ভারতের প্রাচীন অবস্থা এবং সাধু সন্ন্যাসী যােগী ঋষি ও মুনিদের ইতিহাস জানার প্রয়ােজন অনস্বীকার্য। অতীতকে জেনেই গড়ে ওঠে ভবিষ্যত পরিকল্পনা। সমাজবিরােধী, মানবতাবিরােধী যে সমস্ত কাজ আছে তার মধ্যে নারীধর্ষণ ও ব্যভিচার বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ইসলামধর্মে বলাৎকার বা ধর্ষণকারী বিবাহিত পুরুষের শাস্তি প্রাণদন্ড। ব্যভিচারিণী বিবাহিতা মহিলারও ঐ একই শাস্তি। কোন সভ্যদেশ ও আন্তর্জাতিক ধর্ম বলাৎকার বা ধর্ষণকে অনুমােদন করে না। বিশেষ করে পুরুষশাসিত সমাজে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও অনুন্নত নারীর উপর এরকম অত্যাচার পাশবিক ও অসহনীয়। আমাদের ভারতবর্ষে ধর্ম এর নাম দিয়ে ধর্ষণ, বেশ্যাবৃত্তি প্রভৃতি যেভাবে চলে এসেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে শ্ৰী আলােককৃষ্ণ চক্রবর্তী ‘ধর্মের নামে’ নামক একটি পুস্তক প্রণয়ন করেছেন যার সপ্তম সংস্করণ বের হয়েছে ১৯৯২-এর ডিসেম্বর মাসে। তাতে তিনি ঐতিহাসিক ডক্টর শ্রী অতুল সুরের বই থেকেও উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
আলােকবাবু লিখেছেন, “ঋক বেদে দেখি জমি তার যমজ ভ্রাতা যমের কাছে সঙ্গম প্রার্থনা করছেন। দম্ভ নিজ ভগিনী মায়াকে, লােভ নিজ ভগিনী নিবৃত্তিকে, ক্রোধ নিজ ভগিনী হিংসাকে ও কলি নিজভগিনী নিরুক্তিকে বিবাহ করেছে।…মৎস পুরাণ অনুযায়ী শতরূপা ব্রহ্মার কন্যা। কিন্তু ব্রহ্মা নিজ কন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে অযাচারে লিপ্ত হয়। … যৌনজীবনে দেবতাদের কোনরূপ সংযম ছিল না। আদিত্যযজ্ঞে মিত্র ও বরুণ উর্বশীকে দেখে কামলালসায় অভিভূত হয়ে যজ্ঞকুম্ভের মধ্যে শুক্রপাত করে। অগ্নি একবার সপ্তর্ষিদের স্ত্রীদের দেখে কামােন্মত্ত হয়েছিল। ঋক্ষ বজাকে দেখে ইন্দ্র ও সূর্য দুজনেই এমন উন্মত্ত হয়েছিল যে ইন্দ্র তার চিকুরে ও সূর্য তার গ্রীবায় রেতঃপাত করে ফেলে। রামায়ণ অনুযায়ী সূর্যের বীর্য তার গ্রীবায় ও ইন্দ্রের বীর্য তার বালে [কেশে] পড়েছিল। সূর্য অযাচারী দেবতা। চন্দ্র ব্যভিচারী দেবতা। চন্দ্র দক্ষের ৭০০টি মেয়েকে বিবাহ করেছিল। কিন্তু তাতেও তার কামলালসা পরিতৃপ্ত হয় নি। কামাসক্ত হয়ে এসে দেবগুরু বৃহস্পতি-স্ত্রী তারাকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে। দেবগুরু বৃহস্পতি নিজেও সাধু চরিত্রের দেবতা ছিল না। বৃহস্পতি কামলালসায় অভিভূত হয়ে নিজ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রী মমতার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় জোরপূর্বক তার সঙ্গে সঙ্গম করেছিল। আবার ঋগ্বেদে দেখি রুদ্রদেব তার নিজ কন্যা ঊষার সঙ্গে অযাচারে লিপ্ত হয়েছিল। পৌরাণিক যুগে বিষ্ণুই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠদেবতা, কিন্তু বিষ্ণু পরস্ত্রী বৃন্দা ও তুলসীর সতীত্ব নাশ করেছিল।….ইন্দ্র ইন্দ্রাণীর সতীত্ব নষ্ট করে এবং শাপ থেকে রক্ষা পাবার জন্য ইন্দ্রাণীর পিতা পুলমলকে হত্যা করে ইন্দ্রাণীকে বিয়ে করেছিল। ইন্দ্র যে কেবল ইন্দ্রাণীর সতীত্ব নষ্ট করেছিল তা নয়, মহাভারত অনুযায়ী ইন্দ্ৰ গৌতম মুনির অনুপস্থিতিতে গৌতমের রূপ ধারণ করে তার স্ত্রী অহল্যার সতীত্ব নাশ করেছিল। ইন্দ্র এইভাবে মৰ্তালােকে এসে মানবীদের সঙ্গে মিলিত হত। এইভাবে বালীও অর্জুনের জন্ম হয়েছিল। ধর্মও মর্তে এসে মানবীদের সঙ্গে মিলিত হত। ধর্মের ঔরসেই কুন্তীর গর্ভে যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়। অনুরূপভাবে অগ্নির ঔরসে মাহীষ্মতী নগরীর ইক্ষাকু বংশীয় রাজকন্যা সুদর্শনার গর্ভ হয়। পবনদেব ও হনুমানের পিতা কেশরী রাজের স্ত্রী অঞ্জনার গর্ভে এক পুত্র উৎপাদন করেছিল। সেই পুত্রই হনুমান। এইসব দেবতাদের নিয়েই আমাদের ধর্ম – কর্ম। ধর্ম এর নামে এদেরই পূজো করি আমরা। স্বয়ং ধর্মরাজই চরিত্রহীন।”
আবার আলােকবাবু ডক্টর অতুল সুরের উদ্ধৃতি দিয়েই লিখেছেন, “বেদে অযাচারের একাধিক দৃষ্টান্ত আছে। প্রথমেই ঊষার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ঋকবেদের ২০টা সূক্তে ঊষা স্তুত হয়েছে। সে প্রজাপতির কন্যা, কাঞ্চনবর্ণা ও সূর্যদেবের ভগিনী। ঊষা বক্ষদেশ উন্মুক্ত রাখত। ব্রহ্মার ন্যায় প্রজাপতিও ছিলেন একজন কামুক দেবতা। কৃষ্ণ যজুর্বেদের মৈত্রায়ণী সংহিতা (৪/২/২২) অনুযায়ী প্রজাপতি নিজ কন্যা ঊষাতে উপগত হয়েছিল। … [পৃষ্ঠা ২৩] বলির জন্ম হয় সমলিঙ্গ মিলনে। শিব ও বিষ্ণু দুই দেবতাই পুরুষ। তাদের সমলিঙ্গ মিলনে ষষ্ঠের জন্ম হয়।” [দ্রষ্টব্য ২৪ ও ২৫ পৃষ্ঠা]
এ প্রসঙ্গে প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায়ের ‘অপরাধী রামমােহন’ থেকে কিছু অংশ আলােকবাবু উদ্ধৃত করেছেন—“রামমােহনের অপরাধ কত; তিনি মাতৃভাষা বাঙলায় শাস্ত্রগ্রন্থ অনুবাদ করলেন। সেই পাপেই তাে মুর্শিদাবাদের কাছে ভাগীরথী গঙ্গার প্রবাহ পরিবর্তিত হয়ও সেই অঞ্চলে মহামারী হয়। এবং যশােরে কলেরা রােগেবহুলােক মারা পড়ে। এই সবই নাকি শাস্ত্রগ্রন্থ তর্জমা করার প্রত্যক্ষ ফল।… সাধারণ লোেক বুঝতে পারবে না বলেই তাে দেবভাষায় লেখা ছিল এতকাল।” “শেষ লাইনটির দিকে লক্ষ্য করলে বােঝা যায় ধর্মের চালাকি কোথায়। সাধারণ মানুষের বােধগম্য ভাষায় শাস্ত্রগ্রন্থ অনুবাদ হলে ফাঁস হয়ে যাবে ধর্ম গ্রন্থের এই সব ভেতরকার কাহিনী। ধর্ম সম্বন্ধে লােকের ভক্তিও চটে যাবে। তাই চেপে রাখা দরকার শাস্ত্রগ্রন্থীয় এই জাতীয় অনেক কিছু।” [পৃষ্ঠা২৭]
সাঁইবাবার কৌশল ধরে ফেলেন যাদুসম্রাট পি. সি. সরকার আর তার ফটোর চারিদিকে জ্যোতির রহস্য ফাস করেন প্রবীর ঘােষ তাঁর লেখা ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থে। রজনীশের চরিত্র লেখক প্রবীর ঘােষ লিখতে গিয়ে তাকে করেছেন তুলােধােনা।
“প্রথমে আসা যাক পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথের মন্দিরে। এই মন্দিরে জগন্নাথদেব অধিষ্ঠিত। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার লােককে খাওয়ানাে হয়। এই মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে ৬৪ রকমের যৌন মিলন ভঙ্গীর ভাস্কর্য আছে। আছে জয় বিজয় তােরণে জগন্নাথদেবের নানা ধরণের যৌনভঙ্গীর চিত্র।”
