সপ্তদশ শতকে সম্রাট আওরঙ্গজেবের পৃষ্ঠপোষকতায় মাদ্রাসা রহিমিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদ্রাসা রহিমিয়া সম্পর্কে লেখার আগে একটু পিছিয়ে শুরু করি।
ভারতে মুঘল সম্রাট আকবরের সময় ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে ইমামে রাব্বানী শায়খ আহমদ আল ফারুকী সারহিন্দি পাঞ্জাবের সরহিন্দে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৬২৪-এ তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। এর মানে দাঁড়ায় সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীর এই দুই মুঘল সম্রাটের শাসনকালে তিনি কর্মক্ষম ছিলেন।
ওমর ফারুক (রা.)-র বংশধর এই ব্যক্তিটি হানাফি ফিকাহ বিদ, নকশবন্দি সুফি তরিকার অনুসারী ছিলেন। তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত ছিল মোজাদ্দেদ আলফেসানী (দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সংস্কারক) খেতাব। আকবরের দরবারে দীন-ই-ইলাহী প্রবর্তন এবং জাহাঙ্গীরের সময় শিয়া মতবাদ মাথাচাড়া দেওয়ায় তিনি নিরলস পরিশ্রম দ্বারা পুনরায় ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আকবর ত্রয়োদশ শতকের ইসলামি দার্শনিক ইবন আল আরাবীর সর্বেশ্বরবাদ বা প্যানথেইজম অনুসারে দিন ই ইলাহি ধর্মের প্রবর্তন করেন। ইবন আল আরাবীর মতানুসারে আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে বান্দা আল্লাহর সঙ্গে একীভূত হয়ে যান পৃথক কোন অস্তিত্ব থাকে না। আরবিতে তাঁর মতবাদকে বলা হয় ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’। শায়খ আহমেদ সরহিন্দি (রহ.) এই মতবাদের বিপরীত মতবাদ দেন যাকে বলা হয় ‘ওয়াহদাতুশ শুহুদ’। এই মতবাদ অনুসারে ফানাফিল্লাহর একটি পর্যায় হল যখন বান্দা ভাবনার জগতে ঈশ্বরের সঙ্গে একত্রিত হন তবে বাস্তবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যান না। বরং দুটি পৃথক সত্তা হিসেবে বিরাজমান থাকে। তাঁর মতে ওয়াহদাতুশ শুহুদ মতবাদ ইবন আল আরাবীর ওয়াহদাতুল ওযুদ অপেক্ষা আরও বেশি পরিণত।
শায়খ আহমদ সারহিনদি (রহ.)-র ইহলোক ত্যাগের কুড়ি বছর পর সম্রাট শাহজাহানের আমলে ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে শাহ আব্দুর রহিম জন্মগ্রহণ করেন। ততদিনে মুঘল দরবারে নানারকম ঈমান ধ্বংসকারী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকালে তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় দিল্লিতে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা আলেমের নাম ছিল শাহ আব্দুর রহিম। সম্রাট আওরঙ্গজেবের পরিচালনায় যে ফতোয়ায়ে আলমগীরী লেখা হয় তার উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন শাহ আব্দুর রহিম। তাঁরই নামে মাদ্রাসার নাম হয় রহিমিয়া। শাহ আব্দুর রহিম ছিলেন ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর বংশধর।
১৭১৮ খ্রিস্টাব্দে শাহ আব্দুর রহিম ইহলোক ত্যাগ করেন। তখন এই মাদ্রাসা পরিচালনার ভার পড়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবি (র.)-র উপর। শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) কে বলা হয় ভারতের প্রথম মোহাদ্দেস।
মূলত হানাফী ফিকাহ অনুসারে এবং নকশবন্দী সুফি অর্ডারে মাদ্রাসাটি পরিচালিত হলেও শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.)-কে ভারতের সকল চিন্তাধারার আলেম-ওলামাদের পথ প্রদর্শক বলে ধরা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মাদ্রাসাটির প্রভাব ছিল সর্বজনস্বীকৃত।
শাহ ওয়ালিউল্লার সময়েই ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের অন্তিম দিনগুলি শুরু হয়। তিনি একাধারে ইংরেজ, মারাঠা ও শিখদের বিরোধিতা শুরু করেন। তিনি ভারতীয় মুসলিম শাসক ও সাধারণ মুসলিমদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংকটের বিষয়ে বারবার সচেতন করেন।
১৭৬২-তে শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইহলোক ত্যাগ করলে তাঁর পুত্র শাহ আব্দুল আজিজ মাদ্রাসাটির পরিচালনায় এগিয়ে আসেন। তাঁকে সহায়তা দান করেন তাঁর দুই ভ্রাতা শাহ আব্দুর রফি ও শাহ আব্দুল কাদের।
এই মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন সৈয়দ আহমদ শহীদ বালাকোটি (র.)। তিনি ১৮০৬ থেকে ১৮১১ এই পাঁচ বছর মাদ্রাসা রাহিমিয়াতে পড়াশোনা করেন। বলা যেতে পারে শাহ ওয়ালিউল্লাহ যে আধ্যাত্মিক শিক্ষা শুরু করেন তার প্রয়োগ শুরু করেন শাহ আব্দুল আজিজ। তাই দেখা যায় প্রথম থেকেই এই মাদ্রাসার প্রতি ইংরেজদের রোষ ছিল। ধারণা করা হত এখান থেকে ইংরেজবিরোধী যাবতীয় আন্দোলন দানা বাঁধত।
শাহ আব্দুল আজিজের ইহলোক ত্যাগের পর তাঁর পুত্র শাহ মোহাম্মদ ইসহাক মাদ্রাসা রাহিমিয়ার কর্ণধার হন। ১৮৪৬-এ তিনি ইহলোক ত্যাগ করলে মাদ্রাসাটি বহু শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। মাদ্রাসা রহিমিয়া নামে মূল মাদ্রাসাটি রয়ে যায়।
১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পর দিল্লিস্থ মাদ্রাসা রহিমিয়াকে সমস্ত বিদ্রোহের মূল কেন্দ্র ধরে নিয়ে ইংরেজরা রামজি দাসকে বিক্রি করে দেয়। সে আর কি বেঝে? সেটাকে গুদামঘর করে দেয়। মুঘল সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত সমস্ত মাদ্রাসা, কুতুবখানা, সাংস্কৃতিকেন্দ্র গুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়, নয়তো বিক্রি করে দেওয়া হয়, নয়তো গুদামঘর করে দেওয়া হয়।
ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল মাদ্রাসা রহিমিয়ার মত মাদ্রাসাগুলি থেকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জ্ঞান নিয়ে ইংরেজবিরোধী যাবতীয় আন্দোলন গুলি সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু তখনও মুঘল বাদশাহী তখত নেই নেই করেও পাহাড়ের মত বিরাজমান ছিল। তাই তারা সাহস পায়নি মাদ্রাসা রহিমিয়ার মতো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিতে। মহাবিদ্রোহের পর অনাথ ভারতীয়দের শেষ বাধাটুকুও হটে গেলে ইংরেজরা তাদের বিরোধিতার ন্যূনতম চিহ্নগুলি ধ্বংস করে দেয়।
যাইহোক, ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল মুসলিমরা যতদিন শক্তিশালী আছে তাদের সিংহাসন নিষ্কণ্টক হবে না। দৈহিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বলে বলিয়ান করে তাদের মাদ্রাসাগুলি ও মাদ্রাসা ফেরত আলেমসমূহ। তাই ইংরেজরা মহাবিদ্রোহের পর প্রথম যে কাজটিতে হাত দেয় তাহল আলেমদের নির্মূল করা এবং মাদ্রাসা গুলিকে নির্মূল করা।
