লিখেছেনঃ মমতাজুর রহমান তরফদার
ঐতিহাসিকদের প্রবণতা ও ইতিহাসের সমস্যার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে তাদেরকে জাতীয়তাবাদী, প্রশাসক, মিশনারী প্রভৃতি শ্রেণী-বিভাগে চিহ্নিত করা আজকের দিনে রীতিমত রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। স্যার যদুনাথকে১ জাতীয়তাবাদী বলা যায় কি না, সেটি একটি জরুরী প্রশ্ন। প্রশাসনিক স্বার্থ কিংবা স্বধর্ম প্রীতি তাঁর রচনাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তবে জাতীয়তাবাদও তাঁর ইতিহাস-চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে সব সময় কাজ করেছে বলে মনে হয় না। সত্যসন্ধানী, এই অভিধেয়ই তাঁর প্রতি বিশেষভাবে প্রযােজ্য। সত্যের স্বরূপ বুঝবার জন্য সন্ধান-কার্য শুরু হয়েছিল তাঁর ছাত্র জীবনেই, যখন তিনি কতকগুলি ইংরেজী বই পড়ে টিপু সুলতানের পতন-সংক্রান্ত ঘটনা জানতে গিয়ে সন্তোষজনক ফল পাননি।২ এই সন্ধান-কার্যের পরিসমাপ্তি ঘটে তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েক বৎসর পূর্বে—যখন মােগল যুগের উপর তাঁর লেখা কয়েকটি মনােগ্রাফ প্রকাশিত হয়।৩
ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার কর্তৃক রচিত ইতিহাসের ধারা ষােল শতক থেকে শুরু করে উনিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত প্রলম্বিত। সুদীর্ঘ কালের ভারতীয় রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে ঐতিহাসিকের নিবিড় পরিচয় ছিল বলেই তার লেখা History of Aurangzib, Fall of the Mughal Empire এবং Shivaji and His Times৪ কোনাে নিরেট ও সীমিত চিত্রের মত নয়। বইগুলিতে আমরা পাই অতীতের সামগ্রিকতা সম্বন্ধে যাথানুপাতিক ধারণা-পাই ইতিহাসের এমন এক ব্যাপক ভূ-দৃশ্য যাতে বিগত দিনের চেহারাটি সব রকমের রূপ-রেখা-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শসহ ধরা পড়েছে। স্যার যদুনাথ সরকার বােধ হয় জার্মান ঐতিহাসিক Ranke-এর মত মনে করতো যে, অতীতের ঘটনাকে নিছক ঘটনা রূপে (as it actually happened) জানতে পারা সম্ভব। যাঁরা ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করেছেন, তাঁর লেখায় আমরা তাই তাদের আশা-নৈরাশ্য, পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য, মানবীয় মহত্ব ও দুর্বলতা এবং ভ্রান্তির চিত্রধর্মী বর্ণনা পাই। এই চিত্রধর্মের সঙ্গে মিলেছে এক সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্যঃ মােগলদের পতনের ইতিহাস যেন এক বিয়ােগান্ত নাটক। আওরঙ্গজেবের সমগ্র জীবনকে তুলে ধরা হয়েছে একটি বিয়ােগান্ত নাটক রূপে যার বিভিন্ন অঙ্ক ও দৃশ্য দর্শকের মনে তীব্র অনুভূতির সৃষ্টি করে।৫ দাক্ষিণাত্যের কার্যকলাপের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে সম্রাটের জীবনের চূড়ান্ত ব্যর্থতা এবং যুবরাজ মুহম্মদ আকবরের বিদ্রোহের মধ্যেই আছে কোনাে এক নির্মম নিমেসিসের অদৃশ্য হস্ত। ইতিহাসে নাটকীয় আবহ সৃষ্টির অনুপ্রেরণা এসেছে ঐতিহাসিকের সাহিত্যধর্মী মানসিকতা থেকেই।
যদুনাথের বােধ হয় ধারণা ছিল যে, তুচ্ছ ও গুরুত্বপূর্ণ সর্ব প্রকার ঘটনা মিলেই ইতিহাসের সামগ্রিকতা গড়ে ওঠে এবং প্রতিটি ঘটনাই ইতিহাসের প্রক্রিয়ায় কারণিক প্রভাব বিস্তার করে। এই জন্য ইতিহাসের প্রক্রিয়াকে নিবিড়ভাবে বুঝতে হলে সব রকমের ঘটনারই বিশ্লেষণ নিতান্ত প্রয়ােজন। পূর্বোক্ত গ্রন্থগুলিতে সূক্ষাতিসূক্ষ্ম ঘটনা-বিশ্লেষণের মধ্যেই এই ইতিহাস-দর্শন সুস্পষ্ট। এগুলিতে ক্ষুদ্র ঘটনা ও তুচ্ছ উপকরণও উপেক্ষিত হয়নি। ইতিহাসের ঘটনা ও বিভিন্ন শক্তির মধ্যকার জটিল সম্পর্কের গ্রন্থি লেখক যেন নৈপুণ্যের সঙ্গে খুলে দিয়েছেন।
Literary favour-এর দিক দিয়েই হয়ত স্যার যদুনাথ Bengali Gibbon,৬ তাঁর Fall of the Mughal Empire সিরিজ Irvine-এর Later Mughals,৭ -এর পরিপূরক এবং বিষয়বস্তুর বিন্যাসে এবং আলােচনার ব্যাপক ভঙ্গিতেও এতে Irvine-এর প্রভাব আছে বলে মনে হয়। Irvine-এর গ্রন্থটির সমালােচনার অংশ বিশেষ উল্লেখ করে স্যার যদুনাথ বলেছেনঃ৮
The same woodcraft has been followed in this continuation of that work, but the jungle is much thicker here.
তিনি ইংরেজ লেখকের গ্রন্থটির সম্পাদনা করে এবং এতে নাদির শাহের ভারত আক্রমণ সংক্রান্ত তহাস সংযােজনা করে একে পরিপূর্ণ করে তুলেছেন এবং মানুষ ও ঐতিহাসিক হিসেবে Irvine-এর প্রশংসা করে তাঁর নাতিদীর্ঘ জীবনীও লিখেছেন।৯ গবেষক জীবনের শুরুতে তিনি উক্ত ইংরেজ ঐতিহাসিকের কাছে থেকেই help, guidance and light on obscure points পেয়েছেন।১০ ১৭৩৯ খ্রীস্টাব্দে এসে Irvine-এর গ্রন্থটি শেষ হয়েছে। ঐ তারিখ পর্যন্ত নামে এবং কার্যে ভারতের শাসনকেন্দ্র ছিল শুধু একটি। সেইজন্য বইটি লিখতে গিয়ে lrvine যে সুবিধা ভােগ করেছেন, স্যার যদুনাথের ভাগ্যে তা জোটেনি। নাদির শাহের ভারত আক্রমণের পর থেকে মােগল সাম্রাজ্যের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্রুতভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকে এবং অনেকগুলি স্বাধীন শাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় যাদের মধ্যকার সম্পর্কগত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পরবর্তীকালের ইতিহাসকে জটিল করে তােলে। স্যার যদুনাথ এই জটিলতা কমিয়েছেন ক্রমাগত দিল্লীর সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের ইতিহাসের সূত্র গ্রথিত করে। Irvine-এর গ্রন্থের তুলনায় Fall of the Mughal Empire-এ ঘটনা-বৈচিত্র্য যেমন বেশী, ব্যবহৃত মাল-মশলার পরিমাণও তেমনি বিপুল এবং তেমনি তা আবার অসংখ্য উৎস থেকে সঙ্কলিত। আরাে যে কয়জন ঐতিহাসিকের লেখা যদুনাথ সরকারের মানস গঠনে বিশেষভাবে সহায়তা করেছিল, তারা হচ্ছেন : Clarendon, Robertson, Hume, Macaulay, Carlyle, Motley, Froude, Lecky এবং Green।১১ এক Green ছাড়া এদের লেখা মূলতঃ রাজনৈতিক ইতিহাস। এই লেখকদের প্রভাবে রাজনৈতিক ইতিহাসকেই গবেষণার ক্ষেত্ররূপে বেছে নেয়া যদুনাথের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক ছিল। উনিশ শতকে, এমন কি বিশ শতকের প্রথম দিকেও, ইন্দো-মুসলিম রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল প্রায় সম্পূর্ণ অলিখিত। স্যার যদুনাথের মনে মােগল আমলের রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার তাগিদ এসেছিল অন্ততঃ আংশিকভাবে এই শূন্যতা থেকেই। আজকের দিনে যখন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখার প্রতি ঝোঁক ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, তখন রাজরাজড়ার ইতিহাসের গুরুত্ব হয়ত সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারা মুশকিল। রাজনৈতিক ইতিহাসে রাষ্ট্রকে আলােচনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপিত করা হয় এবং প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাষ্ট্র থেকেও প্রবলতম কারণিক প্রভাব জন্ম দিয়ে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করেছে। স্যার যদুনাথ যদি মধ্যযুগের রাজনৈতিক ইতিহাস না লিখতেন, তবে এ যুগের সামাজিক ইতিহাস রচনার প্রস্তুতিও বিলম্বিত হত, কারণ সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা রাষ্ট্রিক কাঠামাে সম্বন্ধে ধারণার স্পষ্টতার উপরে অনেকটা নির্ভরশীল। আলােচ্য ঐতিহাসিকের লেখায় আমরা কান্দাহার থেকে চট্টগ্রাম এবং কাশ্মীর থেকে কর্ণাটক পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল ভূখণ্ডের ইতিহাসের three dimensional view পেয়ে থাকি।
দুই
