পিতা হুমায়ুনের মৃত্যুর সময় সম্রাট আকবর এর বয়স ছিল মাত্র তের বৎসর। ঐ বয়সেই ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দের ১৪ই জানুয়ারি তার প্রধান সহায়ক বৈরাম খাঁ তাকে সিংহাসনে বসালেন। শুরুতে সম্রাট আকবরের নামে শাসনকার্য পরিচালিত হলেও সমস্ত কাজকর্ম ও দায়দায়িত্ব বৈরাম খাঁকেই পালন করতে হােত। পাঁচ বস্তু পরে আর বৈরামের অধীনতায় থাকা অসহ্যবােধ করলেন, তাই তার হাত থেকে সমস্ত দায়িত্ব নিজেই ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে জানিয়ে দিলেন, আমি এখন উপযুক্ত, আপনি বরং হজ্জ করতে যান। এই আদেশ জারী হওয়াতে বৈরাম খাঁ নিজেকে অপমানিত বােধ করলেন এবং শেষে বিদ্রোহী রূপ নিলে সংঘর্ষ হয়। সম্রাট আকবর তাঁকে পরাজিত করলেন কিন্তু কারারুদ্ধ বা প্রাণদণ্ড না দিয়ে তার হজে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন; যেহেতু তাঁর থেকে তিনি বহুভাবে উপকৃত ছিলেন। হজ্জ থেকে ফিরে এসে বৈরাম খাঁর ভূমিকা কী হােত বলা যায় না, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ হজ্জে যাওয়ার পথে গুজরাটে তিনি অততায়ী কর্তৃক নিহত হন। কেউ বলেন এটা গুণ্ডা কর্তৃক, আবার কারও ধরণা সম্রাট আকবরের অঙ্গুলি হেলনেই তাঁর এই নিষ্ঠুর পরিণাম।
সম্রাট আকবর এখন বেশ বুঝতে পারলেন যে, এবড় ভারতবর্ষে প্রভাব বিস্তার করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জাতিকে হাতে রাখলেই কাজের সুবিধা হবে। রাজপুত ও হিন্দু জাতিকে তাঁর দিকে আকর্ষিত করতে সচেষ্ট হলেন।
তিনি হিন্দুদের উপর থেকে জিজিয়া কর তুলে দিলেন এবং তাঁদের বড় বড় পদে ভূষিত করলেন। রাজপুত বীর মানসিংহকে অন্যতম সেনাপতি করলেন। রাজস্ব বিভাগ ছেড়ে দিলেন। এই ভাবে যবন অস্পৃশ্য মুসলমান (?) আর সহজে হিন্দুদের প্রিয়পাত্র হলেন যে, কেউ আপন বােন, কেউ বা নিজের কন্যা সম্রাটের হেরেমে প্রবেশ করিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হলেন না।
অম্বর ও জয়সালমীরের হিন্দু রাজকুমারীদ্বয়কে সম্রাট আকবর নিজে বিয়ে করলেন এবং সম্পর্ক আরও গাঢ় করার জন্য অম্বরের পরবর্তী রাজা ভগবানদাসের কন্যা এবং মাড়ােয়ারের রাজা উদয় সিংহের কন্যার সঙ্গে পুত্র সেলিমের বিয়ে দিলেন।
প্রায় সকলেই বশে এলেন ব্যতিক্রম শুধু মেবারের রাণা। বাধ্য হয়ে সম্রাট আকবর মেবার আক্রমণ করলেন। তখন মেবারের রাণা ছিলেন সংগ্রাম সিংহের পুত্ৰ উদয় সিংহ। তিনি সেনাপতি জয়মল্লের হাতে রাজ্য রক্ষার ভার দিয়ে আরাবল্লী পর্বতে আশ্রয় নিলেন। জয়মল্লর নিষ্ঠুর অকারণ আক্রমণের শিকার হয়ে আট হাজার সৈন্য নিয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ করেও পরাজয় বরণ করলেন। অধঃপতিত চিতাের আবরের দখলে এল বটে কিন্তু সমগ্ৰ মেবার হাতে এল না। উদয় সিংহ উদয়পুরে রাজধানী স্থাপন করে রাজত্ব করতে লাগলেন। উদয় সিংহের মৃত্যুর পর প্রতাপ সিংহ সম্রাট আকবরের সঙ্গে মর্যাদার যুদ্ধ করতে থাকেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যতদিন না চিতাের পুনরুদ্ধার হয় ততদিন তিনি অত্যন্ত সাধারণ আহার করবেন এবং শয়ন করবেন শুধু তৃণশয্যায়। পরে হলদিঘাট নামক গিরি সঙ্কটে তুমুল যুদ্ধ হয় ১৫৭৬ খৃষ্টাব্দে। প্রতাপ পরাজিত হলেন আর মেবারের হােল অনিবার্য পতন। প্রতিজ্ঞা পালনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতাপ বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন কিন্তু প্রিয় রাজধানী চিতােরকে তাঁর জীবদ্দশায় আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
পূর্বে যে সমস্ত দেশ স্বাধীন হয়েছিল সম্রাট আকবর সেই সকল রাজ্য একের পর এক জয় করে চললেন। ১৫৭২ খৃষ্টাব্দে গুজরাট দখল করলেন। তখন সুলাইমান কারনানী ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা। তিনি যুদ্ধের পথে পা না বাড়িয়ে সন্ধি করতে আগ্রহী হলেন। কিন্তু তাঁর স্বাধীনচেতা পুত্র দাউদ বিদ্রোহী হয়ে বিহার আক্রমণ করলে সম্রাট আকবর সৈন্য সামন্ত পাঠিয়ে দাউদের স্বাধীনতার স্বাদ মিটিয়ে তাঁকে হত্যা করে নিশ্চিন্ত হয়ে বাংলা-উড়িষ্যা নিজের দখলে আনলেন। তারপর ১৫৮৬ খৃষ্টাব্দে কাশ্মীর ও ১৫৯০ খৃষ্টাব্দে সিন্ধু দেশ জয় করে সমগ্র আর্যাবর্তের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসলেন।
উত্তর ভারতের সাথে এবার তিনি দক্ষিণ ভারতের দিকেও দৃষ্টি দিলেন। ঐ সময় বাহনী রাজ্য ছােট ছােট অনেক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। আহমাদনগরের রাজার মৃত্যুর পর সেখানে অশান্তি ও বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। বিদ্রোহীরা সম্রাট আকবরের সাহায্য প্রার্থনা করলে ১৫৯৫ খৃষ্টাব্দে সম্রাট আকবর তার পুত্র মুরাদকে একদল সৈন্যসহ আহমাদনগরে পাঠালেন। আহমাদনগরের নাবালক রাজার অভিভাবিকা বিদূষী নারী বীরাঙ্গনা চাঁদ সুলতানা বিপুল বিক্রমে বাধা দিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করলেন। মােগল সৈন্যরা আহমাদনগর করায়ত্ত করতে না পারলে পর বছর সম্রাট আকবর স্বয়ং নারী এবং শিশুর বিরুদ্ধে বিপুল সৈন্য ও শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। চাঁদ বিবি এবারেও প্রাণপণে যুদ্ধ চালনা করলেন। রসদ ও গুলি বারুদে স্বল্পতার জন্য শুধু বন্দুক এবং মামুলি অস্ত্র নিয়েই রুখে দাঁড়ালেন। কিন্তু সম্রাট আকবরের বীর গুপ্তচর পিছন থেকে সুলতানাকে হত্যা করার ফলে আহমাদনগরে নেমে এল পরাজয়। আহমাদনগরের একাংশ বাদশার হাতে এল। তারপর বাদশাহ খান্দেশ ও আলিগড় দুর্গে আক্রমণ চালিয়ে বাকি অংশগুলােও দখল করলেন। এমনিভাবে সম্রাট আকবর বিশাল এক সম্রাজ্যের সর্বেসর্বা রাজাধিরাজ বলে বিবেচিত হলেন।
সম্রাট আকবরের পিতা হুমায়ুনের উপর যখন বিপদের বিরাট কন্যা এসে পড়েছিল, সেই সময় হুমায়ুনের এত বড় বন্ধু আর সুহৃদ কেউ ছিলেন না যিনি তাঁর জন্য নিজের প্রাণ, সম্পত্তি ও সম্মান কিছুই দিতে কুণ্ঠাবােধ করেননি তিনিই হচ্ছেন বৈরাম খাঁ। হুমায়ুন তাঁর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত সামান্য কিছু ভূখণ্ড ছাড়া হারিয়ে যাওয়া জায়গাগুলাে পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। ঐ সময় সিকিন্দার শুর এবং ইব্রাহিম শূরের মধ্যে শক্তির খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল। কিন্তু আদিল শাহের এক হিন্দু মন্ত্রী হিমু তদানীন্তন সময়ে শক্তি সামর্থ্য ও জ্ঞান বুদ্ধিতে প্রধান ছিলেন। তিনি এত শক্তিশালী হয়ে পড়লেন যে, দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করে বিক্রমাদিত্য নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসন আরােহণ করলেন। আবার সম্রাট আকবরের ভাই আবদুল হাকিমের অধীনে কাবুল, বঙ্গদেশ, মালব, গুজরাট, গায়ানা, উড়িষ্যা, কাশ্মীর, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও দাক্ষিণাত্য তখন স্বাধীন হয়ে পড়েছিল। রাজপুতগণও মােগল আক্রমণের প্রথম আঘাত সামলে নিয়ে শক্তিশালী হয়ে পশ্চিম উপকূলে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারে মেতে উঠল। এমনকি পারস্য সাগর ও আরব সাগরে তাদের প্রভুর ফলে মক্কাশরীফগামী হজ যাত্রীদের ভীষণ বিপদ ও বাধার সম্মুখীন হতে হােত।
একে তাে এতগুলাে বিপদ তার উপর সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরােহণ করেছেন বালক বয়সে। তখন বৈরাম খাঁ-ই সম্রাট আকবরকে নওজোয়ান বা প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিলেন। আর যদিও বৈরাম খাঁকে লাঞ্ছিত ও পদচ্যুত করেছিলেন কিন্তু এ কথা ঠিক যে, রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে তিনিই ছিলেন সম্রাট আকবরের শুরু, যদিও সম্রাট আকবর তা প্রকাশ্যে স্বীকার করতেন না। আধুনিক ঐতিহাসিকদের অনেকে এর ধারে কাছেই ঘেঁষেননি অথচ আসল ইতিহাসে এর প্রমাণ আছে যে, সম্রাট আকবর যদিও বাদশাহ ছিলেন তবুও বৈরাম খাঁ জানতেন—সে অবুঝ ও অপরিপক্ক। তাই বাদশার ব্যক্তিগত কাজেও তিনি বাধা দিয়ে এবং কু-পদক্ষেপ নিলে তা থেকে বিরত রাখতেন অভিভাবকের মত। [দ্রষ্টব্য : সেন্ট্রাল স্ট্রাকচার : ইবনে হাসান, পৃষ্ঠা ১২৩]
হুমায়ুন যখন কান্দাহার দখল করলেন তখন কৃতজ্ঞতার সাক্ষী স্বরূপ বৈরাম খাঁকে সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। তাছাড়া তাঁকে বড় একটা জায়গীরও প্রদান করেছিলেন এবং মৃত্যুর পূর্বে তিনি সম্রাট আকবরের অভিভাবক নির্ধারিত করেন ঐ বৈরাম খাঁকেই [খানই খান]। সম্রাট আকবর পিতার কাছে শিখেছিলেন তিনি বাবার মত, তাই তাঁকে ডাকতেন ‘খান-ই বাবা’ সম্বােধন করে।
ঐ বৈরাম খাঁকে অসম্মানিত আর পরাজিত হয়ে যে বহিষ্কৃত হতে হবে গুণমুগ্ধ বন্ধুবান্ধবদের সভা হতে, রাজ্য হতে এবং সব শেষে পৃথিবী হতে এক ভাগ্যহারা বৈরাম খাঁ কোনদিন কল্পনাও করেন নি; কল্পনা করেননি অতীত ইতিহাসের পাঠক। সম্রাট আকবরের জীবনের শুরুই কি তবে ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল আর গােলকধাঁধার পথে?
