লিখেছেনঃ অসিত বরণ পাল
অরণ্যচারী মানব থেকে শুরু করে সকলের ভেতরই একটি শিল্পী মন কাজ করে। প্রয়ােজনের তাগিদেই মানুষকে নতুন নতুন জিনিস উদ্ভাবন করতে হয়েছে। আর তার ভেতরেই প্রতিফলিত হয়েছে তার সৃষ্টিশীলতা। মানুষ তার জীবনের প্রয়ােজনেই শিল্পকর্মে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আর তার প্রতিফলন পড়ে ব্যবহার্য দ্রব্যাদিতে। প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষের শিল্পকর্মের প্রধান মাধ্যম হয় মাটি। এ মাটি দিয়েই তারা তাদের প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি তৈরী করতে থাকে। যেমন, বিভিন্ন ধরনের বাসন পত্র, শিশুদের বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী, সীল, ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত নিদর্শন, বিভিন্ন ধরনের অলংকার, প্রভৃতি। এছাড়াও প্রাচীন সভ্যতার মানুষেরা পােড়া মাটির চমৎকার ভাস্কর্য তৈরীতে দক্ষ ছিল। আগুন আবিস্কারের পর থেকে মানুষ যখন পাকান্ন ভােজন শুরু করে তখন থেকে মাটির হাড়ি পাতিলের ব্যবহার শুরু হয়। তাই বিভিন্ন প্রাচীন বাংলার স্থানে প্রচুর পরিমাণে হাড়ি পাতিলের টুকরা পাওয়া গিয়েছে। এগুলাে মানুষের ব্যবহৃত আদি নিদর্শন। মাটির নিচে প্রাপ্ত কোন প্রাচীন নিদর্শন পর্যবেক্ষণ করে একটি যুগের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা যায়। যেমন প্রাচীন মিশর, ব্যাবিলন ও গ্রীক শিল্পকলা থেকে তৎকালীন সময়ে সে দেশগুলাের জীবনযাত্রা প্রণালী জানা যায়।১ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে গৃহস্থালীর কাজে পােড়ামাটির থালা বাসনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, যেমন পশ্চিম এশিয়ার প্রাচীনতম সভ্যতার কেন্দ্রগুলােতে বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক দ্রব্যাদি আবিস্কৃত হয়েছে, এগুলাের মধ্যে পােড়ামাটির তৈজষপত্র বিশেষ উল্লেখযােগ্য। এছাড়া এখানে প্রাপ্ত পােড়ামাটির টালিতে উ কীর্ণ লিপি থেকেও আমরা তৎকালীন সময়ের মিশর এবং এ অঞ্চলের সভ্যতার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বহু তথ্য পাই। অন্যদিকে ভারতবর্ষের হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়াে সভ্যতার কেন্দ্রগুলােতে প্রচুর পােড়ামাটির সীল, খেলনা, বাসন ইত্যাদি আবিস্কৃত হয়েছে। এছাড়াও থালা, বাটি, সরা, গ্লাস পেয়ালা ইত্যাদি শুধু নির্মিতই হতাে না, অনেক ক্ষেত্রে রং ও বার্লিস ব্যবহার করে অতি সুন্দরভাবে তা চিত্রিতও করা হতাে। হরপ্পার বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের চিত্রিত অনেক হাড়ি পাতিলের টুকরা আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের মাটির খেলনা ও পােড়ামাটির পুতুল আবিস্কৃত হয়েছে। এসব নিদর্শনের শিল্প নৈপুণ্য থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মনে করেন সভ্যতা গড়ে ওঠার পূর্ব থেকেই এখানে এ ধরনের শিল্পের চর্চা হয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার যুগেই এর পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। অমিয় কুমার মহাশয়ের মতে অতি দীর্ঘকাল ধরে সঞ্চিত কৃষ্টি ও সংস্কার গুলােই ভারতীয় ভাস্কর্যের ভিত্তি।২ শিল্প সমালােচক ক্ৰামরিশ সিন্ধু সভ্যতার ভাস্কর্যগুলাে পর্যালােচনা করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, ভারতের মৌর্য ভাস্কর্য এবং সিন্ধু সভ্যতার ভাস্কর্যগুলাে একই শ্রেণীর ভাস্কর্য।৩
প্রাচীন ভারতের শিল্পকলার এ ঐতিহ্য প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন বিহার, মন্দির অলংকরণে প্রচুর ব্যবহৃত হয়েছিল। এদেশে পাথরের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে শিল্পীরা কখনােই হাল ছাড়েনি। তারা তাদের শিল্প সৃষ্টির বিকল্প মাধ্যম হিসেবে এ দেশের বিভিন্ন মন্দির গাত্রে অলংকরণের জন্য পােড়ামাটির ফলক ব্যবহার করেছে। এই ফলকের প্রচুর ব্যবহার দেখা যায় প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন স্থানে।৪
প্রাচীন বাংলার পােড়ামাটি শিল্পের বিকাশ আলােচনার পূর্বে আমাদের এ এলাকার ভৌগােলিক অবস্থা, বিভিন্ন রাজ্যের আয়তন, তখনকার মানুষের ইতিহাস ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা থাকা দরকার। বর্তমান প্রবন্ধের প্রথমে প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন জনপদ এবং পরবর্তীতে এ জনপদ গুলােতে প্রাপ্ত কিছু পােড়ামাটির ফলক সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে।
বাংলা বলতে আমাদের চোখের সামনে বিরাট এক দেশের ছবি ভেসে উঠে, যার শিয়রে উত্তুঙ্গ পাহাড়, দু’পাশে কঠিন শিলাকীর্ণ ভূমি এবং পায়ের নিচে বিস্তীর্ণ সমুদ্র। সে সময়ে বাংলাদেশ নানা জনপদে বিভক্ত ছিল। বর্তমানে এসব জনপদের সঠিক অবস্থান নিরূপণ করা না গেলেও বিভিন্ন উৎস থেকে মােটামুটি একটি ধারণা করা যেতে পারে। এসব জনপদকে কেন্দ্র করেই তখন বিভিন্ন ধরনের পােড়ামাটি শিল্পের বিকাশ ঘটে। প্রাচীন কাল থেকে ঐতিহাসিক কাল পর্যন্ত (আনুমানিক খৃষ্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত) বাঙলাদেশ যে সমস্ত জনপদে বিভক্ত ছিল তন্মধ্যে বঙ্গ, পুন্ড, বরেন্দ্র, রাঢ়, গৌড়, তাম্রলিপি, সমতট, হরিকেল ও চন্দ্রদ্বীপ অন্যতম।৫ মৃৎশিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে সভ্যতার বিবর্তনের পরিচয়। যে সভ্যতা ক্রমে গ্রাম থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে নগর জনপদ কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিল। বাংলার এ নগর সভ্যতা যে কত প্রাচীনকাল থেকে বিবর্তিত হচ্ছিল, নিশ্চয় করে তা বলবার মতাে অনুসন্ধান বা গবেষণা এখনাে তেমন অগ্রসর হয়নি। বর্তমান খণ্ডিত প্রাচীন বাংলার জনপদ হিসেবে পরিগণিত বঙ্গ, পুন্ড্র, সুহ্ম খণ্ডের অন্যতম পুভূমির কেন্দ্র পুদনগল বা পুন্ড্রনগরের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় সুপ্রাচীন মৌর্য বা পরবর্তী যুগের বগুড়া জেলার মহাস্থান লিপি থেকে।৬ নিম্নে এ জনপদগুলাে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলােচনা করা গেল।
