একপক্ষ বলেন, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব গোঁড়া মুসলমান, হিন্দুবিদ্বেষী এবং অত্যাচারী—প্রমাণ স্বরূপ ভ্রাতাদের হত্যা করা, বৃদ্ধ পিতাকে বন্দী করা এবং হিন্দু প্রজাদের ধর্মের নামে অত্যাচার করা যথা জিজিয়া কর নেওয়া, হিন্দুদের মন্দির অপবিত্র করা বা ভেঙ্গে ফেলা ইত্যাদি অনেক কিছু উদাহরণ তারা পেশ করেন। আর অপরপক্ষ বলেন, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বা আলমগীর সমস্ত মুসলমান নৃপতির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম, নিষ্ঠাবান ধার্মিক, সমগ্র কুরআন শরীফ কন্ঠস্থকারী, আলেম, সাধক, নিরপেক্ষ, উদার, দুরদর্শী এবং উপযুক্ত আদর্শ বাদশাহ ছিলেন। তিনি ‘জিন্দাপীর’ বলেও গণ্য।
প্রথম পক্ষের বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য স্কুল, কলেজ ও ইউনিভারসিটির সাধারণ ইতিহাস যথেষ্ট। আমাদের অনেকের মগজে এবং কাগজেও তার প্রমাণের প্রাচুর্য অব্যর্থভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয় পক্ষের উক্তি বহু দলিল ও ঐতিহাসিক সমর্থন এবং বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি তর্ক ছাড়া মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া উচিতও নয়।
এখানেও আমরা ভারতজনের ইতিহাস হতে উদ্ধৃতি রাখবাে। ভারতের হাজার হাজার পাঠ্য পুস্তক ও ইতিহাসের উদ্ধৃতি দেওয়াও যেমন সম্ভব নয় তেমনি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্য ইতিহাসের সমস্ত কথা বাদ দেওয়া যায় না। প্রসঙ্গত হৃদয়ে গেঁথে নেওয়ার মত একটা কথা হচ্ছে এই যে, শিশু অবস্থায় শিশুর কচি মনের কোমল স্মৃতিপটে যে ছবি আঁকা যায় তা বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্টতর জোরও গভীর হয়ে মস্তিস্ক আলােকিত করে তােলে। যদি মাথায় এই কথাটুকু প্রবিষ্ট হয় যে, আকবর ‘মহামতি’, তিনি হিন্দু মুসলমানকে সমান চোখে দেখতেন, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ধর্মভীরু পণ্ডিত ছিলেন কিন্তু তিনি হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন, হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর চাপিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি বৃদ্ধ পিতাকে বণী ও ভাইদের হত্যা করে সিংহাসনে বসেছিলেন ইত্যাদি, তাহলে সাধারণতঃ বয়ােবৃদ্ধির পর অন্যান্য ইতিহাস পড়লেও বাল্যকারে ঐ প্রভাবটুকু যে কাটিয়ে ওঠা অত্যন্ত কঠিন তা আজ নিরপেক্ষ চিন্তাশীল পাঠক পাঠিকাদের কাছে বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঐ ‘ভারতজনের ইতিহাস’-এর ৪৩৮ পৃষ্ঠায় শ্রীবিনয় ঘােষ বলেছেন,
- [১] “শাহজাহানের মৃত্যুর আগেই ঔরঙ্গজীবের দুইবার রাজ্যাভিষেক হয় [জুলাই ১৬৫৮ ও জুন ১৬৫৯] শাহাজাহানের মৃত্যুর পর তৃতীয়বার ঔরঙ্গজীব মহাসমারােহে আগ্রার দুর্গের সিংহাসনে অভিষিক্ত হন (মার্চ ১৬৬৬]। তিনবার অভিষেক কোন মােগল সম্রাটের হয় নাই। কিন্তু ঔরঙ্গজীব যে মােগল সম্রাটদের মধ্যে বহুদিক হইতে অদ্বিতীয় হবেন, একাধিক অভিষেক হইতে তাহারই আভাস পাওয়া গিয়াছিল।”
- [২] “রাজপুতদের প্রতিরােধ ব্যর্থ হয়, ঔরঙ্গজীব মারওয়াড় দখল করেন এবং নানাস্থানে মেগল ফৌজদার নিযুক্ত করেন। তাহার আদেশে হিন্দু দেবাশয় ধ্বংস করিয়া বহু মসজিদও প্রতিষ্ঠিত হয়।”
- [৩] “১৬৭৯ খৃষ্টাব্দেই ঔরঙ্গজীব জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন করেন।”
- [৪] “ইসলামধর্মের আদর্শ অনুসারে মুসলমানরাষ্ট্রে ভিন্নধর্মীর কোন স্থান হইতে পারে না। পাঠান ও মােগল সম্রাটদের মধ্যে যাহারা ভিন্নধর্মীদের প্রতি, বিশেষ করিয়া হিন্দুদের প্রতি উদার ব্যবহার করিয়াছে, তাহারা ব্যক্তিগত মহত্ত্বের পরিচয় দিয়াছেন সত্য, কিন্তু ইসলামের আদর্শ সেবক বলিয়া গোঁড়া মুসলমানদের কাছে শ্রদ্ধা ও প্রশংসা লাভ করিতে পারেন নাই। ঔরঙ্গজীব নিজেকে ইসলামধর্মের আদর্শ সেবক বলিয়া মনে করিতেন এবং রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রে তিনি ইসলামের অনুশাসন বর্ণে বর্ণে পালন করিবার চেষ্টা করিতেন। সেইজন্য তাহার রাষ্ট্রনীতিতে মুসলমান ছাড়া অন্য কোন ধর্মাবলম্বীর দাবী বা অধিকার স্বীকৃত হইত না। বিধর্মীর অধিকার স্বীকার করা ইসলাম ধর্মবিরুদ্ধ।” (ভারতজনের ইতিহাস, ৪৪১-৪৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)
- এই সমস্ত সাংঘাতিক কথায় এটাই প্রমাণ করবার চেষ্টা করা হয়েছে যে “ঔরঙ্গজীব’ পূর্ণভাবে ইসলাম মেনে চলতেন। আর ইসলাম মেনে চললেই তাকে নাকি পশু প্রকৃতির বর্বর, অনুদার এবং হিন্দুবিদ্বেষী হতেই হবে: তারপর ঐ ইতিহাসে আরও যা লেখা হয়েছে তাও খুব গভীর চিন্তার বিষয়—
- [৫] “চিন্তামন মন্দিরে গােহত্যা করিয়া তিনি সাড়ম্বরে তাহা মসজিদে পরিণত করিয়াছিলেন। সেই সময় গুজরাটে আরও বহু হিন্দু দেবালয় তিনি ধ্বংস করিয়াছিলেন।”
- [৬] ৪৪৩ পৃষ্ঠায় আরও লেখা আছে, “তিনি বিধর্মী হিন্দুদের সমস্ত টোলচতুম্পাঠী দেব দেউল ধ্বংস করিতে বলেন। সেই আদেশ অনুসারে হিন্দুদের বড় বড় তীর্থস্থানে বিখ্যাত সব মন্দির ধ্বংস করা হয়।”
- [৭] ঐ পৃষ্ঠাতেই এও লেখা হয়েছে— “গুজরাটে হির্দের সমস্ত দেবােত্তর সম্পত্তি তাহার আদেশে বাজেয়াপ্ত করা হয়।”
- [৮] এই ইতিহাসে লেখক আরও লিখেছেন- “আগেই বলিয়াছি যে ইসলামধর্ম অনুসারে মুসলমানরাষ্ট্রে বিধর্মীর বসবাসের অধিকার নাই।……অর্থাৎ হিন্দুরা বিধর্মী বলিয়া মুসলমানী ভারতরাষ্ট্রে হারে বাস করিবার অধিকার নাই। তাহা সত্ত্বেও হিন্দুদের বাস করিতে দেওয়া হইতেছে বলিয়া মুসলমান সম্রাটরা হিন্দুদের মাথাপিছু জিজিয়াকর দিতে বাধ্য করিতেন।” তার পরেই ঐ ইতিহাসে যা লেখা হয়েছে তাতে হিন্দু ছাত্র- ছাত্রীদের উত্তেজিত করার কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে বলে অনেকের অনুমান।
- [৯] লেখক বলেছেন, “ভারতবর্ষ যাহাদের চিরকালের মাতৃভূমি সেই হিন্দুদের পরদেশবাসীর মতাে অপমান ও অত্যচার সহ্য করিয়া লক্ষ লক্ষ টাকা জিজিয়া কর দিতে হইত এদেশে বাস করিবার জন্য। ইতিহাস এতবড় নিষ্ঠুর পরিহাস কখনও সহ্য করে না।”
- [১০] ঐ ইতিহাসের ৪৪৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ‘নতুন করিয়া জিজিয়া প্রবর্তনের পর দিল্লির বিক্ষুব্ধ হিন্দু জনতা সম্রাটের কাছে উহা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করিযাছিল। সম্রাট ঔরঙ্গজীব হাতে বিচলিত হন নাই। উপরন্তু তিনি জনতার উপর দিয়া হাতী চালাইয়া তাহাদের পদদলিত করিয়া পিশিয়া মারিবার আদেশ দিয়াছিলেন। তাহার উদ্দেশ্য ছিল অসহায় হিন্দুদের জোর করিয়া মুসলমান করা।”
- [১১] “হিন্দুরা মুসলমান হইলে তাহাদের হাতীর পিঠে বসিয়ে রাজপথের উপর দিয়া ব্যান্ড কাড়াকাড়া বাজাইয়া সােভা করিয়া লইয়া যাওয়া হইত।”
- [১২] এতদ্ব্যতীত ৪৪৯ পৃষ্ঠায় আরও লেখা হয়েছে- “ঔরঙ্গজীবের ধর্মান্ধ নীতির ফলে রাজপুত-শক্তিও মােগলদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিয়াছিল।”
- [১৩] “দাক্ষিণাত্যেও বিরাট হিন্দু পুনরভ্যুথান হইয়াছিল মারাঠা বীর শাহজী-শিবাজী শম্ভুজীর নেতৃত্বে।”
প্রথমত ইসলামধর্মে কোথাও বলা হয়নি যে, বিধর্মীর অধিকার স্বীকার করা ইসলাম ধর্মবিরুদ্ধ। বরং হজরত মুহাম্মদের (সঃ) ইতিহাস একথাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তিনি অমুসলমানদের পাশাপাশি বাস করেছে এবং মিলেমিশে থাকার জন্য ঐতিহাসিক সন্ধিস্থাপন করেছেন। আজও আরবে বহু ধর্মের মানুষ বাস করছেন। সারা পৃথিবীতে কোন মুসলিম রাষ্ট্রে ঐ অলীক আজগুবি অবান্তর আলেখ্য দৃষ্টিগােচর হয় না।
এমনি ভাবে চিন্তামন মন্দিরে গােহত্যা করার কথাও কুচিন্তা বা কুকল্পনার নামান্তর। ‘হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস’, ‘সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত’, ‘জোর করিয়া মুসলমান করা’ ইত্যাদিগুলাে কতটুকু সত্য আর কতটুকু অসত্য তা একজন অমুসলিম ঐতিহাসিকের বর্ণনায় পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক বাবু নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পুস্তকে লিখেছেন, “ভােগ ঐশ্বর্যের মধ্যে বাস করিয়া কেবলমাত্র পার্থিব জীবনের সার্থকতা সম্পাদন-করিতে মােছলেম নরপতিগণ অভ্যস্ত ছিলেন না। তাঁহারা সহ কাজে লিপ্ত হইয়াও কখনাে বিস্মৃত হন নাই যে, তাহাদিগকে একদিন আল্লার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া কাৰ্যাকার বাদশাহ ন্যায়ের সীমার মধ্যে অবস্থিত করতঃ তাহাদের অধীন সমস্ত প্রজাবৃন্দকে সমচক্ষে দেখিতে। নরপতির ন্যায়বিচারে প্রজার সন্তোষ এবং সন্তোষের উপর রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত, তাহাদিগের অন্তঃকরণে এই সত্য যেন সুবর্ণ অক্ষরে খচিত ছিল। ধর্মান্তর গ্রহণ সম্বন্ধে কেহ কখনও বলপ্রয়ােগ করিয়াছেন—এই অভিযােগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। মােছলমান বাদশাহদের যদি সে উদ্দেশ্য থাকিত—তাহা হইলে এতদিন ব্যাক্ত করিবার পর হিন্দুস্থানে হিন্দুর সংখ্যা কখনও মােছলমানদের চতুর্গুণ হইত না। হিন্দু ও মােছলমান একই দেশে একই পল্লীর ভিতর এই সুদীর্ঘকালব্যাপী মােছমান রাজত্বের মধ্যে পরম সুখে পরম শান্তিতে বসবাস করিয়াছিল। বিদেশী স্বার্থান্ধ ঐতিহাসিকগণের কাল্পনিক চিত্রে অঙ্কিত মােছলেম নরপতিগণের স্বেচ্ছাচারিতা, নৃশংসতা ও ধর্মান্তরতার বিষয় পাঠ করিয়া এবং কতিপয় স্বার্থপর বিদ্বেষপরায়ণ লােকের প্রচারিত জনরবের উপর আস্থা স্থাপন করিয়া এখনও সেইসব মহানুভব নরপতিগণের নিন্দা ও কুৎসা প্রচার করিয়া থাকেন। রাজকার্যে যােগ্য ব্যক্তিকে নিয়ােগ করিয়া মােছলেম শাসনকর্তাগণ ন্যায়পরায়ণতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিতেন। এমনকি হিন্দুবিদ্বেষী বলিয়া অভিহিত মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব হিন্দুকেই প্রধান সেনাপতি পদে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। রাজকার্যে যােগ্য ব্যক্তি তাহার নিকট বিশেষরূপে সমাদৃত হইত। সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্বের কলঙ্ক কেহ তাহার উপর আরােপ করিতে পারে নাই। রাজ্যে শুভাশুভের দায়িত্ব হিন্দুগণের উপর ন্যস্ত ছিল। তাঁহার রাজত্বকালে দুইজন অমােছলমান কর্মচারী রাজস্ব বিভাগে অতি উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
কয়েকজন ধর্মান্ধ তাঁহার নিকট অভিযােগ করিয়াছিল রাজস্ব বিভাগে হিন্দুকে এইরূপ বিশ্বাস করা অনুচিত। সম্রাট তাহাতে অসন্তুষ্ট হইয়া উত্তর দিয়াছিলেন তিনি শরিয়তের (ধর্মনীতির) বিধি প্রতিপালন করিয়া যােগ্য ব্যক্তিকে যােগ্য পদে নিযুক্ত করিয়াছেন। পবিত্র কোরআন-এ উক্ত হইয়াছে, যাহারা বিশ্বাসের উপযুক্ত তাহাদিগের উপরেই বিশ্বাস স্থাপন করিবে এবং ন্যায়ের উপর ভিত্তি স্থাপন করিয়া বিচারকার্য সম্পাদন করিবে।
এক একজন বাদশাহের ত্যাগের দৃষ্টান্ত পাঠ করিলে শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে শরীর রােমাঞ্চিত হয়। তাহারা অনেক সময় রাজভাণ্ডার মুক্ত করিয়া দান করিতেন। কি দীন-দুঃখী, কি অভাবগ্রস্ত কখনাে বিফল মনােরথ হত না। কোন কোন বাদশাহ প্রাচীন যুগের খলিফাগণের অনুকরণে বিলাসবর্জিত অতিসাধারণ জীবনযাত্রা করিতেন এবং কায়িক পরিশ্রম দ্বারা তাহাদের পােষ্যবর্গকে প্রতিপালন করিতেন।
বাদশাহ ফিরােজশাহ তােঘলক বহু জনহিতকর কার্যে রাজকোষ হইতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করিয়াছেন, কৃষিকার্যে সুবিধার্থে তিনি পঞ্চাশৎ জাঙ্গান, চত্বারিংশৎ মছজিদ, চত্বারিংশৎ শিক্ষালয়, শতাধিক পান্থশালা, ত্রিংশৎ তড়াগ, শতাধিক দাতব্য চিকিৎসালয়, একশত স্নানাগার এবং শতাধিক সেতু ও বহু জনহিতকর কার্য্য করিয়া ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া আছে। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তাহার কায়িক পরিশ্রম লব্ধ অর্থ দ্বারা তাহার সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করিতেন। তিনি টুপি সেলাই ও পবিত্র কোরআন শরীফ লিখিয়া তাহার শেষ জীবনে আট শত পাঁচ টাকা সঞ্চয় করিয়াছিলেন। তাহার মধ্যে মাত্র চারি টাকা আট আনা তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য রাখিয়া অবশিষ্ট সমস্ত অর্থ দীন-দুঃখীকে দান করিবার জন্য উইল করিয়া গিয়াছিলেন।…. সম্রাট বাবর তাঁহার উপাসনা বলে বিশ্বনিয়স্তাকে হৃদগত করিয়া তাহার নিজের জীবনের পরিবর্তে জীবনাধিক পুত্র হুমায়ুনের জীবন ফিরে পেয়েছিলেন। যে সমস্ত ঐতিহাসিক কি উপন্যাসিক মােছলেম বাদশাহদিগের অন্তঃপুৱে সুরার তরঙ্গ প্রবাহিত করিয়াছেন তাহাদের মিথ্যা উক্তির প্রতিবাদ করিতে আমরা ঐতিক লেনপুল প্রণীত ‘মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব’ পাঠ করিতে পাঠকবর্গকে অনুরােধ করিতেছি। সম্রাট নিজেও কখনও মদ্য স্পর্শ করেন নাই এবং আত্মীয় বন্ধুবান্ধবগণকে সুরা পান করিতে কখনও প্রশ্রয় দেন নাই। ধর্মপরায়ণ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তাহার প্রজাবর্গের ভক্তি শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতে পারিয়াছিলেন।”
অতএব নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, সম্রাট মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সচ্চরিত্রের উপর যাঁরা কলঙ্কের কালিমা লেপন করে ইতিহাসের পাতাকে দূষিত করেছেন প্রকৃত ইতিহাস তাদের ক্ষমা করতে পারে না।
শ্রীবিনয় ঘােষের লেখা ঐ সরকারি পাঠ্য ইতিহাসে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সম্বন্ধে যত বিষাক্ত কথাই থাক তবুও এটুকু দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করা হয়েছে যে,
“ভারতবর্ষ যদি ইসলামধর্মের দেশ হইত তাহা হইলে সম্রাট ঔরঙ্গজীব হয়ত ধর্মপ্রবর্তক মুহাম্মদের বরপুত্ররূপে পূজিত হইতেন। বাস্তবিক তাহার মত সচ্চরিত্র, নিষ্ঠাবান মুসলমান ইসলামের জন্মভূমিতেও দুর্লভ।”
তাতে আরাে লেখা হয়েছে—সম্রাট বলতেন, “বিশ্রাম ও বিলাসিতা রাজার জন্যে নহে।” ৪৬৫ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে,
—“বাস্তবিক বিলাসিতার অভ্যাস ঔরঙ্গজীবের একেবারেই ছিল না। বাদশাহের বিলাসিতা তাে দূরের কথা, সাধারণ ধনীর বিলাস ও স্বাচ্ছন্দ্যও তিনি ব্যক্তিগত জীবনে এড়াইয়া চলিনে। লােকে তাঁহাকে যে রাজবেশী ফকির ও ‘দরবেশ’ বলিত তাহা স্তুতি নহে, সত্য। পােশাক-পরিচ্ছদে, আহারে-বিহারে তিনি সংযমী ছিলেন, সুরা নারী বিলাস তাহাকে স্পর্শ করিতে পারে না।”
শ্রীঘােষ আরও লিখেছেন,
“ঔরঙ্গজীব বিদ্যানুরাগী তাে ছিলেনই, নিজেও বিদ্বান ও পণ্ডিত ছিলেন।” “আরবী ও ফার্সী ছাড়া তিনি তুর্কী ও হিন্দী ভাষাতেও বেশ সহজ কথাবার্তা বলিতে পারিনে। ভারতবর্ষে মুসলমান আইনগ্রন্থ প্রণয়নে ‘ফতােয়া-ই-আলমগীরী’র রচয়িতা হিসাবে তাহার কীর্তি শ্রদ্ধার সহিত স্মরণীয়।”
এমনিভাবে সম্রাটের নিজের উদর পুরণ ও উদারতার উদাহরণ স্থাপন নিজ হাতে টুপি সেলাই আর নিজ হাতে লেখা কুরআন শরীফ পরিবেশন রাজা বাদশাহের ইতিহাসে আশ্চর্যতম ঘটনা। শ্রী ঘোষের ইতিহাসে আছে—
“নিজের হাতে তিনি কোরআন’ কপি করিয়াছেন…।”
তাছাড়া ভাইদের মধ্যে আলমগীরের তুলনামূলক সেবা প্রমণেও শ্রীঘােষ তার বড়ভাই দারাশিকোর জন্য লিখেছেন-
“পিতার অত্যধিক স্নেহের ছায়ায় মানুষ হইয়া তিনি যুদ্ধবিগ্রহ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে প্রায় অনভিজ্ঞ ছিলেন বলা চলে।”
শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুজার জন্য বলেছেন,
“কর্মবিমুখতা ও আলস্য তাহার চরিত্রের প্রথম দোষ ছিল… স্থিরভাবে কোন কাজ করিবার ক্ষমতা তাঁহার ছিল না।”
আর আলমগীর বা মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের জন্য লিখেছেন-
“তৃতীয় পুত্ৰ ঔরঙ্গজীবের চরিত্র ছিল ঠিক ইহার বিপরীত। যেমন তীক্ষ্ণবুদ্ধি, তেমনি স্থিরধীর ও হিসেবী অক্ষম ও তৎপরও ছিলেন তিনি যথেষ্ট। রাজনীতির জটিলতা সম্বন্ধে তাঁহার যে অভিজ্ঞ ছিল তাহা আর কাহারও ছিল না। শাহজাহানের পরিষদরা জানিতেন যে এই তৃতীয় পুত্ৰই সিংহাসনের যােগ্যতম উত্তরাধিকারী এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে হয়ত শেষ পর্যন্ত তিনিই জয়ী হইবেন।”
চতুর্থ ও কনিষ্ঠ পুত্রের জন্য লিখেছেন,
“মুরাদ ছিলেন গুজরাটের শাসক কোন দিক দিয়া তিনি ঔরঙ্গজীবের সমকক্ষ ছিলেন না।”
এখানে পরস্পরবিরােধী উক্তির প্রতি প্রত্যেকের দৃষ্টি আকর্ষিত হওয়া স্বাভাবিক। আশ্চর্যের কথা, যে মুখে বলা হয়েছে ‘ক’ সারা জীবন বন্ধ্যা ছিলেন আবার সেই মুখেই বলা হচ্ছে ‘ক’ দুই সন্তানের মা ছিলেন। এর নাম ইতিহাস না পরিহাস। এর নাম ইতিহাস না উপন্যাস? এর উদ্দেশ্য কি ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষিত করে গড়ে তােলা না হিংস্রতার তালিম দেওয়া? সে সবের সঠিক সমীক্ষা সমাজেরই দায়িত্ব।
মুসলমানদের নিকট বড় অপরাধ হলেও তাকে হজরত মুহাম্মাদের বরপুত্র রূপে ‘পূজিত হইতেন’ বলে লিখতে দ্বিধা হয়নি আবার সেই কলমেই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে হিন্দুদের জোর করে মুসলমান করে হাতির পিঠে চাপিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে শােভাযাত্রা বের করতেন। অথচ সকলেই স্বীকার করেন যে, হজরত মুহাম্মাদ ভােগবিলাসের জন্য বাজনা একেবারে নিষিদ্ধ করেছে। আলমগীরও মুসলমানদের মধ্যে বাজনা গীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। অতএব ব্যান্ড বাজিয়ে কি করে বরপুত্রের দ্বারা নব দীক্ষিত মুসলমানদের নিয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় মিছিল বের হতে পারে?
