ত পবিত্র সত্ত্বা রূপে বর্ণিত হয়েছে সেখানে আবেস্তাতে ‘দেব’ শব্দটি অত্যন্ত নেতিবাচক রূপে বর্ণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে আবেস্তায় ‘অসুর’ শব্দটির স্তুতি বন্দনা করা হয়েছে।
আর্যরা যে ভারতের বাইরে থেকে আগমন করেছিলেন তা স্পষ্ট। এক্ষেত্রে মধ্য এশিয়ায় আর্যদের উৎস অনুসন্ধান করলে অনেক সমস্যার সমাধান করা যাবে। আর্য সমস্যার সমাধানের সবচেয়ে কার্যকারী পদ্ধতি হল বিভিন্ন আর্যদের উৎসের খননকার্য। বিশেষ করে তুরস্ক, ইরান, ইরাক প্রভৃতি মধ্য এশিয়ার আর্য সভ্যতার প্রচুর উপাদান লুকিয়ে রয়েছে। সাম্প্রতিককালে তুরস্কের গোবেকেলি অঞ্চলে আবিস্কৃত প্রায় ৭০০০ বছরের প্রাচীন মন্দির ও ইউক্রেনে প্রাপ্ত স্বস্তিকা প্রতীক পাওয়া যায়।
আর্যরা বিদেশ থেকে ভারতে এসেছিলেন এটা প্রমাণ হয় দেবরাজ ইন্দ্রের ঘটনা থেকে। কারণ বেদে ইন্দ্রকে ‘পুরন্দর’ রূপে অভিহিত করা হয়েছে, যেহেতু দেবরাজ ইন্দ্র ‘হরি-গুপয়’ এর যুদ্ধে পুর বা নগর ধ্বংস করেছিলেন; আর এই হরিগুপয় হল হরপ্পা হরপ্পার বেশ কিছু সাইটে প্রাপ্ত কঙ্কালগুলির আঘাত পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে অতর্কিত আক্রমণে এদের মৃত্যু হয়েছে তাছাড়া অনেক জায়গায় কঙ্কালের স্তুপ পাওয়া গেছে, যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে এগুলির কোন রীতি মেনে সৎকার করা হয়নি। হরপ্পা সভ্যতার পতনের জন্য যে বৈদেশিক আক্রমণকে দায়ী করা হয়, সেই বিদেশী আক্রমণকারীরা আর অন্য কেউ নয়, তারাই হল আর্য যাদের নেতৃত্য দিয়েছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। সুতরাং আর্যরা বিদেশী ছিল একথা অকপটে আমাদের মেনে নিতেই হবে। শুনতে খারাপ লাগলেও এটা স্বীকার করতেই হয় যে বৈদিক সভ্যতার জন্মদাতারা ভারতের সুপ্রাচীন নগর সভ্যতাকে নির্মমভাবে ধ্বংস করেছিল এবং তারা কোনদিনই নগর সভ্যতার নিরিখে প্রাচীন ভারতীয়দের সাথে পাল্লা দিতে পারেনি।
ভাষাতাত্ত্বিক পন্ডিতদের মতে আবেস্তা আনুমানিক প্রায় ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচনা করা হয়েছিল। কাজেই ঋগ্বেদের রচনার সময়কালও ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হতে পারে। এশিয়া মাইনরের অন্তর্গত বোঘাজকোই নামক স্থানে খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। এতে বৈদিক দেবতা ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র প্রমুখের অনুরূপ নাম আছে। এ থেকে মনে করা যায় যে ঋগ্বেদের রচনা শুরু হয়েছিল ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। অধ্যাপক ব্যাশাম মনে করেন যে, ঋগ্বেদের রচনা কাল ছিল ১৫০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
ঐতিহাসিকদের মতে, আর্যরা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ভারতে আগমন করেছিলেন। ঋগ্বেদে আর্যদের ভারতবর্ষে বসতি স্থাপন করা ও বিস্তার সম্পর্কে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য মেলে। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে আর্যদের ভারতবর্ষে বসতি স্থাপন করা ও বিস্তার সম্পর্কে আরো কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়।
