লিখেছেনঃ কনিষ্ক চৌধুরী
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে প্রায় সারা ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদী একটি শক্তিশালী প্রবাহের আবির্ভাব ঘটেছিল। ভারতের রাজধানী কলকাতাও তার থেকে মুক্ত ছিল না। ভূদেব-বঙ্কিমের পাশাপাশি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভূমিকাটি ছিল গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। বৈদিক ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, আঙ্গ যত্ব, ভারতীয়ত্ব নিয়ে যে উন্মাদনার আবির্ভাব ঘটেছিল উনিশ শতকে বাংলার বাইরে তার অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮১৪-১৮৮৩)। সারা জীবন ধরে তিনি বৈদিক হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করেছিলেন। পাশ্চাত্য প্রভাবের তিনি ছিলেন তীব্র বিরােধী। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আর্যসমাজ’-এর লক্ষই ছিল বৈদিক সমাজে প্রত্যাবর্তন। এ ছিল ইতিহাসের দিক থেকে পিছু হটা। বিবেকানন্দের চলাচল ছিল এপথেই। যদিও তা কথকিঞ্চিৎ ভিন্ন ভঙ্গীমায়। কিন্তু মূল ভাবনাটি প্রায় একই রকম অথাৎ আর্য ধর্ম ও জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন।
বিবেকানন্দ ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘ভারতের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক বক্তৃতায় বলেছিলেন,
“সমগ্র ভারত আর্যময়, এখানে অপর কোনাে জাতি নাই।” (২০১২৫১৪৫)।
শুধু এইটুকু বলেই যদি থামতেন, তাহলে সমস্যাটা অপেক্ষাকৃত কম হত। কিন্তু তিনি তা না করে আরও বহু কথা বহু স্থানে বলেছেন, যা জন্ম দিয়েছে বহুবিধ সমস্যার, অকারণ জটিলতার এবং অবশ্যই স্ববিরােধিতার। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্যের মধ্যে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশিত হয়েছে।
- ১) আর্যগণ (জাতি অর্থে) বহিরাগত। (২০১২৪২০১)।
- ২) আর্যগণ (জাতি অর্থে) বহিরাগত নয়, ভারতের আদি বাসিন্দা। (২০১২৬১৬৪)
- ৩) আর্যরা বহিরাগত না ভারতের আদি বাসিন্দা তা জানা আর সম্ভব নয়। (২০১২৬২৪)।
তা জানা না গেলেও কোন ক্ষতি নেই কারণ ভারতবাসী প্রকৃত অর্থেই আর্য। এখানে আর্য ছাড়া অন্য কোন জাতি নেই। (২০১২৫১৪৫)।
[২]
বিবেকানন্দের এই ধারণা গড়ে ওঠার একটা প্রেক্ষাপট আছে। তাঁর আর্যভাবনার শিকড়টি রয়েছে। উনিশ শতকে ‘প্রাচ্যদেশীয় নবজাগরণ এবং ভারতীয় দ্বিখন্ডিত সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক ভাবধারার মধ্যে। আঠারাে শতকের শেষের দিকে বঙ্গদেশ সহ গােটা ভারতে ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক আধিপত্য স্থাপনের কাজটি যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে শুরু হওয়ায় কোম্পানির অফিসার (শাসক) দের প্রয়ােজন পড়েছিল ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অনুসন্ধান ও চর্চা। এর পিছনে কারণগুলি হল প্রথমত, প্রায় অজ্ঞাত এই সভ্যতার শাসক হিসাবে শাসিতদের সংস্কৃতি জানার কৌতুহল। দ্বিতীয়ত, উপনিবেশের ইতিহাস না জানা থাকলে সমাজের উপর দৃঢ় আধিপত্য স্থাপন করা কঠিন। তাই সেখানকার ইতিহাস যেমন জানতে হবে তেমনি ইতিহাস খুঁজে বের করে নিজেদের প্রয়ােজন মতাে গড়ে নিতে হবে। আরও সুস্পষ্টভাষায় সাম্রাজ্যবিস্তারের হাতিয়ার হিসাবে প্রয়ােজন পড়লাে ঔপনিবেশিক সমাজকে জানার, ইতিহাস চর্চা করার।
টীকা ১। উনিশ শতকে সমগ্র ইউরােপে এক দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় যে প্রাচ্যকে জানতে পারলে পুনরায় এক নবজাগরণের ঢেউ আসবে এবং নবজাগরণের সে জ্ঞানে নব দিশা উন্মােচিত হবে।
Scholar, R. 1984 (translated). The Oriental Renaissance : Eurupe’s Rediscovery of India and the East, 1680-1880. New York : Columbia University Press.
থাপার কর্তৃক উল্লেখিত, থাপার, রােমিলা, 2011:51
এইভাবে জ্ঞান নিরূপিত হল ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে। (থাপার, ২০১১৩)।
প্রাচ্য সংক্রান্ত এই আগ্রহ আরাে বৃদ্ধি পায় যখন আঠারাে শতকের শেষ ও উনিশ শতকের শুরুতে একগুচ্ছ প্রাচ্য গবেষণা ও অনুবাদ গ্রন্থ ইউরােপীয় চিন্তাবিদদের হাতে পৌঁছায়। শুরুতেই যার নাম করতে হয় তিনি হলেন উইলিয়াম জোন্স (১৭৪৬-১৭৯৪)। ষােলাে শতকের এক ইতালীয় বণিক ফিলিপ সসেটি দাবী করেন যে, সংস্কৃত ও ইউরােপের কয়েকটি ভাষার মধ্যে বেশ কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে। (থাপার, ২০১১৩)। এই জাতীয় দাবী উইলিয়াম জোন্স ও তাঁর সহযােগীদের যথেষ্ট উৎসাহিত করে। উইলিয়াম জোন্স লক্ষ্য করেছিলেন যে গ্রীক-রােমান দেব-দেবীদের সাথে হিন্দু দেব-দেবীদের এক সমান্তরাল সম্পর্ক রয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ বাইবেল ও হিন্দু পৌরাণিক আখ্যানের এক তুলনামূলক আলােচনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। তিনি গুরুত্ব দিতে শুরু করেন বিভিন্ন ভাষার তুলনামূলক পাঠের উপর। এই প্রসঙ্গে জোন্স যে সিদ্ধান্তে আসেন তা হল,
“সংস্কৃত ভাষার প্রাচীনত্ব যাই হােক না কেন সংস্কৃতের গঠন অপূর্ব, গ্রিক ভাষার তুলনায় সংস্কৃত অনেক বেশি নিখুঁত, ল্যাটিনের চেয়ে শব্দ প্রাচুর্য অনেক বেশি, আর এই দুই ভাষার চেয়েও পরিশীলিত। তবুও ক্রিয়ার মূল ও ব্যাকরণগত গঠনের ক্ষেত্রে দুটি ভাষার সঙ্গেই সংস্কৃতের এমন গভীর সাদৃশ্য বর্তমানে এতটাই তীব্র যে এরা এমন কোনাে সাধারণ উৎস থেকে উদ্ভূত হয়েছে তা সম্ভবত এখন যার আর অস্তিত্ব নেই— একথা বিশ্বাস না করে কোনাে ভাষাতাত্ত্বিকের পক্ষে এই তিন ভাষার বিচার করা সম্ভব নয়। এতটা জোরালাে না হলেও একই কারণে অনুমান করা যায় গথিক ও কেল্টিক ভাষায় ভিন্নরীতির বাক্-ধারার সংমিশ্রন ঘটলেও উভয়ের উৎস সংস্কৃতের সঙ্গে অভিন্ন। যদি পারসিকের প্রাচীনত্ব সম্পর্কিত কোনাে কোনাে প্রশ্ন নিয়ে আলােচনা করা হয়, তবে প্রাচীন পারসিকের একই গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।” (জোন্স। ২০১১২৭)।
বিভিন্ন ভাষার এই তুলনামূলক আলােচনা ইউরােপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভাষাতত্ত্বের ক্রমবিকাশ ঘটায়। উনিশ শতকের শুরুতেই বৈদিক ধর্মগ্রন্থগুলি ইউরােপীয় পন্ডিতবর্গের হাতে আসতে শুরু করে। এর ফলে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব চর্চা আরও উৎসাহিত হয়। এই ভাষাতত্ত্ব চর্চার মধ্যে দিয়ে পন্ডিতবর্গ যে ধারণায় পৌঁছাতে চেষ্টা করেন তা হল— এই ভাষাগুলি (সংস্কৃত, গ্রীক, ল্যাটিন, পারসিক) একটি আদিভাষা সঞ্জাত। এই ধরণের প্রচেষ্টা তাঁদের আবার জাতি ধারণা গঠনের দিকে প্রানীত করেছিল। অর্থাৎ ভাষাতাত্বিক চর্চার অঙ্গনে ‘আর্য’ শব্দটির বহুল ব্যবহার জাতি ধারণার সাথে সংযুক্তির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
“ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষা থেকে উদ্ভূত অন্য ভাষা যে সব গােষ্ঠীর কথ্য ভাষা তাদের প্রথম দিকে অন্য নামকরণ হলেও উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ‘আর্য’ নামে অভিহিত করাই যুক্তি সংগত বলে মনে হয়। … ভাষাতাত্বিকদের কাছে ‘আর্য’ একপ্রকার ভাষা এবং এর অর্থ ‘An Aryan-Speaking Person’ অথবা ‘আর্যভাষার কথা বলতে অভ্যস্ত ব্যক্তি’ (থাপার। ২০১১৫)।
‘আর্য’ শব্দটির ক্রমাগত ব্যবহার পরবর্তীকালে জাতি ধারণার সাথে সংযুক্ত হয়ে পড়ে।
উনিশ শতকে ইউরােপে বিশেষ করে জার্মানীতে নিজেদের উৎস ও আত্মপরিচয় জানার জন্যে এক ধরনের আগ্রহ তৈরী হয়। এই আগ্রহ জন্ম দেয় আর্য ভাষা’ থেকে ‘আর্য জাতি’র ধারণার রূপান্তর। আর্যগণকে দুইভাগে বিভক্ত করা হল— এশিয় এবং ইউরােপীয়। এশিয় আর্যগণের আদিবাসভূমি যেমন মধ্য এশিয়া, তেমনি ইউরােপীয় আর্যগণের উদ্ভব উত্তর ইউরােপে (থাপার। ২০১১৭)।
ভারতীয় আর্য ধারণা গঠনের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ চিন্তাবিদ ম্যাক্স মূলারের (১৮২০-১৯০০) একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। তিনি বৈদিক সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ভারতীয় সভ্যতাকে বিচার করেছিলেন। তাঁর মতে, ঋগ্বেদ ছিল ইন্দো-ইউরােপীয়দের প্রাচীনতম স্তর এবং তাই পৃথিবীর মধ্যে প্রাচীনতম সাহিত্য (পূর্বোক্ত ৪)। তাঁর বিশ্বাস অনুযায়ী, আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল মধ্য এশিয়ার কোন স্থানে, যেখান থেকে আর্যভাষী মানব গােষ্ঠী দুই দিকে ছড়িয়ে যায় (Max Muller. 1862, 1883, 1888)। এদের মধ্যে একটি গােষ্ঠী ইউরােপে পৌঁছায় এবং অন্য আর একটি গােষ্ঠী চলে যায় ইরানে। এই ইরানীয় গােষ্ঠীর বিভাজিত একটি অংশ আবার ভারতে আগমন করে। ম্যাক্স মূলার এইভাবে ভাষা ও জাতির সমীকরণ করে, শেষ পর্যন্ত বাংলাকে আর্যভাষা এবং বাঙালীদের আর্য বলেও দাবী করেন। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে রামমােহন রায় সম্পর্কে তিনি বলেছেন,
“রামমােহন রায় আর্যজাতির দক্ষিণপূর্ব শাখার মানুষ এবং আর্যভাষা বাংলা, তাঁর মাতৃভাষা… রামমােহন রায়ের ইংল্যান্ডে অভ্যাগমন যেন আর্যজাতির দুই মহৎ শাখার মধ্যে মিলন ঘটাল, যারা নিজেদের এক উৎস, এক ভাষা, এবং এক বিশ্বাস ভুলে এতকাল পৃথকভাবে কাটিয়েছে (ম্যাক্স মুলার ১৮৮৪১১)।”
