লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
সন্যাসী বিদ্রোহ তথা ফকির বিদ্রোহ ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই বিদ্রোহের মূল নায়ক ছিলেন ফকির মজনু শাহ।
এই সন্যাসী-ফকিররা কারা ছিলেন, তাদের পরিচয় বা কি ছিল। মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের যুগে এই সন্যাসী ফকিররা একটা শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে উপমহাদেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতনে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। সন্যাসীরা ছিলেন ‘নাগা’ ‘গোঁসাই’ ‘দশনামী সন্যাসী’ প্রভৃতি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। ফকিররা ছিলেন মাদারী, বোরহানা তরিকার লোক। শাহ বদীউদ্দিন মাদারের প্রভাবে ভারতব্যাপি একশ্রেণীর দরবেশ বা ফকির সৃষ্টি হয়েছিল যাঁরা সাধারণত মাদারী তরিকার সাধক বলে খ্যাত ছিলেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ পুরোপুরি সন্যাসী বা ফকির ছিলেন, কেউ কেউ আধা গৃহস্থ ছিলেন। (উপমহাদেশের মুসলমান, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৪)
ফকির বিদ্রোহের নাম শুনলে অনেকে হয়তো আমাদের দেশের বর্তমানে গাঁজা খাওয়া, হাতে লোহার চিমটে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো গ্রামে-গঞ্জে ভিক্ষাবৃত্তি করা ভিখারী প্রকৃতির লোক বলে মনে করে বিভ্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু না, এই বিপ্লবী ফকিরগণ পুরোপুরিভাবে মুজাহিদ ছিলেন। স্বৈরাচারী হেস্টিংস এই মহান বিপ্লবকে সন্যাসী বিদ্রোহ ও ফকির বিদ্রোহ বলে অভিহিত করলেও তা মূলতঃ ছিল বঙ্গদেশের প্রথম কৃষক বিদ্রোহ। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় তাঁর ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ গ্রন্থে এই অভিমতই প্রকাশ করেছেন।
ইতিহাসখ্যাত এই ফকির বিদ্রোহের মূল নায়ক ফকির মজনু শাহের পরিচয় দিতে গিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন রকম মন্তব্য করেছেন। ফকির মজনু শাহ ১৭৩৩ খ্রীষ্টাব্দে গোয়ালিয়রের মেওয়াট এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। কোন কোন ঐতিহাসিক বিহার ও অযোধ্যার সীমান্তবর্তী এলাকায় মাখনপুর গ্রমে জন্মস্থান বলে বর্ণনা করেছেন। আবার কোন কোন পুঁথিতে বিহার প্রদেশকে তাঁর জন্মস্থান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এম আব্দুর রহমান ফকির বিদ্রোহের নায়ক মজনু শাহের জীবনী প্রসঙ্গে জমীরুদ্দিন দফাদারের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি মজনু শাহের জীবনী প্রসঙ্গে উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন তার কয়েকটি পংক্তি হ’ল-
সারা সুবে বাংলায় জারি ছিল নাম
মীরখান পুরে ছিল তোমার মোকাম!
দেওয়ানা ফকির নাম মজনু শাহা
গৃহ তেয়াগিয়া নিল ফকির রাহা ।।
——————————-
জুটিল মজনুর সাথে হাজার ফকির
দেখিতে দেখিত হইল ফকিরের ভীড়।।
————————————
কোম্পানীর কত কুঠি লুঠ হইয়া গেল
রাজার সেপাই বহু গায়েব হইল।।
হাতিয়ার হাতে করে ফকিরের বন
মজনু হুঙ্কারে কাঁপে ত্রিভূবন ।।
———————————–
ধন্য ধন্য করে সবে মজনুর নামে
জমিদার লোক সব প্রাণ ভয়ে ঘামে।।
কহিলেন দল বাঁধো নাগাদের সাথে
তলোয়ার লহ লহ জনে জনে হাতে।।
————————————
গেরেঙ্গ আংরেজ ভাগাইতে হইবে
ইহা ছাড়া পথ নাই দেখো বেটা ভেবে।।
[বুলবুল, (১৩৭৮) পত্রিকার সৌজন্যে]
এম আব্দুর রহমান জমীরুদ্দিন দফাদারের ফকির মজনু শাহের হকীকতের উদ্ধৃতি দিয়ে আরও লিখেছেন,
“কাহাতে” মারিতেছে লাখো ইনসান
বাঁচাইতে কর চেষ্টা তাহাদের জান।
———————————
জরু গরু বিকিকিনি চলে গাঁয় গায়
মরা মানুষের গোস্ত জ্যান্তরা খায়।
