লিখেছেনঃ ড: মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যান
বিশ্ববিখ্যাত জার্মান চিন্তাবিদ যিনি ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামী গবেষণায় আত্মনিযয়োগ করেন
‘মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা’ এ বিষয়ে গভীর প্রবেশের আগে মুসলিম বুদ্ধিজীবী কথাটির অর্থের ব্যাপারে একমত হওয়া প্রয়োজন।
‘মুসলিম’ শব্দটি আল-কোরআনে বেশ ভালোভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। মুসলিম হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেন, নেক আমল করেন। এবং ইবরাহীমের আদর্শ অনুসরণ করেন। [৪:১২৫]; যিনি বিশ্বাস রাখেন আল্লাহ ও তার রাসুলদের প্রতি এবং পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের প্রতি [৪:১৩৬]; ভালো কাজের আদেশ করেন, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখেন, নামায কায়েম করেন, যাকাত আদায় করেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মেনে চলেন। [৯:৭১]।
বুদ্ধিজীবী বা Intellectual শব্দটির অর্থ নির্ণয় করা বেশ কঠিন এবং আল-কোরআনে এই শব্দটি সংজ্ঞায়িত হয়নি। আসলে এই শব্দের ব্যবহার শুরু হয়েছে উনিশ শতকের শেষের দিকে। প্রাসঙ্গিক উদ্দেশ্যের কারণেই এখানে প্রত্যেক সংস্কৃতিবান (Cultured); বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি (Academically Trained) আরবীতে ‘আল মুফাসসিকুন’-কে বুদ্ধিজীবী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার প্রস্তাব রাখা হচ্ছে না। বরং এই শব্দটি আরবী ‘আল-মুফাক্কিরুন’-এর মধ্যে দৃঢ়ভাবে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে বর্তমান। আলোচনা, যার অর্থ হলো- বিশ্লেষণাত্মক মন ও মনন (Analytic mind)-এর অধিকারী, যিনি তার বাগ্মিতা বা ভাষণ অথবা লেখা প্রকাশনার মাধ্যমে কোন মতামত বিনিময়ের ক্ষেত্রে নেতৃত্ত্ব দিতে সক্ষম এবং এভাবে যোগাযোগে তার দক্ষতা প্রমাণ করেন, শুধু ঘরে বসে চিন্তা ও সমালোচনা নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেন না। কাজেই আমরা জানি যে, বুদ্ধিজীবী কি বা কে, কিন্তু আসলেই কি এ ধরনের ব্যক্তিত্বের কোন উদাহরণ আমাদের সামনে আছে?
এ কথা তো সবারই জানা যে, ইউরোপ, এমনকি কামালের তুকী এলিট সম্প্রদায়ও এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন যে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস বা আন্তরিকতার এবং বুদ্ধিমান হওয়ার মাধ্যে একটি পারস্পরিক বিরোধ আছে। আর সহজভাবে বলতে গেলে তারা মনে করেন যিনি ধর্মে বা স্রষ্টায় বিশ্বাস রাখেন, তার মাথায় কোন বুদ্ধি নেই। আবার বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্রই আল্লাহকে (বা ধর্মকে) বিশ্বাস করেন না। আসলে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে বর্তমান সময় অবধি পাশ্চাত্য ও তুর্কী শিক্ষিতমহল জড়বাদী (agnostic) বা নাস্তিক (Atheist) হওয়াকে বুদ্ধিবৃত্তিক শৈলীর পরিচায়ক (Intellectually ehic) বিবেচনা করতেন; বিশেষত কেউ যদি হন বামপন্থী তাহলে তো কথাই নেই, যেন বুদ্ধিবৃত্তি (Intellectualism) বামপন্থীদের একচেটিয়া অধিকার এবং রক্ষণশীলদের এতে কোন প্রবেশাধিকার নেই।
সেই যুক্তি ও বিজ্ঞানের বিকাশকাল (Enlightement) থেকে এখন পর্যন্ত এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করা হয়। এর বীজ হয় ১৭ শতকে ডেসক টেসের মাধ্যমে, স্রষ্টা এর ফুল ফুটতে শুরু করে ১৮ শতকে এবং পরিপূর্ণভাবে পত্র পুষ্পে পল্লবিত হয়ে ওঠে উনিশ শতকে। তথাকথিত Project of modemnity ছিল মূলত ইউরোপে খ্রিস্টান যাজক সম্প্রদায়ের ক্রমাগত আধিপত্য থেকে দাসত্ব মোচনের আন্দোলন। এই আন্দোলন মানুষের যুক্তিকে যে অন্তর্দৃষ্টি বা অন্তর্জ্ঞান বা উপলব্ধির উৎস (Source of insight) থেকে শ্রেষ্ঠতর বিবেচনা করতো। কিন্তু জনপ্রিয় চিন্তাবিদ বিজ্ঞানী মার্ক্স, ডারউইন, ফ্রয়েড, নিয়েৎজ সার্জে এবং অন্যান্যের কারণে এই দাসত্ব মােচন আন্দোলন স্থূল বস্তুবাদ এবং চর্চিত নাস্তিকতায় রূপ নিয়েছে।
