লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
শায়খ ইবনে আরাবী আল্লাহর প্রকাশ্য নিদর্শন ছিলেন
নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী তাঁর কিতাবে লিখেছেন,
“সার কথা হল, শায়খ ইবনে আরাবীর স্বপ্ন এবং কারামতের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ কয়েক খন্ডেও সমাপ্ত হবে না। তিনি আল্লাহর প্রকাশ্য নিদর্শন ছিলেন।” (আত্তাজুল মুকাল্লাল)
মাসসালা ওয়াহদাতুল ওজুদ এর প্রবক্তা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) ইসলামের কত বড় বুযর্গ ছিলেন তা প্রমান করার জন্য নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী সাহেব মুজাদুদ্দীন ফিরোজাবাদীর কথা নকল করে লিখেছেন,
“শায়খ ইবনে আরাবী সম্মান এবং জ্ঞানের দিক থেকে তরিকতের শায়খ (বুযর্গ) ছিলেন এবং তাসাউফ এবং হাকীকতের দিক থেকে তরিকতের ইমাম ছিলেন। কর্ম এবং নামের দিক থেকে জ্ঞান বিজ্ঞানের নিদর্শনকে জীবিত কারী ছিলেন। তিনি এমন ঝর্না ছিলেন যাঁকে বিশ্বাস ঘাতকতার কোন নীতি খারাপ করতে পারে নি।……….. তাঁর দুয়া সপ্তম আকাশের পর্দাকেও ভেদ করে দিত। তাঁর বরকত প্রসারিত হয়ে পৃথিবীকে পরিপুর্ন করে দিয়েছিল।” (আত্তাজুল মুকাল্লাল, পৃষ্ঠা-১৬৮-১৬৯)
এখানে নবাব সিদ্দিক হাসান খান সাহেব মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ এর প্রবক্তা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) এর ভূয়ষী প্রসংশা করেছেন এবং তরিকতের শায়খ, তাসাউফের ওভাকীকতের দিক থেকে তরিকতের ইমাম, জ্ঞান বিজ্ঞানের দিক থেকে নিদর্শনকে জীবিতকারী প্রভৃতি বলেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হল যে গায়ের মুকাল্লিদরা নিজেরা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) কাফের জিন্দিক বলে এবং তারাই শায়খ ইবনে আরাবীর প্রসংশায় পঞ্চমুখ। এমনকি তাঁরা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) কে আল্লাহর প্রকাশ্য দলীল এবং ‘খাতেমুল বিলায়াতিল মুহাম্মাদীয়া’ বলেও স্মরন করেছেন।
শায়খ ইবনে আরাবীর মাজার থেকে বরকত হাসিল
গায়ের মুকাল্লিদদের ইমাম নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী সাহেব শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) এর মর্যাদার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করার জন্য এই কথাও লিখেছেন যে লোকেরা শায়খ ইবনে আরাবীর কবরে তাবাররুক অর্জন করতো। এই ব্যাপারে ইমাম মিকরীর কথা নকল করে লিখেছেন,
“আমি শায়খ ইবনে আরাবীর কবর জিয়ারত করেছি এবং বেশ কয়েক বার সেখান থেকে তাবাররুক অর্জন করেছি। তাঁর কবরে নুর ও বরকত স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। সেখানে মুশাহাদাকারীর অবস্থাকে কোন বুদ্ধিমান ব্যাক্তি অস্বীকার করতে পারবে না।” (আত্তাজুল মুকাল্লাল, পৃষ্ঠা-১৭৮)
এখানে গায়ের মুকাল্লিদদের ইমাম নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী সাহেব মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ এর প্রবক্তা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) মাজার থেকে ফয়েজ হাসিল করার কথা নকল করেছেন। সুতরাং গায়ের মুকাল্লিদদের নিকট কবর থেকে ফয়েজ হাসিল করা জায়েজ। আর এখান থেকে বোঝা যায় গায়ের মুকাল্লিদদের নিকট শায়খ ইবনে আরাবীর মাকাম ও মর্তবা কত বেশী।
ওয়াহদাতুল ওজুদ এর ব্যাপারে ইবনে তাইমিয়ার ভুল ধারনা
আহলে হাদীসদের বিখ্যাত মুহাদ্দিস সিহাহ সিত্তাহর উর্দূ তরজমাকারী আল্লামা ওয়াহীদুজ্জামান হায়দ্রাবাদী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হাদিয়াতুল মাহদী’ এর মধ্যে লিখেছেন,
“সুফীদের মধ্যে ওয়াহদাতুল ওজুদের আকিদা পোষন কারীদের ছিলেন শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ)। তাঁরা হুলুল এবং আন্তরিক ইত্তেহাদের প্রবক্তা ছিলেন না। বরং আল্লাহ তাআলার সত্তাকে আরশের উপর সমস্ত মাখলুকের থেকে আলাদা প্রমান করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে আল্লাহ তাআলা এক দিক থেকে মাখলুকে সাথে এক। অর্থাৎ এটা তাঁর অস্তিত্ত্বের কারনেই। কারণ প্রকৃত অস্তিত্ত্ব কেবল একটাই। আর সেটা আল্লাহ তাআলারই অস্তিত্ত্ব। বাকি জিনিস এই একমাত্র অস্তিত্ত্বের কারনেই মওজুদ আছে। এদের কোন প্রকৃত অস্তিত্ত্ব নেই। যেমন মুতাকাল্লিমিন বলেন, যে এখানে দুটি অস্তিত্ত্ব রয়েছে। একটা অস্তিত্ত্ব ওয়াজীব এবং দ্বিতীয় অস্তিত্ত্ব সম্ভব। আর আল্লাহ তাআলা মাখলুকের নন। কারণ সম্ভবের অস্তিত্ত্ব তার মূল অস্তিত্ত্বের থেকে ক্ষীণ। এই কথার জন্য সাধারন মানুষের বুদ্ধিতে ধারনা হল যে স্রষ্টার মধ্যে মিস্ত্রি এবং গৃহের মতো সম্পর্ক। এই অর্থ থেকে পলায়ন করেন ।”
আল্লামা ওয়াহীদুজ্জামান হায়দ্রাবাদী আরও লিখেছেন,
“আল্লামা ইবনে তাইমিয়া শায়খ ইবনে আরাবীর মতবাদকে খন্ডন করেছেন। হাফিয এবং তাফ্তাযানী এর অনুসরন করেছেন। আমার নিকট সত্য ব্যাপার হল এই যে তাঁরা শায়খ ইবনে আরাবীর কথার অর্থ বুঝতে পারেননি। তাঁর কথার অর্থ বুঝার ব্যাপারে তাঁরা গভীর দৃষ্টিপাত করেন নি। ‘ফুসুস’ (ফুসুসুল হিকাম) কিতাব এর মধ্যে শায়েখের বাহ্যিক অর্থ তাঁদেরকে অপরিচিত লেগেছে। যদি তাঁরা ‘ফুতুহাত’ (ফুতুহাতে মাক্কীয়া) কিতাব এর মধ্যে গভীর দৃষ্টিপাত করতেন, তাহলে তাঁরা বুঝতে পারতেন যে, ইবনে আরাবীর নীতি এবং দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে আহলে হাদীস ছিলেন এবং তাকলীদের কঠিন বিরোধীতাকারীদের মধ্যে ছিলেন।” (হাদিয়াতুল মাহ্দী, পৃষ্ঠা-৫০-৫১)
