লিখেছেনঃ ডঃ বিধান মুখোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম জেলা এই বাঁকুড়া। শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধূলা, উৎসব, অনুষ্ঠান, মেলা কোনােদিক থেকেই অন্যান্য জেলা অপেক্ষা পিছিয়ে নেই। হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, জৈন প্রভৃতি ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস এখানে। হিন্দু ধর্মের বাঙালী জাতির মধ্যে অনেক শ্রেণির জাতির মানুষের সন্ধান মধ্যযুগ থেকেই পাওয়া যায়। আধুনিক যুগে সাংবিধানিক পরিভাষায় যারা হরিজন বা তপশিলীভূক্ত জাতি ও উপজাতি, হিন্দু বর্ণব্যবস্থায় পূর্বে ছিলেন এঁরা নিম্নবর্ণ বা অন্ত্যজ, অর্থাৎ হিন্দু শাস্ত্রের চতুবর্ণ প্রথার বহির্ভূত। নৃতাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় তপশিলীভুক্তদের মধ্যে কয়েকটি বর্ণ বা জাতি যেমন নমঃশূদ্র, পৌণ্ড, জেলে, ধােপা, শুঁড়ি প্রভৃতি হিন্দুর উচ্চ ও মধ্যবর্ণের নৃতাত্ত্বিক গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। আবার ডোেম, চামার, বাউরী, বাঙ্গী, রাজবংশী কেউ কেউ অস্ট্রিক গােষ্ঠীভুক্ত, কেউবা মােঙ্গল গােষ্ঠীভুক্ত। এদের মধ্যে আলােচ্য বিষয় বাউরী। এদের মুখে উচ্চারিত ভাষা নিয়ে আগ্রহ ছিল বহুদিনের। এছাড়া এদের নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি আছে যা বর্তমানে প্রায় অপসৃয়মান। বাঙালী সমাজের এই তপশিলী জাতিটি আজন্ম পিছিয়ে পড়ে আছে সবদিক থেকে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সমাজে মর্যাদাপূর্ণ জায়গায় প্রতিষ্ঠা কোনােদিক থেকে এদের কোনাে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। তাই এই পিছিয়ে পড়া জাতিটির বিশেষত ভাষা ও সংস্কৃতির একটি পূর্ণাঙ্গ রূপের মধ্যে তাদের সমাজের অতীত ঐতিহ্য খোঁজার জন্য এই ক্ষুদ্র আয়ােগ পরিকল্পনা। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, সমগ্র ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এই জাতিটির বাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কেমন তাদের জীবনধারণ, কেমন তাদের উৎসব-পার্বণ, কেমন তাদের রীতিনীতি বিশেষ করে বাঁকুড়া জেলায়, সেই অনুসন্ধান এই কর্মের উদ্দেশ্য।
নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
নৃতত্ত্বের বিচারে রাঢ় বাংলার প্রাচীনতম অধিবাসীদের মূলত আদি অস্ট্রেলীয় বা প্রােটো অস্ট্রেলিয় নরগােষ্ঠীরই সর্বাধিক সংমিশ্রণ ঘটেছে। যারা ভেডদিড নামেও পরিচিত বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞ নীহাররঞ্জন রায়। হিন্দু সমাজের তথাকথিত অন্ত্যজ বা তপশিলীভুক্ত জাতিসমূহের মধ্যে বাগদী, ডােম, মাল, মুচি, বাউরী ইত্যাদি। এদের নৃতাত্ত্বিক বনিয়াদটি গড়ে উঠেছে মূলত আদি অস্ট্রেলিয় উপাদান দিয়ে। তাই আজও এসব জাতির মানুষদের অবয়ব ও চেহারার মধ্যে আদি অস্ট্রেলীয় লক্ষণগুলি সুস্পষ্টভাবে চিনে নিতে কোনাে অসুবিধা হয় না। যেমন গায়ের রং কালাে, মাথার চুল ঢেউ খেলানাে, ঠোট ঈষৎ পুরু, নাক চওড়া ও মােটা, মাথার আকার লম্বা বা মাঝারি তবে এসব বৈশিষ্ট্যগুলি বাউরী-বাগদী-ডােমদের তুলনায় রাঢ় বাংলার সাঁওতালি বা কোনাে সম্প্রদায়ের মধ্যে আদি অস্ট্রেলিয় জাতির বিশেষ লক্ষণগুলি যেন তীক্ষভাবে ফুটে ওঠে। সর্বপ্রধান নৃতাত্ত্বিক উপাদান আদি অস্ট্রেলীয় ও খুব স্বল্প পরিমাণে দ্রাবিড় ঐতিহ্য এই দুই সমন্বয়ে জনগােষ্ঠীকে খুঁজে নিতে কোনাে অসুবিধা হয়নি।
