লিখেছেনঃ সােমক দাস (সাংবাদিক)
একুশ বছর আগে এই দিনে স্বাধীনতা এসেছিল, এই দিনে শামীমা আক্তারও এসেছে সুরঞ্জন দত্তের ঘরে। বাহ স্বাধীনতা বাহ। শামীমাকে একবারও বলা হয়নি তার নাম। তার নাম যে সুরঞ্জন দত্ত একথাটি শামীমাকে বলা উচিত ছিল, তবে শামীমাও টের পেত তাকে আঁচড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করেছে যে মানুষ, সে একটি হিন্দু যুবক। হিন্দুরাও ধর্ষণ করতে জানে, তাদেরও হাত পা মাথা আছে। তাদেরও দাঁতে ধার আছে, তাদের নখও আঁচড় কাটতে জানে। শামীমা নিতান্তই নিরীহ একটি মেয়ে, তবু তাে মুসলমান। মুসলমানের গালে এখন একটু চড় কষাতে পারলেও সুরঞ্জনের আনন্দ হয়।
ঢাকার পার্ল পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত লজ্জা’র পঞ্চম সংস্করণের বাষট্টি পৃষ্ঠা থেকে কয়েক লাইন। পরের পাতায় পারভিনের ডিভাের্স হওয়াতে তার কোনও কষ্ট হয় না। বরং মনে হয় বেশ হয়েছে, মজা বােঝ। হিন্দুর কাছে বিয়ে দাওনি, মুসলমানের কাছে দিয়েছ, এখন কেমন? পারভিনকে সে মনে মনে একবার রেপ করে। এই সকালে, দাঁত মাজা অবস্থায় রেপ তেমন স্বাদের হয় না, তবু মনে মনের রেপ-এ স্বাদ থাকে।
আর উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। এই দুটি যৎসামান্য উদাহরণ থেকেই বােধহয় বােঝা গেল ‘লজ্জা’ একটি অত্যন্ত উদ্দেশ্যমূলক ও উত্তেজক রচনা। এই রচনাটিকে যদি সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে ব্যবসায়িক প্রচেষ্টায় রচিত বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে খুব কি অন্যায় হয়ে যাবে! কালােত্তীর্ণ কোনাে উপন্যাস এরকম অসৎ উদ্দেশ্যে রচিত হতে পারে না। একমাত্র ব্যবসায়িক সাফল্য ছাড়া এ উপন্যাসের যে দ্বিতীয় কোনাে উদ্দেশ্য ছিল না, তা খুব সহজেই বােঝা যায়। নিরাপত্তাহীন একটি হিন্দু পরিবারের ওপর মুসলমানদের অত্যাচারকে কেন বেছে নিলেন তসমিলা? খুব সহজে, পাঠকবর্গের একটা ইমােশনাল সাপাের্ট পাওয়া যাবে বলে নয় কি? অন্তত হিন্দুদের কাছ থেকে, যারা তাঁকে পুরস্কৃত করেছে। তাই বেছে বেছে এক হিন্দু পরিবারের ওপর ধারাবাহিক অত্যাচারের রােমহর্ষক ও উত্তেজক এবং লেখকের-প্রতি-সহানুভূতি-আদায় করে-নেওয়া বর্ণনা। সুরঞ্জনের বােন মায়াকে ‘ওরা’ নিয়ে গেছে। একুশ বছর বয়স মায়ার, প্রাণবান এক তরুণী। ওকে কেন ধরে নিয়ে যাবে ওরা, হিন্দু বলে? আর কত ধর্ষণ, কত রক্ত, কত ধনসম্পদের বিনিময়ে হিন্দুদের বেঁচে থাকতে হবে এই দেশে। কচ্ছপের মত মাথা গুটিয়ে রেখে? কতদিন? এ প্রশ্নের উত্তরে পাঠককে তাে সহানুভূতিশীল হতেই হয়।
