লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
সেদিন (২০১২-র জানুয়ারিতে) রামমোহন রায় মেলা উপলক্ষে রামমোহন রায়ের জন্মস্থানে রাধানগর গিয়েছিলাম। যাওয়াটা খুব আরামের ছিল না। দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে হাওড়া জেলার ভিতর দিয়ে হুগলি জেলাতে পৌঁছে বিতর্ক-বিখ্যাত সিঙ্গুর ছাড়িয়ে বঁদিকে ঘুরে তারকেশ্বরে গিয়ে দু’ধারে আলুর খেত রেখে আরামবাগ মহকুমার চাপাডাঙার মোড়ে আবার দিক পাল্টে মায়াপুরে গিয়ে ফের বাঁদিকে সতেরো কিলোমিটার এগিয়ে নাঙ্গুলপাড়া হয়ে রামনগর থেকে আর এক দফা বাঁয়ে ঘুরে প্রায় চার ঘন্টা সুমো মোটরে বসে থাকার পরে পা রাখলাম রাধানগরের মাটিতে।
এই মাটিতে জন্মেছিলেন রামমোহন রায় দু’শো চল্লিশ বছর আগে এক গীষ্মকালে। দিনে দিনে বছরে বছরে শিশু থেকে বালক হলেন। কেমন ছিল তার বাল্যকাল? কারা ছিল তার বাল্যসঙ্গী? তাদের সঙ্গে কোন্ কোন্ খেলা করতেন? সঙ্গীদের সঙ্গে খেলতেন, নাকি একা একা নির্জনে বসে এই গাছপালা, নদীনালা দূরের আকাশ দিবারাত্রির সৃষ্টি রহস্য নিয়ে ভাবতেন? তারপর পুরাকালে মাতৃক্রোড় বা পিতৃগৃহ ছেড়ে বালকেরা যেমন গুরুগৃহে বিদ্যার্জনের জন্য যেত তেমনই ভাবে তখনকার শিক্ষিতদের ভাষা ফার্সি ভাল করে শিখতে একা একা কোন পথে কোন যানবাহনে কী মালপত্র নিয়ে কোন্ গঙ্গারঘাটের উদ্দেশে রওনা হলেন পাটনাতে যাওয়ার জন্য? অচেনা সমাজে নতুন জগতে যেতে বালক রামমােহনের মনে কি কোনও দ্বিধা, কোনও শঙ্কা জাগেনি? পাটনায় কার বা কাদের সঙ্গে ছিলেন? নতুন পরিবেশে কীভাবে কতটা মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন?
পাটনাতে রামমোহন রায় ফার্সির সঙ্গে আররিও শিখেছিলেন এবং আরবিতে অ্যারিস্টটল– ইউক্লিড প্রভৃতি অধ্যয়নের সঙ্গে কোরআন পাঠ করেছিলেন। তার স্বভাবজ মনন ছিল বিশেষভারে বিচারপ্রবণ। সেই বিচারশীলতা থেকে তিনি ঈশ্বরের নানারকম আকার ধারণের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, লাভ করেন নিরাকার ঈশ্বরের উপলব্ধি আর সেই উপলব্ধিতে পান কোরআন-এর সমর্থন। বাড়িতে ফিরে এলে পিতামাতা দেখেন ছেলে পরিবারের ধর্মবিশ্বাস থেকে দূরে চলে গিয়েছে। তখন পরিবার থেকে তাকে বারাণসীতে পাঠালো হল পারিবারিক ধর্মীয় সংস্কারের বলয়ে ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু সেখানে গিয়ে বাংলার বিস্মৃত বেদান্ত আবিষ্কার ও অধ্যয়ন করে নিরাকার ঈশ্বরের পুনর্বার সমর্থন লাভ করলেন। স্বগৃহে ফিরে এলে স্বভাবতই ধর্ম সংক্রান্ত পারিবারিক বিশ্বাস ও সংস্কারের সঙ্গে তার বিরোধ বাধল।