ইসলাম ধর্মে শাস্তিবিধান আছে নরহত্যার বদলে প্রাণদণ্ড – প্রাণদণ্ড বলতে শিরচ্ছেদ, ব্যভিচারের প্রমাণে প্রাণদণ্ড, চুরির জন্য হস্তকর্তন ও মদ্যপানের জন্য চাবুক প্রয়ােগ প্রভৃতি। হজরত মুহাম্মাদ এর আইনে বা তার সামগ্রিক জীবনে কাউকে শূলে চড়িয়ে, না খেতে দিয়ে, বিষ প্রয়ে করে অথবা কোন ভারী বস্তুর চাপ দিয়ে শাস্তি দেওয়ার নিয়ম ছিল না বা আজও নেই। অতএব জিজিয়া করের প্রতিবাদে হিন্দু জনতার উপর হাতি চালিয়ে দেবার হুকুম দিতে পারেন কি করে মুহাম্মদের (স) ‘বরপুত্র’?
অনেকের ধারণা এই প্রকার ঐতিহাসিকতা শুধুমাত্র মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের চরিত্রকে কলঙ্কিত করার অপকৌশলই নয় বরং হজরত মুহাম্মাদ সম্বন্ধেও কুৎসিত ধারণা জন্মিয়ে দিয়ে শিক্ষিত সমাজকে ইসলাম-বিমুখ করে দেবার এক উৎকট প্রচেষ্টা এবং জঘন্য ষড়যন্ত্র। অতএব হজরত মুহাম্মাদের ভক্ত সারা বিশ্বমুসলিম এরূপ চক্রান্তপূর্ণ ইতিহাস ও ঐতিহাসিকতাকে ক্ষমা করতে পারে না।
অবশ্য আকবরের জিজিয়া প্রথার বিলােপ সাধন আর মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের জিজিয়া করের পুনঃপ্রচলন কথাটুকু সত্য হলেও জিজিয়া কাদের জন্য, কতটুকু পরিমাণে নেওয়া হােত তার আলােচনা কিছু পরেই করা হবে।।
ঐতিহাসিক শ্রীঘােষ ইতিহাসের পাতায় লিখেছেন, “ঔরঙ্গজীব কেবল ‘আলমগীর’ নহেন, ‘জিন্দাপীরও।” আবার সেখানেই লিখেছেন,
“সাৎমীরা জাদুমন্ত্র জানে মনে করিয়া তিনি নিজের হাতে বাণী লিখিয়া জাদুমূর্তি আঁকিয়া দিলেন মােগল সৈন্যদের পতাকাতে আঁটিয়া দিবার জন্য।”
আলমগীর যদি হজরত মুহাম্মদ-এর একনিষ্ঠ ভক্তই হলেন অর্থাৎ শ্রীঘােষের উক্তিতে তিনি যদি মুহাম্মাদের বরপুত্রই হলেন এবং ইসলাম ধর্মের অনুসরণকারীই হলেন তাহলে তিনি জাদু করলেন কী রূপে? ইসলাম কি জাদু করা একেবারেই হারাম বা অবৈধ নয়? তাছাড়া জাদুরূপী কোন নর নারীমূর্তি অথবা কোন জীবজন্তুর ছবি অঙ্কন ইসলামধর্মে নিষিদ্ধ। সুতরাং জাদুর প্রয়োগ এবং মূর্তি অঞ্চন—এ অপবাদ দুটি যৌক্তিক না অযৌক্তিক, মিথ্যা না সত্য তার উত্তর দেবে নূতন সমাজ, নূতন শতাব্দী।
এমনিভাবে ‘মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব’কে বাংলায় লেখা হয়েছে ‘ঔরঙ্গজীব’; ‘জীব’ মানে জন্তু। হয়তাে ‘ঔরঙ্গজীব’ বলেই অনেকে শান্তি পেয়েছেন বা পান, তাই শান্তির ধারা সারা ভারতে ছড়াবার জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু আরবী, উর্দু ও ইংরেজী ইতিহাস হতে বাংলায় অনুবাদ করতে হলে ‘ঔরঙ্গজীব’ হতে পারে না বরং ‘মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব’ হওয়াই উচিত ছিল। কিছু দিন পূর্বেও শত-সহস্র বাংলা পুস্তকে ‘মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব’ই লেখা হােত, কিন্তু কালের চক্রে চারিত্রিক উন্নতি বিকাশের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলমান অনেক লেখকই ‘ঔরঙ্গজীব’ লিখতে শুরু করেছেন।
এছাড়াও তার উপর যে সমস্ত মারাত্মক অভিযােগ আরােপিত তা নিয়ে এবার একটু বিস্তৃত আলােচনা করা যাক।
[১] তিনি কাউকে বিশ্বাস করে না,
[২] তিনি হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন তাই হিন্দু কর্মচারিদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন,
[৩] হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করেছিলেন,
[৪] বৃদ্ধ পিতাকে বন্দী ও ভাইদের হত্যা করেছিলেন,
[৫] কেবল হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর চাপিয়েছিলেন ও
[৬] তাঁর অযােগ্যতাই মােগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ—সেই জন্য ইতিহাসে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব চরমভাবে কলঙ্কিত। এ সমস্তর উত্তরে কিছু বলা যায় বা লেখা যায় নয়, বরং প্রত্যেকটি বিষয়ের উপর সূবিস্তৃত আলােচনা করলে এক একটি ইতিহাস লেখা যায়। কিন্তু তা বাহুল্য মনে করে, সমাজের চিন্তাধারার গতি পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রামাণ্য ইতিহাসের উদ্ধৃতি ও তথ্য সংক্ষেপে পরিবেশিত হল।
[১] ‘তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না’—এ কথাই যদি সত্যি হয় তাহলে তিনি কখনই বা এত নামাজ পড়তেন, কখনই বা টুপি সেলাই করতেন, কখনই বা কুরআন নকল করতে আর কখনই বা তিনি রাত্রে এত উপাসনা করতেন আর কি করেই বা আর অপেক্ষা বিরাট বিচিত্রময় ভারতবর্ষ শাসন করতেন ও সামলাতেন? যদি তিনি কাউকে বিশ্বাসই না করতেন তবে নিশ্চয়ই সকলেই তার উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন; আর অসন্তুষ্ট কর্মচারি ও চাকরদের নিয়ে ধমকে ধমকে কিছুদিন বা কয়েক মাস অথবা কোন প্রকারে কয়েকটা বছর গোঁজামিল দিয়ে কাটানাে যেতে পারে, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, তিনি পাঁচ দশ বছর নয় অর্ধ শতাব্দীকাল বা পঞ্চাশটি বছর রাজত্ব করেছেন। এর দ্বারা কি প্রমাণ হয় না যে, রাজকর্মচারিরা তার উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন না, অর্থাৎ তিনি সকলকে অবিশ্বাস করতেন না।
যশােবন্ত সিংহ একবার নয় কয়েক বার বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তবুও দয়ালু সম্রাট তাকে প্রত্যেকবার ক্ষমা করেছিলেন। যদিও যশােবন্ত সিংহ মুসলমানছিলেন না, শুধু ক্ষমা নয়, উদারতার দৃষ্টান্ত স্থাপনে তাকে কলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করতেও দ্বিধা করেন নি।
মারাঠা নেতা শিবাজী শুধু অমুসলমানই ছিলেন না রাষ্ট্রদ্রোহীও ছিলেন। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাকে তিনি বিশ্বাস করে পাঠিয়েছিলেন তিনি ছিলেন একজন অমুসলমান—জয়সিংহ। তাছাড়া শিবাজী যখন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে ক্ষমা চাইলেন বা আত্মসমর্পণ করলেন তখন তিনি তাকে ক্ষমা করলেন। ইচ্ছা করলে তিনি রােষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে অথবা মােগল সৈন্যদের রাতের অন্ধকারে এবং অতর্কিত আক্রমন অগ্নিসংযােগে হত্যার অপরাধে প্রাণদণ্ড দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে পরম ও চরম শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়েও তাকে ক্ষমা করে মহানুভব বাদশাহ ক্ষমাধর্মের অত্যুজ্জ্বল আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। শিবাজীকে একবার নয় কয়েকবার বন্দী করেছিলেন ও ছেড়ে দিয়েছিলেন। অবশেষে তাকে কারারুদ্ধ করেন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, শিবাজীর দেখাশুনার ভার দিয়েছিলেন ঐ জয়সিংহেরই উপর। যখন তিনি তার ধর্মের দোহাই দিয়ে মিষ্টান্ন পাঠাবার অনুমতি চাইলেন, সম্রাট তাও দিলেন। আজ বিশ্বে কোন এমন রাষ্ট্র আছে কি যেখানে জেলখানায় কয়েদীকে আত্মীয়দের মিষ্টি পাঠাবার অনুমতি দেওয়া হয়? তাও এক এক ঝুড়িতে দু এক মণ করে মিষ্টি!—এক কিলাে দু কিলাে মিষ্টির ঝুড়িতে ঢুকে পলায়ন নিশ্চয়ই সম্ভব ছিল না। শিবাজীর পলায়নের পর জয়সিংহকে সন্দেহ করাই স্বাভাবিক ছিল, যেহেতু তার রক্ষণাবেক্ষণ সত্ত্বেও শিবাজীর পলায়ন সম্ভব হয়েছিল। তাই আজ অনেকেই মনে করেন, জয়সিংহের সঙ্গে শিবাজীর গুপ্ত যােগাযােগ ছিল। বাইরে যুদ্ধ যা হয়েছে সেটা বাহ্যিক, ভিতরে ভিতরে যুক্তি ও চুক্তি ছিল অন্য রকম। সে যাইহােক। সম্রাট আলমগীর নিশ্চয় সন্দেহ করতে পারতেন, কেননা শিবাজী ও জয়সিংহ উভয়েই ছিলেন অমুসলমান বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, কিন্তু তা তাে তিনি করেন নি? তাহলে কোন অধিকারে বলা যায় ‘সম্রাট কাউকে বিশ্বাস করতেন না?’
[২] তিনি হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন কি না তার উত্তর প্রথম নম্বরেই বেশ কিছুটা অনুমেয়। তবুও আজ আমরা ঐতিহাসিকদের কৃপায় জানতে পারছি তিনি নাকি হিন্দু কর্মচারিদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের স্থানে মুসলমান কর্মচারি নিয়োগ করেছিলেন। এইসব কথাগুলাের অসত্যতা প্রমাণ করবার প্রয়ােজন নেই, শুধু পাশাপাশি সত্যের আলােকবর্তিকা আনলেই মিথ্যার অন্ধকার নিমেষে বিদূরিত হবে।
মুসলমান বিদ্বেষী কোন রাজা যেমন মসুলমান মন্ত্রী বা সেনাপতি রাখতে পারেন না, তেমনি হিন্দু বিদ্বেষী কোন মুসলমান সম্রাটের পক্ষেও হিন্দু সেনাপতি নিয়োেগ সম্ভব নয়। কেননা তাতে সেনাপতির দ্বারা সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা সততই লগে থাকবে। কিন্তু মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তার সেনাপতি পদে বরণ করেছিলেন অমুসলমান জয়সিংহ এবং যশােবন্ত সিংহকে। শুধু তাই নয় রাজা ভীম সিং, যিনি উদয়পুরের মহারাজা রাজসিংহের পুত্র ছিলেন, তিনিও আলমগীরের উচ্চমানের সামরিক কর্তা ছিলেন। তার অধীনে পাঁচ হাজার সৈন্য ছিল। ইন্দ্ৰসিংহের মর্যাদাও মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে অল্প ছিল না।
দেশদ্রোহী শিবাজীর আপন জামাতা অচলাজী পাঁচ হাজারী পদে অধিকারী ছিলেন, অর্থাৎ পাঁচ হাজার সৈন্য তার আদেশের প্রতীক্ষায় থাকতাে। আর্জুজী, ইনিও শিবাজীর আত্মীয় ছিলেন। তাকে দুই হাজারী পদে নিয়ােগ করা হয়েছিল। এখন যদি আধুনিক ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, শিবাজীর মত সামান্য একজন সৈনিককে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অঙ্গুলি হেলনেই নিঃশেষ করা যেত, তাই তিনি এত লােককে এত বেশি বিশ্বাস করতেন, এমনকি বিধর্মী এবং শত্রুর আত্মীয় স্বজনের হাতেও এত ক্ষমতা দিয়েছিলেন আর সেই জন্যই তাঁদের স্নেহ, মমতা ও স্বজাতিপ্রীতির পরিপ্রেক্ষিতে আওঙ্গজেবকে কষ্ট পেতে হয়েছে, তাহলে আসল ইতিহাসটাই বাদ পড়ে যাবে। আসল কথা হচ্ছে এই যে, আলমগীর নিজে ছিলেন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী তাই তিনি কাউকে বিনা প্রমাণে সন্দেহ করাকে কল্পনা করতেও পারতেন না। কিন্তু ধন্য আমাদের ঐতিহাসিকতা! আমরা আসল ইতিহাসটাকে হজম করে উল্টে লিখেছি—তিনি কাহাকেও বিশ্বাস করিতেন না, হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন ইত্যাদি।
[৩] তিনি হিন্দু দেবালয় বা মন্দির ধ্বংস করেছিলেন বলে যে অপবাদটি নিরপরাধ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তা যদি সত্য হয় তাহলে বলতে হয়, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব নিশ্চয় ইসলাম ধর্মের আইন মানতেন না। অথচ সমস্ত ইতিহাসে শত্রু ও মিত্র ঐতিহাসিকগণ স্বীকার করেছেন যে তিনি কুরআনের নীতি বর্ণে বর্ণে মেনে চলতেন। তাহলে দুটি কথার মধ্যে মিল হচ্ছে কোথায়? আসলে অনেক জায়গায় লেখকের লেখায় এমন ফাঁক থেকে গেছে যে তাতে ব্যাপারটা মিথ্যা প্রমাণ করতে কোন অসুবিধাই হয় না।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পক্ষে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা কোন মতেই সম্ভব ছিল না। কারণ তার আদর্শের উৎস ঐ কুরআনেই আছে—ধর্মে জবরদস্তি নেই। আবার অন্যত্র হজরত মুহাম্মাদকে বলতে বলা হয়েছে- ‘হে অমুসলমানগণ, তােমরা যার উপাসনা কর আমরা তার উপাসনা করি না…. তােমাদের জন্য তােমাদের ধর্ম আর আমাদের জন্য আমাদের ধর্ম।’ তাছাড়া হজরত মুহাম্মাদ কোন মন্দির ভেঙ্গেছিলেন বা ভাঙ্গিয়েছিলেন এ কথা আজ পর্যন্ত কেউই প্রমাণ করতে পারেন নি, পারা সম্ভবও নয়। অতএব এখানেও সেই একই প্রশ্ন হজরত মুহাম্মাদের বরপুত্রের পক্ষে মন্দির ধ্বংস করা কি করে সম্ভব হােল?
