লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
রহস্য উদ্ঘাটন পন্থী খ্রিস্টান মৌলবাদীরা ‘বাইবেল সংক্রান্ত কারণে’ আরও ব্যপকভাবে ফিলিস্তিন–ইজরাইল সংঘাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। [Apocalypse = ‘Revelation’ = ‘রহস্যউদ্ঘাটন’ নামক বাইবেলের শেষ পুস্তক]
বাইবেলের শেষ অধ্যায় ‘রহস্যউদ্ঘাটন’-কে বহু খ্রিস্টান আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেন এবং ‘যিশু খিস্টের পুনরাগমন’ বিশ্বাস করেন। তাঁদের বিশ্বাস ‘ইহুদি কর্তৃক পবিত্র ভূমি পুনরুদ্ধার’ হল ‘যবনিকা পতনের’ পূর্বশর্ত, যখন ‘যিশু খিস্টের পুনরাগমন’ ঘটবে বা যিশু আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। কাজেই তারা ‘মধ্য প্রাচ্যে’ যে- কোনো ধরণের শান্তি উদ্যোগের বিরোধী। তারা সংঘাতের পক্ষে, কেননা তাতে ‘ভাবাবেশ’ এর সৃষ্টি হবে আর তার ফলে তরান্বিত হবে যিশু খিস্টের পুনরাআগমন। এই মনোভাব থেকেই ‘রহস্যউদ্ঘাটনবাদীরা’ ইজরায়েলপন্থী এবং আরব বিরোধী। ফিলিস্তিনীদের ন্যায্য অধিকার নিয়েও তাদের কোন সাহানুভূতি নেই। তার মানে এই নয় যে খ্রিস্টানরা ইহুদিদের হিতাকাঙ্খী। বরং তা উলটো। তারা বেশীরভাগ ইহুদিদের ঘৃণা করে। তারা ইজরায়েলের (ইহুদিদের) পত্তন ও সম্প্রসারণ এই জন্যই চায় যে এর দ্বারা ‘যিশু খিস্টের পুনরাগমনের পথ প্রস্তুত হবে। তারা চায় খ্রিস্টান দেশে অবস্থিত সমস্ত ইহুদিরা ফিলিস্তিনে চলে যাক, যাতে এইসব একগুঁয়ে, পাপী, যিশু খিস্টের হত্যাকারী ইহুদিদের হাত থেকে তাদের নিজেদের দেশগুলি মুক্ত হয়, যাতে ইহুদিদের সবাই মুসলমানদের সাথে লড়াই করে নিহত হয়। অপরদিকে ইহুদিদেরও স্বপ্ন হল সমগ্র ফিলিস্তিনকে দখল করে একটা বৃহৎ ইজরাইল রাষ্ট্র গঠন করতে যাতে সারা পৃথিবীর ইহুদিরা এসে সেখানে বসতি স্থাপন করতে পারে। কিন্তু এই ইহুদি জাতি জানে না বন্ধু সেজে বসে থাকা খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলো ইহুদিদের একটা রাষ্ট্র উপহার দিচ্ছে না, উপহার দিচ্ছে একটা বৃহৎ কারাগার। যাতে সারা পৃথিবীর ইহুদিদের একত্রিত করে একসঙ্গে ইহুদিদের নির্মূল করা যায়। কারণ খ্রিস্টানদের ধর্মীয় বিশ্বাস যে যিশু আবার পৃথিবীতে আগমন করবেন এবং পৃথিবী ইহুদিমুক্ত হলে তবেই যিশু আবার পৃথিবীতে আবির্ভুত হবেন।
ইতিহাসের পাতা উল্টালেই দেখা যায় কোনো খ্রিস্টান শাসক যখন ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন তখনই নিজ দেশ থেকে ইহুদিদের নির্মমভাবে হত্যা করেছেন এবং দেশ থেকে পলায়নে বাধ্য করেছেন। ইহুদিবিদ্বেষী ও খিস্টান ধর্মাবলম্বী অ্যাডলফ হিটলারও ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ৬০ লক্ষ ইহুদিকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। তিনিও চেয়েছিলেন পৃথিবীটাকে ইহুদিমুক্ত করে পৃথিবীকে পবিত্রভুমিতে রূপান্তরিত করতে। এইভাবে সারা পৃথিবী থেকে যখন খ্রিস্টানদের হাতে ইহুদিদের বিতাড়ন শুরু হয়েছিল তখন কোনো রাষ্ট্র তাদের আশ্রয় দেয়নি। দিয়েছিল ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনিরাই ইহুদিদের স্মরণার্থী হিসেবে তাদের ভুমিতে স্থান দিয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের কৃতজ্ঞতা ভুলে গিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজেদের জন্য রাষ্ট্র গঠনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এবং এই ষড়যন্ত্রে সাহায্য করে খ্রিস্টান দেশগুলি। অর্থাৎ বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদি বিতাড়নের সময় খ্রিস্টানরা ছিল ইহুদিদের মূল শত্রু আর মুসলিমরা ছিল তাদের বন্ধু। কিন্তু তাদের রাষ্ট্র গঠনের সময় এই ইহুদিরা মুসলিমদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং খ্রিস্টানদের বন্ধু সেজে যায়। অথচ তারা খ্রিস্টানদের দুরভিসন্ধী এখনো বুঝতে সক্ষম হয়নি। খ্রিস্টানরা মূলত চায় ইজরাইল নামক এক উন্মুক্ত কারাগার। যাতে সারা বিশ্বের ইহুদিদের এক করে হত্যাযজ্ঞ করে হিটলারের ইহুদি নিধনের ইতিহাস পুনরাবৃত্তি করতে।
