লিখেছেনঃ কামরুজ্জামান
স্বাধীনতা লাভের প্রায় এক শতক আগেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রথমদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামী নারীদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন রানি লক্ষ্মীবাঈ, রানি তেজবাঈ, বেগম হজরত মহল প্রমুখ।
১৮৪৮ সালে লর্ড ডালহৌসীর ‘স্বত্ববিলােপ নীতি’র সাহায্যে অযােধ্যা ছাড়াও কেড়ে নেয় সাঁতরা, ঝাঁসি, নাগপুর, বুন্দেলখন্ড, সম্বলপুর। হরণ করে শিক্ষা-সংস্কৃতি সভ্যতা। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে কতিপয় মুসলিম মহীয়সী নারীকে অন্দরমহল থেকে রাজপথে নিয়ে আসে। মিরাটে যে বিদ্রোহের সূচনা হয় তা দ্রুতগতিতে এক বিশাল অংশে ছড়িয়ে পড়ে। মিরাটের নারীরা যখন সিপাহীদের সঙ্গে বিদ্রোহে যােগদান করতে দ্বিধান্বিত, সে সময় লক্ষ্ণৌতে বেগম হজরত মহল (১৮২০-৭৯) বিদ্রোহের নেতৃত্ব দান করতে এগিয়ে আসেন। ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহের প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে লক্ষ্ণৌ। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন-
“Lukhnow was the focal point of the fight for freedom and Begam Hazrat Mahal was brave and resourceful leader.”
১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে ত্রিশক্তির অর্থাৎ দিল্লির মােঘল সম্রাট শাহ আলম, অযােধ্যার নৃপতি সুজাউদ্দৌলা এবং বাংলার। নবাব মীরকাশিমের পরাজয়ের পর ইংরেজ শক্তি অযােধ্যা দখলের পরিকল্পনা শুরু করে। ১৮৪৭ সালে সংস্কৃতি মনস্ক ওয়াজেদ আলি শাহ অযােধ্যার সিংহাসনে বসার পর এই পরিকল্পনা বাস্তব রূপলাভ করে। শিল্পী মনের নৃপতি ওয়াজেদ আলি শাহ রাজ্য পরিচালনায় অক্ষম এই অজুহাতে ১৮৫৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ইংরেজরা তাকে সিংহাসন চ্যুত করে।
এর ফলে ১৩ লক্ষ পাউন্ড বাড়তি রাজত্ব ছাড়াও দোয়া অঞ্চলের ৪০ হাজার বর্গমাইল উর্বর জমি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
তবে বুরহান মুলক প্রতিষ্ঠিত (১৭২২) রাজ্য ও তার ইতিহাস ওয়াজেদ আলি শাহের পতনে শেষ হয়ে যায়নি। তারপরও অযােধ্যা রাজদরবারে একস্বাধীন ও সংগ্রামী ইতিহাস রচনা করেছিলেন ওয়াজেদ আলি শাহের স্ত্রী বেগম হজরত মহল।
ওয়াজেদ আলি শাহ লক্ষৌ ছেড়ে কলকাতার মেটিয়াবুরুজে আশ্রয় নেন। কিন্তু বেগম হজরত মহল (মােহাম্মদী খানম) লক্ষৌতে অবস্থান করেন, ১৪ বছরের পুত্র রিবজিম কাদিরকে নিয়ে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ ও দেশীয় সিপাহীদের মধ্যে বেতনের ফারাক, ইংরেজ সিপাহীদের বৈষম্যমূলক দ্রুত পদোন্নতি ও দেশীয় সিপাহীদের চেয়ে বহুগুণ সুযােগ-সুবিধা প্রদান। সর্বোপরি তাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের দাদাসুলভ, অপমানজনক আচরণ প্রভৃতির কারণে দেশীয় সিপাহীদের মধ্যে ক্রমে ক্রমে একটা ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিল। তার ওপর কোম্পানি তার ফৌজকে আধুনিকীকরণের জন্য আমদানি করল এনফিল্ড রাইফেল। এনফিল্ড রাইফেলের টোটাকে দাঁত দিয়ে ছিড়তে হতাে এবং টোটাকে পিচ্ছিল করার জন্য তাতে চর্বি মাখানাে থাকতাে। প্রচার হয়ে গেল, কোম্পানি হিন্দু-মুসলমানদের ধর্মনাশ করার জন্য টোটায় গােরু ও শুকরের চর্বি ব্যবহার করেছে। ধর্মভীরু হিন্দু-মুসলমান সিপাহী তাদের ধর্মনাশের চক্রান্তের বিরুদ্ধেবিদ্রোহ শুরু করল। সর্বপ্রথম বাংলায় অবস্থানকারী সিপাহীদের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা গেল। মুর্শিদাবাদের অন্তর্গত বহরমপুরের সিপাহীরা নতুন রাইফেল ব্যবহার করতে অস্বীকার করেন। তাদের সহজেই দমন করা হয়।
এরপর ১৮৫৭ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার নিকট ব্যারাকপুরে ৩৪ নং সিপাহী দলের ১৪৪১ নম্বর তরুণ সিপাহী অযােধ্যার ব্রাহ্মণ মঙ্গল পান্ডে পিস্তল ও তরবারি নিয়ে দু’জন ইংরেজ অফিসারকে আক্রমণ করেন। বিচারে ৮ এপ্রিল তার ফাঁসি হয়।
এপ্রিলের প্রথম দিকে কার্তুজের কুপ্রভাব অযােধ্যায় পৌছে গিয়েছিল। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সমগ্র অযােধ্যায় বিদ্রোহ প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে। চিফ কমিশনার লরেন্স লক্ষৌ পৌছান ১৮৫৭ সালের ২৭ মার্চ। মে মাসেই তাকে স্বীকার করতে হয়— আউধে ইংরেজ রাজত্বের অবসান ঘটেছে। ‘এভরি আউটপােস্ট, আই ফিয়ার হ্যাজ ফলেন।’ বিদ্রোহের শিখা ক্যান্টনমেন্ট থেকে অন্য ক্যান্টনমেন্ট, সীতাপুর, ফৈজাবাদ, সুলতানপুর ও গােন্ডায় ছড়িয়ে পড়ে এবং অল্পকালের মধ্যেই ব্রিটিশ শাসনের চিহ্নগুলাে মুছে যেতে থাকে। কলকাতার একজন বণিক রীম এইসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, সে সময়ে অযােধ্যা সমগ্রভাবেই ব্রিটিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। এই অবস্থা আরও খারাপের দিকে যায়, যখন ৩০ জুন সরকারি ভবনের ৮ মাইলের মধ্যে ফৈজাবাদ সড়কের উপর অবস্থিত চিনহাট গ্রামের ভারতীয়দের হাতে ব্রিটিশ ফৌজ পরাজয় বরণ করে। গােটা লক্ষৌ নগরী বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়।
অযােধ্যার শাসক হিসেবে তার পুত্রকে মেনে নিতে অযােধ্যার জনগণকে অনুপ্রাণিত করেন। ১৮৫৭ সালের ৫ জুলাই হজরত মহল রাজ্য হারানাের পর লক্ষ্ণৌ শহরে রণসাজে সজ্জিত হয়ে হাতির পিঠে আবির্ভূত হন এবং জনগণের উদ্দেশ্যে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে। হজরত মহলের উদাত্ত আহ্বানে উদ্বেলিত জনতা বিরজিম কাদিরকে অযােধ্যার নবাব বলে ঘােষণা করেন এবং হজরত মহলকে তার অভিভাবকরূপে মেনে নেয়। গােরক্ষপুরের মহম্মদ হাসান, সুলতানপুরের মেহেন্দি হাসান, শংকরপুরের রানা বেণীমাধব, রুয়ার নরপত সিং, বীরহুতের উদিত নারায়ণ ও ষধুপ্রসাদ, আমেথির লাল মাধ্যো সিং, হনুমন্ত সিং, নানাসাহেব, বালা রাও, জওলাপ্রসাদের নিয়ে অযােধ্যার নতুন নবাবের মন্ত্রণ পরিষদ গঠিত হয়। এই মন্ত্রণা পরিষদের নেত্রী হন হজরত মহল। এইদিনই হজরত মহল যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তা বিশেষভাবে স্মরণীয়—
