স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) সারাজীবন জাতিকে অন্য ধর্মীয় মতবাদকে শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিতে দেখার শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। নিজ ধর্মের প্রতি অবিচল আস্থা, সুদৃঢ় বিধাসই মানুষকে পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তােলে। দুঃখের বিষয়, স্বামীজীর এই শিক্ষার মর্ম আমরা উপলব্ধি করতে সমর্থ হলাম কই? আজও আমরা পরধর্ম বিশেষ করে ইসলামকে একটা ‘বহিরাগত উৎপাত’ বলেই মনে করে থাকি। ইসলাম এর অসাধারণ বৈপ্লবিক গুরুত্ব আর তার বৃহত্তর সাংস্কৃতিক তাৎপর্য সম্বন্ধে আমাদের অধিকাংশেরই সামান্য ধারণাও নেই, তার সহৃদয় অনুশীলন তাে দূরের কথা। অথচ আমাদের কল্যাণের স্বার্থে এমন বিরূপ মনােভাবের অপনােদন জরুরী।
বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ও বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন,
“মহাপুরুষ মােহাম্মদের অনুশাসিত ইসলামের আকস্মিক উত্থান এবং নাটকীয় বিস্তৃতি মানবজাতির সভ্যতার ইতিহাসে একটা বিরাট চমকপ্রদ অধ্যায়। নিতান্ত নির্লিপ্ত ও নৈর্ব্যক্তিক মন নিয়ে মানব ইতিহাসের এই অধ্যায়টি পাঠ করলে দ্বন্দ্বসঙ্কুল বর্তমান ভারতের জন্য অনেক আশার আলাের সন্ধান পাওয়া যায়। বৈজ্ঞানিক দিক থেকে এর অনুশীলনের মূল্য আপনার গুরুত্বেই অধিক তাছাড়া একটা সাধারণ জ্ঞানানুসন্ধিৎসা নিয়ে পড়লেও যে কেউই এর থেকে প্রভুত উপকার লাভ করতে পারবে। কিন্তু ইসলাম ইতিহাসে তথা মানব সভ্যতার সংস্কৃতিতে কী দিয়েছে, তা বিশেষ করে ভারতীয় হিন্দুদের যথাযথভাবে জানা, পারস্পরিক বিদ্বেষ-বিষ জর্জরিত ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে একটা বিরাট আশার এবং অশেষ মঙ্গলেরই ইঙ্গিত দেয়।…
এ (ইসলামের বিজয়) যেন এক ভীষণ ঐন্দ্রজালিক কাণ্ড! কীভাবে আজগুবি ব্যাপার সম্ভব হল এ প্ররে মীমাংসা করতে গিয়ে ঐতিহাসিকেরা আজও হতভম্ব হয়ে যান। আজকে জগতের সত্যিকার শিক্ষিত লােকেরা ইসলামের উত্থান শান্ত ও সহিষ্ণু লােকদের উপর ‘গোঁড়ামির জয়’, এই ঘৃণ্য অভিমত পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ইসলামের এই বিজয় অভিযানের কারণ ছিল অভূতপূর্ব বৈ-বিক প্রতিশ্রুতির মধ্যে লুকিয়ে। গ্রীস, রােম, পারস্য, চীন, এমনকী ভারতবর্ষেরও প্রাচীন সভ্যতায় ঘুণ ধরে যাওয়ায় বিপুল জনসাধারণ যে চরমতম দুঃখ দুর্দশার সম্মুখীন হল তা থেকে বাঁচিয়ে ইসলাম এক আলাে ঝলকিত দেশের নির্দেশ তাদের দিতে পেরেছিল বলেই তার এই অসাধারণ বিস্তার সম্ভব হয়েছিল।”১
বিশ্ব সংস্কৃতিতে ইসলামের অবদানের কথা তথা বিধ ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে ইসলামের এই অনন্য জীবনীশক্তি সম্বন্ধে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন বলেই বিবেকানন্দ ইসলামের গণতান্ত্রিক ও বলিষ্ঠ মনােবলের প্রশংসা করতেন। তিনি হিন্দু জাতির মধ্যে এই মনােবল সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ মহান ভারত গড়বার লক্ষ্য ইসলামকে তাই যথাযােগ্য মর্যাদা না দিয়ে পারেননি। তাঁর লেখায় ও বক্তৃতায় ইসলাম, কোরান, মুসলমান ও মুসলিম সংস্কৃতি ইত্যাদি প্রসঙ্গ বার বার এসেছে নানা আঙ্গিকে। যখনই তিনি ধর্মীয় আলােচনা করেছেন তখনই বিভিন্ন ধর্মের সঙ্গে ইসলাম প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। ইসলাম ধর্মের মহৎ গুণগুলি বারবার তিনি উল্লেখ করেছেন। বিধ ইতিহাসে ইসলাম ও তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারক হজরত মােহাম্মদের (সঃ) স্থান এবং ভারতবর্ষে মুসলিম-শাসন সম্বন্ধে তিনি বহু কথা বলেছেন। ব্যক্তি জীবনেও বহু মুসলমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। শঙ্করীপ্রসাদ বসু লিখেছেন,
