লিখেছেনঃ চৌধুরী আতিকুর রহমান
আমি যে আওরঙ্গাবাদের কথা বলব তা মহারাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান শহর। পূর্ব নাম ছিল রজাতলাকা। সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামানুসারে নাম হয় আওরঙ্গাবাদ। শাহজাদা অবস্থায় এবং সম্রাট অবস্থায় এই আওরঙ্গাবাদ কেন্দ্র করে তিনি দাক্ষিণাত্যের শাসন পরিচালনা করেছিলেন। তাই দাক্ষিণাত্যের রাজধানী বলা হত আওরঙ্গাবাদকে।
২০০৪-এর ডিসেম্বরে কোন এক রাতে সাড়ে এগারোটা নাগাদ ট্রেন ধরেছিলাম। আওরঙ্গবাদ পৌঁছেছিলাম ভোর ছটায়। মনে রাখতে হবে মহারাষ্ট্রের পশ্চিম অংশে জতে আমাদের থেকে এক ঘন্টা পর। যদিও আমি ট্রেনেই ফজরের নামাজ পড়ে নিয়েছিলাম। স্টেশন থেকে বার হয়েই আমার চোখে পড়ে গেলো এক দাড়িওয়ালা অটোচালকের মুখের দিকে। সে-ও হয়তো আমার মত একজনের খোঁজ করছিল। নাম তার সেলিম উদ্দিন। স্টেশন এর কাছাকাছি মসজিদে আমাকে বসিয়ে রেখে আলিমুদ্দিন বলল, আমি ঠিক সাড়ে সাতটা আটটার সময় ফিরে এসে আপনার সফর শুরু করব। মসজিদে সেই সময় তাবলীগের ছয় নম্বরের বয়ান চলছিল। আমি বসে গেলাম, এক কাপ চা-ও জুটল।
স্টেশন থেকে মসজিদ যাওয়ার পথে সালিমুদ্দিন কে আমি আমার আওরঙ্গাবাদ আসার উদ্দেশ্য বলেছিলাম। সে অটো চালাতে চালাতেই আমার টুর প্রোগ্রাম করে দিল। বলল প্রথমেই যাবেন ইলোরা, তারপর দৌলতাবাদ, তারপর খুলদাবাদ, আওরঙ্গাবাদের শাহী মসজিদ ও মাদ্রাসা এবং পানচাক্কি দেখিয়ে তার ছুটি। সময় লাগবে ৪-৪/৩০ ঘন্টা। অর্থাৎ, বেলা ১২.৩০ টা ১ টা নাগাদ সালিমুদ্দিন আমাকে অজন্তা যাওয়ার বাসে চড়িয়ে দেবে। রুট বাসে অজন্তা যেতে লাগবে এক ঘন্টা। এটাও বলে দিল, বিকাল ৫ টার মধ্যে আপনাকে আওরঙ্গাবাদ থেকে রাত দশটার মুম্বাই ফেরার ট্রেন ধরার জন্য অজন্তা থেকে ফেরার বাস ধরতে হবে। আওরঙ্গাবাদ বাসস্ট্যান্ডে নেমেই আমি যেন তাকে ফোন করে দিই সে অটো করে আমাকে আওরঙ্গাবাদ স্টেশনে পৌঁছে দেবে।
ইলোরা ভ্রমণ
আওরঙ্গাবাদ থেকে ইলোরা গুহামন্দির ২৮ কিলোমিটার, ইলোরা থেকে দৌলতাবাদ ১৪ কিমি। দৌলতাবাদ থেকে খুলদাদাবাদ ১৩.৫ কিমি, খুলদাবাদ থেকে আওরঙ্গাবাদ ১০.৫ কিমি।
ইলোরার পাহাড় কুঁদে ১০০-র উপর গুহা মন্দির নির্মিত হয়েছে। গুহা মন্দির নির্মিত হয়েছে। এরমধ্যে ১ থেকে ১২ বৌদ্ধ গুহা মন্দির, ১৩ থেকে ২৯ হিন্দু গুহা মন্দির, ৩০ থেকে ৩৪ জৈন গুহা মন্দির। ১ ম শতাব্দি থেকে গুহা মন্দিরগুলি নির্মিত হতে শুরু করে। কলচুরি ও রাস্ট্রকুটদের রাজত্বে বৌদ্ধ ও হিন্দু গুহা গুলি রচিত হয়। যাদব বংশী ওদের সময় জৈন মন্দির গুলি রচিত হয়। যাদব বংশীয়দের রাজত্বে জৈন মন্দির গুলি রচিত হয়।
দওলতাবাদ বা দেবগিরি ভ্রমণ