ইউরােপে আর্য উৎপত্তির উপর গুরুত্ব আরােপ করার ফলে ইউরােপীয় ও ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যবর্তী সেমিটিক জাতিগােষ্ঠীর মানুষ ও তাদের ভাষা বাতিল হয়ে যায়। ম্যাক্স মূলারের মতে, ভারতীয় সভ্যতার গঠন প্রক্রিয়ায় সেমিটিক জাতির বহির্ভূত হওয়ার অর্থ পরবর্তীকালে ইসলামীয় প্রভাবের অন্তর্ভুক্তি না হওয়া। ম্যাক্স মুলার ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনকে অত্যাচারী বলে বর্ণনা করলেও কেন যে এই শাসন অত্যাচারী তার কোন ব্যাখ্যা দেন নি। কিন্তু তাঁর এই উক্তি প্রায়শ ব্রিটিশ পন্ডিতবর্গ ব্যবহার করতেন। তারা আকাঙ্খা পােষণ করতেন যে, নিপীড়নকারী মুসলিম শাসনের হাত থেকে হিন্দুগণ যে রেহাই পেয়েছে এবং পরিবর্তে হিতৈষী ব্রিটিশ শাসন ভারতবর্ষে স্থান করে নিয়েছে সে জন্য আশা করা যায় হিন্দুরা তাঁদের উপযুক্ত সমঝদার হবে (এলিয়ট এবং ডসন I, xxii)। এই তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে ভাষা ও জাতির সমীকরণ মূলত দায়ী। আর্যদের জয়লাভের অর্থ একদিকে যেমন ইন্দো-আর্য ভাষার জয়, তেমনি অপরদিকে বিশিষ্ট আর্য সভ্যতার সফল অনুপ্রবেশ (থাপার ২০১১৯)।
ম্যাক্স মুলারের এই বৰ্হিদেশীয় জাতিতত্ত্বকে কেশবচন্দ্র সেন, রমেশচন্দ্র দত্ত, বালগঙ্গাধর তিলক, ভূদেব মুখােপাধ্যায় আর্যধারণা গ্রহণ করেছিলেন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। কেশবচন্দ্র সেন একসময় মন্তব্য করেছিলেন যে,
“..ইংরাজ জাতির ভারতবর্ষে আগমনের ফলে আমরা যেন দুই বিচ্ছিন্ন ভ্রাতার মিলন দেখতে পাই, যারা সুপ্রাচীন আর্যজাতির অন্তর্গত দুই পৃথক পরিবারের উত্তরাধিকার” (থাপার কর্তৃক উদ্ধৃত ২০১১১৪)।
উপনিবেশিকগণ ও ভারতীয় সমাজে উচ্চকোটির মানুষের মধ্যে মৌলিক উৎপত্তির এই তত্ত্ব এক দৃঢ় সংযােগ স্থাপন করে।
বালগঙ্গাধর তিলক ম্যাক্স মূলারের উপর যথেষ্ট শ্রদ্ধাবান হলেও, তিনি ভাষাতত্ত্ব অপেক্ষা জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিলকের দাবী অনুযায়ী, বৈদিক আর্যগণের পূর্বপুরুষগণ এবং বেদ-এর বিষয়বস্তুর উৎপত্তি প্রাচীনকালে খ্রিষ্টপূর্ব ১০,০০০ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০০ অব্দ নাগাদ তাদের আদি বাসভূমি উত্তর মেরু অঞ্চলে। তিলকের এই দাবী সম্পর্কে মাধব এম দেশপান্ডের মন্তব্যটি এখানে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
“তিলক নিৰ্নীত বেদ-এর সময়পর্ব এবং বৈদিক আর্যগণের পূর্বপুরুষ বিষয়ক তাঁর মতামত যদি মেনে নেওয়া হয়, তবে এটাও মানতে হবে যে, ইন্দো-আর্য শাখা অপেক্ষা ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠীর, সংস্কৃত ব্যতিরেকে, অন্যান্য ভাষা তুলনায় যথেষ্ট নবীন। এই সিদ্ধান্তের ফলে ঔপনিবেশিক পশ্চিমী আর্যগণের ভ্রাতাস্বরূপ ভারতীয় আর্যগণ যে প্রকৃতপক্ষে তদপেক্ষা প্রবীন তা প্রমাণিত হয় যা আবার জাতীয় গর্ব বৃদ্ধির সুযােগ দান করে। তিলক কিন্তু কিভাবে ইন্দো-ইউরােপীয় গােষ্ঠীর সকল ভাষার উৎসস্থল সংস্কৃত ভাষা বলে মনে করেছেন তার কোন সুসংবদ্ধ ব্যাখ্যা দেন নি। স্পষ্টত না জানলেও সমস্ত ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষার মধ্যে সংস্কৃত ভাষাই যে প্রাচীনতম তা তিলক দাবি করেছেন এবং এর ফলে সংস্কৃত ভাষাই সমস্ত ভাষার সম্ভাব্য জননীরূপে প্রতিভাত হয়” (দেশপান্ডে ২০১১৯২)।
উনিশ শতকের শেষভাগে যে জাতীয়তাবাদের আর্বিভাব ঘটেছিল, এই দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে। তা সুন্দরভাবে খাপ খেয়ে যায়। অর্থাৎ আর্যভাষা থেকে আর্যজাতির সমীকরণ এবং সংস্কৃতকে সমস্তভাষার জননী হিসেবে দেখা। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় যে, উনিশ শতকীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যেই এই ভাবনা সবচেয়ে প্রসারিত, বিকশিত ও গ্রহণযােগ্য হয়ে ওঠে। কারণ তা ছিল তাদের সামাজিক অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দ্রুত সমাজ বদলের স্বপ্নে তারা তাদের আত্ম পরিচয়ের সন্ধান চালিয়েছেন। খুঁজছিলেন তাদের সামাজিক অবস্থানের বৈধতা। এবং তা পেয়েও গেলেন প্রাচীনযুগের ইতিহাসের মধ্যে। দয়ানন্দ সরস্বতী, নারায়ণ পাগবী (১৮৯৩) এবং বিবেকানন্দের রচনায় ও বক্তৃতায় উঠেছিল সুপ্রাচীন অতীতের কথা, আর্যজাতির ভারতীয় উৎস অনুসন্ধান, বৈদিক যুগের গরিমা এবং সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের কথা।
দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮১৪-১৮৮৩) এই ভাবনা দ্বারা ভাবিত হয়েই তৈরী করলেন ‘আর্যসমাজ’। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বৈদিক সমাজে ফিরে যাওয়া। এই প্রসঙ্গে বিবেকানন্দের সাথে তাঁর মতের কিছুটা সাদৃশ্য দেখা যায়। তিনি মনে করতেন বেদ রচয়িতা আর্যগণ তিব্বত থেকে ভারতে এসে পৌঁছায়। বর্তমান উচ্চবর্ণের হিন্দুগণ হলেন আর্য। তিনি বিশ্বাস করতেন— বেদ সর্বপ্রকার জ্ঞান, এমন কি আধুনিক বিজ্ঞানের জনক। আর্যদের জাতিগত এবং ভাষাগত শুদ্ধতার উপর তিনি বিশেষ জোর দেন এবং আর্যসমাজকে ‘আর্যজাতির সমাজ’ বলে বর্ণনা করেন। আর্যগণ উচ্চবর্ণভূক্ত। দলিতগণ এই ব্যবস্থার অন্তর্গত ছিল না— যদিও তারা চাইলে ‘শুদ্ধি’ নামক ক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের উচ্চবর্ণে অন্তর্ভুক্ত করা হত। প্রকৃতপক্ষে এই ‘শুদ্ধি’ ক্রিয়ার ভাবনা উচ্চবর্ণের মানুষের ঘৃণার এক বহিঃপ্রকাশ মাত্র (থাপার ২০১১১৪-১৫)।
ভারতে সমস্ত রকমের পাশ্চাত্য প্রভাবের তিনি ছিলেন তীব্র বিরােধী। ব্রাহ্ম আন্দোলনের তিনি তীব্র সমালােচক ছিলেন। কারণ এই আন্দোলনটি ছিল পাশ্চাত্য ধ্যান ধারণার দ্বারা প্রভাবিত। ব্রাহ্মসমাজের শিক্ষামূলক সাহিত্য খ্রীষ্ট, বুদ্ধ, নানক, চৈতন্য এবং মহম্মদের স্থান ছিল। তাঁর মতে— এ সবই ভারতের অর্থাৎ ‘আর্যাবর্তের’ ঐতিহ্য বিরােধী।
এই ব্রাহ্মণ্য দৃষ্টিভঙ্গী ইন্দো-ইউরােপীয় গােষ্ঠীর আধুনিক জ্ঞানচেতনা এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে যে নবতর চেতনার নির্মাণ করে তার প্রতিফলন দেখা যায়। তিলকের সমসাময়িক নারায়ণ পাবগীর রচনায়। তিলক যখন বৈদিক আর্যগণের আদিবাসভূমি আর্কটিক বা উত্তর মেরু অঞ্চলে বলে দাবী করেছেন, তখন পাগবী দাবী করেছেন, আর্যগণের আদি বাসস্থান ছিল আর্যাবর্তেই— যদিও আর্যাবর্তে বসবাসকারী আর্যগণের একটি শাখা সুমেরু অঞ্চলে অভিবাসন করলেও শেষাবধি তারা পুনরায় ভারতে প্রত্যাবর্তন করে বলে তিনি মনে করতেন। আর্যাবর্তই আর্যগণের আদিবাসভূমি— এই বিশ্বাসে পাগবী, আর্যগণ যে ভারতে বহিরাগত জাতি সে ধারণার বিপক্ষে সওয়াল করেন। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তিনি দাবী করেন যে, আর্যাবর্ত থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আর্যগণ ছড়িয়ে পড়ে এবং তাই সংস্কৃত ভাষাই পৃথিবীর সমস্ত ভাষার মাতৃস্বরূপা।
পাগবীর ‘ভারতীয় সাম্রাজ্য’ (১৮৯৩) নামক গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ড হল ‘দ্য আর্যান পিপল অ্যান্ড দ্য ওয়েলথ অফ দেয়ার ইনটেলিজেন্স’। এই রচনায় তিনি দাবী করেন যে, মনুষ্য প্রজাতির সর্বপ্রধান গ্রন্থ হল বেদ এবং শুধু আর্যগণের নয়, উত্তর ভারতে যে সমগ্র মনুষ্য প্রজাতির আদিবাসভূমি ছিল, বেদ সেই ধারণাকে পুষ্ট করে (পাগবী ১৮৯৩২। দেশপান্ডে কর্তৃক উদ্ধৃত ২০১১৯৩)। ‘ভারতীয় সাম্রাজ্য’ (১৯০০)র নবম খন্ডে তিনি ঘােষণা করেন, ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে আর্যাবর্তই হল। সংস্কৃত ভাষার উৎপত্তিস্থল এবং সংস্কৃতই সমস্ত আর্যভাষার মাতৃস্বরূপা। সমস্ত ভাষা, যথা— মারাঠী, হিন্দি, বাংলা, গুজরাটি, ইরানীয়, গ্রীক, ল্যাটিন, জার্মান, ইংরাজী ও পােলিশ ভাষার জন্ম। সংস্কৃত ভাষা থেকে (পাগবী, ১৯০০১৪। দেশপান্ডে কর্তৃক উদ্ধৃত ২০১১৯৪)। তিনি দেখান যে, প্রকৃত আর্যগােষ্ঠীর বিভিন্ন শাখা নিজস্ব ধর্ম ও জাতি ত্যাগপূর্বক আদি বাসভূমি ছেড়ে চলে যায়, যার ফলে আর্যভাষার বিভিন্ন শাখার উৎপত্তি ঘটে (পূর্বোক্ত১৬, পূর্বোক্ত৯৪)। লক্ষ্য করার বিষয় হলাে, তাঁর এই সিদ্ধান্তের ভিত্তি কোন ভাষা বা প্রত্নতাত্ত্বিক আলােচনা বা গবেষণা নয়, বরং তিনি প্রায় সম্পূর্ণভাবেই স্মৃতি ও পুরাণের উপর নির্ভর করেছিলেন।
১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মাদাম ব্লভাৎস্কি ও কর্ণেল ওলকট ‘থিয়ােসফিকাল সােসাইটি’র প্রতিষ্ঠা করেন। ব্লভাৎস্কি ও ওলকট আর্য শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা প্রচার করার পাশাপাশি এটাও বলতে থাকেন যে, আর্যগণ হল আধুনিক হিন্দুদের পূর্বপুরুষ, ভারতবর্যের দেশজ মানুষ এবং ইউরােপীয় সভ্যতার জনক (থাপার ২০১১১৫)। ভারতবর্ষ সম্পর্কে এই ধারণা জার্মান রােমান্টিসিজমের প্রাথমিক চিন্তার ফসল। একদিকে প্রাচ্য ধর্মের এক বলয় এবং অন্যদিকে তার সঙ্গে ভারতীয় ধর্মচেতনা ও ইউরােপের বস্তুবাদের মধ্যের দোলাচল এই অধ্যাত্মবাদ বা থিয়সফির উত্থানে সহায়ক হয় (পূর্বোক্ত)।
এইভাবে আত্মপরিচয় খোঁজার প্রচেষ্টাটি আর্য খ্যাপামির কানাগলিতে হারিয়ে যায়। ভাষা গােষ্ঠীকে ভ্রান্তভাবে উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত করা এবং প্রাচীন ভারত সম্পর্কে বিশেষ করে বেদ ও সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে মােহান্ধতা জাতীয়তাবাদের ধারণার সাথে মিলেমিশে এক বিচিত্র ধারণার জন্ম দেয়। যাকে সুনীতি কুমার আর্যামি বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এ খ্যাপামি থেকে কেশব সেনের মত বিবেকানন্দও মুক্ত হতে পারেননি। আর তার ফলে বিবেকানন্দ পাগবীর মতই আর্যদের দেশজ বলে চিহ্নিত করেছিলেন এবং বেদকে আদি সাহিত্যের শিরােপা দিয়েছিলেন। এই সিদ্ধান্ত ও ধারণাগুলির পিছনে কেন ভাষাতাত্ত্বিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমান উপস্থিত করার তাগিদ বিবেকানন্দ অনুভব করেননি। পাগবীর মতই তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে বেদ, পুরাণ, স্মৃতি ইত্যাদিই ছিল একমাত্র উৎস। বিষয়টি যথা সময়ে উত্থাপিত হবে। উনিশ শতকের বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯) ম্যাক্স মুলারকে অনুসরণ করে আর্যজাতির আদি নিবাস, ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তা এইরকম,