সহজলভ্য ইতিহাসে পাওয়া যায়, সম্রাট আকবর রাজপুতদের বিশেষতঃ বৈবাহিক সম্বন্ধ পাতিয়ে কাছিয়ে নিয়েছিলেন বা আয়ত্তে এনে বন্ধু জাতিতে পরিণত করেছিলেন। অপর দিকে হিন্দু প্রজাবৰ্গও তাঁকে ‘দিল্লিশ্বর’ উপাধিতে ভূষিত করেই ক্ষান্ত হননি অনেকে আবার তাকে ‘জগদীশ্বর’ উপাধি দিতেও কুণ্ঠিত হননি। দালাল মার্কা ইংরেজ ঐতিহাসিকরা প্রশংসা করতে গিয়ে অনেকে চরম মাত্রায় পৌঁছে গেছেন। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা সম্রাট আকবরের জন্য লিখেছেন, বৃটিশ যুগের ডালহৌসির সাম্রাজ্য প্রসার নীতির সাথে সম্রাট আকবরের তুলনা করলে মনে হয় যেন মােগল বাদশা ভারতের আকাশে প্রখর সূর্যের মত দীপ্তমান আর ডালহৌসির ক্ষুদ্র তারকাটি তার পাশে মিটমিট করে জ্বলছে—“A strong and stout annexationist before whose sun the modest star of Lord Dalhousie pales.” সম্রাট আকবর দেখতেও সুন্দর ছিলেন না, তাঁর রং ছিল কালাে তদুপরি সম্রাট আকবর ছিলেন খর্বাকৃতি। কিন্তু ইংরেজ প্রভূর (?) দেওয়া সনদ হচ্ছে—He looked every inch a king. অর্থাৎ পা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রতি ইঞ্চিই সম্রাট আকবর রাজার মত। আবার কোন কোন প্রভু (?) বলেছে-He was great with the great, lowly with the lowly.” শক্তের সাথে শক্তি প্রয়ােগ আর নরমের সাথে নম্রতা ছিল তার বৈশিষ্ট্য। আবার কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, তাঁর চক্ষু চাহনী ছিল সূর্যকােল সমুদ্রের মত–Vibrant like the sea In sunshine’ ইত্যাদি।
তিনি হিন্দু নারী বিবাহ করেছিলেন। সেখানে নিশ্চয় ইসলাম ধর্মে কোন বাধা নেই। কিন্তু শর্ত হচ্ছে সেই নারীকে প্রথমে মুসলমান হতে হবে, তারপর ইসলাম অনুযায়ী বিয়ে হলে তা বৈধ হতে পারে। বিবাহ আর ব্যভিচারের পার্থক্য এইটুকুই। কিন্তু সম্রাট আকবর তাঁর হিন্দু পত্নীদের রাজ অন্তঃপুরে হােমাগ্নি জ্বালিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং যিনি যে ঠাকুরের পুজারিণী ছিলেন তাঁর তেমনি ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফলে তাঁর স্ত্রী ও পুত্রদের মধ্যে তথা রাজবাড়িতে অনৈসলামিক কুপ্রথার প্রচলন হয়, যথা মদ্যপান, ব্যভিচার, গীতবাদ্য প্রভৃতি। তাঁর সন্তানগণ এত বেশি ব্যভিচার-প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে, সম্রাট আকবরের জীবদ্দশাতেই তাঁর দুই সন্তান মুরাদ ও দানিয়াল অত্যন্ত মদ্যপানে মৃত্যুমুখে পতিত হন। জ্যেষ্ঠপুত্র সেলিম বা জাহাঙ্গীরও চরম মাতাল ছিলেন বলা যেতে পারে। মহামতি সম্রাট আকবরের পুত্রদের মধ্যে মদ্যপান এত চরমে ওঠে যে মদে আর নেশা হােত না বলে তারা মদের সঙ্গে ভাং নামক উগ্র মাদক দ্রব্য মিশ্রিত করে পান করতেন।
যাইহােক, ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিন্দু রাজা হিমুকে বৈরাম খাঁর রণকীর্তির কারণে পরাজিত করা সম্ভব হয়। হিমু বন্দী হন এবং সম্রাট আকবরের শাসনের প্রারম্ভে সম্রাট আকবরের সামনেই তাঁর মুণ্ডটি দেহচ্যুত করা হয়। সম্রাট আকবরকে মহামতির অভিনয় করতে হলে এই অশােভনীয় কাজটুকু ধামাচাপা দেওয়ার প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। আবার অন্যদিকে এত বড় এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ব্যাপার বাদ দেওয়াও যায় না, তাই ‘ভারতজনের ইতিহাসে’ লেখা হয়েছে-
“বন্দী হিমুকে সম্রাট আকবরের কাছে ধরিয়া আনিয়া বৈরাম হত্যা করতে বলিলে তিনি তাহা করেন নাই। শেষে বৈরাম নিজেই তরবারি দিয়া হিমুর মুগুটি কাটিয়া ফেলেন।”
লেখক এই ঘটনাটির প্রমাণ দেবার জন্যে কিছু ইতিহাস ও ঐতিহাসিকেরা দিয়েছেন যাঁরা এই ঘটনা সত্য বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন আবুল ফজল, জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী ইত্যাদি। তবুও বাজারের ঐতিহাসিকদের প্রমাণ প্রয়ােগে শান্তি না পেয়ে পরক্ষণেই লিখেছেন,
“ভিনসেন্ট স্মিথ কেন যে সম্রাট আকবরকে কিশাের বয়সেই এই নিষ্ঠুর হৃদয়ে দোষী করিয়াছেন তাহা রহস্যজনক মনে হয়। হিমুর পরাজয়ে মােঘল রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা এবং আফগান শক্তির অবসান ঘােষিত হয়।”
প্রথম পক্ষের উপরােক্ত প্রমাণের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় দোষ যেন সম্রাট আকবরের নয়-বৈরাম খাঁর। দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্য হচ্ছে—সম্রাট আকবরই হত্যাকারী কারণ কাউকে হত্যা করা সিংহাসন বা পালঙ্কে বসা সম্ভব নয়। হত্যা করার নির্দিষ্ট স্থান প্রত্যেক রাজার থাকে, এখানেও তাই ছিল। সম্রাট আকবর তাঁকে (হিমুকে) হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং হত্যাকাণ্ড তিনি চোখের সামনে দেখতে ইচ্ছুক ছিলেন। শুধু হত্যা করার উদ্দেশ্য থাকলে বৈরাম খাঁ তার আগেই কাজ সমাধা করতে পারনে। হিমুকে বধ্যভূমিতে আনার পর সম্রাট আকবরকে মনে করিয়ে দিলেন তাঁর ইচ্ছার কথা। তারপর সম্রাট আকবরের অনুমতি ও আদেশেই তাঁকে হত্যা করা হল। যিনি যখন নেতৃত্ব দেন সাধারণ নিয়মে হত্যাকাণ্ড তাঁর দ্বারা, তাঁর সঙ্গী বা কর্মী দ্বারা, তাঁর আদেশ, সমর্থন বা মৌনতা প্রভৃতিতেই ঘটে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের আদেশ বা নির্দেশেই একজন রাজার ঐ রকম হত্যাও ঘটেছে। এবার যারা সম্রাট আকবরের দোষ গৌণ এবং বৈরাম খাঁর দোষ মুখ্য বলেছেন তাঁরা হলেন আবুল ফজল, জাহাঙ্গীর আর আবদুর রহিম প্রমুখ। কিন্তু মনে রাখতে হবে যাঁরা ঐতিহাসিক তাঁরা নবী বা অবতার নন যে, তাঁদের সাধারণ মানবিকতা প্রত্যেক মুহুর্তে সজাগ থাকবে। কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁদের লােভ, লালসা, ক্রোধ, অভিমানের কবলেও পড়তে হয়; এক্ষেত্রেও কারণ তাই। যেহেতু আবদুর রহিম হচ্ছেন পিতার অবাধ্য সন্তান [পিতা পুত্রের কলহের প্রমাণ আছে], আর জাহাঙ্গীর হচ্ছেন সম্রাট আকবরের ঔরসজাত সন্তান—সে ক্ষেত্রে যা স্বাভাবিক তাই হয়েছে। এমনি ভাবে আবুল ফজল ও সম্রাট আকবরের মধ্যেও এক গুরুত্বপূর্ণ সম্বন্ধ ছিল—গুরুর পুত্র। অতএব সেখানেও তাঁদের কিছু দুর্বলতাবােধ বােধহয় আশ্চর্যের নয়।
সম্রাট আকবরের মা ও বাবার স্বপ্ন ছিল, আমার ছেলের নাম ও রাজ্য বিস্তার যেন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে—যেমন মৃগনাভীর গন্ধ ছড়িয়ে যায়। সম্রাট আকবরের তাই ইচ্ছা ছিল, ছলে-বলে, কলে-কৌশলে, হত্যা, মিথ্যা, শঠতা যেমন করেই হােক তাঁকে রাজ্য বিস্তার করতেই হবে। তাই তিনি বৈরাম খাঁকে বলেছিলেন, আপনি আমার ধর্ম বাবা, খান-ই-বাবা, সুতরাং যতক্ষণ না আমি মজবুত হই আপনি যা ভাল হয় করুন। হত্যার জন্য দায়ী বন্দুক না বন্দুকধারী সেটাই আজ সিদ্ধান্তের বিষয়। তখন আফগান শক্তি নির্মূল করতে হলে হিমুর ধ্বংসের প্রয়ােজন ছিল। তাই হিমুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লি ও আগ্রী সম্রাট আকবরের হাতে এসে গেল।
অপর দিকে আদিল শাহও অন্যত্র নিহত হন। সেকেন্দার শূর সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেন। ইব্রাহিম শূরও বহু দিন ধরে ঘুরে ঘুরে শেষে উড়িষ্যায় নিহত হলে ১৫৫৮ হতে ১৫৬০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে গােয়ালিয়র, আজমীর ও জৌনপুর সম্রাট আকবরের কবলে এসে যায়। এসবই বৈরামের বীরত্বের ফল আর আকঘরের ভাগ্যের জোর বলতে হবে। অবশেষে ১৫৬১ খৃষ্টাব্দে বৈরাম খাঁকে পদচ্যুত করে তাঁর অপেক্ষা বহু গুণে সর্ব বিষয়ে অনভিজ্ঞ পীর মহম্মদ এবং আদম খাঁকে সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। এটা ছিল বৈরাম খাঁর ব্যক্তিত্বে চরম আঘাত ও পরম বেইজ্জতি। তবুও একপক্ষের কাছে সম্রাট আকবর মহামতি।
বৈরাম খাঁর মৃত্যুর পর এক সময় সম্রাট আকবরের মা হামিদা ও ধাত্রীমাতা মহিম অনাগা সম্রাট আকবরকে অপুত নয়নে বলেছিলেন, সম্রাট আকবর, বৈরাম আর নেই। তােমাকে সৎ পরামর্শ দিয়ে সঠিক পথ দেখাবে তেমন কেউ নেই। তাছাড়া তুমি নিজেও লেখা পড়া জান না। সুতরাং যখন ভাল মন্দ বুঝতে পারবে না আমাদের মতামত নেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু সম্রাট আকবর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজ্ঞ বলে মনে করতেন। পরে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। তবে ছােট ছােট ব্যাপারে মাকে খুশি করবার জন্য মহামতি মায়েরর মতামত নিতেন। তাও আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলাে ছিল অরাজকীয় বিষয়।
