শায়খ আব্দুন নবী ছিলেন ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-র বংশধর। তিনি আব্দুল কুদ্দুস গাঙ্গোহি নামক সাধকের পৌত্র ছিলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে আকবরের প্রাথমিক ধর্মচিন্তা গড়ে উঠেছিল। শায়খ আব্দুন নবীর খেতাব ছিল ‘সদর’। ১৫৬৫-তে প্রাপ্গ ‘সদর উস সুদুর’ পদটি ছিল সাম্রাজ্যোর ধর্মীয় সর্বোচ্চ পদ।
শায়খ আব্দুন নবী ছাড়াও আরও এক জন আলেম মখদুম উল মুলক-এর প্রতিও আকবর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
সম্রাট হওয়ার পরও প্রাথমিক জীবনে আকবর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও অন্যান্য ইসলামী ধর্মীয় নির্দেশগুলি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। এমনকি তিনি প্রতিদিন মসজিদ ঝাড়ু মেরে পরিষ্কার করতেন। আকবর প্রায় প্রতিদিন শায়খ আব্দুল নবীর বাড়ি যেতেন এবং মন দিয়ে হাদিস শুনতেন। তিনি শায়খকে যুবরাজ সেলিমের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন। শায়খের প্রতি সম্রাটের ভক্তি এতটাই ছিল যে সম্রাট শায়খের জুতো জোড়া স্নহস্তে দূর থেকে এনে শায়খের পায়ের সামনে রাখতেন।
ইবাদত খানায় ধর্ম আলোচনা এমন পর্যায়ে চলে যেত আব্দুন নবী এবং মখদুম উল মূলক প্রায়ই বিতর্ক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়তেন। শায়খ সংগীতের উপর ছিলেন খড়গহস্ত। তাঁর চিন্তা-ধারা অনেকেরই উপহাসের পাত্র ছিল। শায়খের চিন্তা ধারায় ও কর্মের মধ্যে যথেষ্ট সামঞ্জস্য ছিল। তাই তাঁকে সরাসরি দায়ী করা যায় না তবে তাঁর অধীনস্থদের দুর্নীতি তাঁকে বিপদে ফেলত।
দরবারে যেমন ছিলেন শায়খ আব্দুন নবী ও অন্যান্য ইসলামী পন্ডিতগন। তেমনই ছিলেন আবুল ফজল ও ফৈজি। দুই ভাইয়ের চিন্তাধারা শায়খ আব্দুন নবী ও অন্য আলেমদের বিপরীত ছিল। এই দুই চিন্তাধারার সংঘর্ষে আকবর আবুল ফজল গংয়ের খপ্পরে পড়ে যান।
আকবরের রাজ্যভিষেকের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আকবর তাঁর রাজকীয় পোশাকে সামান্য পরিমাণে কমলা রঙের কাপড় ব্যবহার করেছিলেন। এই পোশাক পরিদৃষ্টে শায়খ আব্দুন নবী তৎক্ষণাৎ সম্রাটের পোশাকের দিকে তাঁর হাতের ছড়িটি ছুড়ে মারেন ও তাঁর সঙ্গীকে বললেন পোশাকের ওই অংশ ছিঁড়ে নিতে। শায়খের সঙ্গী তাই করেছিলেন।
কম বয়সী, হতচকিত সম্রাট তাৎক্ষণিক এই ঘটনা হজম করলেও তাঁর মায়ের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তাঁর মা উপদেশ দিয়েছিলেন, ঘটনাটি অপমানজনক হলেও গুরুত্ব না দিতে।
কিন্তু আবুল ফজল গং বিষয়টিকে নিয়ে জলঘোলা শুরু করে। কোন এক দিন শায়খ আব্দুন নবী ও তার সঙ্গী কমলা রংএর দস্তরখানে কমলা রং এর খাদ্য (জাফরান) গ্রহণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে আবুল ফজল শায়খ আব্দুন নবীকে বলেন “শায়খ এটা কি করলেন কমলা রং-র দস্তরখানে জাফরান দেওয়া কমলা রং-এর খাদ্য গ্রহণ করলেন এটা কি ইসলাম বহির্ভূত নয়?” যদিও কমলা রং এর পোশাকের ব্যবহার এবং খাদ্য ও দস্তরখানে কমলা রঙের ব্যবহার ভিন্ন বিষয় ছিল তবুও দুই দৃষ্টিভঙ্গির লড়াই সম্রাটকে মাঝে মাঝে বিব্রত করে তুলতো।
বিভিন্ন বিষয়ে ফতোয়া দানকালে ইসলামী পণ্ডিতদের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং একই সঙ্গে আবুল ফজল ও ফৈজির সুযোগসন্ধানি আচরণ বাদশাহকে উত্তরোত্তর বিরক্ত করে তুলছিল। অনেকে সম্রাটের এই মানসিক পরিস্থিতিকে অস্টাদশ শতকের ইউরোপে গির্জা থেকে রাজনীতির বিচ্ছিন্নকরণের সঙ্গে তুলনা করেন। যদিও আকবরের সময় ছিল আরও ২০০ বছর আগে। তখনও পর্যন্ত ইসলাম রাষ্ট্রীয়য ধর্ম ছিল এবং রাষ্ট্র ইসলামী আইন মেনেই পরিচালিত হত।
১৫৭৭ নাগাদ আইন-শৃংখলা বিষয়ক এক অভিনব পরিস্থিতি তৈরি হয়। মথুরার কাজী সম্রাটের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেন, তিনি মসজিদ তৈরি করার জন্য কিছু নির্মাণ সামগ্রী জামা করে রেখেছিলেন। কিন্তু এলাকার এক ধনী ব্রাহ্মণ সেই সকল নির্মাণসামগ্রী জোর করে দখল করে একটি মন্দির তৈরি করে। কাজী বাধা দান করলে উক্ত ব্রাহ্মণ গালাগালি শুরু করে, মুসলিমদের ধর্ম নিয়ে গালাগালি করতে থাকে এবং নবী করীম (সোয়াল্লাল্লাহু আলাই সালাম) সম্পর্কেও গর্হীত বাক্য উচ্চারণ করে।