বড়ই পরিতাপের বিষয়, আমাদের ভারতবর্ষের এই বঙ্গদেশেই কয়েক বছর আগে স্কুলের পাঠ্য ইতিহাসে অনেক কিছু সত্য তথ্যের সন্ধান পাওয়া যেত। প্রমাণ স্বরূপ ১৯৪৬ সালের পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্য পুস্তক, হিন্দুস্থান প্রেস ১০, রমেশ দত্ত স্ট্রীট, কলিকাতা হতে মুদ্রিত ইতিহাস পরিচয় হতে কিছুটা অংশ তুলে ধরছি-
“জোর করিয়া মন্দির ভাঙ্গিয়া মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্যেই যদি সম্রাট আওরঙ্গজেবের থাকিত, তবে ভারতে কোন হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্বই বােধহয় আজ দেখা যাইত না। সেইরূপ করা ত দূরের কথা, বরং রেনারস, কাশ্মীর ও অন্যান্য স্থানের বহু হিন্দুমন্দির এবং তৎসংলগ্ন দেবােত্তর ও ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব, নিজের হাতে দান করিয়া গিয়াছে; সে সকল ‘সনদ’ আজ পর্যন্ত বিদ্যমান।”
স্কুলের ঐ পাঠ্য পুস্তকের ১৩৮ পৃষ্ঠায় আরও লেখা আছে,
“সম্রাট আওরঙ্গজেবের সুদীর্ঘ ৫০ বৎসর রাজত্বের মধ্যে এমন কোন প্রমাণ কেহ দেখাইতে পারেন নাই- যে তিনি কোথাও কোন হিন্দুকে জোর করিয়া মুসলমান করিয়াছেন বা তাহার ধর্মে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন। এমনকি, শিবাজীর পৌত্র শাহুকে তিনি আট বৎসর কাল মােগল দুর্গে বন্দী করে রেখেও কোনদিন তাকে ‘মুসলমান’ করেন নাই; হিন্দু বেশেই মারাঠাদিগের মধ্যে ফিরিয়া গিয়াছিলেন।”
ঐ পুস্তকে আরাে লেখা আছে,
“মুসলমানদিগের বিরুদ্ধে হিন্দুদিগকে উত্তেজিত করিবার জন্য যে সমস্ত মন্দিরে ব্রাহ্মণগণ প্রচারকার্য চালাইয়াছিলেন, কেবলমাত্র সেইগুলােই মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ধ্বংস করিতে আদেশ দিয়াছিল মন্দির-তলে সমবেত হইয়া বিদ্রোহের বড়যন্ত্র করিলে দেবতার আশীর্বাদ লাভ করা যাইবে, এই প্রলােভন দেখাইয়া কুচক্রীগণ কোন কোন মন্দিরকে রাজনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত করিয়াছিল। কাজেই তাহাদের ধ্বংসের প্রয়ােজন হইয়াছিল।”
কিন্তু আজকের স্কুল কলেজের ইতিহাসের ধারা সম্পূর্ণ বিকৃত। শ্রীঘােষের উদ্ধৃতি দিয়ে সেই বিকৃতির ধারা প্রমাণ করা কঠিন নয়।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, শ্রীঘােষের ঐ ‘ভারতজনের ইতিহাস’ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ কর্তৃক নবম, দশম ও একাদশ শ্রেণীর জন্য ১৯৬২ সালে লেখা, আর পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর জন্য ঐ ‘ইতিহাস পবিচয়’ বইখানি ১৯৪৬ সালে লেখা। মাত্র ষােল বছরের মধ্যেই আমাদের ঐতিহাসিকতার এত উন্নতি অথবা এত অবনতি!
যাইহােক, সত্য সিদ্ধান্তে এটাই গ্রহণযােগ্য যে, বিধর্মী বা হিন্দুদের ধর্মে হস্তক্ষেপ অথবা মন্দির ধ্বংস আওবঙ্গজেবের নীতি ছিল না। তবে কিছু মন্দির তার সময়ে ভাঙ্গা গিয়েছিল, অবশ্য তার পশ্চাতে কিছু কারণও ছিল। প্রথমতঃ মন্দিরগুলাে রাজনৈতিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল যেটা পূর্ব আলােচনাতেই উদ্ধৃতি সহ প্রমাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ আকবরের সময়ে অনেক মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির তৈরি করা হয়েছিল এবং অনেক মসজিদকে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেও মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। যেমন—‘মুনতাখাবুত্তাওয়ারিখ’ ও ‘মাকতুবাতে ইমামে রব্বানী’ নামক দুটি গ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদ হতে যথাক্রমে পাওয়া যায়—
“Mosques and prayer-rooms were changed into store rooms and into Hindu guard rooms.”
“A number of mosques were destroyed by Hindus and temples erected in their place.”
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে সৎনামী দল নামে হিন্দুদের এক দুর্ধর্ষ সন্ন্যাসী দল বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। অনেক বাদশাহী সৈন্য তাদের দ্বারা নিহত হয়, অনেক মসজিদও তারা ধ্বংস করে। এই দলের নায়করা প্রচার করত যে, যারা তাদের সঙ্গে যােগ দিয়ে যুদ্ধ করবে তারা মরবে না, আর যদি ভাগ্যচক্রে মরেই যায় তবে এক একজনের রক্তে আশি জন করে লােক তৈরি হবে। তাদের পােশাক পরিচ্ছদ ছিল অসভ্য ও অদ্ভুত ধরণের। দাড়ি গোঁফ এমনকি চোখের ভ্রু পর্যন্ত মুণ্ডিত থাকত, তাই তাদের আর এক নাম ছিল ‘মুণ্ডিয়’। এদের পরিচয় শীঘােষের লেখা ইতিহাসেও কিছু পাওয়া গেছে—
“দিল্লি হইতে প্রায় ৭৫ মাইল দূরে নারনােল জেলায় সৎনামী সম্প্রদায়ের বড় ঘাঁটি ছিল। … যদি কোন বীর সৎনামীর মৃত্যু তাহা হইলে তাহার রক্ত হইতে আরও আশীজন বীরের উৎপত্তি হইবে। দেখিতে দৈখিতে প্রায় ৫০০০ (পাঁচ হাজার) সৎনামী অস্ত্রশস্ত্র লইয়া প্রস্তুত হইল। স্থানীয় রাজকর্মচারীরা যুদ্ধ করিতে গিয়া পরাজিত হইলেন। নারনােলের ফৌজদারকেও বহু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করিতে হইল, শহরও সৎনামীরা দখল করিয়া লুটতরাজ করিল, মসজিদ ধ্বংস করিল, এমনকি নিজেরা শাসনব্যবস্থাও চালু করিয়া ফেলিল।” [ভারতজনের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৪৪৭]।
অতএব নিরুপায় মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব কয়েক হাজার সৈন্য পাঠিয়ে তাদের রক্তে ৮০ জন করে বীর তৈরি হওয়ার ধোকাপ্রদ, অপপ্রচারকেমিথ্যা সাব্যস্ত করেন এবং তাদেরই নির্বিবাদ অত্যাচারে ধ্বংস হওয়া মসজিদগুলাে পুনঃনির্মাণ করেন ও তাদের প্রবর্তিত নূতন শাসন ব্যবস্থারও অবসান ঘটান। আজ ঐ রাজদ্রোহীদল সৎনামীদের উপর কোন অত্যাচার, অনাচার নিরপেক্ষ মানুষদের কাছে নিন্দনীয় হওয়া উচিত নয় অথচ শ্রীঘােষের ইতিহাসে লেখা হয়েছে,
“মােগল সৈন্যদের বিরুদ্ধে সৎনামীরাও বীরের মতাে যুদ্ধ করিয়া হাজারে হাজারে নিহত হইল।”
তাছাড়া যারা স্বেচ্ছায় মুসলমান হয়েছিলো তারা অনেকে কার্যসিদ্ধির এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রাক্তন ধর্মের উপর কত বিরাগী এবং নূতন ধর্মে কত আস্থাশীল তা প্রমাণের জন্য কিছু মন্দিরেরও ক্ষতি সাধন করেছিলেন। যেমন উত্তরবঙ্গের নব-মুসলমান রাজা যদুর গোঁড়ামির কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু মহানুভব সম্রাট সেগুলাের সংস্কার সাধন করে যে উদারতার পরিচয় দেখিয়েছে তা আজকের বাজারের ইতিহাসে দারুণভাবে দুর্লভ বলা যায়।
[৪] মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রতি আর এক অপবাদ আরােপ করা হয়েছে—তিনি বৃদ্ধ পিতাকে বন্দী ও ভাইদের হত্যা করেছিলেন।
পিতাকে বন্দী করা নিঃসন্দেহে দোষণীয়। কিন্তু বন্দী কাকে বলে, তার স্বরূপ কী, বন্দী কেন করা হয় এবং তার উদ্দেশ্যই বা কী ইত্যাদি বিষয়গুলাে গভীরভাবে পর্যালােচনা করা দরকার, নচেৎ আমরাও বন্দী শাহজাহানকে ও ‘মহানুভব’ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে সঠিকভাবে চিনতে পারব না।
বীরত্ব প্রকাশের অভিলাষে শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বিকে শৃঙ্খলিত করে কারারুদ্ধ করার নাম বন্দী। বন্দী সাধারণত নানা কষ্টের মধ্যে উপলব্ধি করে তার পরাজয় ও বিজয়ীর জয়ের দাপট। বন্দীদের খাওয়া-শােয়ার সুব্যবস্থার পরিবর্তে থাকে অব্যবস্থা। কিন্তু শাহজাহান বন্দী ছিলেন কোথায়? তেপান্তরের মাঠেও নয়, আর অন্ধকুপ বা বদ্ধকক্ষেও নয়, বরং সেই সুরক্ষিত সুসজ্জিত অট্টালিকায় যেটা ছিল আকবর হুমায়ুন, জাহাঙ্গীর, মমতাজ প্রভৃতি খ্যাতনামা সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীদের আরামকক্ষ, কর্মক্ষেত্র ও গার্হস্থক্ষেত্র। যেখানে ছিল শাহী পালঙ্ক, ইয়েমেনী চাদরে ঢাকা শাহী কোমল পালকের গদি। যেখানে তার খাওয়া-দাওয়া সেবা-শুশ্রুষা করার জন্য ২৪ ঘন্টা ভৃত্যেরা প্রস্তুত থাকত। শাহজাহানের পিতা জাহাঙ্গীর নেই, স্নেহময়ী মাতাও নেই আর স্ত্রী মমতাজ তাে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন তাজমহলের নীচে; তারা বেঁচে থাকলে হয়ত তারাও থাকতেন ঐতিহাসিক পরিবেশে। আছে শুধু তার অত্যন্ত স্নেহু-ধন্যা কন্যা আর আত্মীয়স্বজন। প্রায় সমস্ত আত্মীয় স্বজনই শাহজাহানের সঙ্গে ইচ্ছা সাক্ষাৎ করতে পারতেন। আর তার মেহসিঞ্চিতা মেয়ে রৌশনআরা অত্যন্ত প্রয়ােজন ছাড়া প্রতি মুহূর্ত পিতার সেবায় নিয়ােজিত থাকতেন। শুধু তাই নয়, আরও উল্লেখযােগই ঘটনা হােল, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সারা দিনে রাত্রে অন্ততঃ একবারও রাজকার্য ছেড়ে স্বহস্তে পিতার পদসেবা করতেন—এই হােল মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অত্যাচার আর শাহজাহানের বন্দীত্ব।
তাঁর এই ঐতিহাসিক বিশ্রামের অনেক কারণের মধ্যে একটি হােল—শাহজাহানের জন্য যখন চারিদিকে রব উঠে যায় শাহজাহান পরলোকগমন করেছেন তখন পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। সবশেষে যখন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের জয় হােল তখন দেখা গেল শাহজাহান মৃত নন, মৃত্যুর হাত হতে ভগ্নদেহ নিয়ে তিনি প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। ঐ অবস্থায় তার সম্পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু তখন তিনি বিশ্রাম না করে অন্ধ স্নেহে বড় ছেলে দারাশিকোকে সিংহাসন দিতে মনস্থ করেন এবং বহু সমস্যার সম্মুখীন হন, যেমন বেশির ভাগ হিন্দু প্রজা দারাকে আর মুসলমানেরা চায় মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে। তবুও তিনি গভীর চিন্তাসহ সমাধানের পথ খুঁজতে যাচ্ছিলেন যা ছিল রাজনীতির নামান্তর। ঐ অবস্থায় তাকে রাজনীতি করতে দেওয়ার অর্থ জোর করে মৃত্যুপথে নিক্ষেপ করা। অতএব সেক্ষেত্রে পিতার পৃথক অবস্থান আধুনিক বিচক্ষণ ঐতিহাসিকদের মতে অনুপযুক্ত কর্ম ছিল না, বরং তা ছিল বিচক্ষণ সন্তানের উপযুক্ত পিতৃসেবা।
শাহজাহানের সঙ্গে সকলে সাক্ষাৎ করতে পেলেও বিশ্রামে বিঘ্ন যাতে না ঘটে সেজন্য তার রাজপ্রাসাদের বাইরে যাওয়া নিষেধ ছিল। তাই একদিন তিনি আলমগীরকে ডেকে বললেন, ‘আলমগীর! তােমার মত হাফেজ সন্তানের নিকট আমি কি বন্দী?’ উত্তরে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বলেছিলেন, ‘আপনি সারা জীবন রাজনীতি করে অন্তরের প্রকৃত শান্তি কি পয়েছেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘কোনও দিন পাইনি আর আজও পাচ্ছি না, তার উপর মমতাজও নেই।’ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তখন বললেন, ‘আল্লাহ তার পবিত্র কুরআন-এ জানিয়েছেন, অন্তরের শান্তি আল্লাহর স্মরণেই সম্ভব। অতএব আমি চাই না, আপনি এই বৃদ্ধ বয়সে অশাস্তির রাজনীতি করুন। আপনার উপাসনা, আরাধনা আর আল্লাহর স্মরণের জন্যই এই পূর্ণ বিশ্রামের ব্যবস্থা।’ শাহজাহানের কণ্ঠস্বর আরও কর্কশ হয়ে উঠলাে। তিনি বললেন, ‘তাহলে আমার প্রিয়া, তােমার মা মমতাজের স্মৃতিসৌধ তাজমহলও কি আমার ইচ্ছামত দেখতে পাব না?’ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব উত্তরে খুব বিনম্রভাবে নিবেদন করেছিলেন—-‘আব্বাজান, সত্যই কি আপনার তাজমহল দেখার সাধ, নাকি তাজমহল দেখার নামে অন্য কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে?’ শাহজাহান অপ্লুত নয়নে বলেছিলেন, ‘যেমন করে তােক আমাকে অন্ততঃ একবার করে প্রতিদিন তােমার মায়ের স্মৃতিসৌধটা দেখতে দাও, আমার আর কিছুর প্রয়ােজন নেই!’ উত্তরে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বলেছিলেন, ‘যদি এখানে আপনার শয়নকক্ষের মধ্যে থেকেই আপনার ইচ্ছামত তাজমহল দেখতে পান তাহলেও আপনাকে বাইরে যেতে হবে?’ শাহজাহান বলেছিলেন, ‘বৎস, বাইরে যাওয়া উদ্দেশ্য নয়, শুধু চোখে দেখতে চাই তাজমহল।’ তখন টেলিভিশন ছিল না, তাই শাহজাহানের ধারণা ছিল বাইরে না গিয়ে। তাজমহল দেখা অসম্ভব। কিন্তু মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব পৃথিবীর এক মুল্যবান মণি নিয়ে বিজ্ঞানময় কৌশলে দেওয়ালের সঙ্গে এমনভাবে তা সংযুক্ত করিয়ে দিলেন যে, হাত দৃষ্টি দিলে দূরের তাজমহল স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যেত। এখন অবশ্য ইংরেজ সেটা খুলে নিয়ে চলে গেছে। অবশ্য নকল যে পাথরটি লাগিয়েছে তাতেও তাজমহল মােটামুটি দৃষ্ট হয়।
অনেকের কাছে আসল সত্য আরও উহ্য হয়ে আছে। যেমন শাহজাহান ভয়াবহ মৃত্যুপীড়া হতে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন বটে কিন্তু সমাজের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে তার বিশুদ্ধ বিবেক ও জ্ঞান প্রায় নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল। কারও মতে মমতাজের গর্ভ হতে গর্ভস্থ শিশুর কান্নার শব্দ শােনা গিয়েছিল বলে তার মৃত্যু হয়েছিল। আবার কেউ বলেন, ওটা গর্ভস্থশিশুর কান্না নয়, পেটের পীড়াজনিত। সে যাইহােক, সমস্ত চিকিৎসক ও সাধারণের কাছে ওটা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
মমতাজের মৃত্যুর পর শাহজাহান শিশুর মত কেঁদে বলেছিলেন, হে আল্লাহ আমার অর্থবল, জনবল, মনােবল সবকিছুর বিনিময়েও মমতাজকে ফেরাবার কোন উপায় নেই। কারণ তােমার শক্তির সামনে আমাদের অস্তিত্ব কত অসার, কত অকেজো। তাই প্রিয়তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য সে যুগে বিশ কোটি বার লক্ষ টাকা ব্যয়ে বাইশ বছর ধরে বহু লােকের পরিশ্রমে পৃথিবীর সপ্তাম আশ্চর্য তাজমহল তৈরি হয়েছিল। এর ফলে রাজকোষ প্রায় অর্থশূন্য হয়ে পড়লেও তাতে বৃদ্ধ শাহজাহান মানসিক অসুস্থতা হেতু শান্তি পাননি। তুষার শুভ্র আকাশ ছোঁয়া তাজমহল যথেষ্ট নয় ভেবে আর একটি ভ্রমর কালাে কৃষ্ণ পাথরের তাজমহল তৈরি করার ইচ্ছা করলেন। তার ভিতরে থাকবে পান্না, হীরা, চুণী, পদ্মরাগ, মণি প্রভৃতি অমূল্য ধাতুর অদ্ভুত সংস্থাপন, আর শুভ্র ও কৃষ্ণ তাজমহলের মাটির নিচে দিয়ে থাকবে সংযােগ রাস্তা। শাহজাহান বিশেষ কোন প্রস্তুতি এবং পরামর্শ না করেই কাজ শুরু করেছিলেন বলে কিছু ঐতিহাসিক মন্তব্য করেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বুঝেছিলেন, আবার যদি দ্বিতীয় তাজমহল সৃষ্টি হয় তাহলে দিল্লির রাজ দরবার অর্থনৈতিক পতনের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হবে। তার উপর শাহজাহান পুত্রদের কলহ বিবাদের কারণে ও মমতাজের মৃত্যুর শােকের প্রভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে প্রতি মুহূর্তে মত পরিবর্তন করতে এবং ভুলক্রমে বহু অপ্রয়ােজনীয় বিষয়ের উপর অনুমতি এবং প্রয়ােজনীয় বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিতে দ্বিধা করতেন না। তার অন্যতম কারণ ছিল, শারীরিক ও মানসিক দৌর্বল্যের জন্য তিনি তদন্ত বা সমীক্ষার পরিবর্তে সংবাদদাতা যা প্রথমে শােনাতেন তাই তার মনে বদ্ধমূল হয়ে যেত। তারপর তা মুছে ফেলা এবং আসল কথা বােধগম্য কানাে বেশ কষ্টকর ছিল।
শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শাহজাহানকে নিজের পতার প্রতি আনুগত্য এবং সারা ভারতে তার কত জনপ্রিয়তা ও মনপ্রিয়তা আছে তা বার বার তুলে ধরে পিতার দৃষ্টি আকর্ষণ করনে, অথচ গােটা ভারতবর্ষের মুসলিম জাতি বিশেষ করে মুসলমান মন্ত্রী সেনাপতি এবং উচ্চ পদস্থ ও নিম্নপদস্থ কর্মচারিদের দারার প্রতি দারুণ অনাস্থা আর অবিশ্বাস ছিল, যেহেতু তিনি তাদের কাছে ধর্মত্যাগী বলে বিবেচিত হতেন। সুতরাং সে অবস্থায় দারাকে সিংহাসন দিলেই বিদ্রোহের দাবানল হু হু করে জ্বলে উঠতাে। সারা দেশে একাধিক বিদ্রোহ দমন করা সহজ, কিন্তু নিজের দরবারের বিদ্রোহ দমন করা মােটেই সহজসাধ্য ব্যাপার নয়, বরং অসাধ্য। অতএব নানা দিক দিয়ে চিন্তা করে দেখলে এই সিদ্ধান্তই গ্রহণ কতে হয় যে, যদি শাহজাহানের বন্দী মার্কা বিশ্রামের ব্যবস্থা না করা হােত তাহলে অবস্থা হােত অত্যন্ত বিপজ্জনক ও লােমহর্ষক। তাই বিচক্ষণ ইতিহাস বিজ্ঞানীদের মতে শাহজাহানকে আরাম কক্ষে আটকে রক্তনদীর গতিকে স্তব্ধ করা হয়েছে।
বিশ্রামের পূর্বে শাহজাহান এক দুঃসাহসিক কুৎসিত পদক্ষেপ নিতে গিয়েছিলেন যা তার খ্যাতি ও যশের মৃত্যু ঘটাতে যদি তিনি অসুস্থ, অতিবৃদ্ধ এবং স্ত্রীর বিয়ােগ ব্যথায় মস্তিষ্ক বিকৃত রােগী বলে গণ্য না হতেন। সেই ঘটনা সত্যের খাতিরে উল্লেখ করা প্রয়ােজন : মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব যখন দিল্লি থেকে দূরে ছিলো তখন তার পুত্র মুহম্মাদকে সিংহাসন দেবার লােভ দেখিয়ে সেই কিশােরকে বিদ্রোহী করতে চরম চেষ্টা করেছিলেন শাহজাহান। কিন্তু শাহজাহানের ঐ চক্রান্ত সফল হয় নি। তাই অন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হােল-মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সুনাম ও সদ্গুণাবলীর কারণে দেশ-বিদেশে ঘরে বাইরে তিনি ‘ফকির’, জিন্দাপীর, দরবেশ, ‘আলমগীর’ এবং মহীউদ্দিন প্রভৃতি বহু নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা ছিল বজ্রের মত, বিশেষত নারীর প্রতি আকর্ষণ হেতু তিনি কোনও দিন দুর্বল ছিলেন না। তাই দারা এবং তার সমর্থকদের পরামর্শে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হােল। তবে পরামর্শদাতারা এটা বুঝেছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নূতন অগ্নি বিপ্লব ও বিদ্রোহ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তাই তারা ঠিক করেছিলেন যে, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে রাজপ্রাসাদে বা হেরেমে আসতে হলা হবে। তার আসার সাথে সাথেই দুর্ধর্ষা তাতার যুবতীরা তাকে জোর করে মদ্যপান করানাের চেষ্টা করে সকলে মিলে হত্যা করবে। পরে রটিয়ে দেওয়া হবে তিনি বাইরে মদ্যপান এবং ব্যভিচারের কপট বিরােধী ছিলেন বটে কিন্তু হেরেমে তিনি স্বয়ং তা পান করে উম্মত্ত হয়ে তাতার রমণীদের ব্যভিচারে বাধ্য করাতে গিয়ে নিহত হন। এর ফলে প্রমাণ হবে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে যদিও হত্যা করা হয়েছে, ঠিকই হয়েছে। হয়ত কেউ কোন প্রতিবাদ না করে এটাই মেনে নেবে যে, চকচক করলেই সােনা হয় না। সমস্ত চক্রান্ত ঠিকঠাক শাহজাহানকে শুধু শােনানাে হয়েছিল যে, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব পিতৃ হত্যার জন্য অনেক ষড়যন্ত্র করেছেন কিন্তু তার সুযােগ্য পুত্র দারা এবং তার অনুচরবর্গের চেষ্টায় তা ব্যর্থ হয়। অতএব নিজে নিহত হওয়ার পূর্বেই মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের উপযুক্ত শান্তির প্রয়ােজন আছে।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে শাহজাহানের স্বাক্ষর করা পত্র পাঠানাে হলাে। তিনি সেদিন অসুস্থতা সত্ত্বেও পিতার আদেশে আগমন করতে প্রস্তুত হলেন। রাজ দরবারে পৌঁছেও পিতার আদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে কখনও কোন ত্রুটি হয়নি, যদিও কুপরামর্শদাতাদের পরামর্শে তিনি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রতি অনেকবার অবিচার করেছেন। কিন্তু ও মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সমস্ত কিছু ভুলে পিতার পদপ্রান্তে হাজির হয়ে শুভাশীষ নেবেন আর প্রত্যক্ষ শুভাশীষ নেবেন বিখ্যাত বিদূষী ভগ্নি জাহানারা সমস্ত কুরআন যিনি কণ্ঠস্থ করেছিলেন। এই সত্যের প্রতিচ্ছবি বােনেরা আজও মৌলিক ইতিহাসে চরিত্র দৃঢ়তায় স্বচ্ছ সুন্দর তারকার ন্যায়, অমর হয়ে আছে। তার আর এক বিদূষী বােন রওশনআরা এই চক্রান্তের গােপন সংবাদ অবগত ছিলেন। যখন বুঝতে পারলেন, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যু অবধারিত তখন তিনি বিশ্বস্ত দূত দ্বারা মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে সমস্ত চক্রান্তের সংবাদ জানিয়ে দিলেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব চক্রান্তকারীদের উপর অতিশয় দঃখিত হলেন এবং সেই সঙ্গে তাদের দমন করারও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।
প্রতিনিয়ত পিতার ঘন ঘন ভুলভ্রান্তির অবসান ঘটানাের একটা পথ ছিল পিতাকে হত্যা করা অথবা বন্দী করা। কিন্তু পিতৃহত্যা যেহেতু আওরঙ্গজেরে প্রাণপ্রিয় ধর্মের বিপরীত এবং মানবতা বিরােধী তাই তার পক্ষে তা কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে তিনি সমস্ত ফিতনা ফসাদের মূলােৎপাটনের জন্য সহজ সরল স্বাভাবিক পথে সম্মানজনক ও আরামদায়কভাবে তাকে আটকে রাখার ব্যবস্থা করলো আর এরই নাম নাকি ‘বন্দীত্ব’।
এইবার কিঞ্চিৎ আলােচনা হওয়া প্রয়োজন যে, এত বড় সন্ন্যাসী, ফকির, জিন্দাপীর, সত্যের প্রতীক বিখ্যাত পণ্ডিতের পক্ষে কিরূপে সম্ভব হয়েছিল সিংহাসনকেন্দ্রিক কোন্দল? কিরূপে সম্ভব হয়েছিল ভাইদের সঙ্গে কলহ? আর এ কথা কি সত্য যে, তিনি তার ভাইদের হত্যা করেছিলেন?
প্রকৃত সমীক্ষান্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ভাল। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব শৈশবেই সমগ্র কোরআন শরীফ কণ্ঠস্থ করেছিলেন। ত্রিশ অধ্যায়যুক্ত সমগ্র কুরআন মুখস্থ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি একজন পূর্ণ আলেম হওয়ারও সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সারা দিনরাতে খুব বেশি কুরআন পাঠ করতেন—তার প্রমাণ মূল ইতিহাস। আর যুক্তি হচ্ছে, তিনি নিজ হাতে ‘কুরআন কপি’ করতেন। তখন প্রেস ছিল না, অতএব অত্যন্ত বিশুদ্ধ এবং জোরালাে স্মরণ না রাখলে তা অনর্গল লেখা যায় না। উপরন্তু কুরআনের শুধু একটি অক্ষর নয় বরং একটি ‘জবর’ ‘জের’ অর্থাৎ আকার ইকার পর্যন্ত গােলমাল হলে তা বাতিল বলে গণ্য হয়।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব চেয়েছিলেন তিনি রাজ্য রাজনীতি ত্যাগ করে শুধুই সাধনা উপাসনা ও কৃচ্ছাসাধনের মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাবেন। কিন্তু শাহজাহান জানতেন সমস্ত ভাইদের মধ্যে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবই একমাত্র যােগ্য। সেইজন্য যৌবনের পদার্পণের পর হতেই ঐ বিষয়ে মৃদু উপদেশ, আদেশ আর তিরস্কারের কশাঘাত সহ্য করতে হয়েছে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে অনেকবার। শেষে জয় হােল পিতা শাহজাহানের। পিতার শেষ যুক্তি ছিল এই—তুমি আমার চেয়ে ধর্মের শিক্ষা দীক্ষার ক্ষেত্রে অধিক অগ্রসর। আর পিতার সব আদেশ শিরােধার্য, যদি সেই আদেশ ধর্মের প্রতিকূল না হয়। অতএব রাজনীতি করা ধর্মে অনুমােদিত না নিষিদ্ধ তুমিই ঠিক করে নিও। আমার দ্বিতীয় কথা—আমা অপেক্ষাও তুমি হজরত মুহাম্মাদের বেশি ভক্ত বলে আমার ধারণা। তিনি কি ঘর সংসার, স্ত্রী পুত্র পরিজন, সমস্ত ত্যাগ করে ধার্মিকতা প্রদর্শন করেছেন, নাকি সমস্ত কিছুর ভারসাম্য বজায় রেখে ধার্মিকতার শ্রেষ্ঠতম কীর্তি স্থাপন করেছে? এই সুচিন্তিত এবং সূক্ষ্ম অথচ তীব্র প্রশ্নের উত্তরে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে পরাস্ত হতে হয় এবং পার্থিব জনকল্যাণকর বিষয়ে তাকে মনােযােগ দিতে বাধ্য হতে হয়।
সেই সময়ে ভারত বিখ্যাত একজন মুসলমান ফকির এবং খুব উচ্চ পর্যায়ের সাধকের দরবারে ‘দোয়া’ নেবার জন্য অনেকেই যেতেন। বাল্যকালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব স্বয়ং তার পর্ণকুটিরে পদার্পণ করে তাকে দেখে অবাক হলেন। ছিন্ন তালি দেওয়া বস্ত্র, নির্ভয় চিত্ত, প্রফুল্লবদন, উদাস আর প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে অবিলম্বে উত্তর দান যেন পাগল বা শিশু উত্তর প্রদানের মত। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁকে সালামপূর্বক বললেন, আমার কিছু বিশেষ কথা আছে। সাধক সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, আগে বস পরে কথা। তিনি ছেঁড়া পুরাতন মখমলের উপর তার পাশে বসলেন এবং বললেন, আমি দিল্লির সিংহাসনের জন্য দোয়া নিতে এসেছি—যেন সারা ভারত জুড়ে অশান্তি আর রক্তপাত না হয়, আর আমার মধ্যে যেন রাজকার্য পরিচালনার যােগ্যতা থাকে। উত্তরে তিনি বললেন, তুমি দিল্লির সিংহাসন পেয়ে গেছ তার উপরেই তাে তুমি বসে আছো। তারপর তা সেই ময়লা মখমলে হাত চাপড়ে বললেন,
“দেখ, এইটাই হল দিল্লির সিংহাসন।”
দারা, সুজা, মুরাদ সকলেই ঐ জীবন্ত দরবেশের কাছে হাজির হলেন। প্রত্যেকেই যথাযােগ্য সম্মান প্রদর্শন পূর্বক দিল্লির বাদশাহী পাওয়ার অনুকূলে দোওয়া প্রার্থনা করলেন। স্বনামধন্য দরবেশ প্রত্যেককে বসতে বলেন। তখন সকলে মাটির উপর বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর দরবেশ বললেন, তােমরা তােমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে নিয়েছ।
সকলে এক বাক্যে উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন তাদের ভাগ্যফল। দরবেশ বললেন, মাটিতে যারা বসেছে অরা বাদশাহী পাওয়ার যোগ্য নয়।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব অত্যন্ত যােগ্য ছিলেন বলেই সম্রাট শাহজাহান তাঁকে অনেকবার জোর করেই যুদ্ধক্ষেত্রে বিদ্রোহ দমনে ও প্রশাসন কার্যে নিযুক্ত করেছিলেন। সব ঐতিহাসিকেরা একমত যে দীর্ঘদিন যাবত আদিল শাহের সঙ্গে শাহজাহানের যুদ্ধ চলেছিল। শাহাজাহান শিবাজীর পিতা শাহজী ও আদিল শাহের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হলেন। দাক্ষিণাত্য সম্রাটের করতলগত হলাে। এই শত্রুভাবাপন্ন দুর্ধর্ষ দাক্ষিণাত্যের শাসনভার কোন্ শাহজাদাকে দেওয়া যায় তা অনেক চিন্তা ভাবনার পর মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের উপরেই ন্যস্ত হয়। অতএব এখানেও অন্যান্য ভাইদের তুলনায় মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ পাওয়া গেল। শাহজাহান অন্যান্য পুত্রদেরও দায়িত্ব দিয়ে বিভিন্ন কার্যক্ষেত্রে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই অযােগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। দারা, সুজা একেবারে মাতাল, অযােগ্য ও অপদার্থ ছিলেন। অবশ্য মুরাদের মধ্যে কিছু যােগ্যতার আভাস পাওয়া যেত। ১৬৪৬ খৃষ্টাব্দে আলিমর্দান নামে একজন সুদক্ষ বীর সেনাপতিকে মুরাদের অধীনে বলখ বিজয়ে পাঠালেন। সম্রাট শাহজাহান মুরাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্বন্ধে সজাগ যদিও ছিলেন তা সত্ত্বেও যুদ্ধে অধ্যাবসায়ী ও দূরদর্শী হওয়ার মানসেই তিনি এই সমরায়ােজন করেছিলেন। আলিমর্দানের যুদ্ধ-কৌশলে বলখ মােগলদের দখলে আসে। আয়েসী মুরাদ পার্বত্য প্রদেশে থাকতে চাইলেন না। সুষ্ঠু মােগল প্রশাসন কায়েম না করেই মােগল হেরেমে ফিরে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে উজবেকগণ শক্তিশালী হয়ে মােগলদের বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহ ঘােষণা করল। বলখ মােগলদের হাতছাড়া হােল। সম্রাট শাহজাহান তখন তাকে তিরস্কার করে বললেন, ‘আমার আদেশ অগ্রাহ্য করে ফিরে এসে যে অযােগ্যতার পরিচয় দিয়েছ তাতে আমার চেয়ে তােমারই ভবিষ্যত বেশি অন্ধকার হয়েছে।’
যাইহােক এবার তিনি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে পাঠালেন বলখ বিজয়ে। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব পিতার আদেশে দু’ রাকাত নামাজ অন্তে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে রওনা হলেন। এখন বলখ হাতছাড়া, আবার নতুন করে যুদ্ধ ঘােষণা করে বলখ দখল করা সহজসাধ্য নয় তবুও মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের উৎসাহ ও আত্মপ্রত্যয়ের অভাব নেই। ১৬৪৭ খৃষ্টাব্দে তিনি বীরবিক্রমে পুনরায় বলখ অধিকার করলেন এবং বিদ্রোহের মুলােচ্ছেদ করে দেশে আবার শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন।
এদিকে বুখারা হতে আবদুল আজিজ এক বিরাটু সৈন্য নিয়ে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে আক্রমণ করলেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব আবার দুরাকাত নামাজ শেষে আল্লার সাহায্য প্রার্থনা করে এক উৎসাহব্যঞ্জক ভাষণে সৈন্যদের অপরাজেয় মনোবলের অধিকারী করে তুললেন। শেষে ঐ আক্রমণকারী দলকে প্রতিহত করে তিনি তৈমুরাবাদের দিকে সসৈন্যে অভিযান করলেন। ঐ সময়ে তার বীরত্ব, বুদ্ধিমত্তা, রণনিপুণতাও দূরদর্শিতায় ভীত বা প্রভাবিত হয়ে বুখারার সুলতান সন্ধির প্রস্তাব দেন।
ঠিক ঐ সময়ে মােগল বাহিনী ভারতে ফিরে যেতে চাইলে বিচক্ষণ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তা মেনে নিয়ে ভারত অভিমুখে যাত্রা করে ১৬৪৭ খৃষ্টাব্দে কাবুল এসে পৌঁছালেন। ভারত সীমান্ত পেরিয়ে এশিয়া মহাদেশের ঐ বিপদসংকুল স্থানে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অভিযানের কারণ ছিল। সম্রাট শাহজাহান এক সময় পুত্রদের কাছে তৈমুরের বাসভূমি ও পূর্বপুরুষদের অধিকৃত সমরকন্দ দখলের অভিলাষ ব্যক্ত করেছিলেন। পিতার ঐ মনস্কামনা পূরণের জন্য মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে সৎসাহস ও পিতৃআনুগত্যের পরিচয় দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার সৈন্যবাহিনী দীর্ঘকাল বিদেশে কাটানাের ফলে যুদ্ধবিমুখ হয়ে দেশে ফিরতে চাইলে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এই পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেন।
উপরােক্ত আলােচ্যাংশে মুরাদের অযােগ্যতা আর পিত্রাদেশ অবহেলা বিশেষ লক্ষ্যণীয়। অপর দিকে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের যােগ্যতা, ধর্মপ্রবণতা এবং পিতৃভক্তির আদর্শ সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। মধ্য এশিয়ায় দ্বিতীয় শাহ আব্বাস কান্দাহার পুনরুদ্ধারের জন্য বিশাল বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলে, এবারেও সাহসী যুদ্ধনীতি বিশারদ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকেই যেতে হল মৃত্যুর মুখােমুখি হতে। ১৬৪৮ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে বিজয়ী হলে শাহজাহানই শুধু নন, বর্জন মনে আকর্ষিত হন তিনি।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের এই বীরত্ব ও খ্যাতি অপরাপর ভাইদের চিন্তিত করে তুলেছিল। বিশেষ করে দারাকে। তাই তিনি পিতা শাহজাহানের গনে নানাভাবে বিষ বর্ষণ শুরু করেছিলেন। ঠিক ঐ সময়ে এক ঘটনা ঘটে যায়। ১৬৪৯ খৃষ্টারে ১৬ই মে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব পারসিকদের সঙ্গে যুদ্ধে আপ্রাণ চেষ্টা করেও পরাজিত হন। অমনি অপরের প্ররােচনায় শাহজাহান মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের উগ্র ক্রোধাবিত হয়ে পত্র লেখেন—পত্রপাঠ প্রত্যাবর্তন কর, আমার আদেশ ইটাই। কারণ তােমার ত্রুটিতেই পরাজয় হয়েছে।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব কোন দুঃখ, অভিমান বা ক্রোধ প্রদর্শন না করে পিতার পদপ্রান্তে উপস্থিত হনে। সিংহাসন, বিজয়মাল্য, নেতৃত্ব কিছুই রাজপুত্রের প্রয়ােজন নেই, শুধু চান উপাসনা করবার সুযােগ, পড়বার আর লেখবার অবাধ ফুরসত।