তখন গৃহত্যাগ করে রামমোহন রায় নানা স্থানে পর্যটনের সুবাদে দেশের বিভিন্ন রকম জীবনযাত্রা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের সঙ্গে মানুষের দুর্দশাও দেখেন এবং তা দেখে কোম্পানি সাহেবদের প্রতি তার প্রবল বিরূপতা জাগে। পিতার অনুরােধে গৃহে ফিরে জীবিকার্জনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তখন জন ডিগবির মতো ইউরোপীয় সাহেবদের সংস্পর্শে এসে তাদের গুণের প্রতি আকৃষ্ট হন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর উন্মেষলগ্নে মুর্শিদাবাদে কর্মোপলক্ষে থাকাকালে রামমোহন রায় ‘তোহফত-উল-মুওয়াহিদিন’ অর্থাৎ একেশ্বরবাদীদের প্রতি তোফা বা উপহার নামে একটি পুস্তিকা লেখেন। পুস্তিকাটির প্রস্তাবনা অংশ উচ্চশিক্ষিতদের জন্য আরবিতে এবং মূল অংশ সাধারণ শিক্ষিতদের জন্য ফার্সিতে লেখা। আরবের যুক্তিবাদী মুতাজিলাদের বিচাররীতি অনুসারে প্রস্তাবনাতে তিনি এই বক্তব্য উপস্থাপন করেন যে যখন সকলেই দাবি করে যে নিজের ধর্মই সত্য আর অপরের ধর্ম ভ্রান্ত তখন সব ধর্মেই কিছু সত্য আর কিছু ভ্রান্তি আছে। এর পর ফার্সিতে তিনি এই বক্তব্যটাকে ব্যাখ্যা করে লেখেন যে এমন পরিস্থিতিতে কারও মনে আঘাত না দেওয়ার নীতি অবলম্বন করে বিশ্বমানবকে শান্তি দেওয়ার ধর্ম পালন করাই বাঞ্ছনীয়। সমগ্র মানব সমাজের জন্য এক ধর্ম এবং তা হবে শান্তির ধর্ম এই ঘোষণা দিয়েই রামমােহনের জীবনব্রত সাধনার শুরু। এখানে বলে রাখা ভালো যে ভারতীয় ধর্মসাধনার ইতিহাসে ‘বিশ্বমানব’-এর কল্পনা ও ধারণা এ যাবৎ ছিল অজানা, এই প্রথম ‘বিশ্বমানব’-এর আগমন ঘটল।
রামমোহন রায়ের বাল্যকাল যেমন অনুমানে অস্পষ্ট, তেমনই তার জীবনের ১৮০৪ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত দশটা বছরও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত তথ্যাবলিতে আচ্ছন্ন। যেখানে শিক্ষিত সমাজের ভাষা ফার্সি সেখানে কেন তিনি এমন গদ্য ভাষাতে শঙ্করাচার্যের আদর্শে বেদান্ত গ্রন্থ লিখছেন যে গদ্য ভাষার পঠনরীতি ১৮১৫ পর্যন্ত অজ্ঞাত ছিল বলে গ্রন্থের শুরুতেই অনুষ্ঠান শিরোনামে ব্যাখ্যা করতে হয়। একই সঙ্গে ‘বেদান্ত গ্ৰন্থ’ এর মূল কথাটা সহজ ও সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করলেন ‘বেদান্ত সার’ গ্রন্থে। প্রচলিত পৌরাণিক ধর্মকে পরিত্যাগ করে তিনি যে প্রাচীন বৈদান্তিক ধর্মকে অবলম্বন করলেন এটারও তাৎপর্য গভীর। ১৮১৫ একটা সাল-ফলক। ওই বছরেই বাংলা গদ্যের জন্ম ঘোষণা এবং বাংলায় বেদান্ত চর্চার সূচনা।
আর একটি সাল-ফলক ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দ। এই সালে কোম্পানি সরকার এক প্রেস অর্ডিন্যান্স জারি করে মূলত ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ ও অন্যান্য ইংরেজি সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য। কিন্তু তার প্রতিবাদ করে ইংল্যান্ডের রাজাকে এক দীর্ঘ পত্র লেখেন রামমোহন রায়। সেই ঐতিহাসিক পত্রের মূলকথা