লিখেছেনঃ আইজাজ আহমদ
ভারতীয় উদারতাবাদের একটি সমীহ জাগানাে দাবি হলাে এই যে, ভারত এর প্রজাতন্ত্রটি এমন এক কাঠামােগত সুবিস্তৃতি এবং আদর্শগত আধিপত্য বিস্তারি উদার গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক ধাঁচায় গ্রথিত যে, সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক শক্তিই এই ধাঁচা মেনে চলতে বাধ্য হয়, এবং এই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাের অভ্যন্তরেই নির্বাচনিক গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ায় তারা ক্ষমতার করিডরে প্রবেশ/প্রস্থান করে এবং এর মধ্যবর্তিতায় তারা উদার গণতান্ত্রিক কাঠামােটিকেই আরও শক্তিশালী করে তােলে। আরও দাবি করা হয় যে, যেহেতু সমস্ত রাজনৈতিক শক্তি কমিউনিস্ট থেকে ফ্যাসিবাদী সব-সার্বজনীন ভােটাধিকারের এবং বহু দলীয় নির্বাচনের রীতিনীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, যে-মুহূর্তে তারা সরকারি কার্যপ্রণালিতে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে, তারা বাধ্য হয় আরও উদারকেন্দ্র-অভিমুখী হতে। এই ক্ষমতার রাজনৈতিক কেন্দ্রটি নিজেই সমশক্তিসম্পন্ন অসামরিক সাধারণ প্রশাসন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, সচ্ছন্দ গতিসম্পন্ন চতুর্থ স্তম্ভ এবং সর্বোপরি প্রাণবন্ত ও তীব্রভাবে উন্মুখর নাগরিক সমাজের বেষ্টনী দ্বারা পরিবৃত। বাস্তবে, যথেষ্টর চেয়েও বেশি উপকরণের সাহায্যে স্বাধীনতা-উত্তর ভারত এর ছবি এই প্রেক্ষিতে নির্মাণ করা সম্ভব। অন্যদিকে, ভারত এর রাজনৈতিক জীবনের মূল গতিপথ, বিগত কম-বেশি পঁচিশ বছরে (১৯৯০ থেকে ২০১৫ ধরা যেতে পারে), বিশেষত ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর যা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আরও,- গুণগত এবং বস্তুগতভাবে সুনিশ্চিত দক্ষিণ-অভিমুখী প্রবণতা এতাে তাৎপর্যপূর্ণ যে, দক্ষিণপন্থী শক্তি উদারতাবাদী কেন্দ্র অভিমুখে যতটা না সরে এসেছে, মাঝে মাঝে কৌশলগত কিছু উপেক্ষার যােগ্য নরম ভাব দেখালেও, উদারতাবাদী কেন্দ্র কিন্তু ক্রমাগত সরে সরে গেছে দক্ষিণ অভিমুখে। সাম্প্রতিক ভারত এর রাজনীতি মনে হচ্ছে, ইতিহাসগত-ভাবে পূর্ব দৃষ্টান্তহীন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে : কার্যত উদার গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতি সবকিছুকে মান্যতা দিয়েই সংস্কৃতি, সমাজ, আদর্শ এবং অর্থনীতির মতাে বিরাট পরিসরে আধিপত্য বিস্তার করতে চরম দক্ষিণপন্থী শক্তিসমূহের অপ্রতিরােধ্য অগ্রগতি ঘটছে। যেন একটি প্রাতিষ্ঠানিক লঙমার্চ, এবং তা রাষ্ট্রক্ষমতা সম্পূর্ণ করায়ত্ত করার জন্য সম্মুখ যুদ্ধে দখল করা নয়, এক সময় যেমন বামপন্থীদের বিপ্লব বা দক্ষিণপন্থীদের দখল অভিযানের স্বাভাবিক নিয়ম ছিল, বরং ধৈর্যশীল নিষ্ঠায় নির্মিত এবং আইনগতভাবে ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়ায় ওইসব প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তর থেকেই তাদের কর্মীকূলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলির অধিগ্রহণ, অবশ্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে রাখা হচ্ছে অপরিবর্তিতরূপে। এর থেকেই সম্পূর্ণ অন্য ধরনের এক প্রশ্ন উঠে আসছে, উদারতাবাদী গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান সমূহ এবং চরম দক্ষিণপন্থীদের রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করার মধ্যে, সত্যিই কী অমীমাংসনীয় কোনাে দ্বন্দ্ব-একটি অসেতুবন্ধনযােগ্য ব্যবধান, বিদ্যমান? চরম, দক্ষিণপন্থীরা কী উদার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান সমূহের মাধ্যমের তাদের নিজস্ব অ্যাজেন্ডা এগিয়ে নিয়ে যেতে বা শাসনক্ষমতা পরিচালনা করতে পারে?
তথ্যগত কিছু খুঁটিনাটিতে এবার আমরা ঢুকবাে। প্রথমে এটুকু বলে রাখাই যথেষ্ট যে ভারত এ এমন একটি ক্ষমতাগােষ্ঠী সন্দেহাতীতভাবে নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে উঠছে যার আদর্শবােধে ‘নেশানহুড’ (nationhood)-এর ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ভাবনা নাজিদের আদর্শবােধে জাতিতত্ত্ব (race theories) যে অর্থে ব্যবহৃত হতাে তারই মতাে। ভারত এর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদী তাঁর ক্ষমতা-দখল অভিযানের সময়, কথায় এবং কাজে, তথা সর্ব অর্থে, প্রথমসারির সমগ্র কর্পোরেট পুঁজির থেকে সমর্থন পেয়েছিলেন, তা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে রাষ্ট্রর একটি গড়ন হিসাবে মুসােলিনির ফ্যাসিজমের বিখ্যাত সজ্ঞা, যেখানে সরকার এবং কর্পোরেট সমূহ এক ও অভিন্ন হয়ে যায়। বর্তমান আলােচনার পরের এক অংশে এই প্রেক্ষিতেই ফ্যাসিবাদের প্রশ্ন আলােচিত হবে সংক্ষিপ্তভাবে। এই ক্ষেত্রে এরকম মন্তব্য করা যায় যে, সবরকম পরস্পর যুযুধান উবােপীয় অযুক্তিবাদীদের (ইর্যাশানালিস্টদের) মতাে নয়, এই চরম দক্ষিণপন্থীরা, সে নাজি বা ফ্যাসিস্ত হােক, কিংবা শুধুমাত্র সামরিকবাদী-ইসলামবাদী প্রতিপক্ষের মতাে হিন্দুত্ববাদী চরম দক্ষিণপন্থীরা উদরবাদী গণতন্ত্রের অবমাননা বা প্রত্যাখ্যানের জন্য, সে রকম কোনাে তুলনীয় তর্কবিতর্ক উপস্থাপন করেনি। বর্তমান শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র জন্য ‘চরম দক্ষিণপন্থী’ শব্দগুচ্ছ খাটে না।
বিজেপি একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে কাজ করে কিন্তু তার মূল নির্যাস হলাে এটি চরম দক্ষিণপন্থীদের প্রতিনিধিত্বকারী আরএসএস-এর একটি দক্ষিণপন্থী ফ্রন্ট মাত্র। তারা তাদের শত সহস্র কাডারকে প্রশিক্ষিত করে তোেলার বিনিময়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মসৃণ, অজেয় নির্বাচনী প্রকৌশল তৈরি করে। তারা ভারত এর সংবিধানের অনেক তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের প্রস্তাবও উপস্থাপন করে। অবশ্য ভারত এর সংসদীয় কমিউনিস্ট বামপন্থীরা যেমন উদারতাবাদী গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ করা সত্ত্বেও (বস্তুত এই অংশগ্রহণের জন্যই তাদের বেশিরভাগ শক্তি ব্যয় হয়) তারা ধারাবাহিকভাবে তাদের সমস্ত আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমে ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’র সমালােচনা করে। তার বিপরীতে, চরম দক্ষিণপন্থীদের উদার গণতান্ত্রিক কাঠামাের সম্পর্কে বাগাড়ম্বরপূর্ণ বিদ্বেষ তেমন নেই। উদার গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি এই শর্তহীন প্রকাশ্য আস্থা কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের কেন্দ্রীয় অঙ্গপ্রতঙ্গের নিজস্ব সংগঠনে তীব্রভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী। এই বিষয়টি আমরা নীচে লক্ষ্য করব। নির্বাচনী রাজনীতির আঙিনায়, ব্যবহারিক প্রয়ােগে, উদার গণতান্ত্রিক কাঠামােয় এই দায়বদ্ধতা বহুলভাবে উচ্চারিত। দেশের সমাজজীবনে যদিও সংগঠিত জন-অসন্তোষকে নিয়মিতভাবে ব্যবহার করা হয় কিন্তু সব সময় তা উপস্থাপন করা হয় মুসলমান এবং অথবা খ্রিস্টানদের অশিষ্ট আচরণের প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দেওয়া হিসাবে। উদার সাংবিধানিকতার প্রকাশ্য বিরােধিতার অনুপস্থিতি ওই দায়বদ্ধতা মান্য করার জন্য, না কি তা পরবর্তী কোনাে স্তরে বর্জনের জন্য উন্মুক্ত রাখার একটি বাস্তবাদী সিদ্ধান্ত, তা অস্পষ্ট থেকে যায়। এই চরম দক্ষিণপন্থীদের জটিল এবং বহুস্তরীয় নেটওয়াক আজকের ভারত -এ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আরএসএস-এর মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে তার রাজনৈতিক ফ্রন্ট বিজেপি-র মাধ্যমে। এ ছাড়াও আরএসএস-এর নিয়ন্ত্রণ আছে দেশব্যাপী হাজার হাজার ফ্রন্টের ওপর, যেগুলি ভারত এর সমাজের, কল্পনায় যতদূর পর্যন্ত বিভাজনক্ষেত্র হিসাবে ধরা যায় যেমন পেশা-জাত বা ভাষা বা অঞ্চলগত অথবা অন্য কোনাে কিছু যাই হােক না কেন, তার সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এই সাংগঠনিক কাঠামোেতার মৌলিক বিষয়সমূহে ভীষণভাবে কেন্দ্রীভূত বহুস্তরীয় এবং অন্যত্র নমনীয়ভাবে সংগঠিত-কৌশলগত দিক থেকে এই তথ্যে সাড়া দেয় যে, বিশ্বে মােটামুটিভাবে ভারত -এ সর্বাধিক অসমসত্ত্ব এক সমাজ ও সামগ্রিকভাবে এই সমাজকে একটি একক আধিপত্যকারী রাজনৈতিক প্রকল্পরূপে বাঁধার জন্য দরকার বিপুল পরিমাণ কল্পনা ও সাংগঠনিক শক্তি, অনুমানেও ধরা যায় না এমন সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত যা বিরাজমান থাকবে। শুধুমাত্র নির্বাচনে জয়লাভ এবং সরকার গঠন করাই লক্ষ্য নয়, বরং সংস্কৃতি, ধর্ম এবং সভ্যতার সর্বক্ষেত্রে ভারত বর্ষীয় সমাজ রূপান্তরের সেই অভিমুখে পৌঁছানাের হাতিয়ার হিসাবেই রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিগ্রহণের তাৎপর্য।
আরএসএস ৯০ বছর আগে ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল আশ্চর্যজনকভাবে এই গ্রামশীয় নীতিতে যে, স্থায়ী রাজনৈতিক ক্ষমতা গড়ে উঠতে পারে কেবলমাত্র প্রাকসাংস্কৃতিক রূপান্তর ও সম্মতির ভিত্তিতে এবং চরম দক্ষিণপন্থীদের মতাবাদের ভিত্তিতে। ব্যাপকভিত্তিক সাংস্কৃতিক সম্মতি কেবলমাত্র তৈরি করা যেতে পারে এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় নিচুতলা থেকে ওপরে। এই দীর্ঘমেয়াদি রণকৌশলের আদর্শগত স্পষ্টতা হলাে এই যে, আরএসএস যদি ভারত -এর বিপুল গরিষ্ঠ জনসংখ্যার হিন্দুদের কিছু পরিমাণে আনুগত্য তৈরি করতে সফল হয় (হিন্দুরা ভারত এর মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ বলে দাবি করা হয়। সে প্রসঙ্গে পরে আসব আমরা) এবং যদি ইতিবাচকভাবে তাদের সভ্যকরণ অভিযান প্রক্রিয়ায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ করা যায় এবং নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত শত্রুর (মুসলমান এবং খ্রিস্টান সংখ্যালঘু) স্থায়ী বিরােধিতায়, যেমন ইহুদিদের বিরুদ্ধে নাজিরা চেয়েছিল জার্মান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে, তাহলে জনবিন্যাসগত গরিষ্ঠতাকে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক গরিষ্ঠতায়। পরিণত করা সম্ভব। সেইক্ষেত্রে, বামপন্থীরা যাকে চরম দক্ষিণপন্থীরূপে অভিহিত করতে পারে, তারা উদার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমেই স্বস্তিতে ভারতে শাসন পরিচালনা করতে পারে, যারা ইতােমধ্যেই নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছেন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নিয়মিত লঘুমাত্রায় হিংসা ব্যবহার করে। দুই বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বছরগুলিতে বা তার পরবর্তী সময়ে ইউরাে-আমেরিকান অঞ্চলের যুদ্ধবাদবিরােধী স্বৈরতন্ত্রীদের মধ্যে এই বিশেষ ধরনের চিন্তা-কাঠামাের কোনাে প্রতিরূপ পাওয়া যায় না। কেবলমাত্র মােটামুটি যে সদৃশ দৃষ্টান্ত আমরা চিন্তা করতে পারি, তা কিছু পরিমাণে, কোনােভাবেই সবটা নয়, তবে কিছু অংশ, ইসলামবাদী রাজনৈতিক দক্ষিণপন্থীরা; রাশিদ রিদা এবং সালাফিজমের মূল চিন্তাভাবনা যার মধ্য দিয়ে উৎসারিত হয়েছে সেইসব গােষ্ঠী; আল-বান্নার ইখানওয়ান আল মুসলিমুন (মুসলিম ব্রাদারহুড) এবং অনুরূপ অন্যান্য। ওই মূল ইখানওয়ান থেকে উৎসারিত কতগুলি সাম্প্রতিক প্রবণতা-যেমন তিউনিসিয়ায় আল-নাহূদা এবং প্যালেস্তাইনে হামাস, এখনকার পশ্চিমী দুনিয়ায় ক্রিয়াশীল ব্রাদারহুড প্রবলভাবে প্রভাবশালী সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিজীবীরা যেমন তারিক রামধন। চরম দক্ষিণপন্থীদের ক্ষমতার প্রতিবন্ধক সব সময় হয় না উদারতাবাদী প্রতিষ্ঠানসমূহ-এই বাস্তবতার সুযােগ নিয়ে প্রথমে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক আদর্শগত আধিপত্য অর্জন করাে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের জন্য উদারতাবাদী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং সাম্রাজ্যবাদের পেটের ভেতরে নয়া উদারতাবাদী পুঁজিবাদ-এর সঙ্গে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতা ও সংখ্যাগরিষ্ঠের হিংসার সংযুক্তিকরণে দীর্ঘ সময়ের প্রচেষ্টায় স্থায়ী রাজনৈতিক ক্ষমতা তৈরি করাে। উদারতার যুগে, বামপন্থী কিংবা দক্ষিণপন্থী কোনাে বিপ্লবের সম্ভাব্যতা প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক সংশয় দূর করারও চেষ্টা করেছে আরএসএস। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ গ্রামশি অবশ্য তাঁর মহান বৌদ্ধিক দীপ্তিতে সুবিস্তৃতভাবেই এই সংশয় নিরসন করেছেন, যদিও তিনি তা করেছিলেন ভাবনাগতভাবে, কখনই সাংগঠনিকস্তরে নয়। একটি জেলের ভেতরে থেকে কীভাবেই বা তিনি সাংগঠনিকভাবে তা করতে পারতেন। দশকের পর দশকের পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যবর্তিতায় আরএসএস এই সংশয় নিরসনে এখন পর্যন্ত অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে তার সাংগঠনিক কার্যধারায়, যদিও এখনও এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠেনি যে, শেষ পর্যন্ত তারা সম্পূর্ণ সাফল্য অর্জন করবে নাকি করবে না। এই সংশয় লেনিনীয় ধারণায় এই ভাষায় অভিব্যক্তি পেয়েছে : বিপ্লব সম্পূর্ণ সংঘটিত করে ক্যাডার পার্টি, যারা জনগণের চোখে অবৈধ চিহ্নিত এক রাষ্ট্রের (যেমন জারতন্ত্র, ঔপনিবেশিক প্রভু) বিরুদ্ধে পালটা একটা রাষ্ট্র তৈরি করতে পারে, রাষ্ট্রীয় হিংসা প্রতিহত করতে সক্ষম হয় বৈপ্লবিক হিংসার সাহায্যে এবং চূড়ান্ত বৈপ্লবিক মুহূর্তে সম্মুখ সমরে রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নিতে সক্ষম এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙে চুরমার করে নতুন এক ধরনের রাষ্ট্র স্থাপন করতে পারে। যাইহােক একবার উদার গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ব্যবস্থা, তার সবরকমের জটিলতা সত্ত্বেও, কায়েম হলে, একটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক অনুগত্য-যা উদারতাবাদী আইনানুগ এবং প্রতিনিধিত্বমূলর গণতন্ত্রের অগ্রণী ভূমিকায় বিশ্বাসী – সার্বিকতা লাভ করে, তখন বিপ্লবীরা এমন এক পরিস্থিতির মুখােমুখি হয় যেখানে তারা, হয় বুর্জোয়া গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করতে পারে এবং রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়তে পারে, নতুবা তারা উদার নির্বাচনী গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ করতে পারে-ভ্যানগার্ড বিপ্লবী একটি দল তৈরির পক্ষে অবিচল থাকার আনুগত্য না দেখিয়ে-এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যবর্তিতায় সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরকরণের প্রতি তারা নিজেদের দায়বদ্ধ রাখতে পারে। এটা প্রকৃতই এক পরিহারযােগ্য, এড়িয়ে যাওয়া যায় না, এমন এক উভয়সংকট। ভারত এ, মাওবাদীরা বিপ্লবী হিংসার পথ বেছে নিয়ে, এ পর্যন্ত, নিজেদের তারা প্রান্তিকীকরণ এবং আভ্যন্তরীণ ক্ষয়ের দিকে নিয়ে গেছে। উভয় কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই এবং সিপিআই (এম)-এর মাধ্যমে সংসদীয় বামপন্থীরা প্রতিনিধিত্বকারী সংসদীয় নির্বাচনী পথটি বেছে নিয়েছে। উদার রাষ্ট্রের বৈধতা এবং ভারত সাংবিধানিকতার সুনির্দিষ্ট ধরন স্বীকার করে নেওয়ার মাধ্যমে তারা বিপ্লবী বিকল্প আগেই বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের বাগাড়ম্বর পূর্ণ বিপ্লবী অবস্থান সত্ত্বেও। উভয়ক্ষেত্রেই এ এক বদ্ধ অবস্থা। এই সমস্যা আরএসএস চরম দক্ষিণপন্থী দৃষ্টিকোণ থেকে তত্ত্বগতভাবে নয়, সাংগঠনিকভাবে মােকাবিলা করেছে। তাদের দলিলসমূহ বড়বেশি ফোলানাে ফাঁপানো, কিন্তু তা পাঠের অযােগ্য, বিষয়বস্তুর নির্বুদ্ধিতায়। তাদের সাংগঠনিক কার্যধারা, বরং প্রায়ই ভয়াবহ রকম বুদ্ধিদীপ্ত। এটা কীভাবে হলাে? পরবর্তী আমাদের যুক্তিবিন্যাসে সেটাই আলােচিত।
[২]
আমরা ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের ঘটনাবলির পশ্চাৎ পটভূমি অনুধাবন করে দেখতে পারি। সেই নির্বাচন তাৎপর্যের দিক থেকে অনন্য, কিন্তু তার প্রকৃত তাৎপর্য উঠে আসতে পারে কেবলমাত্র যদি তার প্রেক্ষাপট—শুধুমাত্র আশু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নয়, বরং বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় তার যথার্থ অবস্থান, আমরা অনুভব করতে পারি। ব্রিটিশ টোরিদের মতাে অথবা আমেরিকার রিপাবলিকানদের মতােও একটি সাধারণ দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল মাত্র নয় বিজয়ী রাজনৈতিক দল বিজেপি। সারা বিশ্বের দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহের সাধারণ বিন্যাসের মধ্যে এর অভিনবত্ব হলাে এই যে, এটা আদৌ স্বাধীন একটি দল নয়-বরং তা পােড়খাওয়া পরিণত এবং আধা গােপন সংগঠন আরএসএস-এর একটি গণ রাজনৈতিক ফ্রন্ট, যে আরএসএস নিজেদের উপস্থাপন করে একটি ‘সাংস্কৃতিক’ এবং ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন হিসাবে, কিন্তু যার ঘােষিত উদ্দেশ্য হলাে ভারত -এর রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় জবীন সামগ্রিকভাবে নীচের থেকে রূপান্তরকরণ এবং যার নিজের তত্ত্বাবধানে আছে, যেসব সংগঠনে তারা জাল বিস্তার করেছে যদি তার হিসাব ধরি, তাহলে খুব সহজেই বলা যায় উদারতাবাদী গণতন্ত্রের দুনিয়ায় তারা সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি এবং ওলিম্পিকীয় ধৈর্য বলতে যা বােঝায়, তারা তার অসামান্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। নব্বই বছর ধরে তারা একাগ্র ভাবনায় নিজেদের লক্ষ্য অনুসরণ করেছে এবং এখনও তাদের কোনাে তারাহুড়াে নেই। এই দৃষ্টিকোণ থেকে একটি নির্বাচনে তাদের বিপুল জয় অন্যান্য অনেক অধ্যায়ের মধ্যে একটি মাত্র। এই অধ্যায়ের দিকে এবার নজর রাখা যাক এবং তারপর আরও গভীরতর বিশ্লেষণের জন্য প্রয়ােজনীয় উপাদানগুলি একত্রে জড়াে করা যাবে।
ভারত এর সংসদে একটি রাজনৈতিক দল শেষবার এককভাবে গরিষ্ঠ সংখ্যক আসন। দখল করেছিল ১৯৮৪ সালে, যখন নিজের দেহরক্ষীর হাতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি নিহত হওয়ার পর সৃষ্টি হওয়া তীব্র সমবেদনার তরঙ্গে নির্বাচনী তরী ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দল। তখন থেকেই ক্রমবর্ধমান হারে এই বিশ্বাস তৈরি হচ্ছিল যে, এক দলীয় শাসনের যুগের অবসান ঘটেছে। ভারত কোয়ালিশন সরকারের অপরিবর্তনীয় একমুখী যাত্রার যুগে প্রবেশ করেছে, কোয়ালিশন সরকারগুলি বরং ভারত -এর আঞ্চলিক বৈচিত্র্যময়তার এবং তার যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক কাঠামাের অনেক বেশি প্রতিনিধিত্বকারী এবং আরও আশ্চর্যজনক উপলব্ধি, কোয়ালিশনে অংশীদার দলসমূহ সরকারের রাশ টেনে ধরার মতাে প্রভাববিস্তারী ভূমিকা নেবে যদি কোয়ালিশনে নেতৃত্বকারী দল কোনাে চরম এবং বেহিসাবী নীতি অনুসরণ করার চেষ্টা করে। ২০১৪ সালে এই বৌদ্ধিক চিন্তাভাবনাকে বিশ্রামে পাঠানাে হয়েছে যখন বিজেপি একাই ২৮২ টি আসনে বিজয়ী হয়েছে-যা আগের সংসদের তুলনায় ১১৬টি বেশি এবং সরকার গঠনের জন্য প্রয়ােজনীয় সংখ্যার থেকেও তা ১০টি বেশি আসন। বিজেপি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দলসমূহের একটি জোট ন্যাশনাল ডেমােক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ)-এর শরিক হিসাবে এবং তাদের এখন আর প্রয়ােজনও নেই এমন তাৎপর্যহীন দলসমূহকে নিয়েও সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
সমান তাৎপর্যপূর্ণ এবং সম্ভবত আরও চমকপ্রদ ছিল কংগ্রেসের বিপর্যয়, যারা বিগত লােকসভার ২০৬ আসন থেকে সামান্য ৪৪ আসনে নেমে এসেছে নতুন লােকসভায়। মােটামুটি, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এটাই তাদের সবচেয়ে কম আসন প্রাপ্তি ছিল অথচ তারা শেষ দশকে (২০০৪-২০১৪) পর পর দু’বার সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছে। অন্য আর একভাবেও এই ফলাফল উপস্থাপন করা যায়। তা হলাে তারা গড়ে প্রতি দশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র একটি করে আসনে জিতেছিল। কংগ্রেস ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী থেকেছে এক শতাব্দীর ওপর। তারা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারত কে স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব করার কৃতিত্ব দাবি করে এবং ভারতীয় উদারতাবাদীরা ধারাবাহিকভাবে কংগ্রেসকে স্বাভাবিক শাসকদল হিসাবেই দেখে এসেছে, আর এই উদারতাবাদ বিজেপি-কে একটি প্রক্ষেপক দল হিসাবেই দেখেছে। দুই দলের নীতিগত অবস্থানে তফাত যৎসামান্যই। কেবলমাত্র তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য একটিই-ভারত এ যা সাম্প্রদায়িকতা বলে অভিহিত – এই প্রেক্ষিত বিবেচনায় রাখলে কংগ্রেস দলের বিপর্যয়ের আকৃতিগত চেহারা এবং ঘটনাকাল বেশ কিছুটা রহস্যময়। তার ভাগ্যের এই গভীর মন্দাভাব ঐতিহাসিক এবং মনে হচ্ছে কংগ্রেস তার অতীতের হারানাে ক্ষমতা অদূর ভবিষ্যতে পুনরুদ্ধার করতে আর সক্ষম হবে না। তার বিপুল এবং সুবিস্তৃত নির্বাচনী হাতিয়ার (Electroral Machine) এখনও বিদ্যামান এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচনে তারা আরও বেশি আসন পেতেও পারে, কিন্তু গৌরবের সেই উজ্জ্বল পথ এখন বন্ধ। কংগ্রেসের বিপর্যয়ের গভীরতার কাছে বিজেপি-র নির্বাচনী বিজয়ের আকার কিছুটা পরিমাণে ঋণী। অবশ্য বিজেপি-র বিরাট সাফল্যের পেছনে আরও অনেক অন্যান্য বিশেষ উপাদানের অবদান আছে। এখন এ বিষয়টি পর্যালােচনা করা হবে।
সমান তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলাে, ভারত এর অগ্রণী কমিউনিস্ট শক্তি সিপিআই (এম)-এর নির্বাচনী ভাগ্যের সমান্তরাল পতন। দশ বছর আগে ২০০৪ সালে এই দল সংসদে ৪৩টি আসন লাভ করেছিল। পেয়েছিল ২২ মিলিয়নেরও বেশি ভােট যা গণনা করা মােট ভােটের ছিল ৫.৬৬ শতাংশ, দশ বছর পর, এরা নেমে এসেছে মাত্র ৯টি আসনে। লক্ষণীয়ভাবে বর্ধিত নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্য থেকে ১ মিলিয়নেরও কম সমর্থন নিয়ে যা মােট প্রদত্ত ভােটের মাত্র ৩.২৫ শতাংশ। ২০০৪ সালে সি পি আই (এম) পরিচালিত বামফ্রন্ট-এর ছিল ৫৯
জন সাংসদ যা লােকসভার মােট শক্তির মােটামুটি ১০ শতাংশ ছিল। ২০১৪ সালে ফ্রন্ট মাত্র ১৬টি আসন জিতেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এই সর্বপ্রথম, ভারতীয় সংসদে কমিউনিস্ট বামপন্থীদের কোনাে লক্ষণীয় উপস্থিতি নেই। বিপ্রতীপে, গড়ে একজন সংসদ সদস্যর সম্পত্তির মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২.৩ মিলিয়ন ডলার, যা আগের সংসদের সদস্যদের গড় সম্পত্তির পরিমাণের মােটামুটি তিনগুণ (৮৫০,০০০ ডলার)। যে দেশে অধিকাংশ মানুষ বাঁচে দিনপ্রতি দু’ডালারেরও কম আয়ে, বলা নিষ্প্রয়ােজন চূড়ান্তভাবে এই সংসদ ধনীদের। এই বিন্যাসের কেন্দ্রভূমিতে প্রতীক ও মুখ্য অভিনেতা অনন্য চরিত্র প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদী। এই বৈশিষ্ট্যর অন্তত তিনটি প্রেক্ষিত এখানে এসে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া যায়। ২০০২ সালে যখন মদী মুখ্যমন্ত্রী, গুজরাটে জনজাতির গণহত্যার (এথনিক ক্লিনসিং) মূল অভিযুক্ত হিসাবে মােদী, ভারতে চরম জনজাতি-ধর্মীয় (ethno religious) হিংসার সবচেয়ে আগ্রাসী প্রতীক। নির্বাচন যত এগিয়ে আসে এবং বিজেপি-র প্রধান হিসাবে তাঁর বিজয় অনিবার্য হয়ে যায়, আমেরিকা এবং যুক্তরাজ্যের দূতাবাস সমূহ পাগল হয়ে ওঠে, যেহেতু তিনি ওই দেশগুলিতে ওই দাঙ্গা কর্মসূচির জন্যই আগে ঢুকতে সক্ষম হননি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বস্তুত আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে ভিসা দিতে অস্বীকারই করেছিল। এর বিপরীতে, ভারত এর অভ্যন্তরে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে যতগুলি নির্বাচন করা হয়েছিল, দেশের সম্ভাব্য পছন্দের প্রধানন্ত্রীর দৌড়ে তাঁকেই অন্যান্যদের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে দেখা যাচ্ছিল। এই ইস্যুতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এমন যুদ্ধং দেহী মনােভাব নিয়েছিলেন এবং কংগ্রেস ও বিজেপি-র মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এতাে দূর-প্রসারী ঐকমত্য ছিল যে, কংগ্রেস সরকারের উদারবাদী প্রধানমন্ত্রী ড. মনমােহন সিং পর্যন্ত নরেন্দ্র মােদীকে আমেরিকার ভিসা দানে অস্বীকৃতির আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করেছিলেন। ক্রমাগত ‘এথনিক ক্লিনসিং’-এর জন্য এতাে সুপরিচিত একজন ব্যক্তি এতাে দ্রুত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের অতি প্রিয়জন (darling) রূপে উঠে এলেন এবং কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সমর্থিত হলেন-এই ঘটনাই সুনিশ্চিতভাবে জানান দেয় যে, ভারতীয় সমাজের সামাজিক ভাবনার আকর্ষণের কেন্দ্র কতদূর সরে এসেছে এবং উদার কেন্দ্রস্থল কতটা চরম দক্ষিণপন্থার অভিমুখে সরে গেছে। নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই এ সবই ছিল। বস্তুত বিপুল পরিমাণ অর্থলগ্নী করে স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতাে ভঙ্গিতে নির্বাচনী প্রচার অভিযান শুরু হয় এমন ক্ষমতা। নিয়ে যা দেখে, শুরু থেকেই বােঝা যাচ্ছিল যে, এর গতি অপ্রতিরােধ্য। ক্ষমতায় মােদীর অপ্রতিরােধ্য উত্থানের দ্বিতীয় প্রধান প্রেক্ষিতটি ছিল, এই দেশের ইতিহাসে আর কখনই। অগ্রগণ্য কর্পোরেট সিইওদের ভ্রাতৃত্ব এতাে তীব্রভাবে ঐক্যবদ্ধ এবং স্পষ্ট ছিল না একজন রাজনীতিবিদকে প্রধানমন্ত্রীত্বে উন্নীত করার প্রশ্নে, যেমনটি দেখা গিয়েছিল মােদর জন্য। গুজরাট ভারত -এর মধ্যে সবচেয়ে শিল্পায়ন সম্পন্ন রাজ্য (এবং গুজরাটের গরিবরা আবার। সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্য লাঞ্ছিত)। গুজরাতি পুঁজির শিরােমণিরা ভারত -এর অর্থনৈতিক রাজধানী। বােম্বাই-এর শিল্পপতিদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। তাদের কারও কারও বাসভূমি বােম্বাই।