নূতন সেনাপতি আদম খাঁ ও পীর মহম্মদ ১৫৬১ খৃষ্টাব্দে মালব জয় করেন। পরের বছর ১৫৬২ খৃষ্টাব্দে সম্রাট আকবর তার সেনাপতি আদম খাঁকে হত্যা করেন। যে আদম খাঁকে সম্রাট আকবর হত্যা করেছিলেন সেই আদম খাঁ ছিলেন তার ধাত্রীমাতা মহিম অনাগার পুত্র। পুত্রের শােকে বৃদ্ধা মাতা বাঁচতে পারলেন না, বুকফাটা শোকে দেহত্যাগ করলেন।
তারপর পীর মহম্মদকেও তিনি দিয়েছিলেন মৃত্যুদণ্ড। পরে সম্রাট আকবর তার একজন অন্যতম মামা খাজা মােয়াজ্জমকে মিথ্যা হত্যার অভিযােগে প্রাণদণ্ড দেন। নানা কারণে সারা মুসলমান সমাজ, আত্মীয় অনাত্মীয় প্রত্যেকেই অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলেন। সম্রাট আকবর বুঝতে পারলেন একটা দল ভেঙ্গে গেছে। অতএব অন্য কূল আর ভাঙ্গতে দেওয়া হবে না। যেমন করেই হোক অমুসলমানদের হাতে রাখতেই হবে। তার এই প্রস্তাবে রাজপুতরা অনেকে সাড়া দিলেন। সাড়া দেওয়ার কারণ ঐতিহাসিকদের মতে প্রধাণতঃ দুটি—প্রথমতঃ, পূর্ব থেকেই রাজপুতরা মুসলমানদের শক্তি ও প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন, দ্বিতীয়তঃ, তারা এর মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয়, আধিপত্য লাভ ও ভবিষ্যতে হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপনের আশার আলাে দেখতে পেয়েছিলেন। যাইহােক, ১৫৬২ খৃষ্টাব্দে অম্বর রাজ্যের রাজা বিহারীমল্ল সম্রাট আকবরের আনুগত্য স্বীকার করেন এবং তাঁর কুমারী এক কন্যাকে দান করেন। সেলিম বা জাহাঙ্গীরের জন্ম ঐ কন্যার গর্ভেই হয়েছিল। সেলিম চিস্তি নামে এক মুসলমান সাধক দোওয়া করেছিলেন বলে তারই নামানুসারে নাম রাখা হয়েছিল সেলিম’।
তারপর মানসিংহ সম্রাট আকবরকে তার আপন বােন দান করেন। সম্রাট আকবর নিজে বিয়ে না করে সেলিমের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন। মানসিংহের বােন ছিলেন বিহারী ভগবান দাসের কন্যা। এই কন্যারই গর্ভজাত সন্তান জনাব খসরু। যােধপুরের রাজা উদয়ের কন্যাকেও গ্রহণ করেন সম্রাট আকবর। বিকানীরের রাজা রায় সিংহও তাঁর কন্যা দান করলেন মহামতির হেরেমে। তাঁকে বিয়ে করলেন জাহাঙ্গীর। জয়সলমীরের রাজা সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন, শুধু বশ্যতাই নয়, সেই সঙ্গে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তার প্রিয়তমা কন্যাকেও।
মােট কথা, মহামতির আসল ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় আর অসংখ্য স্ত্রী, অ-স্ত্রী আর পত্নী-উপপত্নীর কথা, যাঁদের দ্বারা মহামতির মহল সব সমই জমজমাট থাকত। কিন্তু যেহেতু এ সব কীর্তি ইতিহাসে প্রকাশ করলে ‘মহামতি’ নামের সার্থকতা থাকে না, তাই চাপা ছিল এতদিন।
‘সম্রাট আকবরের বহু সংখ্যক উপপত্নী ছিল…’—এইসকনূতন তথ্যের সন্ধান মুসলমান লিখিত ইতিহাসে পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিখ্যাত হিন্দু ঐতিহাসিক শ্রীরামপ্রসাদ শুপ্তের লেখা ‘মােগল বংশ’ পুস্তকের ১৭৮ ঋতৃরন্তব্য বিশেষ স্মরণযােগ্য— “উপপত্নীর সংখ্যা ছিল পাঁচ শতের বেশি।” পাঁচ শত নারীর ধর্ষক রাজা বলে ইতিহাসে যাঁর উল্লেখ আছে যদি এটা সত্য হয় তাহলে তাঁকে আমরা মহামতি বললেও আগামীকালের ইতিহাস বলবে কি করে সেটাই চিন্তার কথা। আমাদের ভারতের বিখ্যাত ‘Vindication of Aowrangzeb’ গ্রন্থের ১৪৩ পাতায় আরও সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে-“Akber had over five thousand wives.” সম্রাট আকবরের পাঁচ হাজারেরও বেশি স্ত্রী ছিল। যাঁরা কন্যা দিয়েছিলেন তাঁরা স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়েই দিয়েছিলেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। ফলে তারা বাদশার অনুগ্রহে ধন্য হয়ে অর্থ, সম্পদ, সম্পত্তি ও সম্মান পেয়েছেন, আর রাজপুতদের হাতে এসেছিল রাজকীয় শক্তির মােটা একটা অংশ।
এক পক্ষ বলেন, সম্রাট আকবর ও রাজপুতদের উদারতার সাক্ষ্য স্পষ্ট হয় কন্যা প্রদানের ক্ষেত্রে। অপর পক্ষ বলেন, নারী লােলুপতা আর চরিত্রহীনতা প্রকাশ পেয়েছে মহামতির দিক থেকে, আর ঐ সমস্ত রাজপুতদের দিক থেকে প্রকাশ পেয়েছে নীচতা ও হীনতা। তাঁরা আবাে বলতে পারেন, পার্থিব উন্নতির জন্য যাঁরা নিজেদের কন্যা ও বােনকে চরিত্রহীনের হাতে স্বেচ্ছায় অর্পণ করতে পারেন তাঁরা নিঃসন্দেহে শুভ কর্ম করেননি।
তবে এ কথা সত্য ও স্বাভাবিক যে, প্রত্যেক রাজপূতই পাইকারি হারে ঐ পাপ পঙ্কিলে নিমজ্জিত হয়েছিলেন তা নয়। বরং বহু রাজপুত বীর তাঁদের বীরত্বের মহিমাকে অক্ষুন্ন রাখতে উল্টো নজির সৃষ্টি করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ ১৫৬৪ খৃষ্টাব্দে সম্রাট আকবর যখন মধ্য প্রদেশের গন্ডােয়ানা দখল করেন তখন সেখানকার বিধবা রাণী দুর্গাবতী যুদ্ধে পরাস্ত হন পরে তিনি আত্মহত্যা করেন, তবুও সম্রাট আকবরের হাতে পড়েন নি। মেবারের রাণা সংগ্রাম সিংহের পুত্র উদয় সিংহ সম্রাট আকবরের প্রস্তাব সত্ত্বেও তাঁর কন্যাকে সমর্পণ করেননি, যার ফলে সম্রাট আকবর কর্তৃক চিতাের আক্রান্ত হয় ১৫৬৭ খৃষ্টাব্দে। উদয় সিংহ পলায়ন করেন কিন্তু রাজপুত সৈন্যগণ জয়মল্ল ও পুত্রের নেতৃত্বে যুদ্ধ করে। অবশেষে পুত্র ও জয়মল্লকে সম্রাট আকবরের হতে নিষ্ঠুর ভাবে নিহত হতে হয় বলে চিতাের সম্রাট আকবরের হতে এসে যায়। যুদ্ধে পরাজিত রাজপুতদের প্রাণ দিতে হল ‘মহামতি’ সম্রাট আকবরের নিষ্ঠুর হাতের ইঙ্গিতে। আর নারীরা হালচাল বুঝতে পেরে জহরব্রত পালন অর্থাৎ আগুনের চিতার মত তৈরি করে তাতেই ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বির্সজন করলেন। ১৫৭২ খৃষ্টাব্দে উদয়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রতাপ সিংহ পিতার স্থলাভিষিক্ত হলেন। তিনি পিতার চেয়েও সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ১৫৭৬ খৃষ্টাব্দে হলদিঘাটের যুদ্ধে সম্রাট আকবরের হাতে তিনি পরাজিত হলেন। তারপর বনে জঙ্গলে লুকিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে কাটিয়ে বহু যুদ্ধ করে অনেক স্থান পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিলেন কিন্তু তাঁর সাধের চিতাের কার করা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রতাপের এই পরাজয় বিজয়েরই নামান্তর। তিনি বশতা স্বীকার ও কন্যা দানের চিন্তাকে মুহূর্তের জন্যও তার মস্তিষ্কে আসতে দেননি।
প্রতাপের জন্য অনেকে গোঁড়া সংকীর্ণমনা হিন্দু বলে অভিয়োগ করেন। কারণ, একবার সম্রাট আকবরের শ্যালক ও সেনাপতি মানসিংহ প্রতাপের বাড়িতে গিয়েছিলেন। প্রতাপ মােটেই অতিথির আপ্যায়ন বা সম্মান প্রদর্শন কিছুই করেননি অপমানের সুরে বলেছিলেন, ‘যারা মুসলমানকে পিসি, বােন বা কন্যা দিয়েছে তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’ মানসিংহের মান নষ্ট হওয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘এর কেমন করে প্রতিশােধ নিতে হয় আপনাকে দেখাতে পারি জানেন?’ প্রত্যুত্তরে প্রতাপ বলেছিলেম, ‘যাও যাও, তােমাদের পিসেমশাই, ভগ্নিপতি, জামাইদা সম্রাট আকবরকে গিয়ে সব বােল এবং তাঁকেও সঙ্গে করে এনাে।’ মােট কথা, প্রতাপ এক সঙ্গে খাদ্য গ্রহণ করেন নি এবং ঘৃণাভরে উঠে গিয়েছিলেন। [দ্রষ্টব্য : রাজপুত ও মারাঠা ও রমেশচন্দ্র দত্ত, পৃষ্ঠা ১৬]
প্রতাপের এমন বীরত্ব আমাদের মতে মােটেই গোঁড়ামি নয় বরং একনিষ্ঠ বীরের বীরত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের উদাহরণ। তাঁকে গোঁড়া হিন্দু না বলে নিষ্ঠাবান বীর প্রতাপ সিংহ বলা উচিত।
তারপর বনে জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে প্রতাপ সিংহকে এক হৃদয় বিদারক ঘটনার সম্মুখীন হতে হােল। তাঁর আদরের কন্যা ক্ষুধায় কাঁদতে কাঁদতে ছটফট করতে লাগল। তাছাড়া আরও পারিপার্শ্বিক কারণে তিনি আর ধৈর্য ধারণ করতে না পেরে সম্রাট আকবরকে এক লিখিত পত্র জানালেন, তাঁর কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করতে সম্মত। পত্র পেয়ে খুশি হয়ে সম্রাট আকবর সভাসদকে ডেকে বললেন, প্রতাপের উপর অত্যাচার যাতে না হয় তার ব্যবস্থা করতে। ঠিক ঐ সময় সভাসদগণের মধ্য থেকে জাহাঙ্গীরের শশুর বিকানীরের রাজা রায় সিংহের কনিষ্ঠ সহােদর পৃথ্বীরাজ মর্মাহত হয়ে এক পত্রে প্রতাপকে বললেন—“আমরা, রাজপুতরা সম্রাট আকবরের অধীনতা স্বীকার করে এবং তাঁকে কন্যা দিয়ে অধঃপতিত হলেও আপনার জন্য গর্ব করি। সম্রাট আকবরকে একদিন মরতেই হবে তখন আমাদের দেশে খাঁটি রাজপুতবীজ বপণের জন্য আমরা আপনার নিকটেই উপস্থিত হব। রাজপুত জাত আপনার মুখের দিকে চেয়ে আছে।”
