লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
বঙ্গাব্দ, বাংলা সন বাংলা বর্ষপঞ্জী হলো বঙ্গদেশের সৌর পঞ্জিকাভিত্তিক বর্ষপঞ্জী। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সৌর দিনের গণনা শুরু। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে মোট ৩৬৫ দিন কয়েক ঘণ্টা লাগে। এই সময়টাই সৌর বছর। গ্রেগরীয় সনের মতো বঙ্গাব্দেও মোট ১২টি মাস রয়েছে। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র। আকাশের রাশিমন্ডলীতে সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে বঙ্গাব্দের মাসের হিসাব করা হয়। যেমন যে সময় সূর্য মেষ রাশিতে থাকে সে মাসের নাম বৈশাখ।
পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও পূর্ব ভারতের আসাম ও ত্রিপুরায় ও বাংলাদেশে এই বর্ষপঞ্জী ব্যবহৃত হয়। বঙ্গাব্দ শুরু হয় পহেলা বৈশাখ দিয়ে। বঙ্গাব্দ সব সময়েই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর অপেক্ষা ৫৯৩ বছর কম। সংশোধিত বাংলা পঞ্জিকা বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয় ১৯৮৭ সালে। বাংলা বা বঙ্গাব্দের প্রচলন শুরু হলে বাংলায় শকাব্দ, লক্ষনাব্দ, পালাব্দ, চৈতন্যাব্দ ইত্যাদি সনের প্রচলন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই সন বাঙালি জাতির একান্ত নিজস্ব অব্দ।
বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনভুক্ত হয় ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে। ১২০১ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলা জয়ের পর মুসলমান শাসনামলে তৎকালীন প্রচলিত শকাব্দ ও লক্ষনাব্দ সনের পাশাপাশি শাসনকার্যে ইসলামী হিজরী সনের প্রচলন শুরু হয়। ‘সন’ শব্দটি আরবি শব্দ হতে উদ্ভূত, যার অর্থ বর্ষ। আর ‘সাল’ কথাটা এসেছে ফার্সি শব্দ হতে।
বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের সূচনা নিয়েও অনেক বিতর্ক ও বিভ্রান্তি রয়েছে। ঐতিহাসিকদের মধ্যে বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে চার ধরণের মত চালু আছে।
প্রথম মত অনুযায়ী – প্রাচীন বঙ্গদেশের রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) ‘বঙ্গাব্দ’ সালের প্রচলন করেছিলেন। আধুনিক বঙ্গ, বিহার এলাকা তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনুমান করা হয় যে, জুলীয় বর্ষপঞ্জির বৃহস্পতিবার ১৮ মার্চ ৫৯৪ এবং গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির শনিবার ২০ মার্চ ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল।
দ্বিতীয় মত অনুসারে, মুঘল যুগে অর্থাৎ ইসলামী শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসরণ করে সকল কাজকর্ম পরিচালনা করা হত। হিজরী পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। সেজন্য চান্দ্র বৎসরে ঋতুগুলি ঠিক থাকে না। আর বঙ্গদেশে চাষাবাদ ও এজাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এজন্য মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে প্রচলিত হিজরী চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুহুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব দেন। আমির ফতুহুল্লাহ শিরাজীর সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত ফার্সি বর্ষপঞ্জির অনুকরণে ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর নতুন বর্ষপঞ্জি ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ বা ‘ইলাহী সন’ চালু করেন। তবে সম্রাট আকবর ঊনত্রিশ বছর আগে তাঁর সিংহাসন আরোহণের বছর থেকে এই পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরী সালের মুহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ হিসাবে ধরা হয়। গবেষক শামসুজ্জামান খান এবং নিতীশ সেনগুপ্তের মনে করেন বাংলা বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি পরিষ্কার নয়। এই উৎপত্তিতে ইসলামী প্রভাব ও বৌদ্ধ বা হিন্দু প্রভাব দুইই থাকতে পারে।
তৃতীয় মত অনুসারে অনেকে হুসেন শাহী বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহকে বঙ্গাব্দ সনের প্রবর্তক মনে করেন। যদিও এই মতের পক্ষে তেমন কোন জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়না।
চতুর্থ মত অনুসারে তিব্বতের রাজা স্রং সন (তিনি ৬০০ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগে রাজা হন এবং মধ্যভারত ও পূর্ব ভারত জয় করেন) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন, কারণ ওই সময় বাংলার উত্তরাঞ্চলের অনেকটাই তিব্বতি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। তিব্বতের বিখ্যাত শাসক স্রং সন গাম্পোর পিতা স্রং সন এক সময় পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা জয় করেছিলেন – আর সে সময় তার ছেলের জন্ম হলে সেই মুহুর্তটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই তিনি ওই অঞ্চলে ‘সন’ গণনা চালু করেছিলেন। এই মতটা খুব চমকপ্রদ হলেও এর পিছনে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। খুব কম গবেষকই এই মতকে সমর্থন করেছেন।
আবার অনেক ইতিহাসবিদ ও নৃতাত্ত্বিক অবশ্য এও মনে করেন যে বাঙ্গালিদের মধ্যে কৃষির সূচনা থেকেই বাংলা সনের উদ্ভব। কিন্তু ঠিক কবে বা কখন তা শুরু হয়েছে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে আসা যায়নি।
যেসব ইতিহাসবিদ ও নৃতাত্ত্বিক সম্রাট আকবরকে বঙ্গাব্দ সনের প্রবর্তক মনে করেন তাঁদের মধ্যে হলেন সুপরিচিত ভারতীয় বিজ্ঞানী ডঃ মেঘনাদ সাহা, অধ্যাপক পবিত্র সরকার, কাশীপ্রসাদ জয়, সওয়ালরামপ্রসাদ ভাস্কর, ডঃ অমর্ত্য সেন প্রভৃতি। তাঁরা সম্রাট আকবরকেই বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে মনে করেন। অমর্ত সেন তাঁর ‘দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ গ্রন্থের মধ্যে এই কথা স্পষ্ট লিখেছেন, তিনি লিখছেন –
“বাংলা ‘সনে’র একটি বিশেষত্ব হল – আকবর সারা ভারত জুড়ে বহু-ধর্মে গ্রাহ্য যে ক্যালেন্ডার ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ চালু করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন, সেটার প্রভাব কিন্তু আজও টিকে আছে শুধু এই বঙ্গাব্দেই।”
তিনি আরও লিখেছেন,
“আকবরের আমলে যখন মুসলিম ক্যালেন্ডার বা হিজরীর প্রথম সহস্রাব্দ শেষ হয়ে আসছে – তিনি তার রাজত্বে একটি বহু-সংস্কৃতির ক্যালেন্ডার চালু করার প্রয়োজন অনুভব করেন। এটাই ছিল তারিখ-ই-ইলাহী।… এই ক্যালেন্ডার হিন্দু সূর্যসিদ্ধান্ত রীতি অনুসরণ করত, আবার মুসলিম হিজরীর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যও এতে সংযোজিত হয়েছিল – যেমন হিজরীর চান্দ্র ইতিহাস।”
অমর্ত সেন আরও লিখেছেন,