স্যার যদুনাথ প্রথম যে বইটি লেখেন, তার নাম India of Aurangzib (Topography, Statistics and Road)১২; এটি ইতিহাস নয় ; কিন্তু এতে ইতিহাসের মাল-মশলা আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। ‘খুলাসাত-উত-তাওয়ারিখ’ (১৬৯৫), ‘দসতুর-উল-আমল’ (১৭০০?), ‘চাহার গুলশান’ (১৭২০?), ‘আইন-ই-আকবরি’ (১৫৮৫) এবং Tieffenthaler-এর Geographie de L’Indowstan (Bernoulli-এর ফরাসী সংস্করণ)-এর ভিত্তিতে এ গ্রন্থে মােগল যুগের ভূমিসংস্থা, পরিসংখ্যান ও পথঘাটের বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে। এতে আছে মােগল সাম্রাজ্যের সুবা ও তাদের বিভাগসমূহ, রাজস্ব, জরিপ করা জমির পরিমাণ, প্রাকৃতিক অবস্থা, কৃষি ও শিল্প, খনিজ ও অন্যান্য উৎপন্ন দ্রব্য, জনসাধারণের আচার-ব্যবহার, ধর্মীয় বিশ্বাস ও উপাসনা-পদ্ধতি, মসজিদ, মন্দির, সাধুসন্ত জন, মেলা এবং আরাে কিছু প্রয়ােজনীয় বিষয়ের বিশদ বর্ণনা। দিল্লী থেকে বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থা সুষ্ঠু, ও সুগম করার জন্য যে সকল সড়ক নির্মিত হয়েছিল, তাদের উপরকার স্থানসমূহের অবস্থান নির্ণীত হয়েছে মানচিত্র ও gazetteer-এর সাহায্যে।
উনিশ শতকের শেষার্ধে ইংরেজ কর্মচারিগণ gazetteer এবং statistical account লিখেছিলেন প্রচুর পরিমাণে। এ জাতীয় লেখা দেখেই বােধ হয় স্যার যদুনাথ মনে করেছিলেন যে, মােগল যগের ভারত সম্বন্ধে অনুরূপ রচনার আবশ্যকতা আছে। তা ছাড়া ‘আইন-ই-আকবরি’ ছিল তাঁর কাছে অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস। Gazetteer শ্রেণীর গ্রন্থ যেমন ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদের কাজে লাগে, মােগল আমলের সামাজিক বা রাজনৈতিক ইতিহাসের আলােচনাতেও India of Aurangzib তেমনি অপরিহার্য। যে দেশের ইতিহাস অল্প দিনের মধ্যেই যদুনাথ লিখতে যাচ্ছিলেন, এ গ্রন্থে যেন সেই দেশের মাটিকেই তিনি সচেতনভাবে জরিপ করেছেন। বইখানি মােগল আমলের ইতিহাস রচনার প্রস্তুতি-পৰ্বরূপে চিহ্নিত হতে পারে।
History of Aurangzib গ্রন্থের শুরুতে বা অন্য কোনােখানে সমগ্র ভারতের ভৌগােলিক অবস্থা সম্বন্ধে কোনো বিবরণ নেই। India of Aurangzib- ই ন্যায়সঙ্গতভাবে এ জাতীয় বিবরণের স্থান গ্রহণ করতে পারে। আওরঙ্গজেব ও শিবাজীর রাজত্ব প্রসঙ্গে বিভিন্নভাবে বর্ণিত বিভিন্ন দেশের ভৌগােলিক ও আর্থনীতিক অবস্থা এবং ইতিহাসের ধারার উপরে তার প্রভাব (যেমন-বল, বদকশান, কান্দাহার, গুজরাট, আসাম, মারওয়ার, মহারাষ্ট্র, সুরাট, বিজাপুর, হায়দরাবাদ, বাংলাদেশ, মালওয়ার বর্ণনা) মােগল ও মারাঠা ইতিহাসের আলােচনায় গভীরতা সৃষ্টি করেছে এবং তাতে করে ইতিহাসের তাৎপর্য ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। India of Aurangzib-এ দেখি এই ভূগােল-জ্ঞানের উন্মেষ ও বিকাশ। ভূগোলে যদুনাথের শিক্ষানবিশী বৃথা যায়নি।
ঐতিহাসিক যদুনাথের মানসিক প্রস্তুতির প্রতি দৃষ্টি রেখে এর পরেই যে বইটির নাম নিতে হয়, সেটি হচ্ছে Economics of British India,১৩ অর্থনীতির বই হিসেবে এতে যথেষ্ট অপূর্ণতা আছে। যদুনাথ নিজেও মুখবন্ধে বলেছেন যে জ্ঞানের তৎকালীন পর্যায়ে ভারতীয় অর্থনীতির উপর লেখা কোনো রচনা ইতিহাস ও ভবিষ্যদ্বাণীর সংমিশ্রণ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। গ্রন্থটির গুরুত্ব এই জন্য বেশী যে, এতে ঐতিহাসিকের মানসিক পটভূমির পূর্ণ পরিচয় আছে। India of Aurangzib-এর সঙ্গে এ গ্রন্থের সম্পর্ক অত্যন্ত স্পষ্ট। এতে আছে ভারতের ভৌগােলিক অবস্থা ও অর্থনীতির উপর তার প্রভাব, শিল্প, কৃষিজ ও খনিজ সম্পদ, গ্রাম-সংস্থা, গ্রামীণ অর্থনীতি, বর্ণপ্রথা ও তার অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য, অর্থনীতিতে অতি প্রাচীন রীতিনীতির প্রভাব, কৃষি-ব্যবস্থা এবং আরো এমন সব বিষয়বস্তু- যা পড়তে গিয়ে India of Aurangzib-এর অন্তর্গত অনুরূপ বিষয়ের কথা বার বার মনে পড়ে যায়। পরিবহন, ভূমি-ব্যবস্থা ও মুদ্রার আলােচনায় মুসলিম ইতিহাসের জ্ঞান ব্যবহৃত হয়েছে এবং ভূমি-সংস্থা ও পরিসংখ্যা বলতে যা বুঝায় Economics of British India-য় তা একটি বিরাট অংশ দখল করে আছে।
অর্থনীতি ও ভূগােল সম্পর্কিত জ্ঞানের স্পর্শ পেয়ে মােগল ও মারাঠাদের রাজনৈতিক ইতিহাস বহুক্ষেত্রে বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমকালীন ঐতিহাসিক Moreland-এর মত অর্থনীতিকে ইতিহাসের এক মাত্র প্রধান ও মৌলিক শক্তি রূপে ধরে না নিলেও স্যার বদনাথ একে রাষ্ট্রের উন্নতি ও অবনতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত অন্যতম প্রধান শক্তি বলে নির্দেশিত করেছেন। কৃষিই ভারতীয় সম্পদের উৎস। এর উন্নতি বা অবাতির উপরই রাষ্ট্রের ভাগ্য নির্ভরশীলঃ১৪
In a predominantly agricultural country like India, the tillers of the soil are the only source of national wealth, Directly or iudirectly, the land alone adds to the annual national stock.” Even the craftsmen depend on the Peasants and on the men eoriched with land revenue, for the sale of their goods, and if the latter have not enough foodstuff to spare, they cannot buy and bandicrast. Hence, the ruin of the peasants means in India the ruin of the non-agricultural classes too. Pauvre paysans pauvre royaume, is even truer of India than of France. Public peace and security of property are necessary not only for the peasant and the artisan, but also for the trader, who has to carry his goods over wide distances and give long credits before he can find a profitable market. Wealth, in the last resort, can accumulate only from saving out of the peasant’s production. Whatever lowers the peasant’s productive power or destroys his spirit of thrift by creating insecurity about his property, thereby prevents the growth of national capital and impairs the economic staying power of the country. Such are the universal and lasting efforts of disorder and public insecurity in India. And the reign of Aurangzib affords the most striking illustration of this truth.
History of Aurangzib গ্রন্থে এ ধরনের আরাে বহু মন্তব্য আছে। অর্থনীতিতে রীতিমত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পণ্ডিতের কাছে থেকেই এ জাতীয় অভিমত আশা করা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের উপরে আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালের যুদ্ধবিগ্রহ যে কি কঠিন আঘাত হেনেছিল, তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন স্যার যদুনাথ। উক্ত সম্রাটের সমকালীন ফরাসী পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ারের মতই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মােগল সাম্রাজ্যের বাহ্যিক আড়ম্বর ও শান-শওকতের আড়ালে। লােকচক্ষুর অগােচরে ধন-সম্পদের ক্ষেত্রে বিরাট শূন্যতা দেখা দিচ্ছিল এবং তার পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ। তেমনি আবার শিবাজী ও প্রথম বাজি রাও-এর দেশ বিজয়ের গৌরবই মারাঠা জাতির গর্বের বিষয় বটে; কিন্তু তারাও দেশে ধন-সম্পদ সৃষ্টির দিকে নজর দেয়নি এবং শুধুমাত্র লুঠনের উপর নির্ভরশীল হতে চেয়েছে। সেই জন্য লুঠনকারী দেশ ও লুষ্ঠিত দেশের আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গিয়েছিলঃ১৫
It is the Nemesis of a Krieg-Staat to move in a vicious circle. It must wage war periodically if it is to get its food, but war, when waged as a normal method of supply, destroys industry and wealth in the iovading and invaded countries alike and ultimately defeats the very end of such wars. Peace is death to a Krieg-Staat, but peace is the very life-breath of wealth.
