লিখেছেনঃ ডঃ বিধান মুখোপাধ্যায়
বাউরীদের সামাজিক পরিচয় বর্তমানে অনেক উচ্চমানের। সুদীর্ঘকাল ধরে এবং বর্তমানে ক্ষেত্রভিত্তিক সমীক্ষার সাহায্যে এই সিদ্ধান্ত উপনীত হওয়া যায় যে, বাঁকুড়া জেলার অধিকাংশ বাউরীদের সামাজিক মান আগের তুলনায় অনেক উন্নত। এদের সমাজে শিক্ষিত এবং উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা খুব বেশি বলা যায় না। সরকারি চাকুরীজীবির সংখ্যা একেবারে নগণ্য। আমি বাঁকুড়ার বহু গ্রাম সমীক্ষা করে মাত্র ৮-১০ জনের মতাে এই সমাজের উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। তাদের মধ্যে একজন অবসরপ্রাপ্ত। এদের পরিবারের সব সদস্যই উচ্চমার্গের শিক্ষিত নয়। সরকারি সংস্থায় কেরানির পদে চাকুরীজীবির সংখ্যাও খুব কম। সুদীর্ঘকাল যাবৎ সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের জীবনে মরণে এরা দুটো গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছে এবং এর থেকে একটা বহুল প্রচারিত প্রবাদ সবার মুখে শােনা যায়। “আসতেও বাউরী, যেতেও বাউরী।” জন্মকালে প্রসূতির কাছে ধাত্রীমায়ের প্রয়ােজন হয়। শৈশব থেকে দেখে আসছি এবং পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শুনে আসছি যে, এই বাউরী জননীরাই আমাদের বাউরী অধ্যুষিত এলাকায় ধাইমার ডাক পড়ে। সেদিন থেকে প্রায় একমাস পর্যন্ত প্রসূতি ও জাতকের গুরুভার দায়িত্ব বহন করে এই বাউরী সম্প্রদায়ের নারী সমাজ। অথচ তাদের সম্পর্কে আমাদের সমাজ কেন যে শিশু মনে একটা ঘৃণ্য ধারণা তৈরি করে দেয় তা দুর্বোধ্য।
প্রায় প্রতি গ্রামেরই এক প্রান্তে অপরিচ্ছন্ন ভাঙাচোরা ঘর, স্থূপীকৃত ভাঙা হাঁড়ি কুড়ি ও শূকরের আনাগােনা, হাঁস, মুরগীর ডাক—অনুমান করা হত এটা বাউরীপাড়া। এদের পেশা সাধারণ ভাগচাষী, লোকের বাড়ীতে মাহিন্দার, মুনিষ রূপে কাজ করে। ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে দেখা গেছে বাঁকুড়ার জেলার অধিকাংশ গ্রামের বাউরীরা ছ’মাস ‘পুব’ চলে যায় অর্থাৎ বাঁকুড়া ছেড়ে চাষাবাদে ভালাে যেমন, বর্ধমান, হুগলি প্রভৃতি জেলায় চাষের কাজ অর্থাৎ ধান লাগানাে, ধানঝাড়া প্রভৃতি কর্ম করতে চলে যায়। এটি তাদের ভাষায় ‘পুব যাওয়া’ বলে। এরা পরিশ্রমী, নিত্য নৈমিত্তিক অভাবের জ্বালায় তারা অনেক ধরনের কাজ করে থাকে। মৃত্যুর পর শ্মশানের সমস্ত ভারী কাজ ওদের দ্বারাই নিষ্পন্ন হয়। এদের সামাজিক ও আর্থিক কোনাে উন্নতি নেই। রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য যদিও প্রভূত পরিমাণ নয়, তবুও এদের সমাজের মানুষেরা গতানুগতিকভাবে জীবনযাপন করে আসছে। মেয়েদের একটিই পরিচিতি কোনাে ধনী লােকের বাড়ীতে কামিন অর্থাৎ মাজা, ঘষা, ঘরদোর পরিষ্কার করার কাজেই নিযুক্ত। মাসে সামান্য কিছু পয়সা পায়, বড়জোর একবেলা আহার মনিবের ঘর থেকে জোটে। এদের প্রায় সব শিশুরাই স্কুলে যায় না। মায়ের পিছনে পিছনে এসে সেও একদিন কাজের মেয়েতে পরিণত হয়ে যায়। এরা এখনও অস্পৃশ্য হয়েই রয়ে গেছে আমাদের সমাজে। এ প্রসঙ্গে H. H. Risley তাঁর গ্রন্তে উল্লেখ করেছেন— “The social rank of Bauri is very low. Members of the higher castes will not take water from this hands, and they themselves eat with Bagdi, Keatas, Lohars and the non-Aryan Kurmis of Western Bengal.”১ এছাড়া অনেক আগে এই বাউরী সম্প্রদায়ের মানুষেরা পালকী বাহকের কাজও করে থাকত। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এদের মধ্যে মানুষের জীবনধারণের জন্য যে তিনটি মৌলিক চাহিদা-খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থান-এর কোনটিই এদের নেই। এদের সম্পর্কে K. c. Sashmal বলেছেন— “The Bauris are traditionally agricultural babourers and palanquin bearers who held one of the bottom rungs of the regional society in wealth, power and caste position.”