ডঃ সুকুমারী ভট্টাচার্যের লিখেছেন- “সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকে আর্যরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে দু-তিনবার দু-তিন দলে ভারতবর্ষে আসে। যারা বেদ নিয়ে এসেছিল তারা হয়তো খ্রীষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের কাছাকাছি কোনো সময়ে এখানে পৌঁছয়, তবে তাদের আগেও এখানে অন্য আর্য দল এসেছিল। আর্যরা যখন মধ্যপ্রাচ্য বা ইরান থেকে আসে তখন চাষের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ পরিচয় থাকলেও ঐ দীর্ঘ পথ তারা পশুচারী যাযাবর হিসেবেই আসে। ঐ পথে বহু মানুষ গরু-মোষ ভেড়া-ছাগল নিয়ে তারা আসছিল। তখন তাদের খাদ্য ছিল মাংস, দুধ, দই, ঘি, ছানা, ছাতু, মধু ইত্যাদি। ভারতবর্ষে পৌঁছতে তাদের অনেক সময় লেগেছিল এবং সে সময়টা কাটে যাযাবর ভাবেই। পথের মধ্যে কোথাও কোথাও কিছুদিন ধরে বাস করলেও স্থায়ী জীবনযাত্রার সুযোগ তো ছিল না, ফলে বীজ বুনে ফসল তোলবার মতো সময় তাদের হাতে থাকত না।
আর্যদের সম্বন্ধে জানবার প্রধানো প্রায় একমাত্র সূত্র হলো বেদঃ আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক, যাঁরা মাটি খুঁড়ে পুরনো সভ্যতার অবশেষ বের করেন, তাঁদের পাওয়া বস্তুগুলি থেকেও খানিকটা জানা যায়। বেদের সময়কার উৎখননে প্রায় তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি ফলে বৈদিক সাহিত্যই আমাদের কাছে খুব বড় উৎস আর্যদের প্রথম দিকের জীবন সম্বন্ধে খবর সম্বন্ধে।” (প্রাচীন ভারত, ডঃ সুকুমারী ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা-১১, প্রকাশনাঃ ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড)
মূলত আর্যদের ভারত আগমনের সময় জানার জন্য প্রয়োজনে প্রথম দৃষ্টিপাত করা হয় বৈদিক সাহিত্যের প্রতি। বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ ঋগ্বেদের রচনাকাল জানা-ই এক্ষেত্রে গবেষকদের জন্য বিশেষ অত্যান্ত জরুরি ছিলো। কিন্তু এ-বিষয়ে সবচাইতে সমস্যার বিষয় হলো ঋগ্বেদ শুরুতেই লিখিত রূপ পায়নি। অনেককাল পর্যন্ত তা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে ছিলো যা এর আগে বলা হয়েছে। এই সংকটের জট খোলার চেষ্টা প্রথম করেন জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্স মুলার (Friedrich Max Muller, 1823-1909 A.D.)।
এ কে এম শাহনাওয়াজ-এর ‘ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস প্রাচীন যুগ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়- “তিনি (ম্যাক্স মুলার) একটি গণনা পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন যাকে বলা হয় ‘Date reckon backward’ বা পেছন দিকে গণনার পদ্ধতি। এর মূল কথা হচ্ছে কোন একটি নির্দিষ্ট সময় থেকে শুরু করে পেছনের দিকে গুনে যাওয়া এবং এভাবে প্রাচীন কোন ঘটনার সময় নির্ধারণ করা। ‘ম্যাক্স মুলার’ এ পদ্ধতির গবেষণা করতে গিয়ে বৈদিক সাহিত্যসমূহকে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি এসব সাহিত্যের ভাষাগত, ভাবগত ক্রমবিবর্তনের দিকে লক্ষ দেন। এভাবে তিনি বৈদিক সাহিত্যকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেন। প্রথম পর্যায়ে রচিত হয় ঋগ্বেদ এবং তার পরে সাম, যজু ও অথর্ববেদ। দ্বিতীয় পর্যায়ে রচিত হয় ‘ব্রাহ্মণ’। আর শেষ পর্যায়ের রচনা ছিল ‘উপনিষদ’। ম্যাক্স মুলার উপনিষদের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের আদি রূপের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। এ কারণে তিনি মন্তব্য করতে পেরেছেন যে, উপনিষদের বিন্যাস ঘটানো হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। ১০৮টি উপনিষদ তৈরিতে সময় লেগেছিল কমপক্ষে দু’শো বছর। সে কারণে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে শুরু হয় উপনিষদের গঠন এবং তা শেষ হয় খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে।”
