লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ তাহির
১৫। পঞ্চদশ ঘোষণা –
“মুকাশিফা” ২য় অধ্যায় ২৬-২৯ নং আয়াত মধ্যে আছে—
যে জয়ী হইবে, এবং আমার কাজের মত শেষ পর্যন্ত আমল করিতে থাকিবে, আমি তাহাকে জাতি সমূহের উপর অধিকার দান করিব, সে লৌহদণ্ড দিয়া তাহাদের উপর হুকুমত করিবে, যেমন ভাবে কুমারের বাসন চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যায়; আমিও আমার পিতার নিকট থেকে অনুরূপ ক্ষমতা লাভ করিয়াছি; আমি তাহাকে ভোরের তারকা দান করিব; যাহার কান আছে, সে যেন শুনিয়া নেয় যে “রূহ” কলীসাদের কি বলিতেছে।
উল্লিখিত বিজয়ী যাহাকে সমগ্র উম্মতের উপর ক্ষমতা এবং প্রাধান্য দান করা হইয়াছে এবং যিনি লৌহ যষ্ঠি দ্বারা তাহাদের তত্ত্বাবধান করিয়াছেন, তিনিই হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)।
আল্লাহ তাআলা তাঁহার সম্পর্কেই ঘোষণা করিয়াছেন— وينصرك الله نصرا عزيزا এবং আল্লাহ তাআলা তাহাকে জবরদস্ত সাহায্য করিবেন।
প্রসিদ্ধ কাহিন “সতীহ” ও হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)কেই এই বিজয়ী বলিয়া মন্তব্য করিয়াছে।
উল্লেখ আছে—হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) – এর জন্ম ক্ষণে পারস্য সম্রাট কিসরার প্রাসাদ ফাটিয়া যায়; তাহার চৌদ্দটি চুড়া ভাংগিয়া পড়ে, সহস্র বৎসর মধ্যে যে আগুন কখনও নিভে নাই, সেই আগুন নিভিয়া যায়। সাভার জলের উৎস শুকাইয়া যায়; মুবন স্বপ্ন দেখে যে বিরাটকায় আরব্য উট দজলা নদী পার হইয়া নিকটবর্তী নগরগুলিতে ছড়াইয়া পড়িয়াছে।
অনবরত এই ঘটনাগুলির ফলে পারস্য সম্রাট উদ্ভ্রান্ত হইয়া পড়ে; এবং পাত্রী আবদুল মসীহ কে “সতীহ” কাহিনের নিকট প্রেরণ করে; সতীহ তখন সিরিয়ার অবস্থান করিতেছে; আবদুল মসীহ যখন সতীহের কাছে পৌছায়, সতীহ তখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত; মৃত্যুমুখে পতিত প্রায়; আবদুল মসীহ তাহাকে সমস্ত ইতিবৃত্ত বলিলে সতীহ বলে—যখন তিলাওতের আধিক্য হইবে, লাঠিধারী প্রকাশ পাইবে, “সাভা” উৎস শুকাইয়া যাইবে, পারস্যের আগুন নিভিবে, তখন পারস্যবাসীদের বাবিলনে বসবাসের আর অবকাশ নাই; এবং সতীহের পক্ষেও সিরিয়ার আরাম শয্যায় শুইবার অধিকার থাকিবেনা। পারস্যবাসীদের মধ্যে আগামীতে প্রসাদ চুড়ার সংখ্যা পরিমাণ কতিপয় পুরুষ এবং নারী নৃপতি হইবেন; এবং যাহা হইবার তাহা হইবেই হইবে।”
এই পর্যন্ত বলিবার পরই সতীহ মারা যায়; আবদুল মসীহ সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করতঃ যখন “কি” কে সতীহের বর্ণনা শুনায়, তখন কিসরা বলে প্রাসাদ চুড়া ত চৌদ্দটি; অতএব চৌদ্দজন রাজার রাজত্বকাল ত অনেকদিন হইবে, এবং ইতিমধ্যে অনেক কিছুই হইতে পারিবে। এই ভাবিয়া সে মনে মনে আশ্বস্ত হয়। কিন্তু ফলতঃ দেখা যায় মাত্র দশ বৎসর মধ্যেই তাহাদের দশ জন রাজা একে একে খতম হইয়া যান; এবং অবশিষ্টগণ হযরত উসমান রাজিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতকালে চির বিদায় গ্রহণ করেন। হযরত উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর আমলেই তাহাদের শেষ সম্রাট “ইজ দুজুর্দ” নিহত হয়।
“মুকাশিফা” কিতাবে উল্লিখিত ভোরের তারা বলিতে পবিত্র কুরআনই উদ্দেশ্য; আল্লাহ নিজেই বলেন—আমি তোমাদের নিকট উজ্জ্বল নুর অবতীর্ণ করিয়াছি।
وارثنا اليكم نور ابنا ۔
বিশিষ্ট আলিম আব্বাস আলী খৃষ্ট ধর্ম সম্পর্কে “সওলাতুয, যাইগুম” নামক একটি কিতাব লিখিয়াছিলেন; কানপুরে পাদ্রী উইলিয়ম এবং ওয়েট এর সংগে তাহার তর্কযুদ্ধ হয়; পাত্রীগণ শেষ পর্যন্ত তাহার উত্তর দানে অক্ষম এবং হার মানিতে বাধ্য হন; তিনি বলেন—আমি যখন উল্লিখিত ঘোষণা অনুসারে বলি যে—হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহ আলাইহি ও সাল্লামই এই লৌহ যষ্ঠি ধারী; তখন তাহারা ঘাবড়াইয়া যায়, অতঃপর বলে-হযরত ঈসা (আঃ) ত এই আগাম খবর “থোয়থ্রি” বাসীদের সম্মুখে ঘোষণা করিয়াছিলেন; অতএব এই যষ্ঠিধারীর আবির্ভাব সেখানেই হওয়া উচিত; অথচ হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম সেখানে কখন ও যান নাই।
