লিখেছেনঃ মুহাম্মদ তাহির
৮। অষ্টম ঘোষণা
বাইবেলের ইয়াসয়াহ কিতাব ৪২ নম্বর অধ্যায়ের ৯ নম্বর আয়াতে আছে—দেখ! পুরাতন কথা পূর্ণ হইয়া গিয়াছে, এখন আমি নতুন কথা বলিতেছি, তাহা সংঘটিত হইবার আগেই তোমাদিগকে বলিয়া দিতেছি—
হে সমুদ্র যাত্রীগণ! সমুদ্র বাসীগণ! দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীগণ! আল্লাহর জন্য নুতন গীত গাও; পৃথিবীতে শুধুমাত্র তাহারই প্রশংসা কীর্তন কর, বস্তি প্রান্তর এবং কীদার এর গ্রাম নিজের কণ্ঠস্বর উচু করিবে; সিলার বাশিন্দারা গীত গাইবে; পর্বতচূড়া হইতে উকি দিবে, আল্লাহর মহিমা প্রকাশ করিবে, দ্বীপপুঞ্জে তাহার প্রশংসা গাহিবে, খোদাওন্দ বীরের মত বাহির হইবে যোদ্ধার মত বিক্ৰম প্রকাশ করিবে, সে শ্লোগান দিবে, চ্যালেঞ্জ দান করিবে, নিজের শত্রুদের উপর বিজয় লাভ করিবে, অনেকদিন হইতে আমি চুপ করিয়া আছি, মৌন রহিয়াছি; সংযম করিয়া আছি, এখন কিন্তু প্রসব বেদনাকাতর নারীর মত আর্তদান করিব, হাঁপাইব, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিব, আমি পাহাড় পর্বতকে ‘বিরান’ করিয়া ছাড়িব; তাহার সবুজ শ্যামলিমাকে শুষ্ক করিয়া দিব, তাহাদের নদনদীকে দ্বীপে পরিণত করিব, পুকুর সসোবরকে জলশূন্য করিয়া দিব, যে পথে তাহারা কখনও যায় নাই, অন্ধদিগকে সেই পথেই লইয়া যাইব, যে পথ তাহারা জানে না, আমি তাহাদিগকে সেই পথেই লইয়া চলিব, তাহার সম্মুখে অন্ধকারকে আলো, এবং উচুনীচু অসম জায়গাকে সমান করিয়া দিব; আমি তাহাদের সংগে এই ব্যবহার করিব, তাহাদিগকে ত্যাগ করিব না; যাহারা খোদাই করা মূর্তির উপর ভরসা করে, নিজের গড় মূর্তিকে পূজা করে, নিজের গড়া মূর্তিকে বলে—তোমরা আমাদের মাবুদ উপাসস্য দেবতা; তাহারা পিছু হটিবে, লজ্জিত হইবে। (আয়াত ৯-১৭)
এই ঘোষণাটির প্রত্যেকটি বাক্যই হজরত মুহাম্মদ হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের প্রতি সুস্পষ্ট ইংগিত করিতেছে; নুতন গীত অর্থে হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের নুতন শরীয়ত এবং পাহাড় পর্বত সাগর সমুদ্র, বস্তি প্রান্তর জনস্থল সর্বত্র তাহার শরীয়তের প্রচার বা ইসলাম ধর্মের বিশ্ব জনিন এবং সার্বজনিনতা, “কীদার” শব্দে হজরত মুহাম্মদসল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের পিতৃপুরুষ কীদার ইবনে ইসমায়ীলের প্রতি ইংগিত উদ্দেশ্য করা হইয়াছে। অনুরূপভাবে পর্বতশৃংগ হইতে আহ্বান দ্বারা হজ্বের অনুষ্ঠান, দ্বীপপুঞ্জে প্রশংসা কীর্তন আযানের বাক্যাবলীর প্রতি ইংগিত করিতেছে। অনুরূপভাবে “বীরের মত বাহির হইবে, যুদ্ধার মত বিক্রম দেখাইবে” বাক্যাবলী জেহাদের প্রতি ইংগিত করিতেছে। পরবর্তী আয়াতগুলিও জিহাদে সংক্রান্ত বর্ণনা মাত্র; ১৬ নং আয়াতে আরবদের তদানিন্তন অবস্থা বিবৃত রহিয়াছে—তাহারা আল্লাহর হুকুম আহকাম আদেশ নিষেধ মোটেই জানিত না, পৌত্তলিকতা মূর্তিপূজা এবং অজ্ঞ যুগের অন্ধ কুসংস্কারে নিমজ্জিত রহিয়াছিল; “আমি তাহাদের ত্যাগ করিব না” বাক্যে আল্লাহর কাছে প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের প্রিয়তার তথা— غير المغضوب عليهم ولا الضالين এর প্রতি যেমন ইংগিত রহিয়াছে, তেমনি তাহার শরীয়তের চিরন্তনতাও আয়াতটি ঘোষণা করিতেছে। খোদাই মূর্তির উপাসনা, ইহা হইতে সরিয়া যাওয়া এবং লজ্জিত হওয়া বাক্যে পৌত্তলিক আরবদের শেষ পরিণতি এবং ইসলামের বিজয় মহিমার প্রতিই ইংগিত রহিয়াছে।
ইতিহাস সাক্ষী—উল্লিখিত প্রতিশ্রুতিগুলি হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের জীবনে অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হইয়াছে। আরবের মুশরিক, রোমের সম্রাট হিরাক্লিস এবং পারস্যের রাজা কেহই মুহাম্মদি নবুওতের উজ্জ্বল শিখা নিভাইতে চেষ্টার ত্রুটি করে নাই, পরিণামে তাহাদিগকেই বিফল মনোরথ হইতে হইয়াছে, লজ্জা অপমান ব্যতীত তাহাদের কপালে কিছুই জুটে নাই।
শেষ পর্যন্ত আরবের এলাকা সম্পূর্ণভাবে শিরিকমুক্ত, পারস্য সাম্রাজ্য ছিন্ন ভিন্ন, সিরিয়ার খৃষ্টান সাম্রাজ্য ও নাস্তানাবুদ হইয়া গেল; প্রাচ্য প্রতীচ্যে ইসলামের বিজয় পতাকা উড়িতে থাকিল।
