লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার রেনেসাঁ নিয়ে বিস্তর বৃত্তান্ত প্রকাশিত হয়েছে। এইসব বৃত্তান্তে যাঁদের কথা পড়ি তাদের ধর্মীয় পরিচয় খুঁজলে দেখব তারা সকলেই হয় হিন্দু নয় ব্রাহ্মন, নয় খ্রিস্টান। এটা লক্ষণীয় যে যখন স্বামী বিবেকান্দের অভিযানে হিন্দু ধর্ম আমেরিকা ইউরোপ জয় করে বেড়াচ্ছে তখনই ইসলাম ধর্ম নীরবে গ্রাম বাংলা জয় করে নিয়েছে। তাই বিংশ শতাব্দীর প্রথম জন-গনণাতেই দেখা গেল বাংলায় মুসলমানের সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা, তারপর বিহার-ওড়িশা বাংলা থেকে বাদ দেওয়ার ফলে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল বাঙালি মুসলমান। অথচ বাংলার রেনেসাঁসের লিখিত ইতিহাসে এই বাঙালি মুসলমান একেবারে গরহাজির। তাই কোনও ঐতিহাসিক ইউরোপীয় রেনেসাঁসের তুলনায় বাংলার রেনেসাঁসকে মুষ্টিমেয় হিন্দু ভদ্রলোকের কাণ্ড বলে খাটো করার চেষ্টা করেছেন। এই ঐতিহাসিকরা খোঁজ করে দেখেননি ইউরোপের মহান রেনেসাঁ আসলে ছিল শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান মুষ্টিমেয় ধনী বণিক পরিবারের পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং তুলনায় বাংলার রেনেসাঁ কত বিস্তৃত ছিল বাস্তবে। যেমন বাংলায় নারীর অধিকার ও আত্মপ্রকাশের যে ইতিহাস শুরু হয়েছিল তার তুলনা অন্যত্র পাই না, এমনকী শহর কলকাতা থেকে অনেক দুরে কুমিল্লায় সেই ১৮৭৩ সালে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানি নামে ৩৯ বছর বয়স্কা এক জমিদার-কন্যা দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ১৯১৫ সালে তিনি পশ্চিমগাঁও গ্রামে এমন একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন যা ইংরেজি শিক্ষাকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে ও পরবর্তীকালে উন্নীত হয় ডিগ্রি কলেজে। নারীশিক্ষার জন্য তার ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে ইংল্যাণ্ডের রানি ভিক্টোরিয়া তাকে নবাব খেতাব দিয়েছিলেন। বাংলার রেনেসাঁর ইতিহাসে কেন তার নাম থাকবে না? কিংবা খুজিস্তা আখতার বানুর (যিনি ১৯০৯ – এ সুহরাবর্দিয়া বেগম মুসলিম গার্লস স্কুলে মুসলিম তামাদ্দুনের সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তন করেছিলেন) অথবা বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের নাম কেন নেই? বিখ্যাত ঐতিহাসিকরা জবাব দেবেন কি?
শিক্ষাই ছিল বাংলার রেনেসাঁর মূল কারণ। শিক্ষা ব্যাপারটা যে কত জরুরি তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরুর পর্বেই যিনি বুঝেছিলেন তিনি হাজি মহম্মদ মহসিন। শিক্ষার জন্য তিনি সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অগেই মহসিন তহবিল গড়েছিলেন যার পরিচালনের জন্য ট্রাস্টের সদস্যদর মৃত্যুর পর সেই তহবিল চলে যায় সরকারবাহাদুরের হাতে। ঠিক কথা যে-শিক্ষার জন্য তিনি ওই তহবিল গড়েছিলেন তা আধুনিক শিক্ষা নয়, আর অষ্টাদশ শতাব্দীতে আধুনিক শিক্ষার আলো ভারতের কোনওখানেই ফোটেনি। তবে শিক্ষা শিক্ষাই। চলতি শিক্ষা থেকেই জাগে নতুন শিক্ষার জন্য আগ্রহ। রামমোহন তো ফারসি শেখার জন্য পাটনা সাহেবে গিয়েছিলেন, ফারসির সঙ্গে তিনি আরবিও শিখলেন, তার পর বারাণসীতে গিয়ে শিখলেন সংস্কৃত, এবার ডিগবির কাছে চাকরি করতে করতে শিখে ফেললেন ইংরেজিও, অবশেষে আধুনিক শিক্ষার জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিলেন, কিন্তু তার রূপায়ণে হিন্দু রক্ষণশীলদের পক্ষ থেকে বাধা পেয়ে তিনি নিজেই সরে আসেন প্রকল্পটি থেকে। কিন্তু আধুনিক তথা ইংরেজি শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত এই হিন্দু কলেজে মুসলমানদের প্রবেশধিকার ছিল না। যখন ১৮৩৮ সালে ফারসির বদলে ইংরেজিকে সরকারি ভাষা করা হল তখন অনিবার্যভাবেই হিন্দু কলেজে শিক্ষিত হিন্দু যুবকদের সামনে যেমন খুলে গেল সৌভাগ্যের দরজা তেমনই ইংরেজি শিক্ষাহীন মুসলমানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেল।