“স্বামীজীর লেখায় বা কথায় ইসলাম প্রসঙ্গ আপেক্ষিকভাবে মােটেই কম নয়। কিন্তু স্মরণ করিয়ে দেব, স্বামীজী মসীজীবী ছিলেন না বলে, যে কোন বিষয়ে রাশি রাশি লেখার প্রয়ােজন বােধ করতেন না। তাঁর রচনাবলী বলে পরিচিত বস্তুর বড় অংশ তার বক্তৃতা ও ঘরােয়া আলাপের নােট। বলাবাহুল্য এমন সংকলন সর্বাত্মক হতে পারে না। ঘরােয়া আলাপের ক্ষেত্রে নােট-লেখক তার ব্যক্তিগত রুচি অনুযায়ী বিষয় নির্বাচন করে তাকে লিপিবদ্ধ করেছেন। সেকালের হিন্দুদের মুসলমান-ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল না বলে তারা স্বামীজী সে প্রসঙ্গ তুললেও, সেসব লিখে রাখার উৎসাহ দেখাননি, কিন্তু স্বামীজীর পাশ্চাত্য শিষ্যরা অপরপরে ব্যাপকতর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি দেখতে সমর্থ ছিলেন বলে তাকে যথােচিত গুরুত্ব দিয়েছেন।”২
ধর্মীয় গোঁড়ামির উগ্রতা একসময় মানুষকে ধর্মোন্মত্ত করে তােলে এবং তার পরিণতি হয় ভয়াবহ ও করুণ। ধর্ম ভালাে, কিন্তু ধর্মোন্মত্ততা কখনওই ভালাে নয়। ধর্মোন্মত্ত মানুষ এই পৃথিবীকে চিরকাল হিংসায় পূর্ণ করেছে, নরশােণিতে সিক্ত করেছে, সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করেছে। তাই স্বামীজী ধর্মোন্মত্ততা দূর করে সহৃদয়তার সঙ্গে নিজের ধর্মকে পালন করে অন্য ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীকে মান্য ও সম্মান প্রদর্শনের উপর জোর দিয়েছেন। আর তার দৃঢ় বির্বাস এরই ফলে প্রতিষ্ঠিত হবে সার্বিক মানবপ্রেম ও মানবকল্যাণ। এইজন্য ধর্মে ধর্মে পার্থক্য থাকলেও উৎস ও ভগবৎগত কোনও পার্থক্য নেই বলে তিনি মনে করতেন। কারণ, উপনিষদে আছে—‘একমেবাদ্বিতীয়া দ্বিতীয়া নাস্তি’ এবং কঠোপনিষদে নিরাকার ঈশ্বরের কথা ব্যক্ত হয়েছে। আর ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্র ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মােহম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ)’, যার অর্থ—আল্লাহই একমাত্র উপাস্য, হজরত মােহাম্মদ (সঃ) তারই প্রেরিত রসুল (বার্তাবাহক)। স্বামীজী তাই ধর্ম, শাস্ত্র ও ঋষি সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে বির্বজনীন ধর্মের আদর্শ, গীতাতত্ত্ব, ভারতীয় মহাপুরুষ, যিশুখ্রিস্ট, হজরত মােহাম্মদ (সঃ) প্রভৃতিকে নিয়ে আলােচনা করেছেন।
মহাপুরুষ-সিদ্ধপুরুষ যখন ঈশ্বরের নৈকট্য পেয়ে যান, তখন তার মধ্যে আর ধর্মাচ্ছাদন বড় হয়ে দেখা দেয় না—সব ধর্মের মূলে বা পরিণতিতে তারা ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেন দ্বন্দ্ব-কলহ-বিবাদ শুধু ধর্মান্ধ ধর্মোন্মত্তদের। স্বামীজী তাই হজরত মােহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কে ‘হজরত মহম্মদ’ প্রবন্ধে নানামুখী আলােচনায় ইসলাম ও অন্যান্য প্রসঙ্গ সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন। আমেরিকা বাসকালে হজরত মােহাম্মদ সম্পর্কে যে সমস্ত বক্তব্য দিয়েছিলেন ‘স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা সংকলন’-এ তা বাংলায় হজরত মহম্মদ শিরােনামে সংক্ষেপে প্রকাশিত হয়। সেখানে হজরত মােহাম্মদ (সঃ), ইসলাম ধর্ম এবং প্রসঙ্গত অন্য ধর্মকথা আলােচিত হয়েছে। শুরুতেই স্বামীজী বলেছেন সৎ ও প্রিয়দর্শন যুবক হজরত মােহাম্মদের (সঃ) প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিত্তবান বিধবা খাদিজা তাকে বিয়ে করেন। প্রভূত অর্থের অধিকারী হয়ে তিনি রােম-পারস্যে আধিপত্য বিস্তার করেন। পাপাচরণ, পৌত্তলিকতা, উপাসনার নামে ভণ্ডামী, কুসংস্কার, নরবলি প্রভৃতি দেখে ব্যথিতচিত্তে তিনি ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারে নিজেকে নিয়ােজিত করেন।
হজরত মােহাম্মদের (সঃ) সাম্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে স্বামীজী খুবই গুরুত্ব দিতেন। আমেরিকায় বক্তৃতাকালে (৩ এপ্রিল ১৯০০) হজরত মােহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কে তিনি বলেন,