বুদ্ধদেব গুহকে উৎসর্গ করা মাত্র উনআশি পাতার ‘লজ্জা’য় তসলিমা নাসরিন অত্যন্ত সার্থকতাবে আদায় করে নেন সাধারণ পাঠকের সেই সমর্থন, যা যে কোনাে লেখক/ লেখিকারই মূল অভীষ্ট। তবে তসলিমা যে কোনাে রিস্কের মধ্যে যাননি, সেটাই তার অন্যতম দুর্বলতা। বােন রেপ হয়েছে বলে তসলিমার নায়ক রাস্তা থেকে শামীমা নামে একজন মুসলমান পতিতাকে ঘরে তুলে এনে রেপ করে—এর বেশি কল্পনাশক্তি তসলিমা নাসরিনের স্বরূপ সন্ধানে । তসলিমার ছিল না। উপন্যাস লেখার জন্য প্রয়ােজনীয় ভাষাবােধের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। শস্তায় বাজিমাৎ করা খাঁর উদ্দেশ্য তাঁর ভাষাবােধ আলোচনার পর্যায়ে পড়ে না।
এহেন তসলিমা নাসরিনের ব্যক্তিগত জীবনদর্শন ঠিক কিরকম? বােম্বে থেকে প্রকাশিত ফ্যাশন ম্যাগাজিন Savvy নভেম্বর ‘৯৩ সংখ্যায় তসলিমা এক বিশাল আত্মকাহিনী লিখেছেন। তাতে তিনি জানাচ্ছেন,
- (১) আমি কোরান বিশ্বাস করি না। নামাজ পড়ি না। কোরানে ভুল রয়েছে। আল্লাহ্ একজন মিথ্যেবাদী। কারণ কোরানে আছে সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে।
- (২) সমাজ আমাকে ঘৃণা করে আমার চিন্তার জন্যে। আমার আত্মীয়স্বজনরা বলে আমি বাজে মেয়ে, খারাপ মেয়ে, উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়েমানুষ। কিন্তু আমি মনে করি আমি। পূর্ণাঙ্গ এক নিখুঁত মানুষ।
- (৩) হ্যা আমি ইসলামকে আঘাত করে থাকি। কারণ ইসলাম নারী-স্বাধীনতা দেয় না।
- (৪) আমি লজ্জা’ লিখেছিবাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী পরিস্থিতিকে ভিত্তি করে। আমি বাবরি সম্পর্কে লিখেছি কারণ এটা বৈষম্যের এক প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছিল।
- (৫) আমি আমার স্তন বা যৌন অঙ্গ সম্পর্কে লিখি। কারণ পুরুষেরা সব সময় ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে।
- (৬) যেহেতু আমার লেখা মেয়েদের মন পাল্টিয়ে দিচ্ছে তাই মােল্লারা আমাকে ভয় পাচ্ছে।
- (৭) যেহেতু আমি কলকাতা থেকে আনন্দ পুরস্কার আমার নির্বাচিত কলাম’-এর জন্য পেয়েছিলাম, তারা আমাকে ভারতের গুপ্তচর বলছে। আমি হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের কোন পার্থক্য করি না বলে তারা আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলে। এখন লজ্জা’র পর তারা বলছে ওটা লেখার জন্য বি জে পি আমাকে ৪৫ লক্ষ টাকা দিয়েছে।
- (৮) আমি অবাধ যৌনসংসর্গের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি—তার জন্য বিয়ে করার দরকার নেই। তার ফলে কেউ আপনার উপর সর্দারি করতে পারবে না। একই কারণে । আমার কোনাে সন্তান হােক, এটাও আমি চাই না।