সম্রাট লােকের কথা শুনেই যে ভুল করেছিলেন একথা তাকে কেউ হয়ত বলেনি, কিন্তু ঠিক এর পরেই সম্রাট নিজেও চেষ্টা করলেন। কিন্তু এবারেও পারলেন তিনবার আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়ে মূখে স্বীকার না করলেও বুঝতে বিলম্ব হল না যে, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ত্রুটিমুক্ত। তাছাড়া জয়ের সাথে পরাজয়ও ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে।
ইতিমধ্যে দারা সম্রাটের মৃত্যুর সংবাদ রটিয়ে সিংহাসনে বসলেন। তখন সম্রাট অবশ্য মৃত নন, তবে সত্তর বছরের বৃদ্ধ, শয্যাগত মুমূর্ষু রােগী সালটি ছিল ১৬৫৭।
আবার উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, শ্রীঘােষ তাঁর ইতিহাসে দারার প্রতি দারুণ দরদ সত্বেও লিখেছেন,
“পিতার অত্যধিক স্নেহের ছায়ায় মন হইয়া তিনি যুদ্ধবিগ্রহ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে প্রায় অনভিজ্ঞ ছিলেন বলা চলে।”
দ্বিতীয় পুত্র সুজার জন্য লিখেছেন, “কর্মবিমুখতা ও আলস্য তাহার চরিত্রের প্রধানদোষ ছিল।” আরও লিখেছেন, “স্থির-ধীর ভাবে কোন কাজ করিবার ক্ষমতা তাহার ছিল না।” অন্যদিকে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সম্পর্কে লেখক বিভিন্ন স্থানে বহু প্রকার অসংযত অপবাদ সৃষ্টি করলেও অন্যত্র আবার যা বলা আছে তা বিশ্বাস করলে লেখকের নিজেই দেখা অভিযােগগুলাে অসত্যে পরিণত হয় অর্থাৎ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব যে সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেমন শ্রীঘাষ লিখেছেন,
“ঔরঙ্গজীবের চরিত্র ছিল ইহার ঠিক বিপরীত। যেমন তীক্ষ্ণবুদ্ধি, তেমনি স্থির ধীর ও হিসেবী। কর্মক্ষম ও তৎপর ছিলেন তিনি যথেষ্ট। রাজনীতির জটিলতা সম্বন্ধে তাহার যে অভিজ্ঞতা ছিল তাহা আর কাহারও ছিল না। শাহজাহানের পরিষদেরা জানিলেন যে, এই তৃতীয় পুত্রই সিংহাসনের যগ্যতম উত্তরাধিকারী এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে হয়ত শেষ পর্যন্ত তিনিই জয়ী হইবেন।”
তিনি মুরাদের জন্য লিখেছেন,
“কোন দিক দিয়া ঔরঙ্গজীবের সমকক্ষ ছিলেন না।”
তার বিরুদ্ধে হত্যা-মারামারির যে অভিযােগ আছে সে ব্যাপারে একটি লক্ষণীয় বিষয় হােল বিবাদ ঝগড়া কাটাকাটি হত্যা লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা নিঃসন্দেহে দোষণীয়। কিন্তু রাজরাজাদের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়। কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, অশােকের নরহত্যা, ভ্রাতৃহত্যা ও দেশকে শ্বশানে পরিণত করার ইতিহাস সাধারণ দৃষ্টিতে মন্দ হলেও রাজাবাদশাহের ক্ষেত্রে তা প্রযােজ্য নয়। বিগত ও বর্তমানের হতভাগ্য ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই বহন করছে। কিন্তু মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ক্ষেত্রে ঐ দোহাই দিয়ে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করার ওকালতি করে তার উজ্জ্বল ইতিহাসকে অনুজ্জ্বল না করাই ভাল।
শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারার পরাজয় ও মৃত্যুর জন্য দায়ী যশােবন্ত সিং এবং অনেক রাজপুতের বিশ্বাসঘাতকতা। অবশ্য প্রথমেই দারার বিরুদ্ধে তিন ভাই-ই একমত হয়েছিলেন যে, দারাকে কোন মতেই দিল্লির সিংহাসনে রাখা যাবে না। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সিংহাসনলােভী ছিলেন না বরং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেককে অকল্যাণ হতে রক্ষা করতেই তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল।
অবিভক্ত বঙ্গে ১৯৪৬ সালের স্কুলের পাঠ্য পুস্তক ‘ইতিহাস পরিচয়’, ইংরেজ ঐতিহাসিক Lanepole এর Analas of Rajasthan, প্রফেসর যদুনাথ সরকারের History of Aurangjeb, ১৯৬৩ সালে ছাপা প্রফেসর এইচ. আর. চৌধুরী ও এ. বি. সিদ্দীক লিখিত ‘পাক ভারতের মুসলমানের ইতিহাস’ এবং ‘তারিখে আলমগীর’ ইত্যাদি পুস্তক হতে কিছু আলােচনা করা হচ্ছে,
“তাঁহার [দারার] চঞ্চল স্বভাব এবং রুক্ষ মেজাজের জন্য দরকারের অনেকেই তাহার বিরুদ্ধভাবাপন্ন ছিলেন। তাহার উদার মতবাদ [হিন্দুবাদ] অনেকে মনে বিরুদ্ধভাব এবং ঘৃণার উদ্রেক করিয়াছিল। তাহার হিন্দুদের সঙ্গে মিত্রতা এবং শিয়া মতবাদের প্রতি অনুরাগ সিংহাসন লাভের পথে অন্তরায় হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। দ্বিতীয় পুত্র এবং বাংলার শাসনকর্তা সুজা বুদ্ধিমান এবং কৌশলী শাসক ছিলেন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত আমোদপ্রিয় ছিলেন এবং মদ্যপানের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি তাহার অনেক সদগুণ নষ্ট করিয়াছিল।”
মিঃ ঘােষের ইতিহাসের উদ্ধৃতি উপরে দিয়েছি তাতে তারা যে মদ্যপানের চুড়ান্ত মাতাল ছিলেন এটা গােপন রাখা হয়েছে। আর শেষের উদ্ধৃতির মধ্যে সুজার স্বেচ্ছাচারিতা, নারী লােলুপতা ও ব্যভিচারের দোষ গােপন করে শুধু লেখা হয়েছে অত্যন্ত আমােদশিয় ছিলেন।
অধ্যাপক চৌধুরী ও সিদ্দিকের ইতিহাসে ঠিক তার পরেই লেখা আছে –
“কনিষ্ঠ পুত্র মুরাদ ছিলেন গুজরাটের শাসনকর্তা। তিনি একজন সাহসী যােদ্ধা ছিলেন, কিন্তু প্রবৃত্তির বাস হইয়া পড়িয়াছিলে। তিনি চরিত্রহীন এবং ঘাের মদ্যপায়ী ছিলেন। শাসকের যে সমস্ত গুণ থাকা দরকার তাহার মধ্যে তাহার অভাব ছিল।”
আর রাজপুত্র চরিত্রহীন মদ্যপায়ী হলে রাজ্যের পরিণতি কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। একজন খুব ধনী ও বিত্তবান ব্যক্তি মদপায়ী ও চরিত্রহীন হলে বাড়ির পরিচারিকা ও অধিনস্থ নারীর ভাগ্যে কী ভয়াবহ – দুর্ভোগ নেমে আসে তা অনেকের জানা আছে। অতএব মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মাথা তুলে তখন সৌভাগ্যসূর্যের মত উদিত না হলে অন্যায়ের অন্ধকার ভারতের নির্মল নীলাকাশের গায়ে যে ভয়াবহ রূপ নিত এ বিষয়ে সন্দেহ খুব অল্প ছিল। সারা ভার পিতার স্নেহের সুযােগে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের উপর যে অত্যাচারের স্টীমরােলার চালিয়েছিলেন তার সংক্ষিপ্ত নমুনা দেওয়া হচ্ছে মাত্র।
[ক] ১৬৪৪ খৃষ্টাব্দে দাক্ষিণাত্য হতে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে আকস্মিক আহ্বান যা অন্য কোন রাজকুমারের পক্ষে সহ্য করা সহজসাধ্য ছিল না।
[খ] কান্দাহারের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বার যুদ্ধের পূর্ণ আয়ােজন করে আক্রমণ করার ঠিক পূর্বে হঠাৎ সংবাদ পৌছালে নিষেধাজ্ঞার। তাও তরুণ শাহজাদা মুখ বুজে সহ্য করলেন।
[গ] মুলতান শাসনের সময় সৈন্যদের ব্যয়ভারের জন্য পিতার কাছে অর্থ সাহায্যের আবেদন পেশ করলেন। কিন্তু অসহায় অবস্থায় তাকে কোনরকম সাহায্য করা হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হােল। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তাও মুখ বুজে সহ্য করলেন।
[ঘ] মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজের পুত্রের বিবাহ সুজার এক সতী সুন্দরী কন্যার সঙ্গে দেবার মনস্থ করেন কিন্তু তাতেও তিনি বাধাপ্রাপ্ত হন।
ইতিহাসে আজও মজুত আছে যে, ঐ সমস্ত অপকর্মের মূলে দারার কারসাজি ছিল সাংঘাতিক ভাবে। যেমন প্রফেসর চৌধুরী ও সিদ্দিকের ইতিহাসে লেখা আছে,
“মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রতি শাহজাহানের এই ব্যবহারের মূলে দারার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রকট।”
‘পাক ভারতের মুসলমানের ইতিহাস’ পুস্তকের ২৮৬ পৃষ্ঠা থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি-
“দারা তাহার ভ্রাতাদের ভকিলগণের [vokil] নিকট হইহে এই মর্মে আশ্বাস লাভ করিয়াছিলেন যে, দূর প্রদেশে অবস্থানরত শাহজাদাদের নিকট তাহারা সম্রাট অথবা দরবারের কোন সংবাদ পাঠাইবেন না। কেন্দ্রের সহিত সকল যােগাযােগ তিনি বিচ্ছিন্ন করিয়াছিলেন এবং পথিকগণ যাহাতে কেন্দ্রের কোন খবর প্রচার করিতে না পারে তাহার জন্য বাংলা, গুজরাট এবং দাক্ষিণাত্যের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। তিনি তাঁহার ভ্রাতাগণের ভকিলদের সম্পত্তি পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করিয়াছিলেন এবং মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীনে বিজাপুরে সংগ্রামরত কর্মচারীদের তিনি রাজধানীতে ফিরিয়া আসিবার জন্য আদেশ দান করিয়াছিলেন। শাহজাদাগণ রাজধানীতে প্রবেশের পূর্বেই তাহাদিগকে আক্রমণ করিবার জন্য তিনি সৈন্যদের আদেশ দিয়াছিলেন। দারাশিকোর এই সমস্ত কার্যাবলী ভাতৃসংগ্রামকে উদ্দীপ্ত করিয়াছিল।”
দারাশিকোর ভিতরের এত নােংরামি, অবিচার, অন্যায় ইতিহাসে না জানিয়ে শুধুমাত্র মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের চরিত্রে কলঙ্ক লেপন আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রুদের বীর এবং সজ্জন বলে মানুষের মনে বিরুদ্ধ ধারণা জন্মিয়ে দিয়ে কাজ শেষ করে গেছেন অনেকেই। কিন্তু এখন সমস্ত চক্রান্ত শিক্ষিত উদারচেতা মানুষদের কাছে আস্তে আস্তে ধরা পড়ছে এবং পড়তেও থাকবে।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের উপর এত অবিচার আর অপমানজনক অনাচার প্রয়ােগ সত্ত্বেও তিনি কোন চরিত্রের মানুষ ছিলেন সেটা জানবার জন্য বিখ্যাত ইতিহাস ‘আদব-ই-আলমগীরী’ হতে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নিজের হাতের লেখা একটি মূল্যবান পত্র যা তার বােন জাহানারাকে তিনি লিখেছিলেন, সেটির অনুবাদ উদ্ধৃত করা হচ্ছে-
“…যদি সম্রাট তার সমস্ত চাকরদের মধ্যে কল আমারই অবমাননার জীবন যাপন এবং অগৌরবময় মৃত্যু দেখতে ইচ্ছা করেন তাতেও আমি তাঁর বিরুদ্ধে যেতে পারব না। কাজেই সম্রাটের অনুমতিক্রমে মাতে রাষ্ট্রের কোন ক্ষতি না হয় এবং অন্য লােকের [দারার] মনে শান্তি ব্যাহত না হয় সেইজন্য এই বিরক্তিকর জীবন যাপন হতে মুক্তি নেওয়াই উত্তম। দশ বছর পূর্বে আমি এই সত্য উপলব্ধি করেছিলাম এবং জীবন বিপদাপন্ন বুঝতে পেরেই অন্য লােকের [দারার] ক্ষতির কারণ না হওয়ার জন্যই পদত্যাগ করতে ইচ্ছা করেছিলাম….।”
এই পত্রটি গবেষকদের জন্য চিন্তার খােরাক হবে সন্দেহ নেই।
শাহজাহান মৃত্যু ব্যাধি হতে আরােগ্য লাভ করে নভেম্বর মাসেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার আগেই দারা পিতার অন্ধ ভালবাসা পেয়ে সিংহাসন দখল করে নিজেকে বাদশাহ বলে ঘােষণা করেছিলেন। মুরাদও লােভ সংবরণ করতে পারলেন না। ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই আহমেদাবাদে রাজমুকুট ধারণ করে নিজেকে হিন্দুস্থানের বাদশাহ বলে ঘােষণা কলেন। সুজাও সােজা পথ ধরলেন অর্থাৎ তিনিও বাংলাদেশের স্বাধীন রাজা বলে নিজেকে ঘােষণা করলেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, শুধু ভাবছিলেন এই অপদার্থ ভাইদের হাতে সিংহাসন যাওয়া মানেই বাচ্চাদের হাতে ধারাল অস্ত্র তুলে দেওয়া। তাই তিনি ‘ইস্তেখারা’র নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে তাকে নাকি বলা হােল, তুমি তােমার লক্ষ্যস্থানে পৌঁছাবার চেষ্টা কর। তােমার সাধুতা ও রাজ্য পরিচালনা দুইই একসঙ্গে সম্ভব হবে।
তিনি এবার মীরজুমলাকে সেনাপতি করে সসৈন্যে অগ্রসর হলেন। ২৮ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসে উজ্জয়িনীতে তিনি সৈন্যসহ মুরাদের সাথে মিলিত হলেন। ঐ সময়ে মুরাদকে যুদ্ধে নিহত করে পথ নিষ্কন্টক করা কষ্টসাধ্য ছিল না। কিন্তু কোন যুদ্ধই করলেন না, বরং মিলনের কথাই হােল।
এদিকে দারার সঙ্গে সুজার সসৈন্যে যুদ্ধ হােল ১৬৫৮ খৃষ্টাব্দের ১৪ই মার্চ। সুজা পরাজিত হলেন। এবার মুরাদ এবং মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের বাহিনীকে শায়েস্তা করার জন্য দারার দুই সেনাপতি যশােবন্ত সিং এবং কাশেম খাঁ যুদ্ধে অতীর্ণ হলেন। ১৬৫৮ খৃষ্টাব্দের ১৫ই এপ্রিল তুমুল যুদ্ধ হয় উজ্জয়িনীর নিকট-ধর্মাট নামক স্থানে। যুদ্ধে দারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। পরাজিত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল চরম মুহূর্তে রাজপুত সেনাপতি যশােবন্ত সিং এর বিশ্বাসঘাতকতা। মিঃ ঘােষও তার ইতিহাসে লিখেছেন-
“মােগল শিবিরে হিন্দু সেনাপতি যশােবন্ত সিংহ ও মুসলমান সেনাপতি কাশেম খাঁর মধ্যে মতবিরােধের ফলে ঔরঙ্গজীব যুদ্ধে জয়ী হন।”
এই সময় যশােবন্ত সিংহ পলাতক দারার দরদে দরদী হয়ে তাকে পত্র পাঠালেন-
“তিনি যদি আজমীরে আসিতে পারেন, তবে তিনি এবং অন্যান্য রাজপুতেরা তাঁকে সাহায্য করিবেন। এই আশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া দারা আজমীরে আসিয়া উপনীত হইলেন। কিন্তু ইত্যবসরে যশােবন্ত সিংহ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া তাহার পক্ষভক্ত হইয়া পড়িলেন। কাজেই দারা আজমীরে আসিয়া প্রতারিত হইলেন।” [ইতিহাস পরিচয়, পৃষ্ঠা১২৭)
এর চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা ইতিহাসে আর কী হতে পারে? সাহায্য তাে দুরের কথা, একেবারে শত্রুপক্ষের সাথে হাত মিলিয়ে চরম কপটতা প্রদর্শন করে ইতিহাসের পাতাকে কলঙ্কিত করেছেন। সেই অবস্থায় যুদ্ধ হল মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সাথে। কিন্তু দারাকে পরাজিত হয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতে বাধ্য হতে হল। এই দারুন সঙ্কট সময়ে দারার যাবতীয় ধনরত্ন ও মাল সামগ্রী একদল রাজপুত লুট করে দারার প্রতি মানবতা বিরােধী ভূমিকা পালন করে।
উপরােক্ত তথ্যগুলাে ঐ ইতিহাস পরিচয় হতে নেওয়া হয়েছে। তারা প্রফেসর যদুনাথ প্রকার তার ‘History of Aurangjeb’ নামক গ্রহের ৫০৫ পৃষ্ঠায় যা বলেছে তাও গভীর কৃগজ্ঞতার সাথে পরিবেশিত হােল :
“Of all the actors in the drama of the War of Succession Jasawant emerges from it with the worst reputation : he had run away from a Alght where he commanded in chief, he had breacherously attacked an unbuspecting friend and to abandoned an ally whom he had plighted his word to support and whom he had lured into danger by his promises. Unhappy was the man who put faith in Jasawant Singh, lord of Marwar and chieftain of the Rathor clan.”