এখানে আহলে হাদীসদের মহামান্য আল্লামা ওয়াহীদুজ্জামান হায়দ্রাবাদী সাহেব মাসআলা ওয়াহ্দাতুল ওজুদের প্রবক্তা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) কে আহলে হাদীস এবং তকলীদ-বিরোধী বলে গন্য করেছেন।
অন্য এক জায়গায় আল্লামা ওয়াহীদুজ্জামান হায়দ্রাবাদী লিখেছেন,
“শায়খ মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহঃ) বলেছেন যে, আমি শায়খ ইবনে আরাবীর বিরোধী এবং এই মাসআলায় তাঁর ভুল হয়েছে বলে মনে করি। কিন্তু এ সত্যেও তিনি আল্লাহর আওলিয়াদের মধ্যে ছিলেন এবং যে ব্যক্তি তাঁর সমালোচনা করে অথবা তাঁর বিরোধীতা করে তার জন্য আশবংকা আছে। আর আমাদের দলের মধ্যে নবাব সিদ্দিক হাসান খান বলেছেন যে, শায়খ মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবী ও শায়খ আহমদ সেরহিন্দীর ব্যাপারে আমাদের আকিদা হল যে তাঁরা দুজনেই আল্লাহ তাআলার পছন্দীয় বান্দাদের মধ্যে ছিলেন। আর যেসব অভিযোগে তাদেরকে অভিযুক্ত করা হয় আমরা সেগুলিকে পরোয়া করিনা। আমাদের দলের মধ্যে আল্লামা শাওকানীও সেই বুযর্গদের মধ্যে একজন যিনি শেষ পর্যন্ত শায়খ ইবনে আরাবীর প্রতি যে ভুল ধারনা পোষন করেছিলেন তা থেকে রুজু করে নিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে আমি ‘ফুতুহাত’ (ফুতুহাতে মাক্কীয়া) গভীরভাবে অনুধাবন করেছি যে ব্যাখ্যার মাধ্যমে শায়েখের (ইবনে আরাবীর) কালামকে (মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ বিষয়ে) সঠিক অর্থে রুপান্তরিত করা যেতে পারে।” (হাদিয়াতুল মাহদী, পৃষ্ঠা-৫০)
শায়খ ইবনে আরাবী এবং মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ এর ব্যাপারে এই হল গায়ের মুকাল্লিদ সম্প্রদায়ের আকিদা। ওয়াহদাতুল ওজুদ এর ব্যাপারে ‘হাদিয়াতুল মাহ্দী’ এর বিশেষ অধ্যায় থেকে নকল করা হল। যার দ্বারা ওয়াহদাতুল ওজুদ এর ব্যাপারে গায়ের মুকাল্লিদ সম্প্রদায়ের যে কি আকিদা তা পরিস্কার বোঝা যেতে পারে। ‘খাতেমুল বিলায়াতিল মুহাম্মাদীয়া’ শায়খ ইবনে আরাবীর মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ আল্লামা ইবনে তাইমিয়া বুঝতে পারেননি এবং তার বিরোধীতা করে বিভ্রান্তের শিকার হয়েছেন এবং গায়ের মুকাল্লিদদের উলামারা সেটাকে বুঝতে পেরে শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) কে ‘খাতেমুল বিলায়াতিল মুহাম্মাদীয়া’ মনে করতে শুরু করে দেন
ওয়াহদাতুল ওজুদ ও উলামায়ে দেওবন্দের অবস্থান
এর আগে আমরা প্রমান করেছি যে উলামায়ে দেওবন্দ ওয়াহদাতুল ওজুদ এর হুলুল বা ইত্তেহাদের কায়েল নন। তাঁরা সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে এক মনে করেন না। যা এর আগে মুফতী তাকি উসমানী (মুদ্দাযিল্লুহু) ও মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) এর সংজ্ঞা থেকে স্পষ্ট ভাবে প্রমানিত হয়েছে।
দেওবন্দী উলামায়ে কেরামদের মধ্যে মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদের সবথেকে বেশী প্রচারক ছিলেন হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী (রহঃ)। তিনি তাঁর কিতাবের মধ্যে স্পষ্ট ভাবে প্রমান করেছেন যে স্রষ্টা সৃষ্টি থেকে পৃথক। সৃষ্টি ও স্রষ্টা কোনদিন এক নয়। হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহঃ) এর ১০টি পুস্তক একত্রে ‘কুল্লিয়াতে ইমদাদিয়া’ নামে প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে শেষ পুস্তকটির নাম হল ‘রিসালা দারবায়ানে ওয়াহদাতুল ওজুদ’। সেখানে হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহঃ) লিখেছেন,
“বিদাঁআকে দর আব্দ ও রব আইনিয়াত হাকিকি লুগাবী হারকে এ’তেকাদ দারাদ ওয়া গাইরিয়াত বজমিয়া উজুহ ইনকারে কুনদ মুলহিদ ও জিন্দিক আস্ত। আজিঁ আকিদাহ দর আব্দ ও মাবুদ সাজিদ ও মাসজুদ হিঁচ না ফারকে নামি মানান্দ ই গাইরে ওয়াকিয়া আস্ত নাউজুবিল্লাহি মিন যালিক।”
অর্থাৎ- “কোন ব্যাক্তি যদি স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝখানে কোন ধরনের পার্থক্য সুচিত না করে অর্থাৎ স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে যদি একই সত্তা মনে করে তাহলে সেই ব্যাক্তি নাস্তিক এবং জিন্দিক। অপরদিকে কোন ব্যাক্তি যদি একথা বিশ্বাস করে যে যাকে সিজদা করা হচ্ছে আর যে সিজদা করছে তারা উভয়েই যদি একই সত্তা তাহলে এটা বাস্ত্বতা বিরোধী। এমরা এই ধরনের আকিদা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।” (কুল্লিয়াতে ইমদাদিয়া, পৃষ্ঠা-২২২)
স্কেন পেজঃ
দেখুন এখানে হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী (রহঃ) সৃষ্টি এবং স্রষটাকে আলাদা আলাদা সত্তা বলেছেন এবং তিনি এই ফতোয়া লাগিয়েছেন যে যারা সৃষ্টি ও স্রষ্টার মাঝখানে কোন ধরনের পার্থক্য সুচিত না করে তারা নাস্তিক এবং জিন্দিক। তাহলে বুঝুন উলামায়ে দেওবন্দের স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে যে সৃষ্টি এবং স্রষ্টাকে আলাদা তাহলে তারা হুলুল এবং ইত্তেহাদের আকিদা রাখেন কি করে?
