লিখেছেনঃ ডঃ শ্যামাপ্রসাদ বসু
১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি গান্ধীজী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলেন। আততায়ী নাথুরাম গডসে ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আর.এস.এস) একজন প্রাক্তন স্বয়ংসেবক। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের সময়ে তিনি সংঘ পরিত্যাগ করে সাভারকারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হিন্দু মহাসভায় যােগ দিয়েছিলেন।
গান্ধীজীর নারকীয় হত্যা তৎকালীন দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলালকে নিশ্চিত করেছিল য়ে এর পিছনে হিন্দু জাতীয়তাবাদী চরমপন্থীদের গােপন হাত আছে। তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদী চরমপন্থীদের কাজকর্মকে “ফ্যাসিক্ত” কায়দা বলে বহুদিন থেকে মনে করে এসেছেন। বিশেষ করে আর.এস.এস সম্পর্কে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে (ডিসেম্বর, ১৯৪৭) তিনি এদের স্বরূপ উদঘাটন করে রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের একটি চিঠি দিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, “আমাদের কাছে প্রচুর প্রমাণ আছে যার থেকে দেখা যায় আর.এস.এস সংগঠন একটি প্রাইভেট আর্মির মত এবং পুরােপুরি নাৎসি লাইন ধরে এগােচ্ছে, এমন কি সেইমত অনুসরণ করছে, সাংগঠনিক কৌশলও।” (উদ্ধৃতির জন্য, খ্রিস্টোফ জেফ্রেলট, দি হিন্দু ন্যাশানালিস্ট মুভমেন্ট এণ্ড ইন্ডিয়ান পলিটিকস, পৃ. ৮৭, পেঙ্গুইন, ১৯৯৯)।
ফলে গান্ধীজীর হত্যার একমাসের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে ভারত সরকার এক আদেশনামায় (৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮) আর.এস.এস-কে বেআইনী সংগঠন হিসেবে ঘােষণা করল এবং সংঘচালক বা সংগঠনের সর্বাধ্যক্ষ হিসেবে সদাশিব মাধব গােলওয়ালকার তার হাজার হাজার অনুগামী সহ প্রায় বিশ হাজারের মত গ্রেপ্তার হলেন।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই গােলওয়ালকার জেলে বসে সরকারের সঙ্গে চিঠি চালাচালি শুরু করলেন কিভাবে তিনি এবং সংঘের কর্মীরা মুক্তি পেতে পারেন ও আর.এস.এস-এর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়। মজার কথা ঠিক এই সময়ে সরকার কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের অভিযােগ এনেন তাদেরও বেআইনী ঘােষিত করেছিল। কিন্তু তারা জেলে বসে সরকারের সঙ্গে মুক্তি পাওয়ার আশায় কোন লাঠি চালাচালিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন নি।
যাই হােক শেষ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেলের মধ্যস্থতায় কিছু শর্ত মেনে নেওয়ার বিনিময়ে ১১ই জুলাই ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে আর.এস.এস-এর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হল। এর পূর্বে গােলওয়ালকার অবশ্য নেহরুর কাছে দরবার করেছিলেন কমিউনিস্টদের ঠেকানাের বিষয়ে সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে নেহরু তাতে আমল দেন নি। কারণ তারা যে “দেশবিরােধী” (anti-national) -এ ধারণায় তার কোন পরিবর্তন আসে নি।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের শেষে (অক্টোবর) জওহরলাল যখন বিদেশে তখন প্যাটেলের নেতৃত্বে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে আর.এস.এস একটা মীমাংসায় আসার চেষ্টা করে। কথা হয় কংগ্রেসে আর.এস.এস-এর সদস্যরা যােগ দিতে পারবে। এতদিন অবশ্য আর.এস.