আমি জিজ্ঞাসা করি—এই কলীসা এবং এলাকাটি কোথায় অবস্থিত? তদুত্তরে তাহারা অভিধান ঘাটাঘাটি করিয়া বলেন – রোমের অন্তর্গত ইস্তাম্বুলের নিকটে অবস্থিত; আমি বলি হযরত উমর ফারুক রাযিয়াল্লাহু আনহুর আমলেই সাহাবারা সেখানে শুধু যানই নাই বরং ইহাকে জয় করেন, এবং অতঃপর বরাববই সেখানে মুসলমান দের আধিপত্য চলিয়া আসিতেছে; উসমানী খলীফাগণ আজও সেখানে রাজত্ব করিতেছেন। অতএব এই আগাম খবর যে হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের নবুওত এবং আবির্ভাব সম্পর্কেই, ইহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই।” বলাবাহুল্য পাদ্রী ওয়েট এবং পাদরী উইলিয়ম ইহার কোন উত্তর খুঁজিয়া না পাইয়া নিরুত্তর থাকিতে বাধ্য হয়। আবকরাবাদে পাত্রী ফাণ্ডারের সংগে মওলানা রাহমাতুল্লাহ (রাঃ) সাহেবেরে ঐতিহাসিক তর্কযুদ্ধের বাইশ বৎসর পূর্বে কানপুর শহরে এই তর্কযুদ্ধ হইয়াছিল।
অষ্টাদশ খবর
১৮২১ খৃঃ ১৮৩১ খৃঃ এবং ১৮৪৪ খৃঃ লণ্ডনে প্রকাশিত ইউহান্না ইঞ্জিলের চতুর্দশ অধ্যায়ের পঞ্চদশ আয়াতে আছে,
তোমরা যদি আমাকে ভালবাস তবে আমার হুকুম অবশ্য মানিবে। আমি পিতার নিকট আবেদন করিব, যেন তিনি তোমাদের জন্য দ্বিতীয় ফারকলীত প্রেরণ করেন এবং তিনি যেন তোমাদের সংগে থাকেন; সত্যাত্মাকে জগৎ আয়ত্ব করিতে অক্ষম, কেননা তাহারা তাহাকে জানেনা, তাহাকে দেখিতে পায়নাই; তোমরা কিন্তু তাহাকে জানিবে, কেননা তিনি তোমাদের সংগে থাকিবেন, এবং তোমাদের মধ্যে বিরাজ করিবেন।” (আয়াত ১৫-১৭)
এই অধ্যায়েরই ২৬ নং আয়াতে আছে—“কিন্তু “ফারকলীত” তথা রুহুল কুদুস যাহাকে পিতা আমার নামানুসারেই প্রেরণ করিবেন; তিনিই তোমাদিগকে সব কিছু শিখাইবেন, এবং আমি তোমাদিগকে যাহা কিছু বলিয়াছি, তাহা ও তিনি তোমাদিগকে স্মরণ করাইয়া দিবেন।
অনন্তর ৩৩নং আয়াতে আছে—“তাহার আবির্ভাবের আগেই আমি তোমাদিগকে বলিয়া দিলাম, যাহাতে তাহার আবির্ভাবের পর তোমরা তাহাকে বিশ্বাস করিতে পার।” স্থির নিশ্চিত হইতে পার।
ইউহান্না ইঞ্জিলেরই ১৫ অধ্যায়ের ২৬ নং আয়াতে আছে – কিন্তু যখন ই ফারকলীত আসিবেন, যাহাকে আমি পিতার নিকট হইতে তোমাদের কাছে প্রেরণ করিব অর্থাৎ পিতা হইতে প্রকাশিত সত্যাত্মা, তিনি আমার সত্যতার সাক্ষ্য দিবেন, এবং তোমরা ও সাক্ষী থাক, কেননা শুরু হইতেই তোমরা আমার সংগে রহিয়াছ।
আবার ১৬ অধ্যায়ে ৭নং আয়াতে বর্ণিত আছে—আমি কিন্তু তোমাদের সত্যই বলিতেছিযে—আমার চলিয়া যাওয়া তোমাদের পক্ষে ভাল; কেননা আমি চলিয়া না গেলে ঐ ফারকলীত তোমাদের কাছে আসিবেন না। আমি যাইয়া তাহাকে তোমাদের কাছে পাঠাইয়া দিব; তিনি আসিয়া জগৎকে গোনাহ, সততা এবং ন্যায় বিষয়ে অপরাধী সাব্যস্ত করিবেন। গোনাহর ব্যাপারে এই জন্য যে তোমরা আমাকে আর দেখিতে পাইবেনা। আদালত বা ন্যায়ের ব্যাপারে এই জন্য যে জগতের অধিপতিকে অপরাধী প্রতীয়মান করা হইয়াছে। তোমাদিগকে আমার আরও কিছু বলিবার ছিল কিন্তু তোমরা তাহা বরদাশত করিতে পারিবেনা; কিন্তু ঐ সত্যাত্মা যখন আসিবে তখন তোমদিগকে সত্যতার পথ দেখাইবে; কেননা সে নিজের থেকে কিছুই বলিবেনা, যাহা কিছু শুনিবে তাহাই বলিবে, এবং তোমাদিগকে ভবিষ্যতের খবর দান করিবে, তাঁহার মহিমা প্রকাশ করিবে, কেমন? আমার নিকট হইতে জানিয়াই তোমাদিগকে জানাইবে, কেননা সাহা কিছু পিতার তাহা আমারই; এই জন্যই বলিতেছি যে—আলার নিকট জানিয়াই তিনি তোমাদিগকে খবর দিবেন।” ( আয়াত ৭-১৬)
প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) আবির্ভাব ও নবুওত সম্পর্কে হযরত ঈসা আলাইহিস সাল্লামের এই ভবিষ্যৎ বাণী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার আগে বলিয়া রাখা ভাল যে—তাহাদের কিতাব পত্রে উল্লিখিত নামগুলির ও অনুবাদ করিয়া দেওয়া আহলে কিতাব তথা খৃষ্টান ইহুদিদের বরাবরের অভ্যাস। হযরত ঈসা (আঃ) র ভাষা ইউনানী বা গ্রীক ছিলনা বরং ইরানী ছিল। অতঃপর এবিষয়ে সন্দেহ থাকেনা যে, হযরত ঈসা (আঃ) যে মহামানবের সম্পর্কে আগাম সুখবর দিয়াছেন, ইঞ্জিল অনুবাদকগণ তাহাদের চিরাচরিত অভ্যাসের বশে তাহার নামের ইউনানী অনুবাদ করিয়াছেন। অতঃপর আরবী অনুবাদকরা তাহাকে আরবী করতঃ ফারকলীত করিয়া দিয়াছেন।
১২৬৮ হিজরীতে কলিকাতায় মুদ্রিত একটি উর্দূ পুস্তিকায় জনৈক পাদ্রী “ফারকলীত” শব্দ সম্পর্কে তাহার গবেষণা প্রকাশ করিয়াছিলেন। “ফারকলীত” শব্দ সম্পর্কে মুসলমানদের ভ্রান্ত ধারনার নিরসনই তাহার এই পুস্তিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য বলিয়া ছিল তাহার দাবী। তাহার বর্ণনার সারমর্ম ছিল—“এই শব্দটি ইউনানী বা গ্রীক ভাষা হইতে আরবী ভাষায় অনুদিত; অতএব আমরা যদি ধরিয়া নিই যে আসল ইউনানী শব্দটি ছিল “পারাক্লিতুস” তবে তাহার অর্থ হয় সহায় সাহায্যকারী, মদদগার, কর্মসাধক, প্রতিনিধি বা উকীল। আর যদি বলা যায় যে শব্দটি আসলে “পীরক্লুতুস” তবে তাহার মানে “মুহাম্মদ” “আহমদ” এর কাছাকাছি হইয়া যায়; ইসলামের আলিম উলামাদের যাহারা এই আগাম খবর কে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করিয়াছেন, তাহারা এই শব্দটি আসলে “পীরক্লুতুস” বলিয়াই মনে করিয়াছেন; যাহার অর্থ প্রায় মুহাম্মদ এবং আহমদ শব্দের সমার্থক। এই জন্যই তাহারা বলেন যে হযরত ঈসা (আঃ) হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও আহমদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম সম্পর্কেই এই ভবিষ্যৎবাণী করিয়াছেন। কিন্তু সত্য বলিতে গেলে এই শব্দটি আসলে পারাক্লিতুস।”
দেখিয়া হাসি পায় যে পাদ্রী সাহেবের সমস্ত গবেষণার সারমর্ম এই যে, শব্দটি “পীরক্লুতুস” নয় বরং “পারাক্লিতুস”
প্রথমটি কেন নয়, এবং দ্বিতীয়টি কেন? পাদ্রী সাহেব ইহার সপক্ষে কোন যুক্তি কোন দলীল প্রমাণই পেশ করিতে পারেন নাই; যাহা কিছু বলিয়াছেন, তাহা গবেষণা নয়, অনুসন্ধান নয় বরং নিছক ধারণা মাত্র। বলাবাহুল্য এতদসত্ত্বেও যদি তাহার ধারণাকেই সত্য বলিয়া মানিয়া নিয়া শব্দটি আসলে “পারাক্লিতুস” ই ছিল বলিয়া স্বীকার করা যায়, তবে তাহাতেও মানে মর্ম হিসাবে বিশেষ কোন ফারাক পড়েনা; কেননা হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের অনুরূপ গুণাবলী এবং বিশেষণ ও রহিয়াছে। অধিকন্তু ইউনানী ভাষায় পারাক্লিতুস এবং “পীরক্লুতুস” দুইটি শব্দের লেখার ধরন প্রায় একই রকম; এমতাবস্থায় কোন কোন কপিতে “পীরক্লুতুস” “পারাক্লিতুস” এ পরিণত ও পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে, এবং খৃষ্টানগণ ইসলাম বিরোধিতায় এই তৃণ খণ্ডকেই আকড়াইয়া ধরিয়া রহিয়াছেন। ইহুদি খৃষ্টানদের চিরাচরিত অভ্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে একথা অমূলক বলা যায়না যে, হযরত ঈসা (আঃ) বর্ণিত মুহাম্মদ, আহমদ শব্দকে তাহারা গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করতঃ এই সু-খবরকে অস্পষ্ট করিতে প্রয়াস পাইয়াছে। বিশেষতঃ এই রকম তাহরীফ ও রদ-বদল যখন তাহাদের কাছে মহাপুণ্য বলিয়া প্রশংসিত রহিয়াছে।
হযরত ঈসা আলাইহিস সাল্লামের এই সুখবর হেতু হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের আবির্ভাবের পুর্বে খৃষ্টান ইহুদীগণ প্রতিশ্রুত ফারকলীতের অপেক্ষায় ছিল; এমন কি এই সুযোগে কেহ কেহ নিজেই এই “ফারকবলীত” বলিয়া দাবী ও করিয়াছিল; ঐতিহাসিক উইলিয়ম মিউর ইহাদের কাহারও কাহারও সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছেন।
এমনকি হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের সমসাময়িক ইহুদী খৃষ্টানগণ ও যে একজন পয়গম্বরের আগমন প্রতীক্ষায় ছিলেন, স্বয়ং খৃষ্টানদের লিখিত ইতিহাসেও ইহার প্রমাণ রহিয়াছে; “ইতিহাসের সার” বা “লুব্বুৎতওয়ারীখ” গ্রন্থের খৃষ্টান ঐতিহাসিক বলেন –“মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের যামানায়ও ইহুদী খৃষ্টানগণ একজন পয়গম্বরের আবির্ভাবের প্রতিক্ষায় ছিলেন; ইহাতে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর খুবই উপকার হয়; তিনিও নিজেকে উক্ত প্রতীক্ষীত পয়গম্বর বলিয়া দাবী করেন।”
ইতিহাস সাক্ষী—আবেসিনিয়ার খৃষ্টান রাজা নাজ্জাশীর নিকট যখন হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের পত্র পৌছায়, তিনি তখনই ঘোষণা করেন আমি আল্লাহকে সাক্ষী রাখিয়া বলিতেছি যে ইনিই আহলে কিতাবের সেই প্রতীক্ষিত নবী;” এক পত্রোত্তরে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে লিখেন, আমি একথার সাক্ষ্য দান করিতেছি যে আপনি আল্লাহর সাচ্চা সত্য রসুল, আমি আপনার কাছে এবং আপনার চাচাত ভাই জাফরের হাতে “বয়অত” করিলাম এবং তাহার হাতে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হইলাম।
অনুরূপ ভাবেই মিশরের খৃষ্টান সম্রাট “মকুকস” হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রেরিত পত্রের উত্তরে লিখেন যে এই চিঠি মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহর নামে; মিশর সম্রাট মকুকসের তরফ থেকে; আপনাকে সালাম জানাই। অতঃপর সমাচার এই যে—আমি আপনার পত্র পাঠ করিলাম, ইহাতে লিখিত বিষয় অনুধাবন ও উপলব্ধি করিলাম; আপনি যে বিষয়ের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন তাহাও বুঝিলাম; আমি জানিতাম যে একজন নবীর আগমন বাকী; তিনি আসিবেন; কিন্তু তিনি সিরিয়াতেই প্রেরিত হইবেন বলিয়া ছিল আমার ধারনা; আমি আপনার প্রেরিত দূতের সাদর সম্ভাষণ করিয়াছি।
অনুরূপ ভাবেই বিশিষ্ট এবং শীর্ষস্থানীয় খৃষ্টান জারূদ ইবনে আলা প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সমীপে উপস্থিত হইয়া বলে—আল্লাহর শপথ! আপনি সত্য লইয়াই আসিয়াছেন, এবং সত্য কথাই বলিতেছেন; যিনি আপনাকে পয়গম্বর করিয়া পাঠাইয়াছেন, সেই আল্লাহর শপথ, আমি আপনার গুণাবলী ইঞ্জিল মধ্যে পড়িয়াছি; এবং বুতুলের (মরয়ম বা মেরী) পুত্র আপনার আবির্ভাবের সুখবর দিয়াছেন। আপনার উপর অজস্র সালাম বর্ষিত হউক; আপনাকে যিনি মৰ্যাদা দান করিয়াছেন সেই আল্লাহর হাযার হাযার শুকুর; দর্শনের পর শ্রবনের প্রশ্নই উঠে না; বিশ্বাসের পর সন্দেহের অবকাশ থাকেনা; আপনি হস্ত প্রসারণ করুন, আমি সাক্ষ্য দিতেছি যে আল্লাহ ব্যতীত কেহই ইবাদতের যোগ্য উপযুক্ত নাই; এবং আপনি আল্লাহর রসুল।” বলাবাহুল্য জারূদের সংগে তাহার সম্প্রদায়ের সকলেই মুসলমান হইয়া যায়।
হযরত ঈসা (আঃ) যে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর “বশারত” বা আগাম সুখবর দান করিয়াছিলেন, এবং এতদনুসারে খৃষ্টান, ইহুদিরা এই প্রতিশ্রুত পয়গম্বরের আগমন আবির্ভাবের অপেক্ষায় ছিলেন, হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের আবির্ভাব কাল পর্যন্ত; অতঃপর এই সত্য অস্বীকার করিবার উপায় নাই, কেহই করিতে পারে না।
সিরিয়া যাত্রাকালে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সংগে ইহুদি ধর্মযাজক “বুহাইরা” রাহিবের সাক্ষাৎ এবং এবং তাহার নবুওৎ সম্পর্কে উক্তি ও ইহার ঐতিহাসিক প্রমাণ যে, শুধু খৃষ্টানরা নয় বরং ইহুদিরাও প্রতিশ্রুত নবীকে জানিত; তাহার নিদর্শনাদি সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই ওয়াকিবহাল ছিল, এবং তাহার আবির্ভাবের প্রতীক্ষায় দিন গুণিতেছিল; এই জন্যই বুহাইরা রাহিব বালক হুযুর সল্লাল্লহু আলাইহি ও সাল্লামকে দেখিবা মাত্রই চিনিতে পারে যে, ইনি সেই প্রতিশ্রুত এবং প্রতীক্ষীত নবী; এবং ইহুদীদের বিদ্বেষ ও শত্রুতা সম্পর্কে সতর্ক করিয়া দিয়া তাহাকে অবিলম্বে মদীনায় ফিরাইয়া লইবার জন্য আবু তালিবকে পরামর্শ দেয়।
এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর আসুন, আমরা আবার “ফারকলিত” শব্দ সম্পর্কে আলোচনা করিতে যাই। একথা স্থির নিশ্চিত সত্য যে-প্রতিশ্রুত পয়গম্বর সম্পর্কে হযরত ঈসা (আঃ) যে শব্দ বা নাম উল্লেখ করিয়াছিলেন, তাহার অস্তিত্বই নাই, খৃষ্টানদের চিরাচরিত অভ্যাস এবং অনুবাদের বেদীমূলে তাহা বলি এবং সম্পূর্ণরূপে অবলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। অতএব আমরা ঐ আসল শব্দটি কি ছিল তাহা লইয়া আর ঘাটাঘাটি করিতে চাইনা। আমরা বর্তমান ইউনানী বা গ্রীক শব্দ “পিরুক্লুতুস” এবং “পারাক্লিতুস” নিয়াই আলোচনা করিব। আমরা বলি—শব্দটি যদি আসলে মুহাম্মদ, আহমদ (দঃ) শব্দের প্রায় সমার্থক “পিরুক্লুতুস” হয়, তবে ত কথাই নাই; আর যদি ইহা সহায় “সহায়ক” “কর্মসাধক”, “ওকীল”, “সুপারিশ কর্তার সমর্থক “পারাক্লিতুস” ই হয়, তবুও তাহাতে কিছু যায় আসেনা। কেননা এই সমস্ত বিশেষণেই হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে বিশেষভাবে প্রযোজিত রহিয়াছে।
