লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর বিপ্লবী হসরত মোহানী (রহঃ) ১ জানুয়ারি ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সারির একজন সক্রিয় বিপ্লবী, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এবং উর্দু ভাষায় শক্তিশালী একজন বিচক্ষণ কবি। তাঁর আসল নাম ছিল সৈয়দ ফজল-উল-হাসান। তিনি বহুবার হজ পালন করেছিলেন বলে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। গীতিকার হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল গগনচুম্বী! ‘চুপকে চুপকে রাত দিন আঁসু বহানা ইয়াদ হ্যায়’ — এই বিখ্যাত গজলটি তাঁরই লেখা। হিন্দী ছায়াছবি নিকাহ (১৯৮২)তে এই গানটি গেয়েছিলেন গজল সম্রাট জনাব গোলাম আলি এবং ‘গজল সম্রাট’ জগজিৎ সিংহ। এ ছাড়া হসরত মোহানী উর্দু-এ-মুয়াল্লা নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন।
হসরত মোহানীর পূর্বপুরুষগণ ইরানের রাজাভি খোরাশান প্রদেশের রাজধানী নিশাপুরের অধিবাসী ছিলেন! তিনি ‘হসরত’ ছদ্মনামে উর্দু কবিতা লিখতেন। আর ‘মোহানী’ হচ্ছে তাঁর জন্মভূমি। সাই নদীর তীরে ‘মোহান’ শহরটি ভারতের উত্তরপ্রদেশের উনান্য জেলায় অবস্থিত। ‘মোহ’ ও ‘হান’ এই দুটি শব্দ মিলে ‘মোহান’ শব্দটি গঠিত হয়েছে। হিন্দিতে ‘মোহ’ মানে প্রেম এবং ‘হান’ মানে কম। তাহলে ‘মোহান’ শব্দের অর্থ দাঁড়ালো ‘কমপ্রেম’। রামচন্দ্র যখন ১৪ বছরের জন্য বনবাসে যান তখন এই মোহান নামক স্থানেই তিনি সীতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তাই এই স্থানের নাম ‘মোহান’ বা ‘কমপ্রেম’। কবিরাজি হাকিমি চিকিৎসা ও অভিনয়ের জন্যও স্থানটির বিশেষ খ্যাতি রয়েছ! প্রাচীনকালে অনেকে ভুল করে স্থানটিকে গ্রীসের অংশ বলে মনে করতেন। ব্রিটিশ যুগে স্থানটি লক্ষ্ণৌ জেলার অধীন ছিল। সেখানে শিয়াদের একটি দরগাহও রয়েছে ‘কাসিম শাহ’ নামে।
কট্টর স্বাধীনতা সংগ্রামী হসরত মোহানী শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অত্যন্ত মুগ্ধ ছিলেন। কৃষ্ণের প্রতি গভীর ভালোবাসা জ্ঞাপন করে তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন।
হসরত মোহানী (রহঃ) এর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কানপুরের ফতেহপুর হাসওয়াহতে। ১৯০৩ সালে বি.এ. পাস করেন মোহাম্মেডিয়ান এ্যংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ থেকে। পরে এই কলেজটি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। সেখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, আলি ভ্রাতৃদ্বয়—মাওলানা মহম্মদ আলি জওহর ও মাওলানা শওকত আলি। কবিতা লেখার ব্যাপারে তাঁর শিক্ষক ছিলেন তাসলিম লাক্ষ্ণৌবী ও নাসিম দেহলবী। ছাত্রজীবনে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধ লেখার জন্য তাঁকে তিন তিনবার কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়াও তিনি বহুবার কারাবরণ করেছেন।
তাঁর প্রকাশিত কয়েকটি গ্রন্থের নাম হচ্ছে যথাক্রমে, ১. ‘কুল্লিয়াত-ই-হসরত মোহানী’ (হসরত মোহানীর কাব্য সংকলন) ২. শারহ-ই-কালাম-ই-গালিব (গালিবের কাব্যের ব্যাখ্যা) ৩. নুকায়েত-ই-সুখান (কবিতার গুরুত্বপূর্ণ দিক) ৪. মুশাহিদাত-ই-জিন্দান (জেলখানায় পর্যবেক্ষণ) ৫. তাজকিরাতুল সুয়েরা (কবিদের ওপর প্রবন্ধ)।