“আমি তােমাদের মাতৃসমা, তােমাদের আর এক মা, জন্মভূমি। এই জননী জন্মভূমি আজ বেইমান নামাবাদের হাতে বন্দিনী। তার এক প্রিয় পুত্র, যিনি একদিন ছিলেন এই রাজ্যের শাসক, সেই জনপ্রিয় নবাব আজ কলকাতায় নির্বাসিত। তার শাহী মহেরল বেগম, পুত্র, কন্যা ইংরেজদের হাতে লাঞ্ছিত।… আমি অযােধ্যার রাজ্যহারা বন্দি নবানের বেগম, তােমাদের মা আমি। আজ বেগম মহল ছেড়ে বাইরে এসেছি তােমাদের সাহায্য চাইবার জন্য। সিপাহীরা বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে, জনসাধারণকেও বিদ্রোহে অংশগ্রহন করে অগ্রসর হতে হবে, অস্ত্র ধারণ করতে হবে। হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে ছিড়ে ফেলতে হবে গােলামীর শিকল। আর দেরি নয়— হাতে নাও হাতিয়ার। বল আমার সন্তানেরা করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে।”
১৮৫৭ সালের ৫ জুলাই বিরজিস কাদিরের রাজ্য অভিষেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। হজরত মহলকে বিরজিস কাদিরের অভিভাবক, রাজ প্রতিনিধি, রাজমাতা এবং মালিকা আলিয়া রূপে স্বীকার করা হয়। হজরত মহল উপস্থিত সকলকে ভারতের মাটি থেকে ইংরেজদের বিভাজন স্পর্শ করে শপথ নেন। রাজ্য পরিচালনার জন্য হজরত মহলের নেতৃত্বে হিন্দু-মুসলমান সেনা আফিসাদের নিয়ে এক সামরিক কমান্ড গঠিত হয়। অযােধ্যার সমস্ত সিদ্ধান্ত দেশপ্রেমিক সেনাদের সামরিক কমান্ডাের পরামর্শ মতাে গৃহীত হতাে। ধীরে ধীরে অযােধ্যার স্বাধীনতা সংগ্রামের রাশ হজরত মহলের হাতে এসে পড়ল।
১৮৫৭ সালে লক্ষৌ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ যে সব খবর পেয়েছিল তা থেকে জানা যায়, হজরত মহল-ই ছিলেন বিদ্রোহী পক্ষের মূল চালিকাশক্তি। শরফদুল্লাহ, মাঞ্জু খান, মনরুদ্দৌলা, মান সিং, জয়লাল এবং অন্যান্যদের জড়াে করে তিনি তাদের ইংরেজদের উৎখাতের জন্য কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। হজরত মহলের নির্দেশে অযােধ্যার দেশপ্রেমিক সেনারা ৭ জুলাই কানপুর সড়কের দিকে রেসিডেন্সির সীমানা অতিক্রম করে জোহারা কুঠি আক্রমণ করে এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর কুঠির দখল নেয়। ৩৭ একরের রেসিডেন্সির চারপাশের ঘেরা প্রাচীরের উচ্চতা ছিল ২০ ফুটের বেশি। হজরত মহলের নির্দেশে রেসিডেন্সির চারপাশে মাইন বিছিয়ে মূল ইমারতটি গুড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২০ জুলাই পরিকল্পনামাফিক ১৮ পাউন্ডের গােলা ব্রিটিশ গােলন্দাজ বাহিনীর ওপর নিক্ষিপ্ত হয় এবং ওয়াটার গেটও উড়িয়ে দেওয়া হয়। ২৮ জুলাই অযােধ্যা সীমান্ত সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মাগারওয়ার গ্রামে জেনারেল