যুক্তিবাদের এহেন বিকাশ কি তার প্রতিশ্রুতিমাফিক শান্তি, সুখ, রাজনৈতিক উন্নয়ন আনতে পেরেছে দুনিয়াতে? বরং ধর্মচ্যুত এবং সংস্কারমুক্ত মানুষ একের পর এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, এর মধ্যে আছে দু’টি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ, লক্ষ লক্ষ নির্দোষ লোকের প্রাণহানি, এমনকি পারমাণবিক বিস্ফোরণও।
তথাকথিত যুক্তিবাদের এই আধিপত্যকালে অধার্মিক আধুনিক মানুষেরা বিচিত্র সব মতাদর্শের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে। ইতিহাস প্রমাণ করে যে, এই নির্যাতন ধর্মীয় নিষ্পেষণের মাত্রাকে ভয়াবহ রকম ছাড়িয়ে গেছে। এসবের উদাহরণ হলো নাৎসীবাদ, ফ্যাসিবাদ, কম্যুনিজম এবং শ্যেভিনিজম। লক্ষ লক্ষ মানুষকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে রাজনৈতিক অথবা জাতিগত ভিন্নতার জের ধরে হত্যা করা হয়েছে। মানুষ তার ঔদ্ধত্য দিয়ে পারিপার্শ্বিক জগৎটাকে ধ্বংস করেছে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে আর AIDS BSE-এর মতো রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটিয়ে।
লক্ষণীয় যে, এসব ব্যর্থতা এবং অক্ষমতা পাশ্চাত্যে বিশালসংখ্যক লোকজনের অহমিকাকে নাড়া দেয়নি। এরা বিভোর হয়ে আছে আমেরিকান জীবনযাত্রার সর্বাত্মক অনুকরণ এবং বুদ্ধিবর্জিত সমর্থনে। তারা ভাবছেই না যে, কি যুক্তি থাকতে পারে এরকম জীবনযাপনে।
আরও লক্ষণীয় যে, কিছু মুসলিম দেশ এবং পাশ্চাত্যের তথাকথিত এলিট সম্প্রদায় এখনও উনিশ শতকে বেড়ে ওঠা শিশুর মতোই আচরণ করছেন। তারা উপলব্ধি করতে পারছে না যে, বিজ্ঞান ও দর্শন ক্রমেই সরে যাচ্ছে বস্তুবাদ ও নাস্তিকতা থেকে। আসলে মুসলিম দেশগুলোর এলিট সম্প্রদায়ের কিছু সদস্য আছেন, যারা ধ্যান-ধারণায়, চাল-চলনে পাশ্চাত্যের অনুকরণে বেশ গর্বিত বোধ করেন; এরা একটা ব্যাপারে পুরোপুরি অচেতন হয়ে আছেন যে, বাঘা বাঘা সব বুদ্ধিজীবী (Intellectual giant) এবং নোবেল পুরস্কা বিজয়ী বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, প্ল্যাংক, হাইজেনবার্গ, শ্রডিনজার, ইক্সলস এবং ওয়েইজস্যাকার এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন আস্তিক এবং তাঁরা স্রষ্টাকে ভয় করতেন।
এ গর্বিত এলিটবৃন্দ এটাও উপলব্ধি করতে পারেন না যে, আধুনিক অণুবিজ্ঞানীদের কাছে শক্তির অস্তিত্ব এখন আর অবিশ্বাস্য নয়। সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বরং বস্তুর প্রতিষ্ঠা। অথবা তারা এটাও উপলব্ধি করতে পারেন না যে, একজন নাস্তিক হতেও পারাটা না যুক্তিসম্মত, না বিজ্ঞানসম্মত। যেহেতু স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই—এটা যেমন প্রমাণিত নয়, তেমন প্রমাণ করাও যাবে না। অন্যদিকে প্রকৃতি বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকবৃন্দ, যেমন সুইনবার্গ, এখন উপসংহার টানছেন এই বলে যে, ‘স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই’, এটি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একেবারেই অসম্ভব একটি ধারণা। কিন্তু আমাদের তথাকথিত এলিটবৃন্দ এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন, তাঁরা দেশ এবং সমাজ থেকে ধর্মকে বেশ সফলভাবেই বিতাড়িত করতে পেরেছেন। বাস্তব ব্যাপারটা হচ্ছে তার এক ধর্মকে প্রতিস্থাপন করেছেন অন্য ধর্ম দেয় বা ধর্মীয় আবহের কোন ধারণা। (Pseudoreligion), ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism), প্রগতিবাদ (Progress), বিজ্ঞানবাদ (Ecientism) অথবা আধুনিকতা (Modernism) দিয়ে।
অতঃপর মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের প্রথম কাজ হলো দর্শনশাস্ত্র এবং বিজ্ঞান শাস্ত্রে যোগ্য হয়ে নাস্তিকতার থিওরির ভিত্তিতেই নাস্তিকতাকে চ্যালেঞ্জ করা; এটা প্রমাণ করা যে, যে কেউ সুশিক্ষিত এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ হওয়ার পাশাপাশি ভালো মুসলিম বুদ্ধিজীবীরাই এটা প্রমাণ করতে পারেন যে, নিজেকে নাস্তিক হিসেবে দাবি করা মানে বুদ্ধিবৃত্তির প্রাখর্য নয়, বরং এটাই হলো বুদ্ধিহীনতা।