এস-এর দাবি ছিল, এটি এক অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সেই কারণে দেখিয়ে তারা দেশের স্বাধীনতার লড়াই থেকে নিজেদের দূরত্বে রেখেছিল। যদিও ব্যক্তিগত স্তরে এঁদের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার গান্ধীজীর অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দিয়ে কিছুকাল কারাবরণ করেছিলেন। তখন আর.এস.এস-এর বক্তব্য ছিল ইংরাজ তাড়ানাের পূর্বে নিজেদের শরীর ও আত্মিক শক্তিকে বলীয়ান হওয়ার দিকে প্রস্তুতি নিতে হবে। এর জন্য অবশ্য তারা কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেন নি। কিন্তু আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করা গেল যতদিন ইংরাজরা ছিল ততদিন তারা নিজেদের উক্ত প্রস্তুতির কাজেই ব্যস্ত রাখল, তারপর দেশছাড়ার জন্য ইংরাজরা জাহাজঘাটায় উঠতে না উঠতেই আর. এস. এস জানাল তাদের প্রস্তুতিপর্ব সম্পূর্ণ হয়েছে এবং এখন তারা রাজনীতিতে যােগ দেওয়ায় উৎসুক। ফলে এতদিন মুখের উপর যে অরাজনৈতিক বােরখাটা তারা চাপিয়ে এসেছিল তা তারা ছুঁড়ে ফেলে দিল। বেরিয়ে এল তাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙক্ষার মুখটি।
প্যাটেলকে ধরাধরি করে কংগ্রেসের সঙ্গে আপােষ করে প্রশাসনের যে সুবিধায় ভাগ বসাবে ভেবেছিল আর.এস.এস তাতে বাদ সাধলেন আবার জওহরলাল। তিনি নভেম্বর মাসে দেশে ফিরে এককথায় কংগ্রেসের পূর্ব সিদ্ধান্ত নাকচ করে ফতােয়া দিলেন, ফলে সংঘচালক গােলওয়ালকারের সামনে একটি রাজনৈতিক প্রধান দলের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ও প্রাণিবিদ্যার প্রাক্তন অধ্যাপক গােলওয়ালকার ছিলেন দৃঢ়বৃদ্ধিসম্পন্ন এক বিজ্ঞ রাজনীতিক। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য সরকারের কাছে তাকে চিঠি দিয়ে মুচলেকা দিতে হয়েছিল (১২ই নভেম্বর, ১৯৪৮) যে আর. এস. এস এক অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সে কখনাে রাজনীতি করবে না। কিন্তু তা ছিল তার কাছে এক নিছক কৌশল মাত্র।
স্বাধীন ভারতের পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র দলীয় রাজনীতির যে স্বর্ণময় সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে তা স্বাভাবিকভাবে গােলওয়ালকারের দৃষ্টি এড়ায়নি। হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের ঈশ্বর নির্দিষ্ট যে “মিশন” তার উপর বর্তেছে তা পূর্ণ করার সুযােগ তিনি ছেড়ে দিতে পারেন না। কারণ এই রাষ্ট্র কাজ করবে মানুষের পার্থিব উন্নয়ন অর্থাৎ খাওয়া-পরার চেয়ে আত্মিক বিকাশের মধ্যে। এই হিন্দু রাষ্ট্রে গােলওয়ালকার বলেন, “হিন্দুস্থানের অ-হিন্দু জনসাধারণকে অবশ্যই হিন্দু সংস্কৃতি ও ধর্মের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে এবং শিখতে হবে হিন্দুধর্মকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করা এবং হিন্দু সংস্কৃতি ও জাতি (race)-র গৌরব চিন্তা করা ছাড়া আর কিছু ভাবনায় আনা চলবে না…কোনরকম সুবিধার দাবি চলবে না…এমনকি নাগরিকের অধিকারও নয়।” (উদ্ধৃতির জন্য, আন্ডারস্ট্যান্ডিং কমিউনালিজম, পৃ. ৮৬, এস. কাপ্পেনের প্রবন্ধ, সংস্করণ ১৯৯৩)।
তবে গােলওয়ালকারের ইচ্ছা ছিল, “জলে নামব তবু বেণী ভেজাব না”, অর্থাৎ রাজনীতি করব পিছনের দরজা দিয়ে অর্থাৎ রাজার প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে। কারণ রাজারা কখনাে সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করেন নি করেছেন মুনিঋষিরা যারা পার্থিব সুখস্বাচ্ছন্দকে সর্বদা তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন (অবশ্য প্রাচীন মহাকাব্যগুলিতে এর বহু ব্যতিক্রমী উদাহরণই দেখা যায়)। তারাই পারেন সমাজ ও রাষ্ট্রকে সঠিকপথে পরিচালনা করতে। রাজা “কেবল সেই উচ্চতম নৈতিক কর্তৃত্বের নিষ্ঠাবান অনুগামী।” (উদ্ধৃতির জন্য, খ্রিষ্টোফ জেফ্রেলট’, পৃ. ১১৫)।
