লিখেছেনঃ আশরাফ উল ময়েজ
মুসলিম বিশ্বের বিস্তৃতি ক্রীতদাস প্রথা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার অন্যতম একটি বড় কারণ। মুসলমানরা উত্তর আফ্রিকা বিজয়ের পর মুসলিম রাষ্ট্রগুলাে বৃহদাকারে সাকালিব (Sagaliba) বা ক্রীতদাস আমদানি শুরু করে বিশেষ করে মধ্য ও পূর্ব ইউরােপ থেকে। ইসলামী রীতি অনুযায়ী একজন মুসলমান অপর কোনাে মুসলমানকে ক্রীতদাস বানাতে পারবে না। একই রকমভাবে খ্রিস্টান, ইহুদি ও সাবিয়ানদেরকেও (হজরত ইব্রাহিম আ. এর অনুসারীগণ) ক্রীতদাস বানানাের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে এর ব্যতিক্রম হলাে এই যে, যদি তারা যুদ্ধবন্ধি হন তখন আবার এই নিয়ম প্রযােজ্য নয়। যুদ্ধবন্দিরা যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করত তবে তাদেরকে মুক্ত করে দেওয়া হতাে। আর যদি সে স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করে তবে তাকে উপযুক্ত (ভাল) শিক্ষা দেওয়ারও নির্দেশ রয়েছে।
অটোমানরা ইউরােপের বিভিন্ন অঞ্চল বিজয় করার পর সেখান থেকে প্রচুর সংখ্যায় খ্রিস্টান অধিবাসীকে জোরপূর্ব ধরে নিয়ে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রীতদাস হতে বাধ্য করে। এই ক্ষেত্রে খ্রিস্টান নারীদের ধরে নিয়ে হারেমে রাখা হতাে কিংবা যৌনদাসী হতে বাধ্য করা হতাে কিন্তু ইসলামিক রীতিগুলাে ক্রীতদাসদের বেলায় অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয় নি। ইবেরিয়া পেনিনসুলার (Iberian Peninsula) মুসলিম শক্তিগুলাে ক্রীতদাসের জন্য প্রায়ই অপর কোনাে অমুসলিম রাষ্ট্র আক্রমণ করত। তা ছাড়া এই রাষ্ট্রগুলাে ইউরােপিয়ান ক্রীতদাস ব্যবসায়ী ও ইহুদিদের নিকট হতে ক্রীতদাস প্রথা চালু ছিল অর্থাৎ ক্রীতদাস ক্রয় করত। ইহুদিরা পঞ্চম শতকের দিকে ক্রীতদাস ব্যবসায় মনােনিবেশ করে।
আমেরিকার নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ওলিভিয়া রেমি কনস্টবল (Olivia Remie Constable) উল্লেখ করেন,
“মুসলিম ও ইহুদি ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা পূর্ব ইউরােপ ও খ্রিস্টান অধ্যুসিত স্পেন থেকে ক্রীতদাসদের প্রথমে ইবেরিয়ান পেনিনসুলার মুসলিম স্পেন অধ্যুষিত রাজ্য আনদালুসে (Andalus) নিয়ে আসত এবং তারপর সেখান থেকে পুনরায় তাদেরকে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে পাঠানাে হতাে।”
স্লাভিক দেশগুলাের আদিবাসীরা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হলে ধীরে ধীরে এই বাণিজ্যের অবসান ঘটে। ক্রীতদাসের ইংরেজি শব্দ Slave এসেছে বাইজেন্টাইন গ্রিক শব্দ Sklabos থেকে যার অর্থ slay অর্থাৎ শুভ অঞ্চলের অধিবাসী।