একটি দুঃখজনক অবস্থা এই গুরুদায়িত্বের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। কোরআনে বারবার মানুষকে বলা হয়েছে তার যুক্তিকে কাজে লাগাতে, প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করতে, চিন্তা করতে এবং তার চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে। প্রকৃতপক্ষে অন্য কোন পবিত্র ধর্মগ্রন্থে এ ব্যাপারটার উল্লেখ নেই। এটা খুব ভালোভাবেই জানা কথা যে, এরই ফলশ্রুতিতে নবম থেকে পনের শতক পর্যন্ত মুসলিম সভ্যতা বাগদাদ থেকে আন্দালুসিয়া, ফেজ থেকে সমরকন্দ, জ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে চমক সৃষ্টি করেছিল।
অনেক মুসলিম, বর্তমানে ইসলামের সেই সোনালী যুগের কথা স্মরণ করে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হন-যেন আজকের এই দুঃখ দুর্দশার অবসান ঘটবে শুধু অলস স্মৃতিচারণেই, যেন যথেষ্ট প্রচেষ্টা ছাড়াই ইসলাম সেই উৎকর্ষের গ্যারান্টি দিতে বাধ্য।
সেই মর্যাদাকর অবস্থান থেকে এক সময় ইউরোপীয় উপনিবেশে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে যে অধঃপতন ঘটে মুসলিম বিশ্বের, তার পেছনে রয়েছে অনেক জটিল কারণ। কিন্তু অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত না করলেও দেখা যায়, ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত মুসলিম বিশ্ব এখনও রয়েছে পাশ্চাত্যের কায়েমী আধিপত্যে। আধুনিকতা পরবর্তী (Post modern) বিশ্বের এটা এমন এক চিত্র, যেখানে আমেরিকান জীবনযাত্রা সর্বাত্মমূলক এবং একমাত্র গ্রহণযোগ্য জীবনযাত্রা। এই অবস্থা কোন পলিসির মাধ্যমে পরিকল্পিত উপায়ে সৃষ্টি হয়নি। সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের ব্যাপারটাই হলো বেনামী, যার পেছনে ছিল না কোন মাস্টার প্ল্যান বা পরিকল্পক। সত্যি কথা হলো, বিল গেটস এবং এ ধরনের কিছু ব্যক্তি স্রেফ মনের আনন্দে এমন কিছু কাজ নিয়ে মেতে আছেন, যা খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং সারা পৃথিবী ও ইন্টারনেট ধরনের কিছু মেশিন বা ডিভাইস (Gadget) এর নিত্য নতুন চমকে অভিভূত (Affected) এবং সংক্রমিত (infected) হতাশাবাদীরা বলেন যে, প্রযুক্তি অগ্রসরতা বা আধুনিকায়ন (Modernisation) কেবল অনস্বীকার্যই নয়, উপরন্তু পাশ্চাত্যকরণ থেকে একে কিছুতেই পৃথক করা যায় না। অর্থাৎ কোন দেশ বা সমাজ প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গ্রহণে বাধ্য। তারা মনে করেন, প্রযুক্তির উনয়ন এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্য। এ ধরনের কথা তারা বলেন, কারণ প্রত্যেক প্রযুক্তিগত পদ্ধতি বা পণ্য এবং প্রত্যেক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানই এর পেছনে কার্যরত একটি মানসিক প্রক্রিয়ার ফসল। এর মানে, যেমন কেউ যদি স্যাটেলাইট বা ক্যাবল টিভির প্রতি তর্জনী তুলে শাসায়, তাহলে তার পুরো হাতকেই সে খেয়ে নেবে। তার ক্ষমতাকে পুরোপুরি গলাধঃকরণ করার মতো। ক্ষমতা এই স্যাটেলাইট চ্যানেল বা ক্যাবল টিভি রাখে এবং এরই ফলস্বরূপ একদিন সে নিজের টিভি স্ক্রিনে পর্নোগ্রাফির সামনে বসে থাকতে বাধ্য হবে। এটা হতাশাবাদীদের ধারণা।
ব্যাপারটা আরেকটু ব্যাখ্যা করলে স্পষ্ট হয়—বর্তমানে অধিকাংশ প্রযুক্তিগত আবিষ্কার, পণ্য পদ্ধতি বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ধারণাসমূহের বিকাশ এবং বিজ্ঞাপন পাশ্চাত্য দেশগুলো থেকে চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের এইসব কর্মকাণ্ড তাদের চাহিদা থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যাতে প্রতিফলন ঘটেছে তাদের জীবনধারা ও সমাজব্যবস্থার বিশেষ রূপটি। ফলত অনেকেরই মনে এরকম একটি ভ্রান্ত ধারণা জন্মে যে, তাদের প্রযুক্তি গ্রহণ করলে তাদের জীবনযাত্রা নেয়া বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। অথচ এসব প্রযুক্তিকে যে সুন্দর কোন লক্ষ্য মোতাবেক পরিচালনা করা যায়, সেখানেও প্রতিফলন ঘটানো যায় স্বতন্ত্র বিশ্বাসের, সে ব্যাপারে এরা অমনোযোগী থাকে না। বর্তমান আলোচনায় এই বিশ্বাস স্পষ্ট, এমন কি অধ্যাপক স্যামুয়েল হান্টিংটন নিজেও জীবনে প্রথমবার ১৯৯৬ সালে সৌদি আরব। ভ্রমণের পর এখন বিশ্বাস করেন যে, পাশ্চাত্যকরণ ছাড়াই আধুনিকায়ন সম্ভব। এই আশাবাদ তিনটি শক্তিশালী দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে প্রতিষ্টিত ইবাদী দক্ষিণ আলজেরীয় M’zab অঞ্চল, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া। চমৎকার আধুনিকায়নের কয়েক দশক পরে সৌদি তরুণ বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে ১৫ বছর আগের চেয়ে কম নয়; বরং অনেক বেশী অনুরক্ত হতে দেখা গেছে অর্থোডক্সি ইসলামের প্রতি। যাই হোক, প্রযুক্তির নবরীতি এবং পাশ্চাত্যকরণকে পৃথক রাখার জন্য শর্ত হিসাবে প্রয়োজন শিক্ষা, সম্প্রচার মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু সেন্সরশীপ ও সব ধরনের পুলিসি তৎপরতার পাশাপাশি একটি স্বচ্ছ ও মজবুত সরকারী নীতিমালা, যতক্ষণ না তৃণমূল পর্যায় থেকে মুসলিম সমাজ পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়। তৃণমূল পর্যায়কে ধন্যবাদ এ জন্যই যে, এখানে ঈমান এবং ইসলামের প্রতি আত্মনিবেদনের সজীবতা এখনও বিদ্যমান এবং ভোক্তার স্বার্থসংরক্ষণের (Consumerism) প্রলোভন থেকে তা নিরাপদ ও মুক্ত।
(উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাজারে নিত্য নতুন পণ্যের চমক। এসব পণ্যের লোভনীয় বিজ্ঞাপনে একশ্রেণীর ভোক্তা আকৃষ্ট হয়। এরা তাদের জীবনযাত্রায় তথাকথিত স্ট্যাটাস বজায় রাখার মোহে অপ্রয়োজনীয় সব পণ্যসামগ্রী ক্রয়ে হিড়িক লাগায়। তৃণমূল সম্প্রদায় এই অপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ে সংযম অবলম্বন করে। ফলে তা আকর্ষণীয় প্রচারের অহেতুক প্রলোভন থেকে মুক্ত)।
যতই হোক পাশ্চাত্য সভ্যতার বিরুদ্ধে টিকে থাকার সংগ্রামে মুসলিম বিশ্বের অগ্রগতি স্থবিরতার শিকার। কিছু নৈর্যব্যঞ্জক অবস্থার দৃষ্টান্ত হচ্ছে এরকম-
বছরকে বছর নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের মধ্যে কোন মুসলিমকে দেখা যায় না।
প্রতি বছর শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর ৫৫,০০০ বই প্রকাশিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে কোন গাড়ির চেয়ে কম্পিউটারের সংখ্যা অনেক বেশি এবং তাদের ৬০ শতাংশ জনগণই কম্পিউটার নেটওয়ার্কে কোন কোনভাবে জড়িত।
পাশ্চাত্যে যেখানে প্রতি এক মিলিয়ন লোকের মধ্যে ৩৮০০ জনই বিজ্ঞানী সেখানে দক্ষিণ বিশ্বে এই সংখ্যা মোট ২০০ জন।
এই পটভূমির বিরুদ্ধে বিশ্ব ব্যাংকের ইন্দোনেশীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরাগেলডিন সম্প্রতি লিখেছেন : পৃথিবী যখন বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে জীবনতত্ত্বের চমক ভাঙছে পরমাণুর রহস্য, পৌঁছে যাচ্ছে তারকাপুঞ্জে এবং হিসাব কষছে শিলার বয়স আমরা মুসলিমরা বিতর্কে লিপ্ত হই মেয়েদের নখে নেইলপালিশ থাকলে পুরোপুরি ওযু হয় কিনা— আসলেই সৌদি পত্রিকার সম্পাদকের কাছে যে প্রশ্নগুলো বারবার উত্থাপিত হতে দেখা যায়, তাতে জনাব সেরাগেলডিনের এই বক্তব্যকে সঠিক বলেই ধারণা জন্মে। লোকে অনুসব্ধিৎসু হয় যত ক্ষুদ্র বিষয়ে-স্বর্ণের দাঁত লাগালো, অথবা একজন বিধর্মী বা অবিশ্বাসী। (nonbeliever) কে কোরআন দেয়া বা পাশ্চাত্য আইন পড়া ইসলাম ধর্মে অনুমোদিত কিনা।
কাজেই মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের দ্বিতীয় কাজ রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অর্থনীতির চর্চায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করার মাধ্যমে সমকালীন প্রশ্নের জবাব দেওয়া, বর্তমান সমস্যার সমাধানকল্পে কাজ করা এবং একই সাথে প্রকৃতি বিজ্ঞান চর্চা থেকে নিজেদেরকে দূরে না সরিয়ে রাখা। বিজ্ঞানের চেয়ে আল-আদাবের চর্চাকে যে সময়টাতে বেশি সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হত, তা এখন অবশ্যই অতীতের অংশ হওয়া উচিত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামের প্রতিরক্ষায় এবং প্রসারে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সমাধান কি? এটা হলো জনমনে ইসলাম সম্পর্কে যে সব ভুল ধারণা জেঁকে বসেছে, তার নিরসন ঘটানো। এটা তাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে, গণতন্ত্র, নারী অধিকার ও মানবাধিকার প্রশ্নে ইসলাম যোগ্যতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ, আধুনিক অর্থনীতি সম্পর্কে এতে কোনো স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় না এবং দাওয়াহ বা প্রচারকার্যে বুঝি ইসলাম সন্ত্রাসমূলক : কর্মকাণ্ডকে অনুমোদন দেয়। এসব জরুরী ক্ষেত্রগুলোতে প্রতিবেদন বা আলোচনাধর্মী প্রস্তুতি মূলক কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত করাই হলো মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের তৃতীয় কাজ।