“There is a surviving calender, the Bengali San, which clearly influenced by Tarikhilahi, and which still carries evidence of the integrating tendency that is so plaintifully present in many other fields of Indian culture and tradition (such as painting, architecture, and so on…. When a Bengali Hindu does religious ceremonies according to the local calender, he or she may not be quite aware that the dates that are invoked in the calendrical accompaniment of the Hindu practices are attuned to commemorating Muhammad’s journey from Mecca to Medina, able it in a mixed lunar-solar representation.” (Argumentative Indian : Writings on Indian History, Culture and Identity; Ed. Penguin, 2005, p. 331-332)
১৯৫৪ সালে ভারতীয় পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির প্রধান ডঃ মেঘনাদ সাহা অঙ্ক কষে নিশ্চিত ঘোষণা করেছিলেন যে সম্রাট আকবরই বাংলা সনের প্রবর্তক। পরে উড়িষ্যার ইতিহাসবিদ কাশীপ্রসাদ জয়সওয়াল ডঃ মেঘনাদ সাহার মতকে সমর্থন করেন। ইতিহাসবিদ রামপ্রসাদ ভাস্করও মনে করেন, ইসলামী হিজরী থেকে উদ্ভুত হয়েছে বাংলা সাল।
ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। কারণ বাংলা ছিলো কৃষি প্রধান অঞ্চল, ফলে খাজনা দেয়াসহ নানা কাজে বছরের শুরুটা হিসেব করতে সমস্যা হতো। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা সুষ্ঠভাবে আদায় হয় সেজন্য মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবর যা চেয়েছিলেন তা হলো রাজস্ব প্রশাসনের সংকট দূর করা। তাঁর এই প্রয়াসের মধ্য দিয়েই বাংলা সনের উদ্ভব হয়। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতুহুল্লাহ শিরাজী সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম আবিস্কার করেন। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ৯৬৩ হিজরিতে বাংলা সন গণনা কার্যকর হয় যখন আকবরের সিংহাসন আরোহণ করেন। কিন্তু তিনি এর প্রণয়ন করেন ৯৯২ হিজরি মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ‘ফসলি সন’, পরে ‘বঙ্গাব্দ’ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি লাভ করে। এর পর থেকেই চৈত্র মাসের শেষ দিনে (সংক্রান্তি) প্রজাদের কাছ থেকে কৃষি ও রাজস্ব কর বা খাজনা আদায় করা হতো৷ সম্রাট আকবরের সময় থেকেই হালখাতা বা পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এইজন্য নিতীশ সেনগুপ্ত বলেছেন, বাংলা বর্ষপঞ্জি হুসেন শাহই শুরু করুন আর আকবরই, এটা বাংলার ঐতিহ্যগত বর্ষপঞ্জির ভিত্তিতে বসন্তের ফসল সংগ্রহের পর খাজনা আদায় করার কাজ সহজ করে দিয়েছিল। কারণ ইসলামী হিজরি বর্ষপঞ্জি খাজনা আদায়ের দিন ধার্য করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি করে।
অথচ ভারতীয় প্রজাদের রাজস্ব আদায়ের জন্য ঋতুচক্র অনুসারে বছরের সময়কাল স্থির থাকা প্রয়ােজন। আকবরের সভাসদ আবুল ফজল রীতিমতাে অঙ্ক কষে দেখিয়ে দেন, ৩২টি সৌর বছরে হিজরি হয়ে দাঁড়ায় এক বছর বেড়ে গিয়ে ৩৩ বছর। অর্থাৎ প্রজাদের ১ বছরের রাজস্ব বেশি দিতে হচ্ছে। আকবর এই সমস্যা নিরসনে ফারসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতহুল্লাহ শিরাজীকে দায়িত্ব দেন। চান্দ্র ও সৌর বছরের সামঞ্জস্য বিধানের। সময়টা ছিল ৯৯২ হিজরি, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ।
