লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে পবিত্র মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল মাওলানা খয়ের উদ্দিন। তিনি ছিলেন আরবী ভাষী। মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নিষ্কলুষতা একদিক থেকে হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর সাথে মিলে যায় এবং তাঁর চিন্তা চেতনা অনেক ক্ষেত্রে হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর সাথে একই বিন্দুতে গিয়ে একীভূত হয়।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ উপমহাদেশের খ্যাতিমান এবং শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গের অন্যতম। ব্রিটিশ দুঃশাসনের কবল থেকে এই উপমহাদেশের নির্যাতিত নিপীড়িত মানবতাকে মুক্ত করতে স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদান ঐতিহাসিকগণ ইতিহাসের সোনালী হরফে অঙ্কিত করে রেখেছেন। তাঁর রীতি নীতি নিয়ে মতবিরোধ করার মত বহু পণ্ডিতের আবির্ভাব ঘটলে আল্লাহ প্রদত্ত তাঁর যোগ্যতার স্বীকৃতি দিতে অমুসলিমরাও বাধ্য হয়েছে। অমুসলিমরাও অবনত শিরে মেনে নিত আজাদের দেওয়া যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য মতামত।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ৭ বছর বয়সে পিতার সাথে ভারতে হিজরত করেন। আজাদের আসল নাম ছিল মুহিউদ্দীন আহমেদ। তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করেন রাখেন আবুল কালাম আজাদ । তিনি তাঁর শ্রদ্ধেয় খালার নিকট কুরআন শিক্ষা করেন। এর পাশাপাশি প্রাচ্যের গোটা জ্ঞান ভান্ডার তিনি তাঁর পিতার নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেন। শৈশব থেকেই গভীর ধ্যান ও অধ্যয়নে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সীমাহীন আগ্রহ ছিল । গ্রন্থ অধ্যয়ন ছিল তাঁর প্রিয় কাজ। অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি কবিতা রচনায় মনোনিবেশ করেন। মাত্র ১০ – ১১ বছর বয়সেই কবিতা লিখতে শুরু করে। বাগ্নিতা এবং বক্তৃতার ময়দানে শুরু থেকেই তাঁকে অভিজ্ঞ মনে করা হয়। তুর্কী, ফারসী, আরবী উর্দূ, ইংরেজী, বাংলা প্রভৃতি ভাষাতেও তিনি অগাধ পাণ্ডিত্য লাভ করেন। লর্ড জর্জ এর মত উগ্রপন্থী রক্ষণশীল খ্রীষ্টানও তাঁর বই পুস্তক ও রচনাবলীর সাবলীলতায় আকৃষ্ট ও প্রভাবান্বিত না হয়ে পারেনি।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে ‘নীরাঙ্গে আলম’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি ১৫ বছর বয়সে ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশ করেন ‘লিসান আল সিদক’ নামে একখানি পত্রিকা। এছাড়াও তিনি ‘আখবারে ওয়াকীল’, ‘আন নাদওয়াহ’ ইত্যাদি পত্রিকায় যখন তিনি তাঁর যাদুতুল্য রচনা ছাপতে শুরু করলেন তখন যেন উর্দূ ভাষায় নব জীবন ও নব জাগরণের সঞ্চার হল।
‘আল হেলাল’ নামে সর্বপ্রথম তিনি উর্দূ ভাষায় একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার মাধ্যমেই তিনি মূলত রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। এটি শুধু একটি পত্রিকায় ছিল না, ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। কালক্রমে এই পত্রিকা খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এই পত্রিকায় তিনি বলকান ও অন্যান্য এলাকায় সংগঠিত মুসলিম নিধনের হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলি জাতির সামনে তুলে ধরেন তখন পাঠক মাত্রেই ক্রোধে ফেটে পড়ে এবং অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে। এই পত্রিকার মাধ্যমে সারা দেশ ইংরেজদের প্রতি ঘৃণা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে ফলে শাসক গোষ্ঠীর শত্রুতে পরিণত হতে থাকে। এভাবে শাসক গোষ্ঠী এক গণবদ্রোহের আশংকা করে এবং মাওলানা আজাদের পত্রিকাটির উপর কড়া নজরদারি শুরু করে। তৎকালীন সময়ে অনেক সংবাদপত্রই অর্থের লোভে ব্রিটিশদের হাতে বিক্রি করে দেয় কিন্তু মাওলানা আজাদের পত্রিকা শতচেষ্টা করেও ইংরেজরা ক্রয় করতে পারেনি এবং তারা আটকাতেও পারেনি। তাঁর পত্রিকা ‘আল হেলাল’ সম্পর্কে শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী (রহঃ) বলেন,