“মন্দিরের সেবায় রয়েছে ১২০ জন দেবদাসী। এদের কাজ জগন্নাথের মূর্তির সামনে নৃত্য করা। সেই নৃত্য শুরু হয় রাত্রে। প্রতিদিন রাত ১০টার পর মন্দিরের রুদ্ধকক্ষে জগন্নাথের নিষ্প্রাণ মূর্তির সামনে চলে ভজনের নৃত্য। প্রতিরাত্রেইনাচে এক একটি নতুন মেয়ে। মাঝে মাঝে বাজনা বাজায় পুরােহিত। শুধু পুরােহিত ছাড়া অন্য কারাের থাকার অধিকার নেই এই ঘরে। একরাত্রে একজনই শুধু নাচে। একসময়ে এই নৃত্য চরমে উঠলে দেহের সমস্ত আচ্ছাদন খুলে ফেলে সেই মেয়েটি। নাচতে থাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে। তারপর? তারপরের ঘটনা রীতিমত রােমহর্ষক, সেই বিবস্ত্রা মেয়েটি নিজেকে সঁপে দেয় জগন্নাথের মূর্তির কাছে। উত্তাল নৃত্যের সঙ্গে উৎকট উত্তেজনায় চিৎকার করতে থাকে—হে প্রভু, তুমি আমার সব। তুমি ইহকাল, তুমিই পরকাল। আমি তােমার স্ত্রী। আমার এ দেহমন সবই তােমার। আমি আর পারছিনা। তুমি আমাকে গ্রহণ কর। তারপর যা ঘটার তাই ঘটে। কে এই বিবসনা যুবতীকে গ্রহণ করে? জগন্নাথের প্রাণহীন মূর্তি না জীবন্ত পুরােহিত? এইসব মেয়েদের শেষজীবন বড় করুণ। যৌবন ফুরিয়ে গেলে এদের আর কোন কদর থাকে না। ওইসব চরিত্রহীন পুরােহিতদের কাছে তাই এরা বারাঙ্গনাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয় শেষ বয়সে। আর এই সব দুশ্চরিত্র দুষ্ট অভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্যই মনে হয় মন্দিরের গায়ে অতসব যৌন মিলনের ভাস্কর্য রয়েছে।”
আলােকবাবুও লিখেছেন, “মন্দির আমাদের কাছে পবিত্রস্থান। কিন্তু নানারকম অপবিত্র কাজই সংঘটিত এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে। কালীঘাটের কালীমন্দিরের পাশেই পতিতালয়।… তারাপীঠের মন্দিরের চারপাশের হােটেলগুলােতে খোঁজ নিলে দেখা যাবে ভক্তের চেয়ে ভন্ডের সংখ্যাই বেশী। যৌন সঙ্গমের জন্যে প্রচুর নরনারীর ভিড় সেখানে।” [ঐ গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৪৮]
তারকেশ্বরের মন্দিরে “দেখা থাক এত ভিড় হয় কেন সেখানে। এই মন্দিরের চারপাশেও ঘরভাড়া দেওয়া হয় সম্ভোগের জন্যে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পান্ডারাই। সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেয়।” (ঐ, পৃ. ৪৮]
“এটি কেরালার চেঙ্গানন্দের কালীমন্দির। ধূর্ত পুরােহিত এমন নােংরা কাজ করেছিল যা কল্পনাও করা যায় না। … হঠাৎ একদিন সেই পুরােহিত ঘােষণা করে কালীমন্দিরে মা কালীর প্রতিমাসে মাসিক রক্তস্রাব হচ্ছে। আর সেই রক্তে ভেজা ন্যাকড়া সব রােগ সারিয়ে দেয়। সে কি ভীড় মন্দিরে; অন্ধবিশ্বাসী ভক্তদের মধ্যে সেই ন্যাকড়া বিতরণ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ঐ শয়তান পুরােহিত। আসলে সে তার স্ত্রী ও মেয়ের মাসিক ঋতুস্রাবে ব্যবহৃত ন্যাকড়া খন্ড খন্ড করে অন্ধ ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করত।” (ঐ, পৃ. ৫০)।
“বিশ্ববিখ্যাত সােমনাথ মন্দিরের কথা কে না জানে। ঐতিহাসিক এই মন্দিরে ছিল কুবেরের ঐশ্বর্য। একদা সেই বিপুল ধনরত্ন লুণ্ঠন করেন গজনীর সুলতান মামুদ। লুণ্ঠন ছাড়া তিনি আর এক উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলেন এখানে। তাই সঙ্গে এনেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, ধাতুবিদ আর বিজ্ঞানীদের। … সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। শূন্যে ভেসে থাকত সােমনাথ দেবের মূর্তি।…পরীক্ষা করে দেখা যায় শূন্যে ঝুলন্ত দেবমূর্তিটি লােহার তৈরী। বিশেষজ্ঞদের অভিমত—মন্দিরের দেওয়ালের চারপাশে চুম্বক পাথর বসানাে আছে। আর সেগুলাে এমন ভাবে বসানোে যে লােহার মূর্তিটি ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় ছেড়ে দিলে চারদিকে চুম্বক আকর্ষণে সেটা ঝুলে থাকতে বাধ্য। প্রমাণ পাওয়া গেল মন্দিরের দেওয়ালের পাথর খােলবার পর। সত্যিই দেখা গেল চুম্বক রয়েছে ভেতরে।আর চুম্বকে হাত পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শূন্যে ভাসমান মূর্তিটি পড়ে গেল মাটিতে।” [ঐ, পৃষ্ঠা ৫১]
“বিপুল ঐশ্বর্যের ভান্ডার তিরুপতি মন্দিরের বর্তমান রােজগার সােমনাথ মন্দিরের অতীতের উপার্জনকেও ছাড়িয়ে গেছে।… শােনা যায় মন্দিরের মাসিক আয় তিনকোটি টাকার উপর। অর্থাৎ রােজ ১০ লাখ টাকারও বেশী। বিশেষভাবে বিবাহিতা নারীদের সতীত্ব নষ্ট করার ব্যাপারে এদের জুড়ি মেলা ভার। কিভাবে এই সব লম্পট চরিত্রহীন। পুরােহিতরা ধর্ম বিশ্বাসী সরল নারীদের সঙ্গে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয় সেই কাহিনী আলােকবাবু লিখেছেন ডক্টর অতুল সুরের উদ্ধৃতি দিয়ে, “অনেক সময় ধর্মের রূপ দিয়ে কামাচারী ব্রাহ্মণ পুরােহিতেরা বিবাহিত নারীদের প্রলুব্ধ করত, তাদের সতীত্ব বিসর্জন দিত। দেবতার আশ্চর্যশক্তি আছে স্ত্রীলােকের বন্ধতা দূর করবার। এরূপমন্দিরের মধ্যে কর্ণাটক দেশের তিরুপতি মন্দির বিশেষ ভাবে প্রসিদ্ধ। এখানকার দেবতা ভেনকাটেশ্বরের কাছে অসংখ্য স্ত্রীলোেক আসে সন্তান কামনায়। পুরােহিতগণ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তারা মন্দিরে রাত্রিযাপন করে। পুরােহিতগণ তাদের বলে যে তাদের ভক্তির দ্বারা প্রীত হয়ে ভোটেশ্বর রাত্রে তাদের কাছে আসবে এবং তাদের গর্ভবতী করে দিয়ে যাবে। তারপর যা ঘটত তা না বলাই ভাল। পাঠক তা সহজেই অনুমান করে নিতে পারেন। পরদিন প্রভাতে এই সকল জঘন্য চরিত্রের ভন্ডতপস্বীরা কিছুই জানেনা এরূপ ভান করে ঐ সকল স্ত্রীলােকের কাছে এসে দেবতার করুণা লাভ করেছে বলে তাদের পুণ্যবতী আখ্যা দিয়ে তাদের কাছ হতে দান গ্রহণ করত। দেবতার সঙ্গে তাদের যৌনমিলন ঘটছে এই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে এই সকল হতভাগিনী নারীরা নিজ নিজ গৃহে ফিরে যেত।” (ঐ, পৃষ্ঠা ৫২]
“মােদ্দাকথা, ব্যাপারটা আসলে ধর্মের নামে লােক ঠকানাের ব্যবসা। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ২২০০ বছর আগে লেখা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে। মিথ্যা প্রচার চালিয়ে সরল বিশ্বাসী মানুষদের স্রেফ প্রতারণা করা হত। যেমন ‘কোনও প্রসিদ্ধ পুণ্যস্থানে ভূমিভেদ পূর্বক দেবতা নির্গত হইয়াছেন, এই ছলে সেখানে রাত্রিতে বা নির্জনে একটি দেবতার বেদী স্থাপন করিয়া এবং এই উপলক্ষে উৎসাবাদি ও মেলা বসাইয়া সেই স্থানে শ্রদ্ধা লােকের প্রদত্ত ধন দেবতাধ্যক্ষ গােপনে রাজসমীপে অর্জন করিবেন।’ [কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র, ৫ম অধিকরণ, ২য় অধ্যায়, ৯০ তম প্রকরণ]