বঙ্গঃ বঙ্গ একটি প্রাচীন জনপদ। দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গ নিয়ে এদেশ প্রাচীন কালে গঠিত ছিল। প্রাচীন কালে এ জনপদের সীমানা ছিল পশ্চিমে ভাগীরথী, পূর্বে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা, উত্তরে পদ্মা এবং দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত৭ ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গ নামে একটি দেশের উল্লেখ সর্ব প্রথম দেখা যায়।৮ মহাভারতে ভীমের দিগ্বিজয় প্রসংগে বংগের উল্লেখ দেখা যায় এখানে ভীম মূঙ্গের রাজাকে হত্যা করেন এবং আরও অগ্রসর হয়ে কোশী নদীর তীরে অবস্থিত পুণ্ড্র রাজকে পরাজিত করেন।৯ দিল্লীর মেহেরৌলি লৌহ স্তম্ভে উল্লেখ আছে যে রাজা চন্দ্র (চন্দ্রগুপ্ত ২য়) তাঁর দিগ্বিজয়ের সময় বঙ্গ দেশ জয় করেছিলেন।১০ এছাড়া বিভিন্ন ঐতিহাসিক পুস্তকে বঙ্গের উল্লেখ এবং অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেলেও সংস্কৃত কবি কালিদাস তাঁর গ্রন্থ ‘রঘুবংশে’ বঙ্গের উল্লেখ করেছেন। তাঁর গ্রন্থ থেকে জানা যায় নায়ক রঘু প্রথমে সুহ্মদের পরাজিত করেন এবং পরবর্তী সময়ে বঙ্গবাসীদেরকে এলাকা হতে বিতাড়িত করেন এবং (গঙ্গাযােতােহন্তরে) অঞ্চলে বিজয় স্তম্ভ স্থাপন করেন। এছাড়া উপরােক্ত শ্লোক হতে বঙ্গবাসীদেরকে ‘নৌসাধনােদ্যত’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।১১ ‘গঙ্গাসােতােহন্তরেযু’ শ্লোকের ব্যাখ্যা সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মত পার্থক্য থাকলেও একথা সত্য যে এ শব্দ দ্বারা গঙ্গাসােতের অনুকূলবর্তী ভূ-ভাগকে নির্দেশ করা হয়েছে। অতএব আমরা বলতে পারি যে গঙ্গার দুই শাখা নদী ভাগীরথী ও পদ্মার তীরবর্তী ত্রিভূজাকৃতিরভূ-ভাগই এ এলাকার অধিবাসীদের আবাসস্থল বঙ্গ। ধারণা করা যেতে পারে কালিদাসের বর্ণিত রঘু বংশের নায়ক রঘু বঙ্গবাসীদের উৎখাত করে যে বিজয় স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন তাই বর্তমানে টলেমি প্রভৃতি ঐতিহাসিকদের বর্ণিত গঙ্গরিডই বা গঙ্গারাষ্ট্র।১২
পুন্ড্র ও বরেন্দ্রঃ প্রাচীন পুন্ড্র জনপদ ছিল মুঙ্গের এবং কোশী নদীর পূর্ব দিকে। বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী লিপিতে উল্লেখ আছে পুরে রাজধানী ছিল পুন্ড্রনগরে এবং এ নগরটির পাশ দিয়ে করােতােয়া প্রবাহিত হতাে।১৩ মহাকাব্য ও পরবর্তী বৈদিক যুগের বিভিন্ন গ্রন্থ হতে পূদেশের অধিবাসীদের সম্পর্কে জানা যায়।১৪ গুপ্ত রাজাদের তাম্রশাসন ও চৈনিক পরিব্রাজকদের লেখনী থেকে জানা যায় যে পুন্ডু ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতকে পুন্ড্রবর্ধনে পরিণত হয়েছে এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের একটি ভূক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে।১৫ রামচরিত প্রভৃতি কাব্য গ্রন্থে বরেন্দ্র গংগা ও করতােয়ানদীর মধ্যে অবস্থিত বলে বর্ণিত আছে।১৬ পুন্ড্রবর্ধনের কেন্দ্রস্থলে আধুনিক রাজশাহী, বগুড়া, এবং পশ্চিম বংগের দিনাজপুর জেলার অংশ নিয়ে প্রাচীন কালে বরেন্দ্র জনপদ গঠিত ছিল।
রাঢ়ঃ রাঢ় ছিল বঙ্গের মত একটি প্রাচীন জনপদ। যাকে উত্তর রাঢ় ও দক্ষিণ রাঢ় এ দু’ভাগে ভাগ করা যায়। রাঢ় জনপদ সম্পর্কে আমরা আচারাঙ্গ সূত্র নামক একটি জৈন গ্রন্থ হতে জানতে পারি। এ জনপদের উত্তরে ছিল গংগা-ভাগীরথী নদী। আচারাঙ্গ সূত্র হতে জানা যায় যে, জৈন তীর্থংকর মহাবীর কয়েকজন শিষ্য সহ এ অঞ্চলে ধর্ম প্রচারের জন্য এসেছিলেন। কিন্তু এখানকার লােকজন ছিল নিষ্ঠুর ও রূঢ় প্রকৃতির। তারা মহাবীর ও তাঁর শিষ্যদের পিছনে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল।১৭
গৌড়ঃ গৌড় নামটি আমাদের নিকট সুপরিচিত হলেও এর সঠিক অবস্থান সম্পর্কে। তেমন কিছু জানা যায়নি। কৌটিল্যের অর্থ শাস্ত্রে গৌড় নামে একটি দেশের উল্লেখ পাওয়া যায়।১৮ বাৎসায়নের ‘কামসূত্রে’ গৌড় নামটি সুপরিচিত ছিল।১৯ এছাড়া পাণিনি সূত্র থেকেও গৌড়পূরের কথা জানা যায়।২০ মৌখরী রাজ ঈষান বর্মার ৫৫৮ খ্রীষ্টাব্দের ‘হর শিলালিপি’ (Hara Inscription) থেকে জানা যায় যে, তিনি গৌড়বাসীদেরকে সমুদ্র পর্যন্তবিতাড়িতকরেছিলেন।২১ এ থেকে বােঝা যায় গৌড় রাষ্ট্র সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