মধ্যযুগের শেষের দিকে আনুমানিক ১১০০-১৫০০ সাল পর্যন্ত ইউরােপিয়ানদের ক্রীতদাস হিসেবে পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মুসলামান রাষ্ট্রগুলাের পাশাপাশি পূর্বদিকে ভেন্সি ও জেনােয়াতেও (Genoa) বিস্তৃতি লাভ করে। ১৩ শতকের দিকে এসে স্লাভিক, বাল্টিক ক্রীতদাসের পাশাপাশি জর্জিয়ান, তুর্কি ও অন্যান্য আদিবাসী জাতিকে ক্রীতদাস হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলােতে বিক্রয় করা হতাে। মধ্যযুগের শেষের দিকে স্নাভ ও বাল্টিক আদিবাসীরা খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করলে ইউরােপিয়ান ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা স্লাভিক ও বাল্টিকদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রয় করা কমিয়ে আনে এবং একপর্যায়ে তা বন্ধ হয়ে যায়।
মুসলমান রাষ্ট্রগুলােতে ইউরােপের ক্রীতদাসরা একটি সময়ে নতুন উপদ্রপ হয়ে দাঁড়ায়, তারা নিজেরাই দস্যুবৃত্তিতে লিপ্ত হয় তারা বিশেষ করে আলজেরিয়ান ক্রীতদাসরা অটোমান সাম্রাজ্যের সহযােগিতায় ইউরােপের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল ও জাহাজগুলােতে আক্রমণ শুরু করে। ১৬ শতক থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত তারা অসংখ্য ইউরােপিয়ান জাহাজ ব্রিস্টল করে লুটে নেয়। ১৭ শতকের দিকে এসে অটোমান নৌশক্তি দুর্বল হয়ে গেলে এবং প্রায় একই সময়ে ইউরােপািনরা উল্টর আফ্রিকা বিজয় করলে আলজেরিয়ান দস্যুদের আক্রমণ বন্ধ হয়।
মঙ্গোলিয়ান পরাশক্তির বিস্তৃতি ও ক্রীতদাস প্রথা
১৩ শতকের দিকে বিভিন্ন রাষ্ট্রে মঙ্গোলিয়ানদের অনুপ্রবেশ ও রাজ্য বিস্তৃতি ক্রীতদাস প্রথা কে আরাে জটিল করে তােলে এবং ক্রীতদাস প্রথা অর্থাৎ ক্রীতদাস ব্যবসায় নতুন শক্তির উদ্ভব হয়। মঙ্গোলরা প্রশিক্ষিত ও সাধারণ নারী, পুরুষ এবং শিশুদেরকে জোরপূর্বক বন্দি করে মঙ্গোল রাজধানী কারাকোরাম (Karakorum)-এর সারাই (Sarai) শহরে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে তাদেরকে ইউরেশিয়াতে বিক্রয় করা হতাে। অনেক ক্রীতদাসকে জাহাজে করে রাশিয়ার বাল্টিক সমুদ্র হতে ওরাল পবর্তমালা পর্যন্ত বিস্তৃত নভােগােরদ (Novgorod) স্টেটসের ক্রীতদাস বাজারেও প্রেরণ করা হতাে।
মধ্যযুগের শেষের দিকে ক্রীতদাস ব্যবসা মূলত ভেনিস ও জেনােয়ার ক্রীতদাস ব্যবসায়ী ও তাদের অ্যালায়েন্সের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই অ্যালায়েন্স মঙ্গোলিয়ার উত্তর-পশ্চিমে রাশিয়ার বর্ডারসংলগ্ন গােল্ডেন হর্দ (Golden Horde) খাননেতে (Khamate: ছােট রাজ্য) ক্রীতদাস ব্যবসায় জড়িত ছিল। ১৩৮২ সালে গােল্ডেন হর্দ খননেত-এর শাসক খান তখতামিশ (Kham Tokhtamysh) মস্কো অবরােধ করেন এবং শহরে আগুন ধরিয়ে দিলে সেখানকার অধিবাসীরা প্রাণ বাঁচানাের জন্য দিকগ্বিদিক ছুটতে থাকে। তখতামিশের সেনাবাহিনী এই পলায়নপর হাজার হাজার মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস বানায়।
১৪১৪-১৪২৩ সাল পর্যন্ত পূর্ব ইউরােপ হতে অন্তত ১০,০০০ জনকে ভেনিসে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রয় করা হয়। জেনােয়ার ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা ক্রিমিয়া থেকে মামুলুক মিসর পর্যন্ত ক্রীতদাস ব্যবসার সমন্বয় করতেন। বৎসরের পর বৎসর ধরে কাজান (Kazam Khanates) ও আসাখান খানেত (Astrakham Khamate) নিয়মিতভাবে রাশিয়ার বড় বড় শহরগুলাে আক্রমণ করত এবং লুটতরাজ শেষে সেখানকার অধিবাসীদের ধরে নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রয় করে দিত।