“In the handbook of Castes and Tribes, 1924, the Bauris are described as lower Uriya a caste of basket makers. They are chiefly domiciled in Ganja, where they are locally known as “Khadals’. They are considered to belong to the category of the palanquin bearers. Sir H. H. Risley described the Bauri as a Tribal Caste’. He mentioned, the Bauri, Chandal and Namasudra castes of Bengal as illustrations of the transformation that had taken place in their tribal character. In his study Dr. Niharranjan Roy has contended that Hadi, Dom, Bauri and they have been gradually absorbed in the Hindu social system, relegated to occupy a lower status.”২
এই সম্প্রদায়ের লােকেদের অর্থনীতি বলতে দিনমজুর অথবা ভাগচাষী। ইদানিং দু-একটি গ্রামে দু-একটি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত এবং সরকারি কাজে নিযুক্ত হয়েছেন, তবে তা করাঙ্গুলি-গণনীয়। এদের আবার দুটি ভাগ আছে। যে সমস্ত বাউরীরা শহরাঞ্চলের নিকটবর্তী জায়গায় থাকে, তারা অনেক বেশি পূর্বের তুলনায় মার্জিত ও শিষ্ট। পােশাক-আশাক, চালচলনে অনেকখানি আধুনিকত্বের ছোঁয়া যে আছে তা লক্ষ্য করা যায়। অপরদিকে যারা একেবারে গণ্ডগ্রামে বাস করে তাদের জীবনধারণের পদ্ধতি খুবই অনুন্নত। তারা নিজেদেরকে অতখানি মেলে ধরতে পারেনি। শহর ও গ্রাম সর্বত্রই এরা ঠিকা শ্রমিক, ভাগচাষী, দিনমজুর, ঠিকা ঝি প্রভৃতি কার্যে নিযুক্ত থাকে। এরা কখনাে সম্প্রদায় বা দলবদ্ধভাবে রাজা, জমিদার বা সামন্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে বলে শােনা যায়নি। এককালে এরাই পাল্কী বহন করত, এদের গায়ের শক্তিও প্রচণ্ড। অবশ্য এখন আর পাল্কীর প্রচলন নেই। রাজতান্ত্রিক বা সামন্ততান্ত্রিক যুগে এদের কোনাে রাজস্ব দিতে হত না। সম্ভবত রাজা বা সামন্তগণ এদের নাগরিক বলে গণ্য করতেন না। এই জাতির যে থাকটা মুছুলিয়া বাউরী বলে পরিচিত তারা সাধারণত মুসলমানের সংস্পর্শে থাকত।
আসলে দুর্বল আর্থ-সামাজিক কাঠামাে, সচেতনতার অভাব, আর্থিক অস্বচ্ছলতার জন্য এঁরা প্রায় একই জায়গায় অবস্থান করেছে। আজও নিজেদেরকে সমাজের অন্যতম জায়গায় নিয়ে যেতে পারেনি। তবে কৃষিকাজ, দৈহিক ক্ষমতা, রাজনীতি, খেলাধূলা এবং কিছুটা শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমানে এদের পারঙ্গমতাবােধ উল্লেখযােগ্য। এদের এই আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামাে উন্নত করতে হলে সর্বপ্রথম এদের শিক্ষার আলােয় নিয়ে আসতে হবে। আত্মমর্যাদার বােধ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
খাদ্যাভ্যাস ও রীতিনীতিঃ প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এরা বহির্ভারতীয় নয়। এরা বাংলা তথা ভারতের আদিম অধিবাসী। ফলে বাংলার জলবায়ুর সংস্পর্শে এরা পূর্বপুরুষদের খাদ্যাভ্যাস, পােশাক-আশাক প্রভৃতি বাঙালি রীতিনীতিই অনুসরণ করে থাকে। তবুও দৈনন্দিন জীবনের রীতিনীতিতে কিছুটা স্বাতন্ত্র পরিলক্ষিত হয়।
বাঙালী হিসাবে তাদের খাদ্য রীতিনীতি বাঙালীদের মতােই। ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, শাক, তরকারী ইত্যাদি তাদের প্রিয় খাদ্য। মাছ, ডিম, মাংসও তাদের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। অনুমান করা যেতে পারে এদেরই একটা গােষ্ঠী সম্ভবত শিকার করে খেত। কংসাবতী ও বরাকর নদীর মধ্যবর্তী শিখরভূমে এখনও ‘মুসলিয়া’ বাউরীরা বিভিন্ন প্রাণীর মাংস খেয়ে থাকে। গত ৩০-১১-২০০৯ তারিখে বাঁকুড়া জেলার মাকুড়গ্রাম সংলগ্ন ‘বিরাডি’ গ্রাম পরিদর্শনে বেশ কয়েকটি বাউরী ঘরের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে জানা গেল যে তারা অত্যন্ত গরীব। ঘরে দু-একটি শূয়াের ঘােরাফেরা করছে। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম যে, আগে তারা শূয়ােরের মাংস খেত। বর্তমানে তারা শূয়াের বিদেশে চালান করে কিছু অর্থ উপার্জন করে থাকে। এছাড়া রুটি, ডাল আরাে অন্যান্য বাঙালীদের খাবার তাদের খাদ্যতালিকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। হাঁস, মুরগী, ভেড়া, ছাগল প্রভৃতির মাংস তারাও খেয়ে থাকে। এদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে L.S.S. Omall তাঁর গ্রন্থে বলেছেন— “The Bauri’s are addicted to strong drink and wit few exception, are indifferent to the nice scruples regarding food which have so inportant a a bearing on the status of the average Hindus; for they eat beef, park, fowls, all kinds of fis and rat.”৩