হসরত মোহানী বহু বছর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। তিনি এক সময় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং ১৯১৯ সালে এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতীয় সংবিধানের খসড়া যখন প্রস্তুত হয়, সেই সময় তিনি গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। তাঁর মনে হয়েছে, সংবিধানে মুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকারের যথার্থ প্রতিফলন নেই। তাই তিনি সংবিধানে সাক্ষর করেননি। সেই মানসিকতায় মোহানী ভারতীয় মুসলমানদের দাবি–দাওয়া আদায়ের ব্যাপারে মুহাম্মাদ আলি জিন্নার নেতৃত্বকে সমর্থন করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভারত ভাগ হবার ঘোষণার পর প্রতিবাদে তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি রাশিয়ার আদলে ভারতবর্ষেও কনফেডারেশন করতে চেয়েছিলেন! ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে গেলে তিনি পাকিস্তান চলে যাননি, ভারতে থেকে যাওয়া মুসলিমদের বিভিন্ন অসুবিধার বিষয়ে সাহায্য ও প্রতিনিধিত্ব করার অভিপ্রায়ে তিনি ভারতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় শুধু হসরত মোহানীই নয় জশ মালিহাবাদির মতো অনেক মুসলিম নেতা ও উর্দু কবি সাহিত্যিকেরাও পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরিবর্তে ভারতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মোহানী কখনো সরকারি ভাতা গ্রহণ করেননি বা সরকারি বাসভবনে থাকতেন না। তার বদলে তিনি মসজিদে অবস্থান করতেন এবং সংসদে যেতে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে ‘টাঙ্গা’ ব্যবহার করতেন। তিনি একজন ধার্মিক পুরুষ ছিলেন এবং অত্যন্ত সহজ–সরল জীবনযাপন করতেন। মোহানী বেশ কয়েকবার সৌদি আরবের মক্কায় হজ পালন করতে গিয়েছিলেন। দেশে রেলপথে যাত্রার সময় তিনি বরাবর তৃতীয় শ্রেণিতে যাতায়াত করতেন। কেন তিনি ওভাবে ভ্রমণ করেন জানতে চাইলে তিনি বলতেন, “কারণ ট্রেনে কোন চতুর্থ শ্রেণি নেই, তাই।”
হসরত মোহানী ব্রিটিশ শক্তিকে ভারত থেকে উৎখাতের জন্য ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। ১৯০৩ সালে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। বহু বছর তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন। সে সময় রাজনৈতিক বন্দিদের প্রতিও সাধারণ অপরাধীদের মতো আচরণ করা হতো, তাদের কায়িক পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হতো। ১৯২১ সালের অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্বের ভাষণে তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার (আজাদ-এ-কামিল)-এর দাবি উপস্থাপন করেন। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের পর কমিউনিস্ট মনোভাবী মাওলানা হসরত মোহানী, ইউনাইটেড সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের (ইউএসএসআর, বর্তমান রাশিয়ান ফেডারেশন) অনুকরণে ভারতেও একটি কনফেডারেশন স্টাইলের সংবিধান দেখতে চেয়েছিলেন। তার প্রস্তাবে ছয়টি ফেডারেশন ছিল—১. পূর্ব পাকিস্তান ২. পশ্চিম পাকিস্তান ৩. মধ্য ভারত ৪. দক্ষিণ-পূর্ব ভারত ৫. দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত এবং ৬. হায়দরাবাদ ডেকান। কিন্তু সেটি অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।
