লিখেছেনঃ ফ্রেডারিক এম ওয়াটকিনস
প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে বলে লেনিন যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তা সফল না হলে ও, এর পর পাশ্চাত্য দুনিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ভয়াবহ সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের দেনা ও ক্ষতিপূরণ শােধ করা এবং যুদ্ধকালীন অর্থনীতিকে শান্তিকালীন অর্থনীতিতে পুনর্বিন্যস্ত করা প্রভৃতি বিষয় বিভ্রান্তকর সমস্যার সৃষ্টি করে এবং এ সব সমস্যা চিরাচরিতপদ্ধতিতে সমাধান করা সম্ভব ছিল না। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ও ব্যবসায়ে মন্দা সে সময়কার সাধারণ ঘটনা হয়ে ওঠে। অর্থনৈতিক সঙ্কট ও অনিশ্চয়তার ফলে রাজনৈতিক বিরােধ তীব্র ও ব্যাপক আকার ধারণ করে। এ অবস্থায় সর্বমতের ঐক্য বজায় রাখা খুবই কঠিন। যেসব দেশে দীর্ঘকাল হতে নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত, সেসব দেশে নেতাদের পক্ষে পার্লামেন্টারী সংখ্যাগুরুদের সমর্থন অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে উঠেছিল, এবং যেসব দেশে গণতন্ত্র তখনাে দৃঢ়মূল হয় নাই, সেসব দেশে এটা প্রায় অসম্ভব ছিল। মন্ত্রিসভাসমূহের অতিদ্রুত ভাঙ্গাগড়া চলছিল, কিন্তু জরুরী রাজনৈতিক সমস্যার কোন সমাধানই হচ্ছিল না। কর্মতৎপরতা যে সময় খুবই দরকার ছিল, সে সময় নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রসমুহে পক্ষাঘাত ছড়িয়ে পড়ছিল এবং তার নিরাময়ের কোন উপায় আছে বলে মনে হচ্ছিল না।
ফলে ইউরােপের বহুলােক একনায়কত্ব নিয়ে রাশিয়ার পরীক্ষার দিকে অনুকূল মনােভাব সহকারে তাকাচ্ছিলেন। শ্রমিকশ্রেণীর অধিকাংশই সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রতি অনুগত থাকলেও বেশ উল্লেখযােগ্য সংখ্যক কমিউনিস্টদের দিকে চলে যায়। একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গেল, এবং সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও একনায়কত্ববাদী মনোেভাব প্রসার লাভ করলো। সর্বহারাদের স্বার্থে কাজ করাই লেনিনের উদ্দেশ্য ছিল, এটা স্বীকার করে নিলেও তার টোট্যালিটেরিয়ান পদ্ধতি অন্যত্র কেন সমভাবে প্রযুক্ত হবে না, তার অন্তর্নিহিত কোন যুক্তি নাই। যে সব লােকের নিকট মার্কসবাদ ব্যাপারটি অভিশাপস্বরূপ, তাদের কাছেও কমিউনিজমের স্বল্পসংখ্যার একনায়কত্ব আকর্ষণীয় ছিল। স্বল্পসংখ্যক পেশাদার বৈপ্লবিক যদি রুশ সাম্রাজ্য জয় করে নিয়ে সেখানে তাদের নেতাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী শাসন কায়েম করতে পারে, তাহলে অন্য জায়গায় একই ধরনের শৃংখলা ও নেতৃত্বের আদর্শ গ্রহণ করে বিপ্লবী দলসমূহ একই ধরনের সাফল্য লাভ করতে পারবে না কেন? যে সময় বলিষ্ঠ কার্যক্রমের দরকার, সে সময় দৃশ্যত নিয়মতান্ত্রিক সরকার কোন কাজ করতেই সক্ষম ছিল না। এ অবস্থা থেকে সিদ্ধান্তে আসা সহজ ছিল যে একনায়কত্বই ভবিষ্যতের ভরসা, বিংশ শতাব্দীর রাজনীতির একমাত্র নির্ভরযােগ্য রূপ।
॥ ফ্যাসিবাদ এর অভ্যুত্থান ॥