উপরােক্ত আলােচনা থেকে আমরা প্রাচীন গৌড়ের অবস্থিতি জানতে পারি। বাংলাদেশের কোন্ অংশ প্রাচীন যুগে গৌড় নামে অভিহিত হত, তা নির্ণয় করা না গেলেও মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের একটি ক্ষুদ্র বিভাগ প্রথমে গৌড় নামে পরিচিত ছিল এবং ধারণা করা যায় যে, ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে এ দেশ সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। গৌড়ের অবস্থান নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও বিভিন্ন সূত্র হতে জানা যায় বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার বীরভূমই প্রাচীন গৌড় রাজ্যের আদি কেন্দ্র। এ গৌড় রাজ্যের আধিপত্য কখনাে কলিঙ্গ আবার কখনাে ভুবনেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।২২ খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকে শশাংক যখন গৌড়ের রাজা হন তখন তাঁর রাজধানী ছিল কর্ণসূবর্ণতে। বর্তমানে একথা স্বীকৃত যে প্রাচীন গৌড়ের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলার কানসােনা বা রাঙামাটি অঞ্চল।২৩ চৈনিক পর্যটক হিউয়েন-সাং তাঁর মণ বিবরণীতে রক্ত মৃত্তিকা নামক যে বিহারের কথা উল্লেখ করেছেন তা সম্ভবত গৌড়ের রাজধানী কর্ণসুবর্ণের পার্শ্ববর্তী কোন এলাকায় অবস্থিত ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে বর্তমান মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে ১০ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম রাজবাড়ী ডাংগাই ছিল উল্লিখিত রক্তমৃত্তিকা বিহারের ধ্বংসাবশেষ।২৪
তাম্রলিপ্তিঃ মহাভারতে ভীমের দিগ্বিজয় প্রসংগে সম্ভবত তাম্রলিপ্তি নামের সর্ব প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে তাম্রলিপ্তিতে কলিংগবাসী নামে এক দুধর্ষজাতি বসবাস করত বলে এর অপর নাম হয়েছে দামলিপ্ত। পরবর্তী সময়ে এ তাম্রলিপ্তিবাসীগণ দক্ষিণ ভারতে উপবিনেশ স্থাপন করে তামিল নামে অভিহিত হয়েছে। এরা ছিল সুনিপুণ যােদ্ধা। তিনি আরও মনে করেন মহামতি অশােকের সৈন্যগণ অসংখ্য লােক হত্যা করে যে কলিংগ রাজ্য জয় করেছিলাে সেই কলিংগ রাজ্যের সৈন্যগণ ছিল তাম্রলিপ্তিবাসী।২৫ এছাড়া বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থ যেমন মহাভারত, পুরাণ, জৈন কল্পসূত্র, প্রজ্ঞাপনা গ্রন্থ, দশকুমার চরিত এবং বিভিন্ন পর্যটক যেমন টলেমি, ইৎসিং, হিউয়েন সাং, বরাহমিহির প্রমুখের বিবরণীতে তাম্রলিপ্ত, তাম্রলিপ্তি, তমালিনি, দামলিপ্ত, তন্তবুত্তি, তাম্রলিপ্তিক, স্তম্ভপুর, বেলাকুল, টালকটেম্ব প্রভৃতি নামের উল্লেখ আছে। এ সব বিবরণী হতে জানা যায় যে, সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত এ অঞ্চলের সামুদ্রিক ব্যবসার খ্যাতি অক্ষুন্ন ছিল।২৬ ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে তাম্রলিপ্তি বঙ্গের কেন্দ্রস্থল, উত্তর ও পূর্বাংশ এবং সমগ্র সুহ্ম নিয়ে গঠিত ছিল। প্রাচীন তাম্রলিপ্তি বন্দর ছিল আধুনিক মেদেনীপুর অঞ্চল জুড়ে এবং তমলুক ছিল এ জনপদের রাজধানী। তিনি চীনা পরিব্রাজক হিউয়ের সাং-এর ভ্রমণ বিবরণীর উপর ভিত্তি করে আরও লিখেছেন যে, তাম্রলিপ্তি চিরকুট হতে ১৪০০ লি (আনুমানিক ২৩৩ মাইল) এবং সমতট হতে ৯০০ লি (আনুমানিক ১৫০ মাইল) দূরে অবস্থিত ছিল। যদিও এর ভূমি ছিল সমতল, জলীয় ও সাত সঁাতে, তথাপি স্থল ও জল। পথে অন্যান্য রাজ্যের সাথে যােগাযােগ ব্যবস্থা ভাল ছিল।২৭
সমতটঃ পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর ভ্রমণ বিবরণীতে সর্ব প্রথম সমতটের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া খ্রীষ্টীয় ৪র্থ শতকে উৎকীর্ণ গুপ্ত রাজা সমুদ্র গুপ্তের (অনুঃ ৩৫৫-৭৬ খ্রীঃ) এলাহাবাদ স্তম্ভ লিপি হতে সমতট সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু লিপিতে এ রাজ্যের সঠিক কোন অবস্থানের উল্লেখ নেই। তবে এই স্তম্ভ লিপি থেকে জানা যায় যে, সমুদ্র গুপ্তের পূর্ব সীমান্তস্থিত করদ রাজ্যগুলাের মধ্যে নেপাল, ডবাক, কর্তৃপুর, কামরূপ এবং সমতট অন্যতম ছিল। বরাহমিহির প্রণীত বৃহৎ সংহিতায় মিথিলা ও ওড্র দেশের নামের সাথে সমতটকে সংযুক্ত করা হয়েছে।২৮ এছাড়া এ গ্রন্থে সমতটকে বঙ্গ জনপদ থেকে পৃথক ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। রাজা দামােদর দেবের মেহার তাম্রশাসনে সমতট নামের সর্বশেষ উল্লেখ দেখা যায়। বর্তমানে মেহার অঞ্চলটি আধুনিক কুমিল্লা শহর হতে ৩২/৩৩ মাইল দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত। এ মেহার তাম্রশাসনে এ অঞ্চলকে সমতট মণ্ডলের অন্তর্গত বলে অভিহিত করা হয়েছে।২৯ পালরাজ মহীপালদেবের উত্তীর্ণ বাঘাউরা ও নারায়ণপুরে প্রাপ্ত মূর্তি লিপি হতে সমতট সম্পর্কে জানা যায়।৩০ সম্ভবত খ্ৰীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্য সমতট রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। আধুনিক কুমিল্লা জেলার ময়নামতিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আবিস্কৃত বিভিন্ন তাম্রশাসন থেকে জানা যায় দেবপর্বত (ময়নামতি) ছিল সমতটের রাজধানী এবং এটি ক্ষীরােদা নদী (আধুনিক ক্ষীর নদী) দ্বারা বেষ্টিত ছিল। সুতরাং ধারণা করা যেতে পারে যে ত্রিপুরা-নােয়াখালি ও কুমিল্লা জেলা এবং তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে সমতট রাজ্য গঠিত ছিল।
হরিকেলঃ প্রাচীন ভৌগােলিক নাম ‘হরিকেল’ এর সঠিক সীমানা নির্দিষ্ট করা যায় না। হরিকেল জনপদটি সমতট রাজ্যের পূর্ব দিকে অবস্থিত ছিল। বিভিন্ন গ্রন্থাদিতে হরিকেল জনপদটিকে হরিকেল, হরিকেলা, হরিকোল ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পাওয়া যায়। চৈনিক পর্যটক ইৎসিং এর ভ্রমণ বিবরণীতে হরিকেল নামের উল্লেখ আছে। ইৎসিং সিংহল হতে সমুদ্র পথে উত্তর পূর্বাভিমুখে যাত্রা করে পূর্বভারতের পূর্ব সীমান্তে হরিকেল রাজ্যে উপস্থিত হন।৩১ হেমচন্দ্র বিরচিত ‘অভিধান চিন্তামনি’ গ্রন্থে হরিকেল ও বঙ্গ একার্থবােধক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।৩২ ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার আবার হরিকেলকে সমতট ও উড়িষ্যার মধ্যবর্তী স্থান বলে উল্লেখ করেছেন।৩৩ বিভিন্ন সাহিত্য গ্রন্থ হতে জানা যায় বর্তমান সিলেট অঞ্চলই প্রাচীন বাংলার হরিকেল জনপদ বলে বিবেচিত হতাে।৩৪ আবার পি, এন, পাল মনে করেন বাকেরগঞ্জ ও নােয়াখালি জেলার কিছু অংশ নিয়ে হরিকেল গঠিত ছিল।৩৫ উপরােক্ত তথ্য থেকে মনে করা যেতে পারে যে হরিকেল রাজ্যের অবস্থান ছিল তাম্রলিপ্তি হতে কয়েক যােজন উত্তরে মেঘনা নদীর পশ্চিমে।৩৬ সম্প্রতি কুমিল্লা এবং আশেপাশের কয়েকটি অঞ্চলে আবিষ্কৃত তাম্রশাসন এবং অন্যান্য প্রত্ন সামগ্রি পরীক্ষা করে পন্ডিতগণ মনে করছেন বর্তমানে সিলেট, ত্রিপুরা রাজ্য, কুমিল্লা, ফেনী ও নােয়াখালীর অংশ বিশেষ নিয়ে হরিকেল রাজ্য গঠিত চিল।
