লিখেছেনঃ মুহম্মদ ইউসুফ সিদ্দিক

সরিয়ত অনল পবন তরিকত ।
হাকিকত জল হয় ভূমি মারফত।।
অনলেতে বায়ু হৈল বায়ু হইতে জল।
জল হইতে জন্ম হৈল মৃত্তিকা সকল।।
সরিয়ত হইতে জন্ম হয় মারফত।
মারফত হইতে জন্ম হয় সরিয়ত।।
বৃক্ষ হন্তে ফল হয়, ফল হন্তে গাছ।
ডিম্ব হয় মিন হন্তে ডিম্ব হইতে মাছ।।
পক্ষী হন্তে ডিম্ব হয় ডিম্ব হইতে পক্ষী।
তত্ত্ব মূল সর্ব্ব এক বুঝ তার সাক্ষী।।
সরিয়ত মারফত এ চারি প্রকার।
চারি দিকে চারি দ্বার গৃহ এক সার ।।
চারি দিকে চারি পন্থ একই নগর।
চারি দিকে চারি ঘাট একই সরোবর।।
কর্ণ নাসা চক্ষু মুখ পন্থ হয় চারি।
জনান্তরে এক মন নৃপ অধিকারী।।
সরিয়ত মারফত কিছু নহে ভিন।
চারি গাছে এক ফল সার মূলে চিন।।
কদাচিত নহে জান চতুর্থ প্রকার।
সরিয়ত মারফত মূলে এক পার।।
সাহা কেয়া মদ্দিন গুরু সর্ব্ব লক্ষ সার।
হিন আলি রাজা কহে আগাম পয়ার।।
খর্ব ছন্দ রাগ বসন্ত
সরিয়ত মারফত এ চারি প্রকার।
চারি দিকে চারি ডাল বৃক্ষ এক সার।।
চারি মত শাস্ত্র এক ঈশ্বর চিনিতে।
সহরেত চারি পন্থ নৃপতি চলিতে।।
![প্রত্নলিপি, বাঙালি, বাঙালিয়ানা ও বাংলায় ইসলাম: কিছু জিজ্ঞাসা [পর্ব ১]](http://nobojagaran.com/wp-content/uploads/2023/07/2.png)
মাছ থেকে ডিম হয়, ডিম থেকে মাছ।।
ডিম থেকে পাখি হয়, পাখি থেকে ডিম।
পরম সত্য হল সবই এক, সব কিছু তার সাক্ষী।।
শরী‘আহ বল আর মারেফা বল, মূলত চার প্রকার।
একটি বাড়ির যেমন চারটি দরজা, সবগুলো ঢোকার পথ ।।
পৃষ্ঠা: ২৪ এর ৭ থেকে ১২ চরণগুলোর আধুনিক বাংলায় রূপান্তরিত ভাবানুবাদ
ভূ-ভাগ
বাংলার পুঁথি সাহিত্যে এ ধরনের আধ্যাত্মিক ভাবসমৃদ্ধ কাব্যিক চরণ প্রায়ই পাওয়া যায়।1 বাংলার গ্রামীণ সমাজে পয়ার ছন্দে লেখা এ ধরনের মরমি কাব্য উনিশ শতকের শেষ দিক পর্যন্ত খুবই জনপ্রিয় ছিল। আধ্যাত্মিক ভাবসমৃদ্ধ কাব্যিক চরণে লেখা বাংলার পুরানো দিনের পুঁথি সাহিত্যে সে সময়ের বহুত্ববাদ, সামাজিক সম্প্রীতি, সাম্প্রদায়িক সহিষ্ণুতা ও রকমারি ধর্মীয় মতবাদের বৈচিত্রে ভরপুর এক সুজলা সুফলা বাংলার চিত্র ফুটে উঠে, যেখানে বাঙ্গালীর সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল যে সে সবার আগে মানুষ। সে মানুষের মত পার্থক্য থাকতেই পারে, সৃষ্টির রহস্য অনুধাবনে তার চেষ্টার পথ ও ধর্ম পার্শ্বের মানুষটি থেকে ভিন্নতরও হতে পারে! সেটাই তো স্বাভাবিক, এবং প্রাকৃতিক। ‘আগাম ’ পুঁথির লেখক আলী রাজা মনে হয় যেন সেরকমই কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন যখন তিনি লিখেছিলেন: “চারি মত, শাস্ত্র এক, ঈশ্বর চিনিতে। সহরেত চারি পন্থ নৃপতি চলিতে”। মধ্যযুগীয় বাংলার লোকসাহিত্যের এই কবিতার চরণগুলোর মতোই বাংলায় ইসলামের প্রথম আবির্ভাব এবং বিকাশও কিছুটা কুয়াশাচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট। এর সত্যিকার ইতিহাস নানাবিধ কিংবদন্তি, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস, ইতিহাসের উত্থান-পতন ও সামাজিক জটিল বিবর্তনের মধ্যে লুকিয়ে আছে, যার সত্য রূপ উদ্ঘাটন করার জন্য ঐতিহাসিকদের এখনো বহু পথ অতিক্রম করতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে যে দেশটি ইউরোপীয় বিবরণে ‘বেঙ্গল’ বা ‘বেঙ্গাল’, আরবী-ফার্সী-উর্দুতে ‘বাঙ্গাল’ এবং বাংলা ভাষায় ‘বঙ্গদেশ’ বা ‘বাংলা দেশ’ নামে আজ পরিচিত, সেটি ২৭০ থেকে ২১০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২.৫০০ থেকে ৮৭০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।

ঐতিহাসিকভাবে মুঘল পূর্বোত্তর যুগে এই এলাকার নানা ধরনের বিচিত্র ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠির মানষপটে দক্ষিণ এশিয়া (তথা উপমহাদেশ) ভিত্তিক কোন ধরনের ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক, দেশাত্মবোধক (প্যাট্রিয়টিজম) কিংবা জাতিয়তাবাদী (ন্যাশান্যালিজম) মনোভাবের কোন বিকাশ ঘটেনি। সে সময়ের প্রেক্ষিতে তেমনটি হওয়ার ও কথা না, কেননা দেশ, জাতি, সমাজ, সংস্কৃতি ইত্যাদি ধরনের বর্তমান কালের সংজ্ঞাগুলোর সঙ্গে সাধারন মানুষের জানাশোনা সেকালে স্বভাবতই গড়ে উঠেনি। সর্বোপরি এসব আধুনিক সংজ্ঞাগুলোর ব্যাবহার সে সময়ে বর্ত্তমান কালের অর্থে কখনই হত না। বরং এগুলো খুব সীমিত ও সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যাবহার হত যার ছাপ গ্রাম বাংলার কথ্য ভাষায় কোথাও কোথাও এখনও রয়ে গেছে। এখনও পূর্ব বঙ্গের দূরবর্ত্তী গ্রামগুলোতে যখন সাধারন মানুষরা বলে ‘আপনাগো দ্যাশ কই?’, কিংবা ‘আমাগো দ্যাশের মানুশ’, তখন ‘দ্যাশ’ বলতে এই সহজ ও সরল গ্রামবাসীদের মানসপটে তাদের ভালবাসার সেই নিভৃত বাঙালি পল্লীর কল্পনা ফুটে উঠে, যাকে কেন্দ্র করে তাদের মনের ভূবনটি গড়ে উঠে। এতদসত্ত্বেও বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক স্বকিয়তাকে ঘিরে একধরনের ক্ষীণ চেতনা সপ্তম শতাব্দির শুরুতে গৌড়েশ্বর মহারাজা শশাঙ্কের শাসনামল থেকে জাগ্রত হতে শুরু করে, যা পাল ও সেন আমলে আরও বিকাশ লাভ করে। ১২০৫ সালে বখয়িতার খিলজীর গৌড় বিজয়ের পর বাংলার মুসলিম শাসকরাও ধীরে ধীরে অঞ্চলটিতে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ে তোলে এবং সুলতান উপাধি ব্যবহার করতে শুরু করে। এই স্বাধীন সুলতানদের শাসনামলে অঞ্চলটিতে একদিকে যেমন ইসলামি সভ্যতার প্রসার ঘটতে শুরু করে, অন্যদিকে বঙ্গীয় আত্মপরিচয়ের ধারনাটিও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। মালদা জেলার পিছলি গঙ্গারামপুরের একটি ধর্মীয় স্থাপত্যের শিলালিপিতে (তারিখ: ৮৮১ হিজরী/ ১৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ) বাঙালি জাতি বোঝাতে ‘আহল আল-বঙ্গ’ (বঙ্গবাসী) শব্দবন্ধনটি ব্যবহার করা হয়েছে। সুলতান জালাল আল-দীন মুহম্মদ শাহ (তারিখ: ৮২১-৩৭ হিজরী/ ১৪১৮-৩৩ খ্রিস্টাব্দ) এবং তাঁর পরবর্ত্তী শাসক শামস আল-দীন আহমদ শাহ (তারিখ: ৮৩৭ হিজরী/ ১৪৩৩-৩৪ খ্রিস্টাব্দ) তাঁদের কয়েকটি মুদ্রায় আবার ‘দাখিল-বাঙ্গালিয়া’ (বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে) শব্দবন্ধনটি ব্যবহার করেছেন।2 সুলতান শাম্স আল-দীন ফীরূয শাহের একটি মুদ্রায় নামটির আগে একটি বিশেষ সম্মানসূচক বিশেষন ব্যবহার করে অঞ্চলটিকে ‘হাদ্বরাত বঙ্গ’ (পূণ্যভূমি বঙ্গ) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।3 ‘বঙ্গ’ নামটির সঙ্গে মুসলিম শাসকরা একেবারে গোড়াগুড়ি থেকেই পরিচিত ছিলেন। ঐতিহাসিক মিনহাজ আল-দীন সিরাজ তাবাকাত–ই–নাসিরী বইয়ে এটিকে ‘বিলাদে বঙ্গ’ বা বঙ্গদেশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার বেশ কিছুকাল পরে মুসলিম শাসকরা ক্রমশ পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব দিকের এলাকাগুলো জয় করতে প্রয়াসী হন, যা সে সময়ে ‘বঙ্গ’ নামে পরিচিত ছিল। এ এলাকাতে একটি নতুন রাজধানীও গড়ে ওঠে যা সোনারগাঁ নামে পরিচিত। পঞ্চদশ শতাব্দীর কোন এক পর্যায়ে ‘বঙ্গ’ নামটি ক্রমশ বাংলার বৃহত্তর এলাকার জন্য ব্যবহৃত হতে শুরু করে।
বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলার পূর্বাঞ্চল, কুমিল্লা জেলা ও সিলেট (ইবনে বাত্তুতার বর্ণনা অনুযায়ী ‘হাবানাক’, অন্যান্য ইসলামী সূত্রানুযায়ী ‘সুকনাত’ এবং সংস্কৃত ভাষায় ‘শ্রীহট্ট’ নামে পরিচিত) জেলা এবং পূর্ব ভারতের বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্য প্রাচীন যুগে ‘সমতট’ নামে পরিচিত ছিল। বাংলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, যা আত্রাই নদীর পশ্চিম থেকে গঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত একটি উঁচু অঞ্চল ছিল, তা আদি যুগে ‘গৌড়’ নামে অধিক পরিচিত ছিল। তবে পরবর্তীতে গৌড় নামটি এ অঞ্চলের রাজধানীর জন্য বিশেষভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। সংস্কৃত ও প্রাচীন বাংলা ভাষায় পরবর্তীকালে অপেক্ষাকৃত এই উঁচু ভূভাগটি ‘বরেন্দ্রভূমি’ বা ‘বরিন্দ’ নামে অধিক পরিচিতি লাভ করে। প্রাথমিক ফার্সী সূত্রগুলোতে (যেমন মাওলানা মিনহাজ আল-দীন ওসমান সিরাজ আল-দীন প্রণীত তাবাকাত–ই–নাসিরী বইয়ে)4 এই অঞ্চলটিকে ‘বারিন্দ’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূভাগ হওয়ায় এ এলাকাটিতে প্রবেশ করা মুসলমানদের জন্য সহজ হয়েছিল এবং বিজয়ের পর প্রথম দিকে মুসলমানরা এ এলাকায় বসবাস করতে শুরু করে। হুগলী-ভাগীরথী নদীর পশ্চিম দিকের অঞ্চলটি সাধারণত ‘রাঢ়’ নামে পরিচিত ছিল এবং মাওলানা সিরাজ আল-দীন তাবাকাত–ই–নাসিরী বইয়ে এই নামটিই ব্যবহার করেছেন। রাঢ়ের উত্তরাঞ্চল বেশিরভাগ সময়ে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আগত মুসলিম সেনাবাহিনীর স্থল অভিযানের প্রবেশ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হত। অন্যদিকে প্রাচীন তাম্রলিপ্তি বন্দর শহরটি রাঢ় অঞ্চলের দক্ষিণ প্রান্তের উপকূলে গড়ে ওঠে।
বাংলার পূর্বের এলাকাটি প্রাচীন যুগে সমতট নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। দক্ষিণ বাংলা, যেমন: সুন্দরবন, খুলনা ও তৎসন্নিহিত এলাকাগুলো ‘বঙ্গ’ নামে অধিক পরিচিত ছিল, যার মধ্যে এক সময়ে চন্দ্রদ্বীপ নামক রাজ্যটিও ছিল। কেশব সেন, বিশ্বরূপ সেন ইত্যাদি সেন বংশীয় রাজাদের কিছু কিছু শিলালিপির দ্বারা প্রমাণিত হয় যে বিক্রমপুর এলাকাটি বঙ্গের অংশ ছিল। আবার একেবারে দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাগুলো ‘হরিকেল’ নামে পরিচিত ছিল। প্রথম দিকে মোটামুটি চট্টগ্রাম ও তৎসংলগ্ন এলাকাগুলো, এবং পরবর্তীকালে সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাটি এর অন্তর্ভুক্ত হয়।5 মুসলিম ভূগোলবিদরা অবশ্য এ অঞ্চলটিকে ‘হারকান্দ’ নামে উল্লেখ করেছেন। এই নাম থেকেই উৎপত্তি হয়েছিল ‘বাহর আল-হারকান্দ’ নামটির, যার দ্বারা বঙ্গোপসাগরকে বোঝানো হত। অষ্টম শতকের প্রথম থেকে দশম শতকের শেষ পর্যন্ত হরিকেল একটা স্বাধী রাষ্ট্র হিসাবে বিরাজমান ছিল।6 প্রাচীন হরিকেল রাজ্যটি এক সময়ে সুন্দরবন এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। সুন্দরবন দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী গঙ্গা ও অন্যান্য নদ-নদীর অববাহিকায় একটি ঘন জঙ্গল ছিল, যা প্রাচীনকালে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । বর্তমানে সেটি সংকুচিত হতে হতে বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের দক্ষিণাংশ এবং পশ্চিম বাংলার কিয়দংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। বনের সংকোচনের ফলে এ অঞ্চলের পরিবেশের ভারসাম্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ঘন বনাঞ্চল হলেও সুন্দরবনের আশপাশে বহু আগে থেকে মানুষের স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়। এদেশের অনার্য যাযাবর গোত্রগুলো এক সময়ে এ সকল এলাকায় ঘুরে বেড়াত। কালক্রমে এদের অনেকেই হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা ক্রমশ প্রভাবিত হতে শুরু করে। বিশেষ করে বার শতকে ডুম্মানপাল রাজার সময়ে এদের অনেকেই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। অবশেষে তের শতকের শেষের দিকে এ অঞ্চলে ইসলামের প্রাথমিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পনের শতক/ নবম হিজরীর মাঝামাঝি কোন এক সময়ে মুসলিম শাসক ও ধর্মীয় নেতা উলুঘ খান জাহানের নেতৃত্বে এ এলাকাটিতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়ে ব্যাপকভাবে ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। অন্যদিকে তের শতকে হরিকেলের পূর্বে দেব রাজবংশ কর্তৃক শাসিত চন্দ্রদ্বীপ নামক একটি হিন্দু রাজ্যের উৎপত্তি হয়, যা সতের শতকের প্রথম পর্যন্ত টিকে ছিল। এরপর মুঘল শাসনের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে এ রাজ্যটিও মুঘল সাম্রাজ্যের একটি অংশে পরিণত হয়।7
মুসলিম বিজয়ের পূর্বের আরবী-ফার্সী ঐতিহাসিক উৎসগুলো অবশ্য এই এলাকাটিকে ‘বাঙ্গলা’ বা ‘বঙ্গ’ হিসেবে কখনোই অভিহিত করেনি। বরং ইসলামের আদিযুগের সূত্রগুলোতে এই এলাকাটিকে ‘রূহমী’ রাজ্য হিসাবে উল্লেখ করা হত।8 রূহমী নামটি বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের একটি অতি প্রাচীন নাম ‘সুহ্ম’র সাথে কোনভাবে সম্পর্কিত হতে পারে। তারপরও এই জায়গাটির অবস্থান ও পরিচয় নিয়ে অনেক বিতর্ক ও অস্পষ্টতা থেকে যায়। প্রাচীন আরবী উৎসগুলোতে এ নামটির নানা ধরনের বানান ও উচ্চারণ পাওয়া যায়, যেমন ‘রূহমী’9, ‘রাহমা’10, ‘দাহোম’11 ইত্যাদি। এসব নামের মধ্যে সবচেয়ে শুদ্ধ নামটি সম্ভবত সোলায়মান আল-তাজের ব্যবহার করেছেন। তাঁর উল্লিখিত ‘ধর্ম’ নামটি বাংলায় ব্যবহৃত মূল নাম ও পটভূমির সাথে বেশ কিছুটা খাপ খায়।12 হয়ত বা সে সময়ে ধর্ম বলে কোন একটি রাজ্য ছিল, কিংবা পাল বংশের বিখ্যাত রাজা ধর্মপালের (৭৬৯-৮১০) রাজ্যটির কথা এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে। সোলায়মান আল-তাজের আরও উল্লেখ করেছেন যে এ রাজ্যের রাজা এক সাধারণ পরিবার থেকে এসে বাংলার অধিপতি হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এ তথ্যটি পাল রাজা ধর্মপালের পারিবারিক পটভূমির সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। আবার ইবনে খুররাদাদবিহের লেখা অনুযায়ী ‘রূহমী’ একটি বিশাল রাজ্য ছিল। সে রাজ্যের সীমার ভেতরে ‘আল-কানজ’ (গঙ্গা) নদী এবং ‘আব্বিনা’ নামে একটি শহর ছিল। এ দেশটির সীমান্ত ‘কামরূন’ (কামরূপ) রাজ্যটির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল এবং চীন এখান থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না।13 রূহমী দেশে প্রচুর হাতি, মহিষ, চন্দনকাঠ ইত্যাদি পাওয়া যেত। অপর একটি সূত্র হুদুদ আল–আলম অনুযায়ী রূহমী দেশের উপকূলবর্তী এলাকায় নিময়াস, সামান্দার (সমুদ্র), আন্দরাস (অন্ধ্র?), উরশিন (উড়িশ্যা), হারকান্দ (দক্ষিণ বাংলার চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য এবং তার আশপাশের এলাকা যা প্রাচীন বাংলায় হরিকেল নামে পরিচিত) অঞ্চলগুলো অবস্থিত ছিল।14 ‘সামান্দার’ নামের বন্দর শহরটি সম্ভবত বর্তমান চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী এলাকায় কর্ণফুলী নদী ও ছোট ফেনী নদীর মাঝামাঝি কোথাও অবস্থিত ছিল।15 কিংবা এটি মেঘনা নদীর উপরে অবস্থিত বর্তমান চাঁদপুর বন্দরও হতে পারে। বিখ্যাত ভূগোলবিদ আল-ইদরিসী এ বন্দরটি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ‘মুসলা’ নামক একটি নদীরও উল্লেখ করেছেন যা সম্ভবত মেঘনা নদী।16
