১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলির ঘােষণার দুদিন পরেই শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বাংলার ছােটলাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি করলেন যে, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ভাগ করলে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলার হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ গঠন করে তা ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ১৯৪৭ সালের ১৯ মার্চ এক বিবৃতিতে বললেন,
“প্রদেশটি যে গুরুতর সাম্প্রদায়িক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তার একমাত্র শান্তিপূর্ণ সমাধান হচ্ছে বাংলার বিভাজন। এর ফলে যে যে অঞ্চলে বাংলার দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের সংখ্যাধিক্য আছে সেখানে তারা নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিকশিত করার পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করবে।”
তাই আজ যারা বলছেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী না থাকলে ভারতে আজকের পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব থাকত না কিংবা বাঙালির একটা বড় অংশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেত, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, যে ব্যক্তি ১৯৪৭-এর এপ্রিলে তারকেশ্বরে অনুষ্ঠিত তিনদিনের (৪ থেকে ৬ এপ্রিল) হিন্দু মহাসভার বার্ষিক প্রাদেশিক সম্মেলনে (এই সম্মেলন বাংলায় হিন্দুদের জন্য একটি পৃথক প্রদেশ গঠনের উদ্দেশ্যে কার্যকরী পদপে গ্রহণের জন্য শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে কর্তৃত্ব প্রদান করে) ৫ এপ্রিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলা ভাগের দাবীর পুনরাবৃত্তি করে বলেন,
“I conceive of no other solution of the communal problem in Bengal than to divide the province and let the two major communities residing herein live in peace and freedom.”
তিনি কোনও অবস্থাতেই কোনও শুভবুদ্ধি মানুষের কাছে প্রণম্য হতে পারেন না। বঙ্গভঙ্গের প্রবকটাকে যদি আমরা বাঙালির নায়ক বা পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা বলে মানতে চাই, তাহলে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী নয়, কার্জনকেই আমাদের পুজোর বেদিতে বসিয়ে আরাধনা করা উচিত। আর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর জন্য পশ্চিমবঙ্গ ভারতে আছে—এর চেয়ে অসত্য কথা আর হতে পারে না।
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর গুণগ্রাহী হিন্দু মহাসভার নেতা বলরাজ মাধোক লিখেছেন যে, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বলেছিলেন,
“কংগ্রেস ভারত বিভাজন করেছিল আর আমি করেছিলাম পাকিস্তান-বিভাজন।”
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী দাবি করেছেন যে, বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করে তিনিই পশ্চিমবাংলা ও পূর্ব-পাঞ্জাবকে পাকিস্তান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এ দাবি একান্তই হাস্যকর হত না যদি বাংলা ও পাঞ্জাব-বিভাজন এত মর্মান্তিক না হত। এই বিভাজনে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ও হিন্দু মহাসভার কী ভূমিকা ছিল সে তাে ইতিহাস। তবে সেদিন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে তাদের ভূমিকার গুরুত্বের পরিমাপ কিছুটা হয়েছিল ১৯৪৫-এর শেষের দিকে কেন্দ্রীয় আইনসভার এবং ১৯৪৬-এর প্রথম দিকে প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নির্বাচনে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাদের গুরুত্ব বুঝতে ভুল করেনি। সাম্রাজ্যবাদ তার স্বার্থ অধুন্ন রাখার জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গেই আপস করেছিল এবং সেই আপসের ফলেই বাংলা ও পাঞ্জাব-বিভাজন তথা ভারত বিভাজন হয়েছিল। এক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীরা ছিলেন অবান্তর। আমরা দেখেছি বিড়লা-গান্ধী-নেহেরু-প্যাটেলরা দীর্ঘদিন ধরে চেয়েছিলেন হয় অখণ্ড ভারত অথবা বাংলা ও পাঞ্জাবকে চিরে এই দুই প্রদেশের এক এক খণ্ড তাদের শাসিত ভারতের সঙ্গে জুড়ে দিতে। দ্বিতীয়টা ছিল তাদের ন্যূনতম দাবি এবং সেই দাবি তারা আদায়ও করেছিলেন। পরে পাকিস্তানকে যারা বিভাজন করেছিলেন তারা হচ্ছেন পূর্ব বাংলা তথা অধুনা বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১-এ। তাছাড়া পাকিস্তানের হিংস্র কবল থেকে সমগ্র বাংলাকে বাঁচানােই যদি বাংলাভাগের কারণ হয়, তাহলে ভারতের সীমানার মধ্যেও তাে অখণ্ড বাংলা গড়তে পারতেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ও তার অনুগামীরা। কেনই বা তারা ভারতের মধ্যকার অখণ্ড বাংলারও বিভাজন চেয়েছিলেন?
