১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগাে ধর্মসভায় স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাব বাঙালির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। বঙ্গভঙ্গ এর আগে ১৮৩১-১৮৩৩ পর্বে রামমােহন রায় ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবী মহলে গভীর আলােড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু বিবেকানন্দের বক্তৃতার প্রভাব বিস্তৃত হয় বুদ্ধিজীবী মহলের বাইরে—মার্কিন সমাজের ব্যাপকতর ক্ষেত্রে, সাধারণ মানুষের মধ্যে। তিনি ধর্মসভার উদ্বোধনী ভাষণের শেষের দিকে বলেছিলেন যে, ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল ধরে বহুবার মানব রক্তে সিক্ত করেছে ও সভ্যতা ধ্বংস করেছে। সবশেষে বিবেকানন্দ বললেন,
“আমি সর্বতােভাবে আশা করি যে, এই ধর্মসমিতির সম্মানার্থে আজ যে ঘন্টাধ্বনি নিনাদিত হইল, উহা সর্ববিধ ধমোন্মত্ততার, তরবারি অথবা লেখনীমুখে অনুষ্ঠিত সর্ববিধ নির্যাতন পরম্পরার এবং একই লৰ্যের দিকে অগ্রসর ব্যক্তিগণের মধ্যে সর্ববিধ অসদ্ভাবের সম্পূর্ণ অবসান বার্তা ঘােষণা করিবে।”
স্বাভাবিকভাবেই প্রণ উঠতে পারে, কারও নাম উল্লেখ না করে বিবেকানন্দ সভ্যতা বিনাশকারী ও মানব হত্যাকারীরূপে কোন ধর্মোন্মত্তদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন? কাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন তা অস্পষ্ট রেখে কাদের প্রতি ইঙ্গিত করেননি তা তিনি পরবর্তীকালে স্পষ্ট করে বলেছেন। ১৮৯৭ সালে দেশে ফিরলে বিবেকানন্দকে বহু সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং তিনি সংবর্ধনাগুলিতে যে ভাষণ দেন তা ‘ভারতের ভবিষ্যৎ’—নামে সংকলিত। এই ভাষণে ভারতের অতীত সম্বন্ধেও বহু কথা তিনি বলেছেন। তিনি বলেছিলেন যে, এক সময়ে ভারতে ব্রাহ্মণদের একাধিপত্য ছিল এবং তাদের সেই একাধিপত্য ভেঙেছে মুসলমানরা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন,
“মুসলমানের (ভারত) অধিকার দরিদ্র পদদলিতদের উদ্ধারের কারণ হইয়াছিল। এই জন্যই আমাদের এক পঞ্চমাংশ ভারতবাসী মুসলমান হইয়া গিয়াছিল।”
অন্যত্র স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন,
“ভারতবর্ষে দরিদ্রদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা এত বেশী কেন? একথা বলা মুখত যে, তরবারির সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তর গ্রহণে বাধ্য করা হইয়াছিল।…বস্তুত জমিদার ও পুরােহিত বর্গের হস্ত হইতে নিস্কৃতি লাভের জন্যই তাহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিলেন।”
কথায় বলে, চোরের মায়ের গলার জোর বেশি। যারা জোর পূর্বক আফ্রিকা-অষ্ট্রেলিয়া-আমেরিকা-নিউজিল্যান্ডে স্থানীয় বাসিন্দাদের ধর্ম-সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে তারাই (ব্রিটিশরা) সবচেয়ে বেশি করে প্রচার করেছে যে, মুসলিম শাসকরা এক হাতে কোরআন অন্যহাতে অস্ত্র নিয়ে ইসলাম প্রচার করেছে। কোনও কোনও মুসলিম শাসক নিশ্চয়ই অনেককে মুসলমান করেছিল। কিন্তু কতজনকে করেছিল? এবং কবে করেছিল? এবং কোন কোন অঞ্চলে করেছিল? কতটা ইতিহাস, কতটা কল্পভাষ? ঐতিহাসিক জগদীশ নারায়ণ সরকার লিখেছেন,
“প্রচলিত বিশ্বাস এই যে, বিজেতা এক হস্তে তরবারি ও অন্য হস্তে কোরআন লইয়া ইসলামের ধর্মের প্রসার ঘটাইয়াছিল। কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণরূপে সত্য নহে।”
এইচ বেভারলি ১৮৭২-এর আদমশুমারির প্রতিবেদনে বলেছিলেন, বাংলার অধিকাংশ মুসলমানই হিন্দু সমাজের নিম্নশ্রেণি থেকে উদ্ভূত। ঢাকার সিভিল সার্জেন্ট জেমস ওয়াইজ মনে করেন, বাঙালি মুসলমানরা মুঘল বা পাঠান বংশােদ্ভূত নন, প্রকৃতপথে তাঁরা ধর্মান্তরিত হিন্দু। ডব্লিউ ক্রুক সম্পাদিত ‘দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে স্যার হার্বার্ট রিজলিও বাংলার মুসলমানরা বাঙালি হিন্দু সমাজের নিম্নশ্রেণি থেকে উদ্ভূত করেছেন। কিন্তু তিনি বলপ্রয়ােগ তত্ত্বের অবতারণা করেননি। তাঁর মতে, হিন্দু সমাজের বর্ণবৈষম্যের ফলে সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের উদ্দেশ্যে অনেক বাঙালি হিন্দু-ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেছিলেন।
ঐতিহাসিক আব্দুল করিম অবশ্য বাংলার বৌদ্ধ-হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পশ্চাতে বহিরাগতদের পাশাপাশি মুসলিম শাসক, উলেমা এবং সুফিদের ভূমিকা উল্লেখ করেছেন। আব্দুল করিমের বক্তব্য থেকে জানা যায়, বাংলা খলজি-তুর্কি, ইলবারি-তুর্কি এবং খুরানা-তুর্কিদের দ্বারা বিজিত হয়েছিল। তার ফলে দফায় দফায় বাংলায় বিদেশ থেকে মুসলমান অভিযাত্রীদের আগমন ঘটে। এই প্রসঙ্গে তিনি সমরখন্দ, বুখারা, আরব, হীরাট, কান্দাহার, বাগদাদ, আবিসিনিয়া, মুলতান, বদায়ুন, লাহাের, কাঠেীর থেকে এদেশে বিভিন্ন সময়ে মুসলমানদের আগমনের কথা উল্লেখ করেছেন। অবশ্য একথাও স্বীকার করতে হবে যে, বহিরাগত মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকেই এদেশে বিয়ে করেছেন এবং তাদের সন্তানদি এই ভূভাগে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। ১৯০১-এর আদমশুমারির প্রতিবেদন লক্ষ্য করে গেইট বলেছেন যে, বলপূর্বক ধর্মান্তকরণের ঘটনা খুব অল্প না হলেও একথা অনায়াসেই বলা যায় যে, বাঙালি মুসলমানদের পূর্বপুরুষরা অনেকেই স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। গেইটের মতে, ইসলাম ধর্মের গুণাবলিই বাংলায় ইসলাম ধর্মের বিস্তৃতির প্রধান সহায়কের কাজ করেছিল। কারণ ওই গুণাবলি একদিকে বুদ্ধিদীপ্ত বাঙালি হিন্দুদের মুগ্ধ করে ওই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।
নৃতাত্ত্বিকরা মনে করেন, বাংলার সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে বিদেশি উপাদান খুবই সামান্য। বেশিরভাগ বাঙালি মুসলমান গ্রামবাংলার কৃষকশ্রেণি থেকে উদ্ভূত, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের সংখ্যাগত ভৌগােলিক অবস্থান থেকে। যমুনা, পদ্মা, মেঘনা নদীর পূর্বাঞ্চলে, মেঘনা-সুরমা ভ্যালি অঞ্চলে, গাঙ্গেয় বদ্বীপের মধ্য ও নিম্নাঞ্চলে মুসলমানদের বিরাট সংখ্যাধিক্য দেখা যায়, আবার ঐসব অঞ্চল বাঙালি হিন্দু মাহিষ্য, পােদ ও নমশূদ্রদের দ্বারা অধ্যুষিত। নৃতাত্ত্বিকরা ওই সব অঞ্চলের হিন্দুমুসলমানদের মধ্যে নৃতত্ত্বগত সাদৃশ্য লক্ষ্য করে উভয়ের উৎপত্তিগত উপাদান যে এক সে বিষয় নিঃসন্দেহ হয়েছেন। বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক অসীম রায় তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন, কীভাবে দুর্গম অঞ্চলে সুফি-পিরদের দ্বারা ইসলাম ধর্মের বিস্তার সম্ভব হয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে ইসলামের প্রচার এ সব সাধুসন্ত পির-ফকিরদের মাধ্যমেই হয়েছে অর্থাৎ আমীর ওমরাহ রাজা বাদশাহের চেয়ে ধার্মিক মুসলিমরাই ইসলামের ব্যাপক প্রচার অধিকতর সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছেন। যে কোনও কারণেই হােক, ভারতীয়দের মনে এই একটা ভুল ধারণা আছে যে এক হাতে কোরআন আর অন্য হাতে কৃপাণ নিয়ে এদেশে ইসলামের প্রচার করা হয়েছে, কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে, মুসলমানের কৃপাণ যেখানে সবচেয়ে প্রচণ্ড ছিল সেই দিল্লি আগ্রা অঞ্চলের চেয়ে ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে যেমন সিন্ধু, পাঞ্জাব, কামীর, কেরল, বিহার, বাংলা প্রভৃতি অঞ্চলে অর্থাৎ যে অঞ্চলে অস্ত্র প্রদর্শনের অনুকূল পরিস্থিতি ছিল না সেসব অঞ্চলেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বেশি এবং কৌতূহলােদ্দীপক ব্যাপার এই যে, কেরল বাদ দিয়ে ভারতে মুসলিম শক্তির কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী সেসব অঞ্চলেই ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত যেসব অঞ্চলে একদা বৌদ্ধরা বিশেষ প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। কেরলে ইসলামের প্রভাব বিস্তৃত হয় আরব বণিকদের দ্বারা। যদি এক হাতে কোর আন আর অন্য হাতে কৃপাণ নিয়ে মুসলিমরা তাদের ধর্ম প্রচারে বের হত তাহলে তার প্রবণতা হত মুসলিম শক্তির কেন্দ্রের অধীন অঞ্চলকে অধিকতররূপে ইসলামের আদর্শাধীন করা, তার পরিবর্তে প্রবণতাটা যখন কেন্দ্রকে নয়, পরিধিতে অর্থাৎ যেসব অঞ্চল পরিধির অন্তর্গত বা সীমান্তবর্তী সেগুলােকেই ইসলামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার দিকে তখন ইসলামের প্রসারের কারণ হিসাবে অস্ত্র শক্তির প্রয়ােগ ছাড়া অন্যতর কারণেরই কথাই চিন্তা করতে হয়। অন্যতর কারণের যথার্থ এই যে, নিরস্ত্রভাবেই মুসলিম ধার্মিকরা এদেশে ইসলামের প্রচারে প্রথম আসতে শুরু করেছিলেন।
[২]
ইতিমধ্যে ১৯০১ সালে ধর্মের ভিত্তিতে বাংলার জনবিন্যাসের রূপটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। শহরে শিক্ষিততসম্পন্ন মানুষদের মধ্যে হিন্দুরাই প্রধান আর গ্রামের নিরক্ষর দরিদ্র মানুষদের মধ্যে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাঙালি সমাজের এই দ্বিখন্ড রূপের ভিত্তিতেই লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আইনকে কার্যকর করলেন। কার্জন প্রণীত বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় বাঙালি সমাজে প্রবল আলােড়নের সৃষ্টি হয়। বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রবল ও সুপরিকল্পিতভাবে আত্মপ্রকাশ করে। “বঙ্গভঙ্গ প্রতিরােধ আন্দোলনের নেতারা ইংরেজ রাজত্বের উচ্ছেদের পরিকল্পনা করেননি। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সীমাবদ্ধ। এবং বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় তখনকার মত ইংরেজ সরকারের অহমিকাতে আঘাত লাগা ছাড়া আর কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু ক্ষতি হয়েছিল মুসলমানদের এবং সেই হেতু ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ প্রতিরােধ আন্দোলন নিঃসন্দেহে মুসলমান বিরােধী ছিল।” আম্বেদকর তাই লিখেছেন,
“The opposition to the partition of Bengal on the part of the Bengali Hindus was due principally to their desire not to allow the Bengal Musalmans to take their place in Eastern Bengal. Little did the Bengali Hindus dream that by opposing partition and at the same time demanding Swaraj they were preparing the way for making the Musalmans the rulers of both Eastern as well as Western Bengal.”
কলকাতা কেন্দ্রিক তৎকালীন রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের একাংশের মনে হয়েছিল যে, নতুন প্রদেশ সৃষ্টির ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। এটা সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থবুদ্ধির কাছে ছিল একেবারেই অসহনীয়। ‘ভারত সভা’-র প্রতিষ্ঠাতা, কলকাতার শীর্ষস্থানীয় নেতা ও বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বিষয়টি রাখ-ঢাক ছাড়াই প্রকাশ করেছেন। তাঁর ভাষায়,
“For it was openly and officially given out that Eastern Bengal and Asam was to be a Mohamedan Province; and that credal destinctions were to be recognised as the basis of the new policy to be adopted in the Province.”
স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গভঙ্গ প্রতিরােধ আন্দোলনের সাফল্য সাধারণভাবে মুসলমানদের মনকে পীড়িত করেছিল একথা অস্বীকার করে লাভ নেই। হিন্দু জনসাধারণের প্রবল আন্দোলনে বঙ্গ-বিভাগ রদ হওয়ার সম্ভাবনায় মুসলমানদের মনে যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল তারই ফলে কিছু অবাঙালি মুসলমানের প্রচেষ্টায় ১৯০৬ সালে বাংলায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে র কিছু মুসলমান নেতা বঙ্গ বিভাগের প্রতিবাদ করে ছিলেন কিন্তু তার কারণ ছিল এই যে, তাদের ভয় ছিল পশ্চিমবঙ্গে তারা সংখ্যালঘু হয়ে হিন্দুদের দয়ার উপর পড়ে থাকবেন। তবে পূর্ববঙ্গের প্রায় সকল বিখ্যাত মুসলিম নেতা বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন।
বঙ্গভঙ্গ প্রতিরােধ আন্দোলনের প্রতি বাংলার সাধারণ মুসলমান যে বিমুখ ছিলেন সে সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ সুস্পষ্টভাবে বহুবার লিখেছেন। তিনি লিখেছেন,
“বঙ্গ-বিচ্ছেদ ব্যাপারটা আমাদের অন্নবস্ত্রে হাত দেয় নাই, আমাদের হৃদয়ে আঘাত করিয়াছিল। সেই হৃদয় যতদূর পর্যন্ত অখন্ড ততদূর পর্যন্ত তাহার বেদনা অপরিচ্ছন্ন ছিল। বাংলার মুসলমান যে এই বেদনায় আমাদের সঙ্গে এক হয় নাই তাহার কারণ তাহাদের সঙ্গে আমরা কোন দিন হৃদয়কে এক হতে দিই নাই।”
রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন,
“হিন্দু মুসলমানের পার্থক্যটাকে আমাদের সমাজে আমরা এতই কুশ্রীভাবে বে-আব্রু করিয়া রাখিয়াছি যে, কিছুকাল পূর্বে স্বদেশী অভিযানের দিনে একজন হিন্দু স্বদেশী প্রচারক এক -স জল খাইবেন বলিয়া তাহার মুসলমান সহযােগীকে দাওয়া হইতে নামিয়া যাইতে বলিতে কিছু মাত্র সংকোচ বােধ করেন নাই। কাজের ক্ষেত্রে প্রতিযােগিতা বশে মানুষ মানুষকে ঠেলিয়া রাখে, অপমানও করে, তাহাতে বিশেষ ক্ষতি হয় না।…কিন্তু সামাজিকতার স্থলে কথায় কথায় কাহারও গায়ে পা ঠেকাইতে থাকিলে তাহা ভােলা শক্ত হয়। আমরা বিদ্যালয়ে আপিসে প্রতিযােগিতার ভিড়ে মুসলমানকে জোরের সঙ্গে ঠেলা দিয়াছি, সেটা সম্পূর্ণ প্রীতিকর নহে তাহা মানি, তবু সেখানকার ঠেলাঠেলিটা গায়ে লাগিতে পারে, হৃদয়ে। লাগে না। কিন্তু সমাজের অপমানটা গায়ে লাগে না, হৃদয়ে লাগে।”
এই বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলন ও তার জন্য সৃষ্ট স্বদেশী-বয়কট আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সে সময় দেশে যে সন্ত্রাসবাদের প্রসার ঘটেছিল, তার একটি বিপজ্জনক পরিণতি প্রকট হয়ে উঠেছিল, সেটা হচ্ছে সাধারণভাবে বেশিরভাগ সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের অবিমিশ্র মুসলমান-বিরােধিতা। মুজাফফর আহমেদ তাঁর লেখা ‘কমিউনিস্ট পার্টি ও আমার জীবন’ বইতে উল্লেখ করেছেন যে, সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের আদি প্রতিষ্ঠান অনুশীলন সমিতির মূল প্রচারপত্রে লেখা ছিল মুসলমানদের দাবিয়ে রাখতে হবে। আবুল কালাম আজাদের বই ‘ইন্ডিয়া উইনস্ ফ্রিডম’-এ একথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। তিনি লিখেছেন,
“The Revolutionary groups were recruited from the Hindu Middle Class. In fact, all the revolutionary groups were actively anti-Muslim” G518911 points foc31f260a, “Revolutionary terrorism failed in one vital matter-it could not enlist active Muslim support.”