১৯২৫ সালে যখন কানপুরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়, তিনি তারও একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন অর্থাৎ তিনি ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির চারজন প্রতিষ্ঠাতার একজন। তিনি ও স্বামী কুমারানন্দই ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা ঘোষনাকারী। ১৯২১ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে আহমেদাবাদ সেসনে এই দাবি করেছিলেন। তিনি ভারতীয় সুপ্রীম ল ‘দি কন্সটিটিউশন অফ ইন্ডিয়ার’ প্রণেতাদের একজন ছিলেন! তাঁর পত্রিকা উর্দু-ই-মুয়াল্লাতে ব্রিটিশবিরোধী ভাবধারা প্রচারের জন্য বিশেষ করে মিশরে ব্রিটিশ নীতির বিরুদ্ধে পত্রিকাটিতে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করায় তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়।
মাওলানা হসরত মোহানী ভারতের লক্ষ্ণৌ শহরে ১৯৫১ সালের ১৩ মে মারা যান। ওই সালেই মাওলানা নুসরত মোহানী তাঁর নামে প্রতিষ্ঠা করেন হসরত মোহানী মেমোরিয়াল সোসাইটি। মহারাষ্ট্রের থানে জেলার মুম্বড়া এলাকার কাদর প্যালেসে মাওলানা হসরত মোহানীর নামে একটি রাস্তা রয়েছে। কানপুরের চামংগানিতে মাওলানা হসরত মোহানীর নামে একটি হাসপাতাল আছে। কানপুরে মাওলানা হসরত মোহানী স্ট্রিট নামে একটি রাস্তাও রয়েছে। বিথুর জাদুঘরে মাওলানা হসরত মোহানী গ্যালারি অবস্থিত। কলকাতার মেটিয়াবুরুজে তাঁর নামাঙ্কিত হসরত মোহানী মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল আছে। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসও তাঁর নামে রয়েছে। ভারত ছাড়া পাকিস্তানের করাচিতেও হসরত মোহানী মেমোরিয়াল সোসাইটি, হসরত মোহানী মেমোরিয়াল লাইব্রেরি ও হল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতি বছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে এই ট্রাস্টের পাশাপাশি ভারত ও পাকিস্তানের আরও অনেক সংস্থার একটি স্মারক বৈঠক হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের কোরাঙ্গি শহরে, করাচির ফিন্যান্সিয়াল হাব-এ তাঁর নামে একটি বিখ্যাত রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।
ইতিহাসবিদ সত্যেন সেন হসরত মোহানীর ব্যাপারে লিখেছেন, উন্নত মেধার ছাত্র হিসাবে তিনি তাঁর শিক্ষকমণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ছিলেন। তিনি সরকারী বৃত্তি লাভ করে আলিগড় কলেজে এসে ভর্তি হলেন। এখানে অতি অল্পদিনের মধ্যেই তিনি তাঁর রচনার গুণে এবং একজন সংস্কৃতিসেবী হিসাবে সকলেরই মন জয় করে নিয়েছিলেন। ভবিষ্যতে তিনি যে একজন উচ্চ শ্রেণীর লেখক বলে পরিচিত হবেন, এ বিষয়ে কারোর মনে কোনও সংশয় ছিল না। কিন্তু তরুণ হসরত মোহানীর মুল চিন্তাধারা কোন আদর্শকে লক্ষ্য করে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, তাঁর অত্যন্ত পরিচিত যারা তাঁরাও তা কল্পনা করতে পারেনি। সকলের দৃষ্টির অলক্ষ্যে মধ্যরাত্রির গোপন আশ্রয়ে তিনি শ্রীঅরবিন্দ ও বাল-গঙ্গাধর তিলকের রাজনৈতিক সাহিত্যের চর্চায় ডুবে থাকতেন। সে সময় এটাই তাঁর প্রধান আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এত গোপনীয়তা কেন? তার কারণ আলিগড় কলেজ কর্তৃপক্ষ বৃটিশ বিরোধী রাজনীতি বা যে কোনও ধরনের প্রগতিশীল রাজনীতিকে বিষ-দৃষ্টিতে দেখতেন। সেই কলেজের এমন একজন জনপ্রিয় ছাত্র যে রাজদ্রোহাত্মক সাহিত্যের মধ্যে মগ্ন হয়ে থাকতে পারে, এমন কথা কেউ ভাবতেও পারত না।