এইবার দেখি উলামায়ে দেওবন্দের প্রানপুরুষ কুতুবে রাব্বানী হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গোহী (রহঃ) সৃষ্টি এবং স্রষ্টাকে আলাদা আলাদা সত্তা বলতে গিয়ে কি লিখেছেন। হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গোহী (রহঃ) এর তাসাউফ সংক্রান্ত একটি বিখ্যাত গ্রন্থ রয়েছে তা হল ‘ইমদাদুস সুলুক’। এই গ্রন্থে তিনি (রহঃ) সৃষ্টি এবং স্রষ্টাকে আলাদা আলাদা সত্তা বলতে গিয়ে লিখেছেন,
“হক তাআলা তামাম আশিয়া কো ঘিরে হুয়ে হ্যায়, আউর হর শয় কে সাথ কারীব ও মায়্যিয়ত রখতা হ্যায়, আউর জার্রা বরাবর চিজ ভি উস সে পোসিদা নেহি, না জমিন মে না আসমান মে, আউর বাওজুদ উস কে হক তাআলা সব সে জুদা হ্যায়, আউর মাখলুক উস সে মুবাইয়ান হ্যায়, পস মাখলুক কা উস সে হুলুল করনা ইয়া মাখলুক কা উস সে হুলুল করনা দোনো হি মুহাল হ্যায়, আউর তামাম আম্বিয়া, আউলিয়া, উলামা হুলুল কে খিলাফ পর মুত্তাফিক হ্যায়। পস হুলুল কা মাযহাব এতমাদ কে কাবিল কিস তরহ হো সকতা হ্যায় ? ইস আকিদা কো খুব মাহফুয রাখখে কে ইস মারতাবা মে হুলুল কি গলতি খুব পড়তি হ্যায়।”
অর্থাৎ- “আল্লাহ তাআলা সমস্ত কিছুকে বেষ্টন করে রেখেছেন এবং প্রত্যেকের নিকটেই রয়েছেন। এবং আসমান এবং জমিনে অনু পরমানু জিনিসও তার থেকে গোপন নয়। তা সত্যেও আল্লাহ তাআলা সবকিছু থেকে পৃথক এবং আলাদা সত্তা। যাইহোক সৃষ্টি তাঁর মধ্যে মিশে যাওয়া এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্যে মিশে যাওয়া দুটোই অসম্ভব। এই ব্যাপারে সমস্ত আম্বিয়া, আউলিয়া, উলামা এই মিশে যাওয়ার বিরুদ্ধে একমত। তাই এই (আল্লাহর সাথে সৃষ্টির মিশে যাওয়ার) মতবাদ কিভাবে গ্রহনযোগ্য হতে পারে? তাই আকিদাকে খুব ভালভাবে সংরক্ষিত করা উচিৎ যেহেতু মানুষ এই (আল্লাহর সাথে সৃষ্টির মিশে যাওয়ার) ব্যাপারে খুব ভুল কর।” (ইমদাদুস সুলুক, পৃষ্ঠা-১৯৪)
স্কেন পেজঃ
দেখুন এখানে হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গোহী (রহঃ) সৃষ্টি এবং স্রষ্টাকে আলাদা আলাদা সত্তা বলেছেন। তাই উলামাদে দেওবন্দের কিতাব থেকে স্পষ্ট প্রমান হয় যে তাঁরা ওয়াহদাতুল ওজুদের ব্যাপারে হুলুল এবং ইত্তেহাদের আকিদায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তারা সৃষ্টি এবং স্রষ্টাকে কোনদিন এক বলেন নি। আর এই হুলুলের আকিদা আমাদের দেওবন্দী উলামায়ে কেরামদের কোন কিতাবে লিপিবদ্ধ করা নেই।
সুতরাং গায়ের মুকাল্লিদদের তাওসীফুর রহমান যাইদী, তালিবুর রহমান যাইদী, মিরাজ রাব্বানী, ফিৎনাবাজ বক্তা মতিউর রহমান মাদানী যে উলামায়ে দেওবন্দ মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ এ বিশ্বাসী হওয়ার জন্য কুফরের ফতোয়া লাগিয়েছে এটা তাদের জালিয়াতি এবং ধোকাবাজী। যা তাদের জন্মগত বদঅভ্যাস।
শাইখে ইবনে আরাবী (রহঃ) এর মতেও সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তা আলাদা সত্তা
শায়খে আকবার মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবী লিখেছেন,
ﻳﺎ ﺇﺧﻮﺍﻧﻲ ﻭﻳﺎ ﺃﺣﺒﺎﺑﻲ ﺃﺷﻬﺪﻛﻢ ﺃﻧﻲ ﺃﺷﻬﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻭﺃﺷﻬﺪ ﻣﻼﺋﻜﺘﻪ ﻭﺃﻧﺒﻴﺎﺀﻩ ﻭﻣﻦ ﺣﻀﺮ ﺃﻭ ﺳﻤﻊ ﺃﻧﻲ ﺃﻗﻮﻝ ﻗﻮﻻً ﺟﺎﺯﻣﺎً ﺑﻘﻠﺒﻲ ﺇﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻭﺍﺣﺪ ﻻ ﺛﺎﻧﻲ ﻟﻪ ﻣﻨﺰﻩ ﻋﻦ ﺍﻟﺼﺎﺣﺒﺔ ﻭﺍﻟﻮﻟﺪ . ﻣﺎﻟﻚٌ ﻻ ﺷﺮﻳﻚ ﻟﻪ ، ﻣﻠﻚ ﻻ ﻭﺯﻳﺮ ﻟﻪ ، ﺻﺎﻧﻊ ﻻ ﻣﺪﺑﺮ ﻣﻌﻪ ، ﻣﻮﺟﻮﺩ ﺑﺬﺍﺗﻪ ﻣﻦ ﻏﻴﺮ ﺍﻓﺘﻘﺎﺭ ﺇﻟﻰ ﻣﻮﺟﻮﺩ ﻳﻮﺟﺪﻩ ، ﺑﻞ ﻛﻞ ﻣﻮﺟﻮﺩ ﻣﻔﺘﻘﺮ ﺇﻟﻴﻪ ﻓﻲ ﻭﺟﻮﺩﻩ . ﻓﺎﻟﻌﺎﻟﻢ ﻛﻠﻪ ﻣﻮﺟﻮﺩ ﺑﻪ ( ﺃﻱ ﻭﺟﺪ ﺑﺈﻳﺠﺎﺩ ﺍﻟﻠﻪ ﻟﻪ ) ﻭﻫﻮ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻣﻮﺟﻮﺩ ﺑﻨﻔﺴﻪ ﻻ ﺍﻓﺘﺘﺎﺡ ﻟﻮﺟﻮﺩﻩ ﻭﻻ ﻧﻬﺎﻳﺔ ﻟﺒﻘﺎﺋﻪ ﺑﻞ ﻭﺟﻮﺩﻩ ﻣﻄﻠﻖ ﻗﺎﺋﻢ ﺑﻨﻔﺴﻪ ، ﻟﻴﺲ ﺑﺠﻮﻫﺮ ﻓﻴﻘﺪﺭ ﻟﻪ ﺍﻟﻤﻜﺎﻥ ﻭﻻ ﺑﻌﺮﺽ ﻓﻴﺴﺘﺤﻴﻞ ﻋﻠﻴﻪ ﺍﻟﺒﻘﺎﺀ ﻭﻻ ﺑﺠﺴﻢ ﻓﻴﻜﻮﻥ ﻟﻪ ﺍﻟﺠﻬﺔ ﻭﺍﻟﺘﻠﻘﺎﺀ ، ﻣﻘﺪﺱ ﻋﻦ ﺍﻟﺠﻬﺎﺕ ﻭﺍﻷﻗﻄﺎﺭ . ﺍﺳﺘﻮﻯ ﻋﻠﻰ ﻋﺮﺷﻪ ﻛﻤﺎ ﻗﺎﻟﻪ ﻭﻋﻠﻰ ﺍﻟﻤﻌﻨﻰ ﺍﻟﺬﻱ ﺃﺭﺍﺩﻩ ﻛﻤﺎ ﺃﻥ ﺍﻟﻌﺮﺵ ﻭﻣﺎ ﺣﻮﺍﻩ ﺑﻪ ﺍﺳﺘﻮﻯ ﻭﻟﻪ ﺍﻵﺧﺮﺓ ﻭﺍﻷﻭﻟﻰ . ﻻ ﻳﺤﺪﻩ ﺯﻣﺎﻥ ﻭﻻ ﻳﺤﻮﻳﻪ ﻣﻜﺎﻥ ﺑﻞ ﻛﺎﻥ ﻭﻻ ﻣﻜﺎﻥ ﻭﻫﻮ ﺍﻵﻥ ﻋﻠﻰ ﻣﺎ ﻋﻠﻴﻪ ﻛﺎﻥ ﻷﻧﻪ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻤﺘﻤﻜﻦ ﻭﺍﻟﻤﻜﺎﻥ ﻭﺃﻧﺸﺄ ﺍﻟﺰﻣﺎﻥ . ﺗﻌﺎﻟﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﺃﻥ ﺗﺤﻠﻪ ﺍﻟﺤﻮﺍﺩﺙ ﺃﻭ ﻳﺤﻠﻬﺎ ﺃﻭ ﺗﻜﻮﻥ ﻗﺒﻠﻪ ﺃﻭ ﻳﻜﻮﻥ ﺑﻌﺪﻫﺎ ، ﺑﻞ ﻳﻘﺎﻝ ﻛﺎﻥ ﻭﻻ ﺷﻲﺀ ﻣﻌﻪ ﺇﺫ ﺍﻟﻘﺒﻞ ﻭﺍﻟﺒﻌﺪ ﻣﻦ ﺻﻴﻎ ﺍﻟﺰﻣﺎﻥ ﺍﻟﺬﻱ ﺃﺑﺪﻋﻪ ، ﻓﻬﻮ ﺍﻟﻘﻴﻮﻡ ﺍﻟﺬﻱ ﻻ ﻳﻨﺎﻡ ﻭﺍﻟﻘﻬﺎﺭ ﺍﻟﺬﻱ ﻻ ﻳﺮﺍﻡ ، ﻟﻴﺲ ﻛﻤﺜﻠﻪ ﺷﻲﺀ ﻭﻫﻮ ﺍﻟﺴﻤﻴﻊ ﺍﻟﺒﺼﻴﺮ