রাশিয়ার ইতিহাসে নথিবদ্ধ আছে যে, ১৬ শতকের প্রথমভাগে কাজান দস্যুরা রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলােতে অন্তত ৪০ বার আক্রমণ করেছিল। ১৫২১ সালে ক্রিমিয়ার খান মেহমেদ জিয়ারি (Khan Mehmed Giray) ও কাজান খানেত যৌথভাবে মস্কো আক্রমণ করেছিল এবং তারা লুটতরাজ শেষে হাজার হাজার মস্কোর অধিবাসীকে ধরে নিয়ে যায়।
১৪২১ সালে হাসি গিরে প্রথম (Haci I Giray) গােন্ডেন হর্দের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্রিমিয়াকে স্বাধীন ঘােষণা দিয়ে স্বতন্ত্র ক্রিমিয়ান খাননেত প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী একটি বড় সময় ১৮ শতক পর্যন্ত ক্রিমিয়ান খাননেত অটোমান সাম্রাজ্যে ও মধ্যপ্রাচ্যের অপরাপর মুসলিম রাজ্যগুলাের সাথে ক্রীতদাস ব্যবসায় লিপ্ত ছিল। ক্রিমিয়ান খাননেত হাজার হাজার স্লাভ কৃষককে ক্রীতদাস হিসেবে সেখানকার তৃণভূমিতে চাষাবাদের কাজে নিয়ােগ করে। ১৫৫৮ থেকে ১৫৯৬ সালে তাতার দস্যুরা মস্কোর প্রান্তীয় অঞ্চলে অন্তত ৩০ বার আক্রমণ করে। ১৫৭১ সালে ক্রিমিয়ার তাতার দস্যুরা মস্কো আক্রমণ করে লুটতরাজ শেষে শহরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ অগ্নিকাণ্ডে প্রায় পুরাে মস্কো শহরই পুড়ে ছাড়খার হয়ে যায় যদিও ক্রেমলিন রক্ষা পায় এবং যাবার সময় হাজার হাজার মস্কোর বাসিন্দাকে ক্রীতদাস হিসেবে বন্দি করে নিয়ে যায়। সে সময় ক্রিমিয়ার প্রায় ৭৫% অদিবাসীই ছিল ক্রীতদাস।
রাশিয়ার বিশাল তৃণভূমির অপর পার্শ্বে ছিল শক্তিশালী অটোমান সাম্রাজ্য আর দক্ষিণাঞ্চলে ছিল আরাে ভয়ঙ্কর মঙ্গল উত্তরসূরি ক্রিমিয়ান খানেত। ক্রিমিয়া খানেতের অর্থনীতিই টিকে ছিল রাশিয়ান ও ভদের অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে অটোমান সাম্রাজ্যে বিক্রয় করার অর্থের ওপর। অটোমান সাম্রাজ্যের পাশাপাশি তারা ইরান ও অপরাপর আন্তর্জাতিক ক্রীতদাস ব্যবসায়ীদের নিকটও ক্রীতদাস বিক্রয় করত। অটোমান সাম্রাজ্যে হাজার হাজার লাভ ক্রীতদাস থাকার ফলেই ১৬ শতকে ইস্তাম্বুল ইউরােপের সবচেয়ে বড় শহরে পরিণত হয়েছিল।
যেহেতু রাশিয়ার এই বিস্তীর্ণ তৃণভূমি ও ক্রিমিয়া খানেতের মাঝখানে কোনাে প্রতিবন্ধকতাই ছিল না তাই অত্যন্ত প্রশিক্ষিত এই ক্রিমিয়ান দস্যরা প্রতি গ্রীষ্মকালেই কৃষকরা যখন মাঠে কাজ করত তখন অতর্কিত আক্রমণ করে শত শত কৃষককে ধরে নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রয় করে দিত। আর যারা উচ্চবিত্ত ছিল তাদেরকে মুক্তিপণের বিনিময়ে ফিরিয়ে দেওয়া হতাে। যদি রাশিয়া ও ক্রিমিয়ার মাঝখানে পর্বতের ন্যায় কোনাে প্রতিবন্ধকতা থাকত তবে হয়তাে বা হাজার হাজার রাশিয়ান ক্রীতদাস হওয়া থেকে বেঁচে যেত।