দারা গুজরাটে পলায়ন করলেন। মুরাদ এতদিন পর্যন্ত মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পক্ষের লােক ছিলেন। হঠাৎ তাঁকে বিশেষ কিছু পক্ষ হতে প্রলােভন ও উৎসাহ দেওয়া হােল। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে মােটেই অবিশ্বাস করতে পারেন না। এই সুযোগ যদি তিনি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে নিহত বা পরাজিত করতে পারেন তাহলে জনসাধারণের কাছে প্রমাণিত হবে মুরাদ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের চেয়েও সুযােগ্য, সুতরাং তাঁর ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল মাতাল মুরাদ এই ভুল ধারণাকে এক অপূর্ব সুযােগ মনে করে বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব অবাক হলেন বটে, কিন্তু কালবিলম্ব না করে সাহস ও নিপুণ কৌশলে মুরাদের দুঃসাহস ব্যর্থ করে তাকে বন্দী করে গােয়ালিয়র দুর্গে পাঠিয়ে দিলেন।
ওদিকে ভ্রাতা সুজা সুলেমানের নিকট পরাজিত হয়ে পুনরায় সৈন্য সংগ্রহ করে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবেরর উপর সসৈন্যে আক্রমণ করলেন খাঁজোয়া নামক স্থানে দুপক্ষের তুমুল সংঘর্ষ হল। এবারে এই যুদ্ধে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাপতি হয়ে এসেছে সেই বিশ্বাসঘাতক নীতিহারা আওরঙ্গজেরে ক্ষমাপ্রাপ্ত যশােবন্ত সিংহবারও যশােবন্ত সিংহের নূতন কীর্তি ইতিহাসের এক নূতন অধ্যায়-যদিও তা যবনিকার অন্তরালে বিরাজমান। ‘ইতিহাস পরিচয়’ থেকে তুলে দিচ্ছি-
“কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যশেবন্ত সিংহ গােপনে গােপনে সুজার সহিত যােগ দিয়া একদিন রাত্রিকালে আওরঙ্গজেবের শিবির আক্রমণ করিয়া বসিলেন। এরূপ বিপদের মধ্যেও মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বিচলিত হইলেন না, শীঘ্রই তিনি যশােবন্ত সিংহকে পরাজিত করিলেন। তখন যশােবন্ত সিংহ প্রাণভয়ে পলাইয়া গেলেন; যুদ্ধে পরাজিত হইয়া পলায়নপূর্বক সুজাও আরাকানে আশ্রয় লইলেন। অতঃপর তাহার আর কোনরূপ সন্ধান পাওয়া গেল না। খুব সম্ভব আরাকানবাসীদের হস্তে তিনি সপরিবারে নিহত হইয়াছিলেন।”
উদ্ধৃতিটুকুতে এও বােঝ গেল যে, তার মৃত্যুর জন্য মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের উপর ভ্রাতৃহত্যার দোষারোপ শুধু মিথ্যা পরিবেশন নয় বরং তা যে ইতিহাস না জানার, না বোেঝার তথা অযােগ্যতার চরম পরিচায়ক, তাতে সন্দেহ নেই।
যশােবন্ত সিংহের আসল উদ্দেশ্য কী ছিল তা গবেষক ও ঐতিহাসিকদের সমীক্ষার বিষয়। এত অপরাধ করার পর যশােবন্ত মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সঙ্গে সঙ্গে তার পবিত্র কুরআনের আদর্শে ও হজরত মুহম্মদের বাণী স্মরণ করে পুনরায় তাকে ক্ষমা করলেন এবং শাসনকর্তারূপে তাকে কাবুলে পাঠিয়ে দেন। আজ বােঝবার দিন এসেছে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শুধু মৌখিক ক্ষমা নয়, আন্তরিকতার নিদর্শনস্বরূপ কাবুলের শাসনকর্তা করে পাঠাননা, অন্ততঃ একজন হিন্দুকে, কোন ‘হিন্দু বিদ্বেষী’ ‘গোড়া মুসলমানের’ পক্ষে সম্ভব ছিল না। এও দিবালােকের মত পরিষ্কার যে, তাকে হিন্দু বিদ্বেষী, তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না, হিন্দুদের রাজকর্ম হতে অপসারণ করতেন প্রভৃতি কথা যারা বলেছে আজ তারাই বরং ইতিহাসের আদালতে আসামী প্রতিপন্ন হবেন। তবে কাঁচা লেখক না জানার কারণে যা করেছেন তা ক্ষমা পাওয়ার দাবী করতে পারে।
মুরাদ হত্যার সহজ অপবাদ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের উপর যেভাবে বরাবর চাপিয়ে আসা হয়েছে তাতে ঐ তথ্যও অনেকের কাছে সত্য বলে মনে হয়েছে। কিন্তু তা মূল ইতিহাস, যুক্তি, তর্ক, বুদ্ধি ও বিবেকের কষ্টিপাথরে যাচাই না করলে ইতিহাস হিসাবে তা স্থায়ী মর্যাদা পায় না। আমাদের মনে রাখা উচিত যে, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব কুরআন ও হাদীসপন্থী সহজ, সরল, সত্যবাদী ও সদাচারী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি কাজী বা মুফতিপদে ছিলেন না। বরং বিচার, ‘ফাতওয়া’, মীমাংসা, সমাধান, ইজমা ও কিয়াসের জন্য কাজী, মুফতি আল্লামা ও উলামাদের কমিটি প্রস্তুত ছিল। তাদেরই কাজ ছিল বিচার ও সমস্যার সমাধান করা। আর মুরাদের মৃত্যুও ছিল এই সমস্ত বিচারকের বিচারের পরিণাম।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে একজন সাধারণ প্রজা তার আত্মীয়কে হত্যা করার অভিযােগে মুরাদের বিরুদ্ধে যথাযােগ্য বিচার প্রার্থনা করেন। বাদশাহ নিজে বিচার করার যােগ্যতা রাখলেও নীতি অনুসারে বিচার বিভাগীয় প্রধান বিচারপতির কাছে মুরাদের বিচার হােল এবং সাক্ষা ও প্রয়াণে অন্যায় হত্যা বলে প্রমাণিত হোল। ইসলাম ধর্মের আইনানুসারে প্রাণনাশের শাস্তি প্রাণদণ্ড—অবশ্যই তা প্রমাণের পূর্বে প্রয়। আজ ইতিহাসে সােজাসুজি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক মুরাদের নিহত হওয়ার সম্পূর্ণ ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। কিন্তু আসলে সত্য কথা হচ্ছে এই যে, বিচারকের বিচারে প্রাণনাশের অপরাধে তার প্রাণদণ্ড হয়েছিল। যাকে মুরাদ হত্যা করেছিলেন তার নাম ইতিহাসের পাতায় স্পষ্টভাবে সংরক্ষিত। সেই বিশিষ্ট নিহত কর্মচারির নাম ছিল আলী নকী।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দারাকে হত্যা করেছিলেন এই রকম কথাও ইতিহাসে সহজ সরল ভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু দারার বিরুদ্ধেও একটা ঐতিহাসিক অভিযােগ ছিল, যার শাস্তি প্রাণদণ্ড। তিনি রাজদ্রোহীতা, গুপ্তচরবৃত্তি, শত্রু রাষ্ট্রের সাথে আঁতাত প্রভৃতি আরও অনেক অভিযােগে অভিযুক্ত ছিলেন। ইসলামের আইনে কিন্তু যখন তখন মনগড়া কোন শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা নেই। যেমন বৈদ্যুতিক আঘাত দেওয়া, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা, জলে ডুবিয়ে কিংবা গরম জলে বা তেলে সেদ্ধ করা, মলদ্বায়ে লৌহ, শলাকা প্রবিষ্ট করিয়ে মাথা অবধি তা পৌঁছে দেওয়া, বিষপান করানাে ইত্যাদি শাক্তিগুলাে নিষিদ্ধ। ইসলামের আইনে কেউ কারো প্রাণনাশ করলে, বিবাহিত ব্যক্তি ব্যভিচার করলে এবং ‘মোরতাদ’ হলে তার প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা আছে। দারারও প্রাণদণ্ড হয়েছিল মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আদেশে নয় বরং আইনের অনুকূলে, জজের বিচারে। মদ্যপান, ব্যভিচার ও স্বধর্ম ত্যাগ প্রভৃতি একাধিক কারণে বিচারকমণ্ডলী তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অবশ্য অনুসন্ধিৎসা থাকা স্বাভাবিক যে দারা সত্যই ধর্মত্যাগী ছিলেন কি না?
অনেক হিন্দু রাজপুত নেতার প্ররােচনায় যেমন আকবরকে বেশ বশ করে মুসলমান নামধারী শ্রেষ্ঠ হিন্দুতে পরিণত করা গিয়েছিল, যুবক অবস্থায় জাহাঙ্গীরের অবস্থা অনুরূপ ছিল এবং পরবর্তী সময়ে দারাও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঐ পথের পথিক হয়েছিলেন। দারা ছিলেন আকবরের মত বাইরের কাঠামােধারী ছদ্মবেশী। দারা সম্বন্ধে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আকরাম খাঁ লিখিত দুর্লভ গ্রন্থ মোঃ বঙ্গের ইতিহাস হতে সংগৃহীত কিছু তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে :
দারারও ধারণা হয়েছিল ভারতে হিন্দু জাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ, সুতরাং তাদের হাতে রাখার অর্থই হচ্ছে বিনা বাধায় দিল্লির সম্রাট হওয়া। অতএব আকবরের নীতি অনুসরণ করে দারার নিজের ভূমিকা আরও হৃদয়গ্রাহী করতে ‘দীনে ইলাহী’র ন্যায় তিনিও এক নূতন ফরমূলা আবিষ্কার করেন। এছাড়া একটি ধর্মগ্রন্থও লিখলেন। বইটির নাম ‘মাজমাউল বাহরাইন’, এর অর্থ হচ্ছে ‘সাগরদ্বয়ের মিলন’। অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্ম দুটি যেন দুটি সাগর আর সেই দুটির সন্ধি ঘটিয়ে খিচুড়ি তৈরি করাই ছিল দারার পরিকল্পনা। দারা দস্তুরমত সংস্কৃত সাহিত্যে বিশেষতঃ উচ্চ পর্যায়ের হিন্দু শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন।
একজন অমুসলমান পণ্ডিত মুসলমান বেশ ধারণ করে দারার জঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং নিজেকে ‘ফকির-মাওলানা’ বলে পরিচয় দেন। বলাবাহুল্য, পণ্ডিত মশাই দারাকে বিভ্রান্ত করবার জন্য মুসলমানের কিছু বই পত্র পড়ে সামান্য কিছু মুন্সীয়ানা হাসিল করেছিলেন। তিনি দারাকে উপনিষদের মহিমা বর্ণনা করে তার শিক্ষা নিতে উৎসাহিত করেন। ফকির মাওলানার কথায় তিনি বেনারস হতে কয়েক সুপণ্ডিতকে আহ্বান করেন এবং মনােযােগ দিয়ে উপনিষদ শিক্ষা করেন। এখান থেকেই দারার হৃদয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণের বীজ রােপিত হয়। মাত্র ছয় মাসের পরিশ্রমের ফলস্বরূপ রাষ্ট্রভাষা ফারসীতে উপনিষদের অনুবাদ করে নিজের যােগ্য প্রদর্শন ও হিন্দু জাতির প্রিয়পাত্র হতে সক্ষম হন। বইটি শুধু উপনিষদের অনুবাদ মাত্রই ছিল না, তাতে ছিল তার নিজের সৃষ্টধর্মের নানা টীকা টিপ্পনী। আর উপনিষদ ও তার ‘সাগরদ্বয়ের মিলন’ গ্রন্থকে প্রমাণিত করতে গিয়ে কষ্টকল্পনা করে কুরআন ও হাদীসের বিকৃত ব্যাখ্যা করতেও দ্বিধা করেননি। তার ‘মাজমাউল বাহরাইন’ গ্রন্থের অনুবাদ করেন ফরাসী কবি ‘মুসাআকতাই দুর্পেয়া’!
যুবরাজ দারা সিংহাসন দখলের জন্য লড়াইয়ের পূর্বে সমাজের নেতৃস্থানীয় হিন্দু নেতাদের সহযােগিতা ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি চেয়েছিলেন। অনেকেই তাকে সহযােগিতা করবার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। দারার প্রতি যাতে বিশ্বাস আরও গাঢ় হয় সেই অভিপ্রায়ে হিন্দুদের তীর্থক্ষেত্র মথুরায় একটি মন্দির করেছিলেন। মথুরার মন্দিরে বহু মূল্যবান কারুকার্য খচিত পাথরের রেলিং স্থাপন করেন। দারার দ্বারা সজ্জিত সেই মন্দির গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল। তার মারাত্মক একটা দিকও ছিল–হিন্দুদের তীর্থস্থানে হিন্দু তীর্থ যাত্রীর ভীড় তেমন কিছু নূতন নয়, কিন্তু দারার সাহায্যপুষ্ট কেশব রায়ের মন্দির, গুজরাটের মন্দিরগুলােকে কেন্দ্র করে অনেক আশ্চর্য অলীক গল্প প্রচারিত হয়েছিল। যেমন শাহজাহান একবার অসুস্থ হলে দারা ঠাকুর দেবতার শরণাপন্ন হন এবং এক ঠাকুরের বরে বৃদ্ধ শাহজাহান সুস্থ হয়ে ওঠেন। সেই দেবতার শক্তিতে অভিভূত হয়ে তিনি হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। ইসলাম ধর্মে মূর্তিপূজা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু সম্রাট দারার অর্ঘ্যের ঘনঘটার বহর লক্ষ্য করে সাদাসিধে রােগগ্রস্ত বিপদগ্রস্ত নরনারীর এমন সমাবেশ। হতে থাকে যে তীর্থকেন্দ্রগুলাে মুসলমান ও হিন্দুদের যুগ্ম তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এবং এখান থেকে দারার রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালিত হােত ঐ সমস্ত ধর্মীয় পুরােহিতদের দ্বারা। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সম্রাট হওয়ার অনেক দিন পরে কাজী মুফতির দরবারে দারার বিরুদ্ধে মােকদ্দমা হয়। সেই মােকদ্দমায় তার স্বহস্তে লিখিত পত্র, সনদযুক্ত লেখা, পুস্তকাদি ও প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের সাক্ষ্যে দারা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। সেই রায় প্রকাশের সংবাদে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বলে পাঠিয়েছিলেন—আপনাদের রায়ের উপর কোন প্রতিবাদ করার স্পর্ধা আমার নেই। কোরআন হাদিসের আলােয় যে বিচার হয়েছে তার বিরুদ্ধে কিছু বলার অর্থ হচ্ছে ইসলাম ধর্মে হস্তক্ষেপ করা।
উপন্যাস মার্কা সস্তা হেটো ইতিহাসে ‘সিংহাসনের জন্য ভাইদের হত্যা, করিয়াছিলেন’ বলে যে তথ্যটি বহুল প্রচারিত, একটু গভীর চিন্তা করলেই তার অসত্য প্রমাণ হয়। কারণ সিংহাসনের জন্য হত্যা করলে তা সিংহাসন পাওয়ার পূর্বেই করা হত। কিন্তু তার সিংহাসন পাওয়ার পরে তখন তিনি সম্রাট হয়ে সিংহাসনে সম্পূর্ণভাবে অধিষ্ঠিত এবং প্রতিদ্বন্দ্বী যখন হাতের মুঠোয় বন্দী যখন এত কলা কৌশল করে হত্যা করার প্রহসন সৃষ্টির প্রয়ােজন ছিল না। তাঁকে মেরে ফেলার পর ‘রােগগ্রস্ত হয়ে মারা গেছে’ বললেই যথেষ্ট ছিল। অতএব বলাবাহুল্য যে, ‘সিংহাসনের জন্য ভাইদের হত্যা’ করার অভিযােগ সম্পূর্ণ অসত্য।
[৫] ‘কেবল হিন্দুদেরই উপর জিজিয়া কর চাপিয়েছিলেন’ বলেও যে অপবাদটি ব্যাপক প্রচারিত তা নিঃসন্দেহে সম্রাট আলমগীরে চরিত্রের উপর এক জঘন্যতম আক্রমণ। অবশ্য বিস্তারিত আলােচনার পরেই তার সত্যাসত্য প্রমাণ হবে।
আকবর জাহাঙ্গীর প্রভৃতি বাদশাহরা জিজিয়া তুলে দিয়েছিলেন বলে সহজেই মনে হয় তা তাদের উদারতা। আর মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব আবার তা প্রবর্তন করে যেন হিন্দু বিদ্বেষের পরিচয় দিয়েছেন। আসলে আকবর ও জাহাঙ্গীরের জিজিয়া প্রথার বিলােপ সাধন ছিল গুরুতর ইসলাম বিরােধী কাজ। সেহেতু মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব যদি তা পুনঃপ্রচলন না করতেন তাহলে তাও হােত ইসলাম বিরােধী নীতি অবলম্বন। তাই তাঁকে জিজিয়া কর আবার ধার্য করতে হয়েছিল। এবং জিজিয়া শুধু হিন্দুদের দিতে হােত, কোন মুসলমানকে নয়। তার কারণ হচ্ছে এই যে, জিজিয়া একটি সামরিক কর মাত্র, এটি মাথা ‘গুণতি’ কর নয়। কোন হিন্দু মহিলা, বালক বালিকা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু, অন্ধ, খঞ্জ, ভিক্ষুক ও সন্ন্যাসীকে ঐ কর দিতে হােত না। অমুসলমানদের মধ্যে যারা যুদ্ধ করবার শক্তি রাখতেন বা সক্ষম অথচ যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক শুধু তাদেরই দিতে হেত এই কয়। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রয়ােজনের পরিপ্রেক্ষিতে বাধ্যতামূলক যুদ্ধ করবার জন্য অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে যােদ্ধাদের সাহায্য ও শুশ্রুষা করবার জন্য নিয়ে যাওয়া হােত। অপর পক্ষে ইসলাম ধর্মে এরূপ কোন সংবিধান নেই যে, জোর করে কোন অমুসলমানকেও যুদ্ধে যােগদান করানাে যাবে।
মুসলমানদের জন্য মাল বা অর্থের ১/৪০ ভাগ একটা কর বাধ্যতামূলক ছিল, তার নাম জাকাত। এতদ্ব্যতীত ওশর অর্থাৎ উৎপন্ন ফসলের ১/১০ অংশ, ফেতরা, খুমুস, সদকা ও ফিদিয়া প্রভৃতি আরও ছােট বড় অনেক কর শুধু মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ছিল, হিন্দুদের ক্ষেত্রে ঐ সমস্ত কর নেওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এখানে উল্লেখযােগ্য কথা হােল, হিন্দু প্রজাদের নিকট যে জিজিয়া নেওয়া হােত তা তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পদ সম্পত্তির রক্ষার দায়িত্বের ভিত্তিতেই নেওয়া হােত। প্রফেসর যদুনাথ সরকার লিখিত ‘Mughal Administration’ গ্রন্থে পাওয়া যায়, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ৬৫ প্রকার কর তুলে দিয়েছিলেন এবং এই কর তুলে দেবার জন্য রাষ্ট্রের সেই বাজারে বাৎসরিক পাঁচ কোটি টাকার উপর ক্ষতি হােত। অপর ঐতিহাসিকদের অনেকেই বলেছেন, যখন তিনি ৮০টি করের বিলােপ সাধন করলেন তখন প্রশংসা পাননি কিন্তু শুধু একটি করের জন্য চারিদিকে এত কলরব ধ্বনি। Vindication of Aowrangzeb’ গ্রন্থে –
“When Aowrangzeb abolished eighty taxes no one thanked him for his generosity. But when he imposed only one, at not heaw at all, people began to show their displeasure.”