অতঃপর মুসলমান সমাজের মধ্যেই জাগল আধুনিক শিক্ষার জন্য আগ্রহ। নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলি, মৌলানা ওবায়েদুল্লাহ সুহরাবর্দি, নবাব খাজা আবদুল গনি প্রমুখ মফস্বল বাংলায় এমন বহু মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন যেগুলির শিক্ষাক্রমের মধ্যে আধুনিক শিক্ষাও ছিল। সৈয়দ আমির আলি তো মাদ্রাসা শিক্ষাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আধুনিক শিক্ষার একজন প্রধান বক্তা ছিলেন। তবে এঁদের শিক্ষা প্রসারের মূল ক্ষেত্র ছিল কলকাতা শহরের বাইরে বিস্তৃত মফস্বল বাংলা। এখানে একটা বাপার বোঝা প্রয়োজন। গ্রামবাংলা মানে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, যারা কৃষিজীবী। তারা আধুনিক শিক্ষা অর্জন করে কি হাতের কাজ ছেড়ে শহরে গিয়ে খাতার কাজ খুঁজবে? এখানে গ্রাম ও শহরের পার্থক্যের প্রশ্ন এসে যায়। ব্যাপার এই রকমই দাড়ায় যে, বাসস্থানের ক্ষেত্রে, ধর্মের ক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রে, জীবিকার ক্ষেত্রে সব ক্ষেত্রেই বিভেদ দেখা যায়। শহরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে দেখা যায় ইংরেজিতে অশিক্ষিত মুসলমান কৃষকের প্রতি তাচ্ছিল্য এবং তাদের শোষণ করার মানসিকতা। অনেক সমাবিজ্ঞানী বলেন যে, ইংরেজরা মুসলমানের হুকুমত কেড়ে নিয়েছে বলে তাদের ভাষা মুসলমানরা শিখতে চায়নি। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে ইংরেজি শিক্ষা তাদের কৃষিভিত্তিক জীবিকার জন্য অপ্রাসঙ্গিক হবে বলেই গ্রামের কৃষিজীবী মুসলমান ইংরেজি শেখার তাগিদ বোধ করেনি। আর স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষায় হিন্দু বাবুরাও মুসলমানদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে মুসলমানরা পেশিশক্তিতে বিশিষ্ট তথা মেধাশক্তিতে বঞ্চিত। অর্থাৎ একজনের গতরের কাজ অন্যজনের জন্য মগজের কাজ।
কিন্তু দেশভাগের পরে, বিশেষত বাংলাদেশের জন্মলগ্নে, বাঙালি মুসলমান পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছে, স্বামী বিবেকানন্দ যা-ই বলুন, যেমন গতরে তেমনই মননে তার মধ্যে কী দারুণ ক্ষমতা কী বিপুল সম্ভাবনা ঘুমিয়ে ছিল। তার ফল দাঁড়িয়েছে আমেদাবাদ-হায়দরাবাদেও এখন অনেক সাধারণ মানুষ বাঙালিমাত্রকে বাংলাদেশি ভাবে। আমার মনে আছে ১৯৮৫-তে মুম্বইয়ে আমাকে উগ্রভাবে এক মারাঠি যুবক জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, কেন আমি নিজের দেশ ছেড়ে হিন্দুস্থানে ভিড় বাড়াচ্ছি। তাকে বোঝাতে আমার মারাঠি বন্ধুর সময় লেগেছিল যে, ইন্ডিয়াতেও বাঙালিদের অর্ধাংশ থাকে ও তাদের অধিকাংশই হিন্দু। আমেরিকা-ইউরোপে এখনও অনেকে ভাবে যে যারা বাঙালি তারাই বাংলাদেশি। বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমান যে বাঙালিকে কোন গৌরবের জায়গায় পৌছে দিয়েছে তা বিদেশের প্রাঙ্গণে না গেলে বোঝা কঠিন। অথচ ভারতের বাঙালি মুসলমানকে বলা হচ্ছে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ। এমনকী পশ্চিমবঙ্গের অনেক বাঙালি মুসলমানও নিজেদের পিছিয়ে পড়া মানুষ বলে উল্লেখ করে। এটা ঠিক যে, আর্থিকভাবে বাঙালি মুসলমান পিছিয়ে পড়া অংশ। চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রেও বাংলা মুসলমানের হাল খুবই খারাপ। কিন্তু শিক্ষা ও মেধার ক্ষেত্রে? কিংবা সৃষ্টিশীল সংস্কৃতির ক্ষেত্রে?
