নবাব সিরাজুউদ্দৌল্লাহর পতনের মুল কাণ্ডারী ক্লাইভকে নিয়ে ইংরেজরা খুব গর্ব করতাে, কি বিরাট বাহাদুরী আর বীরত্বই না তিনি দেখিয়েছিলেন পলাশীর যুদ্ধ ক্ষেত্রে। কিন্তু পলাশীর ওটা যে কোন যুদ্ধই নয় এবং সেনাপতি আর গণ্যমান্য কিছু দেশবাসীর আত্মসমর্পণ ছিল সেকথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বিলেতি সাহেবদের বিলেতি বীরত্বের ইতিহাস বিলেতে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য পলাশী আমবাগানের শেষ শুষ্ক আম গাছটির গােড়ায় মাটি খুঁড়ে গাছটির মূল উপড়ে নেয়া হয়েছে ১৮৭৯ খৃস্টাব্দে। তারপর সগর্বে তা বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিলেতের মাটিতে। দেশবাসীর দেখার তৃপ্তি মিটে যাওয়ার পর ১৮৮৩ খৃস্টাব্দে শ্বেত মার্বেল পাথরে জয়স্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। ক্লাইভ মিথ্যা সম্মানের যে বুদ্বুদ নির্মিত গগনচুম্বী অট্টালিকা তৈরি করেছিলেন কিছুদিন পরে সামান্য সূর্যালােকে তা শেষ হয়ে গেল। প্রকাশ হয়ে গেল ভেতরের তথ্য। নানা গুপ্ত দোষ হয়ে গেল প্রকাশিত। তাই হয়ত তাঁর শেষ পরিণতি হলাে রক্তাক্ত মৃত্যু। অর্থাৎ কাপুরুষের মত নিজের কণ্ঠে কলুষিত হস্তে ধারাল ক্ষুর ধরে শ্বাসনালী কর্তন করে আত্মহত্যার কলঙ্ক নিয়ে ইতিহাসের পাতায় আত্মগােপন করার চেষ্টা করলেন।
এদিকে মীরজাফর ইংরেজদের সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্তে বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি ইংরেজদের হাতে উপঢৌকনের নামান্তরে মােটা অঙ্কের অর্থ প্রদানের ফলে তাঁর ধনাগার প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে। অবশেষে অর্থ দিতে অপারগ হলে তাঁকেও হলওয়েলের কৌশলে সিংহাসনচ্যুত করে তাঁরই জামাতা মীর কাশিমকে নবাব করা হয় অর্থাৎ সিংহাসনে বসানাে হয়। নবাব মীর কাশিম বেশ বুঝতে পারছিলেন ইংরেজরা তাদের গােটা ভারত দখল করতে চায়। তিনি এও বুঝেছিলেন ইংরেজরা তাঁদের শক্তির দ্বারা এখনি তাঁকে পরাজিত করে রাজা হয়ে বসতে সক্ষম। কিন্তু তারা এখনিই তা চায় না, কেননা বাংলার জনতা বিশেষত মুসলমানরা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে আর সেই বহ্নি সারা ভারতের বুকে ছড়িয়ে যেতে পারে। তখন তা সামলানাে হবে মুশকিল। অতএব এই নবাবী শুধুমাত্র প্রহসন। তাই মীর কাশিম ‘করি অথবা মরি’ নীতি অবলম্বন করে ইংরেজদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে বদ্ধপরিকর হলেন।
ইংরেজরা চাষীদের উৎপাদিত শস্য দরিদ্র দেশবাসীর দোকানের মাল যথেষ্টভাবে নিয়ে দাম দিত না। খুব অনুগ্রহ হলে কিছু দিত মাত্র। এছাড়া ইংরেজরা বহুদিন ধরে একটা বাণিজ্যকর দিয়ে আসছিল তাও বন্ধ করে দেয়। এ সমস্ত কারবার দেখে নবাব মীর কাশিম তার হিন্দু-মুসলমান প্রজাদের জানিয়ে দিল যে, তাদেরও আজ থেকে কোন কর দিতে হবে না। কারণ আমার দেশবাসী কর দেবে আর বিেশক ইংরেজ কর ফাঁকি দিয়ে ভারতে শিকড় গাড়বে তা হয় না।