এক চিঠিতে মতিলাল নেহেরু জওহরলালকে বলেছিলেন, “দুভার্গ্যবশত বাঙালি রেভনিউশনারিরা চরমভাবে সাম্প্রদায়িক।” (এ বাঞ্চ অফ ওল্ড লেটার্স দেখুন)। অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা যে হিন্দু সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের উদগাতা ছিলেন সে বিষয়ে সাহিত্যিক গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরি তাঁর ‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার স্বদেশী যুগ’ বইতে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তাই বলি “সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের অনেকেই অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কেউ কেউ প্রাণও দিয়েছেন, কিন্তু সমগ্রভাবে বলতে গেলে এঁরা অন্ধ মুসলমান-বিরােধিতার পথ দিয়ে সারা দেশে সাম্প্রদায়িকতার উগ্র বিষ ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন।” বিখ্যাত বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাই আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “হিন্দুরা স্বদেশপ্রীতি ও স্বধর্মপ্রীতিকে পৃথক করে দেখেনি, এবং এই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মনােবৃত্তির ফলে পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ধর্মীয় প্রভাব দেশের বৃহত্তর স্বার্থের সমূহ ক্ষতি করেছে।” অচিরে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের গভীরে নিহিত সমস্যাটাকে তথা সত্যটাকে প্রত্যক্ষ করে আন্দোলনের আয়ােজনে উন্মত্ত না হয়ে (বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে তিনি কর্ণধারের ভূমিকায় এগিয়ে এসেছিলেন) সরে গেলেন মহানগরীর কোলাহল থেকে শান্তিনিকেতনে। স্বভাবতই কলকাতার বাঙালি বাবু সম্প্রদায় রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিকোণ থেকে দেশজ সত্যকে বােঝবার চেষ্টা করেনি এবং সম্ভবত বেশিরভাগেরই সেরকমভাবে বােঝবার ক্ষমতাও ছিল না। সেই সুযােগে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার আনাগােনা শুরু হল। স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের যুগে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার আর্বিভাবের পিছনে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পরম্পরা অথবা কার্য-কারণ সম্পর্ক দেখেছেন।
[৩]
বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলনের প্রথম দিকে মুসলমানরা এতে অংশগ্রহণ করেছিল। আবদুর রসুল, আবুল কাসেম, আবদুল হালিম গজনভী, লিয়াকত হােসেন, আবদুস সােবহান চৌধুরী, খাজা আতিকুল্লা, খান বাহাদুর মহম্মদ ইউনুস, মুজিবর রহমান, ইসমাইল হােসেন সিরাজী প্রভৃতি নেতারা পরবর্তীকালেও বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।
‘অ্যান্টি-সার্কুলার সােসাইটি’র অন্যতম সদস্য লিয়াকত হােসেন ১৯০৫ সালে প্রতিদিন বিকেলে কলেজ স্কোয়ারে ছাত্রদের নিয়ে শােভাযাত্রা বের করতেন এবং উত্তর কলকাতার রাস্তাগুলি ঘুরে প্রচার করতেন স্বদেশীর আদর্শ। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে তিনি প্রায় প্রত্যেকটি সভায় উপস্থিত থাকতেন এবং বয়কট আন্দোলনের পক্ষে বক্তব্য দিতেন। স্বদেশী ভাবপ্রচারের জন্য তাকে কারাদন্ডও ভােগ করতে হয়েছিল। আব্দুল গফুর ও আবুল হােসেনও স্বদেশী প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন।
তবুও গােড়া থেকেই মুসলমানদের একটা বড় অংশ বঙ্গ বিভাগের পক্ষে ছিল। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন শহরে বঙ্গভঙ্গের পথে মিটিং-মিছিল হয়। ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর যেদিন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়, সরকারের সঙ্গে সহযােগিতার জন্য সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের নিয়ে ঢাকায় ‘মহামেডান প্রভিন্সিয়াল অ্যাসােসিয়েশন’ স্থাপিত হয়। স্থানীয় আঞ্জুমানগুলিও এগিয়ে আসে। বঙ্গ বিভাজন বজায় রাখার জন্য আন্দোলন চলতে থাকে।
বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গের শিক্ষিত মুসলমানরা পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে কলকাতার অগ্রণী হিন্দুদের প্রতিযােগিতা থেকে মুক্তি পেয়েছিল। দ্বিতীয়ত, নতুন প্রদেশে তাদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে চাকুরি দেওয়া হচ্ছিল। ফলে নতুন প্রদেশের শিতি মুসলমানদের একটা বড় অংশ নিজেদের স্বার্থেই বিভাগের সমর্থক হয়ে পড়েছিল। নবগঠিত প্রদেশে মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কাজেই সেখানে তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
সলিমুল্লাহ এবং মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য বঙ্গ ভঙ্গের সমর্থনে এবং বর্জন ও স্বদেশী আন্দোলনের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ করেছিলেন। তারা হিন্দুদের স্বদেশী আন্দোলনের প্রতিবাদে মুসলমানদের মধ্যে ‘স্বজাতি আন্দোলন’-এর ডাক দিয়েছিল। বহু পুস্তিকা ও ইস্তেহার বিলি করা হয়েছিল। এই ইস্তেহারগুলির কিছু কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক। যেমন ময়মনসিংহের ইব্রাহিম খাঁর ‘লাল ইস্তেহার’ (১৯০৭)। তার আবেদন—
“হে মুসলমানগণ! জাগরিত হও। তহবিল সংগ্রহ কর। জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপন কর।…জাতীয় কারবার খােল, হিন্দু দোকান হইতে কোন বস্তু ক্রয় করিও না। শিল্পশিক্ষা কর, হিন্দুর শিল্পজাত দ্রব্য স্পর্শ করিও না। হিন্দুকে চাকুরি দিও না। হিন্দুর বাড়ীতে নিকৃষ্ট চাকুরি করিও না। হিন্দুর কুসংস্কারে আবদ্ধ হইয়া জাতিগত ব্যবসা (গােয়ালা প্রভৃতি ব্যবসা) ছাড়িও না। তােমাদের জ্ঞান নাই, যদি জ্ঞানলাভ করিতে পার তবে একদিনেই হিন্দুকে জাহান্নামে পাঠাইতে পার। দেখ, বঙ্গদেশে তােমাদের সংখ্যা অর্ধেক, তােমরা কৃষক, কৃষিকাজই ধন উৎপত্তির বীজ। হিন্দু ধন কোথায় পাইল, হিন্দুর ধন বিন্দুমাত্রও নাই। হিন্দু কৌশলে তােমাদের ধন নিয়া ধনী হইয়াছে। তােমরা যদি সেই কৌশল শিক্ষা করিতে পার ও জ্ঞানলাভ করিতে পার তবে একদিনেই হিন্দু অন্নাভাবে মরিয়া যাইবে বা মুসলমান হইবে।
মুসলমান মাত্রেই হিন্দুর বিকৃত স্বদেশী আন্দোলনে যােগদান করিবেন না। হিন্দুরা মুসলমানদিগকে স্বদেশী আন্দোলনে যােগদান করার জন্য সাদরে আহ্বান করিতেছে ও অত্যাচার করিতেছে। তাহা মুসলমানদের মঙ্গলের জন্য নহে। মুসলমানগণ চিরকাল তাহাদের থাকে, ইহাই তাহাদের মূল উদ্দেশ্য। হিন্দু স্বার্থপরতা, মুসলমানদের অজ্ঞানতা সর্বনাশের মূল—এই দুই শত্রুই মুসলমানকে অবনত করিয়াছে।”
স্বদেশীয় উত্তেজনায় উন্মত্ত কাজকর্মের যে কিছু হয়েছিল, তা অস্বীকার করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে নিখিলেশের দ্বন্দ্ব শুরু হয় এর প্রতিক্রিয়া থেকেই। ‘ইসলাম প্রচারক’ স্বভাবতই এর নিন্দা করে এবং বয়কট আর বিলিতি দ্রব্য বর্জন আন্দোলনকে মনে করে অনৈস্লিামিক ‘ঐরূপ অস্বাভাবিক আদেশ ইসলাম ধর্মে কুত্রাপি নাই। বিলিতি জিনিস বর্জনের নামে মুসলমান ব্যবসায়ী দোকানদারদের ওপর জোরজুলুম ও অত্যাচার এবং হিন্দু স্বদেশীয়দের দ্বারা শত শত মুসলমানের বিলাতি লবণ বিলাতি চিনি, বিলাতি কাপড় নষ্ট করার নিন্দাও ঐ পত্রিকায় পাওয়া যাবে। ‘ইসলাম প্রচারক’ লিখেছিল, ‘বঙ্গীয় হিন্দুদিগের মধ্যে একদল গুন্ডার সৃষ্টি হইয়াছে।’ এই অভিযােগটিও একেবারে অমূলক নয়। সেই সময় পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে অনুশীলন সমিতির কিছু যুবকও যে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন এবং এর ফলে হিন্দুদের কাছে সমিতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, একথা স্বীকার করেছেন প্রতুল গাঙ্গুলী, তাঁর ‘বিপ্লবীর জীবনদর্শন’ গ্রন্থে। মুসলমানদের দিক থেকেও আক্রামণাত্মক ভূমিকা কিছু কম ছিল না। ময়মনসিংহের জামালপুরে তারা একটি বাসন্তী প্রতিমা ভেঙ্গে দেয়, এই ঘটনা নিঃসন্দেহে হিন্দুদের উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কবি কামিনী ভট্টাচার্য ওই ঘটনার সূত্রেই লেখেন, “আপনার মন রাখিতে জননী/আপনি কৃপাণ ধরা গাে। পরে অবশ্য এই গানটি বিপ্লবীদের প্রিয় একটি দেশাত্মবােধক সঙ্গীতে পরিণত হয়।
স্বদেশী যুগে একদল মৌলবি এরকম প্রচার শুরু করে দেয় যে ঢাকায় নবাবের রাজত্ব কায়েম হতে চলেছে। এখন নির্ভয়ে হিন্দুদের গৃহলুণ্ঠন, তাদের সমাজের বিধবাদের নিকা, এমনকী ধর্ষণ পর্যন্ত করা যেতে পারে। ইসলাম প্রচারক-এর মত পত্রিকাও তীব্র ভাষায় ওই ধরনের প্রচারের নিন্দ করে লেখেঃ ‘একদল ভন্ড মৌলবি…মুসলমানদিগকে এই বলিয়া উত্তেজিত করিতেছে যে, তােমরা হিন্দুর গৃহ লুন্টন কর, হিন্দুর বিধবাদিগকে নিকা কর, হিন্দু রমণীর সতীত্ব নাশ কর। গভর্ণমেন্ট এবং নবাব খাজা সলিমুল্লা বাহাদুর তােমাদের সাহায্যকারী। ‘ইসলাম প্রচারক’ খুব উদারপন্থী পত্রিকা ছিল না, কিন্তু কিছু ধর্মীয় নেতাদের এই ধরণের কুৎসিত এবং বিপজ্জনক আচরণ তারা মােটেই সমর্থন করেনি।
এটা স্পষ্ট যে, স্বদেশী আন্দোলনের বরুদ্ধে মুসলমান সমাজের প্রতিক্রিয়ার কোনও একটিমাত্র স্বর ছিল না। হিন্দু নেতারাও মুসলমানদের ওই আন্দোলনে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এখানে যােগ করতে পারি আর একটি উদাহরণ—‘সােলতান’ পত্রিকায় শিবাজী উৎসবের সমালােচনা করা হয়েছিল এই কারণে যে, এর দ্বারা মুসলমান (বস্তুত মুঘল) শাসনকালকে অসম্মান করা হচ্ছে। এর জবাবে হিন্দু স্বদেশী নেতারা ‘আকবর উৎসব’ এবং ‘মীরকাশিম উৎসব’ পালনের কথাও চিন্তা করেছিলেন। মুসলমানরা শিবাজী উৎসবে যােগ দেয়নি বলে বরিশালে কী তাদের সেই উৎসবে সামিল হবার জন্য আবেদন করেছিলেন অশ্বিনীকুমার দত্ত। এই আবেদনে অবশ্য খুব সাড়া পাওয়া যায়নি।
বলাই বাহুল্য ‘হিন্দুদের স্বদেশী আন্দোলন’ এবং ‘মুসলমানদের স্বজাতি আন্দোলন’-এর প্রচার ও প্ররােচনা ছিল পরস্পরবিরােধী। ফলে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যায়। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি হয়। মুসলিমরা বুঝেছিল যে, মুখে বড় বড় কথা বললেও বাবুদের বঙ্গভঙ্গ বিরােধিতার আসল কারণ অন্যখানে, আর তা হল—
১. কলকাতার ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এ মর্মে আশংকা প্রকাশ করল যে, পূর্ববঙ্গ আসাম প্রদেশের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে অনেক সস্তা হবে বলে অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যই শীঘ্র চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হবে।
২. কলকাতার আইনজীবীরা এজন্য ভীত হল যে, ঢাকায় একটি নতুন হাইকোর্ট স্থাপিত হলে এতে করে বহু মক্কেল হাতছাড়া হয়ে যাবে।
৩. কলকাতাস্থ সংবাদপত্রের মালিকগণ এজন্য চিন্তিত হলেন যে, অচিরেই ঢাকা থেকে পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করবে এবং সেক্ষেত্রে কলকাতার খবরের কাগজের প্রচার সংখ্যা উল্লেখযােগ্য পরিমাণে হাস পাবে।
৪. কলকাতায় আরাম-আয়েসের মধ্যে বসবাসকারী যেসব বর্ণহিন্দু জমিদারের জমিদারী এলাকা পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে।
তারা এ মর্মে আতঙ্কগ্রস্ত হলেন যে, তাদের নিয়মিত খাজনা আদায়ের জন্য ঢাকায় পৃথক অফিস বসাতে হবে এবং তা ব্যয়বহুল হতে বাধ্য। উপরন্তু পূর্ববঙ্গের মুসলিম কৃষকদের পথে কালক্রমে খাজনা বন্ধ আন্দোলন শুরু করারও সম্ভাবনা বিদ্যমান।
৫. কলকাতা-কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু রাজনীতিবিদদের মনে এ মর্মে ধারণা বদ্ধমূল হল যে, নয়া প্রদেশে বিপুল সংখ্যক বাংলাভাষী জনগােষ্ঠীর ভাগ্য স্থানান্তরিত হওয়ার প্রেক্ষেতে তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব সংকুচিত হতে চলেছে।
কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু জমিদার, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতারা বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা করে ও তঁারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। তারা একে জাতীয় সংহতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি আঘাত বলে বর্ণনা করেন। তারা বঙ্গভঙ্গকে মুসলমানদের প্রতি বৃটিশ সরকারের পক্ষপাতিত্ব ও মুসলমানদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রমাণ বলেই উল্লেখ করেন। ১৯০৫-এর ৭ আগষ্ট টাউনহলের সভায় সভাপতির ভাষণে কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী বলেন,
“নূতন প্রদেশে মুসলমানদের প্রাধান্য স্থাপিত হইবে, বাঙ্গালী হিন্দুগণ সংখ্যালঘিষ্ঠে পরিণত হইবে। আমাদেরকে নিজেদের দেশে আগন্তুকের মত থাকিতে হইবে। আমাদের জাতির ভাগ্যে ভবিষ্যতে যে কি হইবে তাহা চিন্তা করিয়া আতঙ্কিত হইয়া পড়িতেছি।”
কলকাতার আইনজীবীগণ বঙ্গভঙ্গের বৈধতা নিয়ে প্রণ উত্থাপন করেন। বুদ্ধিজীবীরা একে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির পরে মারাত্মক বলে অভিমত প্রকাশ করেন। রাজনীতিকগণ সমালােচনা করেন যে, ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতি রােধ করার জন্য ও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বৃটিশ সরকার বাংলা বিভক্ত করেছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, বৃটিশ সরকার ও বাংলার মুসলমানদের মধ্যে মিত্রতার ফলে বাংলা বিভক্ত হয়েছে। তারা বলেন, বাংলা বিভক্ত করে হিন্দুদের অপমান ও অপদস্ত করা হয়েছে।