হােপগ্রান্টের নেতৃত্বে ১৫০০ কোম্পানি সেনা ও ১টি কামান জড়াে করা হয়। পরের দিন হজরত মহলের নির্দেশে ইউসুফ খানের নেতৃত্বে গােলন্দাজ বাহিনী ইংরেজ সেনাদের ওপর লাগাতার গােলাবর্ষণ করতে শুরু করে। মহাবিদ্রোহের ইতিহাসে এই যুদ্ধ ‘বশিরাতগঞ্জ’ প্রথম যুদ্ধ নামে খ্যাত। বশিরাতগঞ্জের দ্বিতীয় ও তৃতীয় যুদ্ধ সংগঠিত হয় যথাক্রমে ৪ ও ১১ আগস্ট। অযােধ্যা সেনার সাহসিকতা ও সামরিক নিপুণতার জন্য ব্রিটিশ সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৬ আগস্ট রেসিডেন্সির দুরবস্থার কথা জানিয়ে মেজর ক্যানিং ইংরেজ জেনারেল হ্যাভলককে এক পত্রে জানান, যদি হ্যাভলক তাঁর সেনা নিয়ে সত্বর রেসিডেন্সি না পৌছান তবে ২০ লক্ষ মুদ্রা, ২০ টি কামান এবং লুণ্ঠিত ধনরত্ন শত্রুর দখলে চলে যাবে। নতুন সেনা আসার আগেই ১৮ ও ২০ আগস্ট হজরত মহলের নির্দেশে রেডিডেন্সির উপর পুনরায় আক্রমণ চালানাে হয়। আর এই আক্রমণ অভিযান ‘অপারেশন শাওন’ নামে পরিচিত। ৫৫ দিন রেসিডেন্সি অবরােধ চলাকালীন অবস্থায় ২৪ আগস্ট ‘অপারেশন মহরম’ চালানাে হয়। রেসিডেন্সি অবরােধ এক জাতীয় চরিত্র গ্রহণ করেছিল। ২৪ আগস্টের শুরু হওয়া অপারেশন মহরমের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ৫ সেপ্টেম্বর বরকত আহমদের নেতৃত্বে ৮০০০ সেনা ও ৫০০ অশ্বারােহী পুনরায় রেসিডেন্সিতে আক্রমণ চালায়। অবরােধ চলাকালীন মেজর অ্যানথ্রপ ৯ পাউন্ড গােলার আঘাতে নিহত হয় এবং লেফটেন্যান্ট আলেকজান্ডার গুরুতরভাবে আহত হয়। রেসিডেন্সির ফিরিঙ্গীদের দুরবস্থার সংবাদ পেয়ে জেনারেল আউট্রাম গভর্নর জেনারেলকে এক বার্তায় জানায়, ‘The moral effect of abandoning Lukhnow will be very serious against us.’ রেসিডেন্সি থেকে জেনারেল ক্যানিং এর কাছে আরও ফৌজ পাঠানাের আবেদন করা হল। ১৯ সেপ্টেম্বর জেনারেল হ্যাভলক এবং আউট্রামের ৩০০০ সশস্ত্র মিলিত বাহিনী অযােধ্যার মাটিতে পৌছায়। ব্রিটিশ সেনার অগ্রগতি বিনা বাধায় হয়নি। প্রতিটি গ্রামবাসী ফিরিঙ্গীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে ছিল। ইংরেজ সেনা আলমবাগে পৌছলে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ সম্পর্কে আউট্রামের ডাইরি থেকে জানা যায়,
“When we carne within a mile of Alambag, they sent some pounders that went right into our column, killing several officers and men. 138 soldiers dies and 77 wounded.”
আউট্রাম প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে রেসিডেন্সিতে পৌছানাের পর রেসিডেন্সি থেকে বেরিয়ে আলমবাগে ফিরে আবার একটা পথের অনুসন্ধান করতে শুরু করেন। কারণ ইংরেজগণ অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে এক মুহূর্তও থাকতে রাজি ছিল না। আউট্রাম তঁার ডাইরিতে লিখেছিলেন,
“All communication cut off. Infact, oudh is a blazing fire that will not be put out in hurry.”