আলহামদুলিল্লাহ, অনেক বিষয়ের ওপরই ইতিমধ্যে প্রচুর কাজ হয়েছে। এজন্য বিশেষ ধন্যবাদের দাবিদার হলো দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টা ওয়াশিংটনের নিকটবর্তী International Institute of Islamic Thought (IIIT) এবং ইসলামাবাদের International Research Institute। আসলে ইংরেজিতে এদের গুরুত্বপূর্ণ চটি বইগুলো প্রমাণ করছে যে,
- পরামর্শ (শূরা) ভিত্তিক ও খিলাফতভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মুসলিম রাষ্ট্রের থাকতে পারে বহুদলীয় গণতন্ত্র, পার্লামেন্টারি প্রজাতন্ত্র এবং লাভ-লােকসানের শেয়ারের মাধ্যমে | এখানে থাকতে পারে একটি সুদমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
- কোরআনের সুরা নিসার ৩৪নং আয়াতে নারীদেরকে যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, অনেক মুসলিম দেশেই তার চর্চা হয় না। (এবং মেয়েরা তাদের উপযুক্ত মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়)।
- ‘দীনের ব্যাপারে কোনো জোরজবরদস্তি নেই’ [২: ২৫৬]-এর ভিত্তিতে কোনো অবস্থাতেই ইসলাম দাওয়াহ বা প্রচার কার্যক্রমে বলপ্রয়োগকে অনুমোদন করে না। মুহাম্মদ (সাঃ) কখনও এক্ষেত্রে বলপ্রয়োগকে অনুমোদন করেননি।
এমনকী মক্কায় শত্রুপক্ষের শক্তির মোকাবিলার সময়ও।
ইসলামকে বুদ্ধিজীবীর ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় শুধুমাত্র কোরআন, হাদীস গ্রন্থ এবং ফিকহ বা আইনশাস্ত্রের কারণেই। এটা কি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ নয় যে, কোরআনের সর্বপ্রথম আয়াতগুলোতেই পড়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে লেখনী, শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের কথা [সূরা আলাক প্রথম পাঁচ আয়াত]? এবং এসবই কি বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যাবলী নয়?
এ বিষয়ে অধিকতর জরুরী যে সত্য, তা হলো— ইসলাম ভেতরে-বাইরে সর্বাত্মক একটি পরিমার্জিত ধর্ম, যার নির্দেশনা— যাবতীয় যাদু ও অতিলৌকিক ধারণা দ্বারা বিভ্রান্ত নয়— শুধুমাত্র ওহী নাযিল এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। একজন মুসলিম অবশ্যই যুক্তিহীন ত্রিত্ববাদ, দীক্ষাদান, পরিত্রাণ (Salvation) জন্ম পাপ সংক্রান্ত তত্ত্ব বা তথ্যসমূহ বিশ্বাস করতে বাধ্য নয়।।
* [খ্রিস্টানদের মতে, ত্রিত্ববাদ হলো নারী এবং পুরুষের সমন্বয়ে খোদা একজন প্রকৃত মানুষ, যিনি জমিনে বিচরণ করেছেন এবং মানুষ যা করে সব কিছু করেছেন, মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করা-সহ। আবার জীবনে এসে পরিত্রাণ লাভ করেছেন। তাঁর আশ্বাস বা করুণা (Grace) একজন উসিলা বা মাধ্যম দ্বারা বর্ষিত হয়। এই মাধ্যমকে পূর্বশর্ত হিসেবে হতে হবে এমন একজন, যাকে দীক্ষা নিতে হবে, তারপরই তাঁর চিন্তা হবে স্রষ্টার সংবাদবাহী (Communicant)।
সামগ্রিক ধারণাটাই যুক্তির সাপেক্ষে অসঙ্গতিপূর্ণ, বিভ্রান্তিকর, আনাড়ি এবং ভিত্তিহীন। ব্যাখ্যার জন্য AL-TAWHID : Its Implications for Thought and Life, ইসমাইল রাজী আল ফারূকী, দ্রষ্টব্য, অনুবাদ গ্রন্থ BIT কর্তৃক প্রকাশিত।] এ-কথাও বলা হচ্ছে না যে, কোরআনের প্রতিটি আয়াত বা শিক্ষাই মানুষের যুক্তিগম্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়— তাকদীর (যা পূর্বনির্ধারিত) এবং স্বাধীন ইচ্ছার বাস্তবায়ন এ দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক এবং তার মাত্রা কিভাবে আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব?