চন্দ্রদ্বীপঃ প্রাচীন কালে চন্দ্রদ্বীপ ছিল বঙ্গের অন্তর্গত একটি প্রাচীন বাংলার জনপদ। চন্দ্র রাজাদের তাম্রশাসন হতে জানা যায় চন্দ্রদ্বীপ ত্রৈকল্য চন্দ্রের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।৩৭ চন্দ্রদ্বীপে প্রাপ্ত তারা মূর্তি লিপিতে উল্লেখ আছে যে বাংলাদেশের বাকেরগঞ্জ জেলাই ছিল প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ।৩৮
বাংলাদেশে কোন্ সময়ে সর্ব প্রথম মানুষের বসতি গড়ে উঠে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ভূতাত্ত্বিক বিচারে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তের পার্বত্যাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন ভূ-ভাগ এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল অপেক্ষাকৃত প্রাচীন। এই প্রাচীন ভূখন্ডে অনুসন্ধান ও প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালিয়ে কিছু প্রাচীন যুগের মানুষের ব্যবহৃত নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। এ সব নিদর্শন পরীক্ষা করে পন্ডিতরা অনুমান করেন যে, প্রত্ন প্রস্তর যুগে এখানে মানুষের বসবাস গড়ে উঠে। সাম্প্রতিক কালে জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব প্রকল্পের ভিজিটিং প্রফেসর ডঃ দিলীপ কুমার চক্রবর্তী বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার লালমাই ও ময়নামতি অঞ্চলে অনুসন্ধান চালিয়ে কিছু অশ্মীভূত পাথরের হাতিয়ার আবিস্কার করেন এবং এ গুলাের উপর প্রয়ােজনীয় গবেষণা করে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন আজ থেকে ২০-২৫ হাজার বৎসর পূর্বে বাংলায় মানুষের বসতি গড়ে উঠেছিল। অন্যদিকে প্রাচীন বাংলার অধিবাসীদের সাথে বৈদিক যুগের আর্য জাতির সম্পর্ক সম্বন্ধে নিশ্চিত জানা যায় না। বৈদিক আর্যরা যখন এ দেশে আসে তখন তাদের প্রভাব এ অঞ্চলের অধািসীদের উপরে পড়েছিল। আর্যরা বাংলাদেশের অধিবাসীদের দস্যু জাতি বলে অভিহিত করেছে।
উপরােক্ত তথ্যের আলােকে গবেষকদের ধারণা এদেশবাসীর উপর আর্য সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তার করতে অনেক দিন লেগেছিল। পশ্চিম বংগের বীরভূম ও বর্ধমান জেলার অজয়, কুনুর ও কোপাই নদীর তীরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে এক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। এ সব এলাকায় প্রাপ্ত নিদর্শন গুলাে পর্যবেক্ষণ করে পন্ডিতগণ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন সিন্ধু সভ্যতা ও মধ্য ভারতের রাজস্থানের অনেক জায়গায় যে তাম প্রস্তর যুগের সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল, অনুরূপ নিদর্শন এসব এলাকাতেও পাওয়া গিয়েছে।৩৯ পান্ডু রাজার ঢিবিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে কয়েকটি চিহ্ন খচিত সীল পাওয়া গিয়েছে। এ সীলগুলাের লিখন পদ্ধতি ছিল চিত্রাক্ষর এবং এগুলাে ছিল ভূ-মধ্যসাগরীয় ক্রীট দ্বীপের। সীল ছাড়াও এখানে প্রাপ্ত অন্যান্য প্রত্ন নিদর্শন পরীক্ষা করে পন্ডিতগণ মনে করেন ক্রীট দ্বীপের সাথে বাংলার বাণিজ্যিক যােগাযােগ ছিল। তাঁরা আরও মনে করেন খ্রীষ্টপূর্ব ১ম ও ২য় শতাব্দীতে এখানে এক উন্নত মানের বস্তুগত সংস্কৃতি (Meterial culture) গড়ে উঠে।৪০ এ ঢিবিতে প্রাপ্ত নিদর্শন গুলাে থেকে বলা যায় এখানকার অধিবাসীরা মাটির সাথে নলখাগড়া মিশিয়ে অত্যন্ত সুন্দর করে বাড়ী-ঘর তৈরী করত, তারা তামার ব্যবহার জানত, কৃষি কাজ করত এবং মাতৃকা দেবীর পুজা করত।৪১
পান্ডু রাজার ঢিবিতে প্রাপ্ত সীলগুলাে থেকে পন্ডিতদের ধারণা তখন ভূ-মধ্যসাগরীয় ক্রীট দ্বীপের সাথে এদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। বাংলার যে সমস্ত স্থানে অনুসন্ধান ও প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে পােড়ামাটির ফলক ও মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে সে গুলাের মধ্যে তমলুক, হরিনারায়ণপুর, চন্দ্রকেতুগড়, পােখরনা, ময়নামতি, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, কর্ণসুবর্ণ, বানগড় এবং সাভার প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।৪২ উপরােক্ত অঞ্চল গুলাে প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে। এ সমৃদ্ধির মূলে ছিল বাংলার সম্প্রসারিত বৈদেশিক বাণিজ্য। এখানে উৎপন্ন বিভিন্ন দ্রব্যাদি, যেমন শালিধান, যব, কার্পাস, কার্পাস বস্ত্র ইত্যাদি বহির্বিশ্বে রপ্তানি করা হতাে।৪৩
মৃৎফলক অর্থাৎ টালি, ফলক লিপি, দেবদেবীর মূর্তি, মনুষ্য মূর্তি, খেলনা পুতুল, হাড়িপাতিল, পশু-প্রাণীর মূর্তি, গাছপালা, লতাপাতা প্রভৃতি ফলক শিল্প মাত্রই পােড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটা। পােড়ামাটির ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য প্রধানত লাল আঠালাে মাটির প্রয়ােজন। এ মাটির সংগে পরিমাণ মত বালি মিশিয়ে প্রথমে কাদা মাটি প্রস্তুত করা হয়। পরবর্তী কালে এ প্রস্তুতকৃত কাদা মাটি ছাঁচে ফেলে পােড়ামাটির ফলক তৈরী করা হয় এবং এগুলােকে রােদ্রে শুকিয়ে আগুনে পােড়ানাের জন্য রেখে দেয়া হয়। আমাদের দেশে দু’পদ্ধতিতে টেরাকোটা নির্মাণ করা হয়; হাতে গড়া এবং ছাঁচে গড়া। টেরাকোটা প্রধানত লাল বর্ণের হয়ে থাকে। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে,
“খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-তৃতীয় শতক হইতে আরম্ভ করিয়া খ্রীষ্টোত্তর দ্বিতীয়-তৃতীয় শতক পর্যন্ত সমগ্র গংগা-যমুনা উপত্যকা ও মধ্য ভারত জুড়িয়া পােড়ামাটির এক ধরনের শিল্প শৈলী প্রচলিত ছিল। পাটালীপুত্র হইতে আরম্ভ করিয়া মথুরা পর্যন্ত নানা জায়গায় অল্পবিস্তর পরিমাণে এ শিল্প শৈলীর নিদর্শন আবিস্কৃত হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে অধিকাংশ যৌবন সমৃদ্ধ নরনারীর মূর্তি, বিশেষ ভাবে নারী মূর্তি, কিছু কিছু শিশু মূর্তিও আছে; কিছু কিছু আছে শুধু শিশু মুন্ড ও নরনারীর মুন্ড। অনেক গুলি মুন্ডের আকৃতি ও মুখাবয়বে, কেশবিন্যাসে ও মস্তকারণে সমসাময়িক যাবুনিক (গ্রীক ও রােমান) বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট।”৪৪
মহাস্থান, ময়নামতি, ও পাহাড়পুর, পশ্চিম বংগের পােকরনা, মেদিনীপুরের তমলুকে বর্ধমান, হুগলী এবং বীরভূমে জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে আবিষ্কৃত বিভিন্ন পােড়ামাটির ফলকে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলাে লক্ষণীয়।৪৫ মৃৎশিল্পের এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য কেবল বাংলার ঐশ্বর্যকে সমৃদ্ধ করেছে তা নয়, এর ভিতর লুকিয়ে আছে সেকালের মানুষের চিন্তাধারা, জীবন যাত্রার পদ্ধতি, ধর্ম, সামাজিক প্রথা ও সংস্কার। সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সাথে মৃৎ শিল্পের ঐতিহ্য বহুলাংশে লুপ্ত হয়ে গেলেও বাংলাদেশে মাটির ব্যবহার ব্যাপক এবং মৃৎশিল্পীরা আজ বহু প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থেকেও তাদের শিল্পকর্ম বাঁচিয়ে রেখেছে।৪৬
বানগড়, তমলুক, চন্দ্রকেতুগড়ের প্রাচীন টিবিতে খননের ফলে অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সাথে পােড়ামাটির ফলকও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গিয়েছে। ভারতের অন্যান্য স্থান যেমন পাটনা, বক্সার, বিহারের বুলান্দিবাগ, মথুরা, কৌশাষি এবং উত্তর প্রদেশের অহিচ্ছত্র থেকে পাওয়া নিদর্শন গুলাের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় খৃঃ পূঃ ১ম ও ২য় শতাব্দীতে এ অঞ্চলে এক উন্নতমানের শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয়েছিল। প্রাচীন বাংলার তাম্রলিপ্তিতে প্রাপ্ত কয়েকটি পােড়ামাটির ফলক বাংলার সর্বপ্রাচীন ভাস্কর্যের নিদর্শন। এর মধ্যে একটি ফলকে একটি যক্ষিনী মূর্তি আছে। এর গঠন প্রণালী ও বসন ভূষন শুংগ যুগের অনুরূপ। মহাস্থানগড় থেকেও শুংগ যুগের একটি পােড়ামাটির নারী মূর্তি পাওয়া গিয়েছে।৪৭ তমলুকে প্রাপ্ত কতগুলাে পােড়ামাটির ফলক থেকে শুংগ যুগের সমৃদ্ধির কথা জানা যায়।
বাংলার পােড়ামাটির শিল্পে মৌর্য ও শুংগ যুগের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। বানগড়৪৮, চন্দ্রকেতুগড়, ইত্যাদি স্থানে খননের ফলে শুংগ যুগের বিভিন্ন ধরনের পােড়ামাটির ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ফলক গুলাে ছিল তখকার সমসাময়িক ভারহুত, সাঁচী, অমরাবতী ও বােধগয়া প্রভৃতি অঞ্চলের কাঠ ও হাতির দাঁত (Ivory) শিল্পরীতির চেয়ে, রীতি ও ডৌলের দিক দিয়ে উৎকৃষ্ট। বানগড় থেকে আঙ্গুলে তৈরী ছােট মাপের অনেক পুতুল ও অনেক মাটির ফলক পাওয়া গিয়েছে। যদিও এ ফলক গুলাে কিছুটা বঙ্কিম ভংগীতে তৈরী ছাঁচে তথাপি এগুলাে রূপ ও রীতির দিক থেকে তমলুক ও চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত ফলকে উৎকীর্ণ মূর্তিগুলাের অনুরূপ। এ ছাড়া এ স্থানে পােড়ামাটির কতগুলাে নারী মূর্তি ফলক পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে একটি ফলকের টুকরা খুবই চমৎকার, যেটিকে শিল্প ও সৌন্দর্যের বিচারে শুংগ যুগের সবচেয়ে প্রাচীন ফলক বলা যায়।৪৯ যদিও এ ফলকটির সম্পূর্ণ অংশ পাওয়া যায়নি তথাপি এটি যে দেবী শ্রীলক্ষ্মী তা ফলকটি দেখে স্পষ্ট বােঝা যায়। এ ফলকে শ্রীলক্ষ্মী পদ্মফুলের উপরে দন্ডায়মান। তাঁর হাতে চুড়ি, পরনে কাপড় ও অন্যান্য পাথরের ও পােড়া মাটির ভাস্কর্য শিল্পের মত।
বগুড়া জেলার মহাস্থান গড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে খ্রীষ্টপূর্ব ২য় শতাব্দী হতে খ্রষ্টীয় ১ম শতাব্দীর কিছু পােড়ামাটির ফলক পাওয়া গিয়েছে। এ ফলকগুলাের অধিকাংশের বেশভূষা ও অলংকরণ জমকালাে, ফলক গুলাে অধিকাংশই নারী মূর্তি। এখানে একটি ফলকে একজন পুজারিণীকে নৈবেদ্য হাতে জানু পেতে বসে থাকতে দেখা যায়।৫০
“চন্দ্রকেতুগড় প্রাচীন কালে পােড়ামাটির ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে এক অভাবনীয় আকারে পরিণত হয়েছে। এখনে পাওয়া ভাস্কর্য সমূহের মধ্যে নানা গড়নে বহু ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ছােট আকারের মূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। তার মধ্যে তমলুকের নারী মূর্তির মত সালংকারা, গােলদেহ, মুখ মন্ডলে মায়ামন্ডিত অনেক নারী মূর্তি সংগৃহীত হয়েছে—দুভার্গ্যক্রমে যার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ অক্ষত মূর্তি অতি বিরল। এছাড়া এখানে পাওয়া গিয়েছে গােল বা চৌকো আকারের এক ধরনের ফলক, যার একাধিক মূর্তিতে রয়েছে গতি প্রবণ দ্রুতগামী রথ বা চলমান সওয়ার পিঠে হাতির রূপায়নে কোন প্রচলিত কাহিনীর ইংগীত। এই একই ধরণের কিছু ফলকে আছে কামলীলার দৃশ্য, যেমনটি সে যুগের অন্যান্য কেন্দ্রের মাটির ফলকে বড় একটি দেখা যায় না।৫১
