১৭৫৬ সালে নবাব আলিবর্দি খানের মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁর প্রিয় দৌহিত্র সিরাজ-উদ-দৌলাহ বাংলার নবাবের পদে অধিষ্ঠিত হন। তখন সিরাজ-উদ-দৌলাহ’র বয়স মাত্র বিশ (২০) বছর। রাজপদে অনভিজ্ঞ যুবক। সিরাজের পক্ষে সমকালীন জটিল সংকটকে সাফল্যের সঙ্গে মােকাবিলা করার শক্তি বা সামর্থ মােটেই ছিল না। সিরাজ সিংহাসনে আরােহণ করার পরপরই তাঁর কতিপয় নিকটাত্মীয়সহ মুসলিম অভিজাতশ্রেণির এক অংশ এবং কিছু সংখ্যক হিন্দু ব্যবসায়ী-মহাজনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। কুচক্রী ইংরেজরাও তাদের সঙ্গে শামিল হতে দ্বিধা করেনি। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাহ’র সঙ্গে ইংরেজদের সংঘাতের সূচনা হলে ইংরেজরা কলকাতার চারপাশে সুরক্ষা করার অজুহাতে সশস্ত্র চৌকি স্থাপন করার ব্যবস্থা নিতে শুরু করল। নবাব এ অবস্থাকে তাঁর কর্তৃত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে মনে করলেন। তিনি তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে কলকাতা আক্রমণ করে শহরটি দখল করে নেন। চতুর ইংরেজ কোম্পানি শীঘ্রই নবাবের সঙ্গে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করল। নবাব তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে মুর্শিদাবাদে ফিরে গেলেন। এর মধ্যেই নবাবের বিরুদ্ধে এক মারাত্মক ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেল। যৌথ ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি হিসেবে ১৭৫৭-এর ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজ ইংরেজদের কাছে পরাজিত হলেন। হতভাগ্য নবাব যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে গিয়েও আত্মরক্ষা করতে পারলেন না। তাঁকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা হল এবং নৃশংশভাবে হত্যা করা হল।

পলাশির পরাজয়ের ঘটনা বাঙালির জন্য খুবই লজ্জাজনক, এতে দ্বিমতের কোনও অবকাশ নেই। তবে লজ্জাটা বীরত্বের অভাবের জন্য যতটা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি চারিত্রিক অধঃপতনের জন্য। একটা ষড়যন্ত্র ছাড়া ওটা কোনও ‘যুদ্ধ’ই ছিল না। পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের পর ২০০ ইংরেজ ও ৫০০ দেশীয় সৈন্য নিয়ে ক্লাইভ প্রবেশ করলেন মুর্শিদাবাদে।
মুর্শিদাবাদের অধিবাসীরা নীরব দাঁড়িয়ে ইতিহাসের এই মােড় পরিবর্তনের ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকল। ক্লাইভ নিজেই স্বীকার করেছেন,
“নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাহ’র মৃতদেহ হাতির পিঠে বহন করে যখন ইংরেজরা বিজয়ােল্লাসে মুর্শিদাবাদ শহর প্রদক্ষিণ করছিল তখন ইচ্ছা করলে মুর্শিদাবাদের জনতা শুধু লাঠি আর পাথর মেরে এই নতুন বিজেতাদেরকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারত। লােকেরা নাকি বলাবলিও করছে যে, কোনও অস্ত্র ছাড়া শুধু ইট-পাটকেল মেরেই মুর্শিদাবাদের লােকেরা ইংরেজদের ধরাশায়ী করতে পারত।”
কৌতূহলােদ্দীপক বিষয় হল, সিরাজের পতন তথা দেশের পরাধীনতার জন্য দায়ী বিশ্বাসঘাতক নায়কদের বেশিরভাগের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি তাদের মৃত্যু অপঘাতে হয়েছিল, অর্থাৎ বলা যায় পৃথিবীতে তাদের কম লাঞ্ছিত হতে হয়নি। যেমন মীরজাফর মারা যান কুষ্ঠরােগে, মীরন বজ্রাঘাতে মারা যান। মহারাজ নন্দকুমার মিথ্যা অভিযােগে ফাঁসিতে মারা যান, মুহাম্মদী বেগ পাগলা হয়ে কূপে পড়ে মারা যান। জগৎ শেঠ ও স্বরূপচাঁদ গঙ্গার জলে ডুবে মারা যান, রায় দুর্লভ জেলে অনশন-অনাহারে মারা যান। উমিচাঁদ কদর্পহীন অবস্থায় উন্মাদ ও ক্ষুধায় কাতর হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। কৃষ্ণচন্দ্র মুঙ্গের দুর্গে বন্দি হয়ে সপুত্র মৃত্যুমুখে পতিত হন। রাজারাম নারায়ণ, রাজবল্লভ ও পুত্র কৃষ্ণদাসকে গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করা হয়। ক্লাইভ আত্মহত্যা