আওরঙ্গবাদ থেকে ইলোরা যাওয়ার রাস্তাটা ক্রমশ চড়াই পথ। ইলোরা যাওয়ার পথে দূর থেকে দেখা যায় লাল রংয়ের একটি মিনার পাশে দূর থেকে মনে হয় কিছু ধ্বংসাবশেষ। প্রকৃতপক্ষে ইলোরা এলাকাটিকে দেখে মনে হয় ছাদ বাকি সব ছাদ থেকে পাখির চোখে দেখা। ফেরার পথে পুনরায় সেই লাল রঙের মিনারটি বহুদূর থেকে রাখা যায়। এটিই হলো চাঁদ মিনার।
সালিমউদ্দিন শুধু অটোচালক নয়, তাদোর এসব রাস্তায় এত বেশি আসতে হয় যে গাইডের কাজও করে দেন। উপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটি ওয়াটার স্পোর্স এলাকা। তার মানে গ্রীষ্মকালেও পর্যটক টানার প্রচেষ্টা। দূর থেকে চাঁদমিনার যথারীতি দেখা যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে আমরা দৌলতাবাদের দুর্গ এলাকায় পৌঁছে গেলাম।
দৌলতাবাদকে দেবগিরি বা দেওগিরিও বলা হয়। যাদব বংশীয় রাজা (৯ম থেকে ১৪ শতক) দের রাজধানী ছিল দেবগিরি। আলাউদ্দিন খিলজী ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম দিল্লি সুলতানির অন্তর্গত করেন। ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ বিন তুঘলক সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বলে দেবগিরিকে রাজধানী ঘোষণা করেন। তিনিই নাম দেন দৌলতাবাদ। পরে ১৩৩৪ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী পুনরায় দিল্লিতে ফিরিয়ে নিয়ে যান। এরপর আহমদ নগর সুলতানির একটি উল্লেখযোগ্য নগর ছিল। বাহমনী সুলতানদের সময়ই দৌলতাবাদের ব্যাপক নির্মাণকার্য হয়। এইসময়ই চাঁদমিনার (২১০ ফিট) টি কুতুবমিনারের আদলে তৈরি হয়। শাহজাহানের সময় ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে দৌলতাবাদ মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়।
দূর্গটিতে একটিই প্রবেশদ্বার। দুর্গর পাথরের রং বেগুনি এবং গোলাপী মেশানো। দুর্গের অভ্যন্তরে স্পষ্টই একটি মসজিদের আদল পাওয়া যায় যার মিম্বারে এখন মূর্তি স্থাপিত। চাঁদমিনারে এখন উঠতে দেওয়া হয় না।
আওরঙ্গাবাদ ভ্রমণ: খুলদাবাদ
মহম্মদ বিন তুঘলক খ্যাত দৌলতাবাদ ভ্রমণ শেষে আমাদের পরবর্তী ভ্রমণস্থল ছিল খুলদাবাদ। খুলদাবাদ হল প্রবল প্রতাপান্বিত সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধিস্থল।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিশাল সাম্রাজ্য আফগানিস্থান থেকে কেরালার দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু সম্রাটের নিজ আয় ছিল কোরআন নকল ও টুপি সেলাই। তাঁর পিতা শাহজাহানের সমাধি রচনায় খরচ হয়েছিল ২২ লক্ষ টাকা। এমনকি আওরঙ্গাবাদের ছোটা তাজ ‘বিবি কা মকবরা’ নির্মিত হয়েছিল আওরঙ্গজেবের স্ত্রী রাবেয়া দুরানির স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর পুত্র আজম শাহ দ্বারা।
আওরঙ্গজেবের সমাধি রচনায় খরচ হয় মাত্র ১৪ টাকা। প্রজাদের করের টাকা তিনি নিতে চাননি। আর প্রজাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু।