একটি বিশেষ ঘটনার মধ্য দিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের অতি প্রিয়পাত্র হসরত মোহানীর প্রকৃত স্বরূপটা একদিন প্রকাশিত হয়ে পড়ল। কলেজের স্টুডেন্টস ইউনিয়নের উদ্যোগে একটি উর্দু কবিতার মোশায়ার (কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান) আয়োজন করা হয়েছিল। হসরত মোহানী-ই ছিলেন তার প্রধান উদ্যোক্তা। এই মোশায়রা শেষ হয়ে যাওয়ার পর কলেজের অধ্যক্ষ থিয়োলর মরিসন এর কাছে এই খবর গিয়ে পৌঁছুল যে, যারা স্ব-রচিত কবিতা আবৃত্তি করেছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নাকি শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করে গিয়েছিলেন।
এই ব্যাপারে কৈফিয়ৎ দেবার জন্য অধ্যক্ষের কাছে মোশায়রার মুল উদ্যোক্তা হসরত মোহানীর ডাক পড়ল। এই শালীনতা ভঙ্গের প্রশ্ন নিয়ে অধ্যক্ষ ও হসরত মোহানীর মধ্যে এক তিক্ত বাদানুবাদ ঘটে গেল। এই প্রসঙ্গে হসরত মোহানী সেদিন বলেছিলেন, “স্যার, আমাদের এই কবিরা মানবতার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ। আপনাদের সমাজে এর শালীনতা ভঙ্গের জন্য নিন্দিত হবেন, এটা বিচিত্র কিছু নয়।”
মুখের উপর এই জবাব পেয়ে অধ্যক্ষের ক্রোধের সীমা রইল না। তিনি এই ব্যাপারে উপযুক্ত কৈফিয়ৎ দানের জন্য তখনই কলেজের ট্রাস্টি মোর্ডের এক সভা ডাকালেন। এই সভার সিদ্ধান্ত কি হবে তা আগে থেকেই জানা ছিল। ১৯০৩ সাল আলিগড় কলেজের পক্ষে একটি স্মরণীয় বৎসর। এই বছরই সর্বপ্রথম একজন বিদ্রোহীকে (হসরত মোহানীকে) কলেজ থেকে বহিস্কৃত করা হয়েছিল।
এবার তাঁর জীবনে এক নূতন অধ্যায় নেমে এলো। সে যুগে বি.এ. ডিগ্রীর যথেষ্ট মূল্য ছিল, কিন্তু এই ডিগ্রী তাঁর কোন বিশেষ কাজে এলো না। সে সময় আইন ব্যবসা ছিল অর্থোপার্জনের সর্বোৎকৃষ্ট পথ। কিন্তু হসরত মোহানী সেই পথে না গিয়ে সাহিত্যের পথকে বেছে নিলেন এবং কংগ্রেসের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। এর ফলে সারাজীবন ধরে তাঁকে দারিদ্র্যের বোঝা টেনে চলতে হয়েছে। এ সময় তিনি একটি উর্দু পত্রিকা পরিচালনা করতেন। কংগ্রেস কর্মী হিসাবে তিনি ১৯০৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের প্রতিটি বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। ১৯০৭ সালে সুরাট কংগ্রেস সম্মেলন গোখেলের নরমপন্থী দল এবং তিলকের চরমপন্থী দলের সংঘর্ষের ফলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তিলকের আদর্শে প্রভাবিত হসরত মোহানী চরমপন্থীদের সঙ্গে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।
ভারতীয় জনমতের মুখ চাপা দেবার উদ্দেশ্যে ১৯০৮ সালে সরকার কর্তৃক কুখ্যাত ‘নিউজ পেপারস, এ্যাক্ট’ জারি করা হয়েছিল। এই আইনের বলে হসরত মোহানী কর্তৃক পরিচালিত পত্রিকাটিতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে এক মামলা আনা হল। এই মামলায় তিনি দুই বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচশত টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। এইবারই তিনি প্রথম দেশসেবার পুরস্কার পেলেন। এই একই কারণে ভবিষ্যতে তাঁকে আরও পাঁচবার কারাবরণ করতে হয়েছিল।
হসরত মোহানী চিরদিনই সরল ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করে গেছেন। উনিশ শতকের কংগ্রেস উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিশ শতকের প্রথম ভাগে কৃচ্ছ্বতাপূর্ণ সাধনা ও আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা বজায় রেখে যাঁরা কংগ্রেসকে সাধারণ মানুষের মধ্যে টেনে নামিয়ে এনেছিলেন, হসরত মোহানী তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর এই আপোসহীন আদর্শের জন্য কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যেও কারো কারো সঙ্গে তাঁর সংঘাত ঘটেছিল। সে সময় জিন্নাহ্ সাহেব কংগ্রেসের মধ্যে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে প্রবল মতবিরোধ ঘটেছিল। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বিরোধিতার অবসান হয়নি।