১৯৪৭ সালের ২২ এপ্রিল বাংলা ভাগের দাবিতে দিল্লীর জনসভায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বলেছিলেন,
“This separation must not be dependent on Pakistan.Even if Pakistan is not conceded and some form of a week and loose centre envirage in the Cabinet Mission Scheme is accepted by the Muslim Leauge, we shall demand the creation of a new Province composed of the Hindu Majority areas in Bengal.”
অর্থাৎ বাংলা ভাগের ব্যাপারটা যে পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর এই বক্তব্য থেকে তা স্পষ্ট হয়। ১৯৪৭ সালের ৫ জুন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস নেতা বি. বি. সিনহা প্যাটেলকে অনুরূপ এক চিঠিতে লেখেন, পুরাে বাংলাও যদি ভারতে যােগ দেয়, তাহলেও বর্তমানে যে অবস্থা আছে সেই অবস্থাই বজায় থাকবে এবং বাংলায় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিস্থাপন করার ধারণা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হবে। নিজেদের হাতে প্রশাসনের ভার না থাকলে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। অতএব ভারতে থাকতে চাইলেও বাংলাকে অখন্ড রাখা যাবে না।
পরে সুরেন্দ্রমােহন ঘােষ এক সাক্ষাৎকারে গর্ডনকে বলেছিলেন যে, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী সেই সময় একান্তে বলেছিলেন,
“এখন আমরা বিভক্ত করি এবং ইংরেজরা চলে গেলে তারপর আমরা সমগ্র অঞ্চল দখল করে নেব।”
সুরেন্দ্র মােহন ঘােষের এই বক্তব্যের মধ্যে সত্যতা আছে। কারণ বাংলা তথা ভারত বিভাজন ঠিক হয়ে যাবার পরেই হিন্দু মহাসভা কর্তৃক এক গৃহীত প্রস্তাব থেকে মনে হয় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী মাত্র কিছুদিন আগে (১৯ মার্চ) বাংলা বিভাজনের পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছিলেন তা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন এবং ‘যুদ্ধং দেহি’ মনােভাব গ্রহণ করেছিলেন। হিন্দু মহাসভার প্রস্তাবে বলা হয়,
“…যতণ না বিচ্ছিন্ন অংশগুলােকে ভারতীয় ইউনিয়নে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে এবং এর অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত শান্তি আসবে না।”
হিন্দু মহাসভা বিশ্বাস করত, ভারতীয় ইউনিয়নে পূর্ব বাংলাকে ফিরিয়ে আনা মাত্র সময়ের অপেক্ষা। কংগ্রেসের শীর্ষনেতারাও নিশ্চিত ছিলেন, পূর্ব বাংলা তথা পাকিস্তান হিন্দুস্তানে ফিরে আসতে বাধ্য হবে। প্যাটেলও এই বক্তব্য রেখেছিলেন। যাইহােক, ১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাজন পরিকল্পনা ঘােষণা করলে হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস নেতারা একত্রে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে আরও জোরদার করলেন। তারা উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে, কাগজে বিবৃতি দিয়ে বােঝাতে লাগলেন যে, হিন্দুরা বিপন্ন, বাংলা ভাগ ছাড়া উপায় নেই। বাংলা পাকিস্তানে গেলে তাে বটেই, স্বাধীন সার্বভৌম হলেও এমনকী ভারতে থাকলেও হিন্দুদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাকে বিভক্ত করে হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ গঠন করতে হবে। এক সভায় হিন্দু মহাসভার বিশিষ্ট নেতা নির্মল চ্যাটার্জি বললেন,
“Our demand for partition today is …to prevent the disintegration of the nationalist element and to preserve Bengal’s culture and to secure a Homeland for the Hindus of Bengal which will constitute a Nationalist State as a part of India.”