“প্রথমত, আৰ্য্য জাতিদিগের দুইটি প্রবাহ দেখিতে পাওয়া যায়। তন্মধ্যে একটি ভারতবর্ষাভিমুখে, অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এবং আর একটি ইয়ুরােপের অভিমুখে অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম দিকে। এই দুইটি প্রবাহের সংযােগস্থল, আসিয়া [এশিয়া] মহাদেশ।”
“দ্বিতীয়ত, প্রাচীনতম কালের সভ্যদেশসমূহ আসিয়া [এশিয়া] খন্ডেই অবস্থিত। আর্য ভাষাসমূ হের মধ্যে ঋগ্বেদের ভাষাই সর্বাপেক্ষা প্রাচীনতম। সুতরাং আসিয়া [এশিয়া] খন্ডের মধ্যে, এবং ঋগ্বেদের জন্মস্থান পঞ্জাব প্রদেশ হইতে অনতিদূরে কোনও প্রদেশে আৰ্যজাতির আদিম বাসস্থান হওয়াই সম্ভব।”
“তৃতীয়ত, অপেক্ষাকৃত আধুনিক সময়ে মধ্য আসিয়া [এশিয়া] হইতে বার বার অনেক পরাক্রান্ত জাতি উদ্ভূত হইয়া ইয়ুরােপ মহাদেশ আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে। খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর হূণজাতি ও ত্রয়ােদশ শতাব্দীর মােগল জাতি তাহার উদাহরণ স্থল। অতএব, প্রাচীনকালেও আৰ্য্যগণ মধ্য আসিয়া [এশিয়া] হইতে উদ্ভূত হইয়া ইয়ুরােপ বিজয় করিয়াছিলেন, ইহা সম্ভব বলিয়া মনে হয়।”
“চতুর্থত, যদি ইয়ুরােপ, বিশেষতঃ স্ক্যান্ডেনেভিয়া হইতে আর্যজাতির উৎপত্তি হইত, তাহা। হইলে, আৰ্য ভাষাসমূহের সমুদ্র সম্বন্ধীয় বহুসংখ্যক সাধারণ শব্দ পাওয়া যাইত। এই সকল ভাষায় পশুবিশেষ বা পক্ষিবিশেষ সাধারণ নাম যাওয়া যায়, কিন্তু এই সকল ভাষায় সমুদ্র বা জলচর জীবের সাধারণ নাম যাওয়া যায় না।” (দত্ত, রমেশচন্দ্র, ২০০১৫২)
ম্যাক্স মুলারের এই ভাষা ও জাতিকে এক করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গীটি রমেশচন্দ্র দত্ত গ্রহণ করলেও, প্রাচীন বৈদিক আর্যদের সম্পর্কে তিনি কোন ভ্রান্ত মােহজালে জড়িয়ে পড়েননি বা আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়ে প্রাচীন অতীত ইতিহাস চর্চা করেননি। এখানেই বিবেকানন্দের সাথে তাঁর চিন্তাগত পার্থক্য। রমেশচন্দ্র দত্ত ভারত ইতিহাসচর্চা করেছিলেন যুক্তিবাদের ভিত্তিতে, নির্মোহভাবে। এখানেই তাঁর কাজের সার্থকতা ও সাফল্য। যদিও বেশ কিছু ক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্তগুলি ঐতিহাসিক কালগত কারণে সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ তখনও মহেঞ্জোদারাে ও হরপ্পার উৎখনন হয়নি। প্রাগার্য এই সভ্যতার আবিস্কার ভারতের ইতিহাস চর্চায় এক নতুন দিগন্ত উত্থাপিত হয়। রমেশচন্দ্র দত্তের যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর উপর ভরসা রেখে বলা যায় যে, তার সময়ের মধ্যে সিন্ধু সভ্যতার আবিস্কার সম্ভব হলে, তার চর্চা আরও বেশি সম্পূর্ণতা লাভ করতাে।
উনিশ শতকের এই আর্য ধারণা উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের বনিয়াদ হিসেবে কাজ করেছিল। এই ধারণাকে কেন্দ্র করে আবির্ভাব ঘটেছিলাে এক ধরনের গোঁড়ামি পূর্ণ চিন্তাধারা। যার হাত ধরেই পরবর্তীকালে যে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয় সেখানে হিন্দু ছাড়া বাকী সকলের ক্ষেত্রেই চলে। exclusion প্রক্রিয়া। যা সেকুলার জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, নিবেদিতা, তিলক, অরবিন্দ প্রমূখ হলেন এর প্রধান কারিগর। এই পর্বের আর্য ধারণা সংক্রান্ত গোঁড়ামির সমালােচনা করে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন—
“আমাদের দেশের একটি বিশিষ্ট মত যা শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত অধিকাংশ লােককে অভিভূ ত করে আছে, সেটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘আৰ্য্যামি’, এই জিনিসটি অতি হালের, গত শতাব্দীর [উনিশ শতকের] ভাষাতত্ত্ব আর প্রত্নতত্ত্ব আলােচনায় এর উদ্ভব, রাজার জাতের সঙ্গে জ্ঞাতিত্ব কল্পনার পুলকে, পাশ্চাত্য জগতের সঙ্গে সাকুল্য লাভের আশায় এর প্রসার।… আমাদের হিন্দু সভ্যতাটা যে একটা মিশ্র ব্যাপার, তা সর্বাদিসম্মত। নামের মােহে পড়ে হিন্দু সভ্যতা গড়তে অনার্যের সাহায্যকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করলে চলবে না। রামেন্দ্রসুন্দর, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখমনীষীরা এই প্রকার বিচারের সারবত্তা যথার্থ উপলব্ধি করেছেন।” (২০০৪৭)।
রবীন্দ্রনাথ এই আর্যামির ধারণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। ‘স্বদেশী সমাজ’-এ তিনি লিখেছেন,
“ভারতবর্ষে প্রবেশ করিয়াই আর্যগণের সহিত এখানকার আদিম অধিবাসীদের তুমুল বিরােধ বাধিয়াছিল। এই বিরােধে আর্যগণ জয়ী হইলেন, কিন্তু অনার্যেরা আদিম অষ্ট্রেলিয়ান বা আমেরিকান গণের মতাে উৎসাদিত হইল না; তাহারা আর্য উপনিবেশ হইতে বহিস্কৃত হইল না; তাহারা আঙু পনাদের আচার বিচারের সমস্ত পার্থক্য সত্বেও একটি সমাজতন্ত্রের [সমাজব্যবস্থার] মধ্যে স্থান পাইল। তাহাদিগকে লইয়া আর্য সমাজ বিচিত্র হইল।” (রচনাবলী, ১৪০২ বাংলা, ২৬৩৮.)।
ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ ও সভ্যতা যে আর্য ও অনার্যদের মিশ্রণের ফল– রবীন্দ্রনাথ তা দ্বিধাহীনভাবে ঘােষণা করেছেন। এবং এরই পাশাপাশি ‘আৰ্যমি’ সম্পর্কে শ্লেষের সুরে বলেছেন,
“সেই প্রবল বেগবান সভ্যতাকে আজ আমরা নিতান্ত নিরীহ নির্বিরােধ নির্বিকার নিরাপদ নিজীবভাবে কল্পনা করে নিয়ে বলছি, আমরা সেই সভ্যজাতি, আমরা সেই আধ্যাত্মিক আর্য, আমরা কেবল জপতপ করব, দলাদলি করব; সমুদ্রযাত্রা নিষেধ করে, বিভিন্ন জাতিকে অস্পৃশ্য শ্রেণীভু ক্ত করে, আমরা সেই মহৎ প্রাচীন হিন্দুনামের সার্থকতা সাধন করব।” (রচনাবলী, ১৪০২ বাংলা ২৫০৭)।
মাত্র ২৭ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন—
মােক্ষমূলার বলেছে, ‘আর্য’
সেই শুনে সব ছেড়েছি কার্য,
মােরা বলে করেছি ধার্য,
আরামে পড়েছি শুয়ে।
মনু নাকি ছিল আধ্যাত্মিক।
আমরাও তাই, করিয়াছি ঠিক,
এ যে নাহি বলে ধিক্ তারে ধিক্
শাপ দিই পইতে ছুঁয়ে।
[বঙ্গবীর, ১৮৮৮]
‘আর্য’ সম্পর্কে উনিশ শতকীয় ভাবনাটি কিভাবে ভাষা থেকে জাতি ধারণায় পৌঁছলাে এবং জাতীয়তাবাদের সাথে যুক্ত হয়ে কিভাবে একটি উন্মাদনা বা খ্যাপামিতে পরিণত হল তারই একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা এখানে উপস্থিত করা হল। এবার দেখা হবে ‘আর্য’ সম্পর্কে বিবেকানন্দের মতটি ঠিক কি ছিল।
[৩]
‘আর্য খ্যপামির’ জন্মদাতা ম্যাক্স মুলার সম্পর্কে বিবেকানন্দ বিরাট শ্রদ্ধার মনােভাব পােষণ করতেন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে বিবেকানন্দ ম্যাক্স মূলার সম্পর্কে তাঁর গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে লিখেছেন,
“অধ্যাপক ম্যাক্স মূলার একজন অসাধারণ ব্যক্তি।… আমি তাঁহার প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করিতে গিয়াছিলাম” (২০১২১০১১৪)। “ভারতের উপর তাঁহার কী অনুরাগ! যদি আমার সে অনুরাগের শতাংশের একাংশও থাকিত, তাহা হইলে আমি ধন্য হইতাম। এই অসাধারণ মনস্বী পঞ্চাশ বা ততােধিক বৎসর ধরিয়া ভারতীয় চিন্তা রাজ্যে বাস ও বিচরণ করিয়াছেন, পরম আগ এহ ও হৃদয়ের ভালবাসার সহিত সংস্কৃত সাহিত্যরূপ অনন্ত অরণ্যের আলাে ও ছায়ার বিনিময়। পর্যবেক্ষণ করিয়াছেন, শেষে ঐ সকল তাঁহার হৃদয়ে বসিয়া গিয়াছে এবং তাঁহার সমগ্র সত্তায় উহার রঙ ধরাইয়া দিয়াছে” (পূর্বোক্ত ১১৫)।
বিবেকানন্দ যদি এইটুকু বলে থামতেন তাহলেও তার একটা অর্থ দাঁড়াতাে। ম্যাক্স মুলার বিবেকানন্দের গুরু রামকৃষ্ণের জীবনী ও বাণী সম্পর্কে বই লিখেছেন। ম্যাক্স মুলারের বইটিই হল রামকৃষ্ণের জীবনী ও বাণী সম্পর্কে কোন বিদেশীর লেখা প্রথম বই। স্বাভাবিক ভাবেই বিবেকানন্দ যে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন—তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিবেকানন্দ নিজেই তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন,
“… যে কোনাে ব্যক্তি শ্রীরামকৃষ্ণকে। ভালবাসেন তিনি নারীই হউন, পুরুষই হউন, তিনি যে কোন সম্প্রদায়-মত বা জাতিভূক্ত হউন না কেন— তাঁহাকে দর্শন করিতে যাওয়া আমি তীর্থযাত্ৰাতুল্য জ্ঞান করি।” (পূর্বোক্ত১১৪)।
এই প্রবন্ধেই (ভারত বন্ধু অধ্যাপক ম্যাক্স মুলার, ১৮৯৬) তিনি ম্যাক্স মুলারকে বেদান্তে বিশ্বাসী একজন হিসাবে ঘােষণা করেছেন। তাঁর ভাষায়,
“ম্যাক্স মূলার একজন ঘাের বৈদান্তিক। তিনি বাস্তবিকই বেদান্ত রূপ রাগিনীর নানা স্বর বিস্তারের ভিতর প্রধান সুরটিকে ধরিয়াছেন” (পুর্বোক্ত ১১৫)।
১৮৯৫-এর মে মাসে ম্যাক্স মূলার সম্পর্কে এতটা উচ্ছাস তাঁর ছিল না। কারণ সে সময়ে ম্যাক্স মূলার রামকৃষ্ণের উপর কোন বই বা প্রবন্ধ লেখেননি। তাছাড়া বিবেকানন্দের সাথেও তাঁর তখনও ব্যক্তিগত পরিচয় হয় নি। তাই বিবেকানন্দ হেল ভগিনীগণকে চিঠিতে দ্বিধাহীনভাবে লিখতে পারেন,
“অধ্যাপক ম্যাক্স মূলার তাঁর হিন্দু ধর্ম বিষয়ক রচনা সমূহের শেষভাগে ক্ষতিকর একটি মন্তব্য না দিয়ে ক্ষান্ত হন না” (১৯৭৭৩২৯)।
কয়েকমাসের মধ্যেই ম্যাক্স মুলারের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত আলাপ হওয়ায়, বিবেকানন্দ তাঁকে ‘ঋষিকল্প লােক’ বর্ণনা করেছেন (১৯৭৭৪৫৯)।
যাইহােক, এটা স্পষ্ট যে তিনি ম্যাক্স মুলারের রচনাবলী এবং মতের সাথে যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন। এবং তিনি যে ম্যাক্স মুলারের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন, সেটা তাঁর ভাবনাটি আলােচনা করলেই বােঝা যায়। ম্যাক্স মূলারের আর্যভাষা ও জাতির সমীকরণ তিনি প্রায় অন্ধভাবে গ্রহণ করলেও, স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গীতে প্রয়ােজনের তাগিদে সে ধারণাকেও পরিত্যাগ করেছেন। নিজের মতাে করে আর্য ধারনাটিকে গড়ে তােলেন। এ ধারণার পিছনে ভাষাতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বের সমর্থন থাক বা না থাক তাতে কিছু আসে যায় না।