গােলওয়ালকারের উপরােক্ত বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছে তিনি যে রাজনৈতিক দল গঠন করবেন সেই দল পরিগণিত হবে “রাজা” হিসেবে আর তাকে উচ্চতম Caroa Pag waistrant (“an ardent follower of that higher and moral authority”) হতে হবে অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের, আরাে সংক্ষেপে বলতে। গেলে সরসংঘ চালকের। জেলেটের মতে গােলওয়ালকার নেবেন রাজগুরুর ভূমিকা। (পৃ. ১১৫)
গােলওয়ালকারের প্রয়ােজন ছিল এমন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের যিনি আদর্শের দিক থেকে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কৃতসংকল্প আর সেই ব্যক্তিত্ব তিনি খুঁজে পেলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়ের মধ্যে।
স্যার আশুতােষের পুত্র শ্যামাপ্রসাদ সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ভারতীয় হিন্দু মহাসভার সভাপতি বিনায়ক দামােদর সাভারকারের হাত ধরে। তখন তার বয়স উনচল্লিশ বছর। পড়াশুনায় তিনি ছিলেন এক অত্যুজ্জ্বল ছাত্র। হিন্দু মহাসভায় যােগ দেওয়ার পূর্বে তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য—যার মেয়াদ ছিল চার বছর (১৯৩৫-৩৮)। শিক্ষা ব্যবস্থায় তিনি নানা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ঘটিয়েছিলেন, এর মধ্যে অন্যতম হল মাতৃভাষার মাধ্যমে ম্যাট্রিকুলেশন স্তরে পঠনপাঠন ও পরীক্ষা দেবার ব্যবস্থা এবং বাংলা বানান পদ্ধতি নির্ধারণ ও বৈজ্ঞানিক শব্দের পরিভাষা রচনা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জওহরলালের নেতৃত্বে গঠিত ভারতের প্রথম মন্ত্রীসভায় শ্যামাপ্রসাদ হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধি হিসেবে যােগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের গােড়ায় হিন্দু মহাসভার সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন। মতভেদের অন্যতম কারণ হল তিনি চেয়েছিলেন রাজনৈতিক দল হিসেবে হিন্দু মহাসভা অ-হিন্দুদের জন্য দরজা খুলে দিক। কিন্তু মহাসভার ওয়ার্কিং কমিটিতে তিনি ভােটের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পরাজিত হন। অন্যদিকে মন্ত্রীসভাতেও তিনি টিকতে পারেন নি পাকিস্তানের প্রতি নেহরুর তথাকথিত তােষণ নীতির জন্য। ৮ই এপ্রিল ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ভারত ও পাকিস্তানের দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দিল্লিতে এক চুক্তি হয় দুই দেশের সংখ্যালঘুদের পুনর্বাসন ও নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে। ইতিহাসে এই চুক্তি পাকিস্তানে হিন্দুদের নিরাপত্তার পক্ষে সহায়ক হবে না এই অভিযােগ তুলে শ্যামাপ্রসাদ শিল্পমন্ত্রী হিসেবে নেহরু মন্ত্রীসভা থেকে ওই দিনই পদত্যাগ করেন। তাঁর সঙ্গে যােগ দিয়েছিলেন বাংলার আরও এক মন্ত্রী ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়ােগী।
পদত্যাগের পর শ্যামাপ্রসাদ চাইছিলেন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে যার ভিত্তি হবে হিন্দুত্ব এবং সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তিনি এমন এক ব্যক্তিত্বের সন্ধান করছিলেন যিনি শুধু সমভাবাপন্ন নন তিনি তাকে সাহায্য করবেন অর্থ ও স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে। এ ধরনের ব্যক্তির সন্ধান পেতে তাকে বিশেষ কোন চেষ্টা করতে হল না, তিনি তার পূর্ব পরিচিত—আর.এস.এস-এর সর্বাধিনায়ক সরসংঘচালক শ্রী গােলওয়ালকারজী।
‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় (২০শে সেপ্টেম্বর, ২০০০) আবদুর রউফ শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে এক নিবন্ধে লেখেন, “শ্যামাপ্রসাদের জাতীয়তাবাদী চেতনায় হিন্দুত্বের অস্মিতা নিয়ে গর্ববােধ ছিল পূর্ণমাত্রায়। স্বাধীন ভারতে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করতে পারে এমন কিছু তিনি বরদাস্ত করতে রাজি ছিলেন না। রােজনামচায় লিখেছিলেন, ভারতে বা ভারতের কোন প্রান্তে ইসলামের পতাকা উড়তে থাকবে এ আমরা স্বীকার করতে চাই না। সারা হিন্দুস্তানে শতকরা ৭৫ জন হিন্দু। যদি গণতন্ত্রবাদের উপর রাষ্ট্রীয় কাঠামাে গড়ে ওঠে, এটা স্বীকার করতে হবে যে তা হলে সারা ভারতের যে গভর্নমেন্ট হবে তার মধ্যে হিন্দুর প্রভাব থাকবে বেশি।”
জয়া চ্যাটার্জী “বেঙ্গল ডিভাইডেড” (কেব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস) গ্রন্থে দেশভাগের এক বছর আগে লেখা শ্যামাপ্রসাদের এক ব্যক্তিগত নােট উদ্ধার করেছেন। তাতে শ্যামাপ্রসাদের মনে হয়েছে অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হলে বাংলায় হিন্দু সংস্কৃতির সমাপ্তি ঘটবে। নিম্নবর্ণ থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের খুশী করার জন্য প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিটাই লােপ পাবে। (“In order to placate a set of converts have low caste Hindus to Islam very Hindu culture will be sacrificed.”) আর.এস.এস-এর প্রবীণ নেতা আপ্পাজী যােশী শ্যামাপ্রসাদ ও গােলওয়ালকারের মধ্যে আলাপ আলােচনা ও বৈঠক বসানাের ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিলেন।
শ্যামাপ্রসাদের মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগের তিন মাস পরে হিন্দু মহাসভার সভাপতি ডাঃ এন.বি.খারে যখন তার সঙ্গে দেখা করতে যান তখন তিনি তাকে বলেন গােলওয়ালকারের সঙ্গে তার কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ফলে খারেকে নিরাশ হয়ে ফিবতে হয়।
অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে গােলওয়ালকার দুটি ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন এবং শ্যামাপ্রসাদ শেষপর্যন্ত তা মেনেও নিয়েছিলেন। প্রথমটি হল, কাঠামাের দিক থেকে আর.এস.এস-এর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকবে আর দ্বিতীয়টি হল, শ্যামাপ্রসাদ কল্পিত “ভারতীয় রাষ্ট্রবাদ”-এর সঙ্গে আর.এস.এস-এর হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণার মধ্যে কোন বিরােধ থাকবে না। (অ্যান্ডারসন এন্ড দামালে, পৃ. ১২৭)
জেফ্রেট লিখছেন, ‘হিন্দুরাষ্ট্র’র আদর্শ সম্পর্কে গােলওয়ালকার যখন নিশ্চিত হলেন মুখার্জী তাঁর সঙ্গে পুরােপুরি সহমত পােষণ করছেন তখন তিনি তার কিছু অভিজ্ঞ পােড়খাওয়া এবং দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ সহকর্মীকে মনােনীত করলেন তাকে রাজনীতিতে সাহায্য করার জন্য। (পৃ. ১১৭)।
মে মাসের শেষে (১৯৫১) আর.এস.এস-এর কিছু সক্রিয় কর্মী জলন্ধরে মিলিত হয়ে ভারতীয় জনসংঘ (সংক্ষেপে জনসংঘ)-এর প্রথম ইউনিট খােলেন। ইতিপূর্বে ওই বছরই (১৯৫১) ১৬ই জানুয়ারি বেশ কিছু আর.এস.এস এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা এক বৈঠকে ঠিক করেছিলেন নাম হবে ভারতীয় জনসংঘ। যদিও “হিন্দু” নাম দেওয়া হয়নি, তবে দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক বলরাজ মাধােক-এর মতে ইচ্ছা করেই “জন” শব্দটি রাখা হয়েছিল। তার মতে একমাত্র সেই ব্যক্তিকেই বলা হবে “জন” যিনি ভারতকে জননী বলে মনে করেন এবং বহন করেন বর্তমানেও প্রাচীন ঐতিহ্য। (উদ্ধৃতির জন্য, খ্রিষ্টোফ জেফ্রেলট, পৃ. ১১৮, পাদটীকা নং ১৩)।
