বর্তমান ভারতীয় রাজনীতিতে বাবরী মসজিদ বনাম রাম মন্দির নিয়ে বিতর্ক বরাবরইচরম পর্যায়ে। আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির রাম মন্দির নির্মাণ নিয়ে চরম সাম্প্রদায়িক বাতাবরণের সৃষ্টি করেছে। কেউ বলছেন, “হিন্দুদের সব সহ্যের বাধ ভেঙ্গে গেছে।” আবার কেউ বলছেন, “মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে।” কিন্তু একথা জেনে আপনারা অবাক হবেন যে আজ থেকে ৩১ বছর আগে আরএসএস পরিস্কার জানিয়েছিল যে রাম মন্দির নির্মাণ তাদের আসল উদ্দেশ্য নয়। তারা এই চলমান সমস্যাটিকে ব্যাবহার করে দিল্লির সিংহাসন দখল করতে চায় এবং ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে চায়। ১৯৮৭ সালে আরএসএস এর সংঘচালক বালাসাহেব দেবরস বিশ্ব হিন্দুপরিষদের কর্ণধার অশোক সিংহলকে এই জন্যই ধমকিয়েছিলেন যে অশোক সিংহল রাম মন্দির নির্মাণের জন্য কিভাবে রাজি হয়ে গেলেন। সেই সময় একটা ফরমুলা বলা হয়েছিল যেটার সাহায্যে বিদেশী টেকনোলজি ব্যবহার করে বাবরী মসজিদের কোন ক্ষতি না করেই অন্য জায়গায় সরিয়ে দেওয়া হবে এবং যেটাকে রাম চবুতরা বলা হয় সেই জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণ করা হবে। এই কথা যখন বালাসাহেব দেবরস জানতে পারলেন তখন তিনি অশোক সিঙ্ঘলের কাছে এসে বললেন,
“এই দেশে মোট ৮০০ রাম মন্দির বিদ্যমান রয়েছে, আর একটি যদি হয়ে যায় তাহলে ৮০১টি হবে। কিন্তু আমাদের রাম মন্দিরের এই আন্দোলন জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করছিল, এর সমর্থন বৃদ্ধি পাচ্ছিল যার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা রাজনৈতিকভাবে দিল্লিতে সরকার বানাবার পরিস্থিতি পর্যন্ত পৌঁছে যেতাম। আর তুমি রাম মন্দির নির্মাণের ব্যাপারটিকে সমর্থন করে বাস্তবে এই আন্দোলনের পিছনে ছোরা ঢুকিয়ে দিয়েছো।”
১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসের হাড় কাঁপানো ঠান্ডার সময় যখন বালাসাহেব দেবরসের এই আশ্চর্য্যজনক কথাগুলি শুনে অশোক সিঙ্ঘল অবাক হয়ে যান। বালাসাহেব দেবরস এবং অশোক সিঙ্ঘলের মধ্যে এই বিস্ফোরক আলোচনার দাবী আমি করছি না। এই দাবী করেছেন বরিষ্ঠ সাংবাদিক এবং অযোধ্যা বিবাদের সমাধানের জন্য বানানো ‘অযোধ্যা বিকাশ ট্রাস্ট’ এর প্রতিষ্ঠাতা শীতলা সিং। শীতলা সিং ফায়যাবাদ থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘জন মোর্জা’র সম্পাদক। ফায়যাবাদ এবং তার আশে পাশের এলাকায় প্রচুর সম্মান রয়েছে। তিনি এই কথা ‘অযোধ্যা – রামজন্মভূমি – বাবরী মসজিদ কা সচ’ (অযোধ্যা – রামজন্মভূমি – বাবরী মসজিদের সত্যতা) শীতলা সিং তাঁর বইয়ের ১১০ পৃষ্ঠায় এই ঘটনার ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন। তিনি এটা জেনেছেন কে এম সুগার মিলস এর মালিক এবং প্রবন্ধ সঞ্চালক লক্ষ্মীকান্ত ঝুনঝুনওয়ালার কাছ থেকে। ঝুনঝুনওয়ালা সেই সময়ের বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রবীন নেতা বিষ্ণুহরি ডালমিয়ার জন্য কিছু কাগজপত্র নেবার জন্য শীতলা সিংয়ের কাছে এসেছিলেন, এরপর কাগজ নিয়ে দিল্লি চলে যান। পরের দিন যখন ফায়যাবাদ ফিরে আসেন তখন তিনি উপরে উল্লিখিত বালাসাহেব দেবরস ও অশোক সিঙ্ঘলের মধ্যে কথোপকথন শোনান।

শীতলা সিং তাঁর বইয়ের ১১০ পৃষ্ঠায় আরও লেখা আছে যে, ঝুনঝুনওয়ালার কথা অনুযায়ী ২৭ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সংখ্যায় আরএসএস এর মুখপাত্র ‘পাঞ্চজন্য’ এবং ‘অর্গানাইজার’ এর মধ্যে এই সংবাদ প্রকাশিত হয় যে, রাম মন্দির অবশ্যই নির্মাণ হবে। সেখানে আরও সংবাদ প্রকাশিত হয় যে রাম ভক্তদের বিজয় হয়েছে এবং কংগ্রেস সরকার রাম মন্দির নির্মাণের জন্য বাধ্য হয়ে গেছে। সংবাদ অনুযায়ী মন্দির নির্মাণের জন্য ট্রাস্টও হবে। ঝুনঝুনওয়ালার কথা অনুযায়ী এই খবর বালাসাহেব দেবরস জানতে পারলেন তখন তিনি আরএসএস এর দিল্লির অফিস কেশব কুঞ্জের ঝান্ডেবালানে অশোক সিঙ্ঘলকে ডেকে পাঠান। তিনি অশোক সিঙ্ঘলকে বলেন,
“তুমি বহুদিনের পুরাতন স্বয়ংসেবক। তুমি এই যোজনার সমর্থন করলে কি ভাবে?”