ঐ গ্রন্থেরই ৯০তম প্রকরণে একথাও আছে, “দেবতাধ্যক্ষ (অর্থাৎ প্রধান পুরােহিত স্থানীয় ব্যক্তি) ইহাও প্রচার করিতে পারেন যে উপবনে একটি বৃক্ষ অকালে পুষ্প ও ফলযুক্ত হইয়াছে” [ঐ, পৃঃ ৫৯]।
‘ধর্ম ও কুসংস্কার’ পুস্তকে সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের লেখা হতে লেখক লিখেছেন, “বন্ধ্যা রমণী দেবতার কাছে মানত করতেন তার সন্তানাদিহলে তিনি দেবতার উদ্দেশ্যে প্রথমটিকে দান করবেন। এভাবে প্রথম সন্তানকে গঙ্গাসাগর সঙ্গমে বিসর্জন দেওয়া হত।”
পাঞ্জাবে কোন কোন জায়গায় কন্যাকে হত্যা করা হত এবং বলা হত তুমি যাও তােমার ভাইদের পাঠিয়ে দিও। দাক্ষিণাত্যের নায়ার জাতির লােকেরা হাম, বসন্ত ইত্যাদি নিবারণের জন্য প্রথম সন্তানটিকে দেবীর কাছে বলি দিত। [ঐ, পৃষ্ঠা ৬৩]
“উপনিষদে আছে কয়েকজন মুনি কোন এক ঋষির অপরূপ সুন্দরী স্ত্রীকে দেখে কামােন্মত্ত হয়ে তাকে টানতে টানতে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। ঐ দুশ্চরিত্র মুনিদের হাত থেকে নিজের স্ত্রীকে রক্ষার কোন চেষ্টাই করে না সেই ঋষি। অসহায় মায়ের এই অপমানে পিতাকে নীরব দর্শকের ভূমিকায় দেখে পিতৃভক্ত পুত্র একেবারে বিস্মিত। ক্ষিপ্তপুত্র পিতার কাছে এই অদ্ভুত আচরণের কারণ জানতে চায়। জবাবে পিতার উক্তি—“নারী হচ্ছে ভােগের সামগ্রী। তাই কেউ ভােগ করতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়া উচিত না। তাছাড়া এক্ষেত্রে নারীর ইচ্ছা বা অনিচ্ছারও কোন মূল্য নেই। এ প্রসঙ্গে দ্রৌপদীর কথাও উল্লেখযােগ্য। দ্রৌপদী চরিত্রে যত মহত্ত্বই আরােপ করা হােক না তার পঞ্চস্বামী ভােগ কিছুতেই গ্রহণযােগ্য নয়। ঠিক এইভাবে শ্রীকৃষ্ণের বিবস্ত্রা গােপিনী দর্শনও সমর্থনযােগ্য নয়। শ্রীকৃষ্ণের এই বিকৃত রুচি সমাজের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতি—তা শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রে যত দর্শনই প্রদর্শন করা হােক।” [পৃষ্ঠা ৬৫ হতে ৬৬]
লেখক আলােকবাবু তার পুস্তকের ১০৭ পৃষ্ঠায় ডঃ অতুল সুরের বই হতে উদ্ধৃতি তুলে দিয়েছেন—“তন্ত্রশাস্ত্রে পঞ্চ ‘ম’-কার সহকারে চক্রপূজার ব্যবস্থা আছে। পঞ্চ ‘ম’-কার হচ্ছে মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন। তন্ত্রপূজার এগুলি হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ। তন্ত্রে শক্তি সাধনা ও কুলপূজার উপর বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছে। কোন স্ত্রী লােককে শক্তির প্রতীক ধরে নিয়ে তার সঙ্গে যৌন মিলনে রত থাকাই তান্ত্রিক সাধনার মূল তত্ত্ব। গুপ্ত সংহিতায় বলা হয়েছে যে, সে ব্যক্তি পামর যে ব্যক্তি শক্তি সাধনার সময় কোন স্ত্রীলােকের সঙ্গে মৈথুন ক্রিয়ায় নিজেকে না নিযুক্ত রাখে। নিরুক্ততন্ত্র এবং অনেক তন্ত্রে বলা হয়েছে যে শক্তি সাধক কুলপূজা হতে কোনরূপ পুণ্যফল পায় না, যদি না সে কোন বিবাহিতা নারীর সহিত যৌন মিলনে প্রবৃত্ত হয়। একথাও বলা হয়েছে যে, কুলপূজার জন্য কোন নারী যদি সাময়িকভাবে স্বামীকে পরিহার করে তবে তার কোন পাপ হয় না। সমাজের দৃষ্টিতে যাকে অযাচার বলা হয় অনেক সময় এটা সেরূপও ধারণ করত।কেননাকুলচূড়ামণিতন্ত্রেবলা হয়েছে যে,অন্যরমণী যদিনা আসে তাহলে নিজের কন্যা বা কনিষ্ঠা বা জেষ্ঠা ভগিনী, মাতুলানী, মাতা বা বিমাতাকে কুলপূজা করবে। [“অন্যা যদি ন গচ্ছেতু নিজকন্যা নিজানুজা। অগ্রজা মাতুলানী বা মাতা তসপত্নীকা। পূর্বাভাবে পরা পূজ্যা মদংশা ঘােষিতত মতাঃ। একা চেৎ কুল শাস্ত্রজ্ঞ পূর্জাহা তত্র ভৈরব।।”]
এবার দেখা যাক সেই তন্ত্রসাধনা বা কুলপুজা কিভাবে হত— রাত্রিকালে সাধক ‘আমি শিব’ (ধ্যাত্বা শিবােহমতি) এইরূপ ভাবতে ভাবতে নগ্ন অবস্থায় নগ্না রমণী রমণ করত (ততাে নগ্নাং স্বিয়ংনগ্নং রমন ক্লেদযুতােহপি বা) রাত্রির তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত নিজ সাধন কার্যে লিপ্ত থাকবে। কুলার্ণবতন্ত্র এই সাধন প্রক্রিয়া কি তা আমি আর বাংলায় অনুবাদ করব না। মূল সংস্কৃত শ্লোকই এখানে উদ্ধৃত করছি,
“আলিঙ্গনং চুম্বনঞ্চচ স্তনয়াে মর্দনস্তথা।।
দর্শনং স্পৰ্শনং যােনি বিকাশশা লিঙ্গ ঘর্ষণম।।
প্রবেশ স্থাপনং শক্তের্নব পুষ্প নিপুজনে। [পৃষ্ঠা ১০৭-১০৮]
সংস্কৃতভাষা মােটেই যিনি জানেন না শুধুমাত্র বাংলা জানেন, তিনিও সহজেই এই সংস্কৃত শ্লোকের আলিঙ্গন, চুম্বন, স্তনমর্দন, স্পর্শ, যােনি বিকাশ, লিঙ্গ ঘর্ষণ, প্রবেশ ও স্থাপন শব্দগুলি হতেই নােংরামির পরিমাপ করতে পারবেন সহজেই।
বারাঙ্গনা, বেশ্যা, পতিতা, দেহােপজীবি প্রভৃতি নামে হতভাগ্য দেহব্যবসায়ীরা সমাজে আজ কলঙ্কিতা। আবার পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষ সম্প্রদায় ঐ কলঙ্ক থেকে নিজেদের আড়ালে রাখতে সর্বতােভাবে সক্ষম হয়েছে। অথচ চরিত্রহীন পুরুষদের বীভৎস ক্ষুধা মেটাতেই তাদের অবতারণা। তাই নিষিদ্ধপল্লী বা পতিতালয়ের নারীদের যেখানে পতিতা বলা হয় সেখানে পুরুষদের পতিত বলা হয় না। এটা ঠিক আমাদের প্রসঙ্গ নয়। আমদের প্রসঙ্গ হচ্ছে, ধর্ম কেন্দ্রিক, ধর্মের মােড়কে মােড়া মন্দিরে ও নানা ধর্মস্থানে পুণ্য সঞ্চয়ের নামে যা সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে সে সম্বন্ধে তথ্যভিত্তিক আলােচনা। নবপরিকল্পিত স্বর্গরাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে ঐ প্রাচীন সভ্যতা চালু করা সার্বিক উন্নতির অনুকূল হবে না প্রতিকূল তা ভাববার বিষয়।
শ্ৰীমতী আরতি গঙ্গোপাধ্যায় নামী দামী লেখকদের লেখা ৩৭টি বই থেকে সাহায্য নিয়ে ১৯৮২-র মার্চ মাসে ‘প্রসঙ্গ দেবদাসী’ নামে একটি পুস্তকে যেসব আলােচনা করেছেন তা আমাদের কারাে মতে অত্যন্ত উপাদেয়, সমাজকল্যাণের অমূল্য সম্পদ আবার কারাে মতে হয়ত বা তা ধর্ম বিরােধিতা ও অশ্লীলতা। তিনি তার পুস্তকের ৬০ পৃষ্ঠায় মন্দিরের দেবদাসী সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে দেবদাসীদের বেশ্যা বলেই প্রমাণ করেছেন। লিখেছেন, “দেবদাসী—মন্দিরের পৃষ্ঠপােষকতায় এক বিশেষ ধরণের বারবণিতা।”
তিনি আরও লিখেছেন, “মনােরঞ্জনই ছিলাে এই দেবদাসীদের অবশ্য কর্তব্য। এই মনােরঞ্জন রাজার রাজপুরুষদের এবং পুরােহিতদের।”
“এ প্রথা নতুন নয়, যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। ভারতবর্ষে এই দেবদাসী প্রথা সবচেয়ে ব্যাপক। ভারতীয় নারী সমাজ বহু যুগ ধরে এই প্রথার প্রভাবে অত্যাচারিত। … ১৯৪৭ সালে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়েছে আইনের সাহায্যে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভারতে দেবদাসী প্রথা আজও বিলুপ্ত হয়নি।” [৩ পৃষ্ঠা]
