বর্তমানে ভারত পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে সম্মিলিতভাবে যে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে প্রায় সেই একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ১০০০ বছর আগে। সুলতান মাহমুদ এর পিতা সবুক্তগীন ছিলেন আলপ্তগীনের ক্রীতদাস। সবুক্তগীন নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া করে বুদ্ধিবলে এবং অধ্যাবসায় দ্বারা একসময় আফগানিস্থানের শাসক হন।
প্রতিবেদনের এই অংশটি গৃহীত হয়েছে মিনহাজ ই মিরাজ লিখিত ‘তাবাকাত-ই-নাসিরী’ থেকে এবং মেজর এইচ জি রাভার্তি কৃত ইংরেজি অনুবাদের টিকা থেকে। (এশিয়াটিক সোসাইটি, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা ৭৪ থেকে ৮১)
সবুক্তগীনের সেনাবাহিনী প্রবল উৎসাহে অতি শীঘ্রই নিকটবর্তী এলাকাগুলিকে পদানত করার উদ্দেশ্যে কুচকাওয়াজ করে গজনী থেকে বার হয়ে পড়ল। বুষ্ত জেলা, দাওয়ারের জামিন, কুসদারের জামিন, বামিয়ান, সমস্ত তুর্কিস্তান এবং ঘুর দখল করলেন। ভারতীয় প্রান্তে জয়পালকে বহুসংখ্যক হাতি ও প্রচুর সৈন্য দিয়ে উৎখাত করলেন এবং কাশগড়ের সামানি পরিবারের বুঘরা খানকে হটিয়ে দিয়ে বলখে প্রবেশ করলেন, বুখারার আমিরকে পূর্ববর্তী স্থানে প্রেরণ করে সিংহাসন পুনর্দখলে সাহায্য করলেন। (রাভার্তির মতে) জয়পাল, যাঁকে ভারতের বাদশাহ রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে, ৩৬৯ (৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ) হিজরীতে সৈন্যদল নিয়ে আমির নাসিরুদ্দিন সবুক্তগীনকে আক্রমণ করার জন্য গজনীর দিকে কুচকাওয়াজ করলেন, কিন্তু এক চুক্তি বলে জয়পাল পিছিয়ে এলেন।….মনে রাখতে হবে সেই সময়ে সিন্ধু নদীর পশ্চিমে সফেদ কোহ, পূর্বের লবণাক্ত ভূমির (কচ্ছের রান) মধ্যবর্তী স্থান এবং হিন্দুকুশ পার হয়ে কাবুল পর্যন্ত হিন্দু রাজত্ব বিস্তৃত ছিল।…৩৭৮ (৯৮৭ খ্রি.) হিজরীতে রাজা জয়পালের সঙ্গে সবুক্তগীনের পুনরায় যুদ্ধ হয়, জয়পাল বিধ্বস্ত হন এবং রাজার পশ্চাদ্ধাবন করা হয়। অতঃপর একটি শান্তি চুক্তি হয় যার শর্ত ছিল, গজনীর নিকটবর্তী চারটি ভারতীয় দুর্গ ও ১০০ টি হাতি সবুক্তগীনকে হস্তান্তর করা হবে।
৩৮৭ (৯৯৬ খ্রি.) হিজরীতে ৫৬ বছর বয়সে বালখ সীমান্তে মদ্রুমু-তে সবুক্তগীন ইহলোক ত্যাগ করেন। সুলতান মাহমুদ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ইসমাইলকে পরাজিত ও বন্দি করে মাত্র ২৬ বছর বয়সে গজনীর সিংহাসনে বসেন।
সবুক্তগীন যে কাজ করে যেতে পারেননি তা সুলতান মাহমুদ শুরু করলেন। বারবার জয়পাল দ্বারা সীমান্ত অঞ্চলের গোলযোগ নিরসনের জন্য খাইবার সীমান্ত পার করে ভারত আক্রমণের প্রয়োজন পড়ল। ৩৯০ হিজরীতে হিন্দুস্থান আক্রমণ করে বারজান্দ দখল করলেন এবং ফিরে এলেন। ৩৯১ হিজরীতে ১০ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে পুনরায় ভারত অভিযান করে পেশোয়ার দখল করলেন। ৩৯২ হিজরীতে রাজা জয়পাল ১৫ জন ভ্রাতা ও সন্তানসহ বন্দী হলেন। এরপর। জয়পালের রাজধানী পাঞ্জাবের ভাতিন্দা দখল করলেন। রাজার মুক্তিপণ ঠিক হয় ২ লক্ষ্য স্বর্ণ দিনার, ১৫০ টি হাতি, রাজার গলার ২ লক্ষ্য দিনার মূল্যের মালা। রাজা মুক্ত হয়েও অপমানিত বোধ করে মাথা কামিয়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করে আত্মহত্যা করলেন। রাজপাট দিয়ে গেলেন পুত্র আনন্দ পালকে।