যাই হােক, ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ২১শে অক্টোবর দিল্লিতে এক কনভেনশন ডেকে গঠিত হল জনসংঘের ওয়ার্কিং কমিটি—যার অধিকাংশ সদস্য এসেছিলেন আর.এস.এস থেকে। শ্যামাপ্রসাদ হলেন জনসংঘ-এর সভাপতি। তাঁর ব্যক্তিগত সচিব হলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী, যিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এম.এ এবং এক সময়ে গােয়ালিয়র শাখার ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি এবং পরবর্তী সময়ে চল্লিশের দশকের (বিশ শতক) শেষে আর.এস.এস-এর এক সক্রিয় কর্মী। অন্যদিকে আর.এস.এস-এর তরুণ “প্রচারক” ভাই মহাবীর জেনারেল সেক্রেটারী হলেন। সহায়ক হিসেবে রইলেন মৌলীচাদ শর্মা (এক সময়ের কংগ্রেসের হিন্দুত্ব গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত)। তিন প্রধান স্বয়ংসেবক, দীনদয়াল উপাধ্যায়, বলরাজ মাধােক এবং বাপুসাহেব সােনীকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেওয়া হল।
অ্যান্ডারসন এবং দামলের মতে সংগঠন যত বাড়তে থাকল তত বেশি করে আর.এস.এস কর্মীরা জনসংঘে ভীড় জমাতে লাগল। ফলে অধিকাংশ স্থানে তৃণমূল। স্তরে দলীয় সংগঠন আর.এস.এস-এর কুক্ষিগত হয়ে গেল। (ঐ, পৃ. ১৫৭) ন্যাশানাল।
ওয়ার্কিং কমিটি, রাজ্য, নগর, জিলা, মণ্ডল এবং সবচেয়ে নীচে স্থানীয় বা ব্লক লেভেল কমিটি পর্যন্ত ছয়টি স্তরে জনসংঘের সংগঠন বিস্তৃত ছিল। অ্যান্ডারসন এবং দামলে পরবর্তী সময়ে শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পর তিনটি লােকসভা নির্বাচন কেন্দ্র (এলাহাবাদ সিটি, দিল্লি সদর এবং মুম্বইয়ে উত্তর-পূর্ব কেন্দ্র) সার্ভে করে দেখেছেন জনসংঘের বিভিন্ন স্তরে আর.এস.এস-এর প্রতিনিধিত্ব প্রায় ৯০ শতাংশ। এদের মধ্যে আবার রাজ্য এবং জাতীয় ওয়ার্কিং কমিটিতে প্রতিনিধিত্বের হার পুরােপুরি একশাে ভাগ। (পৃ. ১৮৯)। উপরােক্ত লেখকদ্বয় আরাে বলেছেন, জনসংঘের সমস্ত ধবনের সম্পাদক সংক্রান্ত (Secretarial) কাজকর্ম পুরােপুরি আর.এস.এস কর্মীদের হাতে ছিল। এ বিষয়ে তাদের সাহায্য করতেন সংঘের প্রচারকরা পার্টির বিভিন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য প্রধানত বিবেচিত হতেন সংঘের কর্মীরাই। জেফ্রেলট বলেছেন, হিন্দুদের এক পতাকার নীচে এককাট্টা করার ব্যাপারে আর.এস.এস এবং জনসংঘের মধ্যে কোনােরকম অনৈক্য ছিল না। (পৃ. ১১৩)।
শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে অক্টোবর জনসংঘ যে প্রচার পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল তাতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বলা হল ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের বিকাশ ঘটতে হবে। একমাত্র কিছু গুরুত্বপর্ণ শিল্প ছাড়া যেমন, প্রতিরক্ষার উৎপাদন, পঞ্চাশেব দশকে (বিশ শতক) এরই ফলশ্রুতিতে জনসংঘ ভারতীয় অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বিরুদ্ধে বিশেষ করে নেহরুর যৌথ সমবায় ভিত্তিক খামার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে নেমেছিল। মধ্যবর্গীয় ব্যবসায়ী শ্রেণীর আর্থিক সুবিধার জন্য জনসংঘ অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণের দাবি জানিয়েছিল।
