দিল্লীর শেষ সম্রাট যেমন বাহাদুর শাহ তেমনি ভারতের প্রাণ কেন্দ্র বঙ্গদেশের শেষ নবাব ছিলেন সিরাজুউদ্দৌল্লাহ । ১৭৫৭ তে ইংরেজ ও তাদের দালালদের চক্রান্তে তাঁকে ধ্বংস করা হয়। সেই সঙ্গে তাঁর জীবনে মহাননেতা, বিচক্ষণতা, বীরত্ব ও মহত্বকে ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাসে বিকৃত করা হয়েছে। আর ভারতের মাটি রক্ষা করতে নিজের দেহের সমস্ত রক্তবিন্দু দিয়ে যিনি ভারতের মাটিকে রক্তরঞ্জিত করলেন তার ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্র রক্ষার জন্য সামান্যতম চেষ্টার পরিবর্তে অসামান্য অপচেষ্টা করা হয়েছে। কীভাবে কেন তা করা হয়েছে, তাই আলােচনার প্রয়ােজন।

আগেই বলেছি বঙ্গদেশকে ভারতের মস্তিষ্ক বলা যেতে পারে। বাংলার সম্পদ সম্পত্তি ও অর্থ ইংরেজদের হাত শক্ত করেছিল তাই ইংরেজদের পক্ষে ফরাসীদের পরাজিত করা সহজসাধ্য হয়েছিল।
সম্রাটদের রাজ্যে বঙ্গদেশ একটা প্রদেশ বলে গণ্য ছিল। মুর্শিদ কুলী খাঁ ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব। পরে ১৭২৭ খৃস্টাব্দে তার জামাতা সুজাউদ্দিন বাংলা ও বিহারের নবাব হন। তারপর ১৭৩৯ খৃস্টাব্দে তাঁর পুত্র সরফরাজ খাঁ সিংহাসনে বসেন। তিনি খুব উপযুক্ত ও শক্তিশালী ছিলেন। তাঁর অধীনস্থ গভর্নর আলিবর্দী খাঁ মারাঠা ও বর্গীদের লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে প্রতিরােধ করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। তাতে সরফরাজ খাঁ খুব একটা গুরুত্ব দেননি। ফলে বীর আলিবর্দীর বীরত্ব প্রকাশে বাধা সৃষ্টি হয় দেখে তিনি বিদ্রোহ ঘােষণা করেন এবং সরফরাজকে পরাজিত করে নিজে নবাব হন।

আলিবর্দী খাঁ উপযুক্ত শাসক ও বীর ছিলেন। মারাঠা, বর্গী প্রভৃতি জাতির লুণ্ঠন ও অত্যাচারকে তিনি কঠোর হস্তে দমন করেন। ইংরেজরা আলিবর্দীর হাভভাবে চরম নীতির পরিবর্তে নরমনীতি অবলম্বন করে এবং তাঁর দরবারে জানানো হয়, ‘আমরা মহামতি আকবরের সময় হতে আজ পর্যন্ত আপনাদের অর্থাৎ মুসলমানদের অনুগ্রহে ব্যবসা করছি এবং ঘটিও নির্মাণ করে থাকি। অতএব আশাকরি আপনি আমাদের ঐ দুটি সুযােগই পুনর্বহাল রাখবেন।
আলিবর্দী জানালেন, ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে কিন্তু দুর্গ নির্মাণের কোন সুযােগই নেই। যদি আপনারা পর্তুগীজদের আক্রমণের ভয় আছে বলে অজুহাত দর্শান তাহলে জেনে রাখবেন যে কোন বহিঃশত্রুর জন্য নবাব আলিবর্দীই যথেষ্ট।
আলিবর্দী খাঁয়ের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তাই তাঁর প্রাণপ্রিয় নাতি সিরাজুউদ্দৌল্লাহই সিংহাসনে বসেছিলেন। সিরাজের পিতার নাম ছিল জয়নুদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন বিহারের গভর্নর। আর তাঁর মায়ের নাম ছিল আমিনা। এই সিরাজুউদ্দৌল্লাহর রাজত্বকাল ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মিথ্যা দুর্নামের আসরে তার ভূমিকা আধুনিক ইতিহাসে অতীব চিত্তাকর্ষক।

সিরাজের বিরুদ্ধে যত অভিযােগ আছে তার কিছুই যে সত্য নয় তা হয়তাে এখানে বলার উদ্দেশ্য নয় কিন্তু এমন অনেক অভিযােগও ইতিহাসে আছে, যার কোন ভিত্তিই নেই।
যাইহােক, সিরাজের সিংহাসনে বসার পরেই নবাবকে অযােগ্য মনে করে ইংরেজরা দুঃসাহসের সঙ্গে কলকাতার ঘটি ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ নির্মাণ করতে আরম্ভ করে। ইংরেজরা জানতাে সারা ভারতের মস্তিষ্ক বাংলা, তাই কলকাতাতেই ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনাকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলতে লাগল। সিরাজুউদ্দৌল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে সংবাদ পাঠালেন যে, দুর্গ তৈরি বন্ধ করা এবং তা ভেঙে ফেলা নবাবের আদেশ। ইংরেজরা নবাবের আদেশ অগ্রাহ্য করে দুর্গ তৈরির কাজ অব্যাহত রাখে। এক কথায় নবাবের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য তাঁরা আগে হতেই তৈরি ছিল। সিরাজ পূর্ণ সাহসিকতার সঙ্গে বিদেশী ইংরেজকে আক্রমণ করেন এবং তাদের ভীষণভাবে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধের সঙ্গেই সংযুক্ত ‘Black Hole’ বা অন্ধকূপের কাহিনী।
কলকাতা অধিকারের সংবাদ মাদ্রাজে পৌছালাে। সঙ্গে সঙ্গে বৃটিশ সেনাপতি ক্লাইভ বিরাট সৈন্য সামন্ত নিয়ে কলকাতা পুনর্দখল করেন। সিরাজুউদ্দৌল্লাহ বুঝতে পারলেন আর লড়াই করে পারা যাবে না। কারণ ইংরেজদের চক্রান্তে তার বিশ্বাস ভাজন হিন্দু ও মুসলমান বন্ধু-বান্ধব ও ইংরেজকে জয়ী করার জন্য সর্বস্ব পণ করে লেগেছেন, ফলে বাধ্য হয়েই তাকে ১৭৫৭ খৃস্টাব্দে অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সঙ্গে সন্ধি করতে হয়। এই সন্ধির নাম হয় ‘আলী নগরীর সন্ধি’। সন্ধির শর্তানুযায়ী কলকাতা ইংরেজরা ফিরে পায় এবং শুধু মাত্র ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের মেরামত বা নির্মাণের অধিকারপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু কিছুকালের মধ্যে ইংরেজরাই বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় হঠাৎ বঙ্গের চন্দননগর দখল করল এবং সিরাজুউদ্দৌল্লাহকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হল।

এ ব্যাপারে ইংরেজরা একটা বড় অস্ত্র হাতে পেয়েছিল। বঙ্গের বিখ্যাত জগৎশেঠ এবং কলকাতার বড় বড় ব্যবসায়ী উমিচাঁদ এবং রাজবল্লভ প্রমুখ দেশের শত্রু ও শােষকবৃন্দ সিরাজের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে যােগ দেন। জগৎশেঠের বাড়িতে গােপন সভা হয়। সেই গােপন আলােচনায় স্ত্রী লােকের ছদ্মবেশে ইংরেজদের দূত মি. ওয়াটস সাহেবকে পালকীতে করে আনানাে হয়। ঐ সভায় মি. ওয়াটস প্রচুর পরিমাণে লােভ লালসায় মুগ্ধ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করা হবে এবং তার ফলে বঙ্গ তথা সারা ভারতের মুসলমানদের উত্তেজিত হয়ে ওঠার রাস্তা বন্ধ করতে তাঁরই আত্মীয় মীরজাফরকে সিংহাসনে বসানাে হবে। মি. ওয়াট্র আরও জানালেন, সিরাজের সাথে লড়তে যে প্রস্তুতির প্রয়ােজন এবং তার জন্য যে প্রচুর অর্থের আবশ্যক তা বর্তমানে আমাদের নেই। জগৎশেঠ কর্তব্য পালন করতে সদম্ভে আশ্বাস দিয়েছিলেন, “টাকা যা দিয়েছি আরও যত দরকার আমি আপনাদের দিয়ে যাব, কোনও চিন্তা নেই।”