এই বিষয়ে অন্যভাবে বলা যায় : কোরআন এবং সুন্নাতে বর্ণিত একশ’র অধিক আসমাউল হুসনার বর্ণনা সত্ত্বেও স্রষ্টা সম্পর্কিত ইসলামী ধারণা এতই বিমূর্ত যে, বুদ্ধিজীবী নয় এমন অনেক মুসলিম প্রায়শই বিষয়টি চিন্তা করতে গিয়ে জটিলতার মুখোমুখি হন। অন্যদিকে বুদ্ধিজীবী মুসলিম উপলব্ধি করতে গিয়ে পারেন যে, আল্লাহকে বর্ণনা করা যায়। ঋণাত্মকভাবে বা না-বোধক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে, তিনি কেমন হতে পারেন না? (যার অস্তিত্ব নেই বা Non-existent, যিনি অনেক প্রভুর মধ্যে একজন অথবা যিনি মরণশীল)। এ বিষয়ে তারা পূর্ণভাবে সজ্ঞান যে, আল্লাহকে কোনোভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায় না, যেহেতু আমাদের পরিচিত বা জানা কোনোকিছুর সাথেই তাকে তুলনা করা অবান্তর : কোনোকিছুই তার সঙ্গে তুলনীয় নয়, সুরা ইখলাস : ৪। একই সাথে তিনি সর্বব্যাপী, মানুষের কাছে তার ঘাড়ের রগেরও বেশী নিকটবর্তী এবং তিনি ইন্দ্রিয়াতীত, যিনি তাঁর সম্পর্কে যাবতীয় দাবী ও বিবরণকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করে যান : দার্শনিক নয়, এমন মনন কিভাবে এই বিষয়টি বুঝতে বা মানতে সক্ষম হতে পারে? এই পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে এটা খুব স্বাভাবিক মনে হয়, যখন কতিপয় খ্রিস্টানের মত কতিপয় মুসলিমও স্রষ্টার নৈকট্যশীল হওয়ার বা তাকে স্পর্শ করার কোন না কোন উপায় খোঁজে। এটা Baby Jesus Syndrm কে বিখ্যাত হরে – কৃষ্ণ গানের কথা দিয়ে ভালোমত প্রকাশ করা যেতে পারে : “Oh my Lord, I really want to see you! really want to feel you.” এই মূল চাওয়াটাই আলী এবং হুসেইনকে ঘিরে শিয়াবিশ্বের আত্মনিবেদন (Devotion)কে ব্যাখ্যা করে। আবার এটাই দরবেশ ও তাদের মাযারের প্রতি কিছু মুসলিমের (বিশেষত পশ্চিমাঞ্চলে), ভক্তির অন্যতম কারণ, যার অস্তিত্ব আদি ও অকৃত্রিম ইসলামে (pristine Islam) একেবারেই নেই। এনম্যারী শিমেলের মে সাম্প্রতিক বই (Deciphering the sings of God) পড়তে গিয়ে সত্যিই মর্মাহত হতে হয় যে, কী পরিমাণ কসংস্কার, ব্ল্যাক ম্যাজিক ইসলামের নাম করে মুসলিমদের জীবনযাত্রায় ঢুকে গিয়েছে। এমনকি আধনিক তুরস্কও এর ব্যতিক্রম নয়। ফাল এর চর্চা (কফির গুঁড়া দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা) খুবই গুরুত্বের সাথে গৃহীত হচ্ছে এবং যথারীতি সেটা শিরক-এর ভিন্ন সংস্করণসহ বটে।
কাজেই মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের চতুর্থ কাজটি হলো—সর্বজনীন ধর্মীয় শিক্ষাকে এমন পর্যায়ে উন্নীত করা যেখানে—বাবা, দাদা, পীর, হযরত এবং তথাকথিত মাওলানাদের ভূমিকা হবে আগের চেয়েও কম। একই সাথে এহেন বুদ্ধিজীবীদের উচিত হবে নামায, রোযা বা এ ধরনের ইবাদতকে শুষ্ক, একঘেয়ে রুটিন বা সামরিক কুচকাওয়াজে পরিণত না করে ইবাদতের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নয়ন ঘটানো। এরকম অনেক খুৎবাই শোনা যায়, যা শুনলে মনে হয় কোন নিয়তি নির্ধারিত যুদ্ধের জন্য এক জেনারেলের আবেগপ্রবণ আহ্বান। এসব খুৎবা উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার বুদ্ধিজীবী ফ্যাকাল্টির জন্য মর্মস্পর্শী বা ঈর্ষণীয় অথবা তাদের বুদ্ধি ও অনুভূতিকে নাড়া দেয়ার মত হয় না।
অবশ্যই কিছু দেশে যথাযথ ইসলামী শিক্ষা নেই। দাদীর কাছ থেকে নাতি-নাতনীর কাছে মুসলিম বিশ্বাসের যে অবশিষ্টাংশ পৌঁছে, তার সাথে তুলনা চলে ঠাকুরমার ঝুলি থেকে বেরুনো গল্পের। মসজিদের মিম্বর থেকে যোগ্যতার সাথে ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসার ঘটেনি। এই অবস্থা উপলব্ধি করার অর্থ এটা নয় যে, এহেন পরিস্থিতি মেনে নিতে হবে।
এর মোগাবিলায় মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের পঞ্চম কাজ হলো ভাষাগত ব্যবধান জয় করা, যে ব্যবধান মুসলিম বিশ্বের বেশীর ভাগ অংশেই দেখা যায়। শুনতে বিস্ময়কর লাগতে পারে যে, বর্তমানে ইসলামের রয়েছে দুইটি ভাষা : আরবী ও ইংরেজী। অন্য যে কোন ভাষার চেয়ে বর্তমানে ইংরেজী ভাষাতেই ইসলামের সপর বেশি লেখা ছাপা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের কাছে লিসেস্টার-এ মুসলিম বিশ্বের বই পর্যালোচনা (Muslim world Book Review) ইংরেজীতে প্রকাশিত ইসলামী সাহিত্যের একটি তালিকা ছাপে, যাতে প্রতি বছর প্রায় ৫,০০০টি নতুন সাহিত্য এই তালিকায় যুক্ত হয়। এসবের অধিকাংশই । আরবী এবং তুর্কী ভাষায় অনুবাদ করা প্রয়ােজন, যেমন ইস্তাম্বুলে হাসান গুনেস ইতিমধ্যে অনেক অগ্রসর হয়েছেন তার Islamic sosyal Bilimler Dergisi’র মাধ্যমে এটি হলো AJISS থেকে সংগৃহীত ইসলামী সাহিত্যের একটি অনুবাদ।