ভারতের সামাজিক ও অর্থনীতিক অবস্থা সম্বন্ধে যদুনাথের বিস্তৃত আলােচনা থেকে মনে হয় যে, তাঁর আর্থনীতিক প্রশিক্ষণ ইতিহাস আলােচনায় বিশেষভাবে কাজে লেগেছে। একটু পরেই আমরা দেখব যে, স্যার যদুনাথের ঐতিহাসিক প্রয়োগবাদ (pragmatic view of history) Economics of British India গ্রন্থে প্রত্যক্ষভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং এই কারণেও বইটির ঐতিহাসিক মুল্য আছে।
স্যার যদুনাথের ইতিহাস সাধনার আরম্ভ ও বিকাশ চোখে পড়ে History of Aurangzib ও Shivaji and His Times গ্রন্থে। বই দুটিতে যা আছে, তা আওরঙ্গজেব ও শিবাজীর নিরেট জীবনী নয়, তা রাষ্ট্রের বা জাতি বিশেষের উথান ও পতনের ধারাবাহিক বর্ণনা এবং সমগ্র ভারতের ষাট বছরের ব্যাপক ইতিহাস। History of Aur angzib রচনার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে স্যার যদুনাথ সরকার বলেছেন যে, আওরঙ্গজেবের সময়েই যেমন মােগল সাম্রাজ্যের সব চেয়ে বেশী বিস্তৃতি দেখা যায় এবং ভারতীয় সভ্যতার উন্নতি হয়, তেমনি আবার মােগল রাষ্ট্র ও সভ্যতার অবক্ষয়ের লক্ষণগুলিও তখনই প্রকট হয়ে ওঠে। এই সম্রাটের রাজত্বকালেই মারাঠা জাতি ও শিখ সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থান এবং ইংরেজ বণিকদের প্রথম বারের মত শক্তি বৃদ্ধি হয়। অতএব গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে এই আমল খুবই উপযুক্ত। স্যার যদুনাথ সরকার দেখিয়েছেন, আওরঙ্গজেবের সুদীর্ঘ জীবন এক শােচনীয় ব্যর্থতার ইতিহাস। এক পুরুষ ধরে যুদ্ধবিগ্রহের দরুন দেশের ধন-সম্পদ ও ধন উৎপাদনের উৎসগুলি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। ঠিক একই কারণে মােগল অভিজাততন্ত্রে নৈতিক অধঃপতন দেখা দিয়েছিল। সভ্যতা ও সংস্কৃতি পর্ব গৌরব হারিয়ে সামরিক পরিবেশের স্থলতার দরুন ক্ষীয়মান হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত চরিত্রে ছিল বহু গুণের সমাবেশ; কিন্তু শাসন-ব্যবস্থার সকল বিভাগে কেন্দ্রীয়করণের আত্যন্তিক প্রচেষ্টার ফলে কর্মচারীদের কার্যস্পৃহা ও ব্যক্তিগত যােগ্যতা হয়েছিল মারাত্মকভাবে ব্যাহত। সকল শ্রেণীর লােকজনকে একত্রিত করে আওরঙ্গজেব একটি ভারতীয় জাতি ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেননি। হিন্দুগণ রাজনৈতিক অধিকার পায়নি। সেই জন্য এবং হিন্দু ও মুসলমানের জীবনযাত্রার আদর্শ ভিন্ন প্রকৃতির বলে এদের মধ্যে সংহতি আসেনি। মুসলমানদের বহির্মুখিতা ও হিন্দু সমাজে শ্রেণীবিভাগ ও দেশপ্রেমিক পুরােহিত সপ্রদায়ের অভাব জাতি গঠনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল। ভারতের হিন্দু ও মুসলিম জনসাধারণ প্রগতি-বিরােধী। এসব কারণেই মােগল ভারতের পতন ঘটে। স্যার যদুনাথ সরকার একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালের সমীক্ষা করেছেন। তাঁর মতামত কোনো কোনাে মুসলমান ঐতিহাসিকের ভাল লাগেনি।১৬ তাঁদের মন্তব্য আওরঙ্গজেবের রাষ্ট্রনীতির সমর্থনে প্রদত্ত কৈফিয়ৎ ছাড়া আর কিছু নয়। স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে অন্ততঃ যুক্তি ও তথ্য যথেষ্ট পরিমাণে দিয়েছে। ইতিহাস আলােচনায় বিষয়বস্তুর প্রতি যে সহানুভূতির প্রয়ােজন এবং ঐতিহাসিকের তরফ থেকে যে মানসিক প্রসারতার দরকার তা তাঁর লেখায় পর্যাপ্তভাবেই পরিলক্ষিত হয়।
Shivaji and His Times গ্রন্থটিকে আমরা বিশেষ অর্থে History of Aurangzib-এর পরিপূরক রূপে এবং Fall of the Mughal Empire-এর অনুক্রম রূপে গ্রহণ করতে পারি। Shivaji and His Times-এ যেমন আছে মারাঠা জাতির প্রতিষ্ঠাতার পূর্ণ পরিচয়, তেমনি আছে মহারাষ্ট্রের সঙ্গে মােগল এবং বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা রাষ্ট্রের সম্পর্কের ইতিহাস। গ্রন্থটির সর্বশেষ অধ্যায়ে মারাঠা বীর ও নবগঠিত মারাঠা জাতির কৃতিত্ব ও বৈশিষ্ট্য আলােচিত হয়েছে। পূর্বেই বলেছি, Fall of the Mughals-এর বিষয়বস্তু বিচিত্র এবং উপকরণও বহুবিচিত্র। স্যার যদুনাথের নিমুেদ্ধিত মন্তব্য গ্রন্থটির বিষয়বস্তুর জটিলতার পরিচায়কঃ১৭
The materials are vast and varied; but this fact does not constitute the difficulty of the bistorian of the period so much as the immense number of the separate political bodies and centres of action created in the country by the dismemberment of an empire that had once embraced nearly the whole of India. A history of India in the 18th century which would attempt to deal with every one of these provinces or states in all its actions will be like a bag of loose stones constantly knocking against one another and not a siogle solid edifice.
স্যার যদুনাথের অন্যান্য রচনা১৮ বা অনূদিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ বা গ্রন্থাংশ পরােক্ষ বা প্রত্যক্ষ উপায়ে মােগল বা মারাঠা ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। Mughal Administration১৯ মুসলিম শাসনরীতি সম্বন্ধে প্রাথমিক পর্যায়ের আলােচনা যাতে মােগল শাসন-ব্যবস্থার মৌলিক রূপটি তিনি সঠিকভাবে বুঝতে চেয়েছেন। তাঁর মতে এই ব্যবস্থা হচ্ছে Perso-Arabic system in Indian setting এবং গ্রামীণ শাসন-ব্যবস্থায় মােগলগণ কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি। স্যার যদুনাথ সরকার রাজ্য-বিস্তার এবং জাতি বিশেষের উত্থান-পতনের বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব বুঝাতে চেয়েছেন; এগুলি বাদ দিয়ে শুধু মাত্র ঘটনার বিবরণ কখনো পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হতে পারে না।
মহারাষ্ট্র দেশের নেতা রানাডে, তিলক ও গােখেলের প্রভাবে বাংলাদেশে হিন্দু জাগরণ দেখা দেয়। উনিশ ও বিশ শতকের বাংলার রাজনীতি ও সাহিত্যে তার সুস্পষ্ট চিহ্ন রয়ে গেছে। মারাঠা বীর ও জাতীয় নেতা শিবাজীর স্মৃতি বাঙ্গালী হিন্দুর চিত্তকে বিশেষভাবে উদ্দীপিত করেছিল। Shivaji and His Times গ্রন্থে এই আন্দোলনের প্রভাব খুব কমই অনুভূত হয়। শিবাজী চরিত্রে নেতৃত্বের যে সকল অসাধারণ গুণ ঐতিহাসিক দেখেছে, তা অনেকটা সত্য-সন্ধানীর দৃষ্টিতেই দেখেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেনঃ২০
The first danger of the new Hindu Kingdom establisbed by him in the Deccan lay in the fact that the national glory and prosperity resulting from the victories of Shivaji aod Baji Rao I, created a reaction in favour of Hindu orthodoxy; it accentuated caste distinction and ceremonial purity of daily rites which ran counter to the homogeneity and simplicity of the poor and politically depressed early Maratha society. Thus, his political success sapped the main foundation of that success…. In proportion as Shivaji’s ideal of a Hindu swaraj was based on orthodoxy, it contained within itself the seed of its own death, … It is beyond the power of any man, it is opposed to the divinc law of the universe, to establish the Swaraj of such a caste-ridden, isolated, internally torn sect over a vast continent like India.’
আলােচ্য গ্রন্থটির প্রথম ও তৃতীয় সংস্করণের মুখবন্ধে লেখক বলেছেন:২১
…so many false legends about Shivaji are current in our country and the Shivaji myth is developing so fast… that I have considered it necessary in the interest of historical truth to give every fact, however small about him…..
কে জানে Shivaji myth কথাটি বলে লেখক মারাঠা বীরের তথাকথিত সর্বভারতীয় নেতৃত্বের ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন কি না! জাতীয়তাবাদী লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের চোখে সিরাজ-উদ-দৌলা এবং অন্ধকূপ রহস্য যে রূপ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল, History of Bengal, vol. II তে তার বাষ্পমাত্রও নেই। প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত জনপ্রিয় ধারণার বিরুদ্ধে তিনি ত প্রতিবাদই করেছেন।২২
স্যার যদুনাথ সরকার প্রধানতঃ রাজনৈতিক ইতিহাস লিখেছেন। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস সম্বন্ধেও তার ধারণা যে অত্যন্ত প্রখর ছিল, তার বিভিন্ন গ্রন্থে ও নিবন্ধে তার অজ্য প্রমাণ ছড়িয়ে আছে। ১৯২৮ সালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত Sir William Meyer বক্তৃতা সিরিজে বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি অনুসরণে তিনি ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের যে পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন, তাতেই সামাজিক ইতিহাসের মূল সূত্রগুলি বিধৃত হয়েছে। তাঁর মতে সমাজগঠন একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া এবং সমাজ-ব্যবস্থা মাত্রই ক্রমবিবর্তনের জটিল শৃঙ্খলায় বাঁধা। এই সাধারণ নিয়ম মেনে নিয়েই তিনি দেখিয়েছেন বিভিন্ন উপাদান ভারতীয় সভ্যতা ও সমাজের দেহ ও আত্মাকে কি এক সক্রিয় ও বিচিত্র প্রণালীতে যুগ যুগ ধরে গড়ে তুলেছে। Arts in Mughal India২৩ প্রবন্ধেও স্যার যদুনাথ সরকার মোগল চিত্রকলার উৎপত্তি, বিকাশ ও ক্রমবিবর্তনের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তা ছাড়া নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙ্গালীর ইতিহাসের পরিচয়পত্রে সামাজিক ইতিহাস বলতে তিনি ‘The how and why of the people’s evolution বুঝিয়েছেন।২৪ “…কোন কোন শক্তির প্রভাবে আমাদের জনসমষ্টির সামাজিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন বর্তমানের আকার ধারণ করিয়াছে, এবং সেই শক্তিগুলি কি প্ৰণালীতে কোন কোন সুযােগে কাজ করিয়াছে,” এবং “…জীবনের সকল দিক হাজার বছর ধরিয়া কালের স্রোতের আঘাতে কেমন করিয়া ভিন্ন ভিন্ন রূপ লইল”, তার আলােচনাই সামাজিক ইতিহাস লেখকের কাজ। “লােকদের দৈনন্দিন জীবন, সমাজ, ধর্ম, কর্ম, সংস্কৃতি, ধন-সম্পদ” এবং “অতীত যুগের ভূমিসংস্থা, কৃষি-পদ্ধতি, শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য, অশন-বসন, ধর্ম ও ক্রিয়াকাণ্ড, শিল্পবিজ্ঞান, ভাষা ও সাহিত্য প্রভৃতিই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু। নীহাররঞ্জন রায়ের গ্রন্থটির বিষয় বিশ্লেষণ করতে গিয়েই স্যার যদুনাথ সরকার উল্লিখিত কথাগুলি বলেছেন; কিন্তু তিনি তা বলেছেন অনুমােদনের সুরে। সেই জন্য উক্ত কথাগুলির মধ্য দিয়ে সামাজিক ইতিহাসের প্রতি তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকাশ পেয়েছে।
তিন
উৎস সমালােচনা যদুনাথ সরকারের ইতিহাস সাধনার অন্যতম বিশেষত্ব। মােগল আমলের সরকারী ইতিবৃত্তগুলি উল্লেখ করবার পর তিনি আসাম বুরঞ্জীকে extremely valuable indigenous annals রূপে আখ্যাত করেছেন, যদিও এগুলিতে কিংবদন্তী, অতিরঞ্জন এবং ঘটনাক্রমের ত্রুটি অতি সহজেই চোখে পড়ে। ‘আখবারাত’ হচ্ছে the very raw materials of history এবং In them we see events as they happened day by day, and not as they were dressed up afterwards by writers with a purpose. ইয়ােরােপিয়ান পর্যটকদের লেখা, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে bazar rumours এবং সুফীদের সম্বন্ধে রচিত কিংবদন্ত। সাহিত্য pious fraud। মারাঠা ইতিহাস রচনায় ফারসী ও ইংরেজী ভাষায় বিবৃত উপাদানের মূল্যের উল্লেখ করে স্যার যদুনাথ সরকার স্তুতিমূলক সংস্কৃত কবিতা, মারাঠা দলিল-পত্র ও ‘বখর’ সাহিত্যের নির্ভরযােগ্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। Poona Residency Correspondence-এর ঐতিহাসিক মূল্য সম্বন্ধে তার উক্তিঃ২৫
These English records, ..will light up in minute detail many superficially known periods and incidents of AngloIndian history, not only with reference to the Poona Government, but to almost all parts of India, and reveal in the most authentic manner possible the social and economic background and the pre-existing administrative arrangements on wbich Mountstuart Elphinstone built up the new British system of government in the Bombay Presidency. The greatness of the transition from the old order to the new will be upfolded most vividly before our eyes when the series now begun is completed.