অ্যান্ডারসন এবং দামলে পার্টির প্রথম ম্যানিফেস্টো বা কর্মসূচী বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে, এটি আর্থিক নীতির দিক থেকে এক রক্ষণশীল দলিল, যেখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্নে বেশি yata Toot (“Greater concern for cultural and political integration than for social and economic problem”)
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে জনসংঘের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এবং শ্যামাপ্রসাদের হাতে গড়া শিষ্য দীনদয়াল উপাধ্যায় যখন শ্লোগান দেন, জনসংঘ একটি দল, অন্যদের চেয়ে আলাদা” (“Jansangha party with a difference, “অর্গানাইজার”, দীপাবলি সংখ্যা, ১৯৬৪, পৃ. ১১) তখন সহজেই তা বােধগম্য হয়। বােঝা যায় এই পার্টি বিরাষ্ট্রীয়করণের পক্ষে এবং কৃষিতে সমবায়ের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক সংযুক্তিকরণের অর্থ হল ভারতে যুক্তরাজ্য ব্যবস্থার পরিবর্তে ঐক্যমূলক (Unitary) ব্যবস্থার প্রবর্তন। যেখানে রাজ্যগুলির নিজস্ব কোন ক্ষমতা থাকবে না। কেন্দ্র থেকে যে সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করা হবে, সেগুলিই কেবল প্রয়ােগ করা হবে। বর্তমান রাজ্যগুলির
পরিবর্তে তৈরি হবে ছােট ছােট “জনপদ” এবং সেগুলিকে ধরা হবে আঞ্চলিক শাসনতান্ত্রিক ইউনিট বা একক হিসেবে। (অ্যান্ডারসন এন্ড দামলে, পৃ. ১৯৮, পাদটীকা ৩নং)। সাংস্কৃতিক সংযুক্তিকরণের অর্থ পরবর্তীকালে বলরাজ মাধ্যের ব্যাখ্যা করে বলেছেন, মূল স্রোতে যােগদান, একইভাবে স্লোগান ও প্রয়ােগের ক্ষেত্রেও স্ববিরােধিতা লক্ষ্যণীয়। হিন্দি বলয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকদের সমর্থন পাওয়ার আশায় জনসংঘ তার ম্যানিফেস্টোয় জমিতে যে চাষ করে অর্থাৎ কৃষকের অধিকার মেনে নিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল শ্যামাপ্রসাদ যে সমস্ত সংগঠন ভূস্বামীদের অধিকার সংরক্ষণের কথা বলে তাদেরই সাথে ১৯৫২ সালের লােকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে আঁতাত তৈরি করলেন। যেমন, বাংলায় হিন্দু মহাসভা, উত্তরপ্রদেশের প্রজা পার্টি এবং পাঞ্জাবের জমিদার মজদুর পার্টি।
জনসংঘ ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের লােকসভা নির্বাচনে মাত্র তিনটি আসন লাভ করেছিল। এর মধ্যে শ্যামাপ্রসাদের ব্যক্তিগত প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকেই দুটি এসেছিল এবং অপরটি ছিল রাজস্থান থেকে। এত কম আসন সত্ত্বেও মুখার্জী নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও বাগ্মিতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন রক্ষণশীল পার্টিকে একত্র করে প্রায় চল্লিশ জন সদস্যকে এক জোট করে তিনি নেতৃত্ব দিলেন ন্যাশানাল ডেমােক্রেটিক পার্টির। লােকসভায় তৈরি হল কমিউনিস্টদের পরই তৃতীয় বৃহত্তম গােষ্ঠী। এই গােষ্ঠীতে ছিল জনসংঘ ব্যতীত দ্রাবিড় কাজাগাম এবং গণতন্ত্র পরিষদ (ওড়িশার ভূস্বামীবৃন্দ) নিছক একটি দল নয় ভারতীয় রাজনীতিতে শ্যামাপ্রসাদ আবির্ভুত হল এক আন্তঃসাম্প্রদায়িক এবং রক্ষণশীল তথা সামন্ততান্ত্রিক গােষ্ঠীর নেতা হিসেবে। বলা বাহুল্য শ্যামাপ্রসাদের এই রূপান্তর গােলওয়ালকারের পক্ষে আদৌ স্বস্তির কারণ ছিল না। কিন্তু এ বিষয়ে উভয় তরফে কিছু ঘটার পূর্বেই ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে (২৩শে জুন) কাশ্মীরে আটক থাকাকালীন শ্যামাপ্রসাদের আকস্মিক মৃত্যু তাকে চিরকালের জন্য রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে অদৃশ্য করে দিল।