প্রাচীন আরবী-ফার্সী সূত্রাদি অনুযায়ী রূহমী রাজ্যটির সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর কিছু না কিছু বিবাদ লেগেই থাকত। যেমন দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট রাজবংশের রাজা (বলহারা রাজ্যের) বাল্লহরায়া রাজার সঙ্গে এবং কনৌজের গুর্জর (আরবী-ফার্সী সূত্রাদিতে ‘জুরজ’) রাজবংশের রাজাদের সঙ্গে একটা না একটা যুদ্ধ লেগেই থাকত। রূহমী রাজ্যটি তাঁতে বোনা অতি সূক্ষ্ম ও হালকা সুতি কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল, যা সম্ভবত ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ‘মসলিন’ কাপড়ের দিকে ইঙ্গিত করে। স্বর্ণমুদ্রা ছাড়াও মুদ্রা হিসেবে কড়ির ব্যাপক প্রচলন ছিল। সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে দক্ষিণের সামুদ্রিক বন্দর শহরগুলোর সঙ্গে আরব বণিকদের একটা বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর ফলে উপকূলবর্তী এলাকার ‘শাতী-জাম’ (বর্তমান চট্টগ্রাম) ও ‘সামান্দার’ বন্দর শহরে তাদের যাতায়াত বেড়ে যায়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে কমপক্ষে দুটি আব্বাসীয় মুদ্রা পাওয়া গেছে। একটি ১৭২ হিজরী/ ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দ আব্বাসীয় খলীফা হারুন আল-রশীদের (১৭০-২০৪ হিজরী/ ৭৮৬-৮০৯ খ্রিস্টাব্দ) সময়ের, যা পাহাড়পুরে পাওয়া গেছে। অন্যটি পাওয়া গেছে ময়নামতীতে, যা আবু-আহমাদ আবদ্-আল্লাহ আল-মুনতাসির বিল্লাহের (২৪৭-৪৮ হিজরী/ ৮৬১-৬২ খ্রিস্টাব্দ) সময়কালের। বাংলা ভূভাগে আব্বাসীয় যুগের প্রথম দিকের এ মুদ্রা দু’টি প্রাচীন আরব-বাংলা বাণিজ্যিক সম্পর্কের ইঙ্গিত বহন করে। বলা বাহুল্য, প্রাথমিক যুগের আরব বণিকদের বাংলার সাথে যোগাযোগ পরবর্তীকালে এ অঞ্চলে ইসলামের ব্যাপক বিস্তৃতির ক্ষেত্রটি তৈরি করেছিল।17
‘বঙ্গ’ নামটি বেশ পুরনো, তা সেটি সংস্কৃত ভাষায় হোক, বা পূর্ব কিংবা দক্ষিণ ভারতীয় অন্যান্য প্রাচীন ভাষাতেই হোক। প্রাচীনকালে বাংলার কোন কোন আদিবাসী গোষ্ঠিদের (যেমন সাঁওতালদের) মধ্যে ‘বঙ্গা’ নামক এক দেবতার সন্ধান ও মেলে। চোল রাজবংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের শাসনামলে (১০২১-২৩ খ্রিস্টাব্দ) তিরুমলয়ের একটি শিলালিপিতে ‘ভাঙ্গালা দেশা’ (তামিল ভাষায়: வங்காளத்தேசம்) নামটি ব্যবহৃত হয়েছে। এ ধরনের নাম তামিলনাডু ও তার আশে পার্শ্বের রাজ্যগুলোর একাধিক শিলালিপিতে (কোন কোনটিতে আবার ‘বাঙ্গালা দেশাম’) পাওয়া গেছে।18 সম্ভবত পূর্ব বাংলার গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলের আদি ও মূল নাম ‘গঙ্গা’ থেকে লোকমুখে ক্রমশঃ পরিবর্তিত হতে হতে প্রথমে ‘ভঙ্গা’, পরবর্ত্তীকালে ‘বঙ্গা’ এবং পরিশেষে ‘বঙ্গ’ নাম ধারণ করে। অন্যদিকে আবার লবন তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে গিয়ে ‘বঙ্গ’ এর উপকুলীয় অঞ্চলে লোনা পানি আটকে রাখার জন্য বর্গাকারের নির্দিষ্ট জমির চতুর্দিকে অল্প উঁচু বাঁধ (বা অনুচ্চ দেওয়াল) দেওয়ার একটি পদ্ধতির প্রচলন ছিল, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হত ‘আইল’ বা ‘আল’ এবং যার দ্বারা অনেক সময় জমির সীমানা ও বোঝানো হত। শব্দ দু’টি ক্রমশঃ যুক্ত হয়ে ‘বঙ্গ’+‘আইল’ থেকে প্রথমে ‘বঙ্গাল’ এবং পরবর্তিতে ‘বাঙ্গাল’ নামের রূপ নেয়। কালক্রমে পুরো অঞ্চলে এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে যায়, এবং এখন পর্যন্ত সর্বত্র ব্যাবহৃত হয়ে থাকে।। ‘বাঙ্গাল’ বলতে যে শুধু পূর্বাঞ্চলীয় ও উপকুলীয় এলাকাটি বুঝানো হত, তা নয়। এমনকি পূর্ব-বাংলার জনসাধারনকে ও ‘বাঙ্গাল’ বলা হত, যে রীতিটি এখনও রয়ে গেছে। আবুল ফযল প্রণোদিত ‘আইনে-আকবারী’ গ্রন্থেও ‘বাঙ্গাল’ নামটির মূল উৎপত্তি সম্পর্কে এ রকম একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ময়নামতীতে প্রাপ্ত চন্দ্র রাজবংশের শাসনামলের আরও দুয়েকটি সংস্কৃত শিলালিপিতে এ ধরনের একটি নামের উল্লেখ রয়েছে।19
তবে মুসলিম লেখকদের মধ্যে ঐতিহাসিক মাওলানা মিনহাজ সিরাজ আল-দীন সর্বপ্রথম লেখক ছিলেন, যিনি ‘বিলাদ-ই-বঙ্গ’ বা ‘বঙ্গ’ দেশটির নাম উল্লেখ করেছেন। বঙ্গ ছাড়াও উনি ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের আরও কয়েকটি অঞ্চলের উল্লেখ করেছেন, যথা: ‘বিলাদ-ই-লাখহানাওয়াতী’ (لَكْهَنَوَتِى যা গৌড়ের পূর্ব দিকে অবস্থিত লক্ষণসেনের রাজধানী লক্ষ্মণাবতী), ‘দিয়ার-ই-সুকনাত’20 (সম্ভবত বর্তমান সিলেট ও তার আশপাশের এলাকাগুলি, যা সে সময়ে সমতট নামে অধিকতর পরিচিত ছিল), ‘কামরূদ’ (কামরূপ)21 ইত্যাদি। ‘লাখহানাওয়াতী’ মুসলিম শাসনামলে বাংলার সুবিখ্যাত রাজধানী শহর গৌড়ের পূর্ব দিকে অবস্থিত লক্ষ্মণাবতীর ফার্সী উচ্চারণ। এটি স্পষ্টতই রাজা লক্ষণসেনের নামানুসারে রাখা তাঁর রাজধানীর নাম, যা বর্তমানে চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ জেলার রহনপুরের কাছাকাছি নাওদা (ফার্সীতে نَوَدَه বা نَوْدِيَهْ) ও তার আশেপাশের জায়গা জুড়ে ছিল। ফার্সীতে লেখার ফলে নামটি বাংলার বাহির থেকে আসা লোকজনের মুখে ভুল উচ্চারণের কারণে কখনও কখনও ‘লখনৌতী’ হিসাবে উচ্চারিত হতে থাকে। অবশ্য মূল ফার্সী বানানে কোনই ভুল নেই, বরং ফার্সী অক্ষরদ্বয় নূন (نَ) ও ওয়াও (وَ) উভয়ের উপরে আরবী বা ফার্সীর ‘যাবার’ স্বরবর্ণটি (তথা হরকত টি) বিদ্যমান, যা কিনা বাংলার স্বরবর্ণ ‘আ-কার’ অর্থাৎ ইংরেজির a (Vowel) এর সদৃশ। যেহেতু আরবী বা ফার্সীতে স্বরবর্ণটি আলাদা করে লেখার প্রচলন নেই, সেজন্য ঐতিহাসিকদের অনেকেই উহ্য থাকা ‘যাবার’ যাবার’ স্বরবর্ণটির (نَوَ) কথা বিবেচনা না করেই ফার্সী থেকে নামটি বর্ণান্তরিত করতে গিয়ে লখনৌতী করে ফেলেছেন, যদিও তার শুদ্ধ উচ্চারণ ফার্সী ভাষায়ও লাখহনাওয়াতী (لَكْهَنَوَتِى) বা লক্ষ্মণাবতী ছিল। বিংশ শতাব্দির গোড়া পর্যন্ত স্থানীয় লোকেরা গৌড় সংলগ্ন এই পুরো এলাকাটিকে নাওদিয়া বলেই চিহ্ণিত করত, এবং স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী লক্ষণসেন এই নাওদিয়া থেকেই বখতিয়ার কর্তৃক বহিস্কৃত হয়ে নদিপথে পূর্ববঙ্গে চলে গিয়েছিলেন।22
![প্রত্নলিপি, বাঙালি, বাঙালিয়ানা ও বাংলায় ইসলাম: কিছু জিজ্ঞাসা [পর্ব ১]](http://nobojagaran.com/wp-content/uploads/2023/07/4.png)
প্রাচীনকালে এই পুরো অঞ্চলটি গৌড় নামে পরিচিত হওয়ায় সেন রাজাদের অনেকেই ‘গৌড়েশ্বর’ উপাধি ধারণ করেন। লক্ষ্মণাবতী শহরটি মুসলিম শাসনামলের আগে থেকেই গৌড়ের রাজধানী ছিল। ষোল শতকের গোড়ার দিকে স্থানীয় ভাবে লক্ষ্মণাবতী নামটি পরিত্যক্ত হলেও বাংলার বাইরে আঠার শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ নামটির ব্যবহার থেকে যায়।24 সুলতানী আমলে এ শহরটির পাশ ঘেঁষে বিখ্যাত রাজধানী গৌড় গড়ে ওঠে। সেন আমলের বিজয়পুর থেকে শুরু করে সুলতানী আমলের প্রায় সব রাজধানীই (যেমন দেবীকোট, পাণ্ডুয়া, একডালা, টাণ্ডা ইত্যাদি) গৌড় বা লক্ষ্মণাবতী (অর্থাৎ নাওদিয়া) শহরের কাছাকাছি ছিল। বাংলায় ইতিহাস চর্চার সূচনা লগ্ন থেকেই প্রাচীন রাজধানী ‘শহর-ই-নাওদিয়া’ বা নাওদিয়া শহরটির অবস্থান ও চিহ্নিতকরণ নিয়ে একটি সাধারণ ভুলের প্রচলন হয়ে গেছে। তাবাকাত–ই–নাসিরী বইটিতে মাওলানা মিনহাজ সিরাজ আল-দীন কয়েক জায়গায় উল্লেখ করেছেন যে এটি দার আল–মুলকে ‘রায় লাখমানিয়া’ তথা লক্ষণসেনের রাজধানী (তথা লক্ষ্মণাবতী) ছিল। মুসলিম শাসন আমলের ঐতিহাসিক উপাদানগুলো বেশিরভাগই ফার্সীতে লেখা। সেখান থেকে নাওদিয়া (نَوْدِيَهْ) নামটির ইংরেজি এবং পরবর্তীকালে বাংলায় বর্ণান্তরিত করতে গিয়ে প্রথমদিকের ঐতিহাসিকেরা সেটিকে ভুলক্রমে ‘নদিয়া’ করে ফেলেছিলেন, যা সময়ের সাথে সাথে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। কিন্তু ভৌগোলিকভাবে কোনমতেই সেটির বর্তমান পশ্চিম বাংলার নদিয়া জেলাতে হওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া নাওদিয়া কিংবা নদিয়া নামের কোন শহরের অস্তিত্ব কোন কালেই এ জেলায় ছিল না। শুধু কল্পনার জোরে কিংবা নিছক অনুমানের ভিত্তিতে নাওদিয়া শহরকে নবদ্বীপের (বা নদিয়ার) সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা সব দিক থেকে অযৌক্তিক।

লক্ষণসেনের রাজধানী ‘লক্ষ্মণাবতী’ পরবর্তীকালে গড়ে উঠা (মুসলিম শাসকদের রাজধানী) গৌড়ের পূর্ব দিকে বিস্তৃত ছিল, যার একটি অংশের নাম ছিল নাওদিয়া (নতুন পত্তন)। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে তাবাকাত–ই–নাসিরী বইটিতে বর্ণিত নাওদিয়া গৌড়ের অদূরে বর্তমান চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ জেলার রহনপুর রেল স্টেশনের পার্শ্ববতী নাওদাপাড়া গ্রাম ও তার সন্নিহিত এলাকাটিতে অবস্থিত ছিল। সেন আমলের একটি বিশাল ও বিস্তীর্ণ ধ্বংসাবশেষের (প্রায় ৫০ ফুট উঁচু বিশাল ঢিবি যা উত্তর-দক্ষিনে প্রায় ১০০০ ফুট দীর্ঘ এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৮০০ ফুট প্রশস্ত) কিছু কিছু অংশ মাটি ও পুরানো ইঁট বিক্রেতাদের হাত থেকে কোনমতে রক্ষা পেয়ে আজ পর্যন্ত টিকে রয়েছে যা যুগ যুগ ধরে স্থানীয়ভাবে লক্ষ্মণসেনের বাড়ী (বা ভিটা) নামে চিহ্নিত হয়ে এসেছে।25 জনশ্রুতি অনুযায়ী বিপদকালীন অবস্থায় ব্যবহারের জন্য একটি ভুগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ বাড়ীটির নীচ দিয়ে পুনর্ভবা নদী পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। এই এলাকাটির বহুদুর পর্যন্ত একসময়ে প্রচুর পরিমানে পুরাকালের গৌড়ীয় ইঁট এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত। এই অঞ্চলে পরবর্ত্তিকালে নির্মিত বাড়ীগুলোতেও প্রত্নতাত্তিক ধ্বংসাবশেষ থেকে সংগৃহিত পুরানো জমানার ইঁট ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও এলাকাটির যত্রে তত্রে পড়ে থাকতে দেখা যেত প্রাচীন যুগের দালান কোঠায় ব্যবহৃত কারুকার্য খচিত বিশাল বিশাল প্রস্তরখন্ড এবং নানা ধরনের প্রত্ননিদর্শন, যার কিছু কিছু নিদর্শন এখনও দেখা মিলে। এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দুরে অবস্থিত পাথরপূজা গ্রামে এ শতাব্দির গোড়ার দিকেও একাধিক রাজকীয় দালানকোঠার বিশালকায় ধ্বংস্তুপ দেখতে পাওয়া যেত। আরও কিছুদুরে রোকনপুর গ্রামে আজ পর্যন্ত কোনমতে টিকে রয়েছে আগাগোড়া পাথর দিয়ে তৈরি সুউচ্চ একটি বাতিঘরের (Lighthouse) মত স্থাপনা। নাওদাপাড়া গ্রামের ঢিবিটি চতুর্দিকে প্রতিরক্ষামূলক গভীর পরিখাবেষ্টিত ছিল যা (বর্ত্তমানে মজে যাওয়া) একটি খালের সাথে সংযুক্ত ছিল। খালটি কিছুদূরে পুনর্ভবা নদীর সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই ঢিপিটির একটি অংশকে নওদা বুরুজ বা ষাঁড় (কোন কোন সুত্রে শাহ) বুরুজ নামে চিহ্নিত করা হত, যা সম্ভবত বখতিয়ারের বিজয়স্তম্ভ হিসাবে কোন এক সময়ে তৈরী হয়েছিল।

বস্তুত পুনর্ভবা ও মহানন্দা নদীদ্বয় লক্ষ্মণসেনের বাড়ী থেকে মাত্র কিছু দূরে মুকর্রমপুরের কাছে মিশে গেছে এবং বেশ কিছুদুর গিয়ে পুনরায় পদ্মা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ফলে সহজেই অনুমান করা যায় যে যখন লক্ষণসেন বখতিয়ার খিলজীর অতর্কিত হামলায় আক্রান্ত হন, তখন তিনি পেছনের খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে বজরায় চড়ে পুনর্ভবা হয়ে মহানন্দা এবং এর পরে পদ্মা নদীপথে ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় চলে যান। অবশ্য এখানে আরও একটি সম্ভাবনা থাকতে পারে। মহদীপুর গ্রাম ঘেঁষে বর্তমান কালের যে পাগলা নদীটি এঁকে বেঁকে শেষ পর্যন্ত মহানন্দায় এসে মিশেছে, সেই পাগলা নদীর পশ্চিম দিকে রাজধানী গৌড়ের ঠিক সামনা-সামনি নাওদা নামে একটি গ্রাম আছে। মিনহাজ সিরাজ আল-দীনের উল্লিখিত নাওদিয়া26 যে এ গ্রামটিও হতে পারে, সে সম্ভাবনার কথাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বর্তমানে মরে যাওয়া পাগলা নদীর খাতটি এক সময়ে মূল ভাগীরথীর (যা প্রাচীন সংস্কৃত সূত্রে জাহ্নবী নদী নামে পরিচিত) অংশ ছিল, যা ব্রিটিশদের আগমনের কিছুকাল আগে পর্যন্ত এই খাতে প্রবাহিত হত। নাওদিয়ার টাকশালে তৈরী মুগীস আল-দীন য়ুযবক (৬৫২-৫৫ হিজরী/ ১২৫৪-৫৭ খ্রিস্টাব্দ) এর শাসন কালের দু’য়েকটি মুদ্রা ও আবিস্কৃত হয়েছে।27
নাওদিয়ার এই এলাকায় হওয়াটা নিছক অনুমান নয়, বরং বাংলার ইতিহাসে এটিই এমাত্র রাজধানী এলাকা যা রাজা লক্ষ্মণসেনের নামে নামাঙ্কিত হয়ে ‘লক্ষণাবতী’ নামে পরিচিত হয়েছিল। সেন ও পরবর্ত্তী আমলের বহু গুরুত্তপূর্ণ প্রত্ননিদর্শন এই এলাকায় ও তার আশেপাশের জায়গাগুলোতে কিছুকাল আগে পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, যার মধ্যে নাওদাপাড়ার লক্ষ্মণসেনের ঢিবির পাশের এক গুম্বজবিশিষ্ট একটি অষ্টকৌণিক সুফী ইবাদতখানা (আশ্রম), পার্শ্ববর্তী শাহানাপাড়া, বীরজওয়ান, হুক্কাপুর ও পীরপুর গ্রামের বিভিন্ন স্থাপত্যিক নিদর্শন, গৌড়ের বল্লালবাড়ি, সাগরদিঘী, ও বাগবাড়ি (লক্ষ্মণসেনের বাগানবাড়ি), পান্ডুয়ার অধুনালুপ্ত লক্ষ্মণসেনী দালান (জালালুদ্দীন তাব্রেযীর [বড়] দরগাহের কাছে) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।28 নাওদিয়া থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দক্ষিণে গোদাগাড়ির অনতিদূরে সুলতানগঞ্জের কাছে বিজয় সেনের রাজধানী অধুনালুপ্ত বিজয়পুর29 (বর্ত্তমান বিজয়নগর ও দেওপাড়া]) ও একই রকম সাক্ষ দেয়। এছাড়া সেন আমল থেকে শুরু করে গৌড়ের মুসলিম শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ের বেশ কয়েকটি শিলালিপি এই এলাকায় কিংবা তার আশপাশে পাওয়া গেছে। নাওদাপাড়ার অদূরে চাঁপাই নওয়াবগঞ্জের বাগমারি গ্রামে লক্ষণসেনের আমলের প্রাচীন বাংলায় খোদিত একটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। আবার নাওদাপাড়া থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে বিজয়নগরের কাছাকাছি সুলতানগঞ্জে পাওয়া সুলতান ‘আলা আল-দীনের ফার্সী শিলালিপি (১২১০-১৩ খ্রিস্টাব্দ) এবং রাজশাহী শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকার নওহাটায় প্রাপ্ত বলকা খানের (১২২৯-৩৩ খ্রিস্টাব্দ) শিলালিপি এটাই নির্দেশ করে যে সেন আমলে এবং পরবর্তীকালে মুসলিম শাসনামলে রাজধানীগুলো মূলত এসব এলাকাতেই গড়ে উঠেছিল। অন্যদিকে বর্তমান নদীয়া জেলা থেকে লক্ষণসেনের কিংবা মুসলিম শাসনকালের তেমন কোনই উল্লেখযোগ্য শিলালিপি পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে বড় কথা হল মধ্য যুগের আরবী, ফার্সী (যেমন মিনহাজ প্রণীত তাবাকাত–ই–নাসিরী বইয়ে) বা অন্যান্য মৌলিক সুত্রের কোনটাই বখতিয়ার খিলজীর বাংলায় অতি সংক্ষিপ্ত অভিযানকালে তাঁর দক্ষিণাভিমুখি কোন যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে না। গৌড় অঞ্চলে অবস্থানকালে (৬০১-০৩ হিজরী/ ১২০৫-০৬ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে যা দুই বছরের কাছাকাছি সময়) তাঁর সবগুলো অভিযান উত্তর, উত্তর-পশ্চিম, কিংবা উত্তর-পুর্ব দিকে (যেমন কামরূপ, কামতা ইত্যাদি এলাকাগুলোতে) সীমাবদ্ধ ছিল। এক সময়ে এ অঞ্চলগুলোতে আদিবাসী ও অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকদের আধিক্য ছিল, যাদের অনেকেই তাঁকে সমর্থন যুগিয়েছিল। প্রান্তিক গোষ্ঠির এসব লোকদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে ও নানান পর্যায়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে (বিংশ শতাব্দির গোড়ায় অনুষ্ঠিত সি. এস. জরিপগুলোতেও এসব পরিবর্ত্তনের ছিটাফোঁটা চিত্র ফুটে উঠে, যার কিছু নমুনা পরিশিষ্ট ৩ এ দেওয়া হল)।
![প্রত্নলিপি, বাঙালি, বাঙালিয়ানা ও বাংলায় ইসলাম: কিছু জিজ্ঞাসা [পর্ব ১]](http://nobojagaran.com/wp-content/uploads/2023/07/6.png)