তথ্যনিষ্ঠ যদুনাথ সরকারের রচনায় historical imagination বা ইতিহাস-ভিত্তিক কল্পনার ব্যবহার খুবই কম, যদিও বর্তমান কালের ঐতিহাসিকগণ এর মূল্য সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন। India Through the Ages গ্রন্থে২৬ এবং History of Bengal-এ।২৭ বখতিয়ার খিলজীর নদীয়া আক্রমণের ইতিহাসের পুনর্গঠনে স্যার যদুনাথ সরকার অত্যন্ত সীমিতভাবে এই চেতনার পরিচয় দিয়েছেন।
সময়কে কাল-বিভাগে খণ্ডিত করলে ইতিহাসের সমস্যাগুলিকে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যায় না; কারণ ঐতিহাসিক সমস্যার ধারাবাহিকতা কাল থেকে কালান্তরে এগিয়ে চলে। সেইজন্য Lord Acton বলেছেনঃ Study Problems, not periods;২৮ কাল-বিভাজন (periodisation) সম্বন্ধে স্যার যদুনাথও অনুরূপ মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেনঃ২৯
We usually study the bistory of India as divided into watertight compartments or periods. One great defect of this method of treatment is that we thereby lose sight of the life of the nation as a whole, we fail to realize that India has been the home of a living growing people, with a continuity running through all the ages, each generation using, expanding or modifying what its long line of predecessors had left to it… Each race or creed that has chosen India for its home, each dynasty that has enjoyed settled rule among us for some time, each school of thought that has dominated the human mind even in a single province in India,–bas left its gifts which have worked in all the provinces and through many centuries, till they have lost there identity by being transformed and assimilated into the common store of India’s legacy from the forgotten past.
এই অতীত যেন বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে না যায়, ঐতিহাসিকের কাজ হচ্ছে সেই দিকে লক্ষ্য রাখা। বিভিন্ন লােকগােঠীর অবদানগুলির উৎস-মূল খুঁজে বের করে সময়ের ছকের মধ্যে তাদের স্থান নির্দেশ করতে হবে। তারা পরবর্তী যুগগুলিকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে এবং বর্তমান কালের ভারতীয় জীবন ও চিন্তাধারার কোন কোন অংশই বা অতীতের বিভিন্ন জাতির প্রত্যক্ষ অবদান, তা বুঝিয়ে দিতে হবে। এই বিশ্লেষণধর্মী বিবরণ যে ইতিহাস-ভিত্তিক কল্পনার উপর নির্ভরশীল, তা যে অঙ্কশাস্ত্রের হিসেবের মত যথার্থ বা যথাযথ হতে পারে না এবং তাতে যে ব্যক্তিগত মতামতের প্রাধান্য থাকতে পারে, সে সম্বন্ধে ঐতিহাসিক অত্যন্ত সচেতন। এই কল্পনা-ভিত্তিক ইতিহাসের দাম আদৌ কম নয়।
কাল-বিভাজনের সূত্র ধরেই এখানে আরাে একটি কথা বলা দরকার। কোনাে বিশেষ যুগের প্রতি মাত্রাধিক গুরুত্ব দিলে ঐতিহাসিক, সরলীকরণ ও পক্ষপাতিত্ব এড়াতে পারেন না। স্যার যদুনাথ সরকার এবং তাঁর অনুসরণে অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ মােগল যুগকে এত বেশী করে তুলে ধরেছেন যে, তার ফলে প্ৰাক-মােগল যুগ যেন তার ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে ঐতিহাসিক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। যদুনাথ সরকারের ধারণা যে, ভারতের ইতিহাসে প্রাকমােগল যুগ একটি অন্ধকারের যুগ—এ যুগে কোনো সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল না।
চার
Fall of the Mughal Empire-এর ভূমিকায় ঐতিহাসিক বলেছেন:৩০
Nor is it wanting in the deepest iostructions for the present, The headlong decay of the age-old Muslim rule in India and the utter failure of the last Hindu attempt at empirebuilding by the Dew-sprung Maratbas, are intimately linked together, and must be studied with accuracy of detail as to facts and penetrating analysis as to causes if we wish to find out the true solutions of the problems of modern India and avoid the pitfalls of the past. The light of our father’s experience is indespensably necessary for guiding aright the steps of those who would rule the destipies of our people in the present. Happily, such light is available in unthought of profusion.
ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে এই হল স্যার যদুনাথের অন্যতম বক্তব্য। অমিরা এই অভিমতকে pragmatic coneption of history রূপে অভিহিত করতে পারি। ইতিহাসের পাতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ঐতিহাসিক সেই শিক্ষার সাহায্যে বর্তমানকে বুঝতে এবং ভবিষ্যতের কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রণ করতে চান। তিনি ইতিহাসের প্রয়ােগ-মূল্যে বিশ্বাসী। বহুকাল আগেই এ ধরনের ইতিহাসদর্শনের সৃষ্টি হয়েছে। তবে আমাদের মনে হয়, সমকালীন চিন্তাধারাই এ ক্ষেত্রে যদুনাথ সরকারের মানসিকতাকে প্রভাবিত করেছে। Oxford History অবতরণিকায় Vincent Smith বলেছেনঃ৩১
The value and interest of history depend largely on the degree in which the present is illuminated by the past…a sound knowledge of the older history will always be a valuable aid in the attempt to solve the numerous problems of modern India.
Vincent Smith-এর মধ্যে এই বিশ্বাস এতই প্রবল ছিল যে, তিনি তৎকালীন ভারত সরকারের ব্যবহারের জন্য Indian Constitutional Reform Viewed in the Light of History৩২ নামক একখানা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
Fall of the Mughal Empire থেকে উদ্ধত অংশটিকে একটি আকস্মিক মন্তব্য বলে ধরে নেয়ার কোনাে কারণ নেই। আলােচ্য ঐতিহাসিকের অন্যান্য গ্রন্থেও আরাে বহু অংশ আছে যাতে ঐতিহাসিক প্রয়ােগবাদ স্বচ্ছভাবে ফুটে উঠেছে। আওরঙ্গজেবের রাজত্বের তাৎপর্য প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক বলেছেনঃ৩৩
History when rightly read is a justificatoin of Providence, a revelation of a great purpose fulfilled in time. The failure of an ideal Muslim king like Aurangzib, with all the advantages he possessed at his accession and bis high moral character and training,- is therefore, the clearest proof the world can afford of the eternal truth that there cannot be a lasting empire without a great people, that do people can be great unless it learns to form a compact nation with equal rights and opportunities for all,-a nation the component parts of which are bomogeneous, agreeing in all essential points of life and thought, but freely toleratiog individual differences io minor points and private life, recognizing individual liberty as the basis of communal liberty,–a nation whose administration is solely bent upon promotiog national, as opposed to parochial or sectariau interests –and a society which pursues knowledge without fear, without cessation, without bounds. It is only in that pure light of goodness and truth that Indian nationality can grow to the full stature of its being.