- (৯) শুধু সিফিলিস ছিল কিংবা আমাকে পেটাতাে বলে রুদ্রকে (কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ-অধুনা মৃত-তসলিমার প্রথম স্বামী) আমি তালাক দিইনি, আমি নিজের হাতে তাকে চিকিৎসা করতাম। প্রধান কারণ ছিল, সে একজন নারীর স্বাধীনতাকে সমর্থন করত না।… তাকে চিঠিতে লিখেছিলাম–তুমি একজন মিথ্যেবাদী। তুমি সিফিলিস বইছ, এবং আমার শরীরে এই রােগ ঢুকিয়ে দিয়েছ।
- (১০) ১৯৮৯ সালে আমি দ্বিতীয় বিয়ে করলাম ঢাকার একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক ও সাংবাদিক নাইমকে (নাঈমুল ইসলাম। এর কাগজে কলাম লিখেই বিখ্যাত হন। তসলিমা)–তার এক কলমও লেখার ক্ষমতা ছিল না। বিয়ের আগে সে নারী-স্বাধীনতার অনেক ওকালতি করত। বিয়ের পর বুঝলাম, ব্যাটা এক নম্বরের মিথ্যেবাদী। আমি বিদ্রোহ ঘােষণা করলাম। বিয়ের দু’মাস পরেই তাকে তালাক দিলাম।
- (১১) ১৯৯১ সালে অন্য এক পুরুষের সঙ্গে লিভ-টুগেদার করলাম দু-মাসের জন্য। তারপর যে যার নিজের পথ দেখলাম। আমি আর বিবাহ প্রথায় বিশ্বাস করি না।
প্রসঙ্গত, কোরানে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে—এমন কথা কোথাও নেই। বিবায়ে অবিশ্বাসিনী সন্তান-আকাঙক্ষাহীনা এক রমণী কি করে ‘পূর্ণাঙ্গ এক নিখুঁত মানুষ’ হয়ে। উঠতে পারেন, আমরা জানি না। ইসলাম নারী-স্বাধীনতা না দিলে ইসলামিক রাষ্ট্রে মুসলমান নারী প্রধানমন্ত্রী থাকেন বা হন কি করে—আমরা তাও জানি না। বাবরি মসজিদকে বৈষম্যের প্রতীক তাে বি জে পি-ও মনে করে; তাই তপন সিকদার লিখিতভাবে জানাতে পারেন—তসলিমা তাে বি জে পির কথাই বলছে। তসলিমা নাসরিনের লেখা মেয়েদের মন কতটা পাল্টে দিচ্ছে—আমরা সে কথাও জানি না, তবে অনেকেই যে মজা দেখছে সেটা ঠিক। হিন্দু ও মুসলিম ধর্মে যে পার্থক্য করে না সে যে ধর্ম সম্পর্কে কিছুই জানে না সে অবশ্য আমরা জানি। বিবাহবহির্ভূত অবাধ যৌনসংসর্গ আমাদের দেশে। সংবিধানসম্মতভাবে সম্ভবত একমাত্র পতিতারাই করে থাকেন।…তসলিমা নাসরিনের তৃতীয় স্বামী ছিলেন সাংবাদিক মিনার মামুদ। বিবাহপ্রথার অসারত্ব অনুভব করবার জন্য যাঁকে তিন তিনবার বিবাহিত হতে হয় তাঁর বােধশক্তি সম্পর্কে সন্দেহ জাগতেই পারে। এলিজাবেথ টেলর আরও অনেক বেশিবার বিবাহ করেছিলেন সম্ভবত তিনি বিবাহ প্রথায় এখনও বিশ্বাসীবলেই। একবারও বিবাহ না করে তাকাধ যৌনসংসর্গ চালিয়ে গেলে ক্ষতি কি ছিল। হয়তাে তখন এতটা বিখ্যাত ছিলেন না কিংবা পুরুষদের ওপরে ওঠার ক্ষমতাও কম ছিল।
প্রসঙ্গত, ১৯৮০ সালে প্রকাশিত, ফেমিনিজমের জন্মদাতা মার্কিন, দেশের লেখক সুসাদ গ্রিফিনের ‘উত্তম্যান অ্যাণ্ড নেচার’ (হার্পার অ্যাও রাে) বইটিতে কোনাে অবাধ যৌনসংসর্গবা লিভ-টুগেদার-সর্বস্বতা নেই। ধর্ম-ইতিহাস-মিথলজিরূপকথা-দর্শন-বিজ্ঞানসাহিত্য খুঁড়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছে—কেন নারী ও প্রকৃতিকে এক করে দেখা হবে?