অশোক সিঙ্ঘল বলেন,
“আমাদের আন্দোলন তো রাম মন্দিরের জন্যই ছিল। এটা যদি গ্রহণ করা হয় তো সেটাকে স্বাগত জানানো উচিৎ।”
এই কথা শুনে বালাসাহেব দেবরস একেবারেই বিগড়ে যান এবং বলেন, “তুমহারি আকল ক্যা ঘাস চরনে গায়ী হ্যায়?” অর্থাৎ সহজ বাংলায় বলা যায় তিনি অশোক সিঙ্ঘলকে বলেন,
“তোমার কি বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়েছে। এই দেশে মোট ৮০০ রাম মন্দির বিদ্যমান রয়েছে, আর একটি যদি হয়ে যায় তাহলে ৮০১টি হবে। কিন্তু আমাদের রাম মন্দিরের এই আন্দোলন জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করছিল, এর সমর্থন বৃদ্ধি পাচ্ছিল যার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা রাজনৈতিকভাবে দিল্লিতে সরকার বানাবার পরিস্থিতি পর্যন্ত পৌঁছে যেতাম। আর তুমি রাম মন্দির নির্মাণের ব্যাপারটিকে সমর্থন করে বাস্তবে এই আন্দোলনের পিছনে ছোরা ঢুকিয়ে দিয়েছো। তাই রাম মন্দির নির্মাণের প্রস্তাব গ্রহণ করা যাবে না।”
তখন অশোক সিঙ্ঘল বলেন,
“মন্দির নির্মাণের আন্দোলনে অবৈদ্যনাথ, জাস্টিস দেবকীনন্দন অগ্রবাল সহ স্থানীয় এবং বাইরের কয়েকজন নেতাও শামিল হয়েছেন।”
এই কথা শুনে বালাসাহেব দেবরস বললেন,
“এদের কাছে থেকে বেরিয়ে এসো, কারণ এরা আমাদের স্বার্থ সিদ্ধির পথে সব থেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।”
এখানে সব থেকে বড় আশ্চর্য ব্যাপার হল যে এই সংবাদ আরএসএস এর মুখপাত্র ‘পাঞ্চজন্য’ এবং ‘অর্গানাইজার’ ছাড়া সেই সময় দেশের কোন মিডিয়ায় ছাপা হয়নি। তাই এটা স্পষ্ট যে, এই খবরের সূত্র বিশ্ব হিন্দু পরিষদের লোকেরাই ছিল। মহন্ত নৃত্যগোপাল দাস এই ট্রাস্টের অধ্যক্ষ ছিলেন এবং রাম জন্মভূমি আন্দোলনের অগ্রগণ্য নেতা পরমহংস রামচন্দ্র দাসও এর মধ্যে শামিল ছিলেন। এঁরা দুজনেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ দ্বারা চালানো রাম মন্দির আন্দোলনের শীর্ষ নেতা ছিলেন। উক্ত ফরমুলা মানার জন্য মুসলিম নেতারাও প্রস্তুত ছিলেনঃ বিদেশী টেকনোলজি ব্যবহার করে বাবরী মসজিদের কোন ক্ষতি না করেই অন্য জায়গায় সরিয়ে দেওয়া হবে এবং যেটাকে রাম চবুতরা বলা হয় সেই জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণ করার ফরমূলা ট্রাস্টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সেটাকে প্রথমে মুসলিম নেতা সৈয়দ সাহাবুদ্দীন আপত্তি করেছিলেন। তিনি মনে করতেন এটা হয়ত আরএসএস এর কোন চাতুরতা হবে। তিনি স্বীয় পত্রিকা ‘মুসলিম ইন্ডিয়া’তে এই ফরমূলার বিরোধীতা করেন এবং অন্যান্য মুসলিম নেতাদেরকেও বলেন এই বৈঠক থেকে দূরে থাকতে। শীতলা সিংয়ের বক্তব্য অনুযায়ী তিনি যখন ফরমূলার বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেন তখন সৈয়দ সাহাবুদ্দীনও ট্রাস্টের বানানো সমাধান করা ফরমূলা মানতে রাজী হয়ে গেলেন। এমনকি তিনি তাঁর সহযোগীকে দিয়ে দিল্লীর জামা মসজিদের ইমাম আব্দুল্লাহ বুখারীর সাথে কথা বলান এবং তাঁকেও রাজী করান।