এই গণনা পদ্ধতির পথ অবলম্বন করে ম্যাক্স মুলারের পক্ষে মন্তব্য করা সম্ভব হয়েছে যে, ঋগ্বেদের গঠনকাল ছিল ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। ম্যাক্স মুলারের এ সিদ্ধান্ত বিংশ শতাব্দীর সূচনাকাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তুরস্কের বোঘাজকুই (Boghajkay) অঞ্চলে পাওয়া যায় একটি শিলালিপি। এটি ছিল দুই রাজার সন্ধি চুক্তি। চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। চুক্তির সাক্ষী হিসাবে চার জন দেবতার নাম লেখা হয়েছে। এঁদের দু’জন হচ্ছেন ইন্দ্র ও বরুণ। ঋগ্বেদ থেকে জানা যায় ইন্দ্র ও বরুণ বৈদিক আর্যদের দেবতা। ম্যাক্স মুলারের বক্তব্যের সমর্থনে এই শিলালিপি ভাষ্য থেকেও মনে করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের দিকে ঋগ্বেদের বিন্যাস ঘটানো হয়েছিল। ফলে আর্যদের ভারতে আগমন এরও শতাধিক বৎসর পূর্বে ঘটে থাকবে।
ঋগ্বেদের মধ্যে আফগানিস্তানের কাবুল ও স্বাত, পাঞ্জাবের বিপাশা, শতদ্রু, চন্দ্রভাগা, ইরাবতী, ঝিলাম এবং সিন্ধু ও সরস্বতী নদীর নাম পাওয়া যায়। হিন্দুকুশ পর্বতমালার গিরিপথ দিয়ে আর্যরা ভারতে অনুপ্রবেশ করে এবং প্রথমে আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে তাঁরা বসতি স্থাপন শুরু করেন। আফগানিস্তান সীমান্ত থেকে পাঞ্জাবের সীমান্ত পর্যন্ত এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে আর্যরা ‘সপ্তসিন্ধু’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে বৈদিক সাহিত্য ঋগ্বেদের প্রথম দিকের স্তোত্রগুলোতে ভারতের প্রধান নদী গঙ্গা বা যমুনার কোন নাম উল্লেখ করা নেই। অধ্যাপক রোমিলা থাপারের মতে, ঋগ্বেদের যুগে আর্যরা দিল্লী অঞ্চল পর্যন্ত তাদের বসতি বিস্তার করেছিল। পরবর্তীকালে আর্যরা আরো পূর্বদিকে তাদের বসতি বিস্তার করে। পরবর্তী বৈদিক উৎসগুলােতে দুটি সাগর এবং হিমালয় ও বিন্ধ্য পর্বতের উল্লেখ পাওয়া যায়। গাঙ্গেয় উপত্যকার আবহাওয়া তখন ছিল আর্দ্র ও বৃষ্টিবহুল। ফলে পাথর, ব্রোঞ্জ ও তামার হাতিয়ার দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে খুব দ্রুত পূর্বদিকে বসতি স্থাপন সম্ভব ছিলনা। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দের দিকে লােহার প্রচলন ঘটলে আর্যরা দ্রুত বসতি বিস্তার করতে সক্ষম হয়। লােকসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে গােচারণ ভূমি, বনজ সম্পদ এবং কৃষি ক্ষেত্রের ওপর চাপ পরে। পূর্ব ভারতের গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা ছিল উর্বর এবং খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ। এসব সম্পদের লােভে এবং পাঞ্জাবে স্থানাভাবের কারণে আর্যরা পূর্ব ভারতের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যসভ্যতার কেন্দ্র পাঞ্জাব থেকে মধ্যদেশ বা গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় সরে আসে। দক্ষিণ ভারতে আর্যসভ্যতা বিস্তার সম্পর্কে সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না। দক্ষিণ ভারতে আর্য সভ্যতা সম্পূর্ণভাবে বিস্তার লাভ করেনি।
Download the Nobojagaran App