অর্থাৎ- “প্রিয় ভ্রাতা ও বন্ধুগণ, আমি তোমাদেরকে সাক্ষী রেখে ঘোষণা করছি, আমি আল্লাহ তায়ালা, ফেরেশতাগণ, নবীগণ এবং উপস্থিত-অনুপস্থিত শ্রোতা ও পাঠককে সাক্ষী রেখে ঘোষণা করছি যে, আমি আমার অন্তরের গভীর থেকে দৃঢ় ও সুনিশ্চিত বিশ্বাস রাখি যে, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা এক। তার সাথে তুলনীয় দ্বিতীয় কেউ নেই। তিনি স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি থেকে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি মহান বাদশাহ। তার কোন অংশীদার নেই। তিনি এমন বাদশাহ যার কোন পরামশর্দাতা নেই। তিনি মহান কারিগর। তার সহযোগী কোন কারিগর নেই। তিনি অনাদি থেকে নিজেই অস্তিত্বশীল। তার অস্তিত্ত্বের জন্য কোন অস্তিত্বদানকারীর মুখাপেক্ষী নন। তিনি ছাড়া সকল বিদ্যমান বস্তুই অস্তিত্বের জন্য তার মুখাপেক্ষী। সমগ্র মহাবিশ্ব আল্লাহর অস্তিত্বদানের কারণেই বিদ্যমান। কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই অনাদি থেকে বিদ্যমান। তার অস্তিত্বের কোন সূচনা নেই। তার কোন অন্ত নেই। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পূণর্ মৌলিক ও স্বাধীন। তিনি স্বয়ং বিদ্যমান সত্ত্বা। তিনি কোন জওহার (মৌল উপাদান) নন। সকল জওহর বা মৌল উপাদান স্থানের মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তায়ালা স্থানের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত। তিনি কোন আরজ বা আপেক্ষিক উপাদান নন। সকল আরজই অস্তিত্বের জন্য অন্যের উপর নিভর্রশীল। আল্লাহ তায়ালা দেহবিশিষ্ট নন। প্রত্যেক দেহবিশিষ্ট বস্তু একটি দিক রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সকল দিক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। আল্লাহ তায়ালা তার আরশের উপর ইস্তাওয়া করেছেন (কতৃর্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন), যেমনটি তিনি পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন। এই ইস্তাওয়া শব্দের প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন। আরশ ও আরশ সংশ্লিষ্ট বস্তুসমূহ আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতা ও কুদরতের মাধ্যমেই অস্তিত্বশীল। সূচনা ও অন্ত সব কিছুর মালিকই আল্লাহ তায়ালা। কোন সময় আল্লাহ তায়ালাকে সীমিত করতে পারে না। কোন স্থান তাকে পরিবেষ্টন করতে পারে না। যখন কোন স্থানেরই অস্তিত্ব ছিলো না, তখনও আল্লাহ তায়ালা বিদ্যমান ছিলেন। স্থান সৃষ্টির পুর্বে যেমন আল্লাহ তায়ালা স্থান থেকে মুক্ত অবস্থায় বিদ্যমান ছিলেন, তিনি এখনও স্থান থেকে মুক্ত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছেন। কেননা সকল স্থান ও স্থানে আবদ্ধ সব কিছুর স্রষ্টা তিনি। তিনিই সময়কে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সত্ত্বার মাঝে নশ্বর বিষয়ের অনুপ্রবেশ থেকে আল্লাহ তায়ালা মহাপবিত্র। কোন সৃষ্টিই আল্লাহর পুর্বে বা পরে অস্তিত্বশীল নয়। বরং আমাদের বিশ্বাস হলো, অনাদিকাল থেকে আল্লাহ তায়ালা বিদ্যমান রয়েছেন। কোন সৃষ্টি তার সঙ্গে অনাদি থেকে অস্তিত্বশীল নয়। কেননা “পুর্বে” ও পরে সময়সূচক দু’টি শব্দ। আর সময়ের স্রষ্টা হলেন আল্লাহ তায়ালা। তিনি চিরঞ্জীব। কখনো নিদ্রাগমন করেন না। তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কখনও দুর্বল হন না। তার সাথে তুলনীয় কিছুই নেই। তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।”
শায়খে আকবার মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবী বলেন,
ﺫﺍﺕ ﺍﻟﺤﻖ ﻟﻴﺴﺖ ﺫﺍﺕ ﺍﻟﻌﺒﺪ ، ﺇﺫ ﻻ ﻃﺎﻗﺔ ﻟﻠﻤﺤﺪَﺙ ﻋﻠﻰ ﺣﻤﻞ ﺍﻟﻘﺪﻳﻢ
অর্থাৎ – “আল্লাহর সত্ত্বা ও বান্দার সত্ত্বা এক নয়। কেননা নশ্বর সৃষ্টির পক্ষে অবিনশ্বর স্রষ্টাকে ধারণ করার ক্ষমতা নেই।”