স্বভাবতই স্বদেশী আন্দোলনকে হিন্দুধর্মীয় আচার-আচরণের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা কালীঘাটে জড়াে হয়ে পুজো করত, বঙ্গভঙ্গের বার্ষিক অনুষ্ঠানে গঙ্গাস্নান করত, গীতার শ্লোক দিয়ে আবেদন করত। সন্ত্রাসবাদীদের কালীমূর্তির সামনে শপথ নিতে হত। স্বাভাবিকভাবেই কোনও ধর্মপ্রাণ মুসলমানের পথে এ আন্দোলনকে আপন মনে করার কোনও সঙ্গত কারণ ছিল। তাই হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়ছিল।
নতুন বড়লাট হার্ডিঞ্জ উপলব্ধি করলেন যে, সাম্রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলন শান্ত করা খুবই প্রয়ােজন। তিনি সেইমত প্রদেশ পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করে তা অনুমােদনের জন্য ভারত সচিবের কাছে পাঠালেন। সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লী দরবারে (১২ ডিসেম্বর ১৯১১) বঙ্গভঙ্গ রদ পরিকল্পনা ঘােষণা করলেন। পরিকল্পনা অনুসারে—
১. বর্ধমান প্রেসিডেন্সি, ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম এই পাঁচটি বাংলাভাষী বিভাগ নিয়ে নতুন বাংলা প্রদেশ গঠিত হল।
২. শ্রীহট্ট আসাম পূর্বের ন্যায় একজন চিফ কমিশনারের শাসনাধীনে গেল।
৩. বিহার, উড়িষ্যা ও ছােটনাগপুরকে নিয়ে একটি লেফটেনেন্ট গভর্ণর শাসিত নতুন প্রদেশ গঠিত হল যার রাজধানী হল পাটনা।
৪. ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হল। ১৯১২-র ২৫ জুন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এটিকে আইনে পরিণত করল।
“বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য মুসলিম লীগ এবং পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ মুসলমান ক্ষুব্ধ হয়েছিল। সলিমুল্লাহ-র মত অকুণ্ঠ রাজভক্ত নেতাদের ব্যাপারে তাদের মােহভঙ্গ হয়েছিল। এ.কে.ফজলুল হকের মত স্বাধীনচেতা নেতাদের জনপ্রিয়তা বেড়েছিল। লক্ষ্মৌর বার্ষিক অধিবেশনে (১৯১৩) মুসলিম লীগ সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বায়ত্বশাসনের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। বঙ্গভঙ্গ রদে হিন্দু নেতারা উল্লসিত হয়েছিল। কিন্তু তারা বুঝতেই পারেনি কলকাতা থেকে দিল্লীতে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাদের পূর্বেকার প্রাধান্য বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল।”
[৪]
প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ নির্মলকুমার বসু তার ‘হিন্দু সমাজের গড়ন’ গ্রন্থের শেষের দিকে লিখেছেন,
“বাঙলা দেশে, বিশেষত পূর্ববঙ্গে, যেখানে নদী অথবা খাল-বিলের প্রাদুর্ভাব নমঃশূদ্র জাতির প্রাদুর্ভাব সেই সকল জায়গায় বেশী। হিন্দু সমাজ চিরদিন এই কৃষিজীবী জাতিকে ঘৃণা করিয়া আসিয়াছে, এমনকী অস্পৃশ্য বলিয়া গ্রামের প্রান্তে ভিন্ন পল্লীতে বাস করিতে বাধ্য করিয়াছে। …নমঃশূদ্র জাতির সংখ্যা অল্প নহে এবং ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ, খুলনা, যশােহর প্রভৃতি জেলার এক এক বৃহৎ অংশে ইহাদের বিস্তৃত বসতি আছে। কতকটা এই কারণে এবং কতকটা শিক্ষালাভের পরে বর্ণহিন্দুদের নিকট অপমানের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ নমঃশূদ্রগণ হিন্দু সমাজ হইতে পৃথক জাতি ও গভর্ণমেন্টের বিশেষভাবে অনুগ্রহের পাত্র বলিয়া দাবি জানান।”
এখানে নমঃশূদ্রদের প্রসঙ্গ টেনে আনার কারণ আছে। পরধর্ম সহনশীলতার জন্যে স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগাের বিধর্ম মহাসভায় হিন্দুধর্মের যে বৈশিষ্ট্যের গুনগান করেছেন বাস্তবে তার পরাকাষ্ঠা কতখানি সেটার সন্ধান করা। যে ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই ভেতরে-ভেতরে অপমান অত্যাচার ঘৃণার ছড়াছড়ি তারা অন্য ধর্মের মানুষদের কোন চোখে দেখবে তা সহজেই অনুমেয়। রাধাকমল মুখােপাধ্যায় বিশাল বাঙ্গালা’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন যে, ব্রাহ্মণ সমাজের আচার-বিধান ও বহু বিধিনিষেধের ফলে উচ্চবর্ণ হিন্দুর সংখ্যা ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন,
“ঘরে ঘরে উদারতর পারিবারিক নীতি ও অভিনব সামাজিক আচার ব্যবহার অবিলম্বে গ্রহণ করতে না পারিলে বাঙ্গালার ১ কোটি ৫০ লক্ষ অবনত ও পতিত জাতি বাঙ্গালার কৃষ্টিকে নীচের দিকে টানিয়া অতলে ডুবাইয়াই দিবে।”
রবীন্দ্রনাথ একই কথা ছন্দে বলেছিলেন, ‘পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তােমারে পশ্চাদে টানিছে।’
শুধু নৃতাত্ত্বিকের চোখে নয়, মহাত্মা গান্ধীর মত দেশ নেতার চোখেও বাঙালি সমাজের অন্তবিরােধের রূপটা সহজেই ধরা পড়েছিল। তিনি যখন ১৯২৫ সালের মে মাসে প্রথম পূর্ব বাংলা পরিক্রমায় যান, তখন তাঁর সঙ্গী ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র ঘােষ। নােয়াখালিতে গিয়ে গান্ধীজি শুনলেন যে ঐ জেলায় শতকরা ৭০ ভাগ মুসলমান আর মাত্র শতকরা ৩০ ভাগ হিন্দু। কিন্তু জমির মালিকদের শতকরা ৭০ ভাগই জেলার সংখ্যালঘু হিন্দু আর মাত্র ৩০ ভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান, তখন গান্ধীজি মন্তব্য করেন, ‘এইখানেই তাে সংঘর্যের কারণ।২৫ অর্থাৎ অর্থনৈতিক বৈষম্য যে মিলনের প্রবল অন্তরায় একথা গান্ধীজি মনে প্রাণে বিধাস করতেন। বর্ণভেদের মত অর্থভেদও যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অন্যতম নির্ধারক একথা এখানে পরিস্কার। সেই সঙ্গে এখানে এটাও বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, জমির মালিক মানে ভদ্রলােক আর কৃষক মানে ছােটলােক বা যারা গতর খাটে। তবে এ ব্যাপারে খুব গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য যার রচনাবলি থেকে পাওয়া যায় তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বকবি ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে শুধু নিখিলেশ-বিমলা-সন্দীপের ত্রিকোণ সম্পর্কটাকে পরিস্ফুট করেননি। তার পাশাপাশি তৎকালীন গ্রাম-বাংলার একটা সমাজ-চিত্রও উপস্থাপন করেছেন। গ্রামের জাতীয়তাবাদী ভদ্রসমাজ সন্দীপের প্রেরণায় ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি তুলে দেশ উদ্ধারের কাজে লেগেছে এবং যাদের দোকান হাট লুঠ করে ও জ্বালিয়ে, যাদের নৌকো ডুবিয়ে সেদিনের দেশ উদ্ধারের যজ্ঞ সম্পন্ন হচ্ছিল সেই অসহায় হতভাগ্যরা ছিল মুসলমান সমাজের মানুষ। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এটাও লক্ষ্য করেছিলেন যে, ভদ্রলােকদের দেশপ্রেমের প্রতিক্রিয়ায় গ্রামে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের আনাগােনা এবং গাে-কোরবানি শুরু হয়েছে। অবশেষে ক্ষেপে উঠেছে মুসলমান দল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯০৭ সালের ময়মনসিং জেলাতে হিন্দু জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে মুসলমান কৃষকের বিদ্রোহ শুরু হলে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের প্রধান নায়ক অরবিন্দ ঘােষ হিন্দু জমিদারদের রক্ষা করার জন্য একদল যুবকের সঙ্গে তিনটি বােমা পাঠিয়েছিলেন। এই বােমা তিনটির নাম ছিল কালী মায়ের বােমা’। বােঝা যায় ভদ্রলােক দেশপ্রেমীদের চিন্তা-চেতনা সেই সময়ে কোন খাতে প্রবাহিত হচ্ছিল।
মহাত্মা গান্ধীর পূর্ববাংলা সফর শেষ করে ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পরে অর্থাৎ ১৯২৫ সালের ১৬ জুন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু হয়। বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে চিত্তরঞ্জন দাশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯২২-এ গয়া কংগ্রেসেই (সভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন) প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল, হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে প্রকৃত মিলন সাধনের উদেশ্যে উভয় সম্প্রদায়ের নেতারা একটা প্যাক্ট বা চুক্তি করে হিন্দু ও মুসলমানের পারস্পারিক স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। এই প্রস্তাবের তাগিদেই চিত্তরঞ্জন ১৯২৩-এ সিরাজগঞ্জ প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মিলনীতে তাঁর বিখ্যাত ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ পাশ করিয়েছিলেন। একে ‘হিন্দু-মুসলিম প্যাক্ট’ ও বলা হয়ে থাকে। এই প্যাক্ট বা চুক্তির ফলে আইনসভাগুলিতে মুসলমানদের গরিষ্ঠতার অনুপাতে সদস্য সংখ্যা নির্ধারণের ব্যবস্থা করা হােল, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল চাকরির সংখ্যানুপাতিক বিন্যাস। সরকারী চাকরিতে মুসলমানদের ৫৫ শতাংশ এবং হিন্দু ও অন্যান্যদের ৪৫ শতাংশের ব্যবস্থা হয়েছিল। ধর্মীয় সহনশীলতার ক্ষেত্রে এই চুক্তি কয়েকটি সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিল। তার মধ্যে প্রধান ছিল,
১. নামাজের সময় মসজিদের সামনে বাজনা বাজিয়ে শােভাযাত্রা করা চলবে না।
২. মুসলমানদের ধর্মীয় অনুশাসনের জন্য গাে-হত্যা হলে তাতে বাধা দেওয়া চলবে না। কিন্তু হিন্দুদের মনে আঘাত লাগে এমন স্থানে গাে-হত্যা করা চলবে না।
এই চুক্তির ফলে হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির একটা আবহাওয়া সৃষ্টি হল। কিন্তু শিথিত মধ্যবিত্ত এবং জমিদার শ্রেণির হিন্দুরা এই চুক্তির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ও সবচেয়ে বেশী ক্ষুব্ধ হলেন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী দল, যাদের হাতে চিত্তরঞ্জন কংগ্রেসের পরিচালনার ভার অর্পণ করে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। এমনকি গান্ধীবাদী প্রফুল্লচন্দ্র ঘােষ পর্যন্ত প্রকাশ্য বক্তৃতায় বলেছিলেন,
‘মুসলমানদের নিকট আত্মসমর্পণ করে আমরা তাদের একটার পর একটা দাবি বাড়িয়ে তুলতেই সাহায্য করছি।’
চিত্তরঞ্জনের হিন্দু-মুসলমান চুক্তি সম্বন্ধে আবুল কালাম আজাদ ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ বইতে লিখেছেন,
“এই সাহসিক ঘােষণা বঙ্গীয় কংগ্রেসের ভিত্তি পর্যন্ত কাপিয়ে তুলেছিল। বহু কংগ্রেস নেতা তুমুলভাবে এর বিরােধিতা করলেন এবং মিঃ দাশের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে দিলেন। …এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে, তিনি দেহত্যাগ করার পর তাঁর কিছু সংখ্যক শিষ্য তাঁর আদর্শকে খর্ব করে দিলেন এবং তাঁর এই ঘােষণাটিকে বাতিল করে দেওয়া হল। ফল এই হল যে, বাংলার মুসলমানেরা কংগ্রেস থেকে সরে দাঁড়াল এবং দেশ বিভাগের প্রথম বীজ বপন করা হল।” আসলে ওই চুক্তি প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেসকে অর্থ সাহায্যকারী জমিদার মহাজনদের স্বার্থের পরিপন্থী—হােক না তারা সংখ্যালঘু তবু তারাই কংগ্রেসী কর্মসূচীর যথার্থ সমর্থক ও তারাই কংগ্রেস-ফান্ডে টাকা জোগায়। জাতীয় কংগ্রেসের এই নীতির ফলে বাংলার মুসলমানরা ভেঙে পড়লেন এবং বাংলার সংখ্যালঘু উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত হিন্দুদের জয় হয়। ১৯২৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর জিন্না এক সাক্ষাৎকারে বললেন, “মুসলমানরা আর কংগ্রেসকে বিশ্বাস করে না, কারণ গয়া কংগ্রেসে হিন্দু-মুসলমানের একটি সর্বভারতীয় চুক্তি স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও কংগ্রেস তা পালন করেনি।”
জে এইচ ব্রুমফিল্ড তাই তাঁর গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, হিন্দু জমিদার মহাজন ও অভিজাতদের বাধার ফলে কংগ্রেসের পক্ষে কোনও কৃষি-সংস্কার পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কথা ভাবা সম্ভব হয়নি। অতুলচন্দ্র গুপ্ত জমির মালিক গ্রন্থে (বিশ্বভারতী) পরিবেশ-পরিস্থিতির বিচার-বিশ্লেষণ করে লেখেন, মহাত্মার প্রথম অসহযােগ আন্দোলনে বাংলার চাষী, যাদের অধিকাংশ মুসলমান, কংগ্রেসের ডাকে সাড়া দিয়েছিল, কংগ্রেসকে মনে করেছিল নিজের জিনিস। তেমন ঘটনা পূর্বে কখনও ঘটেনি। এই অভূতপূর্ব অবস্থার সুযােগেও বাংলার কংগ্রেস নেতারা বাংলার রাষ্ট্রীয় বুদ্ধি ও আন্দোলনকে ধর্মভেদের নাগপাশ থেকে মুক্তি দেবার কোনও চেষ্টাই করেননি। নিজেদের শ্রেণিগত স্বার্থের চিন্তা তাদের বুদ্ধিকে অন্ধ ও কর্মকে পঙ্গু করেছিল। বাংলার চাষীর অনায়াসলব্ধ নেতৃত্ব বাংলার কংগ্রেসের পক্ষে অসাধ্য হয়েছিল। ১৯২৮ সালের আইন সংশােধন ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ হল, বাংলার আইনসভার কংগ্রেসী সভ্যদের কাছে চাষীর স্বার্থের চেয়ে জমিদারদের স্বার্থ বড়।
সেই যে ১৭৯৩ সালে ইংরেজরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন করেন, তাতে ভারতবর্ষের রাজস্ব ব্যবস্থার একটা তৎকালীন সমাধান হয়েছিল বটে কিন্তু এর দ্বারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শক্তিশালী হিন্দু জমিদারের কাছে দরিদ্র মুসলমান কৃষকের অসহয়তাকেও চিরস্থায়ী করে দেওয়া হয়। একাধিক ইতিহাসবিদ, অর্থনীতিবিদ গবেষণা করে দেখিয়েছেন, একাধিক বন্দোবস্তের পরে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার জমির মালিকানা চলে যায় হিন্দুদের হাতে এবং প্রজা হিসেবে যারা থেকে যায় তারা মুসলিম এবং তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। বিপানচন্দ্র ‘ন্যাশনালিজম অ্যান্ড কলােনিয়ালিজম ইন ইন্ডিয়া’তে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন যে, কিভাবে জমি হস্তান্তরিত হয়ে হিন্দু জমিদারদের হাতে জমেছে। যেটুকু জমি মুসলিম জমিদারদের হাতে ছিল সেই জমিটুকুও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে হিন্দু জমিদারদের হাতে চলে যাচ্ছে। ফলে সমাজের মধ্যে জমিকে কেন্দ্র করে একটা ডিভিশন তৈরী হয়েছে। আপনারা সবাই জানেন যে, আজও ভারতবর্ষে যে সমস্ত ফৌজদারি মামলা হয় সেই সমস্ত মামলার বেশিরভাগটাই হয় জমিকে কেন্দ্র করে। জমি মানুষের রক্তের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে যে সেখানে ছেলে বাবাকে রেয়াত করে না, বাবা ছেলেকে রেয়াত করে না, ভাই ভাইকে রেয়াত করে না। সুতরাং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে ভূমি সম্পর্কে যে বিশাল পরিবর্তন ঘটে যায় ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িকতাবাদকে গড়ে তােলবার ক্ষেত্রে তা একটা নতুন মাত্রা যুক্ত করে।
বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলায় যে সব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটা দেখা যাবে যে দাঙ্গাগুলি প্রধানত হয়েছে জমিকে কেন্দ্র করে মুসলিম প্রজা ও হিন্দু জমিদারদের মধ্যে। কিন্তু সেগুলি হিন্দু এবং মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, এইভাবে ভারতবর্ষের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এভাবে এই ভূমিনীতি ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িকতাবাদকে গড়ে তােলবার ক্ষেত্রে একটা নতুন ‘এলিমেন্ট’ বা উপাদান হিসেবে যুক্ত হয়। সাধারণ মুসলমান চাষী এই কারণে ইংরেজদের রাজক্ষমতা লাভকে ভাল চোখে দেখেনি। ইংরেজদের আগমনকে সেই সময়ে সাধারণভাবে শিক্ষিত হিন্দুরা স্বাগত জানিয়েছিলেন। সেই জন্যই ইংরেজরাও হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চুক্তি করেছিলেন যাতে রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে এরা ইংরেজদের শাসন-পরিচালনায় সাহায্য করতে পারেন। অবশ্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে মুসলমান জমিদাররাও সুবিধা পেয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজরা ইতিমধ্যে এত ব্যাপকভাবে হিন্দু জমিদারদের সৃষ্টি করেছিলেন যাতে হিন্দু জমিদারের সংখ্যায় বেশি হয়ে দাঁড়াল। ইংরেজ শাসনব্যবস্থাকে প্রত্যক্ষ্যভাবে সাহায্য করবার জন্য ইংরেজরা দেশে বহু বড় বড় হিন্দু জমিদারীর সৃষ্টি করলেন। যেমন সিরাজ-উদ-দৌলার সৈন্যদের আক্রমণ থেকে ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রাণ রক্ষা করতে সাহায্য করার দরুণ কান্তমুদীকে কাশিমবাজারের মহারাজা করে দেওয়া হয়। মহারাজা নন্দকুমারের বিচারে তার বিরুদ্ধে হেস্টিংসকে সাহায্য করবার দরুণ গঙ্গাগােবিন্দ সিংহকে পাইকপাড়ার রাজা করে দেওয়া হয়। এইভাবে ইংরেজদের শাসনকার্যের সুবিধা হল, হিন্দু জমিদারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি, সৃষ্টি হােল এক নতুন জমিদার শ্রেণী এবং এই জমিদারের মদতপুষ্ট জোতদার-মহাজন ও বাবুশ্রেণী। ফলে বাংলার অর্থনীতিতে এক হিন্দু কায়েমি স্বার্থ বছরের পর বছর ধরে সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রতিক্রিয়ায় বাঙালি মুসলিম মানসে ক্রমশ সৃষ্টি হয়েছে বাঙালি বাবু বিরােধী সাম্প্রদায়িকতা। কিন্তু তবুও গান্ধীজির অসহযােগ আন্দোলন, চিত্তরঞ্জনের স্বরাজ পার্টির রাজনীতি কিংবা ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির প্রভাব বাঙালি মুসলিম সমাজকে মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে ১৯৩৭ সালের নির্বাচন পর্যন্ত দূরে রাখতে পেরেছিল।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয় নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে দিল যে, যদিও এক সময় ব্রিটিশের প্রত্যক্ষ্য সহযােগিতায় বাংলার মাটিতেই মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল তথাপি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায় লীগকে নিজেদের দল বলে মানেননি। নির্বাচনে কোনও দলই নিরঙ্কুশ সংখাগরিষ্ঠ না পাওয়ার ফলে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা অনিবার্য হল। কৃষকপ্রজা পার্টির নেতা ফজলুল হক প্রথমে কংগ্রেসের কাছেই কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠনের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু জমিদারী স্বার্থের রক্ষক কংগ্রেস সে-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে হতাশা-ক্লিষ্ট ফজলুল হক বাধ্য হয়ে মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন করলেন। কংগ্রেস নেতাদের একগুঁয়েমির জন্য বাংলায় মৃতপ্রায় মুসলিম লীগ পুনর্জীবন লাভ করল। ভারতীয় বিদ্যাভবন প্রকাশিত ‘স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম’ গ্রন্থে রমেশচন্দ্র মজুমদার মন্তব্য করেছেন যে, অসাম্প্রদায়িক ফজলুল হকের সুপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কংগ্রেস বাংলায় মুসলিম লীগের ক্ষমতায় পৌঁছানাের পথ সুগম করে দিয়েছিল। তারপর আমরা দেখি সাধারণ বাঙালির নেতা ফজলুল হককে মুসলিম লীগের লাহাের অধিবেশনে। এই অধিবেশনে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ প্রথম উত্থাপিত ও গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি রচনা করেছিলেন সিকান্দার হায়াৎ, উত্থাপন করেছিলেন ফজলুল হক এবং সমর্থন করেছিলেন খালিক-উজ-জামান চৌধুরী।
কিন্তু এটা বাস্তব সত্য যে, ১৯৩৫/৩৬ সাল নাগাদ মুসলিম লীগ নেতারা রহমত আলির পাকিস্তান পরিকল্পনাটিকে কোনও গুরুত্ব দেননি বা আলােচনার মধ্যে আনেনইনি। জিন্না পরিকল্পনাটিকে ‘অমূলক ও অবাস্তব বলে উপহাস করেছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের মধ্যে রক্ষণশীল গােষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান শক্তিতে লীগ নেতারা ক্রমশ শঙ্কিত হচ্ছিলেন। বিশেষত ত্রিপুরি কংগ্রেসের সভাপতির পদে জয়লাভ করার পরে রক্ষণশীল গােষ্ঠীর হাতে সুভাষচন্দ্রের দুর্দশা লীগ নেতাদের আশঙ্কাকে দৃঢ়মূল করল। গান্ধীজিকে নামে সেনাপতির সম্মান দিলেও কার্যনির্বাহক সমিতি প্রকৃতপর্বে তাঁকে শিখন্ডীরূপেই ব্যবহার করেছে এবং গান্ধীজিও সমস্ত ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত অভিমানের ব্যাপার করে অনায়াসে কংগ্রেসের ভেতরের কায়েমী স্বার্থের হাতে নিজেকে ত্রীড়নক হতে দিয়েছেন। ঘটনা এই যে, ‘ত্রিপুরি সংকট’ গান্ধীজির শুভেচ্ছা ও কংগ্রেসের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ঐতিহাসিককে সঙ্গত কারণেই সন্দিগ্ধ করে তােলে।
এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে, এ জি লিওনার্ড তাঁর গ্রন্থে সুভাষচন্দ্রের কংগ্রেস পরিত্যাগ ও ফজলুল হকের মুসলিম লীগে যােগদান ঘটনা দুটির পিছনে তৎকালীন কংগ্রেসী রাজনীতির একই ত্রীড়াকৌশল দেখেছেন—নিরুপায় হয়ে একজন একনায়কতন্ত্রে আর একজন ‘এক ধর্ম এক রাষ্ট্র’ মতবাদের শরণাপন্ন হয়েছেন। আর ‘Last years of British India’ গ্রন্থে মাইকেল এডােয়ার্ডস ত্রিপুরির পরবর্তী ঘটনাবলীর জন্য গান্ধীজিকেই দায়ী করে লিখেছেন,
‘Gandhi now turned the technique of non-cooperation, not against the British, but against congress’s own president.Bose was forced to resign.’
তাই এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, বহুলাংশে কংগ্রেসের অন্তর্গত প্রতিক্রিয়াশীল উপাদান ও হিন্দু মহাসভার হিন্দু জাতিতত্ত্ব সম্মিলিত শক্তি মুসলিম প্রগতিশীল অংশকেও পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণে বাধ্য করেছিল। মুসলমানরা প্রথম থেকে স্বতন্ত্র স্বাধীন বাসভূমি কখনই চাননি। কংগ্রেস নেতারা স্বার্থপরতা এবং অন্ধতার বশে প্রতিনিধিস্থানীয় মুসলমান নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিতে অস্বীকার করায় মুসলমানরা বাধ্য হয়ে স্বতন্ত্র স্বাধীন বাসভূমির দাবি জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
[৫]
পূর্বের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ১৯৩৮-৩৯ পর্বে ফজলুল হক যে দুটি ক্ষেত্রে কংগ্রেসের কাছ থেকে প্রচন্ড বিরুদ্ধতা পেয়েছিলেন— জমিদারি বিলােপ ও মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, স্বাধীনতার পরে কংগ্রেস সরকার সে দুটো ক্ষেত্রেই ফজলুল হকের পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দিয়ে প্রমাণ করল যে ফজলুল হকের বিরােধিতা করে তারা সঠিক কাজ করেনি। কিন্তু সে অনেক পরের কথা। ইতিহাসের সত্য এই যে, বাঙালি হিন্দু বাবুদের কায়েমি স্বার্থে সেদিন কংগ্রেসী নেতাগণ ফজলুল হকের জনমুখী পরিকল্পনাকে বানচাল করে দিয়েছিলেন এবং কংগ্রেসের জনবিরােধী আচরণে হতাশ হয়ে ফজলুল হক আপে করে বলেছিলেন যে, দেশের স্বার্থকে যারা হিন্দুস্বার্থ আর মুসলমান স্বার্থ বলে ভাগ করে দিল তারা দেশভাগ না করে ছাড়বে না।
১৯৩৭-এর অক্টোবর লীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে হাজার হাজার প্রতিনিধির ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনির মধ্যে জিন্নাকে আলিঙ্গন করে ফজলুল হক লীগে যােগদানের কথা ঘােষণা করলেন। ১৭ অক্টোবর প্রকাশ্য অধিবেশনে আবেগপ্রবণ ফজলুল হক বলেই ফেললেন,
“হিন্দু কংগ্রেসের মন্ত্রীরা যদি নিজেদের প্রদেশে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর অত্যাচার চালিয়ে যাবার নীতি বজায় রাখেন তাহলে আমি এই মঞ্চ থেকে ঘােষণা করতে চাই যে, যদি তাতে আমার প্রাণও চলে যায় তবু আমি বঙ্গে তার প্রতিশােধ নেব।”
খালিক-উজ-জামান লিখেছেন যে, ওই বক্তৃতায় হক সাহেব,
“এত দূর পর্যন্ত যান যে তিনি বলেন যে, উত্তরপ্রদেশে একজনের প্রাণ যাবার শােধ তুলতে বঙ্গে তিনি দুজনের প্রাণ নেবেন।”
এই অবস্থায় জিন্না চরম সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় গ্রহণ করে মুসলমান জনগণের ধর্মান্ধতাকে উগ্রতর করে তুলতে অগ্রসর হলেন। বিভিন্ন প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রীসভার কার্যকলাপকে ‘হিন্দু রাজ’ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বলে আক্রমণ করে মুসলিম লীগের নতুন আক্রমণমুখী গণ-আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৩৮ সালের লীগ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে জিন্না অভিযােগ করেন যে, অন্য সব জাতি ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেশে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠা করাই হল কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্য। তিনি আরও বললেন, হিন্দু ও মুসলমান সমাজের মধ্যে কোনও মিল নেই—কোনও ভাবগত ঐক্য নেই—দুটো আলাদা জাতি। এক সম্প্রদায়ের কাছে যিনি বরেণ্য বীর, অপর সম্প্রদায়ের কাছে তিনি ঘৃণ্য শত্রু। হিন্দুর কাছে শিবাজী বরেণ্য বীর, মুসলমানদের কাছে তিনি শত্রু, তেমনি ঔরঙ্গজেব মুসলমানদের নিকট সম্মানিত সম্রাট হিন্দুর মনে তাঁর সম্বন্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা। এভাবে জিন্না ও মুসলিম লীগের এই সাম্প্রদায়িক বিষােদগার হিন্দু ও মুসলমানের বিচ্ছিন্নতাবােধকে আরও বাড়িয়ে তুলল।
দ্বিতীয় রাউন্ডটেবিল কনফারেন্সে যখন ভারতীয় প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সম্প্রদায় নিয়ে সমস্যার সমাধান করতে পারলেন না, তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডােনাল্ড ১৯৩২ সালের ১৬ আগষ্ট যে সূত্র ঘােষণা করলেন তা ‘সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ’ নামে পরিচিত। এই রােয়েদাদের প্রসঙ্গে রাজেন্দ্র প্রসাদ ‘ইন্ডিয়া ডিভাইডেড’ গ্রন্থে লিখেছেন, হিন্দুদের প্রতি এইরূপ ভাগ-বাঁটোয়ারার ব্যবস্থা চরম অবিচার করেছে। মুসলিমদের প্রায় সমস্ত দাবিই মেনে নিয়েছে আর অযৌক্তিক উদারতা দেখিয়েছে ইউরােপীয়দের প্রতি। মুসলিম লীগ এই রােয়েদাদে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। কিন্তু মন্দের ভাল হিসেবে এটাকে স্বাগত জানিয়েছিল। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির প্রতিক্রিয়া হল বেশ বিচিত্র, ঘােষণা করল, ‘it would neither accept nor reject the Award. এই মনােভঙ্গির জন্য পন্ডিত মদনমােহন মালব্যের মত হিন্দু স্বার্থের রক্ষাকর্তাগণ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির তীব্র সমালােচনা করলেন। যাইহােক, এই সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার পরে হিন্দু-মুসলমান প্রণ বাঙালি জীবনে নতুন মাত্রা লাভ করে।
১৯৩২ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত দশ বছরে অন্নদাশংকর রায় হিন্দু-মুসলমান প্রসঙ্গে যে সব প্রবন্ধ লেখেন সেগুলি বর্তমানে তাঁর সমগ্র ‘প্রবন্ধ’-র ১ম খন্ডে সংকলিত এবং এই প্রবন্ধগুলি বিশেষভাবে আমাদের অভিনিবেশ দাবি করে। কারণ সরকারি চাকরিসূত্রে তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে এসে বিচিত্র ও ব্যাপক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। ‘ভারতীয় মুসলমান প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন যে, হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের বিরােধটা তত্ত্বের নয়, স্বত্বের। এখানে তত্ত্বের মানে ধর্ম আর স্বত্বের মানে ভূমি। আবার ভূমির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও নানা অধিকার অথবা জমি, ফসল, চাকরি, শাসনব্যবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ। এ সবের সঙ্গে সামাজিক সম্মানের প্রাও জড়িত। সেই উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে উনিশ শতকের বহু মনীষী হিন্দুকে এক সম্পূর্ণ ও স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে দাবি করে এসেছেন। হিন্দুরা যদি জাতি হয় তা হলে মুসলমানরা কী? বিশ শতকের প্রথম তিন দশক পর্যন্ত ভারতীয় মুসলমানরা শুধু একটা সম্প্রদায় হয়ে থেকেছে। কিন্তু ভারতীয় মুসলমানরা আর সম্প্রদায়ের পরিচয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চাইল না, তারাও হিন্দুজাতির মত জাতির পরিচয়ে অধিকার চাইল।
