দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটক ও জাতীয়তার প্রসঙ্গঃ বঙ্গীয় রেনেসাঁর অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র যে কাজটি সম্পাদনা করেছেন তা নিশ্চিতভাবেই ‘নব হিন্দুবাদ’ বা হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদ সৃষ্টি এবং সেই সঙ্গে ভারতবর্ষে ইংরেজ প্রভূত্ব সুদৃঢ় করা। তিনি নিজে ইংরেজ সরকারের একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। সেই সুবাদে পরম নিষ্ঠাভরে ইংরেজ প্রভুর সেবা ও জয়গানে তিনি তাঁর সাহিত্য সমৃদ্ধশালী করেন। সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার জন্য ইংরেজবিরােধী যাবতীয় সংগ্রামের এমনকি এই সংগ্রামভিত্তিক নাটক ও সাহিত্য রচনার কঠোর সমালােচনা তিনি করেছিলেন। দীনবন্ধু মিত্র রচিত নীলকর সাহেবদের অমানুষিক নির্যাতন সম্পকিত বিখ্যাত ‘নীল দর্পণ’ নাটকের সমালােচনায় তিনি লিখেছেন,
“নীল দর্পণকার প্রভৃতি যাঁহারা সামাজিক কুপ্রথার সংশােধনাৰ্থে নাটক প্রণয়ন করেন আমাদিগের বিবেচনায় তাঁহারা নাটকের অবমাননা করেন। নাটকের উদ্দেশ্য গুরুতর—যে সকল নাটক এইরূপ উদ্দেশ্যে প্রণীত হয় সে সকলকে আমরা নাটক বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না। কাব্যের উদ্দেশ্য সৌন্দর্য সৃষ্টি—সমাজ সংস্কার নহে। মুখ্য উদ্দেশ্য পরিত্যক্ত হইয়া সমাজ সংস্কারাভিপ্রায়ে নাটক প্রণীত হইলে নাটকের নাটকত্ব থাকে না।”১
বস্তুত, এই নাটকের দ্বারা কৃষক বিদ্রোহের বিস্তার লাভের আশঙ্কা বঙ্কিমচন্দ্রকে ভীত করেছিল। তাই এজলাসের বিচারকের মতাে সাহিত্যকর্মেও বিচারকের ‘মহান’ ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বঙ্কিম-যুগে প্রগতিশীল সাহিত্যিক ও নাট্যকার মীর মশাররফ হােসেন রচিত সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহের ঘটনাভিত্তিক বিখ্যাত নাটক ‘জমিদার দর্পণ’-কে বঙ্কিমচন্দ্র শুধু সমালােচনাই করেননি, উপরন্তু এর বিক্রয় ও প্রচার বন্ধেরও ‘সদুপদেশ’ দিয়েছিলেন এইভাবে—
“বঙ্গদর্শনের জন্মাবধি এই পত্র প্রজার হিতৈষী এবং প্রজার হিতকামনা আমরা কখনাে ত্যাগ করিব না। কিন্তু আমরা পাবনা জেলার প্রজাদিগের আচরণ শুনিয়া বিরক্ত ও বিষাদযুক্ত হইয়াছি। জ্বলন্ত অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়া নিষ্প্রয়ােজন। আমরা পরামর্শ দিই যে, এ সময়ে এ গ্রন্থের বিক্রয় ও বিতরণ বন্ধ করা হউক।”
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর নিজস্ব প্রবণতার কারণে ইংরেজ নির্মিত চশমা দিয়েই মুসলমানদের দেখেছিলেন। ফলে অবধারিতভাবেই তাঁর রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ উঠে এসেছে। তার একনিষ্ঠ ও প্রবল স্বধর্মানুরাগ ইংরেজ রচিত বিদ্বেষপূর্ণ ইতিহাসকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুসলমান আমলে নিশ্ৰুপ থাকা হিন্দু জাতিকে ইংরেজ আমলে জাগিয়ে তােলার জন্য তিনি তাদের মধ্যে খণ্ডিত জাতীয়তার বীজ উপ্ত করতে চেয়েছেন। এজন্য তিনি প্রথমাবধি তাঁর উপন্যাসে বৃহত্তর মুসলিম সম্প্রদায়কে ঘৃণিত প্রতিপক্ষ জ্ঞান করে তাদের যবন-ম্লেচ্ছ-নেড়ে প্রভৃতি অবমাননাকর শব্দ দ্বারা সম্বােধন করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের এই বিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গীর সরাসরি প্রকাশ আছে তার আনন্দমঠ উপন্যাসে। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মূল উদ্দেশ্যকে বঙ্কিমচন্দ্র বিকৃত করে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িকভাবে উপস্থাপন করেছেন তাঁর এই উপন্যাসে। এখানে সাম্প্রদায়িকতার যে পরিচয় আছে তাকে কোনাে কোনাে সমালােচক ‘গৌণ’ বলে এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু এই মুসলিম বিদ্বেষ ও তীব্র স্বাজাত্য প্রেম যে সর্বভারতীয় ঐক্যের পথে কত বড় হুমকি সেদিন অনেকের চোখেই তা ধরা পড়েছিল। আনন্দমঠ উপন্যাসটি ‘দ্যা অ্যাবে অফ বিলিস’ নামে অনুবাদ করেন নরেশ সেনগুপ্ত। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলিমবিদ্বেষী মনােভাবের সমালােচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে,
“The anti Mohammedan spirit of the novel and Bankim’s use of Hindu religious symbolism…would hinder the growth of a true Indian nationality by preventing the participation of Mohammedans and other religious communities.”২
উল্লেখ্য যে, বঙ্কিমচন্দ্র ও অন্যান্য বর্ণহিন্দু সাহিত্যিক, কবিদের অনুসরণে বাঙালি মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের একটি অংশেও সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু তাদের সংখ্যা ছিল নগণ্য ও কলমের জোরও ছিল তুলনামুলকভাবে দুর্বল। তাই দেখা যায়, বৃটিশ বঙ্গদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজাকুল তথা মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজে হিন্দু সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। সাহিত্য-ক্ষেত্রে বিদ্বেষ সৃষ্টির প্রথম দৃষ্টান্ত সম্ভবত উইলিয়াম কেরীর একটি গল্প। মৃত্যুঞ্জয়-রাজীবলােচন-রামরামের সময়ে ১৮১২ সালে উইলিয়াম কেরী ইংরেজ সিভিলিয়ানদের জন্য রচনা করেন পাঠ্যপুস্তক ‘ইতিহাসমালা’। কেরীর বইটির নামপত্রে বলা হয়েছে যে এটি হচ্ছে ‘এ কালেকশান অফ স্টোরিজ ইন দ্যা বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ কালেক্টেড ফ্রম ভেরিয়াস সাের্সের্স’। এতে মােট দেড়শটি গল্প আছে। গল্পগুলি অনেকটা বাইবেলের গল্পচ্ছলে নীতিকথা বলার ভঙ্গিতে লিখিত। অনেক সময় আবার ঈশপের গল্পের মতাে শেষে পাঠককে উপদেশও দেওয়া হয়েছে।
গল্পটির নামপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী বলা যায় যে, সম্ভবত কাহিনিগুলাে বিভিন্ন জনশ্রুতি অথবা প্রচলিত বানানাে গল্প মাত্র। ইতিহাসমালার মােট দেড়শটি গল্পের মধ্যে ১৪৭ নম্বর গল্পটির প্রকৃতি একটু ভিন্নরকম। ইতিহাসখ্যাত সম্রাট আকবর এবং তার বিদূষক বীরবর বা বীরবলকে নিয়ে রচিত এই গল্পটির তাৎপর্য বিশেষ কৌতুহলপ্রদ এই জন্য যে, ইংরেজ মিশনারীরা এই গল্পের মধ্য দিয়ে সেকালের দুটি বিশিষ্ট ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে সরাসরি বিদ্বেষ বিষ উপ্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন। গল্পটির উৎস সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না, গবেষকদের অনুমান এটি কেরীর নিজস্ব নির্মাণ।৩ এ গল্প যখন রচিত হয় তখন হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক এত তিক্ত হয়ে ওঠেনি যে কেউ কারাে ধর্মমত নিয়ে প্রকাশ্যে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করবে। সুতরাং এ কাজটি ইংরেজদের দ্বারা সূচিত ও লালিত হতে পারে। এই বিশ্বাসের যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় শাসক ইংরেজের পরবর্তী কর্মকাণ্ডের মধ্যে। উনিশ শতকের প্রারম্ভ থেকেই এই দুটি ধর্ম সম্প্রদায়ের সহমর্মিতা ও সহনশীল সহাবস্থানের মানসিকতায় ফাটল ধরানাের চেষ্টা শুরু হয়। কেরীর এই গল্পটিকে যদি সাম্প্রদায়িকতা প্রচারের প্রথম ইঙ্গিতবাহী সাহিত্য প্রয়াস বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে বলতে হয় যে, কেরী এ কাজ সচেতনভাবে না করলেও এর মধ্য দিয়ে মুসলমানদের সম্পর্কে ইংরেজ জাতির ভীতি ও সন্দেহ নিজের অজান্তেই প্রকাশিত। পরবর্তীকালে ইংরেজতােষণ নীতির প্রতি বিশ্বাসী কয়েকজন খ্যাতিমান সাহিত্যিক এই মুসলিমবিদ্বেষ প্রচারের কাজে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।
লক্ষ্য করার বিষয়, উনিশ শতকের লেখকদের প্রায় সবাই বিষয়বস্তুর জন্য দ্বারস্থ হয়েছেন ইতিহাসের। তখন কন্টার, স্টুয়ার্ট, টড প্রমুখের ইতিহাস গ্রন্থ বাঙালি লেখক-পাঠক সমাজে বিশেষ জনপ্রিয়। প্রকৃতপথে এইসব ইতিহাস গ্রন্থে ইতিহাসের চেয়েও বেশি ছিল লেখকদের ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ। বাঙালি লেখকবৃন্দ তাদের ব্যক্তিগত মানস-প্রবণতার অনুসরণেই কেউ গ্রহণ করেছেন কন্টার আর কেউ বা টড। যেমন ভূদেব মুখােপাধ্যায় হিন্দু কলেজের ছাত্র থাকাকালে এক ইংরেজ শিক্ষকের হিন্দুদের স্বদেশানুরাগ নেই এমন উক্তিতে যারপরনাই ব্যথিত হন। এখানেই নিহিত ছিল তার স্বদেশানুরাগের ভিত্তি যার প্রেরণা এই লেখকের পরবর্তীকালের সাহিত্যচর্চায় প্রভাব ফেলে।৪ এজন্যই তিনি কন্টারের ‘দি মারহাট্টা চিফ’ গ্রন্থের শিবাজী চরিত্রের একনিষ্ঠ স্বদেশানুরাগের প্রাবল্য দ্বারা আকৃষ্ট হন এবং তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসের বিষয় হিসেবে বেছে নেন কন্টারের ইতিহাস গ্রন্থ।
অনুরূপভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের মানস অভিরুচি তাকে টডের ইতিহাস গ্রন্থ অনুসরণের প্রেরণা দিয়েছে। টডের গ্রন্থে আছে রাজপুত জাতির বীরত্ব গাথা।৫ রাজপুত জাতি শুধুমাত্র হিন্দুধর্মাবলম্বী বলেই অন্যান্য স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও তার কাছে আদৃত। বঙ্কিমচন্দ্রের তীব্র, স্বজাতি প্রেমই হিন্দুদের মহিমা কীর্তনের অনুষঙ্গে মুসলমানদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। তিনি জাতীয়তার পরে বাঙ্গালিত্বের চেয়েও হিন্দুত্বের ধারণাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন অধিক।
“When the creative writers of the country who were Hindus were on the looked for the past glories of the nation they insinetively turned to Rajput Maharatta and Sikh history in which examples of Hindu chivalry and heroism were to be found in abundance… There they learned how Hindus and Muhammadans fought for political supremacy nand retold the stories through their creative imagination.”৬
সাহিত্যে হিন্দু সমাজকে সর্বকালের আদর্শ হিসেবে তুলে ধরে এবং মুসলমানদের অপমানের চূড়ান্ত করে বঙ্কিমচন্দ্র সেকালে উদারনৈতিক সর্বভারতীয় চেতনা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এক বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন। ইংরেজ শাসকের ‘ডিভাইড অ্যাণ্ড রুল’ নীতির সমর্থন তাঁর রচনায় প্রকটভাবেই প্রতিফলিত হয়, যা সমকালের মুসলিম সমাজকে বিব্ধ করে তুলে।