সাম্প্রতিক মাৎস্যন্যায় বা মাফিয়াচক্রের সূক্ষ্ম ও স্থূল অত্যাচারের ও শাসনপ্রিয়তার দিকে আঙুল তুলে না দেখিয়ে যে লেখিকা শুধু নারীর প্রতি পুরুষের অত্যাচারকে বড় করে দেখেন, তাঁর দেখার চোখ নেই। সস্তা হাতছানি পাবার লােভ থাকলে বড় লেখক হওয়া যায় কি? শিল্পের প্রতি সততার কথা নাহয় না-ই তুললাম। বা মুসলিমদের কোনাে অখণ্ড সমাজ এবং অভিজ্ঞ শরিয়ত নেই। মূল ধর্মগ্রন্থ কোরানের নির্দেশসমূহ অত্যন্ত ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। ব্যাখ্যা অনুপাতে মুসলিমরা বহু সম্প্রদায় সম্পন্ন এবং প্রত্যেকের পৃথক শরিয়ত আছে, যেগুলি আবার স্থানীয় লােকাচার ভিত্তিক। আসলে। ইসলামের ইতিহাস ধারাবাহিক অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের রক্তাক্ত ইতিহাস বিশ্বের তথাকথিত মুসলিম সমাজ কোনােদিনই অখণ্ড অবিভাজ্য সত্তা ছিল না। তসলিমা তাহলে ঠিক কোন। ইসলামের বিরােধীতা করেন? বহুবিবাহ বা পর্দানসীনতা—ইসলামের এরকম দু-একটি প্রথার বিরােধাতা তাে হসলাম-বিরােধাতা নয়। নির্বাচিত কলাম-এ তসলিমা লিখছে—‘আমার বড় সংসারের সাধ ছিল। … কোনাে পুরুষ আমাকে সংসার দেয়নি। … কোনাে প্রতারক পুরুষের কাছে সংসারের প্রত্যাশায় আমি বসে থাকিনি। অথচ তিনি নিজেই জানাচ্ছেন প্রত্যেকটি বিবাহ তিনি নিজেই ভেঙে দিয়েছেন। তাঁর তৃপ্তি বা কমপ্লেক্স এই যে—‘আমি সেই জীবন যাপন করছি না যে জীবনে আমার দেবতা-পুরুষ গণিকাসম্ভোগ সেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ঘরে ফিরবে আর আমার উরুতে হাত রেখে স্বভাবদোষে বলে উঠবে ভালােবাসি।’ সব পুরুষই এইরকম নাকি? তসলিমা নাসরিনের অত্যধিক স্বাধীনচেতা মন ও স্বভাব তার নিজস্ব পুরুষদের অতিরিক্ত ক্লান্ত ও ক্ষুব্ধ করে তুলতাে না তাে? তেমন হলে, তসলিমার নিজেরই তাে চিকিৎসা হওয়া দরকার, মিডিয়ার হাতে নিজেকে সঁপে না দিয়ে। কুপ্রথা সব সমাজেই অল্পক্তির থাকে। সে সবের বিরােধীতা করতে গিয়ে স্বাধীনচেতা হওয়ার নামে সন্তানহীন অবাধ যৌনতাকে বেছে নেব—এটাকে ঠিক সুস্থতা বলা যায় কি! তিনি যদি আবার লেখক হন তাহলে তাে ভবিষ্যতের সমাজ কাঠামােটা টিকবে না। লেখকরা নাকি সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। এ ‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু, কারণ বাঙালির বউ-শাশুড়ি বিবাদ দীর্ঘদিনের! তসলিমা জানাচ্ছেন, নারী একই সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক। পুরুষের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে নারীকে নারীর উপর নির্যাতনের হাত প্রসারিত করতে হয়—একই নির্যাতন.সে ভােগ করছে, তার মেয়ে ভােগ করছে, এবং পুরুষতন্ত্র যখন তার হাতের মুঠোয়—সে আরেকজনকে ভােগ করাচ্ছে। এ হচ্ছে একটি আবর্ত। কিন্তু, শাশুড়ি যখন ছেলের বৌকে নির্যাতন করে—তখন ‘পুরুষতন্ত্র তার হাতের মুঠোয়’—এমন স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্ত তিনি নিলেন কী করে! পুরুষেরা কি নারীকে শুধু নির্যাতনই করে!