পােশাক-পরিচ্ছদেও এদের মধ্যে সরলতা লক্ষণীয়। সাধারণভাবে পুরুষেরা লুঙ্গি বা ধুতি, জামা, পাঞ্জাবী পরিধান করে, নারীরা শাড়ী। তবে আধুনিক পােশাক পরিচ্ছদ সম্পর্কে প্রায় সব যুবক-যুবতীরাই সচেতন। ফলে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতাে চুড়িদার, পায়জামা, শাড়ী, পায়ে জুতাে পরিধান করে। অলংকার হিসাবে তারা সাধারণ ইমিটেশনের গয়না ব্যবহার করে। কানে অলংকার খুব কম মূল্যের, নাকের দু’দিকে ছিদ্র করে এই ধরনের গয়না পরিধান করে থাকে। পায়ে তড়া, পায়ের আমুলে আঙট পরিধান করে। এছাড়া নারী পুরুষের মধ্যে উলখি পরার রীতি আছে। যুবক-যুতীরা কপালে, চিবুকে, হাতে, বুকে উলখি পরে।
বিবাহ ও উৎসব পার্বণঃ এই সম্প্রদায়ের বিবাহ ব্যবস্থা আর পাঁচটা বাঙালী সম্প্রদায়ের মতাে। বিয়ে হয়ে যায় এদের খুব কম বয়সেই। সরকারী আইন কানুন উপেক্ষা করে বা অজ্ঞাতসারে তারা তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়। পণপ্রথা এদের সমাজে এখনও প্রচলিত আছে। বিবাহ ও পণপ্রথা প্রসঙ্গে গত ১৭/১১/২০১১ ভেদুয়াশােল (ওন্দা) সংলগ্ন পাহাড়পুর বাউরী পাড়ায় সমর বাউরী নামে ৭০ বৎসর বয়স্ক মানুষটির মুখের জবানীতে জানতে পারলাম যে, তাদের সময়ে মেয়েদের বিয়ের সম্বন্ধের সময় পাত্রের যােগ্যতা বিচার করা হত যে, কাদের বাড়িতে কতকগুলি লাঙলের চাষ করে। অর্থাৎ তার মনিবের বাড়িতে কতকগুলি হাল আছে এই হিসেবে তার গুণগত মান নির্ধারণ করে মেয়ের পাত্র নির্বাচন করা হত। অবশ্য বর্তমানে সে চিন্তার অবলুপ্তি ঘটেছে। পাত্রের গােলাঘরের জমি বা হাল লাঙলের পরিমাণগত দিক থেকে বিচার করে মেয়ের বিয়ে ঠিক হত, এতে পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকার নিদারুণ দুরাবস্থার দিকটি যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। অপরদিকে, কনেপক্ষকে বরপক্ষ এক টাকা দিয়ে মেয়েকে কিনে নেওয়ার প্রথা আছে। বিয়ের পূর্বে ‘জল সইতে যাওয়া’ ও ‘জলমা’ পূজার প্রথা আছে। বর ও কনে উভয়ের বাড়ীতেই এই অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয়। ভগিনীপতি বা তার অভাবে ঐ শ্রেণীর মস্করা রসিকতার সম্পর্কিত ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে তরুণী ও প্রৌঢ়াদের একটি শােভাযাত্রা বের হয়। পুকুরঘাটে ‘জলমা’র পূজা দেয়। একটি কাঁসার থালায় একটি মুরগীর ডিম, সিঁদুর, ধান, দূর্বাঘাস, পান, সুপারী, প্রদীপ, লাটাই, নড়া-শাঁখ, গােবর। ডিম বাদ দিয়ে সকলগুলির সার্থকতা বা মঙ্গলপ্রদ বলে জানা যায়। কিন্তু ডিমের সার্থকতা কি? এ প্রসঙ্গে একটি বাউরী প্রধান গ্রামের রাধু বাউরী নামে এক অশীতিপর বৃদ্ধের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে, ডিমটি তাদের গােত্র বা জাতি চিহ্নিত করার জন্য দেওয়া হয়। বাউরী ঘর মাত্রেই মুরগী পােষে। আর সেই থেকে ডিম দেওয়ার প্রথাটি চলে এসেছে। আজও তাদের বিয়ে বাড়ীর উৎসবে ‘জলসওয়া’ বিষয়টি মেয়েদের মুখে ছােট ছােট গানের কলির মাধ্যমে শােনা যায়। যেমন—
(১) ‘টুকুটুকু জল খাও জলমা ঠাকুরণ।
খাব না, বিলাবাে, ঘটি ভরে জল দাও।
ছিল্যার বিহা দুব।
(২) আবার কোনাে ব্রাহ্মণের বাড়িতে গিয়ে বলে—
খুল খুল জলমা ঠাকুরণ
কুচির কপাট খুলো
গােপালের মা এসেছে বালার বিহা দুব।
এখানে ‘বালা’ বলতে ছেলে অর্থে ব্যবহৃত।
অবুঢ়্যান্নঃ এই প্রথাটিও বাউরী সমাজে বিয়ের আগে সম্পন্ন হয়ে থাকে। বিয়ের আগে আগেই এটি হয়। তবে অবুঢ়ান্নে তারা নিজেরা রাঁধে না, স্থানীয় পুরুত ঠাকুরের ঘর থেকে রাত্রিবেলা দল বেঁধে গিয়ে চেয়ে নিয়ে আসে। যেখানে পূজারী ব্রাহ্মণ নেই সেখানে যে কোনাে ব্রাহ্মণের ঘর থেকেই চেয়ে আনে। সেই ভাত খেয়ে কনে বা বর বিয়েতে বসে। বিয়ের দিন অতি ভােরে বর ও কনেকে নিজ নিজ বাড়ীতে স্নান করানাে হয়। এই বিশেষ স্নানকে ওরা বলে কুহুলী স্নান। বরকে নিয়ে বরযাত্রী সরাসরি কনে বাড়ীতে প্রবেশ করে না। কনে ঘরের কাছাকাছি রাস্তায় বা মুক্তাঙ্গনে সমবেত হয়ে মাদল বাদ্য সহকারে বরযাত্রীরা গান ধরে। গানগুলি শুনে মনে হয় ‘রণং দেহি’ ভাব। কনেপক্ষকে উত্তেজিত করবার উদ্দেশ্যেই যেন রচিত। যেমন—
(১) পাল্লাদে, পাল্লা দূব
তােকে হারাই তবে জল খাব।
(২) তুই কি পারবি আমাকে – আমাকে
ছিরিপুরের নীরি ল্যারছে।
(ছিরিপুর-শ্রীপুর, নীরি সম্ভবত নৃপতি, ল্যারছে – পারেনি)।
(৩) কুলিকে (রাস্তায়) বর আসছে।
নীলমণি কি আজও ঘুমাছে।
(নীলমণি – এখানে কন্যাকে বলা হয়েছে)।
(৪) বাজছে মাদল বহড়া তলে বহড়া তলে