‘মা’আশির ই আলমগিরি’ (সাকি মুস্তাইদ খান লিখিত আওরঙ্গজেবের জীবনী)-তে সম্রাটের অন্তিম সময়ের বর্ণনা পাওয়া যায়,
সম্রাট আলমগীরের অন্তিম সময়ের দিনলিপি
২০-শে জানুয়ারী ১৭০৬, রবিবার দাক্ষিণাত্য বিজয়ের পর সম্রাট আহামদনগরে এসে পৌঁছলেন। প্রায় এক বছর অস্থিরতার মধ্যে থাকার পর শাসনকালের একান্নতম বছরে ২৬-শে ডিসেম্বর ১৭০৬-এ সম্রাট শারীরিকভাবে অত্যন্ত পিড়িত হয়ে পড়লেন। কিছুদিন পর সামান্য সুস্থ হয়ে স্বভাবমত তিনি সাধারণ বিচারের আদালতে বসলেন। এর মধ্যেই শাহ আলীজাহকে পাঠালেন মালওয়ার গন্ডগোল থামাতে এবং শাহজাদা কামবক্সকে পাঠালেন বিজাপুরের সুবাদার হিসাবে।
৪-৫ দিন পর আবার সাংঘাতিক রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। অত্যন্ত পিড়িত হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃতিদত্ত শক্তি এবং আত্মিক বলে আদালতে আসতে লাগলেন। এত অসুস্থতার মধ্যেও তিনি বা’জামাত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ে এবং ইসলামের খুঁটিনাটি পালনে গাফিলতি করেননি। তিনি সবসময় আওড়াতেন, “চোখের পলকে, এক মুহুর্তে, এক শ্বাসে, দুনিয়ার অবস্থা যাবে পালটে।” বৃহস্পতিবার বিকেলে সম্রাটের কাছে হামিদউদ্দিন খান বাহাদুরের একটি আরজি পেশ করা হল, একটি হাতির দাম ৪০০০ টাকা দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণের জন্য কাজি উল কুজ্জাত মুল্লা হায়দারকে দেওয়া হোক। এই মর্মে সম্রাট একটি চিঠি লিখলেন এবং শিরোনামে লিখলেন,”এই নগন্য (Wortless-অকর্মা) ব্যক্তিকে প্রথম স্তরে তুলে নিন।”সেই সময় দেখেই মনে হচ্ছিল তিনি পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছেন। শুক্রবার, ২০ ফেব্রুয়ারি সম্রাট বাইরে এসে তাঁর শয়নাগারে ফজর নামাজ আদায় করলেন এবং আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকলেন। অচেতন অবস্থা থেকে বার হওয়ার জন্য এবং শ্বাসকষ্টের মধ্যেই তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলি তসবিহর উপর ঘুরছিল। তাঁর জিহ্বা বারবার উচ্চারিত করছিল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’- নেই কোন উপাস্য আল্লাহ ছাড়া। দিনের চার ভাগের এক ভাগ পার হয়ে গেলে তিনি নিজে থেকেই বললেন,”শুক্রবার মারা গেলে এক মহান আশীর্বাদ”- বলেই তিনি চলে গেলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর ১৩ দিন। তিনি জন্মান মালওয়ার কাছে দোহাদে ১৬১৮-য়। তাঁর রাজত্বকাল ছিল ৫০ বছর ২ মাস ২৮ দিনের।