চর্তুদশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে বাঙ্গালা নামে পরিচিত উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় এ পুরো এলাকাটিতে মুসলিম শাসকগণ একরকম স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে শুরু করেন। বাংলার বিখ্যাত প্রথম স্বাধীন সুলতান ইলিয়াস শাহ (৭৪০-৫৯ হিজরী/ ১৩৩৯-৫৮ খ্রিস্টাব্দ) ‘শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান’ উপাধি গ্রহণ করেন। এ সময়ের আরবী-ফার্সী সূত্রগুলোতেও ‘বাঙ্গালা’ কিংবা কোন কোন আরবী সূত্রে ‘বানজালা’ নামটির আবির্ভাব দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ পনের শতকের গোড়ার দিকের মক্কার সুবিখ্যাত বাঙালি বিশ্ববিদ্যালয়ের (আল-মাদ্রাসা আল-সুলতানিয়্যাহ আল-গিয়াসিয়্যাহ আল-বাঙ্গালিয়্যাহ) দু’জন নামকরা ঐতিহাসিক আল-ফাসী ও আল-শীবী দুজনেই ‘বাঙ্গালা’ নামটি তাদের লেখায় ব্যবহার করেছেন, যা ‘বাঙালি’ ও ‘বাংলা’ নামগুলোকে বিশ্বজনীন করে তুলেছিল। ফার্সী উৎসগুলোতে কোন কোন সময়ে ‘দিয়ার-ই-বাঙ্গালা’30 নামটিও দেখতে পাওয়া যায়। শেরপুরে প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে (১১৪২ হিজরী/ ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) ‘সুবায়ে বাঙ্গালা’ (বাঙ্গালা প্রদেশ) নামটি উল্লিখিত হয়েছে। এ নামটিই আবার চুড়িহাট্টা শিলালিপি (১১৬০ হিজরী/ ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ) এবং আরও কয়েকটা শিলালিপিতে উল্লিখিত হয়েছে। পনের শতকের শেষের দিকে আহমাদ ইবন মাজেদ নামক প্রখ্যাত ভূগোলবিদ (জন্ম ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দ) এ অঞ্চলটিকে বাঙ্গালা বা বঙ্গ ভূভাগ নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর বই আল–ফাওয়াইদ ফী উসূল ‘ইলম আল–বহর ওয়া ’ল–ক্বাওয়াইদ (১৮৯৫ হিজরী/ ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দ) সাগর, মহাসাগর ইত্যাদি তথ্যাবলি——- সম্বলিত একটি রচনা। ষোল শতকের প্রথম দিকের আরেকজন প্রখ্যাত ওমানি ভূগোলবিদ সুলাইমান ইবন আহমাদ ইবন সুলাইমান আল-মাহরী শুধু যে ‘বাঙ্গালা’ নামটি ব্যবহার করেছেন তা নয়, বরং বঙ্গোপসাগর ও তার উপকূল এলাকার নানা দ্বীপ, যেমন: সন্দ্বীপ সম্পর্কে আশ্চর্যজনকভাবে খুঁটিনাটি বহু তথ্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বই দুটো হল: আল–মিনহাজ আল–ফাখির ফী ‘ইলম আল–বাহর আল–যাখির (সমুদ্রসমূহের একটি বিস্তারিত পরিচিতি); এবং আল-‘উমদা আল–মাহরিয়্যা ফী দ্বাবতে আল-‘উলুম আল–বাহরিয়্যাহ (সমুদ্র সম্পর্কে তথ্য নির্দেশিকা)।31 আরবদের এসব তথ্যসমৃদ্ধ লেখাই পরবর্তীকালে প্রাচ্যের সঙ্গে সামুদ্রিক যোগাযোগের পথঘাট সম্পর্কে ইউরোপীয়ান নাবিকদের চোখ-কান খুলে দেয়, যা সম্পর্কে এর পূর্বে তাদের কোন ধারণাই ছিল না।

বর্তমান আলোচনায় বঙ্গ, বাংলা, বাংলা দেশ বা বেঙ্গল শব্দগুলো ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহৃত হয়েছে, যার দ্বারা মূলত বর্তমানকালের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং ভারতীয় অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে বোঝানো হয়েছে। তবে জাতিগত ভিত্তিতে বা অন্যান্য কারণে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় সীমারেখাগুলো স্বাভাবিক কারণে বিভিন্ন যুগের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফলাফল, যা সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তনশীল। ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে ইতিহাসের প্রাকৃতিক গতিকে এ সকল রাজনৈতিক সীমান্তের সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা কোনভাবেই সম্ভব নয়, কিংবা করা উচিতও নয়। এজন্যই বাংলার ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে এই ভূভাগের আশপাশের কিছু কিছু এলাকার (বিশেষ করে বর্তমান মায়ানমার বা বার্মার আরাকান, বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতীয় অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরা, আসাম, বিহার ও উড়িষ্যার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর) কথা স্বভাবতই চলে আসে । তের শতকের সূচনালগ্নে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে এই অঞ্চলটিতে ক্রমশ একটি নতুন ধারার সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে একটি অভিনব সংস্কৃতি রূপে প্রকাশ পায়, যেখানে ইসলামের প্রভাব সুস্পষ্ট ও সুদূরপ্রসারী। এই মিশ্র-সংস্কৃতিই যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মুখ্য সংস্কৃতি, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
বাংলায় ইসলামের আবির্ভাব
ইসলামী বিশ্বের প্রেক্ষিতে বাংলার অবস্থান মাঝামাঝি নয়, বরং ইসলামী বিশ্বের এক সুদূর সীমান্ত এলাকার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এখান থেকে ইসলাম ধর্মের আদি ভূমি আরব উপদ্বীপের হিজাজ্ব অঞ্চল কিংবা পবিত্র নগরী মক্কা ও মদীনা কয়েক হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। তবে উল্লেখ্য, প্রায় বাইশ কোটি বাংলাভাষী মুসলমান পৃথিবীর মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় সতের কোটি বাংলাভাষী মুসলমানের বসবাস। আরও ছয় কোটির কাছাকাছি বাংলাভাষী মুসলমান পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার, নেপাল, মায়ানমারের আরাকান প্রদেশ এবং পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই তেইশ কোটি বাংলাভাষী মুসলমান ভাষাগত দিক দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে প্রথম না হলেও দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী তো বটেই। অন্যদিকে পৃথিবীর বিয়াল্লিশ কোটির কাছাকাছি আরবীভাষী জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় চার কোটিই অমুসলিম, যাদের বেশিরভাগই লেবানন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিশরের খ্রিস্টান অধিবাসী। পৃথিবীর বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর শতকরা সত্তর ভাগের কাছাকাছি বাঙালির ধর্মবিশ্বাস ইসলাম এবং তাদের সংস্কৃতি ও জীবনধারা ইসলামের দ্বারা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এ অঞ্চলে ইসলামের সংমিশ্রণে একটি নতুন সাংস্কৃতিক ধারা ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করেছে, যা মূলধারার বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য রূপ। ইসলামী জগতে তথা ইসলামী সভ্যতায় বাঙালি মুসলমানদের অবদানও নগণ্য নয়। বাঙালি মুসলমানেরা বিশ্বের ইতিহাসে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে।

এ অঞ্চলে ইসলামের আগমন ও বিস্তৃতি কিভাবে ঘটল এবং এমন কি কারণ ছিল যে এ অঞ্চলের জনগণের একটা বিরাট অংশ ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের দিকে এগিয়ে গেল, এসব প্রশ্ন ঐতিহাসিক দিক থেকে শুধু জটিলই নয়, বরং দুর্বোধ্য। দক্ষিণ এশিয়ায় ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল দিল্লি। অথচ মুসলিম শাসনের কেন্দ্রভূমি দিল্লির আশেপাশের এলাকাগুলো কখনোই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পরিণত হতে পারেনি, তা উত্তরপ্রদেশ কিংবা বিহার হোক, অথবা মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান কিংবা হরিয়ানা হোক। অথচ দিল্লি থেকে বহু দূরে অবস্থিত বাংলার ভূভাগ কিভাবে ধীরে ধীরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার পরিণত হল – তা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়! এর কারণ নিয়ে যথেষ্ট তর্ক-বিতর্কের অবকাশ রয়ে গেছে। বাংলায় ইসলামের বিস্তারের ব্যাপারে প্রধান প্রধান তত্ত্বগুলো নিম্নরূপ:
১. এ অঞ্চলে বহিরাগত মুসলমানদের ব্যাপকভাবে আগমন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস।
২. হিন্দু সমাজের নিম্নবর্ণের লোকদের সামাজিক শোচনীয় অবস্থার পরিবর্তনের প্রচেষ্টা স্বরূপ ইসলাম ধর্ম গ্রহণে তাদের বিশেষ উৎসাহ (এ বিষয়ে কিছু নমুনা জন্য দেখুন পরিশিষ্ট ৩)।
৩. ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন স্তরের লোকদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ।
৪. বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটেছিল কোদাল ও লাঙ্গলের ধর্ম হয়ে (দেখুন পরিশিষ্ট ৩), যা খুব চমৎকারভাবে রিচার্ড ইটন ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর বাংলা সীমান্তে ইসলামের উদয় বা দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দি বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার: ১২০৪-১৭৬০ বইয়ে। ইসলাম এ দেশের যাযাবর ও আদিবাসী গোত্রগুলোর জন্য কৃষি সভ্যতা বিকাশের উপযোগী জীবনধারা হিসাবে নতুন বাণী নিয়ে এসেছিল।32
যতদূর মনে হয় এসব আদিবাসী ও অন্ত্যজ শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর মধ্যে অ্যানিমিস্টিক তথা প্রকৃতিপূজা ধরনের বিশ্বাস প্রচলিত ছিল, আর ছিল কিছু আঞ্চলিক ও দেশজ আচার, অনুষ্ঠান, সংস্কার ও নানাবিধ সামাজিক রীতিনীতি। কিন্তু তৎকালীন প্রচলিত মূলধারার ধর্ম তাদের মধ্যে তেমন একটা বিকাশ লাভ করেনি। মুসলিম শাসনামলে এ দেশের যাযাবর আদিবাসীরা অস্থায়ী জীবনযাত্রা ছেড়ে ক্রমশ চাষবাস ও স্থায়ীভাবে বসবাসের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আর তারই সঙ্গে দেখা দিল একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় ব্যবস্থার প্রয়োজন। এদের অনেকের কাছে ইসলাম আবির্ভূত হয়েছিল একটি সুবিধাজনক জীবনব্যবস্থা হিসাবে, ঠিক যেমন ইসলামের আবির্ভাবের সময়ে আরব অঞ্চলের যাযাবর বেদুইনদের অভিজ্ঞতায় ঘটেছিল। এভাবে ধীরে ধীরে, বিভিন্ন পর্যায়ে এদের অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে।33 ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রথম পর্যায়টি সম্ভবত নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল (উপনিবেশ আমলে নাম পরিবর্তনের কিছু নমুনার জন্য দেখুন পরিশিষ্ট ৩), কারণ ইসলামী নাম গ্রহণ ইসলামী সভ্যতা তথা শাসকগোষ্ঠীর ধর্মীয় ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পথে প্রথম ধাপ ছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ইসলামী প্রথাগুলোও আস্তে আস্তে নবদীক্ষিত আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত হতে শুরু করল। তাদের ইসলামী ভাবধারা ও চেতনা নানা পর্যায়ে ধাপে ধাপে বিকশিত হতে থাকে।
নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে সূক্ষ্মভাবে খতিয়ে দেখলে বাংলা দেশের মুসলমানদের বেশিরভাগই নানা জনগোষ্ঠী, নানা বর্ণের সংমিশ্রণের ফলশ্রুতি। ইসলাম ধর্মে বর্ণভেদ ও জাতি প্রথা না থাকায় যে কোন গোষ্ঠীর লোকজনের জন্য অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা খুবই সহজ ছিল। আর্য বৈদিক সমাজে এমনটা সম্ভবপর ছিল না। আবার ভৌগোলিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে বাংলার অবস্থান এমন এক জায়গায়, যে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে অগ্রসর হতে হতে আর্যদের যাত্রাপথ এ দেশে এসে থেমে গেছে। মায়ানমার বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে তারা আর অগ্রসর হয়নি। বাংলা দেশে এক দিকে যেমন এশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় মঙ্গোলয়েড নৃগোষ্ঠীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আগমন ঘটেছে, তেমনই এখানে আছে বহু ধরনের আদিবাসী গোষ্ঠী, যেমন: সাঁওতাল, টিপরা, চাকমা ইত্যাদি। উপরন্তু আফ্রিকা থেকে আসা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস এবং পর্তুগীজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরাও এ দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে। বিচিত্র জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে। বস্তুত ইসলামী সভ্যতাকে যে বিষয়টি বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে, তা হল ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন ধরনের বিচিত্র সাংস্কৃতিক উপাদানের মিথষ্ক্রিয়া ও সংমিশ্রণ। ইসলামী মৌলিকতায় যেখানে এক ধরনের ঐক্যতান আছে, একই সঙ্গে সেখানে রয়েছে বিচিত্র ধরনের রং-বেরঙের সাংস্কৃতিক ধারা ও উপধারা। আঞ্চলিক উপাদানগুলো প্রত্যেক এলাকার সংস্কৃতিকে এক বিশেষ আঞ্চলিক রূপ দিয়েছে। এই আঞ্চলিক বৈচিত্র্যই হচ্ছে ইসলামী সভ্যতার সমৃদ্ধির গূঢ় রহস্য। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এই সভ্যতার চলার পথে এসেছে নানা ধরনের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ও বিচিত্র ধরনের সমস্যা। আর একই সঙ্গে মুসলিম সমাজকেও খুঁজে বের করতে হয়েছে নিত্য-নতুন সমাধান। ইসলামের প্রাথমিক যুগের শাসকদের (তথা খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ের) কল্পিত আদর্শ সমাজব্যবস্থা এবং পরবর্তীকালের বাস্তব মানব সমাজ, বৈপ্লবিক পরিবর্তন বনাম সামাজিক শান্তি ও স্থিরতা ইত্যাদি পরস্পরবিরোধী চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান খুঁজে পাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করা এবং সামঞ্জস্য খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা ইসলামকে যুগে যুগে আরও এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। তারই ফলে ইসলামী সভ্যতা এখন পর্যন্ত একটি জীবন্ত ও জাগ্রত ব্যবস্থা হিসাবে বিশ্বে টিকে রয়েছে। তবে ইসলামী ব্যবস্থার মধ্যে নমনীয়তার যথেষ্ট সংকুলান থাকলেও যুগে যুগে স্থান-কাল-পাত্রভেদে ইসলামকে নিত্য নতুন অভ্যন্তরীণ বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই বাধার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বিশেষ বিশেষ স্থান-কালে ইসলামের আচারগত দিকে দুইটি রূপভেদের উদ্ভব ঘটেছে। তার মধ্যে একটি হল, ইসলামী মূল ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে স্থানীয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের এক কৃত্রিম সংমিশ্রণ বা ‘সিনক্রেটিজম’, আর অন্যটি হল ইসলামী ভাবধারার আঞ্চলিক প্রকাশ ও দেশীয়করণ বা ‘ইন্ডিজেনাইজেশন’। বাহ্যিকভাবে মনে হবে যে এ দুটোর মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য নেই। কিন্তু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে, এ দুটির তাৎপর্য ভিন্ন। দেশীয়করণ প্রক্রিয়াটি অনেকাংশে ইসলামের মৌলিক চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অবকাশ রাখে, কারণ এর মাধ্যমে ইসলামী ভাবধারাকে যে কোন এলাকার আঞ্চলিক রূপরেখায় প্রকাশ করাটা সহজ হয়ে পড়ে। সাদামাটা কথায় বলতে গেলে ইসলামের আঞ্চলিক প্রকাশ ইসলামের দিকে আহ্বানের প্রক্রিয়া (তথা দা‘ওয়া) কে সহজতর করে তোলে। যুগে যুগে উলামা ও সূফী-সাধকেরা স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে ইসলাম প্রচারের জন্য এ প্রক্রিয়াটিকে বিশেষভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য তাঁরা স্থানীয় ভাষাগুলোর ব্যবহার ও কদর করেছিলেন। আঞ্চলিক যেসব আচার-অনুষ্ঠান ইসলামের মূলনীতির পরিপন্থী ছিল না, সেগুলো তাঁরা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিলেন।