পরােক্ষভাবে এ কথা বলা হয়েছে যে, আওরঙ্গজেবের আমলে ব্যক্তি স্বাধীনতা তথা সামপ্রদায়িক স্বাধীনতা ছিল না এবং রাষ্ট্রযন্ত্রও বৃহত্তম জাতীয় স্বার্থের উন্নতি বিধানে নিয়ােজিত হয়নি, হয়েছিল বরং ক্ষুদ্র শ্রেণী স্বার্থ বা সামপ্রদায়িক স্বার্থের উন্নতিকল্পে। সেইজন্য জাতি গঠনের সম্ভাবনাও আর রইল না। অথচ আওরঙ্গজেবের মত শক্তিশালী এবং বিশাল ও একক রাষ্ট্রের অধিকারীর পক্ষে বৃহত্তৰ ভারতীয় জাতি গঠনের সুযােগ ও সম্ভাবনাই ছিল খুব বেশী। আবার অতীতের শিক্ষা থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, ভারতীয় জাতি গঠনের পূর্বশর্ত হচ্ছে হিন্দুত্ব ও ইসলামের সম্পূর্ণ রূপান্তর গ্রহণ ও পুনরুজ্জীবনঃ৩৪
The detailed study of this long and strenuous reigo of fifty years drives one truth home into our minds. If lodia is ever to be the home of a nation able to keep peace within and guard the froutiers, develop the economic resources of country and promote art an:1 science, then both Hinduism and Islam must die and be born again. Each of these creeds must pass through a rigorous vigil and penance, each must be purified and rejuvenated uoder the sway of reason and science,
ইসলামের আমূল পরিবর্তন ও ধর্মনিরপেক্ষ গঠনতন্ত্র রচনা যে সম্ভব, তার ত প্রমাণ আছে তুরস্কের কামাল পাশার রাজনৈতিক কর্মে এবং সমাজ সংস্কারের সার্বিক প্রয়াসে। আবার সনাতনী হিন্দু, মনোবৃত্তি আধুনিকতার পরিপন্থী। সুদূর অতীতের আর্য সভ্যতার প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি গুরুত্ব আরােপ করার সার্থকতা কম। বৈদিক যুগের পরে ত বটেই, মােগল আমলের পরেও বিবর্তনের দরুন ভারত নতুন নতুন উপাদান আত্মসাৎ করেছে—এ কথা না মেনে উপায় নেই। আধুনিক ভারতীয় সভ্যতা প্রতিদিন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত যৌগিক বস্তু—এটা চার হাজার বছরের বালুকা রাশির মধ্যে ডুবিয়ে রাখা কোনাে নিপ্রাণ পদার্থ নয়। প্রগতি শীলতাই অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায়ঃ৩৫
This study of our country’s bistory leads irresistably to the coaclusion that we must embrace the spirit of progress with a full and unquestioning faith, we must face the unpopularity of resisting the seductive cry for going back to the undiluted wisdom of our ancestors, we must avoid eternally emphasizing the peculiar heritage of the Aryan India of the far off past. We must recognize that in the course of her evolution India has absorbed many new elements later than the Vedic Aryan age and even than the Mughal age. We must not forget that modern Indian civilization is a composit daily growing product and not a mummy preserved in dry sand for four thousand years.
ঐতিহাসিক প্রয়ােগবাদের অনুষঙ্গ রূপে স্যার যদুনাথের আরো কিছু মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে History of Bengal গ্রন্থে। ঐতিহাসিক এ ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, প্রত্যেক যুগের মধ্যে তার পরবর্তী যুগের সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে এবং ইতিহাসের নিরবচ্ছিন্ন গতিই তাকে নিশ্চিত থেকে নিশ্চিততর করে তােলে। বাংলাদেশের বিচিত্র অতীত দেখে বুঝতে পারা যায়, বিবাদরত বহু গােত্র ও সমপ্রদায়কে সময় নীরবে কার্য করে কি ভাবে একত্রে গ্রথিত করল এবং তাতে করে মুসলিম আমলের শেষে কি করে এই একই রাজনৈতিক উত্তরাধিকারসম্পন্ন লােকগোষ্ঠী বাঙ্গালী জনসাধারণে (people) পরিণত হল। কিন্তু বাঙ্গালী nation তখনাে জন্ম নেয়নি। দুই শত বৎসর বৃটিশ রাজত্বের প্রভাবে এই লােকগােঠীর জীবনে ও চিন্তায় যে সমতা বা সামঞ্জস্য এসেছে, তার ফলে এখন nation তৈরী হতে পারেঃ৩৬
May the course of the years 1757 to 1947 have prepared us for the supreme stage of our political evolution and helped to mould us truly into a nation. May our future be the fulfilment of our past history.
Econonics of British India-র প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে। তার পূর্বে রমেশচন্দ্র দত্ত ও অন্যান্য জাতীয়তাবাদিগণ বৃটিশ সরকারের শােষণনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের তুমুল ঝড় তুলেছিলেন। কিন্তু উক্ত অর্থনীতির বইয়ে দেখি যে স্যার যদুনাথের ভূমিকা সম্পূর্ণ গঠনমূলক। এই গ্রন্থের মুখবন্ধে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রকৌশল গ্রহণ করে ভারতীয় সমাজ ও অর্থনীতির আমূল সংস্কার সাধনই তাঁর কাম্য। সেইজন্য মনে হয় যে, ঐতিহাসিক যদুনাথের মধ্যে দেশের কল্যাণ-চিন্তা ও সমাজ সংস্কারের প্রবণতা লুকিয়ে আছে। Economics of British India-র বিভিন্ন অধ্যায়েও এই প্রবণতা অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই প্রকাশ পেয়েছে।
পাঁচ
স্যার যদুনাথ সরকার সমগ্র ইতিহাসের ধারাকে ক্রম-বিবর্তনশীল ও ক্রম-প্রবহমান বলে মনে করেছেন। এই মানসিকতা বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে ১৯২৮ সালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত William Meyer Lectures সিরিজে।৩৭ বক্তৃতাগুলিতে ভারতে আর্য ঐতিহ্য, বৌদ্ধ ধর্মের দান, মুসলিম শাসনের অবদান এবং বৃটিশ সভ্যতার প্রভাব আলােচিত হয়েছে। এই আলােচনার সঙ্গে History of Aurangzib এবং Shivaji and Ilis Tinies মিলিয়ে দেখলে স্যার যদুনাথের ইতিহাসের দর্শন অন্ততঃ আংশিকভাবে বুঝতে পারা যায়। ইতিহাসের ধারাকে যে রাজা বা সম্রাট অগ্রগতি দান করতে পারেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ। যদুনাথের মতে আকবর শ্রেষ্ঠ এবং৩৮
The progressive spirit died out of ladia at the death of Akbar. Theo followed a stationary civilization, and such a civilization. is bound to decay as it fiods improvement impossible.
আওরঙ্গজেব শ্রেষ্ঠ হয়েও সার্থক নন :
Such a kiog cannot be called a political or even an administrative genius. He was fit to be an excellent departmental bead, not a statesman initiating a new policy and legislatiog with prophetic foresight for moulding the life and thought of unbora generations in advance.
আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত গুণাবলীর অকুণ্ঠ প্রশংসা করে স্যার যদুনাথ সরকার বলেছেন:
And yet the result of fifty years’ rule by such a sovereign was failure and chaos! This political paradox makes his reign an object of supreme interest to the student of political philosophy no less than to the student of Indian history.
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের, বিভিন্ন ধর্মের ও বিভিন্ন শ্রেণীর লােকজনের ঐক্য ও সমন্বয়ে সবল ও বিরাট জাতি গঠনে আওরঙ্গজেবের চূড়ান্ত ব্যর্থতার মধ্যেই ঐতিহাসিক ঐ political paradox-এর কারণ খুঁজে পেয়েছেন। আর শিবাজী যদি মারাঠা জাতির বীর পুরুষ রূপে আলােচ্য ঐতিহাসিকের প্রশংসা অর্জন করে থাকেন, তাও মারাঠা জাতি গঠনে তার আশ্চর্য রকমের সাফল্যের জন্যইঃ৩৯
“জাতীয় বীর, রাষ্ট্রনেতা, নেশন-গঠনকারী আদি পুরুষ, এই অভিধেয়ের প্রত্যেকটিই তাহার সম্বন্ধে অক্ষরে অক্ষরে সত্য। …মারাঠা রাষ্ট্র একটি জাতি বা নেশনের সৃষ্টি, ইহা সর্ব ধর্মের, সর্ব জাতের অর্থাৎ বর্ণের মিলনের ফল।”
ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের পরিচয় দিতে গিয়ে স্যার যদুনাথ সরকার লক্ষ্য করেছেন যে, বৈদিক আর্যগণ, বৌদ্ধ সমপ্রদায়, মুসলমানগণ ও বৃটিশ রাজশক্তি—এদের প্রত্যেকই এ দেশের জীবনে নতুন নতুন উপাদান সংযােজিত করে নতুন অবদানে একে সমৃদ্ধ করে তুলেছে এবং এই উপাদানগুলি যুগ যুগান্তর ধরে সক্রিয় হয়ে আমাদের জীবনকে পরিবর্তিত করেছে এবং আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসেও সুস্পষ্টভাবে ছাপ মেরেছে। অনার্য সংস্কৃতির সঙ্গে আর্যদের ধর্ম, দর্শন, শব্দভাণ্ডার, সাহিত্যরীতি ও ঐতিহ্য এবং শাসন-পদ্ধতি একত্রিত হয়ে যে সমন্বয়ধর্মী সভ্যতার সৃষ্টি করেছিল, তাকেই বলা যায় হিন্দুত্ব (Hinduism)। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে কালক্রমে যে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, তাই হচ্ছে বৌদ্ধধর্ম যা ভারতীয় জীবনের ক্রমবিবর্তনের একটি নতুন পর্যায়। আচার ও ব্রাহ্মণ্যবিরােধী বৌদ্ধ ধর্ম ভারতীয় চিন্তায় ও জীবনে একটি নতুন শক্তির সৃষ্টি করেছিল। বৌদ্ধ যুগে যে সকল বিদেশী অনার্য গোত্র ভারতে বসবাস করেছিল, তারা উক্ত ধর্মের পতনের যুগে হিন্দু জনসাধারণের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিশ্রিত হয়ে হিন্দু সমাজের সমন্বয়কে আরাে দৃঢ় করল। কীথিয়ান ও অন্যান্য যাযাবর গােত্রের আগমনের ফলে প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে সমাজ জীবনে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা দিল, তার ফলে বিভিন্ন প্রদেশে বর্ণ-প্রথা ধরাবাঁধা ছকের মত হয়ে গেল। কি করে এই প্রথা শেষ বারের মত কঠিনভাবে দানা বাঁধল, সে ইতিহাস আজো ভালভাবে জানা যায়নি। “হিন্দু সমাজের এই পুনর্গঠনের যুগে স্কীথিয়ান ও অন্যান্য লােকগােঠী সম্পূর্ণভাবে হিন্দু সমাজের অঙ্গীভূত হল এবং এই সময়ে রাজপুতগণ রাজকীয় ক্ষমতায় সুপ্রতিষ্ঠিত হল। সিন্ধু নদীর উপর অবস্থিত আটক ও উনদ থেকে দক্ষিণ বিহারের পালামৌ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে তাদের রাজ্যগুলি ছড়িয়ে রইল। এই রাজপুতগণই নব্য হিন্দু ধর্মের উৎসাহী রক্ষকে পরিণত হল। বর্বর বৈদেশিক জনগণের নৈতিক রূপান্তর সাধনই হচ্ছে ভারতের পক্ষে সবচেয়ে বড় গৌরবের কথা। গোঁড়া ধর্মব্যবস্থা নয়, সামাজিক শক্তি ও সভ্যতার বাহক যে হিন্দুত্ব, এইটে তারই মরণজয়ী জীবনীশক্তির প্রমাণ। সাত ও আট শতকে বর্ণ-প্রথা দানা বাঁধবার পর যখন নব্য হিন্দু ধর্ম নিজেকে আবার প্রতিষ্ঠিত করল, শৈবগণ তখন মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের সন্ন্যাস ও চিন্তন ধার করল এবং বৈষ্ণবগণ এর মানব হিতৈষণা ধার করল। তখন বৌদ্ধ ধর্ম নব্য হিন্দু ধর্মের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে তলিয়ে গেল এবং ভারত থেকে এ ধর্ম তখন প্রায় লােপ পেল। তান্ত্রিক দর্শন মহাযান বৌদ্ধ ধর্মকে হিন্দু ধর্মে রূপান্তরিত করার ব্যাপারে অত্যন্ত সক্রিয় হল। …শহরের উচচ শ্রেণীর লােকজন হিন্দু ধর্মে ফিরে গেল এবং বৌদ্ধ ধর্মের রেশ শুধ গ্রামে ও দেশের অভ্যন্তরে টিকে রইল।”৪০
নব্য হিন্দু ধর্মের যারা উদ্যোক্তা, তাঁদের মধ্যে স্যার যদুনাথ সরকার শঙ্করাচার্য, রামানুজ ও চৈতন্যের নাম উল্লেখ করেছেন। যে বিষয়গুলির উপর তিনি জোর দিয়েছেন, হিন্দুত্বের অসাধারণ প্রাণশক্তি তার মধ্যে অন্যতম। হিন্দুত্ব কখন মরে না, বরং যুগে যুগে নতুন নতুন উপকরণ নিজের মধ্যে মিশিয়ে আপন অস্তিত্বকে মজবুত রূপে গড়ে তােলে। সুদীর্ঘকাল মুসলিম শক্তির অধীনে থেকেও হিন্দুত্ব লােপ পায়নি এবং একটু সুযােগ পেলেই নতুন প্রাণের স্পর্শে বিচিত্রভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। শিবাজীর রাজশক্তিও এই হিন্দুত্বেরই প্রতীকঃ৪১
Shivaji has shown that the tree of Hinduism is not really dead, that it can rise from beneath the secmingly crusbiog load of centuries of political bondage, exclusion from the administration, and legal iepression, it can put fortb new leaves and bra nches; it can again lift up its head to the skies.