এ বি এম হাবিবুল্লাহ বাংলার হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সাংস্কৃতিক বৈষম্য এবং তার ফলে ইতিহাসের আবহে ‘স্বতন্ত্র ধারা’ সৃষ্টির জন্য হিন্দু লেখকদের ইতিহাস চর্চার বিশেষ প্রবণতাকে দায়ী করেছেন। এ-প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক ‘মিল্লাত’-এর ঈদ সংখ্যায় (১৯৪৮) প্রকাশিত তাঁর ‘বাঙালী মুসলমানের সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রবন্ধে তিনি লেখেন,
“..বাঙলার ইতিহাসে মুসলমানী আমলকে দেশীয় সাংস্কৃতিক বিবর্তনের এক অধ্যায় মনে না করে, প্রভাবলেশহীন বহিরাগত প্রসঙ্গ বলে যাঁরা মনে করেন, হিন্দুর মধ্যে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, এবং এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আরব ইতিহাসে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াতে’র মতন, প্রাক-মুসলিম বাঙলাকে মুসলমানেরা স্বীয় ইতিহাসের একীভূত অংশ মনে করেন না। ফলে বাঙালীর ইতিহাসে পরস্পরবিরােধী ঝোঁক ও দ্বিধাগ্রস্ত ট্র্যাডিশনের সৃষ্টি হয়েছে। হিন্দু লিখিত বাঙালীর সামাজিক ইতিহাস তাই হিন্দুরই সামাজিক ইতিহাস বাঙালীর স্বাধীনতা বা বাঙালীর বীরত্ব মানে বাঙালী হিন্দুরই স্বাধীনতা ও বীরত্ব।”৭
উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, “কালাপাহাড়ের নিঃসন্দেহ বাঙালীত্ব সত্ত্বেও তার ধর্মান্তর গ্রহণের জন্যই বাঙলার ইতিহাসে তার বীরত্ব ও সমর-কৌশল আসুরিক বর্বরতা রূপেই চিত্রিত হয়। অথচ নৃশংসতায় ও বিশ্বাসঘাতকতায় যার তুলনা মেলা ভার, যাঁর বীরত্ব কাপুরুষের অতর্কিত আক্রমণেরই নামান্তর এবং সম্মুখসমরে একাধিকবার বিনা যুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করেও আত্মম্ভরিতা ত্যাগ করেন নাই সেই প্রতাপাদিত্য বাঙালীর বীরত্ব ও স্বাধীনতাপ্রিয়তার আদর্শ। সীতারাম রায়ও তাই। অথচ বাঙলার স্বাধীনতার জন্য যাঁরা আজীবন প্রান্তরে প্রান্তরে মােগলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, যাঁরা মুহূর্তের জন্যও বশ্যতা স্বীকার করেননি এবং যারা সব হারিয়েও স্ত্রী-কন্যাকে আগুনে সমর্পণ করে রণাঙ্গনে মৃত্যুবরণ করেছেন তবু বশ্যতা স্বীকার করেননি, বাঙলার সেই মুসলমান পাঠান সামন্তদের উল্লেখও বাঙালী ইতিহাসলােচনায় হয় না।”৮
একই প্রসঙ্গে আলােচনায় এবার আমরা মুনীর চৌধুরীর তুলনামূলক সমালােচনা (১৯৬৯) বইটির উল্লেখ করতে চাই। বইটির অন্তর্ভূক্ত প্রবন্ধসমূহের মধ্যেকার ভাবাত্মক ‘যােগসূত্রে’র উল্লেখ করতে গিয়ে মুনীর চৌধুরী তার ভূমিকায় লিখেছেন, “উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে নাট্য সাহিত্যে, হিন্দু পুনর্জাগরণমূলক জাতীয়তাবাদের যে-সঙ্কীর্ণ আদর্শ রূপায়িত হয়েছে, প্রতি প্রবন্ধেই আমরা তার স্বরূপ-বৈচিত্র্য উন্মােচনে মনােযােগী হয়েছি।”৯ এমনকি বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে হিন্দু নাট্যকারদের পুরাতন মনােবৃত্তির কিছু রদবদল’, ‘তারস্বরে হিন্দু-মুসলিম বাণী প্রচার ও তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ইতিহাসকে পুনর্গঠিত করার চেষ্টার প্রসঙ্গেও মুনীর চৌধুরীর উক্তি “কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, মুসলমান পাঠক, বহিরঙ্গের ঐ উচ্চভাবের মােড়কের অভ্যন্তরে যবনবিরােধী অবজ্ঞা ও ঘৃণাকে প্রত্যক্ষ করে আদিত হয় না। অনেক সময় এ রকমও সন্দেহ হয়েছে যে, এই বিদ্বেষের মূল নাট্যকারের হৃদয়ের এত গভীর তলদেশে প্রােথিত যে হয়ত নাট্যকার নিজেও এ বিষয়ে সম্যকরূপে আত্ম-সচেতন নন। ..মুসলমান চরিত্র কেবলমাত্র তখনই শ্রদ্ধার্থ হবে যখন সে ইসলাম সম্পর্কে ঔদাসীন্য প্রকাশ করবে, হিন্দুদের অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করবে এবং নিজেদের পূর্বপুরুষ যে এক সময়ে হিন্দু ছিল আর বর্তমানেও ধমনীতে হিন্দুর রক্ত প্রবহমান একথা সবসময়ে স্মরণ রাখবে। আকবর এত প্রশংসা লাভ করেছেন কারণ, নাট্যকারের বিবেচনায়, তিনি ইসলামের সবিশেষ ভক্ত ছিলেন না। রাজপুতগণকে বন্ধু বলে গ্রহণ করেছিলেন এই জন্যই জাহাঙ্গীর মহৎ। মহামতি শাজাহান হিন্দু মাতার সন্তান, তাঁর পিতা জাহাঙ্গীরও হিন্দু নারীর গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন। ঔরঙ্গজীবের পথে বাংলা নাটকের নায়ক হওয়া বড় কঠিন ছিল।”১০
এসময়ের বাংলা নাটকগুলােতে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদের আদর্শ অত্যন্ত নগ্নভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। হাতে-গােণা গুটিকয়েক বাদ দিয়ে এসব নাটকগুলাের মধ্যে হরলাল রায়-র ‘হেমলতা’ (১৮৭৩) ও বঙ্গের সুখাবসান’ (১৮৭৪), কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়র ‘ভারতে যবন’ (১৮৭৪), হারাণচন্দ্র ঘােষ-এর ‘ভারত দুঃখিনী’ (১৮৭৫), নগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এই কি সেই ভারত’ (১৮৭৫) , কুঞ্জবিহারী বসুর ‘ভারত অধীন’ (১৮৭৬), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরুবিক্রম’(১৮৭৪), ‘সরােজিনী’ (১৮৭৫), ‘অশ্রুমতী’ (১৮৭৯) ও ‘স্বপ্নময়ী’ (১৮৮২), গিরিশচন্দ্র ঘােষের ‘আনন্দ রহাে’ (১৮৮১) ও ‘রাণা প্রতাপ’ (১৯০৪), ডি এল রায়-এর ‘রাণা প্রতাপ সিংহ’ (১৯০৫), ‘দুর্গাদাস’ (১৯০৬) এবং ‘মেবার পতন’ (১৯০৮), ক্ষীরােদ প্রসাদ-এর ‘পদ্মিনী’ (১৯০৬), নিশিকান্ত বসুর ‘বাপ্পা রাও’ (১৯১৪) প্রভৃতি অন্যতম। টডের কল্প-কাহিনীর প্রভাব তীব্রভাবে অনুভূত হওয়ায় এই নাটকগুলিতে জাতীয় সংহতি-বিনষ্টকারী হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ আমরা স্পষ্টাকারে লক্ষ্য করি।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জাতীয়তাবােধ একসময় খুবই প্রকট ছিল। বঙ্গভঙ্গের অব্যবহিত আগে রচিত তাঁর ‘রাণা প্রতাপ সিংহ’ নাটক। একেই তাে প্রতাপ সেই ঊনবিংশ শতক থেকেই বাংলার অত্যন্ত প্রিয় বীর, বিধর্মী মুঘল সম্রাটের প্রতিদ্বন্দ্বী পরাক্রান্ত হিন্দু হিসেবে। তার উপর এই নাটকে ‘ধাও ধাও সমর ক্ষেত্রে’ গানটির পটভূমি মেবার হলেও বারেবারে ‘জয় মা ভারত, জয় মা কালী’ ধুয়াতে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মেবার নয়, এটি আসলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের গান এবং সেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আসলে হিন্দু জাতীয়তাবাদ।
এ নাটকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’-র প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহাসিক নাটক ‘অশ্রুমতী’-ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে ‘রাণা প্রতাপসিংহ’ নাটক রচনায় প্রভাবিত করেছিল। ঘটনা বিন্যাসের দিক থেকে নাটকটি ‘অশ্রুমতী’র ‘স্বগােত্রীয়’ বলে নাট্য-সমালােচক বৈদ্যনাথ শীল মন্তব্য করেছেন।১১ ফলে স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু তথা রাজপুত ও মুসলমান বিরােধের প্রসঙ্গ এসেছে নাটকটিতে। টডের প্রভাব থাকায় কাহিনিতে ইতিহাস বিকৃতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।
নাটকের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যেই রাণা প্রতাপের মুখে আকবরের প্রসঙ্গ উচ্চারিত এবং তা থেকে জানা যায় যে, আকবর অন্যায় সমরে, গুপ্তভাবে জয়মলকে বধ করে চিতাের অধিকার করেন। মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্যবাদী রীতি অনুযায়ী আকবর যুদ্ধ করেই জয় করে নেন চিতাের। অন্যায় সমরে, গুপ্তভাবে জয়মলকে বধ করে চিতাের অধিকার করবার কথা টডও তার ইতিকাহিনীতে বলেননি।১২ এ বক্তব্য একান্তভাবে নাট্যকারের মস্তিষ্কজাত।
শক্তিসিংহ (প্রতাপের ভাই) আকবরের ওপর প্রতিশােধ নিতে চান। এতদিনের বশংবদ পৃথ্বীরাজ প্রতিশােধ নিতে প্রতাপের সাহায্য ভিক্ষার জন্য আগ্রা ছেড়ে প্রতাপের নিকট আসেন। গােবিন্দসিংহও তাকে আকবরের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে বলেন। কিন্তু প্রতাপ নিজের ক্ষমতা বােঝেন, তাই তিনি নিঃসঙ্কোচে তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। প্রতাপের দুরবস্থায় তার মন্ত্রী ভীম সাহা তাকে অর্থ সাহায্যের প্রস্তাব দেন—যা দিয়ে চৌদ্দ বর্ষ ধরে বিংশতি সহস্র সেনার বেতন দেওয়া সম্ভব ছিল। কথাগুলি কিঞ্চিৎ পরিবর্তনসহ টড থেকে নেওয়া।
ভীম সাহার নিকট অর্থ পেয়ে শক্ত সিংহ সৈন্য সংগ্রহে মনােনিবেশ করেন। পৃথ্বীরাজ রানাকে উৎসাহিত করবার উদ্দেশ্যে গান বাঁধেন। গানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বিশেষভাবে প্রতিভাত,
“পুণ্য সনাতন আর্যাবর্তে
রাখিব নাহি যবন পদচিহ্ন।।
মােগল রক্তে করিব স্নান,
করিব বিরঞ্জিত হিন্দুস্থান।”
নাটকে শক্ত সিংহ নারীকে সম্মানের চোখে দেখতে পারেননি। নারী সম্পর্কে আকবর ও শক্তিসিংহের উক্তির মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। বরং শক্তিসিংহের বক্তব্য আকবরের বক্তব্য অপেক্ষা রূঢ়, অশালীন এবং নারীকে তিনি ‘কদাকার’ জীব অপেক্ষা। বেশি কিছু মনে করেন না। দৌলতউন্নিসার মনােভাব কিন্তু শক্তিসিংহের মনােভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। সে তার বিবাহকে সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক মনে গ্রহণ করেছে এবং দৃঢ়কণ্ঠে ঘােষণা করেছে, ‘বিবাহের শাস্ত্র ভালবাসা। দৌলতকে স্ত্রীরূপে স্বীকার করতে শক্তিসিংহের যে সংশয় ছিল, স্বামীরূপে শক্তিসিংহকে গ্রহণ করতে দৌলতের বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা সংশয় ছিল না। অবশ্য এছাড়া দৌলতের অন্য কোনাে উপায়ও ছিল না। তবু উভয়ের মানসিকতা বিশ্লেষণ করলে দৌলতকে অবশ্যই শক্তিসিংহের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হয়। শক্তিসিংহ মাঝে মাঝে দৌলতউন্নিসার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে, তবু সে ছিল অচঞ্চল। দৌলত মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে প্রমাণ করেছে যে, তার ভালবাসায় কোনাে খাদ ছিল না।