এখানে প্রাপ্ত প্রায় সম্পূর্ণ অবস্থায় একটি ফলক উলেখযোেগ্য, যাকে ‘শ্রী’ অথবা ‘লক্ষ্মী’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এ ফলকে মূর্তিটি পদ্ম ফুলের উপর দন্ডায়মান এবং তার দু’হাত পদ্ম ফুলের বৃন্ত দ্বারা আবৃত। তাঁর কোমর চমৎকার, স্তন সুগঠিত, এবং চন্দ্রাকৃতির মুখমন্ডলের উপরে সুপরিপাটি করে কেশ বিন্যাস ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।৫২ বাংলায় পােড়ামাটির ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে কুষান যুগে এক নতুন ধারা লক্ষ্য করা যায়। চন্দ্রকেতুগড় ও তমলুক হতে এ যুগের অনেক পােড়ামাটির পুরুষ মূর্তি খচিত ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ফলকগুলাের মুখমণ্ডল গ্রাকো-রােমান শিল্পের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। অপর দিকে পাটালীপুত্র থেকে আবিষ্কৃত অসংখ্য ছােট আকারের মাটির মূর্তিতে মৌর্য আমলের ব্যাপক ও জনপ্রিয় রূপ কর্মের পরিচয় পাওয়া যায়। কাল নির্ণয়ের অন্য কোন প্রমাণের অভাবে ভারতের অন্যান্য স্থানে প্রাপ্ত বহু শিল্পকীর্তির মতই এ সব পুতুলের ক্ষেত্রে এর গড়ন ও ডৌলের উপর নির্ভর করা ছাড়া অন্যকোন প্রমান এখনাে স্বীকৃত নয়। অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় মত প্রকাশ করেন যে ভারতে মৌর্য যুগের পর গুপ্ত যুগে শিল্পকলার ক্ষেত্রে এক নতুন শিল্প সৃষ্টি হয়েছিল যাকে ধ্রুপদী শিল্পকলা বলা যায়। এ যুগের শিল্পকলার প্রধান কেন্দ্র সারনাথে অবস্থিত মথুরার ভারী শিল্পকর্ম গুপ্ত যুগেই সুক্ষ্ম শিল্প কর্মে রূপান্তরিত হয়।৫৩ তবে গুপ্তযুগের শিল্পকলা শুধু শিল্পীদের দক্ষতার পরিচয়ই বহন করে না, এতে শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে সুগভীর মননশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। গৌড়ের প্রাচীন রাজধানী কর্ণসুবর্ণ অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে কতগুলাে পােড়ামাটির মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া এখান থেকে আনুমানিক খ্রীষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর একটি পলস্তরা (Stucco) নির্মিত মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। গুপ্তযুগ থেকে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মন্দির, বিহার, মঠ, ও রাজপ্রাসাদ প্রভৃতির দেয়াল গাত্রে অলংকরণের ক্ষেত্রে পােড়ামটির তৈরী বিভিন্ন চিত্র খচিত ফলকের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। এ ফলকগুলাে ছিল আকৃতিতে কিছুটা বড়। বাংলাদেশে পাথর দুষ্প্রাপ্য বলে এদেশে নির্মিত মঠ, মন্দির, বিহার অলংকরণের জন্য প্রচুর সংখ্যক পােড়ামাটির ফলকের প্রয়ােজন হয়েছে, আর প্রয়ােজন মিটাবার জন্য এখানে এক ধরনের গ্রাম্য শিল্পীর সৃষ্টি হয়েছিল। এ গ্রাম্য শিল্পীরা তাদের মনের মাধুরী মিশিয়ে মন্দির, বিহার, মঠ, রাজপ্রাসাদ ইত্যাদির গাত্রে অলংকরণের জন্য পােডামটি দিয়ে শিল্প সৃষ্টি করেছিল। তারা তখনকার জীবনের বিভিন্ন বাস্তব আলেখ্য, তাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি এ সব ফলকের মধ্যে চিত্রিত করেছে। বাংলার লােকায়ত সমাজ তথা সামগ্রিক ভাবে বাংগালীর শিল্প সাধনায় পাহাড়পুরের পােড়ামাটির ফলকগুলােত তৎকালীন গণসংস্কৃতির মূল্যবান সম্পদ। পাহাড়পুরের মন্দির গাত্রে প্রায় এক হাজারের বেশী পােড়ামাটির ফলক লাগানাে আছে। কল্যাণ কুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে,
“অনায়াস পটতে সৃষ্ট পাহাড়পুরের পােড়ামাটির ফলকগুলিতে শিল্পীর ব্যাপক জগৎ চেতনা, প্রসারিত সন্ধানী দৃষ্টি এবং নিবিড় মানবীয় অনুভূতি ও আবেগ প্রবণতার অদ্ভুত সমাবেশ দেখা যায়। এখানে আছে আদিবাসী পত্র বিভূষণ শবর জাতির নর-নারীর নানা ক্রিয়াকলাপ।
নিহত পশু হাতে শবর নারীর দ্রুত গমন, শবর নর নারীর দ্রুত লয়েনৃত্য- এই ধরনের বহু দৃশ্যে এই শবর জীবনের সংগে এক নিকট ও সহজ সান্নিধ্য থেকে অনুমান হয় যে, সমসাময়িক যুগে এই শবর সমাজ সাধারণ গ্রামীণ সমাজের অতি নিকট সান্নিধ্যে জীবন অতিবাহিত করত। এক সময়ে সাধারণ দ্বিজাতিবহির্ভূত জনগােষ্ঠীর অতি নিকট সান্নিধ্যে কিরাত শবরেরা নিজেদের সরল আদিম শক্তিগর্ত দৃঢ়কোমল অস্তিত্ব নিয়ে বসবাস করত এবং তারা মার্জিত ভাষা ও সংস্কৃতির উপর যে পরিমাণে প্রভাব বিস্তার করত পাহাড়পুরের ফলকগুলাে তার প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য বহন করছে। এদের পাশেই আছে চিরাচরিত অসংখ্য লােক কাহিনী, যে কাহিনীতে পশুজগতের নানা ক্রিয়াকলাপই ছিল মুখ্য বিষয়বস্তু। যা থেকে অসংখ্য কাহিনী গৃহীত হয়েছিল অতীতের গল্প গুলিতে, এবং পরবর্তী কালের বৃহৎ কথাকোষে, হিতােপদেশে এবং পঞ্চতন্ত্র কথায় পশুর শরীরকে নানা ভাবে বিন্যস্ত, চিত্রিত এবং লীলায়িত করে পাহাড়পুরের মৃত্যলক রচনাকারীরা এক সুবিশাল কল্পনার জগতকে লােক চক্ষুর সমক্ষে চিত্ত বিনােদনের উপকরণ হিসেবে উপস্থিত করেছিলেন। এইসব ফলকে চিত্রিত সিংহ যদিও কল্পনার জন্তু তা হলেও হাতি, ষাঁড়, শেয়াল, খরগােশ ইত্যাদি গ্রাম-বাংলার বহু জন্তু জানােয়ার পাহাড়পুরের বিশাল চিত্রশালার উপকরণ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।”৫৫