এই ঘােষণায় ক্রোধান্ধ হয়ে ইংরেজরা নবাব মীর কাশিমকে সিংহাসনচ্যুত করতে মনস্থ করলে তিনি বীরবিক্রমে সসৈন্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। যুদ্ধ আরম্ভ হলাে। ইংরেজরা কাটোয়া, গিরিয়া, উদয় নালা, মৃঙ্গের প্রভৃতি স্থানে নবাব মীর কাশিমকে পরাস্ত করে। নবাব মীর কাশিম অযােধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং দিল্লীর সুলতান বাহাদুর শাহের সাহায্য প্রার্থনা করলে তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে যথাসাধ্য সৈন্য নিয়ে মীর কাশিমের দুই পাশে এসে দাঁড়ালেন বকসার নামক যুদ্ধক্ষেত্রে। তথাপি নবাব মীর কাশিমের ভাগ্যে পরাজয় নেমে আসে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে পলাশীর যুদ্ধ অপেক্ষা ভারতের ইতিহাসে এই যুদ্ধ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। স্যার জি, স্টেপহেনও বলেছেন,
“Buxar deserves far more than plossey to be considered as the origin of the British power in India.”
১৭৭৪ খৃস্টাব্দে বসার যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। নবাব মীর কাশিম তখন তাঁর রাজধানী মুঙ্গেরে পলায়ন করেন। ১৭৭৭ খৃস্টাব্দে তিনি বাংলার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের অলক্ষে দিল্লীর বুকে পরলােক গমন করেন।
ইংরেজরা আবার মীরজাফরকে পুতুলের মত নবাবী আসনে অধিষ্ঠিত করে। ১৭৬৫ খৃস্টাব্দে দিল্লীর শাহ আলম বুঝতে পারলেন বাংলার মুসলমান শক্তি নিভে গেছে। সেখানে অতঃপর যুদ্ধ করতে যাওয়া আত্মহত্যার নামান্তর। ইংরেজ এখন বহুগুণে বলীয়ান। ঠিক এই সময় ক্লাইভ শাহ আলমের কাছ হতে ১৭৬৫ খৃস্টাব্দে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করেন।
ইংরেজদের বহুদিনের সাধ পূরণ হলাে। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী এখন সামরিক বিভাগ এবং রাজস্ব বিভাগ হাতে পেল। ক্লাইভ শােষণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন বটে কিন্তু তা সাধারণের দৃষ্টি এড়িয়ে যাতে হয় তার জন্য রাজস্ব আদায়ের ভার দিলেন হতভাগ্য দুই বাঙালির ওপর। একজনের নাম মুহাম্মদ রেজা খান অপরজনের নাম শ্রী সিতাব রায়। বিদেশী বণিক ইংরেজ শশাষণের যাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরল জনসাধারণের অর্থনৈতিক কণ্ঠ। দেশের চারদিকে অসন্তোষ দেখা দিল। ১৭৭০ খৃষ্টাব্দে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেল। বাংলা হিসাবে ১১৭৬ সালের এই দুর্ভিক্ষে বাংলার এক-তৃতীয়াশ লােক অনাহারে প্রাণত্যাগ করল। ১১৭৬ সালের এই দুর্ভিক্ষেই ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। এই সময় ওয়ারেন হেস্টিংস কোম্পানীর হাত হতে নিজ হাতে দায়িত্ব নিয়ে নবাবকে বৃত্তিভােগী কর্মচারীতে পরিণত করেন।