————————————-
————————————-
কহিলেন, দল বাঁধো “নাগাদের” সাথে
তলোয়ার লহ লহ জনে জনে হাতে।
————————————-
————————————-
ফেরেঙ্গ আংরেজ ভাগাইতে হইবে
ইহা ছাড়া তথ নাই দেখ বেটা ভেবে।
[বুলবুল, (১৩৭৮) পত্রিকার সৌজন্যে]
ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় ফকির বিদ্রোহের নায়ক মজনু শাহ তাঁর সাংগঠনিক প্রতিভা, সমর কৌশল ও নেতৃত্বের গুনে কোম্পানীর মনে ভীতির সঞ্চার করেছিলেন। এম. মুনিরুজ্জামান লিখেছেন, “তাঁর মুজাহিদ জীবনে উত্তরণের পশ্চাতে যে কাহিনী প্রচলিত আছে তা হল এরুপঃ যৌবনে ফকির বা দরবেশ হওয়ার তাঁর সাধ জাগে, তাই সাধনাও শুরু হয় । উপযুক্ত আধ্যাত্মিক পীরের সন্ধানে তিনি নানা স্থানে ঘুরেছিলেন। এ উদ্দেশ্যে পাটনা থেকে গিয়েছিলেন গৌড়ে হযরত নুর-কুতুব-উল আলমের সমাধিক্ষেত্রে। সেখানে থেকে স্বপ্নযোগে তিনি নির্দেশ পান হযরত নুর-উল-কুতুব এর পীর বীরভূমের রাজনগরে সমাধিস্ত দরবেশ শাহ হামিদুদ্দিনের সঙ্গে যেন সাক্ষাৎ করেন। আধ্যাত্মিক পথের সন্ধানী মজনু শাহ ছুটে চললেন বীরভূমের রাজধানী বা ‘লখনুর’ শহরে। এ সময় চলছিল সারা দেশ জুড়ে সর্বনাশা দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তরের বিভিষিকা। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে তা ইতিহাস খ্যাত। রাজনগরে সাধক হামিদ উদ্দীনের খাদেম মজনু শাহকে দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে ও দেশের শত্রু প্রজা-শোষক ব্রিটিশকে দেশ থেকে তাড়াতে অনুপ্রাণিত করেন।” (উপমহাদেশের মুসলমান, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৫-২৬)
ফকির মজনু শাহের এই ফকির বিদ্রোহ ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ এই ৪০ বছর যাবৎ ইংরেজ সরকারকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। তাই ইংরেজ ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁদের দস্যু, তস্কর (Robble, Lawless, Banditi, Raiclers) প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করেন । প্রখ্যাত ঐতিহাসিক R.C Mazumdar তাঁদের ফকির বিদ্রোহের সংগ্রামের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলেছেন, –
“They (the sannayas and Fakirs) Threatened to sweep away the English power Completely ……… their fighting quality are not regigible.” (History of Freedom Movement)
চৌধুরী শামসুর রহমান ‘বাংলার ফকির বিদ্রোহ’ গ্রন্থের ফকির মজনু শাহর ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, “১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দে মজনু শাহের অদ্ভুদয়ের পরেই তাঁর প্রথম কর্তব্য ছিল ইতস্থত বিক্ষিপ্ত ফকিরদের সংঘবদ্ধ করা । তাঁর দলে বহু হিন্দু সন্যাসীও যোগ দিয়েছিলেন। এখন থেকে প্রায় দেড় দশক পর্যন্ত তিনি বিহার ও বাংলার বৃটিশ শাসকদের ব্যাতিব্যাস্ত করে রেখেছিলেন। ‘Shaw Madjenon’ বা শাহ মজনুর আশঙ্কায় ইংরাজ কর্মচারী ও কুঠিয়ালরা যে সন্ত্রস্ত ছিলেন তার প্রমান তাঁদের তদানীন্তন লেখা চিঠিপত্রে পাওয়া যায়।” এই কথা এম মুনিরুজ্জামান তাঁর উপমহাদেশের মুসলমান গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ২৬ নং পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত করেছেন।
ফকিরদের এই আন্দোলন কেন ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে এত ভয়ঙ্কর ও মারাত্মক রুপ ধারণ করেছিল তা নাটোরের জমিদার রানী ভবানীর কাছে ফকির মজনু শাহর পত্র থেকে তার আভাষ পাওয়া যায়। চিঠিটি হল,