একই সঙ্গে তাঁরা যুক্তরাজ্য (ইউকে), আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র (ইউএসএ) এবং অন্যান্য জায়গার ভারতীয় বংশােদ্ভূত পুঁজিপতিদের সঙ্গেও সম্পর্কিত। দেড় দশক গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন মােদীর পক্ষে যতটা সম্ভব ততােটাই তিনি গুজরাটের ভিতর থেকে এবং অন্যান্য জায়গা থেকে, অন্তরঙ্গ বন্ধু-পুঁজির নিয়ন্ত্রণহীন রাজ্য করে তুলেছিলেন গুজরাটকে, এবং অনিবার্যভাবেই বিপুল পরিমাণ আর্থিক এবং অন্যান্য প্রকারের সমর্থন পাচ্ছিলেন তাদের কাছ থেকেও। এটা তাঁকে ভীষণভাবে সাহায্য করে তাঁর নিজের ভাবমূর্তি কর্পোরেট গণমাধ্যমে (মুদ্রণ এবং বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে) রূপান্তরিত করতে-রক্তলােলুপ এক চরমপন্থী থেকে একজন অর্থনৈতিক প্রতিভাবান মানুষে, যিনি তাঁর একক তৎপরতায় গুজরাটকে দারিদ্র্য থেকে প্রাচুর্যের রাজ্যে পরিণত করেছেন, – একজন যথার্থ উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব, হিন্দি পরিভাষায় একজন ‘বিকাশ পুরুষ’ -যাঁর নেতৃত্ব দৃঢ় এবং দূরদর্শী। বিশ্ব আঙিনায় সুযােগের এই নির্ণায়ক মুহূর্তে, তাঁর নেতৃত্ব ভারত এর জন্য প্রয়ােজন। কপােরেটদের এই সমর্থন, তাঁর নির্বাচনী প্রচার পরিচালনায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি ওবামার সমপরিমাণ মােটামুটি ব্যয় করতেও সাহায্য করেছিল, যখন এর এক ভগ্নাংশও ব্যয় ক্ষমতা ছিল না তাঁর বিরােধীদের। এমন বিপুল অর্থ সংস্থান উৎসের জন্যই মােদীর প্রচার আমেরিকার রাষ্ট্রপতির নির্বাচনী ব্যবস্থার ঢঙে প্রবাহিত হয়। তাঁর নির্বাচনী প্রচার সামগ্রিকভাবে একজন ‘অনন্য’ মানুষকে নির্বাচিত করার প্রশ্নে এসে দাঁড়ায়; তখন পর্যন্ত যা ছিল সংসদীয় ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন ধারার প্রচার তৎপরতা। এই বিপুল অর্থ মােদীর জন্য অভাবনীয় ঘটনা ঘটায়। এটা তাঁকে তাঁর নিজের দলেও তুলনামূলকভাবে স্বাধীন করে তােলে। ওই টাকাই গড়ে তােলে পারসােনালিটি কাল্ট (Personality Cult) যা দলের অভ্যন্তরেও কাউকে কাউকে কোনঠাসা করে ফেলতে পারে, এমনকি কারও বিরােধিতাকেও কিনে নিতে সক্ষম করে তােলে। এই টাকাই সামান্য পরিমাণে হলেও আরএসএস থেকেও তাঁকে স্বাধীন করে তােলে, যে আরএসএস তাঁকে নবীন বালক থেকেই গড়ে-পিটে নিয়েছে। আরএসএস ক্যাডারদের পরিহাস ছিল, যারা তাঁর নির্বাচনী প্রচার অভিযানে অবগাহন করেছিল, তাঁদের আর্থিক দায়-দায়িত্ব বহন সম্ভব হচ্ছিল কর্পোরেট প্রদত্ত অর্থ থেকে। তাই তারা মােদীর গড়ে তােলা নির্বাচনী মেশিনারির ওপরই বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে তাদের মূল সংগঠনের (Parent organization) তুলনায়।
মােদীর ক্ষমতায় উত্থানের প্রকৃত তৃতীয় প্রেক্ষিতটি হলাে, এই প্রথম এমন একজন মানুষ দেশের প্রধান কার্যনির্বাহী (Chief executive) হয়েছেন যিনি, তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশিরভাগ সময় একটি আধা গােপন প্রশ্নদীৰ্ণ সংগঠন আরএসএস -এর.একজন সর্বক্ষণের সংগঠক/প্রচারকের দায়িত্ব বহন করেছেন।
বিজেপি-র আগের সরকারের প্রধান এ বি বাজপেয়ীও আরএসএস-র একজন সদস্য ছিলেন। বিজেপি-র সমস্ত প্রধান নেতারাই যেমন কার্যত আরএসএস সদস্য ছিলেন। অবশ্য, বাজপেয়ী এবং তাঁর মতাে অন্যান্য নেতারা কেবলমাত্র সদস্যই ছিলেন, তাঁরা নিজের পেশাগত বা রাজনৈতিক জীবনযাপন করেছেন এবং তাঁদের প্রথম যৌবনেই তাঁরা ঝাড়ঝাময় সংসদীয় রাজনীতির জীবনে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু মােদী তা করেননি। আমরা জানি যে, কিশাের হিসাবে তিনি আরএসএস -এর যােগদান করেছিলেন কিন্তু তাঁর জীবনের প্রথম বছর তিরিশ সম্পর্কে খুব সামান্যই আমরা জানি এবং যেটুকু যা জানি তাও তার কাছ থেকেই জানা। জনসাধারণের নজরে পরিপূর্ণভাবে যখন তিনি আসেন বিজেপি-র আশেপাশে থাকা একজন আরএসএস সংগঠক হিসাবে, তিনি তখন চল্লিশের কাছাকাছি। আরএসএস-এর নির্দেশনায় তিনি যখন গুজরাটে উড়ে এসে মুখ্যমন্ত্রী রূপে জুড়ে বসেন, নির্বাচনী রাজনীতিতে তাঁর কোনাে কেরিয়ার ছিল না। তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সংসদের কোনাে পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছাড়াই। জাতীয় রাজধানীতে তাঁর ঘনিষ্ঠতম প্রাণের বন্ধু অমিত শাহ্ গুজরাট থেকেই ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ প্রিয়জন, তিনি সাধারণভাবে অনেকগুলি হত্যাকাণ্ডের দায়বাহী একজন কূট ব্যক্তিত্ব বলে পরিচিত।
মােদী কাদের প্রতিনিধিত্ব করেন? খুব সাধারণ উত্তর হলাে, আরএসএস এবং কর্পোরেট অভিজাতদের। কিন্তু তিনিও নিদারুণ অহংবােধে কানায় কানায় পূর্ণ এক আত্মপ্রেমী মানুষ। কে কার সেবা করবে এখনও তা দেখার বিষয়। তাহলে আরএসএস-এর লঙমার্চ-এর কী হবে? পরবর্তী পরিচ্ছেদে আমরা প্রথমে আরএসএস-এর মূল গঠন ও আদর্শগত অতিব্যক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গগুলি পর্যালােচনা এবং পরে তার সাংগঠনিক অভিনবত্ব। প্রসঙ্গে মন্তব্য উপস্থাপন করব।
দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ১৯২৫ সালে বৃহত্তম ক্ষেত্রে আরএসএস-এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। সেটা ছিল এজাতীয় সংগঠনসমূহের ব্যাপকতর বিস্তারের সময়, যেমন মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড-যা ছিল বলশেভিক বিপ্লবের প্রেক্ষিতে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণপন্থীদের বিশ্বব্যাপী জেগে ওঠারই একটি অংশ। উদারতাবাদী গণতন্ত্রের এই ধরনের কোনাে বিপদ প্রতিহত করার কোনাে ক্ষমতা বা আকাঙ্ক্ষা আছে, এই বিশ্বাসই ইউরােপীয় আলােকপ্রাপ্তি বিরােধী (anti enlightenment) দক্ষিণপন্থীরা হারিয়ে ফেলেছিলেন কেবলমাত্র এই কারণে নয় যে, এর নেতাদের দুর্বলচিত্তরূপে দেখা গেছে, বরং এই জন্য যে, উদারতাবাদকেই দেখা গেছে। ফরাসি বিপ্লবের ঐতিহ্যর এক ভিন্ন ধরনের প্রতিরূপ হিসাবে নানাক্ষেত্রে বলশেভিকবাদের অভিমুখে নিয়ে গেছে। এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে এই ধরনের দলসমূহের উত্থান প্রধানত ইউরােপীয় ফ্যাসিবাদের প্রভাবেই বলে ধরে নিলে ভ্রান্তি ঘটে যাবে, সব ক্ষেত্রেই, এই চরিত্র গ্রহণের জন্য দেশের আভ্যন্তরীণ শিকড় এবং অপরিহার্য বাস্তবতা অনেক বেশি। শক্তিশালী উপাদান ছিল, অবশ্য কিছুটা প্রেরণাও একেবারে অস্বীকার করার নয়। তবে বিভিন্ন সংগঠন তা ভিন্ন ভিন্ন বিভঙ্গে অনুপ্রবিষ্ট করিয়েছিলেন। মিশরীয় মুসলিম ব্রাদার হুড এবং ভারতীয় আরএসএস-এর মধ্যকার আকর্ষণীয় সমান্তরাল কাজের ধারা পর্যবেক্ষণ মার মতাে পরিসর আমাদের এখানে নেই। উভয়েরই ধর্মীয় গরিষ্ঠতাবাদ ও ধর্মীয় কতক পুনরুত্থানবাদ-এর বহু বিকল্প নীতিগত অবস্থান ছিল। উভয়েই জাতীয়তাবাদকে (nationalism) জাতি (Race) এবং ধর্মের ভিত্তিতে সম্মায়িত করার নাজি আদর্শবাদকে গভীরভাবে আকর্ষণীয় অনুভব করেছিল, যা ছিল জাতি, ধর্ম ইত্যাদি ব্যতিরেকে সকলের সমান নাগরিক অধিকার-এর ধারণা এবং ফরাসি বিপ্লব-এর উত্তরাধিকার হিসাবে পাওয়া জাতিসত্তার (nationhood) সঙ্ঘার বিপ্রতীপ। হিন্দু জাতীয়তাবাদের কয়েকজন নেতা প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে, ইহুদিদের জন্য জার্মান সমাধান সূত্র’ (German Solution) ফলপ্রসূভাবে ভারতীয় মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করা যাবে। মুসােলিনির কাছ থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছিল স্বর্ণালী ক্ল্যাসিকাল অতীতের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং নাজি ও ফ্যাসিস্তদের থেকে তারা শিখেছিল, শক্তির কৌশলগত ব্যবহার, হিংসা ও সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়া অসামরিক বাহিনী ব্যবহার এবং একটি নতুন বিকারগ্রস্থ উন্মাদনা তৈরির রাজনৈতিক আকাঙক্ষা সৃষ্টির চোখ ধাধানাে প্রকাশ্য আনুষ্ঠানিকতা। এবং তারা নেতার অন্ধ পুজার (Cult) রীতি চালু করলেন এবং গণ আনুগত্যর পাশাপাশি তাদের নিজেদের সংগঠনে গণতান্ত্রিক কাঠামাের অবমাননার রাজনীতি আঁকড়ে ধরলেন।
এই বিষয়ে আরএসএস-এর কর্মপদ্ধতি উল্লেখযােগ্যভাবে লক্ষণীয় : তারা নাজি সংগঠনের চরম কেন্দ্রীভূত চরম কর্তৃত্ববাদী কাঠামাে নৈপূন্যের সঙ্গে সংরক্ষিত করেছে এবং তারা যখনই প্রয়ােজন মনে করে অন্যান্য নানা ধরনের ফ্রন্ট ব্যবহার করে হিংসার প্রয়ােগ এবং দেশের সাংবিধানিকতার বাধ্যবাধকতা অগ্রাহ্য করার জন্য, এমন কী তারা অনুমােদন করে সাংবিধানিক রীতিনীতি মান্য করে চলার জন্যও বর্তমান শাসকদল বিজেপি-কে। এমন মুহূর্তও আসে, যখন বিজেপি-ও নিজে আইনানুগতা থেকে সরে যায়, কিন্তু একবার সরে যাওয়ার ফসল পরিপক হয়ে উঠলে, তাকে আবার রীতিনীতির কাঠামােয় ফিরিয়ে আনা হয়। কারও কাছে জবাবদিহির দায়হীন একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট যে অন্যান্য সাধারণ রাজনৈতিক দলের মতােই ভারতীয় উদারতাবাদী গণতান্ত্রিক পরিবেশে কাজ করে এবং আরও অজস্র অন্যান্য ফ্রন্ট যারা আইনি, বেআইনি বিভিন্ন স্তরে কাজ করে-সেখানে এই খেলা খেলতে আরএসএস ভালো বাহিনী খারাপ বাহিনী (Good cop bad cop) কৌশলে শান দিয়েছে চতুরভাবে সব তছনছ করার জন্য। এই প্রশ্নে আমরা আবার ফিরে আসব। ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ (গান্ধি, নেহরু প্রমুখর প্রামান্য ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের বিপ্রতীপ ধারণা) বলে পরিচিতি পাওয়া অভিব্যক্তিতে শুধু আরএসএস-ই জেগে উঠেছিল তা নয়, সে ছিল অনেকগুলির মধ্যে একটি মাত্র। আরএসএস -এর ১২ বছর আগে ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দু মহাসভা’, ওই ধরনের সংগঠনের মধ্যে মােটামুটি বৃহত্তম ছিল ১৯৫০ সাল অবধি, যখন তার ক্ষয়প্রাপ্তি শুরু হয় এবং তার অনেক সদস্য আরএসএস এবং তার অনুমােদিত সংগঠনের সঙ্গে মিশে যায়। পরিহাসের বিষয়, ‘মহাসভা’ ঘােষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ভেতরে থেকেই ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কার্যকলাপ পরিচালনা করেছিল এবং স্বাধীনতার পর তার বিশিষ্ট নেতাদের অন্যতম শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় পুনরায় ভেসে ওঠেন মন্ত্রিসভার একজন মন্ত্রী হিসাবে- যার তার মন্ত্রিসভা নয়, স্বয়ং নেহরুর মন্ত্রিসভার সদস্য। আমি যাকে ‘প্রামান্য’ জাতীয়তাবাদ বলে অবিহিত করেছি, তা থেকে হিন্দু চরমপন্থীদের কিছু কিছু অবস্থান এবং রক্ষণশীলতা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল না এবং যা কখনও ধর্মনিরপেক্ষতার বিশুদ্ধ সাধারণ অর্থ জোরের সঙ্গে উত্থাপনে ক্লান্ত হয়ে পড়েনি।