নব্য হিন্দু ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছে এবং বৌদ্ধ ধর্ম ও গ্রামে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছে—এসব কথা সত্য। কিন্তু গ্রামে গিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম আত্মগোপন করে থাকেনি, বরং দিনের পর দিন রূপান্তরিত হয়ে সহজিয়া বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব মতবাদ রূপে এবং অবশেষে বাউল ধর্ম রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং সাহিত্য, দর্শন ও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সৃষ্টিমূলক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
যদুনাথ সরকারের মতে হিন্দু ধর্ম ও সভ্যতার মধ্যে মুসলমানদের মিশে না যাওয়ার কারণ তাদের গোঁড়া একত্ববাদ এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের বহির্মুখী দৃষ্টিভঙ্গি। বহির্বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যােগাযােগ স্থাপন, আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা আনয়ন, একক শাসন-ব্যবস্থার মাধ্যমে সমগ্র দেশে প্রশাসনিক সমতা (uniforinity) আনয়ন, জাতি-নির্বিশেষে উচচ শ্রেণীর লােকদের মধ্যে সামাজিক আচার-ব্যবহারে ও পােষাক-পরিচ্ছদে সমতার সৃষ্টি, Indo-Saracenic Art-এর উদ্ভব, lingua franca হিসেবে হিন্দুস্তানী বা রেতার প্রচলন, দেশী সাহিত্যের উদ্ভব, একত্ববাদী ও সুফী আন্দোলনের প্রসার, যুদ্ধবিদ্যায় এবং ইতিহাস-সাহিত্যে ও সাধারণভাবে সভ্যতায় উন্নতি সাধন— এইগুলিই হচ্ছে ভারতীয় সভ্যতায় মুসলিম অবদান। কিন্তু এ কৃতিত্বের বেশীর ভাগই মােগল যুগের প্রাপ্যঃ৪২
With peace, wealth, and enlightened Court patronage, canie a new cultivation of the Indian mind and advance of Indian literature, painting, architecture and handicrafts, whic raised this land once again to the front rank of the civilized world. Even the formation of an Iodian nation did not seem an impossible dream.
স্যার যদুনাথ সরকার মনে করেন, মােগল আমলের তুলনায় প্রাক-মােগল আমল অনুর্বরতার যুগ, স্থল সামরিক কার্যের যুগ এবং মােগলদের পূর্বে ভারতে কোনাে মুসলিম সভ্যতা ছিল না। তাঁর দুটি উক্তি তুলে দিচ্ছিঃ৪৩
Another equally important characteristic of the Muslim elemerit in India was that from 1200 to 1580 A. D. their State and society retained its original military and nomadic character,-the ruling race living merely like an armed camp in the land. It was Akbar, who at the end of the sixteenth century, began the policy of giving to the people of the couotry an interest in the State, …
What is popularly called the Pathan period i.c., from 1200 to 1550, was the Dark Age of north Indian history…. But, by the time that Akbar had conquered his enemies and established a broad empire covering all northern India,–peace and good administration began to produce their fruits… There was a gudden growth of vernacular literature in all our provinces.
স্যার ঘদুনাথ ভারতীয় সভ্যতার ক্রমবিকাশে বিশ্বাসী। সুদীর্ঘ সাড়ে তিনশো বছর ধরে এ দেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র একেবারে অনুর্বর ছিল এবং আকবরের রাজত্বকালে নিতান্ত আকস্মিকভাবে সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ হল—এ কথা সভ্যতার ক্রমবিকাশের সূত্রের সম্পূর্ণ বিরােধী। আকবরের আমলে সাহিত্য, স্থাপত্য, সঙ্গীত ও চিত্রকলার যে রূপটি আমাদের চোখে পড়ে, তার ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্বে দেড়শো বছর ধরে চলছিল তার প্রস্তুতি-পর্ব। রাজস্থানী চিত্রকলার সূত্রপাত হয়েছিল সম্ভবতঃ মুসলমান সুলতানদের রাজসভাতেই এবং চৌদ্দ, পনের ও ষােল শতকের প্রথমার্ধে রচিত, ঐতিহ্যবদ্ধ বাংলা ও আওয়াধী কাব্য-সাহিত্যের অস্তিত্বই যদুনাথের মন্তব্যের অসারতা প্রমাণ করছে। যে ইতিহাস সাহিত্যকে স্যার যদুনাথ সরকার মুসলিম যুগের অন্যতম অবদান রূপে চিহ্নিত করেছেন, তারও একটি বিরাট অংশ রচিত হয়েছে তুর্কী-আফগান শাসকদের আমলেই। নব্য হিন্দু ধর্মে যাঁরা প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেই শঙ্কর, রামানুজ ও চৈতন্যের উপরেও ইসলামিক সুফীবাদের প্রভাব পড়েছিল, একথাও ঐতিহাসিকদের কাছে স্বীকৃতি পাচ্ছে। এরা প্রত্যেকে প্রাক-মােগল যুগেরই বিশিষ্ট চিন্তা-নায়ক; ভত্তি আন্দোলনের ধারা ত প্রবল হয়েছিল প্রাক-মােগল যুগেই। বৃটিশ আমলকে স্যার যদুনাথ সরকার একটি রিনেসাঁসের যুগ রূপে অভিহিত করেছেনঃ৪৪
On 23rd June, 1757, the middle ages of India ended and her modern age began…. On such a hopeless decadent society, the rational progressive spirit of Europe struck with irresistable force. … The dry bones of a stationary oriental society began to stir, at first faintly, under the wand of a heaven-sent magician. It was truly a Renaissance, wider, deeper and more revolutionary than that of Europe after the fall of Constantinople.