এক্ষণে আমরা দৃপ্তকণ্ঠে বলিতে চাই যে হযরত ঈসা (আঃ) যে “ফারকলীত নবী” র বশারত বা আগাম সুখবর দান করিয়াছেন, তিনি যে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)ই তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নাই। “পেন্টিকস্ট” বা ইহুদীদের বিশিষ্ট পর্বদিনে যে রূহ অবতীর্ণ হইয়াছিল এবং যাহার উল্লেখ “আমাল” কিতাবে রহিয়াছে সেই “রূহ” ই এই প্রতিশ্রুত “ফারকলীত” বলিয়া খৃষ্টানদের দাবী সম্পূর্ণ ভিত্তীহীন, সর্বৈব অসত্য, যুক্তিতর্ক এবং দলীল প্রমাণ বিরোধী।
প্রণিধান করুন
(১) ফারকলীত সম্পর্কে “বশারত” দিবার পূর্বেই হযরত ঈসা (আঃ) হাওয়ারীদের সতর্ক করিয়া বলিতেছেন, তোমরা যদি আমাকে ভালবাস তবে আমার কথা শুনো।
ফারকলীত অর্থে যদি উক্ত রূহই উদ্দেশ্য হইত, তবে হযরত ঈসা (আঃ) এর একথা বলিবার প্রয়োজন হইত না; কেননা যে রূহ দ্বারা হাওয়ারীগণ ইতিপূর্বে উপকৃত এবং জ্ঞানলব্ধ, যাহার সংগে তাহারা সুপরিচিত, তাহার আগমন সম্পর্কে বর্ণনাকালে এমন সতর্ক বাণীর কোনই প্রয়োজন ছিলনা। কেননা রূহকে না মানিবার তাহাকে অস্বীকার করিবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও হাওয়ারীদের ক্ষেত্রে ছিলনা। কেননা এই রূহ যাহার উপর নাযিল হইবে, যাহার মধ্যে প্রবেশ করিবে, তাহার মধ্যেই তাহার প্রভাব প্রতিক্রিয়া অবশ্য অবশ্য সঞ্চার করিবে; এমতাবস্থায় তাহাকে অস্বীকার করিবার কোন প্রশ্নই উঠেনা।।
বরং যাহার আবির্ভাবের পর ইহুদী খৃষ্টানরা তাহাকে অস্বীকার করিতে পারে বলিয়া সম্ভাবনা, তাঁহার সম্পর্কে তাহাদিগকে আগাম সতর্কই করা হইতেছে। এমতাবস্থায় এই ফারকলীত যে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) ব্যতীত অন্য কেহ নন, এবিষয়ে সন্দেহ থাকেনা।
(২) রূহুল কুদুস কিছুতেই ফারকলীত হইতে পারেন না; কেননা খৃষ্টানদের মতে তিনি তাহার পিতার সহিত একাত্ম এবং পুত্রের সহিত অবিচ্ছেদ্য; এমতাবস্থায় তাহাকে কিছুতেই দ্বিতীয় “ফরকলীত” বলা যাইতে পারেনা; তিনি কিছুতেই দ্বিতীয় হইতে পারেন না। বরং তাহাকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র স্বত্তা হইতে হইবে; এই জন্যই হযরত ঈসা (আঃ) দ্বিতীয় “ফারকলীত” প্রেরণের জন্য আল্লাহর কাছে আবেদনের কথা বলিয়াছেন। এমতাবস্থায় ফারকলীত যে রুহুল কুদুস নয়, বরং অন্য কেহ, একথা অস্বীকার করা যায়না, এবং যেহেতু রুহুল কুদুস ব্যতীত অন্য কোন ফারকলীত হযরত ঈসা (আঃ) হইতে প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের যামানা পর্যন্ত প্রেরিত হন নাই; এমনকি তাহার পরেও আজ পর্যন্ত জন্মান নাই; অতএব হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)ই যে এই প্রতিশ্রুত ফারকলীত তাহাতে সন্দেহ নাই।
(৩) “ফারকলীত” অর্থে যদি রূহুল কুদুসই উদ্দেশ্য হন, তবে “ওকীল সুপারিশকর্তা সহায় সাহায্যকারী” ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগ তাঁহার সম্পর্কে হইতে পারেনা; কেননা যিনি খৃষ্টানদের মতে স্বয়ং খোদার সংগে অভিন্ন আত্মা, তাহার সুপারিশ করার কোন অর্থই হয়না। অতএব হহজরত মুহাম্মদ (সাঃ)ই যে এই প্রতিশ্রুত ফারকলীত একথা স্বভাবতঃই প্রতীয়মান হইয়া যায়।
(৪) হযরত ঈসা (আঃ) এই প্রতিশ্রুত ফারকলীত সম্পর্কে বলিয়াছেন যে—তিনি সব কিছুই তোমাদিগকে শিক্ষা দিবেন; আমি তোমাদিগকে যাহা কিছু বলিয়াছি, তাহাও স্মরণ করাইয়া দিবেন।
নিউটেষ্টুমেন্টের কোথাও একথা বর্ণিত নাই যে হাওয়ারীগণ হযরত ঈসার (আঃ) শিক্ষা ভুলিয়া গিয়াছিলেন এবং উল্লিখিত রূহ তাহা স্মরণ করিয়া দিয়াছেন।
(৫) হযরত ঈসা (আঃ) আর ও বলিতেছেন – তোমরা যাহাতে তাহাকে বিশ্বাস করিতে পার, সেই জন্য তাহার আবির্ভাবের পূর্বেই আমি তোমাদিগকে তাহা বলিয়া দিলাম।
বলাবাহুল্য হাওয়ারীগণ রুহকে অবিশ্বাস অস্বীকার করিবেন এমন ধারনাই করা যাইতে পারেনা, কেননা ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করিয়াছি খৃষ্টানদের বর্ণনা অনুসারেই খৃষ্ট মহলে হওয়ারীদের নিকট “রূহ” অতি সুপরিচিত এবং শুরু হইতেই তাহারা তাহার অতিভক্ত।
যাহাকে বিশ্বাস এবং স্বীকার করিতে তাহাদের মনে ইতস্ততা জাগিতে পারে, একমাত্র তাহারই সম্পর্কে এই ঘোষণা হইতে পারে; এবং বলাবাহুল্য সেই ফারকলীত হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) ব্যতীত অন্য কেহই নহেন একথা কিছুতেই অস্বীকার করা যায়না!