ম্যাক্স মূলারের মতাে বিবেকানন্দ আর্য ভাষা-গােষ্ঠীর মানুষকে জাতি হিসেবেই গ্রহণ করেছেন। অতঃপর তিনি আরও চরম ও উগ্র সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর কাছে পৃথিবীর ইতিহাসের প্রাচীনতম জাতি হল আর্য। শুধু তাই নয়, এই আর্যরা হল ‘ভারতীয় আর্য’ (২০১২ – ১০৬২)। বিবেকানন্দের এই মন্তব্য থেকে তিনটি বিষয় নিঃসৃত হয়,
- ১) আর্য ভাষাগােষ্ঠী ও আর্য জাতির মধ্যে সমীকরণ করা হল।
- ২) ভারতীয় আর্য বলতে তিনি হিন্দুদের পূর্বপুরুষকেই বুঝিয়েছেন।
- ৩) ভারতীয় আর্যগণ (বা হিন্দুগণ) হলেন পৃথিবীর ইতিহাসে আবির্ভূত জাতি সমূহের মধ্যে প্রাচীনতম।
বিবেকানন্দ যে ম্যাক্স মূলারের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আর্যভাষা ও আর্য জাতির সমীকরণকে গ্রহণ করেছিলেন, সেই ম্যাক্স মূলারই ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা ও জাতির মধ্যেকার সম্পর্ককে অস্বীকার করেন Auld Lang Syne (1898) নামক রচনায়। তিনি বলেন,
“বৈজ্ঞানিক ভাষায় জাতি অর্থে আর্য শব্দের ব্যবহার অনুপযুক্ত। এই শব্দের অর্থ ভাষা এবং ভাষা ব্যতিরেকে অন্য কিছুই হতে পারে না” (থাপার কর্তৃক উদ্ধৃত ২০১১৪)।
ম্যাক্স মূলার তাঁর পুরানাে মত থেকে সরে এসেছিলেন খানিকটা বাধ্য হয়েই। কারণ তাঁর আর্য জাতির ধারণা ইউরােপীয় চিন্তাবিদ ও পন্ডিতদের দ্বারা প্রচন্ডভাবে সমালােচিত হয়েছিল। তাই উপায়ন্তর না দেখেই তার এই পশ্চাৎ অপসারণ। বিবেকানন্দ কি ম্যাক্স মূলারের এই মত পরিবর্তন জানতেন না? জানাটাই স্বাভাবিক। কারণ ততদিনে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছে। ম্যাক্স মুলারের এই মত পরিবর্তন বিবেকানন্দকে সম্ভবত প্রভাবিত করতে পারেনি। কারণ তিনি আর্য জাতি সংক্রান্ত ধারণাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন একেবারে সিংহলীদের দেশে।
বিবেকানন্দের আর্য ধারণা নিয়ে আলােচনা করতে গেলে দুটি বিষয়ের উপর আলােকপাত করা প্রয়ােজন। প্রথমত, তাঁর মতের স্ববিরােধিতা। অর্থাৎ একই বিষয়ে তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয়ত, বিবেকানন্দের সমসময়ে এবং পরবর্তীকালের আর্য সংক্রান্ত গবেষণা তাঁর মতের সীমাবদ্ধতাগুলিকেই চিহ্নিত করে।
১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে আর্যদের ‘প্রাচীনতম জাতি’ (২০১২১০৬২) বলে। চিহ্নিত করলেও, ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘তামিল জাতির’ সভ্যতাকে সর্বপ্রাচীন বলে চিহ্নিত করেছেন। ‘পরিব্রাজক’-এ লিখেছেন,
“মান্দ্রাজ সেই তামিল’ জাতির আবাস, যাদের সভ্যতা সর্বপ্রাচীন, যাদের ‘সুমের’ নামক শাখা ‘ইউফ্রেটিস’ তীরে প্রকান্ড সভ্যতা বিস্তার অতি প্রাচীনকালে করেছিল, যাদের জ্যোতিষ, ধর্মকথা, নীতি, আচার প্রভৃতি অসিরি বাবিলি সভ্যতার ভিত্তি, যাদের পুরাণ সংগ্রহ বাইবেলের মূল, যাদের আর এক শাখা মালাবার উপকূল হয়ে অদ্ভুত মিসরি সভ্যতার সৃষ্টি করেছিল, যাদের কাছে আর্যরা অনেক বিষয় ঋণী” (২০১২৬৬৭)।
এই ‘পরিব্রাজক’ (১৮৯৯)-এ তিনি আবার ‘তামিল’ শব্দের ব্যবহার না করে দ্রাবিড়ি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তাদের নৃতাত্ত্বিক বর্ণনাও দিয়েছেন,
“রঙ কালাে, কিন্তু সােজা চুল, সােজা নাক, সােজা কালাে চোখ— প্রাচীন মিসর, প্রাচীন বাবিলােনীয়ায় বাস করত এবং অধুনা ভারতময়—বিশেষ করে দক্ষিণ দেশে বাস করে; ইওরােপেও এক-আধ জায়গায় চিহ্ন পাওয়া যায়— এ এক জাতি। এদের পারিভাষিক নাম দ্রাবিড়ি” (২০১২ ৬৮৭-৮৮)।
আর্যদের বর্ণনায় বলেছেন,
“… যারা সংস্কৃতের সদৃশ ভাষা কয়, সােজা নাক মুখ চোখ, রঙ সাদা, চুল কালাে বা কটা, চোখ কালাে বা নীল, এদের নাম আরিয়ান” (পূর্বোক্ত ৮৮)।
এরপর তিনি যে সিদ্ধান্তে এসেছেন তা হল,
“বর্তমান সমস্ত জাতিই এই সকল জাতির এই সকল জাতির [নেগ্রিটো, মােঙ্গালয়েড, দ্রাবিড়, সেমিটিক, আর্য ইত্যাদি] সংমিশ্রণে উৎপন্ন” (পূর্বোক্ত)।
অর্থাৎ ১৮৯৭-এ বলা “সমগ্র ভারত আর্যময়, এখানে অপর কোন জাতি নেই” (২০১২৫ঙ্গ ১৪৫)— ধারণাকে তিনি পরিত্যাগ করলেন।
‘পরিব্রাজক’ (১৮৯৯)-এ তিনি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আর্য ও দ্রাবিড়দের মধ্যে নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য করলেও ‘আর্য ও তামিল’ প্রবন্ধে তা করেননি। তাঁর মতে আর্য ও দ্রাবিড়দের মধ্যে শুধুমাত্র ভাষাগত প্রভেদ আছে, নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য নেই। তাঁর ভাষায়,
“আর্য ও দ্রাবিড়— এই বিভাগ কেবল ভাষাতাত্ত্বিক বিভাগমাত্র, করােটি তত্ত্বগত (craniological) বিভাগ নহে, সে ধরণের বিভাগের পক্ষে কোন দৃঢ় যুক্তিই নাই” (২০১২৫২৯৬)।
তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এই প্রবন্ধে বলেছেন,
“ভাষাতাত্ত্বিক ‘আর্য’ ও ‘তামিল’ এই শব্দ দুইটির নিহিত তাৎপর্য যাহাই হউক না কেন, এমন কি যদি ধরিয়া লওয়া যায় যে, ভারতীয়দের এই দুটি বিশিষ্টশাখা ভারতবর্ষের পশ্চিম সীমান্ত পার হইতে আসিয়াছিল, তবু অতি প্রাচীনকাল হইতে এই বিভাগ ভাষাতত্ত্বগত— রক্তগত নহে” (পূর্বোক্ত)।
বিবেকানন্দের উত্থানে দক্ষিণ ভারতের ও তামিল জনগণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ফলে, তাদের প্রতি একটি কৃতজ্ঞতাবােধ তাঁর সবসময়ই কাজ করেছিল। কলকাতা জন্ম দিয়েছে। বিবেকানন্দের, কিন্তু মাদ্রাজ আবিষ্কার করেছে তাঁকে। (হিন্দু পত্রিকা, বসু, শঙ্করী, ২০০৯৫৩৪৮)।
অন্যান্য স্থানে তিনি তামিল/দ্রাবিড়দের পৃথক জাতি হিসাবে, আর্যদের থেকে স্বতন্ত্র ভাষা গােষ্ঠী হিসেবে দেখালেও দক্ষিণ ভারত ভ্রমণকালে কখনই তিনি এই পার্থক্যকে স্বীকার করেননি। বরং তামিল/দ্রাবিড়দেরকে আর্য প্রতিপন্ন করারই চেষ্টা করেছেন। কে. সুন্দরম আয়ার তাঁর স্মৃতি কথায় জানিয়েছেন,
“অধ্যাপক সুন্দরম পিল্লাইদের একটি মন্তব্যে স্বামীজী বিরক্ত হয়ে ছিলেন। অধ্যাপক বলেছিলেন— ‘দ্রাবিড় জাতির’ লােক হিসেবে তিনি নিজেকে হিন্দু সমাজের বহির্ভূত মনে করেন। পরে স্বামীজী বলেছিলেন, অধ্যাপক পিল্লাই পন্ডিত, যে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু জাতি বর্ণের সংকীর্ণতার কাছে বিনা বিচারে তিনি নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছেন” (২০১২৬২)।
অর্থাৎ পিল্লাই-এর বক্তব্য তাঁর কাছে দুটি দিক থেকে আপত্তিকর (১) দ্রাবিড়রা আর্য নয়, পৃথক জাতি এবং (২) দ্রাবিড়রা হিন্দু নয়। বিবেকানন্দের কাছে দ্রাবিড়রা আর্য এবং অবশ্যই হিন্দু। ‘আর্য ও তামিল’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন,
“… আমাদের শাস্ত্রসমূহে ‘আর্য’ শব্দটি যে অর্থে দেখিতে পাই— যাহা দ্বারা এই বিপুল জনসঙ্ঘকে ‘হিন্দু নামে অভিহিত করা হয় সেই অর্থটিই আমরা গ্রহণ করিতেছি। এ কথা সব হিন্দুর সম্বন্ধেই প্রযােজ্য যে, এই আর্যজাতি সংস্কৃত ও তামিল এই দুই ভাষাগােষ্ঠীর সংমিশ্রণে গঠিত। কয়েকটি স্মৃতিতে যে শূদ্রদিগকে এই অভিধা হইতে বাদ দেওয়া হইয়াছে, তাহা দ্বারা ইহাই বুঝায় যে, ঐ শূদ্রেরা এখনও নবাগত শিক্ষার্থী মাত্র, ভবিষ্যতে উহারাও আর্যজাতিতে পরিণত হইবে” (২০১২৫২৯৮)।
বিবেকানন্দের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বলা বক্তব্যের মধ্যে স্ববিরােধিতার জালে জড়িয়ে পড়েছেন বারংবার—
প্রথমত, কোথাও তিনি আর্যদের প্রাচীনতম জাতি (২০১২১০৬২) বললেও অন্যত্র তামিলদের প্রাচীনতম জাতি (২০১২৬৬৭) বলে অভিহিত করেছেন।
দ্বিতীয়ত, কখনও আর্য ও দ্রাবিড়দের একই নৃতাত্ত্বিক গােষ্ঠীভূক্ত (২০১২৫২৯৬) বলে অভিহিত করলেও, অন্য স্থানে তাদের ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কথা (২০১২৬৮৭-৮৮) বলেছেন।
তৃতীয়ত, ভারতবর্ষ আর্যময় (মিশ্রিত জাতি নয়) এখানে অন্য কোনাে জাতি নেই বলে ঘােষণা। করেও তিনি দেখিয়েছেন বর্তমানে কোনাে জাতিই অবিমিশ্র জাতি নয় (২০১২৬৮৮) এবং আর্য। জাতি ‘সংস্কৃত ও তামিল’ এই দুই ভাষাভাষীদের সমন্বয়ে গঠিত (২০১২৫২৯৮)।
চতুর্থত, তিনি আর্যদের হিন্দুবলে অভিহিত করেছেন, আবার একই সাথে ‘আর্য’ ও ‘তামিল’ দের মধ্যে ভিন্নতা দেখিয়েও তামিল/দ্রাবিড়দের হিন্দু বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন। বিবেকানন্দের আর্য ফর্মুলাটি এইরকম—
আর্য = হিন্দু।
হিন্দু = সংস্কৃতভাষী + তামিলভাষী
সুতরাং তামিলগণও আর্য জাতিভূক্ত।
তাঁর এ হেন সিদ্ধান্তটি অন্য একটি সিদ্ধান্ত থেকে নস্যাৎ হয়ে যায়। এটি হল,
“দ্রাবিড়রা মধ্য-এশিয়ার এক অনার্য জাতি – আর্যদের পূর্বেই তারা ভারতে এসেছিল, আর দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড়রাই সব চেয়ে সভ্য ছিল” (২০১২৪২০১)।
বিবেকানন্দের শেষ উদ্ধৃতি থেকে যা নিঃসৃত হল তা এইরকম—
প্রথমত, দ্রাবিড়শব্দটি তিনি জাতিবাচক অর্থে ব্যবহার করলেন, অর্থাৎ দ্রাবিড় জাতির অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিলেন।
দ্বিতীয়ত, দ্রাবিড়দের অনার্য হিসেবে চিহ্নিত করলেন।
তৃতীয়ত, দ্রাবিড়দের বিদেশাগত হিসেবে দেখালেন।
চতুর্থত, দ্রাবিড়দের আর্যপূর্ব জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন।
তিনি শুধু তামিলদের নন, সিংহলীদের ও আর্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ৩ জানুয়ারী, ১৮৯৭-তে মেরীকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেছিলেন,
“সিংহলীরা দ্রাবিড়জাতি নয়- খাঁটি আর্য। প্রায় ৮০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দে বাংলাদেশ থেকে সিংহলে উপনিবেশ স্থাপিত হয় এবং সেইসময় থেকে তারা তাদের পরিস্কার ইতিহাস রেখেছে” (১৯৭৭ – ৫২১)।
তিনি এমন সিদ্ধান্ত কিভাবে করলেন বা বােধগম্য হয় না। বিশেষ করে তাঁরই বর্ণনা থেকে আর্যদের যে ছবি আমরা পাই তা সিংহলীদের সাথে একেবারেই মেলে না। অর্থাৎ তাঁরা সংস্কৃত সদৃশ ভাষায় কথা বলে না, তাদের সােজা নাক মুখ চোখ, গায়ের রং সাদা, চুল কালাে বা কটা, চোখ কালাে বা নীল (২০১২৬৮৮) নয়।
[৪]