এবার রাজা রাজবল্লভ সিরাজের বড় খালা (মাসী) ঘসেটি বেগমকে বােঝালেন-আমরা চেয়েছিলাম আপনি সিংহাসনে বসবেন। কিন্তু এখনও উপায় আছে যদি আপনি আমাদের অর্থাৎ ইংরেজদের শুধু একটু সমর্থন করেন মাত্র।
মীরজাফরকে একটু বােঝাতে বেগ পেতে হল। তিনি প্রথমে বলেছিলেন “আমি নবাব আলিবর্দীর শ্যালক’ অতএব সিরাজুউদ্দৌল্লাহ আমার আত্মীয়, কী করে তা সম্ভব?” তখন উমিচাদ বুঝিয়েছিলেন, “আমরাতাে আর সিরাজকে মেরে ফেলছি না অথবা আমরা নিজেরাও নবাব হচ্ছি না, শুধু তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে আপনাকে বসাতে চাইছি। কারণ আপনাকে শুধুমাত্র আমি নই; বরং ইংরেজরা এবং মুসলমানদের অনেকেই আর অমুসলমানদের প্রায় প্রত্যেকেই গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখে।”
সুতরাং মীরজাফর উমিচাঁদের বিষ পান করলেন। উমিচাঁদের জয় হলেও তিনিও পুরস্কৃত হবেন আর মীরজাফর হবেন বাংলার নবাব। এদিকে জগৎশেঠের শােষণের পথ নিষ্কণ্টক হবে আর ইংরেজদের লাভ হবে ভারত আসবে তাদের হাতের মুঠোয়। পক্ষান্তরে সিরাজুউদ্দৌল্লাহর লাভ হলে তা হবে বাংলার তথা সমগ্র ভারতের লাভ।
যাইহােক, ষড়যন্ত্রের জাল বােনা যখন শেষ, ভারতে স্বাধীনতা সূর্যকে পরাধীনতার গ্লানিতে কবর দেওয়ার সমস্ত পরিকল্পনা যখন প্রস্তুত সেই সময় ১৭৫৭ খৃস্টাব্দে ১৩ জুন ক্লাইভ মাত্র তিন হাজার দুইশত সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ যাত্রা করেন। ১৯ জুন নবাবের অধীনস্থ কাটোয়া ক্লাইভের দখলে আসে। ২২ জুন গঙ্গা পার হয়ে ক্লাইভ মধ্য রাত্রিতে নদীয়া জেলার সীমান্তে পলাশীর প্রান্তরে পৌঁছান। নবাবের প্রচুর সুদক্ষ সেনা আগে হতেই তৈরি ছিল। ক্লাইভের তবুও ভয় নেই, কারণ তিনি জানেন এ যুদ্ধ যুদ্ধ নয় পুতুল খেলার শামিল। আগে হতেই পরিকল্পনা পাকাপাকি। উমিচাঁদ, বায়দুর্লভ, জগৎশেঠ প্রমুখের সাজানাে সেনাপতি আজ ভেতরে ভেতরে ক্লাইভের পক্ষে!

ক্লাইভের সৈন্য যেখানে মাত্র তিন হাজার দুইশত সেখানে সিরাজের সৈন্য পঞ্চাশ হাজার। কিন্তু মীরজাফর, রায়দুর্লভ ও অন্যান্য সেনাপতি পুতুলের মত দাঁড়িয়ে রইলেন আর ইংরেজদের আক্রমণ ও গুলির আঘাতে নবাবের সৈন্য আত্মহত্যার মত মরতে শুরু করল। এ অবস্থায় সেনাপতির বিনা অনুমতিতেই সিরাজের জন্য তথা দেশ ও দশের জন্য মীর মর্দান ভয়াবহ বীর বিক্রমে যুদ্ধে ব্যপৃত হলেন আর পরক্ষণেই বিপক্ষের গুলিতে বীরের মত শহীদ হলেন। নবাব সিরাজুউদ্দৌল্লাহ এই সংবাদে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। ঐ সময় যুদ্ধের গতি নবাবের অনুকূলে যাচ্ছিল। কারণ মীর মর্দানের বীরত্বে মােহনলাল ও সিনফ্রে তখন ইংরেজদের কায়দা করে ফেলে ছিলেন। এমন শুভ মুহূর্তে নবাবের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর যুদ্ধ বন্ধ করতে আদেশ দেন। ওদিকে ক্লাইভ এই মুহূর্তটির অপেক্ষাতেই ছিলেন। নীরব মুসলমান ও হিন্দু সৈন্যদের ওপর গােলাবর্ষণ চলতে লাগলাে। অবশেষে নিরুপায় নবাবের সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। নবাবও রাজমহলের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে গিয়ে ধরা পড়লেন এবং তাঁকে বন্দি করা হলাে। শেষে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
বাংলার বিশ্বাসঘাতক সন্তানেরা এটা বােঝেনি যে, এ পরাজয় শুধু সিরাজের নয়, শুধু বাংলার নয়-সমগ্র ভারতের। আর ঐ জয় ইংরেজ ও ইংল্যাণ্ডের।
কিন্তু সিরাজুউদ্দৌল্লাহ পরাজিত ও নিহত কেন? এর উত্তরে বলা যেতে পারে পলাশীর যুদ্ধ কোন যুদ্ধই ছিল না। কারণ এটা ছিল যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা মাত্র। আসলে যাদের তিনি বিশ্বাস করতেন উমিচাঁদ, সেনাপতি রায়দুর্লভ, প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আর বঙ্গের শ্রেষ্ঠ ধনী জগৎশেঠ এঁরাই ছিলেন সিরাজের প্রতিদ্বন্দ্বী। শত্রু প্রকাশ্যে হলে তার দ্বারা যত ক্ষতি হয়, বন্ধুশত্রু হলে ফল হয় আরও মারাত্মক। পলাশীর যুদ্ধে এ সত্যই দারুণভাবে প্রমাণিত। তাই দেশহিতৈষী নিরপেক্ষ বিখ্যাত লেখক শ্ৰী নিখিনাথ রায় লিখেছেন,
“অষ্টাদশ শতাব্দীর যে ভয়াবহ বিপ্লবে প্লাবিত হয়ে হতভাগা সিরাজুউদ্দৌল্লাহ সামান্য তৃণের ন্যায় ভেসে গিয়েছিল এবং মীরজাফর ও মীরকাশিম ঊর্ধ্বক্ষিপ্ত ও অধঃক্ষিপ্ত কেউ বা অনন্ত নিদ্রায় কেউ বা ফকিরী অবলম্বনে নিষ্কৃতি লাভ করেন। জগৎশেঠগণের ক্রোধ ঝটিকা সেই তুফানের সৃজনের মূল।
দুঃখের বিষয় সেই ভীষণ তুফানে অবশেষে তাদেও অনন্ত গর্ভে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। যে বৃটিশ রাজ রাজেশ্বরীর শান্তি ধারায় আসমুদ্র হিমাচল স্নিগ্ধ হইয়েছে। জগৎশেঠগণের সাহায্যই তার প্রতিষ্ঠাতা। একজন ইংরেজ লিখিয়েছেন যে, হিন্দু মহাজনের অর্থ আর ইংরেজ সেনাপতির তরবারী বাংলায় মুসলমান রাজত্বের বিপর্যয়। যে বৃটিশ রাজলক্ষ্মীর কিরিটি প্রভায় সমস্ত ভারতবর্ষ আলােকিত হইতেছে মহাপ্রাণ জগৎশেঠগণের অর্থ বৃষ্টিতে ও প্রাণপাতে তাহার অভিষেক ক্রিয়া সম্পাদিত হয়।” (ঐতিহাসিক চিত্র, ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায় দ্রষ্টব্য)।
শ্রীঘােষও তাঁর ইতিহাসের ৫১৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,
“আজকের যে কোন বালকও বুঝতে পারে যে পলাশীর যুদ্ধ শুধু যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মতাে অভিনয় ছাড়া কিছু নহে।”
ইংরেজরা যখন ক্লাইভের বিচার করেছিল তখন ক্লাইভ শাস্তিপ্রাপ্ত চোরের মত কোর্টে দাঁড়িয়ে যা উত্তর দিয়েছিলেন তা গুরুত্বপূর্ণ।