সুলতান মাহমুদ মুলতানের শাসক আবুল ফাতেহ দাউসকে পরাজিত করে জয়পাল এর অপর পুত্র সুখ পালকে শাসক নিযুক্ত করে গজনী ফিরে গেলেন। কিন্তু সুখ পাল, সুলতান মাহমুদ ফিরে যাওয়ার পরই বিদ্রোহ ঘোষণা করলে ১০০৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে পরাজিত ও বন্দি করলেন। এরপর আনন্দপাল একটি হঠকারিতা করেন। তিনি ভারতীয় হিন্দু রাজাদের একটি সম্মিলিত সেনাবাহিনী তৈরি করে সুলতান মাহমুদকে চ্যালেঞ্জ জানান। সম্মিলিত বাহিনীতে ছিল কনৌজ, দিল্লি, কালিঞ্জর, গোয়ালিয়ার, উজ্জয়িনী, আজমিরের হিন্দু রাজারা। ১০০৮ খ্রিস্টাব্দে সম্মিলিত বাহিনীর বহু বেশি শক্তি থাকা সত্ত্বেও ভারতীয়রা পরাজিত হলে সুলতান মাহমুদের কাছে তাদের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যায়।
এরপরের ইতিহাস লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংস ও হত্যার। আল-বেরুনীর ভাষায় ভারতীয় রাজাদের তিনি তুলোর মত ধুনে দিয়েছিলেন। সবুক্তগীন ও সুলতান মাহমুদ বারবার জয়পাল ও তাঁর আত্মীয়দের দ্বারা উত্যক্ত হলেও তিনি তাঁদের পরাজিত করেও স্ব স্ব স্থানে বহাল রেখেছিলেন। তবে তাঁদের দুর্বিনীত স্বভাবের জন্যই সুলতান মাহমুদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। তিনি ভৈরবের মত উত্তর, পশ্চিম, উত্তর পশ্চিম ও মধ্য ভারতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তছনছ করে দেন।
এই ইতিহাস বলার প্রয়োজন পড়ল। খাইবার পার হয়ে এই প্রান্তে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান (অখন্ড ভারত) যে তিনটি দেশ বারবার সন্ত্রাসী আক্রমণের সামনে পড়ছে। দেশপ্রেমী আফগানরা মার্কিন দেশ দ্বারা তাদের দেশ দখলের প্রতিশোথ স্বরূপ বারবার, এই তিনটি দেশের মার্কিন সংযোগের জন্য সন্ত্রাসী আক্রমণ করে যাচ্ছ। এখন তো আরও বেশি শঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিবানদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে দেশে ফিরে যাচ্ছে। নিজের দেশে নিরাপদ হয়ে যাওয়ার পর তালিবান আজ না হয় কাল পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের উপর ভৈরব এর মত আপতিত হবে। প্রার্থনা করি তা যেন না হয় এবং তার জন্য আমাদেরও সংযত হতে হবে। অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোই ভালো।
সুলতান মাহমদু গযনবী সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পড়ুনঃ
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান ও সোমনাথ মন্দির প্রসঙ্গ (১ম পর্ব)
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান ও সোমনাথ মন্দির প্রসঙ্গ (২য় পর্ব)
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।