‘জন্মস্বত্ব’ প্রবন্ধে অন্নদাশংকর লিখেছেন যে, “ভারতীয় মুসলমানদের জাতি পরিচয় লাভের জন্যই তাদের পাকিস্তান দাবি। কারণ জাতির জন্যে নিজের দেশ চাই। কিন্তু ভারতীয় মুসলমান পক্ষে বলতে শুধু তাদেরই বােঝায় না যারা শরিয়তি মত কঠোরভাবে মেপে দিনযাপন করে, এদের মধ্যে তারাও আছে যারা হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েও দৃঢ় অর্থে হিন্দু নয়।”
[৬]
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-৯৪) রচনায় জাতীয়তাবাদ একটি চর্চিত বিষয়। লেখক হিসেবে তার কালে তিনিই ছিলেন সর্বপ্রধান, যে জন্য অনুরাগীরা তাকে সাহিত্য সম্রাট’ বলেন। তিনি তখনকার এবং পরবর্তী সময়েরও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, যারা ছিল প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য, তাদের মনােভাব, জগৎদৃষ্টি ও আকাঙ্খকে তার লেখার মধ্য দিয়ে মূর্ত করেছেন তাে বটেই, কোনাে কোনাে দিক দিয়ে সুগঠিতও করেছেন। এমনটা অন্য কেউ পারেননি।
ভারতবর্ষে একটা ঐক্যবদ্ধ সুসংহত, হিন্দু জাতীয়তাবাদভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। অন্য কোনাে জাতীয়তাবাদ, অন্য কোনাে রাষ্ট্রের কল্পনা তার চিন্তায় বা লেখনীতে ঠাই পায়নি। ধর্মনির্বিশেষে সকল ভারতীয়কে নিয়ে সংগঠিত রাষ্ট্রচিন্তা যার কথা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বলে আসছিল সেই ১৮৮৫ সালে তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সেই জাতীয় রাষ্ট্র চিন্তাকে পাত্তা দেননি বঙ্কিমচন্দ্র। স্বাধীনতার সংজ্ঞা দিলেন তিনি এই বলে, সমাজের যে অবস্থা ধর্মের অনুকূল তাহাকে স্বাধীনতা বলা যায়। তার আকাঙ্খিত সেই স্বাধীন ধর্মরাষ্ট্রের নাগরিকবৃন্দ ইতিহাসের নানা কালপর্বে কিভাবে এগিয়েছে, গড়ে তুলেছে উদ্দীপনাময় জয়ের অথবা সম্মানজনক পরাজয়ের গৌরবগাঁথা তার চিত্র তিনি অঙ্কিত করেছেন। তার ইতিহাসনির্ভর উপ্যাসসমূহে। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনী এধরণের উপন্যাসে উদ্দেশ্যমূলক হয়ে ওঠে নতুন ইতিহাস অনুসন্ধান ও নির্মাণের লথে।
বঙ্কিমচন্দ্র ভারতের অতীতকে গৌরবমণ্ডিত করে সমকালের হীনাবস্থাকে অতিক্রম করতে চেয়েছেন। তার অতীত মানে আর্য গৌরব। যে আর্যরাও মুসলিমদের মতই এদেশে বহিরাগত। কিন্তু আর্য গৌরবকেই নিজের গর্ব মনে করে অতীত গৌরব-হরণকারী মুসলিম শক্তির ওপরেই তার প্রচণ্ড আক্রোশ। তাই নবাগত ইংরেজ অপেক্ষা হৃতগৌরব মুসলমান তার। শত্রুতে পরিণত হয়।
একটি পরাধীন দেশে বিদেশি শাসকই হল শাসিত জনগণের স্বাভাবিক প্রতিপক্ষ, এবং তার বিরুদ্ধেই জাতীয়তাবাদ দেশপ্রেমিক আবেগে উদ্যত হয়ে ওঠে স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্খায়। ঔপনিবেশিক ভারতে জাতীয়তাবাদের স্বাভাবিক অভিমুখটি তাই ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ ইংরেজ নয়। কেননা তার নির্মিত ইতিহাস অনুযায়ী অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজের কাছে পরাধীনতাই ভারতের প্রথম পরাধীনতা নয়। তারও বহু আগে দ্বাদশ শতাব্দীতে ইখতিয়ারউদ্দিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের মাধ্যমে মুসলমানদের কাছে যে পরাজয় ও স্বাধীনতাহীনতার সূচনা, বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক উৎস সেইখানে। বস্তুতপথে, মুসলমানদের হাতে সাতশত বছরের পরাধীনতার কলঙ্কমােচনের আকাঙ্খই যেন বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদের প্রাণবস্তু।
এই সময়ে উদ্ভব হয় হিন্দু পুনরুজ্জীনবাদের। হিন্দু-প্রীতিক্রমে হিন্দুত্ব প্রীতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতায়পর্যবসিত হয়। রামমােহন, ইয়ং বেঙ্গল, বিদ্যাসাগরদের সংস্কার আন্দোলন ধীরে ধীরে রাজনারায়ণ, দেবেন্দ্রনাথ, নবগােপাল, বঙ্কিমচন্দ্রের কর্মকান্ডের মাধ্যমে হিন্দু পুনরুভ্যুত্থানে পরিণত হয়। রাজনারায়ণের প্রস্তাবক্রমে, নবগােপাল মিত্রের উদ্যোগে, দেবেন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রনাথগগণেন্দ্রনাথের সহযােগিতায় ১৮৬৭ সালে স্থাপিত হয় ‘হিন্দু মেলা’ বা ‘জাতীয় মেলা’। হিন্দুমেলা নামকরণের যথার্থ ব্যাখ্যা বিপিনচন্দ্র পালের ভাষায়,
“সে কালের এই ভারতবর্ষটা কেবল হিন্দুরই দেশ, মুসলমান-খ্রীষ্টান প্রভৃতির এদেশের উপর দাবি আছে। ইহা শিথিত সমাজের মনে উদয় হয় নাই। এই সঙ্কীর্ণ স্বাদেশিকতার প্রেরণায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম সমাজকে হিন্দুত্বের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ রাখিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন—আর সেই স্বাদেশিকতার প্রেরণায় নবগােপাল হিন্দুমেলার প্রতিষ্ঠা করেন।”
১৮৬৭ থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত ১৪ বছর এই মেলা হয়—প্রথমে চৈত্র সংক্রান্তিতে পরে মাঘ সংক্রান্তিতে। এই মেলার উদ্দেশ্য ছিল ‘বৎসর শেষে হিন্দু জাতিকে একত্রিত করা, হিন্দু সমাজের সারা বছরে কি উন্নতি হয়েছে তার পর্যালােচনা করা এবং জাতীয়তার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হতে ও আত্মনির্ভরতায় উৎসাহ দেওয়া। সেই উদ্দেশ্যে ‘মিলে সব ভারত সন্তান, একতান মনপ্রাণ/ গাও ভারতের যশােগান’ প্রভৃতি স্বদেশি সঙ্গীত রচিত ও গীত হয়েছে। কিন্তু এই ভারত হিন্দু ভারত ও জাতীয়তা হিন্দু জাতীয়তা।
আগেই স্থাপিত হয় ‘জাতীয় সভা’ (১৮৭০), এবং জাতীয় বিদ্যালয় (১৮৭২)। যে মেলা, সভা বিদ্যালয়ের কর্মতৎপরতা কেবলমাত্র হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাকে ‘ন্যাশনাল’ বা ‘জাতীয়’ বলা যায় কিনা, সে প্রণ উঠলে নবগােপাল মিত্র তার ‘ন্যাশনাল পেপার’-এ মন্তব্য করেন, “হিন্দু নিঃসন্দেহে একটি স্বতন্ত্র জাতি। কাজেই তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোনও সভাকে জাতীয় সভা বলতে কোনও বাধা নেই।” এ প্রসঙ্গে বদরুদ্দিন উমর বলেন, “উনিশ শতকের নবগােপাল মিত্র বিশ শতকের কায়েদে আজম জিন্নার যথার্থ পূর্বসূরী।”
হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের সঙ্গে সঙ্গে আসে গােরক্ষা আন্দোলন ও শিবাজী উৎসব। আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ সরস্বতী ১৮৮২ সালে ‘গাে-হত্যা নিবারণী সভা’ স্থাপন করেন। ভারতের অন্যান্য অংশের মত বাংলায়ও গাে-রক্ষণী সভা স্থাপিত হয়। এই সভায় সদস্যরা ঘুরে ঘুরে গােরক্ষার আদর্শ প্রচার করতেন। এই সভার প্রচারে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক জমিদার তাদের জমিদারীর মধ্যে গাে-হত্যা এমনকি গাে-কোরবানি বন্ধ করার আদেশ দেন। এতে করে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের অবনতি হয়।
কাজেই হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদীদের কাছে জাতি শব্দটির অর্থ কখনই নির্দিষ্ট বা স্পষ্ট ছিল না—বর্ণভেদ অর্থেও তারা জাতি শব্দটা ব্যবহার করেছেন, আবার ইউরােপীয় জনগােষ্ঠী অর্থেও জাতি শব্দটা ব্যবহার করেছেন, আবার আফ্রিকা মহাদেশের বাসিন্দাদের এক বৃহৎ জনসমষ্টিকেও কৃষ্ণ জাতি বলে বর্ণনা করেছেন। তবে সাধারণভাবে তাদের প্রভাবে প্রাগ্রসর উচ্চবর্ণ শিক্ষিত ও প্রধানত সম্পন্ন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনে ‘National pride’ বা জাতিগর্ব সৃষ্টি হয়। কেনেথ জোন্স তার ‘আর্য ধর্ম’ গ্রন্থে৩৮ কিভাবে ধীরে ধীরে হিন্দু জাতিতত্ত্ব গড়ে ওঠে তার সুন্দর ও সুস্পষ্ট বিবরণ পেশ করেছেন। লালা লাজপত রায়। প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত ‘পাঞ্জাবি’ নামক পত্রিকায় ১৯০৮ সালে লালা লালচাঁদ ‘Self-abnegation’ শিরােনামে ধারাবাহিকভাবে কতকগুলি রচনা প্রকাশ করেন। ‘Self-abnegation’ ১৯৩৮ সালে সংকলনের আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে ইন্দ্র প্রকাশ ‘এ রিভিয়ু অফ দ্য হিস্ট্রি অ্যান্ড ওয়ার্ক অফ হিন্দু মহাসভা’ গ্রন্থে লালচাদের রচনাগুলিকে হিন্দু মহাসভার ভিত্তিপ্রস্তর বলে উল্লেখ করেছেন। কেনেথ জোন্সের গ্রন্থটিও লালচাঁদের রচনা থেকে বহু উদ্ধৃতি সমৃদ্ধ। ‘আর্য ধর্ম’-এর দশম পরিচ্ছেদ শুরু যে সুদীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়ে তার শেষ অংশে হিন্দুদের কিভাবে দেশ গড়তে হবে তার পরিকল্পনায় বলা হয,
“And this can only be achieved asserting purely Hindu interest, and not by an Indian propaganda, the consciousness must arise in the mind of each Hindu that he is a Hindu, and not merely an Indian.”
হিন্দুর উপর এই বিশেষ গু(ত্ব আরােপ করার ফলে ভারতীয় জনগণকে অনিবার্যভাবেই মুসলমান, শিখ, খ্রীষ্টান প্রভৃতি ধর্মাবলম্বীতে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন করার নীতি প্রতিষ্ঠা করা হল এবং একই সঙ্গে ভারতকে হিন্দুর দেশ, মুসলমানের দেশ প্রভৃতি নামে ভাগ করার পথ উন্মুক্ত করা হল।
কেনেথের দেওয়া সব থেকে বড় তথ্য হল, লাজপত রায়ই ১৯২৫ সালে প্রথম ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের প্রস্তাব আনেন। আর সি মজুমদার সম্পাদিত ‘স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম’ গ্রন্থে এ ঘটনার উল্লেখ আছে। ‘পাঞ্জাবি’ পত্রিকাতে প্রতিনিয়ত যে ধরনের উস্কানিমূলক লেখা প্রকাশিত হয়, তা ঐ অঞ্চলের মুসলিম মানসে বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা জাগিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, সেই বিচ্ছিন্নতার শিক্ষা পরবর্তীকালে খালিস্তানপন্থী শিখেরাও গ্রহণ করেছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারতে পাকিস্তান ও পরবর্তীকালে খালিস্তানের তাত্ত্বিক ভিত্তির প্রকৃত নিমার্ত হলেন সাম্প্রদায়িক স্বাদেশিকতার নিরিখে হিন্দু মহাসভার অন্যতম জন্মদাতা লালা লালচাঁদ। ‘আর্যধর্ম’ গ্রন্থে কেনেথ জোন্স মন্তব্য করেছেন,
“Lal Chand’s letters marked a move from Arya Dharma to Hindu consciousness. They laid the foundation for Hindu politics, as an alternative to the national politics of the Congress.”
লালচাঁদের পরে হিন্দুসভার অন্যতম নেতা ভাই পরমানন্দও লাহােরে মােহাম্মদ ইকবালের ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ উত্থাপিত হওয়ার দু’বছর আগে ১৯৩৮-এ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ভাগের কথা বলেন।
তিলকের বদ্ধমূল সংস্কার ছিল ধর্মই হল জাতি গঠনের ভিত্তি। সুতরাং হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক জাতি। তার জাতীয়তাবাদ প্রকৃতপক্ষে হিন্দুত্ববাদ, যদিও রাজনীতির প্রাথমিক পর্বে তিনি হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়ে বিধাসী ছিলেন। তিনি ধর্ম বলতে স্পষ্ট করে হিন্দু শব্দটাই ব্যবহার করেছেন। ‘স্বরাজ’ বলতেও তিলক বুঝিয়েছেন হিন্দু স্বরাজ আদর্শকে—যেখানে অহিন্দুদের স্থান নেই। রাজনীতিকে তিনি স্থাপন করেছিলেন ধর্মের উপরে।
তিলকের ধর্মীয় ভাবনা শিক্ষানীতি সম্পর্কে তাঁর চিন্তাকেও আচ্ছন্ন করেছিল। শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে তিনি স্পষ্টই বলেছেন যে, অন্যান্য কতকগুলি বিশেষ দিকে লক্ষ্য রাখার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাও ধর্মনিরপেক্ষ না হয়ে তা ধর্মভিত্তিক হওয়া প্রয়ােজন। কারণ ধর্মের মধ্য দিয়েই মানুষ ঈরত্ব প্রাপ্ত হয়। এই ধর্মীয় শিক্ষা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও প্রচলিত হওয়া প্রয়ােজন— এটাই ছিল তাঁর অভিমত। তিনি বলেছেন, বিদ্যালয়ে হিন্দুদের জন্য হিন্দুত্ব এবং মুসলমানদের জন্য ইসলাম শিক্ষা দেওয়া উচিত, যদিও তিনি মনে করতেন সব ধর্মের মধ্যে হিন্দু-ধর্মই সর্বাপেক্ষা সহনশীল। আর তাঁর এই রক্ষণশীল ধর্ম-ভিত্তিক চিন্তা-ভাবনার জন্যই তিনি সমস্ত রকম সমাজ-সংস্করণ প্রচেষ্টায় বিরােধিতা করেছিলেন। তাই তিনি রাণাডে, গােখেল পৃষ্ঠপােষিত ‘National Social Conference’-এর সংস্কার প্রচেষ্টার ঘােরতর বিরােধী ছিলেন এবং ১৮৯৫ সালে পুণায় কংগ্রেস অধিবেশন মন্ডপে এই সংস্কারপন্থী সংগঠনের অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধতা করেছিলেন।
মােটামুটিভাবে বলা যেতে পারে, ভারতের জাতীয় আন্দোলনে তিলকের আপসহীন এত অসামান্য অবদান সত্ত্বেও তাঁর সমাজ-চিন্তা ধর্মচিন্তা রক্ষণশীলই ছিল। বাংলায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ ও ধর্মচিন্তার বিপরীত মেরুতে তিনি অবস্থান করতেন। তিলকের এই ধরনের পশ্চাৎপদ সমাজ ও ধর্মচিন্তা মহারাষ্ট্র বা ভারতের সমাজ প্রগতির পর্বে আদৌ সহায়ক ছিল না। বরং সমাজে রক্ষণশীলতা জইয়ে রাখতে তিলকের চিন্তাধারার অবদান ছিল যথেষ্ট পরিমাণ। এজন্যই আধুনিক ভারতের ঘটনাবলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার মাইকেল এডােয়ার্ডস্ ‘দ্য লাস্ট ইয়ার্স অফ দ্য ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে তিলককে পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন এবং লিখেছেন,
“Tilak had been first to recognize the power for religious feeling as a weapon against the British ; Jinnah learned the lesson and turned it against Congress.”