কংগ্রেসের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিষয়ে তাঁর নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। ১৯২১ সালে কংগ্রেসের আহমেদাবাদ সম্মেলনে তিনিই সর্বপ্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। সে যুগের পক্ষে এর একটা বৈপ্লবিক তাৎপর্য ছিল। গান্ধীজী এই প্রস্তাবের বিরোধী ছিলেন। সে সময় কংগ্রেসের মধ্যে তার অখণ্ড প্রভাব। তা সত্ত্বেও তাঁর বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করতে হসরত মোহানী বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। তাঁর এই প্রস্তাব বিপুল ভোটাধিক্যে পরাজিত হয়েছিল একথা সত্য, কিন্তু তা হলেও তাঁর এই পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব ভবিষ্যতে দিক নিরূপণের ভূমিকা গ্রহণ করে এসেছে।
হসরত মোহানী উত্তর প্রদেশের মুসলমান সমাজে স্বদেশী আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য সর্বপ্রথম উদ্যোগী ভূমিকা নিয়ে কাজে নেমেছিলেন। এই অপরাধে বারবার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। ফলে তিনি কোনদিনই শান্তি ও সাফল্যের মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করতে পারেননি। দেশকে ভালোবেসেছিলেন বলে তাঁকে দুঃখ ও অভাবের জীবনই বরণ করে নিতে হয়েছিল। এই কন্টকময় পথে তাঁর স্ত্রী নিশাত ফাতেমা ছিলেন তাঁর উপযুক্ত জীবন-সঙ্গিণী। কঠিন দুঃসময়ের দিনেও তিনি সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে তাঁর স্বামীকে অনুগমন করে চলতেন। সেই কারণেই হসরত মোহানীর মত বেগম মোহানীও অনেকের শ্রদ্ধা এবং তার চেয়েও বেশী লোকের সমালোচনার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নিশাত ফাতেমা স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পর্দার আবরণ ভেঙ্গে প্রকাশ্য রাজপথে বেড়িয়ে এসেছিলেন। সে যুগের সম্ভ্রান্ত মুসলমান মহিলাদের পক্ষে এটা একটা অচিন্তনীয় ব্যাপার। সমাজের কুটিকে তুচ্ছ করে তিনি সাহসের সঙ্গে এই পথে নেমে এসেছিলেন।
১৯২৮ সালে ‘নেহেরু রিপোর্ট’ নিয়ে আলোচনা করার জন্য কলকাতায় এক সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয়। মুসলমান সম্প্রদায়ের চৌদ্দ পয়েন্ট সম্বলিত দাবি মেনে না নেওয়ার ফলে এই সম্মেলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর প্রতিবাদে কংগ্রেসি মুসলমানদের একটি অংশ কংগ্রেস ছেড়ে চলে যান। হসরত মোহানীও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। এইভাবে কংগ্রেসের আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ হসরত মোহানী কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এ-এক করুণ পরিণতি। তারপর দুটি দশক ধরে সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার ফলে ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে বহু অঘটন ঘটে চলল। কিন্তু মুসলিম লীগ সম্মেলনে পাকিস্তান প্রস্তাব অনুমোদনের চরম মুহুর্তে হসরত মোহানী তাঁর বিদ্রোহের ঝাণ্ডা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে সম্মেলন মঞ্চে দাঁড়িয়ে জিন্নাহ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে তিনি এই হুশিয়ারি দিয়েছিলেন, “মিঃ জিন্নাহ, আপনি বুঝতে পারছেন না যে আপনি একদল রাজনৈতিক স্বার্থন্বেষীদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছেন।”
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শেষ অধ্যায়ে তিনি ভারতের গণপরিষদের (Constituent Assembly) সভ্য হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তিনি বিদ্রোহীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই গণপরিষদে ভারতীয় গঠনতন্ত্রের খসড়া রচিত হওয়ার পর তিনি তাতে স্বাক্ষর করতে রাজী হননি। কয়েকটি কারণে তিনি এই অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে প্রধান কারণ দুটি, দেশ বিভাগ ও ভারতের কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্তি। তিনি শেষ পর্যন্ত তাঁর এই সিদ্ধান্তে অনমনীয় ছিলেন।
হসরত মোহানী সারাজীবন দেশের কাজ করে এসেছেন। কিন্তু প্রখর আপোষহীনতা ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, যার ফলে তিনি শেষ পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সাফল্যলাভ করতে পারেননি। কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অক্ষয় হয়ে আছে। সাহিত্যিক হিসাবে তিনি সৃজনশীল প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন। উর্দু কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর সেই প্রতিভা বিকাশ লাভ করেছিল। পরবর্তী যুগে তরুণ কবিরা তাঁর রচনাশৈলীকে অনুসরণ করে তার স্মৃতিকে অমর করে রেখে গেছেন। [তথ্যসূত্রঃ ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা, সত্যেন সেন, পৃষ্ঠা-১৯২/১৯৬]
“ইনকিলাব জিন্দাবাদ” – শ্লোগানের জনক হসরত মোহানী
১৯২১ সালে মাওলানা হসরত মোহানীই প্রথম ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দেন। আর একজন ভারতীয় প্রসিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা ভগৎ সিং (১৯০৭-১৯৩১) তাঁর ভাষণ ও লেখালেখির মাধ্যমে এই শ্লোগানকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এটি ছিল ‘হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনে’র আনুষ্ঠানিক শ্লোগান। একই সঙ্গে এটি ‘অল ইন্ডিয়া আজাদ মুসলিম কনফারেন্সে’র শ্লোগানও ছিল। ১৯২৯ সালের ১৫ এপ্রিল, দিল্লিতে কেন্দ্রীয় বিধানসভায় বোমা হামলার পর ভগত সিং ও তাঁর সহযোগী বি কে দত্ত এই শ্লোগানটি চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন। পরে ১৯২৯ সালের জুন মাসে এ দুজন যৌথ বিবৃতির অংশ হিসেবে প্রথমবার দিল্লির উচ্চ আদালতে এই শ্লোগান দেন। এরপর থেকে এটি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ক্রুদ্ধ আর্তনাদ হয়ে উঠেছে। ভারতের রাজনৈতিক উপন্যাসগুলো স্বাধীনতা আন্দোলনকে চিত্রিত করার সময় এই শ্লোগানকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শব্দমালা হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে।
শ্লোগানটি ইংরেজি ‘লং লিভ দ্য রেভুল্যুশন’, ফরাসিতে ‘ভিভা লা রেভল্যুশন’-এর অনুবাদ। তিনিই ভারতের সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি ১৯২১ সালের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে স্বামী কুমারানন্দের সঙ্গে একসঙ্গে যোগদানকালে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করেন (ইংরেজিতে কমপ্লিট ইনডিপেনডেন্টস, উর্দুতে আজাদ–এ-কামিল)।
ভারতে কংগ্রেসের জন্মলগ্ন থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিপ্লবী আন্দোলনের শ্লোগান হয়ে উঠেছিল, ‘বন্দেমাতরম’। কিন্তু সারা দেশে খিলাফত আন্দোলন শুরু হলে মুহাম্মাদ আলি জিন্না এই শ্লোগানকে রাজনৈতিক প্রতিবাদ বলে মনে করেননি। গান্ধিজি খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করেন। তাঁর সময় থেকেই ‘বন্দেমাতরম’ নিয়ে আপত্তি উঠতে থাকে।