যারা এ মনােভাব গ্রহণ করেছিল, তারা সাধারণত ফ্যাসিস্ট নামে পরিচিত। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর বিশাল মতবাদভিত্তিক আন্দোলনসমূহের ন্যায় ফ্যাসিবাদ মূলত আন্তর্জাতিক আন্দোলন ছিল না। বিভিন্ন দেশে স্বতন্ত্র পরিবেশে স্বাধীনভাবে এটার উদ্ভব ঘটে। ফ্যাসিবাদ আন্দোলনসমূহের মাঝে সৌসাদৃশ্য হলাে যে প্রত্যেকটি আন্দোলনের পেছনেই একনায়কত্ববাদের মাধ্যমে স্বসমাজের শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধির দৃঢ়সঙ্কপের অভিব্যক্তি ঘটেছিল। নিয়মতান্ত্রিক সরকার তাদের সবার সাধারণ শত্রু ছিল, এবং তারা মনে করতো যে অক্ষম ও মেরুদণ্ডহীন সরকার মৃত্যু ও দুর্নীতি ছাড়া অন্য কোন দিকে জাতিকে পরিচালিত করতে পারবে না। তাছাড়া, মারাত্মক জীবাণুর ন্যায় কমিউনিজম গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রাণধর্ম ক্ষয় করে আনছিল! ফ্যাসিস্টরা এ সমস্যার সমাধান হিসাবে, উদ্দীপনাময় ও প্রশ্নাতীত নেতৃত্বের অধীনে সংখ্যালঘু সুশৃংখল পাটি সদস্যদের হাতে সকল ক্ষমতা ন্যস্ত করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার এবং তুলনাবিহীন সুবিপুল কৃতিত্ব হাসিলের পথ দেখিয়েছিল। এভাবে দুর্বল সংশয় ও বিরামহীন সংঘাতে জর্জরিত বর্তমান বিশ্বের জায়গায় গৌরবােজ্জ্বল নিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ বীরধর্মী নয়া দুনিয়ার জন্ম হবে।
যে অ-মার্কসবাদী দলটি প্রথম একনায়কত্বমূলক ক্ষমতা দখল করে এবং গােটা আন্দোলনকে নিজেদের নামানুসারে পরিচিত করে তুলে, সেটা হচ্ছে ইতালীর ফ্যাসিস্ট পার্টি। যুদ্ধোত্তর নিয়ণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্কট সে দেশেই সবচেয়ে মারাত্মক ছিল। সে সরকারকে অপসারিত করে তার স্থান যে দলটি প্রহণ করে সে দলটি সম্পূর্ণরূপে এক ব্যক্তি, বেনিতাে মুসোলিনীর সৃষ্টি। বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের সদস্য মুসােলিনী প্রথম মহাযুদ্ধে ইতালীর যােগদানের প্রশ্নে দলত্যাগ করেন। জাতীয় স্বার্থের দিক হতে তিনি যুদ্ধে লাভের ভাগ হতে ইতালী বঞ্চিত হবে সেটা চাইতেন না। তাই তিনি গোঁড়া মার্কসবাদীদের যুদ্ধবিরােধী অভিমত অগ্রাহ্য করে অন্তত শেষের দিকে ইতালীর বিজয়ী মিত্রশক্তির পক্ষ অবলম্বনের জন্য দাবী তুলেন। যুদ্ধোত্তরকালীন ব্যবস্থা অনুসারে উল্লেখযােগ্য ঔপনিবেশিক এলাকা দখলে ব্যর্থতা ও আনুষঙ্গিক অর্থনৈতিক মন্দার মাঝে ধর্মঘট বানচাল করা ও বৈপ্লবিক মার্কসবাদীদের দখলকার্যে নিযুক্ত জাতীয়তাবাদী মনােভাবাপন্ন যুদ্ধফেরতদের বা পিনী গােষ্ঠীর সমসম্প্রসারিত প্রতিষ্ঠানের তিনি সর্বজন স্বীকৃত নেতা হয়ে ওঠেন। এ গােষ্ঠীই ভবিষ্যৎ ফ্যাসিস্ট পার্টির কেন্দ্রশক্তি। ১৯২২ সালে এ জোট রুশ বিপ্লবকালীন লেনিনের দল হতে কিছুটা বড় ছিল মাত্র। ধাপা ও বলপ্রয়ােগের সুকৌশল সমন্বয়ের মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষকে বুঝতে সমর্থ হয়েছিলেন যে ইতালীর পার্লামেন্টারী জীবনের দুরারােগ্য অনিশ্চয়তা দূর করতে এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে কেবলমাত্র তিনিই সক্ষম। রাজা তাঁকে একটি সর্বদলীয় মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। এ সুবিধাজনক পদে থেকে তিনি শীঘ্রই সকল বিরােধী দলকে নির্মল করতে এবং মূলত টোট্যালিটেরিয়ান বা সর্বাত্মক রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের আসনে ফ্যাসিস্ট দলকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন।
॥ ফ্যাসিবাদ এর কৃতিত্ব ও ত্রুটি ॥