রাশিয়াতে ক্রিমিয়ানদের এই আক্রমণ পাঁচ-দশ বৎসর পরপর যে হতাে তা নয় এটি প্রতি বৎসরই হতাে। রাশিয়ান সমাজের প্রতিটি সদস্যই গ্রীষ্মকালে সেনাবাহিনীর ন্যায় তৃণভূমি পাহারা দিত যাতে করে ক্রিমিয়ানদের আক্রমণ প্রতিহত করা যায়। মাইকেল খােদারকোভােস্কি (Michael Khodarkovsky) তার Russia’s Steppe Frontie গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, ১৭ শতকের প্রথম দিকে রাশিয়ান সমাজের উচ্চবিত্ত যাদেরকে অপহরণ করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাদেরকে মুক্ত করতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল সে পরিমাণ অর্থ দিয়ে প্রতি বৎসর ৪টি হােট শহর তৈরি করা যেত। ১৭৮৩ সালে ক্রিমিয়া রাশিয় অন্তর্ভুক্ত হলে ক্রিমিয়ানদের এই আক্রমণ বন্ধ হয়।
আরব ও সােমালিয়ার ক্রীতদাস বাণিজ্য
ইসলামিক শাসনামলের প্রথম দিকে পশ্চিম সুদান অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলাে যেমন ঘানা (৭৫০-১০৭৬ সাল), মালি (১২৫-১৬৪৫ সাল), সেগু (১৭১২-১৮৬১ সাল) এবং সনঘাই (১২৭৫-১৫৯১) এর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনগণই ছিল ক্রীতদাস। বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা (Ibn Battuta) তার ভ্রমণ কাহিনীতে অনেকবারই বর্ণনা করেছেন তাকে ক্রিতদাস উপহার দেওয়া হয়েছিল কিংবা তিনি নিজেই ক্রীতদাস ক্রয় করেছিলেন। ১৪ শতকের বিখ্যাত পণ্ডিত ইবনে খালদুন (Ibn Khaldum) বর্ণনা করেছেন যে কালাে চামড়ার মানুষরা অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই ক্রীতদাস হয়ে যেত, কারণ মানুষ হিসেবে একজনের ন্যূনতম যতটুকু বুদ্ধি থাকা দরকার তাদের তাও ছিল না, তারা ছিল অনেকটা বুদ্ধিহীন জন্তুর মতাে। ইসলামিক যুগে সাধারণত যুদ্ধবন্ধিদের এবং যুদ্ধ বিজয়ের পর সেখান হতে ক্রীতদাস ক্রয় করে অথবা জোরপূর্বক নারী-পুরুষ ধরে নিয়ে যাওয়া হতাে ক্রীতদাস বানানাের জন্য। তারপর তাদেরকে কোনাে ক্রীতদাস বাজারে বিক্রয় করে দেওয়া হতাে কিংবা উপহার হিসাবে অন্যদেরকে প্রেরণ করা হতাে। ৯ ও ১০ শতকে ইরাকের নিমাঞ্চলের মােট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি ছিল এই কালাে জাঞ্জ (Zanj) ক্রীতদাসরা। একই সময়ে সেন্ট্রাল এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চল হতে লক্ষাধিক ক্রীতদাস আনা হয়েছিল। মধ্যযুগের ইউরােপ হতেও তখন হাজার হাজার খ্রিস্টানকে ক্রীতদাস হিসেবে আরব দেশগুলােতে আনা হয়েছিল। সহস্র এক আরব্য রজনীর (Thousand and One Nights) গল্পে সাদা চামড়ার ক্রীতদাসের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
বারবারি সমুদ্রতীরে ক্রীতদাস ব্যবসা
১৬ শতক থেকে ১৮ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বারবারি সমুদ্রতীরে ক্রীতদাস ব্যবসা ছিল মূলত বাধ্যতামূলক শ্রম দেওয়ার ক্রীতদাস বেচাকেনার সবচেয়ে বড় মার্কেট। আমেরিকান ঐতিহাসিক রবার্ট ডেভিসের মতে, ১ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত অন্তত ১ থেকে ১.২৫ মিলিয়ন ইউরােপিয়ানকে বারবারি দস্যুরা ক্রীতদাস হিসেবে উত্তর আফ্রিকা ও অটোমান সাম্রাজ্যে বিক্রয় করেছে।