ভারতের মারাঠা শক্তি মােঘলদের বহুবার বিব্রত করতাে। পূর্বেই তাদের লুণ্ঠন, হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি অপরদিকে তাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইতিহাসে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এখন কিন্তু মারাঠা রাজপুতরা এবং দেশের অমুসলমান জনসাধারণের নীরব দর্শক।
মারাঠাদের দ্বারা ভারতের সাংঘাতিক সর্বনাশের আর একধাপ ঐতিহাসিক তথ্য এই যে, ১৭৭২ সালে পেশােয়া মাধব রায়ের মৃত্যুর পর মারাঠারা এত নােংরা ঘরােয়া বিবাদ শুরু করেছিল, যা এক চরম পর্যায়ে পৌছায়। ঐ সময় পূর্ব হতেই রঘুনাথ রাও আর মাধব রাও-এর মধ্যে শক্তির প্রতিদ্বন্দিতা চলছিল। মাধবের মৃত্যুর পর তার ভাই নারায়ণ রাও ‘পেশােয়া’ পদ অধিকার করলেন। বলা বাহুল্য, ঐ অসভ্য জাতি পেশােয়া পদটির জন্য এত লালায়িত যে, যে কোন নাশকতামূলক কাজ করতে তারা পিছপা হত না। যা হােক, নারায়ণ রাও তার পিতৃব্য রঘুনাথ রাওয়ের চক্রান্তে কয়েক মাসের মধ্যেই নিহত হন। কিন্তু চক্রান্তকারী রঘুনাথ রাওয়ের ভাগ্যেও পেশােয়া হওয়া হয়ে উঠল না; বরং নারায়ণ রাওয়ের শিশুপুত্র দ্বিতীয় মাধব রাও নারায়ণ পেশােয়া পদে বরণ করা হয়। তখন রঘুনাথ রাও ক্রোধের আতিশয্যে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। প্রতিশােধ তাঁকে নিতেই হবে। পেশােয়া তাকে হতেই হবে।
সেটি ছিল ১৭৭৫ খৃস্টাব্দ। রঘুনাথ একেবারে বােম্বাইয়ের গভর্নমেন্টের সঙ্গে চুক্তিতে টিপ সই করেন। ঐ চুক্তির নাম “সুরাটের সন্ধি”। ইংরেজরা ভারতকে আরও শশাষণের হাতিয়ারস্বরূপ মারাঠা জাতির প্রত্যক্ষ সাহায্যের রাস্তা পেয়ে গেল।
এইভাবে রঘুনাথ ইংরেজদের সহযােগিতায় পুনরায় মারাঠাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করলেন ১৭৭২ খৃষ্টাব্দে। কিন্তু যুদ্ধের প্রথম ভাগে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়ে ইংরেজরা অপমানজনক “ওয়ার গাওয়ের” সন্ধি করতে বাধ্য হয়। তারপর হেস্টিংস সব চুক্তি ছিন্ন করে মারাঠাদের আক্রমণ করেন। ইংরেজদের পক্ষে ছিল ভোঁসলে ও পায়কোয়াড়। ১৭৮০ খৃষ্টাব্দে ইংরেজ মারাঠাদের পরাজিত করে বেসিনত্তাকঙ্কন অধিকার করে। এমনিভাবে মারাঠা নেতা নানা ফরনবীশের সমর্থনে ১৭৮২ খৃষ্টাব্দে ১৭ মে ইংরেজ-মারাঠা আর একটি সন্ধি হয়। অবশেষে মারাঠা শক্তির অবনতি ঘটে।