বাজুক বাজুক বাজুক মাদল ক্যনেআর
মায়ের ছাঁচকোলে।
এছাড়া বরপক্ষের লােক অভ্যর্থনার সুরে গান ধরে
শালখাড়া শালখাড়া ওরে শালখানা শালখাড়া
কি খ্যায়ে বাড়িলি বাধুয়া তালগাছের পারা।
(বাধুয়া শব্দটি অবৈধ অর্থে ব্যবহৃত, পারা – সমান)—
কনের ঘরে বর আসার পর যথারীতি পুরােহিতের উপস্থিতিতে বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়। রাত্রিবেলায় সিঁদুর দান হয়ে যায়, একে বলে ‘সিঁদরাদান’। আগেকার দিনে ওদের সম্প্রদায়েরই মধ্যে একজন গ্রামের মােড়ল পুরােহিতের কাজ করে থাকত। বর্তমানেও এই প্রথা প্রচলিত আছে। সিঁদুরদানের সময় মন্ত্র বলতাে পুরােহিত তিনবার এইরকমভাবে,
শ্রীহরি শ্রীহরি
বামুন রূপ ধরি
হনু আনলেন ফাল
সীতা রুইলেন গাছ
দিনে দিনে বাড়ে গাছ
দুয়া দশ হাথ
স্বর্গে আছে ধর্ম
মর্ত্যে আছে বসুমাতা
অমুকের সঙ্গে অমুকের বিয়ে।৪
তারপর বরপক্ষ ও কনেপক্ষ উভয়ে ‘হরিবােল’, ‘হরিবােল’ ‘হরিবােল’ বলে তিনবার চিৎকার করে। তারপর তারা ঘরে প্রবেশ করে। এছাড়া ছাদনাতলায় গায়ে হলুদ অন্যান্য প্রক্রিয়া আর পাঁচটা বাঙালী সম্প্রদায়ের মতােই। যেমন— বাঁধাপণ নামে বিবাহ ব্যবস্থার এটি প্রথা আছে। এতে বরপক্ষের কাছে গ্রামের কিছু লােকজন ‘ষােলআনা’র স্বার্থে কিছু টাকা চায়। এই টাকা দেওয়ার প্রথাকে ‘বাঁধাপণ’ বলে। অবশ্য বর্তমানে ব্রাহ্মণ দিয়েও বিয়ে দেবার রীতি প্রচলিত হয়েছে।
‘বিবাহ’ ছাড়াও এদের সমাজে ‘সাঙ্গা’ প্রথা প্রচলিত ছিল। প্রথমবার বিয়ের পর বর যদি কনেকে ছেড়ে দেয় তবে সেই মেয়েরে আবার বিয়ে দেওয়া হয়। সে তখন নিজের এবং বাড়ীর অভিভাবকদের মতামত সাপেক্ষে পছন্দমতাে কোনাে পুরুষকে গ্রহণ করতে পারে, একে বলে সাঙ্গা। এটি বর ও কনের উভয়পক্ষেই প্রচলিত আছে। সে বিষয়ে উৎসব অনুষ্ঠানও সাধ্যমতাে সুন্দর ও আনন্দমুখর করবার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। প্রথম বিয়ে করা বউয়ের মর্যাদা স্বতন্ত্র। এমন কয়েকটি পবিত্র, গম্ভীর ও দায়িত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান আছে যাতে বিবাহিতা বধূর উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ অপরিহার্য, সাঙ্গা করা বউ অথবা ধরা বউয়ের ক্ষেত্রে সে মর্যাদাটুকু দেওয়া হয় না।
এই সম্প্রদায়ের বিয়েতে বরকনের পছন্দের উপর নির্ভর করে না। বর বা কনের অভিভাবকগণে পাত্রপাত্রী নির্বাচন করেন। বাউরীদের মধ্যে বাল্য বিয়েই প্রচলিত। বর বা ছেলেরা ১৪/১৫ বৎসর বয়সে এবং কনে বা মেয়েরে ৯/১০ বছর বয়সে সাধারণত বিয়ে হয়ে থাকে। বিয়েতে বরপক্ষকে কনের জন্য কিছু পণ দিতে হয় এবং আত্মীয় কুটুমদের ভােজনের ব্যবস্থা করতে হয়। মল্ল বাউরীরা বিয়েতে মৌল (মহুয়া) ডাল ব্যবহার করে থাকে কিন্তু শিখরা বাউরীরা বিয়েতে দুটি গাছের ডাল ব্যবহার করে (১) সিদাডাল (২) মৌলডাল। এই বিয়ে উপলক্ষে বরপক্ষ ও কনেপক্ষ উভয়ের মধ্যে ছড়া কাটাকাটি হয়। কনেপক্ষ বরপক্ষকে খেজুর পাতার তালাই বা চাটাই দেয় বসার জন্য তারপর তামাক বা বিড়ি ইত্যাদি সরবরাহ করা হয়। বরপক্ষের লােকদের ছড়ার মাধ্যমে সেগুলির যথাযথ উত্তর দিয়ে আসনশুদ্ধি, তামাকশুদ্ধি, হুঁকো শুদ্ধি কলকেশুদ্ধি করে নিতে হয়। যেমন তামাকশুদ্ধি ও কোশুদ্ধির দু-একটি ছড়ার উদাহরণ,
“ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীচিগুলি
লম্বা লম্বা পাতা
শুন শুন মহাশয় তামাকের কথা
এক ছিলিম তামাক বানাইলে সর্বলােকে খায়
পথের পথিক গেলে ফিরি ফিরি চায়।
উত্তম গাছের ফল আনিয়ে নারকল
তাই দিয়ে গঙ্গার জল
বসাইয়া ঝারির নল,
হুঁকো করে ভুড় ভুড় কলকে করে সাঁই
ধরিলাম হুঁকো মারিলাম ফুক
শুদ্ধ করিলাম কলকের মুখ।”
বাউরী সমাজের বিবাহব্যবস্থায় নারীদের অবদান যথেষ্ট উল্লেখযােগ্য। আধুনিক সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতির প্রসারের সাথে সাথে তারা অনেকখানি নিজেদের পরিবর্তন করে ফেলেছে। অবশ্য এখনও বিয়েতে নারীদের মুখে অনেক ধরনের গান শােনা যায়। গত ১৮-২-২০১০ তারিখে খাতড়া থানার বলরামপুর গ্রামের বাউরীপাড়ায় ক্ষেত্রভিত্তিক সমীক্ষা করতে তারা তাদের পুরােনাে দিনের বিবাহ বিষয়ক গানগুলি এখনও ভােলেনি। বালিকা বাউরী নামে একজন ৫০ বৎসর বয়সের মহিলার মুখ থেকে তাদের বিবাহ উপলক্ষে যে গানগুলি নারীকণ্ঠে ধ্বনিত হত তারই একটি নমুনা নিম্নরূপঃ
শীলত লড়েচড়ে পায়ার ঘুমারে
আজ কেন বরের মা তােয় হিয়া বিদুরে
সাইদের বাড়িএয় ওগাে বলি পাকা কুন্দরি
সাইদের বড় দাঁড়াআছে অতি সুন্দরী
টুকুটুকু জল ধাও টুকুটুকু জল দাও
জলমা ঠাকর্যান
ঘটি ভরে জল দাও ঘটি ভরে জল দাও
বালার বিহা দুব