করেন। ওয়াটসনের মৃত্যু হয়েছিল কলকাতায় এক মহামারিতে, ফটনের মৃত্যু হয় জাহাজ ডুবিতে আর ওয়াটস কোম্পানির চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে মনােদুঃখে মারা যান। মুহাম্মদী বেগ মাথায় গড়বড় অবস্থায় বিনা কারণে কূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে মারা যান। ইয়ার লুতফ হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গিয়ে গােপনে নিহত হন। দানা শাহ বিষাক্ত সাপের কামড়ে মৃত্যুবরণ করেন। আবদুল হাদি খানকে মীরজাফর চক্রান্ত করে মেরে ফেলেন। মীর কাশিমের শেষ পরিণতিও ভালাে হয়নি। শেষজীবনে তিনি কদর্পহীন অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে থাকেন। অবশেষে অজ্ঞাতনামা হয়ে দিল্লির পথে করুণভাবে মৃত্যুবরণ করেন। মৃতের শিয়রে পড়ে থাকা একটা পুটলিতে পাওয়া যায় ‘নবাব মীরকাশিম হিসেবে ব্যবহৃত চাপকান’। তার থেকেই জানা যায়, মৃতব্যক্তি, বাংলার ভূতপূর্ব নবাব মীরকাশিম। সিরাজ কাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ফরাসি বিশ্বাসঘাতকের (নাম টেঁরাউ) শেষ পরিণতির কথাও এখানে বলা দরকার। অর্থলােভে ইনি ইংরেজ বাহিনীকে চন্দননগর লুণ্ঠনের সময় পথ দেখিয়েছিলেন। পুরস্কারের টাকা যখন তিনি ফ্রান্সে পিতাকে পাঠান তখন দেশভক্ত পিতা তা ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দেন। আত্মগ্লানিতে বিশ্বাসঘাতক পুত্র এই সংবাদ পাওয়ার পর আত্মহত্যা করেন। খােজা ওয়াজিদ ক্লাইভের চক্রান্তে জেলে গেলেন, সেখানে তিনি বিষ খেয়ে মরলেন। সিরাজ-বিরােধী ষড়যন্ত্রের পার্শ্বচরিত্র ইয়ার লুতফার নাম পলাশি যুদ্ধের পরই ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে অন্তর্হিত, কারণ মাণিকচাঁদের মতােই এর ভূমিকা ছিল নগণ্য। মানিকচাঁদের নাম পলাশি যুদ্ধের আহত তালিকায় পাওয়া গিয়াছিল বলে একজন ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন। কিন্তু রাজা মাণিকচাঁদ তখন কোন পক্ষে ছিলেন, তার ভূমিকাই বা কী ছিল— তা স্পষ্ট নয়, তাঁর শেষজীবন কীভাবে কেটেছিল তাও আমরা জানি না। বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার তিনি কিছু পেয়েছিলেন কিনা— তারও কোথাও কোনও উল্লেখ নেই। তবে ‘রিয়াজুস সালাতিনে’ বলা হয়েছে, মাণিকচাঁদের মৃত্যুর পর ১৭৬৩ সালে ইংরেজ কোম্পানি ৩০ বছর ধরে তাঁর নানা সাহায্যের প্রতিদানে তাঁর পুত্রকে একটি চাকরি দেন।
প্রধান নায়কদের যে মর্মান্তিক পরিণতি আমরা দেখেছি তাতে মনে হয় ইয়ার লুতফ ও মাণিকচাঁদকেও তাঁদের কৃতকর্মের ফলভােগ করতে হয়েছিল। কারণ বিধির বিধানে প্রতিটি পাপ, প্রতিটি অন্যায়ের প্রতিফল অবশ্যম্ভাবী। এই অমােঘ দণ্ডকে হয়তাে আমরা প্রতিক্রিয়া বলতে পারি বৈজ্ঞানিক পরিভাষায়।
মােটের উপর পলাশি যুদ্ধের কুড়ি বছরের মধ্যে প্রায় সমস্ত ষড়যন্ত্রী সমূলে নিশ্চিহ্ন হন। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই যে, পলাশির বড়যন্ত্র ও তার জন্য বাংলা তথা ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার ঘটনাকে কিছু ঐতিহাসিক সংকীর্ণ দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন স্বনামধন্য ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার। তিনি লিখেছেন, ২৩ জুন, ১৭৫৭তে বাংলার বুকে পলাশির প্রান্তরে ঘটেছিল নবযুগের সূচনা। এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার আর হয় না। পরাধীনতার সূচনাকে বাংলা তথা ভারতের নবযুগের সূচনা বললে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিস্মরণীয় ঐতিহ্যকেই অপমান করা হয়। যদুনাথ সরকার বােধহয় যুক্তির চেয়ে আবেগের দ্বারাই বেশি প্রভাবিত হয়েছেন। মনে রাখতে হবে যে, বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হতে বাংলা তথা ভারতকে বহু যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। কবি নবীনচন্দ্র সেন মনে করেন, পলাশির যুদ্ধের ফলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। কেবল নবীনচন্দ্র নন, বেশিরভাগ ব্যক্তি একথা মনে করেন। তাঁরা আরও মনে করেন যে, এই যুদ্ধের ফলে বাংলার জীবনে এক ঘােরতর দুর্দিন নেমে আসে।
নবাব মিরজাফর হলেন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ক্রীড়নক। ক্লাইভ তথা কোম্পানি পেল বিপুল অর্থ এবং বাংলায় বাণিজ্যের একচ্ছত্র অধিকার। পেল জমিদারি, পরে মীরজাফর কোম্পানির দাবি মেটাতে না পেরে সরে যেতে বাধ্য হলেন। ইংরেজ মীরকাশিমকে নবাব করল, তারপর তার সঙ্গেও বিবাদ। মীরকাশিম অযােধ্যার নবাব ও মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সাহায্য নিয়েও কোম্পানির বিরুদ্ধে বক্সারের যুদ্ধে ১৭৬৪-তে যখন হেরে গেলেন, তখন কোম্পানির ক্ষমতা আরও বাড়ল। ইতিমধ্যে অবশ্য কোম্পানি মীরকাশিমকে সরিয়ে আবার মীরজাফরকে গদিতে বসিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৭৬৫-তে কোম্পানির তরফে লর্ড ক্লাইভ যখন মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা সুবার দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায় ও বিলি বন্দোবস্তের ভার পেল তখন দেশের সূর্য সত্যি অস্ত গেল। ঔপনিবেশিকতার ভিত পাকা হয়ে গেল। এই জঙ্গলের রাজত্বে কোথায়ই বা আধুনিকতা, কোথায়ই বা উন্নয়নশীল সংস্কার? পলাশির যুদ্ধের আগে ইংরেজদের বাণিজ্যের চুয়াত্তর শতাংশ অর্থ আসত ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত ও রৌপ্যপিণ্ডের সাহায্যে।

পলাশি-পরবর্তী যুগে সােনা-রুপাে আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ তাে হলই, বরং এ দেশে থেকে প্রাপ্ত টাকায় ব্যবসা চালিয়ে, মাইনে দিয়ে, মুনাফা স্বদেশে পাঠিয়ে, সােনা-রুপাে পর্যন্ত চিনে রফতানি শুরু হল। বাংলা থেকে অপরিমিত ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেমন লাভবান হয়, অপরদিকে তেমনি ক্লাইভ ও অন্যান্য কর্মচারীরা রাতারাতি প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে নবাবী কায়দায় জীবন যাপন করতে থাকেন। কিন্তু এর মাসুল গুনতে হয় বাংলার জনগণকে। সারা দেশজুড়ে এক নৈরাজ্য ও অর্থনৈতিক সংকট বাংলার জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলল। পলাশি লুণ্ঠনের ফলে বাংলার অর্থনীতি ভেঙে পড়ল। বাংলার জনগণের দুঃখ-দুর্শশার অন্ত ছিল না। আসলে বণিকশ্রেণি যখন রাজশক্তি হাতে পেল, অথচ তা ভােগ করার কোনও দায়িত্ব গ্রহণ করল না বা করতে পারল না, তখন অন্যায়-অত্যাচারই তার স্বাভাবিক পরিণতি। বাংলার দুর্বল নবাবদের পক্ষে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কোনওভাবেই সম্ভব হয়নি। সুতরাং বাংলার জন্য পলাশির যুদ্ধ এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। তবে এটা ঠিক যে, পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনের সংস্পর্শে এসে বাঙালি পাশ্চাত্য শিক্ষা, আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয় এবং তার ফলে বাংলায় এক নবযুগের সূত্রপাত হয়। কিন্তু পলাশির যুদ্ধের সঙ্গে এর যােগ কতটুকু? পলাশির যুদ্ধের ফলে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাত হয়েছিল মাত্র। ইংরেজি শিক্ষা ও আদর্শের সংস্পর্শে আসার কোনও সুযােগই তখন ছিল না বা সেই ধরনের কোনও প্রয়ােজনও তখন অনুভূত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে পলাশির যুদ্ধের অনেক পরে, উনবিংশ শতকের গােড়ার দিকে বাংলার এক নবযুগের সূত্রপাত হয়েছিল। তবে পলাশির যুদ্ধের ফলে ও বাংলায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিকাশের ফলে ভারতের মধ্যে বাংলাতেই প্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষা ও চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। সুতরাং, উনবিংশ শতকে বাংলা ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক বিষয়ে অধিকতর অগ্রসর হয় ও আধুনিকতার পথে পা বাড়ায়।
[সৌজন্যঃ দৈনিক কলম]
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।