লিখেছেনঃ গৌতম রায়
করােনার করাল থাবা থেকে স্বয়ং রামচন্দ্র ও রক্ষা করাতে পারলেন না তাঁর ভক্তদের। পবিত্র মসজিদ ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে, আইন আদালতকে কবজা করে মসজিদের জমির উপরেই ‘রামে’-এর মন্দির করবার উদ্যোগে যারা সব থেকে বেশি ডুগমগ, তেমন বাছাই করা কয়েকজন পুরুতঠাকুর অবশেষে কারােনাতে আক্রান্ত। ভিত পুজো নামক এলাহি কারবারের আগেই এইসব পুরুতেরা নিজের নিজের আখড়াতে সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন।
আজ এই একুশ শতকের প্রায় মধ্য লগ্নে বসে, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তর একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের মসজিদের জমি অবলীলায় অপর ধর্মাবলম্বীদের জমি বলে নিছক বিশ্বাসের বলে সিদ্ধান্ত দেয়—এটা আমাদের দেখতে হল। চরমতম দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, এভাবে রাজনৈতিক হিন্দু দুর্বৃত্তদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমি, কোনও প্রামাণ্য নথি ছাড়া, পুরাতাত্বিক প্রমাণ ছাড়া, একদম পাড়ার সালিশি সভার স্টাইলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত, নিছক ‘বিশ্বাসে’-এর ভিত্তিতে অপর একটি ধর্মের জমি বলে সাব্যস্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি। সেই জমিত তথাকথিত ‘রামমন্দির তৈরির জন্যে কি ধরনের উদ্যোগ কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হবে, তার নির্দেশিকা পর্যন্ত জারি করেছেন।
এই গােটা ঘটনাক্রম ঘিরে অবিজেপি রাজনৈতিক দলগুলি কাত মামুলি প্রতিবাদ করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আগামী ৫ আগস্ট অযােধ্যাতে তথাকথিত রামমন্দিরের শিলান্যাসের নামে যে মােচ্ছব হতে যাচ্ছে, তা চিরন্তন, সমন্বয়ী, বহুত্ববাদীধারার সাধনায় পুষ্ট ভারতকে ভেঙে তছনছ করবার আরও একটি ভয়ঙ্কর আত্মঘাতী উদ্যোগ।
ধর্মে যারা প্রকৃত অর্থে বিশ্বাস করেন, দশরথ-নন্দন রামচন্দ্র কে যাঁরা সাহিত্যের নায়ক নন, ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে অন্ত্রর থেকে বিশ্বাস করেন, তাদের উপলব্ধি হল; নরচন্দ্রমা দশরথ-তনয় কখনও কোনও মন্দিরের সঙ্কীর্ণ চার দেওয়ালের ভিতরে আবদ্ধ নন। বিশ্বাসীদের উপলব্ধি ; রামচন্দ্র এর অবস্থান ভক্তের হৃদয়জুড়ে। তাঁরা অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন, অযােধ্যার এমন কোনও ধুলিকণা নেই, যা রামচন্দ্র এর স্মৃতিমাখা নয়। অপর ধর্মের পবিত্র অর্চনাস্থল ধ্বংস করে, সেই ধবংসস্তুপকেই রামের জন্মস্থান বলে আইনের সাহায্যে, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাহায্যে শীলমােহর দেওয়াটাকে চিরন্তন হিন্দু ধর্মের মূল আদর্শ; ত্যাগ, প্রেম, পরমতসহিষ্ণুতা, ঈশ্বর দর্শনই মানবজীবনের লক্ষ্য ইত্যাদি মূল্যবােধের চরম বিরােধী বলে অম্বর থেকে মনে করেন।
এই অংশের মানুষ, হিন্দু ধর্মকে যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের একটি হাতিয়ার বলে মনে করেন না, মনে করেন, তাঁদের ব্যক্তিগত যাপনচিত্রের একটি অঙ্গ তেমন মানুষদের সঙ্গে কিন্তু এই আরএসএস বা তাঁদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কিংবা বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, সংস্কার ভারতী, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতি, বজরং দল, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, ভারতীয় মজদুর সংঘ ইত্যাদি সংঘ-পরিবারের হাজারাে শাখা সংগঠন, এরা যেভাবে, যে আঙ্গিকে হিন্দু শব্দটির ব্যাখ্যা করে —তার আদৌ কোনও মিল নেই।