১৭২৭ খৃষ্টাব্দে হায়দার আলী নামক এক বীর সম্ভান্ত কোরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। যৌবনের প্রারম্ভে তিনি মহীশরের হিন্দু রাজার অধীনে সৈনিক হিসেবে কাজ আরম্ভ করেন। হায়দারের বহু গুণ ছিল, তন্মেধ্যে দুটি গুণ উল্লেখযােগ্য। একটি বীরত্ব আর এটি সততা। ঐ সময়ে রাজার মন্ত্রী ও সেনাপতিদের মধ্যে মতানৈক্যের ফলস্বরূপ অর্থ দপ্তরের দূরাবস্থাকে রাজা আয়ত্তে আনতে না পেরে অবশেষে হায়দারের হাতে সবকিছু সমর্পণ করেন। হায়দার ঐ ডুবন্ত রাজ্যের হাল সাহসের সঙ্গে গ্রহণ করে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে শাসন, পােষণ, দান, দয়া, মায়া ও বুদ্ধিপূর্ণ কৌশলে সমস্ত কিছু আয়ত্তে আনেন। তিনি পার্শবর্তী ছােট রাজ্যগুলাে দখল করে মহীশূরের সীমানা বৃদ্ধি করে দেশে প্রকৃত শান্তি ফিরিয়ে আনেন। তাঁর অন্তরের আসল ইচ্ছা ছিল ইউরােপীয় আদর্শ ও ভাবধারায় নিজে ও সৈন্যদের সুগঠিত করে ইংরেজদের দেশচ্যুত করা।
এখানে একটা কথা খুব বেশি মনে রাখা দরকার, মুসলমান শাসনের পতন সেখানেই সম্ভব হয়েছে, যেখানে মুসলমান হয়ে ধর্মকে করা হয়েছে উপেক্ষা-অবজ্ঞা। আকবর-জাহাঙ্গীরের ন্যায় সিরাজ হতেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কারণ নবাব সিরাজ মুসলমান ধর্মের অত্যন্ত জরুরি বা অবশ্য প্রতিপাল্য পঞ্চীয় উপাসনা নামাযকে উপেক্ষা বা অস্বীকার না করলেও অবহেলা করেছেন। আকবর ও জাহাঙ্গীরের সময়ের মত আবার সিরাজের সময়েই দেশে মদ্যপান শুরু হয়। অতএব পতন তাঁর অবধারিত হয়ে পড়ে। ভাগ্যে শুধু প্রতিকূল অবস্থার উপস্থিতিই সিরাজের জীবনে লক্ষণীয় আত্মীয়স্বজন বিভ্রান্তি। যুদ্ধে হঠাৎ মীর মদানের মৃত্যু পলায়নের সময় নদীতে নৌকা চলার মত জলের অভাব, ক্ষুধার জ্বালায় আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে দুর্ভাগ্যক্রমে শত্রুগৃহে কবলিত হওয়া সবই বিশ্ব নিয়ন্তার ইঙ্গিতেরই ফলস্বরূপ।
যাইহােক হায়দারের বীরত্ব বুদ্ধি জ্ঞান প্রতিভার অভাব ছিল না, নামায ইত্যাদি ধর্মনৈতিক আদেশ নিষেধেও তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন কিন্তু পুত্র পরিবার বা রাজদরবারে নামায সম্বন্ধে খুব গুরুত্ব দেওয়া হত না। তবে হায়দারের মূলনীতি ছিল ইংরেজ বিতাড়ন। তিনি বেশ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে ইংরেজদের দ্বৈত শাসনের ফলে যেমন তারা ছদ্মবেশে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শাসনকর্তা হয়েছে তদুনুরূপ সারা ভারতকেও তারা পদানত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
এদিকে মারাঠাদের বিশ্বাসঘাকতা তথা ইংরেজদের সাথে হাত মেলানো অপরদিকে অর্থলােলুপ অপদার্থ নিজামের বিশ্বাসঘাতকতার আশক্ষায় তিনি উভয় ক্ষেত্রে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের বােঝান যে, বিদেশী ইংরেজদের পরাজিত করে দেশত্যাগী করতে আমাদের সকলকে একজোট ৰা সংঘবদ্ধ হওয়া আবশ্যক। কারণ, তারা শুধু শাসন করতে চায় না, সঙ্গে সঙ্গে শােষণ করতে চায়। কিন্তু আমরা যে যেখান থেকেই আসি না কেন ভারতকে নিজের মাতৃভূমিরূপে করুণ করে নিয়েছি। অতএব হিন্দু, মুসলমান, শিখ, মারাঠা সবই আমরা ভারতবাসী ভাই ভাই।