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই শ্যামাপ্রসাদ রাজনীতিতে রক্ষণশীল আদর্শের প্রতিভূ ছিলেন। একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি হয়ত প্রাচীন ভারতের মৌর্য এবং গুপ্ত রাজাদের ব্রাহ্মণ্যবাদকে আদর্শ বলে ভেবে থাকবেন। বর্ণবিভাগ ও সামন্তবাদ ছিল প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের অন্যতম দুটি স্তম্ভ। শ্যামাপ্রসাদ এই দুটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোন সংস্কার আন্দোলন গড়ে তােলেন নি। উপরন্তু প্রাচীন ইতিহাসের হিন্দু গৌরব। তিনি খোঁজার চেষ্টা করেছেন মধ্যযুগে তথা মুসলমান রাজাদের আমলে মারাঠা, রাজপুত ও শিখদের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন স্বদেশীয়ানা এবং দেশপ্রেম। শ্যামাপ্রসাদের গুণগ্রাহী এবং ওয়ার্ধার ইনস্টিটিউট অব গাঁধীয়ান স্টাডিজ এর পারদর্শী অধ্যাপক সন্দীপ দাস মনে করেন, “তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কলকাতা) পাঠক্রমে বিভিন্ন শাখায় ভারতীয় ধারা সংযােজন করেন। ইতিহাস পাঠের মধ্যে দিয়ে স্বদেশী ভাব সঞ্চারের জন্য মারাঠা, রাজপুত, শিখ প্রভৃতি ইতিহাসের সংযােজন তারই উদ্যোগে সম্ভব হয়।” (“এক মহাজীবনের নাম”, দেশ, ৪ঠা জুলাই, ২০০১)
প্রাচীন ভারতকে যাঁরা হিন্দু ভারতের সমার্থক মনে করেন তারা ব্যক্তি জীবনে সাম্প্রদায়িক নাও হতে পারেন। মনে রাখা প্রয়ােজন প্রাচীন ভারতে শক, হুণ, গ্রীকরা কোন না কোন সময়ে ভারতীয় রাজদরবারে সাদরে অভ্যর্থিত হয়েছেন। মেগাস্থিনিস কোন সাম্প্রদায়িক হানাহানির তথ্য রেখে যান নি। তাই এটা কোন বিস্ময়ের ব্যাপার। নয় যে তিনি ফজলুল হককে পুতুল্য স্নেহ করতেন অথবা অসুস্থ নজরুল ইসলামকে। সুচিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্য দিয়েছিলেন। এমনকি এটাও সত্য তিনি অনেক মুসলমানের গুণগ্রাহী ছিলেন। কিন্তু বিষয়টি যখন রাজনীতিতে সঞ্চারিত হয় তখনই ওঠে প্রশ্ন সাম্প্রদায়িক—অসাম্প্রদায়িকতার। সন্দীপ দাসও স্বীকার করেছেন, “শ্যামাপ্রসাদ চেয়েছেন ঔদার্য বজায় রেখে তার হিন্দু মনােভাব গড়ে তুলতে।” (ঐ, পৃ. ২০) আর এই হিন্দু মনােভাবই তাঁকে শেষপর্যন্ত নিয়ে গেল আর. এস. এস তথা গােলওয়ালকারের কাছে।
দেশ বিভাগের প্রাক্কালে এবং ঠিক পরবর্তী সময়ে উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক উত্তেজক পরিস্থিতি এবং দলে দলে হিন্দু উদ্বাস্তুদের আগমন শ্যামাপ্রসাদ এবং গােলওয়ালকারকে ভাবাবেগের এক সাধারণ মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। গােলওয়ালকার ভেবেছিলেন হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের যে রথ তিনি জনসংঘের মধ্য দিয়ে তৈরি করতে চলেছেন তাতে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা হবে অর্জুনের এবং তিনি শ্রীকৃষ্ণের মত সারথি হবেন। একদিকে তিনি যেমন হবেন সখা আবার অন্যদিকে তিনি শ্রীকৃষ্ণের মত প্রয়ােজনে গীতার ভাষ্যও দেবেন সংকট মােচনের জন্য।
কিন্তু কিছু কালের মধ্যেই দেখা দিল সুপ্ত বিরােধ। এর কারণ হল উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গির মৌল পার্থক্য সংখ্যালঘু সম্পর্কে। হিন্দু রাষ্ট্র গঠনে শ্যামাপ্রসাদের আপত্তি না থাকলেও মুসলমান বা সংখ্যালঘুদের একেবারে অপাংক্তেয় করা সম্পর্কে গােলওয়ালকারের সঙ্গে তঁার যথেষ্ট মতপার্থক্য ছিল। যদিও সেই পার্থক্য কখনাে আলােচনায় প্রকাশ্যে আসে নি। গােলওয়ালকারের জানা উচিত ছিল এবং তা নিশ্চয় তিনি জেনেওছিলেন যে মুখার্জী হিন্দু মহাসভা ত্যাগ করেছিলেন মুসলমানদের সদস্য পদ না দেওয়ার প্রশ্নে। জনসংঘ তৈরি হওয়ার সময়ে তাই গােলওয়ালকারকে মেনে নিতে হয়েছিল মুসলমান বা সংখ্যালঘুদের জন্য দরজা খুলে রাখতে। অথচ কৌতূহলের বিষয় জনসংঘের প্রধান কর্মকর্তারা যে দল থেকে এসেছেন সেই দল বা আর.