গঠনের প্রথম যুগে আরএসএস নেতাদের খুব সামান্যই নিজস্ব কোনাে আদর্শ ছিল এবং তাদের বিশ্বাসের অধিকাংশই তারা ধার করেছিল ভি ডি সাভারকারের কাছ থেকে। সাভারকার একজন আকর্ষক এবং তীব্রভাবে হেঁয়ালীময় চরিত্র, চিন্তাধারায় অবশ্যই ফ্যাসিবাদী কিন্তু এক সময়কার উপনিবেশবাদ বিরােধী জাতীয়তাবাদী, যিনি গান্ধিজির সঙ্গে হিংসার আইনানুগ প্রসঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন, এবং বাংলার বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীদের কাজের ধারায় বরং অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এমনকি তিনি প্রকাশ করেছিলেন : ‘হিন্দুত্ব : হিন্দু কে?’ (Hinduttya : who is a Hindu)। এটা হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের কাছে বাইবেলের মতােই গ্রহণীয় ছিল। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল আরএসএস প্রতিষ্ঠারও দু’বছর আগে ১৯২৩ সালে। এর পরও তিনি ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। বস্তুত কোনােদিন তিনি আরএসএস-এ যােগদান করেননি, বরং ধীরে ধীরে ক্রমশ একেবার রাজনীতির প্রাঙ্গন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি হিন্দু মহাসভার সভাপতির আসনে অধিষ্ঠিত হওয়াটাই তাঁর রাজনীতির পথ হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভার নিজেদের কাজের সম্পর্কের নিবিড়তা এবং ঝুঁকে থাকার প্রবণতা এতাে বেশি ছিল যে, গান্ধি হত্যার পর আরএসএস যখন নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়েছিল, ওই ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযােগে সাভারকারের বিচার হয়েছিল আদালতে। এমন ঘটনাও হয়েছিল যে, সাভারকার যখন অভিযােগমুক্ত হয়ে ছাড়া পেয়েছিলেন, আরএসএস-এর ওপর থেকেও নিষেধাজ্ঞা অল্প দিনের মধ্যেই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল। আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম যুগের নেতারা, বিশেষত থােড়েওয়ার এবং গােলওয়ালকার, তাঁর চিন্তাভাবনাই ধার করে তাঁদের নিজেদের সংগঠনের জন্য পুনর্নির্মাণ করে নিয়েছিলেন। ১৯৬০ পরবর্তী সময়ে আরএসএস যখন হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ঐক্যবদ্ধ ‘চার্চ’ হয়ে উঠেছে, সাভারকার ক্রমবর্ধমানহারে তাঁদের প্রধান তাত্ত্বিক এর শিরােপা পেতে থাকেন। জন্মসূত্রে, আমাদের নজর রাখতে হবে যে, আজকের দিনেও মােটামুটিভাবে আরএসএস হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হলেও কিন্তু, কোনােভাবেই তাদের সম্পূর্ণ একচেটিয়া নিজস্ব সংগঠন নয়। এর নিজস্ব ছাতার অথবা পরিবারের (যেমন সাধারণত এর ফ্রন্টগুলকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে-) বাইরেও আছে অনেক অনুরূপ সংগঠন। সবচেয়ে উল্লেখনীয় হলাে শিবসেনা-কিন্তু অগণিত ছােটো ছােটো তীব্র হিংস্র প্রকৃতির গােষ্ঠী ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে, সব সময় জানাও সম্ভব হয় না যে, এদের মধ্যে কোন্ কোন্ গােষ্ঠী গােপনতার আড়ালে আরএসএস -এর অনুগামী সংগঠন এবং কারা নয়।
এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রথম উদ্ভাবক সংগঠন মহাসভা এবং আরএসএস নয়। বা এর প্রথম রাজনৈতিক অভিব্যক্তিও নয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকের বাংলায় পুনরুত্থানবাদ এবং গৌরবময় অতীতের হিন্দু স্বর্ণযুগের নস্টালজিয়ার ডিমে তা দেওয়ার জন্য কিছু কিছু উচ্চবর্ণের গােষ্ঠী পরিচর্চা কেন্দ্র উপহার দিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের স্বদেশী আন্দোলনে এসব ভাবনাচিন্তা কিছু কিছু শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেই, দেশের অন্য প্রান্ত মহারাষ্ট্র, খুবই প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক এবং শিক্ষা সংক্রান্ত আন্দোলন বিকশিত হচ্ছিল, ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতপ্রথা মােকাবিলা করে অস্পশ্য জাত ও অন্যান্যদের অগ্রগতি ঘটানাের জন্য। ব্রাহ্মণ্যবাদকে এই চ্যালেঞ্জ ব্রাহ্মণ অভিজাতদের তাঁদের জাতগত সুযােগ সুবিধার সপক্ষে দাঁড়াতে ঐক্যবদ্ধ হতে অনেকটাই সাহায্য করেছিল এবং যেমন অনুমান করা যায় কার্যত তা সামগ্রিকভাবে হিন্দুত্ববাদীদের সপক্ষেই দাঁড়ানাে হয়ে যায়। এটা স্মরণ করানাে হয়েছিল যে, ব্রিটিশরা ভারত এ সর্বশেষে মহারাষ্ট্রীয়দের পেনয়াই রাজত্বকে পরাজিত করেছিল, তাই মহারাষ্ট্রীয় অভিজাতদের শুধুমাত্র কর্তব্য নয় বরং অধিকারও, নতুন ধরনের এক ‘জাতীয়তাবাদ’-এর উদ্ভাবন ও নেতৃত্বদান করা : হিন্দু জাতীয়তাবাদ থেকে মুসলমান দখলদারদের বাদ রাখা হয়েছিল এবং তারা অতীত হিন্দু গৌরব পুনরুজ্জীবিত করবে, পরিশুদ্ধ করবে দেশের সংস্কৃতি। আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম যুগের অধিকাংশ নেতাই মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণরাই ছিলেন।
এজাতীয় ছছাটো-বড় অসংখ্য ঘটনার বিকাশ ঘটছিল শুধুমাত্র হিন্দুদের মধ্যে নয়, মুসলমানদের একাংশের মধ্যেও। এসব ইতিহাস সবিস্তারে খুঁজে নেওয়ার পরিসর এখানে নেই। তবুও, অন্তত ভাবনাগত ভাবে (Conceptually) এটা বুঝে নেওয়া খুবই উপযােগী হবে যে, ঔপনিবেশিক শাসকের কিছু কিছু মৌলিক উপাদান ধর্মীয় এবং জাতপাতগত পরিচিতির পারস্পরিক রাজনৈতিক ক্রিয়া (Political Valence) শক্তিশালী করতে দারুণভাবে সাহায্য করেছিল। মূল বিষয় হলাে, উপনিবেশের একজন অধিবাসী একজন ‘নাগরিক’ নন এবং অধিবাসীদের সাধারণ নাগরিকত্বর (Common Citizenship) অধিকার কোনাে উপনিবেশিক সমাজের ভিত্তি হতে পারে না। ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ প্রশাসনিক আধুনিকতার ধাঁচ আমদানি করা সত্ত্বেও তাই, ধর্ম-নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমূহের। কার্যধারা শিকড় খুঁজে পেতে এবং সমৃদ্ধ হওয়ার পক্ষে পরিস্থিতি অস্বাভাবিকভবে অনুকূল ছিল না। জনপ্রিয় প্রতিনিধিত্বের কাঠামােগত ঘাটতি ছিল, যেমন সার্বজনীন ভােটাধিকার। বলতে বােঝাত ‘প্রতিনিধিরা’ হয় ওপরতলা থেকে মনােনীত বা নিযুক্ত হতেন, নতুবা ‘জনগণ’-এর প্রতিনিধিত্ব করছেন বলে দাবি করতেন তাঁরা, তাঁদের ‘শ্রেণিগত’ সুবিধাভােগী হওয়ার জোরে (Privilage)। অথচ তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য কেউ বেছে নেননি। আধুনিক সমাজের শ্রেণিগুলির বিকাশই দুর্বল থেকে গিয়েছিল-শিল্প উন্নয়নে ঔপনিবেশিক প্রতিন্ধকতাকে ধন্যবাদ-যা তখন শ্রেণি সংগঠন সমূহের দুর্বলতাগুলিতে এবং ওপর থেকে সংগঠিত অ-শ্রেণিগত চাপ সৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর বিস্তারে প্রতিফলিত হয়েছিল, অল্প সংখ্যক প্রলেতারিয়েট ছিল, বরং সংখ্যাগত ভাবে খুব ছােট হলেও, আধুনিক বুর্জোয়ারাও ছিল, যারা বিশেষভাবে তাদের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিল বুর্জোয়া।
এই ধরনের পরিবেশে, সামাজিক অঙ্গনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রের চেয়েও বেশি আধুনিক ধরনের সংগঠনসমূহ জেগে উঠেছিল। এবং এই ধরনের সংগঠনের বেশিরভাগই বিদ্যমান সামাজিক ত্রুটির সরণি ধরে বিকশিত হয় যেমন, ক্ষুদ্রাকৃতি সম্প্রদায় (Denominational Community), ধর্মীয় সম্প্রদায়, জাতিভিত্তিক অ্যাসােসিয়েশন। উপনিবেশিক পরিবেশের অধীনে, এ জাতীয় সংস্থাগুলি তাদের আগের নিরাকার চেহারা হারিয়ে ফেলে এবং ঔপনিবেশিক সরকারের মদত, সামাজিক জীবনে তাদেরকে দেয় বেশি দাঢ্য এবং নতুন উদ্ভূত রাজনৈতিক প্রাঙ্গনে প্রতিনিধিত্ব করার দাবি। সমতার রাজনীতি, এমনকি বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রেও, বিধিনিষেধ মতপার্থক্যের রাজনীতিতে দৃঢ় ছাপ রাখতে সাহায্য করেছিল। যে-সামাজিক সংগঠনসমূহ সংস্কারের জন্য কাজ করছিল, যেমন শিক্ষা সংক্রান্ত সােসাইটিসমূহ, ধর্মীয় ট্রাস্ট ইত্যাদি জেগে উঠেছিল মূলত জাত (Caste) এবং সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে আধুনিক শিক্ষা জাতপাত গত সংগঠন (Caste Society) এবং ক্ষুদ্রাকৃতি সম্প্রদায়ের স্কুল-কলেজের মাধ্যমে পরিবেশন করা যেত, রাজনীতির বেশির ভাগই তাহলে অনুরূপভাবে আবেদন-নিবেদনের (Deputation form) এবং সম্মেলনের রীতিনীতিতে পরিচালনা করা যেত। ও অন্যভাবে বলা যায় যে, ঔপনিবেশিক পুঁজির আকারে আধুনিক ধরনের ক্ষমতার আবির্ভাবের প্রয়ােজন ছিল রাজনীতির অনুরূপ কাঠামাে, যার মাধ্যমে, ঔপনিবেশিক শাসনাধীনরা নিজেদের নিজেরাই প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। যাই হােক, সমান নাগরিক অধিকার এবং সার্বজনীন ভােটাধিকারের ঢঙে সংঘবদ্ধ প্রতিনিধিত্ব আটকে গিয়েছিল। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র খণ্ড খণ্ড করেছিল উদীয়মান জাতিকে তার সামাজিকইউনিট অনুসারে এবং ব্যাপকভাবে বিদ্যমান বিভাজনগুলিকে আরও বিভাজিত করে তুলে। অবশ্য, একই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কর্তৃক শাসিত হওয়ার বাস্তবতা এই ইউনিটগুলির প্রতিটিকে কিছু পরিমাণে, জাতীয় চেতনার অংশীদারিত্ব এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রাথমিক আকারও দিয়েছিল।
[৩]
ঔপনিবেশিক রাজনীতির কাঠামাে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধোত্তর সময় পর্যন্ত এ রকমই থাকে। যখন গণ-রাজনীতির যুগের সূত্রপাত ঘটল, জাত-পাত, ধর্ম আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে, ভারতীয় ঔপনিবেশিক সমাজ ততােদিনে সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক এবং জাত-পাতের রাজনীতির সম্প্রসারণে ঔপনিবেশিকতাবাদের অবদান শুধুমাত্র তাই কৌশলগত (ভাগ করাে এবং শাসন করাে নীতি) ছিল না, ছিল কাঠামােগত। এই সব কিছুতে ধর্মের গুরুত্ব এতে প্রভাব বিস্তারী ছিল এবং ভারতীয় উদার আধুনিকতাবাদীরা সেই শক্তির বিরুদ্ধে মুখখামুখি দাঁড়াতে এতােটাই অনাগ্রাহী ছিলেন যে, প্রামাণ্য, বহুস্তরীয় তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদীরা অতি সাধারণভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুনঃ সংঘায়িত করেছিলেন এইভাবে যে ধর্ম থেকে রাজনীতিকে পৃথক করা নয় বরং থাকবে ‘সকল ধর্মের জন্য সমান মর্যাদা’। যে কথা বলতে গিয়ে ব্যাপকভাবে গৃহীত হন ড. রাধাকৃষ্ণাণ। তিনি ছিলেন রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ্যবাদী স্কলার এবং স্বাধীন ভারত এ দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসাবেও ভারত -এর সেবা করেছেন। গান্ধিজির বিখ্যাত অভিমতই ছিল কোনাে রাজনীতির ধর্ম থেকে দূরত্ব বজায় রাখার প্রচেষ্টা এক গহিত পাপ যা ওই অভিমতেরই ধারাবাহিকতার প্রতিফলন মাত্র। হিন্দু জাতীয়তাবাদের এই সুনির্দিষ্ট মতাদর্শগত অবস্থান, ধর্মীয় উন্মাদনার এই সুগভীর প্রভাবের বিস্তৃত প্রেক্ষিতে দেখাটা জরুরি প্রয়ােজন।
প্রাথমিক গঠন পর্বে, হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের তিনটি সুস্পষ্ট উপাদান ছিল :
প্রথমত ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরােপীয় দক্ষিণপন্থী রােমানটিসিজমের থেকে প্রাপ্ত ‘রক্ত ও ভূমি’র জাতীয়তাবাদ। বিংশ শতাব্দীর অনেক জাতীয়তাবাদে তা জাতি (Race) এবং ‘ধর্ম’র ভিত্তিতে পুনর্লিখিত হয়েছে; যেমন এর অন্তর্গত ছিল হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদ ভারত -এর ইতিহাসের একটি ঔপনিবেশিক পাঠ ও উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল, যা জেমস মিল তাঁর বিখ্যাত ছয় খণ্ড গ্রন্থ ‘ব্রিটিশ ভারত -এর ইতিহাস’ বা ‘The History of British India’-তে ইতিমধ্যেই লিপিবদ্ধ করেছিলেন। গ্রন্থটি ১৮১৭ সালে প্রকাশিত হতে শুরু করে। এতে তিনটি ঐতিহাসিক সময়পর্ব বিভাজন করেছিলেন তিনি, সেটা হলাে হিন্দু স্বর্ণযুগ, হিন্দু সভ্যতার পরাজয় ও মুসলিম অত্যাচারিদের হাতে পতন এবং শেষ পর্ব তৎকালীন ভােরের আলাে ফোটার পর্ব, যার জন্য ব্রিটিশদের। চিত্রিত করা হয়েছে মুসলিম দস্যুদের থেকে হিন্দুদের মুক্তিদাতা রূপে। শেষে বিধৃত হয়েছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে তীব্র দোদুল্যমানতা। হিন্দুত্বের মতাদর্শর প্রবক্তারা যখন হিন্দুরা বিদেশি শাসকদের অধীনে নিষ্পেষিত হয়েছিল বলেন, তাঁরা রুটিন করে উল্লেখ করেন মুসলিম শাসন পর্ব। কিন্তু কখনই ব্রিটিশদের সম্পর্কে কিছু বলেন না। যদিও তাঁরা উপনিবেশ-বিরােধীদের তালিকায় তাঁদের রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু প্রকৃতই সেইসব সংগ্রামে তাঁদের অংশগ্রহণের সপক্ষে খুবই ক্ষীণ সাক্ষ্যপ্রমাণ মেলে। তাঁদের এই শক্তিশালী মতাদর্শগত ঐতিহ্য অক্ষুন্ন থেকে গেছে। আজকের দিনেও তাঁদের জাতীয়তাবাদও লক্ষণীয়ভাবে সব রকম সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী অবস্থান বর্জিত। নয়া উদারবাদী সহমতের ক্ষেত্রেও তাই। বিচ্ছিন্ন এমনকি এক ধরনের স্বনির্ভরতার আদর্শবলী থেকেও, যা গান্ধিবাদীনেহেরুবাদী স্বতন্ত্র ধারার জাতীয়তাবাদ ভারতীয় পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য স্বপ্ন দেখেছিল।