হায়দারের উদার ও যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাবে উভয়েই আঁর হাতে হাত মেলান। এইবার হায়দার ১৭৬৭ খৃষ্টাব্দে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ ঘােষণা করলেন। এটাই ইতিহাসে প্রথম মহীশূর যুদ্ধ (First Mysore war) নামে খ্যাত। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাঝপথে নৌকা ডুবির মত নিজাম হায়দারের পক্ষ ত্যাগ করেন আর মারাঠারা শুধু পক্ষ ত্যাগ নয় বিপক্ষে ইংরেজদের প্রলােভন প্রলােভিত হয়ে ভীতির কারণ হয়ে ওঠে। কিন্তু হায়দার বীর বিক্রমে একাই সৎসাহসকে সঙ্গী করে যুদ্ধের অগ্রগতিকে মাদ্রাজের দ্বারে পৌছে দেন। ইংরেজগণ হায়দারের অসম্ভব সাহসিকতা আর বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ ব্যবস্থায় ভীত হয়ে সন্ধির প্রস্তাব দেয়। হায়দার খুব বেশি লেখাপড়া না জানলেও জন্মগতভাবে চতুর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। তাই অনুমান করলেন মারাঠারা অপর দিক থেকে আক্রমণ করলে ঘরের শত্রু বিভীষণে পরিণত হবে, অতএব আপাতত সন্ধির প্রস্তাব গ্রহণ করলেও অন্যকোন শক্তি হায়দারকে আক্রমণ করলে ইংরেজরা তাঁকে সাহায্য করবে।
এদিকে হায়দারের অনুমানই বাস্তবে পরিণত হয়। মারাঠারাই ১৭০০ খৃস্টাব্দে মহীশূর আক্রমণ করল। কিন্তু সন্ধির শর্তানুযায়ী ইংরেজরা কোন সাহায্য দানে এগিয়ে এল না। আবার হায়দার পূর্বের ন্যায় জ্ঞানগর্ভ যুক্তিতে মারাঠাদের বােঝালেন। ফলে পুনরায় তারা হায়দারের সঙ্গে সহযােগিতা করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ার সদিচ্ছা জ্ঞাপন করে। নিজামও ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে একমত বলে জানান। হায়দার আবার সাহসে ভর করে সসৈন্যে মাদ্রাজ পৌছান। কিন্তু এবার পরােক্ষভাবে নয় বরং প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজদের পক্ষে যােগদান করে মারাঠারা ও নিজাম সাহেব হায়দারকে প্রতারণা করেন। এবার আর সন্ধির কথাও নয় বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন হায়দার। তাঁর সুযােগ্য ও বীর সন্তান টিপু ইংরেজদের এমনভাবে পরাজিত করলেন যে তারা আর পলায়নেরও সুযােগ না পেয়ে অবশেষে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। হায়দার তার বীর সন্তানের বীরত্ব দেখার সুযােগ বেশিদিন পাননি। এক কঠিন দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ১৭৮২ খৃস্টাব্দে তিনি পরলােকগমন করেন।