“চল্লিশ লাখ পাউণ্ড স্টার্লিং কর এবং সেই পরিমাণ ব্যবসায়ে লাভ হতে পারে এমন একটা সাম্রাজ্য আপনাদের জন্যই আমি জয় করেছি আর তার পারিশ্রমিক হিসেবে আপনারা আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছেন, আমি যেন একজন ভেড়া চোর।”
তাহলে ভারতের মানুষের এতবড় সর্বনাশ সাধন করার উদ্দেশ্য কী? এর উত্তরে অনেকে অনেক কথা বলেন। তবে একদল বিচক্ষণ পণ্ডিতের মত সাম্প্রদায়িকতাই প্রধান কারণ। মুর্শিদাবাদের কথা বলতেই মনে পরে যায় মুসলমান মুর্শিদ কুলীর নাম। কিন্তু তিনি মুসলমান ছিলেন বলেই তার অপরাধ ছিল না; বরং তার বড় অপরাধ ছিল তিনি ব্রাহ্মণের সন্তান হয়েও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। (এসিয়াটিক সােসাইটির সংরক্ষিত অক্ষয়কুমার মৈত্রের সম্পাদিত ঐতিহাসিক চিত্র দ্রষ্টব্য)
সিরাজের ইতিহাসে জগৎশেঠদের ভূমিকা
পৃথিবীর ইতিহাস সমালােচনা করে জানা যায় ইংরেজরা মুসলমান শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে বারবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরাজিত হয়েছে। তার ফলস্বরূপ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সারা বিশ্বে মুসলমান রাষ্ট্রের সৃষ্টি। ক্রুসেডের যুদ্ধ গুলিতেও মুসলমানদের বীরত্ব অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
ভারতে ব্যবসাদার ইংরেজ রাজা হয়ে বসতে পারতাে না যদি তাদের হাতে ভারতের বিশ্বাসঘাতকদের সহযােগিতা না থাকতাে। যে বা যাদের বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরেজরা ভারতের মাটিতে তুলাদণ্ডের পরিবর্তে রাজদণ্ড ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল তাঁদের মধ্যে জগৎশেঠদের নাম সবিশেষ উল্লেখযােগ্য।

ভারতের যােদপুরের একটি দরিদ্র পরিবার অভাবের জ্বালায় হীরানন্দ মাতৃভূমি ত্যাগ করে, বঙ্গদেশের এক গ্রামে একটি পর্ণ কুটীরে মৃত্যু শায়িতা বৃদ্ধার সেবা করার সুযােগ পান। সেই বৃদ্ধার মৃত্যুর পর তার গচ্ছিত কিছু টাকা হীরানন্দের মূলধনে পরিণত হয়। এমনিভাবে ঐ বংশের মানিকচাদের সঙ্গে মুর্শিদকুলী খাঁর ভালবাসা হয়। মানিকচাঁদ কাজ গুছিয়ে বেশ উঁচু ধাপে উঠতে থাকেন। ১৭১৫ খৃস্টাব্দে বাদশাহ ফররুখ শাহের নিকট সুপারিশ করে মুর্শিদকুলী খা তাঁকে শেঠ উপাধি দান করেন। হিন্দু-মুসলমান ভালবাসাবাসিরই এক ঐতিহাসিক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই শেঠ উপাধি দান। (রিয়াজুস সানাতিন, Stewarts History of Bengal)
শেঠ বংশের ফতেহচাঁদই প্রথমে জগৎশেঠ উপাধিপ্রাপ্ত হন। আবার রিয়াজুস সানাতিনে ২৭৪ পাতায় পাওয়া যায় মুহাম্মদ শাহও জগৎশেঠ উপাধি দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে মতির মালা এবং কয়েকটি হাতী। সম্রাট মুহাম্মদ শাহকে শেঠজীরা তােষণ ও সেবায় এত মুগ্ধ করেন যে, মুর্শিদকুলী খাঁর ওপর একবার বিরক্ত হয়ে ফতেচাঁদকেই নবাব করতে চেয়েছিলেন। মুর্শিদকুলী খাঁর মৃত্যুর সময়ে তাঁর টাকা শেঠদের বাড়িতে যা জমা রাখাছিল তার পরিমাণ সে বাজারের সাত কোটী টাকা যা শেঠজীরা কোনও দিন ফেরত দেননি। (মুর্শিদাবাদ কাহিনী, ৫৬ পৃঃ, নিখিল চন্দ্র রায়)
ঐ অর্থই যত অনর্থের মূল। সারা ভারতে বহু স্থানে শেঠদের গদি ছিল। ইংরেজরা প্রথম শেঠদের হাত করেন এবং শেঠরা যত টাকা প্রয়ােজন দিতে প্রতিশ্রুত হন। তারপর জগৎশেঠের বাড়িতে গােপন বৈঠক বসে। সেই সভাতে সাহেবদের সঙ্গে সারা ভারতকে তথা সিরাজকে ধ্বংস করতে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা হচ্ছেন জগৎশেঠ, রাজা মহেন্দ্ররায় (দুর্লভ রায়) রাজা রামনারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, কৃষ্ণদাস ও মীরজাফর।
একজন প্রস্তাব করেন যবনকে নবাব না করে হিন্দু নবাব করার। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মুসলমান মীরজাফরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে লজ্জিত ও থতমত খেয়ে বললেন মীরজাফরকেই নবাব করে আমরা সিরাজকে সরাতে চাই। উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানগণ খেপে উঠবে না, মুসলমান নবাবের পরিবর্তে মুসলমান নবাব মাত্র। অনেক বাদানুবাদের পর জগৎশেঠ বললেন, ‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কথাই যুক্তিসঙ্গত। আমরা কেউ নবাব হলে অন্য বিপদ আছে।’ সঙ্গে সঙ্গে ঐ মত চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গেল।
তাই বলা যায়, ভারতে ইংরেজ রাজ্যই শুধু তাদের গােলাগুলি আর মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতাতেই প্রতিষ্ঠিত নয়; বরং শেঠজীদের বিশ্বাসঘাতকতাই এর পশ্চাতে প্রধানতম সহায়ক। উল্লেখ জাফরের তুলনায় কোন অংশেই কম ছিল না; বরং শেঠজীদের বিপুল অর্থ সাহায্যই ইংরেজদের এমন দুঃসাহসিক অভিযানের গােড়াপত্তন। ইংরেজ ঐতিহাসিকগণও এই বিরাট সত্যকে একেবারে হজম করতে পারেননি, তাই বলেছেন-
“The rupees of the Hindu banker, equally with the sword of the English colonel contributed to the overthrough of the Mahammedan powerin Bengal:”
অর্থাৎ বাংলায় মুসলমান শক্তিকে ধ্বংস করতে (ভারতে পরাধীন করতে) বৃটিশ সেনাপতির তরবারির সাথে হিন্দু ধনপতিদের অর্থ সম্ভারও সমানভাবে সহযােগিতা করেছিল।
শেঠজীরা শুধুমাত্র ইংরেজদের হাতেই অর্থ দেননি, সিরাজের সৈন্যদের পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ সরবরাহ করে ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছেন। আরাে দুঃখের কথা, সিরাজকে হত্যা করার প্রস্তাব ইংরেজ সরদারকে ঐ জগৎশেঠই দিয়েছিলেন।
মুর্শিদাবাদ কাহিনীর লেখক নিখিল বাবু বড় দরদ দিয়ে লিখেন হতভাগ্য রাজ্যহারা সর্বাবস্থায় হইয়া অবশেষে প্রাণ ভিক্ষার জন্য প্রত্যেকের পদতলে। বিলুণ্ঠিত হয়েছিল তারা প্রাণ দানের পরিবর্তে যদি প্রাণ নাশের কেউ সম্মতিও দিয়ে থাকে তাহলে তার ঘৃণিত ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির লােক যে সর্ববথা নিন্দনীয় এ কথা মুক্ত কণ্ঠে বলা যেতে পারে।”