পৃথ্বীরাজের কাছে শােনা যায়, প্রতাপসিংহের হাতে মহব্বত খাঁর বন্দিত্বের সংবাদ। শৃঙ্খলাবদ্ধ মহব্বতকে প্রতাপসিংহ নিজ উদারতায় মুক্তি দেন। মহব্বত খাঁ আকবরের আমলে কখনই মেবার অভিযানে যাননি। অতএব মহব্বত খাঁ কর্তৃক শক্তিসিংহের ফিনশরা দুর্গ অবরােধ, প্রতাপের হাতে তার বন্দিত্ব ও মুক্তি এবং সেখান থেকে অধােবদনে প্রস্থান ইত্যাদি ঘটনা নাট্যকারের কল্পনামাত্র। বাহ্যদৃষ্টিতে মহব্বত খাঁর কোনাে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা না থাকলেও দেখা যায় যে, তিনি প্রতাপ, মানসিংহ, তথা রাজপুত জাতির গৌরববৃদ্ধিতে ও গুণকীর্তনে উচ্চকণ্ঠ এবং সুযােগ পেলেই তিনি তাঁর এ ভূমিকা নিরলসভাবে পালন করেছেন। নাটকে মহব্বত খাঁর অন্তর্ভূক্তির প্রয়ােজনীয়তা সম্ভবত এই কারণেই। যুদ্ধশেষে শক্তিসিংহের নিকট দৌলতউন্নিসা নামে তাঁর স্ত্রী হারাবার কথা শুনে প্রতাপ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন,
“..তুমি মুসলমানী বিবাহ করেছিলে।
….. …… ……
শক্তিসিংহ, তুমি আজ হতে
আর আমার ভ্রাতা নও,
মেবার বংশের কেহ নও।…
এ রাণা বংশের কেহ নও।”
প্রতাপের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অশ্রুমতী’ নাটকে মুসলমান সম্পর্কে কন্যাকে জ্ঞানদানের জন্য ব্যবহৃত প্রতাপ ও তার মহিষীর কথােপকথন। প্রতাপসিংহ শক্তিসিংহকে ‘ব্যাধিগ্রস্ত দক্ষিণ হস্তের ন্যায় পরিত্যাগ’ করেন। মুসলমানী বিবাহ করবার অপরাধে প্রতাপ যখন শক্তিসিংহের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন, তখন শক্তিসিংহ যে ‘পত্নীর অস্তিত্ব একদা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন, তারই অস্তিত্ব ভাইয়ের নিকট সগর্বে উচ্চারণ করেন। শক্তিসিংহ স্বীয় ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেন এবং স্ত্রীরূপে স্বীকৃতি দিয়ে দৌলতউন্নিসাকে ‘দেবী’র উচ্চাসনে স্থান দিতে বাধ্য হন। দৌলতউন্নিসার একতরফা প্রেমের জয় হয় এবং সে তার প্রেমের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়। আশুতােষ ভট্টাচার্য সংযমী ভাষায় বলেন,
“দৌলতউন্নিসার সঙ্গে তাঁহার (শক্তিসিংহ) আচরণ একটু অসঙ্গত হইয়াছে। তাহার জীবনের এই মানবিক অংশটির পরিকল্পনায় নাট্যকার যথার্থ শক্তির পরিচয় দিতে পারেন নাই।”১৩
মেহেরউন্নিসা আকবরের কন্যা হলেও প্রকৃত পরে সে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মানসকন্যা এবং তাকে অবলম্বন করে তিনি একদিকে যেমন কল্পনার ফানুস উড়িয়েছেন, তেমনি তাকে আশ্রয় করে নিজের অভিলাষ পূরণ করেছেন। মেহেরউন্নিসার আবির্ভাব ঘটে প্রথম অঙ্কের সপ্তম দৃশ্যে। এ-দৃশ্যে তাকে কৌতুকপ্রিয়তার সঙ্গে তত্ত্বকথা বলতে দেখা যায়। দৃশ্যটির শেষাংশে পিতার সঙ্গে তার কথাবার্তায় বাড়াবাড়ি ঠেকলেও নাটক যতই অগ্রসর হয়, ততই তার চরিত্র স্পষ্টতর হয় যে, সে পিতার আদুরে কন্যা এবং ভাবনা-চিন্তা করে কথা বলবার অভ্যাস তার নেই। পিতাও তাকে প্রশ্রয় দেন। পিতার কাছে তার একটা কথাই আইন-কানুন। সেলিমও তার বিরুদ্ধে অভিযােগ তুলেছে, পিতা তাকে অত্যধিক আদর দিয়ে তার আস্পর্ধা বাড়িয়ে দিয়েছেন। পিতা-পুত্রীর অনাবিল সম্পর্ক জানা যায়, মেহেরের মেবার থেকে আগ্রায় প্রত্যাবর্তনের পর।
মানসিংহ আকবরের সমর্থনে বলেন, “…আকবর মুসলমান, কিন্তু …তিনি হিন্দুধর্মের পক্ষপাতী? যদি মুসলমান হিন্দুধর্ম গ্রহণ কর্ত্তে পার্ত্ত, আকবর এতদিনে কালী ভজনা কর্ত্তেন। তা পারেন না, তাই তিনি পণ্ডিত মােল্লার সাহায্যে এক ধর্ম্ম স্থাপন কব্বার চেষ্টা করেন যা উভয় জাতিই বিনা আপত্তিতে গ্রহণ কর্তে পারে।”
মানসিংহ তথা দ্বিজেন্দ্রলাল আকবরের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে যা-ই বলুন না কেন, আর পি ত্রিপাঠী কিন্তু অকপটে স্বীকার করেন,
“The crux of his faith was an uncompromising, monotheism, the Tawhid-i-Ilahi. He had no attraction for the dortrines of incarnation propounded either by Hinduism or Christianity. His monotheism was certainly Islamic and is clearly distinguishable from that of any other religion of his time.”১৪
আকবর উদার ছিলেন এবং সর্বধর্মের সার সমন্বয়ে দীন-ই ইলাহী নামক তথাকথিত ‘এক ধৰ্ম্ম স্থাপন কর্ব্বার চেষ্টা’ করেছিলেন বটে, কিন্তু সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। রাজা ভগবান দাস ও তার পালকপুত্র মানসিংহ দীন-ই ইলাহী গ্রহণের বিষয়ে প্রায় অভিন্ন ভাষায় আপত্তি জানিয়েছিলেন।১৫ এই ধর্ম ও এর অনুসারী সম্পর্কে ভিনসেন্ট স্মিথ বলেন,
“The number of adherents of the so-called Divine Faith, Akbar’s political sham religion, was never considerable. Blochmann has collected from Abud Fazl and Badaoni the names of eighteen prominent members, Raja Birbal being the only Hindu in the list. The herd of unnamed and unrecorded followers probably never numbered thousands.”১৬
যাইহােক, টডের অনৈতিহাসিক ‘রাজস্থান’-এর ইতিবৃত্ত অবলম্বনে রচিত রাণা প্রতাপের পর্যদস্ত ও বিধ্বস্ত জীবনকাহিনিতে নাট্যকার যে গৌরবদীপ্তি ও মাহাত্ম্য আরােপের প্রয়াস পেয়েছেন, তা তার ব্যর্থতার হাহাকারে ও হতাশার কারণে সার্থকতামণ্ডিত হতে পারেননি। শক্তিসিংহ মেহেরউন্নিসা-দৌলতউন্নিসার ত্রিমাত্রিক অতিরােমান্টিক ও অবাস্তব প্রেমের উপাখ্যান নাটকটির কলেবর বৃদ্ধি করলেও নাট্যোকর্ষ বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারেনি।
টডের ‘রাজস্থান’-এর প্রভাব থাকায় বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য সৃষ্টির মতাে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘দুর্গাদাস’ নাটকেও হিন্দু-মুসলমানের বিদ্বেষ ভাব প্রকাশিত। এ ব্যাপারে সতর্ক নাট্যকার তাই এ নাটকের অন্যতম মুসলমান চরিত্র ঔরঙ্গজেব সম্পর্কে ভূমিকায় লেখেন,
“ঔরঙ্গজেবকে আমি পিশাচরূপে কল্পনা করি নাই—যেরূপ টড ও অর্মে করিয়াছেন। আমি তাহাকে সরল ধার্মিক মুসলমানরূপে কল্পনা করিয়াছি। তাহার অত্যাচার অত্যধিক গোঁড়ামির ফল, ইসলাম ধর্ম প্রচারের দৃঢ় সংকল্প প্রসূত।”১৭
টডের ‘রাজস্থান’ ছাড়া ‘দুর্গাদাস’-এ বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাজসিংহ’র প্রভাবও অনস্বীকার্য।
ঔরঙ্গজেবের অত্যাচার সম্পর্কে দ্বিজেন্দ্রলাল যে বক্তব্য রেখেছেন, তার সঙ্গে স্ট্যানলি লেনপুল ভিন্নমত পােষণ করেন। তিনি বলেন,
“Throughout his long reign of nearly fifty years no singh deed of Cruelty has been proved against him. Even his persecution of the Hindus, which was of a piece with his puritanical character, was admittedly marked my no executions or tortures.”১৮
তাছাড়া মুঘল-ভারতে অরাজক অবস্থা শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। সম্রাট আকবর নিজেই ছিলেন এই সব পরিস্থিতির উদ্যোক্তা। ক্রমেই হিন্দুরা মুসলমানদের উপর বেপরােয়া জুলুম ও অত্যাচার শুরু করেছিলেন। তারা মুসলিম মহিলাদের জোরপূর্বক বিবাহ করে ঘরে আবদ্ধ করে রাখতেন, মসজিদগুলােকে ভেঙে মন্দির ও বাসগৃহে পরিণত করেছিলেন। সম্রাট শাহজাহানের আমলে এ অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছিল। শুধু বেনারসেই ৭৬টি মন্দির নির্মিত হয়েছিল। শাহজাহানের নির্দেশে মহিলাদের উদ্ধার করা হয় এবং মন্দিরে রূপান্তরিত মসজিদগুলিকে পুনরায় মসজিদরূপে বহাল করা হয়। এসব ঘটনা বিস্তৃতভাবে জানা যায় শাহজাহানের নির্দেশে আবদুল হামিদ লিখিত ‘শাহজাহান নামা’ থেকে।১৯
দিলির খাঁ দয়াল সাহার কর্মকাণ্ডের দয়ালসাহা মােঘল সৈন্যকে মালব থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সে কাজিদের ধরে (মুণ্ডণ কচ্ছে, কোরআন কূপে নিক্ষেপ কচ্ছে, মসজিদ সব ভূমিসাৎ কচ্ছে।) সমর্থনে ঔরঙ্গজেবকে দোষী সাব্যস্ত করে বলেন,
“তারা এ জিনিসটা জান্তো না। সম্রাটই পথ দেখিয়েছেন। সম্রাট হিন্দুর বেদ অস্থিকূপে নিক্ষেপ করেননি? ব্রাহ্মণকে ধরে কলমা পড়ান নি? তীর্থ অপবিত্র করেন নি? দেবমন্দির বিচূড় করেন নি?”
ওপরের প্রথম বাক্যে বলা হয়েছে, হিন্দুরা ‘ধর্মের উপর অত্যাচার’ কী জিনিস, তা তারা জানতেন না—ঔরঙ্গজেবই তাঁদের এ-পথ দেখিয়েছেন। কথাটা কতটুকু সত্য। হরবংশ মুখিয়া থেকে জানা যায়, “মুসলমান আক্রমণের বহু আগেই অনেক হিন্দু শাসক তাদের শত্রু এলাকায় গিয়ে একই কাজ করেছেন। পারমার রাজা সুভাত বর্মণ (১১৯৩-১২১০ খ্রি) গুজরাট আক্রমণ করে দাভয় ও কাম্বে অঞ্চলে বহু সংখ্যক জৈন মন্দির ধ্বংস করেছিলেন—কামীরের রাজা হর্ষ তার রাজ্য ভাণ্ডার পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে তার নিজের রাজত্বেই চারটি বাদে আর সব মন্দির লুণ্ঠন করেছিলেন।”২০ এই রাজা সম্পর্কে অন্যত্র বলা হয়, “একাদশ শতকে কাশ্মীরে হর্ষ নামক একজন রাজার কথা বলা যায়, যিনি অত্যন্ত সংগঠিতভাবে মন্দির ধ্বংসের কাজে নেমেছিলেন। কলহনের রাজতরঙ্গিনী থেকে জানা যায় যে, হর্ষ ‘দেবােৎপাটননায়ক’ (আক্ষরিক অর্থে, যিনি দেবতাদের উৎপাটিত করার কাজে নিযুক্ত হয়েছেন) নামে বিশেষ একজন কর্মচারীকে নিযুক্ত করেছিলেন, যার প্রধান কাজ ছিল মন্দির লুট করা।”২১
ব্রাহ্মণকে কলমা পড়ানাের বিষয়টি সম্পর্কে হরবংশ মুখিয়া বলেন, “রাষ্ট্র যে কখনাে ব্যাপকভাবে সব হিন্দুকে মুসলমান ধর্মে দীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, বা প্রচণ্ড উৎসাহে ইসলামী আদর্শ প্রচার করেছিলেন এ রকম কোনাে প্রমাণ নেই। ধর্মান্তরের চেষ্টা একমাত্র হয়েছে রাজনৈতিক অর্থে গুরুত্বপূর্ণ কোনাে কোনাে ব্যক্তি বা পরিবারের ক্ষেত্রে, কখনােই ব্যাপকভাবে সাধারণের মধ্যে নয়। লক্ষণীয় হলাে, শুধুমাত্র সেই সব ব্যক্তিদেরই ধর্মান্তরের কথা উঠতাে যাঁরা হয় বিদ্রোহ করেছেন অথবা রাষ্ট্রের বিরােধিতা বা অনুরূপ কাজ করেছেন। …মধ্যযুগে ধর্মকে জীবনে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হতাে বলে নিজের ধর্ম ত্যাগ করে সম্রাটের ধর্মকে গ্রহণ করাকেই আনুগত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন মনে করা হতাে। তা নইলে কেনই বা অন্যান্য বিস্ত ও কর্মপটু হিন্দু রাজা ও রাজপুত পারিষদদের বেলায় ধর্মান্তর গ্রহণের কথা বলা হতাে না? …সাধারণত কেবল শত্রুপরে এলাকার মন্দিরগুলিই ধ্বংস করা হয়েছে। মন্দিরগুলি ষড়যন্ত্র বা বিদ্রোহের কেন্দ্র হয়ে না দাঁড়ালে (যেমন ঔরঙ্গজেবের আমলে হয়েছিল) সুলতানের নিজের এলাকার মধ্যে কখনােই তা ধ্বংস করা হতাে না। শত্রুর এলাকায় মন্দির ধ্বংস করা যেন জয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।”২২
ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার-এর কথায়,
“His supposed intolerance is little more than a hostile legend based on isolated acts such as the erection of a mosque on a temple site in Benaras.”