“এদেরই কেউ কেউ মন্দিরে নিয়ােজিত হতাে দাসীরূপে। এছাড়া কাঞ্চনমূল্যে কিনে বা বলপ্রয়ােগে এদের সংগ্রহ করা হতাে। অথবা রাজভয়ে গৃহস্থরা মেয়েদের দাসীরূপে নিবেদন করত মন্দিরে।” (ঐ, পৃষ্ঠা ৮ দ্রষ্টব্য)।
“বেশ্যাবৃত্তিকে স্বাধীনবৃত্তিরূপে প্রতিষ্ঠা করার পিছনে দেবদাসীবৃত্তিই সর্বপ্রথম প্রচেষ্টা। মন্দিরবাসীরা যে কার্যতঃ পুরােহিতদের মনােরঞ্জন করতেন সে সম্বন্ধে ইতিহাসে বহুবিধ তথ্য প্রমাণ আছে।” (ঐ পৃষ্ঠা ৯]
“দেবতার নামে যত অন্যায় অনুষ্ঠিত হয়েছে তার চূড়ান্ত হয়েছে দেবদাসী প্রথার মাধ্যমে নারীর অবমাননা।”[ঐ, পৃষ্ঠা ১৪] | দেবদাসীদের বেশ্যা না বলে তাদের অন্য নানা নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল যেমন :
দত্তা : কোন পুণ্যলােভী গৃহস্থ স্বেচ্ছায় মন্দিরে কন্যা দান করলে সে হতাে দত্তা দেবদাসী।
হৃতা : যে সব মেয়েকে হরণ করে নিয়ে এসে মন্দিরে উপহার দেওয়া হতাে।
বিক্রীতা : মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে কন্যাকে বিক্রয় করলে সে বিক্রীতা দেবদাসী রূপে গণ্য হতাে।
ভূত্যা : যে দেবদাসী মন্দিরের কাজে ভৃত্যরূপে আত্মাৎসর্গ করার জন্য স্বেচ্ছায় মন্দিররাসিনী হতে সে ভৃত্যা।
ভক্তা ও স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণকারিনী সন্ন্যাসিনীকে ভক্তা দেবদাসী বলা হতাে।
অলংকারা: নৃত্যগীত ও কলাবিদ্যা শিক্ষা সমাপ্ত হবার পর যে নারীকে অলঙ্কৃত করে দেবমন্দিরে অর্পণ করা হতাে সে অলঙ্কারা। রাজকন্যারাও এভাবে মন্দিরে অর্পিতা হতেন।
গােপিকা বা রুদ্ৰগণিকা : এরা নির্দিষ্ট সময়ে নৃত্যগীত করার জন্য মন্দিরের বেতনভােগিনী দেবদাসী সম্প্রদায়রূপে পরিচিতা।” [আরতি দেবী : ঐ, ২২-২৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য]
দামােদর ভট্টাচার্যের লেখা ‘কুট্টনীমতম’-এ নানা বর্ণনা আছে। তিনি বলেছেন যে, “দেবদাসীরা মন্দিরের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যা পেতেন, তাই তাদের আয় ছিল এবং এই জীবিকা ছিল বংশানুক্রমিক বা ক্রমােপগত।”
ক্ষেমেন্দ্র তার ‘সময়কৃত’ গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে বলেছেন যে, “দেবদাসী দেবালয়ে তার কর্মের জন্য শস্য প্রাপ্ত হয় মজুরী হিসাবে। মন্দিরগুলিতে একাধিক দেবদাসী ছিল। তারা ক্রমান্বয়ে নৃত্যগীত করত। মুক্তেশ্বর মন্দিরের উৎকীর্ণ লিপিতে উল্লিখিত আছে যে পহুব রাজ্ঞী ধর্মমহাদেবী চুয়াল্লিশজন দেবদাসীর নাম উল্লেখ করেছেন যার মন্দিরের কর্মাধ্যক্ষের কাছ থেকে বেতন পেতেন।” [ক্ষেমেন্দ্রের সময়কৃত’, ২৫ পৃষ্ঠ, দ্রষ্টব্য]
“স্বয়ং চৈতন্যদেব পুরীর মন্দিরের তৎকালীন দেবদাসীকে অনুগ্রহ করে ধর্ম দীক্ষা দিয়েছিলেন চৈতন্যচরিতামৃতে তার উল্লেখ আছে। অদ্যাবধি দেবদাসী পদ জগন্নাথ মন্দিরে যথেষ্ট সম্মানিত পদ। রথযাত্রা উপলক্ষে দেবদাসীর উপস্থিতি অবশ্য কর্তব্য।… উড়িষ্যা থেকে শুরু করে দক্ষিণ ভারতের সকল জায়গাতেই এই একই প্রথা অনুসৃত। .. দেবদাসী বৃত্তির অন্য দিকটি অর্থাৎ বারাঙ্গনাবৃত্তি এখন সােজাসুজি মন্দিরের বাইরেও বিস্তৃত হয়ে পড়েছে।” [ঐ, পৃষ্ঠা ৩১-৩২]
“তবে একথা ঠিক, অদ্যাবধি উপজাতি সমাজে নারীর মূল্য ও সামাজিক অধিকার অনেক বেশী। কিন্তু পাল, সেন বা তার পরবর্তীযুগে আর্য জীবনযাত্রার যেটুকু পরিচয় পাওয়া যায় তাতে নারীর মূল্য বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়নি।” [ঐ, পৃষ্ঠা ৩৫]
“মহাভারতের যযাতি উপাখ্যানে’আমরা ঋষি গালৰের বৃত্তান্ত পাই। রাজা যযাতি ঋষি গালবকেতার প্রার্থিত অর্থ উপার্জনের উপায়স্বরূপকন্যা মাধবীকে তার হাতে দান করেছিলেন। মাধবী পর্যায়ক্রমে তিনজন রাজা, একজন ঋষির শয্যাভাগিনী হয়ে চারটি পুত্র প্রসব করে গালবের প্রার্থিত অর্থ উপার্জন করেছিলেন। কোন ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়েও এ ঘটনার নৃশংস বর্বরতাকে চাপা দেওয়া যায় না।” (ঐ, পৃষ্ঠা ৩৬-৩৭]
“দেবদাসী প্রথার নামে গণিকাবৃত্তি প্রচলন এখন তাই বেশ স্বাভাবিক। মাদ্রাজ শহরের গণিকাপল্লীকে ‘দেবপল্লী’ বলে অভিহিত করা হয়।” (ঐ, পৃষ্ঠা ৪১-৪২]
“পুরােহিতদের প্রভাবে এবং কার্যকরী সাহায্যে অনেক কুসংস্কার ও কুপ্রথার মত দেবদাসী প্রথাও অদ্যাবধি প্রচলিত।” (ঐ, পৃষ্ঠা ৪৩)।
“বর্তমানে দেবদাসী প্রথা ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে বিশেষ একটা ভূখন্ডে। কর্ণাটক, কেরল, মহারাষ্ট্র, গােয়া, অন্ধ্র ও তামিলনাড়ুতে এই প্রথার ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ার প্রধান কারণ হল, পশ্চিম উপকূলের শহরগুলিতে বারবণিতার চাহিদা।… মহারাষ্ট্রের বিচিত্র জাতিবিন্যাসের বর্ণনায় বলা হয়েছে কতকগুলি তপশিলী নিম্নজাতির মধ্যে ‘মাঙ্গ জাতি’, ‘মাহার জাতি’ ও ‘চামার জাতির’ অন্যতম বৈশিষ্ট্য এরা নাচ গানে পারদর্শী। বর্তমানে মহারাষ্ট্র অঞ্চলের এই সাংলী জেলাতেই ‘মাঙ্গ’ জাতির উপাস্য দেবী ইয়ালাম্মাকে কেন্দ্র করে দেবদাসী প্রথা চালু আছে।” [পৃষ্ঠা ৫৬]
“কর্ণাটকে দেবদাসী কথাটা চালু নয়। ব্যবহারিক সংজ্ঞা হল ‘বাসবি’, ‘কসবি’, ‘সুলী’ ইত্যাদি। ‘বাসবী’ অর্থাৎ স্বেচ্ছাচারিনী, ‘কসবি’-দেহব্যবসায়ী আর ‘সুলী’ মানে ব্যবসায়ী বেশ্যা। পতিতা পল্লীগুলির বিভিন্ন নাম।গােয়াতে এদের নাম ‘ভবানী’, পশ্চিম উপকূলে ‘কুড়িয়ার’, অন্ত্রে ‘ভগমবন্ধাল’, তামিলনাড়ুতে ‘তেবরিয়াব’ এবং মহারাষ্ট্রে ‘মুরলী’ ও ‘আরাধিনী’। [পৃষ্ঠা ৫৭]
দশম শতাব্দীতে জৈন মন্দিরগুলিতেও দেবদাসী প্রথা প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষকে ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করার এটা ছিল সহজ উপায়। ১৩৯০ সাল পর্যন্তও তিরুপতি ও নঞ্জনগুডের মন্দিরে দেবদাসী নিয়ােগকরা হয়েছে। … কিন্তু আর্য প্রভাবিত দেবদাসী প্রথার সর্বনাশাদিকটাইএখানেও প্রকটধর্মীয় আবরণেরআড়ালে দেবদাসীদের উপভােগের সামগ্রীতে পরিণত করা।” [পৃষ্ঠা ৫৯]
“পর্তুগীজ, ফরাসী, ইংরেজ সকলেই স্থানীয় মেয়েদের ‘উপপত্নী’ হিসাবে বাড়ীতে রাখত। এদের সন্তান সন্ততিরা বর্তমানে ভারতীয় জাতিবিন্যাসে একটা বড় অংশ।” [পৃষ্ঠা ৬০]।
“ধনদেবতা কুবেরের নবমন্দিরের এই নতুন দেবদাসীরা মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের বিভিন্ন গ্রাম থেকে সংগৃহীত।” [পৃষ্ঠা ৬৩]