শায়খে আকবার আরও বলেন,
ﻣﻦ ﻗﺎﻝ ﺑﺎﻟﺤﻠﻮﻝ ﻓﻬﻮ ﻣﻌﻠﻮﻝ ، ﻓﺈِﻥ ﺍﻟﻘﻮﻝ ﺑﺎﻟﺤﻠﻮﻝ ﻣﺮﺽ ﻻ ﻳﺰﻭﻝ ، ﻭﻣﺎ ﻗﺎﻝ ﺑﺎﻻﺗﺤﺎﺩ ﺇِﻻ ﺃﻫﻞ ﺍﻹِﻟﺤﺎﺩ ، ﻛﻤﺎ ﺃﻥ ﺍﻟﻘﺎﺋﻞ ﺑﺎﻟﺤﻠﻮﻝ ﻣﻦ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﺠﻬﻞ ﻭﺍﻟﻔﻀﻮﻝ
অর্থাৎ- “যে ব্যক্তি হুলুলের (সৃষ্টির মাঝে আল্লাহর অনুপ্রবেশ) বিশ্বাস রাখল, সে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত। কেননা হুলুলের আকিদা একটি চিরস্থায়ী রোগ। একইভাবে স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে এক বলার কথা কেবল কাফেররাই বলে থাকে। তেমনি হুলুলে আকিদা পোষণকারী ব্যক্তিও অজ্ঞ ও মূর্খ।” (ফুতুহাতে মাক্কীয়া, আল-ইয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির, ইমাম শা’রানী রহ. খ.১, পৃ.৮০-৮১)
তিনি আরও বলেন,
ﺍﻟﺤﺎﺩﺙ ﻻ ﻳﺨﻠﻮ ﻋﻦ ﺍﻟﺤﻮﺍﺩﺙ ، ﻭﻟﻮ ﺣﻞ ﺑﺎﻟﺤﺎﺩﺙِ ﺍﻟﻘﺪﻳﻢُ ﻟﺼﺢ ﻗﻮﻝ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﺘﺠﺴﻴﻢ ، ﻓﺎﻟﻘﺪﻳﻢ ﻻ ﻳﺤﻞ ﻭﻻ ﻳﻜﻮﻥ ﻣﺤﻼً
অর্থাৎ- “নশ্বর বস্তু বিভিন্ন নশ্বর উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। অবিনশ্বর সত্ত্বা আল্লাহ তায়ালা যদি নশ্বর বস্তুর মাঝে প্রবেশ করেন, তাহলে দেহবাদীদের (মুজাসসিমা) বক্তব্য সঠিক হতো (অথচ তাদের এই বক্তব্য কুফুরী)। সুতরাং অবিনশ্বর সত্ত্বা কোন সৃষ্টির মাঝে প্রবেশ করেন না, তার সত্ত্বাও কোন নশ্বর বস্তু সৃষ্টির অনুপ্রবেশ ঘটে না।” (আল-ইয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির, খ.১, পৃ.৮০-৮১)
ﻭﻫﺬﺍ ﻳﺪﻟﻚ ﻋﻠﻰ ﺃﻥ ﺍﻟﻌﺎﻟﻢ ﻣﺎ ﻫﻮ ﻋﻴﻦ ﺍﻟﺤﻖ ، ﻭﻻ ﺣﻞ ﻓﻴﻪ ﺍﻟﺤﻖ ، ﺇِﺫ ﻟﻮ ﻛﺎﻥ ﻋﻴﻦَ ﺍﻟﺤﻖ ، ﺃﻭ ﺣﻞَّ ﻓﻴﻪ ﻟﻤﺎ ﻛﺎﻥ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻗﺪﻳﻤﺎً ﻭﻻ ﺑﺪﻳﻌﺎً
অর্থাৎ- “আলোচনাটি তোমাকে নিশ্চিত প্রমাণ দিবে যে, সৃষ্টি বা মহাবিশ্ব কখনও হুবহু আল্লাহর সত্ত্বা নয়; সৃষ্টির মাঝেও আল্লাহ প্রবেশ করেন না। আল্লাহ তায়ালা ও মহাবিশ্ব যদি একই হতো অথবা বিশ্বের মাঝে আল্লাহ যদি প্রবেশ করতেন, তাহল আল্লাহ তায়ালা কখনও অবিনশ্বর ও অতুলনীয় স্রষ্টা হতেন না।” (আল-ইয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির, খ.১, পৃ.৮০-৮১)
শায়খে আকবার বলেন,
ﻟﻮ ﺻﺢَّ ﺃﻥ ﻳﺮﻗﻰ ﺍﻹِﻧﺴﺎﻥ ﻋﻦ ﺇِﻧﺴﺎﻧﻴﺘﻪ ، ﻭﺍﻟﻤَﻠﻚُ ﻋﻦ ﻣﻠﻜﻴﺘﻪ ، ﻭﻳﺘﺤﺪ ﺑﺨﺎﻟﻘﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ، ﻟﺼﺢَّ ﺍﻧﻘﻼﺏ ﺍﻟﺤﻘﺎﺋﻖ ، ﻭﺧﺮﺝ ﺍﻹِﻟﻪ ﻋﻦ ﻛﻮﻧﻪ ﺇِﻟﻬﺎً ، ﻭﺻﺎﺭ ﺍﻟﺤﻖ ﺧﻠﻘﺎً ، ﻭﺍﻟﺨﻠﻖ ﺣﻘﺎً ، ﻭﻣﺎ ﻭﺛﻖ ﺃﺣﺪ ﺑﻌﻠﻢ ، ﻭﺻﺎﺭ ﺍﻟﻤﺤﺎﻝ ﻭﺍﺟﺒﺎً ، ﻓﻼ ﺳﺒﻴﻞ ﺇِﻟﻰ ﻗﻠﺐ ﺍﻟﺤﻘﺎﺋﻖ ﺃﺑﺪﺍً
অর্থাৎ- “মানুষ তার মানবীয় গুণ থেকে মুক্ত হয়ে এবং ফেরেশতা তার ফেরেশতাসুলভ সত্ত্বাগত বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত হয়ে যদি আল্লাহর সত্ত্বার সাথে মিশে যাওয়ার কথা সঠিক হতো, তাহলে বস্তুর মৌল উপাদানে পরিবতর্নের ধারণা সঠিক হতো। ফলে আল্লাহ তায়ালা স্রষ্টার বৈশিষ্ট্য থেকে বের হয়ে যেতেন। স্রষ্টা তখন সৃষ্টিতে পরিণত হতো। সৃষ্টি হয়ে যেত স্রষ্টা। কাউকে তার মূল পরিচয়ে সনাক্ত করা সম্ভব হতো না। অসম্ভব বিষয় আবশ্যকীয় হয়ে যেতো। সুতরাং এভাবে কলবে হাকাইক বা বস্তুর মৌল উপাদানে পরিবতর্নের ধারণা কখনও সঠিক হতে পারে না।” (আল-ইয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির, খ.১, পৃ.৮০-৮১)
শায়খে আকবার মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবী বলেন,
ﺇﺫ ﻳﺴﺘﺤﻴﻞ ﺗﺒﺪّﻝ ﺍﻟﺤﻘﺎﺋﻖ؛ ﻓﺎﻟﻌﺒﺪ ﻋﺒﺪ ، ﻭﺍﻟﺮﺏ ﺭﺏ ، ﻭﺍﻟﺤﻖ ﺣﻖ ، ﻭﺍﻟﺨﻠﻖ ﺧﻠﻖ
অর্থাৎ- “সুতরাং মৌল উপাদানে পরিবতর্নের ধারণাটি অবাস্তব ও অসম্ভব। সুতরাং বান্দা অবশ্যই বান্দা। স্রষ্টা অবশ্যই স্রষ্টা। আল্লাহ তায়ালা সদা-সবর্দাই আল্লাহ। একইভাবে সৃষ্টিও সবর্দা সৃষ্টি।” (ফুতুহাতে মাক্কীয়া, খ.২, পৃ.৩৭১)
তিনি আরও বলেন,
ﻓﻼ ﻳﺠﺘﻤﻊ ﺍﻟﺨﻠﻖ ﻭﺍﻟﺤﻖ ﺃﺑﺪﺍً ﻓﻲ ﻭﺟﻪ ﻣﻦ ﺍﻟﻮﺟﻮﻩ ، ﻓﺎﻟﻌﺒﺪُ ﻋﺒﺪٌ ﻟﻨﻔﺴﻪ ، ﻭﺍﻟﺮﺏُّ ﺭﺏٌّ ﻟﻨﻔﺴﻪ ، ﻓﺎﻟﻌﺒﻮﺩﻳﺔ ﻻ ﺗﺼﺢ ﺇﻻ ﻟﻤﻦ ﻳﻌﺮﻓﻬﺎ ﻓﻴﻌﻠﻢ ﺃﻧﻪ ﻟﻴﺲ ﻓﻴﻬﺎ ﻣﻦ ﺍﻟﺮﺑﻮﺑﻴﺔ ﺷﻲﺀ ، ﻭﺍﻟﺮﺑﻮﺑﻴﺔ ﻻ ﺗﺼﺢ ﺇﻻ ﻟﻤﻦ ﻳﻌﺮﻓﻬﺎ ﻓﻴﻌﺮﻑ ﺃﻧﻪ ﻟﻴﺲ ﻓﻴﻬﺎ ﻣﻦ ﺍﻟﻌﺒﻮﺩﻳﺔﺷﻲﺀ.