যাইহোক এই রহস্যউদঘাটনবাদী খ্রিস্টানদের চাপেই, ব্রিটেন ও আমেরিকার বিদেশনীতি এত নির্লজ্যভাবে, অযৌক্তিকভাবে ইজরায়েপন্থী এবং ফিলিস্তিন বিরোধী। ইতিহাসের অনেকগুলি ঘটনা এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। যেমন, ১৯১৪ সালে অটোমান (ওসমানিয়া) সাম্রাজ্য থেকে ফিলিস্তিনের ‘মুক্তি’; ১৯৩৯ সালে জেরুজালেমে ব্রিটিশ দুতাবাস খোলা; ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসনে উৎসাহদান; ১৯৪৮ সালে ইজরায়েলের সৃষ্টি; পরবর্তী বছরগুলিতে ‘ইহুদিদের জন্য রাষ্ট্র’র সম্প্রসারণ।
‘ফিলিস্তিনে ইহুদিদের প্রত্যাবর্তন অবশ্যই যিশু খিস্টের পুনরাগমনের অনুগামী হবে, এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে আর্ল অব শ্যাফটসবেরি গ্রেট ব্রিটেনের জন্য এমন এক পথ স্থির করলেন, যা শেষ পর্যন্ত আধুনিক ইজরায়েল রাষ্ট্রে পরিণতি পেল।’ [Holy War, McFarland & Company, Jefferson, (2002), Page- 32, David S New]
জন কামিং এর মতো অত্যুৎসাহী যাজক লেখক আছেন, যাঁরা “The End” শীর্ষক গ্রন্থের মতো ‘Last Days’ বিষয়ক বইগুলি গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ‘ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগনের জন্য স্ব-ভূমি প্রতিষ্ঠা’ বিষয়ক বেলফোর ঘোষনাপত্রের সূতিকাগার হল বিধানবাদী এই ভাবনাচিন্তা যে ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণকে বাদ দিয়ে কোন বিধান হবে না। ‘ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ এবং লর্ড আর্থার বেলফোর (বেলফোর ঘোষণাপত্রের রচয়িতা), এঁরা দুজনেই যুদ্ধ-শেষ (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ) ব্রিটিশ বিদেশীতির দুই সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যাক্তিত্ব। এঁরা বেড়ে উঠেছেন, dispensationalist চার্চের পরিমণ্ডলে এবং ‘বাইবেলগত কারণবশত’ জিয়নবাদী কর্মসূচীর প্রতি প্রকাশ্যে অঙ্গীকারবদ্ধ।’ [Holy War, McFarland & Company, Jefferson, (2002), Page-33-34] বেলফোর সনদে বেলফোর ঘোষণা করেছেন যে, ‘ফিলিস্তিনে সে দেশের বর্তমান অধিবাসীরা কি চায় তা নিয়ে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাবার কোন ভাবনাই আমরা আদৌ ভাবছি ন…….জিয়নবাদ, তা ঠিক বা ভুল, ভাল অথবা মন্দ যা-ই হোক না কেন এর শিকড় প্রোথিত রয়েছে বহুযুগ-প্রাচীন ঐতিহ্যে, বর্তমান কালের প্রয়োজনে, ভবিষ্যতের আশায় ওই প্রাচীন ভূখন্ডে আজ যে ৭০০,০০০ লক্ষ আরব বসবাস করছে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও কুসংস্কারের চাইতে ভবিষ্যতের আশার গুরুত্ব অনেক নিগুঢ়।’ সনদে বিবৃত ‘বহু প্রাচীন ঐতিহ্য’, ‘বর্তমান প্রয়োজন’ এবং ‘ভবিষ্যৎ আশাগুলি’ কি কি? ‘ওইসব খ্ৰীষ্টান জিয়নবাদীদের ‘সুপ্রাচীন ঐতিহ্য’ এবং ‘ভবিষ্যৎ আশা’ হল এই যে, ইহুদিরা পবিত্রভূমিতে থাকবে যাতে যিশু খ্রীষ্ট প্রত্যাবর্তন করতে পারেন। ‘বর্তমান প্রয়োজনগুলির মধ্যে রয়েছে, খ্রিস্টান জিয়নবাদী ও অন্যান্যদের এই আশা যে ইহুদিরা যেন তাদের বসবাসের জন্য এই জায়গার পরিবর্তে অন্য কোনো জায়গা খুঁজে পায়। [Holy War, McFarland & Company, Jefferson, (2002), Page- 37]