অপরদিকে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী দের সম্পূর্ণভাবে মদত দিয়েছিলেন বিড়লা, গােয়েঙ্কা ও জালানদের মতাে কলকাতাস্থিত বৃহৎ শিল্পপতিরা। হিন্দু মহাসভা এবং বৃহৎ পুঁজিপতিদের চাপে কংগ্রেসের প্রাদেশিক নেতৃত্ব যেভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতার সাবেকি ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিতে উদ্যোগী হয়েছিল ১৯৪৬-৪৭ সালে, তা কিছু প্রাচীন কংগ্রেসী নেতা মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু তারা ছিল সংখ্যালঘু।
এখানে লক্ষ্য করার মত ব্যাপার হল, ১৯০৫ ও ১৯৪৭ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনের বৈপরীত্য। ১৯০৫ সালে যাঁরা কার্জন পরিকল্পিত বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে বুকের রক্ত দিয়ে বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলন করেছিলেন, মাত্র ৪২ বছরের ব্যবধানে সেই শ্রেণির মানুষেরা বাংলা ভাগের আন্দোলন শুরু করেন। তবে দুই-একজন মুসলিম নেতা ১৯৪৭-এর দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা করেছিলেন কারণ তাতে তাদের প্রভাবের ক্ষেত্র কমে যাবে। কিন্তু দু’একজন বাদে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা একজোট হয়ে বাংলার প্রায় সব হিন্দু নেতা বঙ্গভঙ্গের জন্য লাগাতার আন্দোলন করেছেন। কারণ ১৯৪৭ সালে বাংলার রাজনীতিতে মুসলমানদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলা অখণ্ড থাকলে সেখানে হিন্দুদের প্রাধান্যের কোনও রকম সম্ভাবনা নেই। তারা বুঝেছিলেন যে অখণ্ড বাংলা যদি ভারতের মধ্যেও থাকে, তা হলেও সেখানে মুসলমানদের প্রাধান্য থাকবে। মন্ত্রিসভার প্রধান একজন মুসলমানই হবেন। এ বিষয়টা হিন্দু নেতাদের একেবারেই অপছন্দ ছিল। তাই ‘হিন্দুদের স্বার্থরক্ষয়’ বদ্ধপরিকর থাকতে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ও অন্যান্য হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গের দৃঢ় সমর্থক হয়ে পড়েন এবং অখণ্ড বাংলা মেনে নিতে পারেননি। তাদের বাংলার পাকিস্তান ভুক্তির বিরােধিতা সমর্থন করা যেতে পারে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার বিরােধিতাও ভারতপ্রেমের অজুহাত দিয়ে ঢাকা যায়। কিন্তু ভারতের মধ্যে থাকলেও বঙ্গভঙ্গ করার দাবি, নিজেদের কায়েমী ক্ষুদ্র স্বার্থচরিতার্থ করা ছাড়া আর কী দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়?
বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করার বিশেষ প্রয়ােজনীয়তা ইংরেজ বা দিল্লিওয়ালা অনুভব করতে পারেন। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী অবিভক্ত বাংলার যে সর্বনাশ করে গেলেন, সেই সর্বনাশ থেকে বাঙালি জাতি কি আর কোনও দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? ১৯৭১এ বাংলাদেশ সৃষ্টিই তাে প্রমাণ করে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর দূরদর্শিতার অভাব ছিল। ১৯৫২ সালে নদিয়ার চাকদহে এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন,
“বাংলাভাগের জন্য মানুষের (উদ্বাস্তুদের) এত কষ্ট হবে এ যদি আগে বুঝতে পারতাম তাহলে বাংলা ভাগ চাইতাম। এখন মনে হচ্ছে যােগেনবাবুরা বাংলাভাগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিলেন তা সঠিক ছিল।”
১৯৪৭-এর পরবর্তী সময়ে ওপার বাংলায় বিভিন্ন সময়ে হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচার চলে, সে সম্পর্কে কোনও আইনসভা বা বিধানসভায় প্র তােলার সুযােগও এপার বাংলার রাজনৈতিক নেতাদের ছিল না। কারণ বাংলা ইতিমধ্যেই ভাগ হয়ে গেছে। এপার বাংলার যেসব নেতারা নিজেদের ‘আগে হিন্দু তারপর বাঙালি’ মনে করতেন তাদের কাছে একটাই প্রতিকার ছিল এবং তা হচ্ছে, এপার বাংলায় মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানাে ও মুসলমান-বিরােধী দাঙ্গা বাধানাে বা বাধাবার চেষ্টা করা। দু-একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রও এতে মদত দিয়েছিল। উল্টোদিকে এটা সত্য ঘটনা যে, কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা দাঙ্গা ঠেকানাের যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন,
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ও জনসংঘ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।