১৮৫৭-র ১০-ই মে উত্তরপ্রদেশের সামলির থানা ভবন এলাকায় হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রাহমাতুল্লাহি নেতৃত্বে রশিদ আহমেদ গাঙ্গোহি, কাশেম নানুতুবী, ইয়াকুব নানুতবী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিরোধী ভয়ঙ্কর আন্দোলন গড়ে তোলেন স্বাধীন এলাকা হিসাবে সামলিকে ঘোষণা করেন। যদিও পরবর্তীকালে শামলি দখল হয়ে যায় এবং হাজি ইমদাদুল্লাহ মক্কায় চলে যান।
মহাবিদ্রোহের পর মাদ্রাসা রাহিমিয়া এবং ছোটখাটো মাদ্রাসাগুলি ধ্বংস হয়ে যাবার পর ও সংশ্লিষ্ট আলেমদের হত্যার ফলে ভারবর্ষের বুকে সামগ্রিক ইসলামচর্চা স্তব্ধ হয়ে যায়।
মহারানীর রাজত্বে ক্ষমা প্রদর্শনের পর ভারতের বুকে পুনরায় ইসলাম চর্চা শুরু হয়। এই সময়ই উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দে কাশেম নানুতুবী (কাশেমি), রশিদ আহমেদ গাঙ্গোহি (রাশিদি) ইত্যাদি একদা বিদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন করে ইসলাম চর্চা শুরু হয়। কিন্তু এঁদের অন্তরে বিদ্রোহের আগুন সবসময় প্রজ্জ্বলিত ছিল। দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রথম দিককার ছাত্র শাইখুল হাদিস মাওলানা মাহমুদুল হাসানের রেশমি রুমাল আন্দোলন পরবর্তীকালে বহু দেশ নেতার বিদেশি সাহায্য নিয়ে ভারতকে স্বাধীন করার অনুপ্রেরণা ছিল।
যাইহোক, মাদ্রাসা রহিমিয়া ভারতবর্ষের বুকে সংঘটিত উপায়ে কোরআন হাদীস চর্চা শুরু করলেও এবং তার ফলাফল পাওয়া গেলেও ইংরেজ কর্তৃক ভারতীয় মুসলিমদের আধ্যাত্মিক চেতনা ধ্বংসের প্রয়াসের পর ১৮৬৩-তে প্রতিষ্ঠিত দেওবন্দ মাদ্রাসা আরও সুসংহত উপায়ে কুরআন-হাদীস, ফেকাহ চর্চা শুরু করে। শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও প্রায় দেড়শ বছরের উপর দেওবন্দ মাদ্রাসা তার লক্ষ্যে অটল। মানুষের স্বাধীন আচরণ, মুক্তি ও আল্লাহর জমিনে আল্লাহকেই সার্বভৌম জেনে মানুষকে মুক্তির আস্বাদ দেওয়ার যে প্রচেষ্টা শেখ আহমদ সরহিন্দী (রাহ.) আকবর ও জাহাঙ্গীরের দরবার থেকে শুরু করেছিলেন সেই বাটন ধরে রেখেছে দেওবন্দ মাদ্রাসা। তাই দেখি, প্রাক্তন সোভিয়েত দখলদারিত্বে থাকা কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান থেকে খোরাসান ও আফগান তালিবান সকলেই মুক্তি ও স্বাধীনতার শিক্ষায় শিক্ষিত।
শেখ আহমদ সরহিন্দি (রহ.)-এর হাত ধরে ভারতে নকশবন্দী সূফি তরিকার প্রতিষ্ঠা লাভ দেওবন্দ মাদ্রাসা ও মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক (র.)-র ফুরফুরা সিলসিলাকে প্রতিষ্টিত করে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও নকশবন্দী তারিকা ফিলিস্তিন, সিরিয়া, তুরস্ক, ইরাক এবং মধ্য এশিয়ার প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলিতে চর্চিত হয়। ইরাকে ‘৯০-এর দশক থেকেই সাদ্দাম হোসেনের ডান হাত ইজ্জত ইব্রাহিম আদ দৌরির ‘আলহামলা আল ঈমানিয়া’ শিরোনামে ইসলামকে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। আদ দৌরি নিজে ছিলেন নাকশবন্দী এবং তাঁর এই প্রচেষ্টা নকশবন্দিয়া তরিকার ছত্রছায়ায় বিকশিত হয়। সাদ্দামের পতনের পর ২০১৬ পর্যন্ত নাকশবান্দিয়া আর্মি একই সঙ্গে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যায়।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।