অর্থাৎ- “কোনভাবেই স্রষ্টা ও সৃষ্টি কখনও এক হতে পারে না। বান্দা মৌলিকভাবেই সে বান্দা। স্রষ্টা মৌলিকভাবেই স্রষ্টা। বান্দা নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবগত থাকা জরুরি। বান্দা এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা আবশ্যক যে, তার মাঝে স্রষ্টার কোন গুণ নেই। একইভাবে স্রষ্টা ও রব তার অবস্থান সম্পর্কে অবগত। এটিও সুনিশ্চিত যে, স্রষ্টার মাঝে বান্দা বা সৃষ্ট হওয়ার কোন গুণ নেই।” (ফুতুহাতে মাক্কীয়া, খ.৩, পৃ.৩৭৮)
শায়খে আকবার বলেন,
“ﻭﻣﻦ ﻗﺎﻝ ﺑﺎﻟﺤﻠﻮﻝ ﻓﻬﻮ ﻣﻌﻠﻮﻝ ”.
অর্থাৎ- “যে ব্যক্তি সৃষ্টির মাঝে আল্লাহর প্রবেশের ধারণা রাখে, সে অবশ্যই অভিযুক্ত ও জ্বরাগ্রস্ত।” (ফুতুহাতে মাক্কীয়া, খ.৪, পৃ.৩৭৯]
তিনি বলেন,
“ﻭﺍﻟﺤﻖ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻣﻨﺰّﻩ ﺍﻟﺬﺍﺕ ﻋﻦ ﺍﻟﺤﻠﻮﻝ ﻓﻲ ﺍﻟﺬﻭﺍﺕ”
অর্থাৎ- “মহান আল্লাহর সত্ত্বা নশ্বর সৃষ্টির মাঝে প্রবেশ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র।” (ফুতুহাতে মাক্কীয়া, খ.৩, পৃ.৫২, আরও দেখুন, খ.২, পৃ.৬১৪)
সুতরাং শায়খে আকবর মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবী (রহঃ) এর লেখনি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে তিনি সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে আলাদা আলাদা মনে করতেন। তিনি কোন দিনই সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে এক মনে করেন নি। তিনি হুলুল বা ইত্তেহাদের আকিদা রাখতেন না। তাই ওয়াহদাতুল ওজুদ এর জন্য তাঁকে কুফরীর ফতোয়া দেওয়া যায় না। গায়ের মুকাল্লিদরা জালিয়াতি করে তাঁর উপর হুলুল এবং ইত্তেহাদের আকিদা ফিট করে কুফরের ফতোয়া দেয়।
আর এখানে আর একটি কথা স্পষ্ট যে গায়ের মুকাল্লিদরা ওয়াহদাতুল ওজুদ বলতে যে অর্থ করেছে সেই অর্থে ওয়াহ্দাতুল ওজুদের উপর শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) ও উলামায়ে দেওবন্দ বিশ্বাসী নন। তাই ওয়াহদাতুল ওজুদ এর উপর ভিত্তি করে শায়খ ইবনে আরাবী ও উলামায়ে দেওবন্দকে কাফের ও মুশরিক ফতোয়া দেওয়া যায় না। যারা দেয় তারা ধোকাবাজ ও জালিয়াত।
শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) এর কথার ব্যাখ্যা
যখন কোন বুযুর্গকে হক্কানী মনে করা হয়, তখন তার কথা কাজ শরীয়’ত বিরোধী কিভাবে হয়? কারণ বুযুর্গ হওয়ার প্রথম শর্ত হল শরীয়’তের অনুকরণ করা।
প্রকৃত কথা হল সর্ব প্রকার বিদ্যার নিজ নিজ পরিভাষা, থাকে সে বিষয় বিদ্যাণরাই বেশী জানেন, তাদের থেকে সে পরিভাষাগুলি না শিখলে তা বুঝতে অসুবিধা হয়, হাদীস, উসুলে হাদীস, ফিকাহ, তাফসীর, কালাম, ফারায়েজ, আছমায়ে বিজাল, মায়ানী, বয়ান, বাদীই, সরফ, নাহু, তিব্ব, মানতিক, ফালছাফা, তারীখ, জুগরাফিয়া, রিয়াজী, ইত্বাদী বিদ্যার একই অবস্থা, যদি শিক্ষক ছাড়া তা শিক্ষা করা হয়. তা প্রকৃত বিদ্যা হবে না বরং তার ভিতর অনেক ভুল ক্রটি থাকবে।
অনেকে শায়খের বক্তব্য বুঝতে না পেরে তাঁর উপর কুফরের ফতোয়া লাগিয়েছেন। আসলে তাঁরা শায়েখের বক্তব্য বুঝতে পারেন নি। অর্থ বুঝার ক্ষেত্র তাঁরা বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। সেজন্য শায়েখ আকবর মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবী (রহ.) বলেছেন, “যারা আমাদের পরিভাষা জানেনা আমাদের কিতাব পড়া তাদের বৈধ নয়।”
শায়েখ মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবী (রহ.) এর বানী থেকে যে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে বা ভুলতথ্য প্রচার করা হয়েছে এবং শরীয়’ত বিরোধী কথা মিলিয়ে প্রচার করা হয়েছে, হযরত শায়েখ আব্দুল ওহাব শারানী (রঃ) ‘আল ইয়াকিত ওল জাওয়াহির’ এবং ‘কিবরিযাতে আহমার’ নামক কিতাবে ভুলতথ্য গুলির সঠিক ব্যাখ্যা প্রকাশ করেছেন এছাড়া হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিতে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশারাফ আলি থানভী (রহ.) ‘আততাম্বিহ হুতাতিবরী ফি তানজিহি ইবনিল আরাবী’ নামক কিতাবে শায়েখ আকবরের কথাগুলি এমন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে শায়েখ আকবরের কথায় কোন দোষ মনে হয়না বরং তা ক্রটিমুক্ত মনে হয়।
যেমন শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) ‘হামাউস্ত’ এর কথা বলেছেন। ‘হামাউস্ত’ এর অর্থ হল তিনিই সব। এখানে অনেকে বুঝেছেন যে শায়খ একথা বলতে চেয়েছেন যে তিনিই সব এর অর্থ সব কিছুই আল্লাহ। অথচ শায়খের বক্তব্য একথা মনে করার কোন কারন নেই কারন তিনি তাঁর গ্রন্থ গুলিতে আল্লাহ ও বান্দার পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ ও বান্দা পৃথক সত্ত্বা।