কোন কোন ব্যাপারে ফ্যাসিস্ট শাসন সাফল্য লাভ করেছিল। এটা ইতালীর পার্লামেন্টারী রাজনীতির অনিশ্চয়তার দুষ্টক্ষত অপসারণে সক্ষম হয়েছিল, এবং দীর্ঘকালের জন্য সরকারী স্থায়িত্বের ব্যবস্থা করতে পেরেছিল। কয়েকটি আমূল সংস্কারমূলক কাজও এ সময় হয়েছিল। বিদেশী পর্যবেক্ষকরা সপ্রশংস দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছেন যে “যথাসময়ে ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা মুসোলিনী করতে পেরেছেন।” যে-কোন মূল্যে কর্মতৎপরতার যারা অনুরক্ত তাদের কাছে এ কৃতিত্ব উচ্ছসিত প্রশংসারই বিষয়। মুসোলিনী বিস্ময়কর রাজনৈতিক প্রতিভার অধিকারী বলে পরিচিত হয়ে উঠলেন এবং ইতালীর উদাহরণ বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ফ্যাসিবাদী আন্দোলন সৃষ্টির অনুপ্রেরণা স্বরূপ হয়ে ওঠে।
অবশ্য ইতালীর ফ্যাসিবাদ এর সবচেয়ে সুসময়েই রুশ কমিউনিজমের প্রচণ্ড নির্মম বৈপ্লবিক শক্তির সাথে তুলনীয় কোন কৃতিত্ব অর্জনে সক্ষম হয় নাই। অন্তত আংশিকভাবে এটা ফ্যাসিস্ট মতবাদের অকার্যকারিতারই নিদর্শন। সম্ভবত গােড়ার দিকে তার মার্কসবাদের প্রতি আনুগত্যের প্রতি ক্রিয়ার ফলেই তিনি প্রথমত ফ্যাসিজমের মতবাদগত দিকটিকে ছােট করে দেখাতে চেষ্টা করেছেন। প্রথম দিকে পাটির মূলমন্ত্র ছিল অ্যাকশন বা কর্ম। কিন্তু সে অ্যাকশন বা কর্মের প্রকৃতি ও লক্ষ্য কি, তা সুনির্দিষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা খুব কমই হয়েছে। বিশ্ববিপ্লবের মাধ্যমে মানবীয় সমস্যার পূর্ণ সমাধানে পৌঁছার লােভনীয় কমিউনিস্টতত্ত্বের সাথে তুলনীয় এমন কিছু ফ্যাসিজমের ছিল না, যাতে মানুষের কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করে তােলা যেতে পারে এবং তাকে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হতে পারে। পরিশেষে মুসােলিনী বুঝতে পারলেন যে এটা ভুল হচ্ছে, এবং তিনি তা সংশােধন করায় উদ্যোগী হলেন। ‘এনসাইকলােপেডিয়া ইতালীয়ান’-এ “ফ্যাসিজম” নামে তার নিজের স্বাক্ষরিত যে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, বিলম্বে হলেও তাতে আন্দোলনের একটি কার্যকরী মতবাদের ভিত্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এটা তেমন সফল হয় নাই। জাতীয় অনৈক্য দূর করার মূলত নেতিবাচক চিন্তাধারা এবং প্রাচীন রােমের গৌরব ফিরিয়ে আনার অসম্ভাব্য লক্ষ্য ছাড়া ইতালীর ফ্যাসিবাদ মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নতুন কোন প্রতিশ্রুতি কখনাে দিতে সমর্থ হয় নাই। অবশ্য সে সময়কার জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগকে উচ্ছসিত করে তােলার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে আভ্যন্তরীণ ঐক্য ও সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাভিলাষের কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু তা তেমন নতুন বা উত্তেজনাপূর্ণ ছিল না যে একটি যথার্থ বিপ্লব তাতে ঘটে যেতে পারে। বস্তুত, ফ্যাসিস্টরা সরকারী সুবিধাভােগী একটি ছােট গােষ্ঠী বিশেষ ছিল। বৈপ্লবিক পরীক্ষাকার্য চালাবার পরিবর্তে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার সুযােগ সুবিধাভােগের দিকেই তাদের অধিক আগ্রহ ছিল। শুধু ইতালীতেই নয়, অন্যান্য দেশেও কার্যকরী মতবাদের অভাব ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের দুর্বলতা হয়ে রয়েছিল।
[অনুবাদকঃ সৈয়দ শাহাদাৎ হোসেন]
আরও পড়ুন,
১। সাভারকর : এখন শিশুপাঠ্যে ‘দেশপ্রেমিক’ সাভারকারের জীবনী
২। শ্যামাপ্রসাদ ও জনসংঘ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।