বিবেকানন্দকে অনুসরণ করে আর্য কাকে বলে, আর্যরা কারা, তারা কোথা থেকে এলাে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলি কি ইত্যাদি প্রশ্নের যদি উত্তর খুঁজতে হয় তাহলে সরাসরি তাঁর রচনাবলীর সাহায্য নেওয়া প্রয়ােজন। অন্যথায় তাঁর ধারণাটি ঠিক কি ছিল তা বােঝা যাবে না।
আত্মানুসন্ধানে রত ভূদেব মুখােপাধ্যায়ের মতই বিবেকানন্দ আৰ্য্যামিকে আত্মপরিচয়ের সাথে যুক্ত করেছিলেন। বাঙালী সহ সমগ্র ভারতবাসীকে আর্য হিসেবে দেখে একধরনের জাতিগত কৌলিন্যের দাবি জানিয়েছিলেন। এবং তা প্রকাশও করেছিলেন আমেরিকায় সাদা চামড়াদের সামনে। উৎস যেহেতু আর্যজাতি তাই আমেরিকা বা ইউরােপের সাদা চামড়ার প্রভূদের থেকে ভারতবাসী কিছু কম নয়— এই ধরনের ছদ্ম জাতীয়তাবাদী গরিমা তাঁকে গ্রাস করেছিল। তাই তিনি নির্দ্বিধায় ঘােষণা করেন যে আমেরিকার সাদা চামড়ার অধিবাসী ও ভারতের কালাে মানুষেরা একই বংশােদ্ভূত আর্যবংশােদ্ভূত। ১৫ ফেব্রুয়ারী, ১৮৯৪-এ বলেন,
“.. আমরা [আমেরিকার শ্বেতকায় ও ভারতীয় হিন্দুরা] সকলেই একটি সাধারণ সূত্র আর্যজাতি হইতে উদ্ভূত হইয়াছি” (২০১২ ১০১৯)।
১৭ ডিসেম্বর, ১৮৯৪-এ আমেরিকায় অন্য একটি ভাষণে বলেন যে, আমেরিকাবাসী এবং হিন্দুরা একই আর্যজাতির বংশধর। (Burke 2006:2:406)।
নিজেদের অর্থাৎ ভারতীয় হিন্দুদের ভারতীয় হিন্দুদের আর্য বলার ক্ষেত্রে তিনি কারণ নির্দেশ করেছেন। এবং তা করতে গিয়ে একটি সংজ্ঞায় উপনীত হয়েছেন “We call ourselves the Aryan race” (Burke, 2006:2:417)। অথাৎ আমরা নিজেদেরকে আর্যজাতি বলে ডাকি। তাই আমরা আর্য। এই আর্যকে উত্তরে বিবেকানন্দ যা বলেন তার সাথে ভাষাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব বা প্রত্নতত্ত্বের কোন যােগই নেই। তাঁর উত্তরটি হল,
“He is a man whose birth is through religion. This is a piculiar subject, perhaps, in this country, but the idea is that a man must be born through religion, through prayers” (Burke. 2006:2:417)।
বাংলা করলে দাঁড়াবে, আর্য হল সেই মানুষ যে ধর্মের মধ্যে দিয়ে, প্রার্থনার মধ্য দিয়ে জন্মায়। এই বক্তৃতাতেই তিনি বলেছেন যে, একটি শিশুর বস্তুগত জন্মের মধ্যে দিয়ে আর্য হয় না, আর্যকে জন্মাতে হয় আধ্যাত্মিকতার মধ্য দিয়ে (পূর্বোক্ত)। বিবেকানন্দের সমসাময়িক চিন্তাবিগণও এ ধরণের আর্য ধারণাকে সমর্থন করেন নি। পরবর্তী পর্বের ঐতিহাসিক, ভাষাতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিকগণও আর্য কে বা কারা এ প্রশ্নের উত্তরে এই ধরনের অসম্ভব সংজ্ঞাকে কখনই প্রশ্রয় দেন নি।
তিনি তিনটি সভ্যতা সহ প্রায় সব সভ্যতার একটি জাতিগত উৎসের কথা বলেছেন— তা হল আর্য জাতি। এই তিনটি সভ্যতা হল— রােমান, গ্রীক ও হিন্দু সভ্যতা (পূর্বোক্ত৪২০)। এই আর্যদের আদিবাসস্থান কোথায়? এরা কি বাইরে থেকে ভারতে এসেছিল না ভারতবর্ষই তাদের আদি বাসভূমি? এই সব প্রশ্নের উত্তরে বিবেকানন্দের বক্তব্য চূড়ান্ত রকমের স্ববিরােধী ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘ভারতে ভূমির প্রথম বিজেতা’ হিসেবে আর্যগণকে চিহ্নিত (২০১২ ১০৪৬৪) করেই থামেননি, তাদের উদারতা ও সহিষ্ণুতার প্রশংসা করে দেখান যে আর্যরা, “দেশের [ভারতের] তৎকালীন অধিবাসীদিগকে নিশ্চিহ্ন করিবার চেষ্টা করেন নাই” (পূর্বোক্ত)। “উত্তর ভারতের অধিবাসী আর্যের দক্ষিণাঞ্চলের অনার্যগণের উপর নিজেদের আচার-ব্যবহার জোর করিয়া চাপাইবার চেষ্টা করেন নাই, তবে অনার্যেরা আর্যদের অনেক রীতিনীতি ধীরে ধীরে নিজেরাই গ্রহণ করে” (পূর্বোক্ত)। আর্যরা যে বহিরাগত সে কথার সমর্থন পাওয়া যায় তাঁর অন্যান্য বক্তব্যেও। যেমন—
“আকাশচুম্বী হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে বিস্তীর্ন সমতলভূমিতে আর্যগণ আসিয়া বসবাস করেন। এখনও পর্যন্ত ভারতে তাঁহাদের বংশধর খাঁটি ব্রাহ্মণজাতি বিদ্যমান”। (২০১২১০২৯)।
“আর্যগণ ভারতে প্রবেশ করিয়া ভারতের গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়ায় অবিরাম কর্ম করিতে সমর্থ হইল না; সুতরাং তাহারা চিন্তাশীল ও অন্তর্মুখ হইয়া ধর্মের উন্নতি সাধন করিল” (পুর্বোক্ত ১২৮)।
“দ্রাবিড়ীরা মধ্য এশিয়ার এক অনার্য জাতি। আর্যদের পূর্বেই তারা ভারতে এসেছিল…” (২০১২৪২০১)।।
“প্রাচীন নথিপত্র অনুসারে আর্যদের বাসভূমি ছিল তুর্কীস্থান, পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম তিব্বতের মধ্যবর্তী দেশে” (২০১২৫২৮৮)।
বিবেকানন্দের বক্তব্য থেকে এ পর্যন্ত যা দেখা গেল তা হচ্ছে, দ্রাবিড়দের মত আর্যরাও বহিরাগত, বিদেশী এবং ভারতে বসবাসকারী আর্যরা হলেন হিন্দু (২০১২৫২৯৮)। এই হিন্দুদেরই আবার তিনি মূল ভারতবাসী বলে চিহ্নিত করেছেন ইংল্যান্ডে প্রদত্ত একটি ভাষণে, ৭ মে ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে। (Vivekananda. 2008: vol IX:249. The Complete Works.)। এই বক্তৃতায় এমন সিদ্ধান্ত শুরুতে করলেও পরবর্তী অংশে আর্য সংক্রান্ত একটি ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক আলােচনার উত্থাপন করে এমন সিদ্ধান্তে এসেছেন যাতে করে শ্রোতা ও পাঠকের হতভম্ব হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
জোন্স, ম্যাক্স মূলার ও জার্মান ভাষাতাত্ত্বিকদের আলােচনার উল্লেখ করে তিনি দেখিয়েছেন যে সংস্কৃত ও সকল ইউরােপীয় ভাষাগুলির মধ্যে গভীর সাদৃশ্য রয়েছে। প্রাচীন ভাষাগুলির মধ্যে গ্রীক ভাষার সাথে সাদৃশ্য খুবই বেশি। এর পরেই আসে লিথুনিয়ান ভাষার কথা। যার সাথে সংস্কৃতের তাৎপর্যপূর্ণ মিল রয়েছে। এর মধ্য থেকে যে তত্ত্বটি গড়ে ওঠে তা হল প্রাচীনকালে একটি জাতি ছিল, যে জাতির সদস্যরা নিজেদের আর্য বলে অভিহিত করত। এদেরই ভাষা ছিল সংস্কৃত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী এই আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল মধ্য এশিয়ায়। এই জাতি পরবর্তীকালে বহু শাখায় বিভক্ত হয়ে ইউরােপ, পারস্য প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের নিজস্ব ভাষাও গড়ে ওঠে একই সাথে। বিবেকানন্দ এই তত্ত্ব উত্থাপনের পর স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে এ মত এখনও প্রমাণিত হয়নি। কারণ এ তত্ত্ব বহু ক্ষেত্রেই সমস্যাকীর্ণ। যেমন, এই তত্ত্ব যদি সঠিক হয় তাহলে ভারতের মানুষেরা কালাে এবং ইউরােপীয়ানরা সাদা হয় কি করে? এই ধরনের বহু সমস্যাই অমীমাংসিত রয়ে গেছে (পূর্বোক্ত২৫০-৫১)। তিনি কিন্তু দুটি বিষয়ে নিশ্চিত তা হল—
প্রথমত, ইউরােপ ও উত্তর ভারতের মানুষেরা যে ভাষায় কথা বলে তা একই ভাষার ভিন্ন ভিন্ন শাখা (পূর্বোক্ত২৫১)।
দ্বিতীয়ত, আর্যভাষাগুলির মধ্যে সর্বপ্রাচীন হল সংস্কৃত ভাষা। আর্যজাতির যে প্রশাখা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতাে তারাই প্রথম সভ্যতা স্থাপন করেছিল এবং প্রথম গ্রন্থ ও সাহিত্য রচনা করেছিল (পূর্বোক্ত)। তাঁর আন্দাজ অনুযায়ী এই সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্যের সূচনা হয়েছিল ৮০০০ খ্রিঃ পূ বাব্দে (পূর্বোক্ত)।
বর্তমান প্রবন্ধে তিনি আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলােকপাত করেছেন।
প্রথমটি হল, মিশরীয় ও ব্যাবিলনীয়রা আর্য নয়। তাদের সভ্যতা ইউরােপীয়দের থেকেও প্রাচীন। যদিও কোন কোন দিক থেকে মিশরীয়রা আর্যদের সমকালীন ছিল। পদ্ম, বাঁদর এবং চন্দন গাছের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ভারতীয় আর্যদের সাথে তিনি মিশরীয় সভ্যতার সাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা করেছেন (পু র্বোক্ত২৫২)। এর পরেই তিনি মিশরীয়দের আর্যদের তুলনায় খুবই প্রাচীন বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু একই সাথে দেখান যে, তাঁরা হিন্দুদের থেকে প্রাচীন নন (…The Egyptions– were much older than the Aryans, except the Hindus.) (পূর্বোক্ত)
জীবনের শেষ পর্বে তিনি লিখেছিলেন ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ (১৩০৬-০৮ বাংলা)। এখানে কিন্তু এই আর্যদের বিদেশ থেকে আসার ধারণাটিকে তিনি পুরােপুরি ত্যাগ করেছেন। ইউরােপীয় পন্ডিতদের আর্যতত্ত্বের সমালােচনা করে বলেছেন যে,
“আর্যরা কোথা হতে উড়ে এসে ভারতের ‘বুনােদের’ মেরে-কেটে জমি ছিনিয়ে বাস করলেন— ওসব আহাম্মকের কথা। আমাদের পন্ডিতরাও দেখছি সে গোঁয়ে গোঁ— আবার ঐ সব বিরূপ মিথ্যা ছেলেপুলেদের শােনানাে হচ্ছে। এ অতি অন্যায়” (২০১২৬১৬৩)। “কোন বেদে কোন সূক্তে, কোথায় দেখছ যে, আর্যরা কোন বিদেশ থেকে এদেশে এসেছে? কোথায় পাচ্ছ যে, তারা বুনােদের মেরেকেটে ফেলেছেন? খামকা আহাম্মকির দরকারটা কি?” (পূর্বোক্ত ১৬৪)।
বিবেকানন্দের এই ধারণা ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে ভারতের ভবিষ্যৎ’নামক ভাষণে আরও বিস্তৃতভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে তিনি বলেন,
“প্রত্নতাত্ত্বিকগণ স্বপ্ন দেখিয়া থাকেন যে, ভারত কৃষ্ণচক্ষু আদিম জাতিসমূহে পরিপূর্ণ ছিল— উজ্জ্বলবর্ণ আর্যগণ আসিয়া সেখানে বাস করিলেন; তাহারা কোথা হইতে যে উড়িয়া আসিয়া জুড়িয়া বসিলেন, তাহা ঈশ্বরই জানেন! কাহারও কাহারও মতে মধ্য-তিব্বত হইতে, আবার কেহ কেহ বলেন মধ্য এশিয়া হইতে। অনেক স্বদেশপ্রেমিক ইংরেজ আছেন, যাঁহারা মনে করেন— আর্যগণ সকলেই হিরণ্যকেশ ছিলেন। অপরে আবার নিজ নিজ পছন্দমত তাঁহাদিগকে কৃষ্ণকেশ বলিয়া স্থির করেন। লেখকের নিজের চুল কালাে হইলে তিনি আর্যগণকেও কৃষ্ণকেশ করিয়া বসেন। আর্যগণ সুইজারল্যান্ডের হ্রদগুলির তীরে বাস করিতেন— সম্প্রতি এরূপ প্রমাণ করিবারও চেষ্টা হইয়াছে। তাঁহারা সকলে মিলিয়া যদি এই সব মতামতের সঙ্গে সেখানেই ডুবিয়া মরিতেন, তাহা হইলেও আমি দুঃখিত হইতাম না! আজকাল কেহ কেহ বলেন, আর্যগণ উত্তরমেরু নিবাসী ছিলেন। আর্যগণ ও তাঁহাদের বাসভূমির উপর ভগবানের আশীর্বাদ বর্ষিত হইক। আমাদের শাস্ত্রে এই সকল বিষয়ের কোন প্রমাণ আছে কিনা যদি অনুসন্ধান করা যায়, তবে দেখিতে পাইবে— আমাদের শাস্ত্রে ইহার সমর্থক কোন বাক্য নাই; এমন কোন বাক্য নাই, যাহাতে আর্যগণকে ভারতের বাহিরে কোন স্থানের অধিবাসী মনে করা যাইতে পারে; আর আফগানিস্থান প্রাচীন ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শূদ্রজাতি যে সকলেই অনার্য এবং তাহারা যে বহুসংখ্যক ছিল, এ-সব কথাও সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। সে সময়ে সামান্য কয়েকজন উপনিবেশকারী আর্যের পক্ষে শত সহস্র অনার্যের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া বাস করাই অসম্ভব হইত। উহারা পাঁচ মিনিটে আর্যদের চাটনির মতাে খাইয়া ফেলিত (২০১২৫১৪৬)।”