সম্রাটের সামনে বিষয়টি আলোচিত হলেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারা যায়নি, ফলে উক্ত ব্রাহ্মণ দীর্ঘদিন বন্দি অবস্থায় কাটান। অবশেষে বাদশাহ সাম্রাজ্যের ‘সদর উস সুদূর’ শায়খ আব্দুন নবীর কাছে বিষয়টি পেশ করেন। শায়খ কোন গড়িমসি না করেই মৃত্যুদণ্ড দেন এবং কার্যকর করা হয়। কিন্তু তাঁর এই বিচার হট্টগোল শুরু করে দেয়। সভাসদদের মধ্যে কানাঘুষো চললেও আবুল ফজল এই রায় কে সরাসরি বাড়াবাড়ি বলে উল্লেখ করেন। অন্দরমহলে স্বয়ং রানী যোধাবাঈ রাজপুত রমণীরা বিরোধিতা করেন।
রঘুনাথ রায় তার ‘থিমস অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, বাদশাহ বিভিন্ন বিষয়ে সভাসদদের মতামত নিতেন এবং মাঝে মাঝে বুদ্ধিদীপ্ত কিছু কিছু প্রশ্ন করতেন। কিন্তু ইসলামী পণ্ডিতদের কট্টরপন্থা ও অসহিষ্ণুতা দেখে তিনি বিরক্ত হয়ে পড়তেন। রুবিলাল তাঁর বই ‘ডোমেস্টিসিটি অ্যান্ড পাওয়ার ইন এ্যারলি মুঘল এম্পায়ার’ বইয়ে শায়খ সম্পর্কে খুব একটা ভালো কথা লেখেননি। তিনি বলেছেন আব্দুন নবী একাকী নির্জনবাসীব এক মহিলার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। সম্রাট শায়খের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়া এমনকি হত্যার অভিযোগও পান। আকবর শায়খ কে সরিয়ে সুলতান খাবজিকে সদর উস সুদূর পদটি দেন।
পরিণত বয়সে সম্রাট নিত্যদিনের এই তরজা থেকে বাঁচার জন্য নিজেকেই মুজতাহিদ ঘোষণা করলেন। তিনি নিজেই হয়ে গেলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আলেম ও ফতোয়া দানকারী। এই অবস্থায় শায়খ আব্দুল নবী এবং দরবারের অন্যান্য আলেমদের প্রয়োজন ফুরিয়ে আসল।
তিনি মখদুম উল মুলককে সরাসরি বরখাস্ত করলেন এবং আগ্রা থেকে থেকে দূরে নির্বাসিত করলেন। শায়খ আব্দুন নবীকে সসম্মানে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে হজে পাঠিয়ে দিলেন। সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু টাকাও দেন দরিদ্রদের মধ্যে বিতরনের জন্য। হজ থেকে ফিরে এসে পদচ্যুত, নিগৃহীত শায়খ একাকী নির্জনবাসী মহিলার নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। আকবর তাঁর কাছে মক্কা যাওয়ার প্রাকালে দেওয়া টাকা-পয়সার হিসাব চান। স্বাভাবিকভাবেই তিনি হিসাব দিতে পারেননি। শুধুমাত্র এই অপরাধে ১৫৮৪ নাগাদ তাঁকে বন্দি করা হয় এবং ১৫৮৫ নাগাদ তাঁকে হত্যা করা হয়। বোঝাই যাচ্ছে এক ধর্মপ্রাণ মুসলিমকে চক্রান্তের বলি হতে হয়েছিল। চক্রান্ত রচিত হয়েছিল সম্রাটের নবরত্ন সভার নবরত্নদের মধ্য থেকেই। ফল হয়েছিল সম্রাটের সুখী, আরামপ্রিয় নবরত্ন যথেচ্ছাচারের লাইসেন্স পেয়েছিল এবং এই ফাঁকে সম্রাটও বহুশত্নি গ্রহনের মত যথেচ্ছাচার করার লাইসেন্স পেয়ে যান, কলুষিত হয় সম্রাটের ধর্মচিন্তাও।
মোটামু তোমার দুপুরবেলা বালা ফুচকা খাবো ম্যাচের কাট লেগা সী মরে বাংলা বাচ্চাটি রক্ষণশীল ইতিহাসবিদ বাদায়ুনি শায়খের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। তিনিও শায়খকে ধর্মীয় কট্ররপন্থার জন্য দায়ী করেছেন।
বোঝায় যাচ্ছে আকবরের ধর্মচিন্তা যে সঠিক পথ ধরে চলছিল কয়েকজনের ধর্মীয় বাড়াবাড়ির ফলে তা ভিন্ন খাতে বইতে থাকে। কিন্তু আমার মনে হয় আবুল ফজল ও ফৈজি এই দুই ভাইয়ের পরিকল্পিত চক্রান্ত সম্রাট আকবরকে দ্বীন-ই-ইলাহীর মত ধর্ম প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আবুল ফজল পরে ইলাহি ধর্ম গ্রহণ করে। আবুল ফজলের ধর্মচিন্তা ঢিলেঢালা ছিল। আবুল ফজলের পিতা নিজেকে সুফি-সাধক বলতেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি কি ছিলেন তা কেউ বলতে পারেন না।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।