‘রক্ত ও ভূমি’ জাতীয়তাবাদ এবং মুসলিম দস্যুতার রূপকথার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছিল আরও কিছু কিছু বিষয় : একদিকে নিচুজাতের বিদ্রোহের চাপে উঁচুজাতের অভিজাতদের। বৃহদাংশের মধ্যে উদ্বেগ এবং অন্যদিকে, বহু ধর্মীয় ও বহুজাতের জাতীয়তাবাদ, গান্ধিজির পরিচালনায় কংগ্রেসের নেতৃত্বে, বিশেষত ১৯১৯-এর পর, খুব দ্রুত উল্লেখযােগ্য গণআন্দোলন হয়ে উঠেছিল। হিন্দু স্বর্ণযুগ এবং মুসলিম অত্যাচারের ভাবনাগুলি ছিল এমন উপাদান, ঔপনিবেশিক শিক্ষা প্রায়ই যা প্রােথিত করত, তাই দ্রুত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল শিক্ষিত হিন্দু অভিজাতদের মধ্যে। সেই প্রেক্ষিতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ তাদের কাছে।
যথেষ্ট গুরুত্ববহ আবেদন রাখতে পারত। অবশ্য, ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতের উদ্বেগের তীব্রতা ছিল আলাদা ব্যাপার। এ-সবই বিরাজ করছিল উপনিবেশ বিরােধী তীব্র আন্দোলনের উজ্জ্বল সময়ে (১৯১৯-১৯৪৭) এবং প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরবর্তী প্রাথমিক সময়ে, যা আরএসএস এর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার প্রধান কারণ।
ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন অনেক বেশি কৃষক পরিবারকে গণ-বিক্ষোভে সমবেত করতে সক্ষম হয়েছিল, ইতিহাসে আর কোনাে রাজনৈতিক আন্দোলনে এমনটি হয়নি। কৃষক বিক্ষোভ সমাবেশের প্রেক্ষিতে বরং তা চীনের বিপ্লবের সঙ্গে তুলনীয়। বুর্জোয়া আধিপত্যের অধীনে গান্ধি এই স্তরের কৃষি-অসন্তোষ সংঘবদ্ধ করতে পারতেন না, যদি না তিনি গ্রামীণ এলাকায় মধ্যশ্রেণি ও ধনী কৃষকদের (যারা সাধারণভাবে মধ্যমাকৃতির জাতের থেকে সংগৃহীত হতেন) তাঁর সাংগঠনিক কাঠামাের ভেতরে আনতেন অথবা যদি না তিনি অস্পৃশ্যতার প্রশ্নে তীব্রভাবে প্রচার অভিযান সংগঠিত করে নিপীড়িত ‘নিচু জাতের’ মানুষদের কাছে তাঁর আবেদন পৌঁছে দিতে সক্ষম হতেন। স্বভাবতই এতে ‘উঁচুজাতের’ মধ্যে অনেক গোঁড়া মানুষের দারুণ ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল, যদিও গান্ধি ব্রাহ্মণ্যবাদী জাত ব্যবস্থার মৌল চতুর্বর্গ জাত বিভাজন প্রথা কখনও খারিজ করেননি (বর্ণাশ্রম প্রথা)। এখন প্রায়ই ভুলে যাওয়া হয় যে, দেশভাগের আগের গণনায় মুসলমানরা ছিলেন ভারতীয় মােট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ। এই হিসাব পাকিস্তান-বাংলাদেশে মুসলমান জনসংখ্যার তিনের দুই অংশই ঢুকে যাওয়ার আগের। সমগ্র ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারত -এর প্রতিনিধিত্ব করার দাবিদার কোনাে নেতা বা সংগঠনের পক্ষে জনবিন্যাসের এই বাস্তবতা উপেক্ষা করার বিলাসিতা দেখানাে সম্ভব ছিল না অথবা তারা ভারত কে শুধুমাত্র বিশুদ্ধ হিন্দু রাষ্ট্র (Hindu Nation) বলে সঙ্ঘায়িত করতেও পারতেন না। তাই কংগ্রেস দলের নেতারা নিজেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে ঘােষণা করেছিলেন, তবে সেই ঘােষণার প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা ও বিশ্বাসের তারতম্য ছিল। অনুরূপভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদের এই ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বিদ্বেষী মনােভাব ছিল সীমাহীন। হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রধান তাত্ত্বিক সাভারকার সমগ্র প্রেক্ষাপটে তীক্ষ্ণ এবং সুদূরপ্রসারী পার্থক্য টেনে ছিলেন : গান্ধির সীমানা ভিত্তিক (territorial) জাতীয়তাবাদ যা ‘জাতি’ (Nation) ধারণার ভিত নাড়িয়ে দেয়, তাকে সামান্য সীমানা বা অঞ্চলের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে, অথচ তার (সাভারকারের) নিজের ভাবনাটি ছিল হিন্দু জাতির (Hindu race) সাংস্কৃতিক ‘জাতীয়তাবাদ’ যার জন্য সংস্কৃতি (culture) সমগ্র হিন্দু জীবনধারার সমার্থবােধক শব্দ হয়ে উঠেছিল, যার অন্তর্গত ছিল রাজনীতি, সমাজ, সভ্যতার ঐতিহ্য, পারিবারিক কাঠামাে, সরকারের ধরন (form) ইত্যাদি সবই – আদি জাতিসত্তার সামগ্রিকতার ধারণা।
এই সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতার কিছু প্রেক্ষিতে, হিন্দু সমাজের একাংশকে অনুরণিত করে। কিন্তু তা অনুগামীদের খুবই সীমাবদ্ধ সার্কিট ছাড়া হিন্দু জাতির এই রকম চরম সঙ্র গ্রাহক কেউই বিশেষ ছিলেন না, যেহেতু ঔপনিবেশিকতাবিরােধী আন্দোলন ক্রমবর্ধমান হারে দেশব্যাপী বৈচিত্র্যময় জনবিন্যাসের গুরুত্ব অর্জন করেছিল। হিন্দু জাতির ঐ চরম সঙ্র গ্রাহক স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও খুব সামান্যই ছিলেন, যেহেতু প্রজাতন্ত্রটিকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছিল সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে, নেহরু যা মনােরমভাবে ‘সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ’ নামে অভিহিত করেন সেই অভিমুখে। আরএসএস তুলনামূলকভাবে প্রান্তিক শক্তিই থেকে যায় ১৯৫০-এর দশকে গান্ধির হত্যাকাণ্ডের ধুলােঝড় থিতিয়ে আসার সময় পর্যন্ত।
এই সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতার কিছু কিছু প্রেক্ষিত হিন্দু সমাজের নানা অংশে অনুরণন তুলেছিল। কিন্তু এর সীমায়িত ক্ষেত্রের বাইরে হিন্দু নেশনের এই চরম সঙ্র অনুগামী ছিলেন সামান্য কিছু মানুষ। যেহেতু ঔপনিবেশবাদবিরােধী আন্দোলন ক্রমাগত দেশব্যাপী প্রসারিত জনবিন্যাসগত গুরুত্ব অর্জন করেছিল এবং এমনকি স্বাধীনতার পরেও খুব সামান্য অনুগামীই ছিলেন, যেহেতু প্রজাতন্ত্রটিকে সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল – নেহেরু যাকে বেশ চমৎকার ভাষায় চিত্রিত করেছিলেন ‘সমাজতান্ত্রিক ধাঁচ’ বলে, গান্ধি হত্যার ধুলােঝড় স্থিতিশীল হয়ে না-আসা পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে আরএসএস ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত প্রান্তিক শক্তিই ছিল এবং যদিও ভারতীয় উদারতাবাদী দার্শনিকরা যতেটা মানতে পারতেন তার তুলনায় হিন্দু জাতীয়তাবাদের কাছে তার দায়বদ্ধ সংবেদনশীলতা ছিল অনেক অনেক বেশি প্রসারিত।
[৪]
আরএসএস তার অস্তিত্বের প্রথম ২৫ বছর কোনাে রকম অভিনব প্রবণতা প্রদর্শন করেনি, বরং আত্মসংরক্ষণ এবং সম্প্রসারণে মনােযােগ কেন্দ্রীভূত করেছিল। তারা তাদের স্থানীয়স্তর সংগঠন ‘শাখায়’ যত বেশি সম্ভব নবীন বালকদের টেনে আনায় মননানিবেশ করেছিল এই সুস্পষ্ট নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে যে, সাংস্কৃতিক রূপান্তরকরণ গভীরতর হতে পারে যদি ক্যাডার বাহিনীকে নবীন বয়স থেকেই তার নিজস্ব চিন্তাধারায় দীক্ষিত করে তােলা যায়। ধাক্কা দেওয়ার মতাে বিষয় হলাে, আরএসএস এই সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করে যে, তাদের ‘শাখা’তে যােগ দিতে যে বালক আসবে, তাকে তার পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠদের আগাম সম্মতি আদায় করতে হবে এবং প্রতিদিনের কাজ তাঁদের জানাবে। তারা ধরেই নিয়েছিল যে, দেশে এমন অসংখ্য পরিবার আছে যারা তাদের পুত্রের এই সুযােগকে স্বাগত জানাবে এবং ক্রমে ক্রমে তারাও সংগঠনের সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে পড়বে। মনে হয় এই প্রথম পর্যায়ে আরএসএস সংস্কৃতির ব্যানার নিয়ে মােটামুটি স্বচ্ছ সুস্পষ্ট কার্যক্রম পরিচালিত করার সময় তারা নিজেদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতার আশ্রয়ে রাখতে চেয়েছিল। কংগ্রেস এবং কমিউনিস্টদের বিপ্রতীপে, আরএসএস বার বার ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পারস্পরিক সহযােগিতার প্রস্তাব করে এসেছে। স্বাধীনতার পর পরই এবং এমনকি গান্ধি হত্যার প্রেক্ষিতে অল্প কিছু দিন নিবিদ্ধ থাকার পরও, আরএসএস কংগ্রেসের সঙ্গে সহযােগিতার প্রস্তাব করেছিল কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে, যে কমিউনিস্টরা সংসদে স্বল্প সময়ের জন্য প্রধান বিরােধী দল হিসাবে উঠে এসেছিল। ১৯৩৬ সালে তারা প্রবল চাপের মুখে পড়ে প্রথম একটি ফ্রন্ট খােলে মহিলাদের জন্য – নিজেদের পুরুষ কেন্দ্রিক চরিত্র রক্ষা করতে – বিশেষভাবে উজ্জীবিত এবং স্পষ্ট সরব কিছু কিছু মহিলা চাইছিলেন নারীদেরও সদস্যপদ দেওয়া হােক। পুরুষােচিত ভ্রাতৃত্ব প্রদর্শনে সদস্যপদ নয়, আরএসএস ঘােষণা করে বলে, মহিলারা তাদের নিজেদের জন্য একটি সংগঠন (একটি সমিতি) রাখতে পারেন আরএসএস-এর তত্ত্বাবধানে। তারপর ১৯৪৮-৪৯ সালে, যে। সময়ে আরএসএস-ই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, ছাত্রফ্রন্ট খােলার এক অনুৎসায়ী তৎপরতা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগ মােটেই কার্যকরী হয়নি, এবং ছাত্রফ্রন্ট তারও এক দশক বাদে গতিশীল সংগঠন হয়ে ওঠে। আজকে জোরের সঙ্গে দাবি করা হচ্ছে ওই ছাত্রফ্রন্ট দেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন।
প্রকৃত বাঁকের মুহূর্ত আসে ১৯৫১ সালে, প্রথম সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে, যখন একটি নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্ট খােলা হলাে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য, সম্পূর্ণ নতুন একটি রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনস (বিজেএস) – যা ১৯৭৭ সালে ভেঙে দেওয়া। হয়েছিল এবং পুনঃজাগরিত হয়েছিল অনতিবিলম্বে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নামে। ভারতীয় জনসঙ্ঘ (বিজেএস) ৩টি আসন জিতেছিল ১৯৫১ সালে, কিন্তু ১৯৬৭ সালে মােট ভােটের ৯.৪১ শতাংশ পেয়ে নয় নয় করে ৩৫টি আসন লাভ করেছিল তার ছাতার তলে হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের বেশিরভাগকে ঐক্যবদ্ধ করে। ভারতীয় বুর্জোয়াজির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কংগ্রেসকে তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখে, কখনও কখনও অসন্তুষ্টি এবং তর্জনগর্জন প্রকাশ করলেও। সংখ্যালঘিষ্ঠ বিনিয়ােগকারী এবং ব্যবসাদার গােষ্ঠী যারা কংগ্রেসকে সমর্থন করত না, তারা কাজ করত স্বল্পস্থায়ী স্বতন্ত্র পার্টির মতাে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে। স্বয়ং আরএসএস-ই খুব বেশি বাড়তে পারেনি ১৯৪৮ সালে গান্ধি হত্যা থেকে ১৯৬৪ সালে নেহরুর মৃত্যু পর্যন্ত সময়ে। তখনও পর্যন্ত উপনিবেশবাদ বিরােধী আন্দোলনের মূল আলােকবর্তিকা হিসাবে কংগ্রেস ছিল প্রতিদ্বন্দ্বীহীন। তারপর আরএসএস-এর বৃদ্ধি হয়েছে ধারাবাহিকভাবে এবং কখনও কখনও দ্রুতগতিতে। যদিও কংগ্রেস দলের সেই সৌরভ। স্থায়ীত্ব পেয়েছিল ইন্দিরা গান্ধির জমানা পর্যন্ত, কিন্তু তা ভেঙে পড়ে কেবলমাত্র যখন তিনি নাগরিক অধিকার খর্ব করেন এবং দেশে ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করেন।