এই জিজিয়া শুধু ভারতেই মুসলমান বাদশাহ কর্তৃক হিন্দুদের উপর ধার্য হয়েছিল তা নয় বরং বহির্ভারতেও এই কর মুসলমানদের উপর ধার্য হােত যারা যুদ্ধে যেতে সক্ষম অথচ অনিচ্ছুক তাদের উপরই ছিল এই কর। অতএব জিদিয়াকে একটি হিন্দু বিদ্বেষী কর বলে মনে করা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছু নয়।
জিজিয়া একটি war tax বা যুদ্ধ কর মাত্র। এই জিজিয়া কোনও দিন অত্যাচার করে আদায় করা হয়নি। সম্রাট হিন্দু নেতাদের সুখে রামর্শক্রমে এই কর আদায় করনে। কোন ঐতিহাসিক বা লেখক প্রমাণ করতে পারেন না যে, কোন সুস্থ সবল হিন্দু, সৈন্যকেও ঐ কর দিতে হয়েছিল।
আরও মনে রাখবার কথা হােল, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সিংহাসনে বসেই প্রথম বছরেই হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর চাপাননি বরং ১৬ বছরের মধ্যে ৮০ প্রকার কর তুলে দিয়ে তারপর সামান্য জিজিয়া ধার্য করেছিলেন। আর তাই নিয়ে ইতিহাসে এত হৈ চৈ, এত আয়ােজন। বােধ হয় আসল উদ্দেশ্য অন্য কিছু। যাকে ‘ইসলামী কোড’ বলা হয় সেটা আরবী ‘হেদায়া’ আইন গ্রন্থেরই অনুবাদ বা ছায়াবলম্বিত। তাতে লেখা আছে,
“জিজিয়া কর প্রবর্তনের কারণ, এই কর সেই সাহায্যের পরিবর্তে যার দ্বারা রাজা অমুসলিমদের জীবন, ধন ও মানসম্রম রক্ষার দায়িত্ব নিজের স্কন্ধে নিয়েছেন।”
ঐ গ্রন্থের অন্যত্র আরও আছে –
“যদি তারা জিজিয়া গ্রহণ করা মঞ্জুর করলেন তাে তাদের হেফাজত এরূপ ভাবেই করা উচিত যেমন মুসলমানদের করা হয়। তাদের জন্য সে আইন প্রবর্তিত হবে যা মুসলমানদের প্রতি হয়। কারণ হজরত আলী বলে গেছেন, অমুসলিম জিজিয়া এইজন্য দান করে থাকেন যে, তাদের রক্ত মুসলিমদের রক্ত এবং তাদের ধন সম্মানমুসলিমদের সম্মানের সমান।”
বিখ্যাত ঐতিহাসিক পণ্ডিত ডাঃ গান্তাওলিবান লিখেছেন,
“ইসলামের খলিফারা ভালভাবে বুঝেছিলেন যে, ইসলামকে তরবারির জোরে প্রচার করা সম্ভব নয়। কাজেই দেখা গেছে, যেখানেই মুসলমানরা বিজয়ী হয়ে প্রবেশ করেছেন সেখানেই পরাজিত নগরবাসীদের প্রতি খুব নম্র ও ভদ্র ব্যবহার করেছেন এবং তাদের সুখ শান্তিতে রাখবার সবপ্রকার দায়িত্ব গ্রহণ করে তার বিনিময়ে যৎকিঞ্চিং কর (জিজিয়া) গ্রহণ করতে। অমুসলিমগণ পূর্বের রাজাকে যে কর দান করতে তার তুলনায় জিজিয়া কর অতি নগণ্য ছিল। এ অতি সত্য কথা যে, দুনিয়াতে এরূপ সংযমী ভদ্র রাজবিজেতা পূর্বে কোন কালে জন্মে নাই এবং এরূপ নম্র ও দয়ালু জাতি ইতিপূর্বে কখনও দেখা যায় নাই।”
ডাঃ জে. কে. কান্তি তার ‘স্পেনের ইতিহাস’ গ্রন্থে যা লিখেছেন তাতে জিজিয়া সম্বন্ধে কু-ধারণার পরিবর্তে সু-ধারণারই উদ্রেক হয় :
“সেই শর্ত যাহা পরাজিত জাতির নিকট জয়ী মুসলমানদের তরফ হইতে আদায় করা হইত তাহা এইরূপ ছিল, ইহাতে তাহাদের কোনরূপ কষ্টের পরিবর্তে বরং তাহাদের মনে পূর্ব শান্তি বিরাজ করিত। সুতরাং পরাজিত জাতি নিজের ভাগ্যকে যাহা পূর্বে ছিল তাহা বর্তমান অবস্থার সঙ্গে তুলনা করিয়া তাহারা বুঝিতে পারিল যে, মুসলিমদের স্পেনে আসা নিজেদের সৌভাগ্যের কারণ হইয়াছে। ধর্মকর্ম তাহারা স্বাধীনভাবে পালন করিতে এবং তাহারা নিজের ধন, মান, জীবন ও গর্জাগুলি রক্ষার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হইয়া শাস্তিতে জীবন যাপন করিত। তাহাদের এইসব সুখ বিজয়ী নীতির অনুগত হওয়ার ফলস্বরূপ ছিল এবং তাহাদের নিকট হইতে-যে জিজিয়া কর নেওয়া হইত তাহা খুবই সামান্য ছিল। কাজেই স্পেনের সব অমুসলিমদের মনে আরবীয়গণের প্রতি এ বিষয়ে পূর্ণ আস্থা জন্মিয়াছিল যে, তাহারা ন্যায় ও সত্যের দৃঢ় প্রতিষ্ঠাতা এবং বিচারের সময় তাহারা পক্ষপাতশুন্যভাবে ন্যায় বিচার করে।”
ভারতের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পণ্ডিত মাওলানা আবুল কালাম আজাদ দুঃখ করে লিখেছেন,
“পৃথিবীর সমস্ত ইতিহাস পড়াশুনার সুযােগ থাকা সত্ত্বেও ভারতের হিন্দু জনসাধারণ অনেকে জিজিয়া করকে বিরাট ভুল বুঝেছেন। আসলে এটা আসল তথ্যের অজ্ঞতা। (‘সলতানাতে দেহলী মে গায়ের মুসলিম’ গ্রন্থের ৬৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।
কনৌজের গহরাওয়ার বংশেও জিজিয়ার প্রচলন ছিল, সে দেশের ভাষায় তার নাম ছিল। ‘তুরশকী জনডা’, [Medieval Hindu India , p – 211]। তাছাড়া ভারতে ইসলাম আসার আগে রাজপুতদের মধ্যে ‘ফীকস’ কর আদায় হাত [Early History of india by Smith]। ডাঃ ত্রিপাঠির ধারণা, ফ্রান্সে যে জিজিয়া ছিল তার নাম ছিল ‘host tax’, আর জর্মানীতে যে জিজিয়া ছিল তার নাম ‘commonpiny’, এবং ইংল্যাণ্ডে এক প্রকার জিজিয়াসম কর ছিল তার নাম ‘scontage’। [Some Aspects of Muslim Administration : Sir Tripathy দ্রষ্টব্য]
অনেকে বলেছেন জিজিয়া কর পুনঃপ্রচলন করে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব অসহায় হিন্দু জাতির উপর নির্মম অত্যাচার করেছে, কিন্তু আমাদের বক্তব্য অন্য। হিন্দু প্রজাদের উপর অত্যাচার করার উদ্দেশ্যই যদি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের থাকত তাহলে তার দীর্ঘ ৫০ বছর ভারতে রাজত্ব করার পর দেশে সম্ভবতঃ আর একটি হিন্দুরও অস্তিত্ব থাকত না। শুধু মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবই নন, বরং মুসলমান রাজা বাদশাহগণ শত শত বছর বা সহস্র বছরের কাছাকাছি ধরে রাজত্ব করে গেছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও একটা জাতি তাদের অত্যাচারে ধ্বংস হয়ে যায়নি। অপর পক্ষে এই ভারতে এক ধর্মের চাপে অন্য ধর্ম, এক সম্প্রদায়ের চাপে অপর সম্প্রদায় প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যেমন হিন্দু ধর্মের চাপে বৌদ্ধ ধর্ম আজ বিলুপ্ত প্রায়। তাছাড়া অনেকের মতে ভারতের বহু স্বতন্ত্র জাতির অস্তিত্ব আজ লােপ পেয়েছে বা পেতে চলেছে, অথবা তারা নিজেদের হিন্দু বলেই পরিচয় দিয়ে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ জৈন, বৈষ্ণব, ব্রাহ্ম, সাঁওতাল ইত্যাদি সম্প্রদায়ের নাম উল্লেখযােগ্য। অতএব আওরঙ্গব অত্যাচারী ছিলেন অর্থাৎ তিনি হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন এ কথার প্রমাণ কোথায়?
সুবিখ্যাত ঐতিহাসিক কাফি খান বলেছেন, “আকবরের রাজত্বকাল অপেক্ষা তাহার (মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব) সময়ে হিন্দু রাজকর্মচারী সংখ্যায় বেশি ছিল। এছাড়া আরও বহু প্রমাণ ইতিপূর্বে পেশ করা হলেও প্রাসঙ্গিকতার কারণে এক্ষেত্রে আরও কিছু উদ্ধৃতির উল্লেখ করা গেল। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষ ভাগে আলেকজাণ্ডার হ্যামিলটন ভারতবর্ষ পরিদর্শন করতে এসে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সূক্ষ্মশাসন পদ্ধতি দেখে যা বলেছিলেন তা হচ্ছে এই – “Every one is free to serve and worship God in his own way.” অর্থাৎ প্রত্যেকেই কাজকর্মে এবং স্ব স্ব নিয়মে ঈশ্বরের উপাসনায় স্বাধীন) প্রমাণস্বরূপ আরও বলা যায়, আলমগীরের দরবারে বড় বড় পদে ও মর্যাদায় স্থান পেয়েছিলেন যথাক্রমে রাজা রাজরূপ, কবীর সিং, অর্ঘনাথ সিং, প্রেমদেব সিং, দিলীপ রায় প্রভৃতি ব্যক্তিগণ। রাজা রাজরূপ সিংহকে বাদশাহ এত বিশ্বাস করতেন যে, শ্রীরামপুরের রাজার বিরুদ্ধে গােটা যুদ্ধটাই তার অধীনে পরিচালিত হয়েছিল। কবীর সিং ছিলেন সম্রাটের বিশেষ লােক। আসামের যুদ্ধের জন্য প্রেমদেব সিংহকেই আওরঙ্গজের বাছাই করেছিলেন। দিলীপ রায় ছিলেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তি। এছাড়া পুলিশ বিভাগ, গুপ্তচর বিভাগ, রাজস্ব বিভাগ প্রভৃতিতে হিন্দু রাজকর্মচারির সংখ্যা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হােত। রাজস্ব বিভাগে মুন্সীর পদগুলাে হিন্দুদের একচেটিয়া ছিল বলা যায়। তার কারণও ছিল গুরুত্বপূর্ণ কর আদায়ের নামে যেন হিন্দু সম্প্রদায় কোনও ভাবে অত্যাচারিত না হয়—
“Most of the Munsis were Hindus and the proportion rapidly increased. The Hindus had made a monopoly of the lower ranks of the Revenue department.”
রসিকলাল ক্রোরী ছিলেন সম্রাটের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি এবং রাজস্ব বিভাগে সর্বোচ্চমানের পদাধিকারী। শুধু তাই নয়, বরং এমন কোন বিভাগ ছিল না যে বিভাগে সম্ভব সত্ত্বেও হিন্দু কর্মচারি নিয়ােগ করা হয়নি। এমনকি বাদশাহ আইন জারী করেছিলেন যে, প্রত্যেক বিভাগে হিন্দু কর্মচারি নিয়ােগ করা আব্যশক। অতএব তিনি সত্যই শুধু উদার নন বরং উদারতম মহান নৃপতি ছিলেন—এটাই আধুনিক বিশেষজ্ঞ এবং পুরাতন নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের সিদ্ধান্ত।
একটা প্রশ্ন থেকে যেতে পারে, তাহলে কি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের উপর সকলেই সন্তুষ্ট ছিলেন? তার উত্তরে পরিষ্কার ভাবেই বলা যেতে পারে যে, সকলেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার কারণও অবশ্য বিদ্যমান। রাজদরবারে যে সমস্ত গর্হিত বেআইনি কাজ চলে আসছিল এবং আকবর জাহাঙ্গীর প্রভৃতি বাদশাহ কর্তৃক যে সমস্ত বিষবৃক্ষ রােপণ করা হয়েছিল, যার ফলে সারা ভারতে ধর্মের নামে, আভিজাত্যের নামে, সংস্কৃতির নামে যত আগাছা গজিয়েছি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব একধার হতে তা উৎপাটন করাতে যাদের অসুবিধায় পড়তে হয়েছে তারাই অভিযোগ করেছেন। অবশ্য পরে নিজেদের ভুল বুঝে সর্বভারতীয় উন্নতি ও শাস্তি দেখে অনেককেই লজ্জা ও অনুতাপের ইন্ধন হতে হয়েছিল।
বাদশাহদের দরবারে ‘নওয়ােজ’ বলে একটা কুপ্রথার প্রচলন ছিল, যা ছিল শুধু বিলাসিতা ও অহঙ্কার প্রদর্শনের নামান্তর। আর রাজদরবারে রাজকর্মচারিদের মধ্যে মদের মর্যাদা এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে, চীনের আফিম খাওয়ার মত ভারতকেও ধ্বংস হতে হােত যদি না মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব কঠিন হাতে তা দমন করতেন। পক্ষান্তরে মন্দির তৈরি করার একটা হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। এক জায়গায় যেখানে একটা মন্দির যথেষ্ট সেখানে লাগালাগি দশ, বিশ, পঞ্চাশ, একশ’ করে মন্দির হতে লাগল। আর ধর্মের ঐ বাড়াবাড়ি দৃষ্টিকটু হবারই কথা। মসজিদের ক্ষেত্রেও সম্রাটের মত ছিল, বিনা প্রয়ােজনে অথবা যেখানে মসজিদ আছে যতক্ষণ পর্যন্ত সেই মসজিদে স্থান সংকুলান হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানে মসজিদ তৈরি করা যাবেনা। যেমন অস্বীকার করার করার উপায় নেই যে, মুর্শিদাবাদ জেলায় বাদশা নবাবদের কীর্তিসমূহ লক্ষ্য করলে দেখা যায় চারিদিকে শুধু মসজিদ। নিরপেক্ষ মর্তে এত মসজিদ দরকার ছিল না। কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, স্থান সংকুলান হােন বলেই হয়তাে সে যুগে এত মসজিদের প্রয়ােজনীয়তা ছিল। কিন্তু ঘটনা মােটেই অ নয়, কারণ স্থান সংকুলান না হলে মসজিদকে বাড়িয়ে প্রয়ােজন মত লম্বা, চওড়া ওবহুতল করলেই তাে চলতাে। শুধু শুধু সংখ্যায় ছােট ছােট অনেক মসজিদ আর কারুকার্যের এত ছড়াছড়ির কোন সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। অনুরূপভাবে মন্দিরও। এই পশ্চিমবঙ্গে একই স্থানে দু চারটে নয়, বর্ধমান শহরের পাশে ছােট ছােট, গায়ে গায়ে লাগানাে ১০৮টি মন্দিরও দেখা গেছে। মন্দিরের ক্ষেত্রে স্থান সংকুলানের তাে প্রশ্নই উঠতে পারে না, কারণ মন্দিরের ভিতরে পুরােহিত বা ব্রাহ্মণ ছাড়া জনসাধারণের প্রবেশাধিকার পূর্বেও ছিল না আর এখনও নেই। ভবিষ্যতে কী হবে তা অবশ্য বলা যায় না।
বেনারসের শাসনকর্তা মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে গােপনে একটা পত্র পাঠিয়েছিলেন। তাতে অনুমতি চাওয়া হয়েছিল-
“বেনারস একটা হিন্দুদের ধর্মীয় ঘাঁটি, উচ্চশ্রেণী ও নিম্নশ্রেণী প্রত্যেকে মনে করে সমস্ত উন্নতির কুঞ্জী ঐ মন্দিরেই দেবতার হাতে আছে। মন্দিরের নিত্য নূতন নির্মাণ ব্যবস্থা বিদ্যমান এবং বহু অর্থব্যয়ে তাহাতে কারুকার্য করা চলিতেছে, যেন শেষ নাই। এক মন্দির অপর মন্দিরের সঙ্গে পাল্লা দিয়া জিতিতে চাহে। যদি এখানে এই মন্দিরের পুরােহিত বা ব্রাহ্মণদের উপর কিছু শক্তি প্রয়ােগ করা হয় তাহা ঠিক হইবে কিনা? তবে এখানে কেহ কেহ মনে করেন ব্রাহ্মণদের উপাসনাভিত্তি শিথিল করিতে পারিলে লােকে আমাদের ইসলাম ধর্মের দিকে আর্কষিত হইতে পারে………..।”
তার উত্তরে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব যে পত্র দিয়েছিলেন তা উল্লেখযােগ্য এবং লক্ষ্যণীয়,
“….প্রজাদের উপকার সাধন এবং নিম্ন সকল সম্প্রদায়ের উন্নতি সাধন আমাদের দৃঢ় উদ্দেশ্য। সেইহেতু আমাদের পবিত্র আইন অনুসারে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছি যে, পুরাতন মন্দিরগুলি বিনষ্ট করা হইবে না কিন্তু নূতন কিছু সৃষ্টি করাও চলিবে না। …..কোন লােক অন্যায় ভাবে ব্রাহ্মণ অথবা তাহাদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ অথবা তাহাদের উপর কোন হামলা করিতে পারিবে না। তাহারা যেন পূর্বের ন্যায় স্ব স্ব কার্যে নিযুক্ত থাকিতে পারে এবং আমাদের আল্লাহ প্রদত্ত সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্য সুস্থ মনে প্রার্থনা করিতে পারে।” [‘ওয়াকেয়ায়ে আলমগীরী’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য]
যাইহোক, এরকম উদার ও ন্যায়বান সম্রাট আলমগীরকে জিজিয়া করের পুনঃপ্রবর্তনকারী গোঁড়া হিন্দু বিদ্বেষী মুসলমান বলে চিত্রিত করে যারা ইতিহাসের পাতাকে কলঙ্কিত করেছেন ইতিহাস তাদের কিভাবে গ্রহণ করবে তা দেখার বিষয়।
