লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
গণিত এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানে সুনির্দিষ্ট কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য সসীম সংখ্যক অনুক্রমিক নির্দেশের সেটকে ‘অ্যালগরিদম’ বলা হয়। ৯ম শতাব্দীর বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ ‘মুহাম্মাদ মুসা আল খাওয়ারিজমী’-এর নাম থেকে অ্যালগরিদম শব্দটি এসেছে। অ্যালগরিদমের সংজ্ঞায় বলা যায় ‘ধাপে ধাপে অর্থাৎ ক্রমে ক্রমে সমস্যা সমাধানের বিশেষ পদ্ধতি,’ অর্থাৎ কোনো একটি সমস্যাকে বেশ কয়েকটি ধাপে ভেঙ্গে দিয়ে প্রত্যেকটি ধাপ পরপর সমাধান করে সমস্যার একটি সামগ্রিক সমাধান বের করা। অর্থাৎ অ্যালগরিদম হচ্ছে যে কোনোও কাজকে সম্পন্ন করার জন্য বেশ কতক গুলি সুনির্দিষ্ট ও ধারাবাহিক ধাপের সমষ্টি বিশেষ, যেখানে সেইসব ধাপের সংখ্যা অবশ্যই সীমিত ও সসীম হতে হবে। কম্পিউটার, মানুষ, রোবট ইত্যাদি অ্যালগোরিদের ধাপগুলো ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করে একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করতে পারে। কম্পিউটার বিজ্ঞানে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য সঠিক অ্যালগোরিদমের প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি অ্যালগোরিদমকে তখনই ‘সঠিক’ বলা হয় যদি প্রতিটি ইনপুটের জন্য অ্যালগোরিদমটি সঠিক আউটপুট প্রদর্শন করে। এবং পুরোপুরি নির্ভুল নয় এমন অ্যালগোরিদমও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে যদি ভুলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ধরে রাখা যায়। একটি অ্যালগোরিদমকে যেকোনো ভাষায় বর্ণনা বা প্রকাশ করা যেতে পারে, সে ভাষাটি বাংলা, ইংরেজির মত মানুষের মৌখিক ভাষা, অথবা সি++, জাভার মত প্রোগ্রামিং ভাষা এমনকি হার্ডওয়্যার ডিজাইনের মাধ্যমেও হতে পারে। তবে যে ভাষাতেই লেখা হোক না, সমস্যা সমাধানের প্রতিটি ধাপের বর্ণনা নির্দিষ্ট অ্যালগোরিদমে থাকতে হবে। (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া)
এই অ্যালগরিদমের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। এই অ্যালগরিদম শব্দটি এসেছে ৯ম শতাব্দীর বিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ‘মুহাম্মাদ মুসা আল – খাওয়ারিজমী’ এর নাম থেকে। যাঁর প্রকৃত ইতিহাস অনেক আধুনিক শিক্ষিত সমাজও জানেন না।
মুহাম্মদ ইবন মুসা আল – খাওয়ারিজমি বৃহত্তর খোরাসানের খাওয়ারেজম অঞ্চলে ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে প্রখ্যাত গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও ভূগোলবিদও ছিলেন। এই বিখ্যাত বিজ্ঞানী গনিতের শাখা আলজেবরারও আবিস্কারকর্তা ছিলেন। আলজেবরা একটি আরবী শব্দ। তাঁর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ (الكتاب المختصر في حساب الجبر والمقابلة/ The Compendious Book on Calculation by Completion and Balancing (al-Kitab al-mukhtaṣar fi ḥisab al-jabr wal-muqabala) এর মধ্যে আলজেবরা সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারণা দেন। আল – খাওয়ারিজমি ভারতীয় দশভিত্তিক সংখ্যাপদ্ধতি নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেন যেটি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে নামকরণ করা হয় ‘Algoritmi de numero Indorum’। সেই গ্রন্থে মূল রচয়িতার জায়গায় ‘আল-খাওয়ারিজমি’ নামটি যখন ল্যাটিনে রূপান্তর করা হয়, তখন এটি হয়ে যায় ‘Algoritmi’। এটা অনেকটা আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামের ইংরেজীতে লেখার মত। কবিগুরুর ‘ঠাকুর’ পদবীটিকে ইউরোপীয়দের মধ্যমে বিদেশে ‘টেগোর’এ রূপান্তরিত হয়ে যায়। অনুরূপ ‘আল খাওয়ারিজমি’ নামটিও তাঁর বই ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করার সময় লেখকের নাম পরিবর্তন হয়ে হয়ে যায় ‘Algoritmi’। মূল গ্রন্থ লেখার প্রায় ৩০০ বছর পর উক্ত গ্রন্থটি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। এই গ্রন্থটিই প্রথম এক থেকে দশ সংখ্যা ও তার বৈশিষ্ট ইউরোপীয় সমাজে পরিচিত করে তোলে। এর আগে ইউরোপীয়রা জটিল রোমান ভাষায় তাদের সংখ্যা লিখত। আল খাওয়ারিজমের উক্ত গ্রন্থ ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ হলে ইউরোপীয়রা জটিল রোমান সংখ্যার পরিবর্তে ইউরোপে এবং ক্রমে সারা পৃথিবীতে এক থেকে দশ সংখ্যার পদ্ধতি প্রচলিত হয়। আল খাওয়ারিজমির নামানুসারে এই সংখ্যাপদ্ধতিটির নামকরণ করা হয় Algorismus, যার ইংরেজি নাম হল Algorism.