“আমাদের দৃষ্টি সেই মহাপুরুষের (মহম্মদের) দিকে নিপতিত হয়, যিনি জগতে সাম্যভাবের বার্তা বহন করিয়া আনিয়াছেন। তােমরা জিজ্ঞাসা করিতে পার ‘মহম্মদের ধর্মে আবার ভালাে কি থাকিতে পারে?’ তাহার ধর্মে নিশ্চয়ই কিছু ভালাে আছে—যদি না থাকিত, তবে উহা এতদিন বাঁচিয়া রহিয়াছে কিরূপে? যাহা ভাল, তাহাই স্থায়ী হয়, অন্য সমুদয়ের বিনাশ হইলেও উহার বিনাশ হয় না। যাহা কিছু ভাল তাহাই সবল ও দৃঢ়, সুতরাং তাহা স্থায়ী হয়। এই পৃথিবীতেই বা অপবিত্র ব্যক্তির জীবন কতদিন? পবিত্রচিত্ত সাধুর প্রভাব কি তাহা অপেক্ষা বেশি নয়? নিশ্চয়ই কারণ পবিত্রতাই বল, সাধুতাই বল। সুতরাং মহম্মদের ধর্মে যদি কিছুই ভালাে না থাকিত তবে উহা এতদিন বঁচিয়া আছে কিরূপে? মুসলমান ধর্মে যথেষ্ট ভালাে জিনিস আছে। মহম্মদ সাম্যবাদের আচার্য—তিনি মানবজাতির ভ্ৰাতৃভাব—সকল মুসলমানের ভ্ৰাতৃভাবের প্রচারক, ঈশ্বর প্রেরিত পুষ।
সুতরাং আমরা দেখিতেছি, জগতের প্রত্যেক অবতার, প্রত্যেক ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষ…বিশেষ সত্যের বার্তা বহন করিয়া আনিয়াছেন। যদি তােমরা প্রথম সেই বাণী শ্রবণ কর এবং পরে আচার্যের জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত কর, দেখিবে ঐ সত্যের আলােকে তাঁহার সমগ্র জীবনটি ব্যাখ্যাত হইতেছে। অজ্ঞ মূর্খেরা নানাবিধ মত-মতান্তর কল্পনা করিয়া থাকে, আর নিজ নিজ মানসিক উন্নতি অনুযায়ী, নিজ নিজ ভাবানুযায়ী ব্যাখ্যা আবিষ্কার করিয়া এই সকল মহাপুরুষে তাহা আরােপ করিয়া থাকে। তাহাদের উপদেশসমূহ লইয়া তাহারা নিজেদের মতানুযায়ী ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করিয়া থাকে। কিন্তু প্রত্যেক মহান আচার্যের জীবনই তাঁহার বাণীর একমাত্র ভাষ্য…।”৩
হজরত মােহাম্মদের (সঃ) ধর্ম নিয়ে যেমন পাশ্চাত্যের লােক প্রগ্ন তুলেছিল, তেমনি প্রর্থ তুলেছিল তার বহু বিবাহ নিয়ে। স্বামীজী ধর্ম সংস্কারমুক্ত উদারভাবাপন্ন মন নিয়ে এক্ষেত্রে হজরত মােহাম্মদ (সঃ) ও ইসলামধর্মকে সমীক্ষা করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন কুসংস্কার ও গোঁড়ামিযুক্ত মন দিয়ে কাউকে দেখলে যথার্থরূপে দেখা হয় না। হজরত মােহাম্মদের (সঃ) মতাে বার্তাবহগণ নিশ্চয়ই ঈশ্বরের কাছ থেকে আসেন, তা না হলে তিনি মহান হতে পারতেন না। স্বামীজী সান ফ্রান্সিসকোতে ২৫ মার্চ ১৯০০ সালের একটি বক্তৃতায় খুব চাঁছাছােলা ভাষায় হজরত মােহাম্মদের (সঃ) সমালােচকদের ধমক দিয়ে বলেছিলেন,
“…আপনারা খুবই কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বশবর্তী! এই বার্তাবাহকগণ নিশ্চয়ই ঈশ্বরের নিকট হইতে আসেন, নতুবা তাহারা কিভাবে এই মহান হইতে পরিয়াছিলেন? ..পরবর্তী জীবনে মহম্মদ অনেকপত্নী গ্রহণ করেন। মহাপুরুষেরা প্রত্যেকে দুইশত পত্নী গ্রহণ করিতে পারেন। আপনাদের (আমেরিকান)। মতাে দৈত্যকে এক পত্নী গ্রহণ করিতেও আমি অনুমতি দিব না। মহাপুরুষদের চরিত্র রহস্যাবৃত। তাদের কার্যধারা দুর্জ্জেয়। তাহাদিগকে বিচার করিতে যাওয়া আমাদের অনুচিত। খ্রিস্ট বিচার করিতে পারেন মহম্মদকে। আপনি আমি কে? —শিশুমাত্র। এই সকল মহাপুরুষকে আমরা কি বুঝিব?”৪ দুর্জনেরা সর্বদাই দোষ-ত্রুটি খোঁজে তিনি উপদেশ দিয়েছেন এইভাবে “..মাছি ক্ষত অন্বেষণ করে, আর মধুমক্ষিকা শুধু ফুলের মধুর জন্য আসে। মক্ষিকাবৃত্তি অনুসরণ করবেন না, মধুমক্ষিকার পথ ধরুন।”৫
স্বামীজী বলেছেন, কোনও কিছু হঠাৎ বা সব সময় অনায়াসে হয় না। মহৎ কাজ করতে বিরাট প্রস্তুতির প্রয়ােজন। দিন-রাত প্রার্থনার পর হজরত মােহাম্মদ (সঃ) স্বপ্নে অনেক কিছু দর্শন করতেন। জিব্রাইল স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে বলেন, হজরত মােহাম্মদই (সঃ) সত্যের বার্তাবহ যিশু-মুসা ও অন্যান্য নবী বা প্রেরিত পুরুষদের বাণী লুপ্ত হয়ে যাবে। তাই ঈশ্বর হজরত মােহাম্মদকেই (সঃ) ধর্মপ্রচারের আদেশ দেন। তখন খ্রিস্টানরা যিশুর নামে রাজনীতি এবং পারসিকরা দ্বৈতভাব প্রচার করেছেন দেখে হজরত মােহাম্মদ (সঃ) বলেন—