৯। নবম ঘোষণা
ইয়াসয়া কিতাবের ৫৪ নং অধ্যায়, নম্বর ১
হে বন্ধ্যা, তুই যে নিঃসন্তান ছিলি, গান গাহিয়া চল, তুই প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করিতে পারিস নাই, এখন আনন্দ গান গা এবং জোরে চিৎকার কর; কেননা আল্লাহ বলিতেছেন—অসহায় পরিত্যাক্তা নারীর সন্তান স্বামী বর্তমান নারীর সন্তান অপেক্ষা বেশী; নিজের বুকে প্রশস্ত কর; তাহার কিলক মযবুত কর, কেননা দক্ষিণ বাম উভয় দিক দিয়াই তাহা উন্নতি করিবে; তোমার বংশ জাতি সমূহের ওয়ারিশ উত্তরাধিকারী হইবে; উজাড় নগরীর পুনর্বাসন করিবে; তুমি আতংকিত শংকিত হইওনা, কেননা তুমি লজ্জিত অপদস্ত হইবেনা। যৌবনের লজ্জা ভুলিয়া যাইবে, বৈধব্যের দুঃখ আর কখন ও মনে পড়িবেনা। কেননা তোমার স্রষ্টাই তোমার স্বামী; “রব্বুল আফওয়াজ” তাঁহার নাম, ইস্রায়ীলের কুদ্দস তোমার ফিদয়া মুক্তিপণ আদায় করিবে, তিনি সমগ্র পৃথিবীর খোদা কথিত হইবেন। কেননা তোমার খোদা তোমাকে পরিত্যাক্তা বিষমেনা স্ত্রীর মত তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীর মত আবার তোমাকে ডাকিয়াছে, আমি এক মুহর্তের জন্য তোমাকে ছাড়িয়াছি, আবার তোমাকে গ্রহণ করিব। আমার অনন্ত কৃপায় গ্রহণ করিব। তোমার মুক্তিদাতা খোদা বলিতেছেন–রাগের বশে আমি কিছুক্ষণের জন্য তোমা হইতে মুখ ঢাকিয়াছিলাম; কিন্তু এখন আমি চিরদিন তোমার উপর করুণা বর্ষণ করিব, কেননা আমার পক্ষে ইহা নূহের তুফানের মত; কেননা নূহের পরে আর ঐরকম আসিবেনা বলিয়া আমি যেমন শপথ করিয়া ছিলাম, তেমনি তোমার প্রতি ও কখন ও ক্ষুন্ন বিরক্ত হইবেনা, এবং তোমাকে কখন ও ধমকাইবনা বলিয়া ও এক্ষণে শপথ করিতেছি; তোমার দয়াময় খোদা এরূপ বলিতেছেন যে-পাহাড় পর্বত টলিতে পারে কিন্তু আমার রহমত কখনও তোমা হইতে টলিবেনা। আমার প্রতিজ্ঞার ব্যতিক্রম হইবেনা। হে বিপন্ন, তুফানে আহতা, শান্তনা। বঞ্চিতা! দেখ আমি তোমার পাথর গুলিকে কালো কংক্রীটে পরিণত করিব, নীলম পাথরে তোমার ভিত্তি পত্তন করিব, আমি তোমার গুম্বুজকে লালমণি করিব, তোমার ফটকে রাতের প্রদীপ জ্বালিব। তোমার সমগ্র পাচিলকে বহুমূল্য পাথর দ্বারা তৈরী করিয়া দিব, তোমার সকল সন্তানই খোদর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করিবে, তোমার সন্তানদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হইবে, তুমি সত্যনিষ্ট থাকিবে, কেননা তুমি নির্ভীক থাকিবে, ভয়ভীতি হইতে দূরে রহিবে।—- সে তোমার কাছেই আসিবেনা। মনে রাখ সেই প্রতিবেশী আসিবে যে আমার সংগে ছিলনা, এবং যে নিকটে ছিল আরও নিকটে আসিবে; দেখ আমি লোহার কে পয়দা করিয়াছি যে কয়লার আগুণ ফুঁকে, নিজের কাজের জন্য অস্ত্ৰ তৈরী করে; লুঠেরেদের আমিই তৈরী করিয়াছি, লুঠ পাট করিবার জন্যে; তোমার বিরুদ্ধে যে অস্ত্রই তৈরী হউকনা কেন, কোন কাজেই লাগিবেনা; তোমার বিরুদ্ধে আদালতে যে মুখ খুলিবে তুমি তাহাকে অপরাধী সাব্যস্ত করিবে। খোদাওন্দ বলিতেছেন—ইহা আমার বান্দাণের মীরাশ, তাহাদের সততা সত্যবাদিতা আমার সংগে রহিয়াছে।
এই আয়াতগুলির আলোকে লক্ষ্য করিয়া দেখুন, সহজেই বুঝিতে পারিবেন—“বাজা” অর্থে “মক্কা”ই উদ্দেশ্য; কেননা হযরত ইসমায়ীল আলাইহি ও সাল্লামের পর সেখানে কোন নবী আসেন নাই, কোন ওহী ও অবতীর্ণ হয় নাই, পক্ষান্তরে জেরুজালেমে প্রচুর সংখ্যক পয়গম্বর আসিয়াছেন, ওহী অবতীর্ণ হইতে থাকিয়াছে।
“অসহায় পরিত্যাক্তার সন্তান” বলিতে হযরত হাজিরার (রাঃ) সন্তানকেই যে বুঝায় তাহাতে সন্দেহ নাই; কেননা তিনিই সেই পরিত্যাক্তা তালাক প্রাপ্তা রমণীর মত যাহাকে তাহার স্বামী ঘরের বাহির করিয়া দিয়াছে এবং যে মরু প্রান্তরে বসবাস করিয়াছে, এবং এই জন্যই হযরত ইসমায়ীল (আঃ) সম্পর্কে হযরত হাজিরা (রাঃ) কে কথা দেওয়া হইয়াছিল যে, তিনি বন্যগর্দভের মত স্বাধীন যুবক হইবেন। (পয়দায়ীশ ১৬ পধ্যায়) অনুরূপ ভাবে স্বামী বর্তমান নারী বলিতে হযরত সারা (রাঃ) ই যে উদ্দেশ্য তাহাতে ও সন্দেহ থাকেনা।