বাউরীদের উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে পণ্ডিতমহলে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। কেউ বলেন এরা বহিরাগত। যেমন দুঃখভঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে “বাউরী শব্দটি সম্ভবত বহিঃ-বহির্গত বা বহিরাগত থেকে এসেছে আমরা ঘর পালানাে ছেলেমেয়েকে বাওরি বলি। অবহেলিত, উপেক্ষিত, আত্মভােলা ছেলেকে বাউরী বলে গালি দিতে শােনা যায়।”২ অবশ্য এই মতটিকে সমর্থন করা যায় না কারণ বাউরী তপশীলি জাতিটি বহিরাগত নয়। এরা ভারতের অনার্য জাতি। এ প্রসঙ্গে ডালটন ও রিসলের অভিমত, বাউরীদের মূল জনগােষ্ঠী যে এথনিক গ্রুপ সে সম্বন্ধে তাঁরাও নিঃসন্দেহ হতে পারেননি। ডালটন অনুমান করেছিলেন যে, বাগদী ও বাউরীরা একই আদিম গােষ্ঠী থেকে উদ্ভূত এবং পরবর্তীকালে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সংস্পর্শে এসে মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হারিয়ে ফেলেছিলেন। গায়ের রং ও চেহারা দেখে রিসলে অনুমান করিলেন যে, বাউরীরা অনার্যসম্ভুত-
“Bauri, a caltivation earth working and Palanquin bearing caste of Western Bengal, whose fearures and complexion stamp them as of non-Aryan descent, although evidence is wanting to affliate them to any particular tribe now in existence.”৩
এদের গােত্র সম্বন্ধে Dr.Sashmal তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন— “a only one gotra called ‘Kashyap’ is found to exist among the Bauris. All individuals of different sub-castes belong to this particular gotra and as such, the rule of exagamy in connection with gotra is totally absent here. Although they have secured a place in the Hindu social system yet traces of totemism still survive amongst them.”8
নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দিতে গিয়ে Dr. Hiteshranjan Sanyal বলেছেন—
“The major bulk of the population of the Bankura district today is composed of the tribals, such as Santal, Kora and Bhumij and the auto chthonous Aytyaj castes like the Bauri, Khaire, Dom, Bagdi, Majhi, Mal, Hari and Lohar who may have been originally tribals but were later absorbed within the fold of the Hindu society as the lowest ranking ‘Antyaj Castes….apparently the tribals and the Antaj castes wee more important in Bankura in the 16th and 17th centuries when the Malla rajas considerated their Powers,”৫
ওল্ডহাম অনুমান করেছিলেন বাউরীদের নিজস্ব ভূমি ছিল পরগণা শেরগেড়ে। কাকসা থানা এলাকা বাদে বর্তমানে রাণীগঞ্জ মহকুমার প্রায় সমগ্র অংশ পরগণা শেরগেড়ে-র অন্তর্ভুক্ত ছিল। কোনাে এক সময় দামােদরের দক্ষিণ তীরে গিয়ে তাঁরা বসবাস গড়ে তুলেছিলেন। সামাজিক মর্যাদায় বাগদী, কেওট, লােহার প্রভৃতির সঙ্গে তাদের খাওয়া দাওয়া ও ওঠাবসা চলে। বাংলার হাড়ি ও ছােটনাগপুরের ঘাসিদের সঙ্গে সমগােত্রীয়। বাঁকুড়া জেলার সর্দার ঘাটোয়াল, সরিয়াল, দিগােয়ার ও তাবিদার হিসেবে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়। পাইকান ও চৌকিদারির চারকান জমিও এদের অধিগত ছিল একসময়। বাউরী জাতির উৎস সম্বন্ধে ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা তাঁর গ্রন্থে বলেছেন—রাঢ়ের একটি প্রাচীন জাতি বাউরী। এদের আদি বাস হাজারিবাগ।৮ গােত্র প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন—বাউরীদের টোটেম কানাবক গােত্র বলতে এরা শালগাছ, চিতি সাপের উল্লেখ করে। এ প্রসঙ্গে K. C. Shasmal তাঁর গ্রন্থে যা বলেছেন তা এখানে উল্লেখযােগ্য।