আশরাফ আলী থানবী রহঃ লিখিত “আত তাকাশশুফ” কিতাবে ওয়াহদাতুল ওজুদ এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেনছেন,
রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন-
ﻋﻦ ﺃﺑﻲ ﻫﺮﻳﺮﺓ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﻗﺎﻝ ﻗﺎﻝ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭ ﺳﻠﻢ : ( ﻗﺎﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﺰ ﻭ ﺟﻞ ﻳﺆﺫﻳﻨﻲ ﺍﺑﻦ ﺁﺩﻡ ﻳﺴﺐ ﺍﻟﺪﻫﺮ ﻭﺃﻧﺎ ﺍﻟﺪﻫﺮ ﺑﻴﺪﻱ ﺍﻷﻣﺮ ﺃﻗﻠﺐ ﺍﻟﻠﻴﻞ ﻭﺍﻟﻨﻬﺎﺭ [ ﺻﺤﻴﺢ ﺍﻟﺒﺨﺎﺭﻯ – ﻛﺘﺎﺏ ﺍﻟﺘﻔﺴﻴﺮ ، ﺑﺎﺏ ﺗﻔﺴﻴﺮ ﺳﻮﺭﺓ ﺣﻢ ( ﺍﻟﺠﺎﺛﻴﺔ ) ، ﺭﻗﻢ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ -4549، 5827 ، 5829 ، 7053 ]
“আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, আদম সন্তান জমানাকে মন্দ বলে আমাকে কষ্ট দেয়, অথচ জমানাতো আমিই। [অর্থাৎ] আমারই আয়ত্বে সকল কাজ। [যা জমানা ও কালের মাঝে সংঘটিত হয়]। রাত দিনকে [যা কাল সময়ের অংশ] আমিইতো পরিবর্তন করি। [যেদিকে মানুষ ঘটনাবলীকে সম্পৃক্ত করে। অতএব জমানাতো তার মধ্যকার যাবতীয় বিষয়সহ আমারই অধীন। তাই এসব কার্যকলাপ সবইতো আমারই। একে মন্দ বললেতো আমাকেই মন্দ বলা অবধারিত হয়।” {সহীহ বুখারী, হাদীস (নং-৪৫৪৯, ৭০৫৩, ৫৮২৯, ৫৮২৭, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৬০০০, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৫২৭৬)
(এই হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে আল্লাহই সময় অথচ এটা) প্রকাশ্য ব্যাপার যে, আল্লাহ তায়ালা এবং জমানা বা সময় এক নয়। কিন্তু এক না হওয়া সত্বেও উপরোক্ত হাদীসে এক হওয়ার শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তত্ত্ববিদগণের দৃষ্টিতে এই ব্যাখ্যা হিসেসেই [হামাউস্ত] তথা “সবই তিনি” বলা হয়েছে।
এর বিশ্লেষণ হল-দুনিয়ার সমুদয় বস্তু নিজ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াসহ আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতাধীন। অতএব প্রকৃত ক্রিয়াশীল এবং স্ব-অস্তিত্বে অস্তিত্ববান শুধু আল্লাহ তায়ালা, আর সমুদয় বস্তু কিছুই নয়। তাই হাদীস দ্বারা সুফিয়ানে কিরামের উক্তি হামাউস্ত তথা সবই তিনি এর পোষকতা স্পষ্টরূপে বুঝে আসছে।
দুনিয়ার যাবতীয় জিনিস বাহ্যদৃষ্টিতে বিদ্যমান। কিন্তু মূলত কিছুই বিদ্যমান নেই। অর্থাৎ পূর্ণ সত্তা গুণে কিছুই গুণান্বিত নয়। এক আল্লাহ পাকের সত্তা ছাড়া। এই বিষয়টিকেই ‘হামাউস্ত’ তথা সবই তিনি শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
দৈনন্দিন কথাবার্তার ন্যায় এটাও একটি প্রচলিত বাক্য। যেরূপে কোন বিচারক কোন ফরিয়াদীকে বলে- “তুমি কি পুলিশে রিপোর্ট করেছো? কোন উকিলের সাথে পরামর্শ করিয়াছো?” সে বলে- “হুজুর! পুলিশ আর উকিল সবইতো আপনিই”। একথার দ্বারা অর্থ কিছুতেই এরূপ নয় যে, বিচারক, পুলিশ এবং উকিল সবই এক। তাদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। বরং অর্থ হল-পুলিশ, উকিল গণনার যোগ্য কোন বিষয় নয়, আপনিই এই বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তেমনি এখানেও বুঝে নিতে হবে, ‘হামাউস্ত’ তথা তিনিই সব অর্থ এই নয় যে, সব সৃষ্ট বস্তু আর তিনি এক। বরং এ কথার উদ্দেশ্য হল-সকল বস্তুর সত্তা গণনার অযোগ্য। শুধু আল্লাহর সত্তাই গণনার যোগ্য। অবশ্য আল্লাহ ছাড়া অন্য যা কিছু বিদ্যমান, সত্তা সেগুলিরও আছে, কিন্তু সেগুলির সত্তা আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ সত্তার সামনে শুধু বাহ্যিক সত্তা। প্রকৃত ও পরিপূর্ণ সত্তা নয়।
এটার বিস্তারিত বিবরণ হল-প্রত্যেক গুণের দু’টি পর্যায় থাকে। একটি হল পূর্ণাঙ্গ, অপরটি অপূর্ণাঙ্গ। আর নিয়ম এই যে, পূর্ণাঙ্গের সামনে অপূর্ণ সর্বদা অস্তিত্বহীন মনে করা হয়। এটার দৃষ্টান্ত হয়-যেমন কোন নিম্ন আদালতের বিচারক এজলাসে বসে নিজ কর্তৃত্বের বাহাদুরী প্রদর্শন করছিল, এবং নিজের পদ-গৌরবে কোন লোককে কিছুই মনে করছিল না। হঠাৎ করে সেখানে দেশের বাশাহ পরিদর্শন করতে এজলাসে আসলেন। বাদশাহকে দেখামাত্রই চেতনা বিলুপ্ত প্রায় হয়ে তার সমস্ত বাগাড়ম্বর, গৌরব ও অহংকার তিরোহিত হয়ে গেল। এখন নিজের ক্ষমতাকে যখন বাদশাহের শাহী ক্ষমতার সামনে দেখে, তখন তার নিজের পদমর্যাদার কোন অস্তিত্বই কোথাও খুঁজে পায় না। পড়ি কি মরি অবস্থা। না কোন শব্দ বের হচ্ছে, না মাথা তুলতে পারছে। এই সময় যদিও তার পদমর্যাদা বিলীন হয়নি। কিন্তু বিলুপ্তপ্রায় হয়েছে। এমনই বুঝতে হবে যে, জগতের জিনিস সমূহ সব কিছু যদিও বিদ্যমান, কেননা আল্লাহ তা’আলা এগুলোকে সত্তা দান করেছেন, কিন্তু আল্লাহ তা’আলার সত্তার সামনে ওগুলোর সত্তা অতিশয় অপূর্ণাঙ্গ, দুর্বল ও তুচ্ছ বটে। এ জন্য সৃষ্টির সত্তাকে আল্লাহ তা’আলার সত্তার সামনে যদিও বিলীন বলবো না, কিন্তু বিলীন সদৃশ্য নিশ্চয় বলবো। সুতরাং