লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
ভারতীয় হিন্দু পুরাণের সাথে গ্রীক পুরান -এর পার্থক্য হল ভারতীয় পুরাণে শুধুমাত্র দেবদেবীর জন্মবৃত্তান্ত, ও মহিমার ব্যাপারে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু গ্রীকপুরান এ গ্রীক দেবদেবীদের জন্মবৃত্তান্ত ও বিচিত্র দৈব মহিমার সঙ্গে অসংখ্য মর্তের মানুষের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। গ্রীক পুরান এ মানুষ ও দেবতার মধ্যে এক অদ্ভুত মেলবন্ধন সৃষ্টি করা হয়েছে। সেখানে স্বর্গ ও মর্তের মধ্যে সব পার্থক্যকে ভেদ করে দিয়েছে এবং এক অখণ্ড পরিমণ্ডলে বিলীন হয়ে এক বৃহত্তর জীবনাবর্তে আবর্তিত হয়েছে। তাই গ্রীক পুরান -এ পৌরাণিক যুগের সমাজব্যবস্থার যেভাবে প্রতিফলন ঘটেছে ভারতীয় পুরানে তেমনভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
ভারতীয় পুরানে দেখা যায় দেবদেবীরা যে কোন সময় তাঁদের ইচ্ছামত মর্তে আবির্ভুত হয়ে যান এবং মর্ত্যলোকে যাতে তাঁদের পূজাঅর্চনার প্রচলন হয় তাঁদের মহিমা প্রচার করা হয় সেজন্য মুনিঋষি বা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের শরণাপন্ন হন। ভারতীয় পুরানে এও লক্ষ্য করা যায় যে দেবতারা মানুষকে তাঁদের প্রয়োজনের উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করতেন। ভারতীয় পুরানে মানুষের কোন প্রাধান্য নেই। সেজন্য তাদের কোন স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব স্বকীয় বৈশিষ্ট উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারেনি। এখানে ব্যতিক্রম গল পদ্মপুরান। সেখানে লক্ষ্য করা যায় চাঁদ সদাগরের অতুলনীয় পৌরুষের অধিকারী। তিনি দৈববিধানের পরোয়া না করে দৈবত্বের বিরুদ্ধে এক প্রত্যক্ষ সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এবং তিনি তাঁর স্বতন্ত্র পৌরুষত্বময় ব্যক্তিত্বকে এক বিরল মহিমায় তুলে ধরেন।
গ্রীক পুরানেও মানুষের স্থান দেবতাদের নীচে
গ্রীকপুরাণের শুরুর দিকে লক্ষ্য করা যায় যে, দেবরাজ জিয়াস ও অন্যায় দেবদেবীর জন্মকথা ও চরিত্ৰ মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এর পরেই আবার লক্ষ্য করা যায় যে, হার্কিউলিস, পার্সিয়াস, থিসিয়াস, জেসন প্রভৃতি দুঃসাহসিক বীরদের অসাধারণ বীরত্ব কাহিনীও গ্রীক পুরাণে নির্বিঘ্নে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে গ্রীক পুরানে যতই মানুষের বীরত্বগাথা বর্ণনা করা হোক না কেন সেখানে মানুষের স্থান দেবতাদের পরে। কেননা গ্রীকপুরানের যে গ্রীকপুরাণের যে আখ্যানভাগে অসংখ্য বীরত্বপূর্ণ কাহিনীর মধ্যে মানবজীবনের যে কাহিনী স্থান পেয়েছে সেই আখ্যানভাগটিকে অপরিহার্য নিয়তির বা দৈববিধানের এক অলঙ্ঘনীয় প্রভাব ব্যাপ্ত হয়ে আছে।