ততদিনে চারিদিকে প্রচারিত হয়ে যায় যে, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ‘বন্দেমাতরম’ কবিতাটি আসলে হিন্দু মূর্তি পূজারই প্রতিচ্ছবি। এই কবিতা বঙ্কিম ‘আনন্দমঠ’ লেখার আগেই রচনা করেছিলেন। এই উপন্যাস প্রথমে লেখা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রথম সংস্করণ-এর পর থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র কাহিনির প্লট পরিবর্তন করতে থাকেন। এবং পঞ্চম সংস্করণে তা কার্যত একটি মুসলমান বিরোধী কাহিনিতে পরিণত হয়। সেই কারণেই কংগ্রেস নেতারাও ‘বন্দেমাতরম’-কে জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নেননি। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের ‘জনগনমন’-কেই সেই মর্যাদা দিয়েছিলেন।
১৯৩৭-এ মুসলিম লিগের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় লক্ষ্ণৌতে। সেখানে ‘বন্দেমাতরম’ গানটিকে জাতীয়তার ক্ষেত্র থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদক ‘বন্দেমাতরম’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি লেখেন, “ভারতের জাতীয়তার ক্ষেত্র হইতে ‘বন্দেমাতরম’ -এর বহিষ্কার উদ্দেশ্য ভারতীয় মুসলমান বিশেষ করিয়া বাঙ্গলার মুসলমান বহুদিন হইতেই আন্দোলন করিয়া আসিতেছিলেন। কিন্তু সে বিক্ষিপ্ত আন্দোলন, দেশে এতদিন বিশেষ সাড়া জাগাইতে পারে নাই। কিন্তু এইবার এই আন্দোলনে বাঙ্গলার নেতৃত্বে সারা ভারতের মুসলমান মানিয়া লইয়াছেন। সকলের সমবেত আন্দোলনের ফলে লক্ষ্ণৌ-লিগ অধিবেশনে ‘বন্দেমাতরমে’র বহিষ্কারের প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে। তাছাড়া কংগ্রেস প্রদেশগুলিতে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি এবং সঙ্গীত আইন পরিষদে, স্কুলে-কলেজে, স্বায়ত্ত শাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে যেভাবে জাতি ধর্মনির্বিশেষে সকলের পক্ষে বাধ্যতামূলক করার চরম স্বেচ্ছাচার অনুষ্ঠিত হইয়া চলিয়াছে, তাহাতে ভারতের মুসলমানদের ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করিয়াছে। মুসলমানের বিরুদ্ধে এইসুস্পষ্ট পৌত্তলিকতাপূর্ণ হিন্দু যুদ্ধনিনাদে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টার ভিতরে যে জঘন্য সাম্প্রদায়িক জবরদস্তি বিদ্যমান, প্রাণ থাকিতে কোন সত্যকার মুসলমান তাহা বরণ করিয়া লইতে পারে না। মুসলিম লিগ এই কথা হিন্দু-ভারতকে স্পষ্টভাবে জানাইয়া দিয়া ভারতীয় জাতীয়তার মহৎ উপকার করিয়াছে।” [‘বন্দেমাতরম’, মাসিক মোহাম্মদী, কার্তিক ১৩৪৪]
একথাও ঠিক অবিভক্ত ভারতে তো বটেই এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা ‘বন্দেমাতরম’ শ্লোগানটি বিসর্জন দেননি। বরং স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে আজ পর্যন্ত কংগ্রেস এই শ্লোগানই ব্যবহার করে আসছে। আর জিন্নার মুসলিম লীগ গোড়া থেকেই ‘আল্লাহ আকবর’ ব্যবহার করে চলেছে। এই সময় হসরত মোহানীও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি নতুন শ্লোগান জুড়ে দেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ফার্সি ভাষার ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শব্দ দু’টির অর্থ হল, ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক’।