এটা ঠিক যে, দেশভাগের সময় যেসব মেধবী শিক্ষিত ও সংস্কৃতিসম্পন্ন বাঙালি। মুসলমান পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন তাদের অধিকাংশই পূর্ববঙ্গের পাকিস্তানে চলে যান, আবার আবদুল ওদুদ, সৈয়দ মুজতবা আলি, হুমায়ুন কবীর প্রমুখপূর্ববঙ্গে জন্মেও থেকে যান ভারতে। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, এপার বাংলায় তারাই থেকে যান যাঁদের ওপার বাংলায় যাওয়ার মতো জায়গা ছিল না, যাদের অধিকাংশই কৃষিজীবী, বিত্তহীন ও শিক্ষাহীন। স্বভাবতই তারা সন্ত্রস্ত ছিলেন এবং যাতে এপার বাংলার প্রভাবশালী অংশের দৃষ্টিগোচর না হন সে ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। কিন্তু প্রতিবেশে বাংলাদেশের পরে এবং বিশেষত ভারতের সংবিধানে ‘সেকিউলার’ শব্দটি সংযোজিত হওয়ার পরে ভারতের বাঙালি মুসলমানও যথেষ্ট বিশ্বাস ও সাহস লাভ করে এবং বুঝতে পারে যে ভারতের অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও অন্যান্য ভাষাভাষী নাগরিকদের সঙ্গে তাকে প্রতিযোগিতাতে নামতে হবে আর তার জন্য চাই আধুনিক শিক্ষা, চাই আধুনিক কলাকুশলতা, চাই সৃষ্টিশীল সংস্কৃতির চর্চা।
ইতিমধ্যে পূর্ববাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তুরাও পশ্চিমবঙ্গের কোনো নিজস্ব জীবন ও সংস্কৃতিচর্চা শুরু করে দেয়, পেরিয়ে আসে জন্মভূমি ছেড়ে আসার তিক্ততার পর্ব এবং তাদের মধ্যে অনেকে ভারতের মাটিতে চাকরি-বাকরি সমৃদ্ধি সম্মান পেতে শুরু করেন। ১৯৭৬ সালের মধ্যে উদ্বাস্তুদের থেকে এক নতুন বিশাল যুবসমাজ পশ্চিমবাংলায় মাটিতে জীবনসংগ্রাম শুরু করে যাদের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে। তাদের ক্ষেত্রে আর উদ্বাস্তু কথাটা খাটে না। আবার একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে ঘটে একচেটিয়া কংগ্রেসি শাসনের অবসান। মোটের উপর সাতের দশকে পশ্চিমবাংলায় বাস্তবতায় ঘটে এক বিরাট পরিবর্তন। এবং আটের দশক থেকে ভারতের বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে শুরু হয় এক নিঃশব্দ বিপ্লব। গ্রামে গ্রামে স্থাপিত হতে থাকে এমন সব বিদ্যালয় যেগুলোতে আরবি ও মুসলমানি শিক্ষা ছাড়াও বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদি পড়ানো শুরু হল। রাজনীতির বাইরে বাঙালি মুসলমানকে জীবনযুদ্ধের ক্ষেত্রে এগিয়ে দেওয়ার বাইরে মোস্তাক হোসেন একটা অত্যন্ত অর্থপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ‘আলোর নীচে আঁধার’ এবং ‘গুহার ভেতরে আলো’ পুস্তিকা দুটি লিখে আর হাওড়া জেলায় আল-আমীন মিশন প্রতিষ্ঠার প্রেরণা ও সাহায্য করেন।
মোস্তাক হোসেনের দৃষ্টান্তে আধুনিক শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাঙালি মুসলমান সমাজে সাড়া পড়ে যায়। এই মুহূর্তে মফসল বাংলার গ্রামে গ্রামে ভিতরে ভিতরে বাঙালি মুসলমানদের উদ্যোগে স্থাপিত বিদ্যালয়ের ঠিক সংখ্যা আমার জানা নেই। তবে হাওড়া জেলায় অপর আরেকটি উল্লেখযোগ্য মওলানা আজাদ অ্যাকাডেমি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার শিশু বিকাশ অ্যাকাডেমি, উত্তর চব্বিশ পরগনার আল-হিলাল মিশন, বর্ধমানের মামূন ন্যাশনাল স্কুল, নদিয়ার মৌলানা আবুল কালাম আজাদ মিশন, মুর্শিদাবাদের আজাদ মিশন আর আল-হিলাল মিশন বালিকা, মালদহের মহবতপুর কচিকাচা মিশন প্রভৃতি এবং এইরকম আরও অনেক মিশন স্কুল গ্রামবাংলার জীবনে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। অধিকাংশই আবাসিক এবং অধিকাংশ স্কুলেই বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বালক-বালিকা একসঙ্গে পড়াশোনা করে। তিরিশ বছর আগে গ্রামীণ সমাজে আধুনিক বিদ্যাচর্চার যে-মূল্য ছিল তার আমূল রূপান্তর হয়েছে। গত ছ-সাত বছরে বাংলার মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও জয়েন্ট এন্ট্রান্সের কৃতী ছাত্রদের তালিকার দিকে তাকালেই দেখব যে আমাদের শহুরে সম্রান্ত সম্পন্ন চোখের আড়ালে বাঙালি মুসলমান ছেলেমেয়েরা কেমন চুপিচুপি নিজেদের সাফল্যের জায়গা করে নিচ্ছে।
তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে বাঙালি মুসলমান সমাজে যে-মৌল পরিবর্তন ঘটছে সেই ঘটনাবলীর পিছনে সরকারের কোনো অবদান বা কোনো ভূমিকা আছে কি না। ২০০৪ এ নিযুক্ত রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন অথবা ২০০৫-এ নিযুক্ত রাজেন্দ্র সাচার কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে বাঙালি মুসলমানের সমাজে উন্নতিসাধনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের কোনো উদ্যোগই ছিল না। উল্লেখিত বিদ্যালয়গুলির একটি সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছিল, তার জবাবে রাজ্য সরকারের কোনো আমলা জানতে চেয়েছিলেন যে বিদ্যালয়টিতে কোনো বিশেষ ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয় কি না, অথচ বিদ্যালয়টি মধ্যশিক্ষা পর্ষদ অনুমোদিত। অর্থাৎ সরকারি আমলাদের মধ্যে স্কুলের প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারির মুসলমান নাম থাকলেই সন্দেহ জাগে যে, কী ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয় এখানে অথবা আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে হরেক বাহানাতে দেরি করা হয়। একটা আবার সরকারি হুজুগ উঠল যে, মুসলমান প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে সন্ত্রাসবাদী গড়ে তোলা হচ্ছে। অনেককে গ্রেপ্তারও করা হল আবার তাদের ছেড়ে দিতেও হল। গত কয়েক বছরে শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলমান ছেলেমেয়েদের সাফল্যের যে-হার দেখা যাচ্ছে তার কোনো প্রতিফলন কিন্তু চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। এমনকী সিদ্ধার্থশঙ্করের আমলে চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের যে অবস্থান ছিল তা বাম জমানার ক্ষেত্রে শোচনীয় রূপ নিয়েছিল। নির্বাচন সামনে এসে পড়ার পরে ছবিটাকে পাল্টানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু এ কাজ শুরু হল মাথার উপরে সমন এসে পড়ার পরে। বামফ্রন্টের নেতাদের মধ্যেও গুরুত্ব প্রদানের ব্যাপারে মুসলমানরা অবহেলিত। যদি কোনো বিচক্ষণ ব্যক্তি বা মাটির কাছের মানুষ মুসলমান হন তবে তার সুপরামর্শ বিবেচনা করার সংস্কৃতি আমাদের নেই। অবশ্য আমাদের বলতে রাজ্য শাসনের ক্ষমতার জন্য ক্ষুধার্ত সমস্ত রাজনৈতিক দলের কথাই বলছি। নির্বাচন এসে পড়ার ফলে সব রাজনৈতিক দলই এখন মুসলমান ও অন্যান্য সঙঘবাদী সম্প্রদায়কে খুশি করার দৌড়পাল্লায় নেমে পড়েছে। এটাই আমাদের ট্রাজেডি!
লেখক সুরজিৎ দাশগুপ্ত কলকাতার সন্তান – বহুমাত্রিক। কবি, কথাসাহিত্যক, গবেষক, চিন্তাবিদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা ইত্যাদি। শিক্ষা শান্তিনিকেতনে। সঙ্গ ও স্নেহ লাভ করেন অন্নদাশংকর ও লীলা রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ বহু গুণী মানুষের। ১৯৫৪-৫৫ পর্বে, জলপাইগুড়িতে অসুস্থ সুরজিৎ ‘জলার্ক’ নামে একখানি পত্রিকা প্রকাশ করেন — যাতে নিয়মিত লিখতেন সেদিনের প্রতিষ্ঠিত কবি ও লেখক। উল্লেখযোগ্য রচনা একই সমুদ্র, দান্তে গ্যেটে রবীন্দ্রনাথ, ভারতবর্ষ ও ইসলাম, দ্বিতীয় পৃথিবী’ ইত্যাদি। পরিচালিত তথ্যচিত্র বন্য প্রাণীর বন্দী জীবন, আচার্য সুনীতি কুমার, এ সায়েলেন্ট আর্ট, মেট্রো রেলওয়েস ইন ক্যালকাটা, পালকি থেকে পাতাল রেল ইত্যাদি।