পাহাড়পুরের বেশীর ভাগ ফলকেই তৎকালীন জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য দেখানাে হয়েছে, ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ ফলকের সংখ্যা নিতান্তই অল্প। এ ফলক গুলােতে সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ ও জীবন যাত্রার দৈনন্দিন কাহিনী ফুটে উঠেছে। যেমন মেয়েরা নানা ভংগীতে নৃত্য করছে, শিশুকে কোলে নিয়ে মা কুপ হতে জল তুলছে, প্রেমিক প্রেমিকাকে আলীঙ্গন করছে অর্থাৎ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সকল ছবিই এ ফলক গুলােতে লক্ষ্য করা যায়। পাহাড়পুর ছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য স্থান যেমন ময়নামতি, সাভার, পলাশবাড়ী, সরলপুর, মঙ্গলকোট ইত্যাদি জায়গায় বেশ কিছু পােড়ামাটির ফলক পাওয়া গিয়েছে। এগুলাের মধ্যে রয়েছে কীর্তিমুখ, কিন্নর, বিদ্যাধর, রাজহংস, বিভিন্ন জীবজন্তু, বাঘ, হরিণ এবং বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। সাভার থেকে বহু ইষ্টক ক্ষোদিত বৌদ্ধ মূর্তির ফলক আবিস্কৃত হয়েছে। সাভারের নিকটবর্তী রাজাসনে একটি বৌদ্ধ বিহার ছিল বলে অনেকে অনুমান করেন।৫৬ সাভারে প্রাপ্ত একটি ফলকে ৮টি বৌদ্ধ মূর্তি উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এ পােড়ামাটির ইষ্টক নির্মিত ফলকটি সম্পূর্ণ অক্ষত নয়। ফলকটি তিন সারিতে ভাগ করা যায়। ফলকটির প্রতিটি ললিতাসনে এবং বামদিকের মূর্তিটি যােগাসনে উপবিষ্ট। এ মূর্তি দু’টির পাশে বিভিন্ন নকশা খচিত অলংকরণ লক্ষণীয়। দ্বিতীয় সারিতে তিনটি মূর্তি যথাক্রমে ডানদিক হতে বামদিক পর্যন্ত যােগাসনে ও রাজলীলাসনে উপবিষ্ট। এখানেও নানা ধরনের অলংকরণ লক্ষ্য করা যায়। এ ফলকটির শিল্প সৌন্দর্য দেখে মনে হয় এটি সে আমলের একটি অপূর্ব শিল্পকর্ম।৫৭
সম্প্রতি গুপ্ত বা গুপ্ত পরবর্তীকালের কিছু পােড়ামাটির ফলক বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরে সংগৃহীত হয়েছে। এ ফলকগুলাে উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর বগুড়া জেলার দুটি গ্রাম সরলপুর ও পলাশবাড়ী থেকে পাওয়া গিয়েছে। ফলক গুলাে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ফলক গুলাের অধিকাংশ লিপিযুক্ত এবং এগুলােতে ক্ষোদিত দৃশ্যাবলী রামায়ণ থেকে নেয়া হয়েছে। পলাশবাড়ীতে প্রাপ্ত পােড়ামাটির ফলক গুলাের ক্ষোদিত লিপির অধিকাংশ পাঠোদ্ধার যােগ্য এবং শৈল্পিক দিক থেকে ও এ গুলাে খুবই চমৎকার। অন্য দিকে সরলপুর থেকে প্রাপ্ত ফলকগুলাে কিছুটা জীর্ণ প্রকৃতির। পলাশবাড়ী ও সরলপুর প্রায় ৫০টি পােড়ামাটির ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এগুলাে বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে। এখানে প্রাপ্ত ফলকগুলাের গড় পরিমাপ 12×8*1/2-2*1/2। এ ফলক গুলােতে উৎকীর্ণ লিপির সাথে গুপ্তযুগীয় কলাইকুড়ি, সুলতানপুর (৪৪০ খ্রীঃ), বৈগ্রাম (৪৪৮ খ্রীঃ) এবং গুপ্ত পরবর্তী লােকনাথ (৬৬৩ খ্রীঃ) ইত্যাদি তাম্রশাসনে উ কীর্ণ লিপির নমুনার যথেষ্ট মিল রয়েছে। এ থেকে অনেকে মনে করেন, এ ফলকগুলাে খ্রষ্টীয় ৭ম শতাব্দীর শেষ দিকের। শৈল্পিক দিক থেকে এ গুলােতে ভারতীয় শৈল্পিক ছাপ থাকলেও বাংলার লােকায়ত শিল্পের প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট। পাহাড়পুর ও ময়নামতি থেকে সংগৃহীত পােড়ামাটির ফলকে বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির যে নমুনা স্থাপিত হয়েছে। তার সাথে এ ফলকগুলাের যথেষ্ট মিল রয়েছে।৫৮
সার্বিক আলােচনায় একথা বলা যায় যে, এ দেশে পাথরের অভাব থাকার কারণে প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বাংলার স্থাপত্য প্রধানত ইষ্টক রীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এ দেশের বিভিন্ন স্থাপত্যে একদিকে ইটের ব্যবহার লক্ষণীয়, তেমনি লক্ষণীয় স্থাপত্য গুলােয় প্রাপ্ত পােড়ামাটির ফলক সময়ের বিচারে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধারণ করছে। যেমন গুপ্ত আমল পর্যন্ত এদেশের পােড়ামাটির ভাস্কর্যের মান উত্তরাবর্তে প্রচলিত সব স্থানের শিল্পের মত সমুন্নত ছিল। শিল্পরীতির দিক থেকে এ পােড়ামাটির ভাস্কর্যগুলাে ছিল স্থুলকায়, এবং কর্কশ আকৃতির। বাংলায় পােড়ামাটির ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে পাল আমলে একটি স্বতন্ত্র ধারা সূচিত হয়। এ যুগের পােড়ামাটির ফলক গুলাে পর্যালােচনা করে একথা বলা যেতে পারে যে, এ সব মৃত্যলকে লােকশিল্প ও লােক সংস্কৃতির চিত্রায়ণ ব্যাপকতা লাভ করে। এ সব মৃৎফলকে সাধারণ মানুষের বিভিন্ন ঘটনাবলী সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। এগুলাের বহুল ব্যবহার পাহাড়পুর মহাবিহারে লক্ষ্য করা যায়।
তথ্যনির্দেশ:
- ১. শ্রী সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় “সংস্কৃতি শিল্প ইতিহাস”, জিজ্ঞাসা, কলিকাতা, ১৯৭৬, পৃঃ ৪৩।
- ২. শ্রী অমিয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঁকুড়ারমন্দির, সাহিত্য সংসদ, কলিকাতা, ১৩৭১ বাং পৃঃ ১১২-১১৩।
- ৩. Stella Kramrisch The Hindu Temple, Vol. 1. Calcutta University. Calcutta, 1940. p. 86
- ৪. শ্রীঅমিয় কুমার বন্ধ্যোপাধ্যায়, পৃঃ ১১৩।
- ৫. নীহার রঞ্জন রায় “বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, প্রথম খণ্ড”, প্রথম স্বাক্ষরতা সংস্করণ, ১৯৮০ পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি, কলিকাতা, পৃঃ ১৪৮।
- ৬. Epigraphia Indica, Vol. XXI. p. 85. Indian Historical Quarterly 1934. Pp. 57If.