“প্রথমত পরিবারের অনেকগুলি মেয়ে থাকলে অন্ততঃ একটিকে দেবতার কাছে দিতে হবে এটা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ।…কোন দম্পতি সন্তানহীন হলে মানত করে প্রথম কন্যা সন্তানটিকে দেবতার কাছে উৎসর্গ করা ছিল প্রাচীন নীতি। সাত-আট বছর বয়সের মধ্যেই তাকে উৎসর্গ করতে হত।” [পৃষ্ঠা ৬৬]।
“বর্তমানে যে সমস্ত মন্দিরে দেবদাসী উৎসর্গ করা হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে ইয়েলেম্মা যুগপৎ কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের লােকদেবী। কামাপুরের কমলেশ্বরী, খান্ডবার ভাগ্যমুরলী, মহেগাশীর সান্তাদুর্গা ও অন্যান্য লােকদেবীদের মন্দিরেও দেবদাসী প্রথা চালু আছে। এছাড়া হনুমান মন্দির ও জগদগ্নি মন্দিরেও দেবদাসী প্রথা চালু আছে, যদিও এরা লােকদেবী নন। হনুমান তার ব্রতচারী কুমার জীবনের জন্য পূজিত ও প্রশংসিত। তার মনােরঞ্জনের জন্য নারীভােগের ব্যবস্থার ব্যাপারটি কৌতূহল উদ্রেক করে। … সৌন্দৰ্তী মন্দিরে [হেয়ৈলেম্মা গুড়া] দেবদাসী উৎসর্গ হতাে বলে জানা গেছে।…উগার গােলে ইয়েলাম্মা পাহাড়ের কোলে অবস্থিত মন্দিরে দেবদাসী উৎসর্গ হয়।… ধর্ম এর আবরণ ছাড়াই বর্তমানে এখানে বেশ্যাবৃত্তি চলছে অবাধে।” [পৃষ্ঠা ৬৮]
“মুগলকোড, মাঙ্গসুলী, কোকটনুর, তেরদাল কুরচি এবং আঠানী শহরের নিকটবর্তী শংকরহাট্টি, থারুর ইত্যাদি গ্রামে অদ্যাবধি ব্যাপকভাবে দেবদাসী উৎসর্গ করা হয়।… বিজাপুর শহর ও বিজাপুর জেলার সমস্ত তালুকেই দেবদাসী প্রথা প্রবলভাবে প্রচলিত। ‘দেবদাসী বলয়’ নামে যে অঞ্চলটি কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের সংযােগস্থল তার প্রধান অংশ এই জেলাতেই বর্তমান। এই শহরগুলিতে পতিতাপল্লী অত্যন্ত সমৃদ্ধ। শহর ছাড়া নিকটবর্তী গ্রামগুলিতেও দেবদাসী ও অন্য পতিতাদের সমারােহ ব্যাপক।” (পৃষ্ঠা ৬৯-৭০]
“দেবদাসী উৎসর্গ করা হয় ইয়েলেম্মার মন্দিরেই সবচেয়ে বেশী। তুলসীগােরির হনুমান মন্দিরে, টিকেটায় মন্দিরেও দেবদাসীদের উৎসর্গ করা হয়। এছাড়া জগদগ্নি মন্দিরে ও পরশুরাম মন্দিরেও দেবদাসী উৎসর্গ করা হয়।”
“এইসময়কার দৃশ্যটা এই, দূরদূরান্ত থেকেদলে দলে যাত্রীরা আসছে। মাইল খানেক লম্বা গাড়ীর সারি। সারি সারি নগ্নদেহ নিমপাতার মালাপরা ছােট ছােট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে উৎসর্গীত হবার জন্য, শুকনাে উপবাসক্ষিন্ন মুখ, স্নানকরানাে বলির ছাগশিশুর মতাে। একবার দেবদাসী হয়ে গেলে তাদের বিবাহ নিষিদ্ধ।” [ঐ গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৭২]
“যদিও সাধারণ জনসমাজ এই প্রথার বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে উঠেছিল, তবুও মুষ্টিমেয় মন্দির কর্তৃপক্ষ হিন্দু ধর্ম রক্ষণের নামে তাদের নিজেদের স্বার্থ [vested interest] রক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়ে উঠেছিলেন। মন্দিরের অধিকার এবং পবিত্রতা রক্ষার নামে তারা আসলে মন্দিরের সম্পদকে নিজেদের কাজে লাগিয়ে মন্দিরের পবিত্রতা নষ্টই করেছেন।” (ঐ, পৃষ্ঠা ৭৩)।
“অল্পবয়স্কা বা অপ্রাপ্ত বয়স্কা বালিকার বিবাহ সরকারী আইনে নিষিদ্ধ হয়। এই সংশােধন প্রস্তাবটি আইনে রূপান্তরিত হওয়ার পর ১৮ বছরের মেয়েদের উৎসর্গ করা শুরু হলাে।” [ঐ, পৃষ্ঠা ৭৮] ।
“ভারতে সর্বত্র পতিতালয় নিষিদ্ধ হয় ১৮৫৫ সালের পার্লামেন্ট আইনে, কিন্তু এই ব্যাপক পতিতাবৃত্তির উপর তা প্রয়ােগ করবার কোন উপায় ছিল না। শ্রীমতী মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি এই আইনের ফাকটা ধরে ফেললেন। তিনি দেখলেন যে, ভারতীয় মন্দিরগুলি সম্বন্ধে এই আইন প্রযুক্ত হতে পারছে না। ফলে এই প্রথা ধীরে ধীরে মন্দির কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। মাদ্রাজ শহরেই পতিতালয়গুলি প্রকাশ্যে ‘দেবীপল্লী’ বলে অভিহিত হতে শুরু করেছে।” [ঐ, পৃষ্ঠা ৭৮]
“ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭২ও৩৭৩ ধারায় অপ্রাপ্তবয়স্কা কুমারীদের মন্দিরেউৎসর্গ করার জন্য দন্ডদানের ব্যবস্থা থাকলেও তা কোন সময় সঠিকভাবে কার্যকরী হয়নি।”
এই আলােচনায় জানা গেল মুনি ঋষিদের অতীত ইতিহাস এবং বর্তমানে তাদের অনুসারীদের চলমান অবস্থা। আগামীকালের রামরাজত্ব প্রশাসনের পূর্ণ সমর্থন ও সহযােগিতা নিয়ে যদিসৃষ্টিই হয় তাহলে তা হবে সভ্যতাও আধুনিক সংস্কৃতির পরিপন্থী।
রাধাকমল চট্টোপাধ্যায় (এম. এ., পি-এইচ. ডি. আমেরিকা) ‘OH YOU HINDU AWAKE’ বইয়ে লিখেছেন [বঙ্গানুবাদ] : “আমি নিজে কুলীন ব্রাহ্মণ হয়েও একথা আপনাদিগকে বলিতেছি। কুচক্রীগণ হইতে সাবধান।” লেখক ব্রাহ্মণ জাতিকে ব্রহ্মপুত্র উল্লেখ করে বেশ বেদনা নিয়ে ভারতের হিন্দুজাতির দুর্নাম ও কলঙ্ক মুছতে যেভাবে কলম ধরেছেন তা অবশ্যই উল্লেখযােগ্য।
তিনি লিখেছেন, “মুসলমান রাজত্বকালে ইহারাই বাদশাদিগকে সুন্দরী নারী উপহার দিয়ে খােশামােদ করিত, ইংরেজ আমলে ইংরেজদের। অথচ শূদ্র শিবাজী সাম্রাজ্য দখল করিয়া যখন সিংহাসনে বসিয়াছেন এই ব্রাহ্মণগন তখন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করে নাই। পরে মন্ত্রীরূপে প্রবেশ করিয়া তাহার সাম্রাজ্যকে পাঁচভাগ করিয়া ধ্বংস করিয়া দেয়।” [পৃ. ৬]।
“পুরীর শঙ্করাচার্য নিরঞ্জনদেব তীর্থ বলিয়াছেন : অস্পৃশ্যগণ হিন্দু নহে। অথচ কি আশ্চর্য সংবিধান বলিতেছে অস্পৃশ্যগণ হিন্দু। মনুস্মৃতি [হিন্দুধর্মের মূলশাস্ত্র] অনুযায়ী শূদ্রগণ কাক, ব্যাঙ, পাতিহাঁস, ছোঁচা, কুকুর ও ভবঘুরে পশুদের সামিল ও অক্ষম। শূদ্রদিগের ধনসম্পদ বঞ্চনা করিয়া কাড়িয়া লইবার অধিকার উচ্চবর্ণের মানবের আছে। শূদ্রগণকে সম্পদ সঞ্চয়ের, স্বনির্ভর বা স্বাধীনভাবে চলার কোন অধিকার দেওয়া হয় নাই [পৃ. ৪৪]। এই বিংশ শতাব্দীতে যখন দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় বহুদূর অগ্রসর হইতেছে, তখনও ভারতের বহুস্থানে অদ্যাবধি নিম্নবর্গের লােকগণকে জুতা মাথায় তুলিয়া পথ চলিতে বাধ্য করা হয়। হােটেলে, রেস্তোরায় এখনও তাহাদের জন্য আলাদা বাসন রাখা হয়। খাওয়ার পর তাহাদের দ্বারা ধােয়াইতে বাধ্য করে [পৃ. ১৫]। কোন শূদ্র ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করিলে তাহার জিহ্বা কাটিয়া দেওয়া হইবে। কোন শূদ্র যদি উচ্চবর্ণের লােকের সমমর্যাদা ধারণ করে তবে তাহাকে প্রকাশ্য রাজপথে বেত্রাঘাত করিতে হইবে (অপস্তম্ভ ধর্ম সূত্র ৩-১০-২৬ শ্লোক)। আর সে শুদ্র] যদি বেদমন্ত্র মুখস্থ করিয়া রাখে তাহার দেহ টুকরা টুকরা করিয়া কর্তন করিতে হইবে।” [পৃ. ১৭]
