লিখেছেনঃ তপন শিকদার
বি. জে. পি. দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর মুসলিম মৌলবাদীদের যে অত্যাচারের কথা বলে আসছেন, তসলিমা নাসরিন বি. জে পির সমর্থক না হয়েও সেই অত্যাচারের বাস্তবচিত্র তার ‘লজ্জা’ উপন্যাসে অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। মুজিবর রহমানের মৃত্যুর পর ১৯৮৮-র ৮ এপ্রিল সংবিধান সংশোধনের মধ্যে দিয়ে ইসলাম ধর্মকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে গ্রহন করা হয়। এর পর থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সংখ্যাগুরু মুসলিম মৌলবাদীদের অত্যাচার, নির্যাতন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে হিন্দুরা আজ চরম লাঞ্ছিত, অপমানিত, অবহেলিত। অথচ শত শত হিন্দু তাজা রক্ত ঝরিয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। হিন্দুদের এই দুরবস্থা বাংলাদেশের লজ্জা। তসলিমা ‘লজ্জা’ লিখে তার দেশের লজ্জাকে সারা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এই ঘটনাও মুসলিম মৌলবাদীদের মনে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ তো জাগায়ইনি, উল্টে তারা তসলিমার বিরুদ্ধে একটি লজ্জাজনক দন্ড ঘোষণা করে লজ্জার সত্যতাকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা করেছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের জীবন, সম্পত্তি, সম্মান ঐ দেশের সংখ্যাগুরুদের দ্বারা। কিভাবে কতটা সুরক্ষিত হয়েছে তার সাক্ষ্য হিসেবে একটি হিন্দু পরিবারের জীবন ধারণ ও কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ আছে তসলিমার উপন্যাসে। ‘৯০ সালে বাংলাদেশে কয়েকশ হিন্দু পরিবারের ঘর ও সম্পত্তি লুঠ, হিন্দু মা বোনের ইজ্জত হরণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ পেয়েছে ‘লজ্জায়’। তসলিমা লিখেছেন, বাংলাদেশের পথে ঘাটে মুসলিম মৌলবাদীদের মিছিলের শ্লোগান, একটা দুইটা হিন্দু ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর, হিন্দুদের এইরকম প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখে ভয়ংকর দিনযাপনের ছবি লেখিকা এঁকেছে তাঁর লজ্জায়।
লেখিকা হিন্দু না হয়েও কিংবা আমাদের সমর্থক না হয়েও এই সত্য তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। এই নির্মম সত্যই ক্ষেপিয়ে দিয়েছে মুসলিম মৌলবাদীদের। বাংলাদেশের ২ কোটি হিন্দু আজ দাবানলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মোট জনসংখ্যার এই ২০/২৫ শতাংশের একটাই অপরাধ যে তারা হিন্দু। পৃথিবীর কোন দেশে বোধ করি কোন ধর্মের ওপর এত ভয়ংকর আঘাত আসেনি। তসলিমা তাঁর উপন্যাসে সহজ সত্য উদঘাটন করে বাংলাদেশের চৈতন্যোদয় ঘটাতে চেয়েছেন। এক জাতীয় লজ্জার হাত থেকে তার দেশকে রক্ষা করার শুভ প্রয়াস নিয়েছেন। ফলস্বরূপ তাঁর দেশের মৌলবাদী সংগঠনগুলির বোধোদয় হওয়া তো দূরের কথা, উল্টে তাঁকে হুমকি দেওয়া হল, তাঁর প্রাণনাশের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হল। বাংলাদেশ সরকারও ‘লজ্জা’ নিষিদ্ধ করে। মৌলবাদীদের পরোক্ষভাবে সমর্থন করলেন।
লক্ষণীয় যে, মৌলবাদীদের এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও একটি কথাও বলেনি। এখানেও ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরও এই প্রসঙ্গে ভূমিকা লজ্জাজনক। ভোটের লোভে তাঁর এই মৌলবাদীদের এক ধরনের সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছেন। সত্য গোপনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘লজ্জা’ বইটির বিক্রেতাদের ধরে বই আটক করছে। আমরা সাধ্য অনুযায়ী বইটি আমাদের কর্মীদের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিচ্ছি। ১৪ টাকার বইটি কিনে আমরা ১৫ টাকায় কয়েক হাজার কপি বই পূজোর চারদিনে বিক্রি করেছি। উপন্যাস হিসেবে বা বাংলা সাহিত্য হিসেবে নয়, বইটি আমাদের কাছে মুল্যবান একটি দলিল হিসেবে। শুনতে পাচ্ছি এই বাংলায় সম্প্রতি ‘লজ্জা’র একটি পরিমার্জিত সংস্করণ বেরিয়েছে। আমরা চাই মূল ‘লজ্জা’র একটি সুলভ সংস্করণ। আমরা বিভিন্ন মুখপত্রে এই বইটির আলোচনা ছেপেছি। এই মুহুর্তে বইটির কোন অনুবাদের পরিকল্পনা আমাদের নেই। আর লেখিকার বিনা অনুমতিতে আমরা বইটির অনুবাদ করবও না। তবে আমরা এই বইটির আরও বেশি প্রচার চাই। সভ্য সমাজ জানুক মুসলিম মৌলবাদীদের প্রকৃত রূপ। এই মৌলবাদীদের মুখোশ ছিড়ে ফেলার জন্য তসলিমার ভূমিকার প্রশংসা করি। বাংলাদেশে ঝড়ের কেন্দ্রে বসে এই বই লেখা নিঃসন্দেহে সাহসের পরিচায়ক, যদিও তসলিমার অন্যান্য বই গুলি পড়ে আমার তাকে কিছুটা বিকৃত রুচির মহিলা বলেই মনে হয়েছে। তার লেখার বিষয় নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। আমি আপত্তি জানাচ্ছি ওঁর ভাষার। এই ধরনের কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করলে তসলিমা কখনই উঁচুমানের লেখিকার সম্মান পাবেন না বলেই আমার বিশ্বাস।
[সৌজন্যে ও আলোকপাত, ডিসেম্বর ১৯৯৩/ লেখক প্রাক্তন সভাপতি, বিজেপি, পশ্চিমবঙ্গ]
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।