টিপুর জন্ম হয় ১৭৫০ খৃস্টাব্দে। বীর পিতার মৃত্যু হলেও তিনি (হায়দার) ‘মহীশূরের বাঘ’ নামে খ্যাত ছিলেন। যােগ্য পিতার যােগ্য পুত্ররূপে টিপুও পিতা অপেক্ষা বীরত্বে কোন অংশেই কম ছিলেন না। পিতার ন্যায় এরও নীতি ছিল ইংরেজদের দেশচ্যুত করা। তিনি মেথিউ সাহেবকে বদরে সসৈন্যে বন্দি করেন এবং মাঙ্গালাের অধিকার করেন। ১৭৮৪ খৃস্টাব্দে ইংরেজরা টিপুর সাথে অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতার সাথে সন্ধি করে বন্দি বিনিময় অঞ্চল নির্ধারিত করে। কিন্তু ইংরেজগণ এবারও সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে মারাঠা ও নিজামের সহাযোগিতায় বিভিন্ন দিক হতে মহীশূর আক্রমণ করে। টিপু এক বছর পর্যন্ত তাদের ঠেকিয়ে রাখেন। কিন্তু ১৭৯২ খৃষ্টাব্দে অবশেষে পরাজয়বরণ করে এক সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়। অর্ধেক রাজ্য, প্রচুর অর্থ এবং দুটি পুত্রকে জামিন রেখে অত্যন্ত তবুও আবার একবার ভীষণ দূরদর্শিতায় ও তৎপরতায় সৈন্য গঠন করলেন এবং পিতা হায়দারের মত মারাঠাদের ও নিজামের সঙ্গে সন্ধির আবেদন জানালেন। এবার মারাঠারা পুরােপুরি প্রত্যাখ্যান করলেন সুলতানের ঐ সাধু প্রস্তাব। নিজামও ইংরেজদের ঐ বাধ্যতামূলক সন্ধি মেনে নিয়েছিলেন।
মিঃ ওয়েলেসলীর তথা ইংরেজদের রাজ্য বিস্তারের পথে বিরাট বিরাট প্রতিবন্ধক ও প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিশ্চিহ্ন করতে মিত্রশক্তিও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চতুর্থ মহীশূর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৭৯৯ খৃ:। টিপু দেশী-বিদেশী ঐ সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে অত্যন্ত বীরত্ব ও যােগ্যতার সাথে লড়েও জয়যুক্ত হতে পারলেন না। টিপুর শ্রী রঙ্গপত্তন শত্রুপক্ষ অধিকার করে। টিপুর সৈন্যগণ যেভাবে ক্রমপর্যায়ে তিনটি শক্তির সাথে লড়াই করেছিলেন এবং সর্বশেষে শহীদের মর্যাদায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন তাও দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক অলিখিত ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
পরিশেষে সমস্ত সৈন্যের যখন পতন হয় তখন সুলতান টিপুকে ইংরেজরা চিৎকার করে আত্মসমর্পণ করতে বলে। আহত বীরের একহাত অস্ত্রাঘাতে অচল, কিন্তু অপর হাতেই যুদ্ধ করতে করতে ভাগ্যহারা টিপু ভারতের মাটিতে ভারতমাতার সুযােগ্য সন্তানের মত নিজের প্রাণদান করলেন তবুও জীবন্ত বন্দি হতে ঘৃণাবােধ করেছিলেন।
টিপুর চরিত্র বল, মনােবল, দৈহিক বল এবং রাজনীতি জ্ঞান পুরাে মাত্রায় থাকলেও স্বধর্মের আইন কানুন অপেক্ষা তিনি বাহ্যিক পার্থিব আয়ােজনকেই যথেষ্ট মনে করতেন। তাই বেশভুষায় ও চালচলনে ইউরােপীয় বা অপর প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তিনি ইতিহাসের এই অমােঘ শিক্ষা ভুলে গিয়েছিলেন যে, সমস্ত উন্নতি বা অবনতির শুধু নিজের কর্মদক্ষতা ও বাহ্যিক আয়ােজনের ওপরই নির্ভর করে না তার সঙ্গে যােগ থাকে নৈপুণ্যে ভাগ্য নিয়ন্তার অদৃশ্য অঙ্গুলী হেলন।