“আমাদের ঈশ্বর এক। যাহা কিছু আছে, সবকিছুরই প্রভু তিনি। ঈশ্বরের সঙ্গে অন্য কাহারও তুলনা হয় না।”৬
হজরত মােহাম্মদ (সঃ) এই মত প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে অনেক নির্যাতন সহ্য করেছিলেন। অনেক ত্যাগ ও পরিশ্রমে তারই নেতৃত্বে একদিন সমগ্র আরবজাতি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লার নামে হজরত মােহাম্মদের (সঃ) ধর্ম জগৎ প্লাবিত করে।
বিবেকানন্দের এসব উক্তি অবশ্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে মান্য করতে হয়। সহৃদয়শীল ছাড়া হৃদয়ের ভাব উপলব্ধি করতে পারে না যেমন, ঠিক তেমনি ধর্মীয় ভাবে পূর্ণর্তা ছাড়া অন্য ধর্মগুরুকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করা যায় না। আর যা উপলব্ধি নয়, তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণেও সত্যতা থাকে না, যথার্থও হয় না। বিবেকানন্দের এই উক্তি শুধু হজরত মােহাম্মদ (সঃ) কেন—যে কোনও ধর্মগুরু সম্পর্কে সমানভাবে প্রযােজ্য। ‘হজরত মহম্মদ’ শীর্ষক বক্তৃতায় বিবেকানন্দ আরও বলেছিলেন, “মহম্মদের ধর্ম আবির্ভূত হয় জনসাধারণের জন্য বার্তারূপে।…তাহার প্রথম বাণী ছিল—
“সাম্য।…একমাত্র ধর্ম আছে—তাহা প্রেম। জাতি বর্ণ বা অন্য কিছুর প্রর্ণ নেই। এই সাম্যভাবে যােগ দাও। সেই কার্যে পরিণত সাম্যই জয়যুক্ত হইল।…সেই মহতী বাণী ছিল খুব সহজ সরল স্বর্গ ও মর্তের স্রষ্টা এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী হও। শূন্য হইতে তিনি সব কিছু সৃষ্টি করিয়াছেন। কোন প্রগ্ন জিজ্ঞাসা করিও না।”
এই বক্তৃতাতে স্বামী বিবেকানন্দ আচারের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের অত্যধিক সরলতার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন এক ব্যক্তির পিছনে অসংখ্য ব্যক্তি সারবদ্ধ হয়ে নামাজ পড়ে—সাম্যের এ এক বড় দৃষ্টান্ত, “মসজিদগুলিতে..সঙ্গীত, চিত্র ও প্রতিকৃতি নিষিদ্ধ। এককোণে একটি বেদী তাহার উপর কোরান রক্ষিত হয়। সব লােক সারিবদ্ধ হইয়া দাঁড়ায়। কোন পুরােহিত, যাজক বা বিশপ নাই।…যে নামাজ পড়ে (পড়ায়), সেও শ্রোতৃমণ্ডলীর একপার্ধে দণ্ডায়মান থাকিবে।”৭
স্বামীজী হজরত মােহাম্মদের (সঃ) জীবনের ঐতিহাসিকতা নিয়ে নিঃসংশয় ছিলেন। এ বিষয়ে স্বামীজী বলেছিলেন,
“ধর্মাচার্যগণের মধ্যে কেবল বুদ্ধ ও মহম্মদের ভাগ্যেই ‘শত্রু মিত্র উভয়’ লাভই ঘটিয়াছিল, সুতরাং তাহাদের জীবনের ঐতিহাসিক অংশে সন্দেহের লেশ মাত্র নাই। আর শ্রীকৃষ্ণ, তিনি তাে সকলের চেয়ে বেশি অস্পষ্ট…।”৮
ইসলাম ধর্মে এবং মুসলমানের ভাবানুভূতিতে হজরত মােহাম্মদের (সঃ) স্থান যে কত গভীরে সে বিষয়েও স্বামীজী সম্যক অবগত ছিলেন। হজরত মােহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কে তার বক্তব্য,
“যদি কেহ হজরত মহম্মদকে বাদ দিয়া ইসলাম ধর্মের তত্ত্বগুলি প্রচার করিতে অগ্রসর হয়, তবে মুসলমানগণও তাহাকে সহ্য করিবে না। কারণ বাস্তব উদাহরণ—মহাপুরুষ ও পয়গম্বরের জীবনকাহিনীই তত্ত্বাংশকে সর্বতােভাবে আবৃত করিয়া রাখিয়াছে।”৯
এইসব দৃষ্টান্ত থেকে হজরত মােহাম্মদের (সঃ) প্রতি তথা ইসলামের ‘আচার্যের’ প্রতি স্বামীজীর শ্রদ্ধাপূর্ণ মনােভাবকে আমরা লক্ষ্য করতে পারি। তাছাড়া পাশ্চাত্যে যেখানে ইসলাম ধর্ম ও হজরত মােহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কে নানা নেতিবাচক ও সংশয় উদ্রেককারী প্রথা উঠেছিল, সেখানে স্বামীজী ইসলামের প্রতি তাদের ভ্রান্ত ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। উপরন্তু আরব মরুতে ইসলামের উদয় ও তার প্রচারকের প্রভাব সম্পর্কে উচিত মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেননি।