আর্য সংক্রান্ত যে ধারণা বিবেকানন্দের বাণী, রচনা ও চিঠিপত্রে পাওয়া যায় তার উপর ভিত্তি করে পাঠকের পক্ষে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানাে সম্ভব নয়। তাহলে আর্যপ্রশ্ন সম্পর্কে বিবেকানন্দের মতটি ঠিক কি ছিল? নাকি তাঁর কোন মতই নেই। বস্তুত আর্য সংক্রান্ত বিষয়ে যে গভীর অনুসন্ধানের প্রয়ােজন ছিল এবং তার জন্য যে সময় দেওয়া দরকার ছিল তার কোনােটাই বিবেকানন্দের ছিলনা। আরও দুটি সমস্যা এখানে যুক্ত ছিল প্রথমটি হল— সমসাময়িক কালের ঔপনিবেশিক ক্ষমতা কাঠামাের স্বার্থরক্ষাকারী ভাষাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের ক্ষতিকর মতবাদ ও চিন্তা ভাবনার প্রবল প্রভাব, এবং দ্বিতীয়ত, প্রাগার্য সভ্যতা হিসেবে হরপ্পা সভ্যতার অস্তিত্ব তখনও পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত থাকা।
[৫]
বিবেকানন্দ বিশেষজ্ঞ শঙ্করীপ্রসাদ বসু (২০০৯) আর্য ও তামিল প্রসঙ্গে বিবেকানন্দের বক্তব্য আলােচনা করতে গিয়ে একদেশদর্শীভাবে দেখিয়েছেন যে, বিবেকানন্দের মতে আর্যরা বহিরাগত নয়, আর্য ও তামিলরা সদৃশ ইত্যাদি। একই সাথে এও বলেছেন যে,
“তাঁর [বিবেকানন্দের] যুক্তির অংশ কতদূর গ্রাহ্য তা ঐতিহাসিক-প্রত্নতাত্ত্বিক-নৃতাত্ত্বিকগণ বিচার করবেন” (২০০৯৫৩৫৪)।
আধুনিক কালের আর্য সংক্রান্ত যে গবেষণা সে সম্পর্কে শঙ্করীবাবু যথেষ্ট সচেতন হওয়া সত্বেও, সযত্নে সে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেছেন। হয়তাে এই কারণেই যে, আর্য সংক্রান্ত আধুনিক গবেষণাগুলি আর যাই হােক বিবেকানন্দের আর্য ধারণাকে কখনই সমর্থন করবে না। এবং সেই কারণে সে আলােচনা থেকে শঙ্করীবাবু নিজেকে দূরে রেখেছেন। এই প্রসঙ্গে বিবেকানন্দের পরস্পর বিরােধী বক্তব্যগুলিও তাঁর নজর এড়িয়েছে। তাই তিনি এক্ষেত্রে তাঁর পছন্দ মত উদ্ধৃতিগুলিকেই লেখায় স্থান দিয়েছেন এবং ঐতিহাসিক-নৃতাত্ত্বিকদের হাতে বিবেকানন্দের আর্য ধারণা সম্পর্কিত বিচারের ভার ছেড়ে দিতে চেয়ে ভারমুক্ত হতে চেয়েছেন।
এখন এটা দেখার বিষয় হল আর্য ধারণা সম্পর্কে আধুনিক গবেষণালব্ধ জ্ঞানটি কি? জোন্স ও ম্যাক্স মুলারের প্রভাবিত বিবেকানন্দ আর্যকে জাতি হিসেবে দেখালেও জোন্স ‘আর্য’ শব্দটিকে জাতিবাচক হিসেবে ব্যবহার করেন নি। ম্যাক্স মূলার প্রথম দিকে আর্য ভাষার সাথে জাতি ধারণার যােগাযােগ ঘটালেও পরবর্তী সময়ে এ ধারণার বিরুদ্ধে আপত্তি উঠতে থাকে ফলে তিনি তার মত প্রবর্তন করেন। অর্থাৎ ভাষা এক হলেও জাতিও যে এক হবে এর কোন মানে নেই। ম্যাক্স মূ লারের আর্য ভাষা-জাতি সমীকরণের বিরুদ্ধ মত প্রবল হয়ে উঠলে, তিনি একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাঁর পুরানাে মত প্রত্যাহার করে নেন এবং বলেন যে, আমি আর্য অর্থে একটা মনুষ্যজাতিকে বুঝি , একটা ভাষাকেই বুঝি (ভৌমিক, সুহৃদকুমার কর্তৃক উদ্ধৃত ২০১০১৭)।
বিবেকানন্দের যাত্রা ছিল বিপরীত মুখী। জোন্স একটি আদি ভাষার কথা বলেছিলেন, তার বিভিন্ন শাখার মধ্যে সংস্কৃতকে অন্যতম হিসেবে দেখেছিলেন। ম্যাক্স মূলার আর্য ভাষা থেকে শুরু করে জাতি ধারণায় পৌছিয়ে ছিলেন। বিবেকানন্দের শুরু কিন্তু আর্যজাতি থেকে। তার থেকে তিনি আর্যভাষা বা সংস্কৃত ভাষায় পৌঁছান। এবং শেষে গভীর বিশ্বাসের সাথে আর্যজাতি ধারণার সাথে হিন্দুত্বকে মিশিয়ে দেন। ম্যাক্স মূলার পরবর্তীকালে যে নিজের মতের পরিবর্তন করেছিলেন, বিবেকানন্দ ভুলেও কিন্তু তা একবারও উচ্চারণ করেন নি। শঙ্করীবাবুর পরামর্শমত আধুনিক কালের গবেষকরা আর্য ধারণাকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তা যদি আলােচনা করা হয় তাহলে বিবেকানন্দের বক্তব্যটির মূল্য নিরুপন করা সম্ভব হবে।
[৬]
বর্তমান পর্বে দুটি বিষয় নিয়ে কথা হবে—
- ১. সিন্ধু সভ্যতা ও
- ২. আর্য সভ্যতা।
এখানে দেখার চেষ্টা করা হবে যে অনার্য সভ্যতা হিসেবে সিন্ধু সভ্যতার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যগুলি কি ছিল। ভারতীয় সভ্যতার গঠনে সেই উপাদানগুলি যে এখন প্রবলভাবে বর্তমান তারও একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ এখানে উত্থাপিত হবে। দ্বিতীয় অংশে আর্য ভাষা-ভাষী মানুষের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল, আর্য শব্দের অর্থগুলি কি কি এবং তারা বহিরাগত না ভারতীয়—ইত্যাদি প্রশ্ন নিয়ে আলােচনা করা হবে।
সিন্ধু সভ্যতা
উনিশ শতকের (এবং বিশ শতকের প্রথম দিকের) ‘আর্যামী’ উন্মাদনা বেশ কিছু পরিমাণে প্রশ্নের সামনে এসে পড়ে সিন্ধু সভ্যতার (বা হরপ্পা সভ্যতার) আবিস্কারের (১৯২২-২৩ খ্রিষ্টাব্দে) ফলে। বিবেকানন্দের জীবদ্দশাতে এ আবিষ্কার ঘটলে তাঁর মতটা কি দাঁড়াত তা খানিকটা আন্দাজ করা গেলেও যে সম্পর্কে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। কারণ সে মন্তব্য হয়ে পড়বে খানিকটা অন্ধকারের দিকে ঝাঁপ। বরং এটা দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে যে, সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার কোন কোন প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসলাে, কিভাবে ভারতের ইতিহাস চর্চার নতুন দিগন্ত। উন্মােচিত করলাে এবং ‘আৰ্যামী’ নামক উন্মাদনাকে বাধা দিল।
সিন্ধু সভ্যতা ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির সবচেয়ে বিস্তৃত ও ব্যাপক। ভারত, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের আধুনিক রাষ্ট্রগুলিতে অবস্থিত সিন্ধ, মাক্রান, বালুচিস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর রাজস্থান, কাথিয়াবাড়, কচ্ছ এবং বাদাখশানে সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার অসংখ্য এলাকা আবিস্কৃত হয়েছে। ১৯২২-২৩ খ্রিষ্টাব্দকে সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারের কাল বলে চিহ্নিত করা হলেও এই সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছিল এরও প্রায় একশ বছর আগে। ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ চার্লস ম্যাসন পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রাক্তন মন্ট গােমারি এবং বর্তমান সাহিওয়াল জেলার হরপ্পায় এর প্রথম নিদর্শন আবিষ্কার করেন। তিনি এই স্থানটিকে কোন দুর্গনগরীর ধ্বংসাবশেষ বলে মনে করেন। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে আলেকজান্ডার বার্নস স্থানটি পরিদর্শন করেন। তিনিও ম্যাসনের মতই মনে করেছিলেন এটা কোন দুর্গনগরীর ধ্বংসাবশেষ। কিন্তু দুজনের মধ্যে কেউই স্থানটির সুপ্রাচীনত্ব সম্পর্কে কোন ধারণা দিতে পারেননি। এখানে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য শুরু হয় ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে। নেতৃত্বে ছিলেন সে সময়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধিকর্তা স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম। কানিংহাম এই অঞ্চলে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয়বার খননকার্য চালান। উৎখননের মধ্য দিয়ে তিনি যে নিদর্শনগুলি পেয়েছিলেন তার উপর একটি বিবরণ তৈরী করেন, যা প্রকাশিত হয় ১৮৭২-৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রতিবেদনে।
এর ৫০ বছর পর ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় ও দয়ারাম সাহানী সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জদারাে ও হরপ্পা নামক প্রত্নস্থল দুটি আবিষ্কার করেন। তখন ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধিকর্তা ছিলেন স্যার জন মার্শাল। এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চলে ১৯২২ খি -ষ্টাব্দ থেকে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ অবধি। এর পরেও বহুস্থানে এই খননকার্য চলে এবং এই গবেষণার মধ্য দিয়ে আবিষ্কার হয় প্রাগার্য সিন্ধু সভ্যতার— যার ভৌগলিক বিস্তৃতি ছিল ৫০০০০০ বর্গমাইল (চক্রবর্তী, রণবীর। ২০০৭৪৯)। এই উৎখননের ধারাতেই আবিষ্কৃত হয়ে পড়ে ভারতবর্ষের প্রাচীনতম সভ্যতাটি— মেহেরগড় সভ্যতা।