অন্য যে কোন জায়গার চাইতে রহস্যউদ্ঘাটনবাদীদের সংখ্যা আমেরিকায় বেশি। প্রতি তিনজন আমেরিকানের মধ্যে দুজন যিশু খিস্টের পুনরাগমনে (যবনিকাপতনের অংশ) বিশ্বাসী, এদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ এমন মানুষ আছে যারা কখনো চার্চে যায় না। আমেরিকানদের এক তৃতীয়াংশ বিশ্বাস করে মাত্র কয়েক বছর বা কয়েক দশকের মধ্যে ‘পুনরাগমনের’ ঘটনা ঘটবে, এক অষ্টমাংশের বিশ্বাস, ঘটনাটা তাদের জীবদ্দশাতেই ঘটবে। [Holy War, McFarland & Company, Jefferson, (2002), Page- 4]
আমেরিকায় অনেকগুলি রহস্যউদ্ঘাটনবাদী খ্রিস্টান গোষ্টী রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল James Brooks এবং Arno Gaebelein- এর মতো Dispensationalist, ডেনভার-এ Monte Kim Miller 4 Charles Manson- 4 Concerned Christians; Rousas john Rusdoony জামাতা Gary North -এর Christian Reconstructions; Southern Baptist, Moral Majority, Student Intern Training for Evangelism এবং ‘বিশ শতকের রোবেস্পিয়রের’ Jerry Falwell; প্রেসিডেন্ট পদাভিলাষী Pat Paterson –এর CBN।
‘রোনাল্ড রেগনের জীবনীকারের টীকা অনুযায়ী রেগন’ ‘সৎ-অসতের শেষ রণক্ষেত্রে ঝুলছিলেন।’ প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি নিউক্লিয়ার যুদ্ধের গোপন পরিকল্পনা করেছিলেন। মৌলবাদীরা বিশ্বাস করত, রেগন প্রেসিডেন্ট পদে বৃত হলে যিশুর প্রত্যাবর্তন ত্বরান্বিত হবে। প্যাট রবার্টসন বলেছেন, ঈশ্বর তাঁকে বলেছেন, ‘আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি আমার পুত্রের আগমনবার্তার অগ্রদূত হিসেবে’। ১৯৮০ এবং ১৯৮৪ সালে রেগনকে রাষ্ট্রপতি পদে বসানোর কৃতিত্ব দাবী করেছে জেরি ফলওয়েল এবং তার মর্যাল মেজরিটি। প্রথম দফায় যদিও রেগন তেমন বিশেষ কিছু করতে পারেন নি, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থের হানিই ঘটিয়েছিলেন, তথাপি ১৯৮৪ সালে আমেরিকার যে-কোন রাষ্ট্রপতির চাইতে বেশি ভোট পেয়ে পুননির্বাচিত হয়েছিলেন। [Holy War, McFarland & Company, Jefferson, (2002), Page – 37]
রহস্যউদ্ঘাটনপন্থী ধ্যানধারণার প্রতি আনুগত্য থাকার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল। কেবল রেগন নন, ১৯৪৪ সালের ট্রুম্যান থেকে ২০০৪ সালের জর্জ বুশ, বারাক ওবামা ও জো বাইডেন পর্যন্ত প্রতিটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘বাইবেল সংক্রান্ত কারণে’ অযৌক্তিকভাবে ইজরায়েলপন্থী এবং ফিলিস্তিন বিরোধী হয় তাঁরা নিজেরাই রহস্যউদ্ঘাটনবাদী, না হয় অন্তত বিপুল সংখ্যক রহস্যউদ্ঘাটনবাদী ভোটের দ্বারা প্রভাবিত।
আগেই বলা হয়েছে যে এই রহস্যউদ্ঘাটনবাদীদের উদ্দ্যেশ্য হল নিজেদের দেশ থেকে সমস্ত ইহুদিদের বিতাড়িত করে দেশকে ইহুদিমুক্ত করা কারণ তাদের বিশ্বাস এই পাপী ইহুদিরাই যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করেছে। খ্রিস্টান রহস্যউদ্ঘাটনবাদীরা চায় তাদের দেশ ইহুদিমুক্ত হোক এবং তারা যেন মুসলমানদের সাথে লড়াই করে সকলে নিহত হয়।
এই অযৌক্তিক ও বিভ্রান্তিকর ধারণার বশবর্তী হয়ে বাহ্যিকভাবে ইহুদিদের সাহয্য করে এবং ইজরায়েলের সহযোগিতায় বিভিন্ন ইসলামিক গোষ্টীর জন্ম দিয়েছে যাতে সেইসব গোষ্টীর সাথে লড়াই করে ইহুদিরা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।