অন্যদিকে সিনক্রেটিস্টিক বা বিপরীতমুখী ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্যের মিশ্রণ বা নির্বিচার মিলনধর্মী ধারাটি মূলধারার উলামা ও সূফী-সাধকগণ খুব সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি, কারণ এর মধ্যে তাঁরা ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী ও শরীয়তবিরোধী ভাব খুঁজে পেতেন। তবে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতি অঞ্চলেই কোন না কোন ধরনের সিনক্রেটিস্টিক ভাবধারা এবং তার ধারক ও প্রচারকদের খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলা দেশেও এ ধারাটি প্রথম থেকেই দেখা দিয়েছিল। মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা অভিজাত শ্রেণীর মুসলিমদের বড় একটা অংশ এবং এ দেশীয় একদল প্রাচীনপন্থী পীর ও মোল্লারা এ ধারায় বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। এই প্রাচীনপন্থীদের দল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়ে এসেছে, যেমন সাবেকী (প্রাচীনপন্থী), বেশরা (শরিয়তের বিধিনিষেধ থেকে স্বাধীন), ইবাহী (যারা বৈধ-অবৈধের ঊর্ধ্বে) ইত্যাদি। পুরাতন আচার-অনুষ্ঠানকে ইসলামী রূপে উপস্থাপনে এঁরা যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। শাসকদলের মধ্যেও এই ধারার প্রতি কিছুটা পরোক্ষ সমর্থন বরাবরই ছিল, কারণ তাঁরা নিজেরাও পারস্যের প্রাচীন সাসানীয় রাজকীয় সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। বস্তুত স্থানীয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের আড়ম্বর শাহী দরবারে তাঁদের রাজকীয় জৌলুস বাড়াত এবং তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করত। এভাবে এ দেশে একটি মিশ্র ধর্মীয় ধারা গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে পূর্বসূরীদের সমাধির প্রতি ভক্তিপ্রদর্শন তাঁদের ধর্মানুষ্ঠানের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।34 প্রাচীনপন্থী সনাতনধর্মী পীর, মোল্লা ও তাঁদের সমর্থক আশরাফ বা উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের সঙ্গে বৈপ্লবিক ও সংস্কারপন্থী উলামা ও সূফী-সাধকদের একটি প্রচ্ছন্ন স্নায়ুযুদ্ধ বরাবরই লেগে থাকত। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল তিতুমীরের ইংরেজবিরোধী জিহাদের বিরুদ্ধে প্রাচীনপন্থী পীরগোষ্ঠীর অবস্থান। প্রাচীনপন্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্রিটিশদের সমর্থন যুগিয়েছিল।
নানামুখি প্রবণতার জটিলতা থাকা সত্ত্বেও বাংলায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার যে কারণে সম্ভব হয়েছিল তা হল, উলামা ও সূফীগণ জনসাধারণের বোধগম্য ভাষায় ইসলামের আঞ্চলিক প্রকাশের পথটিকে বেছে নিয়েছিলেন। আর সত্যি কথা বলতে ইসলামের সাদামাটা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে যথেষ্ট সাড়া জাগাতে পেরেছিল। কারণ খুব বেশি সামাজিক, জাতিগত, বর্ণগত বিধিনিষেধ না থাকায় ইসলামী জীবনব্যবস্থাটি কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ জীবনযাত্রার প্রাকৃতিক ও সামাজিক চাহিদার সঙ্গে মানানসই ছিল। এর সামাজিক, বৈবাহিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলো ছিল সহজ-সরল। বিশেষ করে আদিবাসী ও বিভিন্ন যাযাবর জনগোষ্ঠীদের (যেমন বেদের দল) জন্য ইসলাম গ্রহণ সামাজিক মর্যাদা বাড়ানোর একটি মোক্ষম উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইসলামের বাণী অনেকটা বৈপ্লবিক হলেও এর প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল ধীরে ধীরে ও শান্তিপূর্ণভাবে। ইসলাম বাংলাদেশে যাযাবর থেকে স্থায়ী বসবাসের এবং সেই সঙ্গে কৃষিজ জীবনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্য দিকে ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করার বিভিন্ন রকমের চেষ্টা বিভিন্ন সময়ে সূফী সাধকেরা করে গেছেন। পাবনা জেলার নবগ্রামে ইলিয়াস শাহী আমলের সুলতান মাহমুদ শাহের সময়কালের একটি শিলালিপি (১৮৫৮ হিজরী/ ১৪৫৪ খ্রিস্টাব্দ) পাওয়া গেছে। শিলালিপিটিতে বাংলার গ্রামাঞ্চলে শরী‘আহ (ধর্মীয় অনুশাসনভিত্তিক জীবনযাত্রা) প্রতিষ্ঠায় উলামাদের প্রচেষ্টা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।35
বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর স্বাধীন সুলতানী আমলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটতে থাকে এবং স্বচ্ছলতাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। বাংলার স্বাধীন সুলতানদের অনেকেই জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমে যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। পথ-ঘাট নির্মাণ,36 কুয়া, পুকুর ও দীঘি খনন, বৃক্ষরোপণ, মাদ্রাসা, মসজিদ, সরাইখানা স্থাপন ইত্যাদি কাজকর্মের জন্য ব্যাপকভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়। মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ ইত্যাদি সংস্থা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য বিভিন্নমুখি অবদান রাখতে শুরু করেছিল। বর্ষা-বাদলার দিনে পথচারীরা প্রয়োজনে এখানে আশ্রয় নিতে পারত। মাদ্রাসা, মসজিদ, সরাইখানা সন্নিহিত পুকুর, দীঘি ও ইঁদারা থেকে গৃহবধূরা পানীয় জল সহজেই ব্যবহার করতে পারত। জীবিকা নির্বাহের নিমিত্তে প্রদত্ত ওয়াকফ ও মদদ–ই–মা‘আশ ইত্যাদির মত কতগুলো কার্যকর ও সুদূরপ্রসারী জনকল্যাণমুখি ব্যবস্থাপনা গোটা দেশব্যাপী গড়ে উঠতে শুরু করেছিল।
এক কথায় বলা যায়, ইসলাম গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে মানানসই ধর্ম হিসাবে হাজির হয়েছিল। সুলতানী ও মুঘল আমলে ইসলামের এই জনপ্রিয়তার ছাপ বাংলার সাংস্কৃতিক বহিঃপ্রকাশে বিভিন্নভাবে দেখা যায়, তা লোকসাহিত্য হোক, শিল্প বা স্থাপত্য হোক, অথবা নান্দনিক ক্ষেত্রে হোক। ক্রমশ ইসলাম এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের একটি বৃহৎ অংশের ধর্মবিশ্বাসে পরিণত হয় এবং একই সঙ্গে এই দেশের বাঙালি সংস্কৃতির উপরও ইসলামের একটা গভীর ছাপ পড়ে। মুঘল যুগে বাংলায় ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে এবং ধীরে ধীরে এমন এক সময় আসে, যখন এই অঞ্চলটি উপমহাদেশের শস্যের ঝুড়ি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করে। প্রামাণ্য তথ্য-উপাত্ত ও উৎসের অভাবে বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার, প্রসার ও প্রভাব সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে। মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্থানের দিক থেকে আগত বিজেতা মুসলিম বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্য সম্ভবত তাদের পরিবার-পরিজন সঙ্গে নিয়ে এদেশে আসেনি। বিজয়ের পর এদের অনেকেই যখন এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করল, তখন স্থানীয় লোকদের সঙ্গেও এদের কি রকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, অধিকাংশ সূত্র এ সম্পর্কে নীরব।
লেখক মিনহাজ আল-দীন সিরাজ তাঁর তাবাকাত–ই–নাসিরী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে বখতিয়ার খলজীর তিব্বত অভিযান বিফল হওয়ার পর তাঁর রাজধানী উত্তরবঙ্গের দেবীকোটে যখন ফিরে আসেন তখন তাঁর সঙ্গে মাত্র কয়েকজন মুসলিম সৈন্য ফিরে আসতে পেরেছিল। বাকি সবাই সে অভিযানে প্রাণ হারিয়েছিল। দেবীকোটে ঢোকার সময়ে এসব সৈন্যের স্ত্রী ও শিশুরা রাস্থায় দুপাশে ও ছাদের উপর দাঁড়িয়েছিল। বখতিয়ার খলজীর সঙ্গে তাদের আপনজনেরা ফিরে এল না দেখে তারা বিলাপের সুরে কান্না শুরু করে দিল। এরপর যখনই বখতিয়ার বাড়ি থেকে বের হতেন, তখনই নিহত সৈন্যদের স্ত্রী, পরিবার-পরিজন, ও সন্তানেরা কান্নায় ভেঙে পড়ত। বখতিয়ারের জন্য বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর ও লজ্জাকর হয়ে দাঁড়াল যে তিনি বাড়ি থেকে বের হওয়াই এক রকম ছেড়ে দিলেন এবং এর কিছুকাল পরে ভগ্ন মনোরথ হয়ে প্রাণত্যাগ করলেন (কোন কোন সুত্র অনুযায়ী আততায়ীর হাতে নিহত হলেন)37 এসব তথ্য থেকে মনে হয় বহিরাগত মুসলিম সৈন্যরা এই নব বিজিত দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিল। খুব স্বাভাবিক কারণেই মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই এদেশে বহিরাগত মুসলমানরা স্থানীয় লোকেদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। শিলালিপিতে মাঝেমধ্যে দেখা যায়, মহিলারাও মসজিদ, মাদ্রাসা ইত্যাদি তৈরি পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। বোয়া মালতী নামক এক মহিলা (৯৪১ হিজরী/ ১৫৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দ) একটি মসজিদ তৈরি করেন। প্রতিষ্ঠাতা মহিলার নামটি খাঁটি বাঙালি বলে মনে হয়। অন্যান্য ঐতিহাসিক উৎসের অভাবে শিলালিপিতে পাওয়া তথ্যগুলোই আমাদের কাছে খুব মূল্যবান হয়ে দাঁড়ায় এবং তারই ভিত্তিতে এ দেশের ইসলামের আগমন এবং প্রচার ও প্রসার সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যায়। তাছাড়া এ সব শিলালিপির সংখ্যা নেহাত কমও নয়। তের শতকের গোড়া থেকে আঠার শতকের গোড়া পর্যন্ত আরবী ও ফার্সী শিলালিপির মোট সংখ্যা পাঁচশ’র কাছাকাছি। এগুলো সে যুগের আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে রকমারি তথ্য যোগায়। অবশ্য এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে শিলালিপির তথ্যাদি নিতান্ত সীমিত হওয়ায় এগুলোর মাধ্যমে সে যুগের বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবর্তন ও সামাজিক চিত্রগুলো সম্পূর্ণরূপে ফুটে ওঠে না।
সামুদ্রিক বাণিজ্য ও ইসলামের প্রাথমিক যোগাযোগ
প্রাচীন বিশ্বে বণিকরা তাদের বাণিজ্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেদের অজান্তে ধর্ম ও সাংস্কৃতিক প্রসারের মাধ্যম ও বাহক হিসেবে কাজ করত। এ কথাটা ইসলামের ব্যাপারে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এশিয়া ও আফ্রিকার দূর-দূরান্ত অঞ্চলে ও পুরাতন বিশ্বের বিভিন্ন কোণে মুসলমান বণিকরাই অনেক ক্ষেত্রে ইসলামের বাণী প্রথম পৌঁছে দেয়। মুসলমানদের এই বাণিজ্য কর্মকাণ্ড স্থলপথের পাশাপাশি জলপথেও বিস্তার লাভ করেছিল। সত্যি বলতে কি, ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারিদের মত ইসলামী জগতে নিছক ধর্মান্তরের কাজে নিয়োজিত তেমন কোন সংস্থা কখনোই গড়ে উঠেনি। মুসলমানদের কোন নিয়মতান্ত্রিক মিশনারি সংস্থা না থাকলেও স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো পরোক্ষভাবে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সাহায্য করেছিল। মুসলিম বণিকদের ধর্মপ্রচারের এই প্রক্রিয়াটি বিশেষত বাংলাতে খুব শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিকভাবে হয়েছিল বলে মনে হয়। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারিদের যিশুখ্রিস্টের বার্তা বহন করার কলা-কৌশলের মধ্যে মৌলিক তফাৎ ছিল। খ্রিস্টান মিশনারিরা প্রয়োজনে জবরদস্তি ও আক্রমণাত্মক পন্থাও মাঝে মধ্যে অবলম্বন করত।38 ফলে প্রাচ্যের জনসমাজের অনেকেই পাশ্চাত্য থেকে আগত এ সকল খ্রিস্টান মিশনারি কার্যক্রমকে ঔপনিবেশিক দখলদারি বিস্তারের একটি মোক্ষম হাতিয়ার হিসাবে সন্দেহ করত। অন্যদিকে ইসলাম যখন এ এলাকায় আসে, তখন তার ভূমিকাটি রিচার্ড ইটনের ভাষায় এক উন্নততর সভ্যতার বাহকের মত ছিল। এসব কারণেই ইসলাম ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর এক বড় অংশের মুখ্য সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায়।
ইসলামের সাংস্কৃতিক ও আদর্শগত প্রভাব বিস্তারের পেছনে কোথাও কোথাও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও ইসলামের বিস্তার শুধুমাত্র বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাছাড়া ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যিক তৎপরতা কেবলমাত্র মুসলমানদের একচেটিয়া ছিল না। ইসলাম বিস্তারের কারণ অঞ্চলভেদে বিভিন্ন প্রকার ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দূর-প্রাচ্যে মুসলমানদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সামুদ্রিক যোগাযোগ সে অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য অংশে, যেমন ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ইসলাম বিস্তারের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও বাংলায় ইসলাম বিস্তারের ক্ষেত্রে বাণিজ্যের ভূমিকা ছিল গৌণ।
বাংলায় ইসলামের আগমনের সূচনালগ্নে এ দেশের সঙ্গে ইসলামের বিভিন্নমুখি যোগাযোগ দেখা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে প্রধানত উত্তর ও উত্তর-পূর্বের স্থল পথে এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপথে এই প্রাথমিক যোগাযোগ হয়েছিল (১ নম্বর মানচিত্র দ্রষ্টব্য)। বলা বাহুল্য যে বখতিয়ারের বিজয় এ দেশের সঙ্গে মুসলমানদের প্রথম যোগাযোগ নয়। অনেক আগে থেকেই ব্যবসায়ী, বণিক, নাবিক ও সূফী সাধকদের সঙ্গে এই দেশের যোগাযোগ পরিলক্ষিত হয়। মাত্র ১৮ জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে বখতিয়ার যখন সেন বংশের রাজধানী নাওদিয়ার প্রবেশ পথে উপস্থিত হন, তখন তাঁদেরকে অশ্ব-ব্যবসায়ী মনে করে দ্বার-রক্ষীগণ ভুলক্রমে বিনা বাধায় প্রবেশ করতে দেয় বলে তাবাকাত–ই–নাসিরী বইয়েরলেখক মিনহাজ উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা অনুমান করা যায় যে মুসলমান বিজয়ের পূর্বে বাংলায় মুসলমান অশ্ব-ব্যবসায়ীগণের যাতায়াত মাঝে মধ্যেই ঘটত।
![প্রত্নলিপি, বাঙালি, বাঙালিয়ানা ও বাংলায় ইসলাম: কিছু জিজ্ঞাসা [পর্ব ১]](http://nobojagaran.com/wp-content/uploads/2023/07/11.png)
ভারতীয় সূত্রাদিতেও মুসলমানদের সঙ্গে বাংলার প্রথম দিকের যোগাযোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। রত্নপালের (৩য় – ৪র্থ হিজরী / ৯ম – ১০ খ্রিস্টাব্দ) একটি শিলালিপিতে ‘তাজিক’40 শব্দের উল্লেখ স্পষ্টভাবে মধ্য এশিয়ার মুসলিমদের প্রতি নির্দেশ রাখে। আবার এ শব্দটির চীনা রূপান্তর তা–শিহ শব্দ দ্বারা মুসলমানদের চিহ্নিত করা হয়েছে।41 আসামের গৌহাটির নিকটে প্রাপ্ত ১২০৬ সালের একটি সংস্কৃত শিলালিপিতে তুরস্ক (তুর্কী বংশোদ্ভূত) শব্দ দ্বারা এই এলাকায় আগমনকারী মুসলমান সেনাবাহিনীকে বোঝানো হয়েছে।42