সৃষ্টি যখন বিলীন সদৃশ্য গণ্য হল, তখন গণনার যোগ্য সত্তা শুধু একটিই রয়ে গেল। অহদাতুর ওজুদের [একক সত্তা] অর্থ এটাই। কেননা এর শাব্দিক অর্থ সত্তা এক হওয়া। অতএব এক হওয়ার অর্থ অপর সত্তা থাকলেও না থাকার মত। এটাকেই একটু বাড়িয়ে ওহদাতুল ওজুদ বা একক সত্তা বলা হয়। মহান আল্লাহ তা’আলাকে জীবন্ত সদৃশ্য মনে কর। আর সমগ্র বিশ্ব ও সৃষ্টিকে মৃত সদৃশ্য মনে কর। যেমন মৃত লাশও এক পর্যায়ে সত্তার অধিকারী। কারণ দেহ তারও আছে। কিন্তু জীবিতদের তুলনায় সেই সত্তা গণনার যোগ্য নয়। কেননা মৃতের সত্তা অপূর্ণ, আর জীবিতদের সত্তা কামেল বা পূর্ণাঙ্গ। পূর্ণাঙ্গের সামনে অপূর্ণাঙ্গ একেবারেই দুর্বল ও অস্তিত্বহীন। এই বিষয়টিকে এলমী পর্যালোচনা ও তাৎপর্যের বিশ্লেষণে তাওহীদ বলা হয়, যা অর্জন করা কোন কামাল বা পূর্ণতা নয়। অহদাতুশ শুহুদের সারমর্মও এটাই। অর্থাৎ বাস্তাবে বহু সত্তা বিদ্যমান থাকলেও আল্লাহর পথের পথিক এক সত্তাকেই প্রত্যক্ষ করে। আর সকল সত্তা তার সামনে অস্তিত্বহীন বলে মনে হয়। যেমন পূর্ব বর্ণিত দৃষ্টান্তগুলোর দ্বারা পরিস্কারভাবে বুঝানো হয়েছে। আর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ শেখ সাদী রহঃ বর্ণনা করেছেন-
“রাত্রিকালে যে জোনাকী প্রদীপের ন্যায় জ্বলে, তাকে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, দিনের বেলা তুমি বাহিরে আস না কেন? জোনাকী চমৎকার জবাব দিল, আমিতো দিবানিশি মাঠে প্রান্তরেই থাকি, কিন্তু সূর্যের দীপ্তির সামনে আমার আলো প্রকাশ পায় না। এরই নাম অহদাতুল ওজুদ। এতে কোন স্থানে শিরকের অর্থ আছে?”
তাই ‘হামাউস্ত’ বা ওয়াহদাতুল ওজুদে কোন শিরকিয়া আকিদা নেই। কিন্তু এই ফিৎনাবাজ গায়ের মুকাল্লিদদেরকে বোঝাবে কে?
শেষ কথা
শায়খ আকবর ইবনুল আরাবী সম্বন্ধে মুসলিম আলেমরা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। ইবনে তাইমিয়া, আল-তাফতাযানী ও ইব্রাহীম আল-বিকায়, মুল্লা আলী কারী হানাফী তাকে কাফের ফতোয়া দিয়েছেন এবং তার হুলুল বা ইত্তেহাদ এর মত প্রচারকারী মনে করে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। অন্যদিকে আল-কামুস রচয়িতা মজদুদ্দীন, আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী (রহঃ), আব্দুর রাজ্জাক আল-কাশানী (রহঃ) ও আব্দুল ওহাব শা’রানী (রহঃ), শায়খ সেরহিন্দী মুজাদ্দিসে আলফে সানী (রহঃ), শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী (রহঃ), ইমাম শাওকানী, মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলবী, নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী তাকে একজন বিখ্যাত ওলী, সুফি ও সিদ্দীক হিসেবে অভিনন্দিত করেছেন। এবং জোর গলায় একথাও প্রচার করেছেন যে, তারা দ্বারা দ্বীন ইসলাম অনেকখানী উপকৃত হয়েছে। তার মহিমা লোক সমাজে উদঘাটিত হয়েছে। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী (রহঃ) বলেছেন, “মহিউদ্দীন ইবনুল আরাবী আলেমকুলের শীরমনি, আল্লাহ তাকে সব রকম হিকমত বা জ্ঞান দান করেছেন।” ইবনুল জাওযী (রহঃ) একদা তাকে বলেছিলেন, “তোমার ফতুহাত আল-মক্কিয়াহ আমার তাযিয়ার ভাষ্য হিসেবে যথেষ্ট।” শেহাবুদ্দীন সুহরাওয়ার্দী (রহঃ) বলেছেন, “মহিউদ্দীন ইবনুল আরাবী হাকায়েক বা সত্যতার সমুদ্র বিশেষ।”
তাই ইবনে আরাবী সম্পর্কে আলেমদের মধ্যে দুই ধরনে মতামত পাওয়া যায়। এক দল তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম বুঝতে না পেরে কাফের ও জিন্দিক হবার ফতোয়া লাগিয়েছেন। যেহেতু শায়েখের বক্তব্য তাঁদের কাছে নতুন লেগেছিল। অপরদল শায়খ ইবনে আরাবীকে শায়েখে আকবর, ‘খাতেমুল বিলায়াতিল মুহাম্মাদীয়া’, আউলিয়াকুল শিরোমনী বলে স্মরন করেছেন।
আরও দেখা যায় শায়খ ইবনে আরাবীর অনুসারীদের মধ্যে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের বুযর্গরাও ছিলেন। তাই ইবনে আরাবীকে কাফের ফতোয়া দিলে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের অনেক বুযর্গদেরকেও কাফের ফতোয়া দিতে হবে। যা কোন দিনই সম্ভব নয়। কেন না তাদের বুযর্গী সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে। তাই শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী (রহঃ), শায়খ আহমদ সেরহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহঃ) প্রভৃতিরা বলেছেন যে, ইবনে আরাবীর সেই সব কথা গ্রহন করা যাবে যা কিতাব ও সুন্নতের অনুকুল এবং সেই সব কথার তাবিল (ব্যাখ্যা) করা হবে যা কিতাব ও সুন্নতের বিপরীত, তাঁর এই ধরনের কথার ভালো অর্থে এনে তাবিল করতে হবে।
প্রথম পর্বটি পড়ার জন্য নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন,
মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ ও শায়খ ইবনে আরাবী রহঃ (১ম পর্ব)