মানবেতিহাস পর্যালােচনায় তিনটি প্রস্তরযুগের সন্ধান যাওয়া যায়— আদি, মধ্য ও নব্য প্রস্তর যুগ। নব্যপ্রস্তর যুগে কৃষির উন্মেষ ভারতীয় উপমহাদেশে এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করলাে। বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত মেহেরগড় প্রত্নস্থল এই নতুন পরিস্থিতির সাক্ষ বহন করে। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মেহেরগড় খননকার্যের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ফরাসী প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্রাঁসােয়া জারিজের নেতৃত্বে আর. আলাচিন, আর. মিডাে, এল. কনস্টানটিনি, এম. লেচূচিভেলিয়ার, জি.এল. পসীল প্রমূখ বিজ্ঞানীগণ মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কারে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেহেরগড় প্রাচীনতম পর্বের কাল নির্দিষ্ট হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ সময়সীমায়। এই পর্বে কৃষির বিকাশের পাশাপাশি পশুপালনও শুরু হতে দেখা যায়। পাথরের অস্ত্রের সন্ধানও মেলে, এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে উপমহাদেশের আদিমতম শস্যভান্ডার নির্মাণ এইসময়েই ঘটে। মেহের গড়ের দ্বিতীয় পর্বে (৫০০০ খ্রিঃপূঃ থেকে ৪০০০ খ্রিঃপূঃ) তলাবস্ত্র ও বীজ তৈল নিস্কাশনের মতাে ঘটনাটি ঘটে। আর্বিভাব ঘটে কাস্তের, অলঙ্কার শিল্পের এবং কুমােরের চাকের। মেহেরগড় সভ্যতার তৃতীয় পর্বে (৪৩০০ খ্রিঃপূঃ-৩৮০০ খ্রিঃপূঃ) কুমােরের চাকের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। এবং পাত্রগুলি ছিল চুল্লীতে পােড়ানাে। পাত্রের গায়ে অলংকার ও নক্সার বৃদ্ধি ঘটে। তামার ধাতুর ব্যবহার শুরু হয়। শুরু হয় নামমুদ্রা বা সীলমােহরের প্রচলন। এগুলি প্রশাসনিক ও ব্যবসা বানিজ্যের কাজেইমুখ্যত লাগে। অর্থাৎ এই পর্বে এসে সাদামাটা গ্রামীন কৃষি প্রধান জীবনের থেকেও জটিলতর সমাজব্যবস্থার আর্বিভাব ঘটেছিল। মেহেরগড়ের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে পাওয়া অসংখ্য কঙ্কালের দাঁতগুলির গভীর অধ্যয়নে দেখা গেছে যে, ভারতবর্ষের এই ‘আদি কৃষকদের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার মানুষদের চেয়ে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার, জনসমষ্টির বেশি সাদৃশ্য ছিল (হাবিব ২০০৮৫৮)। তৃতীয় পর্বে যে শিল্পের নিদর্শন মেলে সেগুলিতে অনার্য প্রভাবই লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে তাদের সমাধীগুলির নিদর্শন এখানে উল্লেখ্য (পূর্বোক্ত৬৪)। এটি ছিল প্রাক-হরপ্পাযুগের সমাজ-সংস্কৃতি (চক্রবর্তী, রণবীর,২০০৭ প্রথমখন্ড৪৫-৪৬)। হরপ্পা সভ্যতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল এই মেহেরগড় সভ্যতাই। অন্য ভাষায় মেহেরগড় সভ্যতার ধারাবাহিক বিকাশের ফলই ছিল হরপ্পা সভ্যতা।
হরপ্পা সভ্যতার সময়কালটি হল খ্রিঃপূঃ ৩০০০ থেকে ১৭০০ খ্রিঃপূঃ পর্যন্ত। সিন্ধু উপত্যকায় পাওয়া মানুষের কঙ্কাল ও করােটি পরীক্ষা করে চারটি ভিন্ন জনগােষ্ঠীর অস্তিত্ব অনুমান করা হয়। জনগােষ্ঠীগুলি হল প্রােটো-অস্ট্রালয়েড, মেডিটেরেনিয়ান, মােঙ্গোলয়েড ও আল্পো-দিনারিক। প্রােটো-অস্ট্রালয়েড বলতে সাধারণত কোল ও মুন্ডাদের বােঝায়। এরাই সংস্কৃত সাহিত্যের নিষাদ। দ্রাবিড়রাই মেডিটেরেনিয়ান। গােন্ড, কুই এবং ওঁরাওগণ এদের মধ্যে পড়েন। যাদের দেহগঠন চিনাদের মতাে তারাই মােঙ্গোলয়েড। আল্পো-দিনারিকগণও অনার্য। যে সকল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হরপ্পা ও মহেঞ্জদারাে সহ সিন্ধু সভ্যতার অন্যান্য স্থানে পাওয়া গেছে সেখান থেকেও এই সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, এই সভ্যতা ছিল একটি প্রাগার্য সভ্যতা (দ্রষ্টব্য রত্নাগর ২০০৩ হাবিব ২০০৪, সুর ১৯৯৫, কোশাম্বি ১৯৫৬,১৯৭২)।
অতুল সুরের (১৯৯৫) আলােচনা থেকে পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতা ছিল পুরােপুরি একটি প্রাগার্য সভ্যতা। শুধু তাই নয় তিনি এও মন্তব্য করেছেন যে, “হিন্দু সভ্যতার গঠনের মূলে বারাে আনা ভাগ হচ্ছে প্রাগার্য উপাদান, আর মাত্র চার আনা ভাগ আর্য সভ্যতার আবরণে মন্ডিত (সুর, ১৯৯৮১২)।
বস্তুত পক্ষে সিন্ধু সভ্যতার সাথে আর্য সভ্যতার কতকগুলি মৌলিক পার্থক্য রয়ে গেছে প্রথমত, সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা ছিলেন শিশ্ন-উপাসক ও মাতৃ-উপাসক। কিন্তু আর্যদের দেবতারা মূলত পুরুষ।
দ্বিতীয়ত, সিন্ধু সভ্যতায় ঘােড়ার কোন কঙ্কাল পাওয়া যায়নি। অন্য দিকে আর্যদের কাছে ঘােড়াই ছিল শ্রেষ্ঠ জন্তু।
তৃতীয়ত, সিন্ধুবাসীরা ছিলেন নগরবাসী। আর্যরা নগর নির্মাণ করতে জানতেন না। বরং তারা নগর ধ্বংস করতেন। সেই কারণেই ইন্দ্রকে ‘পুরন্দর’ (নগর/বাঁধ ধ্বংসকারী) হিসেবে অভিহিত করা হত।
চতুর্থত, সিন্ধু সভ্যতায় মৃতদের সমাধীস্থ করা হত। কিন্তু আর্যরা মৃত ব্যক্তিকে দাহ করতেন।
পঞ্চমত, সিন্ধুবাসীরা ভাষার লিখিতরূপ ছিল। কিন্তু আর্যদের তা ছিল না। তাই ওরা বেদকে মুখস্থ করতাে। বেদকে বলা হত ‘স্মৃতি’ ও ‘শ্রুতি।।
ষষ্ঠত, সিন্ধুসভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক। কিন্তু আর্যরা ছিলেন যাযাবর পশুপালক। সপ্তমত, নৃতাত্ত্বিক দিক থেকেও উভয়ের মধ্যে প্রচুর পার্থক্য ছিল।
অতুল সুরের (১৯৯৫)-র মতে,
“সিন্ধুসভ্যতার লােকেরা এক উন্নত বৈষয়িক সভ্যতার ধারক ছিল। অপরপক্ষে আর্যরা ছিল বর্বরজাতি” (১৯৯৫৮৫)।
আর্যপ্রশ্ন
এবারে আসা যাক আর্য প্রশ্ন নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণার ফলগুলি সম্পর্কে। বিবেকানন্দের শ্রদ্ধেয় ভাষাবিদ ম্যাক্স মূলার এবং উনিশ শতকের রমেশ দত্ত আর্যদের বহিরাগত হিসাবেই চিহ্নিত করেছিলেন। গােটা বিশ শতক জুড়ে আর্য সংক্রান্ত গবেষণার মধ্যে দিয়ে যা বেরিয়ে এসেছে, তা বিবেকানন্দের মতের পক্ষে স্বস্তিদায়ক নয়। শুধু তাই নয় বিশেষজ্ঞদের মতামত বৈদিক আর্যগরিমার ধারণাটিকে প্রায় পুরােপুরিই বাতিল করে দেয়। সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার যেমন দেখায় ভারতে বৈদিক আর্য সভ্যতার থেকেও বহু প্রাচীন মেহেরগড় ও হরপ্পা সভ্যতা এদেশে ছিল, তেমনি আর্য সংক্রান্ত গবেষণা দেখায় যে ভারতবর্ষ কখনই বিবেকানন্দ কথিত ‘আর্যময়’ নয়। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রােমিলা থাপারের পর্যবেক্ষণটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ,
“ভারতে যদি কোন সময় বিশুদ্ধ আর্য জাতি থেকেও থাকে, তা হলে তাদের ‘বিশুদ্ধতা। বেশিদিন টিকিয়ে রাখার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। এমন কোন জাতি যে বর্তমান যুগ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে, একথা আদৌ গ্রহণযােগ্য নয়। বিজ্ঞানসম্মত জীববিদ্যা আজ আর একথা স্বীকার। করে না যে, কোন ‘বিশুদ্ধ’ জাতি অপরিবর্তিতভাবে টিকে থাকতে পারে—ইতিহাসে বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রনের ফলে জাতিগত ‘বিশুদ্ধতা’ক্রমেই হ্রাস পায়” (১৯৮৫২৯)।
ফলে বিবেকানন্দ যখন বলেন,
“আকাশচুম্বী হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে বিস্তীর্ণ সমতলভূমিতে আর্যগণ আসিয়া বসবাস করেন। এখনও পর্যন্ত ভারতে তাঁহাদের বংশধর খাঁটি ব্রাহ্মণ জাতি বিদ্যমান” (২০১২১০২৯)।
সেই ধারণা অর্থহীন ধারণায় পরিণত হয়। বস্তুতপক্ষে এই ধরণের আজগুবি ধারণা উনিশ শতকের প্রধান চিন্তাবিদদের রচনাতেও পাওয়া যায়। বিশেষ করে এই খ উঁটি আর্যতত্ত্ব ও ব্রাহ্মণতত্ত্বের ধারণাটি।।
‘আর্য’ শব্দটির অর্থ
‘আর্য’ শব্দটি অধিকাংশ ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষায় না পাওয়া গেলেও কয়েকটিতে যাওয়া যায়। দুটি প্রাচীন গ্রন্থ ঋগ্বেদ’ ও ‘আবেস্তা’-তে “আর্য’ শব্দটির ব্যবহার আছে। আর্য’ শব্দকেন্দ্রিক সব যুক্তিতর্ক বিচার করে ও. জেমেরেনি সিদ্ধান্ত করেছেন যে, এই শব্দটি ইন্দো-ইউরােপীয় নয়, নিকট প্রাচ্যের, সম্ভবত উগরির মত ভাষা থেকে গৃহীত শব্দ, যার অর্থ হল ‘আত্মীয়’ অথবা ‘সঙ্গী। হিট্টাইট ভাষায়ও ‘আর্য’ শব্দটির অর্থ ‘আত্মীয়’ বা ‘বন্ধু’। আবার ‘ইরান’শব্দটি ‘আর্য’ শব্দের সঙ্গে সম্পর্কিত (শর্মা, রামশরণ ১৯৯৭১০)। অধ্যাপক শর্মার মনে হয়েছে, ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষায় ‘আর্য’ শব্দটির অর্থ ‘প্রভু’ বা ‘অভিজাত শ্রেণীর ব্যক্তি হলেও, সব ক্ষেত্রেই ‘আর্য’ শব্দটি এই অর্থ বহন করতাে না। ফিনিক্সিয় ভাষায় ‘ওরজ’ শব্দটির অর্থ ‘দাস’। [ফিনল্যান্ডবাসী তাদের প্রতিবেশী ইন্দো-ইউরােপীয় বা আর্যদের পদানত করেছিল, তখন তারা নিজেদের ভাষায় ‘ওরজ’ শব্দটি দাসকে বােঝানাের জন্য ব্যবহার করতাে (শর্মা, রামশরণ, ১৯৯৭১০)।] এই ‘ওরজ’ শব্দটির উৎপন্ন হয়েছে ‘আর্য’ শব্দ থেকে (পূর্বোক্ত)।
ঋগ্বেদে ইন্দ্ৰ উপাসকদের আর্য বলা হত। যখন এই গ্রন্থে একদিকে আর্য আর অন্যদিকে দাস ও দস্যুদের মধ্যে যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে, তখন প্রথমােক্তদের স্বদেশী ও দ্বিতীয়কে বিদেশী বিবেচনা করা হয় নি। এই যুদ্ধ হয়েছে দুটি সংস্কৃতির মধ্যে ব্রতপালনকারী ও ব্রত পালনকারী নয় (অব্রত বা অন্যব্রত) এমন মানব গােষ্ঠীদের মধ্যে। সে সময়ে ভারতকে একদেশ বা জাতির দৃষ্টিতে দেখা হয় নি (শর্মা, ১৯৯৭১০)।
গায়ের রঙের (বর্ণের) ভিত্তিতে ঋগ্বেদে কতকগুলি সূক্তে আর্যদের একটি স্বতন্ত্র গােষ্ঠীরূপে দেখানাে হয়েছে। আর্যদের শত্রুদের কালাে (কৃষ্ণবর্ণ) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আর্যদের বলা হয়েছে মানুষী প্রজা, যারা অগ্নি-বৈশ্বানরের পূজা করত এবং কখনও কখনও কৃষ্ণবর্ণ মানুষদের গৃহে গৃহে আগুন জ্বালিয়ে দিত। কথিত আছে, আর্যদেবতা সােম কৃষ্ণবর্ণ লােকেদের হত্যা করতেন। এও বলা হয়েছে, তিনি কৃষ্ণবর্ণ রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন এবং ৫০,০০০ ‘কৃষ্ণ’ (বর্ণ) কে নিহত করেছিলেন। বিশ্বাস করা হয়, তিনি অসুরের কৃষ্ণচর্ম অপসারিত করেছিলেন। ঋগ্বেদে ‘আর্য’ শব্দের সব উল্লেখ জাতি বা বর্ণ অর্থে গ্রহণ করা যায় না। মূল ‘অর’ থেকে নিম্পন্ন এই শব্দটির অর্থ হল ‘পাওয়া। আবেস্তায় ‘আর্য’ শব্দের অর্থ প্রভু অথবা অভিজাতকুলের ব্যক্তি, এবং এই অর্থে ঋগ্বেদের কতকগুলি উল্লেখের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য (শর্মা ১৯৯৭১১)।
ঋগ্বেদে জাতিগত দিক থেকে কয়েকটি মিশ্র গােষ্ঠী দেখা যায়। দশজন রাজা বা বিশপতি বিখ্যাত ‘দশ রাজার যুদ্ধে’ অংশ নিয়েছিলেন। নামের তালিকা থেকে জানা যায়, প্রত্যেকে যুযুধান পক্ষে আর্য ও অনার্য, উভয়ই ছিল। পরে, যাঁরা সম্মানিত ও উচ্চপর্যায়ভূক্ত অথবা অভিজাত কুলােদ্ভূত, তাঁরা আর্য নামে পরিচিত হন। পরবর্তী বৈদিক ও বৈদিকোত্তর কালে ‘আর্য’ শব্দটির দ্বারা উচ্চতর তিনবর্ণকে বােঝাত, যাঁদের ‘দ্বিজ’ নামেও অভিহিত করা হয়। শূদ্রদের কখনই আর্যদের পর্যায়ভূক্ত করা হয়নি। আর্যদের স্বাধীন বলে মনে করা হত। অপরদিকে, শূদ্ররা স্বাধীন ছিল না (শর্মা ১৯৯৭১১)।