মেঘ দুল দুল (হুড় হুড়) করে ওহে রাজা হে
আজকে ন বরের না তাের হিয়া বিদুরে
মেঘে দিল তালি মেঘে দিল তালি
তুমার রাণী দাঁড়ায় আছে।
কিনে দাও পাটের অ শাড়ী।৫
নতুন জামাইকে নিয়ে রঙ্গরসিকতা করার প্রথা সব সমাজেই প্রচলিত। এই সমাজের প্রচলিত গানে আছে যে বর বিয়ে করতে এসে দাঁড়ালে কনে বাড়ীর মেয়েরা কনের মার উদ্দেশ্যে বলতে থাকে—
তুমার জামাই অ্যাল ভাঙা ফুটা গাড়িতে লাে গাড়িতে,
জল দুব নাই ভাল বাটিতে।
কিংবা বরের উদ্দেশ্যে তার শালী শালা, বউয়ের দল বলতে থাকে—
পুঁটি মাছের হয় নাই ঝুল, হয় নাই ঝুল
তুমাকে আমি দেখ্যায় অ্যানব দামদরের পুল
আনারকলি সিনেমাললা সিনেমা
পয়সা বিনা দেখ্যাতে প্যাল না।৬
এত গেল বরকে উদ্দেশ্য করে তাদের মনের কথা কিন্তু কনে বাড়ীর বিবাহিতা নারীরা এত সহজে আসর ভঙ্গ করে না। তাঁরা কনেকে নিয়েই হাসি মস্করায় মশগুল হয়ে ওঠে
বড়বাগানের মেলাতে লাে মেলাতে
আমার হাতের শাঁখা ভ্যাঙে গেল
তাের ভাতারের গুথাতে।
তাের নাগরের সাথে দেখা হল
সাঁইথিয়ার হাটে লাে সাঁইথিয়ার হাটে
মােরব্বা খ্যায়ে কথা দিলাম্
মিলব মােরা কেঁদ্যুয়ার মাঠে লাে
কেঁদুয়ার মাঠে।৭
যাক বিয়ে যখন হয়ে গেল, তখন কনেকে তাে শ্বশুরবাড়ি যেতেই হবে। কিন্তু কন্যা বিদায়পর্ব সব সমাজে এক রূপ। তাই এ সমাজের কনে বিদায়ের একটি গানে শােনা যায়-
“চারদিকে লালের ঘােরা মধ্যে বিহা শাড়ী
হাত বাড়ায়ে তুলে লুব শিমুলফুলের ডালি
এত রাতে বিদায় দিচ্ছে বিদায় ক্যান হব
ঘরে ঢাকা মদ আছে ন্যাচে ন্যাচে যাব।”
নতুন বউ এলে পাড়া প্রতিবেশীরা এসে ভিড় জমাবেই যে যেমনি সম্পর্কের সে সেইভাবেই নববধূর সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কি রঙ্গরসিকতা করে চলে। কিন্তু এদের ভিতর যদি নববধূর দিদিশ্বাশুড়ি ঠাকুরান উপস্থিত থাকেন তিনি কিন্তু আনন্দের সঙ্গে বলে বসেন –
আকাশের তারা লাে, আকাশের তারা
বৌটা তাকাচ্ছাে দেখ য্যেন কোলাব্যাঙের পারা।
দিদিশ্বাশুড়ি ঠাকুরান তার নাতবৌ এর সঙ্গে রসিকতা করে যাই বলুন না কেন পাড়া প্রতিবেশীদের ভিতর যদি কেউ অনুচ্চকণ্ঠেও এই নববধূর রূপ বর্ণনাচ্ছলে কিছু অপ্রীতিকর মন্তব্য করে বসেন তাহলে কিন্তু এসব প্রতিবেশীদের ছেড়ে কথা বলেন না –
তারা করে ঝিকিমিকি চাঁদ দেয় আমােক
এমন সুন্দর মিয়াকে পাড়ার লােকে বলে কাল
লাউ গাছটি লাগালাে ঘরে পুই গাছটি হাল
কোন্ চামারের বেটা বেটি অ্যাসে উঠানে দাঁড়াল।
এই সমস্ত বিয়ের গানের মধ্যে দিয়ে এই সমাজের মানুষদের অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি গুপ্ত আছে। ভাষার মধ্যে শব্দ ব্যবহার উচ্চারণ বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। বিবাহ ব্যবস্থায় পণপ্রথা কেমন জিনিস সে সম্পর্ককে একটি ক্ষেত্রভিত্তিক সমীক্ষা করে জানা গেছে তাদের গানের মধ্য দিয়ে। খাতড়া মহকুমার অন্তর্গত দাঁড়শােল গ্রামের ৭০ বছর বয়সের সুখদেব বাউরীর গানে ফুটে ওঠে সেই কথা—
“আশি হাজার টাকা না হলে
মিয়ার বিহা দুব কি ক্যরে
একটি মিয়ার বিহা দিতে
কত টাকা খরচ হয়
কুথা থ্যাকে আনি বল তবে
আমার জামাই হয়।
নগদ আশি হাজার টাকা না হলে
মিয়ার বিহা দুব কি করে।৮
অর্থাৎ কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার অসহায় আর্থিক দুরাবস্থার কথা উপরিউক্ত গানটিতে প্রকাশিত হয়েছে।
ধর্মীয় পরিচয়ঃ ধর্মগত দিক থেকে এরা হিন্দুধর্মের অন্তর্গত। এ প্রসঙ্গে দুঃখভঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত হল— “বাস্তবিক বিচারে এরা হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ-কোনাে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়। এদের মধ্যে যারা হিন্দু প্রধান গ্রামে বাস করে আসছে তারা কালক্রমে হিন্দুর উৎসব পার্বণ ও সহজ রীতিনীতিগুলি অনুসরণ করেছে। হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলেই ধরা হয় তাদের। এদের মধ্যে আবার অনেকগুলি শ্রেণি আছে। যথা ধূলা, মুলা, শিকরিয়া, মানু বা মাননা, ফুলা, মুছল বা মুসলিয়া, পাশি, ঝেঁটা ইত্যাদি।
Accroding to Risley- “the Bauris are divided into nine sub castes. These are as follows : (1) Mallabumia (2) Sikaria or Gobaria (3) panchakoti (4) Mola or Mule (5) Dulia or Dhulo (6) Malua (7) Jhatia or Jhetia (8) Kathuria and (9) Paturia.৯
এদের মধ্যে ‘মানু’ শ্রেণির বাউরীকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় বেশি। মান্য শব্দ থেকে ‘মানু’ কথাটি এসেছে। এরা যে কোনাে শ্রেণির বাউরদের কন্যা গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু স্বশ্রেণির কন্যাকে অন্য কোন শ্রেণির হাতে সমর্পণ করলে এদের কৌলিন্য থাকে না। অপর শ্রেণি স্ব স্ব প্রধান। ‘মানু’ শ্রেণির প্রাধান্য সকলেরই নিকট স্বীকৃত। বাউরীদের একটি মাত্র গােত্র সেটি হল কাশ্যপ।