কাজী, আলেম ও সাধু ব্যক্তিগণ তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী, সমাধিস্থ করার জন্য দেহটিকে কাফন ও সজ্জিত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জানাজা নামাজ পড়া হলে দ্বিতীয় কন্যা জিন্নতউননেশা বেগমের অনুরোধে কফিনবন্দী (খোয়াব গাহ-বেড চেম্বার) করে রাখা হল, শাহজাদা মোহাম্মদ আজম ২৫ ক্রোশ দূর থেকে শনিবার এসে পৌঁছালেন। পৌঁছেই গভীর শোকে ডুবে গেলেন। সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি শাহজাদা গভীর শোকে আপ্লুত হয়ে তাঁর দেহ কাঁধে করে বিচারসভায় (দিওয়ান ই আদালত) বয়ে নিয়ে গেলেন, তারপর শ্রদ্ধার সঙ্গে পথ দেখিয়ে পৌঁছে দিলেন।
সম্রাটের ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় শায়েখ জৈনুদ্দিনের সমাধিস্থলের চত্বরে। স্থানটি আওরঙ্গাবাদ থেকে ৮ ক্রোশ দূরে এবং দৌলতাবাদ থেকে ৩ ক্রোশ দূরে। লাল পাথরের একটি চতুষ্কোণ (চবুতরা) প্ল্যাটফর্ম, দৈর্ঘ্যে তিন গজ ও প্রস্থে আড়াই গজ সমাধির উপর স্থাপন করা হয়। প্রস্তর চবুতরাটির মাঝামাঝি জায়গায় প্রমাণ সাইজের কেটে বাদ দিয়ে দেওয়ায় কবরের মাটি দেখা যায় এবং সুগন্ধি ফুল গাছ রোপন করা হয়। আমি দেখেছিলাম বন তুলসীর চারা। উক্ত স্থানটির নাম খুলদাবাদ এবং আওরঙ্গজেবের সমাধিস্থলকে বলা হয় ‘খুলদ মকান’।
হামিদউদ্দিন খানকে বলা হত ‘নিমচা ই আলমগীরী’ বা আলমগীরের তরবারি। তিনি সম্রাটের শোক যাত্রার কোন অংশ থেকেই বাদ পড়েননি। পায়ে হেঁটে শবদেহের সঙ্গে গিয়েছিলেন। দরবেশের পোশাক পরে রওজার পাশেই থাকার জায়গা করে নেন।
আওরঙ্গাবাদ ভ্রমণ:
এই শিরোনামে ইলোরা গুহামন্দির, দৌলতাবাদ দুর্গ ও খুলদাবাদে আওরঙ্গজেবের সাদামাটা সমাধি নিয়ে লিখেছি।
এই এলাকায় ঘুরতে গেলে আওরঙ্গাবাদকেই কেন্দ্র করা শ্রেয়। আওরঙ্গাবাদ নামটি অবশ্যই সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামানুসারে প্রাপ্ত। অটো চালক সালেমউদ্দিনের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সে আমাকে আওরঙ্গাবাদ ঘুরিয়ে দিয়ে অজন্তা যাওয়ার রুট বাসে উঠিয়ে দেবে। আমার দুর্ভাগ্য, যে কোন কারণেই হোক আওরঙ্গাবাদ গুহামন্দির ও অজন্তা গুহামন্দিরের ছবি নিতে পারিনি। তবে আমার মণিকোঠায় আছে।
সালেমউদ্দিন প্রথমে আমাকে নিয়ে গেলেন বিবি কা মকবরা, ছোটা তাজমহল বা দক্ষিণের তাজমহলে। তাজমহলের অক্ষম নকল। তৈরী হয়েছিল আওরঙ্গজেবের স্ত্রী দিলরাস বানু বেগম বা রাবিয়া দুরানির সমাধি রূপে। তৈরী করেন শাহজাদা আজম শাহ।
এরপর গেলাম আওরঙ্গজেব নির্মিত মাদ্রাসা ও মসজিদে। সব শেষে পানচাক্কি। পানচাক্কি হল সপ্তদশ শতকের এক মুসলিম সাধক নির্মিত যান্ত্রিক যাঁতাকল। ৮ কিলো মিটার দূরে উঁচু পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে পানি পাইপ দিয়ে বয়ে নিয়ে এসে একটি ফ্যানের মত গঠনকে ঘোরানো হত। সেই গঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল যাঁতাকলের। পানি ফ্যানের উপর পড়ে যাঁতা ঘুরিয়া গম পেশাই করে আটা তৈরী করত যা এতিম বাচ্চাদের খাদ্য ছিল।