আমরা ঔরঙ্গজেব সম্পর্কে আরও জানি,
“He endowed a number of Hindu temples and places of worship with grants of land and issued strict orders that places of worship which had not been constructed in an unauthorised manner should not be desecrated.”২৩
মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) “হিন্দুর মুখে আরঞ্জেবের কথা’ নামক প্রবন্ধে ইতিহাস চর্চায় নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলােচনাকালে তিনি হিন্দুর দেবদেবীর মন্দির ভাঙা বিষয়ে ঔরঙ্গজেবের যে অপবাদ রয়েছে, তার বিরােধিতা করে বলেন, “কাশীর বিবের মন্দির আওরঞ্জেবের একজন সুবাদার ভাঙ্গিয়া দেন, মন্দির ভাঙ্গার জন্য আওরঞ্জেব সুবাদারকে খুব ধমক দিয়াছিলেন। তাঁহার সেই ধমকের পত্র সম্প্রতি বাহির হইয়াছে ও ছাপা হইয়াছে।”২৪ যদুনাথ সরকার এই ‘ধমকের পত্র’কে কাল্পনিকরূপে উল্লেখ করলেও পাদটীকায় স্বীকার করেন যে, এই ফর্মান ঔরঙ্গজেব নিজ ভ্রাতা শূজাকে পশ্চাদ্ধাবন করবার সময় কাশীর কোন ব্রাহ্মণকে দেন এবং তাতে লেখা আছে, আমাদের ধর্মে নতুন দেবমন্দির নির্মাণ নিষেধ, কিন্তু পুরাতন মন্দির ভাঙ্গার বিধি নাই, সুতরাং এই ব্রাহ্মণের মন্দিরে পূজায় কোন বাদশাহী কর্মচারী যেন বাধা না দেয়।২৫
জ্ঞানচন্দ্র তার ‘Freedom of worship for the Hindu under Alamgir’ প্রবন্ধে বার্নিয়ের বরাত দিয়ে হিন্দুদের প্রতি ঔরঙ্গজেবের সহনশীলতা ও উদারতার কয়েকটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছেন এবং সমকালীন জৈন ও হিন্দু কবিদের কতিপয় প্রশস্তিমূলক কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, ঔরঙ্গজেব হিন্দুদের নিকট মােটেও ভীতিপ্রদ ছিলেন না, আর তিনি অত্যাচারী হলে সমকালীন কবিরা তার প্রশংসা করতেন না।২৬
দিলির খাঁ নাকি ঔরঙ্গজেবকে হিন্দুবিদ্বেষ ত্যাগ এবং জিজিয়া কর রদ করার পরামর্শ দেন। নাটকে সম্রাট-কথিত এর উত্তর ‘কখনও না আমি যতদিন জীবিত আছি, ততদিন মুসলমান, মুসলমান, কাফের কাফের’। নিজ ধর্মের প্রতি ঔরঙ্গজেবের ছিল অকৃত্রিম ও আপসহীন ভর্তি, আর এই ভক্তি ও অকৃত্রিমতাই তার জন্য কাল হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার অপবাদ প্রচারিত হয়েছিল। Stanley Lane Poole বলেন,
“Aurangzib might have cast the precepts of Muhammad to the winds and still kept-nay, strengthened, his hold of the sceptre of Hindusthan. After the general slaughter of his rivals, his seat on the Peacock Throne was as secure as ever had been Shah-Jahan’s or Jahangir’s. They held their power in spite of flagrant violations of the law of Islam; they abandoned themselves to voluptuous ease, to ‘Wein, Weib, and Gesang’, and still their empire held together,.. There was nothing but his own conscience to prevent Aurangzib from adopting the eclectic philosophy of Akbar, the luxurious profligacy of Jahangir, or the splendid ease of Shah-Jahan. The Hindus would have preferred anything to a Muhammadan bigot.The Rajput princes only wanted to be let alone. The Deccan would never have troubled Hindustan if Hindustan had not invaded it. Probably any other Mughal prince would have followed in the steps of the Kings his forefathers, and emulated the indolence and vice of the court in which he had received his earliest impressions.
Aurangzib did none of these things…He must have known that compromise and conciliation formed the easiest and safest policy in an empire composed of heterogeneous elements of race and religion…He must have been fully conscious of the danger
ous path he was pursuing, and well aware that to run a-tilt against every Hindu sentiment to alienate his Persian adherents, the flower of his general staff, by deliberate opposition to their cherished ideas, and to disgust his nobles by suppressing the luxury of a jovial court, was to invite revolution. Yet he chose this course, and adhered to it with unbending resolve through close on fifty years of unchallenged sovereignty.
All this he did out of no profound scheme of policy, but from sheer conviction of right. Aurangzib was born with an indomitable resolution. He was not ordinary courage. That he was physically brave is only to say he was a Mughal Prince of the old lionhearted stock. But he was among the bravest even in their valiant rank.”২৭
কতিপয় ঐতিহাসিক হিন্দুধর্মের প্রতি ঔরঙ্গজেবের অসহিষ্ণুতা সম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছেন, তারই প্রতিফলন ঘটেছে। নাটকে। কিন্তু ঐ সব ঐতিহাসিকের বক্তব্য যে বস্তুনিষ্ঠ নয়, তা জানতে পারা যায় স্বয়ং ঔরঙ্গজেবের অনেক চিঠি থেকে। উক্ত চিঠিপত্র থেকে আরও জানা যায় যে, ঔরঙ্গজেব ধর্মের ভিত্তিতে তার কর্মচারীদের বিভাজন করতে অস্বীকার করেছিলেন। মুহম্মদ আবদুল জলীল বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে বলেন যে, আকবরের সময় ছেচল্লিশ জন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর মধ্যে নয়জন ছিলেন হিন্দু। সম্রাট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন রাজা মানসিংহকে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে সামরিক ও বেসামরিক বিভাগে হিন্দু কর্মচারী ছিলেন একান্নজন এবং সম্রাট ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে উচ্চপদস্থ হিন্দু কর্মচারীর সংখ্যা ছিল এক শত ষাটজন। ঔরঙ্গজেব মহারাজা যশােবন্ত সিংহ ও রাজা জয়সিংহের জীবদ্দশায় দশেরা উৎসব করতেন বলেও জানা যায়।২৮ কিন্তু তা সত্ত্বেও তার সম্পর্কে সাম্প্রদায়িকতা ও গোঁড়ামির অপবাদ ঘােচেনি। ঐতিহাসিক স্বীকার করেন,
“Aurangzib never refused office to deserving Hindu and a good many of his generals and civil servants were Hindus. He endowed Hindu temples liberally. He never persecuted any people and was just in his dealings with Hindu or Muslim, Afgan or Rajput. When they asked for forgiveness, he gave it to them without hesitation. It is true that he wated to put a new spirit into the Muslims of India, but this was not at the expense of the Hindus.”২৯
বস্তুত, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন লােক রাষ্ট্রের অনুগত ছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সম্রাটের পক্ষ থেকে তার ভয়ের কোন কারণ ছিল না। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সুশাসন ও ক্ষমতা সম্বন্ধে উল্লেখ করতে গিয়ে ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে, অর্থাৎ ঔরঙ্গজেবের সমকালের কবি কৃষ্ণরাম দাস লেখেন,
“আরং শাহা ক্ষিতিপাল।
রিংপুর উপরে কাল
রাম রাজা সবর্জনে বলে।।
নবাব শায়িস্তা খাঁ।
অধিকারী সাত গাঁ
বহু সরকার করতলে।”
রাজা হিসাবে কর্মের সহিত ঔরঙ্গজেবের তুলনা তার সুশাসন ও প্রজাপালন গুণের পরিচায়ক এবং ‘রিংপুর উপরে কাল’ আখ্যা তার ক্ষমতা ও প্রতাপের দ্যোতক।৩০ দিলওয়ার হােসেন এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ঔরঙ্গজেবকে ‘সর্বজনে রামরাজা’ বলে আখ্যায়িত করা বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত। তিনি আরও বলেন, “আওরঙ্গজেবের উপর হিন্দু কর্তৃক আরােপিত এরূপ প্রশংসাসূচক বিশেষণ পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে দৃষ্ট হয় না।”৩১ তবে লেখকদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটছে এবং ঔরঙ্গজেব সম্পর্কে সত্যনিষ্ঠ তথ্য প্রকাশের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যদুনাথ সরকার রচিত ‘হিস্ট্রি অফ আওরঙ্গজেব’ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন “তাহার আরঙ্গবের ইতিহাস অতি সুন্দর গ্রন্থ। লােকে আরঞ্জেবকে যত মন্দ বলে তিনি যে ততটা ছিলেন না, সেটা উনি বেশ করিয়া দেখাইয়াছেন। উনি আরও দেখাইয়াছেন যে, আওরঞ্জেব একজন খুব ভাল রাজা ছিলেন। প্রজা হিন্দু হউক আর মুসলমান হউক, প্রজার উন্নতিতে যে রাজার উন্নতি, তাহা তিনি বেশ বুঝিয়াছিলেন এবং সেই মত কার্য্যও করিতেন। সুতরাং তাহার রাজত্বে প্রজা বেশ সুখে ছিল। তাহার সুবেদাররা গর্ব করিতেন যে, তাঁহারা টাকায় ৮মন চাউল বিক্রয় করাইতেছেন।”৩২
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘হিন্দুর মুখে আরঞ্জেবের কথা’ প্রবন্ধ লিখেছিলেন যাতে ঔরঙ্গজেবের এক রৈখিক রূপ উদঘাটিত না হয়। আধুনিক ঐতিহাসিকের বিচারে দেখা যায় যে, ঔরঙ্গজেব পরধর্ম-দ্বেষী ছিলেন না, হিন্দুর কোন কোন মন্দির যে তিনি ধ্বংস করেছিলেন তার কারণ, শাসনবিরােধী ষড়যন্ত্রের মূলােৎপাটন করা। অথচ তার আনুকূল্যে ১৬৫৯-১৬৮৫ পর্বে কয়েকটি বড় মন্দির নির্মিত হয়েছিল এবং জৈন মন্দির সংস্কার করার জন্যও তিনি অর্থ দান করেছিলেন। ঔরঙ্গজেব ৬৬টি কর মকুব করেছিলেন যা ‘অসাম্প্রদায়িক’ আকবরের আমলেও বর্তমান ছিল।৩৩ Stanley Lane Poole পরস্পর বিরােধী বক্তব্যে বলেন,
“For religion he persecuted the Hindus and destroyed their temples, while he damaged his exchequer by abolishing the time-honoured tax on the religious festivals and fairs of the unbelievers.”৩৪
