লিখেছেনঃ আজিজুল হক
যেকোন প্রাণীরই অস্তিত্বের সমস্যা মানেই ‘প্যাট’ (পেট) আর তার ঠিক নিচের অঙ্গের সমস্যা! ‘নিচের অঙ্গটিকে প্রজাতি-টিকিয়ে রাখার অর্থে ধরতে হবে। এর মধ্যে আবার ‘প্যাট’-এর সমস্যাটা প্রথম। কারণ খাদ্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে প্রাথমিকভাবে টিকে থাকার প্রশ্ন, সক্ষমতার প্রশ্ন। এটার কোন লিঙ্গভেদ নেই। যেমন নেই ‘ছেলেবেলা’ (চাইল্ডহুড) কথাটার লিঙ্গভেদ।
তসলিমার ‘মেয়েবেলা’ যাঁরা মেয়েদের মেয়ে হিসাবেই ভাবতে ভালবাসেন, মানুষ হিসাবে নয়, মেয়েমানুষ’ বলে কিছু সুযোগ গ্রহণ করতে চান, ‘মানুষ-মেয়ে’ হিসাবে সমানে সমানে লড়াইয়ে ফেলতে চান না (অর্থাৎ রাখিলে মেয়ে করিয়া, মানুষ করো নি’), তারা মেয়েবেলা লিখে চমক লাগিয়ে ঠমক দেখাতে পারেন এবং কথাটার কেউ মানে বোঝে নি ও বোজে নি বলে আন্তরতিজাত আত্মশ্লাঘা অনুভব করতে ভালবাসেল, তারা ‘নারী-খিদে’, ‘পুরুষ-খিদে’ নিয়ে ভাবুন…কারণ ১১লাখ টাকার ফ্ল্যাটে থেকে এসব ভাবা যেতে পারে……। এই সমস্যা সমাধানে প্রাণীজগৎ নানান ঘাত প্রতিঘাতে নিজেদের এক একটা সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলেছে। এদের মধ্যে মৌমাছিদেরটা বেশ মজার। এক রাণী তাঁর কাজ বংশ রক্ষা করা। বিশাল কর্মীবাহিনী-খোজা এক রাজা। দুই রাজা হলেই কলোনি’ বিস্তার।
মানুষের জগতে ব্যাপারটাকে মডেল হিসাবে ধরে নিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু মানুষ বলেই সেটা সম্ভব নয়। পতঙ্গতুল্য কিছু মানুষ (লিঙ্গভেদহীন ভাবেই) ব্যাপারটাকে দার্শনিক এবং বলিষ্ঠ করে তোলার জন্য সেটাকে একটু পাল্টে নিতে চায়। নারী প্রজাতিরক্ষার আধার, সেজন্যই তার পরিচয় কি শুধুই মেয়ে, শুধুই স্ত্রী, শুধুই মা? তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ কি করে হবে? শ্রীরাধিকা এবং মেরি দুজনকেই কি করে মেলানো যায়? বেশিরভাগ মানুষ-ই যদি আয়ান ঘোষ হতেন (কর্মীবাহিনীর মত) তাহলে হয়তো সমস্যার অনেকখানি মিটে যেত। মনুষ্য-প্রজাতি রক্ষার দায়িত্ব যাঁদের (পুরুষদের তো সে ক্ষমতা নেই) তাঁদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথ বাতলেছেন কেউ কেউ (অবশ্যই নিজেদের ‘গোপন কথাটি, রহিবে গোপনে’)।
নারীদের মনের খোরাকটাই প্রথম। তাই ‘খিদে পেলে পুরো থালাটাই’ তার চাই। তার প্রয়োজন ‘কেয়ার-ফ্রি প্রেম’। এই কেয়ার-প্রি প্রেমের জন্য, পেটটাকে ভরাতে হবে। চাই ‘ফাইনান্সার’ আর সর্বক্ষণের একজন সঙ্গী। অর্থাৎ এক একটা নারীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠবে এক একটা সমাজ। চাই সমাজে গ্রহণযোগ্য একজন ‘স্বামী’ নামক বস্তু, প্রেম করার জন্য নির্বাচিত (এবং পরিবর্তনযোগ্য, শুধু যৌনরোগাক্রান্ত না হলেই হল) একজন মুক্ত পুরুষ। যাকে প্রাণ ধারণের জন্য খাবার সমস্যা নিয়ে ভাবতে হয় না। চব্বিশ ঘন্টা শুধুই প্রেম করবে। আর, আগেই বলেছি, একটা ফাইনান্সার। এই শতাব্দীর প্রথম দশকে জার্মান কমিউনিষ্টরা নারীমুক্তির প্রায় এই রকম একটা মডেল লেনিনের সমীপে হাজির করেছিলেন। সেটাকে কেন্দ্র করেই লেনিনের বিখ্যাত ‘গ্লাস অব ওয়াটার তত্ত্ব’। এরপর ‘সেকসুয়াল ইনহিবিশন’-এর দোষে কমিউনিস্টরা পুষ্ট হতে শুরু করেন। এর আগে এরাই কিন্তু প্রচার করত যে, কমিউনিস্টরা মেয়েদের সামাজিক করে তুলতে চায়!
