লিখেছেনঃ কল্যাণকুমার সরকার
ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও ভারতীয় মুসলমান সমাজের আধুনিকতামুখী অগ্রগতির অগ্রপথিক ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। তিনি ১৮১৭ সালে ১৭ই অক্টোবর দিল্লি শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতৃপুরুষগণ মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে এসে এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং মধ্যযুগের ভারতবর্ষে বিখ্যাত মোগল সম্রাটগণের অধীনে উচ্চপদে কর্মরত হন। ১৮৩৭ সালে সৈয়দ আহমদ খান ভারতস্থ ব্রিটিশ সরকারের অধীনে সরকারী চাকুরীতে নিযুক্ত হন। এবং এরপর তাঁর কর্মকুশলতা, দক্ষতা ও প্রাজ্ঞতার ভিত্তিতে ধীরে ধীরে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের উত্তরপশ্চিম অঞ্চলের সাবজজ পদে উন্নীত হন। এদিকে ১৮৫৭ সালে ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হলে সৈয়দ আহমদ একজন পদস্থ ইংরাজ কর্মচারী হিসাবে ইংরাজ সরকারকে প্রভূত সাহায্য করেন। এই সময়ে তিনি বিজনুরে সদর আমিন পদে নিযুক্ত ছিলেন। এই বিদ্রোহ চলাকালে তিনি বিদ্রোহের বিপক্ষে গিয়ে ববং বিদ্রোহকে দমন করার কাজে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি পরম আনুগত্য দেখিয়ে সরকারকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। বিনিময়ে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে পুরস্কৃত হন।
কিন্তু লক্ষ করার বিষয় হল এই যে, সৈয়দ আহমদ কিন্তু ব্যক্তিগত পুরস্কারের আশায় ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত ছিলেন না। বরং তিনি ব্রিটিশ সরকারের প্রতি পরম আনুগত্য দেখিয়ে ছিলেন ভারতীয় মুসলমান সমাজের উন্নতির স্বার্থেই। সেইসময়ে ভারতবর্ষে শিক্ষাসংস্কৃতি আর্থনীতি রাজনীতিতে এগিয়ে থাকা হিন্দু সমাজের তুলনায় মুসলমান সমাজ যথেষ্ট পিছিয়ে ছিল এবং ইংরাজী শিক্ষায় অনাগ্রহী ও ঐতিহ্যবাহী ইসলামিক শিক্ষায় অনুরাগী ভারতীয় মুসলমান সমাজ চরম দুরবস্থা, হতাশা ও মর্মবেদনায় নিমজ্জিত হয়েছিল। তার ২ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে সংখ্যার দিক থেকে মুসলিম জনগণের অংশগ্রহণের আধিক্যের কারণে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় মুসলমান সমাজকেই মূল অপরাধী বলে সাব্যস্ত করেছিল। এর ফলে ভারতীয় মুসলমান সমাজের অবস্থা যথেষ্ট করুণ হয়ে উঠেছিল। এরফলে ভারতীয় মুসলমান সমাজের এইরকম করুণ ও অসহায় অবস্থায় পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সৈয়দ আহমদ। তিনি ইংরাজ সরকার ও ভারতীয় মুসলমান সমাজের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করে সরকার কর্তৃক ভারতীয় মুসলমান সমাজের উন্নতি সাধনের কাজে নিমগ্নভাবে ব্রতী হন।
স্যার সৈয়দের এই দ্বিমুখী কর্মপ্রয়াসের ফল হাতেহাতেই পাওয়া গিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারও এবার তার হিন্দুপ্রবণ মানসিকতা ছেড়ে বেরিয়ে এসে মুসলমানপ্রবণ মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে। হিন্দুরা শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিতে এগিয়ে থাকায় তারাই যে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিপ্লবের মূলে রয়েছে – একথা সরকার ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করে এবং এর ফলশ্রুতিতে সরকার স্বাভাবিকভাবেই সৈয়দ আহমদের মুসলিম আনুগত্যের প্রতিশ্রুতির পটভূমিকায় ভারতীয় মুসলিম সমাজের প্র সহানভুতি সম্পন্ন হয়ে উঠতে থাকে। আর এর ফলেই সৈয়দ আহমদের কাঙিক্ষত মুসলিম সমাজের উন্নয়ন এবার ব্রিটিশ সরকার ও ত্বরান্বিত হতে শুরু করে।
এমত বৌদ্ধিক উৎকৰ্ষকতামূলক কর্মপ্রয়াসের পটভূমিক আহমদ ভারতীয় মুসলিম সমাজের দুর্দশা দূর করতে তৎপর ওঠেন। প্রথমেই তিনি ভারতীয় মুসলমান জন – শিক্ষা ও পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রবর্তন ঘটাতে সচেষ্ট হন। এই লক্ষ্যে তিনি ১৮৬৪ সালে গাজীপুরে মুসলমানদের জন্য একটি ইংরাজী স্কুল প্রতিষ্ঠা করান। অনেক প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান ইংরাজী গ্রন্থকে তিনি মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা উর্দুভাষায় অনুবাদ করেন এবং মুসলমান জনগণের মধ্যে সেইসব মূল্যবান অনুবাদিত গ্রন্থ প্রচার ও বিতরণ করার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞান সমিতি (Scientific Society) নামক একটি সংস্থা গঠন করেন।