যেন আল্লাহ তাআলা এই ঘোষণায় মক্কাভূমিকে লক্ষ্য করিয়া আল্লাহর তাহমীদ তমজীদ তসবীহ তাহলীল এবং কৃতজ্ঞতা নিবেদনের নির্দেশ দান করিতেছেন, কেননা হযরত সারার বংশ অপেক্ষা হযরত হাজিরার বংশধরদিগকে অধিকতর মর্যাদা দেওয়া হইয়াছে; এমতাবস্থায় নিজের অধিবাসীগুণে স্বয়ং মক্কার ও ইজ্জত মর্যাদা বাড়িয়াছে; অতঃপর আল্লাহ তায়ালা হাজিরার বংশে হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামকে সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর রূপে প্রেরণ করতঃ তাহার ওয়াদা প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করিয়াছেন। তিনিই সেই কামার যে কয়লার আগুণ ফুঁকে, এবং বাইবেলের ভাষায় তিনিই সেই লুণ্ঠনকারী মুশরিকদের নিপাত সাধনের জন্য আল্লাহ যাহাকে প্রেরণ করিয়াছেন।
আবার এই পয়গম্বরের বদৌলতেই মক্কা এতই প্রসার এবং উন্নতি লাভ করিয়াছে যে, দুনিয়ার কোন ইবাদত খানাই এমন সৌভাগ্য লাভ করিতে পারে নাই। হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের সময় হইতে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোন ইবাদত খানাই কাবার মৰ্যাদা লাভ করিতে পারে নাই। প্রায় দেড় হাজার বৎসর ধরিয়া পবিত্র কাবা প্রতিবৎসর শুধু লক্ষ লক্ষ হজ যাত্রীদের কাছে যে অবর্ণনীয় ইজ্জত সম্মান লাভ করিয়া আসিতেছে, বয়তুল মুকাদ্দাসের সারা জীবনে মাত্র দুই বারই সৌভাগ্য লাভ হইয়াছে। হযরত সুলাইমান আলাইহি ও সাল্লাম যখন তাহার নির্মাণ কাৰ্য্য সমাপ্ত করেন; অতঃপর “বুসিয়া রাজার রাজত্বের অষ্টাদশ বৎসরে; পক্ষান্তরে আল্লাহ চাহেত মক্কার এই তাযীম সম্মান রোজ কিয়ামত পর্যন্ত সর্বদা অব্যাহত থাকিবে; এরূপ ভাবেই তুমি আতংকিত চিন্তিত হইবেনা, কখন ও লজ্জিত অপমানিত হইবেনা” অপার করুণায় তোমাকে গ্রহণ করিব” তোমার প্রতি কখন ও অপ্রসন্ন হইবনা বলিয়া আমি শপথ করিতেছি,” চিরন্তন রহমতে আপ্লুত রাখিব, তোমাকে ধমকাইবনা, কখন ও তোমার প্রতি আমার দয়ার শেষ হইবেনা, আমার ওয়াদা প্রতিশ্রুতি ও কখন ও টলিবেনা।” এই প্রতিশ্রুতিগুলি ও বাস্তবে পরিণত হইয়াছে এবং হইতে থাকিবে।
সারা দুনিয়া জানে-মক্কার সন্তানরা প্রাচ্য প্রতীচ্যে রাজত্ব করিয়াছে, মাত্র বাইশ বৎসেরের সংক্ষিপ্ত সময় পৃথিবীর বিরাট এলাকায় বিজয় পতাকা উড়াইয়াছে। উজাড় অনাবাদ জমি আবাদ করিয়াছে, হযরত আদম হইতে আরম্ভ করতঃ হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম পর্যন্ত সুদীর্ঘকালে কোন নুতন ধর্মের প্রবর্তক ও দাবীদারই এত অল্প সময়ের মধ্যে এরূপ প্রভাব এবং বিজয়লাভ করিয়াছেন বলিয়া শুনা যায় নাই। ইহা “তোমার বংশই জাতি সমূহের ওয়ারিশ উত্তরাধিকারী হইবে, উজাড় এবং পতিত জমিকে আবাদ করিবে” আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতিরই ফলশ্রুতি।
মুসলমান সম্রাটগণ বরাবরই কাবাশরীফ এবং মসজিদুল হারামের নির্মাণ প্রসার এবং যত্ব সংরক্ষণে, সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছেন ও করিতেছেন, মক্কার এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় পুকুর, কূপ, এবং নহর তৈরী করিয়াছেন।
ইসলামের শুরু হইতে আজ পর্যন্ত বাহিরের লক্ষ লক্ষ লোক মক্কার সান্নিধ্য পিপাসায় অধীর রহিয়াছে; এখনও প্রতি বৎসর লক্ষলক্ষ লোক পৃথিবীর বিভিন্ন এবং সুদূর প্রান্ত হইতে মক্কায় সমবেত হইতেছে; “তোমার বিরুদ্ধে যে কেহ অস্ত্রধারণ করিবে সেই-ই বিফল মনোরথ হইবে,” প্রতিশ্রুতিটিও অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হইয়াছে। যে কেহ মক্কার বিরোধিতায় মাথা তুলিয়াছে, তাহাকেই আল্লাহ তাআলা বিফল মনোরথ এবং অপদস্থ করিয়াছেন।
হস্তীবাহিনী এবং আবরাহা বাদশার কথা কে-না জানেন; আবেসিনিয়া সম্রাটের অধীনস্থ ইমন-অধিপতি আবরাহা রাজধানী “সানা”য় কাবার প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে একটা ঘর তৈরী করতঃ কাবার পরিবর্তে ঐ ঘরটির হজ্ব এবং তাওয়াফ করিতে লোকজনকে আকৃষ্ট করিতে চায় এবং প্রয়াস পায়; কিন্তু ইহাতে বিফল মনোরথ হয়; তাহার তৈরী ঘরের হজ তাওয়াফ করা ত দূরের কথা, লোকে ভাহা অপবিত্র করিয়া দেয়; সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে; ইহাতে তাহার প্রতিশোধ বহ্নি জ্বলিয়া উঠে, কাবা ঘর ধবংস এবং মিসমার করিবার উদ্দেশ্যে হাতি লইয়া এক এক বিরাট সেনাবাহিনী মক্কার দিকে অভিযান করে; স্বয়ং আবরাহা যে হস্তীপৃষ্ঠে আরােহী ছিল তাহার নাম ছিল মাহমুদ; সবার সেরা হাতী।
হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের পিতামহ হযরত আবদুল মুত্তালিব এই অভিযানের খবর পাইয়া মক্কার অদূরে আহার সংগে দেখা করেন; তিহামা অঞ্চলের আমদানী আয়ের এক তৃতীয়াংশ গ্রহণ করতঃ আবরাহাকে ফিরিয়া যাইবে বলেন; আবরাহা তাহার কথায় সম্মত হওয়ার পরিবর্তে তাহার হস্তী বাহিনীকে আগে বাড়াইতে যায়; কিন্তু যখনই তাহাকে কাবা অভিমুখে বাড়াইতে চায়, তখনই হাতীটি হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া পড়ে, কিছুতেই তাহাকে নাড়ানো যায়না, চালানো যায় না; অথচ ইমন কিংবা অন্যকোন দিকে হাকাইতে গেলে সে স্বচ্ছন্দে দ্রুত বেগে ধাবিত হয়, দৌড়িতে থাকে; ইতিমধ্যে আল্লাহ তাআলা এক ঝাক পাখী প্রেরণ করেন, প্রত্যেকটি পাখীর চক্ষুমধ্যে একটি এবং দুই পাঞ্জায় দুইটি করিয়া পাথর, মশুর ডালের চেয়ে বড়, ছোলার চেয়ে ছোট ; পাখীর ঝাক এই প্রস্তর বৃষ্টি আরম্ভ করে, যে কাহারও গায়ে এই পাথরকুচি লাগিত, তাহার দেহ ভেদ করতঃ পাছার দিকে বহিষ্ক্রান্ত হইত। প্রত্যেকটি লক্ষ্য ব্যক্তির নাম লিখিত ছিল; ফলে সমগ্র বাহিনী পলায়ন করিতে যায়; পথিমধ্যেই মারা পড়ে, সর্বস্বান্ত হয়; স্বয়ং আবরাহার মৃত্যুও অতি শোচনীয় ভাবে হয়; তাহার সবকটি আংগুল ঝরিয়া পড়ে; দেহ গলিয়া যায়, এক একটি অংগ খসিয়া পড়ে; এই সন্ত্রস্থ বিভৎস অবস্থায় তাহার উযীর আবু ইকসুম পলায়ন করতঃ এমন ভাবে নাজ্জাশীর কাছে পৌছায় যে তাহার মাথার উপরে একটি পাখী ঘুরপাক খাইয়া উড়িতেছে। সমস্ত ইতিবৃত্ত সে নাজ্জাশীকে শুনায়; যেই মাত্র তাহার মর্মান্তিক বয়ান শেষ হয়, উক্ত পাখীটি তাহার মাথার উপরে পাথর নিক্ষেপ করে; সংগে সংগেই সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়; পবিত্র কুরআনের সুরা ফীল এই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতিই ইংগিত করিয়াছে।
এমনকি পরবর্তীকালে কানা দাজ্জাল ও এই ঘোষণা অনুসারেই মক্কার ত্রিসীমানায় প্রবেশ করিতে পারিবে না বলিয়া হদীস শরীফে বর্ণিত রহিয়াছে।
১০। দশম ঘোষণা
ইয়াসয়া ৬৫ নং অধ্যায়, আয়াত নং ১
যাহারা আমাকে চায় নাই, যাহারা আমার সন্ধান করে নাই, তাহারা আমাকে পাইয়া গেল; যে জাতি আমার নাম করে নাই, তাহাকে বলি—দেখ! আমি হাযির রহিয়াছি; যে সমস্ত দূরত্মার নিজের মনেই মন্দ পথে চলিতে থাকিয়াছে, চিরদিনই তাহাদের দিকে হস্ত প্রসারণ করিয়াছি; এমন জাতি যাহারা আমারই সম্মুখে বাগ-বাগিচায় কুরবানী করিয়াছে, ইট পাথরে খুশবো জ্বালাইয়া আমাকে উত্যক্ত করিয়াছে, কবরে ধর্না দিয়াছে, দেব মন্দিরে নির্জন নিশীথ কাটাইয়াছে, শূকর মাংস খায়, যাহাদের পথে ঘৃণিত বস্তু রহিয়াছে; যাহারা বলে—তুমি দূরেই দাড়াইয়া থাক, আমার কাছে আসিও না, কেননা আমি তোমার অপেক্ষাও পবিত্র; তুমি আমার কাছে আসিও না; দেখ, আমার সম্মুখেই ইহা লিখিত হইয়াছে, অতএব আমি চুপ করিয়া থাকিব না, বরং প্রতিশোধ এবং বদলা নিব; খোদাওন্দ বলেন আমি তাহার কোলে ফেলিয়া দিব। (আয়াত ১-৬)
লক্ষ্য করিয়া দেখুন— “যাহারা আমাকে চায় নাই, আমার সন্ধান করে নাই” বলিতে আবরদের ব্যতীত কাহাকেও বুঝাইতে পারে? কেননা তাহারা আল্লাহর যাত, স্বত্ত্বা এবং গুণরাজী সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞ অনবহিত ছিল; শরীয়ত সম্বন্ধে তাহাদের কোন ধ্যান ধারনাই ছিল না; সেই জন্যই তাহারা আল্লাহকে ও চাহিত না, আল্লাহর সম্পর্কে কোন প্রশ্ন এবং জিজ্ঞাসা ও করিত না, পবিত্র কুরআনের আয়াত মধ্যে এই চিত্ৰই অংকিত করা হইয়াছে।
قد من الله ……………………. لال بین –
১১। একাদশ “বশারত”
দানিয়াল কিতাবের দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে, বাবিলন সম্রাট বুখতে নসর একটি স্বপ্ন দেখে এবং ভুলিয়া যায়, অতঃপর হযরত দানিয়াল (আঃ) ওহী মারফত ঐ স্বপ্ন জানিতে পারেন এবং ইহার তাবীর এবং ব্যাখ্যা এই মর্মে সম্রাটের সম্মুখে বিবৃত করেন-