বাংলার উত্তরাঞ্চলে মুসলমানদের বিজয়ের বহু পূর্বেই বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে বণিক ও সূফী-সাধকরা প্রথম আগমন করেন ও ইসলাম প্রচার করেন। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলবর্তী অঞ্চলে কিছু মুসলমান বসতি গড়ে উঠার সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কেন না বঙ্গোপসাগরে মুসলমান বণিকদের ব্যাপক আনাগোনা ছিল। মধ্যযুগীয় কিছু সামুদ্রিক বিবরণমূলক আরবী ও ফার্সী উৎসগুলোতে বাহর–আল–হারকান্দ তথা বঙ্গোপসাগরের জোয়ার-ভাঁটা, ঢেউ, স্রোত, বায়ুর গতি, দ্বীপসমূহ ইত্যাদি নিয়ে বহুবিধ তথ্য পাওয়া যায়। বঙ্গোপসাগরে জাহাজডুবির মত বিভিন্ন দুর্যোগ এবং অন্যান্য নানা কারণে স্বাভাবিকভাবে মুসলমান নাবিকগণ (বিশেষত আরব বণিকরা) ক্রমান্বয়ে সেখানে বসতি স্থাপনে প্রণোদিত হয়। স্থান-নাম, যেমন চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী এলাকার ‘জাহাজ ভাঙ্গার ঘাট’, কোন সুদূর অতীত ঘটনার স্মৃতি বহন করে। আরাকানি একটি পুরাতন বিবরণে চট্টগ্রামের অদুরে আরাকান উপকূলবর্তী একটি গ্রামে কিছু আরবের বসতি স্থাপনের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিবরণটি উনিশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তী আরেকটি আরাকানি বিবরণে জানা যায় যে রাজা সু-লা-তাইং সান-দা-ইয়া (শাসনকাল: ৩৪০-৪৬ হিজরী/ ৯৫১-৫৭ খ্রিস্টাব্দ) একজন থু-রা-তান (সুলতান) কে পরাজিত করেন এবং সেত-তা-গংয়ে (অর্থাৎ চট্টগ্রাম) একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন।43 এই সুলতান একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন বলে মনে হয়। কোন কারণে তিনি আরাকান রাজার ঈর্ষার পাত্র হন অথবা আরাকান রাজা তাঁকে একজন সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ মনে করেন। তবে অন্য কোন সূত্রে এ বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায় না। আরাকানি বিবরণের ভিত্তিতে এনামুল হক মনে করেন যে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুসলমান বাসিন্দারা ক্রমান্বয়ে একটি সংঘবদ্ধ ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। অবশেষে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর উপকূলবর্তী অঞ্চলে তাঁরা একটি স্বাধীন রাজ্য গঠন করেন। এ ক্ষুদ্র রাজ্যের শাসনকর্তার উপাধি ছিল ‘সুলতান’।44
ইবনে বাত্তুতা ফখর আল-দীন মুবারক শাহের রাজত্বকালে ( ৭৩৯-৫০হিজরী/ ১৩৩৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দ) চট্টগ্রাম সফরে আসেন। তিনি এটিকে গঙ্গা নদীর মুখে একটি বন্দর বলে উল্লেখ করেছেন। পনের শতকের চীনা বিবরণে ও সম্রাট আকবরের রাজসভার ঐতিহাসিক আবু ’ল-ফযলের লেখায়ও অনুরূপ উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে যেসব মুসলমান বণিক এসেছিলেন তাঁদের অনেকে এটিকে শাতি আল–গঙ্গা অর্থাৎ গঙ্গার তীর, অথবা পরবর্তীকালে শাতি–জাম (যেমন: সুলায়মান ইবনে আহমদ ইবনে সুলায়মান, আল-‘উমদা আল–মাহরিয়্যা ফী দ্বাবতে আল-‘উলুম আল–বাহরিয়্যাহ) বলে আরবীতে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে শব্দটি বাংলার স্থানীয় উচ্চারণে ‘সাদকাওয়ান’, ‘চিটাগাং’ অথবা ‘চাটগাঁও’য়ে রূপ নেয়। ইবনে বাত্তুতার সূত্রে আরও জানা যায় যে ব্যবসা-বাণিজ্য শুধু সমুদ্রপথের উপর নির্ভর করত না, বরং অভ্যন্তরীণ নদীপথে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বাণিজ্যিক আদান-প্রদান হত।
![প্রত্নলিপি, বাঙালি, বাঙালিয়ানা ও বাংলায় ইসলাম: কিছু জিজ্ঞাসা [পর্ব ১]](http://nobojagaran.com/wp-content/uploads/2023/07/12.png)
চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী এলাকার আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে আরবী শব্দ, প্রবাদবাক্য ও বাগধারার মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। এটি হয়েছে আরব ও স্থানীয় জনসাধারণের দীর্ঘদিনের যোগাযোগের কারণে। উপকূলবর্তী এলাকাগুলো আরবদের সঙ্গে যোগাযোগের দ্বারা নিঃসন্দেহে বেশ প্রভাবিত হয়েছিল। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে স্থলপথে প্রধানত তুর্কী-পারসিক মুসলমানরা যোগাযোগ স্থাপন করে। চোদ্দ শতকে সোনারগাঁওয়ের সুলতান ফখর আল-দীন মুবারক শাহ চট্টগ্রাম বিজয় করতে সক্ষম হন। তবে ষোল শতকের প্রথম দিকে কেবলমাত্র বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে মুসলমানদের পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পর্তুগীজ ব্যবসায়ী বার্বোসা (৯২৪ হিজরী/ ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দ) যখন এই এলাকা পরির্শন করেন, তখন তিনি বন্দরটি দেখেন এবং এটিকে ‘বঙ্গালা’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি এটিকে একটি সমৃদ্ধ শহর রূপে দেখতে পান। এখানকার বাসিন্দারা অনেকেই ছিলেন আরব, পারস্য ও আবিসিনিয়ার ধনী ব্যবসায়ী। তাঁরা বড় বড় জাহাজের মালিক ছিলেন। তাঁরা করমণ্ডল, ক্যাম্বে, মালাবার, তেন্নাসিরিন, সুমাত্রা, মালাক্কা এবং সিংহলে উন্নত মানের সুতি, বস্ত্র, চিনি, ও অন্যান্য মূল্যবান পণ্য রপ্তানি করতেন। স্বাভাবিকভাবেই এরূপ একটি সমৃদ্ধশালী গোষ্ঠী খুব কম সময়ে গড়ে ওঠেনি। সমুদ্র সম্পর্কিত প্রাথমিক আরবী ও ফার্সী বিবরণগুলোতে বাহর শালাহাত (মালাক্কা প্রণালী) সম্পর্কে বহু মূল্যবান তথ্যাদি রয়েছে। তার মধ্যে একটি হল রামনি বা রামি দ্বীপ সম্পর্কে যা সম্ভবত বর্ত্তমান সুমাত্রার লামুরি দ্বীপ।45 রামি নামটি অবশ্য রামি নামের কোন একটি রাজ্যের সম্ভবনার ইঙ্গিত বহন করতে পারে যা কোন এক সময়ে বাংলার উপকূলে গড়ে উঠেছিল। ইংরেজ পর্যটক র্যাল্ফ ফিচ ১৫৮৫-৮৬ সালে তাঁর বাংলায় ভ্রমণের বৃত্তান্ত লিখতে গিয়ে এরকম একটি জায়গার কথা উল্লেখ করেছেন যার রাজধানী ছিল রামু। তবে কক্সবাজারের নিকটে রামু নামের একটি ক্ষুদ্র ও নিষ্প্রভ শহর এখন ও টিকে রয়েছে।

বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে ইসলামের আবির্ভাবের পর পার্শ্ববর্তী আরাকানেও এটি বিস্তৃত হয়। ব্লেভ্সের মানচিত্রে কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাকে কোদোভাস্কাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হুসাইন শাহী আমলের শেষ দিকে এই এলাকার শাসক ছিলেন খুদা বখশ খান। তাঁর নামানুসারে পর্তুগীজগণ এই এলাকার এরূপ নামকরণ করেছিল।46 মুঘল আমলের প্রথম দিকে আরাকানের মগ রাজারা বাংলার মুসলমান এবং শাসকদেরকে বেশ অসুবিধায় ফেলেন। বাংলার রাষ্ট্র ও জনসাধারণের সঙ্গে আরাকানিদের অবিরত সংঘাত হওয়া সত্ত্বেও তাদের সংস্কৃতির উপর ইসলামের এক ধরনের প্রবল প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এর পরিণতি স্বরূপ আরাকান এলাকায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিকাশ হয়, যা আজও বহাল আছে। এভাবে মুসলমানদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রাথমিক অধ্যায়টি (প্রধানত আরব বাণিজ্যিক যোগাযোগের মাধ্যম) বাংলা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ইসলামের সংহতকরণের পথ রচনা করে, যদিও এটি সীমিত আকারের ছিল। আরব দেশের শাফেয়ী মাযহাব বাংলায় চালু হয়নি। তবে ভারত মহাসাগরের অন্যান্য উপকূলবর্তী অঞ্চলে এটির ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বস্তুত শাফেয়ী মাযহাবের দৈনন্দিন জীবনের প্রতি নমনীয়তা উপকূলীয় এলাকায় এই মতবাদটিকে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। বিশেষ করে খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কে তাদের নীতি যথেষ্ট উদার ছিল। পানিতে [অথবা সমুদ্রে] বাস করা সব রকম প্রাণীকে তারা খাওয়ার জন্য বৈধ (হালাল) মনে করত।
বাংলায় মুসলিমদের সামরিক বিজয় ও শাসন প্রতিষ্ঠা
ইসলামী বিশ্বে অন্যান্য এলাকার মতো বাংলা অঞ্চলে ইসলামের ইতিহাস বিজয় ও উত্থান ও একটি অপেক্ষাকৃত উন্নত শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। এ দেশে প্রথম দিকে প্রাপ্ত শিলালিপিগুলির মূল বার্তা ছিল সামগ্রিক বিজয়ে আল্লাহর সাহায্য কামনা, আল্লাহর পক্ষ থেকে বিজেতাদের জন্য কোন পরীক্ষা নয় (দেখুন: দিনাজপুরের চেহেল গাজী মসজিদের শিলালিপি, তারিখ ৮৬৫ হিজরী/ ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দ)। ‘আলা আল-দীন আলী মর্দান খলজীর আমলে উৎকীর্ণ মুসলিম আমলের প্রথম শিলালিপিতে স্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে যে, শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় দিন দিন ইসলামের প্রসার হচ্ছে। সে যুগে মুসলিম শাসকদের বহুল ব্যবহৃত একটি উপাধি আবূ ’ল-মুযাফফার (বিজয়ী) একই বার্তা বহন করে। ইখতিয়ার আল-দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী (১৯ রমজান ৬০১ হিজরী/ ১০ মে ১২০৫ খ্রিস্টাব্দ) মাত্র অল্প কয়েকজন সৈন্য নিয়ে বাংলার শক্তিশালী সেন বংশের হিন্দু রাজা লক্ষণসেনকে পরাভূত করে লক্ষ্মণাবতী দখল করেন।47 এরপর তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যে রাঢ় ও বরেন্দ্র অঞ্চল বিজয় করে সে এলাকায় তাঁর শাসন কায়েম করেন। মুহম্মদ বখতিয়ার ‘খলজিস্থান’ নামে পরিচিত মধ্য আফগানিস্থানের পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী খিলজী গোত্রের লোক ছিলেন, যারা মূলত তুর্কী নৃগোষ্ঠীরই একটি শাখা ছিল।
মুসলমানদের এই আকস্মিক বিজয় সত্যিই বিস্ময়কর ছিল, কেননা তৎকালীন পূর্ব ভারতে লক্ষ্মণসেনকে একজন শক্তিশালী নৃপতি মনে করা হত। ইতিপূর্বে তিনি পার্শ্ববর্তী অনেক এলাকা ও শহর জয় করেছিলেন, যেমন: কলিঙ্গ, কামরূপ, পুরী (প্রাচীন আমলের পুরুষোত্তম ক্ষেত্র) এবং প্রয়াগ। সমসাময়িক মুসলিম ঐতিহাসিক মিনহাজ আল-দীন তাঁর যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন। মিনহাজের বইয়ে বাংলার প্রাথমিক যুগের মুসলিম অভিযানের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। বখতিয়ারের সামরিক বিজয়ের দ্বারা দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাঞ্চলে মুসলিম শক্তি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর ফলে এই এলাকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও জনমিতিগত পরিবর্তনের সূচনা হয় এবং রাস্ট্রীয় ও সামরিক ব্যাস্থাপনায় ব্যাপক রদবদল ঘটে। বাংলার সামরিক প্রতিরক্ষা নীতিতে এর আগে অশ্বারোহী বাহিনীকে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হত না। এছাড়া অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত অশ্বারোহী ভাড়াটিয়া সৈন্যদের নিয়োগের রীতিও এখানে গড়ে উঠেনি। বাংলার সামরিক ক্রীড়ার মধ্যে ঘোড়সওয়ারির রেওয়াজ, আর বিশেষ করে ঘোড়সওয়ারিতে রেকাবের ব্যাবহার তেমন একটা ছিল না। বাংলায় এই নবাগত সৈন্যশক্তির ঘোড়সওয়ারিতে রেকাবের ব্যাবহার সমর কলাকৌশলকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে এক নতুন মাত্রা দান করেছিল। গৌড় ও দিল্লি থেকে মুদ্রিত বখতিয়ার ও আলী মর্দান খিলজীর প্রাথমিক স্মারক মুদ্রায় পাওয়া ক্ষিপ্র গতিতে ধাবমান অশ্বের প্রতীকী ছাপগুলো থেকে অনুমান করা যায় যে মুসলমান যোদ্ধাদের উন্নত কলাকৌশল ও অশ্বারোহী বাহিনীর ক্ষিপ্রতার কারণে এই বিজয় সম্ভব হয়।48
এই বিজয়ের আরেকটি সম্ভাব্য অন্তর্নিহিত কারণ ছিল এই যে সেন শাসকদের ব্যাপক জনসমর্থন ছিল না। যতদূর মনে হয় বাংলার বিভিন্ন আদিবাসী ও অন্ত্যজ শ্রেণীর আধা-হিন্দু ও বৌদ্ধ জনগন সেন রাজাদের শাসন সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেনি। সেন আমলের পূর্বে বাংলায় বৌদ্ধদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। বৌদ্ধ পাল বংশ ছাড়াও প্রথম দিকের অনেক হিন্দু রাজা বৗদ্ধদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। রামপালের একটি সংস্কৃত তাম্রলিপিতে জানা যায় যে সুবর্ণচন্দ্র নামের জনৈক হিন্দু রাজা বুদ্ধের অনুসারী ছিলেন। সেনদের পূর্বে এদেশে বৌদ্ধ পাল বংশ শাসন করত, যারা বংশগতভাবে স্থানীয় লোক ছিল। পক্ষান্তরে সেনরা উঁচু জাতের হিন্দু ও শিব শক্তির উপাসক ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় ছিল। সুদূর কর্ণাট থেকে ভাগ্যান্বেষণে তারা এই দেশে এসেছিল। এ অঞ্চলে আগমনের পরই তারা উত্তর বঙ্গের বরেন্দ্র এলাকায় একটি জমিদারি স্থাপনে সক্ষম হয়।49 পাল বংশের শাসকদের দুর্বলতার কারণে সেনরা বাংলার একমাত্র শক্তিশালী শাসক হিসেবে আবির্ভূত হয়। জাতিভেদ প্রথার প্রতি তাদের অন্ধ আনুগত্যের কারণে স্থানীয় জনগণের মধ্যে তাদের ভিত্তি রচিত হয়নি।50 তাদের আগমনের আগে কিংবা তাদের সময়ে আর্যরা যে বৈদিক ধর্ম এ দেশে আনে, তা এ দেশের জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। নবাগত মুসলমানরা প্রথম থেকেই বাংলার আদিবাসী ম্লেচ্ছদের (ভারতের অনার্য আদিবাসী অথবা সভ্যতা-বর্জিত অহিন্দু আদিবাসী, যেমন তাবাকাত–ই–নাসিরী বইয়ে বর্ণিত উত্তাঞ্চলের মেচ গোত্র) একটা বড় অংশের সমর্থন পেতে শুরু করে এবং এদের অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে শুরু করে। আর্যরা মুসলমানদের ‘যবন’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। মূলত ‘যবন’ একটি সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ ‘বহিরাগত’ বা ‘বিদেশি’; এর সঙ্গে কিছুটা গ্রীক বার্বারোফোনোস (βαρβαρόφωνος) ধারণার মিল রয়েছে। অপরদিকে বখতিয়ারের আক্রমনের পিছনে যে প্রচ্ছন্ন যুক্তির আভাষ তাবাকাত–ই–নাসিরীর মতো দুয়েকটি সুত্রে পাওয়া যায়, তা হল মুসলিম আক্রমনকারীরা নিজেদেরকে একটি উন্নততর সভ্যতার বাহক হিসাবে দাবি করত, এবং অন্যান্য অঞ্চলকে নিজেদের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসা তাদের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করত। পূর্ববর্তী সেন শাসকদের পতনের পর আঞ্চলিক ক্ষমতায় ভারসাম্য আনয়নের উদ্দেশ্যে বখতিয়ার অনার্য আদিবাসীদের জন্য ও সেখানকার বৌদ্ধ জনগণের জন্য একটি বিরাট বিহার নির্মাণ করেন।51 এই ধরনের পদক্ষেপ স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে আফগানিস্থান ও মধ্য এশিয়া থেকে নবাগত মুসলমানদেরকে এক ধরনের যোগাযোগ বা বোঝাপড়া সৃষ্টি করতে সহায়তা করেছিল। সম্ভবত আদিবাসী জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিবেচনা থেকে বখতিয়ার তাঁর শাসনকেন্দ্র লখনাওয়াতী কিংবা নাওদার পরিবর্তে আরেকটু উত্তর-পশ্চিম দিকে দেবীকোটে নিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ হন। এই এলাকাটি প্রধানত স্থানীয় আদিবাসী লোকদের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল।