তবে ইংরেজরা টিপুর মৃত্যুবধি ভারত গ্রাসের অভিযানকে ইচ্ছানুক্রমিক ত্বরান্বিত করতে পারেনি। কারণ টিপুর অসাধারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিজ্ঞানের দারুণ ভীতিই ছিল এ পথে বাধা। উল্লেখ করা যেতে পারে, টিপূই সর্বপ্রথম ভারতকে রক্ষা করার জন্য তদানীন্তন ইংরেজদের শত্রু ফরাসী শক্তি এবং পারস্যের জামান শাহের সঙ্গে যােগাযােগ করেছিলেন। ফ্রান্স টিপুর পক্ষে যােগও দিয়েছিল।
ঠিক সেই সময় ইউরােপের সঙ্গে ১৭৮৩ খৃস্টাব্দে ফ্রান্সের এক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে অসহায় টিপুকে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয় এবং শেষে স্বদেশবাসীর বিশ্বাসঘাতকতায় সবংশে শহীদ হতে হয়। নিঃসন্দেহে তিনিও ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে বীর শহীদের মর্যদায় বিভূষিত।
এরপর সিন্ধু প্রদেশে আমীরদের সঙ্গে মিঃ মিন্টো ১৮০৯ খৃস্টাব্দে একটা চুক্তি করে তার নাম দিয়েছিলেন চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব। ইংরেজরা বেশ বুঝতে পেরেছিলেন মুসলমানরা তাদের কোন মতেই বরদাশত করবে না। অতএব সকলের সাথে মিত্রতা করে নানা অজুহাতে এক এক করে কায়দা করাই প্রকৃষ্ট পদ্ধতি। কিন্তু ১৮৩৯ খৃস্টাব্দে মিঃ অকল্যাণ্ড চিরবন্ধ মীরদের (মুসলমান) ওপর এমন অপমানকর চাপ সৃষ্টি করেন যে, ইংরেজ সৈন্য এবং নানা মালপত্র যাতায়াতের ব্যবস্থা তাদের অধীস্থানের উপর দিয়েই হবে অর্থাৎ আফগানিস্তান অভিযানে মীরদের পরােক্ষ সহযােগ সৃষ্টির ব্যবস্থা। তখন সম্ভ্রান্ত মীরগণ তাঁদের এলাকায় নিজেদের মুদ্রা প্রচলিত রেখেছিলেন। কিন্তু চতুর গভর্নর জেনারেল মিঃ এলেন বাের এবং জেনালের নেপিয়ার মীরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযােগ আনেন এবং তাঁদের প্রচলিত মুদ্রায় রাণী ভিক্টরিয়ার নাম ছাপতে আদেশ দেন। তখন মীরদের রক্তে বিদ্যুৎ ক্রিয়ার ন্যায় ঘৃণা আর বিদ্বেষের স্রোত বইতে থাকে।
তবুও তারা আর কিইবা করবেন। দেশবাসীর কোন সাহায্যের আশা নেই। বিশেষ করে অমুসলমানদের ইংরেজের প্রভুত্ব বিস্তারের ওপর তেমন কোন আপত্তি দেখা যাচ্ছিল না। তখনাে চিন্তার অবসান হয়নি হঠাৎ ইংরেজ সৈন্যগণ মীরদের অধিকৃত ইমাম গড় দখল করে বসল। মীরগণ প্রাণপণে যুদ্ধ করলেন তবুও ১৮৪৩ সালে দেবু, হায়দ্রাবাদ, মিয়নি তথা সিন্ধু ইংরেজদের হাতে এসে যায়। মুসলমানদের পরাজয় ঘটে।
ঐ সময় হিন্দু ও মুসলমানদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পর্যালােচনা করলে যা দেখা যায় তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
একজন নামকরা ইংরেজ ঐতিহাসিক মিঃ আউটারাম অমুসলমানদের লক্ষ্য করে লিখেছেন,
“তারা ইংরেজদের পক্ষে গুপ্তচরের ন্যায় কাজ করেছিল।”
আর একজন ঐতিহাসিক লিখছেন,
“হিন্দুগণ সুখে থাকলেও মুসলমান শাসনের অবসান কামনা করছিল।”
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।