“রাজা! তুমি একটি বৃহদাকার মূর্তি দেখিয়াছ, যে মূর্তিটি অতীব সুন্দর, তোমার সম্মুখে দণ্ডায়মান; তাহার আকৃতি ভয়ানক, তাহার নাথাটি স্বর্ণনির্মিত; তাহার বক্ষ এবং পাজর চাঁদির তৈরী, তাহার উদর এবং বাম তাম্র নির্মিত; পদদ্বয় লোহার দ্বারা তৈরী; পায়ের কিছু অংশ লোহা এবং কিছু অংশ মৃত্তিকা নির্মিত; তুমি তাহা দেখিতে থাক, ইতিমধ্যে হাতের পরশ ব্যতীতই একটি পাথর কাটিয়া পড়ে; এবং মূর্তিটির লৌহ এবং মৃত্তিকা নির্মিত পায়ে লাগে এবং খণ্ড-বিখণ্ড করিয়া দেয়; ফলে লোহা, মাটি, তামা, চাদি এবং সোনাও খণ্ড-বিখণ্ড এবং গ্রীষ্ম প্রধান খামারের খড়ের মত হইয়া যায়; এবং যে পাথর যে মূর্তিটি ভাংগিয়াছিল সে একটি পর্বতে পরিণত হয়; সমগ্র পৃথিবীতে ছড়াইয়া পড়ে”; ইহাই ছিল তোমার স্বপ্ন, ইহার তাবীর বা ব্যাখ্যা রাজ-সমীপে বয়ান করিতেছি। হে রাজা! তুমি সম্রাট, আসমানের খোদা যাহাকে সাম্রাজ্য শক্তি সামর্থ্য, প্রভাব প্রতিপত্তি দান করিয়াছেন। এবং যেখানেই মানুষ বসবাস করে সেখানার পশুপক্ষী ও তোমার সুপর্দ করিয়া দিয়া তোমাকে তাহাদের অধিকর্তা নিযুক্ত করিয়াছেন; উক্ত স্বর্ণ নির্মিত মস্তক তুমিই; তোমার পরে আরও একজন রাজা আসিবে, তাহার রাজ্য তোমার রাজ্য অপেক্ষা ছোট রাজ্য হইবে; অতঃপর তোমার রাজত্ব সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হইবে। অনন্তর লৌহ সদৃশ শক্ত এবং মযবুত সাম্রাজ্য আসিবে এবং লৌহ যেমন জিনিষ পত্র ভাংগিয়া চুরিয়া দেয়, সকলের উপর প্রভাব বিস্তার করে, সব কিছুকে খণ্ড-বিখণ্ড করিয়া দেয়; পিষিয়া দেয়, তাহাও তেমনি করিবে। আর এই যে তুমি দেখিয়াছি যে তাহার পাথেয়ের কিছু অংশ লোহার এবং মাটির রহিয়াছে, তাহাতে আসলে উক্ত সাম্রাজ্যের বিভেদ বিবাদের প্রতি ইংগিত; আর এই যে তুমি দেখিয়াছ যে লোহা মাটির সংগে মিশিয়া আছে, ইহাতে লোহার শক্তি বাড়িবে, এবং যেহেতু পায়ের কিছু অংগুলি লোহার এবং কিছুটা মাটির রহিয়াছে, তাই এই সাম্রাজ্য কিছুটা মযবুত এবং কিছুটা দূর্বল কমযোর হইবে। আর তুমি যে দেখিয়াছ যে-লোহা মাটির সহিত মিশ্রিত রহিয়াছে, তাহাতে মানুষের সংগে মেলামেশার প্রতি ইংগিত রহিয়াছে; তবে লোহা যেমন মাটির সংগে খাপ-খায়না তেমনি তাহারাও একে অন্যের সংগে খাপ খাইবেনা। এই রাজন্যবর্গদের আমলে আসমানের খোদা এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করিবে, যাহার অবসান কখনও হইবেনা, তাহার রাজত্ব অন্য কোন জাতির সম্পদ করা হইবেনা; বরং তিনি এই সমস্ত রাজ্যকে খণ্ড-বিখণ্ড এবং নাস্তানাবুদ করিয়া দিবেন। এটাই শেষ পর্যন্ত বাকী থাকিবে; আর এই যে তুমি দেখিয়াছ যে হাত না লাগাইতেই পাথরটি কাটিয়া পড়িল; এবং সে স্বর্ণ, রৌপ্য, লৌহ তা সবকিছুকেই চুর্ণ-বিচুর্ণ করিয়া দিল, তাহাতে আল্লাহ তাআলা আসন্ন ভবিষ্যতের ঘটনার প্রতিই ইংগিত করিয়াছেন। স্বপ্ন সত্য, এবং ইহার তাবীর ব্যাখ্যা ও সুনিশ্চিত। (আয়াত-৩১-৪৫ পর্যন্ত)
মোট কথা প্রথম সাম্রাজ্য বুখতে নসরের সাম্রাজ্য, দ্বিতীয় সাম্রাজ্য মেডাস সাম্রাজ্য, প্রসিদ্ধ সম্রাট দারা যাহার সম্রাট ছিলেন; যিনি বুখতে নছরের পুত্র বলশার নিহত হওয়ার পর রাজা হন এবং বাবিলন আক্রমণ ও অধিকার করেন; বলাবাহুল্য কিলদানী রাজ্যের তুলনায় তাহার সাম্রাজ্য দূর্বল ছিল: তৃতীয় সাম্রাজ্য কিয়ানিউনের সাম্রাজ্য; কেননা পাদ্রিদের মতে ইরানের বাদশা কাইখসররা হযরত মসীহ আলাইহিস সাল্লামের জন্মের ৩৩০ বৎসর পূর্বে পারস্য সাম্রাজ্য অধিকার করে, ক্ষমতায় শক্তিতে সৌর্যবীর্যে লৌহ সদৃশ ছিল; সিকন্দর বা আলেকজাণ্ডার তাহার সাম্রাজ্যকে খণ্ড-বিখণ্ড করতঃ বিভিন্ন নৃপতিদের মধ্যে বিভক্ত করিয়া দেন; ফলে সাসানীদের আবির্ভাব পর্যন্ত তাহা দূর্বল থাকিয়া যায়; সাসানীদের আমলে পুনরায় তাহা শক্তিশালী হইয়া উঠে; অতঃপর কখনও দূর্বল কখনও সবল হইতে থাকে; অবশেষে নওশেরওয়া বাদশার আমলে হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের আবির্ভাব হয়; এবং আল্লাহ তাহাকে বাহ্যিক এবং আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্য দান করেন; অল্পদিনের মধ্যেই তাঁহার অনুসারীগণ প্রাচ্য প্রতীচ্য ছাইয়া ফেলে, পরিস্যের উল্লিখিত এলাকা সমূহ তাহাদের অধিকৃত হয়; এমন ভাবেই এই স্বপ্নের তাবীর বাস্তবে পরিণত হইয়া যায়।