ইসলামের সাম্যের আদর্শ স্বামীজীকে খুবই নাড়া দিয়েছিল। বিবেকানন্দ ইসলাম ধর্মকে সম্মান রেখে বলেছেন হজরত মােহাম্মদের (সঃ) বাণী মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। তিনি বলেছেন, হজরত মােহাম্মদের (সঃ) প্রথম বাণী হল সাম্য। স্বর্গ-মর্তেরষ্টা এক ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখা সেই সাম্যের প্রধান সােপান। ইসলামের সাম্যবাদের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামীজী বলেছিলেন,
“মহম্মদ নিজ জীবনের দৃষ্টান্ত দ্বারা দেখাইয়া গেলেন যে, মুসলমানদের মধ্যে সম্পূর্ণ সাম্য ও ভ্রাতৃভাব থাকা উচিত। উহার মধ্যে বিভিন্ন জাতি, মতামত, বর্ণ বা লিঙ্গ ভেদ কিছু থাকিবে না। তুরস্কের সুলতান আফ্রিকার বাজার হইতে একজন নিগ্রোকে কিনিয়া তাহাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া তুরস্কে আনিতে পারেন। কিন্তু সে যদি মুসলমান হয়, আর যদি তাহার উপযুক্ত গুণ থাকে, তবে সে সুলতানের কন্যাকে বিবাহ করিতে পারে। মুসলমানদের এই উদার ভাবের সহিত এদেশে (আমেরিকায়) নিগ্রো ও রেড ইণ্ডিয়ানদের প্রতি কিরূপ ব্যবহার করা হয় তুলনা করিয়া দেখ। আর হিন্দুরা কী করিয়া থাকে? যদি তােমাদের একজন মিশনারি হঠাৎ কোনও গোঁড়া হিন্দুর খাদ্য ছুঁইয়া ফেলে, সে তৎক্ষণাৎ উহা ফেলিয় দিবে। আমাদের এত উচ্চ দর্শনশাস্ত্র থাকা সত্ত্বেও কার্যের সময়, আচরণের সময়, আমরা কিরূপ দুর্বলতার পরিচয় দিয়া থাকি তাহা লক্ষ করিও। কিন্তু অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় এইখানে মুসলমানদের মহত্ত্বজাতি বা বর্ণ বিচার না করিয়া সকলের প্রতি সাম্য ভাব প্রদর্শন।”১০
বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ ইসলামের মহত্ত্ব স্বীকার করেছেন। তিনি নানাভাবে ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে প্রচারিত ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তার একটি ইসলাম ধর্মের মতে নাকি নারীর আত্মা নেই। বিবেকানন্দ লণ্ডনে এক আলােচনা সভায় বলেন,
“এই প্রকার যে উক্তি আমাদের কাছে করা হয়েছে, তা ভ্রান্ত। আমি দুঃখের সঙ্গে বলছি, খ্রীস্টানদের মধ্যে এই ভ্রান্তি বহুদিনের, এবং তারা এই ভ্রমটি ধরে রাখা পছন্দ করেন। মানুষের এই অদ্ভুত স্বভাব—সে যাকে পছন্দ করে না, তার সম্বন্ধে খুব খারাপ কিছু প্রচার করতে উৎসুক।”
তিনি আরও বলেন,
“আমি মুসলমান নই, কিন্তু ঐ ধর্ম অনুশীলনের সুযােগ আমার হয়েছে। আমি দেখেছি, কোরানে এমন একটি উক্তিও নেই যার অর্থ নারীর আত্মা নেই। বস্তুত কোরান বলে, নারীর আত্মা আছে।”১১
তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, মুসলমান নারীর এমন কতকগুলি অধিকার আছে, প্রগতিশীল মার্কিন নারীরাও তা থেকে বঞ্চিত। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সেসব ক্ষেত্রে ইসলামের অগ্রগতির প্রতি বিবেকানন্দ ছিলেন একান্তই শ্রদ্ধাশীল। তিনি আধুনিক ইউরােপের নবজাগরণের পশ্চাতে ইসলামীয় সংস্কৃতির উদার জ্ঞানচর্চার অবদানের কথা বহুস্থানে আলােচনা করেছেন। মধ্যযুগের ধর্মান্ধ খ্রীস্টান-সম্প্রদায়ের বিজ্ঞান-বিরােধিতার সঙ্গে ইসলামের মুক্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার তুলনা করে দেখিয়েছেন, ইসলামে বিজ্ঞান-অনুরাগ প্রবল ছিল। তিনি যথেষ্ট আত্ম-বিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন,
“আজ যে মনুষ্যের বিদ্যা এবং বিজ্ঞানে প্রবেশ আছে, তার কি অকপট খ্রিশ্চান হওয়া সম্ভব? নিউ টেস্টামেন্ট-এ প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ ভাবে কোনও বিজ্ঞান বা শিল্পের প্রশংসা নেই। কিন্তু এমন বিজ্ঞান বা শিল্প নেই যা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ ভাবে কোরান বা হাদিসের বহু বাক্যের দ্বারা অনুমােদিত এবং উৎসাহিত নয়।”১২
পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের পেছনে মুসলমানদের অবদানের বিষয়ে স্বামীজী অবহিত ছিলেন। এ ঋণের কথা স্কুল কলেজে ইতিহাসের পাঠ্য বইগুলিতে উল্লিখিত হয় না বটে, কিন্তু ১৩০৬-০৮ বঙ্গাব্দে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য লেখার সময় তিনি লিখেছিলেন,