[৩] তার অযােগ্যতাই মােগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ বলে যে অভিযােগ বা অপবাদটি যােগ্য সম্রাট মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার অসারতা প্রমাণে পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব অযােগ্য তাে ছিলেনই না বরং তার মােগ্যতাই দ্রুত পতনােম্মুখ মােগল সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের হাত থেকে অব্যর্থভাবে রক্ষা করেছে। অতএব মােগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধােগ্যতা মােটেই নয় বরং কারণ অন্যবিধ। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পরবর্তীগণের আলােচনায় তা পরিস্ফুট হবে। তাছাড়া তিনি অযােগ্য হলে তার পক্ষে এই বিশাল ভারতবর্ষকে অর্ধশতাব্দী ধরে পরিচালনা করা অসম্ভব হােত বরং এই কৃতিত্বই তার চরম যােগ্যতাকে আর অব্যর্থভাবে প্রমাণিত করে। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ অনেকে তাকে এ ব্যাপারে দায়ী করলেও মােগল যুগের সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণ, মুল ইতিহাসের পুরনাে পাতা ও বর্তমানের সত্য সন্ধানী গবেষকগণ তাকে মােটেই দায়ী করেন না।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সম্বন্ধে যত মিথ্যা, অপপ্রচার, কুৎসা ও প্রচণ্ড নিন্দার কাসুন্দি তৈরি করা হয়েছে তা আর কারাের জন্য পরিমাণে এত নয়। যা ঘটে তাই ঘটনা, আর তারই নাম ইতিহাস। আর যা ঘটেনা শুধু রটে, তা ঘটনা নয় রটনা—তাকে ইতিহাস না বলে ত্রুটিহাস বলা ভাল। ঐ প্রথায় মনিবের হুকুমের তাবেদারী করে অথবা মাতালদের মাতলামীর মালসামান জুগিয়ে রুটি ও রুজি হাসিল করা যায়, তা দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না।
সম্রাট মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীর শুধু অনুমানদের উপর অত্যাচার করেছিলেন এই চিত্রই তাে আমরা বর্তমান ইতিহাসে পেয়েছি। কিন্তু তিনি যে কত উদার, ন্যায়পরায়ণ ও নিজ ধর্মকর্মে অটল ছিলেন সে কথা তাে আমরা ঐ সব ইতিহাসে সহজে পাইনি। তার জীবনের ঐতিহাসিক অনেক ঘটনা এমন আছে যা আজও সূক্ষ্মদর্শীদের স্তম্ভিত করে, যেগুলাে আজও মূল ইতিহাসের পাতাকে স্বর্ণোজ্জ্বল করে রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ একটি জনশ্রুতির উল্লেখ করা হচ্ছে।
একদিন সম্রাট আলমগীরের সৈন্যবাহিনী একজন মুসলমান সেনাপতির অধীনে পাঞ্জাবের এক পল্লীব মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পথে জনৈক ব্রাহ্মণের এক অপরূপ সুন্দরী কন্যার প্রস্ফুটিত গােলাপের মত মুখশ্রী দেখে লােভাতুর সেনাপতি তার পিতার নিকট মেয়েটিকে বিবাহের প্রস্তাব দেন এবং সিদ্ধান্ত জারী করেন যে, আজ থেকে এক মাস পরেই তিনি তার বাড়ীতে বর বেশে উপস্থিত হবেন।
কন্যার পিতা স্বয়ং আলমগীরের শরণাপন্ন হলেন এবং তাকে সমস্ত ঘটনাটা বলে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সম্রাট তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, যাও, নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যাও। নির্দিষ্ট দিনে আমি তােমার বাড়িতে উপস্থিত থাকবে। ব্রাহ্মণ নানা চিন্তার ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। সত্যিই কি সম্রাট স্বয়ং আসবেন? না তাঁর পক্ষ হতে কোন প্রতিনিধি পাঠাবেন? আর যদি সত্যিই তিনি আসেন তবে সঙ্গে নিশ্চয়ই লােকলস্কর, হাতি-ঘােড়া কম আসবে ! তাঁদের থাকতে দেবেন কোথায় ইত্যাদি অনেক চিন্তা।
অবশেষে সমস্ত চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বিবাহের আগেরদিন সম্রাট আলমগীর একাই এসে উপস্থিত হলেন ব্রাহ্মণের বাড়িতে। ব্রাহ্মণ হতবাক! সম্রাট ঐ দরিদ্র ব্রাহ্মণের এক জীর্ণ কামরায় সারা রাত এবাদত-উপাসনা ও মােনাজাত-প্রার্থনায় অশ্রুবিসর্জন করে কাটালেন। ব্রাহ্মণের পরিবারবর্গ অবাক-ইনি কাঁদছেন কেন? এর কিসের অভাব? প্রশ্নের উত্তর তাঁরা পেলেন না, আর সাহস করে জিজ্ঞাসা করতেও পারলেন না। যাইহােক, পরদিন মােগল সেনাপতি বর বেশে ব্রাহ্মণের ঘরে উপস্থিত হলেন। বললেন, ‘বিবাহের পর্বে আপনার কন্যাকে একবার দেখা উত্তম। আপনার কন্যা কোথায়?’ ব্রাহ্মণ সম্রাটের শেখানাে অনুযায়ী সম্রাটের কামরার দিকে ইশারা করলেন। সেনাপতি ঘরে প্রবেশ করেই দেখলেন খােলা তরবারি হাতে সম্রাট আলমগীর স্বয়ং। উদভ্রান্ত যৌবনের বুক ভরা আবেগ আর মুখভরা হাসি নিমেষেই উবে গেল। যে সেনাপতির দাপটে শত্রু সৈন্য থরথর করে কাপে, যাঁর হৃদয়ে ভয় ভীতি অথবা দুর্বলতা কখনও স্থান হয় না, আজ সই হৃদয় কালবৈশাখী ঝড়ের মত ভীষণ শব্দে যেন কেঁপে উঠলাে। নিজেকে সামলে নিয়ে ক্ষমা চাইবার চেষ্টা করলেন কিন্তু দুঃখ, লজ্জা, শান্তি আর অপমানের আশঙ্কায় জ্ঞানহারা হয়ে বলিষ্ঠদেহ সেনাপতি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। কন্যার পিতা সম্রাট অগীরের সুবিচার, দায়িত্ববােধ আর অসাম্প্রদায়িক ভূমিকা দেখে আনন্দে রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বললেন, আপনি আমার, বিশেষ করে আমার কন্যার ইজ্জত রক্ষা করেছেন। আপনার এই ঋণ অপরিশােধ্য। সম্রাট ব্রাহ্মণকে বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করে বললেন, ভাই এই মহান দায়িত্ব আমার। আমি যে আমার দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পেরেছি এতেই আমি ধন্য।
সম্রাট আলমগীর আজ নেই সত্য, কিন্তু তাঁর মহিমান্বিত অমর কীর্তি মৃতুঞ্জয়ী হয়ে রয়েছে ঐ গ্রামের অণু পরমাণুতে। ঐ ঘটনার পরই ঐ পল্লীর নামকরণ হয় আলমগীর।
এমনই এক মহৎ ও উদার চরিত্রের সম্রাটকে ইতিহাসে নিঃসঙ্কোচে হিন্দু বিদ্বেষী বলে চিত্রিত করতে ঐতিহাসিকদের কলম এতটুকু কেঁপে ওঠেনি?
আজও ঐতিহাসিক বালাজী মন্দির বা বিষ্ণু মন্দির যেটা চিত্রকুটের রামঘাটের উত্তর দিকে অবস্থিত, সেই মন্দিরে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে লােখা আছে– “সম্রাট মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব নির্মিত বালাজী মন্দির”। কোন মুসলিমের মূর্তিপূজায় অংশ গ্রহণ, মূর্তি বা মন্দির নির্মাণে নিষেধ আছে কিন্তু যখন হিন্দুপ্রজা বা সংখ্যালঘু প্রজাদের মন্দির কোনরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন তাদের ধর্মরক্ষার দায়িত্ব মুসলমান বাদশাহের উপরেও পড়ে। যদি পচা ইতিহাসের পােকাটে পাতায় ইতিহাসের সব তথ্য সত্য আছে বলে কেউ দৃঢ় মনে বিশ্বাস করুেন তাহলে কিছু বলার নেই। নচেৎ অনুরােধ করব হিন্দু তীর্থস্থান বারানসী ধামে গিয়ে দেখুন, সেখানে বহু পুরান মন্দিরের রক্ষক ও স্বাধিকারীদের নিকট সংরক্ষিত সম্রাট মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলের বহু ফরমান বা দলিল দেখে অবাক হতে হবে যে, মিথ্যা অভিযােগে অভিযুক্ত হিন্দু বিদ্বেষী মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব হিন্দু-মন্দির সমূহের সাকল্পে জায়গীর স্বরূপ প্রচুর সম্পত্তি দিয়েছিলেন।
“এই প্রকার কাশ্মীর প্রদেশে হিন্দুমন্দির রক্ষার্থে বাদশাহ কর্তৃক যে সমস্ত জমি বৃত্তিদান করা হইয়াছে সেই ফরমান দেখিয়া অবগত হওয়া যায় যে, তাহার মধ্যে অধিকাংশ সমানে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নাম অঙ্কিত রহিয়াছে।” (দ্রষ্টব্য Islam and civilization)
বেনারস বা কাশীতে কয়েকজন নবদীক্ষিত মুসলমান অতিভক্তির নামে হিন্দুমন্দির ও পূজারীদের কিছু ক্ষতি করেছিল। সংবাদ পেয়ে সম্রাট ক্ষতিপূরণ স্বরূপ প্রচুর অর্থ এবং স্থায়িত্বের জন্য একটি ফরমান জারী করেন। অনুসন্ধিৎসু পাঠক-পাঠিকাদের জন্য তার বঙ্গানুবাদটি এখানে উল্লেখ করছি –
“প্রজাদের মঙ্গলার্থে ব্যথিত হৃদয়ে আমন্বঘােষণা করছি যে, আমাদের ছােট বড় প্রত্যেক প্রজা পরস্পর শান্তি ও একতার সঙ্গে বাস করবে। এবং ইসলামী বিধান অনুযায়ী আরও ঘােষণা করছি যে, হিন্দুদের উপন্যালয়গুলাের রক্ষণাবেক্ষণ বা তত্ত্বাবধান করা হবে। যেহেতু আমাদের কাছে আকস্মিক সংবাদ পৌঁছেছে যে, কতিপয় লােক আমাদের বারানসী ধামে অবস্থিত হিন্দু প্রজাগণের সঙ্গে অসম্মানসূচক নিষ্ঠুর ব্যবহার করতে ও ব্রাহ্মণকে তাদের প্রাচীন ন্যায়সংগত উপাস্যর অধিকারে বাধা দিতে মনস্থ করেছে এবং আরও আমাদের কাছে জানানাে হয়েছে যে, এই সমস্ত অত্যাচারের ফলে তাদের মনে দারুণ দুঃখ, ক্ষোভ ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হচ্ছে। অতএব আমরা এই ফরমান প্রকাশ করছি এবং এটা সাম্রাজ্যের সর্বত্র জানিয়ে দেওয়া হােক যে এই ফরমান (অর্ডিন্যান্স) জারী হওয়ার তারিখ হতে কোন ব্রাহ্মণকে যেন তাঁর উপাসনার কাজে বাধা দান বা কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না করা হয়। আমাদের হিন্দু প্রজাগণ যেন শান্তির সঙ্গে বাস করতে পারেন এবং আমাদের সৌভাগ্য ও উন্নতির জন্য আশীর্বাদ করেন।” [ইসলামিক রিভিউ দ্রষ্টব্য]
আজ যে সাম্যবাদ সারা বিশ্বের মানুষের মস্তকে আলােড়ন সৃষ্টি করেছে, যে সাম্যবাদের অভিনব বন্যায় পৃথিবীর পুরাতন সব ঐতিহাসিক রাজা বাদশাহ ও তাঁদের শাসননীতি, ধর্মনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি মধ্যযুগের অসভ্যতা বলে অনেকের ধারণা হয়েছে। কার্ল মার্ক্সের যে নূতন চিন্তাধারা নূতন পথ আর পাথেয় দান করে পৃথিবীকে রক্ষা করতে উপস্থিত হয়েছে সে সম্বন্ধে আজ প্রমাণিত সত্য কথা এই যে, মুসলমান রাজা বাদশাহদের উদার ব্যবহার, অর্থনৈতিক নীতি আর সাম্যবাদের কথাই বর্ণনা করে গেছেন বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও ফরাসী পর্যটক বার্নিয়ের এবং ভার্নিয়ের। তাদের লেখা হতে না যায়, শাহজাহানের প্রখ্যাত পুত্র মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সাম্যবাদ, অর্থনীতি ও শাসননীতি এত সুন্দর ছিল যে তা যে কোন নিরপেক্ষ মানুষের মনকে আনন্দে এবং বিস্ময়ে অভিভূত করে। কার্ল মার্ক্স ইতিহাসের ঐ অধ্যায় পড়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত হয়ে গিয়েছিলেন। কার্ল মার্ক্স এও বুঝেছিলেন, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বের যত বৈশিষ্ট্য সবই কিন্তু ইসলামধর্ম তথা কুরআন ও হাদীসের; কারণ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব কুরআন বিরােধী কোন কাজ করতে কোন দিনই ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি এই সঙ্গে আরও বুঝেছিলেন, যে মুসলমান বাদশা যত অন্যায় করেছেন তিনি ততাে কুরআনের নীতি থেকে দূরে ছিলেন—তাই আজ কার্লমার্ক্সের কমিউনিজম বৃক্ষেও ইসলামী ফল, ফুল, আর লতা পাতার সৌন্দর্য বেশ কিছু পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু সৌন্দর্যমণ্ডিত এই বৃক্ষটি সুস্থ ধর্মীয় সমাজে গ্রহণযােগ্য হয়ে ওঠে নি। তার নাস্তিকতা নীতি—এই নীতিই যেন বৃক্ষটির শিকড় ও মূল কেটে দিয়েছে। যদি নাস্তিকতা নীতির পরিবর্তন করে কোন নূতন নেতা সাম্যবাদকে পরিবেশন করতে এগিয়ে আসেন তাহলে আজ যে মুসলমান ওলামা মুফতিগণ দূরে দাঁড়িয়ে ভাবছেন তারা বেশির ভাগই ঝাঁপিয়ে পড়বেন সারা বিশ্বে ঐ নীতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে—এ বিষেয় সন্দেহ নেই।
সম্রাট মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ন্যায়নীতিতে মার্ক্স যে মুগ্ধ হয়েছিলেন তা শ্রীবিনয় ঘােষকেও কিঞ্চিৎ স্বীকার করতে হয়েছে। তিনি লিখেছেন,
“বার্নিয়েরের বিশ্লেষণ পাঠ করিয়া কার্লমার্ক্সের মত মনীষীও মুগ্ধ হইয়াছিলেন।” [ভারতজনের ইতিহাস, ৪৮০ পৃষ্ঠা, বিনয় ঘােষ]
মুসলমান যুগের মূল ইতিহাস মূলতঃ ফারসী, আরবী উর্দুতে। সেই যুগের ঔরঙ্গাবাদের ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ কাসিমের লেখা ‘আহওয়াল-উন-খাওয়াকীন’ গ্রন্থে উদ্ধৃত মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের একটি মূল্যবান উক্তি তার সম্বন্ধে আমাদের পুরনাে কু-ধারণার সমাধি সৃষ্টিতে যথেষ্ট হবে আশা করা যায়।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ধর্মমত বিরােধী উপযুক্ত শাহী কর্মীকে সদরবখশী পদে যাকে বসিয়েছিলেন তিনি ছিলেন শিয়া। অথচ সম্রাট অত্যন্ত বেশি শিয়া মতের বিরােধী ছিলেন। আমিন বা তাকে ঐ পদ হতে অপসারণের দাবী জানান। তার যুক্তি ছিল, ধর্মের নীতিতে সম্রাটের সঙ্গে তার সম্পূর্ণ পার্থক্য রয়েছে, সুতরাং তাকে না সরালে ধর্মের ক্ষতি হবে। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তার উত্তরে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন,
“পার্থিব যােগ্যতা ও প্রয়ােজনকে দেখেই তার ঐ নির্বাচন, এখানে ধর্মের সঙ্গে জাগতিক ব্যাপারের সম্পর্ক কোথায়?” প্রশাসনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় ভণ্ডামির তিনি বিরােধী। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, আপনার এই নিয়ম যদি সত্যই আমাকে গ্রহণ করতে হয় তাহলে প্রতিটি [অমুসলমান] রাজা ও তাদের সমর্থকদের অপসারণ করা কি আমার কর্তব্য হবে না? [দ্রষ্টব্য : স্যার যদুনাথ সরকারের আখান-ই-আলমগীরী ও অধ্যাপক সতীশচন্দ্রের লেখা মােগল দরবারে দল ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা ৫৫,টীকা২৭, ১৯৭৮]
মােগল আমলে ফৌজদারি মামলার বিচারের জন্য হিন্দু ও মুসলমানদের কোর্টে আসার প্রথা ছিল। কিন্তু জমি জায়গা, উত্তরাধিকারীর সম্পদ বন্টন, সাংসারিক বিবাদ প্রভৃতির বিচার শুধুমাত্র হিন্দুদের জন্য হিন্দু আইন অনুযায়ী পঞ্চায়েতের মাধ্যমে হােত। এবং ঐ পঞ্চায়েত প্রথা মুসলিম শাসনের পর ইংরেজ আমলেও পুরােপুরি ভাবে ছিল, বর্তমানে আমাদের দেশেও তার অস্তিত্ব পরিদৃষ্ট হচ্ছে। অতএব এখানেও লক্ষণীয় বিষয় হােল, তখন কিভাবে হিন্দু আইন অনুযায়ী হিন্দু প্রজাদের বিচারের ব্যবস্থা হােত তা আজ চির বিষয় সন্দেহ নেই।
হিন্দুপ্রীতির প্রমাণস্বরূপ আকবরের জন্য একটা সুনাম আছে যে, তিনি বড় বড় পদে হিন্দু ও রাজপূত কর্মীদের নিয়ােগ করতে। অবশ্য একথাও ঠিক যে আকবর ১৪ জন হিন্দুকে বিখ্যাত ‘মনবদার’ পদে নিযুক্ত করেছিলেন [দ্রষ্টব্য ‘আইন ই-আকবরী’]। কিন্তু খুব মজার কথা হােল, ঐ যে মনসবদারের বিরাট পদ, তাতে কি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব কোন হিন্দুকে নিয়োেগ করেননি? হ্যাঁ, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবও ঐ বিখ্যাত পদে হিন্দুদের নিয়ােগ করেছিলেন। তবে আকবরের সঙ্গে পার্থক্য এইটুকু ছিল যে, আকবর চোদ্দ জন হিন্দুকে ঐ উচ্চ পদ দিয়েছিলেন আর মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব দিয়েছিলেন মাত্র একশ আটচল্লিশ জনকে। [দ্রষ্টব্য শ্রীশৰ্মার লেখা মােগল গভর্ণমেন্ট, পৃষ্ঠা ১১১]
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।