বলাবাহুল্য ইহাই সেই সাম্রাজ্য যাহার অবসান নাই, এমন সাম্রাজ্য অন্য কাহারো ভাগ্যে জুটে নাই; ইমাম মেহদীর আবির্ভাবের পরই ইহার পূর্ণ পরিণতি ঘটিবে; তবে ইতিপূর্বে কিছুদিনের জন্য দূর্বল এবং কমযোর ও অবশ্য থাকিবে; শেষ পর্যন্ত তাঁহার আবির্ভাবের পর এই ত্রুটি দূর হইবে এবং সমগ্র দ্বীন একমাত্র আল্লাহর জন্যই হইয়া যাইবে; ইহাই স্বপ্নে বর্ণিত সেই পাথর, যাহা পৰ্বত হইতে কাটিয়া গিয়া বা বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়া মাটি লোহা, সোনা চাদি মা সবকিছুকেই পিষিয়া ফেলিয়াছে, এবং স্বয়ং বিশাল পর্বতে পরিণত হইয়া সমগ্র বিশ্বে ছড়াইয়া রহিয়াছে। হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামই ইহার জ্বলন্ত নিদর্শন।
১২। দ্বাদশ বশারত
মাত্তার ইঞ্জিল—তৃতীয় অধ্যায়, প্রথম আয়াত।
তখন বাপটিযম দানকারী আসিয়াছে এবং ইহুদিরা প্রান্তরে ঘোষণা করিতে থাকে—তওবা করো, কেননা আসমানের রাজত্ব নিকটে আসিয়া গিয়াছে।
চতুর্থ অধ্যায়ের দ্বাদশ আয়াতে আছে-যখন তিনি (হযরত ঈসা) শুনিতে পান যে—ইউহান্না ধরা পড়িয়াছেন, তখন গিলীল চলিয়া যান; আয়াত নং ১৭ তে আছে-তখন ঈসা ঘোষণা করিতে এবং বলিতে থাকেন যে তওবা করো, কেননা আসমানী রাজত্ব নিকটে আসিয়া গিয়াছে, অনন্তর আয়াত নং ২৩ শে আছে—এবং ঈসা (আঃ) সমগ্ৰ গিলীলে পরিভ্রমণ করিতে করিতে তাহার ইবাদতখানা সমূহে তালীম দান এবং রাজত্বের সুখবর প্রদান করিতে থাকেন।
মাতার ইঞ্জিলের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে রহিয়াছে যে—হযরত ঈসা (আঃ) তাহার হাওয়ারীদের নামায শিক্ষা দিয়া এই দুআ করিতে বলেন— “তোমার রাজত্ব আসুক।”
উক্ত ইঞ্জিলেরই ১০ম আয়াতে প্রকাশ—হযরত ঈসা (আঃ) যখন তাঁহার শিষ্যদিগকে ইস্রায়ীলী শহরে তবলীগের জন্য প্রেরণ করেন তখন উপদেশ নির্দেশের সংগে এই নির্দেশও দেন যে—চলিতে চলিতে একথাও ঘোষণা করিবে যে—আসমানী রাজত্ব নিকটে আসিয়া গিয়াছে।
লুকার ইঞ্জিলেরও ৯ম অধ্যায়ের ১ম আয়াতে আছে—অতঃপর তিনি এই বারোজনকে ডাকিয়া দূরাত্মা দমন এবং রোগের দূরীকরণের শক্তি এবং ক্ষমতা দান করেন এবং তাহাদিগকে খোদার রাজত্ব ঘোষণ এবং রোগীদের আরোগ্য দানের জন্য প্রেরণ করেন।
১০ম অধ্যায়ে আছে—অতঃপর খোদাও আরও সত্তর জন লোক প্রেরণ করেন এবং যে যে শহরে তাহার নিজের যাইবার কথা ছিল সেখানে দুই দুই জন করিয়া প্রেরণ করেন; আয়াত নং ১৮—যে শহরেই তোমরা প্রবেশ করিবে এবং সেখানকার লোক তোমাদিগকে গ্রহণ করিবে, তোমাদের সম্মুখে তাহারা যাহা কিছু রাখিবে, তাহা খাইবে, সেখানকার রোগীদের ভাল করিবে, এবং তাহাদের বলিবে যে খোদায়ী রাজত্ব তোমাদের নিকটে আসিয়া গিয়াছে; পক্ষান্তরে যেখানকার লোকেরা তোমাদের গ্রহণ করিবে না, তাহাদের হাটে বাজারে গিয়া বল- তোমাদের শহরের যে ধূলাবালিও আমাদের পায়ে লাগিয়াছে আমরা তাহাও ঝাড়িয়া ফেলিয়া যাইতেছি; তবে জানিয়া রাখ— খোদার রজত্ব নিকটে আসিয়া পৌছাইয়াছে।
দেখা যায় হযরত ঈসা (আঃ) হযরত ইয়াহয়া (আঃ) এবং তাহাদের হাওয়ারী শিষ্যগণ যে আসন্ন আসমানী বাদশাহীর সুখবর এবং আগাম সংবাদ ঘোষণা করিতেছেন, হযরত ঈসা (আঃ) ও অবিকল সেই বাক্যেই এই সুখবর দান করিতেছেন, যে বাক্যে হযরত ইয়াহয়া (আঃ) এই ভবিষ্যৎ সংবাদ দিয়া ছিলেন; জানা কথা এই বাদশাহী হযরত ইয়াহয়া (আঃ) হযরত ঈসা (আঃ) এবং তাহার হাওয়ারীদের আমলে আসেনাই, নতুবা হযরত ঈসা (আঃ) এর নবুওতের পর ও তিনি এবং হাওয়ারীগণ এই সুসংবাদ ঘোষণা করিতেন না, এবং এজন্য আল্লাহর দরবারে “তোমার রাজত্ব আসুক” বলিয়া দুআ করিতে ও যাইতেননা; যাহা আসিয়া গিয়াছে, তাহা আসিবে বলিয়া ঘোষণা করার কোন মানে ও হয়না; উল্লিখিত রাজত্বের অর্থ যে পার্থিব সাম্রাজ্য নয়, বরং ধর্মীয় রাজত্ব একথা ও বুঝিতে বাকী থাকেনা; বারে বারে “আসমানী বাদশাহী” শব্দ দ্বারা এতদপ্রতিই ইংগিত রহিয়াছে; বস্তুতঃ ইহাই সেই রাজত্ব, হযরত দানিয়াল যাহার ঘোষণা করিয়াছিলেন, এবং প্রিয়নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের নবুওৎ এবং দ্বীনধর্মই যে ইহার একমাত্র নিদর্শন একথা বলাই বাহুল্য।