সমস্যা কোথায়
সামাজিক মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সমস্যা আছে, এটা সত্য। ব্যক্তির সমষ্টি একটা সমাজ, না সমাজের একেবারে প্রাথমিক একক ব্যক্তি….এটা মোটেই দার্শনিক বা পণ্ডিতির প্রশ্ন নয়। দৈনন্দিন জীবনের প্রশ্ন, ব্যক্তির সমষ্টি সমাজ-এই চিন্তা স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেক মানুষকে আত্মোন্নতির নামে আত্মস্বার্থসর্বস্ব করে তোলে। এবং তার যুক্তি আমার উন্নতি মানেই তো সমাজের উন্নতি। এতে মানুষ যোগ দেয় এক নীতিহীন ইঁদুর দৌড়ে। মুনাফাভিত্তিক, বাজারি সংস্কৃতির অবদান এটা।
ভাষাতত্ত্বের ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে যে, মানুষ প্রথমে কথা বলতে শিখেছে। তারপর শিখিয়েছে প্রত্যেকটা শব্দের পৃথক মানে। প্রথমে এসেছে বচন। তার অনেক পরে এসেছে এক বচন। উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে গেছে ‘সমষ্টিমানুষ’। এসেছে ব্যক্তি মানুষ! সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে দ্রুততার সঙ্গে। সমষ্টি-মানুষের ধ্বংসের মধ্য দিয়েই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে।…..সভ্যতা এগিয়ে গেছে, কিন্তু ‘মানুষ’ ধ্বংস হয়েছে। এটা বাস্তব। এটা ইচ্ছা-নিরপেক্ষ বস্তুগত নিয়মেই হয়েছে।
সেই অর্থে যুথবদ্ধ, কমিউন মানুষের ধ্বংসটা তো প্রগতি বটেই! আজ সেই প্রগতি নিজেই নিজেকে গিলতে উদ্যত। সমষ্টি হয়ে গেছে ব্যক্তি কেন্দ্রিক, ব্যক্তি হয়েছে ব্যক্তিরহিত। ব্যক্তি-সমাজ টিকে থাকতে পারছে না, তার সমস্ত পিতৃতান্ত্রিকতা, ধর্ম, রাষ্ট্র, ফ্যাসিবাদ কোন কিছু নিয়েই ব্যক্তির যোগফলে গঠিত সমষ্টি টিকে থাকতে পারছে না। ভেঙে পড়ছে, পুরানোটা জোরে-এ যেন এক শিশু আসতে চাইছে পৃথিবীতে, জোর করে তার জন্ম ঠেকিয়ে রাখা। ফলে মায়ের দেহেই পচন শুরু হয়েছে। সংকটটা এখানেই।
পুরনোটা ভেঙে পড়েছে, নতুনটা বেড়ে উঠছে না-সংকটের স্বরূপ এটাই। মানুষ যেদিন নিজের পরিশ্রমের ফসল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে আরম্ভ করে, সেদিন থেকেই। এই সংকটের শুরু। নিজের পরিশ্রম থেকে বিযুক্তি তাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যে শ্রমের ফলে মানুষ, মানুষ হয়েছে, সেই শ্রমটাই তার কাছে হয়ে গেছে জীবনধারণের উপায়। জীবনটাই হয়ে গেল জীবনধারণের উপায়। লক্ষ্য হয়ে গেছে উপায়। মানুষের শ্রমের মালিক হচ্ছে যারা, তারা চরম বিচ্ছিন্ন এক ধরনের জীব। নারী, পুরুষ নির্বিশেষে তারা এক বিচিত্র জীব।