“এদিকে মূর নামক মুসলমান জাতি স্পন (স্পেন) দেশে অতি সুসভ্য রাজ্য স্থাপন করলে, নানা বিদ্যার চর্চা করলে, ইউরােপে প্রথম ইউনিভার্সিট হল ইতালি ফ্রান্স, সুদূর ইংলণ্ড হতে বিদ্যার্থী শিখতে এল রাজারাজড়ার ছেলেরা যুদ্ধবিদ্যা আচার কায়দা সভ্যতা শিখতে এল। বাড়ী ঘরদোর মন্দির সব নূতন ঢঙে বানাতে লাগল।”১৩
প্রকৃতপথে জ্ঞানবিদ্যার চর্চায়, শিল্প-সাহিত্যের চর্চায়, ইউরােপের মানুষ মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিকালে যে অগ্রগতি লাভ করে তার মূলে ছিল মুসলমানদের অবদান।
স্বামী বিবেকানন্দ ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’-এ আরও বলেছেন,
“এখন ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীব্যাপী ক্ষিপ্র সভ্যতা বিস্তারের সঙ্গে খ্রিশ্চান ধর্মের প্রথম তিন শতাব্দীর তুলনা কর। খ্রিশ্চান ধর্ম প্রথম তিন শতাব্দীতে জগৎসম আপনাকে পরিচিত করতেও সমর্থ হয়নি এবং যখন কনস্টানটাইনের তলওয়ার একে রাজ্যমধ্যে স্থান দিলে, সেদিন থেকে কোন্ কালে খ্রিশ্চানী ধর্ম আধ্যাত্মিক বা সাংসারিক সভ্যতা বিস্তারের কোন্ সাহায্য করেছে? যে ইওরােপীয় পণ্ডিত প্রথম প্রমাণ করেন যে পৃথিবী সচলা, খ্রিশ্চান ধর্ম তার কি পুরস্কার দিয়েছিল? কোন্ বৈজ্ঞানিক কোন কালে খ্রিশ্চানী ধর্মের অনুমােদিত? খ্রিশ্চানী সংঘের সাহিত্য কি দেওয়ানী বা ফৌজদারী বিজ্ঞানের শিল্প বা পণ্য কৌশলের অভাব পূরণ করতে পারে? আজ পর্যন্ত ‘চার্চ’ প্রােফেন (ধর্ম ভিন্ন অন্য বিষয়াবলম্বনে লিখিত) সাহিত্য প্রচারে অনুমতি দেন না।…ইওরােপের সর্বপ্রধান মনীষিগণ—ইওরােপের ভলটেয়ার, ডারউইন, বুকনার, ফ্লমারিয়, ভিক্টর হুগাে কুল বর্তমানকালে খ্রিশ্চানী দ্বারা কটুভাষিত এবং অভিশপ্ত, অপরদিকে এই সকল পুরুষকে ইসলাম বিবেচনা করেন যে এই সকল পুরুষ আস্তিক, কেবল ইহাদের পয়গম্বর-বিশ্বাসের অভাব। ধর্ম সকলের উন্নতির বাধকত্ব বা সহায়কত্ব বিশেষরূপে পরীথিত হােক দেখা যাবে ইসলাম যেথায় গিয়েছে, সেথায়ই আদিমনিবাসীদের রক্ষা করেছে। সেসব জাত সেথায় বর্তমান। তাদের ভাষা, জাতীয়ত্ব আজও বর্তমান। যদি মুখ চাষার দল না থাকত তাহলে খ্রিশ্চানী তার ঘৃণিত জীবন ক্ষণমাত্র ধারণ করতে সমর্থ হত না এবং সমূলে উৎপাটিত হত কারণ নগরস্থিত দরিদ্রবর্গ এখনই খ্রিশ্চানী ধর্মের প্রকাশ্য শত্রু! এর সঙ্গে ইসলামের তুলনা কর। মুসলমান দেশে যাবতীয় পদ্ধতি ইসলাম ধর্মের উপরে সংস্থাপিত এবং ইসলামের ধর্ম শিক্ষকেরা সমস্ত রাজকর্মচারীদের বহু পূজিত। এবং অন্য ধর্মের শিক্ষকেরাও সম্মানিত।”
ইসলামের শাস্ত্র বলতে মূলত পবিত্র কোরান ও হাদিসগ্রন্থগুলিকে বােঝায়। এ বিষয়ে স্বামীজীর দু-একটা বক্তব্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথমটি কোরান সম্পর্কে। স্বামীজী কোরানের পাঠের শুদ্ধতার বিশ্বাস করতেন। ১৮৯১-এর ফেব্রুয়ারিতে, আলেয়ারে স্বামীজী কোরান প্রসঙ্গে বলেছিলেন,
“কোরান সম্বন্ধে এই আশ্চর্য বিশেষত্ব দেখা যায় যে, এগারশত বৎসর পূর্বে উহা যেমন ছিল, এখনও ঠিক তাই আছে, এর সুপ্রাচীন বিশুদ্ধতা রথিত হয়েছে, এবং কেউ এর উপর কলম চালাতে পারেনি।”১৪
অর্থাৎ কোরানের বিশুদ্ধতায় স্বামীজী পুরােপুরি বিশ্বাস করতেন।
এসব কথা স্বামীজী আবেগে বলেননি। তিনি খুব ভাল করে ইসলামী শাস্ত্র জানতেন। তাঁর বাড়িতেই কোরান পাঠ হত।১৫ এবং তিনি নিজেও কোরান অনুশীলন করেছিলেন। কোরান অনুশীলনে তাঁর গভীর নিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায় তারই উত্তি থেকে। কোরান নাকি নারীর আত্মায় বিশ্বাস করে না—এমনই এক ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করতে গিয়ে স্বামীজী বলেছিলেন,
“মুসলমান ধর্মাবলম্বীগণ স্ত্রীজাতির কোন আত্মা আছে বলিয়া বিশ্বাস করে না—এই প্রকার যে উক্তি এখানে আমার নিকট করা হইয়াছে তাহা ভ্রান্ত। ..কথা প্রসঙ্গে বলিয়া রাখি যে আমি মুসলমান নই, কিন্তু উক্ত ধর্ম সম্বন্ধে অনুশীলন করিবার সুযােগ আমার হইয়াছিল এবং আমি দেখিয়াছি, কোরানে এমন একটিও উত্তি নাই যার অর্থ নারীর আত্মা নাই বস্তুত কোরান বলে নারীর আত্মা আছে।”১৬