ঐতিহাসিক দেখিয়েছেন কি করে ভারতের ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, শিক্ষা, রাজনীতি ও সমাজ পাশ্চাত্যের প্রভাবে নতুন জীবন পেয়েছে।৪৫ এ সমগ্র উপমহাদেশে একই রকম প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রচলনের ফলে বিভিন্ন জাতি ও ধর্ম একত্রীভূত হয়ে একটি সমশ্রেণীভুক্ত লােগােঠীর সৃষ্টি হতে চলেছিল; সামাজিক সাম্য এবং জীবনে ও চিন্তায় সংহতি দেখা দিয়েছিল। এই উপাদানগুলিই জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য ভিত্তির কাজ করবে।
ছয়
আলােচ্য ঐতিহাসিকের বিভিন্ন মন্তব্যের ভিত্তিতে উপরে তার ইতিহাস লেখার পদ্ধতি ও দর্শন এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক সমস্যার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আলােচিত হয়েছে। কিন্তু স্যার যদুনাথ সরকার কি সচেতনভাবে বিশেষ কোনো দার্শনিক সূত্রের অনুসরণে ইতিহাসের ঘটনা ও উপকরণ বিন্যস্ত করেছেন? এ প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেনঃ৪৬
“…ইতিহাস ও জীবন কাহিনী একজন মানুষের বাহ্য আকার ও কর্মগুলি মাত্র আমাদের দেখায়। তাঁহার চরিত্র ও জীবনী শক্তির ক্রিয়া বুঝিতে হইলে এইসব বাহ্য ঘটনার উপর ঐতিহাসিক দর্শন, যাহাকে Philosophy of History বলে, তাহার প্রয়ােগ করা আবশ্যক।”
এই ঐতিহাসিক দর্শন’ বা Philosophy of History কি? উদ্ধৃত পংক্তিগুলির পরে ‘মারাঠা জাতীয় বিকাশ’ পুস্তিকাটির একটি বিশেষ অংশ জুড়ে আছে শিবাজীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তাঁর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, কূটনৈতিক পারদর্শিতা, এবং মারাঠা জাতি গঠনে ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির ব্যাপারে তাঁর কৃতিত্ব সম্বন্ধে দীর্ঘ আলােচনা যা লেখকের critical thinking-এর ভিত্তির উপরে সুপ্রতিষ্ঠিত। এই অংশটিই শিবাজী-জীবনের মৌলিক শক্তির উৎসকে যেন আমাদের সম্মুখে খুলে দিয়েছে। সেইজন্য মনে হয়, স্যার যদুনাথের এই সমালােচনা-ভিত্তিক চিন্তাধারাই এ ক্ষেত্রে শিবাজীর ইতিহাসের দর্শন। History of Aurangzib, এবং Shivaji and His Tinnes গ্রন্থের শেষের দিকে সংযােজিত একটি করে অধ্যায়ে আলােচিত শাসকদের চরিত্র, দেশের অর্থনীতির উপরে যুদ্ধবিগ্রহের প্রভাব, রাষ্ট্রযন্ত্রের ও সভ্যতার ক্ষয়িষ্ণুতা, ভারতীয় জনসাধারণের প্রগতি-বিমুখতা ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য এবং ইতিহাসের ধারার উপরে তার প্রভাব, জাতি গঠনে আওরঙ্গজেবের বা শিবাজীর সাফল্য বা ব্যর্থতা প্রভৃতির চিন্তনকেন্দ্রিক আলােচনাই স্যার যদুনাথ সরকার কর্তৃক উল্লিখিত ঐতিহাসিক দর্শন। আবার History of Bengal (vol. II) এর শেষদিকের কয়েকটি পাতায় Reflections শীর্ষক অংশে বাঙ্গালী জীবনের যে বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাসের যে তাৎপর্য উল্লিখিত হয়েছে, তা মুসলিম আমলের ইতিহাসের দার্শনিক পরিশিষ্ট বিশেষ। ইতিহাস-শাস্ত্রের বৈশিষ্ট্য আলােচনা করতে গিয়ে স্যার যদুনাথ একটি প্রবন্ধে বলেছেনঃ
ইতিহাসের তিন অঙ্গ, কাল-নির্ণয়, সাক্ষী-বিচার এবং দর্শন। এই দর্শন সম্বন্ধে যদুনাথের মন্তব্য এইরূপঃ৪৭
তৃতীয় বা সর্বোচ্চ অঙ্গ ঐতিহাসিক দর্শন (philosophy of history), অর্থাৎ বর্ণিত ঘটনাগুলি হইতে মানব চরিত্র বা জাতীয় জীবন সম্বন্ধে গভীর উপদেশ লওয়া। এই গুণ থাকিলে তবে ইতিহাস সর্বোচচ সাহিত্যের অঙ্গে সমান আসন পায়। ইহাই ইতিহাসের সবচেয়ে বেশী উপকারিতা। যেমন শ্রেষ্ঠ কাব্য ব্যক্তি বিশেষ সম্বন্ধে মানবগণকে শিখায়,
Of their sorrows and delights
Of their passions and their spites
Of their glory and their shame
What doth strengthen and what maim
তেমনি শ্রেষ্ঠ ইতিহাস জাতিকে অর্থাৎ ব্যক্তি-সমষ্টিকে সেই মহা উপদেশ দেয়। ইংল্যান্ডেও শুধু গত দেড় শত বৎসর ধরিয়া ঐতিহাসিকগণ এই গুণের চর্চা করিতেছেন। মুসলমান ইতিহাস তাহার পূর্বে লেখা; তাহাতে এই দর্শনের লেশমাত্রও নাই। তবে এইসব পুরাতন মুসলমানী গ্রন্থ হইতে প্রকৃত ঘটনা। সংগ্রহ করিয়া বর্তমান যুগে শিক্ষিত ভারতবাসীরা দর্শন রচনা করিতে পারেন, জাতীয় উন্নতি ও অবনতির কারণ আবিষ্কার করিতে পারেন।
তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, যদুনাথ সরকারের ইতিহাস-দর্শনের অর্থ অত্যন্ত সীমিত এবং ভিন্নতর অর্থে মধ্যযুগের ভারতীয় ঐতিহাসিকদের লেখায় নিশ্চয়ই দার্শনিক তত্ত্বের অস্তিত্ব ছিল। আর ভারতের সীমা থেকে একটু দূরে গেলেই দেখা যাবে যে, সে যুগে ইবন্ খলদুনের মত পণ্ডিতও ছিলেন, যিনি ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের ভিত্তিতে এক অতি ব্যাপক ও জ্ঞান-গভীর দর্শনের স্রষ্টা। স্যার যদুনাথের মতে ইতিহাস-দর্শনের অর্থই হচ্ছে অতীত থেকে জাতীয় জীবন সম্বন্ধে উপদেশ গ্রহণ এবং জাতীয় জীবনের উন্নতি ও অবনতির কারণ আবিষ্কার। কিন্তু ইতিহাসের পাঠক ঐ কার্যটি কেন করবেন? প্রয়োগবাদী ঐতিহাসিকের কাছে এই প্রশ্নের উত্তরও অত্যন্ত সহজঃ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে তার সাহায্যে বর্তমান জীবনের সমস্যাসমূহের সমাধান সম্ভব।
স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, ইতিহাসের দর্শন বলতে স্যার যদুনাথ সরকার যা বুঝেছেন, তার অর্থ অত্যন্ত অগভীর। মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসের মালমশলা, ইতিহাস লেখার পদ্ধতি ও মুসলমান ঐতিহাসিকদের সম্বন্ধে তিনি যেখানেই যা কিছু লিখেছেন,৪৮ তার মধ্যে বিশেষ কোনো অন্তর্দষ্টির পরিচয় পাওয়া যায় না। জিয়া-উদ-দীন বারানী, ইয়াহিয়া সিরহিন্দী, আবুল ফজল ও বাদায়ুনী অত্যন্ত আত্ম-সচেতন ঐতিহাসিক এবং তাদের প্রত্যেকে এক বিশিষ্ট দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। কিন্তু স্যার যদুনাথ সরকার তাঁদের এই ইতিহাস-দর্শন ও আত্মচেতনা সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন বলে মনে করার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হেগেলের সময় থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত ইতিহাসের দর্শন সম্বন্ধে যে আলােচনা হয়েছে এবং যে সকল মতবাদ জন্ম নিয়েছে, তা যেমন বিচিত্র, তেমনি ব্যাপক। বিশেষ করে কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস্ কর্তৃক dialectical materialism প্রচারের পর থেকে ইতিহাসে জড়বাদী ও ভাববাদী ধারার মধ্যে অনেকেই সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন এবং সমাজতত্ত্বের ভিত্তিতে ইতিহাস রচনার রীতিও ক্রমশ: জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, স্যার যদুনাথের লেখায় এই সকল মতবাদ ও আলােচনার কোনো প্রভাব পড়েনি এবং এগুলির পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো প্রতিক্রিয়া ও প্রকাশ পায়নি।
বিভিন্ন গ্রন্থে দেখা যায় যে স্যার যদুনাথ সরকার মাঝে মাঝে ভারতীয় ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে ইয়ােরােপের ইতিহাস থেকে সমান্তরাল বা অনুরূপ ঘটনার নজির টেনেছেন। সর্বত্রই ইতিহাসের ঘটনাসমূহ বিশেষ বিশেষ ধার্য বা নিয়মের অনগামী হয় বলে বােধ হয় তার ধারণা ছিল।
যদুনাথ সরকারের ঐতিহাসিক প্রয়ােগবাদ বর্তমান কালের ঐতিহাসিকগণ গ্রহণ করবেন কি না, তা বলা মুশকিল। সত্যি কি ইতিহাসের শিক্ষার কোনাে প্রয়ােগমূল্য আছে ? আমাদের মানসিক পরিশীলন ও জ্ঞানের বৃদ্ধি ছাড়া ইতিহাস আর কিছু করতে পারে কি না, তা বিচার্য।
যদুনাথ এক ধরনের সর্ব ভারতীয় জাতীয়তার বিশ্বাসী ছিলেন বলে মনে হয়। তাঁর ধারণা, আকবর ভারতীয় জাতি গঠনে অনেক দূর এগিয়েছিলেন এবং আওরঙ্গজেব এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। অত্যন্ত অস্পষ্টভাবে হলেও যদুনাথ যেন এই জাতীয়তার প্রতীক শিবাজীর মধ্যেও খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন, বিভিন্ন জাতির অবদানে ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি কি করে ঘুগে যুগে একটি যৌগিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। তেমনি আবার তিনি মনে করেন, ভারতীয় জাতীয়তা গঠিত হতে পারে বিভিন্ন জাতির এক উদার সংমিশ্রণে যার ভিত্তি হবে ব্যক্তি-স্বাধীনতা-কেন্দ্রিক সাপ্রদায়িক স্বাধীনতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি ও প্রগতিশীলতা। যদুনাথের জাতীয়তার ধারণা হত বা আদর্শায়িত, কিন্তু তা উদার ও উন্মুক্ত। এই দিক দিয়ে বিচার করলে তাকে রমেশচন্দ্র মজুমদারের বিপরীত মেরুতে স্থাপন করা যায়।
তথ্য-নির্দেশঃ
- ১. যদুনাথ সরকার রাজশাহীর অন্তর্গত করচ মারিয়া গ্রামে ১৮৭০ সালের ১০ই ডিসেম্বর তারিখে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা একজন সংস্কৃতিবান জমিদার ছিলেন। পৈতৃক গ্রন্থাগারে যমুনা বহু বিদেশী বইপত্র পড়ার সুযোগ পান। তিনি রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশুনা আরম্ভ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৯১ সালে ইংরেজী ও ইতিহাসে অনার্স পরীক্ষায় এবং ১৮৯২ সালে ইংরেজীতে এম. এ. পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৩ সালে তিনি ইংরেজীর অধ্যাপকের পদে যােগ দেন; কিন্তু অল্প দিন পরে তিনি ইতিহাসে অধ্যাপনা আরম্ভ করেন। ১৮৯৭ সালে তিনি একটি নিবন্ধে অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়ে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি পান। ১৯২৩ সালে তিনি ইণ্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তারপর ১৯২৬ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত দুই বৎসর তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস-চ্যান্সেলর রূপে কাজ করেন। তিনি ১৯৫৮ সালের ১৯শে মে মারা যান।
- স্যার যদুনাথ মোগল ও মারাঠা ইতিহাসের গবেষণায় অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তার লেখা অসংখ্য গ্রন্থ ও প্রবন্ধের মাল-মশলা সংগৃহীত হয়েছে বিভিন্ন উৎস ও ভাষা থেকে—এগুলি হচ্ছে ফারসী পাণ্ডুলিপি, রাজস্থানী দলিল-পত্রাদি, পর্তুগীজ দলিল-দস্তাবেজ, ফরাসী ভাষায় লেখা আত্মচরিত ও দলিলপত্র, ইংরেজী ফ্যাক্টরী রেকর্ড এবং বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্য।
- ২. ১৮৯১ সালের এপ্রিল মাসে বি. এ. অনার্স পরীক্ষা দিয়ে যখন তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখন এই ঘটনাটি ঘটে; N. K. Sinha : Sir Jadu Nath Sarkar’: Bengal Past and Present, 1958, vol. LXXVII, p. I.