বিচিত্র এই মানুষের বিকাশের পথ একটাই। সেটা হল, কি নারী, কি পুরুষ, নিজের শ্রমের ফসলের সঙ্গে অন্বিত হওয়া। এই অম্বিত হওয়ার সংগ্রামের মধ্যেই ব্যক্তি মানুষের সমাজীকরণ হয়। চরম বিকাশ ঘটে। যত জটিলই হোক না কেন এই সংগ্রাম, এটাই পথ।
এই অধিত হবার রাস্তা খুঁজতেই ব্যস্ত শিল্প-সাহিত্য। কেউ ভাবছেন ভোগবাদ, কেউ ভাবছে যৌনমুক্তিতেই এর সমাধান। কেউ আবার ‘প্রতীকবাদে’ ভিড়ে গিয়ে নিজের চেতনার রঙে দুনিয়াটাকে দেখছেন। নিজের হতাশা, বিকৃতি, এবং ‘বিক্রীত’ অবস্থানকে সকলের ঘাড়ে চাপিয়ে মুক্তি পেতে চাইছেন তাঁরা।
কয়েক হাজার বছর আগে
সময়ঃ আজ থেকে বেশ কয়েক হাজার বছর আগে।
স্থান : গান্ধার (আফগানিস্থান) হতে পারে, আবার সিন্ধুনদের অববাহিকাও হতে পারে। আবার চীন, ইরাক কিংবা অস্ট্রেলিয়াও হতে পারে। কুঁড়েঘরের আদলে কয়েকটা ঘর, কঁচা চামড়ার কয়েকটা তাঁবু……..ঘরগুলোর চারপাশে আগুন জ্বলছে। একজন পুরুষ সেই আগুনে কাঠ দিয়ে যাচ্ছে। এক নারীমূর্তির প্রবেশ মুখে তিনি একটা আওয়াজ করেন। তাঁবুগুলো থেকে একদল পুরুষ বেরিয়ে আসে। নারী তাদের দিকে এগিয়ে যায়। একজনের হাত ধরেন। একটা তাঁবু-তে ঢুকে যান। বাকিরা চলে যায়। নারী-ভোগ্য পুরুষের কপালে সেই রাত্রের জন্য সম্মান জোটে। কেউ কিছু মনে করে না। সকালেই দেখা যায়, এই নারী, আরও কিছু নারীর সঙ্গে তাঁবুর চারপাশের জমিতে কাঠের কিংবা হাড়ের ফলা দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। শস্য ছড়াচ্ছে। পোষা কোন ঘোড়ার দুধ দুইছে। পুরুষরা গেছে বনে, খাবার জোগাড় করতে কিংবা শত্রু নিধন করতে।
বিরুদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হলে সংখ্যা বাড়াতেই হবে। আর নারী সেই ‘রহস্য’-র আধার। গর্ভধারণ করেন নারী। তিনি আর বাইরে বেরোতে পারেন। সংগৃহীত কোন শস্যের বীজ থেকে দেখতে পাওয়া যায় একটা নতুন গাছ। ফাঁকা জমিতে আরও কিছু দানা ছড়িয়ে দেন। নারীর হাতে আসে ‘ডবল’ ক্ষমতা। বিরুদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামের জন্যে সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষমতা। দ্বিতীয়ত কৃষি কাজ এবং পশুপালনের ওপর কর্তৃত্বের ফলে সেই সময়কার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কর্তৃত্ব। অর্থাৎ উৎপাদন শক্তির কর্তৃত্ব।