পত্রটি যে একটি ঐতিহাসিক গবেষণামূলক দলিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সে যাইহােক, এই পত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতাপ নূতন করে শক্তি ধারণ করলেন। রাজপুতগণ রাজপুত জাতির প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতীক্ষা করেছিলেন বীজ বপনের—কিন্তু কালের চক্র তাে পরিচালিত হয় বিশ্বনিয়ন্তার ইঙ্গিতেই।
‘মহামতি’র ইতিহাসে দুর্লভ দলিল
সম্রাট আকবর এক নূতন, ধর্মের সৃষ্টি করেছিলেন, যার নাম ‘দীন-ই-ইলাহি’। এটা এক পক্ষের কাছে দারুণভাবে প্রশংসিত আর অপর পক্ষের কাছে তা নিরেট ভন্ডামি ও আবর্জনার ন্যায় পরিতাজ্য। নিরপেক্ষ ভূমিকায় বলতে হলে, দীন-ই-ইলাহী ছিল মহামতি সম্রাট আকবরের স্বধর্মের নিপাত সাধনের এক পরিকল্পিত চক্রান্ত।
ইসলাম ধর্মে আল্লাহ ছাড়া কোন সৃষ্টির উপাসনা করা শুধু নিষেধই নয় বরং সৃষ্টির দ্বিতীয় কোন উপাস্য স্বীকার করলে তিনি মুসলমানই নন। তাই হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সারা জীবন পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে আপােসহীন সংগ্রাম করে গেছেন এবং বিশ্বকে জানিয়ে গেছেন উপাসনা একমাত্র স্রষ্টারই জন্য। কিন্তু মহামতি তার দীন-ই ইলাহী ধর্ম সূর্য উপাসনার উৎসাহ ও আদেশ দিয়েছেন। তিনি নিজেও শাস্ত্রানুযায়ী নিদিষ্ট সময়ে সূর্যের উপাসন করতেন।
সারা বিশ্বের মুসলমানদের মূলমন্ত্র ‘লা ইলাহা ইল্লাহ মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং হজরত মুহাম্মদ আল্লারই প্রেরিত পয়গম্বর। কিন্তু সম্রাট আকবর তাঁর নূতন ‘কালেমাহ’ চালু করলেন ‘লা ইলাইহল্লাল্লাহ সম্রাট আকবর খলিফাতুল্লাহ।’ এত বড় আঘাত, যা মুসলমানদের উপর কোন বিরুদ্ধাবাদী অন্য ধর্মাবলম্বীর পক্ষেও সম্ভব হয়নি, তাই-ই হয়েছিল ‘মহামতির’ সময়ে।
সম্রাট আকবরের নূতন ধর্মে মদ ও সুদকে বৈধ বলে ঘােষণা এবং উৎসাহ দান করা হয়েছে। কুরআন শরীফে জুয়া খেলাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আর তার নূতন ধর্মে জুয়া খেলা জায়েজ বা বৈধ করেন। শুধু তাই নয়, রাজ খরচে পৃথক অট্টালিকা তৈরি করে সেখানে জুয়া খেলার সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। এছাড়া মজার কথা হােল, জুয়া খেলায় যাদের পুজি বা মূলধন থাকত না রাজকোষ থেকে তাদের ঋণ দেওয়ারও সুব্যবস্থা ছিল।
দাড়ি রাখা ইসলাম ধর্মে ‘সুন্নাত’ বা হজরত মুহাম্মাদ এর নির্দেশ। না রাখলে পাপ হয়। তাছাড়া দাড়ি রাখাকে বা বিশেষ কোন সুন্নাতকে উপেক্ষা কিংবা অস্বীকার করলে সে ইসলাম বিরােধী বলে বিবেচিত। মহামতি দাড়ি মুগুন বৈধ বলে আইন করলেন এবং তার মাতার মৃত্যুর পরেই মাতার শোকে দাড়ি মুক্ত করে আদর্শের ভিত্তি স্থাপন করলেন। পর দিন থেকে রাজদরবারে যত উচ্চ শ্রেণীর কর্মচারি ছিলেন তারা অনেকে নিজের দাড়ি মুণ্ডন করে বাদশাহের পদপ্রান্তে উৎসর্গ করলেন। মহামতি সম্রাট আকবর নিজের ধর্মের ও বুদ্ধির সাফল্যে বেশ আনন্দ উপভােগ প্রতে লাগলেন।
প্রত্যেক মুসলমানের কুরআন ও হাদীসের আইন অনুযায়ী স্ত্রী সংসর্গান্তে ফরজ গােসল [এক বিশেষ নিয়মে স্নান] অবশ্য করণীয়। কিন্তু, নূতন ধর্মে তা রহিত করা হয় এবং এক নূতন প্রথার প্রচলন করা হয়—‘গােসল করা ভাল কিন্তু পরে নয়, পূর্বে।
মহামতি নিজের, রাজপুত্রগণের এবং সভাসদবর্গের সুবিধার্থে এক অভিনব বিয়ের প্রচলন করলেন যার নাম ‘মুৎআ’ বা অস্থায়ী বিয়ে। অর্থাৎ দু-চার দিন বা দু-এক মাসের জন্য একটা বিয়ে করে আবার তাকে তালাক বা বর্জন করা যাবে। বিয়ের নামে এরকম এক বীভৎস ব্যভিচার প্রথার প্রচলন করে নারীর নারীত্বকে কলঙ্কিত করতে মহামতির মতি কোন সময়ে কেঁপে ওঠেনি।
তিনি ইসলামের সুচিন্তিত পর্দা প্রথাকে একেবারে রহিত করেন। অর্থাৎ সারা ভারতের মুসলমান-হিন্দু ভদ্র রমণীগণের মধ্যে অবগুণ্ঠন-যথা ঢিলে পােশাক পরা, মাথায় কাপড় দেওয়া, ওড়না ব্যবহার করা ইত্যাদি যেসব সভ্য নীতিগুলাের প্রচলন ছিল মহামতি কঠোর নির্দেশ দিয়ে তা নিষিদ্ধ করলেন। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা স্বজ্জাশীলতা ও শালীনতাবােধ ছিল। কিন্তু মহামতি পরিষ্কার নির্দেশ দিলেন বাজারে বাইরে চলাফেরার সময় মাথায় কাপড়, পর্দা অথবা অবগুণ্ঠিতা হওয়া চলবে না।
বার বছরের কম বয়স্ক বালকদের ‘খৎনা’ দেওয়া নিষিদ্ধ বড় হয়ে সে নিজের ইচ্ছায় করাতেও পারে আবার নাও করাতে পারে—এরকম আদেশ জারি হােল।
মৃতকে কবর দেওয়া সারা পৃথিবীর মুসলমানের একটা সার্বজনীন প্রথা ও ইসলাম ধর্মের নির্দেশ। আর কবর দেওয়ার নিয়ম হােল, মৃতদেহটিকে কবরে এমনভাবে শায়িত করা যেন মক্কার কাবাঘরের দিকে পা বা মাথা না থাকে [ভারতে উত্তর দক্ষিণে]। সম্রাট নির্দেশ দিলেন, মৃত ব্যক্তির স্কন্ধে একটা গমের প্যাকেট বা ইট বেঁধে জলে ফেলে দাও। আর যদি একান্ত কবর দিতেই হয় তাহলে ভারতবর্ষের পশ্চিম দিকে কাবা শরীফ, অতএব সেইদিকে পা করেই মৃত দেহটিকে শায়িত রাখতে হবে।
ইসলামী বিধি অনুযায়ী পুরুষদের জন্য প্রকৃত রেশম বা সিল্ক বস্ত্র ও সােনার গহনা ব্যবহার অবৈধ। নারীর জন্য অবশ্য বৈধ। সম্রাট আকবর আইন করলেন পুরুষদের জন্য সােনা ও সিল্ক ব্যবহার করা নিষিদ্ধ নয়।
তার নূতন ধর্মে গরু, মােষ, মেষ, উট খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল কিন্তু বন্য জন্তু যথা বাঘ, ভল্লুক, সিংহ ইত্যাদি খাওয়া বৈধ ছিল। গাে মাংস খাওয়া শুধু নিষিদ্ধই ছিল না, বিশ্বের মুসলমানদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ঈদুল আজহা’তেও গরু ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল।
মসজিদে আজান দেওয়া ও একসাথে [জামাতে] নামাজ পড়বার নিয়ম বন্ধ করা হয়েছিল [মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ, পৃষ্ঠা ৩১৪]।
পবিত্র মক্কা শরীফে হজ্জব্রত পালন যুগে যুগে সব দেশের স্বচ্ছল মুসলমানের জন্য একবার জরুরী, যাকে বলে ‘ফরজ’। তঁার সময় হঠাৎ আইন করে হজ্জ নিষিদ্ধ করা হয়।।
কুকুর ও শূয়াের ইসলাম ধর্মে ঘৃণ্য পশু বলে চিহ্নিত। সম্রাট আকবর কিন্তু তার সময়ে কুকুর ও শূযােরকে আল্লাহর কুদরত’ [মহিমা] প্রকাশক ও পবিত্র বলে ঘােষণা করেন।
তিনি কুরআন-এ বিশ্বাস করতে নিষেধ করতেন। অর্থাৎ তিনি চাইতেন সারা পৃথিবী কুরআনের প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ধ্বংসের কারণ হোক।
প্রত্যেক মুসলমানের তঁর মুসলমানত্ব বজায় রাখার জন্য মৃত্যুর পর পুনরুত্থান এবং বিচার দিবসের উপর বিশ্বাস রাখা একান্ত জরুরী। কিন্তু ‘মহামতি’ পুনরুত্থান ও বিচারের ব্যবস্থাকে অস্বীকার করতেন।
মুসলমানদের একে অপরের সাথে সাক্ষাত হলে ‘আসসালামু আলাইকুম’ [আল্লাহ আপনার উপর শান্তি বর্ষণ করুন] বলার নিয়ম আছে। প্রত্যুত্তরে ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম’ [আপনার উপরেও শান্তি বর্ষিত হােক] বলা হয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরে সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে এই পদ্ধতি ছাড়া দ্বিতীয় কিছু নেই।
সম্রাট আকবর সালাম দেওয়ার প্রথা বিলােপ করে তার পরিবর্তে ‘আল্লাহু আকেবর’ বলার নিয়ম চালু করেছিলেন। তার উত্তরে ‘জাল্লা জালালুহু’ বলা হােত। এবারেও প্রজাজাগণ তাঁর কাছে নিবেদন করলেন, সম্রাট, আপনার কাজকর্ম দেখে সমস্ত হিন্দুই আপনার উপরে সন্তুষ্ট। তাই শ্রদ্ধায় হিন্দুরা আপনাকে দিল্লিশ্বর ও জগদীশ্বর বলে। কিন্তু আপনি সালাম তুলে দিয়ে আল্লাহ শব্দ ব্যবহার করলেন কেন? আপনি এটাও তুলে দিন। তখন সম্রাট আকবর হিন্দু প্রজাবর্গকে নিশ্চিন্ত করতে বললেন— মুসলমানদের জন্যই আমিই স্বয়ং আল্লাহ হয়ে প্রকাশিত হয়েছি অর্থাৎ ‘আল্লাহু সম্রাট আকবর’ মানে সম্রাট আকবরই আল্লাহ। তাঁর অনুগত হিন্দু প্রজাগণ আবার অভিযােগ করলেন-আল্লাহ শব্দটা হিন্দু বিরােধী অতএব সেটাকে তুলেই দিন। সম্রাট আকবর তাই-ই করলেন। সারা দেশে ঘােষণা করে দিলেন— আজকে ‘সালাম’ বা আল্লাহর পরিবর্তে ‘আদাব’ শব্দ ব্যবহার করতে হবে।
যীশুখৃষ্টের সঙ্গে যেমন ‘খৃষ্টাব্দ’ জড়িত তেমনি হিজরী সাল হজরত মুহাম্মাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু অনেক হিন্দু প্রজা ‘দিল্লিশ্বরে’র নিকট আবেদন করলেন—আমরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমাদের জন্য একটা পৃথক সালের ব্যবস্থা করা হােক। তাই করা হােল, পৃথক সালের নাম রাখা হােল ‘ইলাহি’ বছর। তাতে অনেক হিন্দু প্রজা তাদের কৃতকার্যতার জন্য মহামতির মহত্বের প্রতি খুবই আস্থাবান হলেন।
এখানে বেশ প্রমাণ হচ্ছে, সম্রাট আকবর আসলে ইসলামধর্ম বিধ্বংসী কতকগুলাে চরমপন্থী মানুষের হাতের পুতুল ছিলেন মাত্র।
মুসলমানদের মসজিদ ও উপাসনালয়গুলােকে গুদাম ঘর ও হিন্দু প্রজাদের ক্লাব ঘরে রূপান্তরিত করেও সম্রাট আকবর এক বিশেষ শ্রেণীর বাহবা কুড়িয়েছিলেন। [দ্রঃ পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩২২]