মাত্তার ইঞ্জিলের এই ঘোষণায় –“খোদায়ী রাজত্ব তোমাদের থেকে কাড়িয়া নিয়া এমন এক জাতিকে দিয়া দেওয়া হইবে যাহারা ফলদান করিবে।” কথাটি আর ও স্পষ্ট হইয়া যায়; হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের নবুওত ও আবির্ভাব এবং ইসলাম ধর্মের পর যে খৃষ্টধর্মের কোন গুরুত্ব এবং মূল্যই থাকিবেনা, এই ঘোষণায় একথাই বলিয়া দেওয়া হইয়াছে।
১৩। ত্রয়োদশ বণারত-
(ইঞ্জিল মাত্তা আয়াত ১০ )
আসমানী রাজত্ব সেই ঘরের মালিকের মত যে সাত সকালে তাহার মাঠে মজুর খাটাইতে যায়; দৈনিক একটি মুদ্রা মজুরী ঠিক করিয়া সে ক্ষেতে মজুর পাঠায়; বেলা বাড়িলে সে বাহির হইয়া অন্যদের ও বাজারে বেকার দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখে এবং তাহাদের বলে তোমরা ও কাজে লাগিয়া যাও, ন্যায্য মজুরী পাইবে; তাহারা কাজে চলিয়া যায়, অতঃপর সে দুপুর ত্ৰিপহরের কাছাকছি সময়ে বাহির হইয়া এমনই করে; বেলা শেষের প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে বাহির হইয়া অন্য লোকদের ও দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখে, সে তাহাদেরও বলে তোমরা কেন সারাদিন এখানে বেকার দাড়াইয়া রহিয়াছ? তাহারা বলে যে আমাদিগকে কেহই মজুরী খাটিতে নিযুক্ত করে নাই; সে তাহাদেরও বলে—তবে তোমরা ও খামারে চলিয়া যাও।
দিনের শেষে সে সকলকে ডাকে— যাহারা দিনান্তে মাত্র একটি ঘণ্টা খাটিয়াছিল তাহাদিগকে এক একটি দীনার মজুরী দেয়; ইহাতে অন্যান্যরা মনে করেন যে—আমরা তবে ইহাদের অপেক্ষা বেশী মজুরী পাইব। কিন্তু মালিক তাহাদিগকেও একটি একটি দীনার মজুরী দিলে তাহারা অভিযোগ করিয়া বলে— ইহারা মাত্র এক ঘণ্টা কাজ করিয়াছে, আমরা যাহারা সারাদিন খাটিয়াছি, রোদ্ৰতাপে পুড়িয়াছি সেই আমাদিগকেও তুমি তাহাদের সমান করিয়া দিলে? মালিক উত্তরে তাহাদের একজনকে বলে—বাবা—আমি তোমাদের প্রতি অবিচার করি নাই; তোমাদের মজুরী কি একটি দীনারই নির্ধারিত ছিলনা? অতএব তুমি তোমার প্রাপ্য লইয়া চলিয়া যাও; আমার মর্জি আমি আমি তোমাদিগকে যত দিতেছি পরবর্তীদেরও ততই দিব, আমার ধনে আমার মর্জিমত অধিকার কি আমার নাই? অথবা তুমি আমাকে কুলোক বলিয়া ভাবিতেছ? এই রূপেই শেষ প্রথম হইয়া যাইবে। (আয়াত ১—১৬)
এই ঘোষণাটিও সুস্পষ্টভাবে হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু এর সম্পর্কে যে বর্ণিত রহিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। বোখারী প্রভৃতি হদীস গ্রন্থে প্রায় অনুরূপ মর্মেই হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের স্পষ্ট বর্ণনা রহিয়াছে; এই উম্মত শেষে আসিয়া ও প্রথম হইবে। হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম আরও বলেন—আমরা সবার শেষে আসিয়াও সবার আগে; আমি যতক্ষণ না বেহেশতে প্রবেশ করিয়াছি, ততক্ষণ কোন পয়গম্বরই বেহেশতে প্রবেশ করিতে পারিবেন না; আমার উম্মত যে পর্যন্ত না বেহেশতে প্রবেশ করিয়াছে, অন্য কোন উম্মতই ততক্ষণ পর্যন্ত বেহেশতে প্রবেশ করিতে পারিবেনা।
১৪। চতুর্দশ ঘোষণা—
মাত্তার ইঞ্জিল অধ্যায় ২:, আয়াত ৩৩;
“আরও একটি উপমা শুনো; এক ছিল ঘরের মালিক; সে একটি বাগান তৈরী করে, তাহার চতুর্দিক পাঁচিল ঘেরা করে, তন্মধ্যে হাউয (জলাধার ) খনন করে, প্রাসাদ তৈরী করে; এবং মালিদের নিকট তাহার ঠিকা দিয়া দেশে চলিয়া লায়; ফলের মৌসুমে সে তাহার মালিদের নিকট তাহার চাকর পাঠায়, ফল নিয়া যাইবার জন্য; মালীরা তাহার চাকরদের কাহাকেও খুবই পিটাই করে, কাহাকেও একেবারে মারিয়া ফেলে; অতঃপর সে আরও বেশী সংখ্যক চাকর পাঠায়; মালীরা তাহাদের সংগেও এই ব্যবহার করে; অবশেষে সে তাহার পুত্রকে পাঠায় এই ভাবিয়া যে—তাহারা অন্ততঃ তাহার পুত্রের সম্মান দিবে; মালীরা তাহার পুত্রকে দেখিয়া নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে—এই-ই ওয়ারিশ, চলো ইহাকে হত্যা করতঃ ইহার