৯ম দৃশ্যে ঔরঙ্গজেবের সামনে দিলির খাঁর কথা : সম্রাট কি ভাবেন যে এ কথা স্বপ্নেও আকবরের মনে আসতাে, যদি সম্রাট তার পথ না দেখাতেন। দিলির খাঁ এখানে ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে শাহজাদা আকবরের বিদ্রোহের কথা বলছেন। ঔরঙ্গজেবের আগেও সিংহাসন দখল, রাজহত্যা, ভ্রাতৃহত্যা, যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদি রাজনৈতিক বিরােধের ভুরি ভুরি নিদর্শন পাওয়া যায়। মুঘল আমলে পিতার বিরুদ্ধে পুত্রের বিদ্রোহের সূচনা হয় আকবরের বিরুদ্ধে তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীরের বিদ্রোহ দিয়ে। জাহাঙ্গীরের বিদ্রোহের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন তৎপুত্র খসরু ও শাহজাহান। শাহাজাহানের পর ঔরঙ্গজেব পিতৃ-পিতামহের ঐতিহ্য অনুসরণ করেন মাত্র। ঔরঙ্গজেব-পুত্র আকবরও পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। অতএব ঔরঙ্গজেব পথ না দেখালে আকবরের মনে বিদ্রোহের কথা স্বপ্নেও আসত না, এ-কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
দিলির পুনরায় ‘বন্ধু’রূপে ঔরঙ্গজেবকে হত্যাকান্ডের প্রায়শ্চিত্ত করতে, জিজিয়া কর তুলে দিতে, হিন্দুজাতিকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে এবং সৰ্ব্ব সর্বনাশের মূল কামিরী বেগমকে দূর করে দিতে অনুরােধ করেন। এখানে বাক্যের প্রথমাংশে দিলির ঔরঙ্গজেব কর্তৃক আত্মীয়স্বজনদের হত্যা প্রসঙ্গের প্রতি বিশেষভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন। ভারত-ইতিহাসে সিংহাসনের জন্য এরূপ হত্যাকান্ডের নমুনা অজস্র। সেগুলাের মধ্যে সিংহাসনারােহনের অব্যবহিত পূর্বে শাহজাহান কর্তৃক স্বজন হত্যা, আলাউদ্দীন খলজী কর্তৃক চাচা হত্যা, অশােক কর্তৃক ভ্রাতৃহত্যার উল্লেখ করা যায়। জিজিয়া কর প্রবর্তন সম্পর্কে বলা যায়, এই কর বহু শতাব্দী আগে থেকেই প্রবর্তিত ছিল। চতুর্দশ শতকের পর্যটক ইবন বতুতা বলেছেন যে, দক্ষিণ ভারতে এক হিন্দু রাজবংশ (‘জামেরিন’) তাদের ইহুদি প্রজাদের কাছ থেকে জিজিয়া আদায় করতেন। ভারতবর্ষের বাইরে মুসলমান শাসকরা তাদের মুসলমান প্রজাদের ওপরেও জিজিয়া কর বসাতাে বলে আমরা জানি। তাছাড়া ফিরােজ তুঘলকের শাসনকাল বাদ দিলে অন্য সব সময়ে জিজিয়ার আওতা থেকে নারী, শিশু, পঙ্গু, ব্রাহ্মণ ও সৈন্যরা বাদ পড়তেন।৩৫ কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক মনে করেন যে, হিন্দুদের ক্ষমতা খর্ব করা এবং হিন্দুদের ইসলাম ধর্মে দীথিত করার প্ররােচনা দানের জন্য ঔরঙ্গজেব জিজিয়া কর প্রবর্তন করেন। হরংবশ মুখয়া এ-প্রসঙ্গে বলেন, তর্কের খাতিরে যদিই বা ধরে নেওয়া হয় যে, জিজিয়া করের উদ্দেশ্য ছিল। সম্পূর্ণই ধর্মীয়, তাহলেও একথা মনে করার কোনাে কারণ নেই যে হিন্দুরা তাদের ধর্ম সম্বন্ধে এমনই উদাসীন ছিলেন যে, সামান্য একটা কর এড়াবার জন্যে ধর্মত্যাগ করতেন (বিশেষত যেখানে পুরােপুরি এড়াবার কোনাে প্রইে ওঠে না, কারণ মুসলমান হলেও, তাদের ‘জাকাৎ’ কর দিতে হত)। তাছাড়া যদি মনে করতে হয় যে, হিন্দুরা কিছু টাকা বাঁচাবার জন্যই ধর্মান্তর গ্রহণ করতেন, তাহলে আমরা কেনই বা ধরে নেব না যে, রাষ্ট্রও শুধু আর্থিক কারণেই এই কর বসিয়েছিলেন। প্রকৃতপথে, হিন্দুবিদ্বেষ বা হিন্দুদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করবার উদ্দেশ্যে জিজিয়া কর প্রবর্তিত হয়নি। সমসাময়িক বিখ্যাত পরিব্রাজক মানুচি এই মত পােষণ করেন যে, রাজকোষের অবস্থার উন্নতির জন্য ঔরঙ্গজেবকে জিজিয়া প্রবর্তন করতে হয়েছিল।৩৬ প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণে শাসক শ্রেণির মধ্যে যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দেখা যায়, তাকে প্রায়ই ধর্মীয় বা আদর্শগত রূপ দেওয়া হয়েছে। “Dr. Satish Chandra maintains that the religious policy of Aurangzib should be seen in the social, economic and political contexts.”৩৭
হরবংশ মুখিয়াও বলেন, “মারাঠা, শিখ ও জাঠ অভ্যুত্থানের প্রকৃত কারণ ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক, ধর্মীয় নয় এবং যদিও বিবদমান দলগুলি মুখে অন্যরকম প্রচার করতেন, তবুও বিরােধ সেই সব স্তরেই আবদ্ধ থাকত।”৩৮
৪র্থ অঙ্ক ১ম দৃশ্যে দিলির খাঁ বার বার দুর্গাদাসকে ধন্যবাদ জানান। প্রথমবার ধন্যবাদ দেন, দুর্গাদাস আকবরকে আশ্রয় দিলে তার সামন্তগণ যখন তাঁকে পরিত্যাগ করে এবং তিনি যখন শম্ভুজীর আশ্রয় নেন তখন ঔরঙ্গজেব-পুত্র মৌজাম (মুয়াজ্জম) দুর্গাদাসকে ঘেরাও করলে তিনি যখন রাত্রিকালে মুঘল ফটক ভেদ করে দাক্ষিণাত্যে পলায়ন করেন, তখন, এবং মৌজাম সম্রাটের আদেশে ৪০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা দুর্গাদাসকে পাঠালে তিনি যখন তা নিজে এক কপর্দকও না নিয়ে পুরােটাই আকবরকে দিয়ে দেন তখন। ধন্যবাদ দেওয়ার বহর দেখে মনে হয়, দিলির যেন দুর্গাদাসকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মওকা অনুসন্ধানে সদা তৎপর। দুর্গাদাস যে কাজই করুন, সব কাজের জন্য দুর্গাদাসমুগ্ধ দিলির খাঁ তার প্রশংসা করবেনই। দিলিরের নিকট থেকেই আমরা জানতে পারি যে, আকবরের পরিবার সমরসিংহের হেফাজতে রয়েছেন, আকবরের বেগমের মৃত্যু হয়েছে এবং আকবরের কন্যা রাজিয়াতুন্নিসা রয়েছে সমরসিংহের আশ্রয়ে। কিন্তু ইতিহাস থেকে দিলিরের এ-কথাগুলাের সমর্থন পাওয়া যায় না।
উক্ত দৃশ্য থেকে জানা যায়, রাজপুতদের সঙ্গে সন্ধি করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে ঔরঙ্গজেব তার পুত্র আজীম (আজম)-কে দিলিরের নিকট পাঠান। দিলির খাঁ সম্রাটের এই ইচ্ছার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং রাজপুত পক্ষ অবলম্বন করে আজীমকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘..বিজয়ী রাজপুত সন্ধি করবে!’ আজীম যখন বলেন যে, বিকানির অধিপতি শ্যামসিংহ সম্রাটের মর্যাদা রেখে সন্ধি করিয়ে দেবেন, তখন দিলির খাঁ আবার বলেন, তবে সম্রাটের এ পূৰ্ব্ববৎ কপট সন্ধি!’ দিলির (টডের পদাঙ্ক অনুসরণ করে) ঔরঙ্গজেবের সদিচ্ছাকে সন্দেহের চোখে দেখেন। তাই তিনি সন্ধি সম্পাদনের কাজে থাকতে চান না। ৩য় দৃশ্যে দিলির শেষ পর্যন্ত টডের অনুসরণে রাজপুতের সঙ্গে সন্ধি করেন চারটি শর্তে চিতাের আর তার অধীনস্থ জনপদ রাজপুতদের ফিরিয়ে দিতে হবে হিন্দুর দেবমন্দিরাদি সব ভবিষ্যতে অগ্ন থাকবে, যােধপুরের রাজাকে তার রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া যাবে। রানা সসৈন্য পূর্ববৎ সম্রাটের সাহায্য করবেন।৩৯ কিন্তু রাজপুত, বিশেষত সমরসিংহ, এ সন্ধিতে সম্মত হতে পারেননি বলে দিলির খাঁকে তার দুই পুত্রকে মােগলের প্রতিভূ রাখতে হয়।৪০
যদুনাথ সরকার রাজপুত যুদ্ধকে ‘drawn game’ বললেও স্বীকার করেন যে,
“Its material consequences were disastrous to the Maharana’s subjects. They retained their independence among the sterile crags of the Aravali but their corn-fields in the plains below were ravaged by the enemy. They could stave off defeat but not starvation. The Mughals, on the other hand, might fail to penetrate into the hills of Kamalmir, their outposts might be surprised and convoys cut off occasionally but held the low country and received supplies from the parts of the empire.”৪১
সহজেই বােঝা যায়, মুঘলদের সাময়িক অসুবিধা হলেও তারা যে খুব একটা বেকায়দায় পড়েছিলেন এমনটা মনে হয় না। তবু যদুনাথ বলেন, উভয়পক্ষই শান্তি কামনা করছিলেন এবং তারা উভয়ই বন্ধুরূপে পেলেন বিকানিরপতি শ্যামসিংহকে। তিনি অনানুষ্ঠানিকভাবে মহারানার নিকট শান্তি প্রস্তাব দেন এবং মধ্যস্থতাকারীরূপে কাজ করতে রাজি হন। মহারানা তার প্রতি প্রসারিত মােগল হাত আঁকড়ে ধরেন এবং তিনি নিজেই শাহজাদা মােহাম্মদ আজমের সঙ্গে ১৪ জুন ১৬৮১ সাক্ষাৎ করেন এবং তারই মাধ্যমে নিম্নলিখিত শর্তে এক সন্ধি হয়।
১. রানার রাজ্যে যে জিজিয়া ধার্য হয়েছিল, সেই করের বদলে মহারানা মণ্ডল, পুর ও বেদনাের পরগণাগুলাে মােগলদের নিকট ছেড়ে দেন।
২. জয়সিংহকে রানা পদবিসহ পাঁচ হাজারি সৈন্যাধ্যক্ষ পদ দিয়ে মেবার ফেরত দেওয়া হয় এবং মােগলরা মেবার থেকে চলে আসেন। ফলে বাদশাহ ও তাঁর সামন্তের মধ্যে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকা সম্পর্ক পুনরায় স্থাপিত হয়।৪২
নাটক ও ইতিহাসে উল্লিখিত সন্ধির শর্তের মধ্যে বিস্তর ফারাক পরিলক্ষিত হয়। নাট্যকার রাজপুতদের পক্ষে সুবিধাজনক কল্পিত শর্ত জুড়ে দিয়েছেন এবং সেই সন্ধি সম্পাদন করতে গিয়ে দিলির খাঁ রাজপুতদের ‘বিজয়ী’ আখ্যাত করে আত্মপ্রসাদ লাভের চেষ্টা করেছেন, কখনও বা এই সন্ধিকে ‘পূর্ব্ববৎ কপট সন্ধি’ বলে ঔরঙ্গজেবের চরিত্রে কালিমালিপ্ত করেছেন। এটা নাট্যকারের অসাম্প্রদায়িক মনােভাবের পরিচয় বহন করে না। যে সন্ধি শ্যামসিংহ সম্পাদন করেন, সেই সন্ধি, ইতিহাসকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে, দিলির খাঁকে দিয়ে সম্পাদন করাতে গিয়ে নানা কথার অবতারণা করা হয়েছে—যার মুখ্য উদ্দেশ্য একাধারে রাজপুত প্রশস্তি গাওয়া এবং ঔরঙ্গজেবের চরিত্র হনন করা। সন্ধি হওয়ার পরও কিন্তু রাজপুত, বিশেষ করে সমরসিংহ, এসন্ধিতে সম্মত হতে পারেননি বলে দিলির খাঁকে তার দুই পুত্রকে মুঘলের প্রতিভূ রাখতে হয়। যে-যুদ্ধে দিলির খাঁ জড়িত ছিলেন, সে যুদ্ধের সন্ধি তিনি কোন অধিকারে করেন, এবং সম্রাট তাকে কেন সে অধিকার দেন, তা আমাদের বােধগম্য নয়। তদুপরি যে কর্মকাণ্ডে দিলির খাঁ নিজেই উপস্থিত ছিলেন না, সেখানে সন্ধি হওয়ার পরও তার দুই পুত্রকে মুঘলের প্রতিভূ রাখার বিষয়টি তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কিনা, ভেবে দেখা যায়। সন্ধি হয়েছিল মেবারের রানার সঙ্গে মুঘল-শাহজাদা আজমের সহযােগিতা করেছিলেন শ্যামসিংহ। তাই এ-সন্ধিতে সমরসিংহের সম্মতির প্র ওঠার কথা নয়। সমরসিংহ ও দিলির খাঁকে অহেতুক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ইতিহাসে কাবলেস খাঁ নামের কোনাে মুসলমানকে শম্ভুজীর জীবনে দেখা যায় না। তবে কবি-কালাশ নামে তার এক ভক্তের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন কনৌজী ব্রাহ্মণ। তিনি এলাহাবাদে ভোঁসলে পরিবারের পুরােহিত ছিলেন। শম্ভুজীর রাজ্যাভিষেকের অব্যবহিত আগে তিনি রায়গড়ে উপস্থিত হন। শিগগিরই তিনি শম্ভুজীর হৃদয় জয় করেন এবং ক্রমশ শম্ভুজীর বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠেন এবং দেশ শাসনের পূর্ণ কর্তৃত্ব নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেন। শম্ভুজী দ্রুত ঠুটো জগন্নাথে পরিণত হন। তিনি চোখ বুজে মন্ত্রীর পরামর্শে চলতে থাকেন এবং সব সময় সুরা ও নারী সংসর্গে কাটাতে থাকেন। ১৬৮২ সালের নভেম্বর মাসেই তিনি রাজ্যের সর্বপ্রধান মন্ত্রী’রূপে বােম্বাইয়ে খ্যাতি অর্জন করেন।