এদিকে ১৮৬৯ সালে সরকারী পদে কর্মরত থাকাকালে তিনি ইংলন্ড সফরে যান। সেখান থেকে তিনি আরও গভীরভাবে ইংরাজী শিক্ষা সংস্কৃতি, আদব কায়দায় ও চিন্তা ভাবনায় রপ্ত হয়ে ১৮৭০ সালে ভারতে ফিরে আসেন। ভারতে ফিরে এসেই তিনি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ইংরাজী ভাবধারা ও শিক্ষা সংস্কৃতি প্রসারে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি তহজিব উল আখলাদ (Tahzibul Akhlad বা Social Reformer) নামক একটি মুসলিম পত্রিকা এবং কমিটি ফর এ্যাডভান্সমেন্ট অফ লার্নিং (The Committee for Advancement of learning) নামক একটি সংস্থা গঠন করে তাদের মাধ্যমে ভারতীয় মুসলমানদের মনে ইংরাজ ভীতি ও পাশ্চাত্য ভীতিকে দূর করতে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
এরকম কর্মমুখী অবস্থায় ১৮৭৬ সালে সৈয়দ আহমদ সরকারী চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং অবসর গ্রহণের পর থেকে ভারতীয় মুসলিম সমাজের সার্বিক উন্নতি সাধনে তিনি সর্বান্তঃকরণে আত্মনিয়োগ করেন। এদিক থেকে তিনি ১৮৭৭ সালে ইংলন্ডের কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাঁচে আলিগড়ে মােহামেডান এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ (Mahammedan Anglo Oriential College) প্রতিষ্ঠা করেন। এই কলেজে তিনি ইংরাজ অধ্যক্ষ (Prinicipal) মি. থিয়োডর বেক মহাশয়ের তত্ত্বাবধানে মুসলমান থাএদের আধুনিক বিজ্ঞান, কলাশাস্ত্র অধ্যয়নের ব্যবস্থা করে তাদের পাশ্চাত্যমুখী ও ইংরাজীবণ শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স (Mahammedan Educational Conference) নামক একটি মুসলিম সংস্থা গঠন করে মুসলিম ছাত্রসমাজে ইংরজী ভাবধারা ও পাশ্চাত্যমুখী উদারনৈতিক মানসিকতা বিস্তারে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী হন।
তবে আলিগড় এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সৈয়দ আহমদ ভারতীয় মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য যে আলিগড় আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেই আন্দোলনই তাকে ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই তিনি একদিকে যেমন ভারতে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ উদারনৈতিক শিক্ষার প্রবর্তন করেন, তেমনি অন্যদিকে ইসলাম ধর্মকেও মহিমান্বিত করে তোলেন এবং ভারতীয় মুসলমান সমাজকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। ডঃ বিশ্বনাথ প্রতাপ ভার্মা বলেছেন, “Syed Ahmad wanted to give pride of place both to secular modern education and to Islamic ideology” বা সৈয়দ আহমদ ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক শিক্ষা এবং ইসলামীয় আদর্শ উভয়কেই গৌরবজনক স্থান দান করতে চেয়েছিলেন (Dr. V. P. Varma, Modern Indian Political Thought, Agra, 2002 P. 423)
স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রথমে উত্তর পশ্চিমে সরকারের ব্যবস্থাপক সভার সভ্য হন এবং পরে ১৮৭৮ সাল থেকে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত সময়ে বড়লাটের ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদে রত ছিলেন। ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসাবে তিনি যথেষ্ট জনহিতকর কাজ করেন। ১৮৮৮ সালে তিনি কে. সি. এস. আই (K.C.S.I.) উপাধি লাভ করেন। ১৮৯৮ সালের ২৭শে মার্চ তারিখে তিনি পরলোক গমন করেন। তিনিই ছিলেন ভারতীয় মুসলমান সমাজের অগ্রগতির পথ প্রদর্শক এবং অগ্রদূত সুলভ অগ্রণী চিন্তানায়ক, সন্দেহ নেই।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, নিজের সমগ্র কর্মজীবনের যাবতীয় কর্মপ্রয়াসের মাধ্যমে সৈয়দ আহমদ ভারতীয় মুসলিম সমাজের মধ্যে আধুনিক প্রগতিশীল উদারনৈতিক ভাবধারা সঞ্চারিত করেন এবং তার মাধ্যমে এই সমাজের আধুনিকীকরণ তথা আধুনিক জীবনচিন্তায় সমৃদ্ধ করে তোলেন। এখানেই নিহিত রয়েছে স্যার – সৈয়দ আহমদ খানের কর্মমুখর জীবনের সুমহান ঐতিহাসিক তাৎপর্য।
আধুনিক ভারতের জনক মহাত্মা রামমোহন