“আবুল কালাম আজাদ নামে আমাদের এক যুবক আছে। যার কলমের ক্ষুরধার লেখনী স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নব জাগরণ সৃষ্টি করেছে। এটা এমন এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা অনেক বড় বড় রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠনের পক্ষেও সম্ভব হয়নি।”
কিছুদিন যেতে না যেতেই ব্রিটিশ বেনিয়ারা মাওলানা আজাদের ‘আল হেলাল’ পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করে। কিন্তু মাওলানা আজাদ থেমে থাকেন নি, কিছুদিন পরে তিনি ‘আল বালাগ’ নামে আর একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। কিন্তু ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রে ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে সেটির প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মাওলানা আজাদ এতেও থেমে থাকেন নি। এরপর তিনি ‘পয়গাম’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। এরপর পরিস্থিতি অনুকুল ভেবে আবার তিনি ‘আল হেলাল’ পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদের বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতা এমনই ছিল যে, একবার তিনি অল পার্টি কনফারেন্সে (তৎকালীন ভারতের একটি সর্বদলীয় সংগঠন) বক্তৃতা করবেন। এই সুবাদে ব্রিটিশদের পদলেহী দু’শ সন্ত্রাসী শ্রোতা সেজে মাওলানা আজাদকে হত্যা করার জন্য উপস্থিত। তারা সুবিধামত ওৎ পেতে ছিল। কিন্তু কিছুক্ষন পর মাওলানা আবুল কালাম আজাদ জ্বালাময়ী ও মর্মস্পর্শী বক্তৃতা শুরু করলেন তখন সেই শ্রোতাবেশী সন্ত্রাসীরা তাঁর বক্তৃতায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে। মাওলানা আজাদের কথাগুলো তাদের হৃদয়ে তীর ও বর্শার মত বিঁধতে থাকে।
অন্য এক দিনের ঘটনা – একটি শত্রু মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নিকট লিখে পাঠায় যে, “আপনি আমাদের এখানে অনুষ্ঠিতব্য সেমিনারে অংশগ্রহণ করবেন না। এরপরও যদি বক্তৃতা করতে আসেন তবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত হয়ে আসুন।” তাদের এই হুমকির উত্তরে পালটা তিনি লিখে পাঠান,
“তোমাদের চিরকুট পাওয়ার আগে পর্যন্ত উক্ত প্রোগ্রামে আমার অংশগ্রহণ করাটা অনিশ্চিত ছিল। সঙ্গত কোন কারণে হয়তো প্রোগ্রাম বাতিলও হতে পারত। কিন্তু এখন জেনে রাখ, ইনশাআল্লাহ আমি অমুক গাড়িতে অমুক সময় কোন দেহরক্ষী ছাড়া একাই গিয়ে পৌঁছাব। যদি কারো সাহস হয়, বুকে হিম্মত থাকে তাহলে আমাকে ঠেকাতে এসো।”
একবার তিনি ইংরেজ দুঃশাসনের রোশানলের শিকার হয়ে কারাগারে জীবন কাটাচ্ছিলেন। বন্দী থাকাকালীন একবার সংবাদ এল যে, বাড়িতে তাঁর স্ত্রী মুহূর্ষু অবস্থায় মৃত্যুর প্রতিক্ষায় আছে। তখন সেখানে তাঁর অন্যান্য সাথীরা তাঁকে অনুরোধ জানালো স্ত্রীর সাথে শেষ বারের মত সাক্ষাৎ করার আবেদন জানিয়ে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত দিতে। এতে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন,
“আমি ইংরেজদের নিকট আমার ব্যক্তিগত কোন বিষয়ে কোন আবেদন পত্র প্রেরণ করতে আদৌ রাজী নই।”
কিছুদিন পর সংবাদ এল তাঁর স্ত্রী ইন্তেকাল করেছেন। তখন তিনি প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বললেন,
“ঠিক আছে, হাশরের মাঠে আমার সাথে ওর সাক্ষাৎ হবে।”
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ নিজ গুণে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনে মানবেন্দ্র নাথ রায়ের মত প্রথম শ্রেণীর বুদ্ধিজীবি যেখানে ভোট পেয়েছিলেন ১৮৩টি, সেখানে মাওলানা আজাদ পেয়েছিলেন ১৮৬৪টি। এত জনপ্রিয়তা থাকা সত্বেও তিনি পদে থাকাকে পছন্দ করেন নি, সেজন্যই ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু তাঁকে সভাপতি পদে দাঁড়াতে বললেও তিনি তাতে সায় দেননি। কারণ তিনি পদের থেকে কাজকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পণ্ডিত নেহেরু সঠিক কথাই বলেছিলেন,
“বড় বড় লোক পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন কিন্তু মাওলানার মত বৈশিষ্ট পূর্ণ মর্যাদার অধিকারী নেতা, ভারত কেন দুনিয়ার বুকে আর ফিরে আসবে না।”