ডি ডি সাভারকরও তাঁর ‘হিন্দুত্ব হু ইজ হিন্দু’ গ্রন্থে (১৯২৩) হিন্দুরা একটা আলাদা জাতি বলে উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে তিলকের মত সাভারকরও ছিলেন জিন্নার পূর্বসূরী। ১৯৩৭-এর ডিসেম্বর নাগপুরে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে তিনি বলেন,
“The idea that there could be one homogeneous all India nationhood was a mirage. The Hindu-Muslim scheme was an unpleasant fact. It could not be wished away or overcome by compromise. The only way to treat it was to recognise that all India was Hindustan, the land of Hindus, at once their father and holy land.” (আর সি মজুমদার সম্পাদিত ‘স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম’ গ্রন্থে উদ্ধৃত)।
এখানেই সাভারকর ক্ষান্ত হননি, হিন্দুদের জন্য জাতীয় ভাষা দাবী করে বললেন, ‘We Hindus are a Nation by ourselves.
জিন্না তাঁর বিষাক্ত দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রচার শুরু করেন ১৯৩৯-এ ও ১৯৪০-এ ভারত ভাগের দাবি তােলেন। কিন্তু একই দাবি সাভারকর তুলেছিলেন দেড় দশক আগে। সাভারকরের যুক্তি অনুসরণ করে জিন্নাও ঘােষণা করলেন যে, ভারতীয় মুসলমানরা শুধু একটা সম্প্রদায় নয়, তারাও একটা জাতি এবং ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু ও মুসলমান এই দুই জাতির বাস। এই দ্বিজাতি ভিত্তিতেই হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের দাবি। আর জে মুরের ‘Escape from Empire’ গ্রন্থে স্ট্যাফোর্ড ত্রি(পস আর জিন্নার মধ্যে ১৯৪২-এ পত্রালাপের কথা থেকে জানা যায়, পাকিস্তান’-এর দাবি মুসলিম লীগ সরকারিভাবে ১৯৪০-এ তুললেও, ওই পত্রালাপে নতুন ভারতীয় ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাব ছিল জিন্নার।
আসলে জিন্না শেষ পর্যন্ত একটি ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন ভারতের ব্যবস্থা চালানাে যায় কিনা তা যাচাই করতে রাজি ছিলেন, যদি জাতীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে সন্তোষজনক উৎসাহ পেতেন। কিন্তু জিন্নার কথায় জাতীয় নেতৃত্ব কর্ণপাতই করেননি। বিখ্যাত গবেষক বিমলানন্দ শাসমল লিখেছেন, “কায়েদে-আজম জিন্নার কাছে পাকিস্তানই শেষ কথা ছিল না। সুযােগ পেলে তিনি সন্তোষজনক মীমাংসায় আসতে রাজি ছিলেন। কিন্তু …কংগ্রেস নেতাদের একগুয়েমি ও বাস্তব সম্বন্ধে এক বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি জিন্না ও মুসলিম লীগ নেতাদের এক নিরুপায় অবস্থার দিকে ঠেলে দেয় এবং যখন তারা দেখলেন, …নেতাদের সঙ্গে কোনও মীমাংসা সম্ভবপর নয়, তখনই তাঁরা দেশ বিভাগই একমাত্র সমাধান বলে মনে করলেন।”
[৭]
ফজলুল হকের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ১৯৪০-এ তিনি যে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন তাতে কোথাও পাকিস্তান শব্দটি ব্যবহার করেননি। কিন্তু এক বছর পরে ১৯৪১-এর ২৩ মার্চ ফজলুল হকের নিষেধ অমান্য করে মুসলিম লীগ কলকাতার মহম্মদ আলি পার্কে পাকিস্তান দিবস পালন করে। ক্ষুব্ধ ফজলুল হক তখন শরৎচন্দ্র বসু, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি প্রমুখের সাহায্যে গঠন করেন। ‘প্রােগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টি’। এবং তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে চারজন লীগ মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। তখন ২৫ জন কংগ্রেস বিধায়ক সমর্থন জানান ফজলুল হককে। তখনকার মত টিকে গেল হক মন্ত্রীসভা।
ইতিমধ্যে ঘটল আগষ্ট বিপ্লব। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বাংলার গভর্ণর জন রবার্ট উগ্র দমননীতি চালালে ফজলুল হক ও শ্যামাপ্রসাদ প্রতিবাদ করেন, তখন ক্ষুব্ধ গভর্ণর পুরাে হক মন্ত্রীসভাকেই বরখাস্ত করেন। গভর্ণরের আহ্বানে ১৯৪৩-এর এপ্রিলে নাজিমুদ্দিন নতুন করে মন্ত্রীসভা গড়লেন। তার পরে ভয়ংকর বেগে এসে পড়ল পঞ্চাশের মন্বন্তর। এ মন্বন্তর যে মনুষ্য সৃষ্ট ছিল এ বিষয়ে কোনও নতুন প্ররে অবকাশ নেই। কিন্তু ওই মন্বন্তর সৃষ্টিকারীদের ধর্ম কি ছিল? মন্বন্তর সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীদের ধর্মীয় পরিচয় তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, অচিন্ত্যকুমার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ কথাসাহিত্যিকদের রচনাবলি থেকে আমরা সহজে জানতে পারি। তাঁদের সাহিত্য থেকে জানা সত্যটা কী? ওই মন্বন্তর সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীরা ছিল প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। নাজিমুদ্দিনের লীগ সরকার দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ ও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে নাজিমুদ্দিন কথিত মাড়ােয়ারি আর হিন্দু মহাসভার ধনী ব্যবসায়ীরা অঢেল টাকা দিয়ে লীগ সরকারের পতন ঘটাল। সমস্ত ঘটনাবলির কার্যকারণ পরম্পরা থেকে বাংলার মানুষ সহজেই বুঝতে পারল যে, মুসলিম লীগই সাধারণ মানুষের প্রকৃত উপকারী বন্ধু। বহু সংগ্রাম ও চেষ্টায় লীগ নেতারা যা পারেনি ঐ ব্যবসায়ী ও মহাজনরা তাদের আচরণ দিয়ে সেই কাজ করল—বাংলার সাধারণ মানুষের বৃহত্তর অংশকে লীগের পক্ষে যােগদানে বাধ্য করল। এই সত্যটি বােঝা উচিত যে, বাংলার দুর্ভিক্ষ র করাল দিনগুলির অন্তরালে মুসলিম লীগের অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে অমুসলমান ব্যবসায়ী ও মহাজনদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু কায়েমি স্বার্থ তখনকার মত টাকার জোরে ওই লীগ মন্ত্রীসভার পতন ঘটালেও শেষ রা করতে পারেনি, কারণ পরবর্তী নির্বাচনে মুসলিম লীগই বাংলায় বৃহত্তম দল হিসেবে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দির (১৮৯২-১৯৬৩) নেতৃত্বে প্রাদেশিক আইনসভা অধিকার করল। লীগের এই সাফল্যকে জিন্না বর্ণনা করলেন,
“a plebiscite of the Muslims of India on Pakistan.’
১৯৪৬-এর মার্চ মাসে ক্যাবিনেট মিশন এল ভারতবর্ষে। এই মিশন প্রস্তাবে ভবিষ্যতে মুসলমান সম্প্রদায় ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার পেয়েছিলেন। কিন্তু জিন্না ও মুসলিম লীগ এই প্রস্তাবকে নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করে ভারত বিভাগকে একটি ভবিষ্যতের সম্ভাবনা মাত্র হিসেবে রেখেছিলেন, অবশ্যম্ভাবী বলে নয়। নেহরুর এক গুঁয়েমির জন্য এই ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব কার্যকরী করা যায়নি। অথচ এই প্রস্তাব মেনে নিলে ভারত ভাগ আটকানাে যেত। সেই সঙ্গে অপর দিকে আবার মুসলিম লীগকে বাদ দিয়েই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হল, কার্যত যা ছিল লীগবিহীন কংগ্রেস সরকার। একতরফা সরকার গঠিত হলে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দি ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন,
“We will see that no revenue is derived by such Central Government from Bengal and consider ourselves as a separate State having no conection with Centre.”
সাম্প্রতিককালে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলার বিরােধের সূচনা এইখানে। এই বিরােধের প্রথম প্রকাশ হল ১৬ অগস্টের ‘Direct Action বা প্রত্যক্ষ্য সংগ্রাম। এটা ইতিহাসের পরিহাস যে ঐ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কার্যক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতে বা হত্যার তান্ডবে পরিণত হয়, যা ‘Great Calcutta Killing’ নামে আজও সবচেয়ে কুখ্যাত অধ্যায়।
উল্লেখ্য, ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগের ‘Direct action’ বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম সংঘটিত হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার এই সংগ্রামকে কেন্দ্র করে কেবলমাত্র কলকাতাতে দাঙ্গা সংঘটিত হয় অথচ প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক ছিল সারা ভারতে। এ দাঙ্গার পিছনে মুসলিম লীগের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য—যা বহু পঠিত ও আলােচিত। জয়া চ্যাটার্জি তাঁর ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, এই দাঙ্গার জন্য হিন্দুদের একাংশও (হিন্দু মহাসভা, আর. এস. এস, মাড়ােয়ারি বণিক গােষ্ঠী, অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দল, জনসংঘ, অন্যান্য বহু হিন্দু পরিচালিত সংঘ বা দল প্রভৃতি) মুখিয়ে ছিলেন। দাঙ্গার প্রথম চোটে মুসলিমরা দাপট দেখালেও শেষ। দাপটটা কিন্তু হিন্দুরাই দেখিয়েছিল। সমকালীন প্রতিবেদন ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ৪৬-এর দাঙ্গা কেবল এক পক্ষের ছিল না, তা ছিল কলকাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ স্বল্পস্থায়ী গৃহযুদ্ধ, যাতে সর্দার প্যাটেলের মন্তব্য অনুসারে—“হিন্দু হ্যাড দ্য বেস্ট অফ ইট’। সত্যিই যদি সরকারি সহযােগিতায় পূর্ব প্রস্তুতি অনুসারে মুসলমানরা (তখন কলকাতায় মুসলিম জনসংখ্যার হার ছিল মাত্র ২৪ শতাংশ) দাঙ্গা করে থাকে তাহলে কি শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে হিন্দুরা সেদিনের গৃহযুদ্ধে জয়ী হতে পারত? শ্রীমতী চ্যাটার্জি যে সিদ্ধান্তের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন তা সকলের পছন্দ নাও হতে পারে। তার যুক্তি ও তথ্যাবলি থেকে আমরা জানতে পারি যে, কলকাতার হিন্দুদের একাংশ তলে তলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি ছিল এবং তৎকালীন বাংলা সরকারের গােয়েন্দা বিভাগ ঐ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির আগাম ইঙ্গিতগুলি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল।
বিভিন্ন সংবাদপত্র যেমন- আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, অমৃতবাজার পত্রিকা, বসুমতী, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড লীগ সরকার ও জনমতের বিরুদ্ধে আম জনমত গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। শুধু তাই নয়, ভারত সেবাশ্রম সংঘের সঙ্গে অমৃতবাজার পত্রিকার মৃণালকান্তি ঘােষের, দৈনিক বসুমতীর হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘােষের এবং মডার্ন রিভিউ পত্রিকার রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের হৃদ্যতা ছিল। লক্ষ্য করার মত বিষয় হল, হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ নানা সময়ে ভারত সেবাশ্রম সংঘের নানা অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করতেন। এদের মধ্যে উল্লেখ্যযােগ্য ব্যক্তিরা হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য পি এন ব্যানার্জি, ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের প্রাক্তন সদস্য ও মন্ত্রী বি এস সিংহরায়, কেন্দ্রীয় আইনসভার কংগ্রেস সদস্য শশাঙ্ক শেখর সান্যাল, কংগ্রেস এম এল সি প্রমুখরা। হিন্দু দাঙ্গাকারীদের সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণে তৎকালীন এমবর্ধমান উগ্র সাম্প্রদায়িকতার প্রেক্ষাপটে কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দুদের সংগঠিত করতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলাে কতটা কার্যকর ভূমিকা নিতে পেরেছিল তা প্রকাশ পায়। এই সাম্প্রদায়িকতা ছিল বিশ শতকের ৪০-এর দশকে উচ্চবর্ণ ভদ্রলােকশ্রেণীর রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মুসলিম দাঙ্গাকারীদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরে আসা ভাসমান শ্রেণীর লােক। কিন্তু অবাকের বিষয় এই যে, বহু ভদ্রলােক হিন্দুকে ছেচল্লিশের দাঙ্গার অভিযােগে গ্রেপ্তার করা হয়। দাঙ্গায় জড়িত হিন্দু জনতার গঠন সম্পর্কে আলােচনাকালে অধ্যাপক সুরঞ্জন দাশ লক্ষ্য করেছেন যে,
“বাঙালি হিন্দু ছাত্র ও অন্যান্য পেশাজীবী বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লােক …সক্রিয় ছিল। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী সওদাগর, শিল্পী, দোকানদার …দাঙ্গার অভিযােগে গ্রেফতার হয়। মধ্য কোলকাতায় মুসলমানদের একটি সভা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য অন্যদের সাথে ভদ্রলােকেরাও অংশগ্রহণ করে, ঐ সভায় প্রধানমন্ত্রী নিজে ভাষণ দেন। বিখ্যাত চ, চিকিৎসক ডা. জামাল মােহাম্মদকে হত্যাকারী জনতার মধ্যে একটা বড় অংশ ছিল ‘শিক্ষিত’ যুবক।…এটা বিস্ময়কর ছিল না যে, তাদের মধ্যে অনেকে পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলছিল।”
আরও বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, ছেচল্লিশের দাঙ্গার পর চলমান অসন্তোষের মধ্যে মুসলিম জনতার মাঝে বােমা নিক্ষেপের জন্য হিন্দুদের মধ্য থেকে গ্রেপ্তার হওয়া একজন ছিলেন বর্ধমানের বিখ্যাত চিকিৎসক ডা. মহেন্দ্রনাথ সরকার। তিনি স্বীকার করেন “এখন আমি একজন কংগ্রেস নেতা। আগে আমি ছিলাম হিন্দু মহাসভার সদস্য। বাংলা বিভাগের পক্ষে আমি এ আন্দোলনে যােগ দিয়েছি।” ১৯৪৬-র দাঙ্গায় শিখরাও হিন্দুদের সঙ্গী হন। তাদের নিয়ন্ত্রণে যে সব মােটরগাড়ী ছিল তা হিন্দুদের উদ্ধার ও ত্রাণকার্যে লাগার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের আক্রমণ করার জন্যও ব্যবহৃত হয়। এই দাঙ্গায় শিখদের যােগদান প্রসঙ্গে এইচ ভি হডসন বলেছেন,
“If the Muslims gave the provocation and started the holocaust, they were certainly its worst victims, for they were in a minority in the city, and the Sikhs in particular, a comparatively small community in Calcutta but tough and armed and largely motorised, being the mechanics and drivers of Bengal as of so many places, swept furiously through the Mulsim quarters slaying mercilessly as they went.”