১৯ শতকে এসেও বারবারি দস্যুরা তাদের লুটতরাজ বন্ধ করেনি তারা তখন সমুদ্রপথের জাহাজ আক্রমণ করত এবং লুটতরাজ শেষে জাহাজের ক্রুদের বন্দি করে নিয়ে যেত। যারা মুক্তিপণ দিতে পারত তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হতাে এবং অবশিষ্টদেরকে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রয় করে দেওয়া হতাে। ১৬০৯ থেকে ১৬১৬ পর্যন্ত ৮ বৎসরের মধ্যে কেবলমাত্র ইংল্যান্ডেরই ৪৬৬টি জাহাজ বারবারি দস্যু দ্বারা আক্রান্ত হয়।
সমুদ্রপথে পণ্যবাহী আমেরিকান জাহাজও বারবারি দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। ১৭৮৪ সালে আমেরিকার পণ্যবাহী জাহাজ মরক্কো প্রণালী থেকে বারবারি জলদস্যুরা হাইজ্যাক করে। পরবর্তী এক দশকে অন্তত ১২টি আমেরিকান পণ্যবাহী জাহাজ তাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ রকম এক পরিস্থিতিতে ১৭৯৪ সালে আমেরিকা অনেক বিতর্কের মধ্যেই আমেরিকান নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠা করে। আমেরিকার সেনাবাহিনী এই অঞ্চলে তাদের জাহাজের নিরাপত্তার জন্য নৌ-টহল চালু করে। ১৮০১ ও ১৮০৫ সালে দুইবার আমেরিকা বারবারি রাজ্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যে সকল নাবিকদেরকে বারবারি দস্যুরা অপহরণ করে জিম্মি করেছিল তাদের মুক্ত করতে আমেরিকার যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তা ছিল ১৮০০ সালের আমেরিকার মােট সরকারি আয়ের ২০% । ১৮১৫ সালে আমেরিকা বারবারি রাজ্যের সাথে যুদ্ধে বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত জাহাজ চলাচলের মাসুল দিতে হয়েছিল। পরবর্তীতে আমেরিকান জাহাজ আক্রান্ত না হলেও ১৮৩০ সাল পর্যন্ত অনেক ইউরােপিয়ান জাহাজ বারবারি দস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছিল।
পর্তুগিজ ক্রীতদাস ব্যবসা : ১৫-১৭ শতক
১৫ শতকে পর্তুগিজ অভিযানের কারণেই প্রথম কোনাে ইউরােপিয়ান জাহাজ সরাসরি সাব-সাহারান আফ্রিকাতে আসে। এই অঞ্চলটি পূর্ব থেকেই ছিল একটি ক্রীতদাস উর্বর স্থান। তখন এই সাহারা অঞ্চল থেকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে নৌপথে ক্রীতদাস নিয়ে যাওয়া হতাে। আর পর্তুগিজদের আগমনের ফলে আরেকটি নতুন নৌপথ আবিস্কৃত হয়।
এখানকার প্রকৃতিই যেন পর্তুগিজদের ক্রীতদাস সংগ্রহ ও ব্যবসা করার জন্য একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করে দেয়। আগ্নেগিরি অগ্নৎপাতের কারণে সৃষ্ট পাথরে পুর কেপ ভার্ডি দ্বীপপুঞ্জ (Cape Verde Islands) মনুষ্যবিহীন হলেও ছিল উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের গাছ ও ঝােপঝাড়ে ভরপুর। এই দ্বীপটি এমনি এক অবস্থানে ছিল যেখান থেকে পশ্চিম আফ্রিকা, ইউরােপ ও। আমেরিকায় যাওয়ার মূল নৌপথ খুব সহজেই ধরা যেত। ১৯৬০ সালে পর্তুগিজরা কেপ ভার্ডি দ্বীপপুঞ্জ বসতি স্থাপন করলে তারা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার একটি নিশ্চয়তা লাভ করে। এই অঞ্চলে ক্রীতদাস ব্যবসার একচ্ছত্র অধিকার তারা লাভ করে। গিনিয়ার (Guinea) সমুদ্রতীরে তারা জোর করে ধরে আনা আফ্রিকানদের ক্রয় করে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রয় করার জন্য। বাণিজ্যকেন্দ্র খুলে বসে।