ধর্মের রাজনৈতিক কারবারি আরএসএস-বিজেপি, সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিক আকুলতাকে নিজেদের পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে। ধার্মিক মানুষদের মনে করে নিজেদের ধর্ম ব্যবসায়ের খুব সফল পুঁজি। তাই তারা মানুষের ভাবাবেগকে নিজেদের সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশেই নগ্নভাবে ব্যবহার করে থাকে। এই ব্যবহারের সঙ্গে যাঁরা প্রকৃত অর্থে আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করেন, ভাববাদী চেতনাতে অনুরক্ত হয়ে মনে করেন, কোনও বিশেষ শক্তি তাঁদের জীবনের যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশা দূর করে দেবেন, তাঁদের সেই বিশ্বাস, বােধ, আকুতি, সারল্যের সঙ্গে ধর্মের এই রাজনৈতিক কারবারিদের ধর্ম ব্যবসায়ের এতটুকু সঙ্গতি নেই। আর এসএস-বিজেপির লােকেরা চাল, ডাল, তেল, নুন আলু, পটল, মাছ, মাংসের ব্যবসার মতােই এই দশরথ-নন্দন রামচন্দ্রকে নিয়েও নিছকই ব্যবসা করে। তাঁদের এই ব্যবসার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার এতটুকু সম্পর্ক নেই।
এটা আমাদের কাছে চরম পরিতাপের বিষয় এই যে, ধর্মের ব্যবসাদের বিরুদ্ধে যেভাবে রাজনৈতিক প্রতিরােধ দরকার, যে প্রতিরােধ অতীতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙার উপক্রমের সময়ে হয়েছিল। সেই প্রতিবাদ হয়েছিল মসজিদটি ভাঙার পরেও। এমন কি গুজরাত গণহত্যার পরেও সেই প্রতিবাদ জারি ছিল। প্রতিরােধের সংকল্প থেকেই মানুষ অটলবিহারীকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। যন্ত্রণার বিষয়; প্রতিবাদ প্রতিরােধের সেই মাত্রাকে সমান ভাবে প্রবাহিত রাখতে আমরা পারিনি। সাম্প্রদায়িক বিভৎসতার বিরুদ্ধে একইসঙ্গে গণ-প্রতিবাদ এবং প্রতিরােধের পাশাপাশি তীব্রভাবে প্রয়ােজন ছিল, বৌদ্ধিক প্রতিরােধের। আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষ। এদেশের প্রতিটি মানুষের ধর্ম পালনের অধিকার আছে, না পালনের ও অধিকার আছে। ১৯২৬ সালেই মুজফফর আহমাদ হিন্দু-মুসলমান সহ সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী এবং নাস্তিক, প্রত্যেকেরই নিজের বােধে স্থিত থাকার অধিকারের কথা বলেছিলেন। এটাই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা। এই চর্চা পরবর্তীতে সব সময়ে সমানভাবে অনুসসৃত হয়েছিল, এটা জোর গলায় বলা যায় না। ধর্মপ্রাণ ধার্মিকের সঙ্গে ধর্মান্ধের মৌলিক ফারাকটি বােঝার ক্ষেত্রে বহু ক্ষেত্রেই ভ্রান্তি থেকে গেছে। আর সেই ভ্রান্তির পথেই তৈরি হয়েছে ভাবের ঘরে চুরি। কমিউনিস্ট হতে গেলে নাস্তিক হতে হবে, এই ধারণার বশবর্তী হয়ে একটা বড় অংশের মানুষ কোমরের ঘুনসিতে মাদুলি-তাবিজ -কবচ বেঁধে, মুখে নাস্তিকতার ভাবের ঘরে চুরি করেছেন। আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস আর মাদুলি-তাবিজ, জলপড়া, তেলপড়ার বুজরুকি, কুসংস্কার যে এক নয়, এটা মানুষকে বােঝানাের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট খামতি থেকে গেছে। ফলে যে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা একটা সময় প্রবলভাবে আমরা দেখেছিলাম, সেই চর্চাতে বৌদ্ধিক চেতনার খামতির ফলে আজ সেটি বেশিরভাগ থেকেই অন্ধ বিশ্বস, কুসংস্কারে পর্যবসিত হয়ে সেই ছিদ্রপথেই আজ বাবরি মসজিদের জমিতে তথাকথিত ভিত পুজো ঘিরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরে যতটা উচ্ছ্বাস, সমস্ত অবিজেপি রাজনৈতিক শিবিরে ততটাই নীরবতা।
কোভিড়-১৯-এর এই ভয়াবহতার ভিতরে শারীরিক দূরত্বের বিজ্ঞানসম্মত বিধি-নিষেধকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে কাণ্ড হতে চলেছে আমােধ্যতে, তাতে নিশ্চিত করে বলা যায়, ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ঘিরে আগুন নিয়ে খেলা হচ্ছে। এই ভিত পুজোর আয়ােজনের কিছু ভিড়িও ইতিমধ্যেই সামাজিক গণমাধ্যমে ঘােরাফেরা করছে। সেখানেও কোনও শারীরিক দূরত্বের বালাই নেই। স্বভাবতই বুঝতে পারা যাচ্ছে, শারীরিক দূরত্বের যে বিধি-নিষেধ এই কোভিড কালকে ঘিরে ভারত সরকার বলছেন, সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই, শারীরিক দূরত্বের বিষয়টিকেও লঘন করা হতে চলেছে এই তথাকথিত ভিত পুজোতে।
(সৌজন্যেঃ পূবের কলম)