১৮৩ “হরিজন নারীগণকে রাজপথে উলঙ্গ অবস্থায় প্যারেড করিতে বাধ্য করা হইয়াছে। [‘কারেন্ট’ পত্রিকা ৬.৪.৮৩]। তাহার পােশাক উচ্চবর্ণের লােকের গাত্ৰস্পর্শ করায় একজন নিম্ন লোেককে মারিয়া হাড় ভাঙ্গিয়া দেওয়া হইয়াছে [টাইমস অফ ইন্ডিয়া’, ১৮.১১.৮৪]। উচ্চবর্ণের লােকেরা হরিজনদের কূপে মরা জন্তু ও মলমূত্র নিক্ষেপ করিয়াছিল, পুলিশ কোন ব্যবস্থা লয় নাই [টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া, ১৮.১.৮৪]। মন্দিরে পূজা দিতে উদ্যোগী এক হরিজনকে মারিয়া তাহার মুখে বিষ্ঠা ঢালিয়া দেওয়া হইয়াছে, সােরাব তালুকের ঠাটুর গ্রামে—‘ডেকান’, ৫.২.৮৮।
এক হরিজন মহিলাকে উদ্ধারকারী নৌকা হইতে জলে নিক্ষেপ করা হইয়াছে—‘ব্লীজ’, ১৮.৩.৮৪।
ইন্দিরাগান্ধী রাজ্যসভায় ১৮.৮.৭০ সালে ঘােষণা করিয়াছিলেন যে, বিগত তিন বৎসরে ১১১৭ জন হরিজন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এইভাবে হত হইয়াছে। ইহা মাত্র রিপাের্ট করা সংখ্যা। রিপাের্ট না করা সংখ্যা ইহার দশগুণ। [পৃ. ১৭, ১৮]
এইতাে সেদিন পাটনাতে একলক্ষ শূদ্র ব্রহ্মপুত্রগণের অত্যাচার হইতে রেহাই পাওয়ার জন্য বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করিল।” [পৃ. ১৯]।
ভারতের খুব বড় বড় পত্রিকাগুলির পরিচালক ও কর্মীদের সংখ্যা –“দিইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ ৯৩% কর্মী, ‘দি হিন্দু পত্রিকায় ৯৭% কর্মী, টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে’তে ৭৩% কর্মী ব্রাহ্মণ সন্তান।” [পৃ. ২০)
ব্রাহ্মণেরা কিভাবে কি পরিমাণে প্রশাসনের চেয়ারগুলি দখল করেছে—“শতকরা হিসাবে লােকসভার সদস্য ৪৮ ভাগ, রাজ্যসভার সদস্য ৩৬ ভাগ, রাজ্যপাল/ লেঃ গভর্ণর ৫০ ভাগ, ঐ সচিব ৫৪ ভাগ, ইউনিয়ন কেবিনের সচিব ৫৩ ভাগ, মন্ত্রীর মুখ্য সচিব ৫৪ ভাগ, মন্ত্রীর একান্ত সচিব ৭০ ভাগ, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব ৬২ ভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর [উপাচার্য] ৫৬ ভাগ, সুপ্রীম কোর্টের জজ ৫৬ ভাগ, হাইকোর্টের জজ/অঃ জজ ৫০ ভাগ, এম্বাসাডর হাই কমিশনার ৪১ ভাগ, পাবলিক আন্ডারটেকিংয়ের কেন্দ্রীয় ৫৭ ভাগ, রাজ্যের ৮২ ভাগ। সৌজন্যে : Voice of the Week 10/89। ব্যাঙ্ক ৫৭,এয়ারলাইন্স ৬১, আই.এ.এস. অফিসার ৭২,আই.পি.এস. ৬১, রেডিও এবং টিভিতে ৮৩, সি. বি. আই., কাস্টমস ও এক্সাইজের ৭২ ভাগ উচ্চ জাতির হিন্দুদের দখলে। ৩.৫% ব্রাহ্মণ ভােগ করে ৬২%, ৫.৫% ক্ষত্রিয় ভােগ করে। ১২%, ৬% বৈশ্য ভােগ করে ১৩%, বাকী ৮৫ ভাগ মানুষ ভােগ করে ১৩ ভাগ চাকরি।” [পৃ. ২১]।
ইউরােপ, আমেরিকা ও আরবদেশগুলিতে যাদের চাকরির জন্য পাঠানাে হয় তাদের বেতন [ভারতীয় টাকায়] ভারতের তুলনায় বহুগুণ বেশী। ব্রাহ্মণরা সেখানে ৬৭% চাকরি করে। আইনের ক্ষেত্রে ৫৩%, ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রে ৫৭% এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ৫১% ব্রাহ্মণরা দখল করে আছে। [পৃ. ২২, ২৩]
রামকমবাবুকে ছেড়ে দিলেও ভারতের ইতিহাসখ্যাত নেতাদের অনেকে ধর্ম গ্রন্থের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন না। তাই মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, আমার রাম [ঈশ্বর রাম] রামায়ণের রাম নহে।
“রামায়ণ ও মহাভারত অপর আরব্য উপন্যাস ছাড়া কিছুই নহে।” — জওহরলাল নেহরু।
“রাম কোন দেবতা নহে, একটি বীর পুরুষ বলা চলে।” — রাজা গােপালাচারী।
চিতাম্বরনাথ মালিয়ার বলেন, “রামায়ণ কোন স্বর্গীয় উপাখ্যান নহে; ইহা একটি সাহিত্য মাত্র।”
প্রসঙ্গান্তরে তিনি লিখেছেন, “পি.টি. আই. জানাইতেছে, বিগত তিন বৎসরে ভারতে কালীমূর্তির পাদপীঠে ২৫০০ যুবক যুবতীকে বলি দেওয়া হইয়াছে। এ.এফ.পি. জানাইতেছে, প্রতি বৎসর শত শত যুবক, কুমারীদিগকে কালীমূর্তির কাছে বলি দেওয়া হয়। কামাসেবক তাহার নিজের ৮ বৎসরের ছেলেকে দিল্লীতে মা কালীর কাছে দিবাভাগে বলি দিয়াছে [পৃ.৩২]। দিল্লীর কালীবাড়ির পুরােহিত বলে, মা কালীর কাছে সন্তান বলি দিলে অবশ্যই তাহার পুত্র সন্তান হইবে।’ মাকে শান্ত ও সন্তুষ্ট করিবার জন্য বয়স্ক লােককেও বলি দেওয়া হয়। বিহারের পুলিশপ্রধান জে. সহায় বলেন, যেখানে গ্রামসুদ্ধ লােক বলির পক্ষে সেখানে আমরা কী করিতে পারি ?” [পৃ. ৩২]
“মহারাষ্ট্রের এক প্রভাবশালী নেতা মাঞ্জা গ্রামের ১১টি বালিকাকে বলি দিয়াছিল গুপ্তধন পাওয়ার জন্য, ৪ ব্যক্তির ফাসি হইল, কিন্তু আসল আসামী প্রভাবশালী ছিল বলিয়া এড়াইয়া যাইল। কিছুকাল পূর্বে সিদ্ধার্থ ও রবি নামে দুই ব্যক্তি তাহাদের ২১ বৎসরের বােনকে কাটিয়া টুকরা টুকরা করিয়া আগুনে আহুতি দেয়। ইহারা গুপ্তধনের লালসায় এই কাজ করিয়াছিল। কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ-সন্তানগণ এই নৃশংস নরবলি হইতে বাতিল। এই কি হিন্দুধর্ম? লজ্জায় আমাদের যে মাথা কাটা যায়! হিন্দুদেরকে ইহারা কোথায় লইয়া যাইতেছে? ..নিজেকে জানুন। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন। আপনার ঈশ্বর কে? মস্তকে গঙ্গানদী ও চন্দ্রধারী এবং আপন পুত্রকে হত্যাকারী শিব কি আপনার ঈশ্বর? …” [পৃ. ৩২, ৩৩ ও ৩৭]
“এই হিন্দু [হিন্দুত্ব] শব্দটি কোথাহইতে আসিল? হিন্দুর কোন পুণ্য পুঁথিতে এই হিন্দু শব্দটি নাই। হিন্দুদের পুণ্যতম পুঁথি বেদই বল আর ভাগ্বদগীতাই বল, কোথাও এই হিন্দু শব্দটি খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। এমন কি রামায়ণ মহাভারতেও নয়। হিন্দুর পবিত্র গ্রন্থগুলিতে ধর্মের কোন সংজ্ঞা নাই।এ কেমন কথা? কি আশ্চর্য ব্যাপার!!” [পৃ.৩৯]
“হে হিন্দুগণ, সত্যের অনুসন্ধান কর। সত্যই তােমাকে মুক্তি দিবে।” [পৃ.৩৯]
“লিঙ্গ ও যােনী হইল স্ত্রী ও পুরুষের রতিক্রিয়ার গােপন অঙ্গ। গােপন অঙ্গ সহ হিন্দুদিগকে সব কিছুরই পূজা করিতে হয়। তাহারা তাহাদের সন্তানের নামও রাখে শিবলিঙ্গ বা রামলিঙ্গ। কর্ণাটক প্রদেশে পুরােহিতগণ পুরুষ ও মহিলা উভয়কে বিবস্ত্র হইয়া উপাসনা করিতে বাধ্য করে। ব্রহ্মপুত্রগণ ধর্ম শিক্ষক নহে। ইহারা ভারতের মানুষকে লইয়া খেলা করে, আনন্দলাভ করে।” [পৃ. ৪১)।
“বারাণসীর বহু যােগী উলঙ্গ হইয়া বাস করে। এবং ভিক্ষা করিয়া খায়। তাহারা নােংরাঅস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাসকরে ও তাহাদের মধ্যে ড্রাগ আসক্তিঘােরতর।…এটা আরও লজ্জাজনক যে, এই ন্যাংটা সাধুদের ভক্তগণের মধ্যে হাইকোর্টের জজ, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, রাজনীতিবিদ এমনকি সিনেমার অভিনেতা অভিনেত্রী আছেন। আরও আশ্চর্যের কথা প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত।” [পৃ. ৪৩]