ঐতিহাসিক সূত্রমতে বাংলায় সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণের যে সব ঘটনা ঘটে, তার অন্যতম হল মেচ গোত্রের একজন অতি প্রতিপত্তিশালী নেতা ও প্রভাবশালী গোত্রপতি ‘আলী মেচ’ এর ইসলাম গ্রহণ। ‘মেচ’ শব্দটি সম্ভবত সংস্কৃত ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দ থেকেই উদ্ভূত হয়েছে, যার সাথে প্রাচীন গ্রীক Xenos বা জেনোস্ [ξένoς] শব্দার্থের অদ্ভূত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মেচ গোত্রের লোকজন বাংলার উত্তরাঞ্চলে হিমালয়ের পাদদেশে বসবাস করত এবং নৃতাত্তিক ও জাতিগত দিক থেকে মঙ্গোল, তুর্কী প্রভৃত জনগোষ্ঠিদের সাথে প্রাচীনকাল থেকেই এদের নিবিড় যোগসুত্র ছিল। আফগানিস্থান থেকে আসা সৈন্যদের সাথে তাদের ভাবগত মিল গড়ে উঠাটা অনেকটেই স্বাভাবিক ছিল বলে মনে হয়, কারন আফগানিস্থানের জনজাতিগুলোর এক অংশ ছিল মঙ্গোল ও তুর্কী জনগোষ্ঠি থেকে উদ্ভুত।52 এই নও-মুসলিম আলী মেচ স্বয়ং নিজেই বখতিয়ার খিলজীর তিব্বত অভিযানের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই অভিযানটি মুলতঃ তিব্বত ও কাশগড় (পূর্ব তুর্কিস্থান) ইত্যাদি দূর্গম পার্বত্য এলাকার মধ্য দিয়ে মধ্য এশিয়া (তথা আফগানিস্থান) গমনাগমনের জন্য একটি বিকল্প পথ খুঁজে বের করার ও অশ্ব সরবরাহকারী অঞ্চলগুলোর উপর নিজেদের আধিপত্ব কায়েম করার এবং মঙ্গোল ও তুর্কী জনগোষ্ঠিগুলোর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি সুদুরপ্রসারী উদ্যোগ ছিল। এই বিষয়ে জাতিগত ও গোষ্ঠিগত কারনে মেচদের ও যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। বখতিয়ারের তিব্বত অভিযানের ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর আলী মেচ তাঁর নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের পথও নিশ্চিত করেন। বাংলায় মুসলিমদের আগমনের পর এলাকার বিভিন্ন যাযাবর উপজাতি ও আদিবাসী জনগণের অনেকেই তাদের শিকার ও প্রকৃতি থেকে জীবিকা আহরনের আদি পেশা ত্যাগ করে ক্রমান্বয়ে কৃষি-ভিত্তিক আবাসিক জীবন বেছে নেয়53 এবং জীবনযাত্রা পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের পুরাতন প্রকৃতিবাদি ধর্ম ছেড়ে ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে (এ বিষয়ে কিছু নমুনার জন্য দেখুন পরিশিষ্ট ৩)। এই এলাকায় ইসলাম বিস্তারের আরেকটি কারণ হল ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, যেমন: কাজী, উলামা ও সূফী, বণিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাঙালি কৃষক সমাজের অবাধ মেলামেশা (মানচিত্র ৩, ৪ ও ৫ দ্রষ্টব্য)। বাংলায় বখতিয়ারের সামরিক বিজয় উপমহাদেশের সুদূর পূর্বাঞ্চলে ইসলামের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি সৃষ্টি করে। এই অভিযানের সফলতার ফলে বাংলার নতুন শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে রাজ্য বিস্তারের এক অদম্য স্পৃহার সৃষ্টি হয়। বখতিয়ারের তিব্বত আক্রমণ সফল হলে সেই অঞ্চলও হয়ত ইসলামী সভ্যতার সংস্পর্শে আসত এবং চীনের সঙ্গে ইসলামী বিশ্বের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ভিন্নরকম হত। বখতিয়ারের উত্তরসূরীরা চারিদিকে রাজ্যবিস্তার নীতি অব্যাহত রাখে। তবে তাদের সাফল্য সীমিত ছিল। প্রাথমিক শাসকগণ, যেমন হুসাম আল-দীন ইওয়াজ খিলজী এবং মুঘীস আল-দীন তুঘ্রীল পূর্ব বাংলায় কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। চৌদ্দ শতকের প্রথম দিকে মুসলমান সেনাদল পূর্ব ও উত্তর-পূর্বদিকে ব্রহ্মপুত্র নদ অতিক্রম করে সুকনাত (সিলেট), কামরূ (কামরূপ) এবং আসাম পর্যন্ত এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী চট্টগ্রাম পর্যন্ত অগ্রসর হয়।
বাংলায় ইসলামের প্রথম পর্যায় ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তার প্রভাবও খুব ক্ষীণ ছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে ইসলাম অধিকতর সক্রিয় শক্তি রূপে আবির্ভূত হয়। ইসলামের প্রথম যুগের রাজধানীগুলোতে (যেমন উত্তরাঞ্চলের লখনৌতি, গৌড়, পাণ্ডুয়া, একডালা এবং টাণ্ডা এবং পরবর্তীতে পূর্বদিকে সোনারগাঁও ও ঢাকা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সাতগাঁও এলাকায়) মুসলিম শাসন সংহতকরণের সাথে সাথে ইসলামের প্রচার ও প্রসারও বৃদ্ধি পায়। দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানদের রাজনৈতিক কেন্দ্র দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত না হলেও বাংলার রাজধানীগুলো ক্রমান্বয়ে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। দিল্লির সঙ্গে বাংলার দূরত্বের কারণে প্রথম থেকেই কেন্দ্রীয় শাসকদের পক্ষে এ দূরবর্তী অঞ্চলটি শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে উঠেনি। দিল্লী থেকে নিযুক্ত বাংলার শাসকগণ প্রায়ই স্বাধীন শাসকদের ন্যায় আচরণ করতেন। একেবারে প্রথম থেকেই এ ধরনের প্রবণতা এই এলাকার স্বাধীন রাজনৈতিক কাঠামো গঠনে সহায়ক হয়। বাংলায় বখতিয়ারের সামরিক বিজয়ের পূর্বে আরব-ইসলামী দুনিয়ার সঙ্গে কেবলমাত্র বাংলার দক্ষিণের উপকূলবর্তী অঞ্চলে সমুদ্রপথে যোগাযোগ হত। স্থলপথে উত্তর দিক থেকে আগত এই নতুন সংযোগটি অতীতের যোগাযোগ অপেক্ষা অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকায় দেখা দেয়। আফগানিস্থানের দিক থেকে আসা এই নতুন রাজনৈতিক শক্তি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি নতুন উপাদান সংযুক্ত করে, যার মধ্যে প্রাচীন সাসানীয়-পারসিক সভ্যতার প্রভাব মিশ্রিত ছিল। একই সময়ে মধ্য-এশিয়া, বিশেষ করে খুরাসানের উলামা, মাশায়েখ ও সূফীগণ (যেমন: মুযাফ্ফার শামস বলখী) ইসলামী শিক্ষা-সাহিত্য বিস্থারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পারস্যের মত এ দেশেও একেবারে গোড়ার দিক থেকেই রওজা (সূফী-দরবেশদের সম্মানার্থে নির্মিত সমাধি) প্রতিষ্ঠা করার একটা প্রবণতা দেখা যায়।54 এ সময়ে বাংলার জনগণের দৈনন্দিন কথাবার্তায় অনেক ফার্সী (ও আরবী) শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে।55 বাংলার প্রথম দিকের শাসক ‘আলা আল-দীন খিলজীর ( ১২১০-১৩খ্রিস্টাব্দ) শিলালিপি এবং বলকা খানের (১২২৯-৩১খ্রিস্টাব্দ) শিলালিপি দুটিই ফার্সীতে উৎকীর্ণ হয়েছিল। গভীরভাবে ফার্সী সংস্কৃতি ভাবাপন্ন শাসকগণ ফার্সীকে দরবারের ভাষা হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। হযরত নূর কুতব আল-আলমের (মৃত্যু ১৪৫৯?) মত সূফীগণ লেখালেখির জন্য অবাধে ফার্সী ব্যবহার করেন। তাঁদের অধিকাংশ মালফুজাত তথা আধ্যাত্মিক নিবন্ধ এবং মাকতুবাত তথা পত্রাবলি ফার্সী ভাষায় রচিত। তবে ধর্মীয় ব্যাপারে আরবীর প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় (যেমন: আরবীতে লেখা ১২২১ সালের খানকাহ শিলালিপি, নং ২)।

স্বাধীন সুলতানী শাসনের অভ্যুদয় এবং ইসলামী সংস্কৃতির বিস্তার
‘আলা আল-দীন ‘আলী মর্দান খিলজী বাংলার তৃতীয় শাসক ছিলেন। তিনি ৬০৭/ ১২১০ সালে অর্থাৎ বাংলা বিজয়ের মাত্র ছয় বছরের মধ্যে নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন (শিলালিপি নম্বর ১, চিত্র ১ দ্রষ্টব্য)। অনুরূপভাবে দিল্লিভিত্তিক বলবনী বংশের বিচ্ছিন্ন কিছু শাসকও এখানে নিজেদেরকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন। দিল্লিতে যখন মুহম্মদ ইবন তুঘলক রাজত্ব করছিলেন তখন সোনারগাঁওয়ে ফখর আল-দীন মুবারাক শাহ, উত্তর-পশ্চিমে লক্ষ্মণাবতীতে ‘আলা আল-দীন ‘আলী এবং সাতগাঁওয়ে সম্ভবত কদর খান রাজত্ব করছিলেন। ক্ষমতা দখলের এই দ্বন্দ্বের মধ্যে হাজী ইলিয়াস শাহ (৭৪০-৫৯ হিজরী/ ১৩৩৯-৫৮ খ্রিস্টাব্দ) প্রথমে সাতগাঁও এবং পরে লক্ষ্মণাবতীতে বিজয়ীবেশে আবির্ভূত হন। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে ক্ষুদ্র এ তিনটি রাজ্য এক অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাজ্যে পরিণত হয় এবং ক্রমান্বয়ে বিস্তৃতি লাভ করে। এভাবে ইলিয়াস শাহী শাসকরাই চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি সার্থকভাবে একটি সত্যিকারের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। এ বংশের শাসনামলে বাংলায় শিল্পকলা ও স্থাপত্যের বিকাশ হয় এবং বস্ত্রশিল্প, কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্রুত বিস্তার ঘটে। পনের শতকের প্রথম দিকে গিয়াস আল-দীন আ‘যম শাহ চীন, পারস্য ও আরব-বিশ্বের সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করেন। বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য চট্টগ্রাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের ভূমিকা পালন করে এবং দূর-প্রাচ্যের সঙ্গে সামুদ্রিক যোগাযোগ ও মুসলমান তীর্থযাত্রীদের হজ্জ-ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে জাহাজে আরোহণ ইত্যাদির জন্য এটি একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় (মানচিত্র নং ১ দ্রষ্টব্য)।57 আরব দেশের অনেক সমুদ্র-যাত্রী, পরিব্রাজক, ব্যবসায়ী ও ধর্মীয় ব্যক্তি এই সময়ে বাংলায় আগমন করেন। এই আমলে মক্কার যেসব আলেমরা বাংলায় ভ্রমণ করেন, তাঁদের মধ্যে আহমদ ইবনে সুলায়মান ইবনে আহমদ আল-তারুজী (মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার একজন পণ্ডিত ও পরিব্রাজক, মৃত্যু: ৮১২ হিজরী/ ১৪১০ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন অন্যতম। সে সময়ে বাংলা একটি সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।58
![প্রত্নলিপি, বাঙালি, বাঙালিয়ানা ও বাংলায় ইসলাম: কিছু জিজ্ঞাসা [পর্ব ১]](http://nobojagaran.com/wp-content/uploads/2023/07/14.png)
বাংলায় শাসক শ্রেণীর সঙ্গে উলামা ও সূফী-শায়খদের বরাবর এক ধরনের অনুরাগ-বিরাগের মিশ্র সম্পর্ক ছিল। সেখানে পারস্পরিক গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর সমস্যা রূপে মাঝে মধ্যে মাথা চাড়া দিত। এটি ইসলামী বিশ্বের একটি ঐতিহাসিক সমস্যা। রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে আসীন হিন্দু অভিজাত শ্রেণী ও আমলাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিষয়টি উলামা ও সূফী-শায়খদের অনেকেই কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখতেন। সূফী-শায়খদের মধ্যে এ বিষয়ে নূর কুতব আল-আলম সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন। তিনি বরেন্দ্র এলাকার ভাতুড়িয়ার শক্তিশালী হিন্দু জমিদার রাজা কংসের (সম্ভবত সংস্কৃত গণেশ শব্দের আরবী বানান) ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। পরিশেষে রাজা গণেশ ১৪১৪ সালে এবং পুনরায় ১৪১৬-১৭ সালে ক্ষমতা দখল করেন। তবে তাঁর পুত্র যদু এক পর্যায়ে নূর কুতব আল-আলমের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় বাংলায় উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। যদু সিংহাসনে আরোহণের পর সুলতান জালাল আল-দীন মুহম্মদ শাহ (রাজত্বকাল ১৪১৪-৩৩ খ্রিস্টাব্দ) নাম ধারণ করেন। উচ্চবর্ণের স্থানীয় একজন হিন্দুর ইসলাম গ্রহণের প্রভাব সুদূরপ্রসারী ছিল, কেননা এটি বাংলায় অভিজাত শ্রেণীর হিন্দুদের ধর্মান্তরের নজির স্থাপন করে। তার সময়ে বাংলার উলামা ও পণ্ডিতবর্গ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর জন্য উত্তর ভারত বা মধ্য এশিয়া থেকে আগত পারসিক প্রভাবের পাশাপাশি সরাসরি মক্কা, মদীনা, দামেশক, কায়রো এবং আরব বিশ্বের অন্যান্য সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রের দিকে তাকাতে শুরু করেন। এভাবে এক আঞ্চলিক বাঙালি ইসলামী সংস্কৃতি রূপে এই এলাকায় ইসলামের বিকাশের তৃতীয় অধ্যায় শুরু হয়। কায়রোর আব্বাসীয় খলীফার নিকট থেকে আমীর (আঞ্চলিক শাসক) হিসাবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও মনোনয়ন সংগ্রহের জন্য সুলতান জালাল আল-দীন সুলতান বারসবাইয়ের নিকট রাজকীয় উপঢৌকনসহ দূত প্রেরণ করেন। তাঁর এ প্রচেষ্টা সফল হয়। মক্কা ও মদীনায় পূর্ববর্তী সুলতান আ‘জম শাহের স্থাপিত দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তিনি মূল্যবান অনুদান প্রেরণ করেন। আল-মাদ্রাসা আল-সুলতানিয়্যা আল-গিয়াসিয়্যাহ আল-বাঙ্গালিয়্যাহ নামে খ্যাত এ বাঙালি বিদ্যাকেন্দ্রদুটোর সুনাম দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। আরব-বাংলার বহু পুরাতন সম্পর্ক এভাবে এক নতুন প্রেরণা পায় এবং বাঙালি সংস্কৃতিকে মূল ধারার আরব সংস্কৃতির আরও কাছাকাছি নিয়ে যায়। অবশ্য এ স্থানীয় বাঙালি মুসলিম বংশ বেশি দিন রাজত্ব করতে পারেনি। পূর্ববর্তী ইলিয়াস শাহী বংশ ৮৪১ হিজরী/ ১৪৩৭ খ্রিস্টাব্দ সালের দিকে পুনরায় ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়। তবে এর ফলে ধর্মীয় ভাবধারার আমূল পরিবর্তন হয় নি। পরবর্তী স্বাধীন সুলতানদের আমলেও বাংলা প্রভূত সমৃদ্ধি অর্জন করে এবং অনেক দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক বন্ধন সম্প্রসারিত হয়। একদিকে বাংলার রাজদরবারে যেমন চৈনিক দূতগণ আগমন করতেন, অন্যদিকে তেমনি বাংলার সুলতানদের দূতগণ তাঁদের উপর ন্যস্ত কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের জন্য সুদূর কায়রো এবং হেরাত পর্যন্ত ভ্রমণ করতেন। এভাবে বাংলার শাসকগন একই সঙ্গে পূর্ব এবং পশ্চিমের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
![প্রত্নলিপি, বাঙালি, বাঙালিয়ানা ও বাংলায় ইসলাম: কিছু জিজ্ঞাসা [পর্ব ১]](http://nobojagaran.com/wp-content/uploads/2023/07/15-219x300.png)
পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশ ৮৯৩ হিজরী/ ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসন করে। পরিশেষে মূলত আফ্রিকা থেকে খোজা ক্রীতদাস রূপে আনীত হাবাশী বা কৃষ্ণবর্ণের প্রাসাদরক্ষীগণের নেতা সুলতান শাহজাদা পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশের সর্বশেষ সুলতান ফাত্হ শাহকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন। কিছুদিন অরাজকতার পর শেষ পর্যন্ত পুনরায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ৮৯৮ হিজরী/ ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে সৈয়দ ‘আলা আল-দীন হুসাইন শাহের হাতে চলে যায়। তিনি আরবের সৈয়দ বংশোদ্ভূত বলে দাবি করেন। এই নতুন বংশের শাসনামলে অনেক মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মীয় ইমারত নির্মিত হয়, যার ফলে বাংলায় ইসলামী ঐতিহ্য আরও শক্তিশালী হয়। এ পর্যন্ত শুধুমাত্র হুসাইন শাহী আমলের প্রায় শ’ খানেক মসজিদের শিলালিপি (শিলালিপির তালিকা দ্রষ্টব্য) আবিষ্কৃত হয়েছে। এই বংশের শাসন (১৪৯৩-১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ) প্রায় ৪৬ বছর টিকে ছিল। এই পরিশীলিত ও উদারমনা শাসকগণ স্থাপত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি এবং বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। মহাভারত এর মত কয়েকটি মহাকাব্যের বঙ্গানুবাদও এই আমলে সম্পন্ন হয়। এসব সুলতানদের জনকল্যাণমূলক কার্যকলাপ জনসাধারণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটায়। এ সময়ের অনেক শিলালিপিতে পানির ঝরনা নির্মাণ, পুষ্করিণী ও কূপ খনন, বাঁধ, রাস্তাঘাট, সংযোগ সড়ক ও সাঁকো তৈরির উল্লেখ পাওয়া যায়। এর সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলে ইসলামের দ্রুত বিস্তারের পথও সুগম হয়। মুঘল আমলের গোঁড়ার দিকেই ‘কলকাতা’ নামী একটি শহর ও সামুদ্রিক বন্দর ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে শুরু করেছিল, যার ছিটাফোঁটা ইঙ্গিত সে সময়ের কোন কোন সুত্রে পাওয়া যায়। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে নিকোলা সুঁসাঁ কর্তৃক ১৬৫২ সালে অঙ্কিত একটি মানচিত্রে (নং ২, চিত্র ৩.৭) কোলকাতা নামটি স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে। উত্তর কলকাতার চিৎপুরে অবস্থিত বসরি শাহের মসজিদ নামে পরিচিত মসজিদটি মধ্য যুগে কলকাতা ও আশেপাশের এলাকায় ব্যাপক মুসলিম জনবসতি গড়ে উঠার পরিচয় বহন করে এবং একই সঙ্গে সে কালে চিৎপুর এলাকার নগরায়নের সাক্ষ্য দেয়। কলকাতা থেকে মাত্র ৪০ মাইল দূরে, চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাট শহরের কেন্দ্রে সুলতান বারবক শাহের (৮৬৪–৭৮ হিজরী/ ১৪৬০–৭৪ খ্রিস্টাব্দ) আমলের সালিক মসজিদ (তারিখ ৮৭১ হিজরী / ১৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ) দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকায় সুলতানী ও মুঘল যুগে ইসলামের বিস্তারের সাক্ষ্য দেয়।