পরে কবি-কালাশ বা কবি-চূড়ামনি উপাধি দিয়ে তাকে মহিমান্বিত করা হয়। তবে যেহেতু তিনি ছিলেন বিদেশী ব্রাহ্মণ, তাই শম্ভুজীর পতনের সঙ্গে সঙ্গে তার কর্তৃত্বও শেষ হয়ে যায়। তিনি বিদেশী বলে স্থানীয় ব্রাহ্মণ ও মারাঠা দেশভক্তরা সমভাবে তার স্মৃতির প্রতি দারুণ বিদ্বেষ পােষণ করতেন। তার প্রতি তাদের ঘৃণা এতই তীব্র ছিল যে, তারা তার পদবি কালাশ (শিরােমণি) বিকৃত করে করেছিলেন ‘কলুষ’ (পাপ)। শম্ভুজীর পাপাচারের জন্য দায়ী করা হয় তাকে। কিন্তু যদুনাথ সরকার বলেন,
“KaviKalash could not have been the minister of Shambhuji’s pleasure as Orme (following Manucci) calls him, because Shambhu had already learnt to outrage women in his father’s lifetime, and wine-drinking and meat-eating are customary among the Maratha caste to which the Rajah belonged. Nor can the failure of Shambhuji’s reign, compared with the glorious success of Shivaji’s, be attributed to this minister, because More Plant himself had been unable to induce his young master to achieve anything great. It is not contended that Kavi-Kalash filled the administration with his own men, as the other seven Pradhans and all the lower officers were men of Maharashtra. It is, therefore, historically untrue to make Kavi-Kalash the scape-goat for Shambhuji’s sins. His unpopularity with the Maratha ministers of the time (and, therefore, with the Maratha, historians ever after) was due solely to the fact that he gained the royal favour and they could not… Odium theologicun intensified the political hatred felt by the maratha Brahmans for Kavi-Kalash; they were vegetarians and Vaishnavas or Shaivas by creed, but he was a Shakta and Tantric worshipper, whose beliefs and rites were abominated by them.”৪৩
এতক্ষণ আমাদের ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে হল। কারণ আমাদের মনে হয়েছে যে, ইতিহাসের এই কবি-কালাশের চরিত্রের আদলে অনৈতিহাসিক কাবলেস খাঁর চরিত্রটি উদ্ভাবিত ও নির্মিত হয়েছে। এমন চরিত্র সৃষ্টিতে অবশ্য কারও আপত্তি থাকবার কথা নয়। কিন্তু যখন বিদেশী ব্রাহ্মণ কবি-কালাশকে মুসলমান কাবলেস খাঁ-এ রূপান্তরিত করে কবি-কালাশের প্রতি স্থানীয় ব্রাহ্মণদের তীব্র ঘৃণা কাবলেস খাঁর ওপর আরােপিত হয়, দুর্গাদাসের ‘কুত্তা’ হয়ে তাঁর পদাঘাত খেতে হয় এবং শম্ভুজীর অপকর্মের সব দায় জোর করে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখনই তা আপত্তির কারণ হয়ে ওঠে। ১৮৭৪-এ জ্যোতিরিন্দ্রনাথও প্রায় একই ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছিলেন ফরাসি নাট্যকার জাঁ রাসিন (Jean Racine, 1639-1699)-এর ‘আলেকজান্ডার দি গ্রেট’ (Alexander le grand, 1665) নাটকের নাম যখন ‘পুরুবিক্রম’-এ পরিবর্তিত করে পুরুর ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন ও আলেকজান্ডারের নাম বদল করে সেকান্দার শা-রূপে মুসলিম নামকরণ করে পরােক্ষ বিষয়কে প্রত্যক্ষ্য ভাবে মুখােমুখি উপস্থিত করেছিলেন, তখনও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
নাটকে দেখানাে হয় যে, কাবলেস খাঁ শম্ভুজীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ঔরঙ্গজেবের পক্ষে যােগ দিয়ে শম্ভুজীকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন এবং দুর্গাদাসকেও ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যে কুকর্মগুলাে কবি-কালাশ করেননি, সেগুলাে মুসলমান হিসাবে কাবলেস খাঁর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই মুসলিম কাবলেস খাঁ, তথা মুসলিম জাতির প্রতি নাট্যকারের অসূয়াপ্রবণতা তার বিভিন্ন কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে প্রকটিত দেখা যায়। অপরপথে, অজিত সিংহ ও দুর্গাদাসের বার বার ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও তার নিকট আত্মসমর্পণের কথা নাট্যকার অন্তর্ভূক্ত করেননি এবং অনৈতিহাসিক কথামালা দিয়ে নাটকটির কলেবর বৃদ্ধি করেছেন। সুকুমার সেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটকগুলাে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলতে বাধ্য হয়েছেন, কি ঘটনাবিন্যাসে কি নামকরণে কি সংলাপে কি চরিত্রচিত্রণে দ্বিজেন্দ্রলাল ইতিহাসের বিন্দুমাত্র মর্যাদা রাখেন নাই।৪৪ একথা যেমন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অন্যান্য ঐতিহাসিক নাটকের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য, তেমনি প্রযােজ্য দুর্গাদাস নাটকের ক্ষেত্রেও। আমরা সুবােধচন্দ্র সেনগুপ্তের এক উদ্ধৃতি দিয়ে আমাদের বক্তব্য পেশ করতে চাই। তিনি বলেন,
“তিনি (দ্বিজেন্দ্রলাল) ইতিহাসের বহিরঙ্গ বজায় রাখিলেও ইহার ভিতরকার সত্তাকে বিকৃত করিয়া ফেলিয়াছেন। মনে হয় ইহা বঙ্কিমচন্দ্রের অপপ্রচারের ফল। বঙ্কিমচন্দ্র দুঃখ করিয়া বলিয়াছিলেন যে, মুসলমান ঐতিহাসিকেরা হিন্দুদের বাহুবল স্বীকার করিতে চাহেন নাই এবং হিন্দুদের সম্বন্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়াছেন। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে হিন্দুর বাহুবল প্রতিপন্ন করিবার জন্য বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দুদ্বেষী ঔরংজেবকে খুব খেলাে করিয়া ফেলিয়াছেন। ইহাও ইতিহাসের বিকৃতি। ঐতিহাসিকেরা বলেন যে, উদিপুরী বেগম ঔরংজেবের প্রেয়সী ভাৰ্য্যা ছিলেন এবং বুড়ােকালে তিনি সম্রাটের প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিয়াছিলেন। তাহার প্রতি অত্যধিক অনুরক্ত ছিলেন। বলিয়াই সম্রাট তৎপুত্র কামবক্সের বহু অপরাধ মার্জনা করিতেন এবং ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান হইলেও উদিপুরীর মদ্যাসক্তি সহ্য করিতেন। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র দেখাইতে চাহিয়াছেন যে, ঔরংজেব শুধু উদিপুরী বেগমের ত্রীড়ার পুতুল মাত্র ছিলেন না, তাহার আহত অভিমানকে তৃপ্ত করার জন্যই ঔরংজেব রাজপুত অভিযানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। শুধু অভিযানের সূত্রপাত কেন তাহার পরিচালনায়ও ঔরংজেব—বঙ্কিমচন্দ্রের চিত্রে—কোন নৈপুণ্য দেখাইতে পারেন নাই। যেমন অন্তঃপুরে, তেমন যুদ্ধক্ষেত্রে— সর্বত্রই এই কঠোর, তীর ধী, কুশলী ও কৌশলী নৃপতি বেয়াকুবের মত আচরণ করিয়াছেন।”৪৫
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও তার ‘দুর্গাদাস’ নাটকে বঙ্কিমের অনুকরণে ঔরঙ্গজেবের এমন চিত্রই অঙ্কন করেছেন।
সুবােধচন্দ্র সেনগুপ্ত আরও বলেন,
“যশােবন্ত সিংহের মৃত্যুর পর ঔরংজেব যে মারবার অধিকার করিতে চাহিয়াছিলেন তাহা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া দ্বিজেন্দ্রলাল কল্পনা করিয়াছিলেন যে (উদিপুরী) বেগম গুলনেয়ারের যশােবন্ত সিংহের রাণীর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রোশই এই প্রায় ত্রিশ বৎসরব্যাপী যুদ্ধের মূল। এইভাবে ইতিহাস শুধু সংকোচিত হয় নাই বিকৃত হইয়া গিয়াছে। এই বিকৃতি চরমে পৌঁছিয়াছে দুর্গাদাসকে বন্দী করিয়া মােগলের হাতে সমর্পণে এবং কারাগারে দুর্গাদাসের প্রতি বেগম গুলনেয়ারের নিষ্ফল প্রেমনিবেদনে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ঔরংজেব এতই অন্ধ ও কামমােহিত যে গুলনেয়ারকে দুর্গাদাসের প্রতি অনুরক্ত জানিয়াও তিনি এই অবিবাসিনী স্ত্রীর প্রতি রােষ প্রকাশ করেন নাই, বরং দুর্গাদাসের সম্মানে তিনি তাঁহাকে ক্ষমা করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন। এখানে নাট্যকার তার মুখে যে হাস্যকর উক্তি দিয়াছেন তাহা সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করিলে ইতিহাস বিকৃতির চরম পরিচয় পাওয়া যাইবে ‘দুর্গাদাস! আমি তােমার কাছে বাহুবলে পরাজিত হয়েছিলাম, কিন্তু তার চেয়ে এই পরাজয় অধিক। তুমি গুলনেয়ারের মত নারীকে মুঠোর মধ্যে পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছাে। গুলনেয়ারের মত সম্রাজ্ঞীর প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছ। তুমি মহৎ! দিলীর খার অনুরােধে, আর তােমার সম্মানে আজ আমি গুলনেয়ারকে ক্ষমা কর্ব—মক্কায় যাবার আগে এক উগ্র, উচ্ছঙ্খল নারীর প্রতি আর ক্রোধ রাখি কেন? ইহা ইতিহাস নহে, রূপকথাও নহে, ইহা পরাজিত, উপদ্রুত জাতির কবির স্বপ্নদর্শন।”
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘দুর্গাদাস’ নাটক চমকপ্রদ দৃশ্যের সমষ্টি, ইহার কতকগুলি ইতিহাস হইতে নেওয়া, কতকগুলি নাট্যকারের সৃষ্টি। এই সমস্ত দৃশ্যগুলির রঙ্গমঞ্চে খানিকটা আবেদন আছে এবং এক সময়ে ‘দুর্গাদাস’ রঙ্গমঞ্চে সফলতাও অর্জন করিয়াছিল কিন্তু সেই সফলতা স্থায়ী হয় নাই। মােটের উপর বলা যাইতে পারে, ‘দুর্গাদাস’ সাহিত্যকর্ম হিসাবে সার্থক নয়।”৪৬
জনৈক সমালােচক অবশ্য বলেন, দুর্গাদাস ও সাজাহান দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কীৰ্ত্তিস্তম্ভস্বরূপ।৪৭ পক্ষান্তরে রথীন্দ্রনাথ রায়ের মন্তব্য, “নাট্যকার দুর্গাদাস চরিত্রকে নায়ক ও কেন্দ্রীয় চরিত্রের মর্যাদা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু নাটকের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দুর্গাদাসের উপস্থিতি সত্ত্বেও কোথাও তিনি তেমন পরিস্ফুট হননি। এর কারণ দুটি প্রথমত, অতিরিক্ত ঘটনা ও অনাবশ্যক চরিত্রের ভিড়, দ্বিতীয়ত, দুর্গাদাস চরিত্রে আদর্শবাদের আতিশয্য। অসাধারণ বুদ্ধিচাতুর্য, বীরত্ব, আত্মত্যাগ, আভিজাত্যবােধ, প্রভুভক্তি, আশ্রিতবাৎসল্য, কর্তব্যবােধ, সুমহান দেশপ্রেম প্রভৃতির দ্বারা তিনি এই রাঠোর বীরের চরিত্রকে ভূষিত করেছেন। এই সর্বগুণান্বিত চরিত্রটির মধ্যে মর্তের মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় না।”৪৮ দ্বিজেন্দ্র-জীবনীকার নবকৃষ্ণ ঘােষ লিখেছেন, “দ্বিজেন্দ্রলালের ‘দুর্গাদাস’ নাটক পাঠ করিয়া তাহার বন্ধু মনস্বী লােকেন্দ্র নাথ পালিত আই সি এস মহাশয় বলেন যে, দুর্গাদাস চরিত্র ‘Bundle of qualities’ হইয়াছে, যদি গুণের সঙ্গে ‘weakness’-এর উল্লেখ থাকিত, তাহা হইলে চরিত্র আরও ফুটিত।”৪৯ প্রকৃতপথে, নাট্যকার চরিত্রটিকে দোষত্রুটিহীন সদগুণাবলীর সমষ্টিরূপে সৃষ্টি করেছেন।