“আমরা বহুকাল ধরে বাংলাদেশে ভিক্ষা করে আসছি। আর এ দেশের মানুষরা আমাদেরকে ভিক্ষা দিয়েও থাকে। আমরা ধর্মস্থানে এবং মাযারে উপাসনা ও আরাধনা করে আসছি। আমরা কাউকে গালমন্দ করি না, মারধর এবং নির্যাতন করি না। তথাপি গত বছরে আমাদের দেড়শ ফকিরকে বিনা দোষে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের পরনের কাপড় এমনকি খাদ্যদ্রব্য পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ইংরেজরা আমাদেরকে দলবদ্ধভাবে ধর্মস্থানে যেতে বাধা দেয়, আমাদের উপাসনা করতে বাধা দেয়। তারা আমাদের ঐক্যবদ্ধ চলাফেরা পছন্দ করে না। আপনি আমাদের দেশের শাসক। আমরা আপনার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করে থাকি। আমরা আপনার নিকট হতে সাহায্য লাভের আশা করি।” (ফকির বিদ্রোহের নায়ক, এম আব্দুর রহমান, পৃষ্ঠা-১৪)
ফকির মজনু শাহ এরকম ধরণের পত্র অন্যান্য কয়েকজন জমিদারের কাছেও প্রেরণ করেন। আত্মরক্ষার জন্য ফকিররা যে ইংরেজবিরোধী তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েছিলেন তা তাঁদের এ পত্রের ভাষায় তার আভাস পাওয়া যায়।
মি. গ্লাডউইনকে লেখা ইংরেজ সেনাপতি রবার্টসনের লেখা এক পত্র থেকে ফকির মজনু শাহর যুদ্ধ তৎপরতার প্রত্যক্ষ বিবরণ পাওয়া যায়। সেনাপতি রবার্টসন লিখেছেন,
“গত রাত ৯ টায় নিজের ক্যাম্প থেকে যাত্রা করে প্রায় নয় ক্রোশ পথ অনিক্রম করার পর আজ সকালে সুর্যোদয়ের পূর্বে আমরা মজনুর শিবিরের নিকটে উপনীত হলাম। আমাদের আগমন সম্পর্কে তারা আগে কোন খবরই পায়নি, এবং এজন্যই প্রজ্বলিত আগুনের চারপাশে তারা অসতর্কভাবে বসেছিল। তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন শো। তাদের প্রহরা এত শিথিল ছিল যে আমরা বিশ গজের মধ্যে গিয়ে পৌঁছানোর পূর্বে আমাদের আগমন সম্পর্কে তারা আঁচই করতে পারেনি। যখন তারা আমাদের দেখতে পেল এবং হাতিয়ার নিয়ে উঠে দাঁড়াল, আমি তখনই আমার সেনাদের গুলি করার আদেশ দিলাম। ফকীর দল তাদের ১৫ গজ পিছন দিকে অবস্থিত এক জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিল। সেখান থেকে তারা আমাদের প্রতি গুলি বর্ষন করতে লাগল। এ গুলি বর্ষনে আমাদের কয়েকজন সেপাই আহত হলো এবং আমি নিজেও একটা গুলির ঘায়ে আঘাত পেয়েছি। সম্পূর্ণ আতর্কিত আক্রমনের পরেও তারা যে এভাবে রুখে দাঁড়াতে পারবে আমি তা ভাবতেও পারিনি। প্রায় আধঘন্টা এভাবে যুদ্ধ চলার পর ফকীর দল স্থান ত্যাগ করে। মজনু ঘোড়ায় চড়ে পলায়ন করতে সমর্থ হয়।” (বাংলায় ফকির বিদ্রোহ, চৌধুরী শামসুর রহমান, পৃষ্ঠা-৮)
ফকির মজনু শাহ ১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দে প্রচুর পরিমানে সঙ্গী-সাথী ও যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে উত্তরবঙ্গে তৎপরতা শুরু করেন। রাজশাহীর সুপারভাইজার ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর রাজস্ব নিয়ন্ত্রন কাউন্সিল (Controlling Council of Revenue) কর্তৃপক্ষকে জানান যে মজনু ২০০০ মুসলিম ফকীর সেনা নিয়ে পূনরাবির্ভূত হয়েছেন। ফকীররা সংখ্যায় অনেক আর আর তাদের প্রতিহত করা কঠিন। (The Fakirs are very numerous and it is difficult to repel them) (চৌধুরী শামসুর রহমান-পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-১০) এ সময় বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করার জন্য সেনাপতি টমাসকে পাঠানো হয়, তখন একদল বিদ্রোহী সেনাপতি টমাসকে হত্যা করে এবং তার সৈন্যবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে। মজনু শাহ ১৭৬৬ সালে মেকেঞ্জির নেতৃত্বে পরিচালিত ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাস্ত করেন। ১৭৬৯ সালে জলপাইগুড়ির যুদ্ধে ব্রিটিশ কমাণ্ডার কীথ সাহেবকে হত্যা করেন। ১৭৭১ সালে ইংরেজ সেনাপতি স্মিথকে হত্যা করেন। ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডও নিহত হন।
ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন,
“এই সময় মজনুর শাহের দুইজন প্রধান শিষ্য ফেরাগল শাহ ও চেরাগ আলী শাহ বন্দুক তলোয়ারে সজ্জিত তিনশত বিদ্রোহী সৈন্য লইয়া দিনাজপুর ইংরেজ শাসক ও জমিদারগণকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছিলেন।” (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ, পৃষ্ঠা-৪৭) ওয়ারেন হেস্টিংস এর লেখা থেকেও একথা জানা যায়। তিনি লিখেছেন, “আমরা আবার জাফর শাহী পরগনায় (ময়মনসিংহ) মজনুর উপস্থিতির সংবাদ পাইতেছি। আমরা প্রতি বৎসরেই এই লোকটার উৎপাত আর সহ্য করিতে পারি না। আমরা শুনিয়া আসিতেছি, এই লোকটা নাকি ব্রহ্মপুত্র নদের উপরেই বহাল তবিয়তে বাস করে। আর প্রতি বৎসর আমাদের কোম্পানীর জেলাগুলিকে জ্বালাইয়া মারে। সেই সকল স্থান হইতে ইচ্ছা মতো টাকা আদায় করে, অথচ কেহ বাধা দিতে পারে না।” (ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের অবদান, সেখ আজিবুল হক, পৃষ্ঠা-১৯)
১৭৭৬ সালে ফকিররা দুটি আলাদা আলাদা দলে বিভক্ত হয়ে উত্তরবঙ্গে হামলা করে। একটি দলের নেতৃত্ব দেন ফকির মজনু শাহ নিজে এবং অপর দলের নেতৃত্ব দেন মুসা শাহ। ১৭৮৬ সালে ১৭ আগস্ট মজনু শাহ লেফটেনান্ট আশলীর সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হন। লেফটেনান্ট ব্রেনানের বাহিনীর সঙ্গে ‘কালেশ্বর’ নামক স্থানে ২৯ সেপ্টেম্বর সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের লোক হতাহত হয় এবং স্বয়ং মজনু শাহ আহত হন। ফকির মজনু শাহ আহত হলে তাঁর অনুচররা এই বিপ্লবী মহান নেতাকে তাঁর প্রধান কর্মস্থল মাখনপুরে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে আহত অবস্থায় আত্মগোপন করে বেশ কিছুদিন যন্ত্রণা সহ্য করে তাঁর গুরুদায়িত্ব দেশবাসীর হাতে সমর্পণ করে ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে ইহকালের মায়া ত্যাগ করে দুর্গম পথ পরকালে পাড়ি দেন।
ফকির মজনু শাহের মৃত্যুর পর তাঁর বিশ্বস্ত অনুগামী ও ছোট ভাই মুসা শাহ এই স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বভার নিজের হাতে তুলে নেন এবং ছ’ হাজার বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। ঐতিহাসিক শান্তিময় রায় লিখেছেন, “পরবর্তী ১৭৮৭ সালে ভবানী পাঠক এবং দেবী চৌধুরানীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে মুসা শাহের অনুগত শিষ্য ফেরাগুল শাহ এবং চেরাগ আলি শাহ পূর্ণ সহযোগিতা করেছিলেন। ময়মনসিংহ এবং রংপুর যুদ্ধে তাঁরা সম্মিলিতভাবে কোম্পানীর বাহিনীকে নিদারুনভাবে পর্যুদস্ত করেছিলেন। এই সময় রমজান শাহ এবং জহুরী শাহর নেতৃত্বে অপর একটি বাহিনী আসামে ব্রিটিশ বাহিনীর মোকাবিলা করে। কিন্তু নিজেদের আত্মকলহেবর ফলে সেখানে তারা পরাজয় বরন করে। (ভারতের মুক্তি সংগ্রামে মুসলিম অবদান, পৃষ্ঠা-২)
তিনি আরও লিখেছেন,
“সন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের শেষ অধ্যায় শোভন আলি। আমুদি শাহ এবং মতি উল্লা শেষবারের মত সংগ্রামী অনুগামীদের সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পরাজয়ের গ্লানী মাথায় নিয়ে শোভন আলি ১৭৯৭ খ্রীষ্টাব্দে ধরা পড়েন। (Located)।” (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-২)
ফকির মজনু শাহের তিরোধানের পর তাঁর সন্তানদের মধ্যে পরাগল শাহ ও তাঁর শিষ্য চেরাগ আলি এই আন্দোলনের লেলিহান শিখাকে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। মজনু শাহের পর ফকিরদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন সোবহান শাহ। তিনি বাংলাদেশ ও বিহারের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তাঁর আন্দোলনের ক্ষেত্র গড়ে তুলেছিলেন। সোবহান শাহের অনুচর জহুর শাহ ও মতিউল্লাহ ইংরেজ সেনা কর্তৃক গ্রেফতার হন এবং তাঁদেরকে কয়েক বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন,