![প্রত্নলিপি, বাঙালি, বাঙালিয়ানা ও বাংলায় ইসলাম: কিছু জিজ্ঞাসা [পর্ব ১]](http://nobojagaran.com/wp-content/uploads/2023/07/16-295x300.png)
বঙ্গ নামটি বেশ প্রাচীন হলেও বাঙ্গাল, বাঙালি, বাংলা ইত্যাদি নামগুলো মুসলিমদের এই অঞ্চলে আগমনের পরে আস্তে আস্তে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে। সুলতানী আমলে এই অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম সত্যিকারের বাঙালি জাতীয় সচেতনতা গড়ে উঠতে শুরু করে, যা নিঃসন্দেহে বাঙালিয়ানার সর্বপ্রথম অঙ্কুরদগোম। উদাহরণস্বরূপ ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮) শাহ–ই–বাঙালিয়ান (বাঙালিদের নৃপতি), শাহ–ই–বাঙ্গালা (বাংলার রাজা) এবং সুলতান–ই–বাঙ্গাল (বঙ্গের সুলতান) উপাধিগুলো দিয়ে চতুর্দিকে পরিচিতি লাভ করেন, যেগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতীয়বাদের বীজ নিহিত ছিল। একটি স্বাধীন বাঙালি জাতির মানষিক স্ফুরণের সব ধরণের লক্ষণই এই সময়ের ‘বাঙালিয়ানা’র জাগরণের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। বহির্বিশ্বে এই বাঙালি জাতীয় সত্তার পরিচিতি ক্রমাগত বাড়তে থাকে। বাংলার বাইরে সুদুর মক্কায় সুলতান গিয়াস আল-দীন আ‘যম শাহের (শাসনকাল ১৩৯০ – ১৪১০) পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত ‘বাঙালি বিশ্ববিদ্যালয়’ (আল-মাদ্রাসা আল-সুলতানিয়্যাহ আল-গিয়াসিয়্যাহ আল-বাঙালিয়্যাহ) আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি পায়, যা ‘বাঙালি’ নামটিকে একটি বিশ্বজনীন রূপ দেয়। বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস থেকে শুরু করে নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি, স্মার্ত্ততিলক রঘুনন্দন, চৈতন্যদেবের পরগামী অপূর্ব বৈষ্ণব সাহিত্য ইত্যাদি নানা ধরণের সাংস্কৃতিক উন্মেষের মধ্য দিয়ে বাঙালির মানষিক জ্যোতি এই অঞ্চলকে উদ্ভাসিত করে, যার মূলমন্ত্র ছিল বহুত্ত্ববাদ এবং যা সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে ছিল। বাংলার সাংস্কৃতিক প্রভাব ধীরে ধীরে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতেও ছড়াতে শুরু করে। এর অন্যতম উদাহরণ হল আরাকান (রোসাঙ্গ) রাজসভা, যেখানে দৌলত কাজী (১৬০০-৩৮), আলাওল (১৬০৭-৮০), মাগন ঠাকুর (১৬০০-৬০) ও মরদন (১৬০০-৪৫) এর মত যশস্বী কবিরা মানবীয় প্রেমের জয়গান করে এক নতুন ধারার বাংলা সাহিত্য রচনায় প্রয়াসী হন। ষোল ও সতের শতাব্দিতে আরাকান রাজাদের বেশ কিছু মুদ্রায় বাংলা হরফের ব্যবহার দেখা যায়।59 পুরাকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত বাংলার ইতিহাসে সুলতানী আমল নিঃসন্দেহে সব দিক থেকে এক সোনালী অধ্যায়, যার নজির আজ পর্যন্ত আর দেখা যায়নি। এই সময়ে বাংলা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী বাণিজ্য অঞ্চলে পরিণত হয়। বাংলার এই প্রবাদপ্রতীম সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি মুঘল যুগে এবং নবাবী আমলে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির ক্ষমতা দখলের সময় পর্যন্ত চলমান থাকে। সে কালের ইউরোপীয় উৎসগুলোও একই রকম সাক্ষ্য দেয়। সে যুগে শস্যের ঝুড়ি হিসাবে খ্যাত সুবাহ-ই-বাঙ্গাল (তথা বঙ্গ প্রদেশ) এর মোট উৎপাদন আনুমানিকভাবে বিশ্বের মোট উৎপাদনের (তথা GDP এর) ১২ শতাংশের কাছাকাছি ছিল, যা সে সময়ে সমগ্র ইউরোপের জিডিপির চেয়েও বেশি ছিল।60
![প্রত্নলিপি, বাঙালি, বাঙালিয়ানা ও বাংলায় ইসলাম: কিছু জিজ্ঞাসা [পর্ব ১]](http://nobojagaran.com/wp-content/uploads/2023/07/17-300x300.png)
এই আমলের শিলালিপিগুলোর মাধ্যমে তখনকার জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক ও সমাজচিত্র সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানা যায়। বর্তমানে ঢাকাস্থ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে হুসাইন শাহের শাসনামলের হাজী বাবা সালিহের তিনটি শিলালিপি আছে, যার মাধ্যমে মধ্যযুগীয় বাংলার মুসলিম ধনী গ্রাম্য জমিদারদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যায়। হাজী বাবা সালিহকে সেকালের সফল একজন ব্যক্তির সম্ভাব্য উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। শিলালিপি পাঠের ভিত্তিতে ধারণা করা যায় যে জীবনের শেষ দিকে সৎকর্ম হিসেবে তিনি ঢাকা জেলার আজিমনগর গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন (দ্রষ্টব্য: আজিমনগর মসজিদের শিলালিপি, তারিখ ৯১০ হিজরী/ ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দ)। পরবর্তী বছর (৯১১ হিজরী/ ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দ) তিনি হজ্জব্রত পালনের জন্য মক্কায় গমন করেন। একটি শিলালিপিতে দেখা যায় যে হজ্জব্রত পালন শেষে দেশে ফিরে তিনি তখন ‘খাদিম আল-নাবী হাজী আল-হারামাইন ওয়া যাইর আল-কাদামাইন’ (নবীর ভৃত্য, যিনি হারামাইনে তীর্থ যাত্রা সম্পন্ন করেছেন এবং যিনি দুটি [পবিত্র] পদচিহ্ন পরিদর্শন করেছেন) ইত্যাদি পদবি ব্যবহার করেছেন (দ্রষ্টব্য: বন্দর মসজিদের শিলালিপি তারিখ ৯১১ হিজরী/ ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দ)। পরবর্তী বছরে কুরআনের আয়াত সম্বলিত একটি কবরের শিলালিপিতে হাজী বাবা সালিহের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে তাঁকে একজন ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। স্বভাবতই এই শিলালিপিটি তাঁর কবরের উপর কোন এক সময়ে স্থাপিত ছিল। হয়তো বা উদ্দেশ্য ছিল তাঁর কবর ঐ এলাকার একটি ধর্মীয় (পবিত্র) স্থান তথা রওজায় পরিণত হবে। হুসাইন শাহী আমলের শেষের দিকে আফগান নেতা শের শাহ সুরী বাংলা দখল করলে হুসাইন শাহী বংশের অবসান হয়। শের শাহ মুঘল সম্রাট হুমায়ূনকে ভারত থেকে বিতাড়িত করার ভিত্তিভূমি হিসাবে বাংলাকে ব্যবহার করেন এবং এক পর্যায়ে পূর্ণভাবে বাংলার উপর নিজের কর্তৃত্ব বিস্তার করেন। এ সময় থেকে বাংলার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে শুরু করে। আফগানদের পরাজয়ের পর লাহোর এবং দিল্লিতে মুঘল শক্তি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর বাংলায় মুঘল প্রভাব দেখা দিতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ বিহারের প্রাক্তন প্রশাসক ও পরবর্তীতে বাংলার শাসক সুলায়মান কররানী (৯৭১ – ৮০ হিজরী/ ১৫৬৪ – ৭২ খ্রিস্টাব্দ) সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেন।
![প্রত্নলিপি, বাঙালি, বাঙালিয়ানা ও বাংলায় ইসলাম: কিছু জিজ্ঞাসা [পর্ব ১]](http://nobojagaran.com/wp-content/uploads/2023/07/18.png)
টীকা ও গ্রন্থপঞ্জি
_________________________________________________________________________________________________________________
- মধ্যযুগীয় ‘মুসলমানি বাংলায় লেখা এ পুঁথিটির জন্য দেখুন: আলি রাজা, আগাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, পাণ্ডুলিপি নং এস. এ. বি. – ৯, পাতা: ২৪-২৫; আরও দেখুন: অসীম রায়, ইসলাম ইন সাউথ এশিয়া: এ রিজিওনাল পারস্পেকটিভ (নিউ দিল্লি: সাউথ এশিয়ান পাবলিশার্স, ১৯৯৬), ২৯।
- স্ট্যান গরন ও জে. পি. গোয়েঙ্কা, দ্যা কয়েনস অফ দ্যা ইন্ডিয়ান সুলতান (নতুন দিল্লি : মুনশিরাম মনোহরলাল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০১), ১৯১-৯৮।
- স্ট্যান গরন ও জে. পি. গোয়েঙ্কা, দ্যা কয়েনস অফ দ্যা ইন্ডিয়ান সুলতান (নতুন দিল্লি : মুনশিরাম মনোহরলাল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০১), ১৪৩, ১৬০-৬১।
- মাওলানা মিনহাজ আল-দীন সিরাজ, তাবাকাত-ই-নাসিরী, সম্পাদনায় আব্দুল হাই হাবীবী, (কাবুল, ১৩৪২ হিজরী), ৪২৫–৬৭। উল্লেখ্য, বাংলায় প্রথম পর্যায়ের মুসলিম শাসন সম্পর্কে সবচেয়ে মূল্যবান তথ্য এ বইটিতে পাওয়া যায়।
- দিলীপ কে. চক্রবর্তী, অ্যানশিয়েন্ট বাংলাদেশ: এ স্টাডি অব দি আর্কিওলজিকাল সোর্সেস (ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০১): ২৫।
- নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদিপর্ব, কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, আশ্বিন, ১৪০২।
- সুন্দরবনের উপর বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: মুহম্মদ ইউসুফ সিদ্দিক, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম, ২য় সংস্করণ, প্রবন্ধ ‘সুন্দরবন’।
- বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: মুহম্মদ ইউসুফ সিদ্দিক, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম, ২য় সংস্করণ, প্রবন্ধ ‘রুহমী’।
- বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: আহমদ ইবন আবী ইয়াকূব, তারীখ ইয়াকূবী, সম্পাদনা. এম থিওডুর হুৎসমা, লেইডেন, ই. জে. ব্রিল, ১৯৬০, ১০৬।
- আল-হামাদানী, কিতাব আল-বোলদান, সম্পাদক: এম. জে. ডি গোজে, লেইডেন, ই. জে. ব্রিল, ১৯৬৭, ১৫।
- শরফ আল-জামান তাহির মারভাজী, ‘ফী ’ল-সীন ওয়া ’ল-তুর্ক ওয়া ’ল-হিন্দ’ (এটি মূল গ্রন্থ তাবাই‘ আল-হাইওয়ান এর একটি পরিচ্ছেদ) শরফ আল-যামান তাহির মারওয়াযী, অন চায়না, দ্য টার্কস অ্যান্ড ইন্ডিয়া, অনুবাদ ও সম্পাদনায়: ভি মিনোরস্কি, লন্ডন, রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি, ১৯৪২, টেক্সট ৩৫।
- সুলায়মান আল-তাজির ও আবূ যায়দ আল-সীরাফী, আখবার আল-সীন ওয়া ’ল-হিন্দ (২৩৭ হিজরী/ ৮৫১ খ্রিস্টাব্দ), সম্পাদনা ও অনুবাদ: জে. সোভাজে, রিলেশিও দ লা শিন এ ল’ইন্দ, প্যারিস, সোসাইটি সংস্করণ, ১৯৪৮, টেক্সট ১৩–১৪।
- কিতাব আল-মাসালিক ওয়া ’ল-মামালিক, সম্পাদনা: এম. জে. ডি গোজে (লেইডেন: ই. জে. ব্রিল, ১৯৬৭), ৬৩–৬৭।
- অনুবাদ. ভি. মিনোরস্কি, লন্ডন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৩৭, ৮৭।
- শাহনাজ হুসনে জাহান, এক্সক্যাভেটিং ওয়েভস অ্যান্ড উইন্ডস অব (এক্স)চেঞ্জ: এ স্টাডি অব ম্যারিটাইম ট্রেড ইন আর্লি বেঙ্গল, অক্সফোর্ড, ব্রিটিশ আর্কিওলজিকাল রিপোর্টস (বি. এ. আর.), জন অ্যান্ড এরিকা হেজেস লি. ২০০৬, ৪৩–৫০।
- এম মোহর আলী, হিস্টরি অব দি মুসলিমস অব বেঙ্গল, খণ্ড ১এ, রিয়াদ, ইমাম মুহম্মদ ইবন সৌদ, ১৯৮৫, ৩৩–৩৫।
- মুহম্মদ ইউসুফ সিদ্দিক, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম, ২য় সংস্করণ, প্রবন্ধ ‘রুহমী’।
- ননী গোপাল মজুমদার, ইনস্ক্রিপশনস অব বেঙ্গল, ৩য় খণ্ড, রাজশাহী, বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম, ১৯২৯, ৩; এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, খণ্ড ৯, ২৩১; ডি.সি. সরকার, এপিগ্রাফিক ডিসকভারিজ ইন ইস্ট পাকিস্তান, (সংস্কৃত কলেজ, কলকাতা: ১৯৭৩), ৩৭; জার্নাল অব অন্ধ্র হিস্টরিকাল রিসার্চ সোসাইটি, খণ্ড ৪, ১৫২।
- বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: দীনেশচন্দ্র সরকার, “ময়নামতী চন্দ্র বংশীয় তাম্র শাসনত্রয়”, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ কোমেমোরেশন ভলিউম, সম্পাদনা. মুহম্মদ এনামুল হক, ঢাকা, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ১৯৭২।
- ভারতবর্ষের উপর ইউরোপীয়ানদের মধ্যযুগের আঁকা দু-একটা মানচিত্রে সুকনাত নামক জায়গাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ দেখুন: হিজ পিলগ্রিমস, স্যামুয়েল পারচা।
- মিনহাজ আল-দীন, তাবাকাত–ই–নাসিরী, সম্পাদনা. ডব্লিউ. এন. লীস, কলকাতা, ১৮৬৩–৬৪, ১৪৮–৫৩।
- রজনীকান্ত চক্রবর্তী, গৌড়ের ইতিহাস, (কোলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯৯), ১২৫, ভুমিকা-পৃষ্ঠা ১০।
- ফার্সী পাণ্ডুলিপি, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, কলকাতা, নং. পি. সি. সি. – ১, ফোলিও ১৬ ও ১৭, ফার্সী পাণ্ডুলিপি, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, কলকাতা, নং. পি. এস. সি. — ৩ ৮৭২, ফোলিও ২৩। এশিয়াটিক সোসাইটির এ পাণ্ডুলিপিটিই সম্ভবত পরবর্তীকালে তাবাকাত–ই–নাসীরী এর বই আকারে সম্পাদনা ও মুদ্রণ এবং অনুবাদ ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।
- উদাহরণস্বরূপ ১০৪৭ হিজরী/ ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ সালে মুহম্মদ মুকীম লাহোর শহরে একটি অ্যাস্ট্রোলাব তৈরি করেন, যেখানে পৃথিবীর ১২০টি গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে ‘লাখনাওতী’ নামটিও স্থান পেয়েছে। অ্যাস্ট্রোলাবটি বর্তমানে ইসলামাবাদ যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
- এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির দিকে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া সর্বপ্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ সম্পর্কে তাঁর যুক্তিপূর্ণ বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: মাওলানা মিনহাজ আল-দীন সিরাজ, তাবাকাত–ই–নাসিরী, অনুবাদ: আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, (ঢাকা: দিব্যপ্রকাশ, ২০১৪), ৩৫–৫৮।
- মধ্যযুগীয় বাংলায় এটি একটি একাধিক শব্দের সমন্বয়ে গঠিত যৌগিক নাম (compound name)। ফার্সী ভাষায় নাও (نَوْ) এর অর্থ নতুন এবং দহ বা দিয়াহ (ده/ دِيَهْ) এর অর্থ গ্রাম বা জনবসতি। এ নামটির একটি প্রতীকী তাৎপর্য সহজেই খুঁজে বের করা যেতে পারে। সম্ভবত বখতিয়ার খলজীর ‘বঙ্গ বিজয়’ এবং এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিত্য-নতুন মুসলিম জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটির প্রতীকী নামকরণ হিসেবে নাওদাহ (نَوْدهْ) নামটি পরিচিতি লাভ করে। অন্যদিকে হিন্দী ও কোন কোন স্থানীয় উপভাষাগুলোতে ‘দিয়া’ শব্দটির অর্থ প্রদীপ এবং এই অর্থে (নও+দিয়া) এর অর্থ নতুন প্রদীপ যা ইসলামের আগমনের প্রতীকস্বরূপ কোন কোন স্থানের নামের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। মালদা, চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এখন পর্যন্ত বেশ কতগুলো গ্রাম রয়ে গেছে, যেগুলোর নাম ‘নাওদাহ’ বা এ ধরনের কোন নাম। গৌড়ের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে উত্তর উমরপুর মৌজায়, কোতওয়ালী দরওয়াজার কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমে মাহদিপুর গ্রামের পার্শ্বে এ ধরনের নামের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ জেলায় রহনপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাছাকাছি নাওদাপাড়া নামক জায়গায় একটি বিরাট এলাকা জুড়ে একটি উঁচু প্রাচীন ঢিবি রয়েছে, যেটা লক্ষণসেনের রাজধানী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং যেখানে বখতিয়ার খলজী তাঁর প্রথম আক্রমণ চালান। এ জায়গাটিতে এখনো প্রচুর প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন, যেমন পুরনো ইট, ভেঙে পড়া দালানের অংশ বা টুকরো ইত্যাদি ছড়ানো আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এখন পর্যন্ত ঢিবিটিকে লক্ষণসেনের বাড়ি (বা ভিটা) নামে চিহ্নিত করে এবং সেই নামেই এলাকাটিতে ঢিবিটি পরিচিত। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী অধুনালুপ্ত রাজপ্রাসাদটির পিছন দিকে একটি খিড়কি দরজা ছিল, যা পুনর্ভবা (মতান্তরে মহানন্দা) নদীর দিকে খুলত। বখতিয়ার আকস্মিকভাবে রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালালে লক্ষণসেন এ পথ দিয়ে বের হয়ে তাঁর বজরায় আরোহণ করেন এবং প্রথমে মহানন্দা, তারপরে পদ্মা হয়ে পূর্ববঙ্গে চলে যান। লক্ষণ সেনের বাড়ীর পাশাপাশি আরও একটি ভগ্নস্তুপ আছে, যা নাওদা বুরুজ বা ষাঁড় বুরুজ নামে স্থানীয় লোকেরা চিহ্নিত করেন। সম্ভবত বখতিয়ার নাওদা বিজয়ের পর একটি বিজয় স্তম্ভ হিসেবে এটিকে নির্মাণ করেন। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: মাওলানা মিনহাজ আল-দীন সিরাজ, তাবাকাত-ই-নাসিরী, অনুবাদ: আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, (ঢাকা: দিব্যপ্রকাশ, ২০১৪), ৩৫–৫৮।