ইসলাম ধর্ম নিঃশেষিত হতে পারে কি না তা পরীক্ষার জন্য কিছু মসজিদ অমুসলমান প্রজারা ভেঙ্গে ফেলে সেই স্থানে মন্দির নির্মাণ করেন। সম্রাট আকবরের নিকট প্রতিবাদ করা হলে তিনি যুক্তি দেখালেন, মুসলমানদের এই মসজিদগুলাে সত্যিকারের প্রয়ােজন নিশ্চয় ছিল না, যদি থাকতাে তাহলে ভাঙ্গা সম্ভব হােত না। মন্দিরের প্রয়ােজন ছিল তাই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদও ধর্মস্থান আর মন্দিরও ধর্মস্থান। একটি ধর্মস্থান ভেঙ্গে অধর্মের কিছু গড়া হলে প্রতিকার করা যায় কিনা বিবেচনা করা হত। কিন্তু এখানে সেরকম কিছু না হয়ে বরং ধর্মস্থানের পরিবর্তে ধর্মস্থানই গড়ে উঠেছে। তারপরেই মসজিদ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে নূতন মসজিদ নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মুসলমান ধর্মের হৃৎপিণ্ড প্রায় পবিত্র কুরআন ও হাদীস শিক্ষা, শিক্ষালয় বা শিক্ষাদাতাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সম্রাট আকবর সবচেয়ে মারাত্মক কর্মের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ইসলাম সংক্রান্ত শিক্ষার চির অবসানই ছিল সম্রাট আকবরের উদ্দেশ্য। এককথায় হজরত মুহাম্মাদ যা নির্দেশ দিয়েছেন বা নিষেধ করেছেন, তিনি যেন তার সঙ্গেই সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন মুসলিম বিদ্বেষী অমুসলমান শাসকও যা কল্পনা করেননি, ‘মহামতি’ তা বাস্তবে পরিণত করবার জন্য কত পাকাপাকি ব্যবস্থা করেছিলেন এই আলােচনার পর সে কথা সহজেই অনুমেয়।
সম্রাট আকবর নিজেকে ঈশ্বরের মত মনে করতেন এবং তিনি ভাবতেন তিনি হচ্ছেন মনুষ্য আকারের দেবতা [দ্রঃ সেন্ট্রাল স্ট্রাকচার, পৃষ্ঠা ৫৯]। আর সেইজন্যই সম্রাট আকবর একটি নূতন ‘বেদাতের’ সৃষ্টি করেন, যাকে বলা হােত ‘ঝরোকা দর্শন’–সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দরবারে জনসাধারণের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে সৌভাগ্যের সৃষ্টি করতেন। আরও পরিষ্কার ভাষায় দিল্লিশ্বরকে জগদীশ্বর (?) মনে করে দেখতে আসতেন গরীব প্রজার দল। ঐতিহাসিক বাদাউনির মতে ওটা ছিল হিন্দু দর্শনের অনুকরণ। [দ্রঃ মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ : ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৬]
সম্রাট আকবর জনসাধারণকে তাঁর সৃষ্ট জীবের মত মনে করে খুব বেশি শ্রদ্ধার আশা করতেন। রাজদরবারের নিয়মের বাইরে একটু বেয়াদবি ভুলত্রুটি বরদাস্ত করতেন না। তাঁর দরবারে ‘কুর্ণিশ’ অর্থাৎ মাথা ও কোমর ঝুকিয়ে দুই হাতের তালু কপালে ঠেকাতে ঠেকাতে এগিয়ে যাওয়া এবং কাজ সেরে ঐভাবে ফিরে আসার প্রথা চালু ছিল। ‘তসলীম’ প্রথাও বর্তমান ছিল, অর্থাৎ ডান হাত মেঝেতে রেখে ধীরে ধীরে সােজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের তালু মাথায় ঠেকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করা। ইসলামে যদিও এক আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে সেজদা বা প্রণিপাত করা মােটেই চলে না তবুও তার দরবারে ‘জমিন বােসা’ অর্থাৎ সম্রাটের সামনে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে সেজদা বা প্রণিপাত করে সম্মান জানানাের ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। [দ্রঃ আইন, প্রথম খণ্ডের ১০ পৃষ্ঠা; দি কালচারাল আস্পেক্ট অব মুসলিম ইন ইন্ডিয়া ও এস. এম জাফর, পৃষ্ঠা ২০-২৯]।
সম্রাট আকবর ইসলামের নিয়ম কানুন বর্জন করার আদেশই শুধু দিতেন না প্রকাশ্যে ইসলামের নিন্দাও করতেন। বলতেন, আরবদেশের ফকীররা ইসলামের সৃষ্টি করেছে। ইসলাম সম্বন্ধীয় আরবী বইপত্র পড়া নিষিদ্ধ ছিল, তবে চিকিৎসা বিষয়ক ও অনৈসলামিক পুস্তকাদি পড়ার অনুমতি ছিল। ঐশীবাণী কুরআনকেও তিনি অস্বীকার করেন। [দ্রঃ নুযহাতুল খাওয়াতির ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৭-৭৯]।
ঐতিহাসিক মাওলানা আকরম খাঁর তথ্যবহুল বিরল গ্রন্থ ‘মােছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’ থেকে আরও কিছু মূল্যবান তথ্য পরিবেশিত হচ্ছে—
- [ক] শাহী মহলে অগ্নি পূজার তিনিই ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা।
- [খ] পারস্যের কুখ্যাত ‘মােলহেদ’ দলের তিনিই প্রশয়দাতা যা থেকে ভারতে তান্ত্রিক ভণ্ড মারেফাত দলের সৃষ্টি হয়।
- [গ] তিনি নিজে স্বাতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে অন্য ধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে কণ্ঠে রুদ্রাক্ষের মালা পরে চন্দনচর্চিত দেহে সন্ন্যাসীর পােষাকে দরবারে বসতেন।
- [ঘ] সন্ধ্যার সময় দীপ জ্বালানাের সঙ্গে সঙ্গে সম্রাট আকবর সকলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে অগ্নি শিখাকে প্রণাম করতেন।
- [ঙ] তার সময়ে বেশ্যাখানা বৈধ করা হয় এবং প্রথম কর ধার্য করা হয় ।
- [চ] তিনি আল্লার ছায়া, তার হুকুম না মানলে নরকে যেতে হবে—এই নির্দেশনামায় ১৭ জন মুসলমান ও একজন হিন্দু পণ্ডিতের সই করান।
- [ছ] হিন্দু প্রজাদেরকে মসজিদে পূজো করার অনুমতি দেন।
- [জ] মূর্খ নর-নারীরা সম্রাট আকবরকে নিয়মিত পূজো করতে শুরু করেন।
যদিও ঐ তথ্যগুলাে উপরােক্ত গ্রন্থের ১২৯-১৪০ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত আছে তবুও এগুলাে লেখকের সৃষ্টি করা বক্তব্য নয়। তিনি সাহায্য নিয়েছেন টার্কস্ ইন ইন্ডিয়া, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, মডার্ন হিস্ট্রি, ভারতের শিল্পকলা, মােগল সাম্রাজ্য প্রভৃতি অমূল্য গ্রন্থের। এমনিভাবে মাওলানা আবুল আ’লা মওদুদী সাহেবের ‘তাজদীদে এহ ইয়ায়ে দ্বীনে’র আবদুল মান্নান তালিব কর্তৃক অনুদিত ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন পুস্তকের ৫৬-৬১ পৃষ্ঠাতেও কিছু তথ্যও পাওয়া যায়।
এখন একটা সহজ প্রশ্ন হতে পারে, উপরােক্ত তথ্যগুলাে যদি সত্যু তবেই তাে সম্রাট আকবর হবেন ঐ অভিযােগে অভিযুক্ত। কিন্তু যদি কোন ইতিহাসে তার প্রমাণ না থাকে তাহলে অভিযােগের অধিকার আধুনিক ঐতিহাসিকদেরই বা থাকবে কি করে? সেহেতু উল্লেখ করা যেতে পারে ‘এছবাতুন নবুওত’, ‘রিসালায়ে অহললিয়া’, ‘মুনতাখাবুল লুবাব’, ‘মুনতাখাবুত্তাওয়ারিখ’, ‘নুযহাতুল খাওয়াতির’, ‘আইন-ই-সম্রাট আকবরী’, ‘Mujaddid’s Conception of Towhid’, ‘Awnul Mabud’, ‘Kalematul Hoque’, ‘History of Nationalism’ প্রভৃতি অসংখ্য আকর গ্রন্থ সম্রাট আকবরের কীর্তিকলাপের সাক্ষী স্বরূপ আজও বেঁচে রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন লাইব্রেরিতে, যেগুলাে পড়ে অব্যর্থ সত্য ইতিহাসের উৎস সন্ধানে উৎসাহের খােরাক পাওয়া যায়। এছাড়া আরও বহু পত্র-পত্রিকা আমাদের দেশে ছােট বড় লাইব্রেরিতেও মজুদ রয়েছে, যেগুলাে হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান প্রভৃতি ঐতিহাসিকদের তথ্য ও তত্ত্বের মিশ্রণে নিঃসন্দেহে মূল্যবান মূলধন।
সম্রাট আকবরের কোন দোষ ইংরেজ ও বর্তমান ঐতিহাসিকরা স্বীকার করতে চান না মােটেই। তাঁর গুণগানে বলা হয়, তিনি হিন্দুদের উপর থেকে জিজিয়া কর তুলে দিয়েছিলেন। যদি ক্ষণেকের জন্য মেনেই নেওয়া হয় জিজিয়া হিন্দুদের প্রতি অত্যাচার ছিল তাহলে সম্রাট আকবর সিংহাসনে বসেই তা তুলে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। সম্রাট আকবর নামায় আছে, ১৫৬৪ খৃষ্টাব্দে সারা ভারতবর্ষ থেকে জিজিয়া তুলে নেওয়া হয়। যদিও সম্রাট আকবরনামা অনেক মুল্যবান্ তথ্য বহন করে তবুও মনে রাখা দরকার, ঐ ইতিহাস সম্রাট আকবর লিখিয়েছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর আবুল ফজলকে দিয়ে। তাই সন তারিখের সঠিকতা জানতে হলে অন্য ইতিহাসের দিকে নজর দেওয়া ভাল। যদি আমরা ঐতিহাসিক বাদাউনির মুনতাখাবুত্তাওয়ারিখ খুলি, তাহলে তার দ্বিতীয় খন্ডের ২৭৬ পৃষ্ঠায় দেখতে পাব সম্রাট আকবর জিজিয়ার উচ্ছেদ করেছিলেন ১৫৬৪ খৃষ্টাব্দে নয়, ১৫৭৯ খৃষ্টাব্দে।
হিন্দুদের কাছ থেকে সম্রাটের দরবারে এত বেশি উপহার আর উপঢৌকন আসতো যে তাঁদের কাছ থেকে জিজিয়া নেওয়ার প্রয়ােজনই ছিল না। তবুও দরদী [?] সম্রাট আকবর তা নিতে ছাড়েন নি। তাছাড়া, তর্কের খাতিরে ১৫৭৯র পরিবর্তে যদি ১৫৬৪ খৃষ্টাব্দকেই জিজিয়া বিলােপের সময় বলে ধরে নেওয়া যায় তাহলেও বলা যায়, সিংহাসনে বসার (১৫৫৬) পর দীর্ঘ আটটি বছর তাঁর দরদ ছিল কোথায়? এতদিন তিনি জিজিয়ার উচ্ছেদ করলেন না কেন, তা কি সূক্ষ্মদর্শী ও নিরপেক্ষ শ্রেণীর চিন্তার বিষয় নয়?
আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হােল, সম্রাট আকবর প্রত্যেক অমুসলমানকেও যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বা যুদ্ধে যােগদানের জন্য অস্ত্রধারণে বাধ্যতামূলক আইন করেছিলেন। সুতরাং সেখানে জিজিয়া নেওয়া তাে কোনমতেই চলে না। তবুও জগদীশ্বর [?]-তা থেকে বিরত হন নি। তা সত্ত্বেও তিনি এক বিশেষ শ্রেণীর মানুষের কাছে মহামতি বলে পরিচিত। [শট হিঃ ঈশ্বরী প্রসাদ, পৃষ্ঠা ৩৩২]।
সম্রাট আকবর অমুসলমানদের নাকি খুবই বিশ্বাস করতেন। বড় বড় সরকারি লেবেল মারা ঐতিহসিকদের ইতিহাসে তাই দরদী সম্রাট আকবরের এত নাম। প্রকৃত ইতিহাস কিন্তু তা না বলে বরং উল্টোটাই তুলে ধরে।
সম্রাট আকবর-প্রচলিত মনসবদারী ব্যবস্থায় পাঁচ থেকে দশ হাজার অশ্বারােহী সৈন্যের মনসবদারদের মধ্যে অমুসলমানগণ থাকতে পারতেন কিন্তু দশ হাজার হতে পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের মনসবদারিতে কোন হিন্দু বা অমুসলন নিয়ে তিনি মেনে নিতে পারেননি। মানসিংহ ও তােডরমল এত উচ্চ পদের হয়েও মাত্র ৮ হাজার অশ্বারােহী সৈন্য রাখতে পারতেন। দশ থেকে পঞ্চাশ হাজার বা তদুধের মনসবদার হতে পারতেন একমাত্র রাজ পরিবারের লােক। [দ্রঃ আনন্দরাম : মিরাট-ই ইতিলাহ কিমিউজিয়াম পাণ্ডুলিপি, ১৮১৩; আইরভিন ? আর্মি, পৃষ্ঠা ৪]
সম্রাট আকবরের দয়া, মায়া আর কোমলতার অভাব হতে দেননি আমাদের ভারতীয় আধুনিক ঐতিহাসিকদের অনেকে, কিন্তু প্রকৃত তথ্যানুযায়ী তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর। প্রাণদণ্ড প্রাপ্ত আসামীরা কিভাবে পরলােকে যাত্রা করবে তার প্রােগ্রাম সম্রাট আকবর সহজেই রতে পারতেন। আসামীকে হাতির পায়ের তলায় ফেলে এবং শূলে চড়িয়ে মারার মত নিষ্ঠুর বর্বর যুগের শাস্তিও তিনি দিতে পারতেন। এমনকি অপরাধীকে ততক্ষণ দুই হাত দিয়ে গলা টিপে ধরে রাখার আদেশ দিতেন যতক্ষণ না প্রাণবায়ু শেষ হয়। [প্রমাণ : মনসারেটের লেখা, ‘কমেনটারী’ পুস্তকের ২১০পৃষ্ঠা]
সম্রাট আকবর কোন গভর্ণর বা আতালিকের ত্রুটি বা অন্যায়ের সংবাদ পেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তদন্ত না করেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়ে ব্যবস্থা মানে একেবারে পদচ্যুত বা বরখাত [দ্রঃ শরণঃ প্রভিনশিয়াল গভর্নমেন্ট পৃষ্ঠা ১৭৩]। আওরঙ্গজেবের পরিবর্তে বরং সম্রাট আকবর কাউকে বিশ্বাস করতেন না বললে যদিও তা সঠিক হয় না তবুও কিছু প্রমাণ পেশ করা যায়। যেমন,
একটা অঞ্চলে সম্মানীয় একজন গভর্ণরের প্রতি সম্রাট আকবর পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে না পেরে অনেক ক্ষেত্রে আর একজন গভর্ণর অর্থাৎ যুগ্ম গভর্ণর নিয়ােগ করতেন, অথচ মােটেই তার প্রয়ােজন ছিল না। কাজের চাপ বেশি থাকলে তার অধীনে সহকারী রূপে আরও কর্মী রাখা যেতে পারতাে, যুগ্মভাবে রাখার প্রয়ােজনীয়তা ছিল না। তাছাড়া কোন একটামাত্ৰ ক্ষেত্রে যদি সম্রাট আকবর যুগ্ম গভর্ণর নিয়ােগ করতেন তাহলে হয়তাে তা প্রসঙ্গ হয়ে উঠতাে না। কিন্তু সন্দেহ প্রবণতার জন্য তিনি অনেক ক্ষেত্রেই এই ব্যবস্থা প্রয়ােগ করেছিলেন। নিয়ােজিত যুগ্ন গভর্ণরদের তালিকা সম্রাট আকবরের বিশ্বাসী ঐতিহাসিক আবুল ফজল তব ‘সম্রাট আকবর নামা’র তৃতীয় বরে ৫১১ পৃষ্ঠায় লিখে গেছেন।
গভর্ণরগণ যাতে বেশি প্রভাব বিস্তার না করতে পারে বা যাতে বিদ্রোহী হয়ে না ওঠেন সেই সন্দেহে প্রত্যেককে তিনি ঘন ঘন বদলি করতেন। তার কারণ কী ছিল? তা কি অবিশ্বাসহেতু নয়? কিন্তু যেহেতু সম্রাট আকবর করেছেন সেহেতু মন্তব্যের অনধিকার অনস্বীকার্য। মানসিংহের মত প্রভাবশালী কর্মকর্তাকেও গুপ্তচরের সামান্য সংবাদের উপর ভিত্তি করে, তদন্ত করেই কাবুল থেকে জোর তলবে দিল্লি ফিরে আসতে বাধ্য করেছিলেন [সম্রাট আকবর নামা, ৩খণ্ড, পৃ. ৫১৭-৫১৮]। এমনি ভাবে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানকেও রাজস্বের অপব্যয়ের অভিযােগ শুনে রাজদরবারে তৎক্ষণাৎ হাজিরা দিতে বাধ্য করেছিলেন। [দ্রঃ রিয়াজুস সালাতিন, পৃষ্ঠা ২২২-২২৩]
সাম্রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রেও সম্রাট আকবরের দূরদর্শিতার যথেষ্ট মজার ছিল। ভারতবর্ষের তিন দিকে শুধু জল আর জল। জলপথের যে কোন দিক থেকে আক্রমণ সম্ভব ছিল। তাছাড়া প্রায়ই দেখা গেছে বিদেশীদের আগমন জলপথেই হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতবর্ষের জন্য বিশাল ও শক্তিশালী এক নৌবহরের যে প্রয়ােজন ছিল সে বিষয়ে সম্রাট আকবরের বুদ্ধিজ্ঞান একটুও উঁকি মারেনি। এই অদূরদর্শিতাকে অধ্যাপক আবদুল আলীম এম. এ. শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকে ‘শিথিল সংগঠন’ বলে উদ্ধৃত করেছেন। অবশ্য তিনি তথ্য সরবরাহ করেছে হুসাইনির লেখা ‘মুঘল এ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ পুস্তকের ২৬৮ পৃষ্ঠা থেকে।
ইংরেজের অত্যাচার মনে পড়লে আজও বুক কেঁপে ওঠে। মনে পড়ে কত শােষন, পীড়ন, প্রহার আর কোটি কোটি মানুষের ইতিকথা। সেই ইংরেজকে সম্রাট আকবরই দিয়েছিলেন ভারতবর্ষে বুক ফুলিয়ে ব্যবসা করার অধিকার। যা তারা আগেও সীমিতভাবে পেয়েছিল। শুধু তাই নয় কুঠী বানাবার অধিকার, রাজদরবারে ও সর্বত্র খৃষ্টানধর্ম প্রচারের অধিকার। আর যেখানে ইচ্ছা বসবাস ও গীর্জা নির্মাণ করার অধিকার-এর প্রমাণ রয়েছে খৃষ্টান ধর্ম প্রচারক মনসারেটের লেখা ‘কমেন্টারী’ পুস্তকের ৪৭ পৃষ্ঠায়।
মােগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ মূলত ইউরােপীয় জাতির আগমন। সেহেতু বলা যায়, ভারতে ইংরেজ তথা ইউরােপীয় জাতির আগমনের বীজ বপন করে গেছেন সম্রাট আকবর, আর জাহাঙ্গীর সেই বীজের চারাগুলােকে শক্তিশালী করতে যথার্থ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এখন যদি এই কথাটুকু প্রমাণ হয় তাহলে সম্রাট আকবরকে ভারতবাসী ক্ষমা করে মহামতি বলে মেনে নেবেন কি না তা পাঠকবৃন্দের দায়িত্বে।
খৃষ্টান ও হিন্দু মহিলাদের বিয়ে করা এবং তাদের স্ব স্ব ধর্ম পালন, প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে সহযােগিতা ও পূর্ণ অধিকার দান সম্রাট আকবরের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অবশ্য এটা উদারতা বটে কিনা তা প্রত্যেক ঐতিহাসিক ও ইতিহাস অনুরাগীর চিন্তার বিষয়।
এই বিয়েকে কেন্দ্র করেই ইংরেজ জাতি ভারতবর্ষে রাজ্য বিস্তারের পথ সুগম করে। তাছাড়া রাজদরবারে মদ্যপানের আমন্ত্রণ ইংরেজ রাজনীতিবিদগণ প্রায়ই পেতেন। মােগল সাম্রাজ্যের সমাধি রচনার কাজ সম্রাট আকবর শুরু করেন এবং মদ্যপ পুত্র জাহাঙ্গীর স্যার টমাস রাে ও তাঁর মূল পুরােহিত, অক্সফোর্ড শিক্ষাপ্রাপ্ত, চতুর কূটনীতিবিদ রেভারেন্ড ফেবীকে অতি মাত্রায় প্রশ্রয় দান করে সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করেন। সম্রাট আকবরের সময়ই ইংরেজরা নিজেদের সুরাট বন্দরে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিন বৎসর ক্রমাগত মােগল দরবারে তদবির করে স্যার টমাস রাে জাহাঙ্গীরের নিকট হতে তার সকল দাবী দাওয়া মঞ্জুর করিয়ে নিতে সক্ষম হন। ইংরেজরা অবশ্য কাজ গােছানাের তাগিদে মদ খেতেন আর সম্রাট আকবর ও তাঁর পুত্রগণ শুধু মদ খেতেন বলা ঠিক হবে না বরং বলা যায়, মদই তাদের খেত।
খৃষ্টানদের মুখে তাদের বীরত্ব গাথা শুনে এবং কিছু প্রত্যক্ষ করে সম্রাট আকবর জাহাঙ্গীর ইংরেজদের উপর ভীত হয়ে পড়েছিলেন। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, ইংরেজরা সুরা ও সুন্দরী রমণী দিয়ে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন বা পরাস্ত করে দিয়েছিলেন পিতা পুত্রের চেতনাকে। সে যাইহােক, তারা ধীরে ধীরে খৃষ্টান ধর্মের প্রতি সশ্রদ্ধ আনুগত্য প্রকাশ করে চললেন এবং দেশের ভিতরে ইউরােপীয় ঘাঁটি তৈরি করতে অনুমতি ও সাহায্য দিলান। আর তার ফলস্বরূপ আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে উদীয়মান ইউরােপীয় শক্তি প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে মােগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। সুতরাং মােগল সাম্রাজ্যের পতন: তথা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সূর্য অন্তমিত হওয়ার জন্য দায়ী আওরঙ্গজেব নন, দায়ী মূলত সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীর।
এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক প্রিঙ্গল কেনেড়ি আর ‘The History of Mughals’ গ্রন্থে যা বলেছে তার অর্থ হােল-সম্রাট আকবরের গঠিত সাম্রাজ্যের দুর্বলতা তার সামরিক নীতির মধ্যেই নিহিত ছিল। তিনি উত্তর পশ্চিম পার্বত্য অঞ্চলের ওপার হতে সতেজ ও সবল সৈন্য আমদানী বন্ধ করে এবং ভারত ভারতীয়দের জন্য নীতির অনুসরণ করে তার সাম্রাজ্যের পতনের জন্য পরােক্ষ ভাবে দায়ী হয়েছেন। তার গঠিত সাম্রাজ্য যখন বিজাতীয় প্রতিকুল শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল তখন তার আর আত্মরক্ষা করার শক্তি ছিল না।
এমনিভাবে বহু উদ্ধৃতির মধ্যে আর একটির উল্লেখ করে বলা যায়, ‘…শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শেকোহ সম্রাট হলে খুব সম্ভবতঃ অতি সত্বর অবস্থান্তর বা পতন ঘটত। মােঘল সাম্রাজ্যের এই পতন স্থগিত রাখতে কৃতকার্য হয়েছিলেন ইসলামীয় তৃণীয়ের শেষ তীর আলমগীর বা আওরঙ্গজেব। দারা ছিলেন সম্রাট আকবরের মত বিজাতীয় ভাবাপন্ন। বলা বাহুল্য, সম্রাট আকবরই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের বীজ বপন করেন। ইসলাম অনুরাগী মােহিউদ্দিন আলমগীর আওরঙ্গজেব বিজাতীয় প্রভাব ও দুর্নীতিসমূহ হতে সাম্রাজ্যকে সংস্কার ও সংশােধন করবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। এই জন্য তিনি কারও সন্তোষ বা অসন্তোষ কিছু মাত্র গ্রাহ্য করেননি। তার চেষ্টা অনেকটা ফলবতী হয়েছিল বলেই ভারতে ইসলাম এবং জাতি হিসাবে মুসলমান এখনও টিকে আছে বা বেঁচে আছে। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এরূপ অসাধারণ শক্তিশালী আদর্শ চরিত্রের কোন ব্যক্তি আর দিল্লির সিংহাসনে আরােহণ করেন নি।” [হবিবর রহমান প্রণীত ‘আলমগীর’ দ্রষ্টব্য]