“ফকির নেতাদের বিচার চলার সময় মালদা জেলার কোন এক জঙ্গলে ফকিরদের এক গোপন অস্ত্রাগারের সন্ধান পাওয়া যায়। (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা-৫০)
১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দে নওয়াজ শাহ, বুদ্ধ শাহ প্রভৃতি ফকির নেতার এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ইমাম শাহের সহযোগিতায় সোবহান শাহ বুভুক্ষ ও নির্যাতিত নিপিড়িত কৃষকদের সংগঠিত করে তাদের সংগ্রামকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং ১৭৯৯ থেকে ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বগুড়ার জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় তাঁদের ঘাঁটি স্থাপন করেন। কিন্তু আধুনিক রণসজ্জায় সজ্জিত ইংরেজ বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে এবং ফকির বাহিনীকে পরাস্ত করে ফলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এই প্রথম অভ্যুত্থান ব্যার্থ হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক শান্তিময় রায় লিখেছেন,
“ব্যার্থ হলেও ফকির ও সন্যাসী বিদ্রোহ উত্তরকালে, উনবিংশ এবং বিংশ শতক জুড়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুগভীর প্রেরণা সঞ্চার করেছিল। বিশেষ করে, পরবর্তীকালে ‘ওয়াহাবী’ এবং ‘অগ্নিযুগ’-এর বিপ্লবী যাঁদের সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল এই ফকির ও সন্যাসীদের স্বাধীনতার লড়াই।” (ভারতের মুক্তি সংগ্রামে মুসলিম অবদান, পৃষ্ঠা-২)
এই ফকির বিদ্রোহের সুদূরপ্রাসারী প্রভাব বিস্তার সম্পর্কে এম মুনিরুজ্জামান লিখেছেন,
“আঠারো শতকের শেষ লগ্নে ফকির বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে এলেও উপমহাদেশের ইতিহাসে এই আন্দোলন সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তীকালে বৃটিশবিরোধী মুজাহিদরা এ আন্দোলন থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন। উনিশ শতকের তৃতীয় দশকেও দেশের মুহাম্মাদী আন্দোলনে (ওহাবী) নায়ক শহীদ বীর তিতুমীরের পরিষদে সংগঠন ও প্রচার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফকির নেতা মিসকিন শাহের অস্তিত্বের দ্বারা অনুমান করা কঠিন নয় যে ফকির আন্দোলন স্তিমিত হলেও তার প্রেরণা অব্যাহত ছিল ভবিষ্যতের সংগ্রামী মানুষের চেতনায়।” (উপমহাদেশের মুসলমান, প্রথম খণ্ড-পৃষ্ঠা-৩০)
যাইহোক এই ফকির বিদ্রোহ ছিল এই ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই ফকিররাই প্রথম এদেশের সরজমিনে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুরু করেন এবং তাঁরাই প্রথম গেরিলাযুদ্ধের রণকৌশল দেখান। তাঁদের কিছু কিছুব অস্ত্র বিপক্ষ দলের কাছে ত্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফকির মজনু শাহের কাছে ‘ভেলা’ নামক এমন এক আগ্নেয়াস্ত্র ছিল যার দ্বারা তিনি বহুদুর পর্যন্ত অগ্নি নিক্ষেপ করতে পারতেন।
ফকির বিদ্রোহ ব্যার্থ হয়ে গেলেও শ্রী নরহরি কবিরাজের মতে –
“মজনু শাহের সমকালে এবং পরবর্তীকালে সন্যাসী বিদ্রোহের পতাকা উড্ডিন রেখেছিলেন ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী প্রমুখ সন্যাসী নেতারা । জলপথে যুদ্ধ ছিল এদের প্রধান কাজ। ভবানী পাঠকের সাথে মজনু শাহের যোগাযোগ ছিল।” (স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা, পৃষ্ঠা-৫১, সংকলন – উপমহাদেশের মুসলমান, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৯)