এই ক্রীতদাসদের কেউ কেউ এই কেপ ভার্ডিতে বসতি স্থাপনকারী পর্তুগিজদের এস্টেটে কাজ করত এবং অবশিষ্টদেরকে এখান থেকে উত্তরে মাদেরিয়া, পর্তুগাল ও স্পেনে পাঠিয়ে দেওয়া হতাে বিয়ের জন্য। এ কারণেই স্পেনের আন্দালুসিয়া প্রদেশের রাজধানী সেভিলে একটি বিশাল ক্রীতদাস বাজার গড়ে ওঠে। ১৪৪৪ সাল থেকেই এই সমুদ্রপথে আফ্রিকান ক্রীতদাস আনা হতাে।
১৪৪৪ সালে হেনরি দা নেভিগেটর তার সমুদ্রযাত্রায় সর্বপ্রথম এই পথে দ্বীপান্তর শাস্তিপ্রাপ্ত মরিসদের (Moorish) এখানে নামিয়ে যাবার সময় জাহাজ বােঝাই করে ক্রীতদাস নিয়ে যায়। কেপ ভার্ডিতে ক্রীতদাসদের চাষাবাদে শ্রম দিতে হতাে এবং এখান জমি খুব উর্বর ছিল বিধায় উন্নতমানের তুলা ও নীল চাষ করা হতাে। এখানকার ক্রীতদাসদের কাপড় ও রং তৈরির কারখানায় কাজ করতে হতাে।
এখানে তৈরি কাপড়ের বিনিময়ে গিনিয়া থেকে ক্রীতদাস সংগ্রহ করে পর্তুগিজরা তাদেরকে নগদ অর্থের বিনিময়ে অপেক্ষমান ক্রীতদাস ব্যবসায়ীদের জাহাজে তুলে দিত। ক্রীতদাস ব্যবসায়ীদের এই জাহাজগুলাে এখানে প্রায় নিয়মিতভাবেই আসত ক্রীতদাস সংগ্রহের জন্য। কেপ ভার্ডির পর্তুগিজদের সাথে আফ্রিকান ক্রীতদাস ব্যবসায়ীদের সখ্যতার কারণে এই ব্যবসা সুদূর ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, যেখানে আখ ও তুলা ও তামাক চাষের জন্য প্রচুর ক্রীতদাসের প্রয়ােজন ছিল।
পর্তুগিজরা তাদের কলােনী ব্রাজিলে, একচেটিয়াভাবে আফ্রিকান ক্রীতদাস সরবরাহ করত। ১৫ শতকের পর্তুগিজরা, পশ্চিম আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রেরণ করত। আটলান্টিক মহাসাগর দিয়ে যত আফ্রিকান ক্রীতদাস দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলে প্রেরণ করা হয় তার প্রায় ৪২%ই পাঠানাে হয়েছিল ব্রাজিলে। ১৮ শতকে এসে এই ক্রীতদাস পরিবহনের এই বাণিজ্য চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। বেনিয়া ব্রিটিশরা যাওয়া আসা উভয় পথেই বাণিজ্য করত, যা ট্রায়াঙ্গুলার ট্রেড (Triangular Trade) বা ত্রিভুজ বাণিজ্য নামে পরিচিত।
১৮ শতকের ত্রিভুজ বাণিজ্য
পণ্যবাহী জাহাজ ব্যবসায়ীদের জন্য এই ত্রিভুজ বাণিজ্য ছিল খুবই লাভবান ব্যবসা। এই দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা তিনটি ধাপে সম্পন্ন হতাে। প্রথম ও শেষ ধাপে পণ্য পরিবহন করা হতাে এবং মধ্যবর্তী যাত্রায় পরিবহন করা হতাে ক্রীতদাস। ব্রিটিশরা জাহাজগুলাে তিন ধাপে তাদের এই সমুদ্রযাত্রা সম্পন্ন করত বিধায় তা ত্রিভুজ ব্যবসা নামে পরিচিত।
- প্রথম ধাপে তারা লিভারপুল থেকে বিক্রয়যােগ্য জিনিসপত্র যেমনবন্দুক, মদ বিশেষ করে ব্রান্ডি, রান্না করার তৈজসপত্র, ঘােড়া ইত্যাদি নিয়ে আফ্রিকা যেত। লিভারপুলের ন্যায় ব্রিস্টল থেকেও এই সকল জাহাজ আফ্রিকার উদ্দেশে যাত্রা করত। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় যে ১৬৯৮-১৮০৭ সাল পর্যন্ত কেবল ব্রিস্টল থেকে ২,১০০ জাহাজ ক্রীতদাস সংগ্রহের জন্য আফ্রিকা যাত্রা করে। ব্রিটেন থেকে আফ্রিকা পৌছতে জাহাজগুলাের সময় লাগত ৪ সপ্তাহ থেকে ৮ সপ্তাহ, যা জাহাজের আকার ও আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করত।