অতএব এত দীর্ঘ আলােচনার পর একথা ভুললে চলবে না যে, আধুনিক সহজলভ্য ইতিহাসে যা আছে তাই-ই অমৃতের ধারা নয়। প্রকৃত ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং যুক্তি বা সত্যের মাপকাঠিতে যা গ্রহণযােগ্য তা অবশ্যই গ্রহণীয়, বাকীটুকু পরিত্যাজ্য বা পরিহার্য।
সম্রাট আকবরের বিদায় পর্ব
বিশ্বের ইতিহাসে যােড়শ শতাব্দীতে ধর্মীয় আন্দোলন ও আলােড়ন শুরু হয়েছিল। ভারতবর্ষে কবীর, নানক, শ্রীচৈতন্য প্রভৃতি মহাপুরুষগণ নানা ধর্মমত সৃষ্টি করে নানা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করলেন। তেমনি মাহদী আন্দোলন জনসাধারণের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। প্রতি হাজার বছরের শেষ ভাগে ধর্মভোলা মানুষকে উদ্ধারের জন্য একজন মসিহ পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন-এই ছিল মাহদীপন্থীদের বিশ্বাস। আফগানিস্থানেও অনুরূপ ‘রাসনী’ আন্দোলন শুরু হয়। তাদের ধ্যানধারণাও অনুরূপ ছিল।
১৫৭৫ খৃষ্টাব্দে পারস্যের শাহ আততায়ীর দ্বারা নিহত হলেন। পাকা ইরানে তখন একটা ‘মােলহেদ’ নামক ইসলাম বিধ্বংসী দল তৈরি হয়েছিল। পারস্যের নতুন শাহ সিংহাসনে বসেই চিন্তা করে দেখলেন, এই কুৎসিত নােরা দলটি অদূর ভবিষ্যতে সুন্দর স্বচ্ছ ইসলাম ধর্মের কলঙ্কের কারণ হতে পারে। তাই এ ‘মােলহেদ’দকে নিষিদ্ধ করেন এবং তাদের বন্দী করার আদেশ দেন। কাস্পিয়ান সাগরের উপকূলে তাদের প্রধান ঘাঁটি ছিল। ঐ ঘাঁটি পারস্যের শাহ আক্রমণ করলে তারা দলে দলে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। সম্রাট সম্রাট আকবরের সঙ্গে তাদের দলনেতারা দেখা করে নিজেদের মত ও পথে কথা বলতে গিয়ে বলে, আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, প্রত্যেক যুগে যুগে নবী আসবেন। হজরত মহম্মদের পর আর কেউ নবী আসবেন না বটে, কিন্তু ইমাম মেহদীর আগমনের কিতাবে আছে। তাছাড়া প্রতি হাজার বছর অল্প একজন মােজাদ্দেদ বা সার্বজনীন ধর্ম বিশারদ আবির্ভূত হন। এখন আরবী হিজরী সালের সেই হাজার বছর পূরণের যুগ। আমরা জানতে পেরেছি এই যুগসন্ধিক্ষণে আপনিই সেই ইমাম মেহেদী ধ্বং ধর্ম প্রচারক। অতএব অপনি এগিয়ে আসুন, পালন করুন আপনার পবিত্র দায়িত্ব। সম্রাট আকবর এই রকমই একটা সুযােগের প্রতীক্ষায় ছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী সম্রাট আকবর তাঁর রাজনীতির ভাল অঙ্গ হিসাবে এবং ধর্মজগতে অমর হওয়ার বাসনায় ঐ দলের নেতাদের নিজের উপদেষ্ট হিসাবে গ্রহণ করলেন। [দ্রঃ হিস্ট্রি অব ন্যাশনালিজম, পৃষ্ঠা ৩১)
কপট সুফী ভ্রাতৃদ্ধয় ফৈজী ও আবুল ফজল এবং তাঁদের পিতার সঙ্গে সম্রাট আকবরের সান্নিধ্য লাভের ফলে সম্রাট আকবরের ধর্মজীন বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়। তাঁরা সম্রাট আকবরকে দর্শন ও ধর্মীয় আলােচনার জন্য ফতেপুর সিক্রিতে এবাদতখানা নির্মাণ করতে উৎসাহ দেন। পরে সম্রাট বিভিন্ন ধর্মাবলখী পণ্ডিতদের তার এবাদতখানায় আ জানাতে শুরু করলেন। ১৫৮০ খৃষ্টাব্দে আকুয়াডিভ ও মনসারেটের জেসুইট মিশনকে (খৃষ্টান মিশন] সম্রাট আকবর তার সভায় সাদরে গ্রহণ করলেন। তিনি জোরােষ্ট্রিয় ও জৈন ধর্মের পণ্ডিতদের সভায় স্থান দিয়েছিলেন। আর হিন্দু পণ্ডিতগণ তাে সভায় ছিলেনই।
ধর্ম বিষয়ক পরামর্শ দাতা ছিলেন আবুল ফজলের পিতা শেখ মুবারক। তিনি বিষয়ে সম্রাট আকবরের মনােরঞ্জনের উপায় উদ্ভাবন করতেন বলে সম্রাট আকবর তাঁকে খুব সমীহ করতেন। শেখ মুবারক নানা যুক্তি তর্কের অবতারণা করে সম্রাট আকবরকে প্রমাণ করে দিলেন যে, উলামাগণ ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করেন। অপরাপর ধর্মের মধ্যেও কিছু ভুল বােঝাবুঝি আছে। যার ফলে বিদ্বেষ, একঘেঁয়ে গোঁড়ামি এবং সম্প্রদায়গত আক্রমণের ভাব পরিলক্ষিত হয়।
নিরক্ষর সম্রাট আকবরের ধর্ম প্রবণতা নতুন খাতে বইতে চাইল। সাম্রাজ্যলিপ্স্যু উচ্চাভিলাষী সম্রাট আকবরের পূর্ব বর্ণিত পার্সী ধর্মগুরুর আশ্চর্য প্রভাব দেখা যেতে লাগল। এই সময়ই শেখ মুবারক তাঁকে পরামর্শ দিলেন, যেহেতু তিনি রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা, সেহেতু তিনি ধর্মনেতাও হতে পারেন। ধর্মগুরু হওয়ার এই পরামর্শে সম্রাট আকবর বিশেষভাবে আকৃষ্ট হলেন।
ওদিকে দরবারের পণ্ডিত ও সভাসদগণ শঠে শঠ্যং নীতি গ্রহণ করেন। তারা সম্রাটকে আল্লার আসনে বসিয়ে দিল্লিশ্বর বা ‘জগদীশর’ এর আওয়াজে ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত মুখরিত করে তুলে তাঁর প্রতি কৃত্রিম আনুগত্য প্রকাশ করতে লাগলেন। সেই উদ্দেশ্যে ১৫৭৭ খৃষ্টাব্দে এক হিন্দু কবি রচনা করলেন-
হেথা এক দেশ আছে নামে পঞ্চগৌড়।
সেখানে রাজত্ব করেন বাদশাহ সম্রাট আকবর।
অর্জুনের অবতার তিনি মহামতি।
বীরত্বে তুলনাহীন জ্ঞানে বৃহস্পতি।
ত্রেতা যুগে রাম হেন অতি সযতনে।
এই কলি যুগে দুখ পালে প্রজাগণে।
[দ্রঃ চণ্ডী, মাধবাচার্য বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, পৃষ্ঠা ৩৭২]
পণ্ডিতগণের এ ধরনের চাটুকারিতা আর সে যুগের কিছু স্বার্থান্বেষী মৌলবিদের অন্তৰ্বিবাদ ও মতভেদ তার ভাবান্তর বা ইসলাম ধর্মের প্রতি অবহেলার অন্যতম কারণ ছিল। দরবারে সম্রাট আকবরের পাশে কে বেশি নিকটবর্তী হয়ে বসবেন তাই নিয়ে বিবাদ হওয়াতেও সম্রাট আকবরের ভাবান্তর হয়। তবে সম্রাট আকবরের উৎসাহ ও পরামর্শদাতারা তাকে বিশেষভাবে নতুন ধর্ম সৃষ্টিতে উৎসাহিত করলেও তেমন কেউ পরবর্তী কালে নতুন ধর্মে দীক্ষিত হননি। বলা বাহুল্য, ইসলাম ধর্মের সর্বনাশ সাধন যাদের উদ্দেশ্য ছিল তারা কেবলমাত্র ঐ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য কপট আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন।
ধর্মগুরু হওয়ার পথে সম্রাট আকবর ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চললেন। ১৫৭৯ খৃষ্টাব্দে ফতেপুর সিক্রীর প্রধান মসজিদে সম্রাট আকবর তার বিশেষ দালাল দলকে উলামা সাজিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। পরে নিজে মসজিদের গেটে সাড়ম্বরে উপস্থিত হন। তার পূর্বে ঐ মসজিদকে জমকালাে করে সাজানো হয়েছিল। এবার যখনই সম্রাট আকবর সেখানে উপস্থিত হলেন অমনি সেই নকল-উলামা আর বহুরূপী সভাসদগণ নামাজ ত্যাগ করে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে তাকে মসজিদের অভ্যন্তরে মিম্বরে বসালেন।
হজমত মুহাম্মাদের সময় থেকে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পূর্বে যে আরবী বক্তৃতা হােত তা বাতিল করে সম্রাট আকবরের গুণগান সম্বলিত কবিতা পাঠ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই কবিতার রচয়িতা ছিলেন ফৈজী। ঠিক হয়েছিল যে, সম্রাট আকবর নিজে সেটা পাঠ করে শোনাবেন বিরাট জনতাকে আর সকলে সরে ‘আল্লাহু সম্রাট আকবর’ [সম্রাট আকবরই আল্লাহ] বলে সাবাস দেকেন এবং সেই সঙ্গে আর তার নতুন ‘দীন-ই-ইলাহি’ ধর্মে দীক্ষিত হতে আদেশ দেন।
আর ফৈজীর লেখা নিজ গুণগান সম্বলিত কবিতা হাতে নিয়ে দণ্ডায়মান হলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক নাটকীয় ঘটনা এই যে, মাত্র তিন লাইন কবিতা আবৃত্তি করেই সম্রাট আকবর চোখে যেন কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার দেখতে লাগলেন। তবু মনকে চাঙ্গা করে আবৃত্তি করতে লাগলেন, কিন্তু পারলেন না। তিনি যেন নিজ কানে শুনতে পাচ্ছিলেন নিজের বুকের স্পন্দন। হৃদকম্পনের কারণে তার একটি হাত বুকে বােলাতে লাগলেন। একটার পর একটা উপসর্গ দেখা দিতে লাগল। প্রথমে চােখ বিদ্রোহ করল, তারপর কণ্ঠস্বর বিদ্রোহী হয়ে উঠল। শেষে তাকে মিম্বারের উচু ধাপ থেকে নচে নেমে আসতে হােল। সকলেই হতবাক। সমস্ত প্রোগ্রাম পণ্ড। শেষে কোনরকমে বললেন, ‘জোর করে নয়, ইচ্ছা করলে যে কেউ এই মত ধর্ম দীন-ই-ইলাহি গ্রহণ করতে পারে’।
এক ইংরেজ ঐতিহাসিক সম্রাট আকবরের হৃদকম্প আর মিম্বার থেকে নীচে অবতরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে লিখেছেন,
“কিন্তু এই ঘটনায় যে ভাবাবেগের সঞ্চার হইল, তাহা যে দৃঢ়চিত্ত, প্রবল শত্রুর মােকাবেলায়ও কখনও বিচলিত হয় নাই তাহাকে অভিভূত করিয়াছিল। যে হৃদয় সকল বিপদে শান্ত থাকিত এখন তাহা দ্রুত স্পন্দিত হইতে লাগিল। যে কণ্ঠস্বর যুদ্ধের তুমুল হট্টনিনাদ ছাপাইয়াও উর্ধ্বে শ্রুত হইত এক্ষণে বালিকার কণ্ঠের ন্যায়ই তাহা ভাঙ্গিয়া পড়িল। প্রথম তিন ছত্রের উচ্চারণ সমাপ্ত করার পূর্বেই এই সম্রাট [নকল] নবীকে সেই উচ্চ মঞ্চ হইতে নামিয়া আসিতে হইল।” [অনুবাদ টার্কস্ ইন ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা ৬৯]