কিন্তু মানুষ প্রতিটি মুহূর্তে উৎপাদনের হাতিয়ারের বিকাশ সাধন নাকরে টিকে থাকতে পারে না। ক্রমশ কৃষিকাজে লাঙ্গল এবং অন্যান্য ভারী যন্ত্রপাত্রি ব্যবহার কৃষিকাজকে পুরুষ নির্ভর করে তোলে। চাষযোগ্য জমি উদ্ধার থেকে জলসেচ এবং পশুপালন, এসব কিছুর জন্যই পুরযের শক্তির দরকার । শারীরিক এই সুবিধার সুযোগ নিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থাটা পুরযের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সভ্যতার বিকাশের ধারা বেয়ে উৎপাদনের হাতিয়ার সহ উৎপাদন শক্তির এই হস্তান্তর থেকেই শুরু হয় নারীর প্রকৃত লাঞ্ছনা। প্রতিটি উৎপাদন ব্যবস্থাই দাবি করে তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সামাজিক সম্পর্ক। মাটির বাড়ির ভিতে চোদ্দ-তলা বাড়ি হলে সেটা ধসে যাবেই। সুতরাং উৎপাদনব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ পুরুষকে সমাজ বা গােষ্ঠীর কাছে এনে দেয়।
যৌন-অতৃপ্তির বিলাপ
অতএব নারী-লাঞ্ছনার উৎস না খুঁজে, সেই প্রশ্নে নীরব থেকে নারী মুক্তির কথা বলা হয় অজ্ঞতা, না হয় প্রচলিত পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত উৎপাদনব্যবস্থাকে আড়াল করে বাঁচানোর চেষ্টা। নারীরা যৌন মুক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকুক এটা মনু, মহম্মদ, হিটলার প্রত্যেকেই বলেছেন। তসলিমা ঠিক এই কাজটাই করেছেন। মেয়েদের হাতে অর্থনেতিক কর্তৃত্বটা সমর্পণ করা নয়, তাঁর আকাঙক্ষা (যে কোন ধর্ষণকামী পুরুষও সেটা মেনে নেবে) পুরুষদের ধর্ষণ করা, একসঙ্গে চারটে বিয়ে করে ‘সপতি’ পোষা (নষ্ট গদ্য)। দ্রৌপদী তো সেটা করেছিলেন, তাতে সমস্যা মিটেছে কি?
উৎপাদনব্যবস্থায় পুরুষ কর্তৃত্বের প্রথম অবদান হল ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে আসে উত্তরাধিকারের সমস্যা। ‘আমার বংশ’—এই ধারণা থেকে উদ্ভূত হয় নারীর ওপর মালিকানার বোধ। সুতরাং ব্যক্তিগত সম্পত্তির (অর্থাৎ মালিকানাবোধের) দিকে বর্শা ফলকটা না ঘুরিয়ে যতই চিল্কার করা হোক না কেন, তাতে নারীর মুক্তি আসে না, বরং পুরুষ কর্তৃত্বকে অর্থনেতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এই কর্তৃত্বের জোরেই ‘নপুংসক’ও যুবতী স্ত্রীর মালিক হয় কিংবা বন্ধ্যা ‘নারী’র (সব অর্থেহ) পিতা সৌম্যদর্শন তরতাজা যুবক কিনতে পারেন। এক্ষেত্রে নারীও জ্বলে। ‘নপুংসক’ সমাজ জ্বালায় এবং আমরা ঘুমোই। ‘ব্যক্তি-পুরুষ’ কিংবা ‘ব্যক্তি-নারী’ সমাজের শিকার মাত্র। এই বিষয়টা উহ্য রেখে তসলিমা তার ‘নপুংসক’ কবিতাটিকে যৌন অতৃপ্ত নারীর আত্মবিলাপ করে তুলেছেন। যেন একজন সক্ষম দশাসই পুরুষ পেলেই কবিতাটির মুক্তি ঘটত।
‘গদ্য’ কিংবা ‘নির্বাচিত কলাম’ গ্রন্থে ঘটনার নাম করে বা তথ্যের ভঁড়ার সাজিয়ে তসলিমা বোঝাতে চেয়েছেন যে, যত নষ্টের গোড়া হল পুরুষ (কর্তৃত্ব)! এবং সেটাও যৌন-অপব্যবহার (!) দু-একটা জায়গায় মিন মিন করে অর্থনৈতিক ব্যাপারটা এলেও সেটা গৌণ। এখানেও তার পুরুষবিদ্বেষ পুরুষ-নির্ভরতারই নামান্তর মাত্র।