‘অযোধ্যা – রামজন্মভূমি – বাবরী মসজিদ কা সচ’ বইয়ে শীতলা সিং আরও লিখেছেন যে মুসলিম নেতারা আধুনিক বিদেশী টেকনোলজি ব্যবহার করে বাবরী মসজিদের কোন ক্ষতি না করেই বিতর্কিত স্থান থেকে সরিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি মেনে নেন। উল্লেখ্য যে এইভাবে ইমারত সরিয়ে দেওয়ার কাজ অন্য দেশে এর আগেও হয়েছিল। দুবাইয়ে একটি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য একটি মসজিদকে অন্য স্থানে প্রতিস্থাতি করা হয়। মুসলিম নেতারা ধার্মিক সহমতি অর্জন করার জন্য পাঁচটি মুসলিম প্রধান দেশে উলামাদের চিঠি লিখেছিলেন যার মধ্যে তিনটি দেশ থেকে এর সহমতিও এসেছিল। এইসব ব্যাপারগুলি তৎকালীন গৃহমন্ত্রী বুটা সিং এবং উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে বাহাদুর সিং এবং পরে নারায়ন দত্ত তিওয়ারীকে জানানো হয়। মন্দির নির্মাণের স্থানীয় ট্রাস্টের এই সমাধানকারী হস্তক্ষেপের সবথেকে বড় সমর্থক ছিলেন মহন্ত অবৈদ্যনাথ। তিনি এই ট্রাস্টের সদস্য ছিলেন না ঠিকই থে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সব থেকে বড় নেতা ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মহন্ত পরমহংস, নৃত্যগোপাল দাস, জাস্টিস দেবকীনন্দন অগ্রবাল, নারায়নচারী প্রভৃতি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতাগণ আরএসএস থেকে আলাদা অবৈদ্যনাথের দলে ছিলেন। অবৈদ্যনাথ আরএসএস এর গতিবিধি দেখে বুঝতে পেরে যান এরা মন্দির বানাবে না। তাই তিনি শীতলা সিংয়ের কাছে এসে বলেন,
“বেটা মন্দির বানিয়ে দাও, এই নেতারা (আরএসএস) শুধু ভোট আর নোট চাই।”
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একটি দল আরএসএস-এর রাম মন্দির নির্মান বিরোধী কর্মকাণ্ডে একেবারেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। মন্দির না বানাবার বাহানাও বের করা হয়েছিলঃ বালাসাহেব দেবরস মন্দির বানাতে নারাজ হয়ে গেলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা ক্ষিপ্ত হয়ে যান। দেবরস সাহেব পরিস্কার বলে দেন যে মন্দির বানানোর পরিকল্পনা থেকে যে দূরে সরে আসেন। কিছুদিন পর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হল যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা বলতে লাগলেন, এই পরিকল্পনাতে এটা নির্দিষ্ট হয়নি যে মন্দিরের গর্ভগৃহ কোথায় হবে। আশ্চর্য্যজনক ব্যাপার হল যে জানুয়ারী ১৯৮৮ সালে সঙ্ঘের মুখপাত্রে ছাপা হয় শীতলা সিং বামপন্থী চিন্তাধারার ব্যাক্তি সেজন্য তার উপর ভরসা করা যাবে না। শীতলা সিং বলেন,
“এইভাবে মন্দির বানাবার সমস্ত পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়।”
পাঠকদের একথা আর বলার দরকার নেই যে কিভাবে ১৯৯২ সালে ৬ ডিসেম্বর বাবরী মসজিদ ধ্বংস করে দেওয়া হয় এবং তার পর থেকেই এ নিয়ে জোরদার রাজনীতির ময়দান গরম করা হচ্ছে।
লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম