লিখেছেনঃ চৌধুরী আতিকুর রহমান
যতই অন্ধকার যুগ বলা হোক, সাধারণ জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মধ্যযুগের ভারত কোন অংশে কম ছিল না। এই সময়ে বা তার পূর্বে দীর্ঘ হুন আক্রমণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের উত্থান হয়েছিল। আবার দ্বাদশ শতকে মুসলিমরা ভারতে রাজ্যবিস্তার করে। হুন ও বর্বর উত্তর ইউরোপীয় জার্মানদের আক্রমণ রোমক সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করার পর ইউরোপে মধ্যযুগ শুরু হয়েছিল বলে ধরা হয়। ভারতেও প্রায় একই সময়ে হুনদের অপর অংশ আক্রমণ করে এবং জার্মানদের মত আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদও ব্যাপক রক্তপাতের মাধ্যমে বৌদ্ধ ও জৈন সতবাদকে হটাতে থাকে। যদিও তাদের ধ্বংসলীলা ইউরোপীয় হুনদের মত ততটা ব্যাপক ছিল না, তবুও আমি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতককেই ধরব ধরব ভারতের মধ্যযুগের প্রারম্ভিক বছর বলে। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব মধ্যযুগের প্রারম্ভিক বছর হিসাবে ধরেন ৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত; প্রাক সুলতানি যুগ, ১২০০ থেকে ১৫০০ সুলতানি ও ১৫০০ থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত মোগল আমল হিসাবে। তাঁর মতে, ভারতে প্রথম ইতিহাসচর্চা সুরু হয় নবম শতকে লিখিত আরব কতৃক সিন্ধু দখলের (৭১২ খ্রি.) বর্ণনা দিয়ে যা ‘চাচনামা’ নামে ত্রয়োদশ শতকে ফারসিতে অনূদিত হয়। এরপর মিনহাজ ই সিরাজ জুরজানি লিখিত ‘তবাকৎ ই নাসিরি’ হল উল্লেখযোগ্য ইতিহাস বই।
আরব ও তুর্ক-আফগানি শাসনে বিজ্ঞানচর্চা- বিশ্বের দরবারে ভারতের সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট দান হল সংখ্যাতত্ত্ব। তখন ‘0’ কে বিন্দু দিয়ে উপস্থাপন করা হত। ৮৭০-৭৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সর্বপ্রথম বিন্দুর পরিবর্তে বৃত্তের ব্যবহার শুরু হয়। ৭১৮ সালে চিনে এই সংখ্যাতত্ত্ব পৌঁছায়। আল খোয়ারিজমি নবম শতকে আরবে প্রচলিত করেন যা ইউরোপে আরবি অঙ্কগুলি সহ দ্বাদশ শতকে পৌঁছায়। বীজগাণিতিক চিহ্নসহ ‘0’, অজানা ও ঋণাত্মক সংখ্যা বাকশালি পান্ডুলিপিতে সপ্তম শতকেই দেখা গেছে। শূণ্য আবিষ্কারের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য ঠিক ততটা অকৃতজ্ঞতা ও মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়নি। তারা শূণ্য ও আনুষঙ্গিক সংখ্যাতত্ত্বকে ইন্দো-আরবীয় সংখ্যাতত্ত্ব নামেই স্বীকৃতি দিতে দ্বিধাবোধ করে না। গুজরাতের মানকিনি প্লেট থেকে প্রথম, প্রায় ৫৯৫-৫৯৬ খ্রিস্টাব্দের খোদাইকৃত ১ থেকে ৯ পর্যন্ত অঙ্ক দেখা গেছে। যদিও প্রাক ইসলামীয় মিশরীয়রা একেবারে ডানদিকে শূণ্য বসিয়ে কোনও সংখ্যা তৈরী করতে পারত না। তবুও দুটি-তিনটি তারও বেশি অঙ্কের মাঝখানে শূণ্য বসিয়ে সংখ্যা প্রস্তুত করা তাদের কাছে অনায়াসসাধ্য ছিল। ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে ৭৯১-৯২ খ্রি. নাগাদ এই সংখ্যাতত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ে। আরবদের আল খোয়ারিজমি প্রায় একই সময়ে এই সংখ্যাতত্ত্বের ব্যাপক ব্যবহার শুরু করেন। একই সময়ে ভারত থেকে প্রাপ্ত একটি প্লেটে প্রথম বিন্দু আকারে শূণ্যের ব্যবহার শুরু হয়। যদিও শূণ্যের বিন্দু থেকে বর্তমান গোলাকার পেতে সময় লাগে ৮৭০-৭৬ পর্যন্ত। অর্থাৎ প্রাচীন মিশরে মাঝামাঝি জাযগায় শূণ্যের ব্যবহার (যেমন-১০১, ২০৩, ২০০২ ইত্যাদি) এবং ভারতবর্ষের বুকে একক (দশক ও তার বেশি) স্থানে শূণ্যের ব্যবহার (যেমন ১০, ১০০, ১০০০ ইত্যাদি) ও আল খোয়ারিজমি দ্বারা ইন্দো-আরবীয় সংখ্যাতত্ত্বের ব্যাপক প্রচলন গা লাগালাগি মিশর, ভারত, আরব ইত্যাদি সভ্যতাগুলির মিলিত প্রচেষ্টা বলেই মনে হয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপ যা গ্রহণ করে আরও প্রায় ২০০ বছর পরে। তাই পাশ্চাত্য একরকম বাধ্য হয়েই ইন্দো-আরবীয় সংখ্যাতত্ত্ব নাম দেয়।
৭১২ খ্রিস্টাব্দে আরবিভাষী মুহাম্মদ বিন কাশিম জলপথে সিন্ধুপ্রদেশে প্রবেশ করে ভারতে প্রথম মুসলিম শাসনের পত্তন করেন। এইসময় ভারতীয জ্যোতির্বিজ্ঞান ও চিকিতসাবিদ্যা দ্বারা আরবদেশ উন্নত হয়। আব্বাসীয় খলিফারা ভারতীয় পন্ডিতদের বাগদাদে স্থান দেন, নয়তো ভারতীয় জ্ঞান আহরণে দরবার থেকে লোক পাঠান। ঠিক তিনশত বছর পর ১০০০-১০১৭ খ্রি. নাগাদ সুলতান মাহমুদ ভারত আগমণকালে দেখেন ছিন্ন-ভিন্ন ভারতীয় আরব সাম্রাজ্য সিন্ধুর কয়েকটি স্থানে টিকে আছে। মাহমুদের সঙ্গে আসা আল বিরুনি ভারতীয় সমাজ, বিজ্ঞানচর্চা সম্বন্ধে নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন।
ইন্দো-আরব সম্পর্কঃ
মুসলিমরা ভারতের বুকে দৃঢ়ভাবে পদক্ষেপ করার পূর্বে সংস্কৃতে লেখা কয়েকটি চিকিৎসাবিদ্যার বই বাগদাদের বায়তুল হিকমায় অনুদিত হয়। আরবিভাষী খ্রিস্টান-ইহুদি, সাবাই, হিন্দু-বৌদ্ধ প্রভৃতি একদল ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, বাগদাদের বায়তুল হিকমায় বা অন্যত্র আরব পরিচালিত সংস্থায় তাঁদের নিজ নিজ জ্ঞান নিয়ে কেউ অনুবাদ, কেউ মৌলিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এঁদের মধ্যে ঈসাক ইবন হুনায়েন, বারমাকিগণ উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে এখন যেমন জ্ঞানচর্চার মাধ্যম ইংরেজি, তেমনই সপ্তম শতকে থেকে রেনেসাঁস-পূর্ব পৃথিবী উচ্চকোটির জ্ঞানচর্চার জন্যে আরবি ভাষার দ্বারস্থ হত।
ভারতীয় অবদান সম্পর্কে জানতে গেলে সব থেকে আগে মনে আসে আল বিরুনির কথা। তিনি বিভিন্ন হিন্দু শিক্ষকের নিকট হিন্দু দর্শন, চিকিৎসা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, ভুগোল ও সংখ্যাতত্ত্ব শেখেন। নিঃসন্দেহে তিনি ভারতবর্ষকে এই সকল ক্ষেত্রে আরও উন্নত জ্ঞান দেন, কারণ বায়তুল হিকমার যুগ পেরিয়ে ততদিনে আরব জ্ঞান-বিজ্ঞান বাকি পৃথিবীকে আরও পিছনে ফেলে দিয়েছে।