সেজন্য দেখা যায় মানুষ যে কোন পন্থায় যতই বীরত্ব অর্জন করুক না কেন দৈববলে বলীয়ান না হওয়া পর্যন্ত অথবা দৈব অনুগ্রহ লাভ করতে না পারলে সে জীবনে চূড়ান্ত জয় বা সাফলের স্বর্ণমুকুট কখনই লাভ করতে পারবে না। গ্রীকপুরানেও দেখা যায় মানুষের জন্মের সময় নিয়তি অর্থাৎ ভাগ্যদেবীরা নবজাতকের জীবনসম্পর্কে একটি ভাগ্যলিপির খসড়া তৈরি করে দেন। আর কোন মানুষই সেই পরিকল্পনামাফিক ভাগ্যলিপির বাইরে গিয়ে তাদেরর জীবনকে অন্য ভাবে গড়ে তুলতে পারেনা। অর্থাৎ মানুষের ভাগ্যের সমস্ত টানাপোড়েন দেবতাদের হাতেই নিহিত। সেজন্য ঈডিপাসের মত বীরত্বপূর্ণ ব্যাক্তিত্বও শত চেষ্টা করেও দেবতাদের দ্বারা নির্দিষ্ট অভিশপ্ত জীবন-পরিণতিকে পরিহার করতে পাবেনি। এক কথায় গ্রীক পুরানেও মানুষের হাতে দেবতার ভাগ্যের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। দেবতা কর্তৃক নির্দিষ্ট মানুষের জীবন বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় মানুষ তাকে কোনদিনই জয় করতে পারেনা।
গ্রীক পুরান ও নিয়তিবাদ
গ্রীক পুরান পাঠ করলে লক্ষ্য করা যায় তৎকালীন গ্রীক জীবনদর্শন এই নিয়তিবাদের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত। এই নিয়তিবাদ অসংখ্য মানবজীবনের গতিপ্রকৃতির মধ্য দিয়ে স্বীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গ্রীকপুরান এর কাহিনীগুলিতে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার এক অভ্রান্ত প্রতিফলন লক্ষ্য যায়। সেকালে গ্রীকসমাজ ছিল প্রধানত পিতৃতান্ত্রিক এবং সেই সমাজে পুরুষদের মধ্যে বহু বিবাহ প্রথাও প্রচলিত ছিল। তবে বিধবা নারীদের পুনর্বিবাহের ক্ষেত্রে কোন সামাজিক সম্মতি দেওয়া হয়নি।
অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় হিন্দু নারীদের মত অনেক গ্রীক নারী স্বামীর মৃত্যুর পরেই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে এবং স্বামীর অনুগামিনী হয়েছে। হিরো ও লেণ্ডারের মত প্রেমিক – প্রেমিকাদের সহমৃত্যু তাদের প্রেমকে এক মহিমা দান করেছে। ফাইলেউসকন্যা ঈভাদনেও তাঁর স্বামীর জলন্ত চিতায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে কোন প্রথাগত কঠোরতা ছিল না। যেমনটা ছিল হিন্দু নারীদের ক্ষেত্রে। তৎকালীন হিন্দু নারীদেরকে জোর করে স্বামীর চিতাকাঠে পুড়িয়ে হত্যা করা হত। কিন্তু গ্রীক পুরানে দেখা যায় পেরিয়ারেসের বিধবা রাণী পার্সিয়াসকন্যা গর্গোফন পুনরায় বিবাহ করেন এবং অনেক সন্তানের জননী বিধবা নারী পরে দ্বিতীয়বার বিবাহ করলেও সমাজ থেকে তাদের ধিক্কার দেয়নি বা সামাজিক বহিস্কারও তাদের করা হয়নি। কিন্তু তৎকালীন হিন্দুসমাজ এর ব্যতিক্রম ভুমিকা পালন করেছে।
উপসংহার
সুতরাং স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে হিন্দুসমাজের মত প্রাচীন গ্রীকসমাজ বিধবা নারীদের সম্পর্কে কোন কঠোর বিধি নিষেধ প্রবর্তন করার পক্ষপাতী ছিল না। গ্রীকপুরাণের কাহিনীগুলিতে অসংখ্য অলৌকিক এবং অতিপ্রাকৃত কাহিনীর ছড়াছড়ি যা আধুনিক পাঠককে বিস্ময়ে হতবাক করে দেবে। সেইসব পৌরানিক গল্পগাথা সত্যিই এক অদ্ভুত বিস্ময়কর শিহরণ জাগায়। গ্রীক পুরানে বর্ণিত আছে, মেলামপাস পাখিদের ভাষা বুঝতে পারত। লাইসেনেউস অন্ধকারে দেখতে পেত এবং মাটির তলায় কোথায় কোন গুপ্ত ধন আছে তা বুঝতে পারত।
হিন্দু পুরানে টাইম ট্র্যাভেলের একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা।