শিলালেখ পাঠ
সারি ১. قال الله تعالى كل نفس ذائقة الموت و قال الله تعالى [فـ] ـإذا جا[ء] أجلهم لا يستأخرون ساعة ولا يستقدمون قال الله تعالى كل من عليها فان ويبقى وجه ربك ذو الجلال والإكر ا م وانتقل
সারি ২. مخدو منا العلامة استاد<أستاذ>الأيمة برهان الأمة شمس الملة حجة الإسلام و المسلمين نافع الفقراء والمساكين مرشد الو ا صلين والمستر شدين من دار الفناء إلى دار البقاء الثامن والعشر ين من ذي الحجة في يو م الإثنين
সারি ৩. و كان ذلك من السنة الثالث<<الثالثة> والستين وثمانماية في عهد {الـ} سلطان السلاطين حامي بلاد أهل الإسلام و المسلمين ناصر الدنيا والدين أبو <أبي> المظفر محمود شاه سلطان صانه الله بالأمن والأمان وبنى هذا <هذه> الر و ضة خانا لاعظم لطيفخان سلمه من البليات والآفات
অনুবাদ
সারি ১. সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বলেন ‘প্রত্যেক আত্মা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। মহান সৃষ্টিকর্তা আরও বলেন, ‘যখন তাদের সময় ঘনিয়ে আসবে, তখন না তারা এক ঘণ্টা এগিয়ে নিতে পারবে না, না পারবে এক ঘণ্টা পিছিয়ে নিতে ।’ মহাপরাক্রমশালী ঈশ্বর বলেন, ‘পৃথিবীর সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে কেবল তোমার পরাক্রান্ত ও মহানুভব প্রতিপালকের অস্তিত্ব অবশিষ্ট থাকবে (আল-কুর’আন ৫৫:২৬–২৭)।
সারি ২. আমাদের প্রভু – মহান পণ্ডিত, ইমামদের শিক্ষক, উম্মতের প্রর্দশক, জাতির র্সূয, ইসলাম ও মুসলমানদের সাক্ষ্য, ফকির ও নিঃস্বদের সাহায্যকারী, আধ্যাত্নিক যোগাযোগ রক্ষাকারী ও সঠিক পথের অন্বেষণকারীদের পথপ্রর্দশক, যুলহাজ্জ্ব মাসের আটাশ তারিখ সোমবার বিসর্জনের গৃহ ছেড়ে স্থায়ী গৃহের পানে যাত্রা করেন।
সারি ৩. ঘটনাটি ঘটে আট শত তেষট্টি হিজরী সনে (১৪৫৯ সালের ২৫ অক্টোবর) সুলতানদের সুলতান, হামী বিলাদ আহল আল-ইসলাম ওয়া ’ল-মুসলিমীন (ইসলাম ও মুসলিম ভূমিসমূহের রক্ষাকর্তা), নাস্বির আল-দুনিয়া ওয়া ’ল-দীন আবূ ’ল-মুযাফ্ফার মাহমূদ শাহ সুলতানরে রাজত্বকালে ঈশ্বর তাঁকে শান্তি ও নিরাপত্তা দান করুন। এই সমাধিটি মহান খান লতিফ খান নির্মাণ করেন; সৃষ্টিকর্তা তাঁকে সকল প্রকার দুর্যোগ ও দুর্দৈব থেকে রক্ষা করুন।
এই শিলালিপিতে উল্লিখিত অনন্য উপাধিগুলোতে গভীর আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা নিহিত রয়েছে। গ্রামবাংলার সর্বসাধারণ সে যুগের অন্যতম মর্যাদাবান সূফী শায়খ নূর কুতব আল-আলমের প্রতি চিরদিন যে গভীর আনুগত্য ও সম্মান প্রদর্শন করতেন, তা এসব উপাধিতে স্পষ্ট। শিলালিপিটি সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত হলেও এর ছন্দময় শৈল্পিক প্রকাশভঙ্গি সত্যিই মোহনীয়। অলংকরণের বাড়াবাড়ি নেই, বাহ্য জাঁকজমকের বাহুল্য নেই। বক্তব্যের সরল সৌন্দর্যের সঙ্গে মানানসই এর প্রতীকী তাৎপর্যপূর্ণ আঙ্গিক সজ্জা। শিলালিপিটি সাদামাটা পটভূমির উপর বাহার রীতিতে উৎকীর্ণ। প্রলম্বিত উল্লম্ব দণ্ডগুলো নিচ থেকে সরু রেখার মাধ্যমে শুরু হয়ে উপরের দিকে ক্রমান্বয়ে পুরু হয়ে সুষম, সারিবদ্ধভাবে সজ্জিত উল্লম্ব রেখাগুলোর উপরের দিকে ক্রমাগত উত্থান ও তাদের সারিবদ্ধ বিন্যাস দেখে মনে হয় যেন তারা বিদেহী আত্মাদের ঊর্ধ্বযাত্রার প্রতীক, কিংবা মৃত শায়খের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের মঙ্গল কামনার জন্য নেমে আসা ফেরেশতাদের প্রতীক। নিচে উৎকীর্ণ পূঞ্জীভূত বর্ণগুচ্ছকে শোকসভায় উপস্থিত সারবাঁধা জমায়েত বা সমাবেশের প্রতীক হিসাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আবার প্রথম সারির উপরের অংশের মাঝখানে একটি আট পাপড়িওয়ালা ফুল উৎকীর্ণ রয়েছে, যা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় আটটি বেহেশ্তের কথা। পুরো উপস্থাপনাটি শোকসভার বিষয়ের সঙ্গে খুবই মানানসই একটি রচনা। মৃতের জানাজায় লাশ যেভাবে উপস্থিত সমাবেশের সামনে রাখা হয় সেই অবস্থানের সাথে এই পুরো বিন্যাসটি মিলে যায়। ইসলামী সংস্কৃতিতে আধ্যাত্মিক ও মরমি বার্তাগুলোর রূপ, রস ও স্বাদ জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে জায়গা করে নেয়। ফলে বাংলায় প্রাপ্ত স্থাপত্যিক চারুলিপির শৈল্পিক অভিব্যক্তিতে প্রকৃতি ও মরমিবাদের প্রকাশ মোটেই আশ্চর্যের বিষয় নয়।
সূফীবাদে সাদামাটা জীবনযাপন, প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক এবং মানবমুক্তির জন্য গভীর আত্মিক অনুসন্ধানের যে বার্তা রয়েছে, তা বাংলার বিস্তীর্ণ পল্লী অঞ্চলের কৃষিজীবী জীবনধারার সাথে মিলে মিশে গিয়েছিল।নবী মুহম্মদ (স:) যাকে দীন আলফিতরা (প্রকৃতির ধর্ম) বলে অভিহিত করেছেন, সেই ইসলাম ধর্ম এই অঞ্চলের মানুষের আধ্যাত্মিক জগৎ ওপ্রকৃতির মাঝে কটি গভীর সম্পর্ক তৈরির মধ্য দিয়েই এখানে বিস্তার লাভ করে। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের সমগ্র পরিবেশ তথা মহাবিশ্ব যেন তার নিজস্ব ধরনে এক স্বপ্রাণ সত্তা, যার প্রতিটি অংশ স্রষ্টার উপাসনায় নিমগ্ন। সৃষ্টি ও স্রষ্টার মাঝে এক শক্তিশালী সম্পর্ক বিদ্যমান, যে সম্পর্ক উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে হয়ে উঠতে পারে সর্বাঙ্গসুন্দর। সূফীদের একটি মতবাদ হল: স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সদাসর্বত্র প্রকাশিত, যা ইসলামী আধ্যাত্মিক সাহিত্যে ওয়াহ্দাত আল–শুহুদ (প্রত্যক্ষ একতা) নামে পরিচিত এই সৃষ্টির সুচনা বা শুরু হয় একটি প্রথম মুহুর্ত (singularity/ সিংগুলারিটি) দিয়ে, যে মুহুর্তের আগে ছিল না কোন স্থান (no space), না ছিল কাল (no time)। আবার সেটি একেবারে পরম শূন্যও (absolute zero) ছিল না, কারণ রহস্যাবৃত সেই ‘প্রথম মুহুর্ত’ এর মধ্যেই নিহীত ছিল অসীম শক্তিপ্রদাতা সৃষ্টিকর্ত্তার সৃজনী ইচ্ছা ও পরিকল্পনা। এই অদ্বৈতবিন্দুতে (সিংগুলার পয়েন্টে) পুঞ্জীভূত অসীম শক্তি স্রষ্টার প্রথম মুহুর্তের একটি শব্দ: ‘কুন’ (كن অর্থাৎ ‘সৃষ্ট হও’) এর ইঙ্গিতে রূপ নিল নিখিল বিশ্বলোক যাকে মহাকাল ও বলা চলে। জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার (Astrophysics) পরিভাষায় যাকে মহাবিস্ফোরন (Big Bang/ বিগ ব্যাং) বলে, তার সঙ্গে ‘কুন’ শব্দে জগৎসৃষ্টির ধর্মীয় ধারণার এক ধরনের সাযুজ্যের অনুসন্ধান করা হয়তো বা খুব একটা অযৌক্তিক হবে না।
তার সঙ্গে কুন শব্দসৃষ্টির ধর্মীয় ধারণার এক ধরণের সাযুয্যের অনুসন্ধান করলে হয়তো বা করাও যেতে পারে, যদিও বা ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিজ্ঞান একে অপরের সম্পুরক না।
এই বিশ্বলোক ও মহাকালের ও আবার শেষ আছে যখন সূর্য, পৃথিবী, দূর আকাশের ঝিকিমিকি তারা – সবকিছুই নিস্তব্ধ, নিঝুম হয়ে যাবে। প্রত্যেকটা জিনিস ধ্বংস হয়ে যাবে, সব অস্তিত্ত্ব বিলীন হয়ে যাবে, কোন প্রাণের স্পন্দনই তখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু সেই মহাপ্রলয়েই যে লীলাখেলা সব শেষ হয়ে গেল, তা কিন্তু না। অস্তিত্বের সেই অসীম শুন্যতা থেকে সঙ্গে সঙ্গেই আবার নতুন করে সব কিছুর সৃষ্টি, যার নাম ক্বিয়ামা (কেয়ামত) বা Resurrection, আর নতুন কালটির নাম হল আল–আখিরা (আখেরাত) বা পরকাল এই বিচিত্র লীলাখেলায় ‘সময়’ বলতে যা আমরা কল্পনা করি, তা কুহেলিকা বৈ কিছুই না একদিক দিয়ে বলতে গেলে সময় চিরকালই, যার শুরু ও নেই, আবার শেষ ও নেই। সেটা লুকিয়ে আছে ঐশ্বরিক তত্ত্বের মাঝে, সেটিকে যেন সৃষ্টিকর্ত্তা নিজেই ধারণ করে রেখেছেন (হাদীসের ভাষায়: فإن الله هو الدهر আল্লাহ স্বয়ং নিজেই সময়)। আর স্থান (space), সেটাও গভীর অর্থে অস্তিত্বহীন এমন কি আমাদের অস্তিত্বও এক অর্থে মনের কল্পনা বৈ কিছুই না (الوجود الوهمي An imaginary existence)| কিংবা বড়জোর ছায়ার অস্তিত্বের মত ক্ষনিকের অনুভুতি (الوجود الظلي \ الخيالي A shadowy existence/অনিত্য)| কতকটা এ ধরনের ইঙ্গিত জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার Conformal cyclic cosmology মতবাদে খুঁজলে হয়তো বা পাওয়া যেতে পারে। তবে বিষয়গুলোর আরও গভীর অনুসন্ধানের পথ হল জ্যোতিপদার্থবিদ্যায়, যেখানে এসব রহস্যগুলো কিছুটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সূফী তত্ত্বের মূলকথা হল একত্ববাদ। সূফী শিক্ষামতে সকলই এক। আল–দীন অর্থাৎ ধর্ম হল সেই অনাদি একের কাছে প্রত্যাবর্তন, যে বার্তাটি নূর কুতব আল-আলমের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শিলালিপিতে (তারিখ ৮৬৩ হিজরী/ ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ) প্রতীকীভাবে প্রকাশ পেয়েছে।গভীর অর্থে আল্লাহই মহাবিশ্বের সারবস্তু ও মূল, এবং প্রকৃত অর্থে তিনিই একমাত্র সত্তা ও অস্তিত তিনি সর্বব্যাপী, কুরআনের ভাষায় আল–মুহীত।তিনি সবকিছু বেষ্টন করে আছেন, তিনি সদাসর্বত্র বিরাজমান। তাঁর সর্বময় উপস্থিতিকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় আল–মাওজুদ, যা আল্লাহর একটি বৈশিষ্ট্য। আল ওয়াজুদই (তার সর্বময় উপস্থিতি) হল অস্তিত্বের সারবস্তু (আল হাক্ব), যা নিহিত আছে তাওহীদে (অর্থাৎ ঈশ্বরের একত্ববাদে)। এই একত্ববাদই ইসলামের মূল বার্তা। সূফীদের ওয়াহদাত আল–ওয়াজূদ (অস্তিত্বের একতা) মতবাদের মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্ত্তার একত্ববাদের বার্তাটি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।সূফী ধারণামতে সবকিছুই (সকল অস্তিত্বই) আদতে এক। আল–দীন অর্থাৎ ধর্ম হল সেই অনাদি ‘এক’ এর কাছে প্রত্যাবর্তন।প্রকৃতির সব কিছুই চলে এক সুক্ষ্ম ও নিগূঢ় নিয়মের (সুন্নাতের سنة الله) মধ্য দিয়ে, যা খুঁজে বের করা ও বুঝার চেষ্টা করার মধ্য দিয়েই একমাত্র মহাসত্যকে উপলব্ধি করা সম্ভব এবং সেটাই হল পরম ধর্ম বা ইসলাম আর সত্যের অনুসন্ধানে একমাত্র বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদেরকে পরম ধর্মের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে, যার অন্য কোন বিকল্প নেই। তাই সূফীবাদের মহাপ্রাপ্তি পর্যায়ে পৌছানোর সর্বশ্রেষ্ঠ তরিক্বা (মাধ্যম) হল জ্ঞানবিজ্ঞানের নীবিড় ও নিরবিচ্ছিন্ন আন্তরিক সাধনা (হাদিসের ভাষায়: طلب العلم فريضة জ্ঞ নবিজ্ঞানের অন্বেষণ ফরজ অর্থাৎ অবশ্যকরণীয়)।
বিশ্বায়নের বর্ত্তমান কালে সকলেই যেন সীমাহীন চাহিদার জাঁতাকলে পিষ্ট, যেখানে নিত্যনতুন ভোগবাদের নানারকম লোভনীয় উপকরণ দিনরাত হাতছা দিয়ে ডাকছে। বস্তুবাদী জগতে একালের পুঁজিবাদী সমাজের আকর্ষণীয় পণ্যসম্ভার ও মানবীয় লোভের তাড়না মানুষের চিত্তকে সবসময় অস্থির-বিক্ষিপ্ত করে রেখেছে। মানুষ এখন নিজের মনগড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমস্যাগুলো নিয়ে অসম্ভবভাবে ব্যস্ত। তার মন স্থির রাখার আর কোনই সুযোগ নেই। তার বিপরীতে সূফীদের মতে বিশ্বলোকের অপূর্ব ছন্দ ও পরিধিহীন সৌন্দর্য, সীমার মাঝে অসীমের মন-ভরানো নৃত্য, বিশ্বজগতের সৃষ্টির আর বিলীনের বিচিত্র লিলাখেলা, কোটি কোটি তারায় ভরা আকাশের ঝিকিমিকি, সেই সুদুরের হাতছানি এবং লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি আলোকবর্ষ দুরে সেই হাতছানির যে মহাবিস্ময়, অসীমের মাঝে সীমা, আবার সীমার মাঝে অসীম, প্রকৃতির অনন্তকালের এসব অদ্ভুত ও বিস্ময়কর বৈচিত্র্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অনাবিল সুখের আস্বাদ নেওয়াই হল মানুষের মৌলিক উদ্দেশ্য। এসবের অনুশীলন ও চর্চা মানবজীবনে অসীম আনন্দ ও প্রশান্তি জাগিয়ে তোলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ও কাব্যেও এই বিষয়গুলো দারুণভাবে অনুরণিত হয়েছে। অনন্ত অখণ্ড স্থানকাল ছাড়িয়ে অদ্বৈতের অনুভব ভাবুকসত্তাকে সৃষ্টিকর্তার মহত্ত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তার প্রাণে গভীর শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও স্ফূর্তির সঞ্চার করে। আধ্যাত্মিক অনুভূতির তুঙ্গে পৌঁছে সে স্রষ্টার সঙ্গে ফানা এর (একাত্মতা/ সমাধি) অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এই পরম অভিজ্ঞতার পর আলোকপ্রাপ্তরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সুবহান আল্লাহ (সত্যিই ঈশ্বর কি মহান!) উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তার পরম বিস্ময় ও আনন্দ প্রকাশ করে। তবে দৃষ্টিলোক ও মহাকালের অভিজ্ঞতার আস্বাদনেই জীবনরসের নিবৃত্তি হয় না এক মহাকাল থেকে আরেক মহাকালে, এক বিশ্বলোক থেকে আরেক বিশ্বলোকে, সৃষ্টি ও বিনাশের এই চিরন্তন খেলার মধ্য দিয়ে রূপ-রস-গন্ধে প্রতিভাত হয় জীবনের রহস্য। তবে মানব জীবন শুধু হাসিখেলা, তা নয়। তার রয়েছে করণ ও জীবনের নানাবিধ দায়িত্ব। এসব দায়িত্ব ও কর্তব্যের সাধন তাকে এনে দেয় ইহ ও পরলোকের শান্তি। সূফীদের গুরুত্বপূর্ণ সাধনাগুলোর একটি হল দাব্ত আল–নফস তথা প্রবৃত্তি ও কামনা বাসনা নিয়ন্ত্রণের সাধনা, যার মাধ্যমে নিজের আমিত্বের বলয়টিকে সম্প্রসারিত করে মানুষ এক সীমাহীন অনন্তকালের যাত্রাপথে পাড়ি দেওয়ার জন্য ইহজীবনে প্রস্তুতি নেয়। এভাবে দৈনন্দিন জীবনের সামান্যতার গন্ডি থেকে বেরিয়ে তারা অসীমের পথে যাত্রার জন্য তৈরী হয়।
প্রাকৃতিক বিষয়াদি কুরআনে বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে, যদিও এ বিষয়টি নিয়ে পণ্ডিতেরা খুব বেশি আলাদাভাবে আলোচনা করেননি। কুর’আনের দৃষ্টিকোণ অনুসারে বিশ্বের প্রতিটি উপাদান প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলে যা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রণীত, কাজেই এই প্রাকৃতিক নিয়মগুলো ইসলামেরই অংশ। কুরআনে আছে: ‘সপ্ত স্বর্গ, মর্ত্য এবং তাতে যা কিছু আছে সবই তাঁর গুণগানে বিভোর।’ (আল-কুর’আন ১৭:৪৪), বাংলার বেশ কিছু শিলালিপিতে প্রকৃতি সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতের উদ্ধৃতি দেখা যায়। ধর্মনিষ্ঠ কর্ম ও উপাসনা বা ইবাদাত মানুষকে প্রকৃতির কাছাকাছি আসতে সাহায্য করে, পরিবেশের সূক্ষ্ম ভারসাম্য বং তার সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বোঝার শিক্ষা দেয়। কাজেই ইসলামী মরমিবাদে পৃথিবীর পবিত্রতা স্বীকৃত মহাসত্য। মহানবী সমগ্র বিশ্বকে একটি মসজিদের মত পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন জায়গা বলে ঘোষণা করেছেন। সুতরাং মর্ত্যের প্রতিটি জায়গা উপাসনার স্থান হিসাবে উপযুক্ত। মুসলমানগণ জঙ্গল, পাহাড়, মরুভূমি অথবা সাগর, যেখানেই থাকুক না কেন, স্বাচ্ছন্দে তাদের ধর্মীয় উপাসনা করতে পারে। দিনে পাঁচবার নামাজ তথা সালাত পালনের মধ্য দিয়ে স্রষ্টাকে স্মরণ করা তাদের ধর্মীয় কর্তব্য। ইসলামী জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মসজিদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও মসজিদ উপাসনা বা নামাজ আদায়ের একমাত্র স্থান নয়, কিংবা ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানের একমাত্র কেন্দ্রও নয়। প্রকৃতপক্ষে, ধর্মীয় অনুশীলনের এই সাদামাটা ব্যবস্থা গ্রামবাংলার কৃষকসমাজের জন্য উপযুক্ত ছিল এতে তাদের জন্য ধর্মচর্চা সহজ ও স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অন্যান্য অঞ্চলের সূফীদের ন্যায় বাংলায়ও তারা মুসলিম সমাজে শরী‘য়াহ তথা শাস্ত্রাচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বারোপ করতেন। তাঁদের মতে ইসলামী শাস্ত্রাচার পৃথিবীতে সুস্থ পরিবেশে ও প্রাকৃতিক পটভূমিতে ব্যক্তি ও সমাজের আনন্দময় জীবন নিশ্চিত করে এবং পরকালের আধ্যাত্মিক পুরস্কারের নিশ্চয়তা দেয়। সে পুরস্কার চিরস্থায়ী পরমানন্দের অনুভূতি, যা প্রতীকী অর্থে ‘জান্নাত’ (যার আক্ষরিক অর্থ হল: ‘বাগান’)। সে স্বর্গীয় উদ্যান জীবন, গাছপালা, ফুল-ফল, নদীজলের সুষম বিন্যাসে পরিপূর্ণ।
ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষায় সৌন্দর্য অন্যতম মহামূল্য গুণ, কারণ সৌন্দর্যের সম্পর্ক আছে সত্যের সাথে।‘সুন্দরই সত্য এবং সত্যই সুন্দর’ – ইসলামের ঐতিহ্যে এই ধারণাটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু দর্শনের ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ (‘सत्यम शिवम् सुंदरम’) ধারণার সাথে এর কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়াটা হয়ত একেবার অস্বাভাবিক নয়। প্রকৃতির শোভা দর্শনের মধ্য দিয়ে স্বর্গীয় সৌন্দর্য উপলব্ধি একজন বিশ্বাসীর অপরিহার্য গুণ নবী মুহাম্মদ (স:) বলেন, ‘আল্লাহ্ নিজেও সুন্দর, পছন্দও করেন সুন্দর।’ নান্দনিক বোধের সাথে ইসলামের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এতে বোঝা যায়। আদতে আল্লাহর অস্তিত্বই হচ্ছে মূলত সকল সৌন্দর্যের সত্যিকার আধার। আল্লাহর সৌন্দর্য এমন এক অদ্বিতীয় মহারূপ, যা কোন মানুষ খালি চোখে সহ্য করতে পারে না। সেই অপার্থিব সৌন্দর্য যখন তাঁর সৃষ্টিতে সরলতর রূপে ব্যক্ত হয়, একমাত্র তখনই তা উপলব্ধি করতে পারেন সেই সজ্জনেরা, যাঁদের গভীর আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি আছে। পৃথিবীতে এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের অনুসন্ধান ধর্মানুরাগের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই অনুসন্ধান ক্রমশই বিশ্বাসীজনকে প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক তৈরির দিকে নিয়ে যায়।
ইসলামের আধ্যাত্মিক বার্তা বাংলার ইসলামী শিল্পকলায় চমৎকারভাবে প্রকাশ পেয়েছে।সেই শিল্পের প্রেরণা যুগিয়েছে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা সৃষ্টির সীমাহীন সৌন্দর্য। এই সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় প্রকৃতির ছন্দময় অথচ বৈপরীত্যসঙ্কুল বিন্যাস এবং মহাজাগতিক ব্যবস্থার বিবিধ উপাদানের অনন্য চরিত্র নিয়ে চিন্তাভাবনা করা বিশ্বাসীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। প্রকৃতির অপরূপ শোভা অনুধাবনের অনাগ্রহকে তুলনা করা হয়েছে মানসিক অন্ধত্বের সাথে। কুর’আনের ভাষায়: ‘চোখ তো তাদের অন্ধ নয়, অন্ধ তাদের বুকে স্থিত হৃদয়।’ (২২:৪৬)। কুর’আন আরও মনে করিয়ে দেয়: “বস্তুত স্বর্গমর্ত্যর সৃষ্টি এবং দিনরাতের আবর্তন আকলমন্দদের জন্য ইশারাস্বরুপÕ (আল-কুর’আন, ৩:১৯০) । ইসলামী সংস্কৃতিতে একজন শিল্পীর চেতনাকে ঐশ্বরিক দান বলে মনে করা হয়। এই চেতনা শিল্পীকে প্রকৃতির বিস্ময়কর লীলাখেলা খুঁটিয়ে দেখার দিব্যদৃষ্টি প্রদান করে এবং এর সৌন্দর্যকে সমগ্ররূপে অবলোকন করার ক্ষমতা দেয়। শিল্পসাধনায় নিয়োজিত থাকার মধ্য দিয়ে সত্য বিষয়ে তার দৃষ্টি ক্রমশ প্রসারিত হয়। এক পর্যায়ে সে আপন কল্পনা ও সৃজনীশক্তির অনিবার্য সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করতে পারে। সে বুঝতে পারে যে প্রতিটি আকার-আঙ্গিক মূলত আল্লাহ্র সৃষ্টির সুবাদেই উদ্ভূত। ‘তিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তাকেই নিখুঁত করে গড়েছেন – – – – – ’ (আল-কুর’আন ৩২:৭)। শিল্পীর বোধশক্তি যত বিকশিত হয়, সে বুঝতে পারে যে প্রতিটি ধরন, গড়ন, আকৃতি, রং, রূপ, আকার, ও নকশার সত্য সারবস্তু একমাত্র সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতেই বিদ্যমান রয়েছে। ফলে, শিল্পীর শিল্পকর্ম যতই নিখুঁত হোক না কেন, সে নতুন কিছু কিংবা আসলেই নিজস্ব কিছু সৃষ্টি করতে অক্ষম। সুতরাং, প্রকৃত শিল্পকর্ম মাত্রই বিশ্বাসীকে মহাজাগতিক সত্যের কাছে নিয়ে যায়। শিল্পী নিজের শিল্পসাধনার পথে আপন স্রষ্টাকে আন্তরিকতার সাথে উপলব্ধি করে।
একজন ধর্মনিষ্ঠ মুসলিম শিল্পী তার সৃজনশীল কাজে যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করলেও তার ইসলামী দৃষ্টিকোণের দরুণ সে সৃষ্টিশীলতায় ইতিবাচক ও হিতকর দিকে লক্ষ্য রাখতে বাধ্য থাকে, কেননা তার শিল্পকর্মকে মানবতার জন্য যে কল্যাণকর হতেই হবে। ইসলামী শিল্পকলা আদর্শগতভাবে সত্য, সুন্দর, মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিক উৎকর্ষসম্পন্ন জীবনের প্রকাশ। এক অর্থে সে ইতিবাচক সৃষ্টিশীলতার পরিপন্থী সবকিছুকে নাকচ করে। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের প্রতি যুগপৎ নিষ্ঠার কারণে ইসলামী জীবনকে ‘পবিত্র’ বনাম ‘লৌকিক’ এই দুই পরিসরে ভাগ করা যায় না। একজন মুসলিম শিল্পী তার শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে একটি মহৎ উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়, ফলে তার শিল্পকর্ম পরিণত হয় উপাসনায়। কুর’আনের ভাষায় তার প্রতিটি কর্ম হয়ে ওঠে ‘ইবাদাত। ইসলামনিষ্ঠ শিল্পী তার শৈল্পিক কর্মকাণ্ডে প্রকৃতির নিয়মের (দীন আল–ফিত্রা) সীমারেখা লঙ্ঘন করে না।প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়োজনাতিরিক্ত বা খেয়ালখুশিমত ব্যবহার কিংবা প্রকৃতির সূক্ষ্ম ভারসাম্যের হানি করার মাধ্যমে প্রকৃতির ঈশ্বরদত্ত বিন্যাসে (অর্থাৎ ‘আল-ফিত্রা’য়) কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা (ফাসাদ) সৃষ্টির অধিকার তার নেই।
এহেন আধ্যাত্মিক বার্তা নিয়ে বাংলার নদীবিধৌত ধানচাষনির্ভর বদ্বীপাঞ্চলে তের শতকের গোড়ার দিকে ইসলাম আবির্ভূত হয়। বাংলায় তখনও জনবসতি ছিল বিরল। এর উর্বর ভূমির বড় একটি অংশ জুড়ে ছিল প্রাকৃতিক বনজঙ্গল ও বিস্তীর্ণ অনাবাদী জমি।বাংলার মাটিতে বৈদিক সংস্কৃতি ও আর্য জাতির অনুপ্রবেশ মূলত প্রায় ১,৫০০ বছর আগে থেকে শুরু হলেও এ অঞ্চলের স্থানীয় জনসাধারণের অধিকাংশই তখনও অনার্যই থেকে গিয়েছিল, যাদের ম্লেচ্ছ তথা অপবিত্র বর্বর বলে আর্য বিজেতারা অভিহিত করত। এই আদিবাসী জনসাধারণের উল্লেখযোগ্য অংশ তখনও স্থায়ী কৃষিভিত্তিক জীবনধারায় থিতু হয়নি। এদের মধ্যে বৈদিক ধর্ম খুব একটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। এদের অনেকেই সর্বপ্রাণবাদী তথা অ্যানিমিস্টিক আচারানুষ্ঠানে বিশ্বাস করত এবং অধিকাংশেরই জীবন যাযাবরের মত ছিল। ইসলাম আগমনের পূর্বে বৈদিক ধর্মীয় ঐতিহ্যে বিশ্বাসী হিন্দু শাসকগোষ্ঠীর সক্রিয় বিরোধিতা সত্ত্বেও বৌদ্ধ ধর্ম এ অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছিল এবং তা দীর্ঘদিন টিকে ছিল। সেন রাজাদের আমল থেকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব দ্রুত কমতে থাকে এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায় ইসলাম ধর্ম একটি নতুন জীবনধারা ও দর্শন নিয়ে এ মুলুকে আবির্ভূত হয়।
বাংলার মাটিতে ইসলামী বার্তার প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায়।অনেক ক্ষেত্রে এই বার্তা দেশে প্রচলিত ধর্মীয় রীতি-নীতি ও চিন্তা-চেতনার সাথে সঙ্গতি রেখেই রূপায়িত হয়েছিল, ফলে স্থানীয় প্রথার সাথে সংঘাতে যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন হয়নি। এই অঞ্চলে ইসলাম বিস্তারের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের মতামত পাওয়া যায়। বাংলায় ইসলামের বিস্তৃতি বৈপ্লবিকভাবে ঘটেনি বরং স্বভাবিক ক্রমবিকাশের পথে অগ্রসর হয়েছে। বস্তুত বাঙালিদের সনাতনী জীবনধারা যুগের পর যুগ ধরে প্রকৃতির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল। প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে ভারসাম্য ও সমন্বয়ের মাধ্যমে ইসলাম এই অঞ্চলের সাহিত্য, লোককথা, শিল্পকলা, স্থাপত্য ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে ছাপ ফেলেছে। বাঙালির আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনে মস্ত কোন ব্যাঘাত বা বিশৃঙ্খলা ছাড়াই এই ধর্ম ধীরে ধীরে স্বচ্ছন্দভাবে এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল। এর আগে বৌদ্ধ ধর্মও এই অঞ্চলে একইভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। ইসলাম স্থানীয় জনগণের কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রার সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে যায়। ফলে প্রকৃতির ধর্ম (তথা দীন আল–ফিত্রা) হিসাবে ইসলাম স্থানীয় জনগণের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রবেশ করে।এই আমলে নিচু জলাভূমি বা জঙ্গল পরিষ্কার করে ধান চাষের বিস্তৃতি ঘটতে শুরু করে। বদ্বীপ অঞ্চলে মানববসতি বিস্তারের সাথে সাথে গ্রামবাংলায় ইসলাম দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। বাংলার নিম্নভুমি এলাকায় কৃষিভিত্তিক বসতি বিস্তারের সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে ইসলাম গ্রামীণ জীবনাচরণে রূপান্তরিত হয়ে দাড়ায়।
সুলতানী আমলের আদিপর্বের কিছু শিলালিপি খিত্তা রিফিয়্যা (গ্রাম বা পল্লী) এলাকায় ‘উলামাদের প্রচার ও শাসকশ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতার সাহায্যে শা‘আ’ইর আল–শারা‘র (অর্থাৎ ইসলামী জীবনধারা) প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত বহন করে।ইলিয়াস শাহী রাজবংশের সুলতান মাহমুদ শাহের শাসনামলের নবগ্রাম মাদ্রাসা-মসজিদ শিলালিপি (৮৫৮ হিজরী/ ১৪৫৪ খ্রিস্টাব্দ) স্পষ্টতই সেই সাক্ষ্য দেয়। স্বাধীন সুলতানী আমলে বাংলা অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি অর্জন করে সুলতানদের অনেকেই সাধারণ জনগণের জন্য পথঘাট তৈরি, ‘সিক্বায়া’ (তথা জলাধার) খনন, প্রভৃতি সুদূরপ্রসারী কল্যাণমূলক কাজ করেন, যা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলাম বিস্তারে সহায়তা করে।
বাংলার কিছু ইসলামী শিলালিপিতে, বিশেষ করে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলের ঐতিহাসিক উৎসগুলিতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়াক্ফ তথা ধর্মীয় অনুদান এবং মদাদ–ই মাআশ তথা ইসলামী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্তদের জীবন নির্বাহের জন্য বিশেষ ধরনের ওয়াক্ফ এর উল্লেখ রয়েছে এসকল অনুদান থেকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে জনসাধারণ উপকৃত হয়েছিল মোঘল আমলের পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ সতের ও আঠার শতকেও বাংলা তার পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট না করে প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। এ অঞ্চলকে সে সময়ে মুঘল সাম্রাজ্যের তথা দক্ষিণ এশিয়ার শস্যাগার বলা হত। বাংলায় সুলতানী আমলের শিলালিপিসমূহে যে তুঘরা রীতির লিপিকলা দেখা যায়, তাতে প্রলম্বিত ও সুষমভাবে সাজানো উল্লম্ব অক্ষররাজি যেন চাষাবাদের লাঙ্গলের প্রতীক হিসাবে প্রকাশ পেয়েছে। আবার কোন কোন জায়গায় সেগুলোতে জলা ও জংলাভূমির নলখাগড়ার প্রতীকী চিত্র ফুটে উঠেছে, যার মধ্য দিয়ে ইসলামের সাথে গ্রামবাংলার কৃষিভিত্তিক জীবনধারার চমৎকার সামঞ্জস্য দারুণভাবে ফুটে উঠেছে।আনুমানিক আঠার শতকের দিকে ইসলাম বাংলার সর্বাধিক জনপ্রিয় ও একটি সুদূরপ্রসারী ধর্মে পরিণত হয়, সেই সঙ্গে হয়ে ওঠে একটি প্রভাবশালী মুখ্য সাংস্কৃতিক ধারা। গ্রামীণ জনগণের নিকট ইসলাম দীন আল ফিতরা (অর্থাৎ প্রকৃতির কাছাকাছি ধর্ম) হিসাবে হাজির হয়েছিল।সুলতানী ও মুঘল যুগের জনপ্রিয় সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য, সংস্কৃতি এবং লোকসংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব গভীর ছাপ রাখে।
বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রথম একশ বছরের প্রায় তেরটি আরবী-ফার্সী শিলালিপি এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে।এগুলোর সময়কাল ১২০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩০৪ সালের মধ্যে। এই শিলালিপিসমূহের মধ্যে ৬টি খানকাহ নির্মাণের স্মারক শিলালিপি। বাংলার দ্বিতীয় প্রাচীন ইসলামী শিলালিপি ৬১৮ হিজরী/ ১২২১ খ্রিস্টাব্দের সিয়ান খানকাহের শিলালিপি। সেই খানকাহটি শুধুমাত্র সূফী দরবেশদের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছিল। খানকাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যা তৎকালীন বাংলার জীবন ও সমাজে ইসলামের আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ প্রচারে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করত (মানচিত্র ৫ দেখুন)। মাদ্রাসার মতই খানকাহগুলোও ইসলাম শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে কাজ করত। মুসলিম বিশ্বে মধ্যযুগে শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় খানকাহসমূহের ভূমিকা এতটাই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হত যে মিশরের মামলুক শাসক বায়বার্স তৎকালীন বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও দার্শনিক ইবনে খালদুনকে (মৃত্যু: ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দ) কায়রোর বিখ্যাত খানকাহের প্রধান (আচার্য্য) হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, যা সেকালের ইসলামী বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক কেন্দ্র ছিল। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণে জানা যায় যে তের শতকের গোড়াতেই বাংলায় ইসলামী মরমি আন্দোলন শুরু হয়, যা গভীরভাবে স্থানীয় জনগণের হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রথম পর্যায়ে উত্তর-পশ্চিম রাঢ় অঞ্চলের অন্যতম মুসলিম প্রশাসনিক কেন্দ্র লাখনোরের অনতিদূরে সিয়ানে একটি খানকাহ গড়ে উঠেছিল। এটি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় অবস্থিত। এই খানকাহের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইবনে মুহম্মদ আল মারাঘী। শিলালিপিটিতে মারাঘী নিজেকে সূফী বা শায়খ নয় বরং একজন ফকীর হিসেবে উপস্থাপন করেন। এটি দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনপ্রিয় উপাধি, যা স্থানীয় বৌদ্ধ ও হিন্দু মরমি ঐতিহ্যে ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসীর (মূল সংস্কৃতে: भिक्षु বা ‘ভিক্ষু’) সদৃশ।এই খানকাহটি সম্ভবত একটি বৌদ্ধ বিহার অথবা হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর নির্মিত হয়েছিল। এর আরবী শিলালিপিটি পাওয়া গেছে স্থানীয় একটি মন্দিরে। এই আরবী লিপির উল্টো দিকে আবার পাল আমলের একটি সংস্কৃত লিপিও রয়েছে। এই শিলালিপিতে সূফীদেরকে আহল আল–সূফ্ফা (আশ্রম নিবাসী) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা মহানবীর যুগে মদিনার প্রথমদিকের আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।এই গোষ্ঠী তাদের অধিকাংশ সময় ব্যয় করত নবীর মসজিদে উপাসনা করে, যার ফলে তাদের দারিদ্র্য বরণ করে নিতে হয়েছিল। শিলালিপিতে বর্ণিত স্থাপনাটি সম্ভবত মসজিদ হিসাবেও ব্যবহৃত হত।এই অঞ্চলে আজও খানকাহসমূহ সাধারণত মসজিদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এই শিলালিপিতে উল্লিখিত পবিত্র কুরআনের বাণী ও হাদিস থেকে বোঝা যায় যে বাংলার প্রথম যুগের এই সূফী দরবেশগণ শরী‘য়াতের বিশ্বস্ত অনুগামী ছিলেন। কালক্রমে এ অঞ্চলের সূফীদের মধ্যে এই অনুগামিতা দুর্বল হতে থাকে।
সিয়ান খানকাহের প্রতিষ্ঠাতা আল মারাঘীর নিসবা (নিবাসসুচক পদবি) থেকে আন্দাজ করা যায় যে তিনি কাস্পিয়ান সাগরের নিকটবর্তী, বর্তমানে আযারবাইজানে অবস্থিত মারাঘা শহর থেকে বাংলায় এসেছিলেন, যা তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের বিশ্বায়ন ও তার ফলশ্রুতিস্বরূপ এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় মানুষের অবাধ চলাচলের সাক্ষ্য।সম্ভবত ১২০৫ সালে বখতিয়ার খিলজীর সফল সামরিক আক্রমণের পূর্বেই সূফীরা বাংলার উপকূলবর্তী অঞ্চলে সমুদ্রপথে আসতে শুরু করে।মুসলমানদের আগমনের ধারাটি জোরেশোরে শুরু হয় তের শতকের গোড়ার দিকে, যখন মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, যেমন খোরাসান, পারস্য ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ক্রমান্বয়ে মোঙ্গল আক্রমণের শিকার হতে শুরু করে। ধর্মপ্রচারের আধ্যাত্মিক জোশের পাশাপাশি সে সব এলাকার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনও মুসলমানদের এই সুদূর ভূমিতে অভিবাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মধ্য এশিয়ায় তুর্কী-মোঙ্গল পূর্বসূরিদের ধারায় তারা তাদের যাযাবর জীবনধারাও কিছুটা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। বেশ কিছু প্রাচীন উৎস ও প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে তাদের অনেকেই পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া বা উত্তর ভারত থেকে তাদের আধ্যাত্মিক গুরুদের নির্দেশক্রমে এই অঞ্চলে এসেছিল। বাংলার সূফীরা যে তাদের অন্যান্য জায়গার সূফী ভাইদের মত বরাবরই তাদের মূল উৎসভূমির গুরুদের সাথে আধ্যাত্মিক যোগাযোগ রক্ষা করত, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। যখনই তারা কোন আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃসংঘের বিস্তৃতির লক্ষ্যে অন্য কোন অঞ্চলে গমন করত, সে অঞ্চলে স্থায়ী আবাস গড়ার পর তারা সেখানে আরেকটি ভ্রাতৃসংঘ গড়ে তুলত। এহেন সংঘে মুর্শিদ বা গুরু এবং মুরিদ বা শিষ্যের মধ্যে আধ্যাত্মিক বন্ধন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
ইসলামী কার্যক্রম শুরু করার জন্য সুদুর বাংলা অঞ্চলে সূফীদের আগমন মোটেও সহজ ছিল না।এই দূরবর্তী অঞ্চলে প্রায়ই তাদের সংগ্রাম করতে হত। স্থানীয় অমুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে তাদের ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে। তবে এসব গল্পে সত্যের চেয়ে কিংবদন্তির ভাগই বেশি। সূফীদের মৃত্যুর পর তাদের সম্পর্কে লিখিত গুণকীর্তনমূলক সাহিত্যে ও জীবনীগুলোতে যে অতিরঞ্জন দেখা যায়, সে ক্ষেত্রে এটা স্মরণ রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে সেকালের জীবনীকারগণ কখনো কখনো ব্যক্তিগত অত্যুৎসাহের কারণে অথবা ধর্মীয় কর্তব্য মনে করে তাদের জীবনাচরণে সূফীদের অর্জনকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাতে স্বকল্পিত নানা বিষয়ের অবতারণা করে গেছে। সূফীদের অসামান্য আধ্যাত্মিক শক্তি ও ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্র হিসাবে দাঁড় করাতে গিয়ে স্থানীয় প্রবাদ ও কিংবদন্তিতে তাদেরকে ইসলামের ঝাণ্ডা তুলে ধরা মুজাহিদ বা ধর্মযোদ্ধা হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। অথচ এ ধরনের দাবির পেছনে ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় অতি সামান্যই। সূফীদের মতে নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে বড় জিহাদই হল আসল সাধনা। এ কারণে আমরা বাংলার সূফীদের খুব কমই গাজী (বিজয়ী) অথবা মুজাহিদ (ধর্মযোদ্ধা) উপাধি গ্রহণ করতে দেখি, যদিও তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাঝে মাঝে অনিবার্য কারণবশত স্থানীয় জমিদার শ্রেণী, সামন্ত বা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিল । লোককথায় অবশ্য কিছু পীরকে গাজী উপাধি দেওয়া হয়েছে, যেমন: শাহ ইসমাঈল গাজী।স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী তিনি পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার মান্দারন গ্রামে সমাহিত হন। প্রাচীন তুর্কী সূফী ঐতিহ্যে ‘কাদখুদা’ বা সূফীদের পরিবার গ্রহণের একটি রীতি প্রচলিত ছিল। বাংলা অঞ্চলেও সূফীগণ তাদের শিষ্যদের স্থায়ী বসবাস এবং গৃহী জীবন অবলম্বন করার অনুমতি প্রদান করে।
বাংলায় সূফীদের আধ্যাত্মিক কর্তৃত্ব তো ছিলই, পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের নানা ক্ষেত্রেও তাদের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সূফীদের অনেকেই বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।তারা জনজীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর বিস্তর প্রভাব বিস্তার করে। সমাজ ও সংসারের নৈতিক দেখাশোনার দায়ভার যেন তাদের উপর ন্যস্ত ছিল। বেশ কিছু প্রাচীন উৎসে এমনও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে সূফীদের আশীর্বাদ কোন কোন শাসকের জন্য ধর্মীয় বৈধতার উৎস ছিল এবং বিশেষ ভাল কাজের প্রতিফল হিসাবে সূফীদের আশীর্বাদ লাভ করে তাদের অনেকেই পরবর্তীতে কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের নেতা বা শাসক হয়। বস্তুত বাংলার বেশ কয়েকজন আদি মুসলিম শাসক সূফীদের আশীর্বাদ পেয়েই রাজনৈতিক জীবন শুরু করে। ইবনে বাত্তুতা তাঁর রিহ্লা নামক গ্রন্থে সোনারগাঁও ও সিলেট অঞ্চলের দরবেশদের সাথে সাক্ষাৎকারের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন। তিনি শায়েদা নামক এক ফকীরের কথা উল্লেখ করেন, যিনি সোনারগাঁওয়ের শাসক ফখর আল-দীন মুবারক শাহের (৭৩৯–৫০ হিজরী/ ১৩৩৮–৪৯ খ্রিস্টাব্দ) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং এক যুদ্ধে নিহত হন।নূর কুতব আল-আলমের (মৃত্যু: সমাধি শিলালিপির তারিখ অনুযায়ী ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ) মত সূফীরা সেকালের রাজনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। মজার ব্যাপার হল যে বাংলায় আসা প্রথমদিকের কতিপয় ঐন্দ্রজালিক মহিমাসম্পন্ন বিজেতাকেও মৃত্যুর পর ক্রমশ মানুষ পীর হিসাবে সম্মান করা শুরু করে। এর অন্যতম উদাহরণ হলেন দক্ষিণ বাংলার বাগেরহাটের খান জাহান। একইভাবে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর থানার আট কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে নারায়ণপুর গ্রামের কাছে পীরপাল বলে পরিচিত এক ঢিবির উপর বখতিয়ার খিলজীর যে কথিত সমাধি আছে, সেটাকেও স্থানীয় জনতা শত শত বছর ধরে কোন এক পীরের মাজার জ্ঞানে ভক্তি করে। সুউচ্চ ও বিশাল এই ঢিবিটি যে মুসলিম আমলের প্রাচীনতম এক শাসনকেন্দ্রের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এখানে এ পর্যন্ত কোন প্রত্নতাত্ত্বিক খনন বা অনুসন্ধান হয়নি, ফলে ঢিবিটির ঐতিহাসিক তথ্য উদ্ঘাটিত হওয়া এখনও বাকি। জায়গাটি বখতিয়ার খিলজীর রাজধানী দেবীকোটের একেবারে কাছেই এবং এ এলাকার জনসাধারণের একটা বড় অংশ আদিবাসী, বিভিন্ন উপজাতি (যেমন মেচ) কিংবা নিম্নবর্ণের হিন্দু, যাদের পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ বখতিয়ার খলজীর তিব্বত অভিযানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। এদের অনেকেই এখনও কবরটিতে ফুল, ধূপকাঠি ইত্যদির অর্ঘ্য অর্পণ করে তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। প্রতি বছর বৈশাখ মাসে ফকীর, দরবেশ ও সন্ন্যাসীরা দলে দলে এসে এই জায়গাটিতে প্রদীপ জ্বালায়, মিষ্টি, বাতাসা ইত্যাদি বিতরণ করে এবং বিভিন্ন যজ্ঞ ও ধর্মীয় আচারাদি পালন করে|
চিত্র ৪.৩: দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর থানার নারায়ণপুর গ্রামে বখতিয়ার খিলজীর মাজার
সূফীগণ রাজনৈতিক ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রভাবশালী ছিল। শাসকশ্রেণীও প্রায়ই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করত।তথাপি তাদের কর্তৃত্ব ও জনপ্রিয়তা মাঝেমাঝে শাসকশ্রেণীর ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াত। সুলতান সিকান্দার শাহ রাজধানীতে শায়খ আলাওল হকের প্রভাব বিস্তার নিয়ে এত সন্দিহান হয়ে পড়েন যে তাঁকে বাংলার পূর্বাঞ্চল সোনারগাঁওয়ে নির্বাসিত করেন। তবে সাধারণত বাংলার মুসলিম শাসকশ্রেণী সূফীদেরকে আধ্যাত্মিক গুরু হিসাবে সম্মান করত এবং তাদের পরামর্শ শুনত, অন্তত প্রকাশ্যে, যেন জনগণের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা বজায় থাকে। কিছু কিছু শাসক ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য তাঁদের পুত্রদের সূফীদের নিকট প্রেরণ করতেন। যেমন মুযাফ্ফার শামস বলখী আ‘যম শাহের (রাজত্বকাল আনুমানিক ৭৯২–৮১৩ হিজরী/ ১৩৯০–১৪১০ খ্রিস্টাব্দ) শিক্ষক ছিলেন। অধিকাংশ নগরকেন্দ্র ও রাজধানী শহরগুলোতে সূফীদের মজবুত অবস্থান লক্ষ্য করা যেত, যেমন: গৌড়, পাণ্ডুয়া ও সোনারগাঁও। এর ফলে রাজনৈতিক পরিবেশ ও রাজপরিবারের উপর সূফীরা প্রভাব বিস্তারের যথেষ্ট সুযোগ পায়। অনেক সূফী ইসলামী সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। অনেকে মাদ্রাসা ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে এবং জনকল্যাণকর সকল প্রকার কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে।
বাংলার সূফীগণ একদিকে আধ্যাত্মিক গুরু ছিল, অন্যদিকে ‘উলামা তথা ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ এবং মুহাদ্দিসীন (অর্থাৎ ‘মহানবীর বাণী ও দৃষ্টান্তের স্বীকৃত পণ্ডিত’) হিসাবেও পরিচিত ছিল তাদের কেউ কেউ এই অঞ্চলে হাদীস শিক্ষা জনপ্রিয় করায় ভূমিকা পালন করে এবং জ্ঞানের নানা শাখায় বিচরণ করে।তারা সাধারণত বুদ্ধিবৃত্তিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ফার্সী ভাষা ব্যবহার করত।ফলে, তাদের অনেক লিখিত কর্ম, যেমন মালফুজাত (তথা ‘মুখনিঃসৃত বাণীর সংকলন’) এবং মাকতূবাত (লিখিত পত্রাবলি) ফার্সী ভাষায় দেখা যায় সূফীদের অনেকেরই ধর্মীয় জ্ঞানে অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। সাধারণত তাদের আরবী ভাষায়ও ব্যুৎপত্তি থাকত। তাদের বেশ কিছু কর্ম আরবী ভাষায়ও রচিত হতে দেখা যায়।
বাংলার অন্যতম আদি ইসলামী সাহিত্যকর্ম ছিল মীরাত আল–মা‘আনী লি–ইদ্রাক আল–ইনসানী, যা হাউজ আল–হায়াত তথা ‘প্রাণসুধার ঝর্ণা’ নামে অধিক পরিচিত বইটি মূলত যোগশাস্ত্রের উপর রচিত একটি গ্রন্থের আরবী অনুবাদ; মূল সংস্কৃত বইটির নাম: অমৃতকুণ্ড । এই বইটির মাধ্যমে সে যুগের সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে চিন্তাভাবনার আদান-প্রদান ও মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে কিছু আভাস পাওয়া যায়। বইটির মূল বিষয় হচ্ছে আধ্যাত্মিক সত্যের পথে জীবনযাত্রা, যে যাত্রার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে বিভিন্ন কণ্টকাকীর্ণ পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হয়। এত কিছুর পরেও জীবনের এই যাত্রা যেন স্বপ্নের মত এক অভিজ্ঞতা (আল-ওয়াজূদ আল যিল্লী) বৈ আর কিছু নয়। সূফীদের মতে এই মহা সত্যই হল জীবনের মুল রহস্য।পাণ্ডুলিপির গোড়ায় একটি ঐতিহাসিক পটভূমি দেওয়া আছে। আলী মর্দানের রাজত্বকালে (১২১০–১৩ খ্রিস্টাব্দ) ভোজার ব্রাহ্মণ নামক কামরূপের এক বিখ্যাত যোগী ও হিন্দুশাস্ত্রজ্ঞ নব্য বিজয়ী মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে কামরূপ থেকে বাংলার রাজধানী লক্ষণাবতীতে আসেন। এক পর্যায়ে এই অঞ্চলে নতুন গড়ে উঠা একটি জামি‘ মসজিদে জুম‘আর নামাজের সময় এলাকার ক্রমবর্ধমান মুসলিম সমাজের অন্যতম নেতৃস্থানীয় হানাফী বিচারক, দার্শনিক ও নৈয়ায়িক কাজী রুকন আল-দীন আবূ হামীদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ সামারক্বান্দীর (মৃত্যু ৬১৫ হিজরী/ ১২১৮ খ্রিস্টাব্দ?) সাথে তাঁর দেখা হয়। সামারক্বান্দীর ‘ইলম আল–জাদাল তথা তর্কশাস্ত্রে বিশেষ আগ্রহ ছিল এই শাস্ত্রের উপরে তিনি বেশ কিছু গ্রন্থও রচনা করেছিলেন, যেমন: আল–ইরশাদ ও আল–তারিক্ব আল-‘আমীদিয়্যা ফি ’ল–খিলাফ ওয়া ’ল–জাদাল। ভোজার ব্রাহ্মণ রুকন আল-দীন সামারক্বান্দীর সাথে ধর্ম বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন। সামারক্বান্দীর যুক্তিতর্ক তাঁর কাছে এতটাই অকাট্য ও সঙ্গত মনে হয় যে এক পর্যায়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ইসলাম ধর্মশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা লাভ করেন। ক্রমশ ধাপে ধাপে উন্নীত হয়ে অবশেষে তিনি একজন শাস্ত্রবিশারদ ও মুফতী (আইন ও শাস্ত্র বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মতামত প্রদানের অধিকারী পণ্ডিত) পর্যায়ে উপনীত হন এই পাণ্ডুলিপিটিতে হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোকে আসমানি কিতাব (ঐশ্বরিক বই) হিসাবে পেশ করা হয়েছে, যেমন বেদ হল ইব্রাহীমি ধারার গ্রন্থ, যা কিনা দুই ব্রহ্মার মাস্হাফ তথা আসমানি কিতাব। দুই ব্রহ্মা বলতে এই পাণ্ডুলিপিতে সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত মহাপুরুষ বা রাসুল ইব্রাহীম ও মুসা নবীদ্বয়কে বোঝানো হয়েছে।
বস্তুত বাংলার প্রথম দিকের মুসলিম পণ্ডিতরা বৈদিক ধর্মকে রিসালাহ বা ঈশ্বরপ্রেরিত বাণী এবং আর্য ঐতিহ্যকে একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার প্রকাশ হিসাবে মূল্যায়ন করেছিলেন এই নব্য বিজিত অঞ্চলের হিন্দু, বৌদ্ধ ইত্যাদি সকল অমুসলিম সম্প্রদায়কে তাঁরা সাধারণভবে মুশাবিহ বি–আহল আল–কিতাব-এর (আসমানি কিতাবধারী জাতিদের সদৃশ) মর্যাদা দিয়েছিলেন। ইসলামী রাষ্ট্রে প্রথাগতভাবে খ্রিস্টান ও ইহুদিরা যেমন মর্যাদা লাভ করত এটাও ছিল তেমনি একটি স্বীকৃতি| সুতরাং বাংলার অমুসলিমরা ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী স্বাধীন অমুসলিম জনগণ হিসাবে আইনগত সকল অধিকার ভোগ করতেন। এই গুরুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের ব্যবস্থাটি দক্ষিণ এশিয়ার ইসলামের ইতিহাসে নতুন নয়। সূফী সাহিত্যে মাঝে মাঝে এটি সুল্হ্–এ–কূল তথা সবার জন্য শান্তি হিসাবে বর্ণিত হয়ে থাকে এর প্রায় পাঁচশ বছর আগে মুহাম্মদ ইবনে আল-কাসিম সিন্ধু বিজয়ের পর অনুরূপ নীতি গ্রহণ করেছিলেন, যার ফলে সিন্ধু অঞ্চলে ইসলামের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এই গ্রন্থে বাংলার উলামা কর্তৃক নবী ইব্রাহীম (আ.) ও মূসার (আ.) প্রতীক হিসেবে ব্রহ্মাকে চিহ্নিতকরণ ছিল উত্তরকালে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় দুই ধর্মীয় সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানদের পরস্পরকে বোঝার পথে প্রথম পদক্ষেপ।
ধর্মীয় দিক থেকে এই পারস্পরিক যোগাযোগ হিন্দু ও মুসলমান পণ্ডিতদের মাঝে সংলাপের একটি কার্যকরী ধারার সূচনা ঘটায়। বাংলার পূর্ব ও উত্তর পূর্ব দিকে কামরূপ ও আসামের মত প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগশাস্ত্র ও তান্ত্রিক অনুশীলনের একটি সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্যের চর্চা ছিল, যার প্রতি মুসলমান পণ্ডিতদের গভীর কৌতূহল ও আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল। বস্তুত প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে বর্ণিত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতাকে ছাড়িয়ে যে চেতনা, বা চেতনারও সীমা ছাড়িয়ে উপলব্ধির জগতে প্রবেশের মাধ্যমে ঈশ্বর উপলব্ধির যে ব্যাখ্যা আছে কিংবা উপনিষদে যে পরমব্রহ্ম নামে নিরাকার এক ঈশ্বরের ধারণা আছে, তার সঙ্গে বাংলার সূফী দর্শনের এক ঈশ্বরের বয়ানের মিল খুঁজে পাওয়া হয়ত খুব দুষ্কর নয়। বাংলায় এই আদি হিন্দু-মুসলিম মোলাকাত উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করে এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির একটি অপূর্ব ধারা রচনা করে। মধ্যযুগের বাংলার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয় কেবল এ দেশে ইউরোপীয় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পর, যখন ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে নিজেদের কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করে।
বাংলায় মুসলমান শাসনের প্রথম পর্যায়ে একজন ব্রাহ্মণ যোগীর ইসলাম গ্রহণ প্রতীকীভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এতে প্রকাশ পায় যে এই অঞ্চলে মুসলানদের আগমনের পর পরই স্থানীয় জনগণের মধ্যে ধর্মান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এবং কেউ কেউ ইসলামে দীক্ষিত হতে শুরু করেছিল। ইসলামের আবির্ভাব ব্রাহ্মণ থেকে ম্লেচ্ছসহ সর্বস্তরের জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। ইসলামের বাণীকে স্থানীয় জনগণের নিকট সহজভাবে উপস্থাপনের জন্য দেশীয় লোকভাষা ও উপমার রূপক ব্যবহারের প্রক্রিয়া শুধু বাংলায় সীমাবদ্ধ ছিল না। গুজরাট ও আরও কিছু অঞ্চলেও অনুরূপ প্রক্রিয়া ঘটেছিল বলে জানা যায়। ‘পুঁথি’ বলে পরিচিত মধ্যযুগের মুসলমানদের বাংলা কাব্যচর্চায় তার ভুরি ভুরি নিদর্শন পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য যে বাংলার আদি আলেমদের মধ্যে অধিকাংশই মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিল, যেমন: কাজী রুকন আল-দীন সামারক্বান্দী। তারা হানাফী ‘ফিক্বহ্’ এর অনুসারী ছিল বলে তাদের প্রভাবে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে মূলত হানাফী ফিক্বহ্ প্রাধান্য পায়। লক্ষণীয়, উপমহাদেশের একমাত্র হানাফী আইনজ্ঞদেরই কেউ কেউ হিন্দুদের মুশাবিহ বি আহল আল কিতাব অর্থাৎ আসমানি কিতাবধারী (ঐশ্বরিক বই প্রাপ্ত জাতি বা ঐশ্বরিক বাণীর অনুগামী) সমাজের সমতুল্য বলে মনে করত, এবং মুসলিম বা খ্রিস্টানদের মত তাদের অধিকার সুস্পষ্ট ও সুরক্ষিত ছিল। শাফেয়ী এবং অন্যান্য মাযহাব অর্থাৎ ইসলামী আইনশাস্ত্রের অন্যান্য শাখার কোন কোনটা তাদেরকে মুশরিকীন অর্থাৎ বহু-ঈশ্বরবাদী বলে মনে করত। হানাফী আইনশাস্ত্রের উদার মনোভাব এই অঞ্চলে একটি বিশেষ প্রভাব ফেলে। এই ধর্মীয় ব্যাখ্যায় মুসলমানদের সাথে হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো সমান বলে বিবেচিত হয়, ফলে মুসলমান শাসনাধীনে সকলের জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ইব্রাহীম আল-নাখা‘ইর (যিনি ইবনে মাস‘উদের একজন বিখ্যাত ছাত্র, এবং ইরাকে কাজীর দায়িত্ব পালন করেন; মৃত্যু ৯৫ হিজরী) মত অনেক মুসলমান আইনজ্ঞ ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই এই দৃষ্টিভঙ্গির পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন, বিশেষভাবে ইরাক ও পূর্বদিকের অন্যান্য নব্য বিজিত অঞ্চলে। আইনজ্ঞদের কেউ কেউ এমনকি ধর্মত্যাগের শাস্তি হিসেবে অনুতাপকেই যথেষ্ট বলে মনে করতেন। আবার কেউ কেউ কোন শাস্তিরই প্রয়োজন নেই বলে মত প্রকাশ করতেন। ইতিহাসে দেখা যায় বাঙালি মুসলমান সর্বদাই আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেরণার উৎস হিসেবে ইরাক ও খুরাসানের অনুসরণ করত যা ছিল হানাফী মাযহাবের আদি পীঠস্থান।
‘উলামা ও সূফী উভয় গোষ্ঠীই সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগে সফল ছিল। স্থানীয় জনগণের নিকট তারা বোধগম্য ভাষায় সহজভাবে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিত। সাধারণত সূফীরা মুসলিম সমাজ গঠনে নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কখনো নীরবে আবার কখনো স্পষ্টভাবে ও প্রকাশ্যে। স্বভাবতই তাদের প্রভাবের মাত্রা ও কর্মকাণ্ডের প্রাবল্য সদাসর্বত্র সমান হত না। সূফীদের একটি বড় অংশ মূলত ইসলামী সমাজে শরী‘য়াহ সম্মত উপায়ে বসবাস করত এবং উলামাদের সাথে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করত। আগেই বলা হয়েছে, ধর্মীয় বাণীর স্বদেশিকরণ এবং আন্তঃধর্ম সমন্বয়বাদের (সিনক্রেটিজম) মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্য বরাবরই রয়ে গিয়েছিল। স্বদেশিকরণে মূলত দেশীয় ভাবভাষা অবলম্বনে ধর্মের শিক্ষা প্রচার করা হয়। অন্যদিকে সমন্বয়বাদে (আন্তঃধর্ম আপোষ ধারায়) নানান পরস্পরবিরোধী বিশ্বাসকে মিশ্রিত করে একটি সমন্বিত রূপ দেওয়া হয়। অন্যান্য অঞ্চলের মত বাংলায় ইসলাম প্রচারেও স্বদেশিকরণের প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিকভাবেই অনুসৃত হয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষার স্বদেশিকরণের মাধ্যমে ধর্মপ্রচারের ক্ষেত্রে সূফীরা বাংলায় যে দৃষ্টান্তমুলকভাবে সফল হয়েছিলেন, সে রকম নজির দক্ষিন এশিয়ার অন্য কোন অঞ্চলে মেলা ভার। মূলধারার সূফীরা কখনই আন্তঃধর্ম সমন্বয়বাদকে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। পারস্যের প্রাচীন সাসানীয় রাজকীয় ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবান্বিত বাংলার মুসলিম শাসকশ্রেণীর একাংশ এবং সাবেকি বা বেশরা (শরী‘য়াহ এর বিধি-নিষেধের উর্ধ্বে) বলে পরিচিত পীর-মোল্লা শ্রেণীর লোকেরা সমন্বয়বাদের পৃষ্ঠপোষকতা করত বস্তুত বাংলায় পীর, মোল্লা, সূফী, আলেম ইত্যাদি শব্দগুলো সাধারণভাবে প্রায় সমার্থক হিসাবেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অন্য কথায় প্রচলিত অর্থে এগুলোর মধ্যে খুব বেশি মৌলিক পার্থক্য নেই। তবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই দুইটি ধারার একটি গূঢ় পার্থক্য বাঙালি সমাজে সদাসর্বদা বিদ্যমান ছিল, এবং স্বদেশিকরণপন্থী শরী‘য়াহ-অবলম্বী উলামাদের ধারা এবং সমন্বয়বাদী বেশরা পীরপন্থী ধারার মধ্যে একটি ভেদরেখা বরাবরই স্পষ্ট ছিল। রাজদরবারের সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদির ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের পারস্পরিক যোগাযোগ ও বোঝাপড়া চিরকাল অব্যাহত ছিল। কিন্তু সামাজিক মিলনের ক্ষেত্রে বিপরীতমুখি ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলোর সমন্বয় সাধনের ধারা তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে নি। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপ্যাধ্যায় তাঁর বহুলপঠিত উপন্যাস ও ছোটগল্পগুলোয় বিশ শতকের গোড়ার দিকের গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ফুটিয়ে তুলেছেন, যেখানে হিন্দু ও মুসলমান শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একসাথে বাস করেছে, নানা লেনাদেনা-মেলামেশাও ঘটছে। তবুও কোথাও যেন কোন একটা স্পষ্ট ভেদরেখা তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনকে আলাদা করে রেখেছে।
এরকম নানামুখি প্রক্রিয়া ও ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে নদিমাতৃক বাংলায় ক্রমান্বয়ে একটি মুসলিম সমাজ ও ধর্মীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠে, যেখানে সূফীদের প্রভাব ও ভুমিকা খুব গভীর ছিল। প্রথমদিকের সূফীদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ সাদামাটা জীবনযাপন। কিন্তু তাদের উত্তরসূরিদের অনেকেই এসব লক্ষ্য থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে। বাংলায় পীরদের সমাধিসমূহ দরগাহ, রওজাহ ও মাজার নামে অধিক পরিচিত। এগুলোতে ঘটা করে বাৎসরিক ওরস মাহফিল ও অন্যান্য ভক্তিমুলক অনুষ্ঠান উদযাপন করার প্রবনতা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে ।
মুর্শিদাবাদের সুতি থানার ছাপঘাটিতে ১৭ শতকের যোগ ক্বালান্দার পুঁথির প্রণেতা বিখ্যাত ক্বালান্দারি সুফী সৈয়্যদ শাহ মুর্তজা (আধ্যাত্মিকভাবে বূ ‘আলী ক্বালান্দারের অনুগামী এবং সুফী সৈয়্যদ শাহ আব্দুর রাজ্জাকের শিষ্য) এর মাযারটি এই সমন্বয়বাদি ও মিলনধর্মী ধারার একটি উদাহরণ। ফার্সীতে লেখা রাণী ভবানীর একটি দানপত্রের মাধ্যমে মাযারটির জন্য পার্শ্ববর্ত্তী মনসুরগঞ্জ গ্রামের বেশ কিছু জমি ওয়াক্ফ করা হয়েছিল। দানপত্রটিতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে শাহ মুর্তজার অধস্তন বংশধরদের তত্তাবধানে একটি স্থানীয় পরিচালকমন্ডলী মাযারটির দেখাশুনা করবে ও আর্থিক সমাগমের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করবে, এবং মাযারটিতে ধনি, দরিদ্র, স্ত্রী, পুরুষ, হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে যে কেউ যিয়ারাতের জন্য (আশীর্বাদ লাভের জন্য) আসতে পারবে এবং চতুর্দিকে লাগানো গাছের নীচে আশ্রয় নিতে পারবে। পদ্মা নদির ভাঙ্গনে ছাপঘাটি তলিয়ে যাওয়ার পর মাযারটিকে প্রথমে নূরপুর ও পরে আহিরনে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন পর্যন্ত মাযারটিতে প্রতি বছর তিন দিন ব্যাপি ‘উরস (উৎসব) হয়ে থাকে, যেখানে প্রচুর লোকের সমাগম হয়। সৈয়্যদ শাহ মুর্তজার রচনায় বৈষ্ণব কাব্যের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষনীয়। আরেকটি উদাহরন হল বর্ধমান শহরের প্রায় তিন কিলোমিটার উত্তরে হটুদেওয়ান পীরের মাযার। এ মাযারে ভক্তি নিবেদন করতে এবং পানি পড়া ও তাবীজ নিতে মুসলিম ছাড়াও স্থানীয় আদিবাসী ও হিন্দুরা বিপুল সংখ্যায় আসে। আদি পর্বের সূফীদের খানকাহসমূহের মূল কাজ ছিল দাওয়াহ তথা ইসলামের বার্তা প্রচার করা। সময়ের আবর্তনে এই সমাধিগুলি বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয়বাদি ধারার জনপ্রিয় পীঠ হয়ে দাঁড়ায়। পীরদের প্রতি ভক্তি সাধারণ মানুষকে সমাধিকেন্দ্রিক ধর্মীয় ভাবধারার প্রতি বেশী আকৃষ্ট করে। শাসকশ্রেণীর অনেকেই নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য সূফীদের কবরে বিশাল সমাধিসৌধ নির্মাণ করতেন, যা সময়ের সাথে সাথে একপর্যায়ে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা ব্যক্তিদের লাভের একটি বিশাল উৎসে পরিণত হয়। বিহারের মুঙ্গের দুর্গের দক্ষিণদিকের প্রবেশপথের নিকটবর্তী শাহ নাফা’র সমাধিসৌধের পূর্ব দেওয়ালে সংযুক্ত একটি শিলালিপি নির্দেশ করে যে ৯০৩ হিজরী/ ১৪৯৭–৯৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হুসাইন শাহ এই সূফী বা দরবেশের সমাধির উপরে এক বিশাল গম্বুজ নির্মাণ করেছিলেন। বলাইবাহুল্য যে বাংলার সাধারণ মানুষের সমর্থন অর্জন করার বাসনায় শাসকগোষ্ঠী যুগে যুগে এ ধরনের সমাধিসৌধ নির্মাণের পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে।
এই প্রক্রিয়ার পীর-দরবেশদের আন্তঃধর্ম সমন্বয়বাদ ধারায় ইসলামের মূল নৈতিক গুণাবলি ও আত্মত্যাগের আধ্যাত্মিক সাধনার গুরুত্ব ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। দাব্ত আল–নফস তথা প্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণের সাধনার গুরুত্ব ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে ক্রমশই আন্তঃধর্ম সমন্বয়বাদের এক দল মুসলিম সাধক তথা পীর, ফকীর ও দরবেশদের এক নতুন ধারা জন্ম নিতে শুরু করে, যাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল গ্রামের অশিক্ষিত জনসাধারণের ভক্তি অর্জনের মাধ্যমে বৈষয়িক সফলতা অর্জন করা। সর্বেশ্বরবাদী দৃষ্টিভঙ্গির এই পীর, ফকীর ও দরবেশদের দিকে স্বভাবতই পল্লী এলাকার সাধারণ জনগণ আকৃষ্ট হতে থাকে। অনেক দরগাহ প্রকৃতপক্ষে পীরদের আয়ের একটি সুনিশ্চিত মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। অচিরেই এই নতুন শ্রেণী খানকাহ পর্যায় অতিক্রম করে ত্বরীকাহ বা আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃসংঘ পর্যায়ে উপনীত হয় এবং অবশেষে তা তাইফাহ বা সাম্প্রদায়িক উপদলের রূপ পরিগ্রহ করে অনেক ক্ষেত্রে এসব পরিবর্তন ঘটে শাসকশ্রেণীর সাথে পীরদের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কারণে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায় যে সূফী ও পীরগণ তাদের নিজস্ব ব্যয় নির্বাহের জন্য রাষ্ট্র থেকে নানা অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করত, যেমন: ইন‘আম তথা আর্থিক পুরস্কার অথবা মাদাদ–ই–মা‘আশ তথা অনুদানকৃত ভূমির আয়ভোগ।
মোটের উপর বলা যেতে পারে যে ‘খানকাহ’ প্রতিষ্ঠান গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত পর্যায়ে নানামুখি ভূমিকা রেখেছিল। অনেক সাধারণ মানুষ খানকাহের সাথে নানাভাবে সম্পৃক্ত হত। বিশেষ করে খানকাহের আশপাশের এলাকায় যে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বাস করত, তারা প্রায়ই বিভিন্ন অনুদান পেত। মাদাদ–ই মা‘আশের মত প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা ব্যক্তিরা এর থেকেই বেতন-ভাতা পেত (যেমন দেখুন, বাহরাম সাক্কা শিলালিপি, সময়কাল ১০১৫ হিজরী/ ১৬০৬–৭ খ্রিস্টাব্দ)। খানকাহগুলোর কোন কোনটিতে জনগণের জন্য বিভিন্ন ধরনের জনকল্যাণমুলক সুবিধা ছিল, যেমন: রান্নাঘর ও বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ইত্যাদি। এই খানকাহগুলো বিশেষভাবে পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার নিম্ন বদ্বীপ অঞ্চলের জনবিরল এলাকায় নতুন মুসলমান-অধ্যুষিত গ্রাম গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
টীকা ও তথ্যসূত্র
- ১। পবিত্র কুর’আনে বিষয়টি গভীর ও অর্থপূর্ণভাবে বর্ণিত হয়েছে। আয়াতটি হলো: ওয়া ইন মিন শায়ইন ইল্লা য়ুসাব্বিহু বি হামদিহি (এবং এমন কিছুই নেই যা তাঁর প্রশংসা করে না [সূরা বনী ইসরাইল, ১৭:৪৪])। এছাড়া দেখুন: আল কুর’আন, সূরা আল-রূম, (৩০: ৩০): ‘তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে ধর্মে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুসারে তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন; আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই, এটাই প্রতিষ্ঠিত ধর্ম, যা অধিকাংশ মানুষ জানে না।’ মুসলিম শরীফ, কিতাব আল-তাহারা, [পবিত্রতার অধ্যায়], ভাগ ১৬, খিসাল আল-ফিতর্ [প্রাকৃতিক স্বভাব]।
- ২। এ বিষয়ে সূফী সাধক ইবন-আল-‘আরাবীর একটি বিখ্যাত চরণ হল:
ومايبدومنالأحكامحكميألاإنّالوجودَوجودُربي
- ৩। সৃষ্টিকর্তার একশটি অতি সুন্দর নামের মধ্যে এটি একটি। পবিত্র কুরআনের আয়াতটি হচ্ছে: ওয়ালিল্লাহিমাফী ’ল–সামাওয়াতিওয়ামাফী ’ল-আরদ্ ওয়াকানাআল্লাহবিকুল্লিশায়ইনমুহীত (আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহরই এবং সবকিছুকে আল্লাহ পরিবেষ্টন করে রয়েছেন (সূরা আন্-নিসা, ৪:১২৬)।
- ৪। ‘ফাযালিকুমআল্লাহরাব্বুকুমআল–হাক্কফামাযাবা‘দ ’ল–হাক্কিইল্লাআল–দ্দালালু, ফা ’আন্নাতুসরাফুন’ (তিনিই আল্লাহ, তোমাদের প্রকৃত প্রতিপালক, সত্য পরিত্যাগ করার পর মিথ্যা বা বাতিল ব্যতিত আর কি থাকে? সুত্রাং তোমরা কোথায় চালিত হচ্ছো? [আল-কুরআন, সূরা ইউনূস, ১০: ৩২])
- ৫। এ বিষয়ে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানিদের চিন্তাচেতনাও খুব বেশি আলাদা না। বিজ্ঞানী স্টিফেন ওয়াইনবার্গ মনে করেন: The efforts to understand the universe is one of the very few things that lifts human life a little above the level of farce and gives it some of the grace of tragedy. অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বিষয়টিকে আরও সহজভাবে তুলে ধরেছেন, One of the strongest motives leading to Art and Science is a flight from everyday life with its painful coarseness and bleak tediousness, from the chains of the ever changing personal wish”.
- ৬। উদাহরণস্বরূপ গীতবিতান গ্রন্থের ‘প্রকৃতি’ পর্যায়ের অন্তর্গত ৮ সংখ্যক গানটিতে এই বিষয়টি দারূণভাবে ফুটে উঠেছে গানটির প্রথম চরণগুলো হল: আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান ॥
- ৭। উইলিয়াম এ. গ্রাহাম, ‘দ্য উইন্ডস টু হেরাল্ড হিজ মার্সি’, ফেইথফুলইম্যাজিনিং: এসেজইনঅনারঅবরিচার্ডআর. নিবুর, সম্পাদনা: ওয়েইন প্রাউডফুট, স্যাং হায়ুন ও লি অ্যালবার্ট ব্ল্যাকওয়েল, অ্যাটলান্টা, স্কলারস প্রেস, ১৯৯৫, ২২।
- ৮। বাংলায় বর্ষাকালে বজ্রপাত প্রকৃতির একটি নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা। কুর’আনের ভাষায়, ‘বজ্রধ্বনি তাঁর সপ্রশংস মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করে, এবং ফেরেশতাগণে ও বিস্ময়াভূত হয়ে একই কাজ করে’ (১৩:১৩)। এই আয়াতটি সুলতানগঞ্জ শিলালিপিতে (তারিখ ৭৮৯ হিজরী/ ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দ) এবং আরও কিছু শিলালিপিতেও উদ্ধৃত হয়েছে।
- ৯। আল-কুরতুবী, ‘সূরা আল-বাক্বারাহ’, আল–জামী‘লিআহকামআল–কুর’আন, ৩য় খণ্ড, আয়াত নং ২৫৩। হাদিসের আরবী পাঠটি হচ্ছে: জু‘ইলাতলী ’ল-আরদ মাসজিদওয়াতুহুর।
- ১০। টাইটাস বুর্কহাডর্ট, মিররঅবদ্যইনটেলেক্ট, আলবেনী, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউয়র্ক প্রেস, ১৯৮৭, ২২৪।
- ১১। প্রাগুক্ত, মিররঅবদ্যইনটেলেক্ট, ২১৬। এই ধারণাটি প্লেটো, ইংরেজি কবি জন কিটস ও অন্যান্যদের লেখাতেও দেখা যায়।
- ১২। মুসলিমশরীফ, কিতাব আল-ঈমান, (বিশ্বাসের অধ্যায়), ভাগ, তাহরীম আল-কিবর (অহংকার করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা)।
- ১৩। টাইটাস বুর্কহাডর্ট, স্যাক্রেডআর্টইনদিইস্টঅ্যান্ডওয়েস্ট, আলবেনী, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক প্রেস (১৯৮৭), ১০১–১১৯।
- ১৪। আল-কুরআনের বাণী, ‘যখন সে প্রস্থান করে তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির এবং শষ্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু নিধনের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না।’ (সূরা আল বাকারাহ, ২: ২০৫)
- ১৫। রিচার্ড ইটন, দ্যরাইজঅবইসলামঅ্যান্ডদিবেঙ্গলফ্রন্টিয়ার (বার্কলে: ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, ১৯৯৩), ৩০৮–৩১৩।
- ১৬। দেখুন: প্রাগুক্ত, দ্যরাইজঅবইসলামঅ্যান্ডদিবেঙ্গলফ্রন্টিয়ার, ৩০৮–৩১৩।
- ১৭। এই অঞ্চলের বন, জলাভূমি ও প্রাকৃতির বিন্যাসের কথা একটি জনপ্রিয় প্রবাদের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠে: ‘জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ’।
- ১৮। উদাহরণস্বরূপ দেখুন, সিলেটের একটি ধর্মীয় স্থাপনার সংযুক্ত ওয়াকফ (অনুদান) শিলালিপি, তারিখ ৯৯৬ হিজরী/ ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দ; দোহার জামি‘ মসজিদ ওয়াকফ (অনুদান) শিলালিপি, তারিখ ১০০০ হিজরী/ ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দ; নয়াবাড়ির ভাগলখান মসজিদের মাদাদ–ই–মা‘আশ শিলালিপি, তারিখ ১০০৩ হিজরী/১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দ; এবং বর্ধমানে অবস্থিত বাহরাম সাক্কার আস্তানা মাদাদ–ই–মা‘আশ শিলালিপি, তারিখ ১০১৫ হিজরী/ ১৬০৬-৭ খ্রিস্টাব্দ।
- ১৯। এম তালিবি, প্রবন্ধ ‘ইবন খালদূন’, দ্যএনসাইক্লোপিডিয়াঅবইসলাম, নতুন (২য়) সংস্করণ, ৩য় খণ্ড, লেইডেন, ই. জে. ব্রিল, ১৯৮২, ৮২৭।
- ২০। রিচার্ড ইটন, দ্যরাইজঅবইসলামঅ্যান্ডদিবেঙ্গলফ্রন্টিয়ার, ৭২।
- ২১। প্রাগুক্ত, ৭১–৭৩।
- ২২। প্রাগুক্ত, ৭৫।
- ২৩। প্রাগুক্ত, ৭৪।
- ২৪। প্রাগুক্ত, ৭৫।
- ২৫। প্রাগুক্ত, ৮৩।
- ২৬। প্রাগুক্ত, ৮৩–৮৪।
- ২৭। প্রাগুক্ত, ৮৫।
- ২৮। ফার্সী পাণ্ডুলিপি, খুদা বখশ ওরিয়েন্টাল পাবলিক লাইব্রেরি, পাটনা, নং এইচ. এল. ১৮২৬, ফোলিও ১৬।
- ২৯। ‘হাউজ আল-হায়াত’, সম্পা. ইউসুফ হুসাইন, জূগনালএশিয়াতিক, ২১৩ (অক্টোবর–ডিসেম্বর, ১৯২৮): ১৯১–৩৪৪। মূল সংস্কৃত গ্রন্থটি সম্ভবত কানামাহ নামের একজন হিন্দু তান্ত্রিক যোগী সংকলন করেন গ্রন্থটি যোগী তান্ত্রিক ধারণার ভিত্তিতে নিগূঢ় শারীরবৃত্ত (যেমন: দেহের ধমনীসমূহ, শিরা-উপশিরা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, প্রাণায়াম, ও বীর্যধারণের গূঢ় তাৎপর্য) ইত্যাদি বিষয়াদি নিয়ে রচিত হয়েছিল, যা দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু সূফী পণ্ডিতের মাঝে আগ্রহ জাগিয়েছিল।
- ৩০। দক্ষিণ ভারতের প্রখ্যাত সূফী শায়খ মীর্জা মাজহার জান-ই-জানানও ‘বেদ’কে একটি ঐশী কিতাব বলে ঘোষণা করেছিলেন।
- ৩১। হাজী মুহাম্মদ, নূরজামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, পাণ্ডুলিপি নং ৩৭৪, সিরিয়াল নং ২৬০, ফোলিও ৬, এম. সি.; সাইয়্যেদ মুরতজা, যোগকলন্দর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, পাণ্ডুলিপি নং ৩৭৪, সিরিয়াল নং ২৬০, ফোলিও ১এ; আলী রাজা, জ্ঞানসাগর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, এস. এস. নং ৩৭৪, সিরিয়াল নং ২৬০, ফোলিও ১০৯, ২১৫, ২১৬।
- ৩২। উদাহরণস্বরূপ দেখুন: শরৎচন্দ্র চট্টোপ্যাধ্যায়, পল্লী সমাজ, ঢাকা: সালমা বুক ডিপার্টমেন্ট, ১৯৯৯, ১৩০–১৩২।