আর্য → আর্যত্বম বা আর্যভাব
↓
শূদ্র
↓
দাস
আর্যপ্রাণ শূদ্রকে দাস পর্যায়ে অধঃপতিত করা যেত না—
আর্যত্বম— এক নাগরিক স্বাধীনতাকে বােঝাত। যে শূদ্রদের পিতা-মাতা আর্য তাঁরা স্বাধীন বলে গণ্য হতেন। গুপ্তযুগ পর্যন্ত তাঁদের সংখ্যা বেশি ছিল না, পাবর্তীকালে তাঁরা সংখ্যাধিক্যতা বেঅর্জন করলে, ব্রাহ্মণসহ উচ্চতর শ্রেণী তাদের অনার্য বিবেচনা কর।
‘আর্য’ শব্দটি তাই কখনই জাতিবাচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। এটা একটা ভাষাবাচক শব্দ মাত্র। ঐতিহাসিক ডি.ডি. কোশাম্বীও এই মতই প্রকাশ করে বলেছেন যে, ‘আর্য’ শব্দটিকে ‘জাতি’ অর্থে ব্যবহার করলে তা হাস্যকর হয়ে দাঁড়াবে। প্রকৃতপক্ষে তারা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতাে এবং নিজেদের ‘আর্য’ বলে অভিহিত করতাে। এখানে নৃতত্ত্বগত সাদৃশ্য ছিল না। অতুল সুরের পর্যবেক্ষণটিও সদৃশ,
“আর্য ভাষাভাষী জাতিগণের মধ্যে কোনরূপ নৃতাত্ত্বিক ও আবয়বিক সাদৃশ্য ছিল না” (সুর, ১৯৯৮১০)।
আর্যদের ভারতে আগমন
হিন্দুত্ববাদীদের বাদ দিলে বর্তমানে প্রায় সকল ঐতিহাসিকগণই একথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে আর্যরা বহিরাগত। অতুল সুর সুস্পষ্টভাবেই আর্যদের বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কোশাম্বীর মতটিও অনুরূপ (Kosambi, ১৯৭২৭৬)। পার্সিভাল স্পীয়ারও আর্যদের বহিরাগত ও আক্রমণকারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এদের একটি শাখা ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে ১৫০০ খ্রিঃপূঃ প্রবেশ করে (Spear 1961:31)। রুশ ঐতিহাসিকগণ দেখিয়েছেন, আর্যদের আদি বাসভূ মি ছিল মধ্য এশিয়ায় বা দক্ষিণ রাশিয়ার স্তেপভূমিতে (আন্তোন, বােনগার্দ-লেভিন কতােভস্কি ১৯৮৬৪১)। আরও অনেকে এই ধারাতেই মত প্রকাশ করে কয়েকটি যুক্তি উত্থাপন করেছেন—
- ১. আর্যদের আদি বাসভূমি ভারতবর্ষ- এই মতের সপক্ষে কোন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় না। বরং এরই বিপরীতে আর্যদের ভারতে আগমনের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। রামশরণ শর্মা (২০০৩) এই প্রত্নস্থলগুলিকে নির্দেশ করেছেন। তিনি বলেছেন,
- “উপমহাদেশে আর্যদের আগমনের পর্যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে উত্তর বালুচিস্তানে ঝােব নদীর পারে পেরিয়ানাে ঘুন্ডাই, বােলান গিরিপথের কাছেপিরাক, গােমস উপত্যকায় গােমাল গিরিপথের কাছে গুমলা এবং অন্যান্য কবরস্থান এবং সােয়াত উপত্যকায় গান্ধার কবরক্ষেত্র” (২০০৩৪১)।
- ২. আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়ে বিবেকানন্দের বক্তব্য ছিল আর্যদের সভ্যতা আড়াই হাজার বছর পূর্বেকার (২০১২৪১৮৯)। এবং আর্যদের প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদ সমপরিমাণ প্রাচীন। যদিও অন্যত্র তিনি তাকে আরও প্রাচীন বলতে চেয়েছেন। কিন্তু কোথাও আবার বেদকে সৃষ্টির সন-তারিখ নিনতি হতে পারে বলে তিনি মনেই করেন না। তাঁর মতে বেদ অনাদি-অনন্ত (বিবেকানন্দ ২০১২৫১১)। আধুনিক ঐতিহাসিকরা কিন্তু বেদের যে কাল নির্ণয় করেছেন তা বিবেকানন্দের থেকে ভিন্ন। তাদের মতে, ঋগ্বেদ খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১০০০-এর মধ্যে রচিত (হাবিব ও ঠাকুর ২০০৬২)।
- ৩. ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠীর ভৌগলিক অবস্থান ভারতবর্ষ যে আর্যদের আদিবাসস্থান তার বিপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। বিবেকানন্দের কাছে এসব সাক্ষ্য-টাক্ষ্য সব ‘আহাম্মকের কথা’ (২০১২ঙ্ ৬১৬৩)।
- ৪. আর্যদের ঘােড়ার ও লােহার ব্যবহার সিন্ধুবাসীদের জানা ছিল না। ঘােড়া, লােহার অস্ত্র এবং রথ প্রাগার্য সভ্যতাকে ধ্বংস করতে সাহায্য করেছিল।
- ৫. বিবেকানন্দের মতে, আর্যরা ভারতের বাইরে থেকে কেবল আসেনি, তারা এদেশীয় বুনােদের মেরে কেটে জমি ছিনিয়ে নিয়ে বাস করতে শুরু করে এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা (২০১২৬ ১৬৩)। বেদেও এমন ধরনের কথা কোথাও নেই যে আর্যরা বুনােদের মেরে কেটে ধ্বংস করেছে। (পূর্বোক্ত ১৬৪)। এর বিপরীতে অতুল সুর বেদ থেকে উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে, আর্যরা ছিল যােদ্ধার জাত। সিন্ধু সভ্যতার বণিকদের ঐশ্বর্য ও ধনদৌলত তাদের ঈর্ষান্বিত করেছিল। তাই তারা সিন্ধু সভ্যতাকে ধ্বংস করতে উদ্যোগী হয়েছিল। নগর ধ্বংসকারী ইন্দ্রকে তাই বেদে পুরন্দর বলা হয়েছে (সুর ১৯৯৫৮৯-৯০ এবং ১৯৯৮১৬)। অর্থাৎ বিবেকানন্দ কথিত ‘আর্যেরা অতি দয়াল ছিলেন’ (২০১২৬১৬৪)। তা বােধহয় খুব একটা সত্য নয়।
[৭]
বিবেকানন্দ ছিলেন উনিশ শতকীয় বাঙালী সমাজে গড়ে ওঠা ভ্রান্ত আর্যভাবনা তথা হিন্দুভাবনার এক সার্থক প্রতিনিধি। তাৎক্ষণিকতা দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ফলে যখন যেমন তথ্য পেয়েছেন তখন সেরকমই সিদ্ধান্ত করেছেন। ফলে তার ভাবনাচিন্তাটি হয়ে পড়েছে স্ববিরােধিতার এক অনন্য উদাহরণ। কিন্তু এক গোঁ থেকে তিনি কখনই সরে আসেননি তা হল “ভারত আর্যময়, এখানে আর কোন জাতি নেই” আধুনিক কালে গবেষণা কিন্তু প্রমাণ করেছে এইরকম অবিমিশ্র জাতি সম্ভব নয়। তাঁর ভাবনার দ্বিতীয় সমস্যা হল তিনি ভাষা ও জাতিকে সমার্থক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ভারতের বহু বিচিত্র ও বহুধাবিভক্ত সমাজকে একটি ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তাই তার কাছে জাতি সমস্যার সমাধান ছিল আর্যজাতির ধারণা। তা যে নিদারুণভাবে বর্ণব্যবস্থা ও বৈষম্যমূলক সমাজের সংরক্ষণেই কাজ করে তা কি তিনি বুঝেছিলেন?
গ্রন্থপঞ্জীঃ
- ১. আন্তোনেভা, কো., বােপ্পাদ-লেভিন, গ্রি., কতােভস্কি, গ্রি. ১৯৮৬। ভারতবর্ষের ইতিহাস। মস্কোপ্রগতি প্রকাশন।
- ২. আয়ার, কে, সুন্দররম। ২০১২। স্মৃতির আলােয় বিবেকানন্দ। স্বামীজীর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের গুণগাহিগণ। ২০১২। স্মৃতির আলােয় বিবেকানন্দ। ভাষান্তর স্বরাজ মজুমদার ও মিতা মজুমদার। কলকাতা উদ্বোধন কার্যালয়।
- ৩. গঙ্গোপাধ্যায়, দিলীপকুমার। ২০০০। ভারত ইতিহাসের সন্ধান। কলকাতাসাহিত্যলােক। চক্রবর্তী, রণবীর। ২০০৭। ভারত-ইতিহাসের আদিপর্ব। প্রথম খন্ড। কলকাতাওরিয়েন্টাল লংম্যান। চট্টোপাধ্যায়, শ্রী সুনীতিকুমার। ২০০৪। সাংস্কৃতিকী। খন্ড। কলকাতাআনন্দ।
- ৪. জোন্স, উইলিয়াম। ২০১১। এশিয়ামানব ও প্রকৃতি। অনুবাদ- অমিতা চক্রবর্তী। কলকাতাদি এশিয়াটিক সােসাইটি।
- ৫. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ। ১৪০২ বাংলা। রবীন্দ্র রচনাবলী। খন্ড ২, ৬, কলিকাতাবিশ্বভারতী। প্রবন্ধস্বদেশী সমাজ।
- থাপার, রােমিলা। ১৯৮৫। পূর্বকাল ও পূর্বধারণা। অনুবাদ—ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়। নয়াদিল্লি ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া।
- ৬. থাপার, রােমিলা, কোনােয়ার, দেশপান্ডে, রত্নাগর। ২০১১। ভারতবর্ষঐতিহাসিক সুচনা ও আর্যধারনা। অনুবাদ— আবীরা বসু চক্রবর্তী। নয়াদিল্লিন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট ইন্ডিয়া।
- ৭. দত্ত, রমেশচন্দ্র। ২০০১। প্রাচীন ভারতবর্ষের সভ্যতার ইতিহাস। কলকাতাদীপায়ন। | দেশপান্ডে। ২০১১। হাবিব, ইরফান। ২০০৪। সিন্ধুসভ্যতা। ভাষান্তর- কাবেরী বসু।। কলকাতাএন.বি.এ. প্রাঃলিঃ।
- ৮. বসু, শঙ্করীপ্রসাদ। ২০০৯। বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ। পঞ্চমখন্ড। কলকাতামন্ডল বুক হাউস।
- ৯. বিবেকানন্দ, স্বামী। ১৯৭৭। পত্রাবলী। কলিকাতাউদ্বোধন। বিবেকানন্দ, স্বামী। ২০১২। বাণী ও রচনা। কলকাতাউদ্বোধন। দশখন্ডে সম্পূর্ণ। ভৌমিক, সুহৃদকুমার। ২০১০। আর্যরহস্য। কলকাতামনফকিরা। রত্নাগর, শিরিন। ২০০৩। হরপ্পা সভ্যতার সন্ধানে। ভাষান্তর- কাবেরী বসু। কলকাতাঙ্গ এন.বি.এ. প্রাঃলিঃ।।
- ১০. শর্মা, রামশরণ। ১৯৯৭। আর্যদের অনুসন্ধান। অনুবাদ- ভাস্কর চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা প্রগে এসিভ পাবলিসার্স।
- ১১. শর্মা, রামশরণ। ২০০৩। আর্যদের ভারতে আগমন। অনুবাদ-গৌতম নিয়ােগী। কলকাতা ওরিয়েন্টাল লংম্যান।
- ১২. সুর, ড. অতুল। ১৯৯৫। সিন্ধুসভ্যতার স্বরূপ ও সমস্যা। কলিকাতাউজ্জ্বল সাহিত্য মন্দির। সুর, ড. অতুল। ১৯৯৮। হিন্দু সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য। কলকাতাসাহিত্যলােক।
- ১২. সেন, সুকোমল। ২০০০। ভারতের সভ্যতা ও সমাজবিকাশে ধর্ম শ্রেণী ও জাতিভেদ।। কলকাতান্যাশানাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড।
- ১৪. হাবিব, ইরফান; ঠাকুর, বিজয় কুমার। ২০০৬। বৈদিক সভ্যতা। ভাষান্তর- কাবেরী বসু। কলকাতাএন.বি.এ. প্রাঃলিঃ।
- ১৫. হাবিব, ইরফান। ২০০৮। প্রাক-ইতিহাস। ভাষান্তর- কাবেরী বসু। কলকাতাএন.বি.এ.প্রাঃলিঃ।
- ১৬. The Complete Works of Swami Vivekananda. 2008. Vol- IX. Kolkata : Advaita Ashrama.
- ১৭. Burke, Marie Louise. 2006. Vol-2. Swami Vivekananda in the west : New Discoveries- His Prophetic Misssion, Part two. Kolkata : Advaita Ashrama.
- ১৮. Kosambi, D.D. 1956. An Introduction to the study of Indian History. Bombay : Popular Book Depot.
- ১৯. Kosambi, D.D. 1972. The Culture and Civilisation of Ancient India. New Delhi : Vikas Publishing House Pvt. Ltd. | Muller, Max. 1862, 1883, 1888. রােমিলা থাপার (২০১১) কর্তৃক ব্যবহৃত ও উদ্ধৃত।
- ২০. Spear, Persial. 1961. India- A Modern History. The University of Michigan Press, USA.
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।