সুনীল দাস তাঁর গ্রন্থে বাউরীদের ধর্মের সন্ধান করতে গিয়ে বলেছেন, “বাউরীরা যে বৌদ্ধ তার দু-একটি প্রমাণস্বরূপ কথা বলি—এখানে শুধুমাত্র দুটি প্রবাদ বাক্যের কথা বলতে চাই, একটি প্রবাদ হচ্ছে—“বেদ বিধি ছাড়া, যাইস বাউড়ী পাড়া” অর্থাৎ বাউড়ীরা বেদ-এর বিধান মানে না। যার অর্থ দাঁড়ায় যে, বাউড়ী জনগােষ্ঠীর মানুষেরা আর্যধর্মের বা হিন্দুধর্মের মানুষ ছিলেন না, তবে বাউরী জনগােষ্ঠীর মানুষেরা কোন্ ধর্মের মানুষ ছিলেন? তাঁরা ছিলেন আদিম তন্ত্র ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের মানুষ, কিংবা বলা যায় যে, বৌদ্ধতন্ত্র ধর্মের মানুষ ছিলেন বা আছেন।১০
এছাড়া ঐ গ্রন্থের অন্যত্র আরাে বলেছেন, “আদিম বাউড়ী জনগােষ্ঠীর মানুষেরা বন্যযুগ থেকেই তাদের নিজস্ব আদিম তন্ত্র ধর্ম ছিল এবং বহু পরে অর্থাৎ বুদ্ধদেবের সময়ে আদিমতন্ত্র ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে। বাউড়ী জনগােষ্ঠীর মানুষেরা কোন কালেই হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেনি। তার কারণ এই যে, আর্যরা হিন্দু ধর্মের মধ্যে মানুষকে উঁচু নীচু জাতের মধ্যে বিভক্ত করে রেখেছে, এই হিন্দু ধর্মের মধ্যে সমাজ ব্যবস্থায় সাম্য কথা বলেনি।”১১
এককালে সব শ্রেণির বাউরীদের মধ্যেই মৃত পশুর মাংস ভক্ষণ প্রচলিত ছিল। অনুমান করা যেতে পারে, এদেরই একটি গােষ্ঠী সম্ভবত পশু শিকার করে খেত। তারা মৃত পশুর মাংস খেত না বা খাওয়া ছেড়েছিল। শিকার শব্দ থেকে খুব সম্ভব শিকারী বা শিকরিয়া শব্দটির উৎপত্তি। কেউ কেউ বলেন এরা কংসাবতী ও বরাকর নদীর মধ্যবর্তী ভূমি শিকরভূম থেকে আগত বলে এদের শিকরিয়া বলা হয়। বাঁকুড়া শহরে এখনাে শিকরিয়া পাড়া বলে একটা পাড়া আছে। অবশ্য এরা দীর্ঘদিন শহরাঞ্চলে বসবাস করার ফলে রুচি ও সংস্কৃতির দিক থেকে পরিবর্তিত হয়েছে। কথাবার্তা, চালচলনের মধ্যেও অনেক মার্জিত রূপ লক্ষ্য করা যায়। তবে নানা বিষয় নিয়ে বিবাদ বিতর্কে তাদের সেই আদিমতার অবগুণ্ঠনটি খসে পড়ে।
‘মুসলিয়া’ কথাটি মুসলমানের অপভ্রংশ। এদের সঙ্গে অন্য শ্রেণীর বাউরীদের চলন নেই, এরা সম্ভবত মুসলমানের প্রতিবেশী বলেই এদের ‘মুছুল’ বা ‘মুসুলিয়া’ বলা হয়। এদের পরিচয় এখনাে শালডিহা অঞ্চলের নাথেরডাঙের পাশের গ্রাম সালানুর-তে আছে বাউরীদের প্রসঙ্গে তরুণদেব ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাঁকুড়া’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন— “বাউরীদের প্রতীক বা টোটেম কানাবক বা নীলবক। অন্য পােত্রও প্রচলিত ছিল। যেমন শালমাছ, চাঁদমুড়া মাছ, চিতি সাপ ইত্যাদি।”১২ এদের গােত্র সম্বন্ধে Dr. K.C. Sashmal তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- “only one gotra, called ‘Kashyap’ is found to exist among the Bauris. All individuals of different sub castes belong to this particular gotra and as such, the rule of exgarny. in connection with gotra is totally absent here. Although they have secured a place in the Hindu social system yet traces of totemism still survice amongst them.১৩
এই বাউরী সম্প্রদায়ের কাছে কুকুর খুব আদরণীয়। একথা Dr. Sashmalও তাঁর গ্রন্থে স্বীকার করেছেন—
“The pay respect to red-beaked heons (Kashyap Bak) and dogs. They do not kill a heron and never touch its carcass. Even when a dog dies they do not dispose of the corpse.”১৪
এছাড়া অশ্ববিষ্ঠা বাউরীদের কাছে অস্পৃশ্য। এ প্রসঙ্গে L.S.S O’malley তাঁর গ্রন্থে সহ্মত করে বলেছেন—
“Traces of totemisn still survive in their neverence for the red-backed heoron and the dog, and perhaps in their strong objection to touching horse-dung. The heron is looked upon as the emblem of the tribe, and may not be killed or molested or pain of expulsion from the caste. Dogs also are sacred, so much so that a Bauri will on no account kill a dong or touch a dead dog’s body.”১৫
ধর্মের দিক থেকে মনসা পূজা বাউরী সমাজে সর্বত্র প্রচলিত। শ্রাবণের শেষ ও ভাদ্রের প্রথম দিকে, কোথাও ভাদ্র সংক্রান্তিতে মনসা পূজা হয়। মনসাপূজার সময় ভক্তদের ওপর মনসাদেবী ‘ভর’ করেন বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। একে বলে ‘ঝুপাল’। ‘ঝুপালে’র সময় ভক্ত উন্মত্ত হয়ে ওঠেন। H.H. Rishley ও এই সম্প্রদায়ের দেবদেবী সম্পর্কে বলেছন—