জগৎশেঠের মৃত্যু হয়েছিল উচ্চ পর্বত হতে নিচে নিক্ষিপ্ত হয়ে। পৃথিবীর প্রখ্যাত ধনী বংশ দরিদ্রতর হতে সৃষ্টি হয়ে দরিদ্রতম গােষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে তাদের। ভগ্নস্তুপের পাশে বিচরণ করছে।
সিরাজুদৌলার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোেগ
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুউদ্দৌল্লাহ সম্পর্কিত ইতিহাসকে সাহিত্য, নাটক, গ্রামােফোন রেকর্ড ও সিনেমা প্রভৃতিতে প্রচার দ্বারা যেভাবে কলঙ্কিত করা হয়েছে তা অত্যন্ত পরিতাপের।
নবাব নাকি চরিত্রহীন ও মদ্যপায়ী ছিলেন। তিনি নাকি নিষ্ঠুর ছিলেন-এ অপবাদ প্রমাণিত হয় তাঁর অন্ধকূপ হত্যার দ্বারা। দুইশত জন ইংরেজকে ছােট একটি অন্ধকার কক্ষে খাদ্য, পানীয় ও বাতাসের অভাব ঘটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল বলে নিরীহ সিরাজের নামে কলঙ্ক দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া আরও বহু অভিযােগ আছে সিরাজের নামে।
আমাদের দেশে ইংরেজদের দালালির দলে যারা যােগ দিয়েছিলেন তাঁরা আজও সিরাজকে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদের সম্মানে ভূষিত করতে পারেননি। এছাড়া বিশ্বাসঘাতকতা যতটুকু হয়েছিল সিরাজকে ঘিরে তার সবটুকুই যেন চাপানাে হয়েছে কুখ্যাত মুসলমান মীরজাফরের ঘাড়ে। কিন্তু আসল ইতিহাস তা বলে না- একথার সত্যতা সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই কিছুটা আভাস দেওয়া হয়েছে ‘সিরাজের ইতিহাসে জগৎশেঠদের ভূমিকা’ পর্যালােচনায় এবং আরও পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠবে পরবর্তী আলােচনায়।
সিরাজুউদ্দৌল্লাহ অল্প বয়সে একবার মদ্যপানের কলঙ্কে কলঙ্কিত হয়েছিলেন। কিন্তু আলিবর্দীর প্রাণপ্রিয় সিরাজকে ডেকে মদ আর কোনও দিন স্পর্শ না করার জন্য কোরান ছুঁয়ে শপথ করতে বলেন। তাতে সিরাজুউদ্দৌল্লাহ বলেছিলেন, নানা, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। সিরাজুউদ্দৌল্লাহ জীবনে কোনদিন আর মদ স্পর্শ করবে না। যদি করি তাহলে আমি আপনাদের নাতি নামের কলঙ্ক। বলা বাহুল্য, সিরাজুউদ্দৌল্লাহ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন সারা জীবন।
এতদ্বতীত নারী লােলুপতার যে মিথ্যা অপবাদটি তার ওপর আরােপ করা হয়েছে তাও ভিত্তিহীন বরং ইংরেজ ও তাদের দালালদের কৌশল মাত্র।
গ্রামােফোন রেকর্ডে সিরাজের কণ্ঠে বলা হয়-প্রথমে যৌবনের উন্মাদনায় নারী অনেক চেয়েছি, পেয়েছিও… ইত্যাদি। যখন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা তথা ভারতের ভাগ্য নিয়ে যুদ্ধ চলছে, মীর মর্দান নিহত-সৈন্যদের বিশ্বাসঘাকতায় সিরাজের চোখে অশ্রু, তখন রেকর্ডে আমরা শুনি তিনি আলেয়াকে নিয়ে প্রেম-লীলায় মত্ত! এতবড় ভুল বাঙালি হয়ে বাঙালির বিরুদ্ধে মানুষ কি করতে পারে? তা কি সম্ভব? তবুও কাল যা সম্ভব ছিল না, আজ হয়ত তা সম্ভব এবং আগামীতেও কল্পনা করা আকাশকুসুম নয় যে, আজকের সুধী সমাজ গড়ে তুলবে পূর্ব পুরুষদের মিথ্যা ইতিহাসের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরােধ। শ্রী সুধীর কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন,
“সিরাজ অতিরিক্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির লােক ছিলেন। তিনি প্রায় নদীতে বন্যার সময় নৌকা হতে আরােহী উল্টায়ে দিয়ে বা ডুবিয়ে দিয়ে এক সঙ্গে এক দুই শত যুবক, যুবতী, স্ত্রী, বৃদ্ধ, শিশু সাঁতার না জেনে জলে নিমজ্জিত হওয়ার নিষ্ঠুর দৃশ্যটি উপভােগ করে আনন্দ লাভ করতেন।”
এই প্রমাণহীন মিথ্যা কাহিনী পড়ে হয়ত অনেকে বলতে পারেন সুধীর বাবু তেমন নামীদামি লােকের মধ্যে গণ্য নন সুতরাং গুরুত্ব না দেওয়াই ভাল। কিন্তু বিখ্যাত কবি, উচ্চ ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি বাবু নবীনচন্দ্র সেন যদি অনুরূপ বা ততােধিক, মারাত্মক কিছু বলে বা লিখে থাকেন তবে সুধীর বাবুরই বা লেখা দোষের হবে কেন? নবীনচন্দ্র সেন শুধু নৌকায় নবাবের নর হত্যার কথা লিখেই ক্ষান্ত হননি; বরং আরও নতুন সৃষ্টি করেছেন। বিশেষ করে ‘গর্ভিনীর বক্ষ বিদারণ’ এর ঘটনা অর্থাৎ সিরাজুউদ্দৌল্লাহ নাকি জীবন্ত গর্ভবতী নারীর পেট কেটে সন্তান দেখতেন। এমনি আরও কত আজগুবী আর অবান্তর কিংবদন্তীর অবতারণা করে সিরাজের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করার জঘন্যতম প্রচেষ্টা চালানাে হয়েছে। সিরাজের অন্ধকূপ হত্যার ইতিহাসটিও এরই প্রতিচ্ছবি। যার সত্যতা সম্পর্কে অমর সাক্ষী নাকি কলকাতার ইংরেজ প্রতিষ্ঠিত কুখ্যাত মনুমেন্ট।

অন্ধকূপ হত্যার পশ্চাতে নিষ্ঠুর ঐতিহাসিক
সিরাজের অন্ধকূপ হত্যার কাহিনী ইতিহাসে এক গুরুত্ত্বপূর্ণ অধ্যায়। শাসকদের চরিত্রে মসী লেপনের এক অদ্ভুত ঐতিহাসিক প্রাকটিস।
তাই এই অন্ধকূপ হত্যা (Black Hole) সম্বন্ধে একটু আলােচনা দরকার। সুধীর বাবু তাঁর রচনায় বাংলা তথা ভারতের কল্যাণের জন্য বেশ বুদ্ধিমানের ও মস্তিষ্কের উর্বর পরিচয় দিতে চেষ্টা করে গেছেন। অন্ধকূপ হত্যার স্রষ্টা সুধীর বাবু নন, তিনি হচ্ছেন ইংরেজ অনুচর মিঃ হলওয়েল (Hal Well)। এই হল ওয়েলকে শ্রী সুধীর বাবু সত্যবাদী ও প্রকৃত ঐতিহাসিকের মর্যাদা দিয়েছেন। সুধীর বাবু মােটামুটি চারটি পয়েন্টের ওপর চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন। প্রথমত-যেহেতু হলওয়েল এই ঘটনার নায়ক সেহেতু অন্ধকূপ সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য ও বক্তব্য অবশ্যই গ্রহণযােগ্য।
দ্বিতীয়ত-মিঃ কুক এবং হলওয়েলের প্রকাশিত তথ্য প্রমাণ করে তারা অন্তত মিথ্যাবাদী নন। অতএব তাঁদের কথা সত্য।
তৃতীয়ত-যদি এই কথা মিথ্যা হতাে তবে Dark এবং Councillor গণ এটাকে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করেননি কেন?