আসলে বাংলা ভাগের জন্য অজুহাত খাড়া করতে বাঙালি হিন্দুদের একটা প্রভাবশালী অংশ এইরকম একটা হত্যাকান্ড মনে মনে দৃঢ়ভাবে চাইছিলেন আর ১৬ আগস্ট মুসলিম লিগের ‘প্রত্যক্ষ্য সংগ্রাম’ দিবসে তাদের সেই বহু আকাঙ্খিত সুযােগটি এনে দিয়েছিল। ১৯৪৬-এর সেই ভয়ংকর দাঙ্গাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়ে অর্থাৎ তার সমস্ত দায় অপদার্থ মুসলিম লীগ সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই বাঙালি হিন্দুদের প্রভাবশালী অংশ প্রদেশ বা বাংলা ভাগের জন্য শুরু করে তুমুল আন্দোলন (অথচ ১৯০৫ সালে এই বাঙালি হিন্দুরা লর্ড কার্জনের বাংলা ভাগের চক্রান্তকে রুখে দেওয়ার জন্য বুকের রক্ত দিয়েছিলেন, ১৯৪৭ সালে তারাই আবার বাংলা বিভাগের দাবি তুলে বাংলা ভাগ করিয়েছিলেন)।
জয়া চ্যাটার্জি তাঁর পূবােক্ত গ্রন্থে বাংলার জাগরণের সুফলভােগী মধ্যবিত্ত শিথিত বর্ণহিন্দু বাঙালির ধর্মীয় তথা ভদ্র সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ এবং বাংলাভাগের নাটকীয় কাহিনিতে এই শ্রেণীর বিশেষ ভূমিকা ও বহু বিস্মৃত কীর্তির ধর্মীয় চরিত্র উদঘাটন করেছেন ও একই সঙ্গে এই শ্রেণীর কায়েমি স্বার্থের অসংকোচ পরিপােষণার বহু দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করেছেন। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, কীভাবে এই শ্রেণী নিজেদের সাম্প্রদায়িকতাকে জাতীয়তাবাদের মােড়কে ঢেকে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল এবং বাংলাভাগের পথকে প্রশস্ত করেছিল।
কলকাতার পর নােয়াখালিতে দাঙ্গা হয়। আক্রমণের শিকার মূলত হিন্দুরাই। ‘মডার্ন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে সুমিত সরকার এই দাঙ্গা সম্পর্কে বলেছেন যে, নােয়াখালির দাঙ্গা ছিল সম্পত্তি-ঘটিত। এই দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৩০০, যা কলকাতা বা বিহারের দাঙ্গার তুলনায় অত্যন্ত নগন্য। নােয়াখালিতে হত্যার সংখ্যাল্পতার কারণ দাঙ্গাকারীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সম্পত্তি ও নারী।
[৮]
এই সব দাঙ্গার ওজুহাতে হিন্দু মহাসভা ও হিন্দু নেতাদের একাংশ বাংলাকে ভাগ করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৭ সালের এপ্রিলে, হুগলির তারকেরে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার বার্ষিক প্রাদেশিক অধিবেশনে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি হিন্দুর জন্যে হিন্দুস্থান ও বাংলাভাগের দাবির পুনরাবৃত্তি করলেন। ঐ অধিবেশনে হিন্দু মহাসভার সভাপতি নির্মল চ্যাটার্জি এক ভাষণে,
Ticmal, “Our demand for partition today is…to prevent the disintegration of the nationalist element and to preserve Bengal’s cutture and to secure a Homeland for the Hindus of Bengal which will constitute a Nationalist State as a part of India.”
শ্যামাপ্রসাদের চিন্তা ছিল সম্ভাব্য পাকিস্তানের হাত থেকে সংখ্যালঘু হিন্দুদেরকে বাঁচানাের। খেয়াল করেননি যে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভাগাভাগিটা সম্প্রদায়গত ভাবে হবার কথা নয়, হবার কথা মতাদর্শগত ভাবে। তার চেয়েও বড় কথা, বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদেরকে ভয় করবার কোনাে যৌক্তিক কারণ ছিল না। সংখ্যার দিক থেকে দুই সম্প্রদায়ের ভেতর ব্যবধানটা আকাশ পাতালের তাে ছিলই না, ছিল নিতান্ত সামান্য। তদুপরি শিং, চাকুরী, পেশা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবদিক দিয়েই হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা অনেক বেশী এগিয়ে ছিল, প্রতিবেশী মুসলমানদের তুলনায়। তাই রাজনৈতিক ক্ষমতা মুসলমানদের কাছে চলে গেলেও, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে হিন্দু প্রাধান্যই থাকবার কথা।
আর রাজনৈতিক ক্ষমতা যে নিরঙ্কুশভাবে মুসলমানদের কজাগত হবে এমন কোনাে আশঙ্কাও ছিল না। ১৯৩৭ সালে কংগ্রেসের অসম্মতির দরুন ফজলুল হক মুসলিম লীগের সঙ্গে যে যৌথ মন্ত্রীসভা গঠন করেছিলেন এমনকী তাতেও হিন্দু সদস্যরা ছিলেন, এবং মুসলমান হিন্দুর সংখ্যানুপাতটি ছিল ৬-৫। বাংলার আসল সমস্যাটা সম্প্রদায়গত ছিল না, ছিল শ্রেণিগত, যে জন্য দেখা যায় হক সাহেব কৃষক প্রজা পার্টির নেতা হওয়া সত্ত্বেও তার মন্ত্রীসভায় তাঁর দলের সদস্য ছিলেন তাঁকে সহ মাত্র দু’জন। এবং এটাও অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ যে, মন্ত্রীসভার এগারাে জন্য সদস্যের ভেতর আটজনই ছিলেন কোনাে না কোনাে ভাবে ভূসম্পত্তির মালিক।৪৮ হক মন্ত্রীসভা থেকে মুসলিম লীগ যখন সমর্থন প্রত্যাহার করে নিল, হক সাহেব তখন যে ‘প্রগ্রেসিভ’ যুক্তমন্ত্রীসভা গঠন করতে উদ্যোগ নেন, তাতে শরৎচন্দ্র বসুর হবার কথা ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, সেটা সম্ভব হয়নি, কারণ যেদিন তার শপথ নেবার কথা সেদিন সকালেই শরৎ বসুকে গ্রেফতার করা হয়। মন্ত্রীসভায় শ্যামাপ্রসাদের থাকার কথা ছিল, তিনি ছিলেনও, তাকে দেওয়া হয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এটাও তাৎপর্যহীন নয় যে, হক সাহেব যদিও মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, কিন্তু মন্ত্রীসভা পরিচিত হয়েছিল শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা নামে, হিন্দু নামটি আগে এসেছে, মুসলিম নামটি পরে। পরবর্তীতে খাজা নাজিমুদ্দিন যে মন্ত্রীসভা গঠন করেন তাতেও হিন্দু সদস্যরা ছিলেন। ১৯৪৬-এর নির্বাচনের পরে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছেন কংগ্রেসের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুক্ত মন্ত্রীসভা গঠনের। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি মূলত কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপে। ১৯৩৭-এর মতাে ১৯৪৬-এ কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে লীগকে গুরুত্বপূর্ণ করতে চায়নি। অন্যদিকে জিন্নাহও চাননি মুসলিম লীগ কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলাক। তার আশঙ্কা ছিল ওই কাজটি করলে যে অলঙ্ঘনীয়’ পার্থক্যের ওপর পাকিস্তানের দাবীটি নির্ভরশীল সেটি হয়তাে বা দুর্বল হয়ে যাবে, তাছাড়া হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দি দ্বিতীয় ফজলুল হক-এ পরিণত হয়ে। তার একক নেতৃত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলুক এটাও তার কাম্য ছিল না।
সব মিলিয়ে সত্যটা তাে ছিল এই যে, ভয়ের কোনাে বস্তুগত কারণ ছিল না। মূল ব্যাপারটা ছিল পাকিস্তান হবে মনে করে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতর যারা তুলনামূলকভাবে বিত্তবান, যাদেরকে বর্ণহিন্দু বলা হয়, তাদের স্বার্থ রক্ষা। করা, এবং কলকাতা যাতে কিছুতেই তাদের হাত ছাড়া না হয়ে যায় সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া। পূর্ববঙ্গের হিন্দু, যাদের অধিকাংশই নিম্নবর্ণের, দেশভাগ হলে তাদের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে সে নিয়ে ওই ভদ্রলােকদের মাথা ব্যাথা ছিল না।
অথচ অনেকে বলেন, পাকিস্তানের হিংস্র কবল থেকে সমগ্র বাংলাকে বাঁচাতে ও হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শ্যামাপ্রসাদ বাংলাভাগের দাবি জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। এটাই যদি বাংলাভাগের কারণ হয়, তাহলে ভারতের সীমানার মধ্যেও তাে অখণ্ড বাংলা গড়তে পারতেন শ্যামাপ্রসাদ ও তাঁর অনুগামীরা। কেনই বা তারা ভারতের মধ্যকার অখণ্ড বাংলারও বিভাজন চেয়েছিলেন? উত্তর জলের মতাে পরিষ্কার—ভারতের মধ্যে থাকলেও মুসলিম প্রাধান্যযুক্ত অখণ্ড বাংলায় পূর্বের মতন হিন্দুদের আর একাধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না। তাই দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলির ঘােষণার দুদিন পরেই শ্যামাপ্রসাদ বাংলার ছােটলাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি করলেন যে, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ভাগ করলে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলার হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ গঠন করে তা ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তখনকার জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি আচার্য কৃপালিনী এই দাবি সমর্থন করলে শ্যামাপ্রসাদ বঙ্গভঙ্গের আন্দোলন শুরু করেন। তিনি, হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারা সভা-সমিতি করে সাধারণ হিন্দুদের বুঝিয়ে চললেন,
“বাঙালি হিন্দুর সংস্কৃতি, সভ্যতা, ভাষা ও ঐতিহ্য গত ১০ বছরের শাসনের ফলে ধ্বংস হইতে চলিয়াছে। এইজন্য হিন্দু বঙ্গভঙ্গ দাবি তুলিয়াছে, এই স্বতন্ত্র হিন্দু-বাংলার সবটাই …পূর্ববঙ্গের বিপন্ন হিন্দুদের একটি প্রকাণ্ড আশ্রয়স্থল হইবে। …স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠনের পর যেমন কতক হিন্দু পূর্ববঙ্গে থাকিয়া যাইবেন, তেমনি সেই সংখ্যার মুসলমানও পশ্চিমবঙ্গে থাকিয়া যাইবেন। এইরূপ অবস্থায় পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের উপর কোনরূপ অত্যাচার করিবার পূর্বে লীগ গভর্ণমেন্টকে যথেষ্ট চিন্তা করিয়া কাজ করিতে হইবে।”
শ্যামাপ্রসাদ ১৯৪৭ সালের ১৯ মার্চ এক বিবৃতিতে বললেন, “প্রদেশটি যে গুরুতর সাম্প্রদায়িক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। তার একমাত্র শান্তিপূর্ণ সমাধান হচ্ছে বাংলার বিভাজন। এর ফলে যে যে অঞ্চলে বাংলার দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের সংখ্যাধিক্য আছে সেখানে তারা নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিকশিত করার পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করবে।” আজ যারা বলছেন, শ্যামাপ্রসাদ না থাকলে ভারতে আজকের পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব থাকত না কিংবা বাঙালির একটা বড় অংশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেত, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, যে ব্যক্তি ১৯৪৭ সালের ৫ এপ্রিল হিন্দু মহাসভার তারকের সম্মেলনে বলেন,
“I can conceive of no other solution of the communal problem in Bengal than to divide the province and let the two major communities residing herein live in peace and freedom.”
তিনি কোনও অবস্থাতেই কোনও শুভবুদ্ধি মানুষের কাছে প্রণম্য হতে পারেন না। ২২ এপ্রিল বাংলা ভাগের দাবিতে দিল্লীতে এক জনসভা করে শ্যামাপ্রসাদ বলেন,
“This separation must not be dependent on Pakistan. Even if Pakistan is not conceded and some form of a week and loose centre envirage in the Cabinet Mission Scheme is accepted by the Muslim Leauge, we shall demand the creation of a new Province composed of the Hindu Majority areas in Bengal.”
অর্থাৎ বাংলাভাগের ব্যাপারটাব যে পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত নয়, শ্যামাপ্রসাদের এই বক্তব্য থেকে তা স্পষ্ট হয়।
পরে সুরেন্দ্রমােহন ঘােষ (যিনি ঐ সময়ে বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন ও শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে একযােগে বাংলা ভাগের জন্য কাজ করেছিলেন) এক সাক্ষাৎকারে গর্ডনকে বলেছিলেন যে, শ্যামাপ্রসাদ সেই সময় একান্তে বলেছিলেন এখন আমারা বিভক্ত করি এবং ইংরেজরা চলে গেলে তারপর আমরা সমগ্র অঞ্চল দখল করে নেব। সুরেন্দ্রমােহন ঘােষের এই বক্তব্যের মধ্যে সত্যতা আছে। কারণ, বাংলা তথা ভারত বিভাজন ঠিক হয়ে যাবার পরেই হিন্দু মহাসভা কর্তৃক এক গৃহীত প্রস্তাব থেকে মনে হয় শ্যামাপ্রসাদ মাত্র কিছুদিন আগে (১৯ মার্চ) বাংলা বিভাজনের পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছিলেন। তা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন এবং ‘যুদ্ধং দেহি’ মনােভাব গ্রহণ করেছিলেন। হিন্দু মহাসভার প্রস্তাবে বলা হয় “…যতক্ষণ না বিচ্ছিন্ন অংশগুলােকে ভারতীয় ইউনিয়নে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে এবং এর অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত শান্তি আসবে না।” হিন্দু মহাসভা বিশ্বাস করত, ভারতীয় ইউনিয়নে পূর্ব বাংলাকে ফিরিয়ে আনা মাত্র সময়ের প্রণ। কংগ্রেসের শীর্ষনেতারাও নিশ্চিত ছিলেন, পূর্ব বাংলা তথা পাকিস্তান হিন্দুস্তানে ফিরে আসতে বাধ্য হবে। প্যাটেলও এই বক্তব্য রেখেছিলেন।
১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাজন পরিকল্পনা ঘােষণা করলে হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস নেতারা একত্রে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে আরও জোরদার করলেন। তারা উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে, কাগজে বিবৃতি দিয়ে বােঝাতে লাগলেন যে, হিন্দুরা বিপন্ন, বাংলা ভাগ ছাড়া উপায় নেই। বাংলা পাকিস্তানে গেলে তাে বটেই, স্বাধীন সার্বভৌম হলেও এমনকী ভারতে থাকলেও হিন্দুদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাকে বিভক্ত করে হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ গঠন করতে হবে। সেইমত তারা বাংলার হিন্দুদের প্রভাবিত করতে লাগলেন। জাতীয় কংগ্রেসের নেতারাও প্রভাবিত হতে লাগলেন। শ্যামাপ্রসাদ সর্দার প্যাটেলকে এক চিঠিতে লিখলেন,
“আমি আশা করি শেষ মুহূর্তে মুসলিম লীগের ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা মেনে নেওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। মি. জিন্না যদি অবস্থার চাপে তা করতে বাধ্যও হয়, অনুগ্রহ করে বাংলাকে বিভক্ত করার ব্যাপারটা ব্যর্থ হতে দেবেন না। ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনায় যেরকম ভাবা হয়েছে সেরকম একটা শিথিল কেন্দ্রীয় সরকার স্থাপিত হলে বাংলায় আমাদের কোনওরকম নিরাপত্তা থাকবে না। পাকিস্তান হােক বা না হােক, আমরা বাংলার বর্তমান সীমানার মধ্যে দুটি প্রদেশ গঠন করার দাবি করছি।”
উল্লেখ্য, ভারতভাগ অনিবার্য না হলেও যে বাংলাভাগের দাবি অনিবার্যভাবে উত্থাপিত হত শ্যামাপ্রসাদের উপরােক্ত বক্তব্য থেকে তা-ই প্রমাণিত হয়।
এর পূর্বে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দি বলেন যে, বাংলাকে বিভক্ত করার প্রস্তাব বাঙালির আত্মহত্যারই শামিল হবে এবং দিল্লির সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন,
‘I am visualising an independent, undivided, sovereign Bengal in divided India.’