আকবরের সিংহাসনে আরােহণ করেন সেই সালটা ছিল ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দ অর্থাৎ ইসলামী ৯৬৩ হিজরী। ৯৬৩ হিজরীর প্রথম মাস মুহররম ছিল বাংলার বৈশাখ মাস। এবার দেখুন, খ্রীষ্টাব্দ ও হিজরী সনের পার্থক্য ১৫৫৬-৯৬৩ = ৫৯৩ বছর। ১৫৫৬-৫৯৩ = ৯৬৩ হিজরী সন, যা সৌর বছরে রূপান্তরিত; অর্থাৎ ৯৬৩ বঙ্গাব্দ বা সন। অতএব, খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৫৯৩ বিয়ােগ করে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের হিসাব চলতে থাকলাে। অর্থাৎ খ্রীষ্টাব্দ ও এখনকার বঙ্গাব্দ – দুটিই সৌর বছর বলে ঋতুচক্রের সময়কাল স্থির থাকলাে। তেমনি, বর্তমান বছর হলাে ২০২২-৫৯৩ গু ১৪২৯ সন। ৯৬৩-কে চান্দ্র বছর না ধরে এটিকে সৌর বছরে রূপান্তরিত করা হয়। অর্থাৎ এর পর থেকে বছরগুলাে বাংলা সন হিসেবে গণনা করা হতে লাগলাে। সুতরাং বাংলা সাল চালু হয়েছে হিজরি সাল অনুকরনে। কিন্তু ৪০০ বছরে হিজরি সাল এবং বংলা সালের মধ্যে ১৪ বছরের গ্যাপ তৈরি হয়েছে কারন হিজরি সাল বাংলা সালের থেকে ১০-১৩ দিন কম।
সুখোময় মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায় যে, কোন কোন পুঁথিতে ‘যবনে নৃপতে শকাব্দ’ বা রামগোপাল দাসের ‘রসকল্পবল্লী’র পুঁথিতে বঙ্গাব্দকে ‘যবনী বৎসর’ বলা হয়েছে। সুতরাং ‘যবন’ শব্দ দ্বারা বোঝায় যাচ্ছে শশাঙ্ক নয় কোন মুসলমান শাসকই বঙ্গাব্দের সূচনা করেছেন।
ব্রিটিশদের আগে এদেশে সবাই হিজরি সনই ব্যবহার করতো। ফলে ফসল কাটার খুব অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতো, কারণ আগের বছর যে তারিখে ফসল কাটতো, পরের বছর সে তারিখ ১১ দিন এগিয়ে যেতো। আকবর যে হিজরি সন ছিল তখন থেকেই এক সৌরসংবত প্রবর্তন করেন। এটিই হচ্ছে বঙ্গাব্দ। সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ (হিজরি ৯৬৩) এবং ৯৬৩ বঙ্গাব্দ।
এই থেকে ঐতিহাসিকরা একমত হন যে, হিজরি থেকেই বঙ্গাব্দ চালু করা হয়। হিজরি সন ছিল চন্দ্রমাস। ঐ মাসই হিজরি সন ও তারিখের হেরফের হতো, অর্থাৎ সৌর বছরের হিসাবের দিন তারিখ মাসের গরমিল হতো প্রচুর। সে কারণেই ৯৬৩ হিজরি = ৯৬৩ বাংলা সন সমন্বয় করে গণনা শুরু করা হয়। এভাবে ৯৬০= হিজরি = ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ এর ১১ এপ্রিল, সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের ও পহেলা বৈশাখ, ৯৬০ বাংলা সন।
বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রয়াত গবেষক শামসুজ্জামান খান তার বইয়েও বাংলা সনের প্রবর্তন নিয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি সম্রাট আকবরকে বঙ্গাব্দ সনের প্রবর্তক মনে করেন। শামসুজ্জামান খান লিখেছেন,
“আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায়, সম্রাট এমন একটি ত্রুটিমুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত সৌর সনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্যই আদর্শ হবে। বাংলা সনের মধ্যে তার সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছিল।”
তিনি আরও বলেন,
“একে বাংলা সন বা সাল বলা হয়। এই সন ও সাল হল যথাক্রমে আরবী ও ফারসী শব্দ। এটা নির্দেশ করছে এগুলো মুসলিম রাজা বা সুলতান কর্তৃক বাংলায় পরিচিত করানো হয়।”
শামসুজ্জামান খান আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন,
“আকবর বহুদিন ধরে হিন্দুস্থানের বিভিন্ন অঞ্চলে (দিন গণনার) সমস্যা সহজ করে দেওয়ার জন্য এক নতুন বছর ও মাস গণনাক্রম প্রবর্তন করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তিনি হিজরী অব্দ ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন। আমীর ফতুহুল্লাহ শিরাজীর প্রচেষ্টায় এ অব্দের প্রবর্তন হল।”