চতুর্থত-হলওয়েলের স্বজাতির মধ্যে যারা তার শত্রু তারাই বা প্রতিবাদ করেননি কেন? অতএব উপরােক্ত সত্যতার ভিত্তিতে কলিকাতায় Hal well Monument (হলওয়েল মনুমেন্ট) রচিত।
এক্ষণে উপরের প্রমাণ দিতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, ‘যা রটে তা কিছুও বটে’ অর্থাৎ সিরাজের অন্ধকূপ হত্যার কাহিনীটিকে নিছক গল্প বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না কিন্তু তবুও বাঁধা বুলিতে মুগ্ধ হওয়ার চেয়ে একটু যুক্তি তর্কের আশ্রয়ে পূর্ণ তথ্যটি আলােচনা করার প্রয়ােজনীয়তা নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমানের পরিচয়।
এইবার মিঃ হল ওয়েলের চরিত্রটা যাচাই করা কর্তব্য। ঐ হলওয়েল সাহেবই মীরজাফরকে সিংসাহনচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করে মীর কাশিমকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন এবং তিন লক্ষ নয় হাজার তিনশত টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন। এর জীবন্ত প্রমাণ ১৭৭২ খৃস্টাব্দের ‘Report of the Committee of the House of commons’ দ্রষ্টব্য। ঐ হল ওয়েলই বিলেতের কর্তৃপক্ষকে পত্র লিখেছিলেন যে, “নবাব মীর জাফর আলি খাঁর জঘন্য চরিত্রের কথা কি আর জানাব? তিনি ১৭৮৬ খৃস্টাব্দের জুন মাসে নওয়াজেস মহিষী ঘষেটী বেগম, সিরাজের মা আমিনা বেগম প্রমুখ সম্ভ্রান্ত মহিলাদের কার রাজ কারাগারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন।”
এই পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে হলওয়েল সাহেব যে মস্তবড় এক বােকা ও মিথ্যাবাদী তা প্রমাণিত। কারণ হলওয়েল যখন ঢাকায় রাজ মহিলাদের মৃত্যু কাহিনী রচনা করেন তার পরেও তারা সশরীরে জীবিত ছিলেন। (Long’s Selection from the record of India, Vol-দ্রঃ)
Letter to court, L177630th September at pas জানা যায় হলওয়েলের ঐ বানানাে কাহিনী পরে অনেকে মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়েছেন।
হলওয়েলের হিসাব
মিঃ হলওয়েলের লেখাতেও প্রমাণ হয় সিরাজের কলকাতা আক্রমণের পূর্বে কলকাতা দুর্গে ষাটজন মাত্র ইউরােপীয়ান ছিলেন। ঐ ষাটজনের মধ্যে গভর্নর ড্রেক, সেনাপতি, মিনচিন, চারলডগলাস, ওয়েভার ব্যারণ, ক্যাস্টনহেনরী, লেঃ মেপল টফট, রেভারেণ্ড ক্যাস্টন, ফ্রাঙ্কল্যাণ্ড, মানিংহাম ও গ্রান্ট প্রমুখ দশজন বীরপুরুষ পালিয়ে গিয়েছিলেন।
তাহলে হলওয়েলের মতে ষাট থেকে দশ গেলে বাকি থাকে পঞ্চাশ অর্থাৎ সিরাজের হাতে মাত্র পঞ্চাশজনের প্রাণহানি হয়। কিন্তু ঐ হলয়েল সাহেব আবার কী করে শতাধিক লােকের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশন করেছেন তা বড়ই আশ্চর্যের বিষয়। এই তথ্যগুলাের প্রমাণ মেলে “Halwell’s Letter to the Honble the court of directors, dated Falta, 30th Nov. 1756, para 36” দ্রষ্টব্য।
পূর্বে বলা হয়েছে মিঃ ড্রেকের দুর্গ পরিত্যাগের পর ১৭০ জন দুর্গে জীবিত ছিল। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী মিঃ যে বলেছেন, ১৯ জুন রাত্রে একজন ইংরেজ সৈন্য ৫৭ জন ডাচ সৈন্যসহ শত্রুপক্ষে যােগদান করে। প্রমাণস্বরূপ Gray’s Letter, Hill Vol Ip-108 দ্রষ্টব্য।
আবার মিঃ ওয়াটস্ বলেছেন, মিঃ ড্রেকের দুর্গ ত্যাগের পর এবং দুর্গের পতনের পূর্ব পর্যন্ত প্রাচীরের উপরেই নিহত হয় ৫০ জন সৈন্য। Hill: vol-1, p-৪৪ -তে উক্ত তথ্যের প্রমাণ মেলে।
এদিকে হলওয়েল বলেছেন, গােলন্দাজ বাহিনীর ৩১ জন সৈন্য ২০ জুনের দুপুরের পূর্বেই নিহত হয়। প্রমাণঃ Hill: Vol-I, p-114 দ্রঃ।
মিঃ মিলস্ বলেন, দুর্গের পতনের সময় ১৮ জন সৈন্য পলায়ন করেন। প্রমাণঃ Vol-1P-44 মিসেস ম্যাসির পত্রে পাওয়া যায়, তাঁর ভ্রাতা ও মিঃ পলক ঐ সময় পলায়ন করেন।
প্রমাণঃ Hill; Vol-1, P-182 দ্রষ্টব্য। কিন্তু মিঃ পলকের নাম মিঃ মিলসের তালিকার মধ্যে পাওয়া যায় না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে ১৭০ জন লােকের মধ্যে ১৫৭ জন দুর্গ পতনের পূর্বে। নিহত হয় বা পলায়ন করে। সুতরাং মাত্র ১৩ জন দুর্গের মধ্যে থাকে বা ছিল।
অন্য অনেক কাগজ পত্রে বা রেকর্ডে দেখা যায় দুর্গ সংলগ্ন পরিখা বা খালে সাতার দিয়ে পালাবার সময় অনেকে ডুবে মারা যায়। প্রমাণঃ Hill: Vol-1, P-50, 208, 293, Vol-3, P-169 দ্রষ্টব্য।
ক্যাপটেন কলিনস এইভাবেই মারা গিয়েছিলেন। প্রমাণঃ Hill Vol-3, P-72, 105 দ্রষ্টব্য। এইসব ঐতিহাসিক হিসাব বা গবেষণার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মাত্র ৮ হতে ১০ জন ইংরেজ দুর্গে বর্তমান ছিল।
তাই ঐ হলওয়েলের কুকীর্তির স্বরূপ দেখে নিরপেক্ষ দৃষ্টিসম্পন্ন বাংলার বীর সন্তান শ্রী অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় বলেন,
“মুসলমানদের কথা ছাড়িয়ে দাও। তাঁরা না হয় স্বজাতির কলঙ্ক বিলুপ্ত করার জন্য স্বরচিত ইতিহাস হতে এই শােচনীয় কাহিনী সযত্নে দূরে রাখতে পারেন। কিন্তু যারা নিদারুণ যন্ত্রণায় মর্মপীড়িত হয়ে অন্ধকূপ কারাগারে জীবন বিসর্জন করলেন তাদের স্বদেশীয় স্বজাতির সমসাময়িক ইংরেজের কাগজপত্রে অন্ধকূপ হত্যার নাম পর্যন্তও দেখতে পাওয়া যায় না। কেন?”