“The Bauris one of the largest scheduled casts of West Bengal, are mainly concentrated in the districts of Bankura, Birbhum, Burdwan, Midnapur, Purulia and Hooghly. They are considered as a lower group people having no Brahmanical assitance in their ceremocial, religious and social performance. Although, they are recognised as a scheduled caste in this state, yet the caste appellation of the Bauris, indicate their migration mainly from Manbhum, Mallabhum, Dhallbhum in Bihar.”৭
অতএব বলা যায় যে, এই বাউরীরা ভারতের কোনাে বহিরাগত জাতি নয়। এরা আমাদের দেশের আদিম অধিবাসী। বাঁকুড়া জেলায় বর্তমানে আনুমানিক বাউরী জাতির সংখ্যা প্রায় চার লক্ষের কাছাকাছি। বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, সােনামুখী, খাতড়া, পাত্রসায়ের এই পাঁচটি শহরে বংশক্রমে বাউরীদের বাস আছে। যদিও সমগ্র জেলাব্যাপী প্রত্যেক থানাতেই এদের বসবাস রয়েছে। তবুও একটা জিনিস বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, পুরুলিয়া জেলার পূর্বাংশ ও বাঁকুড়া জেলার পশ্চিমাংশের যে এলাকাটিকে পশ্চিম রাঢ়ের কেন্দ্রভূমি বলা যেতে পারে, সেই এলাকাতেই বাউরীদের ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। শালতােড়া, মেজিয়া, বড়জোড়া, গঙ্গাজলঘাটি, ছাতনা, বাঁকুড়া, ইন্দপুর, খাতড়া, সিমলাপাল, হিড়বাঁধ, ওন্দা এই এগারােটি থানাতে যত বাউরী বাস করে, তাঁর সংখ্যা সারা জেলার সম্প্রদায়ের মােট সংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। ২০০১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী বাউরীদের সংখ্যা বাঁকুড়া জেলায় ছিল ৩০৩৩১৬ জন। এদের মধ্যে শহরাঞ্চলে ছিল পুরুষ বাউরীর সংখ্যা ৮৭২৮জন। মহিলার সংখ্যা ৮৮০৯ জন। গ্রামাঞ্চলে পুরুষের সংখ্যা ১৪৪৬৬৬৯ জন, মহিলার সংখ্যা ১৪১১১০ জন। অপরদিকে ১৯৬১সালের আদমসুমারি অনুযায়ী বাউরীদের মােট জনসংখ্যা ছিল বাঁকুড়া জেলায় ১৫২৭৪৪ জন। এদের মধ্যে শহরাঞ্চলে ছিল পুরুষ বাউরীদের সংখ্যা ৪০৮১ জন এবং মহিলাদের সংখ্যা ৩৫০১ জন। এদের মধ্যে নিরক্ষর পুরুষ ৩৩৩৮ জন, নিরক্ষর মহিলা ৩৩০২ জন।
এদের মধ্যে আবার সাক্ষর জ্ঞানযুক্ত কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি ছাড়াই এমন পুরুষের সংখ্যা ৬৬২ জন, মহিলা ১৮০ জন। প্রাথমিক শিক্ষিত পুরুষের সংখ্যা ৭৬ জন,মহিলা ১৯ জন। মাধ্যমিক/উচ্চমাধ্যমিক পুরুষের সংখ্যা ৪ জন।
গ্রামাঞ্চলে মােট জনসংখ্যার পুরুষ ৭৫,৩৭৯ জন, মহিলা ৬৯৬৪৩ জন। নিরক্ষর পুরুষের সংখ্যা ৬৯৫০২ জন, মহিলার সংখ্যা ৬৯৬৪৩ জন। সাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন পুরুষ। (প্রতিষ্ঠান স্বীকৃত নয়) এমন পুরুষের সংখ্যা ৪৭৪৬ জন, মহিলা ১২৬ জন। সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত পুরুষের সংখ্যা ১০৪৭ জন, মহিলার সংখ্যা ১৩ জন। মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত পুরুষের সংখ্যা ৮৪ জন, মহিলা ১ জন। বর্তমানে এর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। উপরিউক্ত পরিসংখ্যানে বাউরীদের শিক্ষার হার খুব কম। এই সম্প্রদয়ের শিক্ষার হার সম্পর্কে ড. শাসমল তাঁর গ্রন্থে বলেছেন,
“Out of a total population of 1,270 only 91 were found to be literature. The percentage of literary among the Bauris of this locality is 7.16%.”৮