হজরত মহল জৌনপুর, ফৈজাবাদ, আজমগড় প্রভৃতি জেলায় অবাধ সেনার শক্তি বৃদ্ধির জন্য সেনা রেজিমেন্টগুলােতে আরও বেশি বেশি মানুষকে নিয়ােগ করার নির্দেশ দিলেন। ফৈজাবাদে ভারী কামান ও বন্দুক মেরামতির দ্বিতীয় বৃহত্তম কারখানা স্থাপন করা হল। হজরত মহলের মধ্যে নিঃসন্দেহে নেতৃত্ব দেওয়ার এবং সংগঠন গড়ে তােলার মতাে গুণাবলী ছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে যখন ভয়ংকর যুদ্ধ চলছিল, তখন একটি গােলা এসে প্রাসাদ তােরণে লাগে। সেনাবাসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সৈন্যরা পলায়ন করতে থাকে। কিন্তু হজরত মহল অবিচল রইলেন। আগে তার শিরচ্ছেদ করে, তারপর পলায়ন করবার জন্য তিনি তাঁর প্রধান দলপতিদের নির্দেশ দিলে, সৈন্য-দলপতিদের চেতনা ফিরে আসে।
১৮৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে যুদ্ধের বেগমাত্রা তুঙ্গে ওঠে। প্রতিটি সদর রাস্তা ও গলিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। প্রায় ১৫০ দলনেতা প্রতিরক্ষার কাজে দেখা শোনা করে, খাদ্যদ্রব্য ভান্ডারে মজুত করা হয়। এই রকম যুদ্ধে অভিজাত জমিদার শ্রেণি অর্থ, লোকজন দিয়ে সহযােগিতা করেছিল। এই যুদ্ধে এই অঞ্চলের প্রতিটি গ্রাম ও প্রতিটি ঘর ছােটখাটো দুর্গে পরিণত হয়েছিল। স্যার ক্যানিং এ বিষয়ে প্রেরিত সংবাদে লিখেছিলেন—
“অবরােধের সময় এটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ।”
ম্যালেসনের মতানুসারে ব্রিটিশের অবস্থান এই সময় ছিল অত্যন্ত অদ্ভুত। তারা পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রদেশের মধ্যবর্তী বেষ্টনীর সমগ্র স্থান দখলে। রেখেছিল। কিন্তু উত্তর-দক্ষিণের অংশ হজরত মহল নেতৃত্বাধীন দলগুলাের দখলে ছিল। যার অগ্রভাগে ছিলেন হারদাত সিং, ফিরােজ শাহ, রানা বেণীমাধাে, দেবী বক্স, হনুমন্ত সিং, রাম বক্স সিং, বেহুনাথ সিং, চান্দা বক্স, গােলার সিং, ভােপাল সিং, নরপতি সিং প্রমুখ।
১৮৫৮ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে অযােধ্যার মধ্য অঞ্চলকে কিচটা নতি স্বীকারে বাধ্য করা গেলেও সমগ্রভাবে এই ভূখণ্ড বিভিন্ন বিদ্রোহী দলের প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে। অপেক্ষাকৃত উল্লেখযােগ্য নেতাদের মধ্যে। শঙ্করপুরের রানা বেণীমাববো, আমেথির লাল মাধাে সিং, হনুমন্ত সিং, নানাসাহেব, বালা রাও, জওলা প্রসাদ, মেহেন্দী হাসান, মহম্মদ হাসান।
শক্তিশালী ছিল এবং উত্তর দিকের জঙ্গলের গভীরে অবস্থিত নানা দুর্গগুলাে তখন পর্যন্ত চড়াও হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। রাসেলের তথ্যানুসারে, এই সময় হজরত মহল, মজু খান, বিরজিস কাদির, হনুমন্ত সিং, রানা বেণীমাধাে প্রমুখদের নতি স্বীকার আদায়ের জন্য একটি পরিমার্জিত আলাপ-আলােচনা চলছিল। কিন্তু কেউই আত্মসমর্পণ করেনি। তবে হজরত মহল লক্ষৌত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ তখন লক্ষ্ণৌ তার পক্ষে নিরাপদ ছিল না। তার গতিবিধি শত্রুর গুপ্তচরদের নখদর্পণে ছিল। তার বর্তমান অবস্থান স্থানটিও শত্রুদের জানা হয়ে গিয়েছিল। ১৬ মার্চ তিনি, পুত্র বিরজিস কাদিরকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্ণৌ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। যাওয়ার সময় লক্ষ্ণৌর মাটিকে চুম্বন করে শপথ নিলেন পুনরায় বিশাল বাহিনী গঠন করে ইংরেজ শাসকদের হাত থেকে নিজ মাতৃভূমি ছিনিয়ে নেওয়ার। লক্ষ্ণৌ থেকে ইটাওয়ালি, শাহজাহানপুর, বেরেলি হয়ে তারা ঘর্ঘরা নদীর তীরে চৌকাঘাটে পৌছান। ১৮৫৮ সালের ১৩ জুন সেনাপতি হােপগ্রান্টের নেতৃত্বে ইংরেজ সেনাবাহিনী চৌকাঘাট পরিত্যাগ করে তরাই অঞ্চলের বরাইচ জেলার বুলন্দি দুর্গে আশ্রয় নেন, দীর্ঘ এক বছর ধরে আউধের অভ্যন্তরে ব্রিটিশ বিরােধী সংগ্রাম পরিচালনা করেন। আউধের গ্রামাঞ্চলের গণ-বিদ্রোহ ধীরে-ধীরে গেরিলা যুদ্ধের রূপ ধারণ করে।
এই সময় মৌলবি আহমদুল্লাহ শাহজাহানপুরে সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন। আর ছিল হজরত মহলের ৬০০০ সৈন্য। যার অধিনায়কত্বে ছিলেন মাম্মু খান। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার এই যৌথ শক্তি পরিচয়ের ব্যাপারে লিখেছেন,
“The besieging sepoy at Lukhnow were inspired by the presence of the Begam of Moulavi. Ahamadullah who were bading spirit in the residence against the British.”
কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজপুত রাজারা বিশ্বাসভঙ্গ করে ইংরেজ পক্ষে যােগ দেয়। এই সময় ইংরেজদের পক্ষ থেকে নির্ধারণ। হয় আহমদুল্লাহর মস্তকের মূল্য, ৫০ হাজার টাকা। বিশ্বাসঘাতক রাজা জগন্নাথ সিং, আহমদুল্লাহকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। সঙ্গে সঙ্গে পুরস্কার স্বরূপ ৬৫ হাজার টাকা এবং বিদ্রোহ প্রশমিত হওয়ার পর একটি জমিদারি পান।
ব্রিটিশ সেনা অভিযান সত্ত্বেও সমগ্র ১৮৫৮ সাল জুড়ে হজরত মহল আউধ গ্রামাঞ্চল নিজ কর্তৃত্ব কায়েম রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর সেনারা ব্রিটিশ চৌকিগুলাে ধ্বংস করেছিল, জেলাগুলো পুনর্দখল করেছিল এবং ড্রাম বাজিয়ে হজরত মহলের পুনঃ কর্তৃত্বের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। হজরত মহল গ্রামাঞ্চলে নিজ কর্তৃত্ব বলে ভূমি রাজস্ব সংগ্রহ করেছিলেন। তার অনিয়মিত সেনার অভাব ঘটেনি। ইংরেজদের প্রতি ঘৃণাবশত গ্রামাঞ্চলের মানুষ, কৃষক, মজুর স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে মহাবিদ্রোহে যােগ দেন। হজরত মহল ১৮৫৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
দিল্লি, কানপুর, বঁসি, লক্ষ্ণৌ প্রভৃতি মহাবিদ্রোহের কেন্দ্রগুলাের পতন ঘটলে মহারানি ভিক্টোরিয়া কোম্পানির নিকট থেকে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে এক ঘােষণাপত্র জারি করেন। ভিক্টোরিয়ার ঐতিহাসিক ঘােষণার জবাব দিয়েছিলেন হজরত মহল আর এক ঐতিহাসিক দলিল রচনা করে। তিনি আউধের বরাইচ জেলার বুলন্দি দুর্গে নিজ পুত্রের হয়ে এই ঘােষণা পত্রটি রচনা করেন। আউধের সুদূর তালুকগুলােতে, এমনকি রাজধানীতে ছড়িয়ে দেওয়া হজরত মহলের ঘােষণাপত্রটি আউধের জনগণের মন থেকে ভিক্টোরিয়ার ঘােষণাপত্রের প্রভাবমুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক Charles Balf বলেছেন,
“The beneficial effect produced by the promulgation of the terms, of the amnesty among the people of oudh was soon apparent although on me part of Begum and her adherents no means were neglected that might counteract the influence which the proclamation of the Queen of India was likely to acquire over the temper and cool reflections of the people. Among other expedients to this end, the following counter proclamation of the Begum was extensively circulated not Only through the distant provinces of Oudh, but even in the capital itself, although now completely at the mercy of the captors.”