ত্রয়োদশ শতকে Algorism শব্দটি ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করে। তৎকালিন বহু উল্লেখযোগ্য ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবি ও সাহিত্যিক উক্ত শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। যেমন: জেফ্রি চসার (Geoffrey Chaucer/ Born: 1343, Died: 25 October 1400, London, United Kingdom) Algorism শব্দটি ব্যবহার করেছেন। গ্রিক শব্দ ‘এরিথমস’ (ἀριθμός) শব্দটির অর্থ হল সংখ্যা। ১৫ শতকে এই Algorism শব্দের প্রভাবে ল্যাটিন Algorismus হয়ে যায় Algorithmus। ইংরেজি শব্দটিও তখন পরিবর্তিত হয়ে হয় শব্দটি হয় Algorithm।
উনবিংশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত ‘অ্যালগরিদম’ শব্দের অর্থ ছিল এক থেকে দশ সংখ্যা পদ্ধতি। ল্যাটিন শব্দ Algorithmus এর অর্থও ছিল এক থেকে দশ সংখ্যা পদ্ধতি। বিংশ শতকের শুরুর দিকে এর অর্থ পরিবর্তন হয়ে বর্তমান প্রচলিত অর্থটি আসে। এ সময় অ্যালান টুরিং নামের একজন বিজ্ঞানী যে টুরিং মেশিনস যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন তা অ্যালগরিদম অনুসরণ করে জটিল সমস্যা সমাধান করতে পারে। বাস্তবে এটিই ছিল আধুনিক কম্পিউটার যুগের সূচনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আর একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন যা অ্যালগরিদম অনুসরণ করে জার্মানদের এনক্রিপ্ট করা কোড (এনিগমা (Enigma) কোড) ক্র্যাক করতে পারত।
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করি যেমন: আমাদের ফোন, টেলিভিশন, কম্পিউটার, স্মার্টওয়াচ, অতি প্রয়োজনীয় ইন্টারনেট এগুলোর সবই চলে অ্যালগরিদম দিয়ে। এছাড়াও সোশাল মিডিয়ার গুগল, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব প্রভৃতিতে রয়েছে অনেক জটিল জটিল সব অ্যালগরিদম। অ্যালগরিদমের আরও সহজ উদাহরণ হচ্ছে অনলাইন বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য কেনাকাটার ওয়েবসাইটগুলো যেমনঃ অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট, আলিবাবা প্রভৃতি। বিভিন্ন আকর্ষণীয় পণ্যের যে রেকমেন্ডেশন দেখি সেগুলো সবই অ্যালগরিদমের জন্যই হয়ে থাকে। অপরদিকে ফেসবুকে বিভিন্ন পেইজ, গ্রুপ বা বিভিন্ন ব্যক্তির আইডির যে রেকমেন্ডেশন আমরা পেয়ে থাকি সেগুলোও অ্যালগরিদমের জন্যই হয়ে থাকে। অপরদিকে যে গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে থাকি যার মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার দিকনির্দেশনা পেয়ে থাকি। এক্ষেত্রে গুগল ম্যাপ আমাদের বলে দেয় নির্দিষ্ট স্থান পায়ে হেঁটে, বাইকে, ট্যাক্সিতে বা বাসে গেলে কতক্ষণ সময় লাগবে, এক্ষেত্রে প্রথম যে বিষয়টি বিবেচনা করা হয়, তা হচ্ছে সর্বনিম্ন দূরত্ব। তখন রাস্তাগুলোর দূরত্ব ও রাস্তার ট্রাফিকের অবস্থা দেখে দ্রুততম রাস্তাটিই আমাদের বাছাই করে দেয়। অনুরূপ বিভিন্ন ওলা, উবের, ক্যাব বা র্যাপিডোতে আমরা যেভাবে স্মার্টফোনে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে উক্ত যাতায়াতের মাধ্যমগুলো বুকিং করে থাকি সেগুলোও চলে নির্দিষ্ট অ্যালগরিদমের মাধ্যমে। আর এই অ্যালগরিদমের জনক হচ্ছেন ৯ম শতাব্দীর বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ ‘মুহাম্মাদ মুসা আল খাওয়ারিজমী’। তাঁর নাম থেকেই অ্যালগরিদম নামের উৎপত্তি হয়েছে।
অনেকে মুসলিমদের এই বলে কটাক্ষ করে থাকে যে গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইন্টারনেট প্রভৃতি দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য অনলাইন গণমাধ্যমগুলো তো ইহুদী এবং খ্রীষ্টানদের তৈরী করা। এগুলো মুসলিমরা ব্যবহার করে কেন? আমাদের জবাব হলঃ অ্যালগরিদমের ব্যাপারে বিস্তারিত জানার পর তাঁদের কটুক্তি যে একেবারেই যুক্তিহীন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও পড়ুন
ইন্টারনেটের অন্ধকার জগৎ ‘হ্যাকিং’ ও সাইবার ক্রাইমের বেশ কিছু রোমাঞ্চকর তথ্য