ধর্ষণের অজস্র রেফারেন্স তসলিমা নাসরিনের রচনার পাতায় পাতায়। বিরক্ত হয়ে তিনি অভিশাপও দিয়েছেন পুরুষদের। নির্বাচিত কলামে বলছো, আমি অভিশাপ দিচ্ছি। …আর খাদ্য নয়, নারী এবার খাদক হােক। পুরুষকে খাদ্য হবার অভিশাপ আজ উচ্চারিত হােক সকল নারীর কণ্ঠে।… নারী ধর্ষণ করতে শিখুক, ব্যভিচার করতে অভ্যস্ত হােক। নারী খাদকের ভূমিকায় না এলে তার খাদ্য’ নামের কলঙ্ক ঘুচবে না।… যেন বাড়িতে চুরি হয়েছে বলে গৃহস্থকে চোর হতে হবে। তাছাড়া, নারী ধর্ষণ করতে শিখবে কি করে? ধর্ষণ করার অস্ত্র তার আছে কি? এ প্রসঙ্গে মানুষের চেতনা আলােকিত করার আহ্বান জানালে কি ভালাে হত না? যাতে ধর্ষণের ইচ্ছাই না হয়, সেরকম সমাজ গড়ার শপথ নিলে? অন্তত নিজের চেতনার আলাে তাে ছড়িয়ে দেওয়া যেত।
তসলিমা নাসরিনের লেখা পড়তে পড়তে মনে হয়, সব দোষ যেন শুধু ছেলেদের। মেয়েদের যেন কোনাে দোষ থাকতে নেই। অথচ আমাদের চারপাশের সংসারে আমরা তাে দুষ্ট পুরুষের চেয়ে দুষ্ট রমণীই বেশি দেখি দুর্ভাগ্যবশত। সংবাদপত্রে ধর্ষণের কথা আজকাল প্রতিদিনই থাকে, সেটা যেমন সভ্যতার লজ্জা—সেইভাবে পাশাপাশি মেয়েদের কুচক্রী অত্যাচারের কথা তেমন থাকে কি! তসলিমা নিজেও কি তাঁর তালাকপ্রাপ্ত স্বামীদের বর্তমান মানসিক অবস্থার কথা কখনাে লিখবেন! আমাদের দেশটা রামমােহন, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগরের দেশ। নারীদরদী হবার জন্য রামমােহন বা বিদ্যাসাগরকে কোনাে নির্বাচিত কলাম বা নষ্ট মেয়ের গদ্য লিখতে হয়নি। সব মেয়েকেই যিনি মা বলতেন তিনি অশিক্ষিত গদাধর থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ হয়েছেন নিভৃত নীরব সাধনায়—কোনাে কলম লিখে নয়। মেয়েদের এতখানি সম্মান পৃথিবীতে আর কেউ দিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তসলিমা এসব কথা ভাবেন
কেন? রবীন্দ্রনাথের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে বিদেশিনী নারী স্বামীজির প্রভাবে নিজেকে আমূল পাল্টে-কলকাতার রাস্তায় প্লেগের সময় জঞ্জাল পর্যন্ত সাফ করতেন তিনিও কোনাে নির্বাচিত বা অনির্বাচিত কলাম লিখতেন বলে আমরা জানি না।
তিন কন্যা বর্তমান থাকতে জনপ্রিয় এক বিজ্ঞানমনস্ক সাহিত্যিক শাহজালালের মাজারে মাথায় টুপি পরে পুত্র প্রার্থনা করেছেন, পেয়েছেন, অতএব তসলিমা নাসরিনের প্রশ্ন ‘কি শিখেছে তার অগুনতি পাঠক এবং তার অসংখ্য গুণমুগ্ধ অনুসারী? শিখেছে এই যে, তিন কন্যা যথেষ্ট নয়, একটি পুত্রই সন্তান হিসেবে সম্পূর্ণ …। শরীরে ও মনে পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠলেও নারীর পঙ্গুত্ব কাটে না।’ … বেশ, ভালাে কথা। নিজের বক্তব্যের সমর্থনে সেই সাহিত্যিকের পুত্রকামনাকে আক্রমণ করে নারীর পঙ্গুত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন তসলিমা। সেই লেখকের মন ও মেধার ওর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মূখ মানুষের ও ডিঙিয়ে সামান্যও উর্ধ্বে ওঠেনি। তা তাে হল। কিন্তু একই অভিযােগ যদি তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে করা হয়? কি শিখছে তার অগুনতি পাঠক এবং ভক্তরা ? রমণীরা সন্তানহীনা হও, বিবাহবহির্ভূত যৌনসংসর্গ করাে—পুরুষদের ধর্ষণ করাে-ধর্মহীনা হও—তাহলেই প্রতিষ্ঠিত হবে পুরুষতন্ত্রের ধারাবাহিক অত্যাচারের যাবতীয় প্রতিবাদ ? হায়! তসলিমা! আপনাকে অনুসরণ করলে পৃথিবী যে শুধু জনশূন্য হয়ে যাবে তাই নয়, যে পুরুষদের বিরুদ্ধে আপনার এত প্রতিবাদ–তাদেরও কী অনেক সুবিধে হয়ে যাবে না শেষ পর্যন্ত।
নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য নামকরণে যেমন অভিমানের আর্তি, উচ্চারণেও তেমনি নারী শুদ্ধ হওয়ার প্রথম শর্ত নষ্ট হওয়া। নষ্ট না হলে নাকি এই সমাজের নাগপাশ থেকে কোনাে নারীর মুক্তি নেই। ইস্, কি হবে তাহলে! সুস্থ ও মেধাবী হতে হলে যে কোনাে নারীকে আগে নষ্ট হতে হবে। মুক্তি, সুস্থতা, মেধাবী—এসব কি করে পেতে হয় সেসব কথা এতদিন তাহলে ভুল জানতাম।
এই নষ্ট অবশ্য অন্যরকম। নিজেকে এই সমাজের চোখে নষ্ট বলতে আমি ভালােবাসি। কারণ, তিনি অনুভব করেছে, যদি কোনাে স্বাধিকার সচেতন নারী মােচন করতে চায় নিজের দুঃখ-দুর্দশা, ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে ওঠে প্রতিবাদে সঙ্গে সঙ্গে সমাজের তথাকথিত ভদ্রলােকেরা নাকি তাকে নষ্ট’—এই উপাধি দিয়ে দেয়। অতএব নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য’—পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অবমূল্যায়ন বিষয়কে শাণিত রচনা। কিরকম?