সম্রাট আকবর ১৫৮৭ সালে কাজী বা মুফতির বিচার ব্যবস্থার বিলােপ সাধন করে তার পরিবর্তে তিনি নতুন আইন, সােজা কথায় খিচুড়ি আইনের বর্তন করেন। এই ঘটনায় স্বভাবতই অমুসলমান অনেকে সম্রাট আকবরের প্রতি শ্রদ্ধাবান হতে পারেন। তবে আর যদি পুরাে হিন্দু হয়ে যেতেন তাহলে এই মারাত্মক অভিযােগ থেকে তিনি বাঁচতে পারতেন। কিন্তু তিনি হিন্দুও হননি আবার তাকে পুরােপুরি মুসলমান বলাও কঠিন। উপরন্তু দেখা যায় তিনি ভিতরে মুসলমান হয়ে তওবা করে অনুতাপ ও অনুশােচনা করে নিজের জীবনে সহস্র সহস্র ধিক্কার দিয়ে প্রাণত্যাগ করেন! তাহলে তিনি হিন্দু মুসলমান উভয় জাতির সঙ্গেই সমানভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করে গেছেন বলে মনে হয়। হিন্দুদের খুশি করতে যত রকম ব্যবস্থা আছে তা তিনি করেছিলেন-আজ তা প্রমাণ হতে চলেছে। কিন্তু আসলে তার মধ্যে কোন আন্তরিকতা ছিল না, মৌখিক ছিল সবই। তার রাজনৈতিক চালাকিকে নিছক উদারতার অভিনয় ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না।
১৫৮৮ খৃষ্টাব্দে রাজা ভগবান দাসের ভাগ্না, দত্তক পুত্র এবং উত্তরাধিকারী মানসিংহকে সম্রাট আকবর তাঁর নতুন ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করতে অনুরােধ বা আদেশ করেছিলেন। কিন্তু তিনি যা জবাব দিয়েছিলেন তা চমকপ্রদ ও উল্লেখ্যযােগ্য। মানসিংহ বলেছিলেন,
“যদি জীবন উৎসর্গ করার সংকল্পই হয় মহামান্য সম্রাটের মতবাদ গ্রহণের একমাত্র অর্থ, তাহা হইলে আমার ধারণা, আমি যে সম্রাটের একজন বিশ্বস্ত অনুসারী তাহার প্রমাণ আমি যথেষ্টই দিয়াছি। কিন্তু আমি একজন হিন্দু, সম্রাট আমাকে মুসলমান হইতে বলিতেছে না। আমি তৃতীয় কোন ধর্মের কথা অবগত নহি।”
নবরত্নের অন্যতম সদস্য রাজা তােডরমলও সম্রাট আকবরের ধর্ম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং তিনি ১৫৯০ খৃষ্টাব্দে হিন্দু অবস্থাতেই পরলােকগমন করেন।
সম্রাট আকবরের একান্ত অনুগত বীরবল ও অন্যান্য ১৭ জন ছাড়া আর কেউ ‘দীন-ই-ইলাহি’ ধর্ম গ্রহণ করতে সম্মত হননি। তাছাড়া এই ১৮ জনও কেবল উঁচু রাজপদ ও অর্থের লােভে ঐ নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এখানেও সম্রাট আকবরের সবচেয়ে লজ্জাকর পরাজয়। কারণ, একজন সহায় সম্বলহীন ফকির দরবেশও মৃত্যুর পূর্বে শত সহস্র মুরিদ বা শিষ্য রেখে যেতে পারেন, অথচ সম্রাট আকবর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বা জগদীশ্বর [?] হয়েও মাত্র ১৮ জন শিষ্য পেয়েছিলেন। শিষ্যের এই সীমাবদ্ধতা তার পরাজয় ও অসাফল্য প্রমাণ করে। যাইহোক, সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর সম্রাট আকবর অদৃশ্য হন বটে, কিন্তু তার রােপিত বিষবৃক্ষ ভারতের বুকে ঐস্লামিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির উপর দারুণভাবে আঘাত হানে। ‘দীন-ই-লাহি’ সম্পর্কে বিখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ স্মিথ বলেন,
“এই ধর্মবিশ্বাস ছিল হাস্যকর আভিজাত্য এবং অসংযত স্বৈরাচারের স্বাভাবিক ফল অন্যত্র তিনি আরও বলেছেন, এটা সম্রাট আকবরের ভুলের সৃষ্টি, জ্ঞানের নয়।”
সম্রাট আকবরের কার্যকলাপ ও চরিত্র সম্বন্ধে আলােচনা যদিও হয়েছে তবুও এখানে আরও কিছু মূল্যবান তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে।
আজও ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে খামের উপর ৭৪৷৷ লেখেন। এর অর্থ হচ্ছে অত্যাচারী মুসলমানেরা নাকি এত হিন্দু ব্রাহ্মণ হত্যা করেছিলেন যে তাদের পৈতার ওজন হয়েছিল ৭৪৷৷ মন। এখন প্রশ্ন, কে সেই মুসলমান অত্যাচারী? নাম না জানলে হয়তাে মনে হতে পারে আওরঙ্গজেব, হুমায়ুন, শেরশাহ, বাবর প্রভৃতি রাজা বাদশাহ কেউ, না হয় নাদির অথবা মুহাম্মদ বিন কাসিম। কিন্তু যদি বলা হয়: সম্রাট আকবর—তাহলে হয়তাে অনেকে চমকে উঠতে পারেন। তাই শ্রীবেনু গলােপাধ্যায়ের চিতােরগড়ের কথা থেকে কয়েক লাইল তুলে দিচ্ছি—
“সাড়ে চুয়াত্তর কথাটা শুনেছ নিশ্চয়? কথাটার ব্যবহার কেন হয়েছিল জান? চিঠি লিখে খামের পিছনে সাড়ে চুয়াত্তর লেখা হয় কেননা যাতে করে খামটা কেহ না খােলে। যদি খােলে পাপের ভাগী হবে। গল্পটা ইতিহাসের। সম্রাট আকবর বাদশাহ কুম দিলেন যুদ্ধে যত লােক মরেছে তাদের পৈতৃগুলো ওজন করতে। তাই করা হােল। দেখা গেল ওজন হয়েছে সাড়ে চুয়াত্তর মন৷ যদি পৈতার ওজন সাড়ে চুয়াত্তর মণ হয়, তাহলে অনুমান কর কত হাজার লােক মরেছিল যুদ্ধে। গল্পটা আজ হয়ত ঠিক বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না, তবে ঘটনাটি ঘটেছিল চিতােরে।”
তবুও তাকে মহামতি বলতে হবে যত হত্যাই তিনি করুন না কেন। যদিও তিনি অসংখ্য ব্রাহ্মণ হত্যাকারী তবুও তাে তিনি ইসলামের শত্রুতা করেছিলেন। অবশ্য তাকে মহামতি বানালে অন্ততঃ মুসলমান বুদ্ধিজীবিরা সম্রাট আকবরের মত হিন্দু ভাবাপন্ন হয়ে যাতে ‘উদার’ উপাধি পান সেই রাস্তা পরিষ্কার হবে। ইংরেজদের ইনজেকশন সত্যিই সাংঘাতিক।
দাবা খেলা আজও প্রচলিত আছে। দাবা খেলায় মানুষ খুঁটি ব্যবহার করে। কারও খুঁটি কাঠের, কারও হাড়ের, কারও বা হাতির দাঁতের, কারও রূপাের, আবার কেউ ব্যবহার করেন সােনার খুঁটি। সম্রাট আকবরও দাবা খেলতেন, তার খুঁটি হয়তাে সােনার কিংবা মূল্যবান পাথরের হবে বলে সাধারণের ধারণা। কিন্তু আগেই বলেছি তাঁর চরিত্র বিকৃতি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গিয়েছিল, সম্রাট আকবরের দাবা খেলার খুঁটি ছিল জড় পদার্থ নয়, জীবন্ত সােড়শী যুবতী সুন্দরী নারী। সেই নারী নিয়ে হার জিত হােত আর জিতে নেওয়া নারীদের ব্যবহার করা হােত আনন্দের সামগ্রী স্বরূপ। শ্রীগঙ্গোপাধ্যায়ও লিখেছেন,
“সুন্দরী সুবেশা তরুণীদের দাঁড় করিয়ে ছক কাটা ঘরে পাশা খেলতেন সম্রাট আকবর।”
সম্রাট আকবরের কাছে বিবাহ আর ব্যভিচারের মধ্যে পার্থক্য ছিল না। কোন কোন পণ্ডিতও বলেছেন, বিকানীরের রাজকন্যাকে সম্রাট আকবর বিয়ে করেছিলেন আবার ভারই সঙ্গে খৃষ্টানদের অবাধ মেলামেশা করার ক্ষেত্রে আকারের যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। তারই গর্ভে একটি সুন্দর সুস্থ সন্তান জগেছিল, সম্রাট আকবর সেই নবজাতকের নাম তার মদ্যপানের সাথী মিঃ দানিয়েলের নাম অনুসারে রেখেছিলেন, দানিয়েল। [দ্রঃ “দুর্গেদুর্গে”] ২০১১ ।
ইসলাম ধর্মে ভাগ্য গণনা বা হাত গণনা ইত্যাদি বিশ্বাস করা মারাত্মক অপরাধ। সম্রাট আকবর ইসলামের প্রতি সেখানেও আঘাত হেনেছেন। সম্রাট আকবর হিন্দু জ্যোতিষীকে বসিয়ে রাখলে তার দরবারের চত্বরে এবং তিনি যা বলনে সম্রাট আকবর তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেনে নিতেন। যুদ্ধযাত্রা, প্রমােদ ভ্রমণ, প্রাসাদ নির্মাণ প্রভৃতি কাজে জ্যোতিষীর রায় গৃহীত হােত। তবে অনেক মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে ‘দীন-ই-ইলাহি’র সর্বজনপ্রিয়তার কথাও মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু যেহেতু সম্রাট আকবর তাকে বহুদিন ধরে ভক্তি করে এসেছেন তাই তখন ভক্তি করতে ইচ্ছা না হলেও অনেককে খুশি রাখতে মৌনতা পালন করা ছাড়া উপায় ছিল না।
ইসলামের নামে অসভ্যতা, অনাচার, ইসলাম-ধ্বংসী কাজ, শিরক-বিদআত, বাউল-আউল, মিথ্যা মারেফতি ও অসভ্য মিথ্যাবাদী ফকির দলের নােরামির উৎস সম্রাট আকবরের উৎসাহ এবং তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সমর্থন। পরবর্তীকালে আওরঙ্গজেব অনেক বর্বরতা দূর করেছিলেন। কিন্তু আগাছা চাষ করার প্রয়ােজন হয় না, সার দেওয়ারও প্রয়ােজন হয় না, এমনিই গজিয়ে ওঠে তাই আজ এই আধুনিক যুগেও মাথা উচু করে গজিয়েছে বহু আগাছা ও বিষবৃক্ষ।
সম্রাট আকবর কিন্তু মৃত্যুর পূর্বাহ্নে তার অভিনয়ের মুখােস খুলে ফেলেছিলেন। দীর্ঘ ৪৯ বছর রাজত্ব করার পর ১৬০৫ খৃষ্টাব্দে অজস্র স্ত্রীকে বিধবা করে পরলােকগমন করেন। সম্রাট আকবরের শেষ দশ বছরের ইতিহাস ভাল ভাবে পাওয়া যায় না। কারণ তার মৃত্যুর দশ বছর আগে বিখ্যাত ঐতিহাসিক বাদাউনীর মৃত্যু হয়। অপর একজন ঐতিহাসিক আবুল ফজলও সম্রাট আকবরের মৃত্যুর বার বছর পূর্বেই নিহত হন। যাইহােক, হিজরী ৯৯৯ সালে সম্রাট আকবর দেখলেন মাত্র আর একবছর বাকি ১০০০ হিজরী সন পূর্ণ হতে, অথচ তিনি নতুন নবী বলে খ্যাতি লাভ করতে পারলেন না, ইমাম মাহদী ও মসীহ রূপে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করতেও পারলেন না। তিনি ১০০০ হিজরী সনে বেশ বুঝতে পারলেন যে, তাঁর সমস্ত স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই নয় বরং জাগরিত অবস্থায় দুঃস্বপ্ন দর্শন মাত্র। তাই মিঃ কীসিও বলেছেন-পরের বছরটা ছিল হিজরীর ৯৯৯ সাল। এবং তার পরেই এল ১০০০ হিজরী সাল। এক সহস্র বছরের যে ধােকা ব্যাপক ভাবে পােষণ করা হয়েছিল তার সমাধি রচিত হল ঐ ১০০০ হিজরী সালেই। [দ্রঃ টার্কস্ ইন ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা ৭২]
সম্রাট আকবরের মৃতদেহ কিন্তু দাহ বা নদীর বক্ষে নিক্ষেপ অথবা পশ্চিম দিকে পা রেখেও কবরস্থ করা হয়নি, সমাধি হয়েছিল সাধারণ মুসলমানের মতই। তবে বড় পবিতাগ ও অবাক হওয়ার কথা হােল, যে অমুসলমানদের জন্য তার এত কাণ্ড এত পরিকল্পনা তাই সম্রাট আকবরের কবর খুঁড়ে অস্থিলােক পর্যন্ত যতদূর সম্ভব অপবিত্র করে তুলে ফেলে দিয়েছিলেন।
সম্রাট আকবর সম্বন্ধে আলােচনা আর বেশি নিষ্প্রয়ােজন। দীর্ঘ আলােচনার পর কী সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া উচিত তা সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তার বিষয়। তবে সব শেষে এটুকু বলে রাখা ও মনে রাখা ভাল যে, সম্রাট আকবরের হঠকারিতা, নিষ্ঠুরতা, স্ত্রী-লােলুপতা, শঠত এভদ্যপানের অভিযােগের বিরাট বােঝাটি ঐতিহাসিকরা তাঁর মাথা থেকে বহু টানাটানি করে নামিয় সেটাকে মুসলমান সুলতান, সম্রাট ও শাসকদের মধ্যে সমানভাবে পরিবেশন করে দিচ্ছেন। তারই এক একটি ভাগ পেয়েছেন সুলতান মাহমুদ, মুহাম্মাদ বিন তুঘলক, সম্রাট বাবর হুমায়ুন, আওরঙ্গজেব প্রভৃতি রাষ্ট্রনায়কেরা।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।