- স্ট্যান গরন ও জে. পি. গোয়েঙ্কা, দ্যা কয়েনস অফ দ্যা ইন্ডিয়ান সুলতান (নতুন দিল্লি : মুনশিরাম মনোহরলাল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০১), ১৪৪ – ৪৫, ১৫৭।
- শর্মী চক্রবর্ত্তী, “প্রি মেডিয়েভ্যাল গৌড়”, প্রত্ন সমীক্ষা, স্পেশাল ইস্যু গৌড় (কোলকাতা, সেন্টার ফর আকিওলজিক্যাল স্টাডিজ, ২০১২), ৩২-৩৩।
- সতীশচন্দ্র মিত্র, যশোর খুলনার ইতিহাস, ১ম খণ্ড (কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ২০০১), ৩৬৯।
- রাজমহল, মুর্শিদাবাদ ও চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ জেলায় গঙ্গা বা পদ্মার উভয় তীরে এবং বিশেষ করে চর এলাকাগুলোতে গড়ে ওঠা কৃষিভিত্তিক জনবসতিগুলো বহুকাল ধরে, এমন কি আজও দিয়ার (স্থানীয় ভাষায় দিয়াড়) নামে উক্ত এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত। চর এলাকাগুলোতে পশ্চিমাঞ্চল থেকে আগত এসকল নতুন বসতি স্থাপনকারী মুসলিম জনগোষ্ঠী শেরশাহবাদিয়া, সংক্ষেপে ‘বাদিয়া’ কিংবা অনেক সময় ‘দিয়াড়া’ হিসাবে খ্যাত। দিল্লির বিখ্যাত আফগান সুলতান শের শাহ সুরীর সময়ে এ পরগনাটির নামকরণ করা হয় শেরশাহবাদ পরগনা হিসাবে। শেরশাহ সুরীর মৃত্যুর পর এলাকাটির উপর পুনরায় মুঘল কর্তৃত্ব স্থাপিত হলে চাকুরিহারা আফগান ও পাঠান সৈনিকদের এক বিরাট অংশ গঙ্গা তথা পদ্মার চর এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে কৃষি জীবন বেছে নেয়। শেরশাহবাদীদের আঞ্চলিক বাংলায় প্রচুর ফার্সী এবং কিছু কিছু পুশতু (پختو) শব্দের ব্যবহার দেখা যায। যেমন: ক্লান্ত হওয়ার জন্য তারা খাস্তা (خسته) ফার্সী শব্দটি ব্যবহার করে। আবার শীতের জন্য জাড় ( زاڑا) পুশতু শব্দটি ব্যবহার করে। নৃতাত্তি¡ক দিক দিয়ে খুব সম্ভবত এরা আফগান, পাঠান ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রিত নৃগোষ্ঠী।
- সুলায়মান ইবন আহমদ ইবন সুলায়মান আল-মাহরী, আল-মিনহাজ আল-ফাখির ফী ’ল-বাহর আল-যাখির, সম্পাদনা. ইব্রাহিম খুরী, দামেশ্ক, ১৯৭০, ১৬–২৭; প্রাগুক্ত, ‘উমদা আল-মাহরিয়্যা ফী দাবত আল-উলূম আল-বাহরিয়্যা, দামেশক, ১৯৭০, ১১৩–১২০।
- এ বিষয়ে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক রিচার্ড ইটনের একটি সুচিন্তিত ও সৃজনশীল নতুন তত্ত্ব দিয়েছেন। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দি বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার, ১২০৪–১৭৬০, বার্কলে, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, ১৯৯৩, ১১৩।
- বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: ইটন, দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দি বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার, ১২০৪–১৭৬০, ২৬৮–৩০৩।
- এই প্রসঙ্গে পীর গোরাচাঁদের নাম উল্লেখ করা যায়। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুযায়ী তের বা চোদ্দ শতকের কোন এক সময় সৈয়দ আব্বাস আলী, যিনি নিজেকে আরব বংশোদ্ভ‚ত বলে দাবি করতেন, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বেড়াচাপ বা চন্দ্রকেতু গড় অঞ্চলে আসেন। তিনি ছিলেন বুদ্ধিমান, সুদর্শন, ধর্মতত্তবিদ ও যোদ্ধা। তিনি প্রথমে রাজা চন্দ্রকেতুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেন। কথিত আছে, রাজাকে আকৃষ্ট করার জন্য তিনি বেড়ার গায়ে চাঁপা ফুল ফোটান। আর তাঁর গৌরকান্তি সুন্দর চেহারার জন্য রাজরাণী তাঁকে গোরাচাঁদ নামে আখ্যায়িত করেন। রাজা ইসলাম ধর্ম গ্রহণে রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ হয় এবং রাজা পরাজয় বরণ করেন। বর্তমানে পীর গোরাচাঁদ অবশ্য মিশ্র সংস্কৃতির প্রতীক। তাঁর মাজারে সর্ব ধর্মের মানুষ প্রার্থনা করে। তাঁর ওরস উৎসব হিন্দুদের ঘোষ পরিবার দ্বারাই প্রাথমিক উপাচারে সূচিত হয়।
- কোন কোন শিলালিপিতে পাওয়া এ ধরনের বিশেষ অভিব্যক্তিগুলো বাংলায় ইসলামের সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষের ধর্ম হিসাবে ধীরে ধীরে বিকশিত হওয়ার ইশারা বহন করে। যেমন ‘জনসাধারণের আশ্রয়’, ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্তম্ভ বা সমূর্থক’ উপাধিগুলো ত্রিবেণীর জাফর খান মসজিদের শিলালিপিতে (নং ১২, তারিখ: ৬৯৮ হিজরী/ ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দ) বিশেষভাবে উল্লিখিত আছে যা শাসক শ্রেণীর সাধারণ মানুষের সমর্থন আদায়ের প্রতি অনুরাগের ইঙ্গিত রাখে।
- গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড (জি.টি. রোড) এমনই একটি নিদর্শন, যা দিল্লির সুলতান শের শাহ প্রাচীন কালের অপ্রশস্ত রাস্তাগুলোর জায়গায় নতুন প্রশস্ত শাহী সড়ক নির্মাণ করেছিলেন। কলকাতা থেকে ভারতের অনেক প্রধান শহরের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের পেশাওয়ার পর্যন্ত সেই শাহী সড়ক আজ পর্যন্ত টিকে রয়েছে এবং ইতিহসের সাক্ষ্য বহন করছে।
- মিনহাজ আল-দীন সিরাজ, তাবাকাত-ই-নাসিরী, সম্পাদনা: ডব্লিউ. এন. লীস, কলকাতা, ১৮৬৩–৬৪, ১৪৯–৫৩।
- ভারতবর্ষের গোয়াতে পর্তুগীজ ধর্মযাজকদের প্ররোচনায় ধর্মান্তরকরণে অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের কোন কোন ক্ষেত্রে পুড়িয়ে মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটেছিল বলে কোন কোন সূত্রে জানা যায়।
- ফার্সী পাণ্ডুলিপি, খুদা বখশ ওরিয়েন্টাল পাবলিক লাইব্রেরি, পাটনা, নং এইচ. এল. ২৭, ফোলিও ২৩১।
- জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, খণ্ড ৪৭ (১৮৯৮), ১১৬।
- মোহর আলী, হিস্টরি অব দি মুসলিমস অব বেঙ্গল, ১ম খন্ড, ৩৬।
- মুহম্মদ ইউসুফ সিদ্দিক, ‘অ্যান এপিগ্রাফিক জার্নি টু অ্যান ইসলামিক ল্যান্ড’, মুকারনাস, ৭ (১৯৯০), ৮৩–১০৮।
- জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, খণ্ড ১৩, ১৮৪৪, ৩৬।
- মুহম্মদ আব্দুর রহিম মনে করেন যে সু-রা-তান শব্দটি যে সুলতান, এ ধরনের সম্ভাবনার যথেষ্ট অবকাশ আছে, তার কারণ এ ধরনের শব্দ আরাকানি বা সে এলাকার অন্যান্য ভাষায় কিংবা বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) বৌদ্ধ ঐতিহ্যে তেমন একটা পাওয়া যায় না। আরাকান অঞ্চলে ইসলামী বণিকদের আনাগোনার ফলে মধ্যযুগে আরবী সুলতান শব্দটি অপভ্রংশ হয়ে স্থানীয় ভাষায় সু-রা-তান হিসাবে প্রচলিত হয়েছিল, সেটা সহজেই অনুমেয়। সম্ভবত সে এলাকায় বসতি স্থাপনকারী বহিরাগত আরব ও মুসলিম বণিক সম্প্রদায়ের গোষ্ঠী প্রধানই এই উপাধিটি পেয়েছিলেন। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: মুহম্মদ এনামুল হক, পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম (ঢাকা, ১৯৪৮), ১৭; এম. এ. রহিম, সোশাল অ্যান্ড কালচারাল হিস্টরি অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, ১২০১–১৫৭৬, করাচি, ১৯৬৩, ৪৪। সে যুগের প্রাকৃত ও স্থানীয় লোকসাহিত্যে সুলতান অর্থে সুরতান বা সুরাতান বহুল ব্যবহৃত হত।
- আবূ ‘আবদ আল্লাহ ইয়াকুত আল-হামাওয়ী, মু‘জাম আল-বুলদান, ৪র্থ খণ্ড, কায়রো, মাতবা‘আ আল-সা‘আদা, ১৯০৬, ২১৩; গ্যাব্রিয়েল ফেরান্দ, রিলেশিও দ ভোয়াজ এ টেক্সট জিওগ্রাফিক আরাব, পার্সান এ তুর্ক, প্যারিস, ১৯১৩, ১৮০–৮১।
- মোহর আলী, হিস্টরি অব দি মুসলিমস অব বেঙ্গল, ১, ২২৫।
- বখতিয়ারের গৌড় বিজয় উপলক্ষ্যে বেশ কয়েকটি চমৎকার স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা গৌড় ও দিল্লির টাকশালগুলো থেকে জারি করা হয়েছিল, যেগুলোতে এই তারিখটি সুস্পষ্টভাবে খোদাই করা রয়েছে। এই দুর্লভ মুদ্রাগুলোর দুয়েকটি দিল্লি জাদুঘর, ব্রিটিশ জাদুঘর (লণ্ডন) ও স্মিথসোনিয়ান ইনস্টটিউশনে (ওয়াশিংটন ডি. সি.) সংরক্ষিত আছে। এই মুদ্রাগুলোতে সামনের পা দুটো উত্তোলন করা ক্ষিপ্র গতিতে ধাবমান অশ্বের উপর গদা বহনকারী একটা সৈনিকের ছাপ রয়েছে, যা বখতিয়ার খিলজীর নেতৃত্বে বিজয়ী মুসলিম অশ্বারোহী দলের প্রতীক বহন করে। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: পরমেশ্বরী লাল গুপ্ত, ‘দ্য ডেট অব বখতিয়ার খিলজীস অক্যুপেশন অব গৌড়,’ জার্নাল অব দি বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম, ৪ (১৯৭৫–৭৬), ২৯–৩৪; জি. এস. ফরিদ, ‘হাইদারটু আননোন সিলভার টঙ্কাহ অব সুলতান আলাউদ্দীন আলী মর্দান খিলজী, ৬০৭–৬১০ হিজরী,’ জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি ১৮, নং ১–৪ (১৯৭৬), ১০৪–৬; জন ডেয়েল, লিভিং উইদাউট সিলভার: দ্য মনিটারি হিস্টরি অব আর্লি মেডিয়েভাল নর্থ ইন্ডিয়া, দিল্লি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস (১৯৯০), ৩৬৪–৩৬৭, মুদ্রা নং ২৯৮।
- নিকোলাস ডব্লিউ লোয়িক, ‘দ্য হর্সম্যান টাইপ অব বেঙ্গল অ্যান্ড দ্য কোয়েশ্চন অব কোমেমোরেটিভ ইস্যুজ,’ জার্নাল অব দি নুমিজম্যাটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া ৩৫ (১৯৭৩), ১৯৬–২০৮; প্রাগুক্ত, কয়েনেজ অ্যান্ড হিস্টরি অব দি ইসলামিক ওয়ার্ল্ড, (অ্যাল্ডারশট, যুক্তরাজ্য : ভ্যারিওরাম, ১৯৯০), ১৯৫–২০৮; পরমেশ্বরী লাল গুপ্ত, ‘নাগরী লেজেন্ড অন হর্সম্যান টঙ্কাহ অব মুহম্মদ বিন সাম,’ জার্নাল অব দি নুমিজম্যাটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া, ২০৯–২১২; পরমেশ্বরী লাল গুপ্ত, ‘অন দ্য ডেট অব দি হর্সম্যান টাইপ কয়েন অব মুহম্মদ বিন সাম,’ জার্নাল অব দি নুমিজম্যাটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া, ৩৮ (১৯৭৬), ৮১–৮৭; দিল্লি মিউজিয়াম ক্যাটালগ ৬, মুদ্রা নং ৩.এ।
- নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস, কলকাতা, ১৩৫৯ বাংলা সন, ৫০১।
- সেন আমলে জাত-পাতের ভেদাভেদ মুষ্টিমেয় কিছু ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীর প্রভাবে চরম পর্যায়ে পৌঁছে ছিল । বাংলার প্রাচীন বর্ণ ব্যবস্থার নতুনতর উপশ্রেণী বিভাজন তথা নানা কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তন এ অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে ক্ষুন্ন করে।
- এ বিহারটি টিশু লাম্বা (লামার বিদ্যাপিঠ) নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। এটি বর্তমান রংপুর থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরে ২০.৭০ অক্ষাংশ (উত্তর) এবং ৪৭.২০ দ্রাঘিমাংশ (পূর্ব) এর কাছাকাছি অবস্থিত ছিল।
- মিনহাজ আল-দীন সিরাজ, তাবাকাত–ই–নাসিরী, সম্পাদনা. ডব্লিউ. এন. লীস, কলকাতা, ১৮৬৩–৬৪, ১৪৯–৫৩। মেচ সহ অন্যান্য উপজাতি এখনও কুচবিহারের (আলিপুর দুয়ার থেকে প্রায় পঁচিশ মাইল দূরে) উত্তরাঞ্চলে বসবাস করে। এদের অনেকেই বাংলার সুলতানী আমলের কামরূপ ও কামতা নামের ঐতিহাসিক অঞ্চলগুলোর পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য চলমান আন্দোলনের প্রতি সহানুভুতিশীল।
- আরও দেখুন রিচার্ড ইটন, দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দি বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার, ১২০৪–১৭৬০, ১৯৫–২২৭।
- উদাহরণস্বরূপ দেখুন: বারাহদারির রাওজা শিলালিপি (নং ৭) তারিখ ৬৬৩ হিজরী/ ১২৬৮ খ্রিস্টাব্দ, মহাস্থানগড় রাওজা শিলালিপি (নং ১৩) তারিখ ৭০০ হিজরী/ ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ।
- উত্তর বাংলার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা, বিশেষ করে গৌড় ও পাণ্ডুয়ার আঞ্চলিক ভাষাগুলোতে ফার্সীর প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। একইভাবে মালদা, মুর্শিদাবাদ ও চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ জেলার গঙ্গা ও পদ্মার দুইধারে বসবাসকারী শেরশাহবাদী জনগোষ্ঠীর ভাষায় এখন পর্যন্ত বহু ফার্সী শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অন্য দিকে দক্ষিণ বাংলায় বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে আরবী শব্দের প্রাচুর্য লক্ষ করা যায়।
- ফার্সী পাণ্ডুলিপি, খুদা বখশ ওরিয়েন্টাল পাবলিক লাইব্রেরি, পাটনা, নং এইচ. এল. ৪৭৯৯, ফোলিও ২৮।
- উদাহরণস্বরূপ মুযাফ্ফার শামস্ বলখী (মৃত্যু ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ) সুলতান গিয়াস আল-দীন আযম শাহের (রাজত্বকাল ১৩৮৯–১৪১০ খ্রিস্টাব্দ) অনুমতিক্রমে (এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায়) হজ্জের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সামুদ্রিক জাহাজে মক্কার উদ্দেশ্যে সফর করেন। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: মুযাফ্ফার শামস্ বলখী, মাকতুবাত–ই–মুযাফ্ফার শাম্স বলখী, খুদা বখশ ওরিয়েন্টাল পাবলিক লাইব্রেরি, পাটনা, ফার্সী পাণ্ডুলিপি, এক্সেশন নং ১৮৫৯, চিঠি ১৪৮। আরও দেখুন সৈয়দ হাসান আসকারী, মাকতুব অ্যান্ড মালফুজ লিটারেচার অ্যাজ এ সোর্স অব সোশিও–পলিটিকাল হিস্টরি, পাটনা, খুদা বখশ ওরিয়েন্টাল পাবলিক লাইব্রেরি, ১৯৮১, ১৬।
- তক্বী আল-দীন আল-ফাসী, আল-আকদ আল-সামীন, ৩য় খণ্ড, বৈরুত, দার আল-কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৮, ২৬।
- স্ট্যান গরন ও জে. পি. গোয়েঙ্কা, দ্যা কয়েনস অফ দ্যা ইন্ডিয়ান সুলতান (নতুন দিল্লি : মুনশিরাম মনোহরলাল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০১), ২৬৭-৭৫।
- বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: জে. এন. নন্দ, বেঙ্গল: দ্যা ইউনিক স্টেট, নতুন দিল্লি: কন্সেপ্ট পাবলিকেশান্স কম্পানি, ২০০৫; এম. শাহিদ আলম, পভার্টি ফ্রম দ্যা ওয়েল্থ অব নেশন্স: ইন্টাগরেশন অ্যান্ড পোলারাইজেশন ইন দ্যা গ্লোবাল ইকনমিক্স ১৭৬০ (যুক্ত রাজ্য: পালগ্রেভ ম্যাকমিলান, ২০০০), ৩২; অ্যাঙ্গাস ম্যাডিসন, দ্যা ওয়ার্ল্ড ইকনমি: হিস্টরিক্যাল স্ট্যাটিসটিক্স (প্যারিস: ও. ই. সি. ডি., ২০০৩), ১১২-১২৫, ২৫৯-২৬১; পিটার এল. বার্গার এবং লরেন্স ই. হ্যারিসন, ডেভেলপিং কালর্চাস: কেস স্টাডিজ (রাউটলেজ, ২০০৬), ১৫৮।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।