শ্রীমতি, হেমলতা দেবী লিখিত “ভারত বর্ষের ইতিহাস” পুস্তকের সমালােচনায় শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখা ‘ইতিহাস’ পুস্তকের দ্বিতীয় মুদ্রণে ১৫৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “সিরাজুউদ্দৌল্লাহ রাজ্য শাসনকালে অন্ধকূপ হত্যার বিবরণ লেখিকা অসংশয়ে প্রকাশ করেছেন। যদি তিনি শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয়কুমার মৈত্রের ‘সিরাজুদৌলা’ পাঠ করতেন তবে এই ঘটনাকে ইতিহাসে স্থান দিতে নিশ্চয়ই কুণ্ঠিত হতেন।”
পলাতক ইংরেজ বীরপুরুষগণের পলায়নের বিবরণে বা সিরাজের প্রতি পিগটের পত্রে অথবা সিরাজকে লিখিত ওয়াটগণের ও ক্লাইভের বীরত্বপূর্ণ পত্রে অন্ধকূপের কোনও উল্লেখ নেই। এমনকি আলিনগরের সন্ধির কাগজেও তার উল্লেখ নেই।
ক্লাইভ কোর্ট অফ ডিরেক্টরকে যে পত্র লিখেছেন তাতে সিরাজকে কেন সিংহাসনচ্যুত করা হয়েছে তার বিবরণ আছে, কিন্তু অন্ধকূপ হত্যার কোন কথাই সেখানে নেই। অথচ সুধীর কুমার আর নবীন কুমারের নবীন কলম নবীশতায় তাকে জোরশােরে প্রতিপন্ন করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করা হয়েছে। তাই তাদের এহেন। ধৃষ্টতা বহু দৃঢ়চেতা সৎ মানুষ কথা অক্ষয় কুমার মৈত্র, বিহারীলাল সরকার, গিরিচন্দ্র ঘােষ, নিখিল রায়, কবি রবীন্দ্রনাথ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরনেতা নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুসহ অনেকের মনকে বেদনা দিয়েছিল।
শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয় কুমারের আন্দোলন এবং কলমের অগ্নিবর্ষণকে নেতাজী দারুণভাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ফলে ১৯১৫ খৃস্টাব্দে ২৪ মার্চ কলকাতার হিষ্ট্ৰীক্যাল সােসাইটির মাধ্যমে এসিয়াটিক সােসাইটির ঘরে এক বিরাট সভায় উপস্থিত বঙ্গবীর অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, জে, এইচ, লিটুল, এফ, জে, মানাহন প্রমুখের সম্মুখে ঐ অন্ধকূপ হত্যার ইতিহাস উপন্যাস, উপকথার মত নিক্ষিপ্ত হয় অর্থাৎ ঘটনাটি মিথ্যা বলে স্বীকৃতি পায়। তার কিছুদিন পরে জে, এইচ, লিটল Calcutta Historical Sociсty-এর ম্যাগাজিন বা পত্রিকায় প্রকাশ করে দেন এবং অন্ধকূপের জন্য বলা হয় Gigantic hoax অর্থাৎ প্রকাণ্ড ধাপ্পাবাজি। উপরােক্ত তথ্যাদি ‘Bengali past and present, vol-XI, Serial No-1, P,P,-75-10’ হতে সংগৃহীত।

সিরাজুউদ্দৌল্লাহ বিদ্বেষী ইংরেজদের কল্পিত অন্ধকূপে প্রায় দুশ জন লােকের বন্দির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই ঘরটির আয়তন হচ্ছে মাত্র ১৮x১৪। সুতরাং স্থান সংকুলান হয় না দেখে থেকে কমিয়ে ১৪৬ জন ধরা হয়েছে, কিন্তু শয়তানের দল যখন দেখল ঐ পরিমাণ স্থানে ১৪৬ জনেরও স্থান সংকুলান হতে পারে না তখন সঙ্গে সঙ্গে সুর পাল্টে ১৪৬ হতে মাত্র ৬০ সংখ্যায় এনে দাঁড় করানাে হল। এরই নাম ইতিহাস।
ব্যবসাদার কবি ও সাহিত্যিকদের নীতি হচ্ছে, ‘মামার জয়’ বলার মত অর্থাৎ যখন যেদিকে বাতাস বইবে সেদিকেই লিখে যাওয়া, স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া। বীর তারাই যারা প্রয়ােজনীয় বিষয় সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করেও সমাজের সামনে তুলে ধরতে সাহসী হন। তাই অক্ষয় কুমার, সুভাষ বােস প্রমুখ বীর সন্তানদের প্রতি ধন্যবাদ যে, যখন দেশ স্বাধীন হয়নি সেই সময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে কথা বলা বা আন্দোলন করা খুবই বীরত্বের পরিচয় সন্দেহ নেই।
১৯৪০ খৃস্টাব্দে জুন মাসে সুভাষ বােস ঐ অন্ধকূপ হত্যার মনুমেন্টটি ভেঙে ফেলার দাবি করেন। ফরে বিরাট আন্দোলন হয়। শত্রু ইংরেজ এবং মুসলমান বিদ্বেষী অনেক অমুসলমানই সেদিন অবাক অথবা অসন্তুষ্ট হন কিন্তু সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী, তবে ধৈর্যের প্রয়ােজন। ইংরেজ রাজত্বের রাজধানী কলকাতায় ঐ মনুমেন্ট ইংরেজকে ভেঙে ফেলতে বাধ্য হতে হয়।
এদিকে গিরিশ ঘােষ ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নামে একটি সঠিক সুন্দর বই সাহসের সঙ্গে লিখলেন। তার উপর অক্ষয় বাবুর ‘সিরাজউদ্দৌলা’ ও ‘মীরকাসিম’ অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করে। পরে সত্য চরণ শাস্ত্রী একখানি বই লিখলেন তার নাম ‘জালিয়াত ক্লাইভ’। তারপর সখারাম গণেশ দেউস্কর ‘দেশের কথা’ নাম দিয়ে এ সম্বন্ধেই আর একখানা বই লিখলেন। এটিই বেশ উপাদেয় বই। এর দু-একটি বাক্য এখানে তুলে ধরছি-
“ইংরাজ ইতিহাস লেখকেরা হিন্দু ছাত্রদের হৃদয়ে মুসলমান বিদ্বেষ প্রজ্বলিত রাখবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করেছেন, পরিতাপের বিষয় কোন কোন অদূরদর্শী হিন্দু লেখক কাব্য নাটকাদিতে অনর্থক মুসলমান ভাতাদিগের নিন্দাবাদ করে ইংরাজের উদ্দেশ্য সিদ্ধি বিষয়ে সহায়তা করতেছেন।”