“হিন্দুধর্মগ্রন্থ নরসিংহ পুরাণের ১৬৯ পৃষ্ঠা প্রমাণ করে যে, পৃথিবী চেপ্টা। বরাহ অবতার নাসিকার অগ্রভাগ দ্বারা পৃথিবীকে মাদুরের মত মুড়াইয়াছিলেন। এখন নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে যে, পৃথিবী গােলাকার।”
“বিষ্ণুপুরাণ বলে যে, সূর্য পৃথিবী হইতে ৮লক্ষ মাইল এবং চন্দ্র ২২ লক্ষ মাইল দূরে অবস্থিত। নক্ষত্রবিদ্যা প্রমাণ করিয়াছে চাদ পৃথিবী হইতে ২ লক্ষ ৪০ হাজার মাইল এবং সূর্য ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল দূরে অবস্থিত। কোথায় ৮ লক্ষ আর কোথায় ৯ কোটি!!” [তথ্য ঐ, পৃষ্ঠা ৪৬]।
“শাস্ত্রীয় পুস্তক মার্কন্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী পৃথিবীর আয়তন ৪ বৃন্দ অর্থাৎ ৪০০ কোটি বর্গমাইল। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞান বলে পৃথিবীর আয়তন মাত্র ১৯ কোটি ৭ লক্ষ বর্গমাইল। হায়! কোথায় ৪০০ কোটি আর কোথায় মাত্র ১৯ কোটি!” [তথ্য ঐ, পৃ. ৪৭]
“বেদ-পুরাণ বলে যে, দৈনিকসূর্যোপসনা করা দরকার এবং রােজ সূর্যের দিকে খালি চোখে তাকাইয়া থাকিলে দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়াছে যাহারা এইরূপ করিয়াছিল তাহাদের চোখ এখন অন্ধ। আর এই জন্যই ভারতে সবচেয়ে বেশি অন্ধ লােক। সুর্য বা সােনী উপাসনায় কোন বৈজ্ঞানিক সত্য নাই। বরং বৈজ্ঞানিক ও ডাক্তারগণ খালি চোখে সূর্যের দিকে তাকাইতে মানা করেন। কাহারা সত্য বলিতেছে, ডাক্তারগণ না হিন্দুশাস্ত্র ?” [পৃ. ৪৮]
বইটিতে শ্রী চট্টোপাধ্যায় হিন্দু ধর্মের যে সমস্ত ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরেছেন তার কিছুমাত্র উল্লেখ করা হােল।
ডক্টর চট্টোপাধ্যায়ের বইটির ‘পরিচিতি’ লিখেছেন জি. শ্রীবাস্তব [এম.এ., পি.এইচ. ডি. লন্ডন] মহাশয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০.৫.৯৩ তারিখে লিখিত এই পরিচিতিতে তিনি লিখেছেন— “আমার কথা বলিতে গেলে প্রথমে আমি এসব বিশ্বাস করি নাই। কিন্তু গ্রন্থের শেষে উল্লিখিত ভিডিও টেপ এবং গ্রন্থাদি পাঠ করিয়া আমার বিশ্বাস অটুট হইয়াছে। ভারতের শাসকবর্গ শুধু দেশেরই অবিশ্বাস্য ক্ষতিসাধন করেন নাই, হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দু জাতিরও অকল্পনীয় ও অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করিয়াছেন। ইহা ক্ষমার অযােগ্য।
… আমাদের ধর্ম ও ধর্মীয় গ্রন্থসকল আমাদেরকে কী বলে? কতগুলি দেবতা? পুরাণের কাহিনীগুলি কি ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত ? মােটেইনয়। এসব কতকগুলি কল্পিত রূপকথা মাত্র। রাম, সীতা, দুর্গা, শিব, পার্বতী, ব্রহ্মা, গণেশ এবং কৃষ্ণ সম্বন্ধে ইহারা কী বলে? ইহাদের গল্পে যে এতাে অশ্লীলতা ও ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে যৌন মিলনের কথা সব ফলাও করিয়া লেখা, তাহা কি কেহ দেখিতে পাইতেছে না ? এই সমস্ত পুস্তক পরিবারের লােকজনেদের মধ্যে পাঠের সম্পূর্ণ অযােগ্য। লিঙ্গ, যােনী সম্বন্ধে বিদেশী গুণীগণ আমাদের জিজ্ঞাসা করিলে আমরা কী উত্তর দিব? আমরা যে খুব গর্ব করি যে, বিভূতি, সূর্যপূজা, মূত্রপান উত্তম। ইহা আমাদের মূঢ়তা ও অজ্ঞানতারই বহিঃপ্রকাশ।…এক্ষণে ইহা প্রমাণিত যে, ভারতের ৯৫ ভাগ লােককে ৫ ভাগ লোেক কিভাবে শাসন করিয়াছে। … বিশেষ করিয়া বাবরী মসজিদ ধূলিসাৎ হইবার পর আমরা বড়ই বিব্রত বােধ করিতেছি। ভারত একবার ভাগ হইয়াছে, আবারও ভাগ হইবে বলিয়া আমরা ভীত। ইহার মূলে ব্রহ্মপুত্রগণের এইসব কু-অভিসন্ধি। ভগবান না করুন যদি এই পুনর্বিভাজন ঘটিয়াই যায় তা হইলে হিন্দু বলিতে ভারতে শুধু এই ব্রহ্মপুত্রগণই থাকিবে বাকীরা সব বৌদ্ধ, ইসলাম বা খৃষ্টান হইয়া যাইবে। শ্রেষ্ঠ স্বামী বিবেকানন্দজী কি ইহা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দিয়া যান নাই? এই চিরন্তন সত্যকে প্রকাশ করিবার জন্য তিনি কি ধিকৃত হন নাই?”
ভারতের কোটি কোটি মুসলমান সম্বন্ধে চিন্তার বিষয় থেকেই যায় যে, কী উপায় অবলম্বন করলে তারা নিরাপদে, নিশ্চিন্তভাবে অপর সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করতে পারেন স্বাভাবিক অবস্থায়। ভারতের নব্বই শতাংশের বেশি হরিজন, তপশিলী, অচ্ছুত বা ছােটলােক শ্রেণী এবং অহিন্দু বলে কথিত—তাঁদের যাঁরা কাছে টেনে নিতে পারেননি, হাজার হাজার বছর ধরে যাঁরা তাঁদের মন্দিরে প্রবেশ করতে বা ঠাকুর-দেবতা স্পর্শ করতে দেননি তারা কি করে মুসলমান, শিখ ও খৃষ্টানদের একাত্ম করে নিতে পারেন তা চিন্তার বিষয়। মুসলমান, খৃষ্টান, ইহুদী প্রভৃতি সম্প্রদায়ের অপর সম্প্রদায়ের প্রতি অত্যাচারের প্রচারিত ইতিহাস সামনে এনে ভাবলে দেখা যায়, আক্রান্ত জাতি যখন তাদের মত ও পথকে মেনে নিয়েছিল, নিশ্চয় তখন বাকি ছিল না কোন দ্বন্দ্ব বা ব্যবধান। মুসলমান জাতি যদি সীমা অতিক্রম করে ধর্ম বা ধর্ম বিশ্বাস খতম করে দিয়ে শুধু প্রাণ আর ধনসম্পদ রক্ষার জন্য হিন্দুত্বকে মেনে নেয়, রামরাজত্ব’কে বরণ করে তাহলে আবার প্রশ্ন এসে যায় যে, হিন্দু ধর্ম, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বৈদান্তিক ধর্ম—তিনই কি এক না একেই তিন?
১৯৮৮ সালের এপ্রিলের ১৬ তারিখে শ্ৰীসাগরময় ঘোেষ সম্পাদিত ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা থেকে কয়েকটি প্রশ্ন বা কথা তুলে দিচ্ছি এখানে।
‘যদি বলি যাহারা হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মানে তাহারা মহামেডান মুসলমান, যাহারা হজরত ঈসা (আঃ) বা যীশুখৃষ্টকে মানে তাহারা খৃষ্টান, যাহারা বুদ্ধকে মানে তাহারা বৌদ্ধ, অনুরূপভাবেই যাহারা হিন্দুকে মানে তাহারা হিন্দু; প্রশ্ন আসে হিন্দু কে?
যদি বলি—যাহারা রাম রামায়ণকে মানে তাহারাই হিন্দু; প্রশ্ন আসে, যাহারা রাম রামায়ণকে মানে না, রাবণকে মানে, যাহারা বলে—রাম বলে কোন বাস্তব চরিত্রই নাই; রামায়ণ কোন ধর্ম গ্রন্থই নয়, উপাখ্যান; শুধুমাত্র প্রজার মনােরঞ্জনের জন্য নির্দোষিত নিরপরাধিনী পতিব্রতা সীতার বনবাস ও নির্বাসন, শূর্পণখার কাছে বিবাহিত লক্ষণকে অবিবাহিত বলিয়া পরিচয় দান, শূর্পণখার নাক কাটার নির্দেশে শ্রীরাম চরিত্রের পক্ষে অনপনােদীয় কলঙ্ক; তাহারা কি হিন্দু নয়?