নারীমুক্তিকে যৌনমুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় পুরুষরাই। কারণ এতে তাদের লাভ ষোল আনার ওপর আঠার আনা। যৌনমুক্তি তো বিপরীত লিঙ্গের প্রাণী ছাড়া হতে পারে না। (অবশ্য লেসবিয়ন বা হোমোসেক্সয়ালরা ব্যতিক্রম)। প্রাণীজগতের শারীরিক – নিয়মেই যৌনক্রিয়াতে একজনের ‘অ্যাকটিভ’ এবং অন্যজনের ‘প্যাসিভ’ ভূমিকা থাকে। এবং ‘অ্যাকটিভ’ অংশটা পুরুষের বা পুরুষ-নির্ভর।
আমার প্রশ্ন : মেয়ে হিসাবে নয়, একজন মানুষ হিসাবে, নিজেকে কোন রকম সংরক্ষণ বা করুণার (রাগ দেখিয়েই হোক, ভিক্ষে করেই হোক) প্রার্থী না করে শ্ৰেণীবিভূক্ত, পণ্যপুজারী এই সমাজের মোকাবিলা কি সম্ভব নয়? তাহলেই ‘যোনি’ প্রদেশে কে জাল বোনে বা পশ্চাৎদেশে কে সুড়সুড়ি দেয়, সে ছেলে না মেয়ে সেটা জানা একান্তই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। পণ্যপুজারী এবং ভোগবাদী এই সমাজে সব পুরুষ ‘ভালমানুষ’ হয়ে গেলেই (কিংবা পুরুষবাদীদের ভাষায় ‘ভেডুয়া’) কি মেয়েদের লাঞ্ছনা শেষ হবে? মেয়েরা কি চান? এক বা একাধিক ‘ভেড়ুয়া’, না সহমর্মী, সহকর্মী, সহযোদ্ধা? পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এবং ভালবাসার পথে বাধা হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, আত্মস্বার্থ এবং ব্যক্তি—অধিকার-বোধ। এর উৎস অন্যত্র। যৌনাঙ্গে তো নয়-ই। যদিও, তসলিমার মতে, যৌনাঙ্গেই।
মুসলিম মৌলবাদীদের উকিল
সমাজে পুরুষ কর্তৃত্বের অর্থনৈতিক নিদর্শন যদি ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়, তাহলে ধর্ম হচ্ছে তার সাংস্কৃতিক নিদর্শন, আর ফ্যাসিবাদ বা নাৎসিবাদ তার সর্বোচ্চ সংগঠন। তাই নারী সম্পর্কে মনু, মহম্মদ ও হিটলার হুবহু একই কথা বলেছেন। ভারতবর্ষের বুকে যদি কোন মুসলমান বলে পাকিস্তান বা বাংলাদেশ চল…সেখানেই সব পাব আমরা….তাহলে সে কোন উদ্দেশ্য পূরণ করবে? কার মনোবাঞ্ছা পূরণ করবে সে? অবশ্যই বাল ঠাকরে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বি. জে. পি.র। কারণ ওরা তো এটাই প্রমাণ করতে চাইছে যে এ-দেশের মুসলমানদের প্রাথমিক আনুগত্য ইসলামিক দেশগুলির প্রতি। তাই হটাও ওদের। তসলিমার ‘লজ্জা’ গ্রন্থে নাকি বাংলাদেশের মুসলিম মৌলবাদীদের যুক্তির ভিত শক্ত করে। মোল্লারা তো এটাই বলছে। তসলিমা কিংবা সুরঞ্জন মোটেই ওখানকার হিন্দুদের উপকার করেন নি। যে বইয়ের বাণিজ্যিক সাফল্য দেখে একই নামের একটি বই লেখার বাসনা এই লেখিকার হয়েছিল, সলমন রুশদির সেই ‘শেম’ বইটি পড়লে তিনি ‘কৌশল’টা আরও ভালভাবে আয়ত্ত করতে পারতেন!