তবে আমি বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রভিত্তিক গ্রাম সমীক্ষা করে জানতে পেরেছি যে বর্তমানে এই সম্প্রদায়ের লােকেদের মধ্যে শিক্ষার প্রবণতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে উচ্চশিক্ষা বলতে বি.এ., এম.এ. পাশ ছেলেমেয়ে আছে তবে তা করাঙ্গুলী গণনীয়। অনেক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষিকা রয়েছেন এই সম্প্রদায়ের মধ্যে। বাঁকুড়া জেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে বাউরী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই চিত্র পাওয়া যায়।
According to the Census Report of 1961 “Bauris form the major scheduled caste in the district of Bankura. This caste alone forms 31 percent of the total scheduled castes of the district, it is seen that those belonging to the Bauri Community are primarily engaged in agriculture labourers and 24.22 percent as cultivators. Participation by the Couri Caste in household or non-household manufacturing industries has been to be very poor. Only one in a group of every 25 Bauri workers has been engaged in this sector of Industries. In the urban areas of the district 28.74 percent of the Bauri workers are engaged in manufacturing industries. 20.70 percent of all Bauri workers living in towns of Bankura are found to be engaged in transport and communication services, 8.78 percent of the Bauri workers are seen to be engaged in other services. In the urban sector, of course every fourth Bauri is seen to be engaged in other services. About 80 percent female Bauri workers are found to be engaged in agricultural pursuits.৯
বাউরী জাতির উৎপত্তির দিক থেকে গবেষক সুনীল দাস তাঁর ‘রাঢ় সভ্যতা’ গ্রন্থে। বলেছেন- “বগ” শব্দটি দিয়ে রাঢ় দেশে প্রচুর সংখ্যায় গ্রামের নাম আছে। যেমন বগড়া, বাগড়া, বাগালিয়া, বদড়িচক > গড়িচক, বগডাঙা, বাগড়িহা, বাগুলি, বাদুরপুর > বাহাদুরপুর, বাইগড়া, বাগৈলা ইত্যাদি। উপরােক্ত প্রতিটি গ্রামের নামের মতােই মেদিনীপুরের গড়বেতায় ‘বগড়ি’ নামে একটি গ্রাম রয়েছে। বগআড়া > বগড়া > বগটী> বাগাড় > বাগরি > বাউরী > বাউড়ী। এইভাবে ‘বাউড়ী’ জনগােষ্ঠী নামের উৎপত্তি হয়। বাংলায় বাউড়ী ইংরেজিতে BAURI লেখে বা লেখা হয়। পরে BAURI ইংরেজি লেখা থেকে বাংলায় বাউরী লেখা হচ্ছে। এখনও বহু লােকে বাউরীই লেখে, আসলে ‘বাউরী’ না হয়ে হবে ‘বাউড়ী’। এটিই আদি উচ্চারণ।”১০
বাউরী শব্দটি বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার হতে দেখা গিয়েছে মাত্র—বাতাস ও মন শব্দের সঙ্গে। যেমন—‘বাউরী’ শব্দের প্রকৃত অর্থ আমরা পাই যাযাবর। অর্থাৎ অনুমেয় যে বাউরীরা সুদূর অতীতে যাযাবর ছিলেন।”
‘বাউরী’-দের উৎপত্তির বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে রােমিলা থাপার তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ‘বাউড়ী ল্যান্ড’ এবং বাউরী জনগােষ্ঠীর নাম সর্বপ্রথম জানতে পারা যায় মেগাস্থিনিস-এর লেখা বিখ্যাত ‘ইন্ডিকা’ (INDIKA) নামক গ্রন্থ থেকে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০৫ অব্দে মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় সেলুকাসের দূত হিসেবে মেগাস্থিনিস পাটলিপুত্রে অনেক বছর ছিলেন। সেই সময় ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থটি লেখেন।”
“সেলুকাসের প্রেরিত দূত মেগাস্থিনিস অনেক বছর পাটলিপুত্রে কাটিয়েছিলেন এবং ভারতবর্ষের নানা স্থান পরিভ্রমণ করেছিলেন।”১১