যদি বলি যাহারা পুরাণকে মানে তাহারা হিন্দু, প্রশ্ন আসে—যাহারা অষ্টাদশ পুরাণের একটাকেও ধর্ম গ্রন্থ বলিয়া মানে না তাহারা কী ?
যদি বলি—যাহারা পৌত্তলিক, যাহারা মূর্তিপূজা করে তাহারাই হিন্দু, প্রশ্ন আসে যাহারা মূর্তিপূজা করে না, পৌত্তলিকতার ঘাের বিরােধী তাহারা কি হিন্দু নয়?
অনুরূপভাবেই প্রশ্ন আসে, যদি বলি-যাহারা বেদকে মানে তাহারা হিন্দু, যাহারা বেদবেদান্ত মানে না, তাহারা তবে কি? তাহারা কি অহিন্দু? অবশ্য বেদ যাহারা মানে তাহাদিগকে বৈদিক এবং তাহাদের ধর্মকে বৈদিক ধর্ম বলিয়া পরিচয় দিলে এহেন প্রশ্নের সম্মুখীন হইতে হয় না। আর যদি বলেন যাহারা নিরীশ্বরবাদী তাহারাও হিন্দু, যাহারা একেশ্বরবাদী তাহারাও হিন্দু, যাহারা বহুঈশ্বরবাদী তাহারাও হিন্দু, যাহারা রাম রামায়ণ মানে তাহারাও হিন্দু, যাহারা রাবণের পূজা করে, রাবণকে মানে তাহারাও হিন্দু, যাহারা রামচরিত্র এবং রাময়ণকে ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মচরিত্র বলিয়া আদৌ বিশ্বাস করেনা তাহারাও হিন্দু; যাহারা বেদ মানে তাহারাও হিন্দু, যাহারা বেদ বেদান্ত মানে না তাহারাও হিন্দু,তবে বলিতে হয় যাহারা যীশুখৃষ্ট এবং বাইবেলকে মানে তাহারাও হিন্দু, যাহারা বুদ্ধকে মানে তাহারাও হিন্দু, যাহারা শঙ্করাচার্যকে মানে তাহারাও হিন্দু, যাহারা গুরুনানক এবং গ্রন্থ সাহিবকে মানে তাহারাও হিন্দু, যাহার অগ্নিপূজা এবং সাপের পূজা করে তাহারাও হিন্দু, যাহারা গরু খায় তাহারাও হিন্দু, যাহারা গাে মাংস খায় না, বরং গাভীকে দেবতা মানে তাহারাও হিন্দু, এমনকি যাহারা কুরআন এবং হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মানে তাহারাও হিন্দু। এক কথায় বলিতে হয় বিশ্বের বুকে অহিন্দু কেহ নাই; সমগ্র বিশ্বমানবই হিন্দু।…
বেদ বেদান্ত যে কোন ধর্মের মৌলিক পরিচিতি নির্ভর করে তাহার ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মাবতার বা ধর্মপুরুষ ও ধর্মচরিত্রের উপর। হিন্দুধর্মও ইহার ব্যতিক্রম নয়; সকলে স্বীকার করুক আর নাই করুক, একথা সত্য যে, যে সমস্ত গ্রন্থ হিন্দুসমাজে ধর্মগ্রন্থ বলিয়া পরিচিত-বেদই তন্মধ্যে সমধিক প্রসিদ্ধ।
প্রশ্ন আসে—বেদ কি সত্যই ঈশ্বরপ্রেরিত ধর্মগ্রন্থ? বেদের প্রণেতা কে? বেদের অবতরণকাল কী? বেদের আমন্ত্রণ এবং শিক্ষা কি সকল মানুষের জন্য, সর্বকালের জন্য? বেদ নামক কোন গ্রন্থ যদি কোন কালেই সত্য-সত্যই ঈশ্বরপ্রেরিত হইয়া থাকে তবে আজও যে তাহা অবিকল অবিকৃত, যথাপূর্ব তথাপর একই অবস্থায় রহিয়াছে তাহারই বা প্রমাণ কি? স্বয়ং বেদ এবং বেদের প্রণেতা কি ইহাকে ঐশ্বরিক গ্রন্থ এবং নিজেকে ঈশ্বরপ্রেরিত অবতার কিংবা ধর্মপুরুষ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন? বলা বাহুল্য, ইতিহাসের অগাধ সমুদ্রমন্থন করিয়াও ইহার কোন নির্দিষ্ট নিশ্চিত উত্তর পাওয়া যায় না।..
দৃষ্টান্তস্বরূপ বলি—বেদই ধরুন। কবে কোন্ কালে, ইতিহাসের কোন্ যুগে কোন্ সনে বেদের জন্ম, অদ্যাবধি তাহার কোন নিশ্চিত এবংইতিহাসসম্মত উত্তর পাওয়া যায় নাই। অনেকেই এ বিষয়ে অনুমান প্রকাশ করিয়াছেন, কিন্তু অনুমান অনুমানই, ইতিহাস নয়। অধিকন্তু এই অনুমানও বিতর্কিত। অনুরূপভাবে বেদের সংখ্যা এবং রচয়িতা সম্বন্ধে নানামুনির নানা মত।।
প্রাচীন বা সনাতনধর্মী বলিয়া পরিচিত হিন্দুরা বলেন—ব্রহ্মাই বেদের প্রণেতা, ব্রহ্মার চতুর্মুখ হইতেই ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ এবং অথর্ববেদ এই চারখানা বেদের জন্ম; আবার তাহাদেরই অভিজ্ঞ পন্ডিতদের অনেকের মতে বেদের কোন নির্দিষ্ট প্রণেতাইনাই, বরং একাধিক ব্যক্তির সমবেত চেষ্টা ও যৌথ উদ্যোগে এক একখানা বেদ রচিত হইয়াছে; বেদের প্রারম্ভেই ঐ সমস্ত রচয়িতা ও তাহাদের পুঠনভঙ্গী, গায়ত্রী লিখিত রহিয়াছে।
আর্যপন্থী হিন্দুরা বলেন—চারিখানা বেদ চারজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির নিকট অবতীর্ণ হইয়াছে। কিন্তু এই চারজন কাহারা, কিই-বা তাহাদের পরিচয়, এ সম্পর্কে কোন প্রমাণসিদ্ধ উত্তর নাই।
কেহ কেহ বলেন—পরমেশ্বর হইতেই বেদের উৎপত্তি। কেহ কেহ বলেন—আগুনের ধোঁয়ার মত ব্রহ্মা হইতেই বেদের জন্ম। কেহ কেহ বলেন—অগ্নি, বায়ু প্রভৃতি হইতেই বেদের সৃষ্টি। মনুস্মৃতিতে আছে, অগ্নি বায়ু সূর্য হইতেই যথাক্রমে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ এবং সামবেদের জন্ম।
কোন কোন হিন্দু পন্ডিতের মতে, ঋগ্বেদ, যজুর্বেদযথাক্রমে ব্যাসমুনির সময়ে রচিত হয়। অতঃপর বহুদিন গত হইলে সাম আরও কতিপয় মন্ত্র বৃদ্ধি করতঃ সামবেদ রচনা করেন; অথর্ববেদের জন্ম ইহারও অনেকদিন পরে। এই জন্যই মনুস্মৃতিতে অথর্ববেদের উল্লেখমাত্র নাই।
…. কি করিলে একজন অহিন্দু হিন্দু হয় এবং কি করিলে একজন হিন্দু অহিন্দু হইয়া যায়, যাহারা ছোঁয়া লাগিলে হিন্দুর জাত যায়, ধর্ম যায় এমনকি উপাসনা মন্দির এবং কূপের জল পর্যন্ত অপবিত্র হইয়া যায়, সেও হিন্দু, আর যার জাতধর্ম গেল সেও হিন্দু, অনেক চিন্তা করিয়াও এ রহস্যের কূল কিনারা করিতে পারিলাম না।
… হিন্দু বলিয়া কোন ধর্মপুরুষ ছিলেন কিংবা হিন্দু বলিয়া কোন জাতি ছিল এমন কোন প্রমাণ যেমন অতীত ইতিহাসে নাই, তেমনি হিন্দুধর্ম নামে কোন কালে যে কোন ধর্ম ছিল ইতিহাসের অগাধ সমুদ্র মন্থন করিয়াও ইহার ছিঁটে ফোঁটা পাওয়া যায় না।
অনুরূপভাবেই যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, ভবিষ্যপুরাণ, এমনকি মহাভারত আজও যথাপূর্ব তথাপর তাহার আসল রূপে, অবিকৃত কিংবা বিকৃত অবস্থায়ও মূল গ্রন্থটি বর্তমান রহিয়াছে বলিয়া কোন প্রমাণ না থাকিলেও হয়ত-বা এককালে তাহা ছিল, ঈশ্বর প্রেরিত ছিল, কিংবা সংশ্লিষ্ট মুনি ঋষিদের কেহ কেহ হয়ত বানবী পয়গম্বর ছিলেন তাহার সম্ভাবনা প্রমাণে বড়জোর এই কথাটা বলা যাইতে পারে যে, তাহার বর্তমান দশা এবং তাহাদের বর্তমান পরিচয় যাহাই হউক না কেন, তন্মধ্যে, স্বয়ং বেদ পুরাণ এবং মহাভারতেই হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওত এবং শেষ নবী। হিসাবে আবির্ভাব সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী আগাম খবর, এবং তাহাকে মানিয়া চলিতে স্পষ্ট নির্দেশ বর্ণিত রহিয়াছে।”
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।