উক্ত মন্তব্যটি গভীরভাবে পাঠক-পাঠিকাবৃন্দকে স্মরণ করে দিচ্ছে যে, সমাজের বর্তমান অবস্থা একেবারে সখারাম মহাশয়ের লেখার সঙ্গে সাংঘাতিকভাবে সঙ্গতি রক্ষা করে। যাইহােক, বিরাট ইতিহাস সমুদ্রের মাত্র এক পাত্র নােনা জলকে সিরাজকেন্দ্রিক কলমে পরিশ্রুত করা হয়েছে কিন্তু বাকি তথ্য আর কতদিন দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের সুভাষ আর অক্ষয়ের অপেক্ষায় প্রতীক্ষা করবে জানি না।
আবার এদিকে গিরীশচন্দ্র ঘােষ মহাশয় একটি নাটক লিখলেন যা সহজে বিষাক্ত ও চলতি নাটকের একেবারে উল্টো। সাধারণ মানুষের মস্তিষ্ক একটু নড়ে উঠল-তাহলে ইতিহাস যা শুনি তাতাে ঠিক নয়। কবি নবীনচন্দ্র সেন ঐ বইটি। পড়ে একটি পত্র লিখলেন গিরীশচন্দ্রের নামে তাও এখানে তুলে ধরা হলাে
“ভাই গিরিশ,
বিশ বছর বয়সে আমি ‘পলাশীর যুদ্ধ’ লিখেছিলাম, আর তুমি ষাট বছর বয়সে ‘সিরাজুউদ্দৌল্লাহ’ লিখেছ। আমি বিদেশী ইতিহাসে যেভাবে পাইয়াছি সেভাবে চিত্রিত করেছি কিন্তু তুমি সিরাজের নিখুঁত চিত্রটি অঙ্কিত করছ। অতএব তুমি আমার অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী, আমার অপেক্ষা অধিক ভাগ্যবান।”
অত্যন্ত দুঃখের কথা সিরাজের ইতিহাসে শুধু যেন মনে হয় মুসলমান মীর জাফরের কথা, যেন প্রমাণ হয় মুসলমান জাতি মানেই বিশ্বাসঘাতক জাতি। তাই আজ মুর্শিদাবাদ জেলা ও মুসলমান জাতি পর্যন্ত বাংলার বাতাসে যেন কলঙ্কিত। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস এই কথাই বলে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে স্বাধীনতার আকাশ ছোঁয়া অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়েছিল তা মুসলমানদের হাতেই। ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ তার জ্বলন্ত প্রমাণ, আর এই “সিপাহী বিদ্রোহের” গােড়াপত্তনের দাবিতে যে জেলা গৌরবের অধিকারী, ইতিহাসমণ্ডিত উল্লেখযােগ্য স্থান মুর্শিদাবাদের সদর শহর বহরমপুর। যাঁরা দিলেন খুন, যাঁরা দিলেন জীবন তাঁদের ভাগ্যে পুরস্কারের পরিবর্তে তিরস্কার। হায়! এই নাকি ইতিহাস!
সিরাজ কি সত্যই নিষ্ঠুর ছিলেন?-এই প্রশ্নে অনেকে বিচলিত হন। অথচ ইতিহাস প্রমাণ করে সিরাজ সত্যই নিষ্ঠুর ছিলেন না।
সিরাজুউদ্দৌল্লাহ জানতেন মীর জাফরের হাবভাব। তাহলে এখানে একটা প্রশ্ন হবে এই যে, সিরাজুউদ্দৌল্লাহ যদি জানতেন মীর জাফরের দ্বারা স্বাধীন ভাগ্যাকাশে দুর্যোগ উদয় হবে তবে কেন তাকে পূর্বাহ্নেই সরিয়ে দেননি? স্বাধীন ভারতের প্রতি সিরাজের এটা কি নিষ্ঠুরতা নয়? উত্তরে বলব-না। কারণ মীরজাফর সিরাজের সম্মুখে পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে শপথ করে বলেছিলেন যে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিংহাসন রক্ষা করতে চেষ্টা করবেন। তাই পবিত্র কুরআনের সম্মানার্থে বিশ্বাসঘাতকতার পূর্বেই তাকে শাস্তি দিতে পারেননি। এটা নিষ্ঠুরতা না উদারতা তা অনুমান সাপেক্ষ।
বীর সিরাজুউদ্দৌল্লাহ ওয়াট সাহেবকে সপরিবারে বন্দি করে কাশিমবাজার হতে মুর্শিদাবাদে নিয়ে এসেছিলেন। সিরাজুউদ্দৌল্লাহ জননী আমিনার কোমলতায় সিরাজের করুণাবতী স্ত্রী লুৎফুন্নেসা তাঁদের মুক্তি দিয়েছিলেন। যখন সিরাজুউদ্দৌল্লাহ ঘটনাটা শুনলেন তখন গর্ভধারিণী মা বা সহধর্মিনী স্ত্রী কাউকেই তিরস্কার অথবা কৈফিয়ত চাওয়ার কোন ভূমিকাই তিনি নিতে পারেননি। এটাও সিরাজের সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা ও উদারতা না নিষ্ঠুরতা তাও বিবেচনার ভার পাঠক পাঠিকাদের ওপর থাকল।
রাজা রাজবল্লভ অলিবর্দীর আমলে প্রজাদের সর্বনাশ সাধন করে যে বিরাট অঙ্কের ধন সঞ্চয় করেছিলেন এবং তাঁর পুত্র কৃষ্ণরায় মারফত সেই প্রচুর অর্থ যখন ইংরেজদের ঘাঁটিতে পাচার হয়েছিল তখন সিরাজুউদ্দৌল্লাহ রাজবল্লভ ও তার পুত্র কৃষ্ণরায়ের ওপর স্বাভাবিকভাবেই অসন্তুষ্টই হয়েছিলেন। ঠিক তার পরেই তিনি কলকাতার দুর্গ নির্মাণের অপরাধে কলকাতা আক্রমণ করেছিলেন এবং বিশ্বাসঘাতক হলওয়েল সাহেব, কৃষ্ণদাস ও উমিচাদকে ইংরেজদের কাছ হতে বন্দি করে নবাবের সম্মুখে আনা হল। বলাবাহুল্য, এই কৃষ্ণদাসের পাচার করা প্রচুর অর্থই কলকাতা দুর্গ নির্মাণে ইংরেজদের হাত শক্ত করেছিল। তাই কৃষ্ণদেবের কাণ্ডকে কেন্দ্র করেই সিরাজের কলকাতা অভিযান। সিরাজুউদ্দৌল্লাহ যখন তাদের হাতের মুঠোয় পেলেন তখন তাঁরা জানতেন প্রাণদণ্ডই হয়ত আমাদের যােগ্য শাস্তি। কিন্তু তিনজনেই ক্ষমা প্রার্থনা করলেন আর সিরাজুউদ্দৌল্লাহ প্রত্যেককে ক্ষমা করে বা মুক্তি দিয়ে ক্ষমাধর্মের অতুলনীয় মাহাত্ম্যকে অক্ষুন্ন রাখলেন। এরই নাম বােধ হয় নিষ্ঠুরতা?