‘নব্যভারত’ মুক্তকণ্ঠে ‘দুর্গাদাস’-এর জয়ধ্বনি ঘােষণা করে লিখেছে, “কেহ জিজ্ঞাসা করিতে পারেন কোন দোষ কি পুস্তকে নাই? ‘গাহিতে গাহিতে রাজিয়া অজিতের বাহুলীন হইলেন’—সমস্ত পুস্তকে দোষের কথা থাকিলে এই এই স্থানে আছে।…আর। সৰ্ব্বত্রই রুচিমার্জিত, ভাববিরুদ্ধ, শিল্পচাতুৰ্য্য সুন্দর, কবিত্ব অসাধারণ—পড়িবার সময় মনে হয় যেন ধর্মগ্রন্থ পড়িতেছি, মনে হয় যেন আত্মত্যাগ মন্ত্রের এক জীবন্ত ইতিহাস পড়িতেছি।”৫০ তবে এ নাটক মুসলমানদের খুশি করতে পারেনি। “জনৈক মুসলমান সমালােচক এই নাটকের অভিনয় দেখিয়া আসিয়া ইহাতে মুসলমানদের খৰ্ব্ব করিয়া হিন্দুদের বড় করা হইয়াছে এইরূপ অভিমত প্রকাশ করিয়াছিলেন।”৫১ জনৈক ‘মুসলমান’-এর এই সমালােচনা অমূলক নয়। ‘দুর্গাদাস’ নাটকের দ্বিতীয় অভিনয়রজনীতে অভিনয়ান্তে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বন্ধু রাখালদাস চট্টোপাধ্যায় ‘Here is the author’ বলে দর্শকদের সমক্ষে উপস্থিত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে পরিচয় করিয়ে দিলে দর্শকমন্ডলী তাকে অভিবাদন করে উচ্চস্বরে, মিলিত কণ্ঠে তার নাট্যপ্রতিভার প্রশংসা করেন। অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহাসিক নাটক ‘সরােজিনী’র অভিনয়কালেও। নাটক দুটির দর্শকবৃন্দ রচয়িতাদের যে জন্য সপ্রশংস অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, তার মূলে ছিল নাট্যকারদ্বয়ের মুসলিম বৈরিতা রূপায়ণের দক্ষতা। প্রকৃতপথে একদিকে মুসলিম অপকৃষ্টতা ও বিদ্বেষ জাহির এবং অপরদিকে হিন্দু উৎকৃষ্টতা ও প্রশস্তি প্রচার ছিল নাটক দুটির মূলমন্ত্র।৫২
‘মেবার পতন’ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ক দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের আর একটি নাটক। এই নাটকে প্রথম দিকে ম্লেচ্ছ-বিরােধী হিন্দু জাতীয়তার সুর ছিল প্রবল। টড প্রণীত ‘রাজস্থান’ কাহিনি অবলম্বনে রচিত হলেও নাটকটি নাট্যকারের কল্পনার রঙে রঙীন। ইতিহাস এখানে সর্বত্র অনুসৃত হয়নি। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুসলমান চরিত্র মহব্বত খাঁ। ‘নুরজাহান’ নাটকের মহব্বত চরিত্রের সুচনা এই নাটকে। ধর্মান্তরিত মুসলমান মহব্বতের রাজপুত বিদ্বেষের মূলে অন্ধ ইসলাম-প্রীতি নয়, রাজপুতদের অন্ধ মুসলমান-বিদ্বেষেই বর্তমান। মহব্বত উচ্চাভিলাষী অথচ বিবেচক, প্রণয়ী। স্বজাতির প্রতি তার গভীর বিতৃষ ও গােপন অনুরাগ একত্রে মিলিত হয়ে চরিত্রটিকে এক দ্বন্দ্ব জটিল রূপ দান করেছে। কল্যাণীর প্রতি মহব্বতের প্রেম থাকা সত্ত্বেও তাকে জীবনে গ্রহণ করতে পারেনি সে। তবু, তার জন্য তার গভীর আকর্ষণ মহব্বত চরিত্রের সামগ্রিক কার্যধারাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ধর্মত্যাগী মহব্বত চরিত্রের সবচেয়ে দুর্বলতম অংশ কল্যাণীর প্রতি তার জাগ্রত প্রণয়।
যুদ্ধক্ষেত্রে কল্যাণী ও মহব্বত খাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। কল্যাণী মহব্বত খাঁর নিকট থেকে জানতে পারেন যে, তিনি স্বয়ং নিরীহ মেবারবাসীদের বধ করতে ও রাজপুত জাতির উচ্ছেদ করতে মুঘল সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কল্যাণী রাজপুত মহব্বত খাঁর এরূপ আচরণকে যেমন বিশ্বাস করতে চাননি, তেমনি তার নিকট থেকে এমন নিষ্ঠুর ব্যবহারও আশা করেননি। কল্যাণীর কথায়, হিন্দুদের ওপর প্রতিহিংসা যদি কেউ নিতে চায়, তবে যারা জাতিতে মুসলমান তারা নিতে পারে। স্বামীর প্রতি কল্যাণীর দীর্ঘদিনের লালিত শ্রদ্ধা বীতশ্রদ্ধায় পরিণত হয়। তিনি হতাশ ও কণ্ঠে বলেন,
“আমার মােহ ভেঙে গিয়েছে। আমি এতদিন আপনার পূজা করতাম, আজ আমি আপনাকে পরম শত্রু জ্ঞান করি। আমি মােগলকে তত শত্রু জ্ঞান করি না, যেমন আপনাকে করি। মােগল সেনাপতি! মােগল আমাদের কেউ নয়। তাদের ধর্ম শিক্ষা দেয়—কাফের বধ কর্তে। কিন্তু আপনি এই দেশের সন্তান, আপনার ধমনীতে বিশুদ্ধ রাজপুত রক্ত, আপনি তুচ্ছ রৌপ্যের লােভে, বিদ্বেষে, স্বজাতির উচ্ছেদ-সাধন কর্তে বসেছেন।…আপনি মােগলের উপরেও বাড়িয়েছেন। তারা চায় মেবার জয় কর্তে। তারা এই নিরীহ গ্রামবাসীদের ঘর জ্বালাতে চায়নি। আপনি তাদের সে ত্রুটিটুকু পূর্ণ কচ্ছেন। আপনি তাদের ধর্মের উচ্ছিষ্ট খেয়ে, আপনার এই হিংস্র সৈন্যদের—এই ঘৃণিত মাংসলােলুপ নরকুকুরদের এই নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন।”
ইসলাম ধর্ম কাফের বধ করার শিক্ষা দেয় বলে যে তথ্য উপস্থাপিত, তা অমূলক উক্তি। ইসলাম যদি এই শিক্ষাই দিত, তবে ভারতবর্ষে কাফেরের পথে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। কতকগুলি কাল্পনিক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে মহব্বত খাঁর চরিত্রটি। মহব্বত খাঁ ভারতীয় সন্তান এবং তার ধমনীতে বিশুদ্ধ রাজপুত রক্ত—এসব কথার কোনাে ভিত্তি নেই। মহব্বত খাঁ আফগান সন্তান—তার পিতার নাম গায়ুর বেগ—কথাগুলির সাক্ষ্য মেলে জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘তুযুক-ই জাহাঙ্গিরী’-তে। টডের অনুসরণে মহব্বত খাঁর ইসলাম ধর্মের উচ্ছিষ্ট খাওয়া বা তার বিরুদ্ধে হিন্দু স্বজাতির ‘উচ্ছেদসাধন’-এর অভিযােগ তাই নাট্যকারের কপােলকল্পনা।
হিন্দুধর্মের অনুদারতা যদিও মহব্বত খাঁর মেবার আক্রমণের অন্যতম কারণস্বরূপ উল্লিখিত, তবু তার ব্যক্তিগত স্বার্থ (মহব্বত খাঁর শ্বশুর গােবিন্দসিংহ মুসলমানদের প্রতি ঘৃণায় তার স্ত্রী কল্যাণীকে নির্বাসিত করেছিলেন, তাই তিনি এ কাজের প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য মেবারের বিপক্ষে অস্ত্রধারণ করেন) এ-কাজে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। মহব্বত খাঁ যে কল্যাণীর জন্যই এবং গােবিন্দসিংহের মুসলিম-বিদ্বেষের কারণেই মেবাবের হত্যাযজ্ঞে অবতীর্ণ হয়েছেন, একথা বােঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও কল্যাণী তা বিশ্বাস করেন না এবং মিথ্যা কথা বলে প্রত্যাখ্যান করেন। মহব্বত প্রত্যুত্তরে বলেন, মিথ্যা নয় কল্যাণী! যেদিন শুনলাম তােমার পিতা মুসলমানদের প্রতি ঘৃণায় তােমার নির্ব্বাসিত করেছেন, সেই দিন, সেই মুহূর্তে আমি মেবারের বিপক্ষে অস্ত্রধারণ করেছি।
কল্যাণী মহব্বত খাঁকে প্রশ্ন করেন, তাই যদি হয় তবে কোন্ ধর্মমতে আপনি একের অপরাধে একটা জাতির উচ্ছেদ সাধন কর্তে বসলেন। মহব্বত খাঁ উত্তরে কল্যাণীকে জানান, …এ মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ তােমার পিতার একার নয়। তােমার পিতা সমস্ত মুসলমান জাতির প্রতি সমস্ত হিন্দুর বিদ্বেষ উচ্চারণ করেছিলেন মাত্র, আমি হিন্দুর সেই জাতিগত বিদ্বেষের প্রতিহিংসা নিতে এসেছি।
উপরিউক্ত বক্তব্যে নাট্যকার হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের বাস্তব চিত্রও পরিবেশন করেছেন বটে, তবে সমস্ত মুসলমান জাতির প্রতি সমস্ত হিন্দুর বিদ্বেষ উচ্চারণ এবং মুসলমানদের প্রতি ‘ঘৃণায়’ কল্যাণীকে নির্বাসিত করার প্রতিহিংসা নেওয়ার সংকল্পের সাথে মহব্বত খাঁর মেবার অভিযানের সম্পর্ক ছিল না। জাহাঙ্গীর মহব্বত খাঁকে মেবার অভিযানে পাঠিয়েছিলেন তার সাম্রাজ্যবাদী নীতি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে। মহব্বত খাঁর মেবার আক্রমণের সঙ্গে কল্যাণী নামের কোনাে নারীও জড়িত ছিলেন না। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে সম্ভবত প্রভাবিত করেছিল বীরােদপ্রসাদ বিদ্যাবিনােদ রচিত ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকের কল্যাণী চরিত্রটি। ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকে শঙ্করের স্ত্রী কল্যাণীকে বন্দি করবার চেষ্টা ব্যর্থ হলে মােগল সেনাপতি শের খাঁ যেমন প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য যশাের আক্রমণ করেন এবং একমাত্র কল্যাণীকে কেন্দ্র করে উপস্থিত হয় মােগলের সঙ্গে সংঘর্ষ, তেমনি মােগল সেনাপতি মহব্বত খাঁ মেবারের বিপক্ষে অস্ত্রধারণ করেছিলেন স্ত্রী কল্যাণীর জন্য—‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকের মত ‘মেবার পতন’ নাটকেও যার মূলে কোনাে ঐতিহাসিকতা নেই।
সমগ্র ‘মেবার পতন’ নাটকে জাহাঙ্গীরের আবির্ভাব ঘটেছে মাত্র একবার—৩য় অঙ্কের ৫ম দৃশ্যে। জাহাঙ্গীরের প্রয়ােজন অপেক্ষে সগর সিংহের প্রয়ােজনে এবং তার মাহাত্ম্য, দেশপ্রেম, ধর্মানুরাগ প্রচার ও অতীত কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করবার স্বার্থে। সগরসিংহ মেবারের অতীত এবং বর্তমান গৌরব এক এক করে বর্ণনা করেন এবং অসীম ধৈর্য সহকারে তা শােনা ছাড়া জাহাঙ্গীরের যেন কাজ নেই। জাহাঙ্গীর বিবর্ণ এবং নাটকীয় প্রয়ােজনের দিক থেকে বর্জনীয়’ বলে সমালােচক অভিমত ব্যক্ত করেছেন।৫৩
শাহজাহানকেও নাটকে মাত্র একবারই দেখা যায়। কিন্তু স্বল্পকালীন উপস্থিতিতেই তিনি যে কাণ্ড করেন, তা অবিবাস্য ও অবাস্তব। সৈন্যাধ্যক্ষ্য হেদায়েত আলি চারণী সত্যবতীকে যে-গান বিদ্রোহের গান বলে গাইতে বাধা দেন, সেই গান দিল্লি সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী শাহজাহান ব্যক্তি স্বার্থ উপেক্ষা করে শুধু গাইতেই দেন না, নিজেও সে-গানে যােগ দেন। মহব্বত খাঁ মেবারের পল্লীগ্রাম যেভাবে ধ্বংস করেছিলেন, তার চেয়ে ভয়াবহতা নিয়ে খুররম মেবারের নিরীহ গ্রামবাসীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছিলেন। কিন্তু নাট্যকার ইতিহাসের সমর্থনে খুররমকে এই নৃশংস কাজে প্রবৃত্ত দেখাননি, বরং তার চরিত্রে অতি নাটকীয় ঔদার্য আরােপিত হয়েছে।