হল দেশে সুশাসন ও সুখশান্তির জন্য শাসক শাসিতর মধ্যে সম্পর্ক ও সংলাপের ভিত্তি হল সংবাদপত্র, কেননা শাসিতদের যথার্থ অবস্থা ও অভাব-অভিযােগের কথা সংবাদপত্রের পথেই শাসকের কাছে পৌঁছয়, ওই পথ রুদ্ধ হলে শাসক জানতে পারবে না শাসিতের প্রয়োজনাদি, তাদের দুঃখ দুর্দশার প্রতিকার করতে পারবে না, তখন শাসিতের বিক্ষোভ জমে জমে ঘটে সশস্ত্র অশান্তি বা বিপ্লব। রামমোহন রায়ই প্রথম ভারতীয়, যিনি শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক ও সংলাপকে দেশে শান্তি রক্ষার শর্তরূপে উপস্থাপন করেন।
রামমোহন রায়ের ধর্ম ছিল বিশ্বমানবকে শান্তি দেওয়ার ধর্ম, সব ধর্মের সব বর্ণের সব জাতির মানবিকবাদ। সেজন্য তিনি ১৭৫০ শকাব্দের ১১ মাঘ জোড়াসাঁকোর চিৎপুর রোডে ব্রাহ্ম সমাজের নামে কেনা জমিতে নাগরিক জনতার মধ্যে নিভৃতে সৃষ্টিস্রষ্টার রহস্য নিয়ে চিন্তা করার জন্য এবং বিশ্বমানবের শান্তি কামনা করার জন্য এক গৃহ নির্মাণ করেন। আগে কখনও অন্য কোথাও জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সমস্ত রকম মানুষের জন্য কোনও গৃহের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে বলে জানি না।
যেখানে সমস্ত মানুষ স্বাগত তেমন একটি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠা করার পরে রাঢ় বাংলার এক অজ পাড়াগাঁর ছেলে রামমোহন রায় একদিন কালাপানির ঢেউয়ে দুলতে দুলতে চললেন ইংল্যান্ডে। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ইউরোপের মাটিতে পদার্পণ করে সেখানকার বুদ্ধিজীবী সমাজে আলোড়ন তোলেন এবং চর্চার বিষয় হয়ে ওঠেন। বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে রামমোহন রায় ১৮৩১ সালে ফ্রান্সের বিদেশমন্ত্রীকে এক অভিনব প্রস্তাব প্রেরণ করেন বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিবাদ নিরসন ও সমস্যা সমাধানের তথা বিশ্বশান্তির পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য এক সংস্থা স্থাপনের ঐতিহাসিক প্রস্তাব। এই প্রস্তাবের মূলে ছিল যে কল্পনা তা-ই বাস্তব রূপ পায় প্রথম মহাযুদ্ধের পরে ১৯১৯এ প্যারিস কনফারেন্স-এ গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে গঠিত লিগ অব নেশনস-এ।
রামমোহন রায় মেলার সেমিনার সেরে গাড়িতে চড়ে ফেরার সময় শীতের সন্ধ্যা পথটাকে অন্ধকারে দুর্গম করে দিয়েছিল। সেই মানুষটির কথা ভেবে হতবুদ্ধি হয়ে যাচ্ছিলাম, যিনি ১৭৮০-৮১ সালে এই গভীর অভ্যন্তরে অবস্থিত রাধানগর থেকে যাত্রা শুরু করে ১৮৩০ সালে পালতোলা জাহাজে চড়ে পৃথিবীর অপর প্রান্তে পৌছে বিশ্বশান্তির চিন্তা করতে করতে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত ব্রিস্টলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।