- ৩. ১৯৫৪ সালে Bengal Nawabs (নওবাহার-এ মুর্শিদকুলি খান, মুজফফর নাষা এবং আহ্ওয়ালে মুহাবত জংগ-এর ইংরেজী অনুবাদ) কোলকাতার এশিয়াটিক সােসাইটি কর্তৃক Bibliotheca Indica সিরিজে প্রকাশিত হয় এবং মােগল আমলের সামরিক ইতিহাস সংক্রান্ত গ্রন্থখানি স্যার যদুনাথের মৃত্যুর পর ছাপা হয়।
- ৪. History of Aurangzib, vol. I and II, (1618-1659), 2nd ed., 1925; vol. III (1658-1681), 2nd ed., 1921; vol. IV (1644-৪৭), Ist ed, 1919; vol. V (1689-1707), 1st ed. 1924; Fall of the Mughal Empire, vol. 1 (1739-54), 1932; vol. ll (17541771), 1934; vol. III (1771-1788), 193৪; vol. IV (1788-1403), 1950; Shivaji and His Times, Ist ed., 1920; 3rd revised ed., 1929.
- ৫. Gaath : The life of Aurangzib was one long tragedy,-a story of man battling in vain against an invisible but inexorable Fate, a tale of how the strongest human endeavour was baffled by the forces of the age. A Short History of Aurangzib, 1st ed., 1930; p. 3. : And yet our immediate historic past, while it resembles a tragedy in its course, is no less potent than a true tragedy to purge the soul by exciting pity and horror. Fall, I. Foreword, iii.
- ৬. Bengali Gibbon কথাটি H. Beveridge এর সৃষ্টি।
- ৭. স্যার যদুনাথ কর্তৃক সম্পাদিত W. Irvine-এর Later Mughals, vol. I (1709-1719), 1922 and vol. II (1719-1739), 1922.
- ৮. Fall, I, Foreword, vi-vii
- ৯. এই জীবনী যদুনাথ সরকার কর্তৃক সম্পাদিত, Irvine-এর Later Mugials-এ ভূমিকার সঙ্গে সংযােজিত হয়েছে এবং জীবনীটি Studies in Mughal India গ্রন্থেও স্থান পেয়েছে।
- ১০. N. K. Sinha কর্তৃক উদ্ভূত, পূর্বোক্ত, 2
- ১১. ঐ, p.1.
- ১২. ১৯০১ সালে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত।
- ১৩. ১৯০৯ সালে প্রথম সংস্করণ, ১৯১১ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯১৩ সালে তৃতীয় সংস্করণ এবং ১৯১৭ সালে চতুর্থ সংস্করণ কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। পরে গ্রন্থটির আরাে সংস্করণ মুদ্রিত হয়।
- ১৪. History of Aurangzib, vol. v. 437-39 ; Short History, 442.
- ১৫. Shivaji, 3rd ed., p. 397.
- ১৬. তুলনীয় : Zahiruddin Faruki: Aurangzib and His Times, Bombay, 1935.
- ১৭. Fall, I, Foreword, v.
- ১৮. এই তথ্য-নির্দেশের বিভিন্ন অংশে উল্লিখিত বইগুলি ছাড়া স্যার যদুনাথের লেখা আরাে যেসব রচনা আছে, সেগুলির নাম : Anecdotes of Aurangzib and Historical Essays, Calcutta, 1917; Studies in Mughal India, Calcutta, 1919; Chaitanya’s Life and Teachings (চৈতন্যচরিতামৃতের মধ্যলীলার অনুবাদ), Calcutta, 1922; শিবাজী, কোলকাতা, ১৯২৯: Bihar and Orissa during the Fall of the Mughal Empire, Calcutta, 1932 ; Studios in Aurangzib’s Reign, Calcutta, 1933 ; Cambridge History of India, vol. IV, 1937 : chs. VIII, X-XIX; House of Shivaji, Calcutta, 1940; Poona Residency Correspondence, (ed), vol. VIII, 1945. 47: XIV (1951). Bombay; Maasir-i-Alamgiri (ইংরেজী অনুবাদ), Bibliotheca Indica, 1947; Ain-i-Akbari, vol. III (1948) 47: vol. II (1949), Bibliotheca Indica, (আইন-ই-আকবরীর এই দুই খণ্ড মূলতঃ Colonel H. S. Jarret কর্তৃক অনূদিত হয়ে যথাক্রমে ১৮৯৩-৯৬ সালে এবং ১৮৯১ সালে কোলকাতার এসিয়াটিক সসাসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর তথ্যের সাহায্যে স্যার যদুনাথ ঐ অনুবাদে অজয় টীকা সংযােজনা করেন এবং মূল অনুবাদেও সামান্য রদবদল করেন।); Delhi News for Poona, 1756-1788, Bombay, 1952; তা ছাড়া যদুনাথ নিমোক্ত গ্রন্থাবলীতে ও পত্র-পত্রিকার বহু প্রবন্ধ লিখেছেন : B. C. Law Commemoration Volume, Sardesai Commemoration Voluine (1933), Bengal Past and Present, Birla Park Annual Bumbay Viliversity Journal, Calcutta Municipal Gazette, Hindustan Review, Indian Historical Quarterly, Indian Review, Islamic Culture, Journal of the Asiatic Society of Bengal, Journal of Bihar and Orissa Research Society, Modern Review, Muslim Review, Patna College Magazine, Prabuddha Bharat, Proceedings of the Indian Historical Records Commission, Presidency College Magazine, Ravenshavian, Science and Culture, Times of India, প্রবাসী, ইতিহাস, ইত্যাদি।
- ১৯. Mughal Administration, Calcutta ; Ist edition, 1924.
- ২০. 388-89.
- ২১. Preface, Ist ed, 2nd ed., 49 Preface, 7 qety Hui 3rd ed. v.
- ২২. তুলনীয় : The height of absurdity is reached when our dramatists call Pratapaditya of Jessor as the counterpart of Maharana Pratap Singh of Mewar. It is therefore necessary to debunk the Bengali “hero” by turning the dry light of history on him. Pratapaditya never once defeated any Mughal army in pitched battle ; his son and general Udayaditya took to flight at the sign of a losing naval battle (at Salka), and Pratapaditya himself lamely submitted to the Mughal general without holding out till lie was assured of safety to lise and honour. If we call such a man “the Pratap Singh of Bengal”, then we must adinit that the great hero of Haldighat, in his transit to Bengal.
- Had suffered a sea-change
- Into something mean and strange.
- History of Bengal, II. Dacca University, 1948, 225-26 আরও দ্রষ্টা্ব্য 502.
- ২৩. প্রবন্ধটি Stuilies in Mughal India গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে,
- ২৪. বাঙালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, ১৩৫৯ কোলকাতা,
- ২৫. Mahadji Sindhia and North Indian Affairs, (1785-1794), Poona Residency Correspondence Series, vol. I, Bombay, 1936, Introduction, iv.
- ২৬. India through the Ages (Sir William Meyer Lectures), Calcutta, 1928, p. 4
- ২৭. পুর্বোক্ত,
- ২৮. R. G. Collingwood P6P 170; The Idea of History, Oxford University Press, 1953, paper-back ed. 281.
- ২৯. India through the Ages, 1.3.
- ৩০.পুর্বোক্ত, vol. 1. Foreword, iii-iv.
- ৩১. Vincent Smith, Oxford History of India, London, 1919, xxiii-iv.
- ৩২. C.H. Philips (ed), Historians of India, Pakistan and Ceylon, London, 1962, p. 267.
- ৩৩. History of Aurangzib, vol. V, 495; Short History, 473-74.
- ৩৪. History, V. 494 ; Short History, 473. 9. India through the Ages, 139.
- ৩৬. History of Bengal, II. 499. ৩৭. India through the Ages শীর্ষনামে প্রকাশিত।
- ৩৮. History, V, 493; পরবর্তী উদ্ধৃতির জন্য দ্রষ্টব্য 478 এবং Short History, 472, 463, 3.
- ৩৯. মারাঠা জাতীয় বিকাশ, কোলকাতা, ১৩৪৩, পৃঃ ৩ ও ১৪।
- ৪০. India through the Ages, chs. Il and III.
- ৪১. Shivaji, 406.
- ৪২. Fall, 1, 2.
- ৪৩. India through the Ages, 70 and 78.
- ৪৪. History of Bengal, II. 497 and 498.
- ৪৫. বিস্তৃত বিবরণের জন্য দ্রষ্টাব্য : India through the Ages, ch. VI.
- ৪৬. মারাঠা জাতীয় বিকাশ, পৃঃ ১৬; শিবাজীর চরিত্র ও কৃতিত্ব বিশ্লেষণের জন্য দ্রষ্টব্য পৃ: ১৬-২৬।
- ৪৭. মুসলমান ভারতে ইতিহাসের উপকরণ, ইতিহাস (কোলকাতা), নবম খণ্ড (১৩৬৫-৬৬ সাল), তৃতীয় সংখ্যা (ফাল্গুন-বৈশাখ), ১১২-১৩।
- ৪৮. উপরের পাদটীকায় উল্লিখিত প্রবন্ধটির সঙ্গে দ্রষ্টব্য স্যার যদুনাথের লেখা নিক্তে রচনাগুলি : ‘ইতিহাস এক মহাদেশ’, ইতিহাস, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা ১-৪; ‘বাঙ্গলায় ঐতিহাসিক গবেষণার সমস্যা’, ইতিহাস, ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, পৃঃ ১৩৫৩৯; ‘ইসলামিক ইতিহাস চর্চায় নব-জাগরণ’, ইতিহাস, ৫ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, পৃঃ ৭৩-৮১; ‘ইতিহাস চর্চার প্রণালী’, ইতিহাস, নব পর্যায়, ৫ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, পৃষ্ঠা ২২৯-৪০। বিশেষ দ্রষ্টব্য : যদুনাথের জাতীয়তাবাদী মানসিকতার জন্য দ্রষ্টব্য তার মহারাজা দিব্য ও ভীম প্রবন্ধ ; দেশ, ১৩৪২ সাল, ১লা চৈত্র।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।