একই কথা প্রযোজ্য আরবী উৎস থেকে ইংরেজীতে অনুবাদের ক্ষেত্রেও। আপাতদৃষ্টে মিশরে সিরিয়া ও লেবাননের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের চমৎকার সব বিতর্কের ফলাফল ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপীয় এবং তুর্কী মুসলিমদের মধ্যে। একথা যেমন সত্যি যে, ইবনে কাসীল, মওদুদী এবং সাইদ কুতুবের কোরআনের তাফসীর (ব্যাখ্যা গ্রন্থ) তুর্কী ভাষায় অনূদিত হয়েছে, তেমনি এটাও সত্যি যে, তা হয়েছে সময়ের এক বিশাল ব্যবধানে।
ইসলামের জন্য জিহাদ নিঃসন্দেহে জনগণের সমস্ত অন্তরাত্মা জয়ের জন্য যুদ্ধ, যা কখনো মেশিনগান দিয়ে জয় করা যায় না। যেখানেই এই উদ্দেশ্যে জিহাদ হয়েছে সেখানেই বিজয় এসেছে মিডিয়ার কারণে। এটাই হচ্ছে সেই যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা দক্ষতার সাথে স্বচ্ছন্দে লড়তে পারেন, যদি তার ষষ্ঠ কাজটি সুচারুরূপে সম্পূর্ণ করতে চান। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ক্ষেত্রটিতে মুসলিমদের অনেক কিছু শিখতে হবে, শেখার আছে। রেডিও, টেলিভিশন এবং প্রকাশনার জগৎ প্রত্যেকেরই আছে নিজস্ব আইন, নিজস্ব শ্রোতা অথবা পাঠক এবং প্রত্যেকেরই আছে নিজস্ব একক বৈশিষ্ট্য। যেমন, টেলিভিশনের চেয়ে রেডিও বিস্তারিত তথ্য দিতে বেশি সক্ষম, অনেক নারী-পুরুষই তাদের কাজে যাবার পথে গাড়িতে বসে রেডিও শোনেন, আবার অনেকেই বাড়িতে বা অফিসে কর্মরত অবস্থাতেও রেডিও শোনেন।
মুসলিমরা তাদের বক্তব্য বার্তা (Story) বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবেই অদক্ষ। আরো নিখাদভাবে বলতে গেলে, তারা আসলে তাদের বার্তা (Message) বিক্রয়ে সম্মত নয়। বিবেকের এরকম অস্বস্তিবোধ এখানে অযৌক্তিক। আল-কোরআন বারবার পড়লেই দেখা যায়, আল্লাহ স্বয়ং রাসূলের প্রভাবকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাড়ানোর জন্য কিভাবে বলিষ্ঠ ও তেজস্বী অলংকারবহুল ভাষা ব্যবহার করেছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় যে, মুসলিমরা ইতিমধ্যে মিডিয়াযুদ্ধে হেরে গিয়েছে তাদের অযোগ্যতা, নিষ্ক্রিয়তা এবং অপেশাদার সুলভ মানসিকতা ও আচরণের কারণে, অথচ মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ ভূমিকা রাখার ব্যাপারে এই মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা তো দু’টি সমস্যার দিকে আলোকপাত করতে পারেন।
প্রথমত মুসলিমরা তাদের কাছেই ইসলাম প্রচারে ব্যস্ত, যারা এরই মধ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। যেমন, তুরস্কের টিভি চ্যানেলগুলো সাধারণ তারাই দেখেন, যারা ইসলামের ব্যাপারে ভালোই প্রভাবিত হয়েছেন। টিভির ধর্মপ্রচারক শুধু তাদের কাছেই এর বার্তা প্রচার করে ক্ষান্ত থাকেন, যারা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন যে, প্রভু একজন এবং মুহাম্মদ (সাঃ) তার রাসূল। কাজেই এখন তো এ ধরনের দর্শক-শ্রোতার জন্য প্রয়োজন এমনসব বিষয়াদি, উপকরণ বা মালমসলা (Materials) যা অবিশ্বাসীদের (None beliver) সাথে এসব প্রসঙ্গে আলোচনার সময় তাদের প্রয়োজন হতে পারে।
দ্বিতীয়ত বিধর্মী বা অবিশ্বাসীদের (None beliver) কাছে নিজেদের আদর্শ বা জীবনবিধান মেলে ধরার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা যথেষ্ট আনাড়ী এবং ভুলে ভরা। যে কিনা আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কেই বিশ্বাস রাখে না বা সংশয়ী, সে কিভাবে আল্লাহ (বা তার রাসূল) কি বলেছেন—তা শুনতে আগ্রহী হবে বা মানতে চাইবে। যদি কেউ এই ব্যাপারে দৃঢ়মূল না হতে পারেন যে, নাস্তিকতা মোটেই কোন বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি নয়, শুধুমাত্র কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে তার কাছ থেকে কোন কিছুই আশা করা যায় না। (আল্লাহ আছেন কিনা, তা প্রমাণ করা সম্ভব এভাবে যে, তিনি নিজেই কোরআনে নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি আছেন। এই যক্তি বৃত্তাকার একটি পথের মত, যা যেখান থেকে শুরু হয় সেখানে