ঢাকায় বাংলা একাডেমির ফোকলোর বিভাগের উপপরিচালক ডঃ আমিনুর রহমান সুলতান বলছেন যে বাঙ্গালী বরাবরই পার্বণ প্রিয় জাতি। কিন্তু সম্রাট আকবরের আগে অর্থাৎ শশাঙ্ক থেকে আকবর পর্যন্ত সময়ে পার্বণের তেমন উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না।
আকবরের পৌত্র সম্রাট শাহজাহান রবিবার দিয়ে শুরু হওয়া সাত দিনের সপ্তাহের প্রচলনের জন্য এই তারিখ-ই-ইলাহি বর্ষপঞ্জির সংস্কার করেন। শকাব্দে (ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি) থাকা মাসের নামের সাথে মিলিয়ে তারিখ-ই-ইলাহির মাসের নামকরণ করা হয়। আজ বাংলায় যে বর্ষপঞ্জিটি ব্যবহার করা হয়, সেই বর্ষপঞ্জিটিই তার ভিত্তি স্থাপন করে। শামসুজ্জামান খানের মতে, সম্ভবত মুঘল গভর্নর নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সর্বপ্রথম খাজনা আদায় করার জন্য একটি উৎসবের দিন চালু করেন। আর এটা করার সময়ই তিনি আকবরের বার্ষিক খাজনা আদায়ের নীতি গ্রহণ করেন।
কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন যে মুঘল সম্রাট আকবর নন বাংলা বর্ষপঞ্জি এসেছে ৭ম শতকের গৌড়ের প্রাচীন হিন্দু রাজা শশাঙ্ক ‘বঙ্গাব্দ’ প্রবর্তন করেছিলেন। আকবরের সময়ের অনেক শতক আগে নির্মিত দুটি শিব মন্দিরে ‘বঙ্গাব্দ’ (বাংলা বছর) শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
এ প্রসঙ্গে সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন: “আকবর কর্তৃক হিজরি সনের অবলুপ্তি, ‘তারিখ- ই-ইলাহী’ অব্দ প্রবর্তন প্রভৃতির কথা থাকলেও বঙ্গাব্দ বা বাঙলা সন প্রবর্তনের কোন উল্লেখ নেই। আকবরের রাজস্ব সচিব টোডরমলের ‘আসল- ই-জমা তুমার’ গ্রন্থেও আকবর কর্তৃক উল্লিখিত অব্দ বা সন প্রবর্তনের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। পক্ষান্তরে বর্তমান কালের কিছু বইপত্র, প্রাচীন মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক প্রভৃতিতে আকবর তথা হুসেন শাহের পূর্বে বঙ্গদেশে ‘বঙ্গাব্দ’-এর অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ও উত্তরজীবনে খ্যাতিমান প্রশাসক অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘বাঁকুড়ার মন্দির’ গ্রন্থে ‘১০২ বঙ্গাব্দ’-এর উল্লেখ ; ১৩২০ বঙ্গাব্দে বরিশাল থেকে প্রকাশিত ও বৃন্দাবনচন্দ্র পুততুণ্ড-রচিত ‘চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস’ গ্রন্থে ‘বঙ্গাব্দ ৬০৬ সাল’ বলে বর্ণনা উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা থেকে প্রকাশিত ও স্বামী সারদেশানন্দ রচিত ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যদেব’ গ্রন্থে শ্রীশ্রীচৈতন্যদেবের জন্মসাল হিসাবে বাঙলা ৮৯১ সনের উল্লেখ; কলকাতার বৌবাজার স্ট্রীটে (বর্তমানে বি.বি. গাঙ্গুলী স্ট্রীট) অবস্থিত সিদ্ধেশ্বরী কালী (ফিরিঙ্গি কালী নামেও পরিচিত) মন্দিরের বর্তমান প্রতিষ্ঠাফলকে ‘স্থাপিত ৯০৫ সাল’ বলে উল্লেখ; ১৩২৪ বঙ্গাব্দে শিলচর থেকে প্রকাশিত ও অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি-রচিত ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ (উত্তরাংশ: তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগ) গ্রন্থে ‘সন ৯০৬ বঙ্গাব্দ’-র উল্লেখ; ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা সম্বলিত ও প্রবোধচন্দ্র বসু (প্রবুদ্ধ) রচিত ‘ভগবানপুর থানার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে বাঙলা ৯৭৩ সালের উল্লেখ; পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ থেকে প্রকাশিত ‘হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সংগ্রহ’ (দ্বিতীয় খণ্ড) পুস্তকে প্রকাশিত বাঙলা ৯৮৫ সালে হাতে লেখা কাশীদাসের আদিপর্বের একখানি পুঁথির ফটো কপি প্রভৃতি বঙ্গাব্দ বা বাঙলা সনের প্রাচীনত্ব প্রমাণ করে ও আকবর তথা হুসেন শাহ কর্তৃক এই অব্দ বা সন প্রবর্তনের কাহিনীকে ভিত্তিহীন করে দেয়।” (বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৯ :২৩৩-২৩৪)