- (১) পুরুষ ভাবে সে তার মাংসল পেশি, এবং চার ইঞ্চির পুরুষাঙ্গ দিয়ে পৃথিবী জয় করেছে। … চার ইঞ্চির বাহাদুরি যথেষ্ট হয়েছে। এবার বাপু রাস্তা মাপাে। … (পৃঃ ১০৬ আনন্দ)
- (২) বেশ্যারা সাজে অসামাজিক খদ্দেরের আশায়, আর ভদ্র নারীরা সাজে সামাজিক খদ্দেরের আশায়—দু’সাজের উদ্দেশ্যই খদ্দের পাওয়া। (পৃ ১১)
- (৩) আমি এমন নারী-চিত্রকর দেখতে চাই যে চিত্রকর পুরুষের সুঠাম বাহু, পুরুষের নিতম্ব, ঊরু ও পুরুষের যৌনাঙ্গের ছবি আঁকবে।… পুরুষ মডেল নারী-আর্টিস্টের সামনে উলঙ্গ হয়ে বসবে, নারী-আটিস্ট তাদের ছবি আঁকবেন, মূর্তি গড়বেন এবং সবশেষে পুরুষমডেলদের তঁারা ভোগ করবেন—এই ঘটনা কেন ঘটছে না? … (পৃঃ ২৮)
- (৪) নারীর যেমন কোনাে স্বাধীনতা নেই, নারীর জরায়ুরও নেই। ইত্যাদি। এই যদি শাণিত গদ্য হয়, তাহলে বলার কিছু নেই। প্রকৃত স্বাধীনতা কাকে বলে, তা না জেনে অযথা স্বাধীনতা নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করলে এর বেশি কিছু হবার কথা নয়। জরায়ুর স্বাধীনতা চাইলে আলাদা কথা। অসৎ উদ্দেশ্যে ধর্মের দিকে তাকালে যেমন ধর্মের সম্পর্কে কিছু জানা যায় না, সাহিত্যের বা শিল্পের ব্যাপারেও তাই। পাবলিক খাবে’— জাতীয় কথাবার্তা লিখলে পাবলিক খায় ঠিকই ফরাসী টিভি ডেকে নিয়ে গিয়ে তথ্যচিত্রও নির্মাণ করে—কিন্তু, কতদিন?
শুধু একটা কথা বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখে তাে আর লেখক হওয়া যায়না। |
(সৌজন্যে সংবাদ প্রতিদিন, ১৫ই আগষ্ট ১৯৯৮)
তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে জানতে নিচের লেখাগুলিও পড়ুন,
১) তসলিমার রচনা যৌন-অতৃপ্ত নারীর আত্মবিলাপ
২) কুরআনের বিরুদ্ধে নাস্তিক তসলিমা নাসরিণ এর মিথ্যা অপবাদ ও তার খণ্ডণ
৩) ধর্ষনের বদলে ধর্ষনঃ তসলিমা নাসরিনের এই কথাটা কতখানি যুক্তিযুক্ত?
৪) লেখিকা হিসেবে তসলিমা অত্যন্ত কাঁচা
৫) তসলিমার লেখালেখি নারী প্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে
৬) বি জে পির বক্তব্য তুলে ধরেছেন তসলিমা
৭) Western media is using the Taslima Nasreen affair to malign Islam
৮) Taslima Nasreen’s case is being used to denigrate Islam
৯) Taslima Nasreen is an Ignorant Writer of Obscene
১০) Facts about writer Taslima Nasreen
১১) Facts about Taslima Nasrinn not correctly presented
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।