- ৭. রমেশচন্দ্র মজুমদার “বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড”, কলিকাতা, ১৯৭৪, পৃঃ ৬।
- ৮. A. B. Keith litaraya Aranyaka p. 101. 200.
- ৯. নীহার রঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩১।
- ১০. J. E. Fleet, (Ed), Corpus Inscriptionum, Vol. 111. p. 141.
- ১১. বঙ্গানুৎখায় তরসা নেতা নৌধনােতা। নিচখান জয় স্তন্তান গঙ্গাস্রোতহন্তরেষু সাঃ। রঘুবংশ ৪র্থ অধ্যায়, শ্লোক নং – ৩৬।
- ১২. S. M. Ali The Geography of the Puranas, New Delhi, 1966. p. 151.
- ১৩. নীহার রঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত পৃঃ ১৩৮।
- ১৪. S. S. Biswas: Terracotta Art of Bengal, Agam Kala Prakashan, Delhi, 1981. p. 2.
- ১৫. S. S. Biswas Ibid. p. 5.
- ১৬. রমেশচন্দ্র মজুমদার, পৃঃ ৭।
- ১৭. নীহার রঞ্জন রায়, পৃঃ ১৩৯।
- ১৮. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪৫।
- ১৯. Kamsutra (Chowkhamba series), pp. 115. 295.
- ২০. Kielhorns (Ed), Panini sutra, pp. 269, 282.
- ২১. Epigraphia Indica, Vol. XIV. p. 117.
- ২২. নীহার রঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪৭.
- ২৩. নীহার রঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪৭.
- ২৪. S. R. Das ‘Rjbaridanga’, 1962. pp. 56. 67.
- ২৫. ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন বৃহৎ বঙ্গ, ২য় খন্ড, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৩৪১ পৃঃ ১৩৪২ ও ১১০০।
- ২৬. নীহার রঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪৫।
- ২৭. R. C. Majumder (Ed). History of Bengal, Vol. 1. Dhaka University. Dhaka. p. 22.
- ২৮. বৃহৎ সংহিতা- ১৪শ অধ্যায়, শ্লোক সংখ্যা ৬ (১৪/৬-৮)
- ২৯. Epigrphia Indica, Vol. XXVII, PP. 182-191.
- ৩০. E. I., Vol. XXII. p. 335.
- ৩১. A Record of Buddhist Religion, It-Sing. Translated by J. Takakura, 1896, p. 15; ঢাকার ইতিহাস (২য় খন্ড), কলিকাতা, ১৩২২, পৃঃ ১৬।
- ৩২. অভিধান চিন্তামনি, শ্লোক সংখ্যা ৯৫৩।
- ৩৩. R. C. Majumder, Ibid. pp. 134-135.
- ৩৪. S. S. Biswas, Ibid. p. 9.
- ৩৫. P. N. Paul Early History of Bengal, Vol. 1. pp. III – IV.
- ৩৬. B. C. Law Historical Geography of Ancient Inclin, Delhi 1984. p. 222.
- ৩৭. E. I., Vol-I. 136 96. S. S. Biswas, p. 99.
- ৩৯. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩-১৪।
- ৪০. P. C. Dasgupta The Excavations al Pancu Rajar Dhihi, Calcutta. 1964. Pp. 28-31.
- ৪১. A. K. Sur Preistory and Beginning of Civilizalion in Bengal, Cal. p. 7.
- ৪২. S. S. Biswas pp. 23-32।
- ৪৩. কল্যাণ কুমার গঙ্গোপাধ্যায় বাংলার ভাস্কর্য, সুবর্ণরেখা প্রকাশনী, কলিকাতা, ১৯৮৬, পৃঃ ১৭।
- ৪৪. নীহার রঞ্জন রায়, পৃঃ ৭৭৮।
- ৪৫. মােহাম্মদ শাহজালাল বাংলাদেশের মৃৎশিল্প, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৩৯২ বাং, পৃঃ ৩৪।
- ৪৬. প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪১।
- ৪৭. History of Bengal, Vol. I, P. 521.
- ৪৮. K. G. Goswami Excavation at Bangarh, Calcutta 1848. pp. 18 II.
- ৪৯. Ibid, p. 21.
- ৫০. ডঃ নাজিমুদ্দিন আহমেদ মহাস্থান ময়নামতি পাহাড়পুর ঢাকা, ১৯৭৯. পৃঃ ২১।
- ৫১. কল্যাণকুমার গঙ্গোপাধ্যায় পৃঃ ১১-১২।
- ৫২. Similar figurines have been discovered from Kausambi and other ancient sites and also identified. Allabhabad. 1950. pp. 34-35.
- ৫৩. নীহার রঞ্জন রায়।
- ৫৪. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, পৃঃ ২২৮।
- ৫৫. কল্যাণকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, পৃঃ ৮৫।
- ৫৬. শ্রী যতীন্দ্র মােহন রায় ঢাকার ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড, কলিকাতা, ১৩২২ বঙ্গাব্দ পৃঃ ৫০১।
- ৫৭. উক্ত ফলকটি সাভারের প্রত্নস্থান থেকে পাওয়া গিয়েছে এবং বর্তমানে এটি বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত।
- ৫৮. ডঃ আফরােজ আকমামঃ “সম্প্রতি মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত পােড়ামাটির ফলকে রামায়ণ কাহিনী” স্থাপত্য ও নির্মাণ, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, এপ্রিল-জুন ১২। ১২/বি, ৪র্থ তলা রামকৃষ্ণ মিশন রােড, ঢাকা।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।