এছাড়া যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন— “রাঢ়ের দুর্ধর্ষ জাতি গােষ্ঠীর মধ্যে বাউড়ী জাতির স্থান অন্যতম। পশ্চিমবঙ্গের মােট বাউড়ী জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ বসবাস করে বাঁকুড়া ও বর্ধমান জেলায় এবং তন্মধ্যে বাঁকুড়া জেলায় এরা হয় সর্বাধিক। রিজলে ও ওল্ডহাম উভয়েই বাউড়ী উপগােষ্ঠীকে অনার্য গােষ্ঠীর সদ্ভূত বলে অনুমান করেছেন। কিন্তু কার্লে ডাল্টনের মতে সামাজিক মিলন মিশ্রণের ফলে বাউড়ীরা নিম্নগামী হয়েছে। মেগাস্থিনিসের আমলে উবােরী (Uberrae) জাতি হল একালের বাউরী গােষ্ঠী।
E. T. Delton তাঁর গ্রন্থে বলেছেন—
“The Bauris and Bauris are conceived the rebeant of an Aborigiral race by inter marriage with low caste Hindus that have nearly affected their primitive lincaments.”১২
অতএব ‘বাউরী’ তপশিলী উপজাতি নয়, তপশিলী জাতিভুক্ত। এ বিষয়ে ড. অতুল সুর তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন “মনে হয় পুণ্ডুদের বংশধর হচ্ছে বর্তমান পােদ জাতিও কটদের বংশধর হচ্ছেকৈবর্ত। এছাড়া প্রাচীন বাঙলার আরও কৌমভিত্তিক জাতি ছিল, যথা—বাগদী, হাড়ি, ডােম, বাউরী ইত্যাদি।”১৩ এছাড়া তিনি ঐ গ্রন্থের অনেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন—“বাউরীরা প্রধানত রাঢ় দেশের লােক। তাদের বর্তমান আবাসস্থল হচ্ছে বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, হুগলী ও পুরুলিয়া জেলায়।… তাদের উৎপত্তি সম্পর্কে তাঁরা দাবি করে যে, দেবগণের খাদ্য অপহরণ করার অপরাধে তাদের বাউরী জাতিহিসেবে জন্মাতে হয়েছে। বস্তুত দেশজ উপজাতিসমূহ যখন হিন্দুধর্মে দীক্ষিত হয়েহিন্দু সমাজে অনুপ্রবেশ করে, তখন তাঁরা সকলেই এক একটা উপকথা সৃষ্টি করে নিজেদের গৌরবান্বিত করবার চেষ্টা করে।”১৪
তবে উপরিউক্ত মন্তব্য থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, বর্তমান জাতি বিন্যাস ব্যবস্থিত হবার পূর্বে এ সকল অন্ত্যজ জাতিসমূহের সমাজে যে অন্য রূপ স্থান ছিল তা সহজেই অনুমেয়। প্রাচীনযুগে চর্যাগানেও তাঁর অনেক প্রমাণ মেলে। এমনকি এই জাতির মধ্যে অনেকেই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। তাই রাঢ়ের এই আদিম জনগােষ্ঠী শুধু বাংলায় নয়, ভারতেরও আদি জনগােষ্ঠী। এই জনগােষ্ঠী যে মাত্র বাংলার নৃতাত্ত্বিক বনিয়াদ গঠনেই সাহায্য করেছে তা নয়, তাঁরা উচ্চশ্রেণীর বাঙালির আচার ব্যবহার, রীতিনীতি ও সংস্কার রচনাতেও যথেষ্ট উপাদান যুগিয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বিনয় ঘােষ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৯৯।
- ২. বাউরী জাতির ইতিহাস, দুঃখভঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
- ৩. The Tribes and Castes of Bengal, Vol. I, H. H. Risley, p. 78.
- ৪. The Bauris of West Bengal, K. C. Sashmal, p. 53.
- ৫. Tribes Politics and State System in the pre Colonial Eastern & North Eastern India, Dr. Surajit Sinha, p. 82.
- ৬. রাঢ়ের জনজাতি ও লােকসংস্কৃতি, ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা, পৃ. ৬৮।
- ৭. The Bauris of West Bengal, K. C. Sashmal (Preface).
- ৮. তদেব, পৃ. ১৯।
- ৯. District Bankura Census, 1961, p. 126.
- ১০. রাঢ় সভ্যতা, সুনীল দাস, পৃ. ২৮-২৮।
- ১১. ভারতবর্ষের ইতিহাস, রােমিলা থাপার, পৃ. ৪৯।
- ১২. Description Ethnology of Bengal, ET, Delton, p. 328.
- ১৩. ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচর্য, ড. অতুল সুর, পৃ. ১৯৩। ১৪. তদেব, পৃ. ১৯৫।