গিয়েই শেষ হয়)। কাজেই, মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের উচিত বিধর্মী বা অবিশ্বাসীদের বিশেষ উদ্দেশ্য করে তাদের পূর্ব সংস্কার, তাদের বিশাস বা আদর্শের সামগ্রিক দিক এবং তাদের মনস্তত্ত্ব নিয়েই বই লেখা! সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আজকের অবস্থার সাথে জাহেলী যুগের তেমন পার্থক্য নেই। কেউ যদি ইসলামের প্রাথমিক সময়ে মক্কায় অবতীর্ণ সূরাগুলোর প্রতি লক্ষ্য করেন, তিনি দেখবেন যে, আল্লাহ প্রথম কাজকেই প্রথমে রেখেছেন। অ্যালকোহল নিষিদ্ধ ঘোষণা করার আগে তিনি এই বিশ্বাস মানুষের মনে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন যে, তিনি যেমন অস্তিত্বশীল, মৃত্যুপরবর্তী জীবনও তাই অপরিহার্য।
অবশ্যই মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের যেসব কাজের মুখোমুখি হতে হয়, তা শংকাবহুল (Daunting)। যাহোক এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় কাজ হলো মানুষকে বোঝানো-শিক্ষিত এবং বুদ্ধিদীপ্ত একজন ব্যক্তি মুসলিম হতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে মনে হয়, ছোটখাটো বিষয়ও অনেক বড় বড় প্রভাব ফেলতে সক্ষম। যেমন কোন বিজ্ঞান কনফারেন্সে যদি কো একজন মুসলিম বিজ্ঞানী অংশ গ্রহণ করেন, তাহলে তিনি তার বক্তব্য শুরু করতে পারেন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বলে। এতে দেখা যাবে, তিনি নিজের অজান্তেই কনফারেন্সে উপস্থিত সুধীজনের একাংশের মনে কল্পনাতীত প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছেন।
মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের যে শুধু অনেক কিছু করার আছে তা নয়; বরং এমন অনেক কিছুই আছে, যা তাদের করা মোটেই উচিত হবে না। একজন মুসলিম বুদ্ধিজীবীর থাকতে পারে মানসিক অতি নমনীয়তা এবং ভাষার ওপর ভালো দক্ষতা। এরা যখন পাশ্চাত্যের – কারো মুখখামুখি হন, তখন অন্য অনেক মুসলিমের মতই তিনি অতি নমনীয়তায় আক্রান্ত হন। নিজেকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নেন, এমনকি নিজের সংস্কৃতির জন্য অতিরিক্ত জবাবদিহিতামূলক আচরণও করেন। ফলে তিনি একজন সংস্কৃতিবান মুসলিম হয়ে যান। তার আছে কিছু ইসলামী ব্যাকগ্রাউন্ড, কিন্তু নিজে ইসলামের প্রতি বা ইসলামী জ্ঞানের প্রতি সহানুভূতি ছাড়া আর কিছুই মনে বা জীবনাচরণে লালন করেন না। তিনি সুকৌশলে নামায, রোযা, হজ্জ পালন, এসব ফরয কাজ থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। মদ (Alcohol) পান করা যে হারাম সেকথা এদের সামনে তো বলাটাই বাহুল্য।
আমরা সবাই এ ধরনের লোকদের চিনি। তারা ইসলামকে লবণের দানা পরিমাণ গ্রহণ করেন, অবশ্য এর অর্থ হলো ইসলামকে একেবারেই গ্রহণ না করা।
অন্য চরম রূপটিও সচরাচর দেখা যায় : একশ্রেণীর মুসলিম বুদ্ধিজীবী পাশ্চাত্যের পুরোপুরি বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বাস করেন বা কাজ করেন। এরা এক ধরনের হিজরতের মানসিকতা লালন করেন। এটাও আশা করা যায় না, শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণেই নয়, অন্য অনেক কারণেই। মুসলিম এবং অমুসলিম, পাশ্চাত্য এবং ইসলাম, উত্তর এবং দক্ষিণ- এই পক্ষগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা (Dialogue) হওয়া খুবই জরুরী। এমনকি মুসলিমদের মধ্যে যারা এর বিধানগুলোর চর্চা করেন এবং যারা কিছুই চর্চা করেন না, শুধু এই দাবি করেই ক্ষান্ত থাকেন, যে, তাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আছে—এদের মধ্যেও পারস্পরিক আলোচনা হওয়া উচিত। পাশ্চাত্যকে পুরোপুরি বর্জন করা কোন সমাধান নয়। যদি আমরা পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে ইসলামীকরণ করতে না পারি, পাশ্চাত্য সংস্কৃতিই আমাদের ওপর আধিপত্য কায়েম করবে। বার্নাড লুইস এবং স্যামুয়েল হান্টিংটন যেমন ধারণা করেছেন যে, সাংস্কৃতিক (Cultural clash) একটা ঘটবে, বিপর্যয়টা হচ্ছে এখানেই—এই সংঘাত উপেক্ষা করা যাবে কি যাবে না। অন্য কথায় : বিপর্যয়ের মুখোমুখি এখন শান্তি এবং ইসলামের টিকে থাকা- একটা ধর্ম হিসেবে, একটা সভ্যতা হিসেবে। কাজেই আলোচনা এখন জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে এবং এটাই হলো একমাত্র বুদ্ধিজীবীদের পক্ষেই যা করা সম্ভব।
অনুবাদ : শওকত আরা
(সৌজন্যেঃ তালিম পত্রিকা)