এবং শরৎ বসু এপ্রিল মাসে গঠন করলেন ‘অল বেঙ্গল অ্যান্টি-পাকিস্তান অ্যান্ড অ্যান্টিপার্টিশন’ কমিটি। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দি, শরৎ বসু, আবুল হাসিমের অখন্ড বাংলার স্বপ্নকে কীভাবে শ্যামাপ্রসাদ, আকরাম খান প্রমুখ নেতারা ভেঙে দিয়েছিলেন তার মূল্যবান ইতিহাস অমলেন্দু দে লিপিবদ্ধ করেছেন স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের পরিকল্পনা, প্রয়াস ও পরিণতি নামক গ্রন্থে। জয়া চ্যাটার্জিও এ প্রসঙ্গে মাড়ােয়ারি বণিক সম্প্রদায়ের প্ররােচনার কথা ব্যাখ্যা করেছেন। আর শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন এইসব বণিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, বাংলা অখন্ড থাকলে কলকাতার ওপর অবাঙালি ব্যবসায়ীদের একচ্ছত্র আধিপত্য আর থাকবে না। এই ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য শ্যামাপ্রসাদরা যেভাবে বাংলা ভাগ করে ছাড়লেন তা সত্যিই অবাকের। বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করার বিশেষ প্রয়ােজনীয়তা ইংরেজ বা দিল্লিওয়ালা অনুভব করতে পারেন। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ অবিভক্ত বাংলার যে সর্বনাশ করে গেলেন, সেই সর্বনাশ থেকে বাঙালি জাতি কি আর কোনও দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? ১৯৭১-এ বাংলাদেশ সৃষ্টিই তাে প্রমাণ করে শ্যামাপ্রসাদের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। ১৯৫২ সালে নদিয়ার চাকদহে এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, “বাংলাভাগের জন্য মানুষের (উদ্বাস্তুদের) এত কষ্ট হবে এ যদি আগে বুঝতে পারতাম তাহলে বাংলা ভাগ চাইতাম না। এখন মনে হচ্ছে। যােগেনবাবুরা বাংলাভাগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিলেন তা সঠিক ছিল।”
বলতে চাইছি যে, আরও অনেক অনালােচিত দিক আছে এবং আলােচনাতে সেই সব দিকগুলি টেনে এনে আরও বিস্তৃত করা প্রয়ােজন। গান্ধী, জওহরলাল, সুভাষচন্দ্র প্রমুখের সংগ্রামটা বিশেষভাবে বিদেশী ইংরেজদের বিরুদ্ধে আর শ্যামাপ্রসাদ, তুষারকান্তিদের সংগ্রামটা ছিল মুখ্যত স্বদেশীয়দের একাংশের বা বাংলার মুসলমানদের বিরুদ্ধে এবং রবীন্দ্রনাথের মত বাংলার অখন্ডতায় বিধাসীদের বিরুদ্ধে। তাই ফজলুল হক একবার সখেদে বলেছিলেন, “বাংলায় হিন্দুরাই যে নিখাদ স্বার্থের উপর প্রতিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িকতার মূর্ত প্রতীক সে কথা যদি আমি যে কোনও বিচারকের কাছে সন্তোষজনকভাবে প্রমাণ করাতে না পারি তাে আমি ফাঁসিতে ঝুলতে রাজি আছি।” এরা কখনও পরিচ্ছদে গান্ধীবাদী হয়ে কিংবা ভাষণে নেতাজীর মত আদর্শবাদী হয়ে অথবা কখনও ভঙ্গিতে রবীন্দ্রানুসারী হয়ে বাংলা ভাগের দাবিতে জনমত গঠন করেছিল এবং পরে দেশভাগের সমস্ত দায় মুসলিম লীগের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল।
দেশভাগজনিত দুর্ভোগ আজ প্রথম উদ্বাস্তু-প্রজন্মের সন্তান-সন্ততির নতুন-প্রজন্ম ভুলে গেছে, যারা তখন ঘরবাড়ি, জমিজমা, ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে এসে পশ্চিমবাংলার ক্যাম্প কলােনিতে অথই পাথারে পড়েছিলেন। তাদের বংশধররা আজ পশ্চিমবাংলার সমাজে বহু ক্ষমতা ও প্রভাবের অধিকারী। আজ যদি দুই বাংলাকে এক করে পশ্চিমবাংলা ছেড়ে তাদের পূর্বপুরুষদের দেশে ফিরে যেতে বলা হয় তাহলে তারা কখনও যাবেন না, কারণ ভারতের নাগরিকত্বের ও ভারতের নাগরিক জীবনের স্বাদ তারা পেয়েছেন, তাই আজ ভারতীয় জনতা পার্টি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে দেশভাগ (তথা বাংলা ভাগ) করার জন্য কৃতিত্ব ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামতে পারছেন।
১৯৪৭-এ দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাভাষীরাও দুভাগ হল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল উর্দু ভাষার তানশাহী। কিন্তু উর্দুর এই আধিপত্য পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা মেনে নেবে কেন? বহু সংগ্রাম চলল। অবশেষে ১৯৭১-এ উর্দুশাহীর করাল কবল থেকে মুক্তি পেল তারা। বাংলা ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ থেকে জন্মলাভ করল এক নতুন দেহ। ধর্ম তাকে মুসলিম বিধের সঙ্গে সংযুক্ত করলেও ভাষা তাকে বিধের মাঝে দিয়েছে স্বতন্ত্র মহিমা, নিজস্ব পরিচয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় বাঙালির পরিচয় কি দিয়ে হবে? ভাষা ছাড়া আর কোন পরিচয় আছে তার? অথচ হিন্দির আধিপত্যের মাঝে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তার বাংলা ভাষা-শিক্ষা ও চর্চার কোনও গুরুত্ব আছে কি? আবার বাংলাভাষীরূপে তার বাঙালি সত্তা বজায় রাখতে গেলে তা কি জাতীয় সংহতির বিরােধিতা ও স্বতন্ত্রতার পরিপােষণ করা হবে না? একুশ শতকে এসে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি কি নিজের পরিচয় নিয়ে অনিশ্চয়তার সম্মুখীন? তবে ভারতীয় বাঙালিরও একটা স্বতন্ত্র মহিমা আছে—বাংলাদেশের বাঙালির বেলায় রাষ্ট্রীয় ধর্ম হল ইসলাম, কিন্তু ভারতের যে বাঙালি তার ক্ষেত্রে ধর্ম হল ব্যক্তিগত বিষয়, মুসলিমই হােক কি হিন্দুই হােক, তার রাষ্ট্রীয় ধর্ম হল ধর্মনিরপেক্ষতা।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. জগদীশ নারায়ণ সরকার, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক (মধ্যযুগ), বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, ১৪১৪, পৃ. ১০।
- ২. আব্দুল করিম, সােস্যাল হিস্টরি অফ দ্য মুসলিমস ইন বেঙ্গল, চ্যাপ্টার-২, ৩ ও ৪, এশিয়াটিক সােসাইটি অফ পাকিস্তান, ঢাকা, ১৯৫৯।
- ৩. এস এ সিদ্দিকী, ‘কাস্ট অ্যামাঙ্গ মুসলিমস অফ ক্যালকাটা’, দেখুন-ইমতিয়াজ আহমদ সম্পাদিত, কাস্ট অ্যান্ড সােস্যাল স্ট্র্যাটিফিকেশান অ্যামাঙ্গ দ্য মুসলিমস, নিউদিল্লি, ১৯৭৩, পৃ. ১৫৩।
- ৪. অসীম রায়, ‘দ্য ইসলামিক সিনক্রিটিটিক ট্রাডিশন ইন বেঙ্গল’, প্রিন্সটন ইউনিভারসিটি প্রেস, ১৯৮৩।
- ৫. বিমলানন্দ শাসমল, স্বাধীনতার ফাঁকি, হিন্দুস্থান বুক সার্ভিস, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ৫৪।
- ৬. বি আর আম্বেদকর, পাকিস্তান অর দ্য পার্টিশান অফ ইন্ডিয়া, থক্কর কোম্পানী, মুম্বাই, ১৯৪৬, পৃ. ১১০৷
- ৭. সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, এ নেশন ইন মেকিং, ভাষান্তর-নলিনীমােহন দাশগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ১৯৮৯, পৃ. ১৮৭-৮৮।
- ৮. রবীন্দ্র রচনাবলি, খণ্ড -২৪, বিভারতী, কলকাতা, ১৯৯৮,পৃ. ২৬২।
- ৯. S Gopal, Studies in Bengal Renaissance, Calcutta, 1967, P. 257.
- ১০. পঞ্চানন সাহা, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নতুন ভাবনা, বিপ্লবী, কলকাতা, ১৯৯২, পৃ. ১২৬।
- ১১. বন্দেমাতরম, ৭ নভে.১৯০৭।
- ১২. হিতবাদী, ২১ সেপ্টেম্বর ১৯০৬।
- ১৩. মুনতাসির মামুন, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে প্রতিক্রিয়া, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃ. ৩০।
- ১৪. ‘প্রবাসী’, ফাল্গুন ১৩১৩।
- ১৫. নবনূর, আর্থিন ১৩১২।
- ১৬. ‘কোহিনূর’, ফাল্গুন ১৩১৩।
- ১৭. দেখুন-আর সি মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, ৪র্থ খণ্ড, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিকেশন প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৮২, পৃ. ৪০।
- ১৮. ইসলাম প্রচারক, বিভিন্ন সংখ্যা।
- ১৯. এম আর আখতার মুকুল, কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, সাগর পাবলিকেশন, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃ. ২১৬-১৭।
- ২০. এম এ রহিম, বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ২০০২, পৃ. ১৬৯।
- ২১. দেখুন-ড. নজরুল ইসলাম, বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, মিত্র ও ঘােষ, কলকাতা, ১৪০১, পৃ. ২১৭।
- ২২. নির্মলকুমার বসু, হিন্দু সমাজের গড়ন, বিশ্বভারতী, কলকাতা, ১৩৯১, পৃ.১৪০-৪১।
- ২৩. প্রফুল্লচন্দ্র ঘােষ, ‘মহাত্মা গান্ধী’, কলকাতা, ১৯৫৭, পৃ. ১৭৬।
- ২৪. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম, নবভারত পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৮৩, পৃ. ২০৫।
- ২৫. দ্য বেঙ্গলি, ২৫-০৪-১৯২৭।
- ২৬. আবুল কালাম আজাদ, ভারত স্বাধীন হল, ওরিয়েন্ট লংম্যান, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ২১।
- ২৭. অমৃতবাজার পত্রিকা, বিভিন্ন সংখ্যা।
- ২৮. জে এইচ ব্রুমফিল্ড, এলিট কনফ্লিক্ট ইন এ র্যাল সােসাইটি টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, ১৯৬৮।
- ২৯. এ জি লিওনার্ড, বেঙ্গল দ্য ন্যাশনালিষ্ট মুভমেন্ট ১৮৭৬-১৯৪০, নিউইয়র্ক, ১৯৭৪।
- ৩০. বিমলানন্দ শাসমল, ভারত কী করে ভাগ হলাে, হিন্দুস্থান বুক সার্ভিস, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ১৬৮।
- ৩১. সুরজিৎ দাশগুপ্ত, প্রসঙ্গ সাম্প্রদায়িকতা, পরিবেশক- মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃ.৪০।
- ৩২. প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায়, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্র-সাহিত্য প্রবেশক, প্রথম খণ্ড , বিভারতী, কলকাতা, পৃ. ৪৭।
- ৩৩. যােগেশচন্দ্র বাগল, হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত, ১৯৬৮, পৃ. ১১২-১১৩।
- ৩৪. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, ৩য় খন্ড, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিকেশন প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৩৭৮, পৃ ৫৩২।
- ৩৫. কেনেথ জোন্স, আর্যধর্ম হিন্দু কনসাসনেস ইন নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি পাঞ্জাব, মনােহর বুক সার্ভিস, নয়াদিল্লি, ১৯৭৬।
- ৩৬. আর সি মজুমদার সম্পাদিত, স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম, ভারতীয় বিদ্যাভবন, মুম্বাই, ১৯৭৮, পৃ. ৫৩৮।
- ৩৭. Asgar Ali Engineer, Communalism in India, Bombay, 1993, P. 83.
- ৩৮. Tilak, Speech delivered at Nasik in 1908, Selected Documents etc. ed.Ravindra Kumar, Vol.-IV, P. 50 ; স্ট্যানলি ওলপার্ট, তিলক অ্যান্ড গােখলে রিভােলিউশন অ্যান্ড রিফর্ম ইন মেকিং অফ মডার্ন ইন্ডিয়া, বার্কলে অ্যান্ড লস এঞ্জেলস ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, ১৯৬২, পৃ. ৭১-৭২।
- ৩৯. A.G. Noorani, Jinnah before Pakistan, The Statesman, 03-09-1994.
- ৪০. জয়া চাটার্জি, বেঙ্গল ডিভাইডেড হিন্দু কমিউনালিজম অ্যান্ড পার্টিশন ১৯৩২-১৯৪৭, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ, ১৯৯৪, প্রথম বাংলা সংস্করণ, এল অ্যালমা পাবলিকেশনস, কলকাতা, ২০০৩।
- ৪১. সুরঞ্জন দাশ, কমিউনাল রায়টস ইন বেঙ্গল ১৯০৫-১৯৪৭, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লি, ১৯৯১, পৃ. ১৮৩।
- ৪২. এইচ ডি হডসন, দ্য গ্রেট ডিভাইড অ্যান্ড পলিটিক্স ব্রিটেন ইন্ডিয়া পাকিস্তান, মনােহর পাবলিকেশন, নিউদিল্লি, ১৯৮১, পৃ. ১৬৭।
- ৪৩. Sugata Bose, Subhash Chandra Bose & Indian Struggle against India, New Delhi, 2011, P. 50.
- ৪৪. এ জি লিওনার্ড, ব্রাদার্স এগেনেস্ট দ্য রাজ এ বায়ােগ্রাফি অফ শরৎ অ্যান্ড সুভাষচন্দ্র বােস, ভাইকিং পেঙ্গুইন, নিউ দিল্লী, ১৯৯০, পৃ. ৫৭৪-৭৫।
- ৪৫. সুনীতিকুমার ঘােষ, বাংলা বিভাজনের অর্থনীতি-রাজনীতি, নিউ হরাইজন বুক ট্রাস্ট, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ৩০৪।
- ৪৬. India Annual Register, ed. by N. N. Mitra, 1947, Vol-1, Cal., P. 74.
- ৪৭. লিওনার্ড মােসলে, দ্য লাস্ট ডেজ অফ দ্য ব্রিটিশ রাজ, জয়কো পাবলিশিং হাউস, মুম্বাই, ১৯৭১, পৃ. ১০৭।
- ৪৮. দুর্গাদাস, সর্দার প্যাটেল করেসপন্ডেন্স, ১৯৪৫-৫০, ৪র্থ খণ্ড, আহমেদাবাদ, ১৯৭২, পৃ. ৪০-৪১।
- ৪৯. দ্য স্টেটসম্যান, ১২-১০-১৯৩৩।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।