‘মেবার পতন’ নাটকে বিশ্বপ্রেমের মহানীতির কথা বলা হয়েছে, ‘মানুষ মাত্রকেই’ ভালবাসবার কথা আছে, পিপাসার্ত হেদায়েত আলিকে জল পান করানাে হয়েছে এবং সব মানুষ ঈশ্বরের সন্তান—এই আপ্তবাক্য উচ্চারিত হয়েছে। আবার গােবিন্দসিংহের তরবারি মুসলমানের রক্ত চায়—সেকথাও বলা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম ‘সেই একই ধর্মের সন্তান’ বলা হলেও এধর্মের উদারতাও স্বীকৃত হয়েছে, হিন্দুধর্মের অনুদারতায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। এসত্ত্বেও মেবার ও রাজপুতদের বড় করে দেখাবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এটা অবশ্য নাট্যকারের ওপর সমকালীন হিন্দু মানসিকতার প্রভাব ও ফল। তাহলেও হিন্দুধর্মের অনুদারতা ও মুসলিম বিদ্বেষ যে হিন্দু-মুসলিম, তথা বিশ্বপ্রেমের অন্তরায়, নাটকে তা পুনঃপুনঃ ব্যক্ত হয়েছে।
দ্বিজেন্দ্রলাল এ-নাটকে দেখিয়েছেন যে, হিন্দু-মুসলিম পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবােধ থাকলে মিলনে কোনাে অন্তরায় সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু পারিপার্শ্বিক, সামাজিক ও অতীত ঐতিহ্যের প্রতি অন্ধ মােহ তাদের পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। পরস্পরের সঙ্কীর্ণতা পরিহার করে শত্রুমিত্র জ্ঞান ভুলে গিয়ে, বিদ্বেষ বর্জন করে প্রকৃত মানুষ হয়ে পরস্পরকে ভাই বলে আলিঙ্গন করার মধ্যে নিহিত রয়েছে সত্যিকার মঙ্গল। ‘মেবার পতন’ নাটকে নাট্যকার এই বাণী প্রচারের প্রয়াস পেয়েছেন। আর এ-বক্তব্য উপস্থাপনে ও হিন্দু জয়গান উচ্চারণে মহব্বত খাঁ উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘নুরজাহান’, ‘সাজাহান’ ও ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক সম্পর্কে হয়তাে খুব বেশি অভিযােগ নেই। কিন্ত আলােচনার খাতিরে একথা বলতেই হয় ‘নুরজাহান’ নাটকে বেশ কিছু কিছু চরিত্রে এমন সংলাপ বলানাে হয়েছে তা অবশ্যই শ্রুতিকটু। যদিও নাটকে নাট্যকার চরিত্রের মুখ দিয়ে অনেক কিছু বলান। ‘নুরজাহান’ নাটকের তৃতীয় অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যে যখন নুরজাহান সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রেবাকে (রেবা রাজপুত কন্যা) বলেন—এই হিন্দু নারীর কাছে মাথা হেঁট করে রৈলে! স্বাভাবিকভাবে হিন্দু শ্রোতা বা দর্শকদের মন অন্যখাতে প্রবাহিত হয়। হিন্দু দর্শকের মনে মুসলিম বিদ্বেষী মনােভাব গড়ে ওঠে। আবার পঞ্চম অঙ্কের পঞ্চম দৃশ্যে কর্ণ যখন বলে—“কারণ আমি ভেবে দেখেছি—যত দিন আমরা হিন্দু জাতি আবার মানুষ না হতে পারি ততদিন হিন্দুর স্বাধীন সাম্রাজ্যাধিকার স্বপ্ন…। এই ধরনের সংলাপ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বা স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিকাতে হিন্দু জাতীয়তাবােধকে অবশ্যই প্রশ্রয় দেয়। তাছাড়া দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে খুব একটা উদারপন্থী বলা যায় না। মুসলিম আমলকে তিনি পরাধীনতা বলেই মনে করতেন। ‘জিজিয়া কর’ কবিতায় ৫০০ বছরের পরাধীনতার উল্লেখ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কিছু পরে স্বদেশি যুগের সময় লেখা তার নাটকগুলিতে সম্প্রদায়গত সংঘর্ষের ঐতিহাসিক কাহিনির মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রকাশ লক্ষ করা যায়।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. বঙ্গদর্শন, ভাদ্র ১২৮০।
- ২. রবার্ট মাইলস, রেসিজম, লন্ডন, ১৯৮৯, পৃ. ২৬৮।
- ৩. দিলওয়ার হােসেন, বাংলা উপন্যাসে মুঘল ইতিহাসের ব্যবহার, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৪, পৃ. ২৪।
- ৪. প্রণবরঞ্জন ঘােষ, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙ্গালীর সমাজ ও সাহিত্য, কলকাতা, ১৩৭৫, পৃ. ২১১।
- ৫. কালিকারঞ্জন কানুনগাে, রাজস্থানের কাহিনী, কলকাতা, ১৩৮৪, পৃ. ২।
- ৬. পি আর সেন, ওয়েস্টার্ণ ইনফ্লুয়েন্স ইন বেঙ্গল লিটারেচার, ১৯৬০, পৃ.২৫।
- ৭. এ বি এম হাবিবুল্লাহ, সমাজ সংস্কৃতি ও ইতিহাস, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৪, পৃ. ১৬৮।
- ৮. এ বি এম হাবিবুল্লাহ, সমাজ সংস্কৃতি ও ইতিহাস, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৪, পৃ. ১৬৮-৬৯।
- ৯. আনিসুজ্জামান সম্পাদিত, মুনির চৌধুরী রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৪, পৃ. ১৯৩।
- ১০. আনিসুজ্জামান সম্পাদিত, মুনির চৌধুরী রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৪, পৃ. ৪১০।
- ১১. বৈদ্যনাথ শীল, বাংলা সাহিত্যে নাটকের ধারা, দ্বিতীয় সংস্করণ, এ কে সরকার অ্যান্ড কোম্পানি, ১৩৭৭, কলকাতা, পৃ. ৩৮২।
- ১২. জেমস টড, রাজস্থান, খন্ড-১, লন্ডন, ১৯৬০, পৃ. ২৬২।
- ১৩. আশুতােষ ভট্টাচার্য, বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খন্ড, এ মুখার্জি অ্যান্ড কোম্পানি, প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৬০, পৃ. ৪০৩।
- ১৪. আর পি ত্রিপাঠী, রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার, ২য় সং, সেন্ট্রাল বুক ডিপাে, এলাহাবাদ, ১৯৬০, পৃ. ২৭৯।
- ১৫. VA Smith, Akbar The Great Mughal, S Chand, Delhi, 1962, P. 212-13.
- ১৬. VA Smith, Akbar The Great Mughal, S Chand, Delhi, 1962., P. 221.
- ১৭. প্রভাতকুমার গােস্বামী, দেশাত্মবােধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটক, সাহিত্য প্রকাশ, ১৩৮৫, পৃ. ২০৫।
- ১৮. স্ট্যানলি লেনপুল, আওরঙ্গজীব অ্যান্ড দ্য ডিকে অফ দ্যা মুঘল এম্পায়ার, সুনীতা পাবলিকেশন, দিল্লী, ১৯৮৭, পৃ-৬৪।
- ১৯. শিবলি নােমানী, আওরঙ্গজেব পর এক নজর, অনু ও হাসান আলি, আওরঙ্গজেবের চরিত্র বিচার, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮২, পৃ. ৬০-৬২।
- ২০. থাপার মুখিয়া ও চন্দ্র, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃ. ৪১।
- ২১. থাপার মুখিয়া ও চন্দ্র, থাপার মুখিয়া ও চন্দ্র, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃ.২৭।
- ২২. থাপার মুখিয়া ও চন্দ্র, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃ. ৪৫।
- ২৩. ভি ডি মহাজন, মুঘল রুল ইন ইন্ডিয়া, রামনগর, এস চাদ, ১৯৯২, পৃ. ১৮১।
- ২৪. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ‘হিন্দুর মুখে আরঞ্জেবের কথা’, প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩২২, ১ম খণ্ড, ২য় সংখ্যা, পৃ. ২৯৫।
- ২৫. যদুনাথ সরকার, হিস্ট্রি অফ আওরঙ্গজেব, খন্ড-২, ওরিয়েন্ট লংম্যান, বম্বে, পৃ.২৯৫।
- ২৬. জার্নাল অফ পাকিস্তান হিস্টোরিক্যাল সােসাইটি, খন্ড-৪, পার্ট-২, এপ্রিল, ১৯৫৮ পৃ. ১২৪-২৫।
- ২৭. স্ট্যানলি লেনপুল, আওরঙ্গজীব অ্যান্ড দ্য ডিকে অফ দ্যা মুঘল এম্পায়ার, সুনীতা পাবলিকেশন, দিল্লী, ১৯৮৭, পৃ.৬৯ – ৭১।
- ২৮. মুহম্মদ আব্দুল জলিল, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, পাবনা, ১৯৮৩, পৃ. ৪৯-৫০।
- ২৯. ভি ডি মহাজন, মুঘল রুল ইন ইন্ডিয়া, রামনগর, এস চাদ, ১৯৯২, পৃ. ১৮২।
- ৩০. এনামুল হক, মুসলিম বাংলা সাহিত্য, পাকিস্তান পাবলিকেশন, ১৯৬৫, ঢাকা, পৃ.১২২।।
- ৩১. দিলওয়ার হােসেন, বাংলা উপন্যাসে মুঘল ইতিহাসের ব্যবহার, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৪, পৃ. ৭।।
- ৩২. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ‘হিন্দুর মুখে আরঞ্জেবের কথা’, প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩২২, ১ম খণ্ড, ২য় সংখ্যা, পৃ. ২৯২।
- ৩৩. শিপ্রা রক্ষিত দস্তিদার, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সাহিত্যকর্ম, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯২, পৃ. ৩১৬।
- ৩৪. স্ট্যানলি লেনপুল, আওরঙ্গজীব অ্যান্ড দ্য ডিকে অফ দ্যা মুঘল এম্পায়ার, সুনীতা পাবলিকেশন, দিল্লী, ১৯৮৭, পৃ. ৬৫।
- ৩৫. থাপার মুখিয়া ও চন্দ্র, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃ. ৪৬।
- ৩৬. মানুচি, মুঘল ইন্ডিয়া ১৬৫৩-১৭০৮, খন্ড-২, ওরিয়েন্টাল বুকস, দিল্লি, পৃ. ২৩৪।
- ৩৭. ভি ডি মহাজন, মুঘল রুল ইন ইন্ডিয়া, রামনগর, এস চাদ, ১৯৯২, পৃ. ৩৬৩।
- ৩৮. থাপার মুখিয়া চন্দ্র, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃ. ৫১-৫২।
- ৩৯. জেমস টড, রাজস্থান, খন্ড-১, লন্ডন, ১৯৬০, পৃ. ৩০৯।
- ৪০. জেমস টড, রাজস্থান, খন্ড-১, লন্ডন, ১৯৬০, পৃ. ৩১৩।
- ৪১. যদুনাথ সরকার, হিস্ট্রি অফ আওরঙ্গজেব, খন্ড-৩, ওরিয়েন্ট লংম্যান, বম্বে, পৃ. ২৪৫।
- ৪২. যদুনাথ সরকার, হিস্ট্রি অফ আওরঙ্গজেব, খন্ড-৩, ওরিয়েন্ট লংম্যান, বম্বে, পৃ. ২৪৬।
- ৪৩. যদুনাথ সরকার, হিস্ট্রি অফ আওরঙ্গজেব, খন্ড-৪, ওরিয়েন্ট লংম্যান, বােম্বে, ১৯৭১, পৃ. ২০৭।
- ৪৪. সুকুমার সেন, বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খন্ড, ইস্টার্ন পাবলিশার্স, ১৩৭৭, কলকাতা, পৃ. ৩৭০।
- ৪৫. সুবােধচন্দ্র সেনগুপ্ত, নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল, এ মুখার্জী অ্যান্ড কোং, কলকাতা, ১৩৭৯, পৃ. ১১৪।।
- ৪৬. সুবােধচন্দ্র সেনগুপ্ত, নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল, এ মুখার্জী অ্যান্ড কোং, কলকাতা, ১৩৭৯, পৃ. ১১৪-১১৫।।
- ৪৭. প্রফুল্লকুমার সরকার, বঙ্গদর্শন, জ্যেষ্ঠ ১৩২০।
- ৪৮. দ্বিজেন্দ্র রচনাবলী, ১ম খন্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৬৪, ভূমিকা, পৃ. বত্রিশ।
- ৪৯. উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ, দ্বিজেন্দ্রলাল, শিশির পাবলিশিং, কলকাতা, ১৩২৬, পৃ. ১৪৫-৪৬।
- ৫০. উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ, দ্বিজেন্দ্রলাল, শিশির পাবলিশিং, কলকাতা, ১৩২৬, পৃ. ১৪৫-৪৬।
- ৫১. উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ, দ্বিজেন্দ্রলাল, শিশির পাবলিশিং, কলকাতা, ১৩২৬, পৃ. ১৪৬।
- ৫২. শামসুল হক, বাংলা ঐতিহাসিক নাটকে মুসলিম চরিত্র ও প্রসঙ্গ, গ্রীন পাবলিশার্স, ২০০০, পৃ. ৬৮।
- ৫৩. ক্ষেত্র গুপ্ত ও জ্যোৎস্না গুপ্ত, বাংলা নাটকের আলােচনা, ১ম খন্ড, গ্রন্থ নিলয়, কলকাতা, পৃ. ২৬।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।