সম্পত্তি দখল করিয়া নিই; তাহারা তাহাকে ধরিয়া বাগানের বাহিরে লইয়া যায় এবং কাতল করিয়া দেয়। এমতাবস্থায় খামারের মালিক আসিলে সে মালীদের সংগে কিরূপ ব্যবহার করিবে বল? তাহারা বলে—সে মালীদিগকে নির্মম ভাবে নিহত করিবে, এবং অন্যকে বাগানের ঠিকা দিয়া দিবে; যাহারা সময়ে তাহাকে ফল দান করিবে। ঈসা (আঃ) বলেন তোমরা কি কখন ও পবিত্র কিতাবে পড় নাই যে- রাজমিস্ত্রী নির্মাতারা যে পাথরটাকে অবহেলা ভরে প্রত্যাখ্যান করিয়াছিল সেই পাথরটাই ঘরের কোণার পাথর হইয়া রহিল।” ইহা খোদাওন্দের তরফ থেকেই হইয়াছে; আমাদের চোখে ইহা খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার।” এই জন্যই আমি তোমাদের বলিতেছি তোমাদের সাম্রাজ্য কাড়িয়া নেওয়া হইবে, এবং যে জাতি ইহার ফলদান করিবে তাহাকেই ইহা দেওয়া হইবে। এই পাথরের উপরে যাহা পড়িবে তাহা ও ভাংগিয়া খান খান হইয়া যইবে, যাহার উপরে এই পাথরটি পড়িবে তাহাকে ও সে পিষিয়া ফেলিবে।” এবং সদর কাহিনেরা এই উপমা সমূহ শুনিয়া সহজেই বুঝিয়া নেয় যে তাহাদের সম্পর্কেই ইহা বর্ণিত হইয়াছে। (আয়াত ২১-৪৫)
একটু খানি লক্ষ্য করিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, ইহাতে ঘরের মালিক বলিতে স্বয়ং আল্লাহ তালা, বাগান বলিতে শরীয়ত বা দ্বীন, হাউয, প্রাসাদ বলিতে হারাম হালাল এবং বিধি নিষেধের প্রতিই ইংগিত রহিয়াছে। এবং অবাধ্য মালী বলিতে ইহুদিরাই যে উদ্দেশ্য স্বয়ং কাহিন এবং সর্দারগণই একথা স্বীকার করিতেছেন; প্রেরিত চাকরগণ বলিতে পয়গম্বরগণ এবং পুত্র বলিতে হযরত ঈসা, (আঃ) ই যে উদ্দেশ্য একথা ও স্পষ্ট; কেননা হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কেই এই শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে দেখা যায়, এবং খৃষ্টানদের মতে তিনি নিহতও হইয়াছেন; কাড়িয়া নেওয়া সাম্রাজ্য বলিতে তাহার শরীয়ত এবং অতঃপর নির্মাতাদের অবহেলিত পরিত্যক্ত পাথর বলিতে হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম এবং ফলদান কারী মালী বলিতে যে তাহারই উম্মত উদ্দেশ্য, ইহাতে সন্দেহমাত্র বাকী থাকেনা। তাহার উম্মত তথা মুসলমান জাতিই সেই পাথর, যাহার উপর কিছু পড়িলে ও শেষ, এবং কাহার ও উপর তাহা পড়িলে ও সর্বনাশ।
অনুরূপ ভাবে উপবর্ণিত যে পাথরটির উপরে যাহা পড়ে তাহা ভাংগিয়া খান খান হইয়া যায়, আবার যাহার উপরে তাহা পড়ে তাহাও পিষিয়া ফেলে” আর যাই হউক হযরত ঈসা (আঃ) স্বয়ং এই পাথর হইতে পারেন না; কেননা তিনিই বলিয়াছেন—আমার কথা শুনিয়া যদি কেহ তাহা পালন না করে, তবে আমি তাহাকে অপরাধী ঠাওরাইবনা; কেননা আমি জগৎকে অপরাধী সাব্যস্থ করিতে আসি নাই বরং তাহাকে মুক্তি দিতে আসিয়াছি।” (ইউহান্না ইঞ্জিল ১২ অধ্যায়)
ইহার বিপরীত হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম দুষ্ট দুরাত্মাদের সতর্ক সাবধান করিতে আসিয়াছিলেন, তাহাকে এই হুকুমও দেওয়া হইয়াছে। এমন কি বোখারী প্রভৃতি বিশুদ্ধ হদীসগ্রন্থে আছে—হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম নিজেই বলিয়াছেন, আমার এবং অন্যান্য পয়গম্বরদের উপমা এমন একটি সুরম্য হৈর্মের মত, যাহার কোন একটি অংশে একটি ইটের জায়গা শূন্য রহিয়া গিয়াছে; প্রাসাদের সৌন্দর্য দেখিয়া সকলেই বাহবা দেয় কিন্তু একটি ইটের ঐ শূন্য জায়গা দেখিয়া আফশোষ করিতে থাকে; বলাবাহুল্য আমিই সেই অবশিষ্ট ইটখানি; আমার দ্বারাই শরীয়তের ইমারত পরিপূর্ণতা লাভ করিয়াছে; এবং নবুওতের সিলসিলা বা সূপরিসমাপ্তি ঘটিয়াছে।
স্বয়ং হযরত ঈসা (আঃ) এর বক্তব্য মতে ও উল্লিখিত পাথর পুত্র, হইতে পারেনা। কেননা এই উপমায় পুত্র এবং পাথর পৃথক পৃথক ভাবে উল্লিখিত রহিয়াছে।
রচনাকালঃ ২৫-৯-১৯৮৮
পরের পর্বগুলি পড়তে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে বেদে-বাইবেলে ভবিষ্যৎবাণী (১ম পর্ব)
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে বেদে-বাইবেলে ভবিষ্যৎবাণী (২য় পর্ব)
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে বেদে-বাইবেলে ভবিষ্যৎবাণী (৪র্থ পর্ব)