(৬) প্রতিশ্রুত ফারকলীত সম্পর্কে হযরত ঈসা (আঃ) বলিয়াছেন যে তিনি আমার সত্যতার সাক্ষ্য দিবেন। অথচ খৃষ্টানদের উল্লিখিত ঐ “রূহ” কাহার ও সম্মুখে হযরত ঈসা (আঃ) এর সত্যতার সাক্ষ্য দিয়াছেন বলিয়া কোন প্রমাণ নাই, কেননা হাওয়ারী ও খৃষ্টানগণ হযরত ঈসা (আঃ) কে খুব ভাল করিয়াই চিনিত, জানিত, এমতাবস্থায় এই সাক্ষ্যের কোন প্রয়োজনই ছিলনা।
পক্ষান্তরে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)ই একমাত্র পয়গম্বর, যিনি দৃপ্ত কণ্ঠে হযরত ঈসা (আঃ)র সত্যতার সাক্ষ্য দান করিয়াছেন; অতএব তিনিই যে এই প্রতিশ্রুতি ফারুকলীত, একান্ত ন্যায় বিচারের খাতিরেই একথা স্বীকার করিতে হয়।
(৭) হযরত ঈসা (আঃ) বলিয়াছেন এবং তোমরা ও সাক্ষী আছ, কেননা তোমরা শুরু হইতেই আমার সংগে রহিয়াছি। ইহাতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে হাওয়ারীদের সাক্ষ্য এবং ফারকলীতের সাক্ষ্য এক নয়, বরং দুইটি ভিন্ন ভিন্ন এবং পৃথক পৃথক সাক্ষ্য; এমতাবস্থায় ফারকলীত “অর্থে রূহ” উদ্দেশ্য হইলে উল্লিখিত সাক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন থাকেনা বরং এক হইয়া যায়।
(৮) হযরত ঈসা (আঃ) বলিয়াছেন—আমি যদি না যাই তবে ঐ ফারকলীত তোমাদের কাছে আসিবেনা। অবশ্য আমি যদি যাই তবেই তিনি আসিবেন। লক্ষ্য করুন ইহাতে হযরত ঈসা (আঃ) ফারকলীতের আগমন তাহার বিদায় এবং গত হইয়া যাওয়ার উপর নির্ভর করিতেছে বলিয়া ঘোষণা করিতেছেন। বর্তমানে যে ফারকলীতের আবির্ভাব হইবে না, একথা স্পষ্ট ভাবে বলিয়া দিয়েছেন, অথচ খৃষ্টানদের উল্লিখিত “রূহ” ত হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের বর্তমানেই নাযিল হইয়াছে একথা স্বয়ং খৃষ্ট মহলে সর্ব সম্মত সত্য।
এমতাবস্থায় একমাত্র সেই ব্যক্তিই প্রতিশ্রুত ফারকলীত হইতে পারেন, হযরত ঈসা (আঃ) এর আকাশ অভিযানের পূর্বে তাঁহার শিষ্যগণ যাহার কাছ থেকে কোন ভাবে উপকৃত হন নাই, এবং যাহার আবির্ভাব হহরত ঈসা (আঃ) এর যাত্রার উপরই মকুব রহিয়াছিল; বলাবাহুল্য এই সমস্ত কথা ও বর্ণনা একমাত্র হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কেই অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হইয়াছে; কেননা যেহেতু একই সময়ে দুই স্বতন্ত্র শরীয়ত ধারী পয়গম্বরের আবির্ভাব হইতে পারেনা, তাই তাহার আগমন হযরত ঈসা (আঃ)র বিদায় পর্বের উপর মকুব ছিল; তিনি চলিয়া গেলেন এবং তাহার অবর্তমানে তাহার প্রতিশ্রুত ফারকলীত হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) আগমন করিলেন।
(৯) হযরত ঈসা (আঃ) বলিয়াছেন—তিনি (ফারকলীত) জগৎকে ভর্ৎসনা করিবেন। হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামই যে এই প্রতিশ্রুত “ফারকলীত” হযরত ঈসার (আঃ) এই বাক্যটী ও তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ; কেননা হযরত ঈসা (আঃ) এর পর একমাত্র হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামই তীব্র ভাবে সমগ্র জগৎকে, বিশেষতঃ হযরত ঈসার প্রতি ঈমান না আনার কারনে ইহুদী দিগকে যেমন দারুণ ভাবে ভর্ৎসনা তিরস্কার করিয়াছেন, তাহার তুলনা হয়না।
পাদ্রী রেংকীন তাই এই বাক্যটি অস্বীকার করিতে গিয়া বলিয়াছেন যে এই বাক্যটি পরিবর্ধিত, ইঞ্জিল কিংবা ইঞ্জিলের কোন অনুবাদেই এই বাক্যটি নাই।
কিন্তু পাদ্রীসাহেবের দূর্ভাগ্য যে—১৬৭১ খৃষ্টাব্দে রোম হইতে, ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে ১৮২৫, খৃষ্টাব্দে ১৮১৬ খৃষ্টাব্দে বেইরাত হইতে প্রকাশিত ইঞ্জিলের আরবী অনুবাদ এবং ১৮২৮ ও ১৮৪১ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত ফারসী অনুবাদে স্পষ্ট ভাবে বর্তমান ঐ বাক্যটি পাত্রী সাহেবের অসত্য ভাষণের নিমর্ম সাক্ষী হিসাবে জ্বলজ্বল করিতেছে।
১০। হযরত ঈসা (আঃ) বলিয়াছেন—তোমাদিগকে আমার অনেক কিছু বলিবার আছে, কিন্তু তোমরা এখন তাহা সহ্য করিতে পারিবেনা।”