১৮৫৯ সালের ৭ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার আউধের মহাবিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘােষণা করলেও, তারা তখনও আউধ বিদ্রোহের মূল চালিকা শক্তি হজরত মহল ও তার পুত্র বিরজিস কাদিরকে। গ্রেফতার করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত তার বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল। অবশিষ্ট ভারতের মতােই আউধেও শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছিল ইংরেজ। কিন্তু হজরত মহল ছিলেন অপরাজিত। শক্রব্যুহ ভেদ করে, তাদের বেষ্টন প্রাচীরকে ছিন্নভিন্ন করে পুত্রকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন নেপালে। আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে সাড়া মেলেনি তার। কোনও প্রলোভন টলাতে পারেনি তাঁকে। ব্রিটিশ সরকার বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা পেনশন দিয়ে হজরত মহলকে লক্ষৌ ফিরে আসার প্রস্তাব বার বার দেয়, কিন্তু ব্রিটিশদের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
শেষ জীবন কেমন কেটেছিল হজরত মহলের সে বিষয়ে বিশেষ কিছু জানা যায় না। যদিও নেপালের মহারাজা জং বাহাদুর থাপা নেপালে ইংরেজ পক্ষ নেন এবং বহু বীর বিপ্লবীকে ধরিয়ে দেন। স্বাভিমানি, দৃঢ়চেতা, দেশপ্রেমিক এবং মাতৃভূমি দখলদারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আপসহীন মনােভাবাপন্ন বেগম হজরত মহল ১৮৭৯ সালের ৭ এপ্রিল কাঠমান্ডুতে দেহত্যাগ করেন। শেষ ইচ্ছানুসারে তঁাকে নেপালের জামে। মসজিদের পাশে দাফন করা হয়।
ফ্রান্সের সাংবাদিক, লেখিকা কানিজ মুরাদ ‘ইন দ্য সিটি অব গোল্ড অ্যান্ড সিলভার দ্য স্টোরি হজরত মহল’ গ্রন্থের গবেষণার প্রয়ােজনে পুরােনাে ইংরেজ দস্তাবেজ ও দলিল ঘাঁটতে গিয়ে হজরত মহলের বীরত্বের কথা জানতে পারেন। সে সব দলিলে তাঁকে ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের ‘আত্মা’ বলা হয়েছে। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের মতােই তার চরিত্র বীরত্বে ভরপুর ছিল।
তিনি ছিলেন আধিপত্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে একদিকে আপসহীন সংগ্রামের প্রতীক, অপরদিকে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রতিভূ। লন্ডন টাইমসের সংবাদ দাতা রাসেল লিখেছেন,
“This Begum exhibits great energy and ability. She has excited all oudh.”
আবার কোনও কোনও ঐতিহাসিক তাকে পনেরাে শতাব্দীর ইউরােপের জোয়ান অফ আর্কের সঙ্গে তুলনা করেছেন। জোয়ান অফ আর্ক’ অত্যন্ত অল্প বয়সে ব্রিটিশদের একনায়কত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্য ইতিহাসের আলােকচ্ছটা পড়ল না বেগম হজরত মহলের জীবন ও কর্মে। তিনি রয়ে গেলেন গবেষকের কলমে, পুরােনাে দলিল দস্তাবেজে। ভারত সরকার তার সার্ধ-শতবর্ষে ১৯৭০ সালে ৫ টাকার ‘ডাকটিকিট’ প্রকাশ করেন। আর ২০০৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘বেগম হজরত মহল’ স্কলারশিপ চালু করেছেন ছাত্রীদের জন্য। এই ধরনের বিদুষী, বীরাঙ্গনার প্রাপ্য কি এতটুকুই? বেগম হজরত মহলকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে গেলে ‘পাঠ্যপুস্তকে’ তার সংগ্রামী-জীবন-ইতিহাস চালু করা হােক।
তথ্যসূত্র :
- ১. শ্রীপান্থ – মেটিয়াবুরুজের নবাব
- ২. সত্য সাউ – ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের বীরাঙ্গনা
- ৩. মইদুল ইসলাম – ব্রিটিশ বিরােধী অগ্নিশিখা বেগম হজরত মহল
- ৪. মুহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ – আমাদের মুক্তি সংগ্রাম।
- ৫. শেখ আজিবুল হক – বীরাঙ্গনা হজরত মহল
- ৬. আনােয়ার হােসেন – অন্দরমহল থেকে রাজপথে : ব্রিটিশ বিরােধী সংগ্রাম
- ৭. রীনা পাল – ভারতের জোয়ান অফ আর্ক : বেগম হজরত মহল
- ৮. Charles Ball – The History of Indian Mutiny. Vol- II
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।