ভারতীয় ওয়ুধ যেমন কফুর (কর্পুর), মুস্ক (সুগন্ধি), ইত্যাদি বস্তুগুলির নাম কোরআন ও হাদিসে পাওয়া যায়। তুতিয়া, বিষ. সোন্দল কথাগুলি ভারতীয়। ভার্মা ১৯৯২ নাগাদ তাঁর লেখা ‘ইন্দো-আরব রিলেশনস ইন মেডিক্যাল সায়েন্সেস’-এ প্রমাণ সহ এরকম বহু উদাহরণ দিয়েছেন। আবু সঈদ (রা.) নামক জনৈক সাহাবা লিখেছেন, এক ভারতীয় রাজা নবী (সোয়াল্লালাহে আলায়হেস সালাম)-এর সেবায় মাটির পাত্রে শুকনো জাঞ্জাবিল (আদা) পাঠিয়েছিলেন। মধুর সঙ্গে সাতদিন ধরে খেলে শ্লেষ্মা, বাত ও পঙ্গুত্ব সেরে যায়।
হারিস ইবন কালাদা নবী (স.)-এর সমসাময়িক চিকিৎসক ছিলেন। তিনি জুন্দিসাপুর, খুজিস্তান, দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানে লেখাপড়া করেন। এখানে ভারতীয় বৈদ্য ও দার্শনিকেরা পড়াতেন। লেখাপড়া শেষে আরবে ফেরার পরিবর্তে তিনি ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যার বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে আরও অবগত হওয়ার জন্যে ভারত ভ্রমণে যান। খলিফা মুয়াবিষা (রা.)-র দরবারে চিনের সম্রাট যে সকল উপহার পাঠান তার মধ্যে ভারতীয় ওষুধ, আলকেমি, জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই ছিল। আত তাবারির (৮৫০ খ্রি.) বইয়ে ‘আল খিজাব আল হিন্দ’ নামক একটি কলপের নাম পাওযা যায় যা লাগালে প্রায় এক বছর ধরে চুলের ঔজ্জ্বল্য এবং রঙ অবিকৃত থাকত। আব্বাসীয় যুগে কুঁড়ি অবস্থার অপরিপক্ক আরব জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যে বহু ভারতীয় বিদ্বান ও বৈজ্ঞানিককে বাগদাদে ডাকা হয়েছিল। তাঁদের প্রধান কাজ ছিল সংস্কৃত ভাষা থেকে অনুবাদ। পান্দির, মানাকা, কনকা (গঙ্গা), দীপঙ্কর, নকুল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সংস্কৃত নিম্নবর্ণের কাছে অচ্ছুৎ থাকায ধরে নেওয়াই যেতে পারে এঁরা সকলেই ছিলেন ব্রাহ্মণ। বারমাকিরা ভারতীয় ও আরব সংস্কৃতির মিলনের প্রধান সেতু ছিলেন। বারমাকি কথাটির উৎপত্তি ‘প্রমুখ’ থেকে। প্রথমে খালিদ বারমাকির উৎসাহে বাগদাদে বসে ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হতে থাকে। তিনি বিভিন্ন ভারতীয় পন্ডিতদের এনেছিলেন সংস্কৃত থেকে অনুবাদের জন্যে। আবার লোকজন পাঠিয়ে দুষ্প্রাপ্য পুঁথি ও গাছ-গাছড়া আনিয়ে নেন। সিব্ধু প্রদেশের শাসক দুজন পন্ডিত সহ ব্রহ্মগুপ্তর ‘ব্রহ্মসিদ্ধান্ত’ ও ‘খন্ডখাদক’ নামক দুটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই পাঠিয়ে দেন। ইব্রাহিম আল ফাজারি অনুবাদ করেন আরবিতে। এরপর ‘চরক সংহিতা’ ও ‘সুশ্রুত সংহিতা’র আরবি অনুবাদ হয়। চরকের ফারসি অনুবাদ করেন মানাকা, আরবি অনুবাদ করেন আবু হাবিন। সুশ্রুতের আরবি অনুবাদ কিতাব সামুরাল হিন্দ ই সুশ্রুদা করেন আলি ইবন জাইন। মানাকা বারতীয় বংশোদ্ভূত। আয়ুর্বেদ ও বিবিন্ন ভারতীয় বিজ্ঞানের পন্ডিত ছিলেন। তিনি সংস্কৃত, ফারসি ও আরবি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। বাগদাদের রাজকীয় হাসপাতালের প্রধান নিযুক্ত হন।