সিরাজের ঐতিহাসিক নিমজ্জন
সিরাজ আওরঙ্গজেবের ন্যায় ইসলামের পূর্ণ প্রতীকও যেমন ছিলেন না তেমনি আকবরের ন্যায় স্বধর্মের নিপতি সাধনে অগ্রগামী নায়কও ছিলেন না; বরং তাকে ধর্মভীরু বলার পথে কোন প্রতিবন্ধক নেই। কেননা যখন তিনি বন্দি ছিলেন তখন তাঁর কক্ষে, মুহাম্মদী বেগ উলঙ্গ তরবারী হাতে প্রবেশ করলেই সিরাজ অনুমান করেছিলেন তাঁর মৃত্যু সংবাদ আগত। তখন সিরাজ কাতর কণ্ঠে বললেন-মুহাম্মদী বেগ তুমি আমায় কতল করতে এসেছ? মুহাম্মদী বেগ তখন নিশ্চুপ। নবাবের মুখের দিকে তাকাতেও যেন সে অপারগ। আবার কাতর কণ্ঠে নবাব বললেন-
“আমাকে কি তােমরা সামান্য একটা অসহায় গরিবের মত বেঁচে থাকতেও দেবে না?” এবার মুহাম্মদী বেগ গলাটা সামান্য পরিষ্কার করে বললাে- “না, তারা তা দেবে না, আমিও বাঁচতে চাই না, হুসেন কুলীর মৃত্যুর প্রতিশােধ হােক।”
বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা তথা সারা ভারতের দেদীপ্যমান। আলােকবর্তিকা নবাব সিরাজুউদ্দৌল্লাহ তাঁর দেশবাসীর চোখের আড়ালে অশ্রু মুছে আবার কাতর কণ্ঠে বললেন-“আমাকে একটি বার সুযােগ দাও, আল্লাহর সন্নিধানে যাবার পূর্বে শেষ দুই রাকাত নামায পড়ে নেই।” মুহাম্মদী বেগের চক্ষুদ্বয় তখন বর্ষণােন্মুখ। অশ্রুবৰ্ষক মেঘে কিছু দেখতে পায় না যে, উত্তরও দিতে পারে না। নবাব বুঝলেন মৌনং সম্মতি লক্ষণ। তাই জীবনের অন্তিম প্রার্থনাময় নামাযে আত্মনিয়ােগ করলেন। নামায তখনও শেষ হয়নি, দূরে বাঁশির সংকেত শ্রবণে মুহাম্মদী বেগ প্রার্থনারত অবস্থাতেই তরবারী চালনা করলাে নবাবের পিঠের উপর। ঐ আঘাতেই লুটিয়ে পড়লেন নবাব। অতঃপর আরও কয়েকটি আঘাত করলাে মুহাম্মদী বেগ। সিরাজুউদ্দৌল্লাহ শুধু একবার বলেছিলেন, ‘আল্লাহ তুমি আমায় ক্ষমা করাে’। তারপর রক্তাক্ত সিরাজুউদ্দৌল্লাহ শুধু আল্লাহ আল্লাহ শব্দ করতে করতেই চিরবিদায় নিলেন।
এই ঘটনায় অল্পজ্ঞানী পাঠক মুসলমান ভৃত্য কত বিশ্বাসঘাতক ও নিষ্ঠুর হতে পারে তারই শিক্ষা পারে, কিন্তু সূক্ষ্ম ও সুস্থ জ্ঞানীর নিকট ধরা পড়বে আসল রহস্য।
ইংরেজরা যখন সিরাজকে পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির মত বন্দি করেছিল তখন সিরাজের সমস্ত চাকর-চাকরানী আর সিরাজের ছিল না; বরং ইচ্ছার বিরুদ্ধেও ক্লাইভ আর ওয়াটসের হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় ইতিহাসে মুসলিম চরিত্রকে কলঙ্কিত করার পরিকল্পিত বুদ্ধিতেই সিরাজের সাহায্যপুষ্ট মুহাম্মদী বেগকেই আদেশ করা হয়েছিল সিরাজকে হত্যা করতে। মুহাম্মদী বেগ তাতে রাজি না হওয়ায় তারও প্রাণদণ্ড হবে বলে তাকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল। তখন অন্যোন্যপায় নিরক্ষর বােকা মুহাম্মদি বেগ অশ্রুসম্বরণ করেও মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই হত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল। যদি মুহাম্মদী বেগ শিক্ষিত ও জ্ঞানী হতাে তাহলে হয়ত ইংরেজদের আদেশ প্রত্যাখ্যান করে নিজের প্রাণদণ্ডকেই অমৃত জ্ঞানে বরণ করে মীর মর্দান আর মােহন লালের মত ধন্য হতে পারতাে। সিরাজুউদ্দৌল্লাহ যখন একটু অসহায়ের মত বেঁচে থাকার আবেদন করেছিল তখন মুহাম্মদী বেগ এ কথা বলেছি যে, না, আমরা তা দেব; বরং তাঁর ভাষাতে হৃদয়ের অবারিত প্রেমধারাই প্রবাহিত হয়েছিল, ‘না, তারা তা দেবে না।‘ এই তারা কারা?
যাইহােক, সিরাজকে হত্যা করে তাঁর মৃতদেহকে একটি বস্তায় ভরে হাতীর পিঠে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সিরাজের স্ত্রী, মা এবং অনেক আত্মীয়া তখন বন্দিনী। তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তারা আলিবর্দীর বিখ্যাত বাগানের আম খেতে চান কি না। অশ্রু সজল নয়নে তাঁরা ইঙ্গিতে সম্মতিই দিয়েছিলেন।
তারপর করুণার জীবন্ত ছবি ইংরেজ কর্মচারীর আদেশ অনুযায়ী অৰ্দ্ধ ভর্তি আমের বস্তা পৌছে দেওয়া হয়েছিল। নবাব পরিবারের সমস্ত মহিলাদের পক্ষ হতে একজন বস্তার মুখ কুলতেই দেখতে পেলেন ভেতরে আমও নেই বা অন্য কোন খাদ্য বস্তুও নেই, আছে সিরাজের বীভৎস কাঁচা কাটা মাথা। সিরাজুউদ্দৌল্লাহ যেন তাঁর গর্ভধারিণী মাকে শেষ দেখা দেখতে এসেছে। সিরাজের হতভাগিনী মা প্রিয় পুত্রের মুখের দিকে এক পলক তাকাতেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। সম্বিত ফিরে এলে মীর জাফরের অনুচর গােলাম হােসেনের আদেশে তাকে পুনরায় কারারুদ্ধ করা হয়।
এদিকে জয়নুল আবেদীন নামক এক দরিদ্র নাগরিকের অনুরােধে সিরাজের খণ্ডিত দেহকে ভাগীরথী নদীর পারে খােসবাগ নামক বাগানে নানাজান, আলিবর্দীর কবরের পূর্ব পাশে সমাধিস্থ করা হলাে। আবার মৃত নানা ও নাতীর এক ঐতিহাসিক মিলন হয়েছিল মৃত্যুর পরেও। এ প্রসঙ্গে বর্ধমান জেলার এক। কবির কবিতার কিয়দংশ গভীর শ্রদ্ধার সাথে তুলে ধরছি-
“আলীবর্দীর কবরের ছায়া সূর্যাস্তের সনে, ধীরে ধীরে পরে সিরাজের গােরে! দেখি ভাবি মনে; আজো বুঝি দাদু ভােলে নাই তারি স্নেহের দুলালটিরে, আজো বুঝি তারে দুটি বাহু দিয়ে রেখেছে সােহাগে ঘিরে।”
সিরাজের ইতিহাস পৃথক একটা পুস্তকে তুলে ধরাই সম্ভব। তার জন্য বহু ঐতিহাসিক তথ্য আমাদের হাতে মজুত আছে। কিন্তু এখানে সংক্ষিপ্ত মাত্র জানানাে হলাে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।