ইহাতে প্রমাণ পায় প্রতিশ্রুত ফারকলীত হযরত ঈসা (আঃ)-র বর্ণিত বিষয়বস্তু অপেক্ষাও অতিরিক্ত অনেক কিছু বলিবেন; বলাবাহুল্য একমাত্র হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামই সেই মহান ব্যক্তিত্ব যিনি হযরত ঈসা (আঃ)-র আদেশ নিষেধ এবং নির্দেশাদি অপেক্ষাও অতিরিক্ত হুকুম আহকাম বৰ্ণনা করিয়াছেন;
পক্ষান্তরে খৃষ্টানগণ যে তথা কথিত “রূহ”-কে উক্ত ফারকলীত বলিয়া প্রমাণ করিতে চাহিয়াছেন, তাহার অবতরণের পরও সিফর – খুরুজের উল্লিখিত তওরাতের দ্বাদশ নির্দেশ ও তাহারা বাতিল করিয়া দিয়াছেন।
মোট কথা—উল্লিখিত বর্ণনার পর একথা স্পষ্ট হইয়া যায় যে, এমন একজন নবীই প্রতিশ্রুত ফারকলীত হইতে পারেন, যাহার শরীয়ত এবং দ্বীন ধর্মে হযরত ঈসা (আঃ) এর শরীয়ত এবং দ্বীন ধর্ম অপেক্ষাও অধিক নির্দেশাদি রহিয়াছে; এবং সেই নির্দেশাদিও দূর্বল ঈমান লোকদের পক্ষে পালন দূর্বহ এবং কষ্টকর বলিয়া অনুভূত হইবে।
১১। হযরত ঈসা (আঃ) বলিয়াছেন—ঐ ফারকলীত নিজে থেকে কিছু বলিবেনা বরং যাহা কিছু শুনিবে, তাহাই বলিবে।
খৃষ্টান-ইহুদীগণ উক্ত ফারকলীতকে মিথ্যা ভাষী বলিতে এবং অবিশ্বাস করিতে পারে বলিয়াই হযরত ঈসা (আঃ) এর এই সতর্ক বাণী, সত্যতার সাক্ষ্য; অর্থাৎ তিনি যাহা বলিবেন, তোমারা তাহাকে ‘তাহার নিজস্ব বক্তব্য বলিয়া মনে করিওনা, মিথ্যা বলিয়া উড়াইয়া দিতে যাইওনা; কেননা তিনি যাহা বলিবেন, তাহা তাহার নিজস্ব বাণী নয়, বরং আল্লাহর কাছ থেকে শুনা পবিত্র কুরআন একমাত্র হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম সম্পর্কেই ঘোষণা করতঃ বলিয়াছে যে—তিনি নিজের মনে কিছু বলেন না, বরং তিনি মূর্তিমান ওহী; তাহার প্রতি যে ওহী বা আল্লাহর বাণী অবতীর্ণ হয়, তিনি তাহাই বলিয়া থাকেন।
ما ينطق عن الهوى – إث هو الا وحی وحی
অন্যত্র বর্ণিত রহিয়াছে—আমি তাহাই অনুসরণ করিয়া চলি, যাহা আমার প্রতি অবতীর্ণ হইয়া থাকে।
বলাবাহুল্য হযরত ঈসা (আঃ) বর্ণিত—ঐ প্রতিশ্রুত ফারকলীত যাহাতে হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম না হইতে পারেন, তজ্জন্য খষ্টানগণ সর্বশক্তি প্রয়োগ করিয়াছেন, এবং নিমজ্জিত ব্যক্তি যেমন তৃণখণ্ড আড়াইয়া ধরে তেমনি তাহারাও উপরে উল্লিখিত তথা কথিত “রূহ”-ই এই প্রতিশ্রুত কাকলীত বলিয়া প্রমাণ করিবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা পাইয়াছেন; কিন্তু তাহাদের দুর্ভাগ্য, কি উক্তি, কি যুক্তি প্রমাণ, কি ইতিহাস কোন কিছুই তাহাদের সমর্থন ত দূরের কথা বরং ইহার বিরুদ্ধেই সোচ্চার রহিয়াছে।
উপরে উল্লিখিত সংক্ষিপ্ত বিবরণই এতদপ্রমাণে যথেষ্ট; আরও বিস্তারিত বিবরণ জানিতে হইলে পড়ুন—“ইযহারুল হক তৃতীয় খণ্ড”
বার্ণাবা ইঞ্জিলে হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সালাম
সুবিখ্যাত পাত্রী “সেল” তাহার লিখিত কুরআনের অনুবাদের ভূমিকায় প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম সম্পর্কে বার্ণাবা, ইঞ্জিলে বর্ণিত নিম্নলিখিত একটি বশারত উদ্ধৃত করিয়াছেন—
“ওহে বার্ণাবা! তুমি জানিয়া রাখ যে—গোনাহ যতই ছোট হউক না কেন আল্লাহ তাহাতে শাস্তি প্রদান করিয়া থাকেন, কেননা আল্লাহ গোনাহ পছন্দ করেন না; এবং আমার মা এবং আমার শিষ্যরা যখন পার্থিব লোভেই আমাকে ভাল বাসিল, তখন আল্লাহ তাহাতে নারায অসন্তুষ্ট হইলেন; এবং তাহার ইনসাফের চাহিদা অনুসারে তাহাদিগকে এই পৃথিবীতেই শাস্তিদানের ইচ্ছা করিলেন; যাহাতে তাহারা জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা পায়; এবং সেখানে তাহাদের কোন কষ্ট না হয়; এবং আমি যদিও নির্দোষ, তবুও কিছু সংখ্যক লোকেরা যখন আমার সম্পর্কে বলিল যে-ইনি আল্লাহ এবং আল্লাহর পুত্র, তখন আল্লাহ ইহাতে বিরক্ত হইলেন, এবং কিয়ামতের দিন শয়তান যাহাতে গোনাকে ঠাট্টা বিদ্রুপ এবং উপহাস না করিতে পারে তাজ্জন্য ভিনি ইহুদার মৃত্যু মাধ্যমে দুনয়াতেই হাতে এই ঠাট্টা বিদ্রুপের অবসান হইয়া যায় এই লোকেরা আমারই শূলী হইয়াছে বলিয়া ধাণা করুক বলিয়া সমীচীন মনে করিলেন; বলাবাহুল্য যে পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম না আসিয়াছেন ততদিন পর্যন্ত এই ঠাট্টা বিদ্রুপ চলিতেই থাকিবে; তিনি যখন আসিয়া যাইবেন, সকল মুমিন, ঈমানদারকেই তিনি এই ভুল বিভ্রান্তি সম্পর্কে অবহিত, সতর্ক করিবেন, ফলে জনমন থেকে এই সন্দেহের অবসান ঘটিৰে।” (১৮৫০ খৃঃ এবঃ ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত, এবং সারা ভারতে সর্বত্র প্রচারিত “ইজামে ঈদোয়ী”)।
বিখ্যাত পণ্ডিত, জনাব হায়দার আলী তাহার উর্দূ ভাষায় লিখিত “সইফূল মুরসলিমীন” গ্রন্থের ৬৩ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন যে – “আর্মোনিয়াম পাদ্রী অর্শাগন বাইবেলের “ইয়সয়া” কিতাবের তর্জমা আর্মেনি ভাষায় করিয়াছেন; ১৬৬৬ খৃষ্টাব্দে লিখিত অনুবাদ ১৭৩৩ খষ্টাব্দে “এন্টোনি সোটলী”-তে প্রকাশিত হয়; এই অনুবাদের ৪নং অধ্যায়ে বর্ণিত রহিয়াছে যে—আল্লাহর পবিত্রতা কীর্তন কর; নূতন ভাবে তাহার রাজত্বের প্রভাব প্রকাশ পাইয়াছে; তাহার নাম “আহমদ”; এই অনুবাদ অজিও অর্মেনিয়ানদের নিকট বর্তমান রহিয়াছে, আপনার। ইচ্ছা করিয়েই দেখিতে পাইবেন।”
খৃষ্ট সম্প্রদায় যতই অস্বীকার করুক না কেন, ইতিহাস সাক্ষী, প্রথম যুগের যে সমস্ত ইহুদী পণ্ডিতগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহাদের সকলেই প্রিয়নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের আবির্ভাব ও নবুওত সংক্রান্ত বর্ণনা ও বশারত বাইবেলের ওল্ড এবং নিউ উভয় টেস্টমেন্টেই বর্ণিত রহিয়াছে বলিয়া দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সাক্ষ্য দান করিয়াছেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) শু’বা-পুত্র বিনয়মীন এবং মুখাইরীখ, কাব আহবার প্রমুখ ইহুদী পণ্ডিত, এবং বুহাইরা, নাস্তুরা, _ জারূদ, নাজ্জাশী, রোমান বিশাদ যগাতির, সুস, এবং হযরত জাফর, ইবনে আবিতালিবের সংগে মদীনায় আগত খৃষ্টান পণ্ডিতগণ তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ যোগ্য।
এতাবাতীত দুর্ভাগ্য বশতঃ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করিলেও রোমান সম্রাট হিরাক্লিস, মিশর সম্রাট মকুওকস, ইবনে সুরিয়া, হুয়াই ইবনে আখতাব, আবু ইয়াসির ইবনে আখতাবের মত জাঁদরেল জাঁদরেল দলপতিরা প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের সত্যতা এবং তাহাকে প্রতিশ্রুত ফুরিকলীত ও সত্যিকারের নবী বলিয়া স্বীকার করিতে দ্বিধা রোধ করেন নাই।
অনুরূপ ভাবে নাজরান এলাকার খৃষ্টান ডেপুটেশনের প্রিয়নবী সকাশে উপস্থিতি, তাহাদের আগমন বৃত্তান্ত নিজেদের মধ্যে কথোপকথন, তাহাদের লাটপাদ্রীর বক্তব্য, প্রিয় নবীসল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম কর্তৃক আহুত মুবাহেলা করিতে ভয়, অসম্মতি এবং জিযিয়া প্রদানের সর্তে সন্ধিচুক্তি করতঃ প্রত্যাবর্তন, নিজেদের মধ্যে প্রিয়নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের নবুওতের স্বীকৃতি প্রভৃতি বিস্তারিত বৃত্তান্ত এবং ঘটনাবলী প্রিয়নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের সত্যতা সাপেক্ষে এমন ঐতিহাসিক অকাট্য প্রমাণ যে নেহাৎ, সত্য, এবং লজ্জা শরমের মাথা না খাইলে কেহই তাহা অস্বীকার করিতে পারেনা। ঐতিহাসিক নাজরান ডেপুটেশনের বিস্তারিত বিবরনের জন্য “শেষনবী” এবং “ইসলামের টান” প্রভৃতি বই পড়িতে অনুরোধ করি।
و آخر دعونا أن الحمد لله رب العليين و الصلوة والسلام علی سیدنا و مولانا محمد واله وصحبه أجمعين –
রচনাকালঃ ২৫-৯-১৯৮৮
পরের পর্বগুলি পড়তে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে বেদে-বাইবেলে ভবিষ্যৎবাণী (১ম পর্ব)
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে বেদে-বাইবেলে ভবিষ্যৎবাণী (২য় পর্ব)
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে বেদে-বাইবেলে ভবিষ্যৎবাণী (৩য় পর্ব)