এস.এস-এ কোন মুসলমান বা খ্রিস্টানের ঠাই নেই। তবু বিষয়টি মেনে নেওয়া যেত যদি অর্জুনের ভূমিকা শ্যামাপ্রসাদ পুরােপুরি মেনে নিতেন। কিন্তু নির্বাচনী যুদ্ধে নেমে তিনি গােলওয়ালকারকে নিছক একজন সারথি হিসেবে ব্যবহার করলেন তার বেশি কোন সম্মান দিতে রাজি হলেন না। আর.এস.এস-কে তােয়াক্কা না করে জনসংঘকে মই হিসেবে ব্যবহার করে একটি সর্বভারতীয় দক্ষিণপন্থী জাতায়তাবীদ ফ্রন্ট গঠনে সচেষ্ট হলেন—যা আছে। গােলওয়ালকারের মনঃপূত ছিল না। মনে রাখা প্রয়ােজন লােকসভায় যে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে নিয়ে তিনি ন্যাশানাল ডেমােক্রেটিক পার্টি গঠন করলেন, তার একদিকে ছিল দ্রাবিড় কাজাঘাম, যারা ব্রাহ্মণ্যবাদের চরম শত্রু আর অন্যদিকে ওডিশার। সামন্তপ্রভুদের নিয়ে গঠিত গণতন্ত্র পরিষদ, যারা জমির উপরে ধর্মকে স্থান দেয় না।
খ্রিষ্টোফ জেফ্ৰেলট বলেছেন, ন্যাশানাল ডেমােক্রেটিক পার্টির নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে মুখার্জীর যে রাজনৈতিক উচ্চাশা প্রকাশিত হল তা আদৌ আর.এস.এস কে খুশি করল না। তারা মনে করল এতে পরােক্ষভাবে হিন্দু জাতীয়তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনেকটাই লঘু হয়ে পড়বে। এছাড়াও মুখার্জীর নেতৃত্ব আর.এস.এস আন্দোলনের ক্ষেত্রেও অন্যদিক থেকে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল।
প্রাথমিকভাবে গােলওয়ালকার সতর্ক করে দিলেও জনসংঘ নেতারা আশা করেছিলেন আর.এস.এস-এর সক্রিয় কর্মীরা রাজনৈতিক কাজেই নিজেদের ব্যস্ত রাখবেন। শ্যামাপ্রসাদ তাদের উপদেশ দিয়েছিলেন তারা যেন তাদের বিচ্ছিন্নতার নীতি পরিত্যাগ করেন (“isolationist policy”)। কিন্তু সেই মুহূর্তে ১৯৪৮-৪৯-এর সরকারি নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর সবচেয়ে জরুরি কাজ ছিল আর.এস.এস-এর সারা ভারত জুড়ে ব্যাপ্তি ও প্রচার। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এক নম্বর প্রাথমিকতায় আসে না, বিশেষ করে নির্বাচনী প্রচার। ফেব্রুয়ারি মাসে (১৯৫২) সাধারণ নির্বাচনের পর জনসংঘের অভ্যন্তরে আর.এস.এস কর্মী সদস্যদের চাপে জনসংঘ যে প্রস্তাব গ্রহণ করল (প্রস্তাব নং ৮) তাতে সুস্পষ্টভাবে জানাল, বর্তমানে সংঘ নিজেদের নিয়ােগ করবে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনরুজীবনের জন্য। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে কানপুরে অনুষ্ঠিত প্লেনারি সেশনে উপরােক্ত লক্ষ্যগুলির কথাই আরাে একবার জনসংঘ বলল।
শেষের দিকে মুখার্জীর কাজকর্ম সম্পর্কে আর.এস.এস এত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল যে মুখার্জীর মৃত্যুর পর আর কোন মুখার্জী মার্কা ব্যক্তিকে তারা জনসংঘের সেনাপতির পদ ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও শ্যামাপ্রসাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ প্রবাণ প্রাক্তন কংগ্রেসসেবী মৌলিচঁাদ শর্মা যখন জনসংঘের সভাপতি হলেন তখন আর.এস.এস কর্মীদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়াল তাকে অসহযােগিতার মাধ্যমে চাপ দিয়ে পদত্যাগ করানাে। শেষপর্যন্ত ছ’মাসেরও কম সময় সভাপতির পদে থেকে নভেম্বর মাসে (১৯৫৩) শর্মা পদত্যাগ করলেন। শর্মার পদত্যাগের পর জনসংঘকে পুরােপুরি গ্রাস করে না আর.এস.এস–এক মাসের ব্যবধানে জম্মর আর.এস.এস সংঘচালক প্রেমনাথ ভােলা’ (শব্দের মিছিল, শারদ, ১৪০৮)।