ধর্মের (হাদিশের বিভিন্ন উদ্ধৃতি অসম্পূর্ণ রাখার ফলে ধর্মের মূল জায়গাটাতে পৌঁছোতে চাননি তিনি। ‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত’…’ এটাও যেমন আছে, তেমনই হাদিশেই তার পরেই আছে… ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তান সন্ততির বেহেস্ত…’। এটা যদি আমি তাকে দেখিয়ে দিতে পারি, তাহলেই কি নারী মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়? তসলিমা যুক্তিতে আসুন, মায়ের মেয়ে যখন কেউ থাকছে, বেহেস্ত থাকছে মায়ের পায়ের নিচে, যেই সে স্ত্রী হচ্ছে তখন বেহেস্ত জায়গা বদলাচ্ছে—এগুলি পর পর সাজালে কি দাঁড়াচ্ছে? মা-তার পায়ের নিচে-ছেলে (এবং স্বামী) তার পায়ের নিচে স্ত্রী (এবং মা) পৌনঃপোনিক আবর্তন।
তাহলে ‘আদিমা’ – স্বয়ম্ভু (মানে ভগবান বা খোদ সৃষ্ট…) তাহলে আর কি? বেহেস্ত-এর মালিকানা মেয়েদের। অতএব তসলিমার হাদিশবিরোধিতা হাদিশেরই পক্ষে যায়। কিন্তু মজাটা হল এই যে, কোন ধর্ম-ই মাকে এই স্বীকৃতি দেয় না। ধর্ম মানেই পিতৃতান্ত্রিকতা। হাদিশ নয়, ধরতে হবে সেখানটাতেই। পার্থিব ‘জমি’র বদলে যদি কল্পিত ‘বেহেস্ত’ দিয়ে পুরষদের দুবৃত্তগিরি (উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিকানা থেকে বঞ্চিত করা) চাপা দেওয়া যায়, ক্ষতি কি? যে কারণে ধর্মের জন্ম, সেই কারণটা দূর করতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
মেয়েদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব কেড়ে নিয়ে সব পুরুষরাই কিন্তু সেটার ওপর সমান মালিকানা দীর্ঘদিন বাজায় রাখতে পারে নি। ক্রমে সেই কর্তৃত্বটা চলে যায়, ছোট্ট একটা সম্প্রদায়ের হাতে। সেখানকার নারী-পুরুষ সকলেই পরশ্রমজীবী, লুঠেরা, দুবৃত্ত। নারী-পুরুষে ভেদ থাকলেও, অন্যের শ্রমে বেঁচে থাকার প্রশ্নে তারা এক! তাদের কোন যুক্তি নেই, কোন হৃদয় নেই। এরাই হয়ে যায় সমাজের অভিভাবক। বাকিরা ভারবাহী পশু। বঞ্চিত মানুষকে সায়েস্তা করার জন্য আসে রাষ্ট্র, শান্ত করার জন্য ধর্ম। সব পারে ওপরে-এই তত্ত্বের জন্ম হয়। এই সান্তনা।
যুক্তিহীন সমাজের যুক্তি, হৃদয়হীন সমাজের হৃদয়, ভারবাহী পশুর বুক চেরা ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস (ভগবান তুমি বিচার কোরো….) হলো ধর্ম আর ধর্ম হল আফিম। যা দিয়ে বিদ্রোহকে প্রশমিত করা যায়? মানুষকে মেনে নেবার যুক্তি সরবরাহ করা যায়। এই ধর্মের উৎসকে আক্রমণ না করে কেবলমাত্র আরণগত সমস্যাটা