এরপর একে একে আসে অন্যান্য ফ্রন্ট। ১৯৫৫ সালে শ্রমিকশ্রেণির জন্য খােলা হয় ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ (বিএমএস), যা এখন ভারত -এর সর্ববৃহৎ একক কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন, যার সদস্য নাকি এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে এবং চার হাজারের বেশি ট্রেড ইউনিয়ন তার অ্যাফিলিয়েশন নিয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) আত্মপ্রকাশ করে ১৯৬৪ সালে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল হিন্দু সংস্কৃতি বিদেশে প্রচার করা। দুই দশক ছায়ার আড়ালে থাকার পর, ১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে নির্দিষ্ট ফ্রন্ট করে বেছে নেওয়া হয়েছিল ব্যাপক হিংসার মেশিনারি এবং কুৎসিত ‘আদর্শগত’ জিগির তােলার জন্য, যা পরবর্তী এক দশকে সারা দেশকে প্রবল ভাবে আলােড়িত করে এবং দিল্লিতে বিজেপি-কে ক্ষমতায় আনে ১৯৯৬ সালে প্রথমে ১৩দিনের জন্য এবং পরে ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত টানা ছ বছর। ব্যাপক ভিত্তিক কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্ব করার জন্য। বিজেপি নেতারা বারংবার দাবি করেছেন যে, ১৯৮৪ সালের বিচ্ছিন্ন প্রান্তিক সংখ্যালঘিষ্ঠ অবস্থা থেকে উত্থান ঘটিয়ে ১৯৯৮ সালে তাদের ক্ষমতা করায়ত্ত করার দক্ষতা লাভ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ঋণী। ব্যাপক গণ-সমাবেশ এবং নিরন্তর কর্মকাণ্ডের কাছে। যে কর্মকাণ্ড ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে এক বিশেষ তীব্রতায় পৌঁছে সম্পূর্ণতা পেয়েছিল চোখ ধাঁধানাে বাবরি মসজিদ। ধ্বংসের মধ্যে, যে বাবরি মসজিদ ভারত সরকারের এজেন্সির মাধ্যমে রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিমকোর্ট। অবশ্য ভারতীয় উদারতাবাদ কখনই এটা স্বীকার করে নেয়নি যে, আরএসএস এবং তার সহযােগীরা (affiliates) হিংসার বছরগুলি থেকেই অর্জন করেছে। এমন সম্পন্ন নির্বাচনী মুনাফা এবং এই বাস্তবতাও যে, এতগুলাে বৃহৎ এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনে যােগ দেয় যার অর্থ প্রজাতন্ত্রটির মৌল জমিনেই খুব মৌলিক কিছু পরিবর্তন ঘটে গেছে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মােদী, সেই দু’বছরে অন্যান্যরা যেমন দেখেছিলেন, তিনিও সেটা দেখেছিলেন : সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড, মুসলমান এবং খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের হত্যাকারী হিন্দু। হন্তারকদের ভাবমূর্তি নির্বাচন জয়ের জন্য বেশ ভালাে।
২০০২ সালে তাঁর নিজের ‘এথনিক ক্লিংসিং অভিযানের’ পর তিনি আর ফিরে তাকান নি। সেই হত্যাকাণ্ডর পরবর্তী সময়ে রাজ্য বিধানসভায় তিনি তাঁর গরিষ্ঠতা দৃঢ় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করেন। এরপর আরও দুটি রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন জিতে নেন এবং তারপর তাঁর নিজের দলকে সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনে চোখ-ধাঁধানাে বিজয় অর্জনে নেতৃত্ব করেন। – আইনি শাসনের এজেন্সিসমূহ এবং নাগরিক সমাজের মুখপত্রগুলির প্রত্যক্ষ পূর্ণ দৃষ্টির সামনেই আইনি-বেআইনি নির্বাচনী রাজনীতি এবং হিংসা সৃষ্টির উপাদানসমূহের সবকিছুকে মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়ে আরএসএস তার ফ্রন্টগুলিকে ভারতীয় রাজনীতির দাবার বাের্ডে বােড়ের মতাে খেলায়। এটা বরং বলা যায় বিখ্যাত সূত্রের অশুভ সংস্করণ : আধিপত্য = সম্মতি (consent) + বলপ্রয়ােগ (coercion)। এবং বল প্রয়ােগের এক নির্দিষ্ট ধরন . আগেও ছিল, পরেও থাকবে, তা হলাে : অল্প পরিমাণে প্রয়োেগ, শক্তভাবে মােকাবিলা, কোনাে গ্যাস উনুন নয়, সামান্য গুটি কয়েক ঝটিকা বাহিনী এখানে-ওখানে, আসছে-যাচ্ছে। এবং এক স্থায়ী আতঙ্ক সৃষ্টি যা স্থানীয় এলাকার গরিব মানুষের হৃদকম্প সৃষ্টি করবে। আর পাশাপাশি উদার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমূহ সচল থাকবে – নাগরিক স্বাধীনতার কোনাে আনুষ্ঠানিক স্থগিতকরণ প্রয়ােজন হবে না।
সমাজের বিভিন্ন স্তরের জন্য বিভিন্ন সময়ে খুব বিশেষ ধরনের ভূমিকা পালনের উপযােগী ভিন্ন ভিন্ন রকমের ফ্রন্টের এক দীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত করতে হবে, এটা লক্ষ্য করার জন্য যে, বুর্জোয়া আইনসিদ্ধতা এবং আনুগত্যের জন্য সংসদীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনানুগতা রক্ষার পাশাপাশি চরম দক্ষিণপন্থী দিক থেকে একটি বিপ্লবের জন্য প্রয়ােজনে হিংসা প্রয়ােগের চর্চা করা যায় কি না। দ্বিতীয় বিষয় হলাে, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং অনুগামী সংগঠনের (ফ্রন্ট, সমমনােভাবাপন্ন সংস্থার) সম্পর্ক প্রসঙ্গ। ভারত এ এটাই স্বাভাবিক যে, বৃহৎ রাজনৈতিক দলসমূহের সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের জন্য বিভিন্ন ধরনের ফ্রন্ট থাকবে : মহিলা, শ্রমজীবী মানুষ, কৃষক, ছাত্র ইত্যাদি।
কংগ্রেসের আছে, যেমন আছে সংসদীয় কমিউনিস্টদেরও। বিপ্রতীপে, এখানে অভিনবত্ব হলাে এই যে, আরএসএস একটি রাজনৈতিক দল নয় অথচ ফ্রন্ট খােলে এবং নিয়ন্ত্রণ করে এবং সংহতভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের সর্বপ্রেক্ষিতে হস্তক্ষেপ করে কিন্তু ফ্রন্টের মাধ্যমে যা করা হয় তার দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে না। খুব নিখুঁতভাবে বললে, বিজেপি ও একটি রাজনৈতিক দল নয় – একটি ফ্রন্ট মাত্র, কার্যত যার প্রায় সমস্ত মুখ্য নেতা এবং সংগঠকরা আরএসএস থেকে সংগৃহীত হন। সর্বোপরি, অন্যান্য ফ্রন্টগুলিও আরএসএস -এরই ফ্রন্ট মাত্র। আর আরএসএস একটি সংসদ বহির্ভূত অস্তিত্ব (extra parliamentary entity)। বিজেপি যেহেতু নিজেই একটি ফ্রন্ট মাত্র – ওই ফ্রন্টগুলির ওপর তার কোনাে নিয়ন্ত্রণ নেই। চতুর্থ অভিনবত্ব : এর কোনাে কিছুই গােপন নয় : যেহেতু সবকিছুই প্রকাশ্য এবং বার বার সংহতভাবে দলিলকৃত – উদার গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার এক স্বাভাবিক অংশ হিসাবে। আরএসএস ঠিক কি-করে না-করে তা উন্মােচন না করে বরং একটি আইনসিদ্ধ সংস্থা হিসাবে জনসমক্ষে তারা কতদূর পর্যন্ত কাজ করতে পারে তা নির্ণয় করতে আইন ও সাংবিধানিক জটিলতা সরিয়ে রাখা হয়েছে। স্বঘােষিত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসাবে আরএসএস রাজনৈতিক দল সমূহের যে দায়বদ্ধতা (accountability) প্রয়ােজন হয় তার থেকে ছাড় পেয়ে গেছে। গােপন কর্তৃত্ববাদী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে উদার নিরাপত্তার ব্যবস্থা। আরএসএস তার আশেপাশে যা-কিছু ছুঁড়ে দেয় তাতে দুটি দাবি সুস্পষ্ট, যেন সেগুলি অভিন্ন : আরএসএস জোরের সঙ্গে দাবি করে যে তারা একটি বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক সংগঠন, রাজনীতিতে জড়িত নয় এবং তাই রাজনৈতিক দলগুলির ওপর আরােপিত শর্তাবলী থেকে তারা ছাড়প্রাপ্ত, (যেমন এর সদস্য সংখ্যা প্রকাশ করা, বা সাধারণের নজরদারির (scrutiny) জন্য হিসাবপত্র রাখা।) একই সঙ্গে তারা দাবি করে যে, সব প্রেক্ষিতেই রাজনীতিকে গাইড করার অধিকার তাদের আছে কারণ, রাজনীতি কোনাে স্বনিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্র তাে নয়ই, হিন্দু সমাজে বরং তা ‘সাংস্কৃতি’র একটি অঙ্গন মাত্র, যেহেতু সাংস্কৃতিই জাতির ধর্মীয় অভিব্যক্তি বিজড়িত করে রাখে। দুটি দাবিই অবশ্য এক সঙ্গে খাপ খায় না। অকারণে তাে মুসােলিনি ঘােষণা করেননি যে, আমরা ফ্যাসিস্টরা চরম ব্যতিসঙ্গবাদী। (We fascists are super-relativists’)..
এবং সর্বশেষ, খুবই সুদূর অভিমুখী উদভাবন : শুধু ফ্রন্টের সংখ্যাই কত! নিশ্চয় তা শত শত ছাড়িয়ে গেছে, হাজার হাজারও হতে পারে। কেউ জানে না ঠিক কত। অ্যানথ্রপলজিকাল, সার্ভে অব ইন্ডিয়া অনুযায়ী ভারতীয় জনসংখ্যা হলাে হাজার হাজার সুস্পষ্ট সম্প্রদায়ের (Distinet Communities) সমষ্টি যা সমাজতাত্ত্বিকভাবে রীতিনীতি (custams) বাকধারা, বসবাসের এলাকা, রন্ধন প্রণালী, আধাত্মিক বিশ্বাস, জাত-উপজাত, পেশা ইত্যাদি যা কিছু ভাবতে পারা যায়, এমন সবকিছুতেই বিশেষায়িত। আরএসএস-ই ভারত এ একমাত্র সংগঠন যার এই বহু বৈচিত্র্যময়তার ভিত্তি যত বেশি সম্ভব তত, ফ্রন্ট গড়ার লক্ষ্যমাত্রা আছে। প্রকৃত পক্ষে তারা বেশি বেশি করে ফ্রন্ট সৃষ্টি করতেই তৎপর। এই অর্থে আরএসএস এক উজ্জ্বল চোখ-ধাঁধানোে মিশনারী সংগঠন এবং তার মিশন ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত এবং অবশ্যই রাজনৈতিক। আরএসএস-এর জন্য এই সমস্যার হৃদপিণ্ড হলাে এই যে, যদিও ‘হিন্দু’ শব্দটি সকলেই ব্যবহার করেন, যেন শব্দটি বলতে বােঝায় কোনাে এক সমসত্ত্ব ধর্মীয় সম্প্রদায়কে অথবা একটি ঐক্যবদ্ধ সামাজিক গােষ্ঠীকে, কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হলাে, এই সকল বৈচিত্র্যময়তা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রীতিনীতির বিপুল পার্থক্য সত্ত্বেও, বিরাজ করে খুব সুনির্দিষ্ট করে বললে ৮০ শতাংশ ভারতীয়র মধ্যে, যাদের হিন্দু বলে বিবেচনা করা হয়। এই বাস্তবতার বিপরীতে, হিন্দু বলতে তারা কী বলতে চায় সে সম্পর্কে আরএসএস-এর খুব সুস্পষ্ট ধারণা আছে, যা তার নিজস্ব মতবাদের ভিতের উপর ভিত্তি করে গড়া, অন্যান্য আনুগত্য এবং জীবনাচরণ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনাে ধর্মীয় ক্যাটাগরির মানুষ হিন্দু নন, তা হলাে সমগ্র জীবনধারা শৈশবের দোলনা থেকে শেষকৃত্যের চিতা পর্যন্ত। তারা নিশ্চিত করতে চায় যে, তারা যে আদর্শ ধরন আবিষ্কার করেছে তা যেন ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রে সাধারণ মান হয়ে ওঠে। এই সমুদ্রসম বিশাল বৈচিত্র্যময়তা থেকে সাংস্কৃতিক আধিপত্য তৈরি করার জন্য তার দায়বদ্ধতা এবং সেই সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষায় ভাষান্তরিত করার অর্থ হলাে একই সঙ্গে তারা চার্চ এবং রাষ্ট্র হয়ে উঠতে চায়।
সেই লক্ষ্য ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিকতার বিরুদ্ধে এবং তার কর্তৃত্ববাদী সুনির্দিষ্ট উপাদানের জন্য তার লড়াই-এর হৃদকেন্দ্রে বিরাজমান। সেটা এতাে সুসংহত একটি সভ্যতা বিস্তারি প্রকল্প; তা যে সম্পূর্ণভাবে সফল হবে, তা অসম্ভব বলে মনে হয়। এটা যদিও এক দুঃসাহসিক। তৎপরতাও, এবং এখন পর্যন্ত অর্জিত সাফল্য আংশিক, তবু তার প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
[৫]
ভারত -এর স্বাধীনতা উত্তরকালের ইতিহাস মােটামুটি তিনটি পর্বে বিভাজিত করে অনুধাবন করা যায়। প্রথম পর্ব স্থায়ী হয়েছিল ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। এই পর্বটি নেহরুর চারটি মূলনীতিবােধ দ্বারা চিহ্নিত করা যায় :
- (১) ধর্মনিরপেক্ষতা
- (2) গণতন্ত্র
- (৩) সমাজতন্ত্র এবং
- (৪) জোট নিরপেক্ষতা।
কার্যক্ষেত্রে প্রয়ােগ সব সময় নীতিবাক্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ থাকত না এবং তার ছাঁদগুলাে ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছিল। বিশেষত, ভারত-চীন যুদ্ধ (১৯৬২) এর পর থেকে। এর অল্প পরেই নেহরুজীর মৃত্যুও হয়। তবুও কিছু পরিমাণে উদার বাম আধিপত্য তখনও টিকে ছিল এবং ধীরে ধীরে তা ক্ষয়ে আসে। ঘটনাচক্রে, মধ্য-সত্তরের দশকে ইন্দিরা গান্ধির নাগরিক অধিকার খর্ব করে জরুরি অবস্থা জারি করার প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণপন্থী জনপ্রিয় তীব্র আন্দোলনের সময়ে জমে-থাকা সংকটসমূহ সামনে চলে আসে।
প্রথম পর্বর সমাপ্তি এবংদ্বিতীয় পর্বের শুরু এসে মিলিত হয় সেই আন্দোলনের ব্যাপক দ্বিধা-জড়তায়, যে আন্দোলনে নেতৃত্ব করেছিলেন এক প্রবীণ কংগ্রেসী এবং নেহেরুর একদা বন্ধু জয়প্রকাশ নারায়ণ, যিনি তখন আরএসএস -এর সঙ্গে সমস্ত দক্ষিণপন্থী শক্তির সুদূর স্পর্শী অ্যালায়েন্সের পাশাপাশি যুব সমাজকে সম্পূর্ণ বিপ্লব’ (Total Revolution) স্লোগানের তলায় সমবেত করে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা এজেন্সিসমূহসহ সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। জরুরি অবস্থা বিরােধী আন্দোলনের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়ায় আরএসএস -এর হাজার হাজার ক্যাডার। যখন ভারতীয় জনসঙ্ঘর সংসদীয় আসন ১৯৬৭ সালের ৩৫ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭৭ সালে ৯৪ হয়। আরএসএস-এর দুই প্রবীণ সদস্য বাজপেয়ী এবং আদবানি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীপদে উঠে আসেন। জরুরি অবস্থা বিরােধী আন্দোলন, যা দেশে প্রথম অকংগ্রেসী সরকার প্রতিষ্ঠার অভিমুখে এগিয়ে নিয়ে যায় – সেই পরিণতি এখনও পর্যন্ত অকংগ্রেসী উদার মহলে উদযাপিত হয় একটি আন্দোলন হিসাবে, সেখানে ভারতীয় গণতন্ত্রর বলিষ্ঠতা ইন্দিরা গান্ধির স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতাকে ছাপিয়ে উঠতে পেরেছিল। শুধু তাই নয়, সেটাই ছিল সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া যা ভারতীয় রাজনীতিতে একটি সম্মাননীয় আইন সিদ্ধ শক্তি করে তােলে আরএসএস -কে এবং তার রাজনৈতিক ফ্রন্টকে। এই প্রথম সরকারে এক তাৎপর্য পূর্ণ জায়গা করে নিতে সাহায্য করে। আমি এখানে আরও একটু যােগ করতে চাই যে, ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে অর্থাৎ জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের পরবর্তী পাঁচ বছরে আরএসএস -এর অতি দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটেছিল, যা ছিল স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের রক্ষক হিসাবে তার নতুন খ্যাতির অর্জন।