আর এটাই নির্দেশ করে, আকবরের সময়ের আরও অনেক আগেও বাংলা বর্ষপঞ্জির অস্তিত্ব ছিল। বাংলা সনের সূচনা নিয়ে বিতর্কটি তোলা হয়েছে কারণ অনেকে রাজা শশাঙ্ককেই এর প্রবর্তক হিসেবে দেখাতে চান। অথচ শশাঙ্কের শতাব্দের সাথে বাংলা সনের সাথে মিলও খুব কম।
ঐতিহাসিক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় শশাঙ্ককে বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলতে চাওয়া প্রসঙ্গে লিখেছেন, এই মতের সপক্ষে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই প্রমাণ করতে হবে যে, শশাঙ্ক ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে এক শকাব্দহীন। রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বা অন্তত এই সময়ে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন। এর কোন নিশ্চিত প্রমাণ নেই, যদিও খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীর প্রথম ভাগে তাঁর রাজত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য আমাদের আছে। ..শশাঙ্কের রাজ্যের সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত সীমানার মধ্যে তাঁর পরবর্তীকালীন এক হাজার বছরের মধ্যে তারিখযুক্ত যে বিরাটসংখ্যক লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলিতে বঙ্গাব্দ ব্যবহারের চিহ্নই নেই। (বঙ্গ, বাঙ্গালা ও ভারত, ১৫১-১৫২)।
বঙ্গাব্দের সূচনা নিয়ে ইতিহাসে যতই বিতর্ক থাকুক বঙ্গাব্দ-সহ ভারতীয় সকল অব্দের সূচনা হয়েছিল মূলত বৈদিক ঋষিদের হাত ধরে। আর্যরা যখন বঙ্গদেশে অনুপ্রবেশ করেছিলেন, তখন এই অঞ্চলের আদিবাসীরা বর্ষগণনা করতেন কি না তা জানা যায় না। তবে ইতিহাস থেকে জানা যায় যে আর্য ঋষিরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা করতেন। সে অধীত জ্ঞান আবার একই সাথে ধর্মীয় নিয়মকানুন সম্পাদনের জন্য ব্যবহার করতেন। এই সূত্রে আর্য ঋষিরা, খালি চোখে দেখা যায় এমন দূর আকাশের নক্ষত্রাদি, সূর্য, খালি চোখে দেখা যায় এমন গ্রহগুলো, চাঁদ ইত্যাদির গতিপথ এবং পৃথিবীর ঋতুচক্র ইত্যাদি সব মিলিয়ে পঞ্জিকার আবিস্কার করেছিলেন। প্রাচীনকালের ঋষিদের গবেষণালব্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞান বহুভাবে বহুবার পরিবর্তিত ও সংশোধিত হয়েছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব পঞ্জিকার সৃষ্টি হয়েছিল এই সকল ঋষিদের জ্ঞান অনুসারে। প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে সেইসব পঞ্জিকার নাম বা সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায়। এইসব ঋষিদের প্রণীত সৌর সালের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই বোধ হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুহুল্লাহ শিরাজী আকবরের আদেশে বঙ্গাব্দ সনের প্রবর্তন করেন।
[প্রথম প্রকাশঃ দৈনিক পূবের কলম, সম্পাদকীয়, ১৯ এপ্রিল ২০২২]
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।