আক্রমণ করলে আসলে ধর্মকেই রক্ষা করা হয়। যেন সেটা শুধরে নিলেই সব জলো হয়ে যাবে। মুসলিম ধর্মকে ভালবাসেন বলেই কি তসলিমা তার খারাপ দিক সম্বন্ধে এত সোচ্চার! কোন সংস্কারেরই, কোন ধর্মেরই আর ভাল কিছু করার ক্ষমতা নেই। কারণ, ধর্ম মানে, আতঙ্ক, ধর্ম মানে স্বার্থপরতা, ধর্ম মানে কিছু পাবার জন্য ঘুষ দেওয়া….। আমি মনে করি, ধর্মমুক্ত পৃথিবী ছাড়া সত্যিকার সম্পূর্ণ মানুষ সৃষ্টি সম্ভব নয়। সেই সমস্যাটা নারী-পুরুষের সমস্যা নয়। বঞ্চিতের সঙ্গে বঞ্চনাকারীর মোকাবিলার সমস্যা। তসলিমা এটাকেই গুলিয়ে দিতে চান। এরই জন্য ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের হাতে তিনি সচেতনভাবেই নিজেকে সঁপে দেন। তিনি মুখে বাম, কাজে ডান। সামাজিক পরিবর্তনকামীদের তিনি অন্য খাতে ঘুরিয়ে দিচ্ছেন।
লজ্জা!
– তাঁর নৈরাজ্য তঁর মানসিক বিকলাঙ্গতার পরিচয় বহন করে। মনে রাখতে হবে, ধর্ম যদি আফিম হয়, নৈরাজ্য তাহলে মাদক। একটা ঝিম ধরিয়ে রাখে, অন্যটা হঠাৎ ‘কিক’ দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী অবসাদে ঠেলে দেয়। দুটোর ফলই এক।
মাদকাসক্ত ‘গণ হিস্টিরিয়া যে বিপদ ডেকে আনছে, আমার ‘লজ্জা’-টা সেখানেই।
কাদের সমস্যা নিয়ে তসলিমা এত চিন্তিত? অঢেল, এক নম্বরী, দুনম্বরী, তিন নম্বরী, চার নম্বরী পয়সার মালিক, পেটের জন্য যাদের ঘুরতে হয় না, কি করে পয়সা উপার্জন করতে হয় এটা যাদের ভাবতে হয় না, যাদের সমস্যা হল কি করে পয়সা খরচ করতে হয়…..তসলিমার চিন্তার কেন্দ্রে এদেরই সাম্রাজ্য। কিংবা এদের দ্বারা প্রভাবিত অন্যান্য অভাগাজনদের। এই সমস্যা চাষী এবং চাষী বউ-এর নয়, সাঁওতাল দম্পতির নয়। যে সংসারে দুজনেই প্রাণপাত খাটে, তাদের নয়। আমার ‘লজ্জা’ এখানেই যে, মানুষ দেখেননি তসলিমা, দেখেছেন নারী এবং পুরুষ। আদর্শ পুরুষ বিহনে ব্যর্থতার আত্মবিলাপে তিনি নিমজ্জিত।
পুনশ্চঃ তসলিমার রচনার প্রত্যেকটি শব্দের আমি বিরোধী। এটা আমার গর্ব। কারণ শব্দগুলোর রাজনৈতিক ব্যবহার ‘লজ্জা’র। তবু, গড়াপেটার ছলে হলেও কিছু কাঠমোল্লা, বর্বর, মনুষ্যেতর মানুষ তসলিমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেবে, এটা সহ্য করা যায় না।
(লেখক বিশিষ্ট বামপন্থি চিন্তাবিদ ও সম্পাদক সাপ্তাহিক স্বাধীন বাংলা, কলিকাতা।)
(সৌজন্যে : মাসিক আলোকপাত ডিসেম্বর ১৯৯৩)
Taslima Nasreen’s case is being used to denigrate Islam
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।