মােটের ওপর, যদিও সেই শক্তিও ভেঙে টুকরাে হয়ে গিয়েছিল তার নিজস্ব দ্বন্দ্বের ফলে, এবং ভারত এ বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামােয় তুলনামূলক রাজনৈতিক সংকটের পর্ব চলতে থাকে, যেখানে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন আগেকার ক্ষমতাগােষ্ঠী (Power block) আর স্থায়ী শাসন দিতে সমর্থ ছিল না, কিন্তু অন্য কোনাে বিকল্প শক্তিও তাকে প্রতিস্থাপন করার জন্য আত্মপ্রকাশ করেনি। সেই সংকট দু-দশকেরও বেশি চলতে থাকে, অবশেষে সমাপ্ত হয় সম্পূর্ণভাবে ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয় বিজেপি পরিচালিত সরকারের আবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে (বিজেপি-র নেতৃত্বে পরিচালিত প্রথম সরকার-এর ১৯৯৬ সালে পতন হয়েছিল ১৩ দিনের মাথায়)। কংগ্রেস সরকারের নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি সমূহ দশ বছর আগে উদবােধিত হয়েছিল, ততদিনে তা শিকড় প্রােথিত করেছিল। নতুন উদার নীতি সমূহ এক নতুন পর্ব সূচনা করে সেখানে সমস্ত অবাম দল সমূহের – কংগ্রেস থেকে বিজেপি পর্যন্ত – ক্ষমতা গােষ্ঠী ব্যাপকভাবে পুনর্গঠিত হয় এবং ভারত এ বুর্জোয়া শাসনকে নতুন স্থায়ীত্ব দেয়, সেই-সব দলের কোনাে কোয়ালিশন কখনও কোনাে নির্বাচনে জয়ী হয়ে এলাে সে সব ব্যতিরেকে। নির্ণায়ক বাঁকের মুহূর্ত, অবশ্যই, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে আগেই এসেছিল, ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সময় সীমায় সেই ঘটনাবহুল তিনটি বছর।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, সেই বছরগুলি সাক্ষী থেকেছিল সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ পূর্ব ইউরােপে সাধারণভাবে, কমিউনিজমের ঐতিহাসিক ভেঙে পড়া এবং আমেরিকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্ব আধিপত্যের দাবিদার হয়ে ওঠা এবং সমগ্র ভারতীয় শাসকশ্রেণির ও তার রাষ্ট্র কাঠামাের প্রকাশ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে সুপার পাওয়ারের পেছনে কোনােরকম অভ্যন্তরীণ বিরােধ ছাড়াই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াননা। দেশের অভ্যন্তরে, সেই একই বছরগুলিতে, রাওমনমােহন তথাকথিত পুনর্গঠনের হাত ধরে নয়া উদারনীতি যুগের আবির্ভাব এবং কংগ্রেস ও ভিএইচপি-র মধ্যে ১৯৮৯ সালে শিলন্যাসের সময় গােপন বােঝাপড়া এবং আরও বেশি নাটকীয়ভাবে ১৯৯২ সালে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস যার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সাম্প্রদায়িকীকরণের সেই নির্ণায়ক বাঁক এর সাক্ষী হয়েছিল। পরিস্থিতি কয়েক বছরের জন্য অবশ্য খুবই অস্থির ছিল।
১৯৯৮ সালের মধ্যেই নয়া উদারতাবাদ হয়ে ওঠে সম্পদশালী শ্রেণি এবং জাতীয় জীবনের বিভিন্ন আঙিনায় তাদের প্রতিনিধিত্বকারীদের এক ঐক্যমত্য অবস্থান (consensual position)। এই সময়ে চরম দক্ষিণপন্থীরা দ্রুত বিকাশ লাভ করে এবং তারা একত্ৰীকৃত নতুন পাওয়া ক্ষমতা সংহত করতে শুরু করে। নব্বই দশকের শুরুর দিকের দিনগুলির চরম হিংসা আর তেমন প্রয়ােজন ছিল না। বরং অনেক বেশি জরুরি ছিল বিজেপি-কে মৃদুভাবে উদার মুখ দেওয়া, যাতে তাদের বুর্জোয়া শাসনের কংগ্রেসের একটি বিকল্প দল। হিসাবে গ্রহণীয় করে তােলা যায়। তারা ১৯৯৮ সালে যে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল তা ছ’বছর স্থায়ী হওয়ার পর দশ বছরের জন্য কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার এসেছিল, যার পরিসমাপ্তি ঘটে ২০১৪ সালের সংসদে দৃঢ় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি-র ফিরে আসার মধ্যে দিয়ে। লক্ষণীয়ভাবে, সরকারের এই পরিবর্তনগুলি নজর করার মতাে কোনাে নীতিগত পরিবর্তন ঘটায়নি। এই অর্থে ভারত পরিপক্ক (matured) উদার গণতন্ত্রের দেশ হয়ে উঠেছে নয়া উদারনীতির যুগে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (USA), যেমন যুক্ত রাজ্য (United Kingdam) – যেখানে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল অথবা দল সমূহের কোয়ালিশন,কাজ করে যেন, সামগ্রিক বুর্জোয়াদের ম্যানেজিং কমিটির এক একটা গােষ্ঠীর বা খণ্ডাংশের মতাে। এই নতুন ঐকমত্যতার পেছনে আছে ভারতীয় শাসকশ্রেণির হৃদ কেন্দ্রে বহির্বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে নিবিড় ঘনিষ্ঠতার সমঝােতা এবং আভ্যন্তরীণক্ষেত্রে নয়া উদার নীতি প্রবর্তন।
পিছনের দিকে তাকিয়ে কেউ এমনও বলতে পারেন যে, নয়া উদারবাদী অর্থনীতি প্রবর্তন করা খুব প্রয়ােজনীয় মুহূর্ত ছিল শাসকশ্রেণির বিভিন্ন গােষ্ঠীর জন্য অর্থাৎ বিভিন্ন যে রাজনৈতিক দলগুলি পুঁজিপতিদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে জাতীয় এবং আঞ্চলিক স্তরে, ঐক্যের দৃঢ় ভিত্তি অর্জন করে পরিবর্তিত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে মার্কিন পুঁজির সঙ্গে একটি নতুন ধরনের সমঝােতা গড়ে তুলতে। এইসব দল এখন পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযােগিতা করে ক্ষমতার অন্ন ভােগ করার জন্য; নীতিগত বা এমনকি মতাদর্শগত কারণেও নয়। এই নয়া উদারবাদী নীতি হলাে, যাকে বলা যেতে পারে, চরম পুঁজিবাদী নীতি, এবং এখন পর্যন্ত এই নীতির পরিণতি একইরকম হয়েছে; ভারতে উচ্চ বৃদ্ধি হার এবং ইউরােপীয় ইউনিয়নে (UE) নিম্নহার বৃদ্ধি। এই শ্রেণিগত ঐকমত্যতার ধর্মনিরপেক্ষ মুখ হিসাবে কাজ করে কংগ্রেস দল, আর বিজেপি করে এর সাম্প্রদায়িক মুখ হিসাবে, যদিও কংগ্রেস তার নিজস্ব বাস্তববাদী কৌশলে সাম্প্রদায়িকতাকে বেশ দক্ষভাবে ততটাই ব্যবহার করতে জানে, যতটা বিজেপি মাঝে মাঝে আগ্রহী হয়ে ওঠে তার কর্মসূচির প্ররােচনামূলক প্রেক্ষিত স্থগিত রাখতে, যাতে ব্যাপকভিত্তিক কোয়ালিশনের ক্ষমতার শীর্ষদেশে তারা অবস্থান করতে পারে। সেই জন্যই, মােদী তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের দৌড়ে নেমে রক্ত ঝরানাে হিন্দুত্বের বাগাড়ম্বরপূর্ণ বুলি আউরাননি অথচ এটাই তাঁকে প্রথমে ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছে দিয়েছিল। তিনি বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভাষণে ক্রমাগত বৃদ্ধি (Growth) এবং উন্নয়ন (Development)-এর কথা বলেছেন, যা বিজেপি কংগ্রেসের সঙ্গে শেয়ার করে। যথেষ্ট ন্যায়বিচার করে কংগ্রেস বলে, তার নিজের নীতিসমূহ-ই এখন বিজেপি রূপায়ণ করছে। মােদীই একমাত্র সব কর্পোরেট পুঁজির অনন্য প্রার্থী ছিলেন না। ঘটনা হলাে এই যে, শুধুমাত্র তিনিই অনেক বেশি খুল্লামখুল্লাভাবে অনেকবেশি শীর্ষস্থানীয় সিইও-দের তাঁর পেছনে সমবেত করেছিলেন। কংগ্রেস দলে তাঁর স্তরের নেতারা (Counterparts) তা কখনও পারেননি, এমনকি যখন তাঁরা যে চেষ্টাও করেছিলেন।
এমন নয় যে, যথা সময়ে হিংসার ব্যবহার কৌশল হিসাবে অপরিহার্যতা হারিয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু কিছু মানুষ হত্যা করা খুবই সাধারণ একটি বিষয়, কোথাও এক খ্রিস্টান দম্পতি, আবার কোথাওবা পাঁচ-দশজন মুসলমান হত্যা, চোখ-ধাঁধানাে নয়, খুব লঘুমাত্রার (Low intensity) এবং রুটিনমাফিক ব্যাপার-উদার ধর্মনিরপেক্ষ, গভীরভাবে গণতান্ত্রিক ভারত -এর ভাবমূর্তি এতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতাে নয়। দেশে এখন আর তাৎপর্যবাহী একটিও রাজনৈতিক দল নেই, ব্যতিক্রমী বামপন্থী কমিউনিস্টরা ছাড়া, ১৯৯৬ সাল থেকে (বিশেষত ১৯৯৮ থেকে) কোনাে-না-কোনাে সময়ে যে বিজেপি-র সঙ্গ নেয়নি। ২০০২ সালে গুজরাটে জনজাতি গণহত্যার (Ethnic Cleanings) সময় সংসদের ভিতরে অনেকগুলি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সংসদে এ বিষয়ে আলােচনা আটকাতে। এমনকি কংগ্রেস দলও প্রয়ােজনের সময় মিলেমিশে গাঘেষে, তবে খুব নিঃশব্দে, খােলাখুলিভাবে নয়, যেহেতু তারা আর যাইহােক, মূল নির্বাচনী প্রতিপক্ষ তো। জনচেতনাকে ক্রমবর্ধমানভাবে সাম্প্রদায়িকীকরণ দু’দিক থেকে অগ্রসর হতে পারে। অবশ্যই আরএসএস-এর গণভিত্তিক কর্মকাণ্ড আছে, যা গত আশি বছরেরও বেশি সময়ে বেশি বেশি সংলগ্নতা অর্জন করেছে। গ্রামসি যাকে বলছেন, সমাজের মূল ভিতে গণচেতনার গুণমানে অতি অকিঞ্চিত্বর পরমাণুর আকৃতির ক্ষুদ্র আলােড়ন যা নতুন সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান সৃষ্টি করে। উদারতাবাদীদের গরিষ্ঠ অংশ এখন আর জানেনই না, তারা নিজেরা কত পরিমাণে সাম্প্রদায়িক নয়াউদারবাদী দক্ষিণপন্থীদের দিকে সরে এসেছেন। এখন, বেশ কয়েকবছর যাবদ, চলছে এই একই সরে যাওয়া। রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দলসমূহ, শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান, পীড়ন যন্ত্র, এমনকি কখনও কখনও বিচারমহলের দিক থেকেও এই সরে আসা ঘটতে পারে। ভারত যেহেতু ক্রমবর্ধমানভাবে একটি জাতীয় নিরাপত্তা রাষ্ট্র হয়ে উঠছে, আগ্রাসী পেশিবহুল দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদ সমাজের আরও গভীরে প্রবেশ করতে বাধ্য।
[৬]
কোথায় কীভাবে, তাহলে এগুলি ফ্যাসিবাদের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে? আমার উল্লেখ করতেই হবে যে, ১৯৯২ সালের চোখ-ধাঁধানাে ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে, বর্তমান লেখকই সর্বপ্রথম সংহতভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, প্রথমে কলকাতায় এক দীর্ঘ ভাষণে এবং তারপর হায়দরাবাদে আর একটি সমান দীর্ঘ ভাষণে। ১৪ আরও অনেক উল্লেখযােগ্য স্কলার, বিশেষত সুমিত সরকার এবং প্রভাত পট্টনায়েকও একইরকম মতপ্রকাশ করেছিলেন। বামমহলে মােটামুটিভাবে এই চিন্তা দানা বেঁধেছিল যে, আরএসএস এবং তার অনুমােদিত সংগঠনসমূহ এবং সহযােগী বন্ধুরা সুস্পষ্টভাবে নাজি/ফ্যাসিস্ট মত দ্বারা প্রভাবিত, তাদের সূচনার সময় থেকেই। তাঁদের অনেক ভাবনা এবং নীতি তাঁদের নিজেদের সংগঠনে এবং জীবনাচরণে এসেছে। তাঁদের অনেকগুলি সাম্প্রতিক রণকৌশল এবং প্রয়ােগ ধারা নিশ্চিতভাবেই ফ্যাসিবাদী। একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে সি পি আই(এম), এ সংক্রান্ত নানা ছড়ানাে বিষয়ে বিতর্কে জড়িয়ে যায়। এমনকি সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ’ শব্দ যুগলও তারা গ্রহণ করে নেয়, তার ভেতর ফ্যাসিবাদী উপাদান কিছু মাত্রায় বিরাজমান এবং সেই উপাদানে যে ভারতীয় মােচড় চমৎকারভাবে বিধৃত রয়েছে তা নির্দিষ্ট করে নিতে। আমি আরও যুক্তি দিয়েছিলাম যে, যে ধরনের রাজনীতিকে আমরা মােটামুটিভাবে এবং কোনাে কোনাে সময় মােটা দাগে ফ্যাসিজম বলে চিহ্নিত করি, তা সমগ্র সাম্রাজ্যবাদী কালের বিশেষ বৈশিষ্ট্যমাত্র। ফরাসি ‘অবিচ্ছেদ্য জাতীয়তাবাদকে’ (Integral Nationalism) কখনও কখনও ফ্যাসিবাদের উৎস রূপ-এর কৃতিত্ব অযথা দেওয়া হয় না, যা উদ্ভূত হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে। বা লেনিনের জার্মান এবং ইতালির অভিজ্ঞতা আমাদের হাতে আছে এমন কথা যতক্ষণ কেউ না বলছেন, আরএসএস -কে এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে তুলনা করাটাই যথার্থভাবে বিধিসম্মত। সেই বিশেষ ধরনটি ব্যাপকভাবে ছড়ানাে, এমনকি সমকালীন ইউরােপের মধ্যেই গ্রিস থেকে ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়া থেকে ইউক্রেন পর্যন্ত বিস্তৃত। আমি দ্বিধাহীনভাবে আরও তর্ক জুড়েছিলাম, প্রত্যেক দেশই তার ইতিহাস, সমাজ এবং রাজনীতির বাস্তবতা অনুযায়ী (গ্রামসির এক অতিপ্রিয় রূপকল্প) প্রাপ্য ফ্যাসিবাদ পায়। এর সঙ্গে আমি এখানে আরও একটু যােগ করব; যে ঐতিহাসিক পর্যায় দেশটি অতিক্রম করছে তার ওপরও নির্ভর করে। অন্যভাবে বলা যায়, আমাদের বুঝতে হবে যে, ফ্যাসিবাদী ধরনের প্রত্যেক সফল আন্দোলন মাত্রই অতীতে ঘটে-যাওয়া কোনাে আন্দোলনের প্রতিরূপ নয় তা, বরং যে পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এই আন্দোলন বিকশিত হচ্ছে, তার মৌলিকত্বটাই দেখায়। ‘এখানে এবং এখনই’-এর বাস্তবতা থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকার কোনাে সুযােগ নেই। সমস্তরকম পুনরুত্থানবাদই আসলে অতীতের সমকালীন পুনর্লিখন। একেবারে একটি র্যাডিকাল আধুনিক নয়া ঐতিহ্যবাদীতা। ফ্যাসিস্ট ধরনের সবগুলি সমকালীন রাজনৈতিক দলই তাদের জাতীয় বিষাদে সাড়া দেয় এবং বৃহত্তর বাস্তবতা হলাে, সামান্য কিছু তুলনামূলকভাবে ব্যতিক্রম বাদে, বিশ্বজুড়ে শ্রমিকশ্রেণি নেতিয়ে পড়েছে, পুঁজি সংগঠনের নয়া উদারতাবাদী সাফল্যের তীব্র কষাঘাতে। রাজনৈতিক উদারবাদীরা নিজেরাই এই চরম পুঁজিবাদে শান্তি খুঁজে নিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে নজর রাখাে, নাজিরা আসছে জুজু দেখানাের অবস্থান গ্রহণই যথাযথ পদক্ষেপ নয়। ষাটের দশকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি পদের জন্য গােল্ডওয়াটার-এর তৎপরতার সময় যা কালেকটিং উপস্থাপন করেছিলেন সেটাই মূল কথা : ফ্যাসিজম কেমন চেহারা নেবে, যদি তা আসে গণতান্ত্রিক শিল্পসম্পন্ন কোনাে দেশে, যেখানে এর বিরােধিতা করার জন্য শক্তিশালী কোনাে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন নেই? এটাই হলাে সাধারণ জিজ্ঞাসা। আমার মনে হয়, আজকের ভারত এ বিশেষভাবে এটা প্রযােজ্য : চরম দক্ষিণপন্থীদের উদার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বহিরঙ্গের কোনাে পরিবর্তন ঘটানাের প্রয়ােজন নেই, কারণ এইসব প্রতিষ্ঠানসমূহকে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মীবাহিনী দ্বারাই অধিগ্রহণ করে নেওয়া যাবে। তা ছাড়াও অন্যান্য আর সকলের অধিকাংশই এর সহযােগী হতে আগ্রহী হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত বৃহদাগার হিংসার ঘটনাবলী ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত থাকে এবং আরও ঘন ঘন লঘুমাত্রার হিংসা সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে রাখা যাবে একচেটিয়া গণমাধ্যমের সঙ্গে উদারতাবাদ ও চরম দক্ষিণপন্থার বােঝাপড়ার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে। কমিউনিস্টরাও ইতিমধ্যেই অতি ক্ষুদ্র এমন এক শক্তিতে পরিণত হয়েছে যা বেআইনি ঘােষণার জন্য বিবেচনারও উপযুক্ত নয়। অবশ্য ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের প্রসঙ্গ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে যথেষ্টভাবে, যদি একটি শক্তিশালী সমাজবাদী (Socialist) আন্দোলন পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা যায়। নতুন কোনাে আঙিনায় বা কৌশলগত প্রেক্ষিতে যাই হােক না কেন, যা এখন পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও পুনর্নির্মাণের জন্য প্রয়ােজন হতে পারে।
প্রসঙ্গকথা
- ১. রাজনৈতিকভাবে চরম দক্ষিণপন্থী হিন্দু মতাদর্শের প্রতিষ্ঠাতা ভি ডি সাভারকর তাঁর নিজস্ব মতাদর্শকে হিন্দুবাদী ধর্মীয় কাঠামাে থেকে সুস্পষ্টভাবে সরিয়ে রাখার জন্য ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি চয়ন করেছিলেন। তিনি ইংরাজিতে হিন্দুত্বকে অনুবাদ করেছিলেন কখনও ‘Hinduness’ কখনও ‘হিন্দু ন্যাশনালিজম’। তাই ‘হিন্দুত্ব’ বা ‘হিন্দু ন্যাশলালিজম’ শব্দগুলি এই নিবন্ধে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সাভারকরও তাঁর উত্তরসুরী এবং অনুগামীদের রাজনৈতিক মতাদর্শ বােঝাতে। এছাড়াও অচিন ভিনায়ক কৃত পর্যালােচনা India’s Landmark Election লিও প্যানিৎস, এবং গ্রেগ এলবাে (Leo Panitch & Greg Albo edited) সম্পাদিত, Socialist Register 2015 Casa (Transforming classes, London Martin Press, 2014)
- ৩. ইতিহাসবিদ বিপান চন্দ্র একসময় সাম্প্রদায়িকতা বা Communalism সঙজায়িত করেছিলেন এইভাবে : সাম্প্রদায়িকতা এমন এক মতাদর্শ যা প্রচার করে যে, কোনাে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যরাও একটি সুস্পষ্ট জাতীয় সম্প্রদায় (National Community) গঠন করে, যা যুক্তিসঙ্গতভাবে এই অনুমানের দিকে নিয়ে যায় যে, এই সাম্প্রদায়িক জাতিরও অবশ্যই তাদের নিজস্ব একটি রাষ্ট্র থাকবে। সেই রাষ্ট্র এমন হবে যে, সেখানে অন্য সম্প্রদায়ও থাকতে পারবে কিন্তু কেবলমাত্র অতিথি হিসাবে, বিদেশি হিসাবে বা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে। এটা আরএসএস এবং তার সহযােগীদের গােপন মতাদর্শের একটি অকপট প্রতিচ্ছবি।
- ৪. মােদির উত্থান এবং তাঁর কর্পোরেট দুনিয়ার ব্যাপক সমর্থন প্রসঙ্গে বিনােদ কে জোস-এর প্রবন্ধ ‘The emperor un crowred : The rise of Narendra Modi’ [CARAVAN Magazine, March 2012] একটি অপরিহার্য প্রবন্ধ।
- ৫. অন্যান্য আরও অনেক এরকম প্রকাশনায় আমি এইসব বিষয়ে বৃহৎ আকারে তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে এবং সুবিস্তৃত দৃষ্টান্তসহ আলােকপাত করেছি। দেখুন; On the ruins of Ayodhya: Communalist offensive and recovery of the seculars : Social Scientist, 21(7/8), 1993; In the Eye of the storm : The Left chooses, Economic and Political Weekly, 31(22), 1 June 1996 4978 Tryst with Destiny: Free and devided, The Hindu, August 1997 –এই প্রবন্ধ তিনটি কিছু কিছু পরিমার্জনার পর আমার ‘Lineage of the present : Ideology and Politics in contemporary South Asia’, গ্রন্থটিতে সংকলিত করা হয়েছে।
- প্রাসঙ্গিক প্রকাশনার মধ্যে আছে : Fascism and National Culture : Reading Gramsci in the days of Hindutya, Social Scientist 21 (314), 1993 : Indian Politics at the cross roads, Towards Election 2004, in Mushir Ul Hassan, ed vill Secular India Servive’ Delhi : Monohar 2004; 472 ‘Communalism : Changing Forms and Fortunes’: The Marxist 29 (2), 2013
- ৬. একটা উপাদেয় কৌতুককর পরিহাস লক্ষ্য করা যায় এই ঘটনায় যে, আরএসএস সােৎসাহে তাদের সংগঠন কেবলমাত্র পুরুষদেরই সদস্য হিসাবে গ্রহণ করা হয় বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও, তার সবকটি ফ্রন্ট-ই তাকে ‘মা’ (Mother) বলে উল্লেখ করে এবং তারা বিশ্বাস করে এই মায়ের গর্ভ থেকেই তাদের সকলের জন্ম যা সঙ্ঘ পরিবার বলে চিহ্নিত হয়।
- ৭. আরএসএস -এর পৌরুষকেন্দ্রিক সংগঠনের সুবিধাগুলি তার প্রধান একটি ফ্রন্ট – বিশ্ব হিন্দু পরিষদকেও পুনরাবৃত্তি করতে দেখা যায়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে আরএসএস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামার কাজে ব্যবহার করে সময় সময়। ১৯৯১ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তার নিজের ছত্রছায়ায় মহিলাদের জন্য আলাদা একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছে-দুর্গা বাহিনী, যে সংগঠন প্রায়ই তরুণীদের সাধারণ বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে দীক্ষিত করে তাদের, এবং যুদ্ধকৌশল প্রশিক্ষণ দেয়। এই সংগঠনের মহিলারা সংখ্যালঘুদের ওপর হিংসাত্মক অভিযানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল বলে জানা যায়। ঘটনাগুলি প্রকল্প মাফিক যা ভারত এ তুলনীয়ভাবে সাদামাটা শিরােনাম ‘দাঙ্গা’ বলে চলছে।
- ৮. এখানে বিশেষ জোরের সঙ্গে উল্লেখ করা উচিত যে, আরএসএস-এর ফ্রন্ট এইগুলি অর্জন করেছে কমিউনিস্টদের ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে দুরমুশ করার মধ্য দিয়ে নয়, বরং উদার গণতান্ত্রিক কাঠামাের অভ্যন্তরেই তাদের সঙ্গে সহ অবস্থান করে। কমিউনিস্টদের ট্রেড ইউনিয়নসমূহ এবং আরএসএস -এর সংগঠন অদ্ভুতভাবে জাতীয় স্তরে শ্রমিকদের সংগঠিত প্রতিবাদে সহযােগিতাও করে থাকে। এখানে ফ্যাসিস্ট মডেল নেই।
- ৯. কেবলমাত্র দোলনা থেকে না, প্রকৃতপক্ষে ভ্রুণ থেকেই। যেমন এম এস গােলওয়ালকার, আরএসএস -এর দ্বিতীয় সরসঞ্চালক (সুপ্রিম গাইড) তাঁর Bunch of Thoughts (বাঙ্গালাের, সাহিত্য সিন্ধু প্রকাশন, ১৯৯৬) গ্রন্থে বলেছেন: “আজকের দিনের কিছু কিছু বুদ্ধিমান বা চালাক মানুষ আমাদের বলেন যে, কোনাে মানুষই হিন্দু বা মুসলমান বা খ্রিস্টান হিসাবে জন্মায় না, জন্মায় একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে। বস্তুত আমরা আমাদের মাতৃগর্ভ থেকে আত্মপ্রকাশ করার আগে থেকেই হিন্দু। আমরা তাই জন্মাই হিন্দু হিসাবে। অন্যান্যরাও এই জগতে আসে একজন সরল অনামী মানব সন্তান হিসাবে এবং পরবর্তীতে পরিবেশের জন্য বা দীক্ষিত হওয়ার জন্য একজন মুসলমান বা একজন খ্রিস্টান হয়।”
- ১০. এমন কী যারা আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দু বলে অভিহিত হন তাঁদেরও এই সমসত্ত্বতা উপলব্ধি করার পথে প্রধান বাধা ‘জাত’ ব্যবস্থা। সকলের জন্য প্রযােজ্য এমন সুশৃংখল সমভাগী হিন্দুত্বকে অতি অবশ্যই জাতপাতহীন (casteless) হতে হবে, কিন্তু তা কাঠামােগতভাবেই অসম্ভব। প্রাচীন ভারত -এর বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ সুভিরা জয়সওয়াল যুক্তি বিন্যস্ত করে লিখেছেন : হিন্দুত্ববাদ আদর্শগতভাবে এত নমনীয় এবং সূক্ষ্মভাবে বিকেন্দ্রীত কারণ তার দাঢ্যতা বিরাজ করে বিশ্বাস ব্যবস্থার অনমনীয়তায় বা গোঁড়ামিতে নয়। বরং হিন্দু সমাজের কেন্দ্রীকতায় অর্থাৎ ব্যবহারিক প্রয়ােগের ক্ষেত্রে। আরএসএস এই প্রশ্নে কালাপাহাড় হয়ে উঠতে পারে কিন্তু জাত ব্যবস্থার বিলুপ্তিকরণের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না।
- ১১. আমাদের প্রজাতন্ত্রের প্রথম দিককার বছরগুলিতে উদারতাবাদী বামপন্থীদের সংসদে আধিপত্য লক্ষ্য করা যাবে এই তথ্য থেকেই যে, নেহরুর নিজের সরকারে কংগ্রেসবামপন্থীদের আধিপত্য ছিল শুধু নয়, অনেকদিন পর্যন্ত সংসদে সি পি আই সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বিরােধী শক্তি ছিল।
- ১২. জে পি (জয়প্রকাশ)-আরএসএস নেতৃত্বাধীন জনপ্রিয় দক্ষিণপন্থী আন্দোলন এবং স্বল্পস্থায়ী জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধির শােচনীয় ভ্রান্ত কর্তৃত্ববাদী শাসনের সংঘর্ষের দিনগুলিতে দুই প্রধান কমিউনিস্ট পার্টির বিপরীত ধর্মী অবস্থান গ্রহণের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল। সিপিআই জরুরি অবস্থা সমর্থন করেছিল এবং সি পি আই। (এম) জনপ্রিয় দক্ষিণপন্থী জরুরি অবস্থা বিরােধী আন্দোলনে যােগ দিয়েছিল (অবশ্য তাদের নিজস্ব যুক্তির জন্য)।
- ১৩. সেই-সব ঘটনাবলির বিস্তারিত বিশ্লেষণের জন্য দেখুন আমার ‘On the ruins of Ayodhya’।
- ১৪. পরবর্তীকালে পরপর প্রকাশিত হয়েছিল ‘Fascism and National Culture’ এবং ‘On the ruins of Ayodhya’ ।
- ১৫. মিচেল কালেকি (Michel.Kalecki) ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধে এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। The Fascism of our time’ পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল তাঁর The last phase in the transformation of capitalism, New York’ Monthly Review Press, 1972।
- ১৬. সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলিতে, যেমন লক্ষ্যণীয় এখনকার গ্রিস। মৌলিক ধরনের একটি ফ্যাসিস্ট আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে সুক্ষ্মভাবে কারণ হিসাবে বলা যায় একটি বামপন্থী সম্ভাব্যতা হাতের কাছেই বিরাজ করছে।
- [‘দি পলিটিক্স অফ দি রাইট’ সােশালিস্ট রেজিস্টার ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত ইংরাজি নিবন্ধের অনুবাদ।]
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।