- দ্বিতীয় ধাপে এই সকল মালামাল আফ্রিকাতে বিক্রয় করে সেখান থেকে জাহজা ভর্তি করে ক্রীতদাস নিয়ে আটলান্টিক মহাদেশ পাড়ি দিয়ে ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও উত্তর আমেরিকায় নামিয়ে দিত।
- তৃতীয় ধাপে সেখান থেকে জাহাজ ভর্তি করে যেমন মদ, বিশেষ করে রাম ও চিনি, তামাক, কফি ইত্যাদি নিয়ে পুনরায় ইংল্যান্ডে ফিরে আসত।
১৫ শতকের পর্তুগিজ ও স্পেনিশনি ব্যবসায়ীরা সমুদ্রপথে আফ্রিকান ক্রীতদাসদের আমেরিকান কলােনি প্রধানত ব্রাজিলে ক্রীতদাস সরবরাহ কত যা তারা ১৫ শতকে বিজয় করে। ১৬ শতকের এসে ব্রিটিশরা এই ব্যবসায় জড়ায় এবং ১৭১৩ সালে Treaty of Urecht চুক্তির মাধ্যমে তারা তৎকালীন স্পেন সাম্রাজ্যে ক্রীতদাস প্রথা অর্থাৎ ক্রীতদাস বিক্রয়ের অনুমতি পায়। আফ্রিকা থেকে অন্তত ১২ মিলিয়ন ক্রীতদাসকে এই সমুদ্রপথে ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে আনা হয়। দীর্ঘ এই। সমুদ্রযাত্রায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে মারা যেত। এই সমুদ্রযাত্রায় প্রতি ৬ জন ক্রীতদাসের মধ্যে ১ জন সমুদ্রযাত্রার ধকল, অসুখ ও খাবারের অভাবে মারা যেত। ১৮ শতকে অন্তত ৬ মিলিয়ন আফ্রিকানকে ক্রীতদাস হিসাবে আমেরিকার কলােনীগুলােতে কৃষিকাজ করার জন্য নেওয়া হয় আর এদের এক তৃতীয়াংশকেই বহন করত ব্রিটিশ জাহাজগুলাে। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল মাঝখানের অংশটুকু, যেখানে অনেক স্ক্রীতদাসই অসুস্থ হয়ে যেত কিংবা মারা যেত। যে সকল ক্রীতদাস মারা যেত কিংবা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ত বিশেষ করে ছোঁয়াচে রােগ হলে সে সকল ক্রীতদাসকে হাত-পা বেঁধে জাহাজ থেকে সমুদ্রে ফেলা দেওয়া হতাে।
দিনে দিনে ক্রীতদাস বাণিজ্যের বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হতে থাকে। অনেক সময় ক্রীতদাসরা জাহাজেই বিদ্রোহ করত ফলে জাহাজ ডুবে যাওয়ার আশংকা থাকত। জ্যামাইকাতে পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসরা নিজস্ব কমিউনিটি গড়ে তােলে। ব্রিটিশ কৃষ্ণাঙ্গরা নিজদেরকে আফ্রিকার সন্তান বলে বিভিন্ন জায়গায় ক্রীতদাস বাণিজ্যের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করতে থাকে। ১৭৮৭ সালে ব্রিটেনে ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ করার কমিটি গঠন করা হয়। ১৮০৭ সালে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ, ক্রীতদাস প্রথা বিরােধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ উইলিয়াম উইলবারফোর্স (William Wilbeforce) ক্রীতদাস বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য সংসদে বিল উত্থাপন করেন। অনেক বিতর্ক ও ক্রীতদাস মালিকদের প্রবল প্রতিরােধের মুখে সংসদে ক্রীতদাস বাণিজ্য নিষিদ্ধ হয়।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।