“Bauris profess to be Hindus of the Sakta sect, but in western Bengal at any rate, their connection will Hinduism of the slenderest kind and their favourite objects of worship are Manasa’, Bhadu, Mansingh, Barpahari, Dharmaraj and Kudrasini.”১৬
পৌষ সংক্রান্তিতে ‘বড়াম’ পুজা বাউরীদের প্রধান উৎসব। দুদিন তখন তারা কাজ থেকে ছুটি নেন। ধার করে নতুন জামাকাপড় কেনে। কার্তিক মাসে কালিপূজার সময় হয় তাদের ‘ভাত বাড়ানাে’ উৎসব। একে অনেক জায়গায় ‘হাঁড়িকাড়া’ উৎসবও বলে থাকেন। পুরাতন হাঁড়িমাটির বাসনপত্র ফেলে নতুন হাঁড়ি কাড়তে হয়। ঘরদোর পরিষ্কার করে স্নান সেরে সাধ্যমত সব থেকে ভালাে খাবার তৈরী করে। মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে নতুন থালায় খাবার নিবেদন করা হয় কাছাকাছি কোনাে পুকুর বা ডােবায়। তারপর গৃহকর্তা খাবার নিয়ে বাড়ী ফিরে আসে। এভাবে উৎসবেরও তখন পরিসমাপ্তি ঘটে। বাউরীদের বিভিন্ন বিভাগ থাকলেও ধর্মের দিক থেকে তারা হিন্দুধর্মের রীতিনীতিগুলােকেই পালন করে থাকে। এই অনার্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সংস্কৃতির মধ্যে বেশ কিছু লােকাচার যেমন আছে তেমনি আদিম ঐতিহ্যও বর্তমান।
উৎসব পার্বণঃ বাউরীদের নিজস্ব কোনাে উৎসব নেই। মনসা পূজা এদের সমাজে প্রায় সর্বত্র প্রচলিত। এদের প্রধান উপাস্য দেবদেবী ভৈরব, কুন্দরা, মনসা প্রভৃতি। তবে এদের মধ্যে মনসাপূজা সবচেয়ে এদের কাছে আকর্ষণীয় এবং আড়ম্বরপূর্ণ। মনসা অনার্য সম্প্রদায়ের দেবী, মর্ত্যভূমিতে পূজা প্রচারের জন্য মনসার নানারকমের ছলনা সে তাে মধ্যযুগের মনসামঙ্গলে কথিত আছে। অনার্য সম্প্রদায়ের অনার্য দেবী মনসা খুব জাগ্রত। শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে এই পূজাকে কেন্দ্র করে বিশাল আয়ােজন করা হয়। মাটির হাতি, ঘােড়া বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসে। পূজার পুরােহিত এদের মধ্যে থেকেই ঠিক করা হয়। গ্রামের মােড়লই সাধারণভাবে মনসামেলায় পূজা করে থাকেন। সারাদিন নির্জলা উপবাস করে সন্ধ্যাবেলায় মাথায় ঘট নিয়ে পুকুর থেকে জল নিয়ে আসে, ভর এলেই ‘ঝুপাল’ হয়। এটি এক ভয়ংকর শারীরিক কষ্ট। প্রায়ই এদের ঝুপাল ভয়ানক রকম উন্মত্ত হয়ে ওঠে। তখন ঝুপাল থেকে নিবৃত্ত করবার উদ্দেশ্যে অপেক্ষাকৃত বলবান লােকদের ছুটে আসতে হয়। K. C. Sashmal তাঁর গ্রন্থে বলেছেন—
“Manasa is a highly respected deity of the Bauris. Almost in every village there is a place for her worship. She is worshipped annually by the villages.”১৭
প্রতিটি বাউরী সম্প্রদায়ের গ্রামে একটি করে মনসামেলা আছে। মনসা তাদের জাগ্রত দেবী। সারা বছরে এই দিনটিকে তারা, যথােচিত মর্যাদা ও আনন্দের সঙ্গে পালন করে ও আনন্দ উপভােগ করে।
‘অম্বুবাচী’ এদের প্রধান উৎসব। এ সময় নানা অভাব অভিযােগের মধ্যেও তিনদিন উৎসবের মধ্যে সম্পূর্ণ নিজেদের ভাসিয়ে দেয়। এছাড়া অন্যান্য হিন্দু জাতির মতাে এরাও শিব, কালী, দুর্গা, বিশ্বকর্মা প্রভৃতি দেবদেবীর পূজা নিজেদের মতাে করে থাকে। তবে কার্তিক মাসে ‘অমাবস্যা’ অর্থাৎ কালীপূজার দিন নতুন হাঁড়িকাড়ার রীতি রয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে আগে আলােচনা করা হয়েছে।
‘ছাতুবাড়ান’– ছাতুবাড়ান এটি এদের সমাজের উৎসব। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে ছাতু, গুড় নতুন পাতায় পুকুরঘাটে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে নিবেদন করা হয়। এ সম্পর্কে তাদের গান আছে। যেমন-
আকাশের জাল
পাতালের নাল
ধান ফুটে গালগাল
মা লক্ষী তুমি স্বাদ দাও।
এদের উৎসব বা পার্বণ সম্পর্কে K. S. Shasmal তার গ্রন্থে যে ছকটি দিয়েছেন তা উল্লেখযোগ্য –
Mainly religion ceremonies – Mainly festivals with less stress on religions aspects – Observance of day a Brata
Mainly religion ceremonies | Mainly festivals with less stress on religions aspects | Observance of day a Brata | |||
Communical | Individual | ||||
1. Sitala | 1. Bhadu | 1. Goparban | 1. Jamai Sasthi | ||
2. Kali | 2. Tusu | 2. Bhut Parban | 2. Bahi Dwitiya | ||
3. Manasa. | 3. Barabhun | 3. Luai | |||
4. Gunrihar | |||||
5. Pous Parban | |||||
6. Chhatu Parab | |||||