ফার্সি ভাষার ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শব্দ দু’টির অর্থ হল, ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক’। গান্ধির অহিংস নীতির সমর্থক কংগ্রেস দলের পক্ষে এই শ্লোগান অনুমোদন করা সম্ভব ছিল না। কারণ বিপ্লব বলতে তখন বোঝাতো, ফরাসি বিপ্লব, প্যারিস কমিউন এবং হাতে গরম রুশ বিপ্লব – যেসব রাজনৈতিক উত্থানের মধ্যে হিংসার বাতাবরণ ছিল। শ্লোগানটি প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল ১৯২১ সালে আমেদাবাদের কংগ্রেস (Congress) অধিবেশনে। আগেই বলা হয়েছে যে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শ্লোগানটি প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন, মওলানা হসরত মোহানী। তবে কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে হসরত মোহানীর এই শ্লোগান উচ্চারণ করার একটা পটভূমি আছে।
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের প্রতি অনেকেই অনুরাগী হয়ে পড়েছিলেন। সেই তালিকায় স্বামী বিবেকানন্দের ছোটো ভাই ভূপেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন ঠাকুরের নাতি সৌম্যেন ঠাকুর, স্বরোজিনী নাইডুর দাদা বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন। তাছাড়া মুজাফফর আহমদ বা এস. এ ডাঙ্গেরা তো ছিলেনই। হসরত মোহানীও তখন সেই গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন। আমেদাবাদ অধিবেশনেই তিনি ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলেন। যদিও গান্ধি সহ কোনো কংগ্রেস নেতাই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিকে অনুমোদন করেননি।
‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শ্লোগানটি জনপ্রিয়তা লাভ করতে প্রায় এক দশক সময় নেয়। ১৯২৮ সালে ভগৎ সিং এবং তাঁর সহযোগীরা যখন কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা বিস্ফোরণ করেন, তখন তাঁরা ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিয়েছিলেন। এমনকি ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগেও তাঁদের শেষ উচ্চারণ ছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। তার পর থেকেই ভারতে প্রধানত বামপন্থী সহ অনেকের কাছে এই শ্লোগান আদরণীয় ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এই শ্লোগান আবিস্কারের আগের বছরেই ১৯২০ সালে, তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছে। লেনিন সেই দলকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বাঘাযতীনের সহযোগী বারুইপুরের ছেলে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য – তিনিই পরে মানবেন্দ্রনাথ রায় বলে পরিচিত হন। রায় বিদেশে বসেই ঠিক করেন, আমেদাবাদ অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব তোলা হবে। সেইমতো তাঁর এবং অবনী মুখার্জীর সই করা লিফলেট ভারতের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। সেইসব লিফলেট হয়তো পুলিশের তৎপরতার জন্য মুজাফফর আহমেদ বা ডাঙ্গের ঠিকানায় পৌঁছায়নি। কিন্তু আজমীরে সাম্যবাদী মনোভাবাপন্ন একটি গোষ্ঠীর হাতে সেই বিবৃতির কপি এসে পৌঁছয়। তারাই সেই বান্ডিল নিয়ে আমেদাবাদ যান। সেখানে হসরত মোহানী এবং বিপ্লবী কুমারানন্দ সহ অনেকেই তা সম্মেলনে বিলি করেন। সেই সূত্রেই মওলানার হসরত মোহানীর মুখ থেকেই প্রথম ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শ্লোগানটি বেরিয়ে আসে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।