এর থেকে প্রমাণিত হয়, কোরানের সারতত্ত্ব তার জানা ছিল। তাই কোরান সম্পর্কে পাশ্চাত্যের মানুষের সঙ্কীর্ণ সমালােচনাকে তিনি নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন।
বিবেকানন্দের নামের সঙ্গে যাঁদের নাম ওতপ্রােতভাবে জড়িত তাদের একজন হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস (যিনি বিবেকানন্দের গুরু) আর একজন হলেন ভগিনী নিবেদিতা। নিবেদিতা ছিলেন বিবেকানন্দের অন্যতম প্রধান পাশ্চাত্য শিষ্যা। ইসলাম এবং মুসলমানদের জীবন ও সংস্কৃতি বিষয়ে নিবেদিতার চিন্তাদর্শ ছিল স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাধারার অনুরূপ। নিবেদিতা মুসলমানদের প্রতি গভীর প্রীতি-সম্পন্ন ছিলেন। এই প্রীতি তিনি তাঁর গুরু স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। শঙ্করীপ্রসাদ বসু বলেছেন, স্বামীজীর সূত্র ধরেই নিবেদিতা তার ইসলাম-সমাদরের ব্যাপারে অগ্রসর হয়েছেন।১৭
ভারতীয় জীবনে ইসলামের সামগ্রিক প্রভাব আলােচনা প্রসঙ্গে নিবেদিতা বলেছেন,
“…যেখানেই শিক্ষা মুসলমান চেতনাকে ছুঁয়েছে, সেখানেই প্রতিযােগিতার মাধ্যমে দেখা দিয়েছে সুগঠিত জাতি। যেখানে ইসলামের সঙ্গে সংযােগ হয়নি, যেমন একেবারে দক্ষিণ সীমান্তে সেখানে এই মানসিক শক্তি জাতীয়তাবাদকে জাগাতে পারেনি।…আমরা এও দেখেছি যে হিন্দু ও মুসলমান জনগণের মধ্যে যেসব যুদ্ধ হয়েছিল, সেগুলােও ছিল অনেকটা ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের শক্তি পরীক্ষার মত। এ ক্ষেত্রে লড়াই ছিল ব্যক্তিগত, দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব নয়। বিজয়ী পক্ষ কখনােই জয়ের পর প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্প্রদায়কে পদচ্যুত কিংবা উভয়ের মধ্যে পার্থক্যও সৃষ্টি করত না। বাংলায় বড় বড় মহাজন ও অভিজাতরা নবাবী শাসনে ঠিক তেমনভাবে হিন্দুই থেকে গিয়েছিল, যেমন হিন্দু সিংহাসনের ছায়ায় মুসলমানও তার ধর্ম-বিশ্বাস স্বাভাবিকভাবেই বজায় রেখেছিল।”১৮
ইসলামের আদর্শ, ইসলামের শিক্ষা, ইসলামিক সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে নিবেদিতা যে বিশেষ জ্ঞানার্জন করেছিলেন তার যথেষ্ট প্রমাণ মিলে তাঁর ‘ভারতে ইসলাম ধর্ম’ প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধ নিবেদিতার গভীর ইতিহাস-চেতনা ও পয়গম্বর হজরত মােহাম্মদের (সঃ) প্রতি তার অকৃত্রিম শ্রদ্ধার স্বাক্ষর বহন করছে। নিবেদিতার কথায় জানা যায়, ইংল্যাণ্ড যাবার সময়ে একবার তিনি খুব আনন্দের সঙ্গে বলছিলেন তুর্কিদের সমুদ্র বিষয়ক জ্ঞান কতটা নিখুঁত, তারা ব্যবহারে কত ভদ্র।
নিবেদিতা আরও লিখেছেন,
“(স্বামীজীর মতে) খৃষ্টধর্ম বর্তমানকালে যেভাবে কাজ করছে সেটাকে গ্রহণ করা কঠিন। কিন্তু আর একটি অহিন্দু ধর্মবির্বাস ইসলামের বেলা সে কথা খাটে না। ইসলামের নামে আমার গুরুর মনে যে চিত্র ফুটে উঠতাে সেটা হচ্ছে আবেগময় সৌভ্রাতৃত্ব, সাধারণ মানুষকে মর্যাদাবান করে তােলা এবং উচ্চ শ্রেণীকে সাম্যের ভাবে নিয়ে আসা। বর্তমান ভারতের বিবর্তনের ইতিহাসে তিনি ইসলামী বহিরাগতদের অবদানের কথা এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারতেন না যারা অতীতের ভারতীয় সভ্যতা ও শাসন ব্যবস্থাকে আনুগত্যের সঙ্গে গ্রহণ করে নিজস্ব করে নিয়েছিল। তিনি এটাও ভুলতে পারতেন না যে তারা শুধুমাত্র জন্মসূত্রে নিম্নজাতীয়দের সামাজিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেনি পরন্তু এক অতি সহিষ্ণুতাপরায়ণ জাতির মধ্যে সংঘবদ্ধ সংগ্রাম এবং প্রতিরােধের আদর্শকে সঞ্জীবিত ও বিকশিত করবার কাজেও আত্মনিয়ােগ করেছিল। তিনি বারবার উল্লেখ করতেন যে মুসলমানদের মধ্যেও চারটি জাতি’ আছে—সৈয়দ, পাঠান, মােগল এবং শেখ। এদের মধ্যে শেখদের ভারতভূমিতে এবং ভারতীয় ঐতিহ্যের উপর এক জন্মগত অধিকার রয়েছে যেটা যে কোনাে হিন্দুর ক্ষেত্রে যেমন তেমনি সুপ্রাচীন এবং অবিসম্বাদিত। একটি অবিজ্ঞজনােচিত বক্তব্যকে লক্ষ্য করে তিনি এক শিষ্যকে বলেছিলেন শাহজাহান যদি শুনতে পান তাকে ‘বিদেশী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে তাহলে তিনি তার কবরের মধ্যেও ছটফট করতেন। সর্বোপরি তার দেশমাতৃকার মঙ্গলের জন্যে তার মহত্তম প্রার্থনা এই ছিল যে ‘বৈদান্তিক হৃদয় এবং ইসলামি দেহের যৌথ আদর্শ দেশে প্রতিষ্ঠিত হােক।”১৯
তথ্যসূত্রঃ
- ১. মানবেন্দ্রনাথ রায়, দ্য হিস্টোরিক্যাল রােল অফ ইসলাম, বাংলা অনুবাদ-অধ্যাপক এম আবদুল হাই, রেনেসাঁস, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ৭-১০।
- ২. শঙ্করীপ্রসাদ বসু, বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, খণ্ড-৫, মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃ. ৩৮৯।
- ৩. মহাপুরুষ প্রসঙ্গ, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৮, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১৯৫।
- ৪. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৮, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৩৫৭।
- ৫. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৮, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১২৭।
- ৬. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৮, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১২৬।
- ৭. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৮ম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৩৫৬-৫৮।
- ৮. ভগিনী নিবেদিতা, স্বামীজীর সহিত হিমালয়ে, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃ. ৪৫ ৯ জুন ১৮৯৮-এর নােট, আলমােড়া, স্বামী বিবেকানন্দ বাণী ও রচনা, খণ্ড-৯, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ২৮৩।
- ৯. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৩, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ২৭৫।
- ১০. মহাপুরুষ প্রসঙ্গ, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৮, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ.১৯৪-১৯৫।
- ১১. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৩, উদ্বোধনী কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৪১৭ ।
- ১২. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ২১২।
- ১৩. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ২০৮।
- ১৪. প্রমথনাথ বসু, স্বামী বিবেকানন্দ, ১ম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, ৫ম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৯৪-৯৫, পৃ.৩০৩-৩০৪।
- ১৫. মহেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বামী বিবেকানন্দের বাল্যজীবনী, মহেন্দ্র পাবলিশিং কমিটি, কলকাতা, ১৯৬০, পৃ. ৫১।
- ১৬. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৩, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৪১৭ ‘আত্মানুসন্ধান বা আধ্যাত্মিক গবেষণার ভিত্তি’ লণ্ডনের বক্তৃতা।
- ১৭. শঙ্করীপ্রসাদ বসু, নিবেদিতা লােকমাতা, খণ্ড-২, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ১৬৪।
- ১৮. কাঞ্চন বসু সম্পাদিত, নিবেদিতা সমগ্র, খণ্ড-১, রিফ্লেক্ট পাবলিকেশান, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃ. ১১৯-১২০।
- ১৯. ভগিনী নিবেদিতা, দ্য মাস্টার অ্যাজ আইস হিম, স্বামী মাধবানন্দ অনুদিত—স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি, উদ্বোধন কার্যালয়, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, কলকাতা, ১৩৮৪, পৃ. ২৩৯-২৪০।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।