7. Sar | |||||
টুসু, ভাদু এগুলাে এদের সমাজে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। আঞ্চলিক দেবী হিসাবে এঁদের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। টুসু-সারা পৌষ মাস একটি মাটির খলায় তুসের উপর গাঁদা ফুল দিয়ে পূজা করে গ্রামের ছােট বড়াে মেয়েরা। তারপর পৌষ সংক্রান্তি বা মকরসংক্রান্তির দিনে এই টুসুকে নদী বা পুকুরের জলে বিসর্জন দেওয়া হয়। এই উপলক্ষে বিরাট মেলাও বসে। এ সম্বন্ধে বাঁকুড়া জেলার খাতড়ার নিকটে পােরকুল গ্রামে বিরটা মেলা হয়। দক্ষিণ বাঁকুড়ার তপশিলী জাতিদের অন্যতম স্মরণীয় মেলা। নতুন ধান তখন তাদের বাড়ীতে, আর্থিক অভাব কিছুটা কমে, চাষীদের মনে খুশীর মেজাজ। তাই এই মেলাকে ঘিরে তাদের সমাজের সংস্কৃতির সম্পূর্ণ রূপটি ফুটে ওঠে। নতুন জামাকাপড় পরে এই উৎসবে আনন্দ উপভােগ করে থাকে।
‘ভাদু’ ও ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিনে এই সমাজের অন্যতম উৎসব। মাটির প্রতিমা করে কোলে বা মাথায় নিয়ে মেয়েরা নাচে, নাচতে নাচতে গানও গায়। মল্লভূমের মল্ল বাউরীগণ বড়াম, কুদ্রাসিনী ইত্যাদি দেবদেবীর স্থানে শূয়াের বলি দিয়ে থাকে। এই রীতি অবশ্য বৌদ্ধ তন্ত্র থেকে আগত। জামাইষষ্ঠী, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। অন্যান্য হিন্দু সমাজের সম্প্রদায়ের মতাে বাউরী সম্প্রদায়ের লােকেরাও পালন করে থাকে।
গোপার্বণ : এটি একটি বাউরীদের অন্যতম উৎসব। কার্তিক মাসে হয়। বেশ কিছু ছেলে ছােকরা মদ্য পান করে ড্রাম বা ধামসা জাতীয় বাদ্য বাজায়। গােরুকে ভগবতী দেবী হিসাবে পূজা করে। সারারাত ধরে গাে-জাগরণ গানও করে থাকে। এ সম্পর্কে K. c. Shasmal তার গ্রন্থে বলেছেন—
“They sing various festival songs and dance with the beating of drums. These songs are known as ‘Jagren’ or ‘awaking’. The singing and dancing go on for the whole night. In this festival, they pay respect to the cattle which are looked upon as the incarnations of the goddess, ‘Bhagabati’, i.e. the goddess of wealth. These songs are mainly confused describing the physical features of the cows and this sort of music continuous till next morning.”১৮
যেমন বাঁকুড়া জেলার বলরামপুর গ্রামের ক্ষেত্রভিত্তিক সমীক্ষা করে ৭৫ বছর বয়সের অহি বাউরী নামক এক ব্যক্তির মুখ থেকে দু-কলির একটি গান সংগ্রহ। করি। সেটি হল এরকম—
‘জাগাে গাে সরস্বতী, জাগাে তাে ভগবতী,
জাগাে তাে অমাবস্যা রাত্রি।”
এই গানে দেবী ভগবতী আরাধনার কথা আছে। এছাড়া আরেকটি গানেও একই ভাববাণী ব্যক্ত হয়েছে।
কালিয়া বলদ বাছা, কালিয়া বলদ রে
তােরে তাে মুঠা ভরা সিংও তাে হাে
ঐ সিংএ বাগাইয় ও লাল রুরা সিদুরে
স্বর্গে, পাতালে ধূলা উড়াই হাে
আজ তাে অমাবস্যা রাতি হাে।১৯
এইভাবে উৎসব পার্বণে এই সংস্কৃতি ও তাদের জাতীয় ঐতিহ্য ফুটে ওঠে যা বাংলার সংস্কৃতির জগতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. H.H. Risley, ‘The Tribes and Castes of Bengal’
- ২. K.C. Shasmal, ‘The Bauris of West Bengal’ – Indian Publication on 1972, p. 205।
- ৩. L.S.S. O’Malley, ‘Bengal Gazetters’, Bankura.
- ৪. মানিকলাল সিংহ, রাঢ়ের জাতি ও কৃষ্টি – ১ম খণ্ড, ১ম সংস্করণ, ১৯৮২, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বিষ্ণুপুর, পৃ. ১৫৪
- ৫. ক্ষেত্রভিত্তিক সমীক্ষা – ‘খাতড়া মহকুমার দাঁড়শােল গ্রাম’, ১৮-২-২০১০
- ৬. ক্ষেত্রভিত্তিক সমীক্ষা – মাকুড়গ্রামের বিরাডি গ্রাম, ৩০-১১-২০০৯।
- ৭. ক্ষেত্রভিত্তিক সমীক্ষা – খাতড়া মহকুমার দাঁড়ােল গ্রাম, সুকদেব বাউড়ী।
- ৮. H.H. Risley, The Tribes and Castes of Bengal’
- ৯. সুনীল দাস, ‘বাউড়ী ল্যান্ড’, পৃ. ১৯
- ১০. তদেব,
- ১১. পশ্চিমবঙ্গ দর্শন ও বাঁকুড়া – তরুণদেব ভট্টাচার্য, ১৯৮২
- ১২. K.C. Shasmal, ‘The Bauris of West Bengal’ – Indian Publication on 1972, p. 205
- ১৩. K.C. Shasmal, ‘The Bauris of West Bengal’ – Indian Publication on 1972, p. 205।
- ১৪. তদেব।
- ১৫. L.S.S. O’malley, ‘Bengal Gazetters’, Bankura. p. 65
- ১৬. H.H. Risley, ‘The Tribes and Castes of Bengal’, p. 72
- ১৭. K. C. Shasmal, ‘The Bauris of West Bengal’ – Indian Publication on 1972, p. 205
- ১৮. K. C. Shasmal, ‘The Bauris of West Bengal’ – Indian Publication on 1972, p. 206
- ১৯. ক্ষেত্রভিত